Hot Posts

6/recent/ticker-posts

শেষের কবিতা উপন্যাসের বিষয়বস্তু

শেষের কবিতা উপন্যাসের আলোচনা 

শেষের কবিতা উপন্যাসের বিখ্যাত উক্তি

শেষের কবিতা উপন্যাসের মূলভাব

শেষের কবিতা উপন্যাসের বিষয়বস্তু

শেষের কবিতা উপন্যাসের চরিত্র

শেষের কবিতা উপন্যাসের সারসংক্ষেপ

শেষের কবিতা উপন্যাসের শেষ লাইন

শেষের কবিতা উপন্যাসের নায়ক কে

শেষের কবিতা উপন্যাসের অমিত চরিত্র

শেষের কবিতা উপন্যাসের সারমর্ম

শেষের কবিতা উপন্যাসের কবিতা

Shesher Kabita - Novel by Rabindranath Tagore 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর অনবদ্য সৃষ্টি "শেষের কবিতা"---

তারুণ্য মানবজীবনের একটি সুবর্ণ সময়। প্রকৃতিতে সর্বদাই তারুণ্যের জয়গান রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর সমগ্র লেখায়, কবিতায়, গল্প, গানে তারুণ্যের তেজোদীপ্ত স্বাক্ষর রেখে গেছেন শেষের কবিতা উপন্যাস তার উজ্জ্বল উদাহরণ। রোমান্টিক এই উপন্যাসের শুরু যেমন গতিপ্রকৃতিও তেমন তার পরিণতিও একই সমান্তরালে প্রবাহমান।

গল্পের শুরুটা এভাবে ভাবলে কেমন হয়। শব্দে শব্দে টেলিফোন সেটটি বেজেই চলেছে, বাড়িতে লোকজন তেমন নেই একটি তরুণী ফোনটি ধরল। অপর প্রান্ত থেকে যিনি কথা বলছেন তরুণীর কাছে তিনি সম্পূর্ণ অপরিচিত। কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলার পর কেটে গেল ফোন। হতবাক হল মেয়ে, জানে না, শোনে না এ কেমন যোগাযোগ! অথচ কথা শেষ হবার পর পরই বুকের মাঝে যেন কি নেই কিছু নেই এহেন অনুভূতি তার জীবনে এই প্রথম। পরদিন একই সময় আবার ফোনের বাজনা, ছটফট করে ওঠে তরুণী। সে যেন এই বাজনাটার জন্য অনন্তকাল অপেক্ষা করতে পারে। অবশেষে এমন হল প্রতিটি দিনের বেলা অসহ্য কাটে তার বিকাল কখন হবে, কখন বাজবে সেই ফোন । ছেলেটি কথা বলে—কিন্তু নিজের পরিচয় ফাঁস করে না। বলে সে মেয়েটিকে কখনই দেখেনি কিন্তু তার কথা এত শুনেছে যে কথা না বলে অপেক্ষা করে থাকতে পারেনি।

শেষের কবিতা উপন্যাসের চরিত্র:-

মেয়েটির সাথে সে কখনই দেখা করবে না, তার বাড়িতেও আসবে না কারণ সামনে এলে তার এতদিনকার মনের মাঝে সাজানো ছবি যদি ভেঙ্গে খানখান হয়ে যায়। সে আরও বলে শুধুমাত্র এই আলাপটুকুতেই সে খুশি থাকবে। কিভাবে মেয়েটির ঠিকানা সে পেয়েছে এমন জিজ্ঞাসার জবাবও সে দিল না। এমনি করে আলাপে আলাপে দিন কেটে যেতে লাগল—আলাপ তখন বেশ জমে উঠেছে ছেলেটি হঠাৎ জানালো সে বিদেশে চলে যাচ্ছে আর আলাপ করা সম্ভব হবে না। দেখাসাক্ষাৎ হওয়ার তো প্রশ্নই থাকছে না। বিস্মিত হয় মেয়েটি। এরপর বেশ কিছুদিন কেটে যায় মেয়েটি শিলং পাহাড়ে বেড়াতে গেল। বেড়াতে গেল—হয়ত তার শরীরও কিছুটা অসুস্থ ছিল। সেখানে অকস্মাৎ তার গাড়িটি একটি ছোট্ট দুর্ঘটনায় পড়ল। দুর্ঘটনার সময় সাহায্য করতে এগিয়ে এলেন এক লোক, তার কন্ঠস্বর শুনে মেয়েটি চমকে উঠল। মেয়েটি যেমন বুঝতে পারল সাহায্যকারী। ভদ্রলোকটি কে, ছেলেটিও তেমনিভাবে বুঝতে পারল । গল্পটা এ পর্যন্ত যেভাবে বলা হল, শেষের কবিতার গল্প কিন্তু এত সাদামাটা ও সহজ নয়। শেষের কবিতার শুরু এক সড়ক দুর্ঘটনায় একথা সত্যি নায়ক অমিত নায়িকা লাবণ্য এদের দুজনের মধ্যে যে প্রেম সেই প্রেমের ব্যাখ্যা রবীন্দ্রনাথও পরিষ্কার করে প্রকাশ করেননি। অমিত রায় স্টাইলের উচ্চারণ বে উচ্চ সমাজের লোক, সুশিক্ষিত, শিক্ষিত সমাজে তার হাঁটা চলা, উঠাবসা বেপরোয়া ডজন ডজন মেয়েদের সাথে সে মেলামেশা হাসি-ঠাট্টা করে সে রমণী মোহন পুরুষ, সমাজের শিক্ষিত সুন্দরী অসুন্দরী সকলেই তাকে চায়—কেন যেন প্রত্যেকে মনে করে অমিত তার কিন্তু আসলে অমিত কারও নয়। এই দ্বন্দ্ব সংঘাতের চিত্রটি একমাত্র রবীন্দ্রনাথ ছাড়া অন্য কেউ আঁকতে পারতেন কিনা সন্দেহ হয় ।

অমিতের চরিত্রের একটি দিকের আলোচনা অবশ্যই জরুরি। “অমিতের নেশাই হল স্টাইলে, কেবল সাহিত্য বাছাই কাজে নয়, বেশেভূষায় ব্যবহারে, ওর চেহারাতেই একটা ছাপ আছে। পাঁচজনের মধ্যে ও যে কোন একজন মাত্র নয়, ও হল একেবারে পরতম । অন্যকে বাদ দিয়ে চোখে পড়ে। দাড়ি গোঁফ কামানো চাছা মাজা চিকন শ্যামল পরিপুষ্ট মুখ, স্ফুর্তিভরা ভাবটা, চোখ চঞ্চল, হাসি চঞ্চল নড়াচড়া চলাফেরা চঞ্চল। কথার জবাব দিতে একটুও দেরি হয় না। মনটা এমন এক রকমের চকমকি যে, ঠুন করে একটু ঠুকলেই স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে পড়ে। দেশী কাপড় প্রায়ই পরে, কেননা ওর দলের লোক সেটা পরে না। ধুতি সাদা থানের যত্নে কোঁচানো, কেননা ওর বয়সে এরকম ধূতি চলিত নয়। পাঞ্জাবী পরে তার বা কাঁধ থেকে বোতাম ডান দিকের কোমর অবধি। আস্তিনের সামনের দিকটা কনুই পর্যন্ত দুভাগ করা, কোমরে ধৃতিটাকে ঘিরে একটি জরি দেওয়া খয়েরি রঙের ফিতে তারই বা দিকে ঝুলছে বৃন্দাবনী ছিটের এক ছোট থলি, তার মধ্যে ট্যাকঘড়ি, পায়ে সাদা চামড়ার উপর লাল চামড়ার কাজ করা কটকি জুতো। বাইরে গেলে একটা পাড়ওয়ালা মাদ্রাজী চাদর বাঁ কাঁধ থেকে হাঁটু অবধি ঝুলতে থাকে; বন্ধুমহলে যখন নিমন্ত্রণ।

খাবে মাথায় চড়ায় এক মুসলমানী লক্ষ্মৌ টুপি সাদার উপর সাদা কাজ করা। এতসব সাজের বর্ণনা দেবার কারণ হল বাংলা সাহিত্যে যতসব উপন্যাস আছে তাতে মোটামুটি নায়িকা সাজের বর্ণনা অধিক। নায়ক বা পুরুষের সাজের কোনো বর্ণনা শেষের কবিতার নায়কের সমকক্ষ নয়। এহেন অমিত যদি রমণী মোহন হয় এবং অনায়াসে যদি রমণীকুলের হৃদয়কে কড়াইতে ভাজা ভাজা করে তাহলে তা যেন খুব অন্যায় হয় না ।

ওদিকে ওর দুই বোন যারা সিসি ও লিসি নামে পরিচিত হালের বাজারে এরা নতুন আমদানী, ফ্যাশানের পশরায় আপদ মস্তক যত্ন সহকারে মোড়ক করা পয়লা নম্বরের প্যাকেট বিশেষ, পায়ে উঁচু ঘুরওয়ালা জুতো, লেস পরানো বুক কাটা জ্যাকেটের ফাঁকে প্রবালে আম্বারে মেশানো মালা, শাড়িটা শরীরে তীর্যকভাবে আঁট করে ল্যাপটানো, তারা খুটখুট করে দ্রুত লয়ে চলে, উচ্চস্বরে বলে, স্তরে স্তরে তোলে সূক্ষ্মহাসি, ঈষৎ মুখ বেঁকিয়ে স্মিতহাস্যে উঁচু কটাক্ষে চায়, জানে কাকে বলে ভাবগত চাউনি, গোলাপের রঙে রাঙা বেনামের পাখা ক্ষণে ক্ষণে গালের কাছে ফুরফুর করে সঞ্চালন করে এবং পুরুষ বন্ধুর চৌকির হাতার ওপর বসে সেই পাখার আঘাতে তাদের কৃত্রিম স্পর্ধার প্রতি কৃত্রিম তর্জন প্রকাশ করে থাকে। উল্লিখিত দুটি বর্ণনায় যে সমাজের ছবি পাওয়া গেল তা সেকালের আধুনিকদের স্থির চিত্র। এমনই এক সমাজের তারুণ্যের প্রতিনিধি অমিত, তার সামাজিক অবস্থানটাও বিবেচনায় আনা দরকার। আপন দলের মেয়েদের সাথে অমিতের ব্যবহার দেখে অন্য বন্ধুদের চোখ টাটায়—ঈর্ষা হয়। অমিতের কোনো মেয়ের প্রতি উদাসীন্য নেই কিন্তু বিশেষভাবে কারুর প্রতি আসক্তি আছে তাও নয়। স্থানভেদে রসেরও অভাব হয় না। এককথায় বলতে গেলে মেয়েদের প্রতি ওর আগ্রহ নেই। উৎসাহ ষোলআনা। সে পার্টিতেও যায় তাসও খেলে, ইচ্ছে করে বাজিতে হারে, যে রমণীর গলা বেসুরো তাকে পুনরায় গাইতে অনুরোধ করে। কাউকে বদ রঙের কাপড় পরতে দেখলে ঐ কাপড় কোন দোকানে পাওয়া যায় জিজ্ঞাসা করে। মোটকথা যেমন যে লোক অনেক দেবতার পূজারী সে প্রত্যেক দেবতার কাছে গিয়ে তাকেই শ্রেষ্ঠ বলে তোষামোদ করতে সেরা করে না। দেবতারা অন্তর্যামী তারা সবই বুঝেন কিন্তু ভক্তকে তো নিরাশ করা চলে না।

অমিতের জন্য কন্যার মায়েদের অঢেল-আশা। কিন্তু কন্যারা অচিরাৎ বুঝে নিয়েছে অমিত সোনা রঙের দিগন্ত রেখা। ধরা দিয়েই আছে কিন্তু তাকে ছোঁয়া যাবে না। এহেন অমিতের সাথে দুর্ঘটনা উপলক্ষে লাবণ্যের সাথে পরিচয়। যদি প্রেম হয়েই যায় তাহলে তার পরিণাম কী হতে পারে – এখানে একটা জিনিস মনে রাখা দরকার কাল হল সবচেয়ে বড় শিক্ষক। সেই কালের পরিবর্তনে যদি অমিতের আচরণে পরিবর্তন আসে তাহলে হয়ত লাবণ্যের আঁচলের তলায় অমিত স্থিতি লাভ করতেও পারে। কিন্তু সেক্ষেত্রে অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় কী?

সরু পাহাড়ি পথে অমিতের গাড়ির সাথে লাবণ্যের গাড়ির ছোট একটি ধাক্কায় দু'জনের যে পরিচয় তা গড়িয়েছিল অনেক অনেকদূর। দীর্ঘদিন হাজার হাজার কথা হয়েছে বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হয়েছে কবির কারিশমা এতটা গভীর যে কে কতটা হৃদয়ের কাছাকাছি এসেছে তার পরিমাপ করা যায় না। কার আগ্রহ বেশি বা কম তাও অনুমান করা কষ্টকর। এহেন দোলাচল সমস্ত গ্রন্থ জুড়ে এবং এই একটা কারণেই শেষের কবিতা সার্থক উপন্যাস হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। প্রেমের উত্তাপ কখনও বাড়ে কখনও কমে ঠিক যেন নদীর জলের জোয়ার ভাটা; আমরা শেষের কবিতায়ও অনুরূপ জোয়ার ভাটার প্রত্যক্ষ সাক্ষী।

অমিত-লাবণ্য এক ছাদের তলায় বাস করবে এমন উদ্যোগও নেওয়া হয়েছি তা কার্যকর করা হয়নি। অমিতের জীবনে আরও লাবণ্যরা যেমন এসেছে লাবণ্যের জীবনেও অনেক অমিত এসেছে। দোলাচলে কেটেছে সমস্ত সময়। অভিভাবক পক্ষ যতই চান কিছু একটা হোক তাদের সঠিক সিদ্ধান্তের অভাবের ফলে ওদের ঘর বাঁধা হল না।

যে ভালবাসা ব্যাপ্তভাবে আকাশে মুক্ত থাকে, অন্তরের মধ্যে সে দেয় সঙ্গ। যে ভালবাসা বিশেষভাবে প্রতিদিনের সবকিছুকে যুক্ত হয়ে থাকে সংসারে সে দেয় অসঙ্গ দুটোই আমি চাই, এমনি ধরনের সব যুক্তি অমিতের লাবণ্যর দিক থেকে ঠিক এমন গুরুগম্ভীর কিছু না থাকলেও মনের দোলাচল তার কম ছিল না।

এমনি এক সময়ে অমিতের কাছাকাছি আসা কেতকী যে জানত লাবণ্য অমিতের মিলন ঘটতেও পারে সে গেল তার এক বোনের বাড়ি সেখানে এক বন্ধু মারফত পেল লাবণ্যের লেখা এক পত্র তাতে বিয়ের সংবাদ বিয়ে হবে জ্যৈষ্ঠমাসে রামগড় পর্বতের শিখরে।


অমিত কথা প্রসঙ্গে জানায় একদিন আমার সমস্ত ডানা মেলে পেয়েছিলুম আমার গুড়ার আকাশ, আজ আমি পেয়েছি আমার ছোট্ট বাসা, ডানা গুটিয়ে বসেছি কিন্তু আমার আকাশও রইল। অন্যদিকে আবার বলে কেতকীর সঙ্গে আমার সম্বন্ধ ভালোবাসারই কিন্তু সে যেন ঘড়ায় তোলাজল প্রতিদিন তুলব, প্রতিদিন ব্যবহার করব। আর লাবণ্যের সঙ্গে আমার যে ভালবাসা সে রইল দিঘী, সে ঘরে আমার নয়, আমার মন তাতে সাঁতার দেবে। পৃথিবীতে ঘড়ায় তোলা জল ব্যবহারের মানুষও থাকবে দিঘীতে সাঁতার কাটার লোকেরও অভাব হবে না এ কারণেই শেষের কবিতার আবেদন কোনকালেই শেষ হবে না।


ফারহানা দিবা

(অনার্স) এম. এ. (ঢা. বি) সিনিয়র শিক্ষক বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ পাবলিক কলেজ

পিলখানা, ঢাকা-১২০৫

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ