Hot Posts

6/recent/ticker-posts

বাদল সরকারের "বাকি ইতিহাস" নাটকের বিষয়বস্তু ও নামকরণের সার্থকতা

  বাদল সরকারের 'বাকি ইতিহাস' নাটকের নামকরণের সার্থকতা :

লিখেছেন :-

তনুশ্রী রায় রিয়া

বাংলা বিভাগ

বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়,রংপুর। 


ভূমিকা :

 নাটক বিনোদনের মাধ্যম হলে তা কখনও কখনও হয়ে ওঠে প্রতিবাদের হাতিয়ার। এই কাজটাই করেছিলেন সুধীন্দ্রনাথ সরকার (১৯২৫ - ২০১১)। যিনি থিয়েটার জগতে বাদল সরকার নামে পরিচিত। খানিকটা শখের থিয়েটার থেকে যাত্রা শুরু করলেও তাঁর হাত ধরে জন্ম নেয় এক নাট্য দর্শনের।

বাদল সরকার একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বাঙালি নাট্যব্যক্তিত্ব। যিনি থার্ড থিয়েটার নামক ভিন্ন ধারার নাটকের প্রবক্তা হিসেবে পরিচিত। এই থার্ড থিয়েটারের ধারণা নিয়ে তিনি নিজেই বলেছেন -

" যদি কেউ কোনো সামাজিক তাগিদে থিয়েটার- কে ব্যবহার করতে চান এবং তাঁর কাছে প্রথম বা দ্বিতীয় থিয়েটারের (বাদল সরকারের চোখে প্রথম থিয়েটার 'লোকনাট্য' আমর দ্বিতীয় থিয়েটার 'নগরনাট্য') কোনোটাকেই সম্পূর্ণভাবে উপযোগী বলে মনে না হয়, তবে তাঁকে অনুসন্ধান করে একটি বিকল্প থিয়েটার তৈরি করতে হয়। যদি আংশিকভাবেও তা তৈরি হয়, তবে তাকে তৃতীয় থিয়েটার নামে দেওয়া অযৌক্তিক বোধ হয় হবে না। এই পরিপ্রেক্ষিতেই আমরা আমাদের থ্রি- য়েটারকে তৃতীয় থিয়েটার (থার্ড থিয়েটার) আখ্যা দিয়েছি।"

৭০ দশকের নকশাল আন্দোলনের সময় প্রতিষ্ঠান বিরোধী নাটক রচনার জন্য তিনি পরি চিত হন, মঞ্চের বাইরে সাধারণ মানুষের ভেতর নাটককে ছড়িয়ে দেওয়ার প্রথম কাজ তাঁরই। তাঁর নিজস্ব নাটক দল 'শতাব্দী' গঠিত হয় ১৯৭৬ সাল লে। কলকাতার কার্জন পার্কে নিয়মিত এই নাট্য- গোষ্ঠীর পক্ষ থেকে তিনি থার্ড থিয়েটারে অভি- নয় করেছেন। নাটক রচনার ক্ষেত্রে তিনি মূলত অ্যাবসার্ড নাট্যদর্শন দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। তিনি তাঁর নাটকে জাদুবাস্তবতা তুলে ধরেছেন। অতি নিপুনভাবে বাম ধারাকে উপস্থাপন করতে পারঙ্গমতা প্রদর্শন করেছেন ।

এবং ইন্দ্রজিৎ' (১৯৬৩) তাঁর লেখা সর্বাধিক জনপ্রিয় নাটক। এছাড়াও তাঁর অন্যান্য উল্লেখযোগ্য নাটক হচ্ছে "বাকি ইতিহাস' (১৯৬৫), 'পরে কোনোদিন' (১৯৬৬), 'প্রলাপ' (১৯৬৬), 'বিংশ শতাব্দী (১৯৬৬), 'পাগলা ঘোড়া' (১৯৬৭), 'শেষ নাই (১৯৬৯), 'তোমা' (১৯৭৬) প্রভৃতি ।

‘বাকি ইতিহাস' নাটকের নামকরণের সার্থক : 

শিল্পের নামকরণ নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ ও মান সজ্জাত। শিল্পের নামকরণে বিশেষ প্রযত্ন নিতে হয়। নামকরণ এমন হওয়া প্রয়োজন যা থেকে সৃষ্টিকর্মের চেহারা ও মৌল প্রতিপাদ্য বিষয়টা স্পষ্ট হয়। আয়নায় যেমন নিজের প্রতিবিম্ব বিম্বিত হয়, নামকরনেও তেমনি শিল্পের মূল্য মৌল উপজীব্য বিষয় বিম্বিত হয়। তাই শিল্প- সাহিত্যের ভেতরকার আহ্বানটির দিকে মনো- যোগ রেখে নামকরণ করাই শিল্পসম্মত । মূলত নামকরণ একটা শিল্পায়ন। শিল্পের নামকরণ কখনও নায়ক, নায়িকা, বা কেন্দ্রীয়

চরিত্রের নামে হতে পারে। আবার কখনও বিষয়বস্তুর আলোকে হতে পারে, ক্ষেত্র বিশেষে প্রতীক সাংকেতিক নামকরণও হতে পারে। নাট্য- কার বাদল সরকারের 'বাকি ইতিহাস' নাটকের নামকরণে এক ধরণের ব্যঞ্জনা আছে, যা এক গূঢ় অর্থের দ্যোতনা সৃষ্টি করে।


বাদল সরকারের 'বাকি ইতিহাস' নাটকে খবরের কাগজের একটি আত্মহত্যার কাহিনীকে কেন্দ্র করে নাটকের দুটি প্রধান চরিত্র শরদিন্দু- বাসন্তী-দম্পতি সেই আত্মহত্যার কারণ অনুসন্ধা ন করতে গিয়ে নিজস্ব ভাবকল্পনায় দুটি গল্প মেসেন সীতানাথ ও কণা নামে এক দস্রুতিকে কেন্দ্র করে। সীতানাথের আত্মহত্যার কারণ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে শরদিন্দুকে শূন্যতাবোধ গ্রাস করলেও শরদিন্দু আত্মহত্যা করেন না, শূন্যতা অবসাদের মধ্যেও আশার আলো খুঁজে গান। সমালোচক আশুতোষ ভট্টাচার্যের মতে, "ইহার মধ্যে আত্মহত্যার মনস্তত্ত্ব আরও বিস্তৃতভাবে বিশ্লেষিত হইয়াছে । ”

এ নাটকে ছুটির দিনে খবরের কাগজের একটি আত্মহত্যার কাহিনী নিয়ে শরদিন্দু ও বাসন্তীর মতামত ও আলোচনার মধ্যে গল্পের প্লট নির্মাণে যে চিন্তাধারা দেখা গিয়েছে তা বাদল সরকারের বিচ্ছিন্নতার প্রতি আকৃষ্টতা প্রাধান্য পেয়েছে। ঘটনার প্রধান প্লট হিসেবে তারা সীতানাথের আত্মহত্যার ঘটনাকে রূপ- করেছেন। বাসন্তী ও শরদিন্দু এই আত্মহত্যার কাহিনীকে কেন্দ্র করে যে গল্প লিখেছে তাতে নাটকটি পেয়েছে ভি নতুন মাত্রা, তৈরি হয়েছে এক নতুন কাহিনীর পূর্নাঙ্গ গল্প ।


দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মারাত্মক ও ভয়াবহ প্রভাব চিন্তাশীল শিক্ষিত মানুষের মত মনকে কতটা অস্থির ও হতাশ করে তুলেছে এবং তাদের আত্মহননের পথে ঠেলে দিচ্ছে অথবা মানুষ কতটা জীবন্‌মৃত হয়ে আত্মযন্ত্রণায় ছটফট করছে তারই জীবনচিত্র ফুটে উঠেছে এ নাটকে। ছোট ছোট গল্পের প্লট এ গঠিত কয়েকটি স্বয়ংসম্পূর্ণ ঘটনার মাধ্যমে এক শূন্যতাবাদী জীবন প্রত্যয়ের হাজার হাজার বছরের বাকি ইতিহাসের কথা বলার চেষ্টা করেছেন নাট্য কার। এ নাটকের শরদিন্দু ও সীতানাথের কথোপকথন থেকে একটি দৃষ্টান্ত দেওয়া হলো -


"সীতানাথঃ হিটলারের কসানট্রেশন ক্যাম্প। ঐ লোকগুলো ইহুদি। পেছন ডানদিকে ঐ সাদা বাড়িটা গ্যাস চেম্বার | — মাদ্রিদের একটি রাস্তা- স্পেনের গৃহযুদ্ধের সময়কার। ঐ পড়ে থাকা বাচ্চা ছেলেটার ডান হাতটা নেই, দেখেছো? -হ্যাঁ, কি হিরোশিমা । ঠিকধরেছো । হিরোশিমা |

শরদিন্দু : বেছে বেছে এইসব ছবি জমা করেছো কেন ?

সীতানাথ : এই তো ইতিহাস ।

শরদিন্দু : ইতিহাস!

সীতানাথ: মানুষের ইতিহাস। জীবনের ইতিহাস শরদিন্দু : মিথ্যে কথা। এ মৃত্যুর ইতিহাস। সীতানাথঃ (স্মিতহাস্যে) মৃত্যুকে বাদ দিয়ে কি জীবন হয় ?

শর দিন্দু : কিন্তু মৃত্যুর ইতিহাস তো জীবনের ইতি-

হ্রাস হতে পারে না ? সীতানাথ : (একটা নিঃশ্বাস ফেলে) হয় তো তাই। আলাদা আলাদা মানুষের জীবনের আলাদা আলাদা ইতিহাস – হয় তো আছে। এ তা নয় । এ বাকি ইতিহাস।”

এ নাটকের প্রথম অঙ্কে বাসন্তী তার নারীসুলভ দৃষ্টি দিয়ে আত্মহত্যার কারণ বিশ্লেষণ করেছে এবং আর্থিক অভাব ও স্বামী স্ত্রীর ভাবাবেগপূর্ণ সম্পর্ক বিশ্লেষণ করে সমস্যাটির সরলীকৃত রূপ তুলে ধরেছেন। তার গল্পে কণা নিষ্ঠুর পিতার কন্যা। তার বড় দিদির বাঁচার আকাঙ্ক্ষা থাকলেও না খেতে পেয়ে মৃত্যুবরণ করেছে। তার মেজদি সমাজের অন্ধগলিতে দেহ বিক্রি করেছে এবং পেয়েছে হতাশাময় অন্ধকার জীবন। কনার পিতার সাথে সীতানাথের এক গোপন লেনদেন হয় যার কারণে সীতানাথকে কণার পিতাকে নিত্য মূল্য দিতে হয়। নিষ্ঠুর পিতার করাল হাত থেকে বাঁচানোর জন্য সীতানাথ কণারকাছে এ কথা গোপন রাখে। এক পর্যায়ে সীতা- নাথের টাকা ও জমি শেষ হয়ে যাওয়ার কারণে কনা সীতানাথের উপর রেগে গিয়ে সীতানাথের ধর্মী বন্ধু নিখিলের কাছে চলে যায়, পা বাড়িয়ে দেয় অন্ধকার গলির দিকে। সকল চরিত্রই এখানে জীবনযুদ্ধে পরাজিত, জীবনের থেকে বিচ্ছিন্ন চরিত্র। বাসন্তীর মতে-

“কনা সত্যি সত্যি কাউকেই ভালোবাসে নি । নিখিলকেও না, সীতানাথকেও না । ছোটবেলায় একটানা দারিদ্র্য তাকে শুধু একটা জিনিস শিখিয়েছে দারিদ্র্য থেকে মুক্তি পাবার ইচ্ছে। টাকার লোভ নয়, নিশ্চিত আশ্রয়ের লোভ ।"

আবার দ্বিতীয় অঙ্কে শরদিন্দু উগ্র সত্যভাষণের পুরুষোচিত সাহস নিয়ে বিকৃত মনস্তত্ত্বের জগতে আত্মহত্যার কারণ সন্ধান করেছেন। তার গল্পে সীতানাথ এক আদিম আরণ্য প্রবৃত্তির তারনায় নাবালিকা পার্বতীকে পাপ দৃষ্টিতে দেখার বিকৃত রোধে এক দুষ্কৃতিরোধ্য অপরাধবোধে অস্থির হয়ে উঠেছে এবং পরিনামে আত্মহত্যা করে

প্রায়শ্চিত্ত করেছে ।


এ নাটকের তৃতীয় অঙ্কে নৈরাশ্য, অবসাদ, অর্থহীনতা, আশাভঙ্গের যন্ত্রণার সুতীব্র প্রকাশ ঘটেছে। সীতানাথ আত্মহত্যা করেছে – সেই আত্মহত্যার কারণ বোঝাতে গিয়ে সে এই জী বনের ও জগতের সম্পর্কে তার যন্ত্রনাময় উপ- লব্ধির কথা শরদিন্দুকে ব্যাখ্যা করেছে। সীতা- নাথ শরদিন্দুর মতো নিয়মিত খবরের কাগজের কাটিং জমায় । সে জেনেছে, সেই কোন যুগ থেকে মানুষ মানুষের অ উপর অপরিসীম শোষণ, বঞ্চনা, অত্যাচার চালায়, তাদের ক্রীতদাস করে ফয়দা লোটে 1


সীতানাথের অ্যালবামে জমা হয়েছে যে সবকিছুর কাটিং, তা এরূপ : মহাভারতে দুঃ- শাসনের রক্তপান, চাবুকের আঘাতে জর্জরিত ক্রীতদাসরা পাথর টেনে তুলে পিরামিড তৈরি করছে, রোমান সম্রাটের নৌ বিহারে দাঁড় টান- ছে গিঁটবাধা চামড়ার চাবুকের আঘাতে জর্জ রিত ক্রীতদাসের দল, রোমের কলিসিয়মে।

সিংহদের দিয়ে ক্রিশ্চানদের খাওয়ানোর ছবি, জোয়ান অব আর্ককে পুড়িয়ে মারার ছবি, সম্রাট নেপো- পিয়নের জয়যাত্রার ছবিতে 'বেয়নটে গাঁথা রয়েছে শত্রুসৈন্যের ছিন্ন শির, সাহারা মরুভূমির বাণিজ্য পথে শিকলে বাঁধা ক্রীতদাস চালান দেওয়া, প্রথম মহাযুদ্ধে কাঁটাতারের বেড়ায় ঝুলতে থাক একজন নিচু দরের সৈনিক, হিটলারের কনসান ট্রেশন ক্যাম্প ও ইহুদিদের পুড়িয়ে মারার জন্য গ্যাস চেম্বার, মোপনের গৃহযুদ্ধে মাদ্রিদের ভয়া- বহ ধ্বংসলীলার চিত্র, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে দেশে দেশে বিধ্বংসী ক্ষতের ছবি, আনবিক বোমায় বিশ্বস্ত হিরোশিমার ধ্বংসস্তূপ, ভিয়েতনামে মার্কিন বাহি নীর বীভৎস তান্ডব। সীতানাথের মতে-

" এই তো ইতিহাস- হাস। জীবনের ইতিহাস ।" মানুষের ইতিহাস ".

যুগে যুগে কালে কালে সমগ্র মানবসমা- জের ওপর এই ধ্বংসাত্মক, শোষনমুখর যন্ত্রনা- দায়ক অভিজ্ঞতার কালো ছায়া পড়েছে চলেছে। আলাদা আলাদা মানুষের আলাদা আলাদা ইতিহাস হয়তো আছে। কিন্তু সমগ্র মানবসমাজে র ইতিহাস তো সেটি নয়, মানুষের ওপর মানু ষের নৃশংস অত্যাচার ও নিপীড়নের নৈরাশ্য- ময় ইতিহাস বাকি ইতিহাস ।

সীতানাথের মতে, এই নৈরাশ্যময় অন্ধকার জীবন নিয়ে বেঁচে থাকবার কোন সার্থকতা নেই। তাই মৃত্যুই এক্ষেত্রে তোয়, তা এই যন্ত্রনা ও নৈরাশ্য থেকে মুক্তির একমাত্র উপায়। তাহলে কি মানুষ বেঁচে থাকতে চায় না? অবশ্যই চায়। তার তেমনভাবে বেঁচে থাকা আত্মহত্যার আমি ল। সীতানাথের মতে – “ তারা নিঃশব্দে নীরবে বাঁচা বন্ধ করে বসে আছে।” মানুষের কাছে বাঁচা কিংবা মরা -এই দুটি পথ মাত্র খোলা আছে। এর যে কোনো একটিকে বেছে নিতে হবে। সীতানাথ বলেছে – “মানুষ হয় বাঁচবে, না হয় মরবে।” কিন্তু বিরুদ্ধ পরিবেশে, আশাহীন, স্বপ্ন- হীন জড়বং জীবনটুকু শুধু নিয়ে বেঁচে থাকাও তো একপ্রকার মৃত্যু। সীতানাথের জীবনেও ঠিক তেমনি ঘটেছিল। তার মতে – “উনিশ বছর আগে পৃথিবী সুন্দর ছিল। মানুষসজীব ছিল। জীবন মূল্যবান ছিল। উনিশ বছর আগে । "

নিত্য দিনের অভ্যাসে সজীব প্রাণের উৎস কনা শুকিয়ে যায়। তখন সে জীবনের সঙ্গী নয়, হয়ে ওঠে অভ্যাসের সঙ্গী। শরদিন্দু জানে না যে, তার অবচেতন মনের গভীরে জমা হয়ে আছে এই নিত্য অভ্যাসের ক্লান্তিকর অভিজ্ঞতা- র অবসন্নতা । সীতানাথের সঙ্গে মিলটুকু সে এই মুহূর্তে অনুভব করে, যদিও চেতন অভাবে অনুভূতি দিয়ে সে তা স্বীকার করতেও অস্বীকার চেষ্টা করে। জীবনের অর্থহীনতা সম্পর্কে সীতা- মাথের মুখে আমরা শুনেছি। -

"এগারো বছর। এগারো শতাব্দী । এগারো হাজার বছর। রাশি রাশি বছরের অর্থহীনতার ইতিহাস । রাশি রাশি মানুষের, রাশি রাশি কীটে র অর্থহীনতার ইতিহাস ।"

এ তো ব্যক্তিমানুষের ইতিহাস | তাতেও আছে ক্লান্তিকর অভ্যাসের পুনরাবৃত্তি, অবসাদ, বিষণ্ণ তা, অর্থহীনতার মর্মান্তিক ইতিহাস বা অভিজ্ঞতা। ব্যক্তি মানুষের এই অভিজ্ঞতা ছাড়াও রয়েছে সমগ্রমানবসমাজের যন্ত্রণার ইতিহাস এবং অর্থহীন অস্তিত্বের মর্মান্তিক ইতিহাস। সীতানাথের উক্তি :

"হ্যাঁ, বাকি ইতিহাস । পরীক্ষা নয়। চাকরি নয়। কনা নয়। বাসন্তী নয়। বাকি ইতিহাস ! দাঙ্গার ইতিহাস! মহাযুদ্ধের ইতিহাস! রাশি রাশি বছ- -রের হত্যা নির্যাতন যন্ত্রণার ইতিহাস! কুরু পান্ডব সিকন্দর নীরো চেঙ্গিস যা নেপোলিয়ন হিটলারের ইতিহাস। হাজার হাজার বছরের ইতিহাস পিরামিডের পাথরে, কলোসিয়মের বালিতে, জালিয়ানওয়ালাবাগের দেওয়ালে, হিরে শিমার পোড়া মাটিতে লেখা রয়েছে! হাজার হাজার বছরের বাকি ইতিহাস ।

মানুষের ভাই শোষণ, বঞ্চনা, লাঞ্ছনার প্রতিকারের জন্য আমরা কেউ কিছু করতে পারি না, কেউ কিছু করতে পারে না। - " নির্যাতন হত্যা দাঙ্গা যুদ্ধ – সবকিছু চলবে, সবকিছু মানু ষই করবে – তবু মানুষের কিছু করবার নেই" আর ব্যক্তিমানুষ ? – “এরা সবাই জীবনের এক একটা অর্থ খুঁজে নিয়ে বাঁচবার চেষ্টা কর ছে।”

কিন্তু এভাবে বাঁচা তো সত্যিকারের বাঁচা নয়, বাঁচবার ভান মাত্র । এই বাঁচাতো সমগ্র মানব সমাজের আমূহিক কল্যানের সঙ্গে সংযুক্তি হয় নি, ব্যক্তি মানুষের চাওয়া পাওয়ার চার দেয়া লের মধ্যে প্রাত্যহিক অভ্যাসের জালে আবদ্ধ এক বন্দি জীবন মাস । তাই সীতানাথ বলেছে -

বাঁচবার ভান করছে । অর্থ যখন থাকছে না, তখন অভ্যাস সম্বল করে বাঁচবার জ্ঞান করছে । যেমন আমি করেছিলাম । যেমন তুমি করছো।"

সীতানাথের আত্মহত্যা অনিবার্য হয়ে উঠেছিলএভাবেজীবনের অর্থ ফুরোলে ভাবে একদিন অর্থ ফিরবে। বেঁচে থাকা শেষ হলে ভাবে — একদিন আবার শুরু হবে, তাদের আশা আছে।” না। আমার আশা ছিল। আমার অতীত বর্ত- মান ভবিষ্যতৎ সব একাকার হয়ে গিয়েছিল।”

শেষকথা

সুতরাং পরিশেষে বলা যায় যে, 'বাকি ইতিহাস' নাটকে নাট্যকার বাদল সরকার ব্যক্তিমানুষের ইতিহাসের সাথে সমগ্র মানব সমাজের ইতিহাসকে মিলিয়ে দিয়েছেন। তিনি এ নাটকে নাগরিক জীববেন জীবনের সংকট- কে তুলে ধরেছেন। ব্যক্তিমানুষের ইতিহাসের বাইরে যুগে যুগে মানুষের উপর মানুষের শোষণ, নির্যাতন, নিপীড়নের নৈরাশ্যময় ইতি- হাসই হচ্ছে বাকি ইতিহাস। সুতরাং ব্যক্তিমানু- ষের যন্ত্রণার চেয়েও বড় যন্ত্রণা সমগ্র মানব- সমাজের বা বিশ্বরাজনীতির বেদনাকে গোপন রেখে পরিবার ও বাইরের আর্থিক সমৃদ্ধি নিয়ে সুখী থাকার প্রানপন প্রয়াস করে যেতে মানুষ কৃতসংকল্প – এটাই হচ্ছে জীবনের বাকি ইতিহাস, যা এ নাটকে নাট্যকার অতি নিপুনভাবে তুলে ধরেছেন। আর এখানেই নাট- কটির নামকরণ সার্থক হয়েছে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ