Hot Posts

6/recent/ticker-posts

চণ্ডীদাসের খোঁজে!... চন্ডীদাস সমস্যা কি?? চণ্ডীদাস সমস্যার প্রশ্ন উওর..

চন্ডীদাস সমস্যা----

**চন্ডীদাস সমস্যা ও এর সমাধানঃ-


চন্ডীদাস কবিখ্যাতি খুবই প্রাচীন বৈষ্ণবতোষণী' টীকায় এবং 'চৈতন্যচরিতামৃতে' চণ্ডীদাসের উল্লেখ পাই। চৈতন্যদেব চণ্ডীদাসের পদ আস্বাদন করতেন। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এই যে, “শ্রীচৈতন্যদেবের তিরোধানের প্রায় দেড় শত বৎসর পর্যন্ত, খ্রীষ্টিয় সপ্তদশ শতকের শেষ পাদ পর্যন্ত যতগুলি পদ সংগ্রহ সঙ্কলিত হইয়াছিল, সেগুলির একটিতেও চণ্ডীদাসের একটিও পদ ধরা হয় নাই; এমনকি অষ্টাদশ শতকের 'সঙ্কীর্তনামৃত' নামক একখানি পদসংগ্রহ-গ্রন্থে চণ্ডীদাসের কোনও পদ নাই। কিন্তু অষ্টাদশ শতক হইতে যত এদিকে আসা যায় অর্বাচীন পদ-সংগ্রহ গ্রন্থে চণ্ডীদাসের ভণিতাযুক্ত পদ মিলিতেছে, ও দেখা যায় ক্রমশঃ এইরূপ পদের সংখ্যা বাড়িতেছে 

অর্থাৎ চৈতন্যদেব কর্তৃক চণ্ডীদাসের পদ আস্বাদিত হওয়া সত্বেও চণ্ডীদাস বহুদিন পর্যন্ত বৈষ্ণবসমাজে অনাদৃত ছিলেন। এবং বৈষ্ণব সমাজেই শুধু নয়, ঊনবিংশ শতাব্দীর বাঙালী সাহিত্য পাঠকের কাছেও চণ্ডীদাস খুব বহুল পরিচিত কবি ছিলেন না। ঐ শতাব্দের শেষ দিকে শিক্ষিত বাঙালী পাঠকের কাছে চণ্ডীদাস প্রথম পরিচিত হতে থাকেন। তারপর ক্রমেই চণ্ডীদাস সম্পর্কে এতো বিচ্ছিন্ন পদ, পুঁথি ও তথ্যাদি পাওয়া যেতে থাকে যে, বর্তমানে চণ্ডীদাস সমস্যা এক অসাধারণ জটিল রূপ ধারণ করেছে।

চণ্ডীদাসের নামের আগে বড়ু, দ্বিজ, দীন, আদি এই কটি বিশেষণ যুক্ত হ'তে দেখা যায়। এর মধ্যে 'আদি চণ্ডীদাস' ভণিতায় পাওয়া যায় মাত্র দুটি পদ, অতএব কোনো যুক্তির অবতারণা না করেও 'আদি চণ্ডীদাস' নামে যে পৃথক কোনো কবি ছিলেন না সে কথা স্পষ্ট বুঝা যায়। আদি চণ্ডীদাসের একটি পদ আবার 'দ্বিজ চণ্ডীদাস' ভণিতায়ও পাওয়া যায়। ২৮ বস্তুতঃ বড়ু, দ্বিজ, দীন- এই তিনটি বিশেষণ নিয়েই যতো গণ্ডগোল। তাছাড়া, কোনো বিশেষণ যুক্ত নেই, কেবলি 'চণ্ডীদাস' ভণিতায় যে সব বিচ্ছিন্ন পদ পাওয়া যায় সেগুলিও যে একজন চণ্ডীদাসের রচনা তাও নিঃসংশয়ে বলা যায় না।

বিচ্ছিন্ন পদ ছাড়া রাধাকৃষ্ণের লীলাবিষয়ক পালাগানের যে পুঁথিগুলি পাওয়া গেছে তা হচ্ছে- (১) চণ্ডীদাসের চতুর্দশ পদাবলী – নগেন্দ্র নাথ বসু প্রাচ্যবিদ্যামহার্ণব ১৪টি পদের এই পুঁথি বিষ্ণুপুর অঞ্চল থেকে আবিষ্কার করেন। এতে সহজিয়া তত্ত্বের ব্যাখ্যা এবং রামী-চণ্ডীদাস ঘটিত কাহিনী পাওয়া যাচ্ছে ।

(২) রাসলীলা—নীলরতন মুখোপাধ্যায় ১৩০৫ বঙ্গাব্দের দিকে চণ্ডীদাসের রাসলীলা বিষয়ক ৭১টি পদের একটি পুঁথি পান। পদগুলির ভাব ভাষা খুব দুর্বল ॥ 

 (৩) রাধার কলঙ্ক ডঞ্জন। এটিও চণ্ডীদাসের ভণিতায় প্রাপ্ত একটি পালাগানের পুথি। আবিষ্কার করেন আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ।

(8)টর আবিষ্কারক ব্যোমকেশ মুস্তকী। মোট পদ সংখ্যা

তার মধ্যে ১৪টি পনে পাওয়া যায় 'দীন চীদ'। 'বড়ু' বা '' যুক্ত ভণিতা একটিও

(৫) শ্রীকৃষ্ণকীর্তন - বড়ু চণ্ডীদাসের ভণিতায় প্রাপ্ত। (৬) মনীন্দ্রমোহন বসু কর্তৃক আবিষ্কৃত দীন চণ্ডীদাসের ভণিতা-যুক্ত দুটি

(৭) ১২০২টি পদ সম্বলিত দীন চণ্ডীদাসের ভণিতাযুক্ত পালাগানের পুঁথি ৷৩৪ এই পুঁথিগুলির মধ্যে ৪, ৬ ও ৭ নম্বরে উল্লেখিত পুঁথিগুলি যে একই কবির, অর্থাৎ দীন চণ্ডীদাসের, সে কথা বুঝতে কোনো অসুবিধার কারণ নেই। ভাব, ভাষা ও রচনা রীতির বিচারে ২ ও ৩ নম্বরে উল্লেখিত পুঁথি দুখানিও দীন চণ্ডীদাসের বলেই মনে হয়। কিন্তু শ্রীকৃষ্ণকীর্তন' নামে প্রকাশিত গ্রন্থটি বড়ু চণ্ডীদাসের ভণিতাযুক্ত। বড়ু চণ্ডীদাস ও দীন চণ্ডীদাস যে এক ব্যক্তি হ'তে পারেন না সে সম্পর্কে অধিকাংশ পণ্ডিতই একমত। তাছাড়াও প্রশ্ন হচ্ছে, সহজিয়া তত্ত্ব-মূলক ১৪টি পদের (এ ধরনের আরো বিচ্ছিন্ন পদ চট্টদাসের ভণিতায় পাওয়া

ধরনের আরো বিচ্ছিন্ন পদ চট্টদাসের ভণিতায় পাওয়া যাচ্ছে) পুঁথিখানি কোন চণ্ডীদাসের?


তাহলে চণ্ডীদাস সমস্যার রূপটি দাঁড়াচ্ছে মোটামুটি এ রকম ঃ    চন্ডীদাস----

    

১.রাধাকৃষ্ণলীলা বিষয়ক পালাগানের লেখক


২.রাধাকৃষ্ণ বিষয়বিচ্ছিন্ন পদের লেখক। দ্বিজ, দীন, বড়ু, আদি প্রভৃতি নানা বিশেষণ-যুক্ত চণ্ডীদাসের ভণিতায় বিচ্ছিন্ন পদাবলী পাওয়া যাচ্ছে। এই পদাবলী দু'ভাগে বিভক্ত।


1.সাধারণ ভাবমূলক

2.সহজিয়া ভাবমূলক

প্রশ্ন এই, সবটা মিলিয়ে কি চণ্ডীদাস একজন? না একাধিক? স্পষ্টই বুঝা যাচ্ছে, একাধিক হ'লে সংখ্যাটা দুই, তিন অথবা চার পর্যন্ত যেতে পারে । প্রথমেই আমাদের বক্তব্য, বড়ু চণ্ডীদাস ও দীন চণ্ডীদাস দুজন স্বতন্ত্র কবি ।

(১) ভাষা বিচারে দেখা গেছে, বড়ু চণ্ডীদাসের কাব্যের ভাষায় চতুর্দশ শতাব্দের  বহু রুপ রয়েছে।

২.বড়ুচব্ডীদাস পলরথম শ্রেণির কবি আর দীন চন্ভাডীদাস তৃতীয় শ্রেণির কবি।দীন চণ্ডীদাস এর পদাবলী সম্পর্কে শ্রীকুমার বন্দোপাদ্ধায় এর অভিমত “পৌরাণিক ঘটনার রসহীন বর্ণনা ভাষার শ্লথ-শিথিল , কে রে পাদপুরণের জন্য অহেতুক বাক্যাবলীর বারংবার প্রয়োগ, অসংযত পরিমিতিহীন বহুভাষিতা, একই বিষয়ে ক্লান্তিকর পৌনঃপুনিক পুনরাবৃত্তি, ভাব-সংহতি ও রস-গাঢ়তার অভাব- এ সমস্ত দোষই তাঁহার রচনায় সুস্পষ্টভাবে উপলব্ধি যায়। এই শিশু সুলভ কাকলীর কবি যে মহাকবি চন্ডীদাসের সরল, মর্মস্পর্শী, ভাবঘন পদগুলির রচয়িতা হইতে পারেন ইহা যেন আমাদের ধারণারও অগম্য। 

(৩) বিষয়বস্তু পরিকল্পনায় দুজন কবির মধ্যে পার্থক্য প্রচুর বড়ু চণ্ডীদাসে রাধা ও চন্দ্রাবলী অভিন্ন, রাধা সেখানে সাগর গোয়ালার কন্যা, মায়ে নাম পদুমা৷ সখীদের সঙ্গে সে দধি-দুধের পসরা সাজিয়ে নিয়ে বেচতে যায়। কিন্তু দী চণ্ডীদাসে রাধা ও চন্দ্রাবলী পৃথক; চন্দ্রাবলী রাধার সখী, প্রতিনায়িকা! এখানে রা ‘বৃষভাণু’ বা ‘বৃদ্ভানু’ রাজার কন্যা, মায়ের নাম কলাবতী বা কীর্তিদা বড়ু চণ্ডীদাসের কাব্যে কৃষ্ণের আবির্ভাব হয়েছিল কংসাসুর বধের উদ্দেশে এখানে পুরাণের অনুসরণ করেছেন কবি। পুরাণমতে অসুরধ্বংস করবার জন্যই নার কৃষ্ণরূপে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। কিন্তু দীন চণ্ডীদাস বলেছেন—

"বৃন্দাবন রস

রস আস্বাদিতে

জন্মিল গোলক হরি ""।

বড়ু চণ্ডীদাসের কাব্যে মানবীয় ভাবের সঙ্গে ঐশ্বর্যভাবে প্রাধান্য আছে; চণ্ডীদাস মুখ্যতঃ মাধুর্যময় ব্রজলীলার কবি; সেখানে মানবীয় ভাবটি উপেক্ষিত।


(৪) ‘দাস্য, সখ্য, বাৎসল্য ও মধুর ভেবে যে মাধুর্য চতুর্বিধ এই তত্ত্ব বৈষ্ণবগণ কর্তৃক সর্বপ্রথম বঙ্গদেশে প্রচারিত হইয়াছিল । ....... চৈতন্য-প প্রেমমূলক মাধুর্যভাবের উপাসনার ধারণা প্রবর্তিত হইয়াছে। .... দীন চণ্ডীদাস বাৎল। প্রকরণে নন্দবিদায় প্রভৃতি পালাতে বাৎসল্যভাব, ‘রাখালবিলাপে” সখ্যভাব।দাসেই প্রত্যক্ষ করা যায়, বহু চা পূর্ববর্তী কবি বলে তাঁর কাব্যে এ সব প্রভাব পড়েনি।

(2) দাসের পার্থক্য আরো স্পষ্ট। বড়ু চণ্ডীদাসের দীন চণ্ডীদামে নেই। (৬) রাধা কৃষ্ণের কারো কোনো সখাসখীর নাম নেই। কিন্তু চৈতন্য পরবর্তীকালের ব'লে দীন চণ্ডীদাসের কাব্যে তাদের অনেক নাম পাওয়া।

(৭) বড়ু চণ্ডীদাস বাসলীদেবীর উপাসক ছিলেন, কিন্তু দীন চণ্ডীদাসের কাব্যে। কোখাও বাসলীর উল্লেখ নেই

৮.সবশেষে বলা যায়, আনুমানিক কাল নির্ণয় করতে গেলে দেখা যাবে, বড়ু চট্রীদাস চৈতন্য পূর্বে কালের এবং দীন চণ্ডীদাস চৈতন্য পরবর্তীকালের কবি।অতএব বড়ু চণ্ডীদাস ও দীন চণ্ডীদাস যে দুজন পৃথক কবি সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ খুব কম। যাঁরা চণ্ডীদাস একজন ছিলেন মনে করেন তাঁদের মধ্যে, যে কোনো সতর্ক পাঠকই লক্ষ্য করবেন, যুক্তি অপেক্ষা হৃদয়াবেগ বেশি। বড়ু চণ্ডীদাস ও দীনচণ্ডীদাসকে একজন কবি মনে করার পেছনে সত্যকার কোনো যুক্তি খুঁজে পাওয়া কঠিন ।

উন্নত আধ্যাত্মিক ভাবমণ্ডিত ও সুন্দর রসোত্তীর্ণ কতকগুলি বিচ্ছিন্ন পদ বড়ু, দ্বিজ প্রভৃতি নানা ভণিতায় পাওয়া যায়—সবচেয়ে সমস্যা দেখা দিয়েছে এই পদ কয়টি নিয়ে৷ মনীন্দ্র মোহন বসু মনে করেছিলেন পদগুলি দীন চণ্ডীদাসের, শ্রীকুমার বন্দোপাধ্যায় তাঁকে সমর্থন করেন। কিন্তু অনেক সমালোচকই অত্যন্ত সার্থকভাবেই এ কথার প্রতিবাদ করেছেন। কেননা ঐ পদাবলীর চণ্ডীদাস একজন প্রথম শ্রেণীর প্রতিভাসম্পন্ন কবি। কিন্তু দীন চণ্ডীদাস সত্যই স্বল্পক্ষমতাসম্পন্ন একজন তৃতীয় শ্রেণীর কবি। এ সম্পর্কে সতীশচন্দ্র রায়ের মন্তব্য আমরা সম্পূর্ণরূপে সমর্থন করি—

“আমাদিগের বিবেচনায় কৃষ্ণকীর্তনের প্রবল শক্তিশালী কিন্তু উন্নত আধ্যাত্মিকতার লেশশূন্য কবি চণ্ডীদাস বরং কোন অচিন্তনীয় সাধনার বলে পদাবলীর শ্রেষ্ঠ আধ্যাত্মিক কবি চণ্ডীদাসে পরিণত হইতে পারেন, কিন্তু দীন চণ্ডীদাসের পক্ষে উহা সম্পূর্ণ অসম্ভব বটে।”৩৭ হরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় বৈষ্ণব সাহিত্যে একজন সুদক্ষ পণ্ডিত ব্যক্তি। তিনিও বিচ্ছিন্ন পদাবলীর কবি চণ্ডিদাস ও দীন চণ্ডীদাসকে এক ভাবতে পারেননি। বরং নানা প্রমাণ সহযোগে ঐ সব বিচ্ছিন্ন পদাবলীর চণ্ডীদাস যে বড়ু চণ্ডীদাস হলেও হ’তে পারেন,কথা তুলে ধরতে চেষ্টা করছেন মুপ্যাে এই চেষ্টা অনেকটাই সত্যের কাছাকাছি পৌঁছেছে। সতীশ চন্দ্র রায় অবশ্য বলেছেন "আমরা চণ্ডীদাসের প্রচলিত পদাবলীর ভাষা, ভাব ও আখ্যানবস্তুর সহিত কোনরূপেই বড়ু চণ্ডীদাসের মিঃস কৃষ্ণকীর্তনের সামঞ্জস্য সাধন করিতে সমর্থ হই নাই সামঞ্জস্য সাধন করা দুরূহ বটে, তবে অসম্ভব নয়। সব বাদ দিলেও একটি কথা মনে রাখা যায় যে, ঐ পদাবলী এবং কৃষ্ণকীর্তন-উভয়ই উন্নত শ্রেণীর কবি প্রতিভার বলেই শুধু রচনা করা সম্ভব। এবং উভয়ই, অধিকাংশ পণ্ডিতের মতে, চৈতন্য পূর্ব যুগের সৃষ্টি। এখন, এ কথা যদি মানতে হয় যে, বিচ্ছিন্ন পদাবলীর কবি চণ্ডীদাস এবং বড়ু চণ্ডীদাস দুজন পৃথক কবি তাহ'লে এই সিদ্ধান্তই অপরিহার্য হয়ে পড়ে যে, চৈতন্যপূর্ব যুগে দুজন মহাকবি চণ্ডীদাসের আবির্ভাব হয়েছিল। অত্যন্ত কাছাকাছি সময়ে একই নামে দুজন মহাকবির আবির্ভাব, অসম্ভব ঘটনা না হ'লেও, অত্যন্ত বেশি বিরল, প্রায় অসম্ভবের কাছাকাছি, একটা ঘটনা বটে। শহীদুল্লাহ্ সাহেবের এ মন্তব্য ঠিক যে, বড়ু চণ্ডীদাস যে বিচ্ছিন্ন পদাবলী রচনা করেছিলেন তার কোনো সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়নি ॥৪০ সুস্পষ্ট প্রমাণ খুঁজতে গেলে এ ক্ষেত্রে কোনো নিশ্চিত সিদ্ধান্তে পৌছানো সত্যই অসম্ভব। তবে, চণ্ডীদাসের নামে প্রচলিত উন্নত শ্রেণীর মাত্র ৪০/৫০টি পদের জন্য পৃথক কোনো কবির অস্তিত্ব যদি স্বীকার না ক'রে তাঁকে বড়ু বা দীন যে- কোনো একজনের সঙ্গে একীভূত করে দেওয়াটা সঙ্গত বিবেচিত হয় তাহলে আমরা বড়ুচণ্ডীদাসের পক্ষপাতী অর্থাৎ বড়ু চণ্ডীদাসই জীবনের পরবর্তী অংশে সাধনা বলে 'দ্বিজ' হয়েছিলেন এবং বৃদ্ধ বয়সে আখ্যায়িকা কাব্য লেখার পরিশ্রম সইতে না পেরে কয়েকটি বিচ্ছিন্ন পদ রচনা করেছিলেন। সাধারণভাবে, মধ্যযুগের কবি-মানসে কোনো পরিবর্তন সহজলভ্য ব্যাপার নয়, কিন্তু চণ্ডীদাসের মতো প্রতিভাবান কোনো কবির কাছে আমরা তা নিশ্চয়ই আশা করতে পারি।

এবার রাগাত্মিকা পদাবলীর সহজিয়া চণ্ডীদাসের প্রসঙ্গে আসা যাক। পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে, নগেন্দ্রনাথ বসু ১৪টি রাগাত্মিকা পদাবলীর একটি পুঁথি পেয়েছেন। এ ছাড়াও বিচ্ছিন্নভাবে অনেক রাগাত্মিকা পদের ভণিতায় চণ্ডীদাসের নাম পাওয়া যায়, এ সব পদে রামীঘটিত কাহিনীর উল্লেখও রয়েছে। তাছাড়াও, চণ্ডীদাস ও রামীকে জড়িয়ে প্রচুর উপকাথাও কিংবদন্তি এবং নানা গল্প বীরভূম বাঁকুড়া অঞ্চলে এবং সহজিয়াদের বিভিন্ন পুঁথি-পত্রে ছড়িয়ে আছে। এই সহজিয়া চণ্ডীদাস কি স্বতন্ত্র কবি? না, তিনি বড়ু বা দীন বা দ্বিজ কোনো একজনের পরিবর্তিত রূপ মাত্র? ঐ কবিদের একজন কেউ কি পরবর্তী জীবনে সহজিয়াদের দ্বারা প্রভাবান্বিত হয়ে রাগাত্মিকা পদগুলি রচনা করেছিলেন? সঠিক কিছুই বলা যায় না। কেবল এটুকু সিঃসন্দেহে বলা যায় যে, সহজিয়া চণ্ডীদাস কেউ থাকলে অবশ্যই তিনি চৈতন্য-পরবর্তী যুগের কবি। কারণ বৈষ্ণব সহজিয়া মত প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল চৈতন্য-পরবর্তী যুগে। 'পূর্ব-চৈতন্যযুগের চণ্ডীদাস সহজিয়া পদ লিখিতে পারিতেন না, কারণ, সে যুগে পীরিতি-সাধনার উৎপত্তি হয় নাই ।”৪১ মনীন্দ্ৰ মোহন বসুও লিখেছেন— “রামী যদি কাহারও থাকিয়া থাকে তবে তাহা এই দীন বা দ্বিজ চণ্ডীদাসের, বড়ু চণ্ডীদাসের নহে।”৪২ অনেকে মনে করেন, যেমন

- পালা গানের পুথির মধ্যে কোথা

সঙ্গে রামীকে বাড়িত করা ঠি

উপনি পরামী, সত্য হ'লে, বিশেষ

হয়েছিলেন, অথবা সহজিয়া

রেছিলেন সুইে

এটি রামীকে লাভ করার পূর্বের কোনো রচনায় বাদীর

থাকতে পারে। সুবৃহৎ পালাগানের পুঁথিটি তাঁর জীবনে রামীর আবির্ভাবের।এতোই সর? মনীন্দ্র মোহন বসু দেখিয়েছেন' 'দীন চণ্ডীদাসের গুলি পদে সহজিয়া ধর্ম-তত্ত্বের বিবৃতি রহিয়াছে। "৪৩ অতএব সয়াসকে যদি কারো সঙ্গে মেলানো সম্ভব হয় তবে তিনি দীন চণ্ডীদাসএ কথাও একেবারে উপেক্ষা করবার মতো নয় যে, সহজিয়া চণ্ডীদাস মূলতঃই

সহজিয়া মতকে সমাজে শ্রদ্ধেয় ক'রে তুলবার জন্য সহজিয়ারা তাদের

ধর্মমত ও আচার-অনুষ্ঠানমূলক পদ রচনা ক'রে চণ্ডীদাস, রূপ গোস্বামী, স্বরূপ দামোদর,

কৃষ্ণদাস কবিরাজ প্রভৃতি মহাজনদের নামে চালিয়ে দিতেন। বিমানবিহারী মজুমদারঠিক এই যুক্তিতেই সহজিয়া চণ্ডীদাসের অস্তিত্ব অস্বীকার করেছেন। অসিতকুমারবন্দ্যোপাধ্যায়ও মনে করেন “১৭শ ১৮শ শতাব্দীর অনেক বৈষ্ণব সহজিয়া কবি

চণ্ডীদাসের নামটি নিজ নামের সঙ্গে যোগ করিতেন। ৪৪ কথাটি সত্য । এইভাবেই

বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন সহজিয়া কবি তাঁদের সম্প্রদায়গত সুবিধা অনুযায়ী পদ রচনা ক'রে।

চজীদাসের নামে চালাতে চালাতে আজ স্বতন্ত্র একজন চন্ডীদাসকে যেন অবশ্যম্ভাবী ক'রে

তুলেছেন। ডঃ বিমানবিহারী মজুমদার চমৎকার একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা

লিপিবদ্ধ করেছেন—“চণ্ডীদাস নামটি যে সহজিয়া সম্প্রদায়ের মধ্যে গুরু পরম্পরাক্রমেচলিয়া আসিতেছে, তাহা আমরা স্বচক্ষে দেখিয়াছি। পঞ্চাশ বছর পূর্বে, আমরা যখন

স্কুলের তৃতীয় চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ি, তখন নবদ্বীপের বনচারির ডাঙ্গায় এক চণ্ডীদাস ও

রজকিনী দেখিতে যাইতাম। তাঁহারা পাশাপাশি যোগাসনে বসিয়া থাকিতেন। আর

তাঁহাদের সামনে একটি কুকুরও স্থির হইয়া থাকিত। এই চণ্ডীদাস পদ রচনাও

করিতেন। আমরা চারি আনা দিয়া তাঁহার পদের বইও কিনিয়াছিলাম।”৪৫ ডঃমজুমদারের উক্তি সত্য হ'লে (এবং সত্য ব’লেই আমরা মনে করি) সহজিয়াদের মধ্যেচণ্ডীদাস কোনো বিশেষ একজন ব্যক্তি নয়, উপাধি। এবং অনেকেই ঐ উপাধি লাভক'রে চণ্ডীদাস হতেন ও পদ রচনা করতেন। কিন্তু ডঃ মজুমদারের এই সিদ্ধান্ত, আমাদের ধারণায় সত্যের কাছাকাছিপৌঁছালেও, এখনো পর্যন্ত সর্ববাদী—মত বলে গৃহীত হয়নি। তাঁদের আপত্তি মোটামুটিএই ধরনের-“সহজিয়ারা নিজেদের দল পুষ্ট করিবার জন্যই একজন সহজিয়া চণ্ডীদাসখাড়া করিয়াছিলেন, এ ধারণা একেবারে অসম্ভব না হইলেও পুরাপুরি সত্য কি নাসন্দেহের বিষয়। একজন কাল্পনিক কবিকে লইয়া এত উপকথা প্রবাদ সৃষ্টি হইতে পারেনা।

পরিশেষে এই ব'লে যে পূর্বযুগে বড়ু [5] [চৈতনা-- বিষয়ে আমাদের কোনোই সংশয় নেই। তবে বিয়ি সমাজ সম্পর্কে কোনো নিশ্চিত সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার মতো যথেষ্ট উপাদান এখনো মেলেনি। বড়ো তোর এতটুকু বলা যায়, আমার মনে হয়েছে বড়ু চণ্ডীস এবং বিচ্ছিন্ন পদাবলীর হ'লেও হ'তে পারেন, কিন্তু দীদাসের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন পদাবলীর চণ্ডীদাসের অভিন্নতা কল্পনাই করা যায় না। আর সহলিয়া চণ্ডীদাস, খুবই সম্ভব যে, কোনো একজন বিশেষ।সবশেষে এ কথা ব’লে প্রসঙ্গ শেষ করা যেতে পারে যে, চণ্ডীদাস সম্পর্কিত সকল প্রশ্নের সঠিক উত্তর দেওয়া এখন পর্যন্ত সব নয়। বিশেষ করে চণ্ডীদাস ভণিতায় একটিও কোনো গৌরচন্দ্রিকার পদ পাওয়া যায়নি কেন—এ প্রশ্নের উত্তর কেউই দিতে পারেননি। চৈতন্য-পূর্ব চণ্ডীদাস সম্পর্কে এ প্রশ্নের কী জবাব মিলবে? আরো নতুন তথ্য না পাওয়া পর্যন্ত কোনো কথা স্থির করে বলা যায় না।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ