Hot Posts

6/recent/ticker-posts

নুরজাহান নাটক আলোচনা

 

(নুরজাহান নাটক আলোচনা 
নুরজাহান নাটক চরিত্র 
নুরজাহান নাটক ও দ্বিজেন্দ্রলাল রায়
নুরজাহান নাটকের নারী চরিত্র 
নুরজাহান নাটকের কাহিনী)
**বিঃদ্র-বাংলা বিভাগের সকল পড়াশোনা পেতে ব্লগটিতে যুক্তথাকুন https://monoweredu13.blogspot.com/?m=1 
নুরজাহান নাটক আলোচনা ---

বাংলা সাহিত্যের এক অনবদ্য নাম দ্বিজেন্দ্রলাল রায়(১৮৬৩-১৯১৩)। বিশেষ করে বাংলা নাটকে তার অবদান অবিস্মরণীয়। তার লেখা নাটকগুলোর মধ্যে নুরজাহান নাটকটি অন্যতম।

চরিত্রসমূহ---

জাহাঙ্গীর (ভারত সম্রাট), রেবা(ভারতের সম্রাজ্ঞী)মেহেরুন্নিসা [নুরজাহান] (শের খাঁর স্ত্রী),লয়লা (নুরজাহানের কন্যা),শের খাঁ (সম্রাটের ওমরাও),মহাবৎ খাঁ (সম্রাটের সেনাপতি),আয়াস (সম্রাটের কোষাধ্যক্ষ, পরিবেশ মন্ত্রী),আসফ্ (আয়াসের পুত্র),কর্ণ সিংহ (মেবারের রাণা),খসরু (রেবার পুত্র),পরভেজ, খুরম [সাজাহান], শারিয়ার (জাহাঙ্গীরের পুত্রগণ) বিজয়সিংহ (মেবারের সেনাপতি)

দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের 'নুরজাহান' নাটক ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে রচিত। নাটকটি তিনি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের পুণ্যস্মৃতির উদ্দেশে উৎসর্গ করেছেন। এ নাটকের বিশেষত্ব সম্পর্কে নাট্যকার নিজেই এর ভূমিকায় বলেছেন:

'মৎ প্রণীত অন্যান্য ঐতিহাসিক নাটক হইতে নুরজাহান নাটকের অনেক বিষয়ে প্রভেদ লক্ষিত হইবে। প্রথম প্রভেদ এই যে, আমি এই নাটকে দেব-চরিত্র সৃষ্টি করিবার চেষ্টা করি নাই। আমি এই নাটকে দোষগুণ সমন্বিত মনুষ্যচরিত্র অঙ্কন করিতে প্রয়াস পাইয়াছি। দ্বিতীয় প্রভেদ এই যে,

এই নাটকে বাহিরের যুদ্ধ অপেক্ষা ভিতরের যুদ্ধ দেখাইতেই আমি আপনাকে সমধিক ব্যাপৃত রাখিয়াছি। তৃতীয় প্রভেদ এই যে, আমি এই নাটকে দ্বিতীয় ব্যক্তির সমক্ষে কাহারও স্বগতোক্তি একেবারে পরিহার করিয়াছি।'


ইতিহাসে নুরজাহান একটি উল্লেখযোগ্য চরিত্র। প্রচলিত ইতিকথায় নুরজাহানকে অসাধারণ রূপগুণসম্পন্না রহস্যময়ী মোহিনী নারী রূপে চিত্রিত করা হয়েছে। প্রথম জীবনে তার নাম মেহেরুন্নিসা. সম্রাজ্ঞীরূপে তিনি নুরজাহান। মোগল রাজ-অমাত্য আয়াস খাঁর যুবতী কন্যা, অনন্য রূপসী ও বুদ্ধিমতী মেহেরুন্নিসাকে দেখে সম্রাট আকবরের জ্যেষ্ঠপুত্র শাহজাদা সেলিম মুগ্ধ হন। সেলিমের প্রতিও প্রেমাসক্ত হন। মেহেরুন্নিসা। কিন্তু সম্রাট আকবর এই প্রণয়কে অনুমোদন করেন না। তিনি সেলিমকে এই প্রেমাবেশ থেকে মুক্ত করার জন্য মেহেরুন্নিসাকে শের আফগান নামক এক সৈন্যাধ্যক্ষের সঙ্গে বিবাহ দিয়ে তাদেরকে সুদূর বঙ্গদেশের বর্ধমানে পাঠিয়ে দেন। সেখানে তারা সুখে কালাতিপাত করতে থাকেন। তাদের একটি কন্যা সন্তান জন্মলাভ করে। আকবরের মৃত্যুর পর সেলিম 'জাহাঙ্গীর' উপাধি গ্রহণ করে সিংহাসনে বসেন। দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হলেও জাহাঙ্গীরের হৃদয় থেকে মেহেরুন্নিসার মধুময় স্মৃতি মুছে যায় নি। তিনি বঙ্গদেশের সুবাদারকে দিয়ে শের আফগানকে হত্যা করিয়ে কন্যা লয়লাসহ মেহেরুন্নিসাকে আগ্রার প্রাসাদে নিয়ে আসেন। সেখানে মেহেরুন্নিসা বহুদিন পর্যন্ত স্বামীহত্তা সম্রাটের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেই অস্বীকৃতি জানান। আর যখন সাক্ষাৎ করলেন, তখন সম্রাটের সঙ্গে বিবাহবন্ধনেও আবদ্ধ হলেন। বিবাহের পর তিনি সম্রাটকে এতোটাই বিমোহিত করলেন যে, সাম্রাজ্য শাসনে সম্রাট তার আজ্ঞাবহ হয়ে পড়লেন। পর্দার অন্তরালে থেকেও সাম্রাজ্য শাসনের ক্ষেত্রে নূরজাহান প্রায় একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেন। কেবল জাহাঙ্গীরের রাজত্বের শেষপর্বে শাহজাদা খুররম (সাজাহান) বিদ্রোহী হয়েছিলেন এবং সেনাপতি মহাবৎ খাঁ সম্রাটকে বন্দি করেছিলেন। সম্রাটের মৃত্যুর পর নুরজাহান স্বীয় জামাতা অকর্মণ্য শাহরিয়ারের মাধ্যমে তার আধিপত্য এবং কর্তৃত্বকে স্থায়িত্ব দান করতে সচেষ্ট হয়েছিলেন। কিন্তু সম্রাট জাহাঙ্গীরের মৃত্যুর পর সাজাহান ক্ষমতা দখল করেন এবং নুরজাহান ক্ষমতাচ্যুত হন। ডি. এল. রায় তাঁর নাটকে ইতিহাসের এই ধারাবাহিকতার বাইরে যান নি। তবে যে ইতিহাস লিখিত হয় নি, নাটকে তিনি নরনারীর বিশেষত নুরজাহানের হৃদয়বৃত্তান্তের সেই ইতিহাসকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। ইতিহাসের নুরজাহান প্রথম স্বামী শের আফগানকে ভালবেসেছিলেন কিনা সে বিষয়ে ভালমন্দ কিছুই জানা যায় না। বরং নুরজাহানের জীবনে মেহেরুন্নিসার স্বামী শের খাঁর স্মৃতি কোনো রেখাপাত করে নি। জাহাঙ্গীরের সঙ্গে তার বিবাহিত জীবন সুখেরই হয়েছিল। তিনি কখনই জাহাঙ্গীরের প্রতি প্রতিশোধপরায়ণ ছিলেন না। অসুস্থ সম্রাটকে যখন চিকিৎসকেরা একে একে ত্যাগ করে চলে যান, তখন এই পতিপ্রাণা রমণীর সেবাতেই তিনি সুস্থ হয়ে উঠেন। নুরজাহানকে জাহাঙ্গীরের সঙ্গে বিবাহের জন্য আসফ খাঁর প্ররোচনার কথা ইতিহাস

সমর্থন করে না। মানসিংহের বোন খসরুর মাতা (যার নাম: মানবাঈ রেবা নয়) জাহাঙ্গীরের সিংহাসন লাভের আগেই আত্মহত্যা করেন। খসরুর হত্যাকাণ্ডে মুরজাহানের ইজ্জনের কোনো ঐতিহাসিক প্রমাণ নেই। শের খাঁর কন্যা পয়গ্য চরিত্রের ইতিহাসস্বীকৃতি থাকলেও তার কোনো সক্রিয় ভূমিকা ছিল না। আর নুরজাহানের যে পরিণতি নাটকে দেখানো হয়েছে, তা সম্পূর্ণই অনৈতিহাসিক। কেননা, পরিণামে যে নুরজাহান উন্মাদিনী হন নি এ-কথা ইতিহাসস্বীকৃত। বরং ইতিহাসে তার শেষ জীবনের চিত্র পাওয়া যায় ঐতিহাসিক বেণী প্রসাদ (Beni Prasad)-এর বর্ণনায়:


Henceforword she wore only white cloth, abstained from parties of pleasure and lived privately in sorrow, chiefly at Lahore, with her daughter, the widow of Prince Shahriyar. (Jahangir,


Chapter XXII) সম্রাট আকবরের মৃত্যুর পর জাহাঙ্গীরের সিংহাসন আরোহণ থেকে নাটকের ঘটনারম্ভ এবং তা জাহাঙ্গীরের মৃত্যুর পর সাজাহানের সিংহাসন অধিকার পর্যন্ত বিস্তৃত। কিন্তু সাম্রাজ্য শাসনের ইতিহাস নাটকের পটভূমি মাত্র। মূল ঘটনাঃ নুরজাহনের মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বসংঘাত এবং জাহাঙ্গীর, লয়লা প্রমুখের মনোলোকের উপর আলোকসম্পাত। 'নুরজাহান' ঘটনা প্রধান নয়, চরিত্র প্রধান নাটক। নুরজাহানই এ নাটকের মুখ্য চরিত্র। নাটকের আরম্ভ নুরজাহানকে দিয়ে, নাট্যকাহিনী বিকশিত হয়েছে তার চরিত্রের দ্বন্দ্ব-সংঘাতে এবং তার পরিণতিই নাটকেরও পরিণতি। সুতরাং নুরজাহান চরিত্রের সঙ্গতি, বিশ্বাসযোগ্যতা ও সার্থকতার উপরেই নাটকটিরও শিল্প-সার্থকতা নির্ভরশীল।


নুরজাহান চরিত্রের মনস্তত্ত্বসম্মত রূপ চিত্রণে নাট্যকার উল্লেখযোগ্য কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। এই চরিত্র ধারণ করেছে একাধিক বিরুদ্ধ বৃত্তির সংঘাতলীলা। প্রথম অঙ্কের প্রথম দৃশ্যেই নুরজাহানের দ্বন্দ্বময় মনোভাবের প্রকাশ লক্ষ করা যায়। সুন্দরী ও বুদ্ধিমতী স্ত্রী এবং কন্যার সংসার নিয়ে শের খাঁর মনে পরিতৃপ্তির আনন্দ। নুরজাহানও স্বামী-কন্যার সঙ্গে সুখে দিনাতিপাত করছেন। কেবল তার মনে চিন্তা: ‘এত সুখ বুঝি সইবে না। স্বামীও তাকে মাঝে মাঝে বিচলিত দেখেছেন। জাহাঙ্গীর সম্রাট হয়ে শের বাঁকে পাঁচ হাজারি মনসবদার নিযুক্ত করে আগ্রায় যেতে আদেশ দেন। শের খাঁ সানন্দে সে আমন্ত্রণ গ্রহণ করলেও নুরজাহান তা প্রত্যাখ্যান করার জন্য স্বামীকে অনুরোধ করেছেন। এখানে তার মানসিক দ্বন্দ্বের স্পষ্ট আভাস ফুটে উঠেছে। এই দ্বন্দ্ব আরও প্রকটিত হয়েছে জাহাঙ্গীরের সিংহাসন আরোহণের খবর শুনে তার মনে যে দুর্নিবার আবেগ জেগে উঠেছে, তা প্রাণপণে দমনের চেষ্টার মধ্যে। 'সেলিম সম্রাট। আবার সে কথা কেন মনে আসে? না, সে চিন্তাকে আমি মনে আসতে দিব না না না না! সে প্রথম যৌবনের একটা খেয়াল মাত্র। এখন আবার সে চিন্তা কেন! সেলিম সম্রাট, তাতে আমার কি? (প্রথম অন্ত: প্রথম দৃশ্য) অন্য একটি দৃশ্যে আগ্রায় শের খার গৃহে নুরজাহান তার বান্ধবীর কাছে নিজের কুমারীজীবনের প্রেমবৃত্তান্ত এবং সেলিমের রূপোনাদনার কথা বিবৃদ্ধ করেছেন। এখানে তার সংলাপের মধ্যে স্পষ্ট হয়েছে

জাহাঙ্গীরের প্রতি তার মনোভাবের বিশ্লেষণ: না, তাকে আসক্তি বলে না। সে একটা উদ্দাম প্রভৃত্তি। হয়ত উচ্চাশা- হয়ত অহঙ্কার। কিন্তু আসকি নয়  (প্রথম অঙ্ক: চতুর্থ দৃশ্য) শাহজাদা সেলিমকে জয় করবার উদ্দাম এক প্রবৃত্তি যৌবনে তাকে পেয়ে বসেছিল সত্যি। কিন্তু শেষ ঘাঁর মতো মহান বীর ও সাফরিত্র স্বামীর ভালবাসাও তাকে কম মুগ্ধ করেনি। তাই দেখা যায়, শের খা নুরজাহানের নিকট থেকে শেষবার বিদায় গ্রহণের পর নুরজাহান বলেছেন: 'স্বামী! যদি ডক্তি প্রেমের শূন্যতা পূর্ণ কর্ডে পার্তো, তবে সে ভক্তি আমি তোমার পায়ে ঢেলে দিতাম।' (প্রথম অঙ্ক: অষ্টম দৃশ্য) প্রথম অন্তে নাট্যকার নুরজাহানকে যেভাবে পরিচিত্রিত করেছেন, তাতে এ-কথা বলা যায় যে, তিনি শের খা বা জাহাঙ্গীর কাউকেই ভালবাসতে পারেন নি। শের থাকে তিনি ভক্তি করেছেন আর জাহাঙ্গীরকে স্বীয় রূপ ও গুণে মুগ্ধ করে রাখতে পেরে আত্মপ্রসাদ অনুভব করেছেন। নুরজাহানের মনে দুই বিরুদ্ধ শক্তির ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াজাত দ্ব প্রথমাবধি ক্রিয়াশীল। একদিকে আদর্শ পতিব্রতা নারীর কর্তব্য পালনে সদিচ্ছা, অন্যদিকে প্রবল উচ্চাশা নুরজাহানকে পলে পলে দগ্ধ করেছে।


শের খাঁর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে নুরজাহান জীবনের একটি অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটেছে। বলা যায়, বধূ মেহেরের চরিত্রের পরিসমাপ্তি ঘটেছে। শের খাঁর মৃত্যু থেকে জাহাঙ্গীরের সঙ্গে বিবাহের পূর্ব পর্যন্ত চার বৎসরকাল নুরজাহান জীবনের সন্ধিপর্ব। এই পর্বে একদিকে স্বামীর স্মৃতি ও কন্যার প্রতি কর্তব্যবোধ, অন্যদিকে উচ্চাশা ও ক্ষমতালিপ্সা এই বিপরীত বৃত্তির সংঘাতে নুরজাহান চরিত্র প্রবলভাবে আলোড়িত হয়েছে। 4 পর্বেই আসফের প্ররোচনায় ও অনুরোধে তিনি শয়তানীর কাছে অসহায় আত্মসমর্পণ করেছেন। তার পত্নীসত্তা ও মাতৃসত্তা- দুই-ই এক শয়তানী বাসনার মধ্যে বিলীন হয়ে গেছে। জাহাঙ্গীরকে স্বামী হিসেবে বরণ করে নেয়ার পর তার মনোভাব: আমি আজ ভারতের সম্রাজ্ঞী! কিন্তু এ আমার গৌরব, না লজ্জা? এ আমার জয়, না পরাভব? উঃ কি পরাজয়! শয়তানীর সঙ্গে এতদিন ধরে যুদ্ধ করে এসে শেষে পরাস্ত হলাম। আমি হেরেছি। যখন বিবেক খুইয়েছি, তখন সব দ্বিধা সঙ্কোচ হৃদয় থেকে দূর হোক। যখন সম্রাজ্ঞী হয়েছি, রাজত্ব কৰ্ব্ব!' (দ্বিতীয় অঙ্ক: অষ্টম দৃশ্য) প্রবল একটা শক্তি যেন তাকে পতনের দিকে তাড়িত করছে। এই অনিবার্য শক্তির দ্বারা তাড়িত হয়েই নুরজাহান চারদিকে ধ্বংস ও মহামারীর বীজ ছড়িয়েছেন। সর্বব্যাপী এই ধ্বংসলীলার লেলিহান শিখা শেষ পর্যন্ত তাকেই ঘিরে ধরেছে। তিনি অপ্রতিহত গতিতে উচ্চাশা ও প্রতিহিংসার পথে অগ্রসর হয়েছেন এবং বাহিরে ও অন্তরে পর্যুদস্ত হয়ে উন্মাদিনী হয়েছেন। নুরজাহান চরিত্রের পরিণতি অনৈতিহাসিক হলেও অসঙ্গত হয় এবং এতে নাট্যগুণও ক্ষুণ্ন হয় । মূল পরিকল্পনার সঙ্গে এই পরিণতি সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং সম্পূর্ণরূপেই মনস্তত্ত্বসম্মত। কেননা, অন্তর্দ্বন্দ্বজর্জরিতা নুরজাহানের মনে যখন শূন্যতার হাহাকার, তখন বাইরেও তিনি অবলম্বনহীন। 'বজ্রবিদ্যুৎপূর্ণ বহিঃপ্রকৃতির সঙ্গে নুরজাহানের অসুস্থ মনোবিকারের চিত্র একসূত্রে গাঁথা হয়েছে।' (রবীন্দ্রনাথ রায়: দ্বিজেন্দ্রলাল রায়: সাহিত্য-সাধনা, দ্বিজেন্দ্র রচনাবলী, দ্বিতীয় খণ্ড)


নূরজাহান বাংলা সাহিত্যের এক সংঘাত-তাড়িত ট্র্যাজিক নারীচরিত্র। বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ট্রাজেডি রচয়িতাগণের ন্যায় দ্বিজেন্দ্রলালের নুরজাহানও এক অনন্যসাধারণ সৃষ্টি। কঠিনতম অন্তঃসংঘাতের মধ্য দিয়ে তার জীবন একান্ত দুঃখময় ট্র্যাজিক মহিমা লাভ করেছে বলেই তিনি অনন্যসাধারণ। তার ট্রাজেডির মূল নিহিত আছে তারই অস্ত জীবনের সংঘাতময় অস্থিরতার মধ্যে এবং নিরাবলম্ব রিক্ত নিঃস্ব পরিণতির মধ্যে। নাট্যকার অত্যন্ত সূক্ষ্মতার সঙ্গে তার এই আত্মিক অপচয়ের চিত্র এঁকেছেন। প্রথম অঙ্কে বধূ মেহেরের বিবাহিত জীবনের দ্বন্দ্ব, দ্বিতীয় অঙ্কে বধূ মেহের ও মাতা মেহেরের প্রাণপণ আত্মরক্ষার চেষ্টা ও শেষে ‘শয়তানী'-বৃত্তির জয়লাভ। তৃতীয় ও চতুর্থ অঙ্কে সম্রাজ্ঞী নূরজাহান তার স্বেচ্ছাচার ও শক্তিমত্ততার শকট চালিয়েছেন। চতুর্থ অঙ্কের শেষ দিক থেকেই নুরজাহানের আত্মক্ষয়কারী সংগ্রাম ঢালুপথ অবলম্বন করেছে। পঞ্চমাঙ্কে নুরজাহানের ট্রাজেডি পূর্ণতা লাভ করেছে। বধূ মেহের ও মাতা মেহেরের অপমৃত্যু ঘটিয়ে পিশাচী নুরজাহানের ধ্বংসের তাণ্ডবনৃত্য শুরু হয়েছিল। ধীরে ধীরে তার অধিকারও চলে যাচ্ছে। তাই এক মর্মান্তিক হাহাকার ও শূন্যতার বেদনা পঞ্চমাঙ্কের শেষ দিকে চরিত্রটির মধ্যে সঞ্চারিত হয়েছে।' (রথীন্দ্রনাথ রায়: পূর্বোক্ত) সুরাসক্ত মোহাবিষ্ট জাহাঙ্গীর নুরজাহানকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন: তুমি দেবী না মানবী! নূরজাহানের উত্তর: আমি পিশাচী! (চতুর্থ অঙ্ক: দ্বিতীয় দৃশ্য) তবে সত্য এই, নুরজাহান নিরবচ্ছিন্নভাবে পিশাচী নন। 'প্রকৃতপক্ষে দ্বিজেন্দ্রলাল নুরজাহানকে একাধারে দেবী, मानवी পিশাচী করিয়া সৃষ্টি করিয়াছেন এবং কেমন করিয়া তাহার দেবত্ব ও মানবত্ব পৈশাচিকতায় আচ্ছন্ন হইয়াছে তাহা দেখাইতে চাহিয়াছেন।' (সুবোধচন্দ্র সেনগুপ্ত: নাট্যকার দ্বিজেন্দ্রলাল )


পাশ্চাত্ত্য নাটকের বিভিন্ন নারীচরিত্রের সঙ্গে নুরজাহান চরিত্রের উল্লেখযোগ্য মিল পরিলক্ষিত হয়। মিডিয়া, লেডি ম্যাকবেথ, হেড্ডা গ্যাবলার প্রভৃতি চরিত্রের বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্য নুরজাহান চরিত্রে দৃশ্যমান হলেও আগামেমনন-পত্নী ক্লাইটেমনেস্ট্রার সঙ্গেই তার অধিকতর সাদৃশ্য। ক্লাইটেমনেস্ট্রার ন্যায় তিনিও স্বামীহত্তাকেই স্বামী হিসেবে তাহণ করেছেন এবং কন্যার নিকট থেকেই শত্রুর আঘাত পেয়েছেন। ইউরিপিডিসের ইলেট্রা' নাটকে ক্লাইটেমনেস্ট্রা অন্যায়-অপরাধে নিমজ্জিত হলেও যেমন পাঠক দর্শকের বেদনাকরুণ সহানুভূতি আকর্ষণ করে, এল. রায়ও তেমনি নুরজাহানকে ক্ষমাকরুণ সহানুভূতির যোগ্য পাত্রী হিসেবেই সৃষ্টি করেছেন।


দ্বিজেন্দ্রলাল নুরজাহানের ট্রাজেডি পরিকল্পনায় শেক্সপিয়রীয় পদ্ধতিই অনুসরণ করেছেন। শেক্সপিয়রীয় ট্রাজেডির ন্যায় চরিত্রের অভ্যন্তর থেকেই 'নুরজাহান' নাটকে ট্রাজেডির উৎপত্তি হয়েছে। এখানে ট্রাজেডির জন্য নূরজাহান নিজেই সবচেয়ে বেশি দায়ী। কিন্তু কেউ কি স্বেচ্ছায় সচেতনভাবে নিজের করুণ পরিণতি ডেকে আনে? ডেকে আনে না এ-কথা সত্যি; কিন্তু ভাবনা ও আচরণের কারণে কাঙ্ক্ষিত স্বাভাবিকতা বিনষ্ট করে অনিবার্য দুঃখ-পরিণতির দিকে অপ্রতিহত বেগে অগ্রসর হয়। এখানেই অনুভূত হয় অদৃশ্য শক্তির অলঙ্ঘ্য নিয়ন্ত্রণ-লীলা। নুরজাহান পরোক্ষভাবে শেষ খাও

নূরজাহান বাংলা সাহিত্যের এক সংঘাত-তাড়িত ট্র্যাজিক নারীচরিত্র। বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ট্রাজেডি রচয়িতাগণের ন্যায় দ্বিজেন্দ্রলালের নুরজাহানও এক অনন্যসাধারণ সৃষ্টি। কঠিনতম অন্তঃসংঘাতের মধ্য দিয়ে তার জীবন একান্ত দুঃখময় ট্র্যাজিক মহিমা লাভ করেছে বলেই তিনি অনন্যসাধারণ। তার ট্রাজেডির মূল নিহিত আছে তারই অস্ত জীবনের সংঘাতময় অস্থিরতার মধ্যে এবং নিরাবলম্ব রিক্ত নিঃস্ব পরিণতির মধ্যে। নাট্যকার অত্যন্ত সূক্ষ্মতার সঙ্গে তার এই আত্মিক অপচয়ের চিত্র এঁকেছেন। প্রথম অঙ্কে বধূ মেহেরের বিবাহিত জীবনের দ্বন্দ্ব, দ্বিতীয় অঙ্কে বধূ মেহের ও মাতা মেহেরের প্রাণপণ আত্মরক্ষার চেষ্টা ও শেষে ‘শয়তানী'-বৃত্তির জয়লাভ। তৃতীয় ও চতুর্থ অঙ্কে সম্রাজ্ঞী নূরজাহান তার স্বেচ্ছাচার ও শক্তিমত্ততার শকট চালিয়েছেন। চতুর্থ অঙ্কের শেষ দিক থেকেই নুরজাহানের আত্মক্ষয়কারী সংগ্রাম ঢালুপথ অবলম্বন করেছে। পঞ্চমাঙ্কে নুরজাহানের ট্রাজেডি পূর্ণতা লাভ করেছে। বধূ মেহের ও মাতা মেহেরের অপমৃত্যু ঘটিয়ে পিশাচী নুরজাহানের ধ্বংসের তাণ্ডবনৃত্য শুরু হয়েছিল। ধীরে ধীরে তার অধিকারও চলে যাচ্ছে। তাই এক মর্মান্তিক হাহাকার ও শূন্যতার বেদনা পঞ্চমাঙ্কের শেষ দিকে চরিত্রটির মধ্যে সঞ্চারিত হয়েছে।' (রথীন্দ্রনাথ রায়: পূর্বোক্ত) সুরাসক্ত মোহাবিষ্ট জাহাঙ্গীর নুরজাহানকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন: তুমি দেবী না মানবী! নূরজাহানের উত্তর: আমি পিশাচী! (চতুর্থ অঙ্ক: দ্বিতীয় দৃশ্য) তবে সত্য এই, নুরজাহান নিরবচ্ছিন্নভাবে পিশাচী নন। 'প্রকৃতপক্ষে দ্বিজেন্দ্রলাল নুরজাহানকে একাধারে দেবী, मानवी পিশাচী করিয়া সৃষ্টি করিয়াছেন এবং কেমন করিয়া তাহার দেবত্ব ও মানবত্ব পৈশাচিকতায় আচ্ছন্ন হইয়াছে তাহা দেখাইতে চাহিয়াছেন।' (সুবোধচন্দ্র সেনগুপ্ত: নাট্যকার দ্বিজেন্দ্রলাল )


পাশ্চাত্ত্য নাটকের বিভিন্ন নারীচরিত্রের সঙ্গে নুরজাহান চরিত্রের উল্লেখযোগ্য মিল পরিলক্ষিত হয়। মিডিয়া, লেডি ম্যাকবেথ, হেড্ডা গ্যাবলার প্রভৃতি চরিত্রের বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্য নুরজাহান চরিত্রে দৃশ্যমান হলেও আগামেমনন-পত্নী ক্লাইটেমনেস্ট্রার সঙ্গেই তার অধিকতর সাদৃশ্য। ক্লাইটেমনেস্ট্রার ন্যায় তিনিও স্বামীহত্তাকেই স্বামী হিসেবে তাহণ করেছেন এবং কন্যার নিকট থেকেই শত্রুর আঘাত পেয়েছেন। ইউরিপিডিসের ইলেট্রা' নাটকে ক্লাইটেমনেস্ট্রা অন্যায়-অপরাধে নিমজ্জিত হলেও যেমন পাঠক দর্শকের বেদনাকরুণ সহানুভূতি আকর্ষণ করে, এল. রায়ও তেমনি নুরজাহানকে ক্ষমাকরুণ সহানুভূতির যোগ্য পাত্রী হিসেবেই সৃষ্টি করেছেন।

দ্বিজেন্দ্রলাল নুরজাহানের ট্রাজেডি পরিকল্পনায় শেক্সপিয়রীয় পদ্ধতিই অনুসরণ করেছেন। শেক্সপিয়রীয় ট্রাজেডির ন্যায় চরিত্রের অভ্যন্তর থেকেই 'নুরজাহান' নাটকে ট্রাজেডির উৎপত্তি হয়েছে। এখানে ট্রাজেডির জন্য নূরজাহান নিজেই সবচেয়ে বেশি দায়ী। কিন্তু কেউ কি স্বেচ্ছায় সচেতনভাবে নিজের করুণ পরিণতি ডেকে আনে? ডেকে আনে না এ-কথা সত্যি; কিন্তু ভাবনা ও আচরণের কারণে কাঙ্ক্ষিত স্বাভাবিকতা বিনষ্ট করে অনিবার্য দুঃখ-পরিণতির দিকে অপ্রতিহত বেগে অগ্রসর হয়। এখানেই অনুভূত হয় অদৃশ্য শক্তির অলঙ্ঘ্য নিয়ন্ত্রণ-লীলা। নুরজাহান পরোক্ষভাবে শের খা ও

জাহাঙ্গীরের মৃত্যুর জন্য দায়ী। কিন্তু এঁদের কারও মৃত্যু তার কাম্য ছিল না। কারণ শের খা তাকে দিয়েছিল সংসার ও নিঃস্বার্থ ভালবাসা আর জাহাঙ্গীরের নিকট থেকে তিনি পেয়েছিলেন সাম্রাজ্য। কিন্তু চরিত্র-বৈশিষ্ট্যের অনিবার্য টানে তিনি অন্তহীন ট্র্যাজেডির নিষ্কৃতিহীন গহ্বরে নিপতিত হয়েছেন। নুরজাহানের বাহ্যিক পরাজয়ের চেয়ে তার অন্তর্গত ক্ষরণ অধিকতর হৃদয়বিদারক। বস্তুত, তার অন্তর্গত পরাভবতাই তাকে ট্র্যাজিক মর্যাদায় অভিষিক্ত করেছে। এ প্রসঙ্গে সমালোচকের মন্তব্য স্মরণযোগ্যঃ "বাহাত নুরজাহানের পরাজয় ও পতন ঘটিল মহাবৎ-সাজাহান-কর্ণসিংহের কাছে। কিন্তু আসলে তাহার বড় পরাজয় ঘটিল অন্তরের মধ্যে সে পরাজয় তাহার শয়তানী সত্তার কাছে নারীসত্তার। নুরজাহান যতই একটির পর একটি অন্যায় কাজ করিয়াছে ততই তাহার অন্তরতম নারীসত্তা নিরুপায়ভাবে আর্তনাদ করিতে করিতে ক্ষয়িষ্ণু হইয়া পড়িয়াছে। জাহাঙ্গীরের মৃত্যুর পর সেই শয়তানী-সত্তাটির বিলোপ ঘটিল আর তখন বাহিরে প্রকাশিত হইয়া পড়িল তাহার অন্তরসত্তাটি দেখিলাম, পরাজিত, ক্ষত-বিক্ষত, অপ্রকৃতিস্থ একটি নারী। উপরের দেবতা তাহাকে শাসন করিবার জন্য ঝড়ের গর্জন ও বিদ্যুতের কষাঘাত শুরু করিয়াছেন, নীচের মানুষ তাহাকে দমন করিবার জন্য তাহার শক্তি ও দর্প চূর্ণ করিয়া তাহাকে সহায়-সম্বলহীনা এক ভিখারিণী করিয়া ফেলিয়াছে। ইহা অপেক্ষা হৃদয়বিদারক দৃশ্য আমরা আর কোথায় দেখিয়াছি?' (অজিতকুমার ঘোষ: পূর্বোক্ত)


'নুরজাহান' নাটকে শের খাঁ চরিত্রটি নুরজাহান চরিত্রের আলোকেই ফুটে উঠেছে। শের খাঁ উদার হৃদয়ের অধিকারী, অসমসাহসী বীর। নূরজাহানের রূপবহ্নি ও প্রেমস্বপ্নই তার জীবনে করুণ পরিণতি ডেকে এনেছে। তার হৃদয়ের আঙিনা জুড়ে এক সীমাহীন সর্বগ্রাসী ভালবাসা ব্যাপ্ত হয়েছিল। কিন্তু সে ভালবাসা নুরজাহানের হৃদয়দ্বারের কড়িকাঠে মাথা কুটে আহত হয়ে আর্তনাদ করে উঠেছে। স্ত্রীর ঔদাসীন্য শের বার মনে অভিমান জাগিয়ে তোলে। অভিমানক্ষুব্ধ এই মহান বীর প্রেমহীন জীবনের চেয়ে মৃত্যুকেই শ্রেয়তর মনে করেছেন। শের খাঁর অতৃপ্ত প্রেমপিপাসা, আত্মাভিমান ও আসন্ন মৃত্যুর কথা চিন্তা করে জীবন সম্পর্কে ঔদাসীন্য নাট্যকার দক্ষতার সঙ্গে রূপ দিয়েছেন।' (রথীন্দ্রনাথ রায়: পূর্বোক্ত) নাটকে প্রতিনায়ক হয়েও তাই মানবিক সদ্‌গুণে শের খাঁ চরিত্র ঔজ্জ্বল্যে ও মহত্ত্বে অপ্রতিদ্বন্দ্বী। বীরের মতো তার মৃত্যু নুরজাহানের চিত্ততলে এবং আমাদের হৃদয়ে এক ব্যথামৌন দীর্ঘশ্বাস চিরকালের জন্য সঞ্চিত রেখে গেছে।

নুরজাহান চরিত্রের পরেই এ-নাটকের উল্লেখযোগ্য চরিত্র জাহাঙ্গীর। আপাতদৃষ্টিতে জাহাঙ্গীর চরিত্র নিষ্ক্রিয় মনে হলেও তার মধ্যে এক সূক্ষ্ম দ্বন্দ্ব-লীলা সর্বদা ক্রিয়শীল । প্রবৃত্তি ও বিবেকের দ্বন্দ্বে জাহাঙ্গীর চরিত্রটি জটিলতর হয়েছে এবং পূর্ণতা লাভ করেছে। তিনি ন্যায়পরায়ণ বলে তার একটা অভিমান ছিল। কিন্তু তার এই ন্যায়পরায়ণতা বার বার দুর্দমনীয় রূপতৃষ্ণার কাছে পরাজিত হয়েছে। পরস্ত্রীর প্রতি লোভ করা অন্যায়- এ কথা জেনেও তিনি নিজের হৃদয়বৃত্তিকে দমন করতে পারেন

নি। নুরজাহানকে বিবাহ করার পর থেকে তার স্বেচ্ছাচারিতার কাছে সাম্রাজ্য সমৰ্পণ করে জাহাঙ্গীর সুর-সঙ্গীত-রূপতৃষ্ণার স্রোতে নিজেকে ভাসিয়ে দিয়েছেন। ক্ষমতাপ্রাপ্তির পর নুরজাহানের একটির পর একটি নৃশংস কাজে জাহাঙ্গীরের ন্যায়বোধ তীব্রভাবে আহত হয়েছে, অথচ প্রতিরোধ করবার আগ্রহ বা শক্তি কোনোটিই তার নেই। সে জন্যে স্বীয় বিচারবোধকে জোর করে নিস্তেজ করার জন্যে তিনি আরও বেশি মদ খেয়েছেন, অধিক সম্ভোগ-স্রোতে গা ভাসিয়ে দিয়েছেন। নুরজাহানকে তিনি বলেছেন: 'সুরা, সৌন্দর্য্য ও সঙ্গীত আমায় ঘিরে রাখুক। আর তার উপর তুমি তোমার রূপ, কন্ঠস্বর, চুম্বন, আলিঙ্গন দাও প্রিয়ে। চক্ষু থেকে পৃথিবী মুছে যাক।' (চতুর্থ অঙ্ক: চতুর্থ দৃশ্য) এই উক্তির মধ্যে জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণাই ফুটে উঠেছে এবং একজন মৃত্যুকামী মানুষের অস্তিম বেদনা ধ্বনিত হয়েছে। বিবেকদংশন এবং বাস্তব অসহায়ত্বের দ্বন্দ্বে ক্ষতবিক্ষত জাহাঙ্গীর তিল তিল করে নিজের জীবনকে মৃত্যুর হাতে সমর্পণ করেছেন।

লয়লা, নুরজাহানের কন্যা, চরিত্রটি নাটকের মধ্যে নুরজাহানের প্রতিদ্বন্দ্বিনী শক্তিরূপে বিরাজিত। শেক্সপিয়রের হ্যামলেট চরিত্রের সামান্য প্রভাব লয়লা চরিত্রের মধ্যে রয়েছে। তবে গ্রীক নাটকের ইলেকট্রা চরিত্রের সঙ্গেই তার সাদৃশ্য অধিক। পিতৃহত্তাকে তার মা বিবাহ করেছে- এ চিত্তা লয়লার অসহ্য। সে তার মাকে তীব্র ও অশোভনভাবে সমালোচনা করেছে। সে পিতৃহত্যার প্রতিশোধ গ্রহণে যেমন দৃঢ়সংকল্প তেমনি মাতৃ-অপরাধের প্রতিকারেও প্রবৃত্ত হয়েছে। প্রতিহিংসাপরায়ণা লয়লা প্রথমে সর্বনাশী শক্তির সঙ্গে হাত মিলিয়েছে। কিন্তু শাহজাদা খসরুর মৃত্যুর পর সে আহত ও অনুতপ্ত চিত্তে সেই অপশক্তির নিকট থেকে সরে দাঁড়িয়েছে। এখান থেকেই শের খাঁর তেজস্বিনী কন্যা প্রতিহিংসার পথ পরিহার করে হে-মমতা-করুণায় গড়া সাধারণ নারীতে রূপান্তরিত হয়েছে। লয়লা চরিত্রের অসঙ্গতিও এখানেই। তার এই হঠাৎ রূপাত্তরের নিগূঢ় কোনো ইঙ্গিত নাটকে স্পষ্ট হয় নি। তথাপি তার এই সেবাপরায়ণা কল্যাণী সত্তার সাথে নুরজাহানের শয়তানী সত্তার তীব্র লড়াই চলেছে। কিন্তু ক্ষমতাহীন হয়ে যখন নুরজাহানের শয়তানী সত্তা বিলুপ্ত হয়ে গেছে, তখন থেকেই নুরজাহানের সঙ্গে তার সকল বিরোধ দূরীভূত হয়েছে। অপার হে ও মমতা নিয়ে লয়লা নিঃস্ব ও অভাগী মায়ের দুঃখক্ষত শুভ্র অশ্রুপাতে মুছিয়ে দিতে সচেষ্ট হয়েছে। ঐশ্বর্য ও ক্ষমতার বাইরে লয়লার মমতাময়ী কল্যাণী মূর্তি উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।


মহাবৎ খাঁ চরিত্রটি দ্বিজেন্দ্রলালের অনন্য সাধারণ সৃষ্টি। মহত্ত্ব, উদারতা, ক্ষমতা ও সহিষ্ণুতার সুসমন্বয়ে চরিত্রটি অতুলনীয় মহিমা লাভ করেছে। নুরজাহানের স্বেচ্ছাচারিতার পথে উপযুক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী এই মহাবৎ থা। নুরজাহান জাহাঙ্গীরকে ভালবাসেন না। তিনি সম্রাটকে দৈহিক সৌন্দর্যসুধা পান করিয়ে এবং রূপের যাদুতে মুগ্ধ করে রাজক্ষমতা কুক্ষিগত করে স্বেচ্ছাচারিণী হয়ে উঠেছেন। আর সম্রাটের সকল দুর্বলতা ব্যথাহত মন নিয়ে দেখেও মহাবৎ খাঁ তাকে প্রাণ দিয়ে ভালবাসেন। মোগল সেনাপতি হিসেবে তিনি মহামতি আকবরের বংশের মান অম্লান রাখতে সদাসচেষ্ট।

সম্রাটের প্রতি ভালবাসা থেকেই উৎসারিত হয়েছে তার বিদ্রোহ। তাই সমস্ত ক্ষমতা মুঠোর মধ্যে পেয়েও তিনি তা উপযুক্ত ব্যক্তির হাতে সমর্পণ করে পথের ফকির হয়েছেন। নুরজাহানের ক্ষমতাদৃপ্ত সম্রাজী-গরিমা এই মোগল সেনাপতির মহত্ত্বের কাছে মুহূর্তে ম্লান হয়ে গেছে। নাট্য সমালোচক বৈদ্যনাথ শীল তাঁর তাই মন্তব্য করেছেন: 'নাটকের নারকীয় ঘটনার সমস্ত ভুচ্ছতা ও কদর্যতার ঊর্ধ্বে অমল ধবল গৌরীশৃঙ্গের মতো মাথা উঁচু করিয়া দাঁড়ান এই মহাবৎ যা সমগ্র বাংলা ঐতিহাসিক নাটকে এই চরিত্রটির তুলনা হয় না।'


'নুরজাহান' নাটকের চরিত্রসৃষ্টিতে নাট্যকার যথেষ্ট কৃতিত্ব দেখালেও তাঁর সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব ঘটনাসংস্থানে ও কাহিনী সংগঠনে। তাঁর এই দক্ষতার কারণেই নাটকটির গঠনরীতি অতি সুসম্পূর্ণ। নুরজাহান চরিত্রকে কেন্দ্র করেই নাটকের সমগ্র কাহিনী ও পার্শ্বচরিত্রগুলো আবর্তিত হয়েছে। এ নাটকের প্রত্যেক পরবর্তী ঘটনা পূর্ববর্তী ঘটনার সংঘাতে ও পরিপূরণের প্রয়োজনে গড়ে উঠেছে। প্রত্যেক পরবর্তী ঘটনা প্রত্যেক পূর্ববর্তী ঘটনার স্পন্দিত গতিবেগের আকুতি বহন করে পূর্ণতা লাভের দিকে এগিয়ে চলেছে। ফলে ঘটনার অনিবার্যতা ও তার দ্রুতসঞ্চারী পরিণামমুখী গতি কাহিনীর মধ্যে অনন্যসাধারণ নাটকীয়তা সৃষ্টিতে সক্ষম হয়েছে। তাই 'নুরজাহান' নাটকটি আদি থেকে অন্ত পর্যন্ত নিবিড় রসানুভূতি সৃষ্টি ও স্থান-কাল পাত্রের যথাযথ ঐক্য বজায় রেখে বাংলা সাহিত্যের অন্যতম সার্থক নাটকের মর্যাদায় অভিষিক্ত হওয়ার স্পর্ধা অর্জন করেছে।


দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের অন্যান্য নাটকের মতো 'নুরজাহান R^ prime -9R মঞ্চসাফল্য ও জনপ্রিয়তার প্রধান কারণ এর অপরূপ অনবদ্য ভাষা। দ্বিজেন্দ্রলালের ভাষা কবিত্বপূর্ণ ও নাটকীয়তায় পরিপূর্ণ। তাঁর পূর্বসূরি নাট্যকারগণের ভাষা এতোটা শক্তিশালী নয় । বাংলা গদ্য-সংলাপের ভাষা যে হৃদয়বৃত্তির আলোড়নে উচ্ছ্বসিত কবিতা হয়ে প্রকাশ পেতে পারে, দ্বিজেন্দ্রলালের পূর্বে আর কোনো নাট্যকার তা দেখাতে সক্ষম হন নি। 'নুরজাহান' নাটকে তাঁর কবিত্বময় ও গতিশীল ভাষার উদাহরণ উদ্ধৃত করা যায়:


যেদিন তুমি আমার উদ্ভাত্ত দৃষ্টিপথে উদয় হয়েছিলে- হে সুন্দরী! যখন আমার উন্মুখ বাসনার মাঝখান দিয়ে তোমার রূপের শকট চালিয়ে দিলে; যখন জীবনের ধ্যান, শরীরী হয়ে আমার জাগ্রত স্বপ্নে এসে দেখা দিলে; আমি আপনার মধ্যে আপনাকে ধরে রাখতে পার্লাম না! আমি মানুষ!- দুৰ্ব্বল মানুষ মাত্র!- আর সে আমার প্রথম যৌবন, মেহের! প্রথম যৌবন! যখন আকাশ বড়ই নীল, পৃথিবী 1 বড়ই শ্যামল; যখন নক্ষত্রগুলি বাসনার স্ফুলিঙ্গ, গোলাপফুলগুলি হৃদয়ের রক্ত; যখন কোকিলের গান একটা স্মৃতি, মলয় সমীরণ একটা স্বপ্ন; যখন প্রণয়ীর দর্শন ঊষার উদয়, চুম্বন সজল বিদ্যুৎ, আলিঙ্গন আত্মার প্রলয়!- সেই যৌবনে আমি তোমার রূপের সুরা পান করেছিলাম!- জানতাম না যে বিষপান কলাম (প্রথম অঙ্ক: অষ্টম দৃশ্য)

নাটকের ভাষা যে প্রাণহীন কথার সমষ্টি নয় এবং ভাষার মাধ্যমেই যে চরিত্রবিশ্লেষণ ও ঘটনাশরীরে গতির সঞ্চার করতে হয়, এ-কথা দ্বিজেন্দ্রলাল সম্যকভাবেই উপলব্ধি করেছিলেন। তাই তাঁর ভাষায় সবসময় একটা গতির আবেগ এবং কবিত্বময় ভাবোচ্ছ্বাস লক্ষ করা যায়। তাঁর সৃষ্ট সংলাপের প্রতিটি কথা এক-একটি তীক্ষ্ণফলা ডুবির মতো দর্শকহৃদয়ে নিমেষেই বিদ্ধ হয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করে। দ্বিজেন্দ্রলাল নিজেই বলেছেন: 'কবিতায় আমার আসক্তি থাকায় আমি গদ্যের ভাষাকে কবিতার আসনে বসাইবার প্রলোভন পরিত্যাগ করিতে পারি নাই। (আমার নাট্যজীবনের আরম্ভ: নাট্যমন্দির) গদ্যে নাটক রচনা করলেও তিনি গদ্যের ভাষাকে কাব্যিক সুষমা দান করেছেন। সে কারণেই তাঁর ভাষা শব্দ-পারিপাট্য, ছন্দমাধুর্য ও অলঙ্কার সৌন্দর্যে অনবদ্য হয়ে উঠেছে। বিরোধাভাস, উৎপ্রেক্ষা, সমাসোক্তি প্রভৃতি অলঙ্কারের অন্তর্নিহিত বিরোধ ও আকস্মিকতা তাঁর ভাষাকে উপভোগ্য করেছে। দ্বিজেন্দ্রলালের ভাষার অশেষ গুণের পাশাপাশি কিছু দুর্বলতাও পরিলক্ষিত হয়। তাঁর ভাষা বৈচিত্র্যহীন। স্ত্রী-পুরুষ, উচ্চ-নীচ, রাজা-প্রজা, হিন্দু-মুসলমান সকলের মুখে তিনি একই রকম সালঙ্কারা ও ওজস্বী ভাষা ব্যবহার করেছেন। সে জন্যে তাঁর ভাষা কোনো কোনো ক্ষেত্রে স্বাভাবিকতা হারিয়েছে। তবু এ কথা স্বীকার করতেই হবে  , একমাত্র রবীন্দ্রনাথ ব্যতীত সে যুগের আর কোনো নাট্যকারই ভাষাসৃষ্টিতে তাঁর সমকক্ষতা অর্জনে সক্ষম হন নি।

***তথ্যসংগ্রহ***

(দ্বিজেন্দ্রলালের নুরজাহান-সম্পাদনা ও ভূমিকা- মুহম্মদ হায়দার) 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ