Hot Posts

6/recent/ticker-posts

সারদামঙ্গল কাব্য ও বিহারিলাল এর কাব্য ভাবনা

 


(সারদামঙ্গল কাব্য ও বিহারিলাল এর কাব্য ভাবনা

মধ্যযুগের কবিতার বৈশিষ্ট্য বিহারিলাল সারদামঙ্গল কাব্যের বৈশিষ্ট্য মঙ্গলকাব্য মঙ্গলকাব্য ও বিশ্বসাহিত্য)) 

**বিঃদ্র-বাংলা বিভাগের সকল পড়াশোনা পেতে ব্লগটিতে যুক্তথাকুন https://monoweredu13.blogspot.com/?m=1 

**কবি-জীবনী

টেনিসনের জীবন-চরিত প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ মন্তব্য করিয়াছেন যে, কর্মবীরতাঁহার জীবনকে গড়িয়া তোলেন কিন্তু কবির ক্ষেত্রে তাঁহার কাব্যই হইল সার্থকজীবনের পরিচায়ক। 'জীবন-চরিত মহাপুরুষের এবং কাব্যমহা কবির'। কবিরকাব্যাশ্রুতি জীবন-চরিত্র রচনা করা যায়; কিন্তু তাহা বাস্তব জীবনের পক্ষে অমূলকহইলেও কবি-জীবনের পক্ষে উপযোগী হইবে। কল্পনার সাহায্যে ইহাকে সত্যকরিয়া তোলা যায়। শেক্সপীয়রের নাটক ও সনেট হইতে তাঁহার কবি-জীবন সৃষ্টিকরা হইয়াছে। ইহা তাঁহার কবি-মানসের পরিচয় দান করে। বাল্মীকি ওকালিদাসের কাব্যসমূহ তাঁহাদের কাব্যগত জীবন চরিতরচনায় সাহায্য করে।তথাপি বাস্তব জীবনের পরিচয় কবির কাব্য সৃষ্টির মর্ম উপলব্ধিতে সাহায্য করিয়াথাকে। কীটসের চিঠিপত্র পাঠ করিয়া তাঁহার মানসলোক ও সমসাময়িক কাব্যসম্পর্কে তাঁহার অভিমতের পরিচয় পাওয়া যায়। এই চিঠিপত্র সম্পর্কে অবহিতহইতে না পারিলে কবির সম্পর্কে আমাদের বহু ভ্রান্ত ধারণা থাকিয়া যাইত।জীবনকে কত গভীরভাবে, কী নিষ্ঠার সহিত তিনি গ্রহণ করিয়াছিলেন,সৌন্দর্যবোধ সম্পর্কে তাঁহার কি বিশ্বাস ছিল, জীবন সম্পর্কে কবির দৃষ্টিভঙ্গিকিরূপ হওয়া বিধেয়, শেক্সপীরীয় নাটক কি দৃষ্টিতে গ্রহণ করা কর্তব্য এইগুলিসম্বন্ধে তাঁহার চিঠিপত্র পাঠে জানা যায়। বাস্তব জীবনাশ্রিত চরিত পাঠে আমরা জানিতে পারি কবি কোন অবস্থায় ও পরিবেশে, কী জাতীয় মানসিক প্রক্রিয়া ওপ্রভাবের ফলে তাঁহার কাব্য রচনা করিয়াছেন। এই জন্য বঙ্কিমচন্দ্রের মন্তব্য স্মরণযোগ্য যে, কবিত্ব অপেক্ষা কবিকে বুঝিতে পারিলে আরও গুরুতর লাভআছে। কবির পরিচয় লাভ না করিতে পারিলে কাব্যের রসাস্বাদন পূর্ণভাবে করা যায় না। কাব্যগত জীবন চরিত কবি-মানসের পরিচয় একটি বিকশিত পুষ্পেরন্যায় আমাদের নিকটে উদঘাটিত করে। শেক্সপীয়রের নাটক পাঠে আমরা যেভাবেকবি-জীবনীর কল্পনা গ্রহণ করি তাহা হইল যে, তিনি প্রথম যুগের শিক্ষানবিশীকাল অতিক্রম করিয়া পর্যায়ক্রমে ঐতিহাসিক ও সরস কমেডি, ডার্ক কমেডি ওট্রাজেডি এবং রোমান্টিক কমেডিসমূহ রচনা করিয়াছিলেন। জীবনের ক্ষয়-ক্ষতি,আঘাত-সংঘাতের স্তর পার হইয়া তিনি মানসিক প্রশান্তিরক্ষেত্রে উত্তীর্ণ। 

যে, ডার্ক ট্রাজেডি ও ট্রাজেডি রচনাকালে বাস্তব জীবনে ক

অভিজ্ঞতার সম্মুখীন তিনি হইয়াছিলেন ও তাহা তাঁহার মনোলোকে কী প্রভাব বিস্ত করিয়াছিল। ইহা জানিতে পারিলে জীবনের আলোকে নাটককে ব্যাখ্যা করাসহজ হইত। সুতরাং কবিকে জানতে না পারিলে তাঁহার কাব্যের রসাস্বাদন ব্যাহতহয়। কবির বাস্তব জীবন হইতে যে তথ্যাদি পাওয়া যায় তাহাদের সহিত কাব্যেরচিরস্থায়ী যোগ না থাকিতে পারে, কিন্তু কাব্যসৃষ্টির পক্ষে তাহারা যে সহায়ক ইহাপাঠকের পক্ষে অভিজ্ঞতার বিষয়। যে কাব্য-সৃষ্টি অন্তরে অপরিমেয় শক্তির প্রকাশরবীন্দ্রনাথেরতাহা জীবননিরপেক্ষ নহে। টি এস এলিয়ট ভিন্নমত পোষণ করন। তাহার মতেকাব্য কবির ব্যক্তিত্বকে প্রকাশিত করে না, ইহাকে পরিহার করে।মতে বিষয় বিষয়ী কাব্যে একাত্মতা লাভ করে।বিহারীলালও 'সারদামঙ্গল' প্রসঙ্গে অনাথবন্ধু রায়কে একটি পত্রেলিখিয়াছিলেন : মৈত্রী ও প্রীতিবিরহ যথার্থ সরলভাবে বুঝাইতে হইলে আমারসমস্ত জীবনবৃত্তান্ত লেখা আবশ্যক করে'। এই জীবনবৃত্তান্ত লিখিত না হওয়ায়তাঁহার মৈত্রী ও প্রীতিবিরহ সম্পর্কে স্পষ্ট কোন কিছু জানা যায় না। তবে তাঁহার

‘বন্ধুবিয়োগ’ কাব্য ‘অবোধবন্ধু' পত্রিকায় অগ্রহায়ণ-মাঘ ১২৭৫ সালে প্রকাশিতহইয়াছিল। এই কাব্যে কবির চারিজন বন্ধু ও প্রথমা স্ত্রী অভয়া দেবীর পুণ্যস্মৃতিতিনি লিপিবদ্ধ করিয়াছেন। ১২৯৭ সালের ‘সাহিত্যে'নীহারিকা ‘সারদামঙ্গল’নামক প্রবন্ধে লিখিয়াছিলেন : ‘শুনিতে পাই সারদামঙ্গল দ্ব্যর্থব্যঞ্জক। কবিজনআরাধ্য দেবী সরস্বতী এবং কবির পরলোকগতা প্রেয়সী পত্নীকে লক্ষ্য করিয়া পুস্তকখানি বিরচিত হইয়াছি'। কবির এই মৈত্রী-পীতি প্রেমভক্তিমূলক পারমার্থিকসন্দর্য-চেতনায় সম্প্রসারিত হইয়াছে। আবার তাঁহার এই ভক্তিভাব অতি সহজেবিনা চেষ্টায় পারিবারিক বিগ্রহের পূজাকে কেন্দ্র করিয়া উৎসারিত হইতেপারিয়াছে। কবির এই ভক্তি প্রেমলীলার অঙ্গীভূত'।১৮৩৫ খ্রীষ্টাব্দের ২২শে মে (৮ই জ্যৈষ্ঠ, ১২৪২) কলিকাতার জোড়াবাগানঅঞ্চলে কবির জন্ম হয়। বর্তমানে সেই গলিটি তাঁহার নামানুসারে পরিচিতহইয়াছে। তাঁহাদের কৌলিক উপাধি চট্টোপাধ্যায়। কিন্তু কবির প্রপিতামহহালিসহরের জনৈক সুবর্ণ বণিকের দান গ্রহণ করায় ব্রাত্য বা পতিত হন।

স্বভাবতঃ তাঁহাদের বৃত্তি হইল পৌরোহিত্য। কবির পিতৃব্য পণ্ডিতরূপে খ্যাত য়াছিলেন। তিনি ছিলেন বিদ্যাসাগরের সহাধ্যায়ী ওরেভারেণ্ড কৃষ্ণমোহনবন্দ্যোপাধ্যায়ের শিক্ষক। কিন্তু পাতিত্য দোষ-হেতু সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষেরপদ তিনি পান নাই। কবির পিতা দীননাথ চক্রবর্তী যাজ্যক্রয়া করিতেন। তাঁহারদুই পুত্রের অকালমৃত্যুর পরে বিহারীলাল জন্মগ্রহণ করেন। তাঁহার চারি বৎসরবয়সে মৃত্যুবিয়োগ হওয়ায় তিনি পিতার স্নেহাধিক্য লাভ করেন। ইহার ফলেতাঁহার লেখাপড়া বিদ্যালয় অধিক দূর অগ্রসর হইতেপারে নাই। বিহারীলালমাতৃস্মৃতি 'সাধের আসন' কাব্যের 'নিশীথে' নামক অধ্যায় ইহা লিপিবদ্ধকরিয়াছেন।

নবকৃষ্ণ ঘোষের বিবরণী (প্রায়স ফেব্রুয়ারি, ১৯০০)— হইতে জানা যায় যে,বিহারীলাল দশত হইতে পঞ্চদশ বৎসর পর্যন্ত জেনারেল এসেমব্লিজ ইনষ্টিট্যুশনেবর্তমানে স্কটিশ চার্চ কলেজ) যাতায়াত করিয়াছিলেন ও আনুমানিক তিন বৎসরসংস্কৃত কলেজে অধ্যায়ন করিয়াছিলেন।বিহারীলালের বিদ্যালয়ে শিক্ষা এই পর্যন্ত। কিন্তু বিদ্যালয়ের বাহিরে কিছুকিছু শিক্ষা হইতেছিল। মাতৃভাষা আলোচনার কথা পূর্বেই উল্লেখ করিয়াছি। তাহা

অধিকতর আগ্রহের সহিত এবং অবাধে চলিতেছিল। আর একটি শিক্ষাও সঙ্গে সঙ্গ আরম্ভ হইয়াছিল, যদিও সেটিতে বিহারীলালের অন্যান্য উচ্ছ, জ্বলতারঅন্যতম বলিয়া সে সময়ে জনসাধারণের নিকট পরিগণিত হইয়াছিল। এটি ভাবীকবির গান শিক্ষা; অবশ্য ও শিক্ষাটিও কোনরূপ নিয়মাধীন ছিল না। বিহারীলালবাল্যকাল হইতেই সঙ্গীতপ্রিয় ছিলেন এবং যাত্রা পাঁচালী বা কবির গানের কথাশুনিলেই তিনি ঘটনাস্থলে উপস্থিত হইয়া তাঁহার সঙ্গীত-শ্রবণ-সাধ পরিতৃপ্তহইতেন।...ভাবী কবি কেবল গীত শ্রবণ করিয়াই সন্তুষ্ট থাকিতেন না, বাটীতেআসিয়া সেগুলিকে সুরলয়ে পুনরাবৃত্তি করিবার চেষ্টা করিতেন এবং গীতের কোন অংশ বিস্তৃত হইলে তাহা নিজেই পূরণ করিয়া লইতেন। এইরূপ পর-রচিতগীতের অংশ পূরণ করিতে করিতে তিনি আপনি গীত রচনা করিতে আরম্ভ করেন।ইহার বিহারীলালের কবিতা চরনার প্রথম উদ্যম।রবীন্দ্রনাথও ‘জীবনস্মৃতিতে' 'সাহিত্যের সঙ্গী' নামক অধ্যায়ে বিহারীলালেরএকটি চিত্র অঙ্কিত করিয়াছেন। রবীন্দ্রনাথের বউঠাকুরাণীকাদম্বরী দেবীবিহারীলালের কাব্যের অনুরাগিণী ছিলেন। 'আর্যদর্শনে', 'সারদামঙ্গল' তখন বাহিরহইতে সুরু করিয়াছেন। ইহার অনেক অংশ তাঁহার কণ্ঠস্থ ছিল। রবীন্দ্রনাথতাহার দেহও যেমন বিপুল তাঁহার হৃদয়ও তেমনি প্রশস্ত। তাহার মনেরচারিদিক ঘেরিয়া কবিত্বের একটি রশ্মিমণ্ডল তাঁহার সঙ্গেসঙ্গেই ফিরিত—তাঁহারযেন কিবাতময় একটি সূক্ষ্ম শরীর ছিল-তাহই তাঁহারযথার্থ স্বরূপ। তাঁহার মধ্যে পরিপূর্ণ একটি কবির আনন্দ ছিল।ভাবে নিমগ্ন হইয়া তিনি কবিতা শুনাইতেন, গানও গাহিতেন।গল’য় যে তাঁহার খুব বেশি সুর ছিল তাহা নহে, একেবারে বেসুরাও তিনি ছিলেন না-যে সুরটা গাহিতেছেন তাহার একটা আন্দাজ পাওয়া যাইত। গম্ভীরগদগদ কণ্ঠে চোখ বুজিয়া গান গাহিতেন, সুরে যাহা পৌছিত না ভাবে তাহা ভরিয়াতুলিতেন। কালিদাস ও বাল্মীকির কবিত্বে তিনি মুগ্ধ ছিলেন।বিহারীলালের বাল্যবন্ধু কৃষ্ণকমল ভট্টচার্য তাঁহার 'স্মৃতিকথায়'বিহারীলালের লেখাপড়া সম্বন্ধে বলিতে হয় যে, দিনকতক সে সংস্কৃতকলেজে ভর্তি হইয়া মুগ্ধবোধ পড়িতে গিয়াছিল। কিন্তু স্কুল-কলেজের বাঁধাবাঁধিনিয়মের বশবর্তী হইয়া থাকা তাহার স্বাভাবের সহিত মিলিল না। তাহার individuality এতই তীব্র ছিল। অল্পকাল মধ্যেই সংস্কৃতকলেজ ত্যাগ করিয়া সেবাড়ীতে পণ্ডিতের নিকট মুগ্ধবোধ কিছুদিন পড়িয়াছিল;সাঙ্গ করা হইয়াছিল কি নাবলিতে পারি না। তাহার বাড়ীর শিক্ষকও বড় ‘কেওকেটা’ ছিলেন না। তিনিআমাদের লব্ধপ্রতিষ্ঠ ভাইস-চেয়ারম্যান নীলাম্বর বসুরপিতা। তিনি ঐ পাড়ায়অনেক বালককে-মুগ্ধবোধ পড়াইয়াছিলেন। মুগ্ধবোধ সাঙ্গ হইকে আর নাই হউক,বিহারীর সংস্কৃতি ব্যাকরণে এতটুকু অধিকার জন্মিয়াছিল যে, তিনি সাহিত্য-শাস্ত্রঅধ্যায়ন করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন। সাহিত্য-শাস্ত্রের কয়েকখানি গ্রন্থ যথা,রঘুবংশ, কুমারসম্ভব, আর বোধহয় ভারবি, মুদ্রারাক্ষস, উত্তর চরিত এবং শকুন্তলাআমি তাঁহাকে পড়াইয়াছিলাম। তিনি আমার কাছে সকালে বৈকালে পড়িতেআসিতেন। এই সময়ে Monier Williams শকুন্তলার এক অপূর্ব সংস্করণ বাহিরকরিয়াছিলেন : ....পিতা। ১৯ দিয়া পুত্রকে ' শুকুন্তলা' কিনিয়া দিয়াছিলেন।

আমিও বড়ই আনন্দের সহিত বিহারীর সঙ্গে সেই শকুন্তলা একত্রে পড়িলাম।বোধহয় বিহারীর তখন ইংরাজী ব্যাখ্যা বুঝিবার ক্ষমতা হয় নাই কিন্তু পরেহইয়াছিল। ইংরেজীও তিনি কতকদূর আমার কাছেই পড়িয়াছিলেন। আমার মনেআছে রায়রণের Childe Harold এবং শেক্সপীয়রের ওথেলো, ম্যাকবেথ, লীয়র প্রভৃতি দু'পাচখানি নাটক একত্রে পাঠ করা হইয়াছিল বিহারী ধীশক্তি এতই তীক্ষ্ণছিল, বিশেষতঃ কাব্যশাস্ত্র পর্যালোচনাতে এরূপ একটি স্বাভাবিক প্রবণতা চিল যে,অতি সামান্য সাহায্যেই তিনি ভালরূপ ভাবগ্রহ করিতে পারিতেন। ইহার আরওএক কারণ ছিল ; বাংলা সাহিত্যট তিনি অতি উত্তমরূপ আয়ত্ত করিয়াছিলেন।রামায়ণ, মহাভারত ঈশ্বরগুপ্ত, দাশু রায় ইত্যাদি তৎকালপ্রচলিত অনেক বাংলাগ্রন্থ তাঁহার ভালরূপ পড়া ছিল।বিহারীলালের এই যে বিস্তৃত অধ্যয়ন ইহা তাঁহার কবি-মানস গঠনের পক্ষেঅনুকূল হইয়াছিল। কবির কাব্য দেশী ও বিদেশী কবিগণের প্রভাব পড়িয়াছে।আবার তিনি তাঁহার 'নিসর্গ সন্দর্শন' ও 'প্রেম প্রবাহিনী' কাব্যে নানা কবির উদ্বৃতিগ্রহণ করিয়া প্রমাণিত করিয়াছেন যে, তাঁহার কবি-মানসেনানা কবি ঢালে গাননানা-দিক হতে’ বিহারীলাল অল্প বয়সে কবিতা লিখিতে আরম্ভ করেন। কৃষ্ণকমলবলিয়াছেন যে, প্রথম হইতে তাঁহার রচনার একটি ধর্তা তিনি লক্ষ্য করেন।নৃতনত্বের জন্য কৃষ্ণকমলের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা কবিকেউৎসাহিত দিতেন। সেই নৃতনত্বেরব্যাখ্যা প্রসঙ্গে তিনি লিখিয়াছেন :লবোধহয় ইংরাজীতে পোপ ও তাঁহার অনুগামী কবিদিগের পর ক্র্যাব,কাউপর, বায়রণ যে এক নবীনতা আনিয়াছিলেন, বিহারীর নবীনতা কতকটা সেপ্রকারের ছিল। ভাবব্যঞ্জক কোনও প্রচলিত শব্দ প্রয়োগ করিতে তিনি কুণ্ঠিতহইতেন না; এবং সেকেল ভাবসকল লইয়াই নাড়াচাড়া করিতেন। আচার্যকৃষ্ণকমল আরও মন্তব্য করিয়াছেন যে, ইংরেজিসাহিত্যেপোপের আবির্ভাবেরপরে কাব্যে একটা পেশাদারি বাব বদ্ধমূল হইয়া আসিতেছিল। রবীন্দ্রনাথলিখেছেন ‘সাহিত্যেও এক এক সময়ে দীর্ঘকাল আচারে পেয়ে বসে—রচনায় নিখুঁত রীতির ফোঁটার তিলক কেটে চললে লোকে বলে সাধু। ক্র্যাব ও কাউপারের আবির্ভাবে তাহা খণ্ডিত হইল। 'কবি বার্নাসের পরে ইংরেজি কাব্যে যে যুগ এলোসে যুগে রীতির বেড়া ভেঙে মানুষের মর্জি এসে উপস্থিত। কীটস, বায়রণ, শেলি,ওয়ার্ডওয়ার্থ এই পেশাদারি ভাবের খণ্ডন ব্যাপারে চূড়ান্ত করিয়াছেন। তাঁহারমতে বাঙ্গালা কাব্যে বিহারীর আবির্ভাব সেই জাতীয় পেশাদারি কবিতারলেশমাত্র তাঁহার প্রতিভাতে ছিল না।বিহারীলালের আকৃতি যেরূপ বিরাট ছিল, হৃদয়ও ছিল তদ্রূপ প্রশস্ত। তিনিদীর্ঘাকৃতি, সবলকায়, তেজীয়ান ও অকুতোভয় ছিলেন। সাংসারিক অভিজ্ঞতা ওলোকজতা তাঁহার অধিক ছিল। তিনি বাল্যকালে একটু দাঙ্গাবাজ তাঁহার স্বভাব-চতি অত্যন্ত নির্মল ছিল। কৃষ্ণকমল লিখিয়াছেন:বিহারীলালের) নিতান্ত শৈশব কিম্বা প্রথম উঠতি বয়সে যৎসামান্য কিঞ্চিৎচরিত্রস্থলন হইয়াছিল কিনা বলিতে পারি না, কিন্তু আমিযতদিন দেখিয়াছি, এরূপসজিব, – মহাশয়, নির্মলস্বভাব ব্যক্তি আমি দেখি নাই। তজ্জন্য আমি যে তাঁহাকেকতদূর শ্রদ্ধা ও ভক্তি করিতাম তাহা বাকপণাতীত। আমরা নিজের চেয়ে এবিষয়ে তাঁহাকে যে কতদূর শ্রেষ্ঠ বিবেচনা করিতাম তাহা বলিয়া কি জানাইব।তিনি আমাকে যথেষ্ট স্নেহ করিতেন, ইহা আমি অত্যন্ত শ্লাঘার বিষয় ভাবিতাম।দেখিতে বিহারী প্রথমে যে প্রকার বলিয়াছি, যাবজ্জীবন সেই রকমই ছিলেন,দীর্ঘাকৃতি সবলকায়, খাড়াদেহ ও হৃষ্টপুষ্ট।প্রথম বিবাহের (১৮৫৪) চারি বত্সর পরে প্রথমা পত্নী অভয়া দেবী মৃত সন্তান প্রসব করিয়া পরলোক গমন করেন। 'বন্ধুবিয়োগ' কাব্যে কবি সন্তপ্ত হৃদয়লইয়া তাঁহাকে স্মরণ করিয়াছেন।

""কই! কই! কোথা গেল দেখিতে দেখিতে,

সৌদামিনী লুকাইল খেলিতে খেলিয়ে!

দৃষ্টিপথে আবির্ভূত দ্বিগুণ আঁধার,

শ্রবণে বজ্রের ধ্বনি বাজে অনিবার।

হাহারে হৃদয়ধন সরলা আমার,

কোথা গেলে ত্রিভুবন করি অন্ধকার।""

১৮৬০ খ্রীষ্টাব্দে বউবাজারের নবীনচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের দ্বিতীয়া কন্যা কাদম্বরী দেবীকে তিনি বিবাহ করেন। তিনি পতির বিশেষ অনুরাগিনী হন। ‘বঙ্গসুন্দরী'কাব্যের 'প্রিয়তমা' নামক সর্গে কবি তাঁহার কথা গভীর অনুরাগের সহিত স্মরণকরিয়াছেন। তাঁহাকে ভালবাসিয়া কবি স্বর্গীয় সৌরভের পরিচয় পাইয়াছেন।

লৌকিক প্রেম পারমার্থিক ভাবে পরিণত হইয়াছে। কবি অনাথবন্ধু রায়কে লিখিয়াছেন নরনারীদের ভালবাসা প্রথমে প্রস্ফুটিত হয়। তাহার স্বর্গীয় সৌরভ চিরদিন জীবনকে পরমানন্দময় করিয়া রাখে। ক্রমে ক্রমে সমস্ত বিশ্ব আপনার হইয়াযায়। এই অমায়িক আত্মভাব দেবদুর্লভ। ইহার নাম পরমার্থ, স্বার্থ নহে। পত্নীরপ্রতি অনুরাগ হেতু কবি লিখিয়াছেন :চরাচর যেন সকলি আমার, নারী নরগণ ভগিনী ভাই, আননে আনন্দ উত্থলে সবার, গলে যায় প্রাণ যে দিকে চাই।তাঁর মতে এ মর্ত্য ভুবন কমল কাননে নারী সরস্বতী বিরাজ করে'। স্বভাবতঃ এই মানবপ্রীতি সম্প্রসারিত হইয়া 'সারদামঙ্গলে' সরস্বতী প্রীতিতে পরিণত হইয়াছে।বিরাহীলাল শেষ জীবনে বহুমূত্র রোগে আক্রান্ত হন। ২৪শে মে, ১৮৯৪ খ্ৰীষ্টাব্দে। (১১ই জ্যৈষ্ঠ, ১৩০১) বঙ্গ ভারতীয় এই একনিষ্ঠ সাধকের জীবনদীপ নির্বাপিত হয়। তাঁহার কিব-শিষ্য অক্ষয়কুমার বড়াল তাঁহাকে তাঁহার ‘কনকাঞ্জলি' উৎসর্গ করিয়া লিখিয়াছিলেন:

""নহে কোনে ধনী, নহে কোন বীর,নহে কোন কর্মী—গর্বোন্নত-শির, কোন মহরাজ নহে পৃথিবীরনাহি প্রতিমূর্তি ছবি; তবু কাঁদ কাঁদ, ""

–জনম ভূমিরসে এক দরিদ্র কবি ।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ