রস কি!ঃঃ--
"কাব্যং রসাত্মং বাক্যং" অর্থাৎ রস যুক্ত বাক্যই কাব্য। সরল ভাষায় রস হলো,কোনো কিছুর রস।সাধারণ ভাবে আমরা টক,ঝাল মিষ্টি কিংবা কটু রস বলি।ঠিক তেমনি সাহিত্য কতটা মাধুর্যপুর্ণ তা রসের মাধ্যমে বিচার ও বিশ্লেষণ করা হয়।কোন সাহিত্য কিংবা শিল্প কোন বিষয় কে নিয়ে বলেছেন তা মুলত রস দ্বারাই বিচার করা হয়। একজন সাহিত্যক তার চিন্তা ও মনন থেকে সাহিত্য রচনা করেন আর পাঠক তা উপলব্ধি করার প্রয়াসে অবশ্যই রস কে অবলম্বন হিসেবে নিবেন।
রস শব্দের অর্থ আস্বাদন করা।সাহিত্য বা শিল্পকে আস্বাদন করা।একজন প্রকৃত লেখক যেমন সঠিক রসকে নির্দেশ এর মাধ্যমে সাহিত্য রচনা করবেন,একজন পাঠক ও সেই নির্দেশিত রস কে চিন্তিত করে সাহিত্যকে আস্বাদন করবেন।আর এতেই সাহিত্যের প্রকৃত সার্থকতা।
রসের শ্রেণীকরণ ও উদাহরণ---
ভরতমুনির 'নাট্যশাস্ত্রে উল্লেখিত রসের সংখ্যা আট, পরবর্তীকালে অভিনবগুপ্ত 'শান্ত'রসকে সংযুক্ত করে, রসের সংখ্যা দাঁড় করালেন নয়টি। সেই থেকে আজ পর্যন্ত প্রাচ্যকাব্যতত্ত্বে নবরসের প্রতিষ্ঠা প্রায় তর্কাতীত প্রাধান্য লাভ করেছে। অলঙ্কারশাস্ত্রী রুদ্রটঅবশ্য এই নয়টি রসের সঙ্গে 'প্রেয়ান' (এটি বৈষ্ণবমতে 'সখ্য' রসের সগোত্র) নামেআরেকটি রস সংযুক্ত করে এর সংখ্যা দশ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু রুদ্রট প্রস্তাবিত এদশম রসটি পরবর্তীকালের রসতত্ত্বে তেমন ব্যাপক প্রভাব বিস্তারে সমর্থ হয় নি এবংঅধিকাংশ অলঙ্কারশাস্ত্রীর স্বীকৃতি লাভও করে নি। ফলে আচার্য ভরত থেকে আজ পর্যন্ত
নয়টি স্থায়ী ভাব এবং এদের আনুষঙ্গিক নয়টি বসের বিবরণ দিয়ে আমরা এ অধ্যায়েউদাহরণ সহযোগে আলোচনায় ব্রতী হবো।যে নয়টি স্থায়ী ভাব পণ্ডিত-মহলে তর্কাতীত স্বীকৃতি লাভ করেছে এবং কারোব্যবহৃত এ ভাব-সমূহ যে রস পরিণামে ধন্য, সর্বাগ্রে তা উল্লেখ করা প্রয়োজন।রতি স্থায়ী ভার থেকে শৃঙ্গার বা আদিরস, উৎসাহ থেকে বীররস, ক্রোধ থেকেরৌদ্ররস, হাস থেকে হাস্যরস, শোক ভাব থেকে করুণরস, ভয় থেকে ভয়ানক, জুগুপাথেকে বীভৎস, বিস্ময় থেকে অদ্ভুত এবং শম স্থায়ী ভাব হতে শান্তরস! অর্থাৎ নয়টিস্থায়ীভাব নাট্য বা কাব্যে বিভাব, অনুভাব ও ব্যভিচারী ভাবের সংযোগে নয়টি রসে সার্থকপরিণতি লাভ করে। আমরা এবারে প্রাগুক্ত রসের স্বরূপ উপলব্ধির জন্যে দু'চারটি
দৃষ্টান্তের সাহায্যে সংক্ষিপ্তভাবে আলোচনা করতে আগ্রহী।
১। শৃঙ্গার বা আদিরসঃ।সাহিত্যদর্পণকার বিশ্বনাথ কবিরাজের মতে, "রতিমনোনুকূধেঁ মনসঃ প্রবণায়িতম" -
অর্থাৎ প্রিয়বস্তুর প্রতি মানবমনের সহজ অনুরাগই 'রতি'। অবশ্য প্রচলিত অলঙ্কারশাস্ত্রে 'রতি' শব্দটি এতো ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত নয়। এখানে নর-নারী বা নায়ক-নায়িকার মধ্যেঅনুরাগের সম্পর্কই কেবল রতি হিসেবে আখ্যায়িত হয়ে থাকে। এবং এ ক্ষেত্রে নাট্যঅথবা কাব্যে নায়ক নায়িকাই এর আলম্বন বিভাব।সে-যাহোক, 'রতি' স্থায়ীভাব থেকেই শৃঙ্গার বা আদিরসের উৎপত্তি।অলঙ্কারশাস্ত্রীদের অনুসারে এই শৃঙ্গার রস আবার দু'ভাগে বিভক্ত,
সুম্ভোগ শৃঙ্গার এবংবিপ্রলম্ব শৃঙ্গার রস।
নায়ক-নায়িকার মিলনকালীন রতিভাব থেকে সম্ভোগ শৃঙ্গার রসেরজন্ম, আর তাদের বিরহকালীন রতিভাব থেকে বিপ্রলব্ধ শৃঙ্গার রসের উৎপত্তি। আমরা এবিষয়ে ব্যাপক গভীর আলোচনায় না গিয়ে সাধারণভাবে শৃঙ্গার রসের কতিপয় উদাহরণউদ্ধৃত করে ভিন্ন রসের আলোচনায় প্রবৃত্ত হবো।
রবীন্দ্রনাথের ‘কল্পনা' কাব্যের 'স্বপ্ন' কবিতা থেকে শৃঙ্গার রসের একটি
উজ্জ্বল উদাহরণ সঙ্কলিত করা যাক; -
"""“হেনকালে হাতে দীপশিখা ধীরে ধীরে নামি এল মোর মালবিকা।
দেখা দিল দ্বারপ্রান্তে সোপানের 'পরে সন্ধ্যার লক্ষ্মীর মতো, সন্ধ্যাতারা করে।
অঙ্গের কুঙ্কুমগন্ধ কেশধূপবাস ফেলিল সর্বাঙ্গে মোর উতলা নিশ্বাস।
প্রকাশিল অর্থচ্যুত-বসন-অন্তরে চন্দনের পত্রলেখা বামপয়োধরে।
দাঁড়াইল প্রতিমার প্রায়নগর গুঞ্জন ক্ষান্ত নিস্তব্ধ সন্ধ্যায় """
- এখানে নায়িকা 'মালবিকা' আলম্বন বিভাব, 'নগরগুঞ্জনা ক্ষান্ত নিস্তব্ধ সন্ধ্যা' এবং নায়িকার সাজ সজ্জা (যথা- 'অঙ্গের কুঙ্কুমগন্ধ, কেশধূপবাস, চন্দনের পত্রলেখা বামপয়োধরে ইত্যাদি) উদ্দীপন বিভাব, এবং এর সঙ্গে সর্বাঙ্গে উতলা নিশ্বাসের অনুভাবে শৃঙ্গার অনুভাবে শৃঙ্গার রস গভীর ব্যঞ্জনায় দীপ্তিমান।এরপর ‘নিস্তব্ধ সন্ধ্যায় দণ্ডায়মান প্রতিমার প্রায়’ নায়িকার জড়তা কেটে গেছে।
“""নাহি জানি কখন কী হলে
সুকোমল হাতখানি লুকাইল আসি
আমার দক্ষিণকরে কুলায় প্রত্যাশী
সন্ধ্যার পাখির মতো। মুখখানি তার
নতবৃত্ত পুষ্প-সম এ বক্ষে আমার
নমিয়া পড়িল ধীরে। ব্যাকুল উদাস
নিঃশব্দে মিলিল আসি নিশ্বাসে নিশ্বাস"""
আর সে মুহূর্তে কালান্তরের নর-নারী অনাদি অনুরাগে জন্ম দেয় সার্থক শৃঙ্গারের বাআদিবসের। "
২) বীররস ঃ
উৎসাহ বীররসের স্থায়ীভাব। অলঙ্কার শাস্ত্র অনুসারে দয়া, ধর্ম, দানকিংবা মহত্তর কোনো সংগ্রামের হেতু মানুষের চিত্তে যে উৎসাহ জন্মে, সে ভাব থেকেইবীররসের উত্তর। বীররসের বিস্ময়কর বৈচিত্র্য-হেতু আলঙ্কারিকেরা এটাকে নানা ভাগেবিভক্ত করেছে। তবে এ বিভাজনের ক্ষেত্রে পণ্ডিত-মহলে বিতর্ক বর্তমান। মনীষী ভরত তাঁর নাট্যশাস্ত্রে তিন শ্রেণীর বীর-এর উল্লেখ করেছে, দানবীর, ধনবীর এবং যুদ্ধবীর ।"দশরূপক' গ্রন্থে অলঙ্কারশাস্ত্রী ধনঞ্জয় ভরতের সিদ্ধান্তকে শিরোধার্য করলেওসাহিত্যদর্পণকার বিশ্বনাথ কবিরাজ 'দয়াবীর' সংযুক্ত করে বীর-এর সংখ্যা চার বলেঘোষণা করেছেন। সপ্তদশ শতাব্দের পণ্ডিতরাজ জগন্নাথ তাঁর 'রসগঙ্গাধর' গ্রন্থে এ চারশ্রেণীর সঙ্গে সংযুক্ত করেছেন আরো চারটি শ্রেণী,
সত্যবীর, পাণ্ডিত্যবীর, ক্ষমারীর ওবলবীর,
এবং তিনি এতেই ক্ষান্ত হন নি, আলোচনা করে দেখিয়েছেন বীররস অতিবৈচিত্র্যময় এবং নানা প্রজাতিতে বিভক্ত। মহাভারতের 'অনুশাসন' পর্বে ভীষ্মের উক্তিতেওজগন্নাথের বক্তব্যের সমর্থন মেলে। আমরা এ অধ্যায়ে বীররসের ব্যাপক-গভীরসূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিশ্লেষণে না গিয়ে প্রচলিত অলঙ্কার শাস্ত্রের প্রধান প্রবণতাকে অনুসরণ করতেপ্রয়াসী। আমরা জানি যে কোন মানুষ স্থান, কাল, পাত্র ভেদে একই চিত্তবৃত্তির(স্থায়ীভাবের) প্রকাশে অল্প-বিস্তর স্বতন্ত্র হতে পারে। এবং আস্বাদনের মাত্রাগত ওশ্রেণীগত পার্থক্য হেতু এগুলোর নামান্তর সম্ভব। তবু এ যাবৎ কালের বহুল প্রচলিতঅলঙ্কারশাস্ত্রে এবং অভিধানে 'বীর' বলতে সাধারণত যুদ্ধবীরকেই বোঝানো হয়ে থাকে।সে যাহোক বীররসের উদাহরণ সঙ্কলনের আগে আরেকটি বিষয় স্পষ্ট করা প্রয়োজন।কারণ, সাধারণ পাঠক অনেক সময়ে মনে করেন, বীররসের সঙ্গে বোধ হয় রোদ্র রসের
সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। সত্য কিন্তু এর বিপরীত, কারণ ক্রোধ ও উৎসাহ ভাব কখনই।একই শ্রেণীভুক্ত হতে পারে না। মানুষ যখন রুষ্ট হয়, প্রতিশোধের ধ্বংসের প্রবণতায়প্রমত্ত হয়, ক্রোধান্ধ হয়ে তার বিচারশক্তি বিলুপ্ত হয়, তখনকার চিত্তবৃত্তির সঙ্গে সে যখনকোনো কর্মে, কল্যাণ-ধর্মে, বৃহত্তর ত্যাগে, মহান সংগ্রামে, বিবেচনাপ্রসূন কোনো ক্রিয়ায়।নিজেকে নিয়োজিত কিংবা উৎসর্গ করে, তার তখনকার চিত্তবৃত্তি নিশ্চয়ই একইপ্রজাতিভুক্ত নয় । অর্থাৎ ক্রোধে যেখানে মানুষের শক্তিহীন, অবিবেকী মৃঢ়তার রূঢ় প্রকাশ অনিবার্য হয়ে ওঠে, সেখানে, উৎসাহে তার সত্তার গভীরতর মহানচেতনার পরিপূর্ণ প্রকাশহয়ে ওঠে অবশ্যম্ভাবী। বিবেকী-বুদ্ধির প্রদীপ্ত প্রকাশে উৎসাহ তাই ক্রোধের বিপরীতঅভিধায় চিহ্নিত। এবারে কতিপয় উদাহরণের সাহায্যে বীররসের স্বরূপ বিশ্লেষণ করা
যাক,
>) “সাবাসি, ঘৃত। তোর কথা শুনি,
কোন বীর-হিয়া নাহি চাহে রে পশ্চিতে
সংগ্রামে? ডমরুধ্বনি শুনি কাল ফণী,
কভু কি অলসভাবে নিবাসে বিবরে!
ধন্য লঙ্কা, বীরপুত্রধারী!
(মেঘনাদবধ, ১ম সর্গ)
- এখানে দূতের মুখে বীরপুত্র বীরবাহুর মৃত্যু সংবাদ রাবণকে ব্যথিত করেছে সত্যি,
কিন্তু স্বদেশ ভূমির স্বাধীনতা রক্ষা হেতু প্রিয়-পুত্রেরবীরোচিত মৃত্যুতে এখানে শোকশক্তিতে রূপান্তরিত, এবং বিষাদকে নেপথ্যে রেখে উৎসাহভাব প্রবল হয়ে ওঠে যখন তারগৌরবময় আত্মত্যাগের বৃত্তান্ত বর্ণিত হয় ভগ্নদূত মকরাক্ষের মুখে। ফলে, ডমরুর ধ্বনিশুনে যেমন সৰ্পকুল চঞ্চল হয়ে ওঠে, তেমনি বীরের গৌরবময় মৃত্যু এখানে উৎসাহস্থায়ীভাবের আলম্বন বিভাব।
যেমনঃ-
""""স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে,
কে বাঁচিতে চায় ।
দাসত্বশৃঙ্খল আজি কে পরিবে পায় হে,
কে পরিবে পায় |"""
এখানে অন্যায়কারী শোষকের বিরুদ্ধে শোষিত মানুষের চিত্তে অন্যায় প্রতিরোধের উৎসাহ সঞ্চারে- এটি বীররসের উজ্জ্বল উদাহরণে পরিণত।
""বল বীর
বল উন্নত মম শির
শির নেহারি আমারি, নত-শির ওই শিখর হিমাদ্রির।
বল বীর
বল মহাবিশ্বের মহাকাশ ফাড়ি'
চন্দ্র সূর্য গ্রহ তারা ছাড়ি'
ভুলোক দ্যুলোক গোলক ভেদিয়া,
খোদার আসন 'আরশ' ছেদিয়া
উঠিয়াছি চির-বিস্ময় আমি বিশ্ব
বিধাত্রীর!
মম ললাটে রুদ্র ভগবান জ্বলে রাজ-রাজটীকা দীপ্ত
জয়শ্রীর।
বল বীর
আমি চির-উন্নত শির।"""
(অগ্নিবীণা ঃ বিদ্রোহী)
কাজী নজরুল ইসলামের এ কবিতাংশ বীররসের সার্থক দৃষ্টান্ত হিসেবে স্মর্তব্য এই জন্যে যে, এখানে কবি পরাধীন দেশের শৃঙ্খল মোচনে আত্ম-শক্তির উদ্বোধন কামনা করেছেনএকান্তভাবে। এবং কালান্তরেরও সহৃদয় পাঠক এ কবিতা পড়ে আত্ম-জাগরণে উৎসাহিতহয়ে ওঠে।
সুকান্ত ভট্টাচার্যের ‘ছাড়পত্র' কাব্যের 'বিবৃতি' কবিতা থেকে একটি উদাহরণ সংযুক্ত করে আমরা রৌদ্ররসের আলোচনায় ব্রতী হবো।
"""রক্তে আনো লাল,
রাত্রির গভীর বৃত্ত থেকে ছিঁড়ে আনা ফুটন্ত সকাল।
উদ্ধত প্রাণের বেগে উন্মুখর আমার এ দেশ,
আমার বিধ্বস্ত প্রাণে দৃঢ়তার এসেছে নির্দেশ।""
(৩) রৌদ্ররস ---
ক্রোধ স্থায়ীভাব থেকে রৌদ্ররসের উৎপত্তি। সাধারণত প্রতিপক্ষ শত্রুএর আলম্বন বিভাব হয়ে থাকে এবং তার চেষ্টাদি উদ্দীপন বলে কথিত হয়। অর্থাৎ
জঘন্যতম অন্যায়কারীর প্রতি আমাদের হৃদয়ে (চিত্তে) যে স্বাভাবিক রোষানল প্রজ্বলিত হয়, তারই কাব্যরূপ রৌদ্ররস।
যেমনঃ-
"""মানুষেরে ঘৃণা করি
ওকারা কোরান, বেদ, বাইবেল চুম্বিছে মরি মরি।
ও মুখ হইতে কেতাব গ্রন্থ নাও জোর করে কেড়ে,
যাহার আনিল গ্রন্থ-কেতাব সেই মানুষেরে মেরে।
পূজিছে গ্রন্থ ভণ্ডের দল।
(সর্বহারা : সাম্যবাদী)"""
নজরুলের এ কবিতায় অবিবেকী ধর্মব্যবসায়ী ভণ্ডদের বিরুদ্ধে মানবিক ক্রোধের
উজ্জ্বল প্রকাশ ঘটেছে বলেই এটিই রৌদ্ররসের সার্থক উদাহরণ।
(৩) """প্রিয়াকে আমার কেড়েছিস তোরা,
ভেঙেছিস ঘরবাড়ী,
সে কথা কি আমি জীবনে মরণে
কখনো ভুলিতে পারি?
আদিম হিংস্র মানবিকতার যদি আমি কেউ হই
স্বজন হারানো শ্মশানে তোদের
চিতা আমি ভুলবই।""
সুকান্তের এ কবিতায় শোষকশ্রেণীর বিরুদ্ধে শোষিত জনতার দৃপ্ত ক্রোধের বহ্নিমান
বিকাশ অনিবার্য হয়েছে বলেই রৌদ্ররস গভীর ব্যঞ্জনায় ভাস্বর।
(৪) হাস্যরস :
এ রসের স্থায়ীভাব 'হাস'। কৌতুকজনক কোন কাজ বা বাক্য হতেএ রসের উৎপত্তি। সাধারণত হাস্যোদ্দীপক অঙ্গ বিকৃতি এর আলবন বিভার এবং এরচাদি উদ্দীপন বিভাগ হয়ে থাকে। সংস্কৃত নাটকে বিমূখক কিংবা পৌরাণিক যাত্রা নাটকেভাঁড় হিসেবে নাট্যকার যে-চরিত্রটি সৃষ্টি করতেন, তার সঙ্গে নাটকের মূল বিষয়বস্তুরম্পসমর্ক খুবই ক্ষীণ, কিন্তু নাটকে হাস্যরস সৃষ্টিক্ষেত্রে এ ধরনের চরিত্রের জুড়ি মেলা ভার।এ ক্ষেত্রে তাদের ভূমিকা সত্যি বিকল্পবিহীন। হয়তো দেখা যাবে, নাটকের ঘটনাপ্রবাহ
যখন এক গুরুগম্ভীর বাতাবরণ শ্বাসরুদ্ধ, তখন এ জাতীয় চরিত্র তাদের (বিদূষক বা ভাঁড়)হাসাময় উপস্থিতি দিয়ে সে অবস্থার অবসান ঘটিয়ে আমাদের চিত্তকে নির্মল হাস্যরসে হিকরে তোলে। অর্থাৎ যেখানে কাজের সঙ্গে কারণের কিংবা কারণের সঙ্গে কাজের, ইচ্ছারসঙ্গে অবস্থার উদ্দেশ্যের সঙ্গে উপায়ের ঘোষণার সঙ্গে রূপায়ণের অসঙ্গতি প্রকট হয়েওঠে, সেখানেই এ ধরনের অসঙ্গতিজনিত কারণে আমরা এক প্রকার কৌতুক বোধ করিএবং এ অবস্থায় কেউই হাসি চেপে রাখতে পারে না। জাগতিক জীবনের হাস' স্থায়ীতারথেকে কাবা কিংবা নাট্যে হাস্যরসের জন্য অনিবার্য হয়ে ওঠে।বাংলা কাব্য-সাহিত্য থেকে কতিপয় উদাহরণের সাহায্যে হাস্যরসের স্বরূপ
চিহ্নিত করা যাক।
(২)""" নগ্নশির সব্জা নাই, লজ্জা নাই ধড়ে
কাছা কোঁচা শতবার খ'সে খসে পড়ে।
অস্তিত্ব আছে না আছে, ক্ষীণখর দেহ
বাক্য ঘরে বাহিরায় না থাকে সন্দেহ।
এতটুকু যন্ত্র হতে এত শব্দ হয়
দেখিয়া বিশ্বের লাগে বিষম বিস্ময়।"""
(সোনার তরী ঃ হিং টিং ছট)
রবীন্দ্রনাথের এ কবিতা নির্মল হাস্যরসের অমল উদাহরণ হিসেবে সর্বকালে স্বতব্য।
(৩) ""অ-মা। তোমার বাবার নাকে কে মেরেছে ল্যাং।
খাঁদা নাকে নাচ্ছে ন্যাদা-নাক, ডেঙাডেং ড্যাং।
ওঁর নাটাকে কে করলো খাঁদা রাঁদা বুলিয়ে।
চামচিকে-ছা ব’সে যেন নেজুড় ঝুলিয়ে।
বুড়ো গরুর পিঠে যেন শুয়ে কোলা ব্যাং।
অ-মা। আমি হেসে মরি, নাক ডেঙাডেং ড্যাং""""
(-ঝিঙে ফুল ঃ খাদু দালু)
কাজী নজরুলের এ কবিতায় বিকৃত অঙ্গ এবং আজগুবি সব কার্য-কারণের অসঙ্গতিতেঅপূর্ব হাস্যরসের সৃষ্টি হয়েছে।বাংলা কাব্যে হাস্যরসের সৃষ্টিতে একাধিক কবি ঈর্ষণীয় ক্ষমতার পরিচয় দিয়েছেন।
(৫) করুণরস :
শোক' করুণরসের স্থায়ীভাব। শোকের বিষয় এর আলম্বন বিভাবএবং এ বিষয়ের দর্শন, শ্রবণ কিংবা মননাদি এ রসের উদ্দীপন বিভাব। মানুষের জীবনেইউনাশ অথবা অনিষ্টপাত যখন অবধারিত হয়ে ওঠে তখন চিত্ত স্বাভাবিকভাবে শোকভাবেআক্রান্ত হয়। লৌকিক জীবনের এই শোকই কাব্য-সাহিত্যে করুণরসে পরিণত হয়।কালিদাসের রঘুবংশ কাব্য থেকে একটি উজ্জ্বল উদাহরণের সাহায্যে এ রসের স্বরূপ
বিশ্লেষণ করা যাক,
(১ মাইকেল মধুসূদন দত্তের মেঘনাদবধ কাব্য থেকে করুণরসের একটি
উদাহরণ উদ্ধৃত করছি;
"""এ হেন সভায় বসে রক্ষঃ কুলপতি,
বাক্যহীন পুত্রশোকে! ঝর ঝর ঝরে
অবিরল অশ্রুধারা-ভিডিয়া বসনে,
যথা তরু, তীক্ষ্ণ শর সরস শরীরে
বাজিলে, কাঁদে নীরবে।""
(-প্রথম সর্গ)
-প্রিয়পুত্র বীরবাহুর মৃত্যু সংবাদে শোকার্ত রাজা রাবণ। এখানে শোক ভাবের আলম্বন পুত্র
বীরবাহু। এবং তার মৃত্যু সংবাদ শ্রবণ ও তার সম্পর্কিত চিন্তা উদ্দীপন বিভাব। ফলে এটি
করুণরসের সার্থক উদাহরণ। আমরা এবারে রবীন্দ্রনাথের 'কথা' কাব্যের 'বিসর্জন'
কবিতা থেকে করুণরসের একটি উদাহরণ সঙ্কলিত করছি
রোমাঞ্চিতকায়
""নয়ন মেলিয়া কহে, 'কই মা? . কোথায়।
পরিপূর্ণ চন্দ্রালোকে বিহ্বলা রজনী""
গঙ্গা বহি চলি যায় করি কলধ্বনি।
চীৎকারি উঠিল নারী, "দিবি নে ফিরায়ে?’
মর্মরিল বনভূমি দক্ষিণের বায়ে""
- দু'বছর পূর্ণ না হতেই জননী হারিয়েছে দু'পুত্রকে, তৃতীয় পুত্রের জন্মের পর অভাগিনী
নারী হারালো তার স্বামীকেও। বিধবা মল্লিকা 'ব্রতধ্যান-উপবাসে আহ্নিকে তর্পণে' মন্দিরে
মন্দিরে কাটায় কাল, সাধু-সন্ন্যাসীর আশীর্বাদ ভিক্ষা করে শিশুর কল্যাণ কামনায়। কিন্তুদেড় বছর বয়স হতেই যকৃতের বিকারে প্রবল জ্বরে শিশু শীর্ণ হয়ে আসে, বিধবা জননীরশত আরাধনায়ও 'ব্যাধি শান্তি নাহি মানে।' অবশেষে জননী মল্লিকা প্রাচীন পুরাণ শুনেসরল প্রত্যয়ে জ্বরতন্ত্র সন্তানটিকে সমর্পণ করে জাহ্নবীজলে। তার বিশ্বাস, হাসিমুখেঅনিন্দিত কান্তি ধরি দেবীর কোল ফেলে নীরোগ সন্তান ফিরে আসবে তার কোলে। কিন্তুপূর্ণিমার জোয়ারে স্ফীত জাহ্নবী থেকে মল্লিকার শেষ সন্তানটি আর ফিরে আসে নি:জননীর বক্ষ বিদীর্ণ করে অন্তিম জিজ্ঞাসা ধ্বনিত হয় `দিব নে ফিরায়ে?' আর সে শোকার্তপ্রশ্ন পরিব্যাপ্ত হয় সর্বত্র, জাহ্নবী তীরের বনভূমিতে এবং সহৃদয় পাঠকের মনভূমিতেও।
এখানে শোকভাবের আলম্বন বিভাব "গঙ্গায় সমর্পিত সন্তান আর তার স্মৃতি অনুধ্যান
ইত্যাদি উদ্দীপন বিভাব এবং রোমাঞ্চ, হাহাকার (চীৎকারি উঠিল নারী) এগুলো অনুভাব।ফলে এটি করুণরসের এক উজ্জ্বল উদাহরণে পরিণত।কাজী নজরুল ইসলামের সিন্ধু হিন্দোল কাব্যে 'সিন্ধু' কবিতা করুণরসের এক
ব্যতিক্রমী ব্যঞ্জনায় ভাস্বর। যেখানে সমূহ-বিনষ্টি, সর্বগ্রাসী রিক্ততার বিশাল শোকে প্রতিটি
ছত্র উচ্চকিত।
(৪) ""মাগিব বিদায় যবে, নাহি র’ব আর,
তব কল্লোলের মাঝে বাজে যেন ক্রন্দন আমার।
বৃথাই খুঁজিবে যবে প্রিয়া
উত্তরীয় বন্ধু ওগো সিন্ধু মোর, তুমি গরজিয়া।
তুনি শূন্য, আমি শূন্য শূন্য চারিধার,
মধ্যে কাঁদে বারিধার, সীমাহীন রিক্ত হাহাকার।"""
(সিন্ধু, তৃতীয় তরঙ্গ)
(৫)"" ওই দূর বনে সন্ধ্যা নামিছে ঘন আবিরের রাগে
অমনি করিয়া লুটায়ে পড়িতে বড় সাধ আজ জাগে।
(—কবর ঃ জসীমউদ্দীন)""
-এখানে বৃদ্ধ তাঁর জীবনের বেদনার ইতিবৃত্ত বর্ণনা করছে,
৬) ভয়ানক রস ঃ
ভয় হতে ভয়ানক রসের উৎপত্তি। বিভীষিকা এর আলম্বন বিভাব
এবং ভয়জনিত চেষ্টাদি এর উদ্দীপন বিভাব। অর্থাৎ কবি-বর্ণনার চমৎকারিত্বে আমাদের
চিত্তগত ভীতি-ভাবটি (যেটা মানুষের চিত্তে সংস্কাররূপে বর্তমান) উদ্বুদ্ধ এবং প্রকাশিতহয়ে যখন কাব্যে আস্বাদ্যমান হয়ে ওঠে তখন তাকে ভয়ানক রস হিসেবে আখ্যায়িত করাহয়।মহাকবি কালিদাসের ‘অভিজ্ঞান শকুন্তল' নাটকের প্রথম অঙ্ক থেকে একটি
উদাহরণের সাহায্যে ভয়ানক রসের স্বরূপ উপলব্ধি সহজ হতে পারে।
ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গলে ভয়ানক রসের অনেক উদাহরণ থেকে এখানে একটি মাত্রউদ্ধৃত করা হচ্ছে,
(২) ""বিপ্ৰসর্ব দেখি পর্ব ভোজাবস্তু সারিছে।
ভূতভাগ পায় লাগ লাথি কীল মারিছে ।
ছাড়ি মন্ত্র ফেলি তন্ত্র মুক্তকেশ ধায় রে।
হায় হায় প্রাণ যায় পাপ দক্ষ দায় রে।
(-ভারতচন্দ্র : অন্নদামঙ্গল)""
(৩) ""কেমনে বর্ণিব বীরবাহুর বারতা?
মদকল করী যথা পশে নলবনে,
পশিলা বীরকুঞ্জর অরিদল মাঝে
ধনুর্দ্ধর। এখনও কাঁপে হিয়া মম
থরথরি, স্মরিলে সে ভৈরব হুঙ্কারে।
(-মধুসূদনঃ মেঘনাদবধ কাব্য, ১ম সর্গ)"""
-এখানে দ্রুত মকরাক্ষ বীরবাহুর মৃত্যু সংবাদ শোনাচ্ছে রাজা রাবণকে। যুদ্ধে নিহত
বীরবাহু। কিন্তু তার অবিস্মরণীয় পরাক্রম স্মরণ করে এখনো দূতের হৃদ্-কম্প উপস্থিতহয়। ফলে বীরবাহু এখানে ভয়ভাবের আলম্বন বিভাব এবং তার মত্ত হাতীর মত শত্রু মধ্যেপ্রবেশ উদ্দীপন বিভাব।
"""নেতা। আমার কেমন যেন মনে হচ্ছে যে মরেছে,
সে এখনও আমাদের পেছনে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
(-মুনীর চৌধুরী ঃ কবর)""
- কবর নাটকে মুনীর চৌধুরী এখানে শোষক শ্রেণীর প্রতিভূ নেতার সংলাপে ভয়ানকরসের গভীর ব্যঞ্জনা সৃষ্টিতে সার্থক। কারণ অন্যায় উৎপীড়নকারীর হৃদয়ের গভীর ভীতি
তাকে তাড়িত করে সর্বক্ষণ। যাদেরকে হত্যা করা হয়েছে দুনিয়া থেকে তাদের অস্তিত্ব
বিলুপ্ত হলেও হত্যাকারীর সন্ত্রস্ত চিত্তে তাদের ভয়-ভাবের যবনিকা পড়ে নি। তাই গুলিবিদ্ধ
আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতা এখানে আলম্বন বিভাব এবং রাত্রির নির্জন গোরস্থানের অশরীরী
বাতাবরণ এ ভাবে উদ্দীপিত করেছে বলে উদ্দীপন বিভাব।
৭.বিভৎস রস---
কোন কুৎসিত বিষয়ের প্রতি জুগুপ্সা Disgust বা ঘৃণার ভাব
থেকেই বীভৎস রসের জন্ম। কুৎসিত বা রুচি বিরোধী বিষয়ই এর আলম্বন বিভাব এবং এবিষয়ের বিজ্ঞাপক লক্ষণসমূহ এ রসের উদ্দীপক বিভাব হয়ে থাকে। মানুষ যখন কোন
ঘৃণ্য বা অরুচিকর বিষয় বা বস্তু শ্রবণ কিংবা দর্শন করে তখন তার চিত্তে এক ধরনেরজুগুপ্সা বা ঘৃণার ভাব জেগে ওঠে- এই ভাব থেকেই ভয়ানক রসের জন্ম। তবে লৌকিক
জীবনের এ ঘৃণা-ভাবের থেকে উৎপন্ন বীভৎস রসের কাব্য কিংবা নাটক কিন্তু ঘূণিত নয়,
কারণ রসে রূপান্তরিত ভাব সর্বক্ষণই সহৃদয় চিত্তে আস্বাদনযোগ্য আনন্দদায়ক।
উদাহরণের সাহায্যে বিষয়টি স্পষ্ট হতে পারে।
>)
"""ঝাঁকড় মাকড় চুল নাহি আঁধি সাঁধি।
হাত দিলে ধুলা উড়ে যেন কেয়াকাঁদি!
ডেঙ্গর উকুন নিকী করে ইলিবিলি।
কোটি কোটি কান কোটারির কিলিবিলি ॥
কোটরে নয়ন দুটি মিটি মিটি করে।
চিবুকে মিলিয়া নাসা ঢাকিল অধরে।"""
(ভারতচন্দ্র : অন্নদামঙ্গল)
ভারতচন্দ্রের এ কবিতাংশে ঘৃণার ভাব এতো স্পষ্ট যে এখানে বীভৎসরসের ব্যাখ্যার
অবকাশ নেই।মাইকেল মধুসূদন দত্তের মেঘনাদবধ কাব্য থেকে আরেকটি উদাহরণ উদ্ধার করা যাক :
"""সে রোগের পাশে
বিশাল উদর বসে উদরপরতা
অজীর্ণ ভোজন দ্রব্য উগরি দুর্মতি
পুনঃ পুনঃ দুই হস্তে তুলিয়া গিলিছে
সুখাদ্য।"""
(অষ্টম সর্গ)
-এখানে বমন করা অজীর্ণ, ভোজন দ্রব্য ঘৃণা ভাবের আলম্বন বিভাব এবং তা দু'হাতেতুলে গেলা (গলাধকরণ) এ ভাবকে আরো উদ্দীপিত করে তোলে বলে উদ্দীপন বিভাব।ফলে এটি বীভৎসরসের সার্থক উদাহরণ। মেঘনাদবধের প্রথম সর্গে প্রাসাদ শিখর থেকে
রাজা রাবণ যে রণক্ষেত্র দেখেছেন, সেখানেও মধুসূদন বীভৎস রস সৃষ্টিতে সার্থক।
অদূরে হেরিলা রক্ষঃপতি
রণক্ষেত্র। শিবাকুল, গৃহিণী, শকুনি,
কুকুর, পিশাচদলে ফেরে কোলাহলে।
কেউ উড়ে, কেহ বসে, কেহ বা বিবাদে,
পাকশাট মারি কেহ খেদাইছে দূরে
সমলোভী জীবে, কেহ গরজি উল্লাসে,
নাশে ক্ষুধা-অগ্নি, কেহ শোষে রক্তস্রোতে।
রবীন্দ্রনাথের কবিতায় প্রাচীন আলঙ্কারশাস্ত্রীদের বর্ণিত বীভৎস রসের উদাহরণ খুব
সহজলভ্য না হলেও কিছুটা স্বতন্ত্র ব্যঞ্জনার দৃষ্টান্ত দুর্লভ নয়। যেমন পরিশেষ কাব্যের
"বাঁশি' কবিতায় হরিপদ কেরানীর জীবন প্রতিবেশের চিত্রাঙ্কনে
8)
গলিটার কোণে কোণে
জমে ওঠে, পচে ওঠে
আমের খোসা ও আঁঠি, কাঁঠালের ভুতি,
মাছের কানুকা,
মরা বেড়ালের ছানা
ছাইপাস আরো কত কী যে
৮) অদ্ভুত রসঃ
এ রসের স্থায়ী ভাব বিস্ময়। আলঙ্কারিকদের ভাষায়, অদৃষ্টপূর্ব বাঅশ্রুতপূর্ব কোন অদ্ভুত পদার্থ দর্শনে কিংবা শ্রবণে সহৃদয় পাঠকমাত্রের পুলকাদিজনকচিত্তবিস্তারকে বিস্ময় বলা হয়। অদ্ভুত বিষয় বা ব্যাপারই এ রসের আলম্বন বিভাব এবং এবিষয়ক মহিমাদি অদ্ভুত রসের উদ্দীপন বিভাব। অর্থাৎ কোন কাব্য কিংবা নাট্য পাঠে,দর্শনে অথবা শ্রবণে আমাদের চিন্তগত বিস্ময়বোধের বিকাশ যদি অনিবার্য এবংআস্বাদনযোগ্য হয়ে ওঠে, তবে সে রচনাকে প্রাচ্যকাব্যতাত্ত্বিকেরা আখ্যায়িত করেন
অদ্ভুতরসের কাব্য বলে। উদাহরণের সাহায্যে এ রসের স্বরূপ উপলব্ধি করা যাক।
>) """সবিস্ময়ে রঘুনাথ নদীর উপরে
হেরিলা অদ্ভুত সেতু, অগ্নিময় কভু,
কভু ঘন ধূমাবৃত, সুন্দর কভু বা,
সুবর্ণে নিৰ্ম্মিত যেন! ধাইছে সতত
সে সেতুর পানে প্রাণী লক্ষ লক্ষ কোটি
হাহাকার নাদে কেহ কেহ বা উল্লাসে।""
(মধুসূদন দত্তঃ মেঘনাদবধ, অষ্টম সর্গ)
-এখানে মায়াদেবীর সঙ্গে রামচন্দ্র প্রেতপুরীতে গমন করে এ দৃশ্য দেখেছেন চরমবিশ্বয়ে। ফলে এখানে, অদ্ভুত সেতু আলম্বন বিভাব এবং সেতুর রূপবৈচিত্র্য উদ্দীপনবিভাব। সুতরাং এটি অদ্ভুত রসের সার্থক উদাহরণ।
সেই স্বপ্ন আজি
এসেছে কি পাণ্ডবজননী রূপে সাজি
সন্ধ্যাকালে, রণক্ষেত্রে, ভাগীরথী তীরে।
(রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর : কর্ণকুন্তী সংবাদ)
কর্ণের বিস্ময় এখানে জননী কুন্তীকে ঘিরে অদ্ভুত রসের সৃষ্টি করেছে।
(৯) শান্তরসঃ
পরম শান্তি বা নির্বেদভাব হতে শান্তরসের উৎপত্তি। অর্থাৎ জাগতিকজীবনে প্রতিটি বস্তুর চরম নশ্বরতা প্রত্যক্ষ বা উপলব্ধি করে প্রাজ্ঞ ব্যক্তির চিত্তে একধরনের বৈরাগ্যভাবের সৃষ্টি হয় এবং এ ভাবই কবিশক্তিরসার্থক লালনে যখন কাব্যরূপলাভ করে, আর সে কাব্য পাঠে বা শ্রবণে সহৃদয় চিত্তও অনুরূপ চেতনায় আক্রান্ত হয়।এই যে চরম শান্তি, নির্বেদ বা শম ভাব- এরই সার্থক পরিণাম শান্তরস। শম মানে-বিষয়বীতরাগ, উদাসীন এবং পরমাত্মায়ই জীবাত্মার অনির্বচনীয় বিশ্রাম-সুখ-এ ধরনের ভাবকেবুঝায় । পূর্বেই উল্লিখিত, আচার্য ভরত স্থায়ী ভাবের সংখ্যা নির্দেশ করেছিলেন আট এবংতার থেকে আগত রসও ছিলো আট প্রকার, পরবর্তীকালের আলঙ্কারিকেরা শম ভাবকেসংযুক্ত করে আট স্থানে নয় করেছেন। আমরা এবারে মধুসূদনের মেঘনাদবধ কাব্য থেকে
একটি উদাহরণের সাহায্যে শান্ত রসের স্বরূপ সন্ধানে ব্রতী হবো।
3)
"""ভাবি; প্রভু, দেখ কিন্তু মনে,
অভ্রভেদী চূড়া যদি যায় গুঁড়া হয়ে
বজ্রাঘাতে, কভু নহে ভূধর অধীর
সে পীড়নে। বিশেষতঃ এ ভবমণ্ডল
মায়াময়, বৃথা এর দুঃখ সুখ যত।"""
(প্রথম সর্গ)
-এখানে বীরবাহুর মৃত্যুর সংবাদে শোকার্ত রাজা রাবণকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন তাঁর মন্ত্রী
সারণ! তার উচ্চারণে শমভাবের সার্থক শান্তরসে পরিণতি ঘটেছে (এ ভবমণ্ডল মায়াময়,
কতোটা সমীচীন তা তর্কসাপেক্ষ। কারণ রবীন্দ্র কবি-চেতনায় সমর্পণের ভাব অনুপস্থিত
নয়, তবে সে সমর্পণও জীবন-প্রীতির ভিন্ন প্রকাশ। ফলে রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলি,
গীতিমালা ও গীতালি থেকে স্বতন্ত্র স্বাদের শান্তরসের দু'একটি দৃষ্টান্ত সম্বলিত করে।
আমরা এ অধ্যায়ের অভিম সূচিত করছি।
"""সীমার মাঝে অসীম, তুমি বাজাও আপন সুর।
আমার মধ্যে তোমার প্রকাশ তাই এত মধুর।
কত বর্ণে কত গন্ধে, কত গানে কত ছন্দে,
অরূপ তোমার রূপের লীলায় জাগে হৃদয়-পুর
আমার মধ্যে তোমার শোভা এমন সুমধুর।""""
(গীতাঞ্জলিঃ সীমার প্রকাশ )
২) ""কিন্তু চিরস্থায়ী কিছু নহে এ সংসারে।
এ বায় আর আসে, জগতের রীতি
সাগরতরঙ্গ যথা
(মেঘনাদবধ, ষষ্ঠ সর্গ)"""
রাবনের অফুরন্ত ঐশ্বর্য প্রসঙ্গে বিভীষণের প্রজ্ঞা-প্রসূন উক্তিতে শম বা নির্বেদ ভাব প্রধান,এজন্যেই এটি শান্তরসের একটি সার্থক উদাহরণ।প্রাচ্য কাব্যতাত্ত্বিকদের প্রদত্ত সূত্রানুসারে রবীন্দ্র-কাব্যে 'শম' ভাব বা শান্তরস অন্বেষা
0 মন্তব্যসমূহ