****বাঙলা সাহিত্যের মধ্যযুগের ইতিহাসে শাহ মুহম্মদ সগীর প্রণীত ইউসুফজোলেখা' কাব্যের পাণ্ডুলিপির আবিষ্কার একটি অভূতপূর্ব ঘটনা। স্বনামধন্য আবদুলকরিম সাহিত্যবিশারদই ইহার আবিষ্কর্তা। আমি যখনকলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের
গবেষক রূপে, সাহিত্যবিশারদ মহোদয়ের বাড়িতে দীর্ঘ তিন মাস বাস করিয়া তাঁহারপারিবারিক গ্রন্থাগারের পাণ্ডুলিপির পাঠ লইতেছিলাম, তখন আমি শাহ মুহম্মদ সগীর
প্রণীত ইউসুফ জোলেখা' কাব্যের পাণ্ডুলিপির সহিত পরিচিত হই। তখন কথা
প্রসঙ্গে সাহিত্যবিশারদ সাহেব বলিয়াছিলেন, “দেখ, কাব্যখানির ভাষা ও ব্যাকরণ
প্রাচীন, অন্ততঃ আমাদের জানা মুসলিম কাবাগুলির পাণ্ডুলিপির ভাষা ও ব্যাকরণ হইতেপ্রাচীনতর। কাব্যখানি অত্যন্ত সুন্দর; ইহা সম্পাদিত হইয়া প্রকাশিত হওয়া আবশ্যক।
আমার শারীরিক ও মানসিক শক্তি ক্ষীণ হইয়া আসিতেছে,কোন নূতন কাজে হাতদিবার সাহস নাই। (অনুযোগের সুরে) আচ্ছা সকল কাজ যদি আমরাই করি, তবেতোমরা কি করিবে? তুমিই একমাত্র তরুণ, যে এই কাজে হাত দিয়া কাজটি সমাধ্যকরিতে পারিবে। তুমি কাজটিতে হাত দাও না, আমি তোমাকে জানে-প্রাণে সাহায্যকরিব।" এই কাজের উপযোগিতা সম্বন্ধে সম্যক অবগত না হইয়া পূর্বাপর বিবেচনা নাকরিয়াই স্বকীয় তারুণ্য বশে সাহিত্যবিশারদ মহোদয়ের কথাগুলি আমার প্রাণে
উৎসাহের ফোয়ারা খুলিয়া দিল; আমি বলিলাম, “আপনার আদেশ শিরোধার্য।" আমিতখনও (১৯৩৪ খ্রীষ্টাব্দ) —–—এমন কি এখনও (১৯৮১খ্রীষ্টাব্দ) প্রাচীন পাণ্ডুলিপি কষ্টকরিয়াই পড়িতে পারি। ভাবিলাম : তাঁহার সাহায্যটাই চাহিয়া লই না কেন? বলিলাম,আমি আপনার কাছ হইতে সংগৃহীত পাণ্ডুলিপিগুলিরএকটা সমন্বিত পাঠ পাইলেই পৃথিসম্পাদনের অন্যান্য কাজ শুরু করিব। তিনি এক কথাতেই রাজি হইয়া গেলেন এবং
আমার সম্মুখে 'বিসমিল্লাহ' বলিয়া আমাকে দেখিতে বলিয়া কাজে হাত দিলেন। সমগ্রপুথি অন্যান্য পাণ্ডুলিপির সহিত মিলাইয়া নকল করিতেতাঁহার তিন বৎসর লাগিয়াছিল।তখন তিনি কিস্তি কিস্তি করিয়া 'পাঠ' পাঠাইতেন, আমি তাহা পড়িতাম ও নিজের হাতেটীকা-টিপ্পনীর জন্য নকল করিতাম। আদর্শ পুথির নকলকারীর নকলের তারিখ পাওয়াগেল, কিন্তু রচনার কালজ্ঞাপক কিছু পাওয়া গেলনা।সমন্বিত পাঠ আলোচনা করিতে গিয়া ইহার বিষয়বস্তু ও কবিত্ব-সৌন্দর্যে আকৃষ্টহইয়া একটি দীর্ঘ প্রবন্ধ রচনা করিয়া বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকায় প্রকাশ করি। এইপ্রবন্ধ পাঠ করার পর মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেল কাব্যেরবিষয় বস্তু যে সুন্দর ওকবিও যে শক্তিশালী, সে-বিষয়ে অধিকাংশ পাঠক দ্বিমত পোষণ করেন নাই; তবেকাব্যে ব্যবহৃত ভাষায় কিছু কিছু প্রাচীনত্বের নিদর্শন থাকিলেও, এত আগে অর্থাৎখ্রীষ্টীয় পঞ্চদশ শতাব্দীতে কোন মুসলমান বাঙলা ভাষায় কোন কাব্য রচনাকরিয়াছিলেন, এই বিশ্বাস তাঁহাদের মধ্যে দেখিতে পাওয়া যায় নাই। সুনীতি বাবুবলিলেন, ইহাতে ভাষার কিঞ্চিৎ নিদর্শন রহিয়াছে; কেবল এই নিদর্শনের উপর নির্ভরকরিয়া কাব্যটি পঞ্চদশ শতাব্দীর রচনা বলিয়া ধরিয়া লওয়া ভুল হইবে। তাহা করিতেহইলে সমসাময়িক বা পূর্বাপর অন্য কাব্যের ভাষার সহিত তুলনামূলকআলোচনাআবশ্যক । শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের ভাষা নিঃসন্দেহে চর্যার পরবর্তী অর্থাৎ ১২০০ খ্রীস্টাদেরকিছুকাল পরবর্তী; সুতরাং ইহার ভাষা ১৩৫০ খ্রীষ্টাব্দের কাছাকাছি হইলেও হইতেপারে; তবে এই অনুমান ভাষার তুলনামূলক আলোচনা নাকরিয়া স্থির করা যায় না।ডক্টর শহীদুল্লাহকে জিজ্ঞাসা করা হইলে তিনি বলিলেন, দেখিয়া মনে হয়, সগীরেরভাষা বেশ প্রাচীন; তবে পাণ্ডুলিপি চট্টগ্রাম হইতে আবিষ্কৃত হওয়ায় বলিতে হয়, প্রত্যন্ত
অঞ্চলের ভাষা প্রায়ই আপন প্রাচীনত্ব রক্ষা করে। কেবল ভাষার ভিত্তিতে সগীরেররচনাকে পঞ্চদশ শতাব্দীর ভাষা বলিয়া প্রমাণ করিতে হইলে, অনেক কাঠ-খড়পোড়াইতে হইবে।
বলা আবশ্যক যে, আমি সর্বদা বন্ধু বান্ধব আত্মীয় স্বজন ও ছাত্র ছাত্রীকেপুথিসংগ্রহের জন্য উৎসাহ দিতাম। তাহাদের কেহ কেহ আমার উৎসাহে উৎসাহিতহইয়া, কিছু কিছু পুথির পাণ্ডুলিপি আমার জন্য সংগ্রহ করিয়া আমার কাছে পাঠাইতেন।ত্রিপুরার এক ইস্কুল সাব-ডিভিশনাল ইনসপেক্টারের কাছ হইতে একদিন ডাক যোগে
এক বান্ডিল পাণ্ডুলিপি পাইলাম। তাহা বুলিয়া দেখিলাম ৩/৪ খানা মাদুলী গুথিরপাণ্ডুলিপির সহিত একখানা খণ্ডিত পুথির পাণ্ডুলিপিও ইহাতে রহিয়াছে। এই পণ্ডিতপাণ্ডুলিপিটি শাহ সগীরের 'ইউসুফ-জোলেখা' কাব্যের; ইহাতে প্রথম হইতে কিছুসংখ্যক
পাতা ক্রমিক সংখ্যায় পাওয়া গেল।
এই পাতাগুলির মধ্যেই মুসলিম ঐতিহ্য অনুসারে হামদ, নাত, পিতা-মাতারপ্রশংসা কীর্তনের পর একটি 'রাজ-প্রশস্তি'ও রহিয়াছে।আমি আমার পাণ্ডুলিপির
প্রথমাংশটি শোধরাইয়া লইলাম ও 'রাজ-প্রশস্তি' হইতে ইনি কে, সে-বিষয়ে অনুসন্ধানেপ্রবৃত্ত হইলাম। এই অনুসন্ধানের ফলে, 'ইউসুফ-জোলেখা' রচনার তারিখ নির্ণীত
হইয়াছে।
যোশেফের বিবরণ (সংক্ষিপ্ত)
১.তৎকালে যাকোব আপন পিতার প্রবাস দেশে, কনান দেশে বাস করিতেছিলেন।
২.যোশেফ সভের বৎসর বয়সে আপন ভ্রাতৃগণের সহিত পশুপাল চরাইত।
৩.যোশেফ ইস্রায়েলের (অর্থাৎ যাকোবের) বৃদ্ধাবস্থার সন্তান, এই জন্য ইস্রায়েল
(অর্থাৎ যাকোব) সকল পুত্র অপেক্ষা তাহাকে অধিক ভালবাসিতেন।
8.
কিন্তু পিতা তাঁহার সকল ভ্রাতা অপেক্ষা তাহাকে অধিক ভালবাসেন ইহা দেখিয়া
তাঁহার ভ্রাতৃগণ তাহাকে দ্বেষ করিত, তাঁহার সঙ্গে প্রণয় ভাবে কথা কহিতে
পারিত না।আর যোশেফ স্বপ্ন দেখিয়া আপন ভাতাদিগকে তাহা কহিল; ইহাতে তাহারা
তাহাকে আরও অধিক দ্বেষ করিল।
৬..
পরে সে আরও এক স্বপ্ন দেখিয়া ভ্রাতৃগণকে তাহার বৃত্তান্ত কহিল। সে বলিল
দেখ, আমি আর এক স্বপ্ন দেখিলাম; দেখ সূর্য, চন্দ্র ও একাদশ নক্ষত্র আমাকে
প্রণিপাত করিল।
১০. সে আপন পিতা ও ভ্রাতৃগণকে ইহার বৃত্তান্ত কহিল, তাহাতে তাহার পিতাতাহাকে ধমকাইয়া কহিলেন, তুমি এ কেমন স্বপ্ন দেখিলে? আমি তোমার মাতা
ও ভ্রাতৃগণ, আমরা কি বাস্তবিক তোমার কাছে ভূমিতে প্রণিপাত করিতে আসিব?
১১. আর তাঁহার ভ্রাতৃগণ তাঁহার প্রতি ঈর্ষা করিল, কিন্তু তাঁহার পিতা সেই কথা মনে
রাখিলেন।
১২. একদা তাঁহার ভ্রাতৃগণ পিতার পশুপাল চরাইতে শিখিমে গিয়াছিল।
১৩. তখন যাকোব যোশেফকে কহিলেন, তোমার ভ্রাতৃগণ কি শিখিমে পশুপাল
চরাইতেছে না? আইস আমি তাহাদের কাছে তোমাকে পাঠাই।
১৪. সে কহিল, দেখুন, এই আমি। (পিতার আদেশে) ভাইদের কুশল ও পশুপালের
১৫খবর লইবার জন্য শিখিমে উপস্থিত হইল। তাহার ভ্রাতৃগণ তখন শিখিম ছাড়িয়া
১৫'দোখনে’ চলিয়া যাওয়ায়, যোশেফ সেইখানে গিয়া পৌঁছিল।
১৮. তাহার ভ্রাতৃগণ তাহাকে দূর হইতে দেখিতে পাইল এবং সে নিকটে উপস্থিত
হইবার পূর্বে তাহাকে বধ করিবার জন্য ষড়যন্ত্র করিল।
১৯. তাহারা পরস্পর কহিল, ঐ দেখ স্বপ্ন দর্শক মহাশয় আসিতেছেন;
২০. এখন আইস আমরা উহাকে বধ করিয়া একটা গর্ভে ফেলিয়া দিই; পরে বলিবকোন হিংস্র জন্তু তাহাকে খাইয়া ফেলিয়াছে, তাহাতে দেখিব উহার স্বপ্নের কি
হয়।
করেন
২১ অরে ইহা শুনিয়া তাহাদের হস্ত হইতে তাহাকে উদ্ধার করিল, কহিল, না,
উহাকে প্রাণে মাৰিব না।
২২. সার করেন তাহাদিগকে কহিল, তোমরা রক্তপাত করিও না, উহাকে প্রান্তরের
এই গর্ত মধ্যে ফেলিয়া দাও, কিন্তু উহার উপরে হস্ত তুলিও না।...
২৩. পরে যোশেফ আপন ভ্রাতৃগণের নিকটে আসিলে, তাহারা তাহার গাত্র হইতে বহু
২৪. আর তাহাকে ধরিয়া গর্ত মধ্যে ফেলিয়া দিল; সেই গর্ত শূন্য ছিল, তাহাতে জল
ছিল না।
২৫. পরে তাহারা আহার করিতে বসিল; এবং চক্ষু তুলিয়া চাহিল, আর দেখ গিলিয়ন
হইতে একদল ইসমায়েলীয় ব্যবসায়ী লোক আসিতেছে; তাহারা উষ্ট্র বাহনে
সুগন্ধি দ্রব্য, গুগগুলু ও গন্ধরস লইয়া মিসর দেশে যাইতেছিল।
২৬. তখন বিদ্রো আপন ভ্রাতৃগণকে কহিল, আমাদের ভ্রাতাকে বধ করিয়া তাহার রক্ত
গোপন করিলে আমাদের কি লাভ?
২৭. আইস ঐ ইসমায়েলীয়দের কাছে তাহাকে বিক্রয় করি, আমরা তাহার উপর হাত
তুলিব না; কেননা সে আমাদের ভ্রাতা, আমাদের মাংস। ইহাতে তাহার ভ্রাতৃগণ
সম্মত হইল।
২৮. পরে বণিকেরা নিকটে আসিলে উহারা যোশেফকে গর্ত হইতে টানিয়া তুলিল,
এবং বিংশতি রৌপ্যমুদ্রায় সেই ইসমায়েলীয় (=মিদিয়নীয়) বণিকদের কাছে
যোশেফকে বিক্রয় করিল; আর তাহারা যোশেফকে মিসর দেশে লইয়া গেল।
২৯. পরে রুবেন গর্ভের নিকটে ফিরিয়া গেল, আর দেখ, যোশেক সেখানে নাই।
তখন সে আপন বস্তু চিরিল, আর ভ্রাতাদের নিকট ফিরিয়া আসিয়া কহিল,
যুবকটি নাই।।
৩০. আর আমি! আমি কোথায় যাই?
৩১. পরে তাহারা যোশেফের বস্ত্র লইয়া একটা ছাগ–মারিয়া তাহার
রক্তে তাহা
০২. আর লোক পাঠাইয়া সেই বস্তু পিতার নিকট উপস্থিত করিয়া কহিল; আমরা এই
মাত্র পাইলাম, নিরীক্ষণ করিয়া দেখ, ইহা তোমার পুত্রের বস্ত্র কিনা?
৩০. তিনি চিনিতে পারিয়া কহিলেন, এত আমার পুত্রেরই বজ্র; কোন হিংস্র জন্তু
তাহাকে খাইয়া ফেলিয়াছে, যোশেফ অবশ্য খণ্ড খণ্ড হইয়াছে।
৩৪. তখন যাকোক্স আপন বস্ত্র চিরিয়া কটিদেশে চট পরিধান করিয়া পুত্রের জন্য
অনেক দিন পর্যন্ত শোক করিলেন।
৩৫. আর তাঁহার সমস্ত পুত্রকন্যা উঠিয়া তাঁহাকে সান্ত্বনা করিতে যত্ন করিলেও তিনি
প্রবোধ না মানিয়া তাহার (যোশেফের) জন্য রোদন করিলেন।
৩৬. আর ঐ মিদিয়নীয়েরা যোশেফকে মিশরে লইয়া গিয়া ফরৌনের কর্মচারী রক্ষক
সেনাপতি পোর্টীফরের নিকটে বিক্রয় করিল।
যোশেফের দাসত্ব ও কারাবাস----
১. যোশেফ মিশর দেশে আনীত হইলে পর যে ইসমায়েলীয়রা (অর্থাৎ
মিদিয়নীয়েরা) তাহাকে তথায় লইয়া গিয়াছিল, তাহাদের নিকটে ফরৌনের
কর্মচারী পোর্টীফর তাহাকে ক্রয় করিলেন; ইনি রক্ষক সেনাপতি, একজন মিস্ত্রীয়
লোক।
2.
আর সদাপ্রভু যোশেফের সহবর্তী ছিলেন, এবং তিনি সফলকর্মা হইলেন ও
আপন মিস্ত্রীয় প্রভুর গৃহে রহিলেন।
আর সদাপ্রভু তাঁহার সহবর্তী আছেন, এবং তিনি যে কিছু করেন, সদাপ্রভু তাঁহার
হস্তে তাহা সফল করিতেছেন, ইহা তাঁহার প্রভু দেখিলেন।
অতএব যোশেফ তাঁহার দৃষ্টিতে অনুগ্রহপ্রাপ্ত হইলেন ও তাঁহার পরিচারক হইলেন
এবং তিনি যোশেফকে আপন বাটির অধ্যক্ষ করিয়া তাঁহার হস্তে আপন সর্বস্ব
সমর্পণ করিলেন।
8.
অতএব তিনি নিজের আহারীয় দ্রব্য ব্যতীত আর কিছুরই তত্ত্ব লইতেন না।
যোশেফ রূপবান ও সুন্দর ছিলেন।
এই সকল ঘটনার পর, তাঁহার প্রভুর স্ত্রী যোশেফের প্রতি দৃষ্টিপাত করিল;
তাঁহাকে কহিল আমার সহিত শয়ন কর।
কিন্তু অস্বীকার করিয়া আপন প্রভুর স্ত্রীকে কহিলেন, দেখুন এই বাটীতে আমার
হস্তে কি কি আছে আমার প্রভু তাহা জানেন না; আমারই হস্তে সর্বস্ব
রাখিয়াছেন।
এই বাটীতে আমার বড় কেহ নাই; তিনি সমুদয়ের মধ্যে কেবল আপনাকেই
আমার অধীন করেন নাই, কারণ আপনি তাঁহার ভার্যা। অতএব আমি কি রূপে
এই মহা দুষ্কর্ম করিতে ও ঈশ্বরের বিরুদ্ধে পাপ করিতে পারি?
১০. সে দিন দিন যোশেফকে সেই কথা কহিলেও তিনি তাহার সহিত শয়ন করিতে
কিম্বা সঙ্গে থাকিতে তাহার কথায় সম্মত হইতেন না।
১১. পরে একদিন যোশেফ কার্য করিবার জন্য গৃহমধ্যে গেলেন; বাটীর লোকদের
মধ্যে অন্য কেহ তথায় ছিল না, তখন সে যোশেফের বস্ত্র ধরিয়া বলিল, আমার
সহিত শয়ন কর;
১২. কিন্তু যোশেফ তাহার হস্তে আপন বস্তু ফেলিয়া বাহিরে পলাইয়া গেলেন।
১৩, তখন যোশেফ তাহার হস্তে বস্ত্র ফেলিয়া বাহিরে পলাইলেন দেখিয়া, সে নিজঘরের লোকদিগকে ডাকিয়া কহিল।
১৪. তিনি আমাদের সহিত ঠাট্টা করিতে একজন ইব্রীয় পুরুষ আনিয়াছেন, সে আমার
সঙ্গে শয়ন করিবার জন্য আমার নিকটে আসিয়াছিল, তাহাতে আমি চীৎকার
করিয়া উঠিলাম;
১৫. আমার চীৎকার শুনিয়া সে আমার নিকটে নিজ বস্ত্রখানি ফেলিয়া বাহিরে পলাইয়া
১৬. আর যে পর্যন্ত তাঁহার কর্তা ঘরে না আসিলেন, সে পর্যন্ত সেই স্ত্রীলোক তাঁহার
বজ্র আপনার কাছে রাখিয়া দিল।
১৭. পরে সেই বাক্যানুসারে তাঁহাকে কহিল, তুমি যে ইব্রীয় দাসকে আমাদের কাছে
আনিয়াছ, সে আমার সহিত ঠাট্টা করিতে আমার কাছে আসিয়াছিল;
১৮. পরে আমি চীৎকার করিয়া উঠিলে সে আমার নিকটে তাহার বস্ত্রখানি ফেলিয়া
বাহিরে পলাইয়া গেল।
১৯. তাঁহার প্রভু যখন আপন স্ত্রীর এই কথা শুনিলেন যে, 'তোমার দাস আমার প্রতি
এইরূপ ব্যবহার করিয়াছে', তখন ক্রোধে প্রজ্জ্বলিত হইয়া উঠিলেন।
২০. অতএব যোশেফের প্রভু তাঁহাকে লইয়া কারাগারে রাখিলেন, যেস্থানে রাজার
বন্দীগণ বদ্ধ থাকিত; তাহাতে তিনি সেখানে, সেই কারাগারে থাকিলেন।
২১,২২.২৩, কিন্তু সদাপ্রভু যোশেফের সঙ্গে ছিলেন এবং তাহাকে কারারক্ষকের
অনুগ্রহপাত্র করিলেন। কারারক্ষক সমস্ত বন্দীর ভার তাঁহার হাতে সমর্পণ
করিলেন।
১. এই সকল ঘটনার পরে মিসররাজের পানপত্রবাহক ও মোদক আপনাদের প্রভুর
বিরুদ্ধে দোষ করিল।
তাহাতে ফরৌন আপনার সেই দুই কর্মচারীর প্রতি... ক্রুদ্ধ হইলেন,
৩.৪. এবং তাহাদিগকে বন্দী করিয়া রক্ষক- সেনাপতির বাটীতে, কারাগারে,
যেস্থানে বন্ধ ছিলেন, সেইস্থানে রাখিলেন। রক্ষক-সেনাপতি বন্দিদ্বয়েরযোশেফদেখাশুনার জন্য যোশেফকে নিযুক্ত করিলেন ও যোশেফ তাহাদের পরিচর্যা
করিতে লাগিলেন। এই রূপে তাহারা কিছুদিন কারাগারে রহিল।
৫.৬.৭.৮.৯. পরে একরাত্রে পানপাত্রবাহক ও মোদক দুই প্রকার অর্থ- বিশিষ্ট দুই স্বপ্ন
দেখিল। কেহ তাহা ব্যাখ্যা করিতে পারিল না। যোশেফ তাহাদিগকে স্বপ্নবৃত্তান্ত
বলিতে অনুরোধ করিলে, তাহারা তাহাকে স্বপ্নবৃত্তান্ত বলিল । পানপাত্রবাহক
যোশেফকে বলিল, দেখ,
১০. আমার সম্মুখে এক দ্রাক্ষালতা । সেই দ্রাক্ষালতার তিনটি শাখা, তাহা যেন
পল্লবিত হইল, ও তাহাতে পুষ্প হইল এবং স্তবকে স্তবকে তাহার ফল হইয়া পৰ্ব
১১, তখন আমার হস্তে ফরৌনের পানপাত্র ছিল, আর আমি সেই দ্রাক্ষাফল লইয়া
ফরৌনের পাত্রে নিংড়াইয়া ফরৌনের হস্তে সেই পাত্র দিলাম।
১২. যোশেফ তাহাকে কহিলেন, ইহার অর্থ এই ঐ তিন শাখায় তিনদিন বুঝায়।
১৩. তিনদিনের মধ্যে ফরৌন আপনার মস্তক উঠাইয়া আপনাকে পূর্বপনে নিযুক্ত
করিবেন; আর আপনি পূর্বরীতি অনুসারে পানপাত্রবাহক হইয়া পুনর্বার ফরৌনের
হস্তে পানপাত্র দিবেন।
১৪. কিন্তু, বিনয় করি, যখন আপনার মঙ্গল হইবে, তখন আমাকে স্মরণ রাখিবেন,
এবং আমার প্রতি দয়া করিয়া ফরৌনের কাছে আমার কথা বলিয়া আমাকে এই
গৃহ হইতে উদ্ধার করিবেন।
(১৬. প্রধান মোদক যখন দেখিল, অর্থ ভাল, তখন সে যোশেফকে কহিল, আমিও স্বপ্ন
দেখিয়াছি; দেখ, আমার মস্তকের উপরে শুরু পিষ্টকের তিনটি ডালা।
১৭, তাহার উপরের ডালাতে ফরৌনের জন্য সকল প্রকার পঞ্চান্ন ছিল; আর পক্ষিগণ
আমার মস্তকের উপরিস্থ ডালা হইতে তাহা লইয়া খাইয়া
১৮. যোশেফ উত্তর করিলেন, ইহার অর্থ এই সেই তিন ডালাতে তিনদিন বুঝায়।
১৯. তিনদিনের মধ্যে ফরৌন আপনার দেহ হইতে মস্তক উঠাইয়া আপনাকে গাছে
টাঙ্গাইয়া দিবেন এবং পক্ষিগণ আপনার দেহ হইতে মাংস ভক্ষণ করিবে।
২০. পরে তৃতীয় দিনে ফরৌনের জন্মদিন হইল, আর তিনি আপনার সকল দাসের
জন্য ভোজ প্রস্তুত করিলেন, এবং আপনার দাসগণের মধ্যে প্রধান
পানপাত্রবাহকের ও প্রধান মোদকের মস্তক উঠাইলেন।
২১. তিনি প্রধান পানপাত্রবাহককে তাহার নিজ পদে পুনর্বার নিযুক্ত করিলেন,
তাহাতে সে ফরৌনের হস্তে পানপাত্র দিতে লগিল;
২২. কিন্তু তিনি প্রধান মোদককে টাঙ্গাইয়া দিলেন, যেমন যোশেফ তাহাদিগকে অর্থ
বলিয়াছিলেন।
২৩. তথাপি প্রধান পানপাত্রবাহক যোশেফকে স্মরণ করিল না, ভুলিয়া গেল।
ফরৌনের স্বপ্ন ও যোশেকের ব্যাখ্যা ও উন্নতি এবং বিবাহ--
১.১. দুই বৎসর পরে ফরৌন স্বপ্নে দেখিলেন।
দেখ, তিনি নদীকূলে দাঁড়াইয়া আছেন, আর দেখ, নদী হইতে সাতটা হৃষ্ট পুষ্ট
-সুন্দর গাভী উঠিল ও খাগড়া বনে চরিতে লাগিল।
সেগুলির পরে, দেখ, আর সাতটা কৃশ ও বিশ্রী গাভী নদী হইতে উঠিল ও নদীর
তীরে এই গাভীদের নিকটে দাঁড়াইল।
8,
পরে সেই কৃশ বিশ্রী গাভীরা ঐ সাতটা হৃষ্টপুষ্ট গাভীকে খাইয়া ফেলিল। তখন
ফরৌলের নিদ্রার্ভঙ্গ ।।
তাহার পরে তিনি নিদ্রিত হইয়া দ্বিতীয় বার স্বপ্ন দেখিলেন, দেখ, এক বোঁটাতে
সাতটি স্থূলাকার উত্তম শীর্ষ উঠিল।
সেগুলির পরে, দেখ, পূর্বীয় বায়ুতে শোষিত অন্য সাতটি ক্ষীণ শীর্ষ উঠিল।
*9. আর এই পশীগুলি ঐ সাতটা স্কুলাকার পূর্ণ শীর্ষ গ্রাস করিল।
পানপাত্রবাহক ফরৌনকে বলল, কারাগারে আমাদের স্বপ্নের সঠিক ব্যাখ্যা
দিয়েছিল যোশেফ শুনে ফরৌন যোশেফকে মুক্তি দিয়ে দরবারে আনালেন,
যোশেফ ব্যাখ্যা দিলেন, 'ঐ সাভটি উত্তম গাভী, সাতটি উত্তম শীর্ষ সাত বছরের
উত্তম ফলন জ্ঞাপক। আর পরের সাতটি কৃশ ও বিশ্রী গাভী ও কুশ শীর্ষ সাত
বছরের অজ্যার ও দুর্ভিক্ষের প্রতীক। মিশর দেশে সাত বছর অধিক শস্য
জনারে, এরের সাত বছরের দুর্ভিক্ষ ঠেকানোর জন্যে শস্য সঞ্চয় করতে হবে।
প্রথম সাত বছর উৎপন্ন শস্যের এক পঞ্চমাংশ মৌজুদ করা হোক)
ফরৌন তখন যোশেফকে বললেন, ঈশ্বর তোমাকে এসব জ্ঞাত করেছেন,
অতএব তোমার তুল্য বুদ্ধিমান ও জ্ঞানবান কেউ নেই, তুমিই আমার বাড়ির
অধ্যক্ষ হও। গোটা মিশর দেশের কর্তত্ব দিলাম।
১০. ফরৌন যোশেফের নাম রাখলেন সাফমৎ-পানেহী। এবং ওন নগরের যাজক
পোর্টীফের -এর কন্যা আসনথ্র-এর সূঙ্গে তার বিয়ে দিলেন।
১১. যোশেফ শসাবাহুল্যের সাত বছর দেশের উদ্বৃত্ত শস্য মৌজুদ করালেন এবং
ইতিমধ্যে তাঁর দুটো পুত্রের জন্ম হল। দুর্ভিক্ষ শুরু হল। সব দেশের লোক
মিশরে শসা ক্রয় করতে এল।
১২. যাকোব পুত্রদের মিশরে শস্যক্রয় করতে পাঠালেন, কিন্তু বিপদের আশঙ্কায় বেন
আমীনকে যেতে দিলেন না। যাকোবের সন্তানদের যোশেফ চিনলেন, কিন্তু না
চেনার ভান করে বললেন, তোমরা কোথা থেকে এসেছ, তোমরা কারো চর,
এদেশের ছিদ্র দেখতে এসেছ। ওরা বলল, আমরা সৎ লোক, খাদ্য ক্রয় করতে
এসেছি, আমরা আপনার দাস স্বরূপ।
১৩. যোশেফ বললেন একজনকে পাঠিয়ে তোমাদের ছোট ভাইকে না আনা অবধি
তোমরা মিশরে বদ্ধ থাকবে। কারাগারে দুইদিন রাখার পরে তৃতীয় দিনে
যোশেফ বললেন, তোমাদের এক ভাই কারাগারে [জামিন স্বরূপ| বন্ধ থাকুক,
তোমরা শস্য নিয়ে বাড়ী যাও, এবং ছোট ভাইকে নিয়েএস। যোশেফের ভাইরা
এ আকস্মিক বিপদপাতে যোশেকের প্রতি তাদের অপরাধ স্মরণ করে অনুতপ্তহল–বুঝল এ তাদের সেই পাপেরই শাস্তি লিমিয়ে করাগারে বন্ধ রইল।
১৪. যোশেষের নির্দেশে তাদের শস্যের বস্তায় মূল্যের অর্থও গোপনে ফেরৎ দেয়াহল। সে অর্থ বস্তা খুলে দেখেই পাছে চুরির দায়ে তাদের নতুন বিপদ ঘটে
আশঙ্কায়ও তাদের পিতা ভীত হলেন।
১৫. কেনানে ফিরে তারা পিতা থাকোবকে সব বৃত্তান্ত জানাল। পিতা বেন আমীনকেবেনজামিন দিতে সম্মত না হলে পুত্র করেন অভয় দিয়ে পিতাকে বলেন
'আমীনকে আমার সঙ্গে দাও, যদি তাকে ফিরিয়ে না আনি, তাহলে আমার
[রুবেনের] দুই পুত্রকে তুমি হত্যা করো।'
১৬. খাদ্যশস্য ফুরিয়ে এলে যাকোব পুত্রদের আবার মিশরে যেতে বললে, পুত্র যিহুদা
জানাল যে, আমীনকে সঙ্গে না নিলে যোশেফ তাদের মুখ দেখবেন না। তখন
পিতা বললেন, কেন তোমরা তাঁকে জানালে যে তোমাদের আরো এক ভাই
আছে? উত্তরে সে বলল যোশেফ, আমাদের পিতা জীবিত কিনা, আমাদের আরো
ভাই আছে কিনা জিজ্ঞাসা করাতেই বলতে হয়েছে। যিহুদাও আমীনকে ফিরিয়ে
আনবে কথা দিল।
১৭. যাকোব রাজি হলেন এবং তাঁর পরামর্শ অনুসারে, গুগ্গুলু, মধু, সুগন্ধি দ্রব্য,
গন্ধরস, পেস্তা বাদাম প্রভৃতি উপঢৌকন এবং আগের এবং এবারের শস্যের দাম
স্বরূপ অর্থও দ্বিগুণ নিয়ে তারা মিশরে গেল।
১৮. যোশেফ আমীনকে দেখে সবাইকে অন্দরে নিয়ে যাবার জন্যে এবং সবার জন্যে
মধ্যাহ্নভোজের আয়োজন করাবার জন্যে গৃহাধ্যক্ষকে নির্দেশ দিলেন। অন্দরে
নেবার নির্দেশ শুনে দাসরূপে আটক হওয়ার ভয়ে ভাইরা ভীত হয়ে গৃহাধ্যক্ষকে
বলল আমরা আগেকার শস্যের দাম আমাদের বস্তার মুখে পেয়ে সেগুলো দেবার
জন্যে নিয়ে এসেছি এবং এবারও শস্যক্রয়ের অর্থ এনেছি। গৃহাধ্যক্ষ অভয় দিলে
তারা আশ্বস্ত হল। শিমিয়োনকে আনা হল। তাদের পা ধোয়ার পানিও দেয়া
হল। গর্দভকে দেয়া হল আহার্য। তারাও যোশেফের জন্যে উপঢৌকন সাজাল ।
যোশেফ আসলে তারা প্রাণপাত করলে, তিনি তাদের কাছে পিতার কুশলসংবাদ
জিজ্ঞাসা করলেন।
১৯. ভাইকে পেয়ে যোশেফ আবেগবশে নিজ কক্ষে গিয়ে গোপনে রোদন করলেন।
তারপর তিনি আর ইব্রীয়রা, মিশরীয়রা ও ভাইরা যথাযোগ্য আসনে বসে
যথাযোগ্য আহার্য গ্রহণ করলেন, আমীনকে সাদরে পাঁচগুণ বেশী আহার্য দেয়া
হল।
২০. তারপর যোশেফের নির্দেশে গৃহাধ্যক্ষ অন্যসব ভাইয়ের শস্যের বস্তায় শস্য ও
অর্থ আগের বারের মতো রাখল আর বেন আমীনের বস্তায় মুদ্রার সঙ্গে
যোশেফের রূপার বাটিও রাখল। এবং প্রভাতে ওরা স্বদেশ রওয়ানা হলে,যোশেফের গৃহাধ্যক্ষ রূপার বাটি চুরির দায়ে তালাসী করে আমীনের বস্তায় তা
পেল, সব ভাই দোষ স্বীকার করে দাস হয়ে থাকতে চাইল, কিন্তু, যোশেফ যারবস্তায় বাটি মিলেছে, কেবল তাকেই বন্দী রেখে অন্যদেরপিতার কাছে সশস্য
ফিরে যেতে দিলেন।তখন যিহুদা যোশেফকে পূর্বকথা স্মরণ করিয়ে দিলেন- আপনার জিজ্ঞাসারউত্তরে আমরা পিতার পরম স্নেহের কনিষ্ঠ পুত্রের কথা, তার বড় ভাইয়ের(যোশেফের) মৃত্যুতে পিতার শোকের কথা, কনিষ্ঠ পুত্রের অভাবে বৃদ্ধ পিতার
মৃত্যুর আশঙ্কার কথা আপনাকে জানিয়েছিলাম, তবু আপনি তাকে না আনলে
আপনার মুখ দেখতে পাব না বলাতেই আমরা আপনার দায় আমাদের পিতাকে
স্থান পর্যন্ত ম্মদ এনামুল হক পিখিয়াছিলেন।
হলে করে জামিন হয়ে এনেছিলাম। এখন তিনি মার
যাবেন। অতএব মিনতি করি, আমাকে বন্দী রেখে তাকে যেতে দিন।
২২. খন যোশের অন্যসব লোককে সেখান থেকে সরিয়ে দিয়ে আত্মপরিচয় দিলেন।
এবং অভয় দিয়ে বললেন, দুর্ভিক্ষের কবল থেকে মানুষকে বাঁচাবার জন্যেই ঈশ্বর
আমাকে পাঠিয়েছেন এখানে। তোমরা নির্মিত মাত্রা। তোমরা সব
গো-মেঘ ও পিতাকে নিয়ে মিশরে চলে এগ এবং পুত্র-পৌবাদিক্রমে গোশন
প্রদেশে বাস করবে। আরো পাঁচ বছর মূর্ভিক্ষ থাকবে, পিতাকে আমার ক্ষমতা
প্রতিপত্তির কথা সহ সব বিষয় জানাবে। পরে যোশেফ আমীনকে জড়িয়ে ধরে
কাঁদলেন, অন্য ভাইদের চুম্বন করলেন এবং বললেন আমার শকটে করে শিশু ও
নারীদের এবং পিতাকে শিগগির নিয়ে এসো।
২৩. যোশেষ প্রেরিত শকটাদি দেখে যাকোর পুত্রদের কথা বিশ্বাস করলেন।
মিশবযাত্রা করে বেরশেরাতে তাঁর পিতা ইসহাকের কল্যাণে বলি দিলেন এবং
বারে স্বপ্নে ঈশ্বর তাঁকে মিশরে যাবার জন্যে বললেন ও সেখানে তাঁর বংশধর
বৃদ্ধির আশ্বাস দিলেন। তারপরে যাকোবের বারো পুত্রের বংশ বৃদ্ধি পেতে থাকে
[এখানে সবার পুত্রের নামও রয়েছে। এর পরেও বাইবেলে ভেরৌনের সঙ্গে
যাকোবের পরিচয়, যোশেফের মিশর দেশ শাসন, (যাকোব মিশরে সতেরো বছর
বেঁচে ছিলেন), যাকোর কর্তৃক তাঁকে কনানে কবর দেয়ার জন্যে যোশেফকে
নির্দেশ দান, যোশেফের পুত্র ইফয়িমকে ও মনঃশিকে যাকোর আশীর্বাদ করে
তারপরে নিজের পুত্রদের শেষ আশীর্বাদ করেন এবং পুত্র যিহুদা রাজা হবেন
বলে ১১০ বছর বয়সে যোশেফ মৃত্যু বরণ করেন।
কোরআন বর্ণিত ইউসুফ বৃত্তান্ত, সুরা-১২।
সুন্দরতম কাহিনী
ইউসুফ পিতাকে জানালেন, আমি এগারোটি নিক্ষত্র এবং সূর্য ও চাদ (স্বপ্নে)
দেখলাম এবং দেখলাম তারা আমাকে। সাষ্টাঙ্গে। সেজদা করছে২. পিতা বললেন- বস এ স্বপ্নের কথা তোমার ভাইদের জানিয়ো না, তারাশয়তানের খপ্পরে পড়ে তোমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করতে পারে।
৩. প্রভু (আল্লাহ) তোমাকে ইব্রাহিম ও ইসহাকের মতোই নরী নির্বাচন করবেন,
ইউসুফ ও তাঁর ভাইদের বৃত্তান্তের মধ্যে নিহিত রয়েছে গভীর তত্ত্ব।
8.
সৎ ভাইরা নিজেরা উপলব্ধি করল যে পিতা ইউসুফকে ও ইবন ইয়ামীনকে বেনজামীনা বেশি ভালোবাসেন।পিতার পুরো স্নেহ পাবার লক্ষ্যে তারা ইউসুফকে হত্যা অথবা অজ্ঞাত দেশেতাড়িয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করল।ভাইদের একজন বলল, ইউসুফকে হত্যা করো না, বরং এই গভীর কূপে নিক্ষেপকরলে, কোন পর্যটক কাফেলা তাকে তুলে নিয়েও যেতে পারে।
৭. পিতা তুমি ইউসুফের ব্যাপারে আমাদের উপর ভরসা রাখো না কেন? আমাদের
সঙ্গে ইউসুফকে যেতে দাও, সে খেলে আনন্দে পাবে, আমরা তাকে দেখাশোনা
প্রতিযোগীতায়ইয়াকুব বললেন, তোমাদের অমনোযোগের ফলে পাছে তাকে নেকড়েতে খায়,
এই আশংকায় তোমাদের সঙ্গে তাকে পাঠাতে আমার মন চাইছে না।আমরা এতজন থাকতে সে যদি নেকড়ের মুখে পড়ে তাহলে আগে আমাদেরমরণই শ্রেয়।
১০. এভাবে তারা ইউসুফকে সঙ্গে নিয়ে গেল এবং কূপে ফেলার সিদ্ধান্ত নিল।একদিন ভাইয়েরা এর পরিণাম জানবে।
১১. সন্ধ্যার পরে বাড়ী ফিরে তারা কেঁদে পিতাকে জানাল পিতা- বললে বিশ্বাস,করবে না যে আমরা যখন দৌড় প্রতিযোগিতায় বাহু, তখন আমাদের জিনিসপত্রপাহারারত ইউসুফকে সত্যই নেকড়ে খেয়েছে। তারা ইউসুফের রক্তরাঙা জামাদেখাল।
১২. ইয়াকুব বললেন, তোমাদের বানানো গল্পে আমার কাজ নেই, আমি আল্লাহর
সাহায্যের ভরসায় ধৈর্য ধরে থাকব।
১৩. পর্যটকের কাফেলার এক লোক কুয়ায় পানির জন্যে বালতি ফেললে ইউসুফবালতি চড়ে উঠে এলেন। আর ভাইয়েরা তাকে সামান্য মূল্যে বেচেছিল।
১৪. রাজদরবারের প্রধান উজির (আজিজ ইউসুফকে সওদাগর থেকে ক্রয় করে ঘরে
এনে স্ত্রীকে বললেন, একে সসম্মানে রাখ, এ আমাদের সৌভাগ্যের কারণ হতে
পারে, অথবা আমরা পুত্ররূপেও গ্রহণ করতে পারি। এভাবে ইউসুফ মিশরেপ্রতিষ্ঠিত হলেন। ইউসুফ বয়ঃপ্রাপ্ত হলে আল্লাহ তাঁকে জ্ঞান ও শক্তিদান
করলেন।
১৫. আজিজ-পত্নী দরজা বন্ধ করে তাঁকে সম্ভোগে আহ্বান করলে আতঙ্কিত ইউসুফ
মনিবের প্রতি বিশ্বাসভঙ্গের ভয়ে অসম্মত হলেন, পরে প্রলুব্ধ হওয়ার মুখে তিনি
আল্লাহকে স্মরণ করে বিরত হলেন।
১৬. এবং পালাবার জন্যে দরজার দিকে ধাবমান হলেন, তখন আজিজপত্নী- তাঁর
পিঠের দিকে জামা আকর্ষণ করলে তা ছিঁড়ে গেল আর সে মুহূর্তেই আজিজ দ্বারে
উপস্থিত। আজিজ-পত্নীই জানাল ইউসুফের বদমতলব সম্বন্ধে নালিশ ও দাবীকরল শাস্তি।
১৭. পরিজনের একজন বলল- যদি জামা বুকের দিকে ছিড়ে তাহলে আফ্রিজ পত্নীর
অভিযোগ সত্য। পিঠের দিকে ছেঁড়া হলে, ইউসুফের কথাই সত্যি। আজিজ
বুঝলেন এবং বললেন এ ফাদ তোমারই পাতা। তুমি এ পাপের জন্যে ক্ষমা
১৮. শহরের নারীরা দাস ইউসুফের প্রতি আজিজ-পত্নীর আসক্তির কথা শুনে তার
নিন্দা করতে থাকে। পরপুরুষাসক্তির এ নিন্দা শুনে আজিজ-পত্নী এক
ভোজোৎসবের আয়োজন করে শহরের সব মহিলাকে আমন্ত্রণ করল। সমাগত
সব মুহিলার হাতে চাকু দিয়ে ইউসুফকে এনে তাদের সামনে দাঁড় করাল, তারা
হতভম্ব হয়ে অজ্ঞাতে নিজেদের হাতই কাটল এবং স্বীকার করল যে এ কোন
মতামানবই নয় মহান ফেরেস্তা।
১৯. আজিজ-পত্নী বলে- এ মানুষটির প্রতি আমার আসক্তির জন্যেই তোমরা আমার
নিন্দা করেছ। কিন্তু এ লোক দৃঢ়ভাবে পাপমুক্ত থাকে। কিন্তু এখন যদি সে
আমার আদেশ অমান্য করে, তাহলে সে নিক্ষিপ্ত হবে কারাগারে এবং থাকবে
মন্দলোকের সঙ্গে।
২০. ইউসুফ বলে, 'হে আল্লাহ, যে কাজে তারা আমাকে আমন্ত্রণ করছে, তার চেয়ে
কারাগারই আমার অধিক কাম্য, যদি তুমি আমাকে প্রলোভনের এ ফাঁদ থেকে
বৃক্ষা না কর, তাহলে প্রলুব্ধ হব এবং অজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত হব। আল্লাহ তাঁর কামনা
পূর্ণ করেন। এবং তিনি কারাগারেই ঠাঁই পান
২১. কারাগারে তাঁর সঙ্গে ছিল আরো দুইজন যুবক। দুজনই স্বপ্ন দেখল একজনে
দেখল মদ বানাচ্ছে, অন্যজনে দেখল সে মাথায় রুটি বয়ে নিচ্ছে এবং পাখীরা
তা খাচ্ছে। ইউসুফকে পরহিতকামী জেনে তারা স্বপ্নের ব্যাখ্যা চাইল তার কাছে।
ইউসুফ বললেন- আজকের আহার্য পৌঁছার আগেই এবং এ স্বপ্ন বাস্তবে ঘটবার
আগেই এর তাৎপর্য তোমাদের জানিয়ে দেব, কেননা আল্লাহ আমাকে স্বপ্নতত্ত্ব
শিখিয়েছেন। কেন না আমি আল্লাহতে ও পরলোকে অবিশ্বাসীদের একজন নই।
আমি আমার পিতৃপিতামহের ইব্রাহিমের-ইসহাকের-ইয়াকুবের পথই অনুসরণ
করি।
২২. স্বপ্নের ব্যাখ্যা এই– একজন হবে মনিবের সরাব পরিবেশক এবং অন্য জন
ফাঁসিতে ঝুলবে এবং পাখিরা তার মাথার মাংস খাবে ।
২৩. আসন্নমুক্তি লোকটিকে তার মনিবের কাছে ইউসুফের মুক্তির কথা বলার জন্যেই
ইউসুফ অনুরোধ করেছিলেন, কিন্তু মুক্তি পাওয়ার পরে শয়তান তাকে সে
অনুরোধের কথা ভুলিয়ে রেখেছিল।
২৪. মিশররাজ স্বপ্নে দেখলেন, সাতটি পুষ্ট গরু সাতটি অস্থিচর্মসার গরু গিলে
খাচ্ছে: আর দেখলেন সাছটি সবুজ শস্যছড়া ও সাতটি শসাহীন ছড়া। 'রাজা
এই স্বপ্নের ব্যাখ্যা চাইলেন, তখন ওই মুক্তিপ্রাপ্ত কয়েদী ইউসুফকে স্মরণ করল
এবং তাঁকে এ স্বপ্নের ব্যাখ্যা দেবার জন্যে বলল। ইউসুফ-প্রদত্ত ব্যাখ্যা- এই
সাত বছর সযত্নে ফসল ফলাবে এবং খাওয়ার প্রয়োজন অতিরিক্ত শস্য মৌজুত
করবে, তারপর আসবে সাতটি অজন্মার বছর। তখনতোমরা সঞ্চিত শস্য খাবেএবং সামান্য পরিমাণ শস্য বীজ হিসাবে রাখবে। তারপর আসবে একটি বছরযখন পানি পাবে পর্যাপ্ত এবং তখন সুখী মানুষেরা রস (মদ আর তেল)নিঙড়াবে।
২৫. স্বপ্নের ব্যাখ্যা পেয়ে তুষ্ট রাজা তাঁকে মুক্তি দিতে চাইলে তিনি রাজার মাধ্যমে
শহরের মহিলারা তাঁর সম্বন্ধে কি ধারণা পোষণ করে তা জানতে চাইলেন, রাজা
মহিলাদের জিজ্ঞাসা করলে তারা জানাল যে ইউসুফ নির্দোষ। আজিজ-পত্নীও
জানালেন, সভ্য এখন একটিত, আমিই তাকে প্রলুব্ধ করতে চেয়েছিলাম। সে
সত্যবাদীদেরই একজন। তার অনুপস্থিতিতে আমি তার প্রতি মিথ্যাচারী ছিলাম
না এবং আল্লাহ ষড়যন্ত্রকারীর সহায় নন।
২৬. রাজা যখন ইউসুফকে চাকরী দিলেন তখন ইউসুফ তাঁকে আশ্বস্ত করে বললেন,
আমি বিশ্বস্ততার সঙ্গে কর্তব্য করব। আমাকে ধন-ভাণ্ডারের দায়িত্ব দিন, আমি
এর গুরুত্ব জানি, কাজেই আমি তা সযত্নে রক্ষা করব। এভাবে আল্লাহ
ইউসুফকে মিশরে সুপ্রতিষ্ঠিত করলেন।
২৭. ইউসুফের দুর্ভিক্ষতাড়িত ভাইয়েরা তাঁর কাছে এল, তিনি তাদের চিনলেন, কিন্তু
তারা তাঁকে চিনতে পারল না। তাদের যোগ্যমতো খাদ্যশস্য দিয়ে তিনি বললেন,তোমাদের বৈমাত্রেয় ভাইকে আমার কাছে নিয়ে আসবে। দেখছ না আমি মাপেঊন দিই না এবং আমার আতিথেয়তাও নিখুঁত, শ্রেষ্ঠতম। যদি তাঁকে না আন
তাহলে এককণা শস্যও পাবে না এবং আমার কাছেওঘেঁষতে পারবে না। আমরাঅবশ্যই পিতাকে বলে তাকে আনব।
২৮. তারপর তাদের কেনা শস্যের মূল্য তাদের শস্যপূর্ণ বস্তার নীচে রেখে দেয়ার
জন্যে ইউসূফ তাঁর লোককে নির্দেশ দিলেন, যাতে ভাইয়েরা বাড়ি ফিরে গিয়েসে-অর্থ দেখতে পেয়ে আবার মিশরে ফিরে আসে।
২৯. বাড়ি ফিরে তারা পিতাকে জানাল, ইবন ইয়ামীনকে (বেনজামিনকে সঙ্গে নিয়ে
না গেলে আমাদের আর শস্য দেয়া হবে না, অতএব তাকে আমাদের সঙ্গে দিন,
আমরা তাকে যত্নে রাখব। পিতা বললেন, পূর্বে ইউসুফের ক্ষেত্রে যা ঘটেছে তার
ব্যতিক্রম ঘটাবে এমন বিশ্বাস কি আমি তোমাদের উপর রাখতে পারি। আল্লাহই
সর্বশ্রেষ্ঠ সংরক্ষক।
৩০. বস্তা খুলে যখন তারা দেখল যে শস্যমূল্য ফেরত দেয়া হয়েছে, তখন তার প্রতিপিতার দৃষ্টি আকর্ষণ করে তারা বলল, 'আমরা আরো বেশী শস্য পাব, আমরাআমাদের ভাইকে যত্নে রাখব, তাকে নিলে উট-বোঝাই শস্য আনতে পারব।'
৩১. ইয়াকুব বললেন “যতক্ষণ না তোমরা আল্লাহর নামে শপথ করছ যে তোমরা
তাকে সযত্নে ফিরিয়ে আনবেই, যদি না তোমরা নিজেরাশত্রু বেষ্টিত হয়েহতবল হয়ে পড়"। তারা শপথ করল। ইয়াকুব আল্লাহর উপর ভরসা রেখেতাঁকে সাক্ষী ও সংরক্ষক করে বেনজামিনকে ভাইদের সঙ্গে দিলেন। এবং যাত্রারসময়ে পরামর্শ দিলেন ‘পুত্রগণ, তোমরা সবাই এক দরজা দিয়ে প্রবেশ করোনা। তাঁরা তা-ই করল। এতে আল্লাহর ইচ্ছাতিরিক্ত কোন ফল হবে না বটে,
তবে পিতৃ হৃদয়ে তুষ্টি মিলবে মাত্র।
৩২. যখন তারা ইউসুফের কাছে এল, তখন ইউসুফ সহোদরকে গ্রহণ করলেন এবং
কাছে রাখলেন আর বললেন, 'দেখ', আমিই তোমার হৃত সহোদর ভাই, ওদেরদুষ্কর্মের জন্যে দুঃখ করো না। তারপর ভাইদের শসা দেয়া হল এবং ইউসুফেরঅভিপ্রায়ক্রমে একটি পানপাত্র বেনজামিনের বস্তার নীচে গুঁজে রেখে একজনমহিলাদের জিজ্ঞাসা করলে তারা জানাল যে ইউসুফ নির্দোষ। আজিজ-পত্নী ও
জানালেন, সভ্য এখন প্রকটিত, আমিই ডাকে প্রলুব্ধকরতে চেয়েছিলাম। সেসত্যবাদীদেরই একজন। তার অনুপস্থিতিতে আমি তার প্রতি মিথ্যাচারী ছিলামনা এবং আল্লাহ ষড়যন্ত্রকারীর সহায় নন।
২৬: রাজা যখন ইউসুফকে চাকরী দিলেন তখন ইউসুফ তাঁকে আশ্বস্ত করে বললেন,
আমি বিশ্বস্ততার সঙ্গে কর্তব্য করব। আমাকে ধন-ভাণ্ডারের দায়িত্ব দিন, আমি
এর গুরুত্ব জানি, কাজেই আমি তা সযত্নে রক্ষা করব।এভাবে আল্লাইসুফকে মিশরে সুপ্রতিষ্ঠিত করলেন।
২৭. ইউসুফের দুর্ভিক্ষতাড়িত ভাইয়েরা তাঁর কাছে এল, তিনি তাদের চিনলেন, কিন্তুতারা তাঁকে চিনতে পারল না। তাদের যোগ্যমতো খাদ্যশস্য দিয়ে তিনি বললেন,তোমাদের বৈমাত্রেয় ভাইকে আমার কাছে নিয়ে আসবে। দেখছ না আমি মাপেঊন দিই না এবং আমার আতিথেয়তাও নিখুঁত, শ্রেষ্ঠতম। যদি তাঁকে না আন
তাহলে এককণা শস্যও পাবে না এবং আমার কাছেও ঘেঁষতে পারবে না। আমরাঅবশ্যই পিতাকে বলে তাকে আনব।
২৮. তারপর তাদের কেনা শস্যের মূল্য তাদের শস্যপূর্ণ বস্তার নীচে রেখে দেয়ারজন্যে ইউসুফ তাঁর লোককে নির্দেশ দিলেন, যাতে ভাইয়েরা বাড়ি ফিরে গিয়ে।
সে-অর্থ দেখতে পেয়ে আবার মিশরে ফিরে আসে।
২৯. বাড়ি ফিরে তারা পিতাকে জানাল, ইবন ইয়ামীনকে বেনজামিনকে সঙ্গে নিয়ে
না গেলে আমাদের আর শস্য দেয়া হবে না, অতএব তাকে আমাদের সঙ্গে দিন,আমরা তাকে যত্নে রাখব। পিতা বললেন, পূর্বে ইউসুফের ক্ষেত্রে যা ঘটেছে তার
ব্যতিক্রম ঘটাবে এমন বিশ্বাস কি আমি তোমাদের উপর রাখতে পারি। আল্লাহ্ই
সর্বশ্রেষ্ঠ সংরক্ষক।
৩০. বস্তা খুলে যখন তারা দেখল যে শস্যমূল্য ফেরত দেয়া হয়েছে, তখন তার প্রতিপিতার দৃষ্টি আকর্ষণ করে তারা বলল, 'আমরা আরো বেশী শস্য পাব, আমরাআমাদের ভাইকে যত্নে রাখব, তাকে নিলে উট-বোঝাই শস্য আনতে পারব।'
৩১. ইয়াকুব বললেন “যতক্ষণ না তোমরা আল্লাহর নামেশপথ করছ যে তোমরা
তাকে সযত্নে ফিরিয়ে আনবেই, যদি না তোমরা নিজেরা শত্রু বেষ্টিত হয়েহতবল হয়ে পড়"। তারা শপথ করল। ইয়াকুব আল্লাহর উপর ভরসা রেখেতাঁকে সাক্ষী ও সংরক্ষক করে বেনজামিনকে ভাইদের সঙ্গে দিলেন। এবং যাত্রারসময়ে পরামর্শ দিলেন ‘পুত্রগণ, তোমরা সবাই এক দরজা দিয়ে প্রবেশ করোনা। তাঁরা তা-ই করল। এতে আল্লাহর ইচ্ছাতিরিক্ত কোন ফল হবে না বটে,তবে পিতৃ হৃদয়ে তুষ্টি মিলবে মাত্র।
৩২. যখন তারা ইউসুফের কাছে এল, তখন ইউসুফ সহোদরকে গ্রহণ করলেন এবংকাছে রাখলেন আর বললেন, 'দেখ', আমিই তোমার হৃত সহোদর ভাই, ওদের
দুষ্কর্মের জন্যে দুঃখ করো না। তারপর ভাইদের শস্য দেয়া হল এবং ইউসুফেরঅভিপ্রায়ক্রমে একটি পানপাত্র বেনজামিনের বস্তার নীচে গুঁজে রেখে একজন
চিৎকার করে বলে উঠল, "এই কাফেলাওয়ালা তোমরা নিশ্চিতই চোর।” ওরা
জিজ্ঞাসা করল, 'তোমরা কি হারিয়েছ?' উত্তরে জানাল, 'আমরা রাজার বহুমূল্য
বৃহৎ পানপাত্র হারিয়েছি। যে তা খুঁজে পাবে, তাকে উট বোঝাই মালে পুরস্কৃত
করা হবে। ভাইয়েরা বলল আমরা চোর নই, আমরা কারো কোন ক্ষতি করবার
জন্যে এদেশে আসিনি।' যদি তোমরা মিথ্যা বল [অর্থাৎ যদি তোমাদের কাছে
হৃত মাল পাওয়া যায়। তাহলে তোমাদের কি শাস্তি হওয়া উচিত? যার বস্তার
মধ্যে তা পাওয়া যাবে তাকে বেঁধে রেখে তার অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে।
যখন ইউসুফ স্বয়ং তাঁর সহোদরের বস্তা থেকে পানপাত্র বের করলেন এবং
আল্লাহর ইচ্ছায় ইউসুফের পরিকল্পনা বাস্তব রূপ পেল।
৩৩. ভাইয়েরা বলল-পিতা বৃদ্ধ ও মানী ব্যক্তি। তিনি এর জন্যে শোকাভিভূত হবেন।
তার বদলে আমাদের কাউকে বন্দী রাখুন। চোরকে বাদ দিয়ে অন্য কাউকে বন্দী
রাখলে অন্যায় করা হবে। নিরুপায় হয়ে ভাইয়েরা নিজেদের মধ্যে পরামর্শে
বসল, তখন ভাইয়ের মধ্যে যে নেতা সে বলল, 'পিতার কাছে তোমাদের
শপথের কথা কি মনে নেই, তোমরা ইউসুফের প্রতি দায়িত্ব কি করে ভুললে?
কাজেই পিতার অনুমতি বা আল্লাহর নির্দেশ ব্যতীত আমি এ অপরাধের কারণে
এদেশ ত্যাগ করব না।
৩৪. তোমরা পিতাকে বল- 'পিতা, তোমার সন্তান চুরি করেছিল, আমরা যা জানি
কেবল তারই (সাক্ষ্য) বর্ণনা দিতে পারি, যা অদৃশ্য তার প্রতি সতর্ক পাহারা
দেয়া চলে না। [মিশর] শহরবাসীদের এবং কাফেলার অন্যান্যদের জিজ্ঞাসা করো
দেখ, আমরা সত্য কথাই বলছি।
৩৫. ইয়াকুব বললেন- তোমরা তোমাদের স্বার্থে গল্প বানিয়ে বলতে পারো, আমার
ধৈর্য ধরা ছাড়া উপায় নেই, হয়তো আল্লাহ পরিণামে সবার সঙ্গেই মিলন
ঘটাবেন।
৩৬. ইয়াকুব স্বগত বললেন- 'ইউসুফের জন্যে আমার শোক কত গভীর। এবং তাঁর
চোখ দুঃখে সাদা হয়ে গেল এবং বিষণ্নতা তাঁকে আচ্ছন্ন করল। তারা বলল,তুমি ইউসুফকে ভাবতে ভাবতে অসুস্থ হয়ে মরবে। বললেন, 'আমি কেবলআল্লাহকেই আমার মনস্তাপ ও যন্ত্রণার কথা জানাই। হে পুত্রগণ যাও ইউসুফ, ওতার ভাইয়ের সন্ধান নাও, আল্লাহর দয়ার আশা কখনো ত্যাগ করো না।'
৩৭. ইউসুফের কাছে ফিরে এসে ভাইয়েরা বলল, “হে মান্যবর, আমরা সপরিবারেদুঃখ দারিদ্র্যে পড়েছি, এ সামান্য পুঁজি নিয়ে এসেছি, আমাদের দান হিসেবেইপুরো মাপের শস্য দিন। তোমরা ইউসুফ ও তার ভাইয়ের প্রতি কিরূপ ব্যবহারকরেছ, স্মরণ কর।' 'তুমিই কি সত্যি ইউসুফ।' তিনি উত্তরেজানালেন, “আমিইইউসুফ এবং এ আমার সহোদর। আল্লাহ আমাদের প্রতি সদয়, দেখ তিনিন্যায়বান ও ধৈর্যশীলকে পুরস্কৃত করেনই।" আল্লাহর দোহাই তিনি আমাদেরউপরে তোমাকে শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন এবং অপরাধ করেআমরা পাপী। ইউসুফবললেন, 'আজ আর তিক্ত কথা স্মরণে কাজ নেই, আল্লাহ তোমাদের ক্ষমাকরবেন। আমার এই জামা নিয়ে যাও, পিতার মুখের কাছে ধরবে, তিনিদৃষ্টিশক্তি ফিরে পাবেন। এবং পিতাকে সপরিবার এখানে নিয়ে এসো।'
৩৮. কাফেলা মিশর ত্যাগ করার সঙ্গে সঙ্গেই পিতা বললেন, 'আমি সত্যই ইউসুফের
উপস্থিতি অনুভব করছি।' অন্যেরা বলল 'বার্ধক্যবশে তুমি তোমার পুরোনোমতিভ্রমে পড়েছ।' যখন ইউসুফের জামা এনে পিতার মুখমণ্ডলে রাখা মাত্রইপিতা দৃষ্টিশক্তি ফিরে পেলেন, পিতা বললেন, 'আমি তোমাদের বলিনি যে আমিআল্লাহ থেকে তা-ই জানি, তোমরা যা জান না?' তারা বলল, 'পিতা, আমাদেরপাপের জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করো, আমরা সত্যই দোষ করেছি।' পিতা বললেন,'আল্লাহর ক্ষমা আমি তোমাদের জন্যে চেয়ে নেব, তিনি দাতা ও দয়ালু।”
৩৯. তারা যখন ইউসুফের কাছে উপস্থিত হল, তিনি পিতামাতাকে নিজের বাড়িতেরাখলেন, আল্লাহর দয়ায় নিরাপদে মিশরে প্রবেশ করুন। তিনি পিতামাতাকেমর্যাদার তখতে উঠালেন, ভাইয়েরা তাকে আনুগত্যের সেজদা বা প্রণিপাতকরল। ইউসুফ বললেন ‘পিতা, আমার পুরোনো স্বপ্ন আজ বাস্তব হল, আল্লাহএকে সত্যে পরিণত করলেন, দয়ালু আল্লাহ আমাকেকারামুক্ত করেন, ভাইদেরমধ্যে শয়তান যে শত্রুতার বীজ বপন করেছিল, তা ব্যর্থ করে দিয়ে মরুভূ থেকে
তোমাদের এখানে আনলেন নিশ্চয়ই আল্লাহ সব রহস্যের জ্ঞাতা, সব কর্মেরকর্তা। এসব বৃত্তান্তে বুধজনের জন্যে রয়েছে উপদেশ, এটি বানানো গল্প নয়,
অতীতে যা ঘটেছে তারই প্রত্যায়ন মাত্র।
শাহ মুহম্মদ সগীরের কাব্যের কাহিনীসার---
বাংলা সাহিত্যে মুসলমানদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ দান যে বর্তমান, সে সম্বন্ধে
কোন দ্বিমত নাই। তবে এ-কথা সচরাচর বলা হয় যে, বাংলা সাহিত্যে মুসলমানদের
তরোদ্ধ দান অনেক পূর্ববর্তী এবং প্রত্যক্ষ দান বহু পরবর্তী সপ্তদশ শতাব্দীর ঘটনা।
মুসলমানেরা খ্রীষ্টীয় ত্রয়োদশ শতাব্দী হইতে যে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে পরোক্ষভাবে
প্রভাব বিস্তার করিয়া আসিয়াছে, ইহা ঐতিহাসিক ব্যাপার হইলেও সপ্তদশ শতাব্দীর
অন্ততঃ দুই শতাব্দী পূর্ব হইতে বাংলা সাহিত্যে তাঁহাদের প্রত্যক্ষ দান যে বিদ্যমান
ছিল, ইহাও বর্তমানে একটি ঐতিহাসিক সত্যে পরিণত হইয়াছে। শাহ মুহম্মদ সগীর
নামক এক মুসলিম কবির ‘ইউসুফ জলিখা' নামক একটি বাংলা কাব্যের আবিষ্কারেই
এই ঐতিহাসিক সত্যটি প্রতিষ্ঠিত। এই কাব্যের রাজ-প্রশস্তি হইতে জানিতে পারা যায়,
গৌড়ের সুলতান গিয়াসুদ-দীন আজম শাহের রাজত্বকালে (১৩৯৭-১৪১০থী) কবি
এই কাব্য রচনা করিয়াছিলেন। সুতরাং "ইউসুফ-জলিখা " খ্রীষ্টীয় পঞ্চদশ শতাব্দীর
প্রথম দশকের কাবা
ইউসুফ - জলিখার প্রণয়-কাহিনী অতি প্রাচীন। বাইবেল ও কুরআনে ‘প্যারাবোল'
বা নৈতিক-উপাখ্যান হিসাবে এই কাহিনী সংক্ষেপে বর্ণিত হইয়াছে। এই সংক্ষিপ্ত মূল
কাহিনীকে পল্লবিত করিয়া ইরানের মহাকবি ফিরদৌসী (মৃত ১০২৫ খ্রী:) ও সুফী কবি
জামী (মৃত ১৪৯২ খ্রী:) তাঁহাদের ইউসুফ জলিখা' নামক কাব্য দুইখানি রচনা
করিয়াছিলেন। ফিরদৌসীর “ ইউসুফ-জলিখা" একটি রমন্যাস বা রোমাঞ্চ এবং জামীর
"ইউসুফ জলিখা” একটি ‘এলিগরিক্যাল এপিক বা রূপক কাব্য। বিষয়বস্তু বা
অনুবাদগত দিক হইতে সগীরের কাব্যের সহিত উক্ত কাব্যদ্বয়ের কোনটিরই হুবহু মিল
নাই। তবে, সগীরের কাব্য ফিরদৌসীর কাব্যের ন্যায় রমন্যাস বটে। জামী তাঁহার
পরবর্তী কবি; সুতরাং তাহার কথা উঠেই না। ইহা হইতে অনুমিত হয় যে, কুরআন ও
ফিরদৌসীর কাব্য ব্যতীত মুসলিম-কিংবদন্তীতে ও স্বীয় সৃজনী-প্রতিভায় নির্ভর করিয়াই
শাহ মুহম্মদ সগীর তাঁহার “ইউসুফ- জলিখা" কাব্য রচনা করিয়াছিলেন।
১. “ইউসুফ-জলিখা' কাব্যের রাজ-বন্দনাটি নিচে উদ্ধৃত হইল :
তিরতিএ পরণাম করোঁ রাজ্যক ঈশ্বর।
বাঘে ছাগে পানি খাত্র নিভয় নির্ভর
রাজ রাজশ্বর মৈছে ধার্মিক পণ্ডিত।
দেব অবতার নির্ণ জগত বিদিত।
মনুষের মৈদ্ধে জেহ ধর্ম অবতার।
মোহানরপতি গোছ পিরথিথির সার।
ঠাঁই ঠাঁই ইচ্ছে রাজা আপনা বিজএ।
কবি শাহ মুহম্ম সগীরের জীবন-কথা জানা যায় না। কেননা, তাহার কাব্যে
আত্মবিবরণী বলিতে সচরাচর যাহা বুঝাইয়া থাকে, তাহা তিনি লেখেন না।
ch অনুমান করা যাইতে পারে যে, তিনি দরবেশ-বংশে জন্ম
করিয়াছিলেন। তাঁহার কাব্যের অধিকাংশ পাণ্ডুলিপি চট্টগ্রাম ও একটি খণ্ডিত পাণ্ডুলিপি
ত্রিপুরায় আবিষ্কৃত হওয়ায়, বিশেষতঃ তাঁহার কাব্যে ব্যবহৃত কতকগুলি বিশিষ্ট শব্দ
আজও চট্টগ্রামী বাংলা উপভাষায় ব্যবহৃত হয় বলিয়া, অন্য প্রমাণের অভাবে ধরিয়া।
লওয়া যাইতে পারে যে, তিনি চট্টগ্রাম জিলার অধিবাসী ছিলেন।
একমাত্র "ইউসুফ-জলিখা” ব্যতীত কবি শাহ মুহম্মদ সগীরের অন্য কোন কারা
কবিতা আজ পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয় নাই। ইহাতে তিনি অন্য কোন কাব্য রচনা করেন।
নাই,—এমন মনে করার কোন সঙ্গত কারণ নাই। আলোচ্য কাব্যখানি পাঠ করিতে
দেখা যায়, ইহা বেশ পরিণত রচনা। তাঁহার ভাষা প্রাচীন বটে, তবে কাঁচা হাতের
লেখা নহে। ইহা রচনার পূর্বে তিনি অন্য লেখায় হাত পাকাইয়া থাকিবেন।
কাব্যটিতে কোন বিদেশী আবহ নাই বলিলেও চলে। বাংলার পরিবেশ এই
কাব্যের রক্তমাংস ও বাংলার আবহ ইহার প্রাণ বলিয়া কাব্যখানি পাঠ করিতে মনেই হয়
না যে, ইহা কোন বিদেশীয় পুস্তকের অনুবাদ অথবা ভাবানুবাদ। তবে, তিনি কিতাব
কোরান দেখিয়া কাব্য রচনা করিয়াছেন বলিয়া প্রচার করিতেও কসুর করেন নাই।
ইউসুফের সর্বকনিষ্ঠ ভ্রাতা বনী য়ামীনের সহিত মধুপুরীর (ভাওয়ালের অন্তর্গত 'মধুপুর'
কি?) গন্ধর্বরাজকন্যা বিষুপ্রভার বিবাহ-কাহিনী কোন কিতাব-কোরানে পাওয়া গিয়াছিল,
বলিতে পারি না। এই সমস্ত দেখিয়া শুনিয়া মনে হয়, কাব্যখানি মুসলিম কিংবদন্তী
নির্ভর রচনা।
"""
পুত্র সিসা হস্তে তিঁহ মাগে পরাজবা
মোহাজন বাক্য ইহা পুরণ করিত্র।
লইলেন্ড রাজপাট বঙ্গাল গৌড়িআ
করুণা হীদএ রাজা পুণ্যবন্ত তর
সবগুণে অসীম অতুল মনোহর ....
রমণী বল্লভ নির্গ রসে অনুপমা
কনে বা কহিতে পারে সে গুণ মহিমাচ
জিনিলা নিপতি সব করিআ সময়।
জএবাদ্য দুন্দুমি বাহন্ত উৎসর
জাবত জীবন মুঞি দেখিট্হি কাম।
তান ভক্তি বিনা ধিক নাহি আর ধাম।
মোহাম্মদ ছগির তান আজ্ঞাক অধীন।
তাহান আছুক জস তুবন এ তিন"""
বলা বাহুল্য, এখানে যে 'গোছ' বা গিয়াসুদ্দীন রাজার নাম উল্লেখ করা হইয়াছে, তিনি যুদ্ধে
পিতাকে পরাজিত করিয়া তাঁহার নিকট হইতে বাংলা ও 'গৌড়' রাজা দখল করেন। কবি 'গোছ'-কে
পিতৃহন্তা না বলিয়া, কৌশলে ব্যাজবুতিতে বলিয়াছেন- ইনি সেই গিয়াস, যিনি সংস্কৃত মহাজন বাকা
সর্বত্র বিষয়নিচ্ছে, পুরাৎ শিষ্যাৎ পরাজয়ম" (অর্থাৎ মানুষ সর্বত্র নিজের বিজয় কামনা করে; কিন্তু পুর
ও শিষ্যের কাছ হইতে পরাজয় চায়) পূর্ণ করিয়া 'বঙ্গ' ও 'গৌড়' দেশ জয় করিয়াছেন। এই গিয়াস
বাংলার ইতিহাসের গিয়াসুদ্দীন আজম শাহ ব্যতীত আর কেহ নহেন। তিনি ১৩৯৭ খ্রীষ্টাব্দ হইতে ১৪১০
-খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন।
আল্লাহ ও রসুল, মাতাপিতা ও গুরুজন এবং রাজবন্দনান্তে “ইউসুফ-জলিখা "
কাব্য আরম্ভ হইয়াছে। কাব্যবর্ণিত কাহিনী সংক্ষেপে এইরূপ :
পশ্চিম দেশে তৈমুস) নামে এক প্রবল প্রতাপশালী রাজ্য ছিলেন। তিনি বহুদিন
নিঃসন্তান থাকিয়া অনেক দানধর্ম করার পর এক কন্যারত্ন লাভ করেন। অতি আনন্দে
ও যত্নে কন্যার নাম রাখা হয় 'জলিখা'। যথাকালে জলিখা বয়ঃপ্রাপ্তা হইলেন । তাঁহার
সর্বাঙ্গে যৌবনশ্রী ঠিকরিয়া পড়িতে লাগিল। যে তাঁহাকে দেখিল, সে-ই ভাবিতে
বৈশ বেশ সভেস অলক বন্ধ ফন্দি।
সুরপুরী হুরী কিবা হেরি কাম বন্দী ......
“নহলী যৌবনী কন্যা সর্ব কলাজিত।
শরৎ চন্দ্রিমা জেহ্ন নক্ষত্র বেষ্টিত।
এই সময়ে জলিখা একে একে তিন বৎসরে তিনবার স্বপ্নে এক সুপুরুষকে দেখিয়া
তত্পতি প্রেমাসক্তা হইলেন। তিনি আর কেহ নহেন, মিসরাধিপতি আজিজ-মিসর।
তৈমুস-রাজ তাঁহার কন্যা জোলেখাকে আজিজ-মিসরের সহিত বিবাহ দিবার জন্য
মিসরে দূত প্রেরণ করিলেন। দৌত্য সফল হইল; আজিজ-মিসর তৈমুস রাজকন্যা
জলিখাকে বিবাহ করিতে রাজি হইলেন। জলিখা যথাসময়ে মিসরে প্রেরিত হইলেন।
তাঁহার সহিত আজিজ মিসরের দেখা হইল। হায়! জলিখা দেখিলেন যে, এই আজিজ
সেই ‘আজিজ' নহে। অথচ ইহাকেই বিবাহ করিতে হইবে, এই কথা ভাবিয়া, জলিখার
মাথায় আকাশ ভাঙ্গিয়া পড়িল। তিনি সখীগণকে ডাকিয়া গদগদ কন্ঠে আক্ষেপ করিতে
লাগিলেন :
...এই দিকে কেনান দেশে ইয়াকুব নামে এক নবী ছিলেন; তাঁহার দুই স্ত্রী। প্রথমা
স্ত্রীর গর্ভে ইয়াকুব নবীর দশ পুত্র এবং দ্বিতীয়া স্ত্রীর গর্ভে এক কন্যা ও দুই পুত্র
জন্মগ্রহণ করেন। এই দুই পুত্রের মধ্যে এক জনের নাম ইউসুফ' এবং অপরটির নাম
‘বনী আমীন' বা ইবনে আমীন' রাখা হয়। ইউসুফ এমন সুপুরুষ ছিলেন যে, তাঁহার
ভুবনমোহন রূপ দেখিয়া অন্যের কথা দূরে থাকুক স্বয়ং ইয়াকুব নবীও মুগ্ধ হইয়া
গিয়াছিলেন। ফলে :
ইয়াকুব নবীর ইছুফ জেহ্ন আঙ্খি
সর্বক্ষণ ইছুফ নয়ানে থাকে পেখি |
ইয়াকুব নবীর বাসভবনে একটি ধর্মতর ছিল। তাঁহার এক এক পুত্রের জন্মকালে
এই বৃক্ষে একটি করিয়া শাখা অঙ্কুরিত হইত। সন্তান বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শাখাটিও
বড় হইত এবং ইয়াকুব নবী তাহা কাটিয়া যষ্টি বানাইয়া পুত্রকে দান করিতেন। যখন
ইউসুফ জন্মগ্রহণ করিলেন; তখন এই বৃক্ষে আর ডাল নির্গত হইল না। ইহা লক্ষা
করিয়া ইয়াকুব নবী আল্লার কাছে ইউসুফের জন্য একটি যষ্টি ভিক্ষা করিলেন। ফলে
স্বর্গ হইতে এক 'আসা' বা যষ্টি নামিয়া আসিল। ইয়াকুব নবী ইহা ইউসুফকে দান
করিলেন; আর
হেন 'আছা' দেখিআ ইছুফ করগত।
সর্বলোকে কহিলেন্ত আছার মহত্ত্ব
ইহাতে ইউসুফের ভ্রাতৃগণ দেখিল যে, তিনি শুধু পিতার স্নেহ অত্যধিক মাত্রায়
লাভ করিতেছেন এমন নহে, বরং স্বর্গীয় 'আসা' প্রাপ্তিতেও সৌভাগ্যবান। সুতরাং,
তৎপ্রতি তাঁহার ভ্রাতৃবর্গের ঈষা পোষণ করা একটি মামুলী ও স্বাভাবিক ব্যাপারে
দাঁড়াইয়া গেল। এমন সময় ইউসুফ স্বপ্নে দেখিলেন,
একাদশ নক্ষত্র আওর রবিশশী।
অষ্টাঙ্গে প্রণাম করে ভূমিতলে পশি
এই অদ্ভুত স্বপ্নের কথা তিনি পিতাকে কহিলেন। পিতা এই স্বপ্ন কাহারও কাছে
ব্যক্ত করিতে ইউসুফকে নিষেধ করিলেন। দুর্ভাগ্যবশতঃ, ইহাতে কোন ফল হইল না।
কারণ
""নিভৃতে ইছুক্ত তরে করিলা নিষেধ।
দৈববলে কেহ তাকে করিলেক ভেন।
এহি কথা ভাই সবে সকল শুনিল।
বিধির নির্বন্ধ কেহ খাইতে নারিল।"""
অতঃপর ভ্রাতৃগণের মধ্যে ইউসুফকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র চলিল। ঠিক হইল যে,মুগয়া করার ছলে ইউসুফকে বনে লইয়া গিয়া হত্যা করিতে হইবে। ইউসুফকে সঙ্গেহইয়া বনে মৃগয়া করিতে যাইবার প্রস্তাবটি যথাসময়ে ইয়াকুব নবীর নিকট পেশ করা
হইল। নবী এই প্রস্তাবে সম্মতি দিলেন না। তখন ভ্রাতৃগণ ইউসুফকে নানা কথা বলিয়া
ভুলাইয়ার চেষ্টা করিলেন এবং চেষ্টায় সফলকামও হইলেন। ইউসুফ পিতার নিকট
হয়না ধরিয়া ভ্রাতৃগণের সহিত মৃগয়া করিতে বনে গমন করিলেন। বনে পৌঁছিলে
ষড়যন্ত্র অনুসারে ভ্রাতৃগণ ইউসুফের শরীর হইতে কাপড়-চোপড় খসাইয়া লইল, এবং
অকস্মাৎ সকলে মিলিয়া তাহাকে আক্রমণ করিল। ফলে, তাঁহাকে
""কোহ ভাই ক্রুদ্ধ হই মারে অনুরাগে।
আর ভাই নিকটে জায়ন্ত দয়াভাগে।
সেহো ভাই ঠেলা দিআ ফেলে এক পাশ।
আর ভাই কাছে জাএ হইয়া হতাশ।
সেহো ভাই নিদয়া হিদয় হৈআ মারে।
আর ভাই নিকটে জায়ন্ত বস্তু আড়ো।
কোহ্ন ভাই মায়া নাহি সবে মারে বেড়ি।
কান্দিতে লাগিলা তবে বাপ অনুস্মরিঃ""
সকলে বলিতে লাগিলেন ইউসুফকে এই সুযোগে মারিয়া ফেল। কিন্তু জ্যেষ্ঠভ্রাতা
তাঁহাকে এইভাবে মারিতে দিলেন না। তাঁহার হস্তক্ষেপে ইউসুফকে বনমধ্যে এক কূপে
নিক্ষেপ করা হইল। কূপে পড়িবার সময় ইউসুফকে ফিরিশ্তারা ধরিয়া ফেলিলেন এবং
স্বর্গ হইতে একটি সুন্দর পাট আনিয়া তাঁহাকে দেওয়া হইল। তিনি সেই স্বর্গীয় পাটধরিয়া কূপের মধ্যে ভাসিতে লাগিলেন।
ইউসুফের বস্ত্র লইয়া তাঁহার ভ্রাতৃগণ সানন্দে বাড়ি ফিরিতেছিলেন; এমন সময়
পিতার নিকট ইউসুফ-হত্যার কি কৈফিয়ৎ দিবে, সে চিন্তা তাহাদের মনে দেখা দিল।
পরামর্শের পর স্থির হইল যে, ইউসুফকে বনে বাঘে খাইয়াছে বলিয়া প্রচার করিতে
হইবে এবং তাহার নিদর্শনস্বরূপ ইউসুফের কাপড় ছিড়িয়া তাহাতে রক্ত মাখিয়া
পিতাকে ব্যাঘ্র কর্তৃক ইউসুফ হত্যার প্রমাণ দিতে হইবে। তাহাই করা হইল। ইয়াকুব
নদী রূপট-কাহিনী বিশ্বাস না করিয়া তাহার পুত্রগণকে ইউসুফহন্তা বাঘটি ধরিয়া
হানিতে আদেশ দিলেন। পুত্রেরা বাধ্য হইয়া বন হইতে এক বাঘ ধরিয়া আনিল। কিন্তু,
বনের পশু বলিল যে, নবী বা নবীবংশের কাহারও মাংস বাঘ খায় না। সেও ইউসুফকে
হত্যা করে নাই। আসল ব্যাপারটি যে কি, তাহা সমারূপে বুঝিতে পারিয়া, ইয়াকুব
পুত্রশোকে দিন যাপন করিতে লাগিলেন।
ক্ষণিকর নামে মিশরে এক মহাবণিক বাস করিতেন। তিনি এই সময়ে বহু বণিক
ও লোকজন সঙ্গে লইয়া 'কেনান' অভিমুখে বাণিজ্যের জন্য যাত্রা করিয়াছিলেন।
বলাবাহুল্য,
এহি সাধু পূর্বকালে স্বপ্ন দেখিছিল।
পূর্ণিমার শশী তার ঘরেত পইসিলা
বহুদিন এমন কোন সৌভাগ্য তাঁহার হয় নাই। ফলতঃ, তিনি একরূপ স্বপ্নের কথা
ভুলিয়াই গিয়াছিলেন। তাঁহার নেতৃত্বে বণিক-গোষ্ঠী যখন সীমান্তে অবস্থিত অরণাধী
অতিক্রম করিতেছিলেন, তখন তাঁহাদের মধ্যে পানীয় জলের অভাব দেখা দিল।
তাঁহারা বাধ্য হইয়া এই অরণ্যে তাঁবু ফেলিয়া জলের সন্ধানে বাহির হইলেন। কিয়দূরে
এক জলপূর্ণ কূপের মিলিল। সুদীর্ঘ রসিতে কলসী (ঘড়া) বাঁধিয়া জল তুলিতেকূপ মধ্যে ফেলা হইল । কি আশ্চর্য, কলসীতে বসিয়া জলের সহিত এক অনিন্দ্যসুন্দরযুবক উঠিয়া আসিল। তাঁহার রূপ দেখিয়া সকলে বিমোহিত হইয়া তাঁহাকে সাধুর নিকটলইয়া গেল। ইউসুফকে দেখিয়া সাধু মনে মনে ভাবিলেন, এতদিনে তাঁহার স্বপ্ন সফল
হইয়াছে। এইবার তাঁহাকে বিনা বাণিজ্যে দেশে ফিরিয়া যাইতে হইবে। ভাল করিয়া
ইউসুফের মুখ ঢাকিয়া দিয়া 'মণিরু' তাঁহার দলীয় শ্রেষ্ঠিবর্গকে আহারান্তে দেশে ফিরিয়া
যাওয়ার আদেশ দিলেন।সকলেই আহারের আয়োজনে ব্যস্ত। এমন সময় ইয়াকুব নবীর দশ পুত্র, তখনও
ইউসুফ কূপমধ্যে বাঁচিয়া আছেন কিনা, পরীক্ষা করিয়া দেখিতে আসিয়া, শূন্যরূপ
দর্শনে ইউসুফের অনুসন্ধানে বাহির হইল এবং বণিকদের মধ্যে ইউসুফকে আবিষ্কার
করিয়া ক্রুদ্ধ হইয়া বলিল যে, তাহাদের এই দুরাচারী দাস' নিজের অসৎকর্মের জন্য
কূপে নিক্ষিপ্ত হইয়াছিল; তাহাকে তাঁহারা ঐ কূপ হইতে উঠাইয়া লইয়াছেন কেন?দাসটিকে হয় যথোপযুক্ত অর্থ দিয়া কিনিয়া লইতে হইবে, না হয় তাহাদের কাছেফিরাইয়া দিতে হইবে; নতুবা তাহাদের সহিত যুদ্ধ করিয়া তাহাকে লাভ করিতে হইবে।
বণিকশ্রেষ্ঠ “মণিরু' ভয় পাইয়া ইউসুফকে এই দাবীর সত্যতা সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করিলেন;
""(ইছুকে বোলন্ত আমি হই তান দাস।
আকাশের দিকে মুখ করিআ প্রকাশ""
ইউসুফের এই উক্তিতে 'মনিরু' -সাধুর মাথায় আকাশ ভাঙ্গিয়া পড়িল। ইউসুফকে
ক্রয় করিয়া এই আকস্মিক বিপদের হইতে মুক্তি লাভ করার কোন সহজ উপায়
আছে কিনা, সেই কথা চিন্তা করিতে করিতে হঠাৎ
""সাধু বোলে মোর ঠাঁই ধন নাহি আর।
তামার ঢেপুয়া লহ এই মূল্য তারা
ভাই সবে বোলে জেই দেহ তা সত্বর।
আহ্মা হোস্তে দূর হউ দিক দিগন্তর।""
এইভাবে 'মণিক' সাধু ইউসুফকে তামমুদ্রার (তামার ডেপুয়ায়) কয় করিয়া দেশে
ডিবিরা গেলেন। তাঁহার অন্য কোন সদা হইল না। নতন হইলেন
দেশে পৌঁছিতেই 'মণিক' সাধু দেখিতে পাইলেন দেশের সর্বত্র হট্টগোল শুরু
ছে। ত-মুখে সর্বত্র প্রচারিত হইয়াছে যে, 'মণি' বিদেশ হইতে এক
অপূর্ব মাস জন্ম করিয়া আনিয়াছেন; এমন ক্রীতদাস জগতে দুর্লভ। আজিজ মিসরও
এই কথা জানিতে পারিলেন। ইউসুফকে তাঁহার দেখিবার ইচ্ছা হইল। এই ইচ্ছা পূর্ণ
করিবার জন্য, আজিজমিদর এক বিশিষ্ট দিনে সভা ডাকিয়া রাজ্যময় এক আদেশ জারী
জন্ম ৰূপৰম্ভ আছে নারী বা পুরুষ।
সুবেশ করিয়া আইস আক্ষার সমুখা
আদেশ প্রচারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই চারিদিকে 'সাজ-সাজ'রব পড়িয়া গেল।
হিজরে যত রূপবান নর ও রূপবতী নারী ছিল, রাজানুগ্রহ লাভের আশায়, তাহাদের
সকলেই যথাকালে আজিজমিসরের দরবারে উপস্থিত হইতে চলিল। “মণিরু' -সাধুও
ইউসুফকে সঙ্গে লইয়া মিসর-দরবারে যাত্রা করিলেন। চলিতে চলিতে
"""
নীল নামে গঙ্গা আছে মিছির ভর্মিত।
তার তীরে মণিরু হৈলা উপস্থিত
ইছুফ সম্বোধি বলে সাধু গুণবান।
এহি নীল গঙ্গা নীরে করহ আসনান।
সাধুর আদেশ পাইআ জলেতে নামিলা।
জল সুখমান ধর্ম যাপ্য আচরিলা
তান পদ পরশে নীলের পুণ্য নীর।
সুরেশ্বরী ধারা জেহ সুধাবর্ণ বীরঃ""""
নীল নদের জলে স্নানান্তে পবিত্র ও সুন্দর পোশাকে সুসজ্জিত হইয়া ইউসুফ ও
মনিরু' সাধু রাজ সভায় উপস্থিত হইলেন; ইউসুফকে বসিবার জন্য বহুমূল্য বিচিত্র
আসন দেওয়া হইল। তাঁহাকে এই আসনে সমাসীন দেখিয়া সকলের মনে প্রতীয়মান
হইতে লাগিল :
""সিল্ক বিদ্যাধর রূপ জিনি তান তনু।
মানব মূরতি ধরি মর্ত্যে আইল ভানু।"""
এ আবার কেমন ক্রীতদাস? এমন ক্রীতদাস তো কখনও দেখি নাই। কে সে
ভাগ্যবান, যে ইহাকে কিনিবে? ইহার মূল্যই বা কত হইবে? কি আশ্চর্য! এই ক্রীতদাস
""তো দাস নহে, বরং
নাম দাস ভুবনে ঈশ্বর হেন পেখি।
জগৎ ভরিল তান রূপরেখ আঁখি""
জলিখাও রাজ-অন্তঃপুর হইতে তাঁহার ধাত্রী ও সখীগণকে সঙ্গে লইয়া ক্রীতদাস
ইউসুফকে দেখিবার জন্য উটের 'আম্বারীতে আরোহণ করিয়া দরবারে উপস্থিত
হইলেন। ইউসুফকে দেখিয়া তিনি মূর্ছিতা হইলে, 'আম্বারী' রাজঅন্তঃপুরে ফিরিয়া
গেল। তথায় যাত্রীর বিশেষ যত্নে তাঁহার সংজ্ঞা ফিরিয়া আসিল। মূর্ছান্তে জলিখা
ধাত্রীকে লাচারী ছন্দে গুজরী রাগে কহিলেন,
শুন খাজি মোহোর বচন।
এহি মোর হরিল জীবন ॥ ধ্রু
দেখাইল আপনক মুখ।
দিলেক বিরহ মনে দুঃখ
অন্তরিক্ষে দিল দরশন।
সে অবধি পোড়ে মোর মনঃ
ধাত্রী জলিখাকে প্রবোধ দান করিল। ইহাতে তাঁহার হৃদয় চাঞ্চল্য দূরীভূত হইল
না, তাঁহার মনও কিছুতেই প্রবোধ মানিল না। বাধ্য হইয়া জলিখা ইউসুফকে ক্রয়
করিবার জন্য রাজদরবারে ফিরিয়া আসিয়া দেখিলেন
"""
ইছুফ কিনিতে আইল জথ বণিজার।
জার জেই মনে ভাএ মূল্য করিবার।
এক বুঢ়ী কতখানী সুতা হাতে লৈআ।
ধাইতে খাইতে জাএ আন উপেখিআ !
লোকে পুছে কেনে ধাম কহ বৃদ্ধ নারী।
বুঢ়ী বলে মোর এহি পুঁজি ধন কড়ি ।
সাধুর মেলেত মোক গণিতে জুয়াএ।
মোর কর্মফলে তাক কিনিতেন ভাএ 1
লোক সব হাসএ বুঢ়ীর বুঝি মতি।
ন পায় কিনিতে তাক লক্ষ কোটিপতি ॥
ডাকোয়ালে ডাকি বলে শুন সাধুগণ।
ইছুফ কিনিতে আইস জার জথ ধন !""""
অতঃপর, ইউসুফকে ক্রয় করিবার জন্য বহু বণিক আগাইয়া আসিয়া লক্ষ লক্ষ
মুদ্রা 'মণিরু'-সাধুকে দিতে চাহিল। 'মণিরু' বলিলেন, ইহা ইউসুফের উপযুক্ত মূল্য
নহে। তখন 'মণিরু' -সাধুর নিকট হইতে ক্রেতৃগণ ইউসুফের প্রকৃত মূল্য জানিতে
চাহিলে, তাহাদিগকে জানানো হইল যে,
"""তান যোগ্য মূল্য হয় কনক রতন।
মুকুতা প্রবাল হীরা চুনি মণি ধন ॥
সব সমতুল্য করি ভুথিবেক সার।
কিনিবারে আইস এহি মূল্য হৈল সার"""
এই ঘোষণার পর ক্রয়েচ্চু সাধুগণ নিরাশ হইলেন। এমন কি, অধিক মূল্যে
ইউসুফকে কিনিবেন কি না, সে সম্বন্ধে আজিজমিসরও বিশেষ চিন্তিত হইয়া পড়িলেন।
জলিখা আজিজমিসরের চিন্তার কারণ বুঝিতে পারিয়া বলিলেন যে তিনি তাঁহার পিতৃদত্ত
মণি-মাণিক্য দিয়া ওজন করিয়া ইউসুফকে কিনিবেন। তাঁহাকে যেন এই ক্রীতদাসটিকে
কিনিবার অনুমতি দেওয়া হয়। আজিজের সম্মতিক্রমেই জলিখা
এক এক মাণিক্য মিছির মূল্য জান।
বিদ্যমান ।
সেহি রত্ন আনি দিলা সাধু
ইছুফ জলিখা সঙ্গে রত্ন মণি মূল্য।
তথাপিহ ইছুফক নহে সমতুল্য
এতৎসত্ত্বেও 'মণিক' সাধু ইউসুফকে আজিজের নিকট বিক্রয় করিয়া নিজেকে
সৌভাগ্যবান মনে করিলেন। কারণ
লোকে বোলে মণিরু বড়হি ভাগ্যবন্ত।
ধনের ঈশ্বর হৈল সাধু গুণবস্তু।।
"মণিরু' -সাধু ইউসুফের পদধূলি লইয়া চলিয়া গেলেন। আজিজ 'পুত্রবাচ’ দিয়া
ইউসুফকে জলিখার হাতে সমর্পণ করিলেন। জলিখার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হইল। তিনি
ইউসুফকে নিজের অন্তঃপুরে লইয়া গেলেন। সেখানে জলিখার আদেশক্রমে
ষোড়শোপচারে ইউসুফের সেবা চলিল।
এই সময়ে একদা ইউসুফ অশ্বারোহণে নগর-ভ্রমণে বাহির হইলেন। মিসরে
‘বারেহা' নামে এক বণিক ছিল। তাহার অপূর্ব সুন্দরী যুবতী কন্যা ইউসুফকে দেখিবার
জন্য পথে আসিয়া দাঁড়াইল। সে ইউসুফকে দেখিয়া অজ্ঞান হইল। সেবা-শুশ্রূষার পর
সংজ্ঞা ফিরিয়া পাইলে, ইউসুফ তাহাকে প্রবোধ দিলেন ও তত্ত্বকথা শুনাইলেন। শ্রেষ্ঠী
বারেহার কন্যার চিত্ত ইউসুফের তত্ত্বকথায় বিগলিত হইল। ফলে তাঁহার
নীলগঙ্গা তীরেত গোফার মধ্যে বাস।
সর্বক্ষণ সমাধি করএ মনুদাস!
এইভাবে জলিখা ইউসুফের নায়িকার ভূমিকায় অবতীর্ণা হইলেন। নানাবিধছলাকলায় ইউসুফকে ভুলাইবার প্রয়াস চলিল। কিন্তু, কিছুতেই ইউসুফের আত্মসংযমটুটিল না। জলিখা তাঁহার ধাত্রীকে অত্যন্ত দুঃখভারাক্রান্ত হৃদয়ে সকল কথা নিবেদন
করিলেন ও তাহার নিকট ইহার প্রতিকার প্রার্থনা করিলেন। ধাত্রী জলিখাকে আশ্বস্তকরিলেন যে, ইউসুফের প্রতি তাঁহার আসক্তির কথা জানাইয়া, প্রণয়াস্পদের সহিততাঁহার চির-বাঞ্ছিত মিলন ঘটাইয়া দিবে।
অতঃপর, ধাত্রী তাহার দৌত্য সমাধা করিলে, ইউসুফ উত্তর দিলেন, আজিজ মিসর
‘পুত্ৰবাচ’, দিয়া তাঁহাকে জলিখার হাতে সমর্পণ করিয়াছেন। সুতরাং তিনি জলিখার
অভিজ্ঞ বুলস মোক তুমি পুর ধর্ম।
এই পাতাহার পৌতা-কাব্যের্থ হইলে, ইউনিট
প্রেম নিবেদন করিলেন। ইহাও বিশেষ নো আবার তাঁহার
ব্যর্থতার কথা যাত্রীকে জানাইলেন। যাত্রী অলিখাকে দিলেন যে, ই
অনভিজ্ঞ পুরুষ। সুতরাং, তাঁহাকে কামকলায় প্রলু করিতে হইলে
তোষা জধ সঙ্গী আছে নৌহালি জৌবন।
তা সব পাঠাই দেউ জাউ বৃদ্ধাবন
ইছুফক বোলহ জাউ নিধুবনে।
তুলিআ আনউ পুষ্প তোয়ার কারণে।
অমাত্য কুমারী জথ রূপে কামাতুর।
লাস বেশ করি জাউ বৃন্দাবন পুরা
জথেক নাগরীপনা কামাকুল রূপে।
ইছুফ ভুলাউ গিয়া সুরতি আলাপেঃ
ধাত্রীর পরামর্শ অনুসারে কাজ করা হইল। ইউসুফের অজ্ঞানিতে জলিধার
সখীগণকে বাস-বেশ করাইয়া, ইউসুফকে ভুলাইবার পরামর্শ দিয়া, নগর বাহিরে
'বৃন্দাবনে' start উদ্যান বাটিকায় বিহার করিতে প্রেরণ করা হইল। পরে, ইউসুফও
উথায় প্রেরিত হইলেন। জলিখার সঙ্গীগণ শুধু যে ছলাকলায় ইউনুষের কামোদ্রেক
করিতে ব্যর্থ হইলেন, তেমন নহে, ইউসুফের মুখে তৎকথা শুনিয়া তাঁহারা ও গলিয়া
গেল। এই ব্যর্থতার কথাও ধাত্রীকে জানাইয়া জলিখা তাহার পরামর্শ চাহিলেন। ধাত্রী
বলিল, চিন্তিত হইবার কারণ নাই; কেননা
হেন এক মন্দির রচিব সুরচিত।
জীবন নক্ষত্র পুরিয়া সমুদ্রিত।
ইহুদ্ধ জলিখা কেলি চিত্রে লিখি আর।
ইছুকে দেখিয়া নেহি হৈব কামাতুর।
রতিসুখ কেলিরঙ্গে হৈব মতি ভোরঃ
অঙ্গ ভঙ্গ সঙ্গম যে বিবিধ প্রকারঃ
বলা বাহুল্য, ধাত্রীর পরামর্শ অনুসারে জলিখা এক মন্দির' অর্থাৎ গৃহ নির্মাণ
করাইলেন। ইহারই নাম কামভাব উদ্রেকায়ক সিপ্তখণ্ড টঙ্গী”। জলিখা অপূর্ব সাজে
সজ্জিতা হইয়া এই “সপ্তখণ্ড-টঙ্গীতে” গমন করিলেন। যথাসময়ে ইউসুফও তথায় নীত
হইলেন। এইখানেই জলিখা ইউসুফকে যৌবন নিবেদন করিলেন। এবারও তাঁহার চেষ্টা
ব্যর্থ হইল। ইউসুফ পলাইয়া গিয়া জলিখার কামকবল হইতে আত্মরক্ষা করিলেন।
পলাইবার সময় বাধা দিতে গিয়া জলিখা ইউসুফের পিঠের কাপড় ধরিয়া ফেলিলেন।
ইউসুফ পলাইয়া গেলেন বটে, জলিখার হাতে তাঁহার কাপড় ছিঁড়িয়া থাকিয়া গেল।
জলিখা মূর্ছিতা হইয়া মাটিতে পড়িয়া গেলেন। সন্দ্বীগণের যত্নে তাহার মূর্ছাভঙ্গ হইল।
চরম হতাশায় দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হইয়া জলিখা আজিজ-মিসরের নিকট ইউসুফের নামে
নিকট লৌকিক-সম্পর্কে পুত্র সমতুল্য। আপন গর্ভজাত সন্তান ও ধর্ম-পুত্রের মধ্যে
""প্রভেদ কোথায়? অধিকন্তু,
মহাদেবী যেন শুরু পত্নীর সমান।
রাজপত্নী মাতৃতুল্য মোর অনুমান।""
আলিঙ্গ বুগিস মোক তুমি পুত্র ।
পুত্র ধর্ম ন হত করিতে হেন কর্ম
এই ধারী তাহার দৌতা-কার্যে বাগ হইলে, ইউসুফের নিকট অলিখা স্বয়ং
প্রেম নিবেদন করিলেন। ইহাতেও বিশেষ ফলোয় হই না। লিখা আবার তাঁহার
ব্যর্থতার কথা ধাত্রীকে জানাইলেন। যাত্রী জলিখাকে বলিলেন যে,
অনভিজ্ঞ পুরুষ। সুতরাং তাঁহাকে কামকলায় প্রলুব্ধ করিতে হইলে.
তোতা জণ সখী আছে নৌআলি জৌবন।
তা সব পাঠাই দেউ জাউ বৃন্দাবন
ইyফক বোলহ জাউ নিধুবনে।
তুলিআ আনউ পুষ্প তোহ্মার কারণে।
অমাত্য কুমারী জথ রূপে কামাতুর।
লাস বেশ করি জাউ বৃন্দাবন পুরা
জথেক নাগরীপনা কামাকুল রূপে।
ইছুফ ভুলাউ গিয়া সুরতি আলাপের
যাত্রীর পরামর্শ অনুসারে কাজ করা হইল। ইউসুফের অজানিতে জলিখার
সহীগণকে পাস-বেশ করাইয়া, ইউসুফকে ভুলাইবার পরামর্শ দিয়া, নগর বাহিরে
"বৃন্দাবনে" অর্থাৎ উদ্যান বাটিকায় বিহার করিতে প্রেরণ করা হইল। পরে, ইউসুফও
ভিথায় প্রেরিত হইলেন। জুলিখার সখীগণ শুধু যে ছলাকলায় ইউসুফের কামোদ্রেক
করিতে ব্যর্থ হইলেন, তেমন নহে, ইউসুফের মুখে তত্ত্বকথা শুনিয়া তাঁহারাও গলিয়া
গেল। এই ব্যর্থতার কথাও ধাত্রীকে জানাইয়া জলিখা তাহার পরামর্শ চাহিলেন।
বলিল, চিন্তিত হইবার কারণ নাই; কেননা
ধাত্রী
"""
হেন এক মন্দির রচিব সুরচিত।
জীবন নক্ষত্র পুরিআ সমুদিত।
ইদ্বুদ্ধ জলিখা কেলি চিত্রে লিখি আর।
অঙ্গ ভৃঙ্গ সঙ্গম যে বিবিধ প্রকারঃ
ইছুকে দেখিয়া সেহি হৈব কামাতুর।
রতিসুখ কেলিরঙ্গে হৈব মতি ভোৱ৷""""
বলা বাহুল্য, ধাত্রীর পরামর্শ অনুসারে জলিখা এক 'মন্দির' অর্থাৎ
নির্মাণ
করাইলেন। ইহারই নাম কামভাব উদ্রেকাত্মক সিপ্তগও টঙ্গী”। জলিখা অপূর্ব সাজে
সজ্জিতা হইয়া এই "সপ্তখণ্ড-টঙ্গীতে" গমন করিলেন। যথাসময়ে ইউসুফ ও তথায় নীত
হইলেন। এইখানেই জলিখা ইউসুফকে যৌবন নিবেদন করিলেন। এবারও তাঁহার চেষ্টা
ব্যর্থ হইল। ইউসুফ পলাইয়া গিয়া জলিখার কামকবল হইতে আত্মরক্ষা করিলেন।পলাইবার সময় বাধা দিতে গিয়া জলিখা ইউসুফের পিঠের কাপড় ধরিয়া ফেলিলেন।
ইউসুফ পলাইয়া গেলেন বটে, জলিখার হাতে তাঁহারকাপড় ছিঁড়িয়া থাকিয়া গেল।
জলিখা মূর্ছিতা হইয়া মাটিতে পড়িয়া গেলেন। সন্দ্বীগণের যত্নে তাহার মূর্ছাভঙ্গ হইল।
চরম হতাশায় দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হইয়া জলিখা আজিজ-মিসরের নিকট ইউসুফের নামে
নিজের সতীত্ব নাশের অপবাদ দিলেন। ইউসুফের বিচার হইল। তিনি দৃঢ় কণ্ঠে অপবাদ অস্বীকার করিলেও, সজ্জায় সমস্ত কথা খুলিয়া বলিতে পারিলেন না। ফলে, তিনি কারাগারে নিক্ষিপ্ত হইলেন।
ক.
জলিখার অপবাদে ইউসুফের কারা-জীবন আরম্ভ হইল। তিনি খোদাকে স্মরণ করিয়া কারাজীবনের কাঠোর দিনগুলি একটির পর একটি করিয়া কাটাইয়া দিতে লাগিলেন, আর খোদাকে লক্ষ্য করিয়া মনে মনে বলিতে লাগিলেন :
মোর জথ অপরাধ তোহ্মা পদগত। এহি কথা সাচা মিছা করহ বেকতা
এই সময় ইউসুফ এক 'অন্তরীক্ষ বাণী' শুনিতে পাইলেন যে, জলিখা যখন তাঁহাকে অধর্মকার্যে লিপ্ত করিতে সচেষ্টা ছিলেন, তখন তাঁহার এক সখী পর্দার আড়ালে থাকিয়া তিন মাসের দুগ্ধপোষ্য শিশুকে ঢুলনি' অর্থাৎ দোলনায় রাখিয়া ঘুম পাড়াইতে ছিলেন। শিশুটি সবকিছু দেখিয়াছে ও আল্লার হুকুমে সে সাক্ষ্য দিবে।
এহেন 'অন্তরীক্ষ বাণী শ্রবণ করিয়া ইউসুফ আজিজ-মিসরের নিকট নিবেদন করিলেন যে, তিনি যে নির্দোষ ও নিষ্কলঙ্ক সে সম্বন্ধে এক সাক্ষী আছে এবং এই সাক্ষী হইতেছে জলিখার সখীর তিন মাসের নির্বোধ শিশু। আজিজ-মিসরের আদেশে জলিখা কোলে করিয়া এই শিশুকে লইয়া আসিলেন। এই কার্যে দোষগুণ কাহার, এই কথা আজিজ-মিসর শিশুকে জিজ্ঞাসা করিলেন; আর
শিশু বোলে মুঞি নহো নবির চরিত।
কার ভরে কার বাক্য ন কহি বিদিত।
জাহার অগ্রত ভাগে বিদার বসন।
তার কথা মিথ্যা জান প্রলাপ ৰচনা জার পৃষ্ঠগত বস্ত্র বিদার প্রমাণ।
সেহি সত্যবাদী ধর্মশীল অনুমানা
শিশুর এই কথা শুনিয়া আজিজ-মিসর বিস্ময়ে অভিভূত হইয়া দেখিলেন যে, ইউসুফের পৃষ্ঠের এবং জলিখার সম্মুখের বজ্র ছিন্ন। ইহাতে আজিজ জলিখাকে অনেক গঞ্জনা করিলেন বটে, কিন্তু ইউসুফকে উপদেশ দিলেন,
তোহ্মার কর্তব্য কর্ম মুক্তি ভাল জানো। তুদ্ধি মাত্র কার ঠাঞি ন কহিবা আনঃ
এতৎসত্ত্বেও, জলিখার কেলেঙ্কারীর কথা গোপন রহিল না। দুঃসংবাদ যেমন বায়ুর আগে আগে উড়িয়া বেড়ায়, কলঙ্কের কথাও তেমন দেখিতে দেখিতে মুখে মুখে দেশময় ছড়াইয়া পড়ে। ইহাতে জলিখা বিচলিতা হইলেন।
কলঙ্ক-মোচনের উপায় সম্বন্ধে ধাত্রীর সহিত পরামর্শ করিয়া স্থির করা হইল যে
দেশের যাবতীয় যুবতী নারীকে নিমন্ত্রণ দিয়া একত্র করিয়া, এই রমণী সমাজে
ইউসুফকেও ডাকিয়া আনিতে হইবে। তখন তাহাদের সম্মুখেই ধাত্রী কু-চৰ্চা খণ্ডন
করিবে। পরামর্শ অনুসারে কাজ করা হইল। দেশের যাবতীয় যুবতী নিমন্ত্রিত হইয়া
রাজ-অন্তঃপুরে সমবেড হইলেন। তাহাদের জন্য নানাবিধ ভোজ্য দ্রব্য সরবরাহের
আয়োজন করা হইল। ভোজনান্তে ফলাহারের জন্য তাহাদের প্রত্যেকের হাতে একটি
করিয়া ("ত্যা' নামে পরিচিত সে দেশের সর্বোৎকৃষ্ট ফল এবং তাহা কাটিবার জন্য
একখানা করিয়া (খরশান কার্ডি দেওয়া হইল। আহারের সুযোগ লইয়া যুবতীগণ
বলিল, ইউসুফকে না দেখিলে তাহারা কিছুই খাইবে না। অগত্যা
জলিখা আদেশ কৈল এক সখী তরে...
ইছুফক কহ গিআ আসউ সত্তুরে
ইউসুফ আসিলেন না। পরিশেষে তাঁহাকে আনিবার জন্য জলিখাকেই যাইতে
হইল। জলিখার অনুনয়ে ইউসুফ রমণীদের সভায় আগমন করিলেন। রমণীগণ তখন
ফলাহার করিতেছিল। ইউসুফের প্রতি তাহাদের দৃষ্টি নিবন্ধ হইতেই রমণীরা আত্মহারা
দেখিলেস্ত পরতেক কিবা এ স্বপন।
এক দৃষ্টে নেহালন্ত পাসরি আপনা
হাতেত তরুঞ্জা ফল কাতি খরশান।
হস্ত সন্ধে ফল কাটে মনে নাহি আন
কেহো ফল কাটিতে অঙ্গুলি কাটি নিল।
কিবা কর কিবা ফল এক ন জানিল।
হাস্য-পরিহাসচ্ছলে জলিখা রমণী-সমাজে বলিলেন যে, বহু ধন দিয়া এই
ক্রীতদাসকে কিনিয়া কত আদর যত্ন করিয়াছি সে আমার বশ্যতা স্বীকার করিল না।
এইবার তাহাকে নির্জন কারাগারে বন্দী করা হইবে। রমণীরা ইউসুফের ভয়াবহ নির্জন
কারাবাসের কথা শুনিয়া সদয় হৃদয়ে তাঁহাকে জলিখার বশীভূত হইতে উপদেশ
দিলেন। ইউসুফ তাহাদিগকে অবিচলিত কন্ঠে বলিলেন
""তিরীক সমাজ হোস্তে রাখম বান্ধি মন।
তিরী মুখ ন দেখি গোঙায় কত ঘনঃ
লুবুধ নহম মুঞি তিরী মুখ দেখি।
বন্দীত থাকম মুঞি এসব উপেখি।""
অতঃপর ইউসুফ নির্জন কারাগারে প্রেরিত হইলেন। এতৎসত্ত্বেও জলিখার মনে
শান্তি রহিল না। একদা তিনি আজিজ-মিসরের আদেশ লইয়া নির্জন কারাগারে গমনকরিয়া ইউসুফের নিকট কামবাসনা তৃপ্তির প্রস্তাব করিলেন। প্রস্তাব পূর্ববৎ সুদৃঢ়ভাবেইঅগ্রাহ্য হইল। ইহাতে জলিখার ক্রোধের সীমা রহিল না। তিনি অনুচরগণকে আদেশকরিলেন যে, তাহারা যেন ইউসুফের শরীর হইতে ভাল বস্ত্র ও আভরণ কাড়িয়া লইয়া
তাঁহাকে অঁর্তি সাধারণ পোশাকে সাজাইয়া দেন। ফলে, জলিখার অনুচরেরা ইউসুফের
আভরণ কমক লৈল তখন।
লোহাক দাতুকা দিল অঙ্গক ভূষণঃ
গর্দভ পৃষ্ঠেত তানে চড়াইল ছলে।
নগরাস্ত ইচ্ছুক ফিরাইল বলে।
ডাকোয়ালে ডাক ছাড়ে সকলে শুনিল।
এহেন দুর্জন দাস জলিখা কিনি।
অন্তঃপুর মধ্যে কর্ম দুষ্কৃতি রচিত।
ঈশ্বর ঘাতক মহাপাতকী বিদিত।
এহি তার যোগ্য শান্তি সর্বলোকে জান।
বন্দীর ভবনে ডাক রাখহ সাবধান!
ইহাতে ইউসুফের অপবাদ ঘোষিত হওয়া দূরে থাকুক, অধিকন্তু, তাঁহাকে দেখিবার
জন্য সকলের ঔৎসুক্য বাড়িয়া গেল এবং বন্দীশালায় দলে দলে লোক আসিয়া তাঁহাকে
দেখিয়া যাইতে লাগিল। ইউসুফের দেবমূর্তি সন্দর্শনে সকলে বলাবলি করিতে শুরু
করিল,
শিষ্টজন কদাচিত দৃষ্ট নাহি হএ।
কৃষ্ণ কালি দাগ ন জায়ন্তি শত ধোঞ৷
ইউসুফ নির্বিবাদে আরও দশজন বন্দীর সহিত মুখেই বাস করিতে লাগিলেন।
তাঁহার আগমনে বন্দীশালা 'চন্দ্রপুরে' পরিণত হইল। অন্যান্য বন্দীরা তাঁহাকে দাসের
ন্যায় সেবা করিতে লাগিল। আসল ব্যাপারটি জানিতে পারিয়া সুখ শান্তি বৃদ্ধির জন্য
গোপনে জলিখা
ইছুফক দিলা যথ খাট পাট পাটি।
তুলি গদি বসন ভূষণ বাটা বাটি।
ইউসুফের জন্য এত করিয়াও জলিখার মনের সাধ মিটিল না। তিনি মনের দুঃখে
বনে না গিয়া রাজ প্রাসাদে বসিয়াই এই বলিয়া বিলাপ করিতে লাগিলেন যে,
খেনে খেনে বয়ানেত
পিউ জেহ সুধাবিন্দু
হাকলি বিকলি করি রীতা
ইছুফক পাদুকাএ
জেহ সেহ পতাকাএ
খির উপরে রাখি থাকো।
থেনে খেনে নয়ানেত
খেনে খেনে মস্তকে ধরাওঁ৷
নবীন নাগরী আহ
রূপেত আগরী তাহ
জেহ্ন হওঁ পাগল চরিত।
প্রেমলাভ ভাবসিন্ধু
বিলাপান্তে জলিখার মনের বেদনা জলভারমুক্ত মেঘের ন্যায় লঘুতা প্রাপ্ত হইল,
বটে, কিন্তু সকল বন্ধন ছিন্ন করিয়া কারান্তরালে লুক্কায়িত দয়িতদর্শনে ছুটিয়া চলিল।
একদা নিশীথে কারাকক্ষে ইউসুফের সহিত জলিখার দেখা হইল। জলিখা তাঁহাকে
মনোবেদনা নিবেদন করিলেন। জলিখার মুখে তাঁহার মনোবেদনার কথা শুনিয়া
ইউসূফও দুঃখিত হইলেন। এই সময় রজনী ভোর হইয়া আসিতেছিল। আর কারাগারে
অবস্থান করা সঙ্গত মনে না করিয়া, জলিখা রাজ-অন্তপুরে ফিরিয়া গেলেন।
এইভাবে জলিখার বিরহ-জীবনের আতপ্ত দিনগুলি যখন একে একে কাটিয়া
যাইতেছিল, তখন এক দিন হঠাৎ আজিজ-মিসরের মৃত্যু হইল। ইহাতে জলিখার খুশি
হইবারই কথা। কিন্তু তিনি তাহা হইতে পারেন নাই। তাঁহার হৃদয়ে চিন্তার অবধি রহিল
না: তিনি ভাবিলেন, হিতে যে বিপরীত হইল,
দুক্ষের উপরে দুক্ষ দিল বিধি তাঁর।
হস্ত হোস্তে দূর গেল রাজ্য অধিকার।
আজিজ-মিসরের মৃত্যুর পর পূর্ব নরপতি মিসরের রাজা হইলেন। তিনি তখন
কঠোরভাবে দেশ শাসন করিতে লাগিলেন। এই সময় রাজার দুই প্রধান অনুচর বন্দী
হইয়া ইউসুফের সহিত বন্দীশালায় বাস করিতে লাগিল। কিছুদিন এইরূপে অতিবাহিত
হইল। একদা বন্দীদ্বয় দুইটি আশ্চর্যজনক স্বপ্ন দেখিল। স্বপ্ন দুইটি ইউসুফের নিকট
এইভাবে বিবৃত করিল :
""ভুঞ্জন সামগ্রী সব থাল বাটি ভরি।
মস্তক উপরে রাখিনু হাতে ধরিে
চিলে কাকে কাঢ়িআ খায়ন্ত শির 'পর।
এহি ভএ পাই মুঞি জাগিলু সত্বর
আর একে বোলে স্বপ্ন দেখিলু প্রভাতে।
সম্পূর্ণ কনক কটোরা মোর হাতে।
রহিআছোঁ নৃপতি অগ্রেত ভএ মন।
কহ মহাশয় এহি স্বপ্নের বাখানা""
ইউসুফ চট করিয়া উত্তর দিলেন প্রথম ব্যক্তি যে স্বপ্ন দেখিয়াছে, তাহার ব্যাখ্যা
এই যে, আগামীকলা রাজা তাহার শিরচ্ছেদ করিবেন এবং দ্বিতীয় ব্যক্তি যে স্বপ্ন
দেখিয়াছে তাহার মর্ম এই যে, বন্দীজীবন হইতে সে অচিরে মুক্ত হইয়া বাজারে বহু
সম্মান লাভ করিবে।
দুর্ভাগ্যবশতঃ, এই সময়ে দ্বিতীয় ব্যক্তিকে ইউসুফ অনুরোধ করিলেন যে, মুক্ত
হইয়া রাজ-সম্মান লাভ করিলে, ইউসুফের বিনাদোষে কারাবাস ভোগ করার বৃত্তান্তটুকু
যেন সে রাজার গোচরীভূত করে। দ্বিতীয় ব্যক্তি তাঁহার অনুরোধ রক্ষা করিবে বলিয়া
প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হইল। আকস্মিকভাবে ঠিক এই মুহূর্তেই ইউসুফ এক 'আকাশবাণী শুনিতে
পাইলেন, 'হে ইউসুফ! ঈশ্বরের উপর নির্ভর না করিয়া মানুষের কাছে স্বীয় মুক্তির জন্য
অনুরোধ করিয়া তুমি অধর্ম করিয়াছ। ইহাতে ঈশ্বর তোমার প্রতি অসন্তুষ্ট হইয়াছেন
এবং যতদিন তোমার বন্দী জীবন কাটিয়াছে, আরও ততদিন তুমি কারাগারে জীবন
কাটাইবে।”
পরদিন প্রভাতে বাজার আদেশে প্রথম অনুচরটির শিরচ্ছেন করা হইল এবং দ্বিতীয়
অনুচরটি মুক্ত হইয়া বাজানুগ্রহ লাভ করিল বটে, কিন্তু সে তাহার মুক্তির আনলে
আত্মহারা হইয়া, ইউসুফের সহিত যে প্রতিজ্ঞায় আবদ্ধ হইয়াছিল, তাহার কথা বিলকুল
তুলিয়া গেল। এইভাবে কয়েক বৎসর কাটিয়া গেল।
এই সময়ে মিসররাজ এক অপূর্ব স্বপ্ন দেখিলেন। পাত্রমিত্র সকলকে ডাকিয়া এই
ব্যাখ্যা চাওয়া হইল। কেহই স্বপ্নের কোন ব্যাখ্যা দিতে পারিল না। তখন
ইউসুফের কথা ঐ রাজ অনুচরটির মনে পড়িয়া গেল। সে নিজের স্বপ্নের ব্যাখ্যার কথা
রাজাকে জানাইয়া কহিল যে, বন্দী ইউসুফ ব্যতীত আর কেহ এই স্বপ্নের ব্যাখ্যা করিতে
পারিবেন না। স্বপ্নব্যাখ্যার জন্য ইউসুফকে সসম্মানে রাজসভায় লইয়া আনিতে রাজা
অনুচরটিকে কারাগারে প্রেরণ করিলেন। যথাসময়ে ইউসুফকে রাজসভায় আনা হইল ।।
রাজা তাঁহাকে স্বপ্নের বর্ণনা দিলেন :
"""বু হৃষ্টপুষ্ট অভি সুবলিত।
আর সপ্ত বৃদ্ধ কম তনু দুর্বলত
বল বৃদ্ধ বলবন্ত হৈআ
এসবুদ্ধ খাইতে গেল জে খাই আ
জেহ্ন ব্যাঘ্ৰে ঝম্প দিআ তাহাকে ধরিল।
আহি সপ্ত পুষ্ট তনু বৃষক ভখিলা
আর এক অপূর্ব দেখিল নৃপবর।
সপ্ত ছড়া গোহোম গাছাইল মাটি পরচ
ছবজা বর্ণ সপ্ত ছড়া তেহেন সুরিত।
জেহেন চামর দোলে অতি সুললিতা
তাহার নিয়ড় হোন্তে আর সপ্ত ছড়া।
গাছাইল তেহেন বর্জিত জেহ মড়া
সও ছড়া মরএ জানিল পূর্ণ ছড়া।
সেহি ক্ষণে তথাইল জেহ হৈল মরার""
বর্ণনান্তে ইউসুফের কাছ হইতে রাজা তাঁহার এই স্বপ্নের ব্যাখ্যা জানিতে
চাহিলেন। তখন ইউসুফ স্বপ্নের ব্যাখ্যা দিতে শুরু করিলেন ও মিসররাজ তাহা একমনে
শুনিতে লাগিলেন। রাজাকে লক্ষ্য করিয়া ইউসুফ বলিলেন,
"""দেখিলা যে সপ্ত বৃষ পুষ্ট অঙ্গ তার।
সপ্ত ছড়া গোহোম তণ্ডুল পূর্ণ আরও
সেহি সপ্ত ছড়াত সংযোগ হৈব কাল।
সপ্ত অব্দ পৃথিবী পূরিত শসা ভাল।
আর সপ্ত বৃদ্ধ কৃষ তনু দুর্বলত
আর সপ্ত গোহোম জে ভণ্ডুল বর্ণিতঃ
সেহি সপ্ত বরিখ দুর্ভিক্ষ হৈব ফাল।
জলশূন্য পৃথিবী শুকাইব খাল নাল।"""
মিসর-রাজ তাহার স্বপ্নের এহেন অদ্ভুত ব্যাখ্যা শুনিয়া, এই ব্যাখ্যায় সম্ভ
এবং দেশের কথা চিন্তা করিতে করিতে [“নৃপতি দেখস্ত আগে নিজ মন হিত"
বলাবাহুলা, ইউসুফকে ইতঃপূর্বে কারামুক্ত করিয়া মহাসম্মানে রাজসভায় আনা
হইয়াছিল। স্বপ্ন ব্যাখার পর হইতে মিসর-রাজ দেশের মঙ্গল চিন্তায় ব্যস্ত হইয়া
পড়িয়াছিলেন। তাঁহার চিন্তার বিষয় হইল, সাত বৎসর দেশে যখন অসম্ভব ফসল
ফলিবে, তখন দিন আনন্দেই কাটিয়া যাইবে। কিন্তু, পরবর্তী সাত বৎসর যখন ভীষণ
দুর্ভিক্ষ হইবে, তখন কিভাবে দেশকে রক্ষা করিতে পারা যাইবে তাহার কোন না কোন
উপায়- উদ্ভাবন একান্ত প্রয়োজন। তিনি যতই ভাবিতে লাগিলেন, ততই তাঁহার মনে
প্রতীতি জন্মিতে লাগিল যে, (মহামতি ইউসুফ সর্বত্য পাত্র মিত্রকে এ বিষয়ে
জিজ্ঞাসা করা হইল; তাঁহারাও ইউসুফের অতিমানবীয় প্রজ্ঞা সম্বন্ধে মিসর-রাজের সহিত
এক মত হইলেন। যথাকালে এক সভা আহুত হইল। তখন,
সভা সম্বোধিআ কহে মিছির ঈশ্বর।
শুন শুন মহাজন আহ্মার উত্তর।
বৃদ্ধ হৈলু পৃথিবীত পুত্ৰ নাহি মোর।
অনুদিন এহি চিন্তা করো মতি ভোর!
মনে মনে জুকতি কল্পিআ কৈলু সার।
ইছুফক দিমু এহি রাজ্যের অধিকার।
যেই কথা সেই কাজ। প্রস্তাব মত কাজ হইতে কোন বিলম্বই করা হইল না। এই
সভাতেই মিসর- রাজ সানন্দচিত্তে সদ্যঃকারামুক্ত ইউসুফকে
আপনক ছত্র দিলা রত্ন সিংহাসন।
মাণিক্য রতন দিলা অঙ্গক ভূষণা
এই ভাবে একেবারেই অপ্রত্যাশিতভাবে ইউসুফ আজিজ-মিসর পদে অভিষিক্ত
হইলেন। তাঁহার নাম অচিরেই মিসরের ঘরে ঘরে প্রচারিত হইল। চারিদিকে ‘ধন্য ধন্য
পড়িয়া গেল।
ইউসুফ 'আজিজ-মিসর' পদে বৃত হইয়াই রাজ্য শাসনে মনোনিবেশ করিলেন।
তিনি গ্রামে গ্রামে ঘুরিয়া ঘুরিয়া দেখিলেন, দেশে অপর্যাপ্ত শস্য ফলিয়াছে; এই শস্য
জমা করিয়া রাখিতে হইবে, যেন আসন্ন দুর্ভিক্ষের সময় লোক অনাহারে মারা না যায়।
তিনি প্রতি গ্রামে দুইটি করিয়া প্রকাণ্ড শস্যাগার নির্মাণ করাইয়া উপযুক্ত মূল্যে শস্যকিনিয়া তাহাতে জমা করিতে আদেশ দিলেন। আদেশ মত কাজ চলিল। ধীরে ধীরে
সরকারী শস্যাগার সংগৃহীত শস্য-সম্ভারে পূর্ণ হইয়া উঠিতে লাগিল।এই সময়ে অপুত্রক মিসররাজের আয়ুর সপ্ততি বর্ষ পূর্ণ হইল। হঠাৎ একদিন বৃদ্ধরাজা পরলোক গমন করিলেন। অতঃপর, ইউসুফ অতি সহজেই মিসরের রাজপদঅলংকৃত করিলেন। তখন তিনি সসৈন্য নগর ভ্রমণে বাহির হইয়া স্বচক্ষে প্রজার অবস্থা
অবলোকন করিতেন। তাঁহার দুই পার্শ্বেই বহু দেহরক্ষী (ছড়িদার) চলিত। এই সমস্ত
ছড়িদার প্রতি আজ্ঞা কৈল নৃপবর।
তিরী জেহ্ন গোচর ন হত্র মোর তরঃ
মিসবে ইউসুফ সুখ্যাতি ও সুবিচারের সহিত রাজত্ব করিতেছিলেন। তাঁহার রাজত্বে
লোকের কোন অভাব-অভিযোগ রহিল না। অথচ, জলিখার অবস্থা সম্পূর্ণ ভিন্ন। তিনি
তখন প্রায় নির্বোধ ও উন্মাদ। এই সময়ে তাঁহার কাছে
কেহ যদি ইউসুফক কহস্তি বারতা
জেহি মাগে সেহি দেস্ত হইআ সম্মতা৷
সুতরাং, অচিরেই জলিখা ফতুর হইয়া গেলেন। অর্থাভাব বশতঃ সমস্ত দাসদাসীই
তাঁহাকে ত্যাগ করিয়া চলিয়া গেল। এমন কি, মাতৃতুল্যা ধাত্রীও তাঁহার মায়া কাটাইয়া
পরলোক গমন করিল। শোকে ও দুঃখে জর্জরিত হইয়া তাঁহার অবস্থা এমন হইল যে,
তাঁহাকে দেখিলে মনে হইত, তিনি এখন এক অতি সামান্যা 'নগরুয়া নারী' মাত্র। হায়,
একদিন
জার কেশ সৌরভে সমীর সমুদিত।
আউল বাউল তডি কুভেস চরিত!
জার দন্ত বিজুত চমকিত ছটফট।
দেখি দূর জাএ তার দশন বিকট
মিছিরের লোক সভে বিসরিল তারে।
বহুল বরিখ হৈল কোহে পুছে কারে।।
তথাপি, ইউসুফ যেই পথ দিয়া যান, জলিখা সেই পথের পার্শ্বে বাসা বাঁধিয়া
রাত্রিদিন সেখানেই বসিয়া থাকেন। কিন্তু, 'ছড়িদারেরা' পূর্ব আদেশ অনুসারে জলিখাকে
ইউসুফের দৃষ্টির বাহিরে রাখিবার জন্য অন্যত্র সরাইয়া দিতে লাগিল। জলিখার সহিত
আজিজ মিসর- অর্থাৎ মিসর-রাজ ইউসুফের আর কোন মতেই দেখা হয় না।
একদিন তাঁহার বাসায় বসিয়া ইউসুফের চিন্তায় জলিখা বিনিদ্র রজনী
কাটাইতেছিলেন। তিনি যে দেবতার আরাধনা করিতেন, তাহার এক প্রস্তর-মূর্তিও
সঙ্গে ছিল। হঠাৎ ইহাকে পূজার বেদী হইতে নীচে নামাইয়া আনিয়া জলিখা বলিলেন,
পাষাণ ভাঙ্গিয়া আজি করিম চৌখও।
বার্থে সেবা কৈল তোক জানিখুঁত ৬০॥
বিরহ-বেদনা ও মর্মপীড়ায় জলিখার ধৈর্যের বাঁধ ভাঙ্গিয়া গেল। তিনি প্রতিমা
পূজায় বিশ্বাস হারাইলেন এবং যেই অদৃশ্য পরমেশ্বরকে ইউসুফ পূজা করেন, তৎপ্রতি
আস্থাপরায়ণা হইয়া
পাছাড়িআ কৈল খণ্ড খণ্ড।
""ভূমি তলে থেপি তাক কৈল লণ্ডভণ্ড।
কান্দিআ পশ্চিম দিকে করিলেন্ত মুখ।
পরম ঈশ্বর সেবা করেও মন সুখ।
কহিতে রজনী শেষ হইল প্রভাতঃ""
88
বলাবাহুল্য, ইহা দুঃখের ঘোর তমসাচ্ছন্ন রজনীর অবসানে জলিখার সুপ্রভাত।
কেননা, আল্লাহতায়ালা এই বজনীতেই তাঁহার তওবা কবুল করিয়া তাঁহার সমস্ত দুঃখের
অবসান ঘটাইলেন। এখন হইতেই তাঁহার দিন ফিরিল।
প্রভাতে আজিজ-মিসির ইউসুফ নগর ভ্রমণে বাহির হইলেন। তাঁহার সঙ্গে মাত্র
অল্প সংখ্যক সৈন্য ছিল। 'ছড়িদারদের মধ্যে হইতে কেহই সেই দিন তাঁহার
শরীররক্ষিরূপে নগরে বাহির হয় নাই। মিশরের রাজপথেও তখন অধিক সংখ্যায় লোক
সমাগম হয় নাই। ইউসুফ যখন এইভাবে জলিখার বাসা-বাড়ির পাশ দিয়া
যাইতেছিলেন, তখন
আস্তে ব্যস্তে জলিখা পন্থে দণ্ডাইআ
আজিজক তরে কহে প্রাণ উপেক্ষিআঃ
শুনরে আজিজ তুমি কর অবধান।
জেহি বিধি কৈল তোক ভুবন প্রধান।
দাস হোস্তে আজিজ মিসির কৈলা তোরে।
তাহার শপথ জদি নাহি দেখ মোরেঃ
ইউসুফ ফিরিয়া দেখিলেন, এক দীন-দরিদ্রা বৃদ্ধা তাঁহার করুণা ভিক্ষা করিতেছে।
ভিখারিণীর কাতর আর্তনাদে ইউসুফের মন গলিয়া গেল। তিনি এক অনুচরকে আদেশ
দিলেন যে, বৃদ্ধা যাহা চাহে তাহা যেন তাহাকে দিয়া দেওয়া হয়। ইহার কোন ব্যত্যয়
ঘটিলে, তাহার কঠোর শাস্তি হইবে। ভয়ে জলিখার প্রতি ছুটিয়া গিয়া -
অনুচরে বুলিলেক শুন বুঢ়া মাই।
জথ ধন চাহ তুমি দিমু তোহ্মা ঠাঁই।
বৃদ্ধাএ বোলএ শুন পুত্ৰতুল্য তুমি।
কিছু ধনকড়ি তোহ্মা ন মাগিএ আহ্মি৷
মোক নিআ আজিজক করাঅ দর্শন।
আপনার নিবেদন করিমু আপনা
বৃদ্ধা কিছুতেই কোন অর্থ গ্রহণ করিল না। অনুচরটি মহাবিপদে পড়িয়া অগত্যা
বুড়ীর পীড়াপীড়িতে তাহার সহিত ইউসুফের সাক্ষাৎকার ঘটাইয়া দিতে রাজী হইল।
যথাসময় ইউসুফ রাজ প্রাসাদে প্রত্যাবর্তন করিয়া অন্তঃপুরে বিশ্রাম গ্রহণ
করিতেছিলেন। এই সুযোগে অনুচরটি বৃদ্ধাকে তাঁহার নিকট উপস্থিত করিল। বৃদ্ধাকে
দেখিয়া ইউসুফ বিরক্ত হইলেন ও তাহার নিকট বৃদ্ধার আগমনের কারণ জিজ্ঞাসা
করিলেন। তখন
বুঢ়ী বোলে শুনহ আজিজ সুবদন।
একেবারে তুমি আহ্মা হৈলা বিসরন৷
তোহ্মার কারণে মোর এথেক আবথা।
শেষ মাত্র জীবন আছএ মন ব্যথাঃ
সতাই ইউসুফ জলিখার কথা একরূপ ভুলিয়াই গিয়াছিলেন। বুড়ীর কথা শুনিয়া
আকস্মিকভাবে সমস্ত কথা তাঁহার মনে পড়িল। বিস্ময়ে অভিভূত হইয়া তিনি ভাবিতে
লাগিলেন।
আস্তে ব্যস্তে আসন ত্যজিলা মনে গুণি।
তুমি নি জলিখা বিবি তৈমুছ নন্দিনীয়
সাচা নি জলিখা বিবি কহ সত্য করি।
এথ কাল কোথাত আছিলা একসরি
এই বলিয়া ইউসুফ অতর্কিতে জলিখার সম্মানার্থে তাঁহার সম্মুখে দাঁড়াইয়া গেলেন
এবং প্রকাশ্যে সমস্ত অতীত স্মৃতি রোমন্থন করিয়া প্রবোধ দিতে দিতে জলিখাকে
তাঁহার নিকট অসংকোচে মনের ভাব প্রকাশ করিতে বলিলেন। জলিখা মরিয়া হইয়া
ইউসুফকে লক্ষ্য করিয়া তাঁহার নিকট প্রথম বর প্রার্থনা করিলেন:
তুহ্মি ভক্ত পরম ঈশ্বর মনোগত ।
বর মাগ হউ আহ্মা নয়ন মুকত।
যথাবিধি বর মাগা হইল। জলিখা তৎক্ষণাৎ চক্ষুষ্মতী হইলেন। অমনি ইউসুফের
চেহারার প্রতি জলিখার দৃষ্টি পড়িতেই, তাঁহার মূর্ছা হইল। ইউসুফ শশব্যস্ত হইয়া
নিজের হাতেই তাঁহাকে ব্যজন করিয়া সুস্থ করিলে পর, তাঁহার অন্য কোন প্রার্থনা
থাকিলে জলিখাকে তাহাও নিবেদন করিতে বলিলেন। তাই আবার
জলিখা বোলন্ত স্তন আজিজ স্বরূপ।
সপ্তখও টঙ্গীতে আছিল জেহি রূপ৷
সেহি রূপ যৌবন মোর পুনি দেউ বিধি।
তোহ্মার প্রসাদে হউ মনোরথ সিদ্ধি!
জলিখার এই দ্বিতীয় প্রার্থনা শুনিয়া ইউসুফ আল্লার কাছে দোয়া করিলেন যেন
জলিখাকে এই বর দেওয়া হয়। প্রার্থিত বর তৎক্ষণাৎ মঞ্জুর করা হইল, দেখিতে
দেখিতে জলিখা তাঁহার বিগত যৌবন ফিরিয়া পাইলেন। তারপর, ইউসুফ জলিখাকে
“পুছিলেন্ত কহ আর আছে কি বাঞ্ছিত"। জলিখাও ছাড়িবার পাত্রী নহেন। এইবার শেষ
বাসনা জ্ঞাপন করিতে গিয়া
কন্যা বলে তোহ্মা পদতলে মোর ছায়া।
নিশি গোঙাইতে চাহো লুবুধিত কায়া।
ডুবিলু বিরহ সিন্ধু ঢেউএ পোড়ে মন।
পদ অবলম্বে মোর রাখহ জীবন ।
এই অদ্ভুত প্রস্তাব শুনিয়া ইউসুফের মাতা হেঁট হইয়া গেল। তিনি অবাক বিস্ময়ে
স্তব্ধ হইয়া রহিলেন। এই সময়ে আকাশ হইতে এক ফেরেশতা অবতরণ করিয়া
ইউসুফকে জানাইল যে, জলিখা ইউসুফের ধর্মপত্নী এবং তিনি যেন তাঁহাকে বিবাহ
করেন।
এতদিনে ইউসুফের নিকট সমস্ত ব্যাপার খোলসা হইল। তিনি মনে মনে
করিলেন যে, জলিখাকে তাঁহার বিবাহ করিতে হইবে। কেননা, ইহাই খোদা তায়ালার
হুকুম। বলা বাহুল্য, 'অন্তরীক্ষবাণী' লাভ করিয়া ইউসুফ পাত্রমিত্রকে ডাকিয়া এই
সংবাদ দিয়াছিলেন। পাত্রমিত্রেরাও ইহাতে উল্লসিত হইয়া উঠিয়াছিলেন। ইউসুফ
তাহাদিগকে জলিখার সহিত তাঁহার শুভপরিণয়ের আয়োজন করিতে আদেশ দিলেন।
ফলে, যথারীতি এই বিবাহের মহা-আয়োজন চলিল,
শুভক্ষণে চন্দ্রাতপ তুলিলেক রঙ্গে।
ধর্মরি (?) পতাকা তুলিলা ধ্বজ সঙ্গে৷
জথ বাদ্য ডাও আছে সর্ব রাজ্য দেশ।
পঞ্চ শব্দে বাদ্য বাজে পুরিআ বিশেষা
ঢাক ঢোল দণ্ডী কাঁসী দুন্দুমি নিশান।
মন্দিরা মাদল ভাল তবল বিষাণ।
দোসরি মোহরি বাজে মৃদঙ্গ বহুল।
শঙ্খনাদ সিঙ্গা ভেরী বাজএ তম্বুল।
জয়তুর শরমণ্ডল যন্ত্রতন্ত্র পুর।
নৃত্যগীতে নৃত্যক নাচত্র জেহ্ন শূরা
ঝনঝনি ঝাঁঝরি ঝুমুরি ঝনাকার।
বাঁশী কাঁশী চৌরাশী বাজন অনিবারঃ
সানাই বর্গোল বাজে ভেউর কর্ণাল।
করতাল মন্দিরা বাজএ সুমঙ্গল৷
বিপঞ্চী পিণাক বাজে অতি মৃদুস্বর।
কপিলাস রুদ্র বাজএ নিরন্তর।
বিদ্যাধরী কুমারী নাচত্র নানা ছন্দে।
সুর সিন্ধু শৃঙ্গার মদন রস বন্দে॥
সুরপুরী জিনিআ আজিজপুরী সাজ।
বহুল নৃপতি আসি ভরিল সমাজ!
এইরূপে ইউসুফের সহিত জলিখার বিবাহ সাড়ম্বরে যথারীতি সুসম্পন্ন হইয়া
গেল। অতঃপর, তাঁহারা মহানন্দে বাসর যাপন করিলেন। নবদম্পতিরূপে বসবাস
করার জন্য ইউসুফ-জলিখা অন্তঃপুরে এক সুরম্য টঙ্গী রচনা করিলেন। ইহার নাম রাখা
হইল উদয় মুঙ্গলী। এই প্রমোদ টঙ্গীতেই পর পর তাঁহাদের দুই পুত্র জন্ম গ্রহণ
করিল। দেশের নিয়ম অনুসারে ধাত্রীর হাতে সম্ভান দুইটির লালন-পালনের ভার
পড়িল। তাই,
ধাঞিসবে ছাওয়াল পালএ মহানন্দ।
দিনে দিনে বাঢ়ে জেহ দুতিয়ার চান্দন
এই সময়ে ইউসুফের রাজত্বের শসাপূর্ণ প্রথম সাত বার পূর্ণ হইল। অষ্টম
বৎসরে দেশে নিদারুণ দুর্ভিক্ষ প্রকট হইয়া দেখা দিল। এই দুর্ভিক শুধু মিসরে সীমাবদ্ধ
তথাই পড়িল সবহেসে মেদিনী
না। পৃথিবীর সর্ব ছড়াইয়া পড়ি। ফলে,
মিছিরের বড় বড় অর্থ
বরিষা মেঘ নাই বৱিখিতে জল।
তথাইল খাল নাল জেহ ভূমি থল।
দুর্ভিক্ষের প্রথম বৎসরে মিসরের লোক ধানা বেচাকিনা করিয়া দুর্ভিক্ষের হাত
হইতে আত্মরক্ষা করিল; দ্বিতীয় বৎসরে মালমারা বিক্রয় করিয়া প্রাণ বাঁচাইল; তৃতীয়
বৎসরে কাহারও কাছে আহারের জন্য এক কণা শসাও অবশিষ্ট রহিল না। এইরূপ
অনন্যোপায় হইয়া মিসরের লোক ইউসুফকে কহিল,
তক্ষ্য দি কিন আড্ডা পূর্ব পরিষ্কাল।
"দাস দাসী করিআ রাখহ প্রাণধন।...
ইউসুফ পূর্ব-সঞ্চিত শস্য ভাণ্ডারের দ্বার একে একে খুলিয়া দিতে লাগিলেন।
মিসরবাসীরা সরকারী শস্য-ভাণ্ডার হইতে বিনামূল্যে জীবন ধারণের উপযোগী শস্য
লাভ করিয়া আসন্ন মৃত্যুর হাত হইতে রক্ষা পাইল। ইহাতে মিসরের লোক কৃতজ্ঞ
হৃদয়ে ইউসুফের দাস-দাসী তুল্য হইয়া গেল। ইউসুফ খোদার কাছে প্রার্থনা করিলেন
বৃদ্ধ নবী মোর বাপ আছে মহা দুখী।
মোহোর বিচ্ছেদে কান্দি হৈছে অন্ধ আঙ্খী!
কৃপা কর তান মোর হউ দরশন।
অন্ধজন জেহ্ন পাউ ফিরিয়া নয়ানঃ
তখন আকাশ বাণী হইল, “হে ইউসুফ নিশ্চিন্ত হও, অবিলম্বে তোমার সহিত
তোমার পিতার দেখা হইবে
ক্রমেই, ঘোরতর দুর্ভিক্ষে মিসর ও তঞ্চতুষ্পার্শ্ববর্তী সকল দেশের অবস্থা
সংকটাপন্ন হইয়া পড়িল। শাম-রাজ্যের কেনান (কনয়ান)গ্রামে এয়াকুব নবী ও তাঁহারদশ পুত্র বাস করিতেন। এই শাম-দেশও ডিক্ষের করাল গ্রাস হইতে রক্ষা পাইল না।
এই সময় এয়াকুব নবীর দশ পুত্র শস্যের অন্বেষণে মিসরে আসিল। ইউসুফ তাহাদের
পরিচয় লইলেন ও নিজের পরিচয়টি গোপন রাখিয়া তাহাদিগকে পরম সমাদরে
আপ্যায়িত করিলেন; আর প্রচুর শস্য ও গোপনে তৎসহ শস্যের মূল্য ফেরত দিয়া
স্বদেশে পাঠাইয়া দিলেন। বিদায়কালে বলিলেন যে, তাহারা যদি শস্য আহরণে পুনরায়
মিসরে আসে, তখন যেন তাহাদের সর্বকনিষ্ঠ ভাই বনি আমীনকে সঙ্গে লইয়া আসে,
তাহা হইলে, তাহাদিগকে আরও অধিক শস্য দেওয়া হইবে। এয়াকুব নবীর পুত্রগণ
স্বদেশে ফিরিয়া
ধান্যের জথেক শুনি করম্ভ মুকত।
তাহার অন্তরে ধন দেখন্ত বেকতঃ
এই সময়ে ইউসুফের রাজত্বের শসাপূর্ণ প্রথম সাত বৎসর পূর্ণ হইল। অষ্টম
বৎসরে দেশে নিদারুণ দুর্ভিক্ষ প্রকট হইয়া দেখা দিল। এই দুর্ভিক্ষ শুধু মিসরে সীমাবদ্ধ
রছিল না। পৃথিবীর সর্বত্র ছড়াইয়া পড়িল। ফলে,
মিছিরের বড় বড় জণ পুষ্করিণী।
তখাই পড়িল সব জেহ সে মেদিনী
বরিষাত্র মেঘ নাই বৱিখিতে জল।
তথাইল খাল নাল জেহ ভূমি থল।
দুর্ভিক্ষের প্রথম বৎসরে মিসরের লোক ধান্য বেচাকিনা করিয়া দুর্ভিক্ষের হাত
হইতে আত্মরক্ষা করিল; দ্বিতীয় বৎসরে মালমাত্তা বিক্রয় করিয়া প্রাণ বাঁচাইল; তৃতীয়
বৎসরে কাহারও কাছে আহারের জন্য এক কণা শস্যও অবশিষ্ট রহিল না। এইরূপ
অনন্যোপায় হইয়া মিসরের লোক ইউসুফকে কহিল,
ভক্ষা দিত কিন আহ্মা পুত্র পরিজন।
দাস দাসী করিআ রাখহ প্রাণধনা...
ইউসুফ পূর্ব-সঞ্চিত শস্য ভাণ্ডারের দ্বার একে একে খুলিয়া দিতে লাগিলেন।
মিসরবাসীরা সরকারী শস্য-ভাণ্ডার হইতে বিনামূল্যে জীবন ধারণের উপযোগী শস্য
লাভ করিয়া আসন্ন মৃত্যুর হাত হইতে রক্ষা পাইল। ইহাতে মিসরের লোক কৃতজ্ঞ
হৃদয়ে ইউসুফের দাস-দাসী তুল্য হইয়া গেল। ইউসুফ খোদার কাছে প্রার্থনা করিলেন
বৃদ্ধ নবী মোর বাপ আছে মহা দুখী।
মোহোর বিচ্ছেদে কান্দি হৈছে অন্ধ আঙ্খী!
কৃপা কর তান মোর হউ দরশন।
অন্ধজন জেহ্ন পাউ ফিরিয়া নয়ানয়
তখন আকাশ বাণী হইল, “হে ইউসুফ নিশ্চিন্ত হও, অবিলম্বে তোমার সহিত
তোমার পিতার দেখা হইবে
ক্রমেই, ঘোরতর দুর্ভিক্ষে মিসর ও তৎচতুষ্পার্শ্ববর্তী সকল দেশের অবস্থা
সংকটাপন্ন হইয়া পড়িল। শাম-রাজ্যের কেনান (কনয়ান) গ্রামে এয়াকুব নবী ও তাঁহার
দশ পুত্র বাস করিতেন। এই শাম-দেশও ডিক্ষের করাল গ্রাস হইতে রক্ষা পাইল না।
এই সময় এয়াকুব নবীর দশ পুত্র শস্যের অন্বেষণে মিসরে আসিল। ইউসুফ তাহাদের
পরিচয় লইলেন ও নিজের পরিচয়টি গোপন রাখিয়া তাহাদিগকে পরম সমাদরে
আপ্যায়িত করিলেন; আর প্রচুর শস্য ও গোপনে তৎসহ শস্যের মূল্য ফেরত দিয়া
স্বদেশে পাঠাইয়া দিলেন। বিদায়কালে বলিলেন যে, তাহারা যদি শস্য আহরণে পুনরায়
মিসরে আসে, তখন যেন তাহাদের সর্বকনিষ্ঠ ভাই বনি আমীনকে সঙ্গে লইয়া আসে,
তাহা হইলে, তাহাদিগকে আরও অধিক শস্য দেওয়া হইবে। এয়াকুব নবীর পুত্রগণ
স্বদেশে ফিরিয়া
ধান্যের জথেক শুনি করও মুকত।
তাহার অন্তরে ধন দেখস্ত বেকত॥
ইহাতে তাহারা আশ্চর্য হইয়া গেল। অনেক কল্পনা জল্পনা ও আলাপ-আলোচনার
পর স্থির হইল, মিসর-রাজ এক মহাজন ব্যক্তি, তাঁহার ধনের কোন অন্ত নাই,
প্রয়োজনও নাই; এত ধন দিয়া তিনি কি করিবেন? এই জন্যই তিনি 'গুনি'- অভ্যন্তরে
সংগোপনে শস্যের প্রদত্ত মূল্য ফেরত দিয়াছেন।
এই ঘটনার পরে পরেই, কিছু দিনের মধ্যে এয়াকুব নবীর পুত্রগণ তাহাদের কনিষ্ঠ
ভাই বলী আমীনকে সঙ্গে লইয়া আবার শস্য সংগ্রহ করিতে মিসর গমন করিল।
এইবারও তাঁহারা পূর্বের ন্যায় মিসরে সমাদরে গৃহীত হইল ও রাজগৃহে নিমন্ত্রিত হইয়া
ইউসুফের সহিত আহার করিল। এইখানেই একান্তে রাজ-অন্তঃপুরে বনী আমীনের
সহিত ইউসুফের পুনর্মিলন ঘটিল । তখন ইউসুফ তাঁহাকে গোপনে বলিয়া দিলেন
ভাই সব সঙ্গে জাইতে তোহ্মাক ন দিমু।
সংকেত সন্ধান করি তোহ্মাক রাখিমু।
কনকের এক কাটা ধান্য মাপি দিতে।
তোহ্মার গুণির মাঝে রাখিব গোপতেঃ
ফিরাই আনিব পাই অনুচর সব।
তবে ভাই সব মেলে ন হৈব রৌরবা
এই পরামর্শ অনুসারে কাজ হইল। শস্য লইয়া এয়াকুব নবীর পুত্রগণ
শামদেশাভিমুখে রওয়ানা হইল। মিসরের সীমা অতিক্রম কালে বিদেশীয়দের সকলের
থানাতল্লাশী হইতেছিল। এয়াকুব নবীর পুত্রগণের খানাতল্লাশী শুরু হইল। এই সময়
বনী আমীনের শস্য 'শুনিতে' স্বর্ণনির্মিত ধান্যের 'কাটা' পাওয়া গেল। ফলে বনী
আমীনকে চোররূপে রাজদ্বারে চালান দেওয়া হইল এবং অপর ভাইদিগকে শাম-দেশে
শস্য লইয়া চলিয়া যাইতে আদেশ দেওয়া হইল। ভ্রাতৃগণ ইউসুফের নিকট বনী
আমীনের জন্য ক্ষমা ভিক্ষা করিলেন। ইউসুফ ক্ষমা করিলেন না, বরং বলিলেন যে,
তিনি একটি “পাখরিয়া অশ্ব" বৃদ্ধ নবীকে আনিবার জন্য দান করিতেছেন; নবী না
আসিলে বনী আমীনকে ছাড়া হইবে না।
অগত্যা নবীর পুত্রগণ পিতাকে মিসরে আনিবার জন্য “পাখরিয়া অশ্ব" লইয়া
শামদেশে ফিরিয়া গেল। যথাসময়ে পিতাকে সঙ্গে লইয়া পুত্রগণ মিসরে রওয়ানা হইল।
যখন তাহারা মিসর- সীমান্তে পৌঁছিল, পিতাকে অভ্যর্থনা দান করিবার জন্য আজিজ
মিসর ইউসুফ সপারিষদ ও সসৈন্যে সীমান্ত অভিমুখে রওয়ানা হইলেন; আর
অন্তঃপুর নারীগণ
পুষ্পবৃষ্টি অনুক্ষণ
আজিজ অগ্রত নানা ভাতি
ধন্য ধন্য বোলে লোক
শুনিয়া শ্রবণ সুখ
আজিজ মিছির শুদ্ধমতি
অন্তঃপুর-চারিণীদের শুভেচ্ছাজ্ঞাপক "পুষ্পবৃষ্টি" মাথায় লইয়া ইউসুফ
পিতৃসংবর্ধনায় রাজধানী ত্যাগ করিলেন। এই সংবাদ শুনিয়া মিসরের লোক আনন্দে আত্মহারা হইলেন। সাত দিন পথ চলার পর, ইউসুফ যখন মিসর-সীমান্তে উপস্থিত
হইলেন, তখন তিনি পাত্র-মিত্র সকলকে সম্বোধন করিয়া আদেশ দিলেন
রথ হোস্তে লামহ জথ রথ রথিগণ।
পদে হাঁটি দেখি গিআ বাবার চরণত
চলিলেও সৈন্য সব পদরথি হৈআ
নৃপ সক্ষে চলে সব আনন্দে পুরিআঃ
সীমান্তেই পিতাপুত্রে মিলন হইল। তাঁহারা আনন্দে অধীর হইলেন ও মিসরের
রাজপুরী অভিমুখে রওয়ানা হইলেন। পথ চলিতে চলিতে নীল নদের তীরে উপস্থিত
হইলে, ইউসুফ পিতাকে বলিলেন যে, এই নদীতে স্নান করিলে অধিক পুণ্য লাভ হয়।
তখন ইয়াকুব নবী নীল-নদের জলে স্নান করিয়া পরম পরিতোষ লাভ করিলেন, এবং
সেহি পদ পরশনে নীলে পাইল মুক্তি।
সেহি জল বৰ্ণ হৈল দুধের আকৃতিঃ
যথাসময়ে পিতাপুত্র রাজধানীতে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। অনুচর দ্বারা জলিখার
কাছে সংবাদ পাঠাইয়া দেওয়া হইল যে, যেন "জলিখা আসউ শীঘ্ৰে মঙ্গল-বিধান"
করিতে । অমাত্য-কুমারীদের কাহারও হাতে দূর্বা, কাহারও হাতে ধান ও কাহারও
হাতে নানা পুষ্পলতা দিয়া তাহাদিগকে সঙ্গে লইয়া
নানা দ্রব্য সঙ্গে করি মঙ্গল-বিধান।
আইলা জলিখা বিবি সভা বিদ্যমান।
সর্বতনু বসনে ঢাকিআ আঙ্খী মুখ।
নবীর চরণ বন্দে মনে বাসি সুখ
অমাত্য রমণীগণে হৈলা দণ্ডবত।
স্বর্গ হোন্তে ইন্দ্ৰাণী আইলা জেহ্ন মতা
নবী একে একে সকলকে আশীর্বাদ করিলেন। জলিখাকে পুত্রবধূরূপে পাইয়া তিনি
অত্যন্ত আনন্দিত হইলেন। তাঁহাকে লইয়া গিয়া সুবর্ণ-বেদিকায় স্থাপিত এক রত্ন
সিংহাসনে বসানো হইল। চারিপাশে দাঁড়াইয়া অনুচরগণ চামর দোলাইতে দোলাইতে
বাতাস করিতে লাগিল । তখন
জলিখাকে আদেশ করিলা নৃপবর।
কনক ডিঙ্গার ভরি আনহ সত্তুর
বাপ-পদ আপনে পাখালে নৃপমণি ।
জলিখাএ জল ঢালে অবিরত পুনি
পাখালি নবীর পদ নির্মল করিলা।
জলিখা মস্তক কেশে উপস্কার কৈলাঃ
পুত্ৰক বুলিলা তবে জলিখা সুন্দরী।
সম্মুখে দণ্ডাই রহ পদ অনুসারিয়
বনী আমীনও আসিয়া পিতার সহিত মিলিত হইলেন। ইউসুফের দশ ভাই এই
সুময়ে "উদয়-মঙ্গল' টঙ্গীতে বিশ্রাম করিতেছিলেন। পিতাকে পরম যত্নে আদর
আপ্যায়ন করিয়া, বনী আমীন সহ তাঁহাকে এই টঙ্গীতে বাস করিবার ব্যবস্থা করিয়া।
হইল। ইয়াকুব নবী, তাহার দ্বাদশ পুত্র, দুই নাতি ও এক পুত্রবধূ পইয়া
আনন্দে বাস করিতে লাগিলেন।
মিসবাধিপতি ইউসুফ আবার রাজ্যশাসনে মনোনিবেশ করিলেন। এইবার তিনি
তাঁহার বড় ভাইকে মুখপাত্র করিলেন; অপর ভাইদিগকেও যথোপযুক্ত রাজকার্যের তার
দেওয়া হইল। তাঁহার সুশাসনে রাজ্যে কাহারও অভাব-অভিযোগ রহিল না। স
হেন মতে সপ্তম বরিখ গঠি গেল।
রাজ্যের দুর্ভিক্ষ নাহি তত দশা তেল:
দুর্ভিক্ষরে পুনরায় শস্যশ্যামলা হইল। মিসরেও পুনরায় পূর্ববৎ শস্য
ফলিতে লাগিল। এই রূপে দেশে সুখ-শান্তি ফিরিয়া আসিলে, ইউসুফ তাঁহার পুত্রয়ের
বিবাহ সম্বন্ধ ঠিক করিবার জন্য জলিখার সহিত পরামর্শ করিলেন। ঠিক হইল যে
মহাসাধু আছএ বারহা তান নাম।
তান কন্যা রূপবর্তী আছএ অনুপামঃ
সেহি কন্যা ইচ্ছুক জ্যেষ্ঠপুত্র লাগি।
বিবাহ নিবন্ধ কৈলা মন অনুরাপিঃ
পরিণয় কৈলা নূপ পত্ৰ সমাহিত।
মণিরত্ন কাঞ্চন ভূখত কৈল নিতঃ
আর এক নৃপতি আমির তান নাম।
চীন রাজ্যে নির্বাসন্ত মহিমা উপামঃ
সেহি রাজকন্যা এক রূপেত পার্বতী।
ত্রিভুবনে তান সম নাহি রূপবতী।
সেহি কন্যা ছোট পুত্রে কৈলা পরিণয়।
রাজ্য সক্ষে কন্যা দান কৈলা মহাশয়ঃ
অতঃপর, স্ত্রী-পুত্র ও পরিবার-পরিজন লইয়া ইউসুফ সুখে সংসারযাত্রা নির্বাহকরিতে লাগিলেন। তাঁহার ভ্রাতৃগণের মধ্যে যাঁহাকে যে রাজকার্যের ভার দেওয়া
হইয়াছিল, তিনি সে-কাজ অত্যন্ত কৃতিত্বের সহিত সমাধা করিতেছিলেন। মিসররাজ্যে
শান্তি-সুখের অবধি রহিল না।এই সময়ে একদিন মিসর রাজ ইউসুফের দিগ্বিজয়ে বাহির হইবার বাসনা হইল।
দি ইয়াকুব নবী পুত্রের এই বাসনার কথা জানিতে পারিয়া উপদেশ দিলেন যে,
ইউসুফ যেন দিগ্বিজয়ে বাহির হইবার পূর্বে খোদার কাছে প্রার্থনা করিয়া নিজের
মনোবাঞ্ছা জানাইয়া দেন। ইউসুফ তাহাই করিলেন। প্রার্থনান্তে দূতবর জিব্রাইল
তাঁহাকে জানাইয়া দিলেন যে,
প্রভু আজ্ঞা হৈল তুমি সর্বরাজ জিন।
কাফির সকল মারি করহ অধীন।
মহামন্ত্র কলিমা ন কহে জেহি জন।
ডাহার উপরে কর অস্ত্র বরিষণ।
স্বর্গীয় দূতমুখে এই সংবাদ শুনিয়া ইউসুফের পূর্ব-সংকল্প সুদৃঢ় হইল। তিনি
পাত্রমিত্রগণকে ডাকিয়া আনিলেন এবং তাহাদিগকে তাঁহার দিগ্বিজয় বাসনার কথা
জানাইয়া দিলেন। অতঃপর, মিসরের সেনা-বিভাগে সারা-সাজ রব পড়িয়া গেল
কারণ, আদেশ দেওয়া হইল
সুসা করহ সৈন্য জথ অশ্ববর।
সুবৰ্ণ কৃমীজ জীন পাথর।
জথেক পদাতিগণ রণেত জুঝার।
তা সম্ভাক দেঅ আনী রত্ন অলঙ্কার।
মহাবলী সেনা সেই সমরে তুখড়।
সিংহ সম পরাক্রম হাতে ধনুশরা
গজ বাজী রথ ধ্বজ পতাকা সুসাজ।
চতুরঙ্গ সেনা সাজে নৃপতি সমাজ
এইরূপে এক সুসজ্জিত প্রবল বাহিনী গঠন করিয়া, ইউসুফ তৎসহ দিগ্বিজয়ে
বাহির হইলেন। তিনি যেই দিকে গমন করিলেন, সেই দিকেই ভয়ে থরহরি কম্পিত
হইয়া উঠিল। তথাকার রাজন্যবর্গ আজিজ-মিসর ইউসুফের সহিত বিবাদ এড়াইয়া,
তাহার বশ্যতা স্বীকার করিয়া লইয়া, মনের আনন্দে তাঁহার সহিত দিগ্বিজয়ে চলিলেন
অধিকন্তু, রাজ-রাজড়ারা
সুবর্ণ মণ্ডিত ছত্র শির পরে ধরি।
চারিপাশে চামর দোলাএ সারি সারি
কোহ্ন রাজা সন্ধে কভো ন করিল রণ।
সব রাজা আজিজক পশিল শরণঃ
এইভাবে ইউসুফ দিগ্বিজয় করিয়া চলিলেন। অবশেষে তিনি 'সুবর্ণপুর' ('সোনার
গাঁও' কি?) নামক নগরে প্রবেশ করিয়া তথায় বিশ্রাম করিতে লাগিলেন, আর
সৈন্য অধিকারী ছিলা পাত্র একজন।
ইবিন আমিন ভাই আপনা ভবন,
এইস্থানে বিশ্রাম কালে ইউসুফ একদিন প্রভাতে মৃগয়ায় বাহির হইলেন। পথে এক
বনে অপূর্ব জন্তু দৃষ্টিগোচর হইল। ইউসুফ জন্তুটিকে ধরিতে তৎপ্রতি অশ্ব-ধাবন
করিলেন। আর, জন্তুটি প্রাণরক্ষার্থে অরণ্যের অভ্যন্তর ভাগে অনেক দূরে চলিয়া গেল।
জন্তুর পশ্চাতে ছুটিতে ছুটিতে ইউসুফ কাতর হইয়া পড়িলেন। তথাপি তিনি
পন্থের নির্গমন পারম্ভি লখিবার।
ন জানি কি গতি হয় অরণ্য ভিতর।
ইউসুফ বনে পথ হারাইয়া যখন এইরূপ চিন্তা করিতেছিলেন, তখন মধ্যাহ্ন কাল।
পরিশ্রমে তাঁহার অশ্বের মুখে ফেনা বাহির হইতেছিল ও তৃষ্ণায় তাঁহার ছাতি ফাটিয়া
যাইতেছিল। এই সময়ে অদূরে বনমধ্যে “আচম্বিতে শুনে রাজ হংসের কল্লোল।
নিকটেই জল আছে মনে করিয়া ইউসুফ সেই দিকে অশ্ব ধাবিত করিতেই দেখিতে
পাইলেন যে, তথায় এক দিব্য সরোবর বিদ্যমান। এই সরোবরে জল টলমল
করিতেছিল এবং তাহাতে
পদ্ম উপলে ক্রীড়ে হংস চক্রবাক।
নানা পক্ষী কেলি রঙ্গে আছে লাখে লাখ...
সেহি জ্বলে নামি নৃপ অঙ্গে পাখালিলা।
তীরে উঠি বসন ভূষণ বিভূষিলায়
ঘোটক আনিলা শীঘ্ৰে জল পান দিলা।
জলেত লামাই অশ্ব সিনান করাইলা!
অতঃপর, এই সরোবর-তীরে শিলাসনে বসিয়া তিনি বিশ্রাম করিতেছিলেন। এই
সময়ে সরোবরের পশ্চিম দিকস্থ অরণ্য হইতে সুললিত সংগীত ভাসিয়া আসিতে
লাগিল। তিনি ঘোড়ায় চড়িয়া ধীরে ধীরে সেই দিকে অগ্রসর হইলেন। কিয়দূর গমন
করিলে পর, তিনি তথায় এক সুরমপুরী দেখিতে পাইলেন এবং আরও দেখিতে
পাইলে বা
মধ্যে এক কন্যা রত্ন সিংহাসনে।
বিবুর বিৰুদের তার
ইহার নাম বিষুবর্তী বা বিধুপ্রভা। তিনি তখন মনোবাঞ্ছা সিদ্ধির জন্য মহেশ
রূপ নাহি তিন ভুবনে!!
দেবতার পূজায় ব্যস্ত ছিলেন। পূজা সারিয়া তিনি নবাগত অতিথি ইউসুফকে আদর
আপ্যায়নে তুষ্ট করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, যেখানে কাহারও আসিবার শক্তি নাই, তিনি
কিভাবে সেখানে আসিলেন এবং তিনি কে? ইউসুফ তাঁহার পরিচয় দিলে কুমারী
বলিলেন যে, “মনোরথ সিদ্ধি এবে কৈল নিরঞ্জন"। তিনি আরও বলিলেন যে, তাঁহাকে
এক নবীপুত্র স্বপ্নে দেখা দিয়াছিলেন। তাঁহার মত রূপবান পুরুষ তিনি কখনও দেখেন
নাই। তিনি তাঁহার স্বপ্নদৃষ্ট বাঞ্ছিতকে না পাইয়া অগ্নিকুণ্ডে প্রাণত্যাগ করিতে চাহিলে
এক আকাশ-বাণী শুনিতে পাইলেন,
ন মরিঅ আএ কন্যা দুক্ষিত হৃদয় ।
তোহ্মার মানস আখি পুরিব নিশ্চয়।
এই প্রসঙ্গে কন্যা বিধুপ্রভা এই বলিয়া ইউসুফকে জানাইলেন যে, তাঁহার সহিত
সাক্ষাৎকার ঘটায়, তিনি বুঝিতে পারিতেছেন যে, তাঁহার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হইবে।
বিধুপ্রভার এহেন উক্তি শুনিয়া
আজিজ বোলস্ত তন রাজার নন্দিনী।
জার মুখে স্বপ্নে তুথি দেখিলা আপনিঃ
তাহান বৃত্তান্ত আদি জানি ভালমতে।
কহিব তোহ্মাত আমি সর্ব কথা তত্ত্বে।
আহ্মার কনিষ্ঠ ভাই ইবিন আমিন।
জার লাগি মনস্তাপ ভাব রাত্রিদিন।
এই কথা শুনিয়া বিধুপ্রভা ইউসুফের পদস্পর্শ করিয়া পদধূলি গ্রহণ করিলেন।
ইউসুফ তাঁহাকে আশ্বস্ত করিয়া বলিলেন যে, শীঘ্রই তাঁহার মনোরথ পূর্ণ হইবে।
ইউসুফের কথায় আশ্বস্ত হইয়া,
আজিজ প্রণাম করি বোলে বিধুবতী ।
মোর বাপ রাজ্যেত আইস মহামতিঃ
আজিজ মিসর ইউসুফ বিধুবতী বা বিধুপ্রভার এই আবেদনে সাগ্রহে সাড়া
দিলেন। অতঃপর, তিনি অশ্বে ও বিধুপ্রভা রথে আরোহণ করিয়া কন্যার উদ্দিষ্ট
পিতৃপুরীতে যাত্রা করিলেন। এই রাজপুরীর নাম "মধুপুরী"। ইহা বিধুপ্রভার পিতার
রাজধানী। যাত্রান্তে ইউসুফ ও বিধুপ্রভা
অবিলম্বে পাইল গিআ সেহি মধুপুরী।
জিনিআ অমরাপুর রাজার উয়ারী।
মধুপুরী (ভাওয়ালের অন্তর্গত মধুপুর কি?) পৌছিয়াই, বিধুবতী-বিধুপ্রভা রথ
হইতে অবতরণ করিয়া পিতৃমাতৃ-পদে প্রণাম করিলেন ও তাঁহাদের কাছে নিবেদন
করিলেন যে,
জার লাগি মনস্তাপ পাড় (পাওঁ) রাত্রি দিনে।
তান জ্যেষ্ঠ সহোদর আসিছে আপনে!
তোহ্মা পুরী মধ্যে আনি দেখহ যতন।
তান রূপে পুরী মোর হৈছে সুশোভন!
বিধপ্রভার পিতার নাম শাহরাল: তিনি গন্ধবদের রাজা ছিলেন। কন্যার অনুরোধে
তিনি ইউসুফকে অভ্যর্থনা দান করিবার জন্য "মধুপুরী' হইতে “পদরথি হাঁটিআ আইলা
শীঘ্রগতি। দেখা হইতেই, তিনি ইউসুফকে জোড়হস্তে প্রণাম করিয়া কি কারণে এই
গন্ধর্বপুরে তাঁহার আগমন, তাহা জানিতে চাহিলেন। ইউসুফ মধুপুরপতিকে সমস্ত কথা
সুস্পষ্টভাবে জানাইলে, গন্ধর্বরাজ শাহাবাল সন্তুষ্ট চিত্তে বলিলেন,
তোহ্মার অনুজ এবে আন শীঘ্র করি।
কুমারী বিবাহ সজ্জ এথা আমি করি৷
গন্ধর্বরাজ-কুমারী বিধুপ্রভার এক শুক-পক্ষী ছিল। ইহার নাম “সুধীর ললিত”।
এই পক্ষী "বহুল পড়িছে শাস্ত্র জানে তত্ত্ব সার" । পক্ষীটি আজিজের সম্মুখে আসিয়া
তাঁহাকে প্রণাম করিল। আজিজ-মিসর ইউসুফ পক্ষীকে বলিলেন যে, সৈন্য-সামন্তসহ
'সুবর্ণ পুরীতে' তাঁহার ভ্রাতা বনী আমীন অবস্থান করিতেছেন, অথচ তিনি সে পুরীর
পথের সন্ধান জানেন না। পক্ষীটি যেন 'সুবর্ণ পুরীর' উদ্দেশ তাঁহাকে জানাইয়া দেয়।
তখন ‘সুবর্ণপুরী' হইতে বর্নী আমীনকে আনিবার জন্য, চন্দ্রপ্রভা তাঁহার শুক “ললিত
সুধীরকে" পাঠাইয়া দিতে পরামর্শ দিলেন। তাহার পরামর্শ অনুসারে
নৃপতি লেখিল পত্র ভাই সন্নিধানে।
পাত্রগণ প্রতি পত্র লেখে জনে জনে॥
এথা মধুপুরী আমি আছি সাবধানে।
কোহ্ন চিন্তা তুমি সব ন চিন্তা মনে
আহ্মার কনিষ্ঠ ভাই ইবিন আমিন।
শুক সন্ধে দি পাঠাঅ ন ভাবিঅ ভিন।
আখিঁ এথা শাহাবাল নৃপতি সঙ্গতি।
কুটুম্বিতা তান মোর সম্বন্ধ পিরীতি।
পত্র লইয়া শুকপক্ষীকে 'সুবর্ণ পুরীতে' পাঠানো হইল। পক্ষী যখন সুবর্ণ পুরীতে
পত্র লইয়া উপস্থিত হইল, তখন নিরুদ্দিষ্ট আজিজ-মিসরের খোঁজাখুঁজিতে তাঁহার পাত্র
মিত্র, সৈন্য-সেনা ও ভ্রাতা বনী আমীন ব্যস্ত সমস্ত ছিলেন। পক্ষীর পত্র দেখিয়া খবরের
প্রত্যাশায় সকলে বলিয়া উঠিল, "পত্র দেঅ পক্ষীরাজ এড়হ ভূমিত"। কিন্তু, কাহাকেও
চক্ষুস্থ পত্র না দিয়া
পক্ষী বোলে ইবিন আমিন কার নাম।।
সেহি আসি পত্র মোর লেহ এহি ঠামঃ
পক্ষীর মুখে এই উক্তি শুনিয়া বনী আমীন তাহার মুখ হইতে পত্র লইয়া দেখিলেন
যে, ইহা আজিজ-মিসর ইউসুফের পত্র পাঠ করিয়া সকলে আশ্বস্ত হইলে, শুক পক্ষী
বনী আমীনকে বলিল,
শাহাবাল নামে রাজা গন্ধর্বের পতি।
তান কন্যা বিধুপ্রভা রূপেত পার্বতী
স্বপনেত দেখিল সুরূপ মনোহর।
ইবিন আমিন মোর প্রাণের দোসর।
পক্ষীর মুখে এই কথা শুনিয়া এক বিস্মৃতপ্রায় অতীত স্বপ্নের স্মৃতি বনী আমীনের
মনে জাগিয়া উঠিল। তিনি এক গন্ধর্বসুতাকে বহুদিন পূর্বে স্বপ্নে দেখিয়া প্রাণেশ্বরী-রূপে
বরণ করিয়াছিলেন। এখন তিনি বুঝিতে পারিলেন যে, এই সেই গন্ধর্ব-নন্দিনী, যাঁহাকে
তিনি স্বপ্নে পত্নীরূপে গ্রহণ করিয়াছিলেন। তখন তাঁহার হৃদয়ে সুষুপ্ত প্রেম বাত্যাবিক্ষুব্ধ
বহির ন্যায় জ্বলিয়া উঠিল। তিনি ধৈর্যধারণ করিতে অসমর্থ হইয়া শুকপক্ষীকে লক্ষ্য
করিয়া বলিয়া ফেলিলেন
সুধীর ললিত তোর পড়ঙ্ চরণে।
শীঘ্র করি কন্যা সহ্মে করাঅ মিলনে।
পক্ষী বোলে শুন আএ নবীর সন্ততি।
এক মন্ত্র তোহ্মাক শিখাও ভাল অতিঃ
সেহি মন্ত্র প্রভাবে হৈবা খগচর।
অবিলম্বে জাইবা তুমি কুমারী গোচর।
এই মন্ত্র 'গন্ধর্ব-মহামন্ত্র' নামে পরিচিত। ইহার কার্যকরী ক্ষমতা সম্বন্ধে অবগত
হইয়া, খগচররূপে উড়িয়া তিনি 'সুবর্ণপুর' হইতে ‘মধুপুর' যাইবেন কিনা সে বিষয়ে
পাত্রমিত্রদের সহিত পরামর্শ করিলেন। ঠিক হইল যে, এইভাবে বনী আমীনের মধুপুর
যাওয়া চলে।
অতঃপর, শুক বনী আমীনের কানে 'গন্ধর্ব-মহামন্ত্র' কহিল। বনী আমীন পক্ষীর
ম্যায় নভঃচারী হইয়া অল্পক্ষণের মধ্যেই 'মধুপুর' চলিয়া গেলেন। তথায় ইউসুফের
সহিত বনী আমীনের পুনর্মিলন ঘটিল। তখন ইউসুফ তাঁহার কনিষ্ঠ ভ্রাতার নিকট
আদ্যোপান্ত সমস্ত ঘটনা বিবৃত করিলেন। বনী আমীন এই কাহিনী শুনিয়া আনন্দিত
হইলেন। তিনিও ডাঁহার স্বপ্ন-বৃত্তান্ত জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার নিকট বিবৃত করিয়া কহিলেন,
সেহি হোস্তে মোর মনে ন ভাবএ আন।
স্বপ্নে দেখা দিআ মোর হরিলেক প্রাণা
গন্ধর্বরাজ শাহবাল মধুপুরে ইউসুফ ও বনী আমীনকে পরম যত্নে ও আদর
আপ্যায়নে সম্রষ্ট রাখিয়া অতিথি সৎকার করিতেছিলেন। ভৃত্যেরা তাঁহাদিগকে বাতাস
করিতেছিলেন ও গন্ধর্ব-কন্যারা নাচিয়া-গাহিয়া আনন্দ করিতেছিলেন। এই সময়ে
বিষ্ণুপ্রভা তাঁহার স্বয়ম্বরের আয়োজন করিবার জন্য পিতাকে অনুরোধ করিলেন।
১২.
বিষুবর্তী-বিধুপ্রভার অনুরোধে মধুপুরে স্বয়ম্বর সভার উদ্যোগ চলিল। চতুর্দিকে
বিষ্ণুপ্রভার স্বয়ম্বরের আতসম্ভাবনার কথা প্রচার করিয়া দেওয়া হইল। নানা দিগদেশ
হইতে তরুণ রাজ-রাজড়ারা এ স্থানে আগমন করিতে লাগিলেন। তাঁহাদের
মনোরঞ্জনের জন্য
বেয়াল্লিশ বাদ্যের ধ্বনি বাজে সুললিত।
মধুপুরী মধ্যে জেহ অমৃত পুরিত!
জথ দেবগণ আছে আইল দেবপুরী।
ইন্দ্র বিদ্যাধরী নাচে হাতে চামরীঃ
পশু পক্ষী হরিষে করএ মৃদুধ্বনি।
রভস বিলাসে নাচে গন্ধর্ব-রমণী।
বিধুপ্রভাও স্বয়ম্বর সভায় গমন করিবার জন্য স্নানান্তে নানা বস্ত্রে ও আভরণে
সজ্জিতা হইতে লাগিলেন। তিনি অর্ধচন্দ্র আকৃতির কবরী বাঁধিলেন, বক্ষে অনুপম
কাঁচুলি পরিধান করিলেন, বাহুতে তাড়, সু-অঙ্গুলে অঙ্গুরী, কটিদেশে কিঙ্কিণী, পদে
মঞ্জীর পরিলেন। অধিকন্তু
দেব আর গন্ধর্ব কমারী জথ আছে।
সকল জোগান হৈল কন্যা চারিপাশেঃ
এমন আড়ম্বরপূর্ণ স্বয়ম্বরের আয়োজন দেখিয়া ইউসুফের মনে কষ্ট হইল। কারণ,
তখনও তাঁহার সৈন্যগণ সুবর্ণপুরীতে অবস্থিত বলিয়া এহেন নৃত্যগীত-সম্বলিত বিবাহের
উপভোগ হইতে বঞ্চিত। তখন 'সুধীর-ললিত' নামক শুক পক্ষীটিকে ইউসুফ ও
বিধুপ্রভা আদেশ দিলেন,
অবিলম্বে চলি জাঅ সুবর্ণের পুরী ।
সর্ব-সৈন্য আন গিআ কার্য অনুসরিয়
শুক “সুধীর ললিত” পত্র লইয়া সুবর্ণপূরীতে চলিয়া গেল ও অল্পকাল মধ্যে
ইউসুফের সৈন্যগণকে পত্র দিল। পত্র-পাঠান্তে সৈন্যগণ মধুপুরী অভিমুখে বিষ্ণুর
বিবাহে যোগ দিতে রওয়ানা হইল। যথাসময়ে তাহারা মধুপুরীতে আসিয়া উপস্থিত
দেব সৈনা রাজসৈন্য একত্র হইনা।
স্বাঘর স্থানে বৈসে সমাজ করিআঃ
দুই বাজা বাদ্য বাজে জয় শঙ্খ ধ্বনি।
বিবাহ মঙ্গলা গাছে দেবের রমণী।
তখনও বিষুপ্রভা স্বয়ম্বর সভায় প্রবেশ করেন নাই। তাঁহার আগমন প্রতীক্ষায়
সমন্বেত পাণিগ্রার্থিগণ অধীর। দর্শকগণের অবস্থাও প্রকৃতপক্ষে তথৈবচ। অত্যল্পকাল
মধ্যে সঙ্গী ও সহচরী সংবেষ্টিতা হইয়া, বিষ্ণুপ্রভা কুঞ্জর-গমনে স্বয়ম্বর সভায় প্রবেশ
করিলেন। অমনি
উৎকণ্ঠ নৃপ সঙ নয়ান চঞ্চল।
দেখিআ কন্যার রূপ হইলা বিকলা
কুমারী আসিছে সভে আছিল হেরিয়া!
পশুপক্ষী হরিষে অদ্ভূত করে ধ্বনি।
কার আড়ে কেহো চাহে অলক্ষিত হৈআ
স্বর্গেত হরিষে নাচে অমর রমণী।
বিষ্ণুপ্রভার হাতে পুষ্পমালা ছিল। এই বরমাল্য তিনি কাহার গলায় পরাইবেন,
তখনও তাহা কাহারও জানা ছিল না। মালা হাতে বিধুপ্রভা সভায় প্রবেশ করিয়া ধীরে
ধীরে হাঁটিয়া চলিলেন। তাঁহার পাণিপ্রার্থীদের মধ্যে হইতে তিনি যাঁহাকে পাছে ফেলিয়া
আগাইয়া চলিলেন, তাঁহার মানসিক দুর্দশার অন্ত রহিল না। চলিতে চলিতে বনি
আমীনের সমীপবর্তিনী হইয়া তাঁহার গলায় মালা পরাইয়া দিতেই
জয় জয় শব্দ হৈল স্বয়ম্বর পর।
দোহানে দোহান দেখি আনন্দ মন ভোর।।
মুখরোল কৈল জথ গন্ধর্বের নারী।
দুহু জন বসাইল নিআ অন্তঃপরী
নানা হাসি-ঠাট্টা ও আমোদ প্রমোদে স্বয়ম্বর-দিবস অতিবাহিত হইল। নিশাভাগে
বিধুপ্রভা ও বনী আমীন বাসর যাপন করিলেন। প্রভাতে নিদ্রা হইতে
বিষ্ণুপ্রভা বনী আমীনকে বলিলেন,
আউল হইল কেশ মুকল কুন্তল।
কানড়ী কবরী বান্ধি দেঅ পুষ্পদল৷
জাগরিত হইয়া
এইরূপ ভোগ-উপভোগে সাত রাত্রি সাত দিন কাটিয়া গেল। গন্ধর্বরাজ শাহবাল
সভা করিয়া বসিলেন। আজিজ-মিসর ইউসুফ এবং তৎ ভ্রাতা বনী আমীনও সেই সভায়
যোগ দিলেন। গন্ধর্ব ও মানব একত্র বসিয়া নানাবিধ চর্ব্য-চোষ্য-লেহ্য-পেয় দ্রব্যাদি
আহার করিল। আঙ্গুরান্তে শাহাবাল বলিলেন
পুত্র নাহি মোর ঘরে দিতে রাজা ভার।
জামাতাক রাজ্য দিমু দেব অধিকার!
আজিজ-মিসর এই প্রস্তাবে সম্মত হইয়া বনী আমীনকে শুভক্ষণে রাজ্য মানের
জন্য আয়োজন করিতে বলিলেন। অতএব, নরপতি শাহবাগ অভিষেক-ক্রিয়া সম্পন্ন
করিয়া জামাতাকে বাজাভার অর্পণ করিতে মনস্থ করিলেন। অভিষেকের আয়োজন
নানান তীর্থের জল আনে ঘট ভরি।
সুরভি দুগ্ধ আনি অভিষেক করি
পাত্র সন্ডে বসাইল রাজ সিংহাসনে।
চামর দোলাএ আসি জথ দেবগণের
বিষ্ণুপ্রভা ইবিন আমিন সঙ্গে করি।
তান ঠাঁই সমর্পিল রাজ্য অধিকারী।
মধুপরীতে বনী আমীনের রাজ্যাভিষেক-ক্রিয়া সুসম্পন্ন করিয়া, ইউসুফ মিসর
দেশে ফিরিয়া গেলেন। মিসর যাত্রাকালে তিনি বনী আমীনকে বলিলেন যে,
তুমি রহি থাক এথা রাজ্য অধিকার ।
পশ্চাতে জাইবা তুদ্ধি বাপ দেখিবার।
ইউসুফ মিসরে পৌঁছিয়া সমস্ত বৃত্তান্ত বৃদ্ধ নবীকে বলিলেন। নবী এই বৃত্তান্ত শুনিয়া
সুখী হইলেন। অতঃপর, ইউসুফ এমন সুখ্যাতি সহকারে রাজ্য পালন করিলেন যে,
রামেহো নারিল হেন রাজ্য পালিবার।
বলি কর্ণ দানে সম ন হৈল তাহারা
এদিকে মধুপুরীতে বনী আমীন বেশ কিছুদিন বাপ ভাই-এর বিচ্ছেদে কাটাইয়া
দিয়া অস্বস্তিবোধ করিতেছিলেন। এই সময়ে তাহাকে প্রায়ই শোকাকুল দেখাইত। এমন
কি, তাঁহাকে কখনও কখনও রোরুদ্যমান অবস্থায়ও দেখা যাইতে লাগিল। হঠাৎ
একদিন বিধুপ্রভা তাঁহাকে এইরূপ অবস্থায় দেখিতে পাইয়া কি কারণে তিনি এহেন
বিষাদিত মনে কালাতিপাত করিতেছেন, তাহা জানিতে চাহিলে
কুমারে বোলন্ত স্তন রাজক নন্দিনী।
বাপ ভাই বিনে নিত্য জলএ আগুনিয়
বাপভাই পদ প্রণামিআ এক মতি।
আজা দেঅ জাইআ আসিমু শীঘ্রগতি।
কুমারী বোলএ আমি জাই তোমা সঙ্গে।
বৃদ্ধ নবী চরণ বন্দিমু গিআ রঙ্গে।
এথ শুনি কুমার সন্তোষ হৈল মন।
কুমারী চলিলা সঙ্গে লৈআ পরীগণা
যথা সময়ে বনী আমীন ও বিষুপ্রভা মিসরে গিয়া উপস্থিত হইলেন। তাঁহারা যে
ভাতা ও পিতার সহিত মিলিত হইবার জন্য দেশে আগমন করিতেছেন, এই সংবাদ
দেখিতে দেখিতে চতুর্দিকে ছড়াইয়া পড়িল। আজিজ মিসর ইউসুফ তাঁহাদিগকে
সাদরে ও সানন্দে অভ্যর্থনা দান করিলেন। তাঁহারা নবীর পদধূলি লইলেন। নবী
তাঁহাদের মণ্ডকে চুমা দিয়া তাঁহাদিগকে প্রাণ ভরিয়া আশীর্বাদ করিলেন। অতঃপর
বধূ-বরণ প্রভৃতি স্ত্রী-আচার শুরু হইল। অন্তঃপুর হইতে বাহির হইয়া আসিয়া
মঙ্গল করিআ তবে জলিখা সুন্দরী।
অন্তঃপুর মধ্যে কন্যা নিলা হাথে ধরি।।
অন্যে অন্যে দুই দেবী সম্ভাষা আছিল।
বিধুপ্রভা জলিখাক চরণ বন্দিল৷
প্রেমভাবে আলিঙ্গিআ কোলে বসাইলা।
সন্তোষে জলিখা বিবি আশীর্বাদ কৈলা!
কন্যা সন্ধে ইবিন আমিন মুখ দেখি।
আজিজ জলিখা মন হৈল বহু সুখী৷
ইহুফ জলিখা বন্ধু বান্ধব সংহতি।
সুখে নিবাসএ হৈআ রাজ্য অধিপতি।
মধুপুরী ইবিন আমিন অধিকার।
পরিচর্যা গন্ধর্বে করন্তি অনিবারঃ
এইভাবে ইউসুফ আজিজ-মিসর বা মিসরের রাজারূপে সপরিবারে মিসরেই বাস
করিতে লাগিলেন। তাঁহার সহিত তাঁহার পিতা ইয়াকুব নবী ও ভ্রাতৃবর্গও ছিলেন। কিন্তু,
তাঁহার কনিষ্ঠ ভ্রাতা বনী আমীন বিধুপ্রভাকে লইয়া মধুপুরীতেই চলিয়া যান এবং তথায়
গন্ধর্ব-রাজ্য শাসন করিতে থাকেন।
এইখানে “ইউসুফ জলিখা" কাব্য শেষ হইয়াছে।
0 মন্তব্যসমূহ