---সারদামঙ্গল কাব্য আলোচনা
সারদামঙ্গল এর সৌন্দর্যপ্রীতি
সারদামঙ্গল এর নিসর্গচেতনা
sarodamongol kabbo
সারদামঙ্গলের রোমান্টিকতা সারদা
গীতিকবি বিহারিলাল ত্রিকালের স্বরস্বতীমুর্তী ---
**বিঃদ্র-বাংলা বিভাগের সকল পড়াশোনা পেতে ব্লগটিতে যুক্তথাকুন https://monoweredu13.blogspot.com/?m=1
ত্রিকালের সরস্বতী মূর্তি
যে সরস্বতী মূর্তির কথা বিহারীলাল উল্লেখ করিয়াছেন তিনি মাঘ মাসের শুক্লাপঞ্চমীতে পূজিতা বাগ্দেবী নহেন, যদিও তিনি জ্যোতির্ময়ী সুরূপসী ও যোগীরদ্যানের ধন ৷ এই দেবী কবির সৌন্দর্যলক্ষ্মী, মানস-সুন্দরী, শেলি যাঁহাকে Spiritof Beauty রূপে অভিহিত করিয়াছেন। এই দেবীর সহিত, কবির বিরহ-মিলনেরকাহিনী সারদামঙ্গল কাব্যে বর্ণিত হইয়াছে। বিহারীলাল তাঁহার বন্ধু অনাথবন্ধুরায়কে একটি পত্রে লিখিয়াছেন 'সরস্বতীর সহিত প্রেম, বিরহ ও মিলন বুঝাইতেহইল অনেকগুলি অসর্ববাদিসম্মত কথা কহিতে হয়। বাগ্দেবীকেসৌন্দর্যলক্ষ্মীরূপে কল্পনা করিলে সত্যই তাহা অসৰ্ববাদিসম্মত হইয়া পড়ে। এইদেবীর সহিত তাঁহার হৃদয়ে সম্পর্ক স্থাপিত হয়াইছে। কবি তাঁহাকে সম্বোধনকরিয়া বলিয়াছেন :
"এস মা করুণা রাণী
ও বিধু-বদনখানি
হেরি হেরি আঁখি ভরি হেরি গো আবার""!
পর্ণিমা যামিনী সদৃশ ষোড়শী রূপসী বামা করিবর মানস-মরালী, আনন্দরূপিণী,Lআবার তিনিই ত্রিদিব দেবী। জ্যোতির প্রবাহ মাঝে তিনি বিশ্ব-মোহিনী প্রেমের প্রতিমা
মূর্তিতে বিরাজ করেন, আবার তিনিই দেবী যোগেশ্বরী, সত্যরূপা সরস্বতী। কবিরমানস দৃষ্টিতে তিনি 'আলোয় করেছ আলো প্রেমের প্রতিমা'। তিনি আবির্ভূতা হইয়ানশাস্ত্র কালে সন্তপ্ত প্রাণকে শীতল করেন, আবার অরুণ উদয়ে অন্তর্হিতা হন।তাঁহাকে হারাইয়া জীবন মরুভূমি সদৃশ বলিয়া মনে হয়।"
"এ বিরস মরুভূমে
সকলি আচ্ছন্ন ধূমে।'"
কোথাও একটিও আর নাহি ফোটে ফুল।
তথাপি এই দেবী কবির প্রাণকে আকর্ষণ করেন। তাঁহার সহিত মিলনের
অভিপ্রায়ের মধ্যে কবি দ্বৈতের মধ্যে অদ্বৈতানুভূতির আনন্দ উপলব্ধি করিতে চান।
থাকি বা প্রিয়ার বুকে,
যাই বা মরণ-মুখে,
"""এ আমি, আমিই রব ; দেখুক জগৎ।"""
সারদাকে কবি দ্বিবিধরূপে উপলব্ধি করিয়াছেন, কবির দৃষ্টিতে ও যোগীর দৃষ্টিতে। কবির দৃষ্টিতে তিনি আনন্দ-স্বরূপিণী, অমূর্ত সৌন্দর্যের সারভূত প্রকাশ ওপ্রমের প্রতীক। অবার যোগীর দৃষ্টিতে তিনি সত্যরূপা সরস্বতী; তাঁহার মধ্যেমাধুর্য ও ভয়ঙ্করের দীপ্ত প্রকাশ। তিনি জগতের ঐক্য বিধায়িত্রী, বৈচিত্র্যের মধ্যেঅখণ্ড স্বরূপিণী। এই নিত্য স্বরূপার মধ্যে সকল প্রবহমান ধারা আসিয়া স্তব্ধ ওশান্ত হইয়াছে। শেলিও এই অঞ্চল সত্যের ধ্যান করিয়া বলিয়াছেন, 'the one'remains, the many change and pass শেলি ও বিহারীলালের কবি-দৃষ্টিতে এইসৌন্দর্য প্রেম-স্বরূপা। কীটস্ তাঁহাকে নিষ্কলুস সৌন্দর্যের আদর্শরূপে গ্রহণকরিয়াছেন। বেদনা ও মানবিক সহানুভূতির মাধ্যমে তাঁহাকে লাভ করিতে হয়।জগতের খণ্ড সেন্দর্য পরিপূর্ণ সৌন্দর্যের প্রকাশ, কিন্তু শেলির নিকটে পার্থিবসৌন্দর্য ক্ষণস্থায়ী। ২২ বিহারীলালের দৃষ্টিতে পার্থিবসৌন্দর্য পরিশুদ্ধ হইয়া অপার্থিব সৌন্দর্য মূর্তিতে পরিণত হইয়াছে।
"""কোটি শশী উপহাসি,
উথলে লাবণ্য রাশি,
তরল দর্পণে যেন দিগন্ত আবরে।"""
ত্রিকালের সরস্বতী মূর্তির পরিচয় দান করিয়া বিহারীলাল লিখিয়াছেন :
গাহিতে গাহিতে সহসা বাল্মীকি মুনরি পূর্ববর্তী কাল মনে উদয় হইল। তৎপরবাল্মীকির কাল, তৎপরে কালিদাসের। এই ত্রিকালের ত্রিবিধ সরস্বতী মূর্তি রচনাস্তর আমার চির আনন্দময়ী বিবাদিনী সারদা কখন স্পষ্ট, কখন বা অস্পষ্ট, কখনতিরোহিতভাবে বিরাজ করিতে লাগিলেন।
কবি যে মূর্তির ধ্যান করিয়াছেন তাহা হইল :
""কপোলে সুধাংশু ভাস
অধরে অরুণ ভাস,
নয়নে করুণা সিন্ধু প্রভাতের তারা জ্বলে।""
এই দেবী নিত্যা ও বিশ্বরূপা। নিত্যে সা জগনূর্তি। মানবসংসার তাঁহারপ্রকাশ করুণারূপিণী প্রেমমূর্তিতে। ইহাকে প্রত্যক্ষ করিলে অস্তর হইতে শোকতাপ বিদূরিত হয়। এই দেবী কবিগণের বন্দিতা ও যোগীগণের আরাধ্যা।বৈদিক যুগের সরস্বতী মূলত: নদী, পরে তাহার অধিষ্ঠাত্রীদেবী ও তৎপরে বাগদেবী। তিনি সিংহবাহনা কেননা তিনি দেবগণের হাত এড়াইবার জন্য একদাসিংহমূর্তি ধরিয়াছিলেন। জ্ঞানরূপা জ্যোতির্ময়ী বাগদেবী সরস্বতীই গায়ত্রীর সহিতমিশিয়া গেলেন। ২৪ গায়ত্রী মন্ত্রে যে বরেণ্য ভর্গের কথা বলা হইয়াছে তাহা ব্রহ্মেরশক্তি। গায়ত্রী-সরস্বতীকে জ্যোতির্ময়ী দেবী বলিয়া গ্রহণ করা হইল। এইভাবে
বিহারীলালও লিখিয়াছেন :
"ব্রহ্মার মানস সরে
ফুটে ঢল ঢল করে
নীল জলে মনোহর সুবর্ণ-নলিনী।"
‘সারদামঙ্গলের' সূচনায় প্রথম সর্গের গীতাংশে ঘুমন্ত প্রকৃতি-পানে সন্নিবদ্ধদৃষ্টি অমরাবালা ঊষার বর্ণনা দিয়া কবি লিখিয়াছেন :
"চরণকমলে লেখা, আধ আধ রবি-রেখা,
সর্বাঙ্গ গোলাপ-আভা, সীমস্তে ও শুকতারা জ্বলে।"""
যোগে যেন পায় স্ফূর্তি
সদয়া করুণ মূর্তি
বিতরেণ হাসি হাসি শাস্তিসূধা ভূমন্ডলে"""
এই সুখস্বরূপিণী দেবী ঊষারানীরূপে খ্যাত। এই ঊষারাণীর সহিতবীণাপাণির আবির্ভাবের জন্য কবি প্রার্থনা করিয়াছেন।নিশীথকালে আকাশ চন্দ্রসূর্য-তারা তিরোহিত, চরাচর অন্ধকারে আবৃত।
"তিমিরে নিমগ্ন ভব,
নীরব নিস্তব্ধ সব,
কেবল মরুতরাশি করে কোলাহল"।
অন্ধকার অপসারিত করিয়া হিমাদ্রিশিখর আলোকিত করিয়া পূণ্য তপোবনে অপরূপ জ্যোতির আবির্ভাব ঘটিল। 'তামসী-তরুণ-ঊষা-কুমারী রতনের ২৫অভ্যুদয় ধরিত্রী উদ্বুদ্ধ হইল, দিগঙ্গনাগণ শূন্যে জাগিল, অন্বরতলে পারিজাতবিকশিত হইল ও মানস সরোবরে কমল-কানন প্রফুল্ল হইয়া উঠিল। ঊষাচৈতন্যস্বরূপা। তাই তাঁহার আবির্ভাবে মানসিক জড়তা অপসারিত হয় এবং
মানবকূল আনন্দিত হয়। সুতরাং দেখা গেল ঊষারূপে জগতে সরস্বতীর আবির্ভাব ঘটিয়া থাকে ।দ্বিতীয় সর্গে বাল্মীকির যুগে এই দেবীর আবির্ভাব বর্ণনা করা হইয়াছে ।তটনী-রাণী তমসা কর্তৃক বিধৌতা লোচনলোভা পুলিনবিপিনের শোভায় বিমুগ্ধবাল্মীকি ভাবভোলা মনে বিচরণ করিতেছেন। তথায় এইশান্ত পরিবেশ সহসা এক শবর আবির্ভূত হইয়া ক্রৌঞ্চমিথুনের মধ্যে ক্রৌঞ্চকে বধ করিল। শোকার্তাক্রৌঞ্চীর করুণ ক্রন্দনে অরণ্য পূর্ণ হইল। এই দৃশ্য দেখিয়া করুণ-হৃদয় মুনি
বিহবলের প্রায় হইলেন। এই অবস্থায়:
""সহসা ললাটভাগে
জ্যোতির্ময়ী কন্যা জাগে,
জাগিল বিজলী যেন নীল নবঘনে।""
ললাটিকা মেয়ের আবির্ভাবে ঋষির ললাট দেশ দীপ্ত হইল।এই দীপ্তিসমুজ্জ্বল শান্তির। দেবীর সহিত ঊষার অভিন্নতা বর্ণিত হইয়াছে।
"করে ইন্দ্রধনু বালা
গলায় তারার মালা,"
সীমান্ত নক্ষত্র জ্বলে, ঝলমলে কানন।
তিনি আবির্ভূতা হইয়া একবার ক্রৌঞ্চীকে আরবার বাল্মীকিকে 'নেহারেনফিরে ফিরে যেন উদ্ভাদিনী'। তিনি করুণাভরে বিষাদ সুরেবীনা বাজাইয়া গানকরিতে লাগিলেন। করুণাময়ী দেবীর, বাল্মীকি ও ক্রৌঞ্চীর শোকপূর্ণ হৃদয়ে সহিত সহিতত্ব স্থাপন হওয়ায় সৃষ্ট হইল সমাক্ষরবিশিষ্ট পাদবন্ধ তন্ত্রীলয়-সমন্বিতসঙ্গীত। বাল্মীকির 'প্রফুল্ল কপোল বহি বহে অশ্রুজল'। কবিগণ এই দেবীকেদেখেন ধ্যানের দৃষ্টিতে আর যোগীরা দেখেন যোগের সাধনে। কবি ও যোগীরদৃষ্টিভঙ্গি মিলিয়া যায় ও তাঁহারা কমলার রত্নরাজিকে উপেক্ষা করেন।করুণারূপিণী এই কন্যাকে প্রত্যক্ষ করিতে পারিলে শোকতাপ বিদূরিত হয়, অন্তরআনন্দে পরিপূর্ণ হইয়া উঠে। জগতের ঐশ্বর্য তখন তুচ্ছ বলিয়া মনে হয় ।
"যাও লক্ষ্মী অলকায়
যাও লক্ষ্মী অমরায়,
এসন না ও যোগি-জন-তপোবন স্থলে"।
কালিদাস কাব্য-সরস্বতীর বন্দনা করিয়াছিলেন। তাঁহার ধ্যানদৃষ্টিতে জগৎলক্ষ্মী সৌন্দর্যমূর্তিতে, জ্যোতির্ময়ী শক্তিরূপে আবির্ভূতাহইয়াছিলেন। ইনিব্রহ্মজ্যোতিরূপিণী আদিশক্তি নয়। ইহার আবেদন গভীরতর। ইহা সৌন্দর্যের সারাৎসার, প্রাণচেতনার দীপ্তপ্রকাশ। কবি লিখিয়াছেন অবশেষে হয়ত দেবী আসিয়া দেখিবেন :
""অভাগার ভস্মরাশি
অথবা হাড়ের মালা, বাতাসে ছড়ায়।""
তখন সারদার মনে যে গভীর প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হইতে সেই কথা স্মরণ করিয়া তিনি মরিতে পারেন না। হৃদিকমলবাসী দেবী তাঁহার প্রাণ-স্বরূপা; তাঁহাকে হারাইয়াতাঁহার হৃদিরাজ্য অন্ধকারে আবৃত হইয়াছে। তাঁহাকে তাই তিনি আবেদন করিয়াছেন,অয়ি, সুপ্রসন্ন হও কাতর পাগলে'। এমনি করিয়া কবিরঅরাধ্যা সারদা কখনও স্পষ্টআবার কখনও তিরোহিত হইয়া বিরাজ করেন। যাঁহাকে বিশেষরূপে উপলব্ধিকরিয়াছিলেন, বিরহে তাঁহাকে নির্বিশেষরূপে সমগ্র বিশ্বে অনুভব করিতে পারিলেন।বিশেষ কবির-ধ্যানে অপার্থিব নির্বিশেষ রূপ ধারণ করিয়াছে।
ভাব, ভাষা ও ছন্দ---
অন্তরের গভীর অনুভূতি যাহা প্রকাশিত হইতে চায় তাহাকে সম্পূর্ণ ব্যক্ত করা যায় না বলিয়া কবিগণের চিত্তে ব্যাকুলতা সৃষ্ট হয়। মা যাহা জ্ঞানে জয়রূপে প্রকাশিত হয়, কিন্তু ইহাতে তুवি আসে না। আত্মপ্রকাশের তাগিদ মানুষকে সম্বল করে। কাব্যের মধ্যে সেই আত্মপ্রকাশের প্রয়াস বাধামুক্ত হইয়াথাকে। গীতিকবিতায় কোন তত্ত্ব থাকে না, কিন্তু ইহাতে পরিস্ফুট হয় মানবচিত্তেঅনির্বচনীয় আবেগজনিত আনন্দ নিলে ইহার রূপ ব্যক্ত হয়,বি৪ ইহার রহস্যময় সৌন্দর্যকে আশ্রয় কয়িা উহার স্বরূপটি উদঘাটিত হয়। ইহারLআলোকে আমরা আমাদের হৃদয়কে জানিতে পারি। গীতিকবিতা তাই কবিচিত্তেরঅনুভূতি ও আবেগকে ব্যক্ত করিয়া সৌন্দর্যকে প্রকাশ করিয়া থাকে। আবার যাহাসুন্দর তাহা এক বিচিন্ন অনুভূতিবেদ্য উপলব্ধি নহে।সৌন্দর্য তাহার নিবিড়তারমাধ্যমে সত্যকে প্রকাশ করে। সৌন্দর্য যে অনুভূতিকে জাগাইয়া তোলে তাহারLযাথার্থ্য অন্তরে আমরা উপলব্ধি করিয়া থাকি। কীট্স-বর্ণিত গ্রীকস্মাধারেরইন্দ্রিয়গ্রাহ্য সৌন্দর্য আমাদের মনকে অধিকার করে। পরিণামে ইহার ব্যঞ্জনাআমাদের মনেক অসীমাভিমুখীন করে বলিয়া ইহার সত্যতা অনস্বীকার্য। সুতরাংঅনুভূতির মাধ্যমে সৌন্দর্য ও সমন্বয় স্থাপিত হইয়া থাকে। এই হেতু ব্রাউনিংবলিয়াছেন, সত্যের মধ্যে 'The rest may reason and welcome;" tis we musicians know.' বস্তুর রূপ অথবা বস্তু অতিরিক্ত অতীন্দ্রিয় ভাবের যে সৌন্দর্য
আমাদের মুগ্ধ করে তাহা আমাদের মানসিক অভিজ্ঞতার প্রকাশ। পূর্বোক্ত সৌন্দর্যআমাদের উদ্দীপন বিভাবের কাজ করে। অবশ্য উপলব্ধির তারতম্য মানসিকপ্রবণতা হেতু ঘটিয়া থাকে। কাব্যের ধর্ম হইল বস্তুর প্রত্যক্ষগোচর রূপকে প্রকাশকরা নহে, ইহার অন্তর্নিহিত স্বরূপকে ব্যক্ত করা। ওয়ার্ড-সওয়ার্থের মতে ইহা---not as they exist in themselves but as they seem to exist to the senses and to the passions.'
রবীন্দ্রনাথ সারাদামঙ্গলকে অপরূপ কাব্য বলিয়াছেন। ইহার ভাব, ভাষা ওসঙ্গীত তাঁহাকে মুগ্ধ করিয়াছিল কিন্তু এই কাব্যের আদ্যোপান্ত একটা সুসংলগ্ন অর্থআছে তাহা তিনি মনে করেন নাই। ইহার শ্লোকগুলি হইতে সৌন্দর্য বিচ্ছুরিতহইয়াছে কিন্তু কোন রূপকে ইহা স্থায়িভাবে ধারণ করে নাই। তাঁহার মতে কবিযাহা দিয়াছেন তাহাতে সন্তুষ্ট থাকা প্রয়োজন। পাঠকের ইচ্ছা অনুযায়ী রস গ্রহণকরিতে চাহিলে নিরাশ হইতে হইবে।এই কাব্যের যাহা ভাবের দিক তাহা পুরাতন হইয়াও নবীন কবির আরাধ্যা স্বতী বা সারদা লোকবন্দিতা বাগ্দেবী নহেন। তিনি নানা মূর্তিতে, জননী,প্রেয়সী বা নন্দিনীরূপে বিরাজ করেন। তিনি সৌন্দর্যলক্ষ্মী, ত্রিবিদ্যারূপিণী,আদ্যাশক্তি। করুণা ও প্রেমে তিনি মানবচিত্তকে অহরহ আন্দোলিত করিতেছেন।তাহার সহিত কবি বিরহ-মিলনের বিচিত্র অবস্থা বর্ণনা করিয়াছেন। তিনি কবি।চিত্তের আনন্দরূপিণী মানস মরালী, কিন্তু বাহিরে তিনি বিশ্ববিমোহিনীসৌন্দর্যলক্ষ্মী। অন্তরে যাহাকে তিনি একা একাকিনীরূপে ধ্যান করেন, বস্তুবিশ্বে।তাঁহার সারভূত রূপের প্রকাশ প্রত্যক্ষ করিয়া তিনি আনন্দিত হন। অন্তরেআলোকে বহির্জগৎ দীপ্যমান হইয়া উঠে। বাহিরে যাহা বহু তাহা একেরবহিঃপ্রকাশ।কবি প্রেমিকরূপে সারদাকে ধ্যান করিয়াছেন বলিয়া শাশান অমরাবতী দু-ইভাগ লাগে'। তিনি তাঁহার মনের তৃপ্তি ও নয়নের দীপ্তি, তাহার করুণা কটাক্ষে অস্তরে অনির্বচনীয় শান্তিরসে পূর্ণ হয়। কিন্তু সৌন্দর্য প্রতিমাকে হারাইয়া কবির বিরহসন্তপ্ত মন বিষাদে ভরিয়া উঠে। তখন এই জীবনকে মরু সদৃশ বলিয়া তাঁহার মনে
"এ বিরস মরুভূমে
সকিল আচ্ছন্ন ধূমে,
কোথাও একটিও আর নাহি ফোটে ফুল ।"
এই অপূর্ণতাবোধ অপ্রাপনীয়ার ব্যাকুলতাবোধ হইতে সৃষ্ট হইয়াছে। প্রেমিকা যেন মানস-সরোবরের অপর তীরে বাস করেন। কবির হৃদয়রূপ চক্রবাক এইপারে অবস্থান করে। ‘কেন মন্দাকিনী-তীরে দুপারে দুজন।' সুখ পরনির্ভরশীল ।তাই সদাশিব সতী বিনা নিরানন্দ। কবি তাহার হৃদয়প্রতিমাকে অন্তরে প্রতিষ্ঠিতকরিয়া ভক্তিভাবে মানস-পূজা করেন। মন্তদশাস্ত তিনি তাঁহাকে জ্যোতির্ময়ীরূপেবস্তু-বিশ্বে প্রত্যক্ষ করেন।সারদা শুধু মধুরা-রূপিণী-নহেন, তিনি ভয়ঙ্করী। তিনি জগতের আদ্যাশক্তি।কবির নিকটে তাঁহার সংহার মূর্তিও অতি মধুর। প্রণয় পবিত্র, কামসুখ স্বৰ্গ মোক্ষধাম হইলেও কখনও কখনও কবির মনে সংশয় দেখা দেয়। কিন্তু প্রেম যেজীবনের সঞ্জীবনী সুধা এই কথা ভাবিয়া তিনি আশ্বস্ত হন। দেবী শুধুবিশ্ববিমোহিনী নহেন। তাঁহার কায়াহীন মহাছায়া ত্রিলোক পরিব্যাপ্ত করিয়া বিরাজিতা। ওয়ার্ডসওয়ার্থ এই শক্তিকে টিনটার্ন কবিতায় a sense sublime ofsomething for more deeply interfused' রূপে বর্ণনা করিয়াছেন। সারদার সহিত প্রশান্ত গিরিভূমিতে মিলিত হইয়া কবি আনন্দিত হইয়াছেন। ‘এমন আনন্দআর নাই ত্রিভুবনে'। সংক্ষেপে ইহাই হইল কাব্যের ভাব। রবীন্দ্রনাথ মন্তব্যকরিয়াছেন, 'এ কথা বলিতে পারি, আধুনিক বঙ্গসাহিত্যে প্রেমের সংগীত এরূপসহস্রধার উৎসের মতো কোথাও উৎসারিত হয় নাই'। তিনি আরও মন্তব্য করিয়াছেন,'এমন নির্মল সুন্দর ভাষা, এমন ভাবের আবেগ, কথার সহিত সুরে মিশ্রণ আর কোথাও পাওয়া যায় না'। বিহারীলালের ভাবের আবেগ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথেরঅভিমত সুচিন্তিত। তিনি হৃদয়ভাবকে একান্ত প্রাধান্যদিয়াছেন। কোথাও ইহাকেমননের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত করিবার প্রয়াস করেন নাই। যখন যে কোন অনুভূতি বাজ্রর সৌন্দর্যকে উপলক্ষ্য করিয়া তাঁহার হৃদয়ে ভাবের আবেগ দেখা দিয়াছে তিনিতাহার নিকটে আত্মসমর্পণ করিয়াছেন। সারদার কল্পনা যেরূপ তাঁহারমনকেউদ্দীপিত করিযাছে, তেমনি নিসর্গের সৌন্দর্য তাঁহার মনকে যুগ্ধ করিয়াছে। উভয়ক্ষেত্রে আবেগের আলোড়ন তাঁহার হৃদয়কে অভিভূত করিয়া ভাবের ক্ষেত্র হইতেমনকে শিল্পসৃষ্টির জন্য নির্লিপ্ত ও মননধর্মী হইতে নাই।রবীন্দ্রনাথ বিহারীলালের ভাষা এবং কথার সহিত সুরের একাত্মতার কথা উল্লেখকরিয়াছেন। কাব্যের ভাবকে যথাযথ রীতির মাধ্যমে প্রকাশ করিতে না পারিলেবাণীমূর্তি রচনা করা যায় না। এই হেতু প্রয়োজন হয় ভাষা ও ছন্দের। জর্জ মুর কোনএক তরুণীকে শিল্পীর জীবন ও কর্ম সম্পর্কে ব্যাখ্যা করিয়া লিখিয়াছেন:
""An artist's life is in this like an acrobat's he must exercise his craft daily when inspiration is by him and when it is afar.""
শিল্পী তাঁহার শিল্প-সাধনা নিরলভাবে করিবেন এবং তিনি তাঁহার কাব্যলক্ষ্মীর নিকটে নম্র চিত্তে আত্মসমর্পণ করিবেন। নির্জনে বসিয়া তাঁহার ধ্যানকরিবেন। 'you must dine in and alone very often.
শিল্পী বা কবিকে তাঁহার রীতির উৎকর্ষ সাধনের দিকে মনোনিবেশ করা অবশ্য কর্তব্য। ইহার ফলে তাঁহার সৃষ্টি শুধু তাঁহার যুগ অথবা অনাগত কালকেসুখী করিবে না, তাঁহারা অন্তরস্থিত কাব্যলক্ষ্মীকেও প্রসন্ন করিবে।মনে হইতে পারে যে, কাব্যসৃষ্টিতে ভাবাবেগই যথেষ্ট, রীতির প্রতি মনোযোগীহইবার কোন কারণ নাই। যেহেতু কাব্যের সাধারণ পাঠকগণ রীতি সম্পর্কে সচেতন নহেন, সুতরাং রীতি বা প্রসাধন কলার প্রয়োজন অপরিহার্য নহে। কিন্তুকাব্যের ব্যবহৃত ভাষা বিভিন্ন বস্তু বা ভাবের মধ্যে সাদৃশ্যঅথবা পার্থক্য পরিস্ফুটকরে মাত্র। কিন্তু কাব্যের সার্থকতা হইল অখণ্ড ভাবের প্রকাশে। স্রষ্টা ও সৃষ্টিরমধ্যে যখন অন্তরঙ্গ সম্পর্ক স্থাপিত হইয়া থাকে তখন কাব্যের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণিতহয়। সুতরাং রীতির উদ্দেশ্য হইল এমনভাবে ভাষার ব্যবহার করা যাহাতে সহজেভাব পাঠক-মনে সঞ্চারিত হইতে পারে এবং প্রত্যক্ষগোচরের অন্তরালে অবস্থিত বস্তু বা ভাবের স্বরূপ উদ্ঘাটিত হয়। এই স্বরূপের প্রকাশের জন্য বিশেষ রূপসৃষ্টিপ্রয়োজন। রূপসৃষ্টির মাধ্যমে আশা ও আনন্দের সৃষ্টি হয় ও ইহা পাঠকমনেপ্রত্যাশা সমাপ্তির আশ্বাস বহন করিয়া আনে। # অন্যদিকে ভাবসাধনার মাধ্যমেপাঠকের মন অসীম ভাবলোক প্রসারিত হইবার সুযোগপায়। এই কারণে চার্লস মর্গান বলিয়াছেন, 'I believe this form and pressure to be purges of the human spirit'সতুরাং 'an aritist's elementary duty to be the perfecting of his instrument'.
ইহারই সাহায্যে শিল্পী তাঁহার ভাবকে সঞ্চারিত করিতে পারেন।তাঁহার ক্ষেত্রে বাহিরের উত্তেজনার কোন প্রয়োজন থাকে না, কেননা চিন্তা ওঅনুভব করিবার শক্তি কবির অসাধারণ।ওয়ার্ডওয়ার্থ প্রশ্ন তুলিয়াছেন যে, যেহেতু কবি সাধারণ মানুষদের মতো চিন্তা ওঅনুভব করেন, সুতরাং তাঁহার ভাষা সাধারণ ভাষা হইতে পৃথক হইবার কোনকারণ নাই । কবি তাঁহার সমধর্মীদের জন্য শুধু কাব্যসৃষ্টিকরেন না, সাধারণ পাঠকসমাজ তাঁহার লক্ষ্য। তাই তাঁহাকে বাস্তব জীবনের ভাষা ব্যবহার করিতে হইবে।
""The poet must descend, from this supposed height; and, in order to excite rational sympathy, he must express himslf as other men express themselves.""
তবে এই ভাষা কবিকে নির্বাচন করিতে হইবে। এই নির্বাচনের পশ্চাত্যে থাকিবে রুচি ও অনুভূতলোকভাষা বহু ব্যবহারে জীর্ণ হইয়া পড়ে ও ইহার প্রাণশক্তি নিঃশেষিত হয়।সুতরাং ভাষায় নির্বাচনের প্রশ্ন উঠিয়াছে যাহাতে ইহা অনুভূতি ও আবেগেরবাণীবহ হইতে পারে। এই ক্ষেত্রে ওয়ার্ডসওয়ার্থ বিষয় নির্বাচনের প্রসঙ্গ উত্থাপনকরিয়াছেন। বিষয়েরগাম্ভীর্য অনুযায়ী কবি-মনে আবেগ জাগিয়া উঠে এবংতদনুযায়ী নির্বাচিত সাধারণ ভাষা ইহাকে রূপ দান করিতে পারে। স্বভাবতঃ এইভাষাও হইবে
'must necessarily be dignified and variegated, and alive with metaphors and figures.
সুতরাং ওয়ার্ডওয়ার্থ ভাবের গাম্ভীর্য প্রকাশেরজন্য অলংকৃত কবি-ভাষার উপযোগিতার কথা ব্যাখ্যা করিয়াছেন। তবে যে কবিরামানব-জীবন হইতে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করিয়া কৃত্রিম ভাষা ব্যবহার করেন(Carbitrary and capricious habits of expression') তাঁহারা ব্যর্থতার পরিচয় দিয়া থাকেন। কৃত্রিম ভাষার অর্থ হইল যাহা অনুভূতির সুষ্ঠু প্রকাশক নহে।অষ্টাদশ শতকে পোপের কাব্যের ভাষা অর্থদ্যোতক, স্পষ্ট ও সুনির্বাচিত। কিন্তুতাহা অনুভূতি হইতে বিচ্ছিন্ন বলিয়া ইহাকে কৃত্রিম বলঅসঙ্গত নহে। অথচচসারের ভাষা বর্তমানকালেও বিশুদ্ধ ও সর্বজনগ্রাহ্য বলিয়া স্বীকৃত। 'The subjectis indeed important'– ইহাকে কেন্দ্র করিয়া অনুভূতিলোক আলোড়িত হইয়া উঠে। ওয়ার্ডওয়ার্থ বিষয় অনুযায়ী ভাষা ব্যবহারের পক্ষপাতী ছিলেন। এই হেতুতিনি পূর্বযুগের কবিগণ ব্যবহৃত Poetic diction অর্থাৎ কাব্যানুমোদিত কৃত্রিমভষা বর্জন করিয়াছেন। যে প্রচলিত বাগ্বিধি ও অলংকার প্রথাসিদ্ধ রূপে কবিগণব্যবহার করিয়া থাকেন তাহার নিন্দা করিয়া বিষয়ানুগ ভাষার প্রতি তিনি আনুকূল্যপ্রদর্শন করিয়াছেন। এই অর্থে তিনি বলিয়াছেন
""I have at all times endeavoured to look steadily at my subject.""
সুতরাং যে সত্যে তিনি উপনীতি হইয়াছেন তাহা হইল :
""The most interesting parts of the best poems will be found to be strictly the language of prose when prose is will written."
গদ্যরূপ যদি আবেগবহ হয় তখন তাহার প্রকাশের ভাষার সহিত কাব্যের ভাবার কোন পার্থক্য থাকে না । গদ্য কবিতায় হুইটম্যান বা রবীন্দ্রনাথের চরনায় ইহার প্রমাণ পাওয়া যায়।র্যাপদ হইতে বৈষ্ণবপদাবলীর ভাষাকে কবি-ভাষা রূপে অভিহিত করা যাইবে। চর্যাপদের বিষয়বস্তু সাধান সংকেত দ্যোতক, কিন্তু ইহার ফাঁকে ফাঁকে
কবিগণ সমাজের নানাদিকের প্রতি দৃষ্টি প্রসারিত করিয়াছেন। তাঁহাদের ব্যবহৃতভাষাও বিষয়ানুগ হইয়াছে। বৈষ্ণবপদাবলীর ভাষার একটি বড় পরিচয় হইল ইহাএকটি কৃত্রিম ভাষা, যাহা ব্রজবুলি নামে খ্যাত। তথাপি এই ভাষার ব্যবহার মহাজন পদকর্তাগণ নৈপূণ্য প্রদর্শন করিয়াছেন। ইহানিছক শব্দ-ঝংকার আবদ্ধ নাথকিয়া গভীর ভাব প্রকাশেও সহায়তা করিয়াছে। ভাব হইতে বিচ্ছিন হইয়া ইহাস্বাতন্ত্র্য ঘোষণা করে নাই। বৈষ্ণব ও শক্তপদাবলীর ভাষা, ভাবের অনুষঙ্গ রূপেব্যবহৃত হইয়াছে। যেখানে এই ভাষা তত্ত্ববাহী সেখানেও মানসিক নিষ্ঠার সহিতসম্পৃক্ত বলিয়া ইহাকে কৃত্রিম বলিয়া কোথাও সংশয় জাগে না।ভারতচন্দ্র ও পরবর্তী কালে সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত ছিলেন শব্দ-কুশলী কবি।তাঁহাদের আকর্ষণ ছিল শব্দ-সঙ্গীতের প্রতি। কাব্যের কারবার কথাকে লইয়া।
‘তায় গোড়ায় দরকার এই অর্থটা যেন রসমূলক হয়। অর্থাৎ সেটা এমন কিছু হয়যা স্বতঃই আমাদের মনে স্পন্দন সঞ্চার করে, যাকে আমরা বলি আবেগ।'বীন্দ্রনাথের বক্তব্য হইল যে, কাব্যের ভাষা আবেগের বাণীবহ হইবে। এইঅর্থে তাহা হইবে সুরের মতো স্বপ্রকাশ। প্রসঙ্গটি ব্যাখ্যা করিয়া প্রমথ চৌধুরী 'ভারতী' পত্রিকায় ১৩২৩ সালে মাঘ সংখ্যায় লিখিয়াছিলেন যে, শব্দের ধ্বনিগত আনন্দ নিতান্ত ইন্দ্ৰিয়জ সুখ সৃষ্টি করে। এইশব্দাঢ্যতআমাদের লেখকদেরক্ষেত্রে বিপদ সৃষ্টি করে। মধুসূদনের মেঘনদবধ কাব্যে ব্যবহৃত ভাষা সম্পর্কেতিনি মন্তব্য করেন ‘সে আরাব বঙ্গসরস্বতীর বাণী নহে, গড়ে বাদ্যির’। কিন্তু মধুসূদনের কবি-ভাষা মহাকাব্যের ভাব প্রকাশে সহায়ক হইয়াছে। অপর কোনভষায় ইহার সুইচ্ছ ভাব, উত্তুঙ্গ কল্পনা ও ত্রিলোকব্যাপী সৌন্দর্য-চেতনা প্রকাশকরা যাইত না।সত্যেন্দ্রনাথ ভালের্নের অনুরাগী ছিলেন। ভার্লেন তাঁহার 'Ars poetique'কবিতায় লিখিয়াছেন 'De la musique avent toute chose. শব্দের সুমধুর সঙ্গীতকে সর্বাগ্রে স্থান দিতে হইবে। নির্ভুল শব্দ নির্বাচনের কোন সার্থকতা নাই।স্পষ্ট ও অস্পষ্ট শব্দের সমবায়ে মধুর সঙ্গীত রচিত হয়।
''Rieu de plus cher que la chanson Grise
Ou l' indecis au pre'cis se joint.''
ভারতচন্দ্রের ছিল শব্দ-সঙ্গীতের প্রতি গভীর আকর্ষণ, আর তাঁহার ধারায় সত্যেন্দ্রনাথ শব্দ-ধ্বনির মাধ্যমে চিত্রাঙ্কণের প্রতি প্রবণতা দেখাইয়াছেন। ইহারলে অনেক ক্ষেত্রে চিত্রই ভাবকে পশ্চাতে ফেলিয়া অগ্রাধিকার পাইয়াছে। তাইতাঁহার কবিতার ধ্বনির প্রতি মোহ এবং চিত্রাতিরেকপ্রাধান্য লাভ করিয়াছে ।বিহারীলালের কাব্যের ভাষাপ্রসঙ্গে মধুসূদন, হেমচন্দ্র ও নবীনচন্দ্রের ব্যবহৃতবি-বাষার আলোচনার সার্থকতা আছে। মধুসূদনের চতুর্দশপদীর ভাষা ভাবগাম্ভীর্যের সহিত সমতা রক্ষার জন্য নির্বাচিত ও ধ্বনি সম্পদে পূর্ণ। যে বিষয় তিনিগ্রহণ করিয়াছিলেন তাহা বিশেষ রীতির বন্ধনে প্রকাশিত হওয়ায় তাহার মধ্যেভার্লেন কথিত ললিত সঙ্গীত সৃষ্টির কোনে অবকাশ ছিল না। তথাপি যেখানে আবেগ প্রকাশের সুযোগ ঘটিয়াছে, অনুভূতির স্পর্শ বিষয়ে সঞ্চারিত হইয়াছে,তথায় ভাষা ও ভাবের মধ্যে সমন্বয় স্থাপিত হইয়াছে।
""বহু দেশে দেখিয়াছি বহু নদ-দলে,
কিন্তু এ স্নেহের তৃষ্ণা মিটে কার জলে?
দুগ্ধ-স্রোতোরূপী তুমি জন্মভূমি-স্তনে ।
এবে ইন্দ্রপ্রস্থ ছাড়ি যাই দূর বান!
এই বর, হে বরদে, মাগি শেষ বারে, –
জ্যোতির্ময় কর বঙ্গ—ভারত-রতনে।""
হেমচন্দ্র তাঁহার ‘কবিতাবলীতে' কিংবা নবীনচন্দ্র তাঁহার ‘অবকাশরঞ্জিনীতে’প্রথাসিদ্ধ সাধারণ ভাষা ব্যবহার করিয়াছেন। ভাষা অথবা ছন্দের কোন বৈচিত্র্যাতাঁহাদের কাব্যে পরিলক্ষিত হয় না। হেমচন্দ্রের 'হতাশের আক্ষেপ' ও 'এই কিআমার সেই জীবনতোন্বিণীতে প্রেমের আতি ও জীবন সম্পর্কে মোহ-ভঙ্গেরআর্পেণ বর্ণিত হইয়াছে। কিন্তু প্রকাশ-রীতি প্রথানুগ হওয়ায় আবেগের প্রকাশহম্মোচিত হইতে পারে নাই। ' মরীচিকা'তেও আশাভঙ্গের নৈরাশ্য ও বেদনাঅপপ্রকাশের দুর্বলতা হেতু সার্থকতা লাভ করে নাই।সে সাধ তরঙ্গকূল, এবে কোথায় লুকাইলকে ঘুচালে জীবনের হেন রম্য ধাঁধা রে।বিশুদ্ধ পবিত্র মন স্বর্ণবাসী সিংহাসন,পঙ্কিল করিল কে রে দগ্ধচিতা অঙ্গারে।মতন যুগের জীবন ভাবনাকে পুরাতন রীতির মধ্যে বাণীবদ্ধ করিতে যাইয়াতিনি ভুল করিয়াছেন। অনুরূপ ভ্রম নবীনচন্দ্রের কাব্যেওপরিলক্ষিত হয়। তাঁহারভাষা আবেগবহ নহে, ছন্দও পয়ার অথবা ত্রিপদীর অনুসরণে গঠিত। নবীন্দ্রচন্দ্রেরগীতিকবিতা সম্পর্কে আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথ শীল ইহাদের emphemeral class of
poems' নামে অভিহিত করিয়াছেন।নবীনচন্দ্রের খণ্ড-কবিতায় বিশুদ্ধ চিন্তা ও অনুভূতিরপ্রগাঢ়তার অভাবরিলক্ষিত হয় এবং এই হেতু তাঁহার রীতির দিকটিও দুর্বল। এ দুর্বলতা কবিরসৃষ্টিধর্মী মনের পরিচয় প্রকাশিত করে না। 'অবকাশরঞ্জিনী’র গীতি-কবিতায়কবিমনের অকারণ বিষাদ, যথা 'হতাশ', কল্পনাকে কেন্দ্র করিয়া বিগত দিনেরস্মৃতি-চারণ যথা ‘একটি চিন্তা', নিয়মিতর লীলা, যথা 'কে বলিতে পারে' অথবাঅন্যত্র স্বদেশ প্রীতির সুর প্রকাশিত হইয়াছে। নৈতিকঅথবা দার্শনিক তত্ত্বেরঅনুপ্রেবেশে কবিতার লিরিক-ধর্মিতা ব্যাহত হইয়াছে।
"""ফুটে বঙ্গ-অন্তঃপুরে যে কম-কামিনী,
তা’র কি তুলনা হিয় উদ্যান কুসুময়,
প্রত্যেক বাতাসে যা'রা হয় কলঙ্কিনী?
দুঃখী বঙ্গবাসীদের রমণীই মণি। (একটি দিন)
অথবা, সে বিধি পাষাণ-মনে, ভারত-সন্তানগণে,
দিলেন জ্ঞানের নেত্র, দেখাতে কেমন
দাসত্ব-শৃঙ্খল ভার, অবস্থা নরক। (সায়ংচিন্তা)""
বিহারীলালের 'সারদামঙ্গল' কবির ধ্যানময়তার প্রতীক। ইহার মধ্যে তাঁহারএকটি বিশেষ আদর্শ, সৌন্দর্য ধ্যান প্রকাশিত হইয়াছে। ইহা তাহার অন্তরে যেনিবিড় আবেগ সৃষ্টি করিয়াছে তাহাকে তিনি রূপে প্রকাশ করিতে চাহিয়াছেন।তথাপি ধ্যানই তাঁহার আসল লক্ষ্য, বাহির তাহা ছন্দোবদ্ধ ভাষায় বাণীবন্ধ হইতেপারিয়াছেন কিনা সেদিকে তিনি সচেতন নহেন। তিনি শুধু তাঁহার অন্তরখানিউদ্ঘাটিত করিয়া দেখাইতে চাহিয়াছেন। কাব্যের বহুস্থানে সেখানে কবির হৃদয়সৌন্দর্য ধ্যানে নিমগ্ন হইয়াছে সেখানে কবির ভাষা ধ্যানের স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ রূপেউৎসারিত হইয়াছে। প্রথম সর্গে নিশীথ কালের বর্ণনা, উষার আবির্ভাব।
বিশ্বব্যাপিনী সৌন্দর্যলক্ষ্মীর রূপ-পরিচয় আবেগবহ ভাষার বাণীবদ্ধ হইয়াছে।।আবার তৃতীয় সর্গে সারদার সহিত বিচ্ছেদ হেতু হৃদয়ের আর্তি, জ্যোতির প্রবাহ
মাঝে বিশ্ববিমোহিনীর ভাবমূর্তির ধ্যান, সারদাকে আদ্যাশক্তি রূপে কল্পনা অিসুন্দরভাবে গীতিময় ভাষায় বর্ণিত হইয়াছে। এখানে কথার সহিত সুরের মিশ্রণ একাত্মতা লাভ করিয়াছে। ভাবের তীব্রতা প্রকাশের জন্য আলংকারিক প্রযোগ,যথা ‘এ নহে প্রলয়-ধ্বনি, বাঁশরী বাজনা' অথবা 'খুনে আর পরিত্রাণে অনেক অন্তর’, শব্দের পুনরাবৃত্তি, যথা 'অনন্ত নিদ্রার কোলে/অনন্ত মোহের ভোলে’, গদ্যরীতিছাড়া! আন! যাও, যাও!/ বেগে বুখে ধিধে দাও' অথবা আবেগ প্রকাশের জন্যপ্রতীকের ব্যবহার ‘সোনামুখী তরীখানি গিয়েছে কোথায়', যথাযথ হইয়াছে। ৪৭দ্বিতীয় সর্গে কবি যেখানে ভাব-প্রেরণার জগৎ হইতঅবতরণ করিয়াছেন, যেখানেবরহ-সন্তপ্ত জীবনের পরিণাম তিনি সচেতনভাবে কল্পনা করিয়াছেন সেখানে ভাষা তাঁহার নৈরাশ্য ও বেদনাবোধের প্রকাশক হইলে তাহা ব্যঞ্জনা-শক্তি বিরহিত হইয়া ব্যবহারিক জীবনে নামিয়া আসিয়াছে। যথা:অথবা,
"""মরু মরু মরু ময় জীবন লহরি
ভাবিতে পারিনে আর।
অন্ধকার অন্ধকার
ঝটিকার ঘূর্ণী ঘোরে মাথার ভিতর।"""
আবার চতুর্থ সর্গে হিমালয় বর্ণনায় নিসর্গ-সৌন্দর্যের সহিত কবির ভাবাত্মক যোগ স্থাপিত হয় নাই। রূপমুগ্ধ দৃষ্টিতে তিনি সৌন্দর্যকে প্রত্যক্ষ করিয়াছেন, কিন্তুইহাকে প্রকাশ করিবার জন্য শিল্পীর সজ্ঞান প্রয়াসঅপরিহার্য। কিন্তু রূপ প্রেমিক কবির দৃষ্টিতে প্রকৃতির সৌন্দর্য সহজ ও পরিচিত ভাষায় প্রকাশিত হইয়াছে। ইহাঅনুভূতির বাণীবহ হয় নাই।
""বিশ্ব যেন ফেলে পাছে
কি এক দাঁড়ায় আছে!
কি এক প্রকাণ্ড কাণ্ড মহান ব্যাপার""!
প্রাণের উচ্ছ্বাস সহজ ভাষার ব্যক্ত হইয়াছে কিন্তু ইহাতে কোন রূপ সৃষ্ট হয়নাই।
কবে যেখানে লিখিয়াছেন :
""দেদার চলিয়া গেছে কাতারে কাতারে""
সেখানে ভাষা অত্যন্ত সাধারণ ও গদ্যধর্মী। কোলরিজ ইহাকে প্রভিনসিয়ালিজম্ রূপে অভিহিত করিতেন। পঞ্চম সর্গে ভাবগভীরতা হেতু ভাষা সুরধর্মী হইয়াছে। কবির অনুভূতি ব্যাপ্ত হইয়া আনন্দলোকে বিস্তৃত হইয়াছে।
""দেখিয়া মেটে না সাধ,
কি জানি—কি আছে স্বাদ,
কি জানি কি মাখা আছে ও শুভ আননে!""
কবির ভাষা মাঝে মাঝে সাধুতা পরিহার করিয়া কর্ণপীড়ক হইয়াছে। “নিটোলবুকের পাটা, নধর শরীর' কিংবা 'মেজাজ গিয়েছে খুলে বসেছে দুনিয়া ভুলে',অথবা 'ফড়ফড় তুবড়ি ফোটে, ফেটে পড়ে ফুল'—এই জাতীয় ভাষার ব্যবহার স্বেচ্ছাকৃত হইলেও অকস্মাৎ সুর লয় ভঙ্গ করে। যেখানে কবি বর্ণনা দিয়াছেন
""উঃ! কি আগুন-মাখা দারুণ বাতাস""
সেখানে ভাব-বিহবলতা ভাষাকে আড়ষ্ট করিয়াছে। ভাষাএখানে বাণীবহ নহে।ছন্দ সম্পর্কে কোলরিজের অভিমত হইল যে, ইহা ব্যতীত কবিতা অপূর্ণহইয়া পড়ে। ছন্দ কবিতার অপরিহার্য না হইলেও দীর্ঘকালের সাচর্য হেতু ইহারপ্রয়োজনীয়তা অস্বীকার্য। ভাবের স্বতঃস্ফূর্ত প্রবাহকে সংযত করিবার জন্য ছন্দেরব্যবহার প্রয়োজন। ইহা কাব্যপাঠ কালে সচেতনতা ও সবেদনশীলতা বৃদ্ধি করে।সর্বোপরি গদ্যরীতি হইতে পার্থক্য দেখাইবার জন্য ছন্দের প্রয়োজনীয়তা আছে।গদ্যকবিতারও ছন্দ আছে, সাধারণ গদ্য ভাষারও আছে। কিন্তু গদ্যকবিতার ছন্দ প্রত্যক্ষ ও নির্দিষ্ট নিয়মে বাঁধা না হইলেও ইহার যথাযথ প্রয়োগ ইহাকে সাধারণদ্য-রচনা হইতে পৃথক করিয়া রাখে।ছন্দোরীতি ভাব অনুযায়ী নিরূপিত হইয়া থাকে। 'বঙ্গসুন্দরীতে' যে ছন্দের।প্রয়োগ বিহারীলাল করিয়াছিলেন তাহা ছিল স্বধ্বনিপূর্ণ। কিন্তু 'সারদামঙ্গলে’ কবি যুক্তব্যঞ্জনবর্ণকে স্বীকার করিয়াছেন বটে, কিন্তু ছন্দের ক্ষেত্রে ইহাকে পূর্ণ মূল্য দেন
""হেরিলে রক্তমাখা
মৃত ক্রৌঞ্চ ভগ্ন পাখা
কাঁদিরে কাঁদিরে ক্রৌঞ্চী ওড়ে ফিরে ফিরে।""
ছন্দের এই রীতি বিহারীলাল তাঁহার কাব্যে অনুসরণ করিয়াছেন। এই ছন্দতান-প্রধান ও ইহা ৮+৬ মাত্রার উপরে গঠিত। গীতিপ্রধান সুর প্রকাশের পক্ষেএই ছন্দ উপযোগী হইয়াছে ।মাঝে মাঝে অতর্কিতে তিনি ৬ +৮+ ৮ মাত্রা একটি দীর্ঘঅসমমাত্রিক চরণব্যবহারে ভাবকে বর্ণনাধর্মী করিয়া তুলিয়াছেন।
""অবাক দেখিলে হয় অমনি অবাক : চক্ষে পড়ে না পলক""
।এই চরণে শেষোক্ত দুই পর্বের অন্ত্যমিল ছন্দেরকাঠামোটিকে ধরিয়া রাখিয়াছে। প্রথম পর্বটি যেন বিযুক্ত থাকিয়া ছন্দের মধ্যে বৈচিত্র্য সম্পাদনকরিয়াছে। আবার প্রথম সর্গে কবি বর্ণনা করিয়াছেন :
""সমস্বরে স্তব করে ভাসে অশুজলে।
অমর কিন্নর নরে ভাসে অশ্রুজলে॥""
এখানে প্রথম ও দ্বিতীয় চরণের প্রথম পর্বে ৮ মাত্রা আছে, কিন্তু তিন মাত্রারপরে উপচ্ছেদ স্থাপন করিয়া তিনি বৈচিত্র্যের আস্বাদ দিয়াছেন।তবে ভাবের আতিশয্য হেতু ছন্দ প্রয়োগে সামঞ্জস্যের অভাবও লক্ষ্য করাযায়। চন্দের ধর্ম হইল, কোলরিজের মতে, ভাবের পরিমিতি বোধ রক্ষা করা।সুতরাং ছন্দ হইল ‘a supervening act of the will and judgement,' সুতরাংস্বতঃস্ফূর্ত ভাবপ্রবাহকে ছন্দের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত করিতে হয়। বিহারীলাল লিখিয়াছেন :
""নির্ঝর ঝর্ঝর রবে
পবন পুরিয়ে যবে""
অঘোষিত সুরপুরে কাননের করুণ ক্রন্দন হাহাকার।
এখানে শেষ চরণে তিনটি পর্ব ৮ + ১০ + ৪ মাত্রায় বিভক্ত হইয়া অসমমাত্রিকতা প্রমাণিত করে। এইস্থানে ছন্দপতন ঘটিয়াছে। চরণটি ভাবের সৌন্দর্যে সিঞ্চিত হইলেও বিন্যাসের দিক হইতে ত্রুটিপূর্ণ। এই জাতীয় চরণ পঞ্চম সর্গে ওকবি ব্যবহার করিয়াছেন।
""বিবহবল পাগল প্রায় বেড়ায় কি বোকে বোকে আপনার মনে।""
এখানে ত্রিপার্বিক চরণ ৮ + ৮ + ৬ মাত্রায় বিভক্ত হইয়াছে। তবে এখানে ছন্দপতন ঘটে নাই, কেননা, কবি বৈচিত্র্যের জন্য অতিরিক্ত একটি আট মাত্রারপর্ব ব্যবহার করিয়া কুশলতার পরিচয় দিয়াছেন। কোন কোন স্থানে শেষ চরণে তিনি ৮ + ৬ মাত্রার পরিবর্তে ৮+ ৮ চরণ ব্যবহার করিয়াছেন।সরমে কি বাধে বাণী মরমে বা বাজে ব্যথা।বৈচিত্রের জন্য কবি চরণের দৈর্ঘ্য সমান রাখিয়া ৮+৬ মাত্রার পরিবর্তে ৬ +৮ মাত্রা ব্যবহার করিয়াছেন।
""ধোরো না ধোরো না বৃথা রুধ না আমাকে।
অথবা, মেঘে শশী ঢাকা রাকা-রজনীরূপিণী ।""
চরণের মধ্যে তিনি অতিরিক্ত পর্বের সংযোজনীকিংবামাত্রা বিন্যাসের বৈচিত্র্য পরবর্তী কালে রবীন্দ্রনাথ প্রদর্শন করিয়াছেন। এখানে বিহারীলালের প্রভাব লক্ষণীয়।
‘সারদামঙ্গল’ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ বলিয়াছেন, '"সারদামঙ্গলের ছন্দ নৃতন নহে,তাহা প্রচলিত ত্রিপদী, কিন্তু কবি তাহা সংগীতে সৌন্দর্যে সিঞ্চিত করিয়া তুলিয়াছেন'।
বঙ্গসুন্দরী ছন্দোলালিত্য অনুকরণ করা সহজ, কিন্তু সারদামঙ্গলের গীতসৌন্দর্য অনুকরণ সাধ্য নহে'।
প্রভাব প্রকৃতপক্ষে মধুসূদনের 'ব্রজাঙ্গনার'। তিনি প্রচলিত পয়ার-ত্রিপদী ছন্দে বিস্ময়কর বৈচিত্র্য সৃষ্টি করিয়াছেন ।
""নামি আমি শৈলরাজ, তোমার চরণে— ৮+৬-মাত্রা
"রাধা ও দাসীর না -গোকুল-গোপিনী, --৮+৬
"কেনে যে এসেছি আমি, তোমার সনে-- ৮+৬
"শরমে মরম-কথা কহিব কেমনে,-- ৮+৬
""আমি, দেব, কুলের কাহিনী-- ৮+৬
""কিন্তু দিবা অবসানে, হেরি তারে, কেনা জানে--, ৮ + ৬
""নলিনী মালিনী ধনী কাহার বিহনে-- ৮ + ৬
""কহার বিরহানল-তাপে তাপিত সে সরঃ- ১০+১০
"সুশোভিনী ?-- ০ + ৪
বিহারীলাল যুক্ত অক্ষরকে স্থান দিয়াছেন। ছন্দের ঝংকার ওইহার উপরে নির্ভর করে। কিন্তু বিহারীলালের ছন্দে মাইকেল মধুসূদনের ন্যায়।পরিপূর্ণ ধ্বনি ও তরঙ্গিত গতি অনুভব করা যায় না। মধুসূদন ধ্বনিপূর্ণ তৎসমশব্দরাজি ব্যবহার করিয়াছেন ও ভাবতরঙ্গের স্বচ্ছন্দ প্রবাহের জন্য ছেদকে যতিহইতে বিযুক্ত করিয়াছেন। কিন্তু তাঁহার ছন্দও তানপ্রধান। কিন্তু বিহারীলালশব্দধ্বনি সম্বন্ধে যথেষ্ট অবহিত ছিলেন না। তবে মাঝে মাঝে তাঁহার মধ্যে এইনিপুণতা দেখা যায়।
***ধ্বনি-বৈচিত্র্য---
"চক্রবাক চক্রবাকী দুপারে কুজন"
এখানে প্রথম পর্বটি ব্যঞ্জনবর্ণের আঘাতে ধ্বনিময় হইয়াছে। অথবা, অন্যএকটি স্থানে:
"জীবনের সঞ্জীবনী অমৃত বল্লরী"
এখানেও হসন্ত বর্ণ ও যুক্তবর্ণ ধ্বনিপ্রবাহ সৃষ্টি করিয়াছে। অথবা অপর দুইএকটি স্থানে এই জাতীয় বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায় :
""দানব রুধির রঙ্গে নাচে ভয়ঙ্কর।
দীপ্ত সূর্য ছতাশন
ধ্বকৃ ধ্বকৃ দুনয়ন
হুঙ্কারে বিদরে ব্যোম লুকায় মিহির।
নাহি চন্দ্র সূর্য তারা
অনল হিল্লোলধারা
বিচিত্র বিদ্যুতদাম দ্যুতি ঝলমল।""
আসলে 'সারদামঙ্গলে' গীতসৌন্দর্য ভাব হইতে উৎসারিত হইয়াছে। কবি এইভাবকে রীতির বন্ধনে সুগ্রথিত করিয়া বাণী বিগ্রহ রচনারদিকে বিশেষ মনোনিবেশকরেন নাই। ভাবের সৌন্দর্য তা প্রধান ছন্দে বিধৃত হইয়া সঙ্গীত সৃষ্টি করিয়াছে।কবির নিকটে এই ছন্দ তাঁহার স্বতস্ফূর্ত ভাবপ্রকাশের পক্ষে সর্বাপেক্ষা উপযোগীহইয়াছে।
সৌন্দর্যধ্যান বিহারীলালের কাব্যের বিষয়বস্তু। স্বভাবতঃ এই ধ্যানেরবিষয়কে তিনি তানপ্রধান ছন্দের অন্তর্নিহিত সঙ্গীত স্পন্দে বাণীবদ্ধ করিয়াছেন।বীন্দ্রনাথ ‘মানস সুন্দরী’তে এই ধারা অনুসরণ করিয়াছেন।কোলরিজ ছন্দ ব্যতীত কাব্যে অলঙ্কার ব্যবহারের কথা (a frequency of
forms and figures of sreech) বলিয়াছেন। বিহারীলালের কাব্যে চিত্ররীতি ব্যবহার বৈশিষ্ট্যপূর্ণ যে চিত্রসমূহ ইন্ড্রিয়নির্ভর তাহাদের ব্যবহার তাঁহার কাব্যেকম, কেননা, তাঁহার সৌন্দর্য্যান রূপ হইতে রূপাতীতে প্রসারিত হইয়াছে।
""অধর কমল-দল কাঁপে থর থর
অথবা, মেঘে শী ঢাকা রাকা-রজনীরূপিণী""
এখানে চিত্র রূপনির্ভর, স্পষ্ট ও মনোরম। কিন্তু অধিকাংশ চিত্ররূপের ব্যবহারে কবি ইন্দ্রিয়াতীতের ব্যঞ্জনা ব্যক্ত করিয়াছেন। প্রথম সর্গের গীতি অংশে ঊষার পরিচয় দিয়া তিনি লিখিয়াছেন, 'ওই কে অমর বালা দাঁড়ায়ে উদয়াচলে।'আবার হৃদি কমলে অবস্থিতা ত্রিদিব দেবীর বর্ণনায় লিখিয়াছেন, 'মানস মরালী মমআনন্দরূপিণী। সৌন্দর্যলক্ষ্মীর বর্ণনায় যে চিত্ররূপের সৃষ্টি করিয়াছেন তাহা হইলনীল জলে মনোহর সুবর্ণ-নলিনী। এই জাতীয় চিত্র রূপনির্ভর নহে, ভাবসম্পদেপূর্ণ। সৌন্দর্য্যাধিষ্ঠাত্রী দেবীরপরিচয় প্রসঙ্গে কবি লিখিয়াছেন ‘চমকে চরণতলেমানস সরসী।' এই চিত্র স্পষ্ট ও স্পর্শযোগ্য হইয়াও যেন অরূপের ব্যঞ্জনা পরিস্ফুট করিয়াছে। জ্যোতির প্রবাহ মাঝে যে বিশ্ববিমোহিনী বিরাজ করেন সেইলাবণ্যলতার মূর্তি মধুরিমা স্বপ্নের ন্যায় সুন্দর অথবা রূপাতীত। এই হেতু তিনি মায়ার মোহিনী মেয়ে স্বপ্ন সুন্দরী'। এখানে কবির কল্পনা ওঅরূপের ব্যঞ্জনাআসিয়া মিলিত হইয়াছে। আর একস্থানে কবি লিখিয়াছেন, ‘"সোনামুখী তরীখানিগিয়েছে কোথায়'""—
প্রতীকের এই ব্যঞ্জনা অরূপ লোকের ইঙ্গিত বহন করে।যে সৌন্দর্যলক্ষ্মীর ধ্যান কবি করিয়াছেন তিনি একাধারে নিসর্গের সারভূতপ্রকাশ ও কবিচিত্তের অনুভূত ভাবের আনন্দ মূর্তি। অন্তর বহির্লোক ব্যাপ্ত হইয়াউভয়ে একাত্ম হইয়াছে। তাই সৌন্দর্যলক্ষ্মী যখন চমকিত হন তখন রূপলোক ওভাবলোক তরঙ্গাবেগে আলোড়িত হয়।
""চমকে গগনে তারা
ভূধরে নির্ঝর ধারা
চমকে চরণতলে মানস-সরসী।""
বিশ্বব্যাপী সৌন্দর্যের মধ্যে তিনি বিরাজ করেন ও কবির মনকে তিনি প্রেম মাধুর্যে পূর্ণ করিয়া রাখেন। সমগ্র বিশ্বে তাঁহার কায়াহীন মহাছায়া প্রসারিত। তাই তাঁহার অনাদি, চিন্ময়ী সত্তাকে কবি অপরূপ ব্যঞ্জনার মধ্যে পরিস্ফুট করিয়াছেন।
বিহারীলালের নিসর্গপ্রীতি ও সৌন্দর্য চেতনা----
বিহারীলালের নিসর্গ-চেতনায় অন্তরের অসীমহা ব্যক্ত হইয়াছে। কবির নিকটেপ্রকৃতি শুধু শোভা ও সৌন্দর্যের আধার নহে অথবা এই সৌন্দর্যকে আশ্রয় করিযাকবি-চিত্তের উল্লাস নির্ঝরের ন্যায় সকল বাধাব, দৈন্য ও জড়তাকে দূরীভূত করিয়া উৎসারিত হয় নাই, ইহার মধ্যে কবি প্রত্যক্ষকরিয়াছেন প্রাণসত্তার প্রকাশ।
এই প্রাণ কায়াহীন মহাছায়া ও বিশ্ববিমোহিনী মায়ারূপেচরাচর পূর্ণ ও পরিব্যাপ্তকরিয়া আছে। ইনি মহাময়া, কান্তি, প্রেম ও প্রজ্ঞার পূর্ণবিকাশ। এই তত্ত্বটি কবিরমনে সত্যরূপে উদ্ভাসিত। 'সাধের আসন' কাব্যে কৰি লিখিয়াছেন:
"""প্রত্যক্ষ বিরাজমান
সর্বভূতে অধিষ্ঠান
তুমি বিশ্বময়ী কান্তি, দীপ্তি, অনুপমা""।
কবির নিকটে তিনি উদার সুষমা। এই সৌন্দর্যের দেবীকে কবি আবাহন করিয়াছেন। যদি ইহা ভুলও হয় তথাপি :
""এ ভুল প্রাণের ভুল
মর্মে বিজড়িত মূল
জীবনের সঞ্জীবনী অমৃত-বল্লরী""।
দার্শনিকগণ যাঁহাকে প্রত্যক্ষ করেন মহামায়ারূপে, কবির ধ্যান দৃষ্টিতে তিনি--
""কে তুমি প্রাণেতে পশি
ত্রিদিবের পূর্ণ শশী;
কান্তি-সংকলিত-কায়া অপরূপ ললনা?""
বিহারীলাল অন্তরে গভীর উপলব্ধিজনিত আনন্দে জিজ্ঞাসা করিয়াছেন 'কে তুমি? কে তুমি এই বিরাট বিকাশ'? ইহার উত্তর কোন তত্ত্বের মাধ্যমে নহে,
বোধির আলোকে তিনি লাভ করিয়াছেন যে, এই দেবী সারদা প্রাণের প্রাণ,জীবের চেতনা স্বরূপ। জীবলোকে অঙ্কে অঙ্কে চৈতন্যের যে পালা অনুষ্ঠিত হইয়াচলিয়াছে তাহার উৎস এই দেবী।সৌন্দর্যম্বরূপা এই যে দেবী তিনি যেমন মধুরা তেমনি ভয়ঙ্কর। তাঁহার ভয়াল
""রূপ মনকে শঙ্কিত ও ত্রস্ত করে।
কখন গেরুয়া পরা,
ভীষণ ত্রিশূল ধরা,
পদতরে কাপে ধরা ভূধর অধীর""
দীপ্ত সূর্য হুতাশন
ধ্বক ধ্বক দুনয়ন
হুঙ্কার বিদরে ব্যোম, লুকায় মিহির।"
আবার ইহার বিপরীত দিক, মধুরা মূর্তি মানবচিত্তকে প্রসন্ন করে।করেন মধুর স্বরে অভয় প্রদান।
ওয়ার্ডসওয়ার্থও অনুরূপভাবে পরম সত্তার দ্বিবিধ প্রকাশকে বর্ণনা করিয়াছেন।
""কভু বরাভয় করে
চাঁদে যেন সুধা ক্ষরে""
আবার,,,
Tumult and peace, the darkness and the light,
Were all like workings of one mind, the features
of the same face, blossoms upon on tree,
বিহারীলাল যাহাকে বিশ্ববিমোহিনী মায়া রূপে বর্ণনা করিয়াছেন ওয়ার্ডওয়ার্থ তাঁহাকে বলিয়াছেন :
""Wisdom and spirit of the universe!
Thou Soul, that are the eternity of thought!
And giv'st to forms and images a breath
And everlasting motion!""
বিহারীলালের সংবেদনশীল কবি-চিত্ত প্রকৃতির মধ্যে শুধু সৌন্দর্য উপলব্ধি করে নাই, ইহার গভীরে প্রবেশ করিয়া প্রাণ-সত্তার পরিচয়ে চমৎকৃত হইয়াছে।সারাদামঙ্গলের প্রথম সঙ্গে তিনি যে ঊষার বর্ণনা করিয়াছেন তাহা সারদা মূর্তিতেরূপান্তরিত হইয়াছে। অন্তরের অসীমতা বাহিরে প্রকাশিত হইয়াছে। তাই যে ত্রিদিবদেবী তাঁহার হৃদ্কমলে বিরাজ করেন, যিনি অন্তরব্যাপিনী, আনন্দরূপিণী
মানস-মরালী বহির্জগতে তাঁহাকে তিনি প্রকৃতির সারভূতা নির্বিশেষ সৌন্দর্যলক্ষ্মী রূপে প্রত্যক্ষ করিয়াছেন। প্রথম সর্গে বর্ণিত করুণ—হৃদয় বাল্মীকির সম্মুখে
যোগীর ধ্যানের ধন যে লালটিকা মেয়ে, আবিভূতা হইয়াছিলেন তিনি কবি-চিত্তের প্রেরণার বহিঃপ্রকাশ।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মধ্যে মাবন আপনাকেই অনুভব করে'—তাই অন্তরের দিব্য প্রেরণা, যাহা প্রেমানুভূতির সঙ্গে বিজড়িত তাহাই নিসর্গের সৌন্দর্যের মধ্যে
রূপমূর্তি লাভ করিয়াছে। ইহা বিচিত্ররূপিণী, নিসর্গের নানা বস্তু আশ্রয়ে ইহার প্রকাশ। কবির সঙ্গে এই মানস মরালীর প্রেমের সম্পর্ক।
""তোমারে হৃদয়ে রাখি
সদানন্দ মনে থাকি,
শ্মশান অমরাবর্তী দুই ভাল লাগে।""
কবির এই যে প্রেম তাহা ভক্তির রূপভেদ মাত্র। ভক্তিভাবে একতানে তিনি
রূপলক্ষ্মীর ধ্যান করেন এবং তোমা-হারা হলে আমি প্রাণ হারা হই'।
তাঁহাকেপ্রত্যক্ষ করিয়া কবি-প্রাণে আনন্দের সীমা থাকে না।
"মন কেন রসে ভাসে
প্রাণ কেন ভালবাসে
আদরে পরিতে গলে সেই ফুলহার?""
যখন মানস-মরালীর সহিত কবি সাহচর্য বঞ্চিত হন তখন দুঃখে তাঁহার হৃদয়ভরিয়া উঠে। মৃত্যুর মধ্যে তিনি আশ্বাস পাইতে চান ‘এ পোড়া পিঞ্জর রাখি, উড়ু
ক পরাণ পাখী'—মর্ত্যলোকে কোন কিছু তাঁহার প্রাণকে আশ্বস্ত করিতে পারে না।এই মানস-লক্ষ্মী বিশ্বব্যাপিনী সৌন্দর্য-মূর্তিতে পরিণত হইয়াছেন। তাঁহার প্রাণে
প্রাণ জাগিয়া উঠে, জড়জগতে সঞ্চারিত হয় চেতনার প্রবাহ।
""চমকে গগনে তারা,
ভূধরে নির্ঝর ধারা,
চমকে চরণতলে মানস-সরসী।""
প্রকৃতি তাই বিহারীলালের নিকটে রূপের উৎস মাত্র নহে, ইহা 'স্বপনেবিচিত্র-রূপ দেবী যোগেশ্বরী’, ‘সত্যরূপা সরস্বতী' ও 'লাবণ্যলতা মূর্তি মধুরিমা।
কিন্তু তাঁহাকে চিরদিনের মত পাইতে চাহিলে প্রয়োজন হইল আদর্শ কবি পুরুষের সাহচর্য।
""আহা সে পুরুষবর
না জানি কেমন তর।
দাঁড়ায় রজতগিরি অটল সুধীর!"
চতুর্থ সর্গে কবি যে হিমালয়ের বর্ণনা করিয়াছেন তাহা অপ্রসাঙ্গিক বলিয়া মনে হইবে না। এখানে কবি-মনের দুইটি ধারা আসিয়া মিলিয়াছে। একদিকে যেমন নিসর্গের সৌন্দর্য দর্শনে তাঁহার মন উল্লসিত হইয়াছে অন্যদিকে তিনি ইহারমধ্যে সৌন্দর্য প্রতিমাকে প্রত্যক্ষ করিয়াছেন। রূপোল্লাসের পরিচয় পাওয়া যায় চতুর্থ সর্গে বর্ণিত বিভিন্ন স্তবকে। নিসর্গ যেন কবির অন্তরের আনন্দকে আকর্ষণ করিয়া লইয়াছে। কবি তাঁহার প্রাণ ও সমগ্র চেতনাকে নিসর্গের সৌন্দর্যের মধ্যেসমর্পণ করিয়াছেন।
""কি যে ওই মনোহারী
দেবদারু সারি সারি
দেদার চলিয়া গেছে কাতারে কাতারে।
দূর দূর আলবালে""
কোলাকুলি ডালে ডালে,
পাতার মন্দির গাঁথা মাথায় সবারপরিণামে এই সৌন্দর্য-প্রীতি কবিকে আকর্ষণ করিয়াছে অসীমের প্রতি,
রহস্যময়তার অভিমুখে। হিমালয়ের উদার, উদারতর শিখরে তাঁহার সহিত
সারদার মিলন ঘটিয়াছে ।
""এ নিসর্গ রঙ্গভূমি
মনোরমা নটী তুমি,
শোভার সাগরে এক শোভা নিরুপমা।""
তিনি বর্ণনা করিয়াছেন :
""দাঁড়াও হৃদয়েশ্বরী ত্রিভুবন আলো করি
দুনয়ন ভরি ভরি দেখিব তোমায়।""
‘কবির 'মানস-মরালী মম আনন্দরূপিনী’ প্রকৃতির সারভূতা সৌন্দর্যের প্রকাশ
রূপে, বিশ্বলক্ষ্মী রূপে উদিতা হইয়া তাঁহার অর্ঘ্য গ্রহণ করিয়াছেন
গীতিকবি বিহারীলাল----
ভারতবর্ষে ও পাশ্চাত্য দেশে আলঙ্কারিকগণ কাব্যের বিধি রূপ লইয়াআলোচনা করিয়াছেন। ভারতবর্ষে কাব্যকে দৃশ্যকাব্য, আখ্যানকাব্য ও খণ্ডকাব্য এইতিনটি শ্রেণীতে সাধারণভাবে বিভক্ত করা হইয়াছে। শেষোক্ত শ্রেণীর মধ্যে
গীতিকবিতা অন্তর্ভুক্ত হইতে পারে। মনের আবেগ প্রকাশের জন্য যেহেতু মানুষআগ্রহশীল সেইজন্য তাহা সুরাশ্রয়ী হইয়া থাকে। বঙ্কিমচন্দ্রের বক্তব্য এই প্রসঙ্গে
স্মরণীয়। গীতের জন্য যদি বাক্যবিন্যাস করা যায় তবে তাহাকে নিয়মাধীনকরিতে হয়। ‘সেই সকল নিয়মগুলির পরিজ্ঞানেই ছন্দের সৃষ্টি।গীতের পারিপাট্যের জন্য স্বরচাতুর্থ ও শব্দচতুর্থ আবশ্যক। যেহেতু দুইটিক্ষমতা একজনের মধ্যে সচরাচর পাওয়া যায় না সেইহেতু একজন গীত রচনাকরেন ও অপরজন গান করেন।
অতএব গীতের যে উদ্দেশ্য, যে কাব্যের সেই উদ্দেশ্য, তাহাই গীতিকাব্য।বক্তার ভাবোচ্ছ্বাসের পরিস্ফুটতা মাত্র যাহার উদ্দেশ্য সেই কাব্যই গীতিকাব্য।মনুষ্য হৃদয়ের সকল ভাব ব্যক্ত হয় না। যাহা ব্যক্ত হইল তাহা নাটককারের
সামগ্রী। তিনি তাহাকে কথায় ও ক্রিয়ায় রূপ দান করেন। অব্যক্ত অংশটুকুগীতিকাব্যকার সুরের ভাষায় প্রকাশিত করেন। ভরভূতি রামচরিত্রের পরিস্ফুট ওঅপরিস্ফুট অংশ নাটকাকারে গ্রথিত করিতে যাইয়া গীতিকাব্যের রাজ্যে প্রবেশকরিয়াছেন, কিন্তু বাল্মীকি রামের কার্যগুলি মাত্র বর্ণনা করিয়াছেন। অথচ উভয়কাব্য আখ্যান কাব্যরূপে রচিত।
বঙ্কিমচন্দ্রের বক্তব্যকে বিশ্লেষণ করিলে আমরা যাহা পাই তাহা ইহল এই যে,
মানুষের যে সকল ভাব ও চিন্তাধারা কার্যে প্রকাশিত হয় তাহা নাটকের বস্তু। ইহার
মধ্যে তাহার চরিত্র পরিস্ফুট হয়। কিন্তু যাহা মনের অন্তলীন ভাব, যাহা প্রকাশের জন্য
ব্যাকুল কিন্তু অবকাশ যেখানে কম তাহা লইয়া গীতি-কবিতা রচিত হইয়া থাকে।
ওয়ার্ডওয়ার্থ এই গীতিধারার পরিচয় দিতে যাইয়া বলিয়াছেন : 'for all
good poetry is the spontaneous overflow of powerful feelings' যিনি কবি
তাঁহার আছে সংবেদনশীল মন। তাঁহার অনুভূতি মননের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এই
মননও অতীতের বিচিত্র অনুভূতির যোগে প্রভাবিত হইয়া থাকে। মানব প্রকৃতি
সম্পর্কে কবির ব্যাপক অভিজ্ঞতা হেতু মন উদার ও সর্বব্যাপী হয়। যেখানে তিনি
প্রাণের প্রকাশ দেখিতে পান সেখানে তাঁহার চিত্ত উল্লসিত হইয়া উঠে। ছন্দ
সম্পর্কে ওয়ার্ডওয়ার্থের বক্তব্য হইল, ‘the distinciton of metre is regular
and unifrom', ছন্দের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে কোলরিজ বিস্তৃত আলোচনাকরিয়াছেন। আবেগকে নিয়ন্ত্রিত করিয়া আনন্দদানেরনিমিত্ত ছন্দ কাব্যে ব্যবহার
করা হয়। স্বাভাবিক প্রেরণা যখন ইচ্ছাশক্তির সঙ্গে মিলিত হয়, যাহাকে কোলরিজবলিয়াছেন, ‘an interpenetration of Passion and of will of spontaneous
impulse and of voluntary purpose', তখন তাহা পাঠকচিত্তে আনন্দ দানকরিয়া থাকে। ইহা পরিণামে অনুভূতি ও মনোযোগকে পরিবর্ধিত করে। তবেছন্দের উপযোগিতা কবির চিন্তা ও প্রকাশের উপরে নির্ভরশীল।কবিতার ফলশ্রুতি সম্পর্কে ওয়ার্ডওয়ার্থের উক্তি হইল theend of poetry
is to produce excitement in co-existence withan over balance of
pleasure' কিন্তু কবির পক্ষে মানসিক উত্তেজনায় কবিতাসৃষ্টি করা যায় না।একটি বিশেষ অভিজ্ঞতা যে উত্তেজনা সৃষ্টি করে তাহা যখন প্রশমিত হয় তখন
কবি নূতন করিয়া প্রশান্ত-চিত্তে তাহা আবার স্মরণ করেন। তখন যে আবেগজাগিয়া উঠে তাহার মধ্যে অপ্রাসঙ্গিক ও তুচ্ছ চিন্তা থাকে না। সেই সময়ের যে
স্মরণীয় উক্তি তাহাই হইল কবিতা। এই সৃষ্টির পশ্চাতেযুগপৎ কবির হৃদয়, মনও মনীষা কাজ করিয়া থাকে। অতীতে যখন জগৎ ছিল সুন্দর ও সজীব, তখন জীবন ছিল কাব্য। জীবনেরমধ্যে কাব্য ধারা প্রবাহিত হইত এবং কবির মুখ হইতে স্বততই রূপকাশ্রিত ভাষাপ্রকাশিত হইত। তখন কবিগণ তাঁহাদের অভিজ্ঞতালব্ধ অনুভূতি গীতির মাধ্যমেপ্রকাশ করিতেন। কিন্তু বর্তমান কালে গীতি ও কবিতার মধ্যে বিষম ছেদ
ঘটিয়াছে। বার্ণস্ ও ব্লেকের গীতি কবিতায়, শেক্সপীয়রিয়নাটকের গীতি-কবিতায়যে যৌগপদ্য লক্ষ্য করা যায় তাহা বর্তমান কালে প্রত্যক্ষগোচর নহে। স্বভাবত
কবিতার ভাষাকে কবি-ভাষায় পরিণত না করিতে পারিলে ভাবের সঞ্চার হেতুপাঠকমনে আনন্দ দান করা যায় না। তবে ভাষার জীণতাহেতু এবং প্রকাশভঙ্গীর তাগিদে কবি-ভাষায় পরিবর্তন ঘটিয়া থাকে।কবিতা পাঠকমনে অনুভূতি ও আবেগ সঞ্চালিত করে। কিন্তু ইহার সঙ্গে যদিঅভিজ্ঞতার দিকটি ব্যক্ত না হয় তবে রসোপলব্ধি ঘটে না। অনুভূতি ও মনন এক
অচ্ছেদ্য সম্পর্কে গ্রথিত।যেখানে সমগ্র অভিজ্ঞতার পরিচয় পাওয়া যায় তথা চিত্তের জাগরণ ঘটে।আমরা যাহা আছি ও যাহা হইতে পারি নাই, এই উভয় ধারার সম্পূর্ণতায় আমরাপূর্ণতার আনন্দ আস্বাদন করিয়া থাকি। ইহাকে বিশুদ্ধ কবিতা বা গীতিকবিতারূপে ব্যাখ্যা করা সঙ্গত। ইহার মধ্যে ব্যক্ত ভাব মুধু আমাদের আনন্দ দান
করে না, মনকে সীমার বন্ধন হইতে মুক্ত করে। এই দিকেহইতে বিচার করিলেবলা যাইবে যে, শ্রষ্ট কবিতার মধ্যে আছে আধ্যাত্মিক ভাবের প্রেরণা। পার্থিব
জীবন ও এই জীবনের অভিজ্ঞতা লইয়া গীতি-কবিতারচিত হইয়া থাকে। কিন্তুযেখানে উচ্চ চিন্তা বা তত্ত্ব কবিমানসের গভীর অনুভূতিলব্ধ প্রকাশ, তাহারআবেদন আরও গভীর।গীতি-কবিতার ধারা বাংলা কাব্যে প্রথম যুগ হউইতে চলিয়া আসিতেছে।চর্যাগীতিকারগণ সাধনসঙ্কেতদ্যোতক পদ রচান করিলেও গীতি-কবিতার ধর্ম
বিস্তৃত হন নাই। তাঁহাদের ব্যবহৃত রূপক আত্মগত ভাবের সৌরভে পূর্ণ।বৈষ্ণবপদাবলী হইতে মধুসূদন এবং হেমচন্দ্র-নবীনচন্দ্রেরকাব্যে এই গীতিধারাপ্রবাহিত হইয়া আসিয়াছেন। বৈষ্ণব পদকর্তাগণ রাধা-কৃষ্ণ প্রণয়-লীলা ব্যাখ্যানেরমাধ্যমে গীতি-কবিতার সুরকে স্বচ্ছন্দভাবে প্রকাশ করিয়াছেন। তাঁহাদের রচনা
যতই তত্ত্ববাহী হউক তাঁহারা কদাপি তাঁহাদের কবি-স্বভাব হইতে বিচ্যুত হননাই। এমন কি মঙ্গলকাব্যসমূহ আখ্যায়িকামূলক হইলেও চন্দ্রধরের সঙ্কল্পে ও
সংহত শোকে, বেহুলার পতির শব সহ অনির্দেশ্য পথেযাত্রায়, দেবলোকপ্রার্থনায়, চণ্ডর নিকটে পশুগণের নিবেদনে, ফুল্লরার বারমান্যায়, খুল্লনার দুঃখ
বর্ণনায় গীতি-কবিতার সুর উৎসারিত হইয়াছেভারতচন্দ্রের 'অন্নদামঙ্গলেও'গীতি-ধর্মিতার অসম্ভাব নাই।মধূসূদনের প্রতিভা ছিল মূলতঃ গীতি-ধর্মী। তিনি বস্তুনিষ্ঠআখ্যায়িকামূলকমহাগীত' রচনা করিতে যাইয়াও রাবণের বিলাপে, সীতার করুণ কাহিনীতে,ইন্দ্রজিৎ-প্রমীলার প্রণয় সম্ভাষণে গীতি-কবিতার সুরকে উক্ত মহাগীতের মধ্যেপ্রবাহিত করিয়াছেন। তাঁহার 'তিলোত্তমাসম্ভব' আখ্যায়িকার আধারে গীতিধর্মিতাকে ‘ব্যক্ত করিয়াছে। 'ব্রজাঙ্গনা' অথবা 'চতুর্দশপদী কবিতাবলী' পরিপূর্ণ
গীতি-কবিতার রূপকল্পে ও সুরে প্রকাশিত।
গীতি-ধর্মের প্রতি প্রবণতা হেতু হেমচন্দ্র বা নীবনচন্দ্র স্বচ্ছন্দচিত্তেমহাকাব্যের বিশাল, বস্তুনিষ্ট রাজ্যে বিচরণ করিতে পারেন নাই। গীতি-ধর্মতাঁহাদের মনকে অধিকার করিয়াছিল। তবে হেমচন্দ্রের আত্মনিষ্ট সুর তত্ত্বেরআবির্ভাবে ব্যাহত হইয়াছে। চট্টগ্রামের শ্যামল প্রকৃতির মনোরম ও স্নিগ্ধ সাহচর্যেনবীনচন্দ্রের শৈশব অতিবাহিত হওয়ায় তাঁহার কবি-মানস আত্মনিষ্ঠ কল্পনায় ও
অনুভূতিতে পরিবর্ধিত হইয়াছিল। ইহার পরিচয় আমরা তাঁহার দুই ভাগে প্রকাশিত
‘অবকাশরঞ্জিনী’র মধ্যে পাই। তবে তিনিও আত্মবিস্মৃতহইয়া 'চিরমুগ্ধকারীপ্রকৃতি সুন্দরী' বা কল্পনার নিকটে নিজেকে সমর্পণ করিতে পারেন নাই। তাই
অনেক কবিতায় যথা 'একটি চিন্তা' বা 'কে বলিতে পারে' বা 'সায়ং চিন্তা'য়বায়রণের প্রভাবে আত্ম-কর্তৃত্বের সুর, কোথাও তত্ত্বচিন্তা যথা 'হৃদয় উচ্ছ্বাস’ বাবিষ্ণুণ্ণ কমল’ কবিতায় প্রবল হইয়া দেখা দিয়াছে। নবীনচন্দ্রের ত্রুটি হইল যে,তিনি অত্যাধিক ভাবোচ্ছ্বাস হেতু সংযত থাকিতে পারেন না। ভাবের অপরিমিত প্রাবল্যে লিরিকের সংযত অথচ গভীর প্রকাশ তাঁহার ব্যাহত হয়। 'কেন দেখিলাম’কবিতায় এই জাতীয় ভাবের তরল প্রবাহ লক্ষ্য করা যায়।বিহারীলালের প্রভাবকোন কোন কবিতায় পরিলক্ষিত হয়।
""এ বিরস রঙ্গভূমে
সকলি আচ্ছন্ন ধূমে,
কোথাও-একটিও আর নাহি ফোটে ফুল।""
নবীনচন্দ্র 'কি করি' কবিতায় লিখিয়াছেন :
""কত কাল রব বল,
হয়! এই তীব্রানল,
স্মৃতির সহস্র শিখা,—সংসার নির্দয়,
কণ্টকিত, রক্তীকৃত, করিবে হৃদয় ।"""
বিহারীলাল আত্মনিমগ্ন ভাবরসে সমাহিত গীতিকবি।সারদা ধ্যান তাঁহার
মনকে এমনভাবে অধিকার করিয়াছে যে, 'সারদামঙ্গলে' তিনি তাঁহার ভাবরসেপরিপূর্ণ হৃদয় উদঘাটিত করিয়াছেন। তত্ত্ব তাঁহার কাব্যে আছে। কিন্তু তাহা তাঁহারকল্পনা ও আবেগের নিবিড়তার সহিত মিশিয়া গিয়াছে। প্লেটো ইহাকে
একটাসিরূপে অভিহিত করিয়াছেন। বোদলেয়ার ইহার পরিচয় দিয়া লিখিয়েছেন :
Il fault etre toujours ivre, Tout est la : c' est l' unique question.
গাহিতে তাঁহার মনোলোকে ত্রিকালের সরস্বতী মূর্তি কখনো স্পষ্ট বা অস্পষ্ট হইয়াবিরাজ করিতে লাগিল। চির আনন্দময়ী বিষাদিনী সারদার সহিত মৈত্রী-প্রীতির
স্মরণা মূর্তি মিশ্রিত হইয়াছে--
"""করুণা কটাক্ষ তব
পাই প্ৰাণ অভিনব
অভিনব শাস্তিরসে মগ্ন হয়ে রই।""
যখন এই স্মৃতি অস্পষ্ট হয় তখন
"""কোথা গেলে সঞ্জীবনী।
মণি-হারা মহাখনি
অহো, সেই হৃদিরাজ্য কি ঘোর আঁধার।""
সারদার সহিত বিরহ-মিলনের কাহিনী, আশা-নৈরাশ্য, হর্ষ-বিষাদ ওঅভিমানের শত কথা স্বপ্নের মত বিচিত্র সর্গপ্রবাহে এক সূত্রে গ্রথিত হইয়াছে। এইহেতু রবীন্দ্রনাথের মতে বাঙালা সাহিত্যে প্রেমের সঙ্গীত সহস্রধার উৎসের মতোআর কোথাও এমন উৎসারিত হয় নাই। ভক্তিভাবেএকতানে সারদার ধ্যানে কবিআত্মবিস্মত হইতে পারিয়াছেন বলিয়া লিরিকের প্রবাহ উচ্ছ্বসিত হইতেপারিয়াছে। এই হেতু বিহারীলাল লিখিয়াছেন, এখন বোধ করি বুঝিতে পারিলেনযে, আমি কোন উদ্দেশ্যেই সারদামঙ্গল লিখি নাই। যেখানে চিন্তা ও অনুভূতিএকাত্ম সেখানে গীতিধারা প্রবাহিত হয় ও তাহাই তখন কাব্যসৃষ্টির আদর্শরূপেপরিগণিত হইয়া থাকে।লিরিক কবিতার প্রথম পর্বে চিন্তা ও কথা অপেক্ষা ভাবাশ্রিত সুরই প্রধানহইয়া দেখা দেয়। শেক্সপীয়রের অথবা ক্যারোলিন কবিগণের কবিতায় ইহা
লক্ষণীয়। শেক্সপীয়রের As you like it or The Tempes'- বর্ণিত হয়েছে :
"""
Under the green wood tree
Who lovers to lie with me
And turn his merry note
Unto the sweet bird's throat,
Come hither, come hither, come hither!"""
অথবা, """Full Fathom five father lies;
Of his bones are corla made;
Those are pearls that were his eyes:"""
কিন্তু ঊনবিংশ শতাব্দীতে গীতি কবিতায় পরিবর্তন লক্ষ্য করিবার মতো।ওয়ার্ডসওয়ার্থ হইতে কীট্স পর্যন্ত সকল কবিগণের কবিতায় সুরে সহিত ভাবনা বাতত্ত্ব যুক্ত হইয়া এক নূতন স্বাদ আনিয়াছে। এমন কি, যেখানে কবিতা নিছকভাবধর্মী তাহাও পক্ষান্তরে জীবনযাত্রার সহিত বৈপরীত্য হেতু তত্ত্বকে বর্জনকরিতে পারে নাই। প্রভাতে ওয়েস্টমিনস্টার ব্রিজ হইতে নগরার শান্ত ও সুন্দর
রূপ পত্যক্ষ করিয়া ওয়ার্ডসওয়ার্থ লিখিয়াছেন
""Ne'er saw I, never felt, a calm so deep!""
কিন্তু ইহা বৈপরীত্যের পটভূমিকায় রচিত হইয়াছে। অনুরূপ পরিচয়, বর্তমান কালের অপূর্ণতাবোধ-জনিত দুঃখানুভূতি শেলির সুরাশ্রয়ী কবিতাতেও পাওয়া যায়:
O world! O life ! Time!
When will return the glory of your prime?
No more-oh, O never more!"""
‘সারদামঙ্গল' কাব্যে ও কবির বেদনাম চৈত্যন্যের প্রকাশ সুন্দরভাবে ঘটিয়াছে।।।
0 মন্তব্যসমূহ