Hot Posts

6/recent/ticker-posts

সধবার একাদশী নাটকের আলোচনা

 


((সধবার একাদশী নাটকের আলোচনা
 সধবার একাদশী 
দীনবন্ধু মিত্র 
sodhobar ekadoshi
সধবার একাদশী নাটকের চরিত্র প্রহসন দীনবন্ধু মিত্রের প্রহসন বাংলা প্রহসন))
**বিঃদ্র-বাংলা বিভাগের সকল পড়াশোনা পেতে ব্লগটিতে যুক্তথাকুন https://monoweredu13.blogspot.com/?m=1 
পুরুষ-চরিত্র--
জীবনদন্দ্র (ধনবান ব্যক্তি)। অটলবিহারী (জীবনচন্দ্রের পুত্র)। গোকুলচন্দ্ৰ
(অটলের খুড়শ্বশুর)। নকুলেশ্বর (উকিল) । নিমচাঁদ, ভোলা (অটলের ইয়ার)।
রামমাণিক্য (বাঙ্গাল)। দামা (অটলের ভৃত্য)। কেনারাম (ডিপুটি মাজিস্ট্রেট)।
(ব্রাহ্মণ পণ্ডিত)। রামধন রায় (অটলের পিতৃব্য)।
বৈদিক
স্ত্রী-চরিত্র

গিন্নী (জীবনচন্দ্রের স্ত্রী ও অটলের মাতা)। সৌদামিনী (অটলের ভগ্নী) কুমুদিনী
(অটলের স্ত্রী)। কাঞ্চন (বেশ্যা))।

উনিশ শতকে ভারতবর্ষ তথা বাংলায় ঘটে আধুনিকতাবাদের প্রথম জাগরণ। সে
ভাগবগে জেগে ওঠে এছু ধান ব্যক্তি। যাঁদের চিন্তা ও চেতনাকে
ও বিজ্ঞান ও দর্শন ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে। ফলে দীর্ঘদিনের
সংস্কারাবদ্ধ ভারতীয় সমাজে এক সুতীব্র ঢেউ এসে লাগে। সেখানে একদিকে
সামাজিক সংস্কার থেকে ব্যক্তিকে বের করে আনা অন্যদিকে ঔপনিবেশিক শোষণ ও
পরাধীনতা থেকে সমাজকে মুক্ত করার প্রচেষ্টা লক্ষ করা যায়। এ অবস্থায় বাংলার
সংস্কারের মতো সাহিত্যও পরিবর্তিত হতে থাকে। সে পরিবর্তনের প্রথম সারপি
মাইকেল মধুসূদন দত্ত (১৮২৪-১৮৭৩)। তাঁরই চালিত নাট্যরথে অর্জুনের মতো গাণ্ডীব
হাতে এগিয়ে আসেন দীনবন্ধু মিত্র (১৮৩০-১৮৭৩)। তাঁর নাট্যবাণে বাংলার উচ্ছৃঙ্খল
যুবসমাজ থেকে শুরু করে নীলব্যবসায়ী ব্রিটিশ দরবার পর্যন্ত বিদ্ধ হয়েছিল। বাধ্য
হয়েছিল নীলচাষের বাধ্যবাধকতাকে বন্ধ করতে বাংলা নাট্যসাহিত্যকে সর্বপ্রথম
শোষণের বিরুদ্ধে অস্ত্রের মতো ব্যবহার করেছিলেন 'নীল-দর্পণ'-এর এই অমর স্রষ্টা।
মধুসূদনপরবর্তি 'প্রহসন' রচনাতেও যিনি স্বতন্ত্র। সমালোচক ক্ষেত্রগুপ্ত দীনবন্ধুর এই
স্বাতন্ত্র্যকে সমকালীন সাহিত্যিকদের সঙ্গে তুলনা করে বলেছেন,

দীনবন্ধুর ব্যক্তিত্বে প্রথম শ্রেণীর প্রতিভার লক্ষণ নেই। মধুসূদন বা বঙ্কিমের সঙ্গে এ
বিষয়ে তাঁর ঠিক তুলনা চলে না। মধুসূদন নব্য সাহিত্যের জনক। পশ্চিমের ভাবরস
আকণ্ঠ পান করে তিনি নীলকণ্ঠ; বঙ্গভারতীয় পদ্মবনে মধু যোগানোয় ব্যাঘাত ঘটে নি।
সেখানে ধূমকেতুর ঔজ্জ্বল্যে, অট্টহাস্যে আকাশ দীর্ণ, ক্রন্দনে দিগন্ত স্তব্ধ, কামনায়
সিন্ধুচারি পাখির ডানার কম্পন। দীনবন্ধুর অতবড় কামনা নেই। নেই অতবড় ব্যর্থতাও।
দীনবন্ধুর জীবনে নাটক নেই। মুহুর্মুহু আকস্মিকের বাঁক ফেরে নি সে-জীবনে। শিল্পী
বঙ্কিম মানবচরিত্রের গহনচারি, চিন্তানায়ক বঙ্কিম জাতির নেতা ডেপুটিগিরির
নিয়মতান্ত্রিক পথে তাঁর জীবন চক্রমিত। কিন্তু ব্যক্তিত্ব তাঁর অনেক বড়। নব্য
জাতীয়তাবাদের মন্ত্রোচ্চারণে তিনি যুগগুরু চিন্তানায়করূপে বঙ্কিমের প্রতিষ্ঠার বারো
বছর আগে 'নীলদর্পণ' লিখলেও দীনবন্ধু জাতির নেতা হতে চান নি। সে প্রতিভা তাঁর
নয়।
দীনবন্ধু মিত্রের জীবনী।
দীনবন্ধু মিএ বাংলা ১২৩৮ (দীনবন্ধুর পুত্রের মতে ১২৩৬) বঙ্গাব্দের চৈএ)
সালে ভারতের নদীয়া জেলার চৌবেড়িয়া গ্রামে দীনবন্ধু জ
করেন। সীনবস্ত্র মিত্রের প্রকৃত নাম নারায়ণ মিত্র। সমবয়সীরা গন্ধ বলে উপহা
করতেন বলে তিনি নিজের নাম নিজেই পরিবর্তন করেন। গন্ধর্বনারায়ণ মিত্র হয়ে।
ঠ। পরবর্তিতে দীনবন্ধু মিত্র নিজের নামের মতো নিজের জীবনের।
পথও পরিবর্তন করেন নিজেই। বাবা কালাচাদ মিত্র দরিদ্র ছিলেন। গ্রামের পাঠশালায়।
শুরু হয় বালক দীনবন্ধুর শিক্ষাজীবন। দীনবন্ধু জীবনে বড় হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন
জীবনের শুরু থেকে। এ কারণে মাত্র ষোলো বছর বয়সে পিতার অমতে চলে আসেন।
কলকাতায় আশ্রয় নেন কাকা নীলমণি মিত্রের বাড়িতে। সে বাড়িতে নানা ধরনের
কাজের বিনিময়ে তাঁকে থাকতে হয়েছে। এমনকি স্কুলের বেতনও তাঁকে বিভিন্ন জনের
নিকট থেকে সংগ্রহ করতে হয়েছে। ১৮৪৬ সালে তিনি লঙ্ সাহেবের ইংরেজি স্কুলে
ভর্তি হন। এরপর সে স্কুল থেকে ভর্তি হন কলুটোলা ব্রাঞ্চ স্কুলে। এ স্কুলে তিনি
প্রথমবারের মতো বৃত্তি পান। স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে দীনবন্ধু ভর্তি সে কালের বিখ্যাত
হিন্দু কলেজে। এ কলেজ থেকে তিনি একাধিক বৃত্তি পেয়েছিলেন। কিন্তু এ কলেজ
থেকে তিনি শেষ পরীক্ষা না দিয়েই শিক্ষাজীবনের সমাপ্ত করেন। দীনবন্ধুর মিত্রের
কর্মজীবন শুরু হয়েছিল শৈশবে। বালক বয়সেই আট টাকা বেতনে কাজ করতে হয়।
জমিদারি সেরেস্তার। কিন্তু যে দীনবন্ধু জীবনে অনেক বড় হবেন, প্রতিষ্ঠিত হবেন সেই
দীনবন্ধু নিজেকে গ্রামের সেরেস্তাদারির কাজে শেষ করবেন না এটিই স্বাভাবিক।
কলকাতায় এসে শিক্ষাজীবন অসমাপ্ত রেখেই তিনি যোগদান করেন হিন্দু কলেজে
শিক্ষকতা পেশায়। এ পেশায় যোগদানের অল্প দিনের মধ্যেই তিনি তা ছেড়ে দেন এবং
১৮৫৫ সালে যোগ দেন ১৫০ টাকা বেতনে পাটনা পোস্টমাস্টারের পদে। এ কাজে
তিনি অত্যন্ত দক্ষতার পরিচয় দেন। ফলে দেড় বছরের মধ্যেই তাঁর পদোন্নতি হয়।
ইনুসপেকটিং পোস্টমাস্টার হয়ে তিনি দায়িত্ব পেলেন উড়িষ্যা (বর্তমানে ওড়িশা)
বিভাগের। এ পদে থাকাকালীন দীনবন্ধুকে উড়িষ্যা, নদীয়া ও ঢাকা বিভাগের বিভিন্ন
অঞ্চলে পোস্টের কাজ তদারকির জন্য ঘুরতে হয়েছে। এসময় দীনবন্ধু কয়েকজন বন্ধু
নিয়ে একটি প্রেসও কিনেছিলেন। যাই হোক কর্মদক্ষতার গুণে দীনবন্ধুর আবারো
পদোন্নতি হয়। ১৮৭০ সালে তিনি সুপারনিউমারি ইন্সপেকটিং পোস্টমাস্টার হন।
এসময় তাঁর কর্মস্থল হয় কলকাতা। ১৮৭১ সালে সংঘটিত লুসাই যুদ্ধে বিপর্যস্ত
যোগাযোগ ব্যবস্থাকে পুনর্গঠিত করার কাজে দীনবন্ধু মিত্র আবারো দক্ষতার পরিচয়
দেন। এ বছরই তিনি ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক 'রায় বাহাদুর উপাধি লাভ করেন।
এরপরই কর্মজীবনে এক ঘোরকালের সূচনা হয় দীনবন্ধুর। দীনবন্ধুর দুই সিনিয়র
কর্মকর্তা (পোস্টমাস্টার জেনারেল মিস্টার টুইডি ও ডাইরেক্টর জেনারেল মিস্টার হিগ)
ছন্দের প্রতিফল ভোগ করতে হয় দীনবন্ধুকে। দীনবন্ধকে বদলি করা হয় ইস্ট ইন্ডিয়ান
রেলওয়ের ইন্সপেক্টর হিসেবে। এরপর তাঁকে পদাবনতি দিয়ে আবারো ইনসপেকটিং
পোস্টমাস্টার হিসেবে হাওড়া বিভাগের দায়িত্ব দেয়া হয়। কিন্তু জীবনের লুডু খেলার
এই সাপ-সিঁড়ির উত্থান-পতনে দীনবন্ধু ততদিনে ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। নিজেকে আর
খুব বেশি দিন সচল রাখতে পারেন নি (১৮৭৩ সালের পহেলা নভেম্বর মাত্র তেতাল্লিশ...
বছর বয়সে দীনবন্ধু মিত্র ইহলোক ত্যাগ করেন।

দীনবন্ধু মিত্রের সাহিত্যজীবন:

মাত্র তেতাল্লিশ বছরের জীবনে দীনবন্ধু মিত্রের সাহিত্যজীবনও মাত্র তের বছরের।
১৮৬০ সাল থেকে ১৮৭৩ এই তের বছর তাঁর জীবনের স্বর্ণসময়। এ সময় তিনি
একদিকে যেমন কর্মক্ষেত্রে ঈর্ষণীয় সাফল্য অর্জন করেন অন্যদিকে এসময়ই তাঁর
সাহিত্যপ্রতিভার বিকাশ ও পরিণতি। দীনবন্ধু মিত্র বাংলা সাহিত্যে একজন স্মরণীয়
নাট্যকার হিসেবে পরিচিত হলেও তাঁর সাহিত্যজীবন শুরু হয় কবিতা লেখার মধ্য
দিয়ে। হিন্দু কলেজে পড়াকালীন তিনি সে সময়ের শীর্ষ খ্যাতিসম্পন্ন কবি ও সম্পাদক
ঈশ্বরগুপ্তের সংস্পর্শে আসেন বাংলা সাহিত্যের আরেক দিক্‌পাল বঙ্কিমচন্দ্র
চট্টোপাধ্যায়ের মতো তিনিও হয়ে ওঠেন ঈশ্বরগুপ্তের ভাবশিষ্য। সে সময় ঈশ্বরগুপ্তের
‘সংবাদ প্রভাকর' ‘সাধুরঞ্জন' প্রভৃতি পত্রিকায় দীনবন্ধু শুরু করেন কবিতা লেখা।
এরপরেও তিনি বেশ কিছু কবিতা লিখেছেন, দুটো গল্পও লিখেছেন তবে নিজেকে
পুরোপুরি নিয়োগ করলেন নাটক লেখায়। ১৮৬০ সালে ঢাকা থেকে প্রকাশিত হলো
তাঁর সাহিত্যজীবনের শ্রেষ্ঠ এবং বাংলা সাহিত্যের অবিস্মরণীয় এক নাট্যশিল্প ‘নীল
দর্পণ'। এরপর মৃত্যুঅবধি তিনি লিখেছেন বেশ কিছু নাটক ও প্রহসন। এগুলো 'নীল
দর্পণ'-এর সমতুল্য না হলেও সময়ের কারণেই স্মরণীয়। যাই হোক এই তের বছরে
তিনি লিখেছেন চারটি নাটক, তিনটি প্রহসন, তিনটি কাব্যগ্রন্থ ও দুটি গল্প। এছাড়া
হিন্দু কলেজে পড়াকালীন (১৮৫০-১৮৫৫) লেখা সতেরটি কবিতার সংকলন 'নানা
কবিতা' গ্রন্থিত হয়। দীনবন্ধুর প্রকাশিত রচনাসমূহের নাম ও প্রকাশকালঃ

নাটক:

১.নীল-দর্পণ (১৮৬০)]
২. নবীন তপস্বিনী) (১৮৬৩)

৩. [ লীলাবতী (১৮৬৭))

৪.কমলে কামিনী (১৮৭৩)
প্রহসন ---

১. সধবার একাদশী (১৮৬৬)
২. বিয়ে পাগলা বুড়ো (১৮৬৬)

৩. জামাই বারিক) (১৮৭২)
কাব্যগ্রন্থ

১.সুরধুনী কাব্য ১ম ভাগ (১৮৭১)

২. দ্বাদশ কবিতা (১৮৭২)
৩. সুরধুনী কাব্য ২য় ভাগ (১৮৭৬)
গল্প
১. যমালয়ে জীবন্ত মানুষ (১৮৭২)

(পোড়া মহেশ্বর (১৮৭২)

প্রহসন

প্রহসনের ইংরেজি প্রতিশব্দ (Farce' শব্দটি ল্যাটিন Farcio) হতে এসেছে। এর
অর্থ হলো কোনো কিছু ঠেসে ভর্তি করা। মধ্যযুগ গির্জার প্রার্থনাসভার বক্তৃতায়
অতিরিক্ত ব্যাখ্যা ও বিষয় উপস্থাপনকে ফার্স বলা হতো। পরবর্তিতে শব্দটি স্থূল
কৌতুক ও হাস্যরসে ব্যবহার হয়। এভাবেই শব্দটি নাটকে আসে। বর্তমানে ফার্স বা
প্রহসন নাট্য-আঙ্গিকেরই আরেক রূপ হিসেবে পরিগণিত। তবে যে বিশাল বিস্তার,
ব্যক্তি-সমাজ-রাষ্ট্রের নানামুখি দ্বন্দ্ব ও সংঘর্ষ, জীবনের গভীর ও গম্ভীর মহিমাময় প্রাপ্তি
কিংবা পরাভব নাটকের কাহিনীকে সুতীক্ষ্ণ ও গতিময় করে তোলে, প্রহসনে তেমনটা
নয়। প্রহসনের আবেদন আনন্দে আর সে আনন্দ সিক্ত হয় হাস্যরসে। অর্থাৎ প্রহসনের
অন্যতম ধারক হলে কমেডি। তবে সে কমেডি বা হাস্যরসে থাকে সময় সমাজের নানা
অসঙ্গতি। স্বল্প আকারে সে অসঙ্গতিরই হাস্যরসময় নাটকীয় উপস্থাপন হলো প্রহসন।
শ্রীশচন্দ্র দাস মনে করেন, “সমাজের কুরীতি শোধনার্থে রহস্যজনক ঘটনাসম্বলিত
হাস্যরসপ্রধান একাঙ্কিকা নাটককে সংস্কৃত আলঙ্কারিকগণ 'প্রহসন' বলিতেন”
"সাহিত্যের রূপভেদ: রূপরীতি' গ্রন্থে Encyclopedia of Britanicaর উল্লেখ করে বলা
হয়েছে 'A faree is a form of comic comedy, stuffed with low humour and
extravagant wit । এ গ্রন্থে অধ্যাপক নিকলের একটি অন্যতম সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে।
আর তা ‘ফার্স হলো একটি সংক্ষিপ্ত হাস্যকর নাট্যরচনা যাতে অতিরঞ্জন, অবিশ্বাস ও
অসম্ভব ঘটনার সমাবেশ থাকবে কিন্তু চরিত্র বিশ্লেষণ এবং প্লট বা বৃত্তের সংহত বিন্যাস
থাকবে না। হৈ হুল্লোড়, ধস্তাধস্তি, চেঁচামেচির মধ্য দিয়ে অট্টহাস্যের এক জগৎ সৃষ্ট
হবে।' উপরিউক্ত গ্রন্থে গ্রহসনের যেসব বৈশিষ্ট্যসমূহ পাওয়া যায় সেগুলোর মধ্যে

অন্যতম হচ্ছে.....
স্থুলকুচির এবং নিম্নমানের আনন্দ পরিবেশন প্রহসনের বৈশিষ্ট্য।
হ্রাসাসৃষ্টিই প্রহসনের মূল লক্ষ্য এবং এই হাস্যসৃষ্টির উদ্দেশ্যেই সম্ভাব্য
অসম্ভাব্য ক্রিয়া ও অবস্থার কল্পনা করা হয় অঙ্গভঙ্গি, ভাঁড়ামি এই হাস্যসৃষ্টির মূল

হাতিয়ার।
৩ গ্রহসন বা ফার্মের সব চরিত্রই অতিরঞ্জিত।

৪.– গ্রহসনের লক্ষ্য হৈ হুল্লোড় ধস্তাধস্তি, চেঁচামেচি, ভাড়ামির দ্বারা এমন এক
জগৎ সৃষ্টি করা যা উদ্ভট এবং অবাস্তব।

৪ প্রহসনের ঘটনাকে কেন্দ্র চরিত্র সৃষ্টি হয়। কিন্তু ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে
কাহিনী বা বৃত্তের সংহত বিন্যাস থাকে না। ঘটনার ক্রমের পরিণতিও থাকে না ।

৬ প্রহসনে মনের গভীরে দাগ কাটার মতো বিষয়-বৈচিত্র্য নেই।
ও এহসনে জীবনের খণ্ডিত রূপ অতিরঞ্জিত ও উদ্ভট আকারে বিদ্যমান থাকে।

৮ প্রহসনের উদ্দেশ্য একটাই-সামাজিক ভণ্ডামিকে নগ্ন করা যাতে দর্শক
আত্মত্মসংশোধনের পথ খুঁজে পায়।
প্রহসন কমেডির মতো দীর্ঘ আয়তন নয়। সংস্কৃত প্রহসন এক অঙ্কের। কিন্তু

ইংরাজী ফার্স দুই বা তিন অঙ্কেরও হতে পারে।
১০, দেশ ও কালকে অতিক্রম করে না যাওয়াটাই প্রহসনের ধর্ম।

পাশ্চাত্য সাহিত্যে শেক্সপিয়র, মলিয়ের মতো বাংলা সাহিত্যেও অনেকে প্রহসন
লিখেছেন। আজ থেকে প্রায় দেড়শত বছর আগে বাংলা ভাষায় প্রহসন লেখা শুরু
করেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত। তাঁর 'একেই কি বলে সভ্যতা' ও 'বুড়ো শালিকের ঘাড়ে
রো' বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক ও অন্যতম দুটি প্রহসন। এরপরেই নাট্যকার
দীনবন্ধু মিত্র। তাঁর তিনটি প্রহসন মধুসূদনের সে পথকে আরো উজ্জ্বল করে তোলে।
পরবর্তিতে অমৃতলাল বসু, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
প্রমুখ লেখকরা বাংলা প্রহসনকে সমৃদ্ধ করেছেন।

দীনবন্ধু মিত্রের 'সধবার একাদশী' প্রহসনের প্রেক্ষাপট:

'সধবার একাদশী' প্রবন্ধটি প্রথম প্রকাশিত হয়। ১৮৬৬ সালে মাত্র চার বছরের
মাথায় ১৮৭০ সালে প্রহসনটির দ্বিতীয় সংস্করণ বের হয়। প্রহসনটি শ্যামবাজার
নাট্যসমাজ বা বাগবাজার অ্যামেচার থিয়েটারে ১৮৬৮
 সাল থেকে ১৮৬৯ সালের মধ্যে
চারবার এবং ন্যাশনাল থিয়েটারে ১৮৭২ সালের ২৮শে ডিসেম্বর একবার অভিনীত হয়।
সে সময় আধুনিকতার নামে সমাজে মদপান এতদূর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছিল যে,
প্যারীচরণ সরকারকে সুরাপান-নিবারণী সমাজ প্রতিষ্ঠিত করতে হয়েছিল। 'সধবার
একাদশী' প্রকাশ পাবার পর গ্রহসনটি তৎকালীন সমাজে এতটাই জনপ্রিয় হয়ে
উঠেছিল যে, প্যারীচরণ সরকার দীনবন্ধু মিত্রের সঙ্গে দেখা করে বলেছিলেন, আপনার
যে বহি বাহির হইয়াছে এখন আমাদের সোসাইটি উঠাইয়া দিলেও চলিতে পারে'
দীনবন্ধু মিত্রের বন্ধু ও সতীর্থ বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় দীনবন্ধু মিত্রকে এ প্রহসনটি
প্রকাশ করতে নিষেধ করেছিলেন। সে সময়ের সমাজবাস্তবতা ও প্রতিক্রিয়াশীলদের
কথা চিন্তা করেই হয়তো বঙ্কিমচন্দ্র এমন নিষেধ করেছিলেন। তবে দীনবন্ধু সে কথা না
মেনে গ্রহসনটি প্রকাশ করে শুধু সে কালের কলকাতাকেন্দ্রিক বঙ্গীয় সমাজে মদপানের
কারণে অধঃপতনের দিকটিই তুলে ধরেননি, বাংলা সাহিত্যের একটি অন্যতম
প্রহসনশিল্পও উপহার দিয়েছেন।

'সধবার একাদশী' এই নামকরণটিও এ প্রহসনের একটি তাৎপর্য অংশ। সধবা
বলতে আমরা বুঝি যেসব নারীর স্বামী বেঁচে আছে। অন্যদিকে একাদশী শব্দের অর্থ
(একাদশতম অর্থাৎ এই একাদশী বলতে চাঁদের একাদশতম দিন বোঝায়। এ দিন
ভারতীয় পুরাণমতে অন্ততপক্ষে পঞ্চরবিশষ্য (ধান, গম, যব, ডাল, তেল জাতীয়)
আহার হিসেবে গ্রহণ নিষিদ্ধ। এমনকি এদিন নিরাহার কিংবা অনাহারের কথা বলা হয়ে
থাকে। কারণ হিসেবে জৈবিক তাড়না ও পাপ থেকে দূরে থাকার জন্য এমন
বিধিব্যবস্থা। কিন্তু সে সময় বিবাহিত অনেক পুরুষই মদ ও পতিতার আশ্রয়ে দিনের
পর দিন রাতের পর রাত বাড়ির বাইরে অবস্থান করতেন। এ কারণে তাদের বিবাহিত
স্ত্রীরা স্বামীসঙ্গের অভাবে একাকী জীবন যাপন করতে বাধ্য থাকতেন। তাদের এমন
অবস্থাকেই একাদশী বা উপবাসীর সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। মূলত স্বামী বেঁচে থাকার
পরেও সে স্বামীর সঙ্গ না পাওয়া স্ত্রীর দুঃখকে তীব্রভাবে উপলব্ধি করার জন্যই নাট্যকার
এ প্রহসনটির নাম দেন 'সধবার একাদশী'। এ প্রহসনটি রচনার প্রেক্ষাপট সম্পর্কে
দীনবন্ধুর পুত্র ললিতচন্দ্র মিত্রের বর্ণনাটি অনুধাবনযোগ্য। তিনি বলেন,

যেমন দেশের নিরক্ষর প্রজামণ্ডলীর দুঃখে কাতর হইয়া, সেই দুঃখ বিমোচনের জন্য
পিতৃসের নীলদর্পণ রচনা করিয়াছিলেন, সেইরূপ দেশের তদানীন্তন শিক্ষিত ভদ্রমণ্ডলীর দুঃখে
কাতর হইয়া 'সধবার একাদশী' রচনা করেন। শিক্ষিত সমাজ যখন ইংরাজী শিক্ষার বাহ্য
চাকচিক্যে বিকৃতমস্তিষ্ক হইয়াছিল, আমার পিতৃদেব সেই সময়ে হিন্দু কলেজের ছাত্র ছিলেন।
দুইটি জলীয় পদার্থবিশেষকে একত্র মিশ্রিত করিলে যেমন ফেনপুঞ্জর আবির্ভাব হয়, শিক্ষিত
সমাজের তখন সেই অবস্থা ছিল। কলেজের ছাত্রগণ অনেকেই তখন স্থির, শান্ত, স্বাভাবিক ভাব
পরিত্যাগ করিয়া, উচ্ছৃঙ্খলতার তাণ্ডব নৃত্যে মগ্ন হইয়াছিল।.. মিদিরা-রাক্ষসীব্র প্রভাব শিক্ষিত
যুবকবৃন্দের উপর অপ্রতিহত আধিপতা করিতেছিল। মদ না খাওয়া যেন শিক্ষার অভাব বলিয়া
পারিপার্শিত হইত। দেশ হিতৈষী বাশ্মীপ্রবর রামগোপাল ঘোষ মহাশরের এক
সুশিক্ষিত হইয়া কলেজ হইতে বাহির হয়েন। তিনি মদ্যপান করিতেন না শুনিয়াছি, যেখ
মহাশয় তাঁহাকে বলিতেই মদ খেতে শিখিল না, তাতে আমি সমাজে বারে করিব কি
করিয়া?” সিঁহারই যেন প্রতিধ্বনি করিয়া নিমচাঁদ বলিয়াছে, বেটা কলেজের নাম ডোবাইল,
শিক্ষিত সমাজের এই শোচনীয় অবস্থা দেখিয়া সহৃদয় ব্যক্তিমাত্রই
হইয়াছিলেন। ...তদানীন্তন সমাজের দুর্দশা দেখিয়া পিতৃদেবর হৃদয় ব্যকুল হইয়াছিল। বৰ্তমান
অবস্থার উন্নতির জন্য এবং ভবিষ্যৎ অমঙ্গল নিবারণের জন্য তিনি সাহিত্যের আশ্রয় লইলেন।
এই অধঃপতনের নিখুঁত চিত্র সমাজের সমীপে উপস্থিত করিলে কল্যাণ হইবে এই আশায়
আবার লেখনী ধরিলেন। শরীরে গলিত গময় ক্ষতস্থান দেখিলে লোকে যেমন শিহরিয়া উঠ
এবং তাহার প্রতিকারের জন্য চেষ্টা করে, সমীরে ক্ষতস্থান দেখাইয়া তাহাকে সচেতন
করিবার জন্য তাই দীনবন্ধু শিক্ষিতলীর করে দ্বিতীয় দর্পণ অর্পণ করিলেন। সেই দর্শন
সধবার একাদশী।

সংবার একাদশী' প্রহসনের কাহিনি-বিন্যাস:

'সধবার একাদশী' প্রহসনটি তিনটি অঙ্কে মোট নয়টি গর্ভান্তে বিন্যস্ত।

প্রথম অঙ্কের প্রথম গর্ভাঙ্ক:

‘সধবার একাদশী' প্রহসনের প্রথম অঙ্কের প্রথম গর্ভাঙ্কটি শুরু হয়েছে এ প্রহসনে
উকিল হিসেবে পরিচিত নকুলেশ্বরের উদ্যানের বৈঠকখানায় স্থান হিসেবে নির্দেশ করা
হয়েছে কাঁকুড়গাছা। নকুলেশ্বর ও নিমচাঁদের কথোপকথনে এ প্রহসনের শুরু। সেখানে
দুজনেই মদপান করেছেন এবং তারা সুরাপান-নিবারণী সভা নিয়ে কথা বলছেন।
নিমচাঁদের মতে যারা এই সভায় যোগ দিয়েছেন তাদের মদ ছাড়া আর না ছাড়া সমান।
কারণ তারা দীর্ঘদিন ধরে মদ পান করে তারপর বিভিন্ন অসুখে জর্জরিত হয়ে মদ
ছেড়েছেন। কিন্তু নকুলেশ্বর বলেন যে, যেহেতু মদ পান করে তাদের এমন সব অসুখ
হয়েছে তাই ‘মদ অতি ভয়ঙ্কর শুরুফা মদের পক্ষে-বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে চলতে থাকা
দুজনের সংলাপের মাঝে আসেন অটলবিহারী অটলকে নিম মদ খাওয়ার জন্য
আহবান করেন কিন্তু অটল প্রথমে তার বাবার কথা বলে মদ পানে অনীহা জানান।
কিছুক্ষণ পর নিম ও নকুলেশ্বরের অনুরোধে অটলও মদ (অ্যামাপন) পান করেন। এই
তিন জন যখন মদপানরত তখন সেখানে হাজির হন রূপোপজীবিনী
কানের
সঙ্গে তাদের কথাবার্তায় জানা যায় গতকাল অটল কাঞ্চনের বাসায় গিয়েছিলেন।
নিমের অনুরোধে অটল এবার ব্রান্ডি পান করে এবং
 কিছুটা বেসামাল হয়ে পড়ে।
প্রথম অঙ্কের দ্বিতীয় গর্ত

এ গর্তটি বর্ণিত হয়েছে চিতপুর রোডে। গোকুল नার বৈঠকখানায়।
বৈঠকখানায় গোকুলবাবু ও অটলের বাবা (জীবনচন্দ্রের কথোপকথন হয়। সেখানে
জীবনচন্দ্রের কথায় তার ছেলে অটলের অঢেল অর্থ অপচয়ের বিষয়টি প্রকাশ পায়। এ
কারণে জীবনচন্দ্রের জীবনে যে হতাশা ও বিরক্তির সৃষ্টি হয়েছে সেটিও আমরা বুঝতে
পারি। গোকুলচন্দ্র অটুলের এ অধঃপতনের কারণ হিসেবে কাপানের সংস্পর্শকে দায়ী
করেন। জীবনচন্দ্ৰ গোকুলকে অনুরোধ করেন তার হৌসে (ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান) অটলকে
কাজ শেখাতে এবং প্রতি রাতে অটলকে লেখাপড়া করাতে অটল সেখানে প্রবেশ
করলে জীবনচন্দ্র অটলকে সে কথা জানান। অটল তার পিতার প্রস্তাব অস্বীকার করেন।
গোকুলচন্দ্র ও জীবনচন্দ্রের সঙ্গে অটলের উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় হয়)

দ্বিতীয় অঙ্কের প্রথম গর্ভাঙ্ক:

এ গর্ভাঙ্কটি বর্ণিত হয়েছে কাঁশারিপাড়ায় কুমুদিনীর শয়নকক্ষে। সেখানে কুমুদিনী
ও তার ননদ সৌদামিনীর কথোপকথনে প্রকাশ পেয়েছে স্বামী অটলের সাহচর্য ছাড়া স্ত্রী
কুমুদিনীর মনোবেদনার কথা যেখানে সৌদামিনীর স্বামী এক শনিবার না এলে
সৌদামিনীর (মনটি কেমন হয় চক যে ছল ছল কত্তে থাকে। সেখানে দশ দিন হলো
কুমুদিনী বাবার বাড়ি থেকে স্বামীর বাড়ি এসেছেন অথচ স্বামী অটলের কোনো দেখাই
কুমুদিনী পান নি। কুমুদিনীর সঙ্গে আলাপকালে সৌদামিনী তার ভাইয়ের নানান
কুকীর্তির কথা জানান। কাঞ্চনকে বাসায় এনে অটলের যে অস্বাভাবিক আচরণ সে
সম্পর্কে সৌদামিনী কুমুদিনীকে অবহিত করেন। পাশের বাড়ির বড় কাকা এর প্রতিবাদ
করলে কাঞ্চন রাগ করে বাড়ি থেকে বের হয়ে যান। অটল তখন মাকে আত্মহত্যার ভয়
দেখালে অটলের মা নিজে কাঞ্চনকে অনুরোধ করে ফেরান এবং বলেন মা, তোমার
হাতে ছেলে সুপে দিলেম, দেখ বাছা, যেন আমি গোপালহারা হই নৌ।

দ্বিতীয় অঙ্কের দ্বিতীয় গর্ভা

এ পর্ভাঙ্কের শুরুতে দেখা যায় কাঁশারিপাড়ার অটলবিহারীর বৈঠকখানায়
অটলবিহারী ও কাঞ্চনের কথোপকথন। নিমে দত্তকে সঙ্গে করে কাঞ্চনের বাসায়
যাওয়ার জন্য কাঞ্চন অটলকে অভিযুক্ত করেন। সেখানে কাঞ্চনের প্রস্থানের সময়
কাধানের প্রতি অটলের সমাদর বেশ লক্ষণীয়। এরপর সেখানে একে একে প্রবেশ
করেন অটলের বন্ধু নিমচাঁদ, ভোলা চাঁদ, রামমাণিক্য, ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট কেনারাম ও
আদানি। আরদালি বাদে বাকি সবাই মদ পান করেন এবং নানা বিষয়ে
হাস্যরসে মেতে ওঠেন। সেখানে দেখা যায় থেক্তেশ্বরের জামাই ভোলা। ভোলার স্ত্রী নয়।
মাসের গর্ভবর্তী । রামমাণিক্যেরও মেয়েমানুষ' আছে, তার নাম ভাগ্যধরী। রামমাণিক্য
নেশার ঘোরে নিচে পড়ে যান। ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট কেনারাম ও নিমের মধ্যে বেশ
হাস্যরসের আলাপ জমে ওঠে। সেখানে নিজেরই ভুলের কারণে কেনারাম কীভাবে
ঘটিরাম নামে পরিচিতি পান সে বিষয়টি প্রকাশ পায়। গোকুল বাবুর বাড়িতে যাওয়ার
কথা বলে অবশেষে তাদের সে আলাপচারিতা শেষ হয়।

দ্বিতীয় অঙ্কের তৃতীয় গর্ভাঙ্ক:

এ গর্ভাঙ্কে শুরুতে দেখা যায় গোকুল বাবুর বাড়ির সামনে চিতপুর রোডে নেশাসক্ত
নিমচাঁদকে বাড়ি যাওয়ার কথা বলে গোকুল বাবুর বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করেন অটল.…..….
কেনারাম ও দ্রামা। নিম গোকুল বাবুর বাড়িতে প্রবেশ করতে চাইলে গোকুল বাবুর
নির্দেশে দারোয়ানরা নিমকে রাস্তায় চিত করে ফেলে রেখে যায়। নেশাগ্রস্ত অবস্থায় রাস্তায়
পড়ে থাকতে দেখে একজন দাসী নিমকে চিনতে পারেন। কিন্তু নিম সেই দাসীকে
অন্যের রক্ষিতা মনে করে কথা বললে সেই দাসী নিমকে সেখানে রেখেই চলে যান।
এরপর সেখানে নিমের সাক্ষাৎ পান দুজন বারবিলাসিনী। তারাও চলে গেলে সেখানে
আসেন জীবনচন্দ্র ও একজন বৈদিক। তারা গোকুল বাবুর বাড়িতে যাচ্ছিলেন। পথে
তারা দেখতে পান নেশাগ্রস্ত নিমকে। জীবনচন্দ্র নিমকে দেখতে পেয়ে তাকে বেশ
তিরস্কার করেন। এরপর সেখানে আসেন সার্জন ও দুইজন পাহারাওয়ালা। সার্জন ও
পাহারাওয়ালারা নিমকে ধরে নিয়ে যান।

দ্বিতীয় অঙ্কের চতুর্থ গৰ্ভাঙ্ক:

চিতপুর রোড গোকুলবাবুর বৈঠকখানায় বসে আসেন জীবনচন্দ্র, গোকুলবাবু,
বৈদিক। জীবনচন্দ্র তার ছেলে অটলের জন্য খুবই উদ্বিগ্ন। জীবন আশঙ্কা করেন, যে
ছেলে মদ না খেলে আহার করতে পারে না সেই ছেলে মদ ছাড়লে অসুস্থ হয়ে পড়বে
কি-না! কিন্তু গোকুলবাবু অভয় দেন যে, মদ ছাড়লে অসুখ হয় না। কিছুক্ষণ পরে
সেখানে প্রবেশ করেন অটলবাবু ও কেনারাম। জীবনচন্দ্র পুত্র অটলকে মদ খাওয়ার
জন্য আবারো তিরস্কার করেন এবং মদ ছাড়ার জন্য অনুরোধ করেন। কিন্তু অটল
বলেন যে, মদে আমার সংস্কার হয়েছে, এখন মদ ত্যাগ কল্যেই আমার যক্ষ্মাকাশ
হবে, আঠারো দিনের মধ্যে মরে যাব, তোমার আর নাই, আঁটকুড়ো হয়ে থাকবে।
বৈদিক পরামর্শ দেন যে, পরিবারের সব সদস্যকে নিয়ে কাশী থেকে ঘুরে আসতে।
তাতে অটলের কিছু পরিবর্তন হতে পারে। অটল তখন কাঞ্চনকেও সঙ্গে নিতে চাইলে
সকলে আবারো হতাশ হয়ে পড়ে ।
তৃতীয় অঙ্কের প্রথম গর্ভ

কাঁকুড়াগাছায় নকুলেশ্বরের বৈঠকখানায় জগদ্বিখ্যাত ক্লিওপ্যাটরার ছবির সামনে
দাঁড়িয়ে নেশাগ্রস্ত নিম প্রার্থনা জানাচ্ছেন। ক্লিওপ্যাটরাকে দেবী মনে করে তাঁর বর
প্রার্থনা করেন। এখানে নিমের প্রার্থনার ভঙ্গিটি দেখলেই বোঝা যায় তিনি স্বাভাবিক
নেই। তাঁর একজন স্ত্রী আছে তবু তিনি আরেক স্ত্রীর বর প্রার্থনা করেন। তবে সে স্ত্রী
হিসেবে তিনি কল্পনা করেন 'বোতলসুন্দরী' অর্থাৎ মদের বোতলকে বোঝা যায় তিনি
প্রকৃতস্থ অবস্থায় নেই। নিমের অপ্রকৃতস্থতা আরো বেশি প্রকট হয় যখন দেখা যায় যে,
রামমাণিক্য এসে সে বোতলে চুমুক দিলে নিম বলে ওঠেন, ' এই বাঙ্গাল ব্যাটা আমার
বিবাহিতা স্ত্রীর ধর্ম্ম নষ্ট করেছে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট কেনারাম সেখানে প্রবেশ করে সে
বিচার নিম কেনারামের ওপর দেন কেনারাম সেখানে বিচারের নামে এক হাস্যরসের
অবতারণা করেন। সে মুহূর্তে কাঞ্চন প্রবেশ করেন। কাঞ্চনের কথায় প্রকাশ পায় যে,
ম্যাজিস্ট্রেট কেনারাম আরদালিকে সঙ্গে নিয়ে সেখানে থাকার জন্য কাঞ্চনের বাসায়
গিয়েছিলেন এবং কাঞ্চনের দাসী ইচ্ছের কাছে বেশ হাস্যকরভাবে অপমানিত হয়ে
ফিরে আসেন।

তৃতীয় অঙ্কের দ্বিতীয় গর্ভাঙ্ক:

কাঁসারিপাড়ায় অটলের বৈঠকখানায় কাঞ্চন ও অটলের কথোপকথন চলছে। অটল
কাঞ্চনের কাছে অভিযোগ করেন যে, কাঞ্চন কেন নকুলবাবুর বাগানে গিয়েছিলেন। সে
অভিযোগের সঙ্গে সঙ্গে কাঞ্চনের মতো মেয়েমানুষ' রাখতে পারার জন্য একধরনের
অহংকারও প্রকাশ পায় অটলের মধ্যে। নিম সে সময় সে বৈঠকখানায় প্রবেশ করে
অটলের সে অভিযোগের সূত্র ধরে কিছুটা অটলের প্রতি ব্যঙ্গাত্মক হাস্যরসের সৃষ্টি
করেন। খেতে বসে কাঞ্চন কারো মুখে পায়েস ধরেছিলেন নিমের মুখে এমন সংবাদ
পেয়ে অটল জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যান। সে সময় অটলের মুখ দিয়ে রক্তও পড়ছিল।
কাঞ্চন অটলের মাকে ডাকার জন্য বাড়ির ভেতরে গেলে নিম অটলের শরীরে মদ ঢেলে
দেন এবং অটল চেতনা ফিরে পান। অটল নকুলেশ্বরের প্রতি প্রতিশোধ নিতে চান কিন্তু
নিম চান গোকুলের ওপর প্রতিশোধ নিতে। শেষ পর্যন্ত অটলও রাজী হলেন গোকুল
বাবুকে জব্দ করার জন্য। তাদের দুই বন্ধুর এই সিদ্ধান্ত হয় যে, নিম গোকুলের স্ত্রীকে
কৌশলে ডেকে নিয়ে আসবেন অটলের বৈঠকখানায়। তারা এর জন্য দিন ঠিক করেন
আগামিকাল। কারণ কাল অটলদের বাড়িতে মেয়েদের কিবিগান হবে। সেই কবিগান
শুনতে আসবেন গোকুলের স্ত্রী।
তৃতীয় অঙ্কের তৃতীয় গর্ভাঙ্ক:

এ গর্ভাঙ্কটি 'সধবার একাদশী প্রহসনের শেষ অঙ্কের শেষ গর্ভাঙ্ক। এখানে বর্ণনা
করা হয়েছে কাঁশারিপাড়ার অটলবিহারীর বৈঠকখানার দৃশ্য। সেখানে দেখা যাচ্ছে,
অটলবিহারী মোগলের বেশে আছেন এবং সঙ্গে আছেন একজন হিজড়া। অটল
হিজড়াকে বলে দেন যে, যিনি নীলাম্বরী শাড়ি ও চেন পরে আছেন তাকে নিয়ে আসতে
হবে। এর জন্য অটল হিজড়াকে মূল্যবান উপহার বখশিসও দেবার প্রলোভন দেখান।
এ মুহূর্তে প্রবেশ করেন নিমচঁাদ। অটল নিমের সঙ্গে পরিকল্পনা করেন গোকুলবাবুর স্ত্রী
এলে তাকে নিয়ে যাবেন সাতপুকুরের বাগানে। সেখানে নিমেরও যাওয়ার ব্যবস্থা তিনি
করবেন। এমন সময় সেই হিজড়া একজন মুখাবৃতা নারীকে বুকে ধরে নিয়ে আসেন
এবং বৈঠকখানার খাটে বসিয়ে দেন মুখাবৃতা নারী দেখতে পান তার সামনে যিনি
আছেন নিম তাকে গোকুলবাবু বলে সম্বোধন করছেন। অটল সেই নারীর মুখের রুমাল
সরিয়ে দেখতে পান সেই নারী আর কেউ নয়, তারই স্ত্রী কুমুদিনী। এরপর সে
বৈঠকখানায় প্রবেশ করেন অটলের বড় কাকা রামধন রায়। রামধন রায় অটলকে জুতো
দিয়ে আঘাত করেন। অটল তখন সব দোষ দেন নিমের। কিছুক্ষণ পরে রামধন
নিমচাদের গলা টিপে ধরে প্রবেশ করেন এবং প্রহার করেন। এরপর দুই বন্ধু একে
অপরকে দোষ দিতে থাকেন। নিম অটলকে বলেন, 'তোকে বারম্বার বলিচি, রাত্রে
কখন বাইরে থাকিস্ নে, আপনার ঘরে গিয়ে শুস্' অটল তখন কাঞ্চনের কথা বললে
নিম বলেন, কাঞ্চনের সতীত্ব যেন চৌকি দিয়ে রক্ষা কল্যে, তোমার মেগের সতীত্ব
বুঝি বাবার উপর বরাৎ?” কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই তাদের এই অনুতাপ উপহাসে রূপ
নেয়। তারা দুজনেই মনের বেদনা দূর করবার জন্য আবার মদ পান করেন। নিম বলে
ওঠেন,

কি বোল বলিলে বাবা বলো আর বার
মৃত দেহে হলো মম জীবন সঞ্চার ।

মাতালের মান তুমি, গণিকার গতি,

সধবার একাদশী, তুমি যার পতি।

‘সধবার একাদশী' প্রহসনের চরিত্র পরিচিতি:

‘সধবার একাদশী' প্রহসনের কেন্দ্রীয় চরিত্র অটলবিহারী। তিনি জীবনচন্দ্রের পুত্র ।
জীবনচন্দ্র তৎকালীন কলকাতা শহরে অর্থ-বিত্তে বেশ প্রভাবশালী ব্যক্তি| অটলবিহারী
তার একমাত্র পুত্র সন্তান। পিতার ঐশ্বর্যে উচ্ছন্নে যাওয়া এ সন্তান মাদকাসক্ত,
রূপোপজীবিনীর প্রতি আসক্ত, অলস, অমিতব্যয়ী এবং মূল্যবোধহীন। অটলকে কেন্দ্র
করেই বসেছে এ প্রহসনে মদের আসর। সে আসরে বন্ধু নিমচাদের মতো যারা আসেন

তারা সকলেই অটলের অর্থেই আপ্যায়িত হন। এ প্রহসনের শুরুতে আমরা অটলকে
এক ব্যক্তিত্বহীন পুরুষ হিসেবে দেখতে পাই। নিমচাদ অটলকে মদপানের জন্য
আহবান করলে প্রথমে অটল তার বাবার কথা বলে তা পান করতে অস্বীকৃতি জানান।
কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই তার সে অস্বীকৃতি অসত্যে পরিণত হয়। নিমর্চাদের সঙ্গে বসে
তিনি মদপান শুরু করেন। রূপোপজীবিনী কাঞ্চনের প্রতি তার যতটা আগ্রহ ঠিক
ততটাই অবহেলা তার স্ত্রীর প্রতি কাঞ্চনকে প্রতি মাসে তিনশত টাকা দেন তিনি।
অথচ তার স্ত্রী কুমুদিনী দশ দিন হলো বাবার বাড়ি থেকে এসেছেন, সেই স্ত্রীর সঙ্গে
তিনি দেখা করার সময় পর্যন্ত পান নি। তদুপরি, কাঞ্চনকে নিজের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে
সবার সামনে যে অশালীন আচরণ তিনি করেছেন তাতে তার চরিত্রহীনতারই পরিচয়
প্রকাশ পায়। পিতা জীবনচন্দ্র কিংবা পিতৃতুল্য গোকুলের সামনে কাঞ্চনের কথা বলতে
কিংবা কাশীতে বাবা-মা-স্ত্রী সবার সঙ্গে কাঞ্চনকেও নিয়ে যাওয়ার কথা বলতে তার
দ্বিধা হয়নি। গোকুলের ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানে বসে কাজ শেখার মতো কষ্টসাধ্য কাজ অটল
করতে পারেন না। কিন্তু কাঞ্চন অন্য কারো মুখে পায়েস তুলে ধরেছেন এ কথা শোনার
সঙ্গে সঙ্গে অটল মূর্ছিত হয়ে পড়েন। এমনকি যে গোকুলবাবু অটলের সুস্থ ও স্বাভাবিক
জীবনের কামনার জন্যই অটলকে তিরস্কার করেছেন এবং কাঞ্চন যে এর জন্য
অনেকটা দায়ী এ সত্য প্রকাশ করেছেন, সেই কারণে গোকুল বাবুর স্ত্রীকে কূটকৌশলে
মিথ্যা কথা বলে হিজড়াকে দিয়ে ধরে আনতে অটলের মূল্যবোধে এতটুকু বাধে নি।
গোকুলের স্ত্রী সম্পর্কে অটলের শাশুড়ি হন এটি জেনেও অটল তাকে ধরে বাগান
বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করেন। অর্থাৎ মনুষ্যত্বের সর্বসীমা অতিক্রম করেছেন
অটল। তবে, অটল এ প্রহসনের অন্যতম প্রধান চরিত্র হলেও অটলের চালিকাশক্তি
নিমচাদই এ প্রহসনের সবচেয়ে জীবন্ত ও সক্রিয় চরিত্র। এ প্রহসনে নিমচাঁদের
সবচেয়ে বড় পরিচয় তিনি মাতাল। সেই সঙ্গে নিমচঁাদ অত্যন্ত বুদ্ধিমান, কৌশলী।
নিমচাঁদ তার বন্ধু অটলকে ভালোভাবেই জানেন এবং সেই কারণে অটলকে সঙ্গে
নিয়েই মদ পান করেন আর সেই মদের অর্থ অটলের নিকট থেকেই আদায় করেন।
নিমর্চাদের ইংরেজি ভাষা-সাহিত্য সম্পর্কে অঢেল জ্ঞান। এ কারণে তিনি মাঝে মাঝে
শেক্সপিয়র, বায়রন প্রমুখের প্রবাদ-প্রতীম উক্তি তুলে ধরেন। অটলের সব ধরনের
কুকর্মের সঙ্গী ও সারথি নিমর্টাদ। নকুলেশ্বরের বাগানে কাঞ্চন গিয়েছিলেন বলে অটল
নকুলেশ্বরকে জঙ্গ করতে চান। অন্যদিকে গোকুলবাবু নেশাগ্রস্ত নিমচাদকে বাড়িতে
ঢুকতে না দিয়ে দারোয়ান দিয়ে দূর করে দেওয়ার আদেশ দেন। সেই অপমানের
প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য নিমচঁাদ অটলকে নকুলেশ্বর নয় গোকুলের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে
তোলেন। প্রতিহিংসা পরায়ণ হয়েই নিমচঁাদ এ কাজ করেছেন এবং গোকুলের স্ত্রীকে
অপহরণ করার জন্য অটলকে উদ্বুদ্ধ করেন। তবে নিমর্টাদ অটলের অতটা চরিত্রহীন
নন। কাঞ্চনের সঙ্গে তাকে আলাপ করতে দেখা গেছে কিন্তু আনন্দ উপভোগের কোনো
চিত্র পাওয়া যায় নি। কাঞ্চনকে অটল মাসোয়ারা দিয়ে রেখেছেন বলে সেকালের রীতি
অনুযায়ী নিমচাঁদ কানকে ‘মাসী' বলেই সম্বোধন করেছেন। গোকুলের স্ত্রীকে কৌশলে
অপহরণের বুদ্ধি তিনিই দিয়েছিলেন কিন্তু তিনি নিজে সে কাজ করেন নি। অটল হঠাৎ
অসুস্থ হয়ে পড়লেও তিনি অটলের বাড়ির ভেতর প্রবেশ করেন নি। বরং অটলের
শরীরে মদ ছিটিয়ে দিয়ে তার জ্ঞান ফিরিয়েছেন। নিমচঁাদের স্ত্রী আছে। বন্ধু অটলের
মতো অন্য নারীতে আসক্ত হন নি নিমচঁাদ। বরং একজন মাতালের মতোই তিনি
বোতলসুন্দরী (মদের বোতল)কে নিজের দ্বিতীয় স্ত্রী মনে করে হাস্যরসের জন্ম
দিয়েছেন। এমনকি গ্রহসনের শেষ প্রান্তে অন্তত প্রতি রাতে ঘরে না ফেরার জন্য তিনি
অটলকে তিরস্কার করেন। জীবনচন্দ্র ও গোকুলচন্দ্র চরিত্রদুটি এ প্রহসনে সে কালের
মূল্যবোধসম্পন্ন, সুস্থ ও ঐতিহ্যসচেতন মধ্যবয়সী মানুষের প্রতিনিধি। তারা দুজনেই
অটলকে সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার সব ধরনের চেষ্টাই করেছেন। কিন্তু
কোনো কাজ হয় নি। কেনারাম ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। তিনি ব্রাহ্ম সমাজের সম্পাদক।
তবে তারও কাঞ্চনের সঙ্গ পাবার অভিপ্রায় ছিলো এবং তিনি মদ পান করেন না মানুষ
খারাপ বলবে বলে। এছাড়া ঢাকার রামমাণিক্য, নকুলেশ্বর, ভোলা প্রমুখ চরিত্র
অনেকটা টাইপ। তারা সকলেই মদপানে অভ্যস্ত এবং তারা নিয়মিতই সে কাজ
করেন। এ প্রহসনের হাস্যরস সৃজনে তাদের যথেষ্ট ভূমিকা রয়েছে। নারীচরিত্রগুলোর
মধ্যে কাঞ্চন নিমচাঁদের মতোই জীবন্ত ও সক্রিয়। কাঞ্চন তার শারীরিক সৌন্দর্যকে
পুঁজি করে জীবন নির্বাহ করেন। অটলের নিকট থেকে তিনি তিনশত টাকা মাসোয়ারা
নেন। কাঞ্চন অটলকে এতটাই প্রভাবিত করেছেন যে, অটল কাঞ্চনকে দশহাজার টাকা
দিয়ে গহনা বানিয়ে দিয়েছে। তবে কাঞ্চন শুধু অটলের নন, সবার। তিনি নকুলেশ্বরের
বাগান বাড়িতেও যান আবার তার বাড়িতে কেনারামের মতো ম্যাজিস্ট্রেটও আসেন।
এমনকি মদের আসরে তার উপস্থিতি বেশ সরব। গোকুলবাবু অটলের অধঃপতনের
জন্য এই কাঞ্চনকেই দায়ী করেন। তবে অটলের এই অধঃপতনের জন্য অটলের মা
কম দায়ী নন। অটলের মা অন্ধমাতৃস্নেহের বশে পুত্র অটলকে অধঃপতনের দিকে ঠেলে
দিয়েছেন। অটল আত্মহত্যা করতে চাইলে অটলের মা কাঞ্চনকে অনুরোধ করেছেন
অটলের কাছে থাকবার জন্য। পুত্রের দায়িত্ব তিনি পুত্রবধূর হাতে না দিয়ে দিয়েছেন
কাঞ্চনের মতো এক রূপোপজীবিনীর হাতে। অটলের স্ত্রী কুমুদিনীই এ প্রহসনে
সবচেয়ে বঞ্চিত ও অপমানিত চরিত্র। মূলত তার জীবনকে লক্ষ করেই এ প্রহসনের
নামকরণ করা হয়েছে। কুমুদিনীর স্বামী অটল যুবক এবং শ্বশুর আর্থিকভাবে
সামর্থবান। অথচ তিনি বিবাহিত জীবনে স্বামীসুখ থেকে বঞ্চিত । তিনি অপমানিতও হন
যখন দেখেন তার মাদকাসক্তস্বামী অন্যের স্ত্রী মনে করে তাকেই অপহরণ করেন অথবা
তিনি যখন শোনেন তার স্বামী তার অনুপস্থিতিতে গরে আনেন এক বারাঙ্গনাকে। এ
শুধু কুমুদিনীর জন্যই নয়, সব মানুষের জন্যই অপমানকর। মূলত কুমুদিনীর প্রতি
অটলের অপমান আর অবহেলা এ প্রহসনের প্রকৃত নাট্যতরঙ্গ হলেও তার নাট্যধারা
অটলের মাত্রাতিরিক্ত মদ্যপানেই প্রবাহিত।

'সধবার একাদশী'র সমাজ-বাস্তবতা:

আঠারো শতকের শেষ এবং উনিশ শতকের শুরুতে ভারতবর্ষে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য
বেশ শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে যায়। বাণিজ্যিক পরিচয়ের পাশাপাশি তারা এদেশে
তাদের প্রশাসনিক পরিচয়টাকে বড় করে তোলে। এক কথায় ভারতবর্ষের প্রশাসনের
সর্বময় চালিকাশক্তি এবং শাসক হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করে। ফলে অর্থনৈতিক ও
রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তাদের প্রভাব একচ্ছত্র হয়ে ওঠে। এর ঢেউ এদেশের
সামাজিকজীবনে অনিবার্যভাবেই এসে পড়ে। বস্তুত দীর্ঘকাল ধরে চলে আসা এদেশের
সমাজ-জীবনে অশিক্ষা, কুসংস্কার, ধর্মের নামে শোষণ প্রভৃতি বিষয়গুলো এদেশের
মানুষের জীবনে নিয়তির মতোই অবধারিত ছিলো। সেখানে মানুষের সমাজ-জীবনে
নানা ধরনের শ্রেণিবিভেদ যা শ্রেণিশোষণে রূপ নেয়। সাম্প্রদায়িক চেতনা, সতীদাহ,
বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ প্রভৃতি কুপ্রথাগুলো সে শোষণের এক একটি রূপ। ১৮০০ সালে
কলকাতায় ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠিত হলে এদেশে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার
নবপর্যায় শুরু হয়। উইলিয়াম কেরির নেতৃত্বে সেখানে মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার, রামরাম
বসু গোলোকনাথ শৰ্মা প্রমুখ পণ্ডিত এদেশে বিশেষত বাংলা ভাষা ও সাহিত্যশিক্ষার
এক নতুন দ্বার উন্মোচন করেন। এরই সঙ্গে ব্রিটিশদের সঙ্গে এদেশের মানুষের
সরাসরি সংযোগ স্থাপনের একটি মেলবন্ধনও ঘটে এ কলেজকে কেন্দ্র করে। ফলে
ইউরোপীয় আচার-সংস্কৃতি-সাহিত্য-দর্শন-বিজ্ঞান প্রভৃতির সঙ্গেও সরাসরি পরিচিত
হতে থাকে এদেশের মানুষ। এরই মাঝে ১৮১৪ সালে রামমোহন রায় কলকাতায়
আসেন স্থায়ীভাবে বসবাস করার জন্য। পরের বছর ১৮১৫ সালে তিনি কলকাতায়
(আহার সভা নামে একটি সভা স্থাপন করেন। সে সভায় ভারতীয় বেদান্তদর্শনের
ব্যাখ্যা ও বিচারবিষয়ক নানা আলোচনা শুরু হয়। রামমোহন রায় অবশ্য কলকাতায়
আসার আগে থেকেই এ ধরনের আলোচনা করে আসছিলেন। কলকাতার বিদ্বদসমাজে
তা সভায় রূপ নেয়। এ সভা থেকেই তিনি প্রচলিত ধর্ম ও সমাজ সংস্কারে প্রবৃত্ত হন।
১৮৯৭ সালের ২০শে জানুয়ারি তাঁরই অন্যতম প্রচেষ্টায় প্রতিষ্ঠিত হলো হিন্দু কলেজ।
এই কলেজই হয়ে ওঠে তৎকালীন ভারতীয় বাঙালি হিন্দু সমাজ ও সংস্কৃতি সংস্কারের
সূতিকাগার। রামমোহন রায় হিন্দু সমাজের সংস্কার সাধনের যে আন্দোলন শুরু করেন
তাতে তিনি সহযোদ্ধা হিসেবে পেয়েছিলেন দ্বারকানাথ ঠাকুর, কালীনাথ মুন্সী, মথুরানাথ
মল্লিকের মতো সেকালের সম্ভ্রান্তদের। তাঁদেরই সহযোগিতায় তিনি ১৮২৮ সালে
প্রতিষ্ঠা করেন ব্রাহ্মসমাজ। অসংখ্য দেব-দেবীর ধারণাসম্বলিত হিন্দু তথা ব্রাহ্মণ্য ধর্ম
থেকে এ সমাজ এক পৃথক ধর্মানুসারির সৃষ্টি করে। যেখানে একশ্বরবাদের ধারণাকেই...
চূড়ান্ত বলে ধরে নেওয়া হয় এবং সেইসব দেব-দেবী যারা এতদিন হিন্দু সমাজে
পূজিত হয়ে আসছিলেন তারা এ সমাজে উপেক্ষিত হলেন। বস্তুত কুসংস্কারের কণ্টক
থেকে হিন্দু সমাজকে মুক্ত করা, হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিস্টানসহ সব ধর্মানুসারির মানুষের
নিকট গ্রহণযোগ্য করে তোলা এবং সে সময়ের সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতার নিরিখে
রামমোহন এ পদক্ষেপ নেন। অন্যদিকে হিন্দু সমাজের রক্ষণশীলদের প্রতিনিধি হিসেবে
সে আন্দোলনের বিরোধীসভা গঠন করেন রাধাকান্ত দেবের মতো ব্যক্তিত্ব। তৎকালীন
হিন্দু সমাজসংস্কারের পক্ষে-বিপক্ষে এ আন্দোলনের সময় হিন্দু কলেজ হয়ে ওঠে
সংস্কারের দুর্গ। সে দুর্গের ছাত্রপ্রিয় পথপ্রদর্শক হন হেনরি ভিভিয়ান ডিরোজিও তিনি
এ কলেজে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। ১৮২৮ সালে। ডিরোজিও ছিলেন মুক্ত চিন্ত
ার আধার। সেই চেতনা থেকেই তিনি তাঁর ছাত্র-শিষ্যদের নিয়ে গঠন করলেন
একাডেমিক এসোসিয়েশন'। এই এসোসিয়েশনে ডিরোজিও ও তাঁর শিষ্যরা ধর্ম,
সংস্কৃতি, বিশ্বাস, বিজ্ঞান, দর্শন প্রভৃতি বিষয় নিয়ে আলোচনা করতেন। ডিরোজিও-এর
সংস্পর্শে এসে তাঁর শিষ্যরা (যাদের মধ্যে পরবর্তিতে অনেকেই খ্যাতিমান হয়েছিলেন)
অন্ধবিশ্বাস, যুক্তিহীন সংস্কার, প্রাচীনমূল্যবোধ প্রভৃতির মোহ থেকে মুক্ত হতে সচেষ্ট
হয়েছিলেন। বিশেষত তৎকালীন হিন্দুসমাজে প্রচলিত নানা সংস্কারকে তাঁরা
সচেতনভাবেই অবজ্ঞা করতেন। উদাহরণ স্বরূপ মদপানের উল্লেখ করা যায়। সে
সময়ে সুরাপান করা কুসংস্কার-ভঞ্জনের একটা প্রধান উপায়স্বরূপ ছিল। যিনি শাস্ত্র ও
লোকাচারের বাধা অতিক্রম পূৰ্ব্বক প্রকাশ্যভাবে সুরাপান করিতে পারিতেন, তিনি
সংস্কারদলের মধ্যে অগ্রগণ্য ব্যক্তি বলিয়া পরিগণিত হইতেন'। স্বয়ং রামমোহন রাতের
খাবারের সময় মদ পান করতেন। তবে তা নির্দিষ্ট ও পরিমিত। সে পরিমাণ
সচেতনভাবে কখনোই তিনি অতিক্রম করেন নি কিংবা মদকে নেশায় পরিণত হতে
দেন নি। কিন্তু ইয়ং বেঙ্গল' খ্যাত ডিরোজিও'র শিষ্যরা বা রামমোহনের অনুসারিদের
মধ্যে অনেকেই তা অতিক্রম করেন। ধীরে ধীরে অন্যদের বিশেষ করে শিক্ষিত যুবক
সম্প্রদায়ের মধ্যে মদ পানের মাত্রা এতই বেড়ে যায় যে তা শুধু নেশারই জন্ম দেয় নি,
জন্ম দিয়েছে নানা অনাচারের। এ অনাচার রোধ করার মানসেই কলম ধরেছিলেন
দীনবন্ধু মিত্র, লিখেছেন ‘সধবার একাদশী'। এ প্রহসনের মূল চরিত্র অটল, তার বন্ধু
নিমচঁাদ্র, নকুলেশ্বর, কেনারাম প্রমুখের মধ্যে সে অনাচারেরই বাস্তবচিত্র পরিলক্ষিত
হয়। অনেক সমালোচক উনিশ শতকের বাঙালি নব জাগরণের অন্যতম প্রাণপুরুষ
মাইকেল মধুসূদন দত্তের আদলে নিমচঁাদ চরিত্রটিকে আঁকা হয়েছে বলে মনে করেন।
উদাহরণ হিসেবে তাঁরা নিমচাদের I read English, write English, talk English,
Speechify in English, think in English, dream in English' 43 face you
ধরেন। এ উক্তি মূলত মাইকেলের। কিন্তু এ প্রহসনে নিমর্টাদ অটলকে বলেছেন 'ওর
ভালোমন্দ তুমি বুঝবে কি, তুমি পড়েচ দাতাকর্ণ, তোমার বাপ পড়েছে, দাশরথি,
তোমার ঠাকুরদাদা পড়েছে কাশীদাস। তোমার হাতে মেঘনাদ, কাটুরের হাতে মাণিক
মাইকেল দাদা বাঙ্গালার মিলটন সুতরাং দীনবন্ধু মাইকেল মধুসূদনকে এমন চরিত্রে
অর্জন করতে চান নি বলেই মনে হয়। কারণ আধুনিকতার নামে মাইকেল আগুন থেকে
নিয়েছেন আলো আর নিমচাদ নিয়েছেন উত্তাপ। তাতে তিনি যেমন দগ্ধ হয়েছেন।
তেমনি দগ্ধ করেছেন অটলসহ অন্যদের। একই সঙ্গে সে সময় ধনী ও সম্ভ্রান্ত
পরিবারের সন্তানদের অলস ও অপচয়ী জীবনেরও চিত্র পাওয়া যায় এইসব চরিত্রে।
অটল অজস্র অর্থ অপচয় করেছেন মদ ও কাঞ্চনের পেছনে অথচ পরিশ্রম করতে তিনি
নারাজ৷ এ সে সময়েরই আরেক বাস্তবতা। শিবনাথ শাস্ত্রী এইসব চরিত্র সম্পর্কে
বলেন, 'এই সময়ে সহরের সম্পন্ন মধ্যবিত্ত ভদ্র গৃহস্থদিগের গৃহে “বাবু” নামে এক
শ্রেণীর মানুষ দেখা দিয়েছিল। তাহারা পারসী ও স্বল্প ইংরাজী শিক্ষার প্রভাবে প্রাচীন
ধৰ্ম্মে আস্থাবিহীন হইয়া ভোগসুখেই দিন কাটাইত।... এই বাবুরা দিন ঘুমাইয়া, ঘুড়ি
উড়াইয়া, বুলবুলির লড়াই দেখিয়া, সেতার, এসরাজ, বীণ প্রভৃতি বাজাইয়া, কবি, হাপ
আকড়াই, পাঁচালি প্রভৃতি শুনিয়া, রাত্রে বারাঙ্গনাদিগকে লইয়া দলে দলে নৌকাযোগে
আমোদ করিতে যাইত'। অটল, নিমচাদ সে বাস্তবতার প্রতিভূ। অন্যদিকে ফার্সির
পরিবর্তে ইংরেজি রাজভাষা হলে ইংরেজি ভাষা শিক্ষার তীব্র তৎপরতা তৈরি হয় সে
সময়। আর এরই সুযোগে সুবিধা বুঝিয়া কয়েকজন ফিরিঙ্গী কলিকাতার স্থানে স্থানে |
ইংরাজী স্কুল স্থাপন করিলেন। এইসব স্কুলে পড়ে যারা ভাঙ্গা ভাঙ্গা ব্যাকরণ-হীন
ইংরাজী বলিতে পারিতেন এবং লিখিতে পারিতেন...তৎকালীন কলিকাতা সমাজে
ইহাদের খ্যাতি প্রতিপত্তির সীমা ছিল না'। এ প্রহসনের ভোলা সেই সব বাক্য রচনা না
করে শুধু অর্থ অনুযায়ী ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করে কৃত্রিম ও হাস্যকরভাবে ইংরেজি
ভাষার ব্যবহারকারীদের প্রতিনিধি। এমনকি ঔপনিবেশিক ভারতে বিচারকার্যে
নিয়োজিত ব্যক্তির সাধারণ মানুষদের ওপর প্রভাব ও প্রতিপত্তির বিষয়টিও ধরা পড়ে
কেনারামের ওপর। গ্রামীণ ও অবহেলিত মানুষের সঙ্গে এমন আচরণ পরাজিত রাষ্ট্র
পরাধীন অধিবাসীর প্রতি শোষণেরই নামান্তর। যাই হোক উনিশ শতকের মধ্য সময়ে
আধুনিকতার নামে যে অনাচারের সৃষ্টি হয়েছিল তার কারণ হিসেবে শাস্ত্রী মহাশয়ের যে
কথাকেই মূল্যবান হিসেবে ধরা যায়। তিনি রামমোহন রায় ও সে কালের বাস্তব
প্রসঙ্গে বলেন, হিন্দুজাতির কোথায় মহতু তিনি তাহা পরিষ্কাররূপে হৃ
করিয়াছিলেন এবং তাহা সযত্নে বক্ষে ধারণ করিয়াছিলেন, অথচ পাশ্চাত্য
শাশ্চাত্যনীতি ও পাশ্চাত্য জনহিতৈষণাকে অনুকরণীয় মনে করিয়াছিলেন। কিন্তু সামাজিক সকল প্রকার বিপ্লবেরই একটা ঘাত প্রতিঘাত আছে। প্রাচীন পক্ষাবলম্বিগণ এক দিকে অতিরিক্ত মাত্রাতে যাওয়াতে এই সন্ধিক্ষণে নবীন পক্ষপাতিগণও অপরদিকে অতিরিক্ত মাত্রাতে গিয়াছিলেন'। আর 'সধবারএকাদশী'তে নিমচাদ বলেন, 'সভ্যতার সহিত বিদ্যাভাবের উদ্বাহ হলেই বিড়ম্বনার জন্ম হয়”]।

সংবার একাদশী'র আঙ্গিক:

'সধবার একাদশী' প্রকাশের অনেক পূর্বে (৬ বছর) প্রায় একই বিষয় নিয়ে মাইকেল মধুসূদন দত্ত লেখেন 'একেই কি বলে সভ্যতা?' নামক প্রহসন। এটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৬০ সালে। সুতরাং এ ব্যাপারে দীনবন্ধু মাইকেল দ্বারা প্রভাবিত বা উৎসাহিত হতে পারেন। এ প্রসঙ্গে অজিতকুমার ঘোষ বলেন, শেক্সপীয়র তাঁহার পূর্বতন নাট্যকার ক্রিষ্টোফার মারলোর বহু নাটক হইতে ভাগ্রহণ করিয়াও যেমন এলিজাবেথীয় সময়ের সর্বশ্রেষ্ঠ নাট্যকাররূপে বিখ্যাত হইয়াছেন, দীনবন্ধু মিত্রও তেমনি অগ্রবর্তী পথিকৃৎ মধুসূদনের দ্বারা অশেষভাবে প্রভাবিত হইয়াও মাইকেলী-যুগের শ্রেষ্ঠতম নাট্যকাররূপে অবিসংবাদিত ভাবে স্বীকৃত হইয়াছেন'। এ স্বীকৃতির অন্যতম কারণ এ প্রহসনের হাস্যরস। দীনবন্ধু মিত্র এ প্রহসনের মাধ্যমে তৎকালীন সমাজের অসঙ্গতিগুলোই প্রকাশ করার চেষ্টা করেছেন এবং সে অসঙ্গতি সাধনই ছিল তাঁর মূল অভিপ্রায়। কিন্তু সমাজের কথা চিন্তা করতে গিয়ে তিনি শিল্পকে সীমিত করেন নি। এ প্রহসনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত নাট্যকার হাসিরই রসদ যুগিয়েছেন। অটলের বোকামি, নিমচাদের সংলাপের তীক্ষ্ণতা, ভোলার ভাঁড়ামি, কেনারামের কৃত্রিমতা এসবই সে সে রসদের এক একটি যোগান। এমনকি যেখানে প্রচণ্ড প্রহারে নিমচাঁদ প্রহৃত সেখানেও হাসির দৃশ্য। দীনবন্ধু ‘ইংরাজী সাহিত্যের বেন জনসন, সুইফট প্রভৃতির ন্যায় ভ্রান্ত, পতিত মানব-জীবনকে নিষ্করুণ আঘাত করিয়া তিনি তাঁহার মানব-বিদ্বেষ প্রকাশ করেন নাই এ কারণে প্রহসনের শেষে রামধনের আগমনের মধ্য দিয়ে দীনবন্ধুরই আবির্ভাব ঘটেছে। দীনবন্ধু রামধনকে দিয়ে অটল ও নিমচঁাদকে প্রহার করিয়েছেন সত্য তবে সে প্রহার স্নেহপূর্ণ, বিদ্বেষপ্রসূত নয়। আবার এ প্রহসনের অন্যতম শক্তি হয়ে উঠেছে এর ভাষা। পেশাজীবনে উচ্চ আসন অলঙ্কৃত করা এ মানুষটি যখন শিল্পী তখন তিনি ঠিকই মিশে যান সমাজের একবারে নিম্ন আসনে। প্রতিটি চরিত্র তার ভাষার গুণেই জীবন্ত থাকে, বাস্তবতা পায় এবং শিল্পসত্যের স্বীকৃতি পায়। এ প্রহসনের সবচেয়ে উজ্জ্বল চরিত্র নিমচঁাদ কিংবা ম্যাজিস্ট্রেট কেনারামের ভাষায় যে ইংরেজি ভাষা-সাহিত্য ও শব্দের প্রয়োগ পাওয়া যায়, তাতে তাদের সে কালের শিক্ষার অহমই প্রকাশ পায়। এমনকি ঢাকার বিক্রমপুর থেকে যাওয়া রামমাণিক্যের মুখে ঢাকাইয়া শব্দের ব্যবহার
(এক্ষেত্রে শেঞ্জণিয়নের Merry Wives of Windsor' নাটকে Dr. Calus Hugh
রক্ত ব্যবহারে সৃষ্ট হাস্যরস তুলনীয় কাঞ্চনের মুখের জড়তাহীন
বাক্যবাণ এসব শ্রেণিচরিত্রের পরিচয়কেই প্রকাশ করে। এ কারণেই সমালোচক বলেন,
থাকে আব দ্বারা ডাকিয়া তাহার ইজ্জত রক্ষা করিবার জন্য ব্যস্ত হন নাই,
সেজন্য অলিভাষিণী বারবনিতা, মদ্যপায়ী মাতাল, বয়াটে আদুরে দুলাল প্রভৃতির মুখ
দিয়া সমাজের ভব্যতা ও শালীনতার মুখোশ খসিয়া পড়িয়াছে, এবং এক অশ্লীল, অভদ্র
রসস্রোতে সমস্ত নাটকীয় গ্ৰাঙ্গন প্লাবিত হইয়া পড়িয়াছে'। এ গ্রহসনে দীনবন্ধু প্রহসনের
প্রাচ্য বা সংস্কৃত ধরন নয়, পাশ্চাত্য ধরন অনুসরণ করেছেন। কেননা, প্রহসনটিকে
ভিনটি অন্ধের নয়টি গর্ভাভে বিভাজন করা হয়েছে। প্রাচ্যআঙ্গিকে প্রহসনের একটি অঙ্ক
থাকে। যাই হোক, এ গ্রহসনের প্রথম অল্পে দুটি দ্বিতীয় অঙ্কে চারটি, তৃতীয় অঙ্কে
তিনটি গর্ভাদ্ধ রয়েছে। এর মধ্যে প্রথম অঙ্কের প্রথম গর্ভাঙ্ক থেকে তৃতীয় অঙ্কের দ্বিতীয়
পর্যন্ত নাটকের ঘটনা একমুখি, কাহিনি অনেকটা শিথিল। একমাত্র দ্বিতীয় অঙ্কের
প্রথম গর্ভাঙ্কের কুমুদিনী ও সৌদামিনীর কথোপকথনের দৃশ্য ব্যতিত অন্যান্য অঙ্ক ও
তদ্‌সংশ্লিষ্ট গৰ্ভাঙ্কসমূহে মদপানের মাত্রাতিরিক্ত দৃশ্যের কারণে প্রহসনটি ক্লান্তিকর হয়ে
ওঠে। সে ক্ষেত্রে চরিত্রগুলোই বিশেষ করে নিমচাঁদ নাটকটির আবেদন ও আকর্ষণকে
ধরে রাখে। তৃতীয় অঙ্কের তৃতীয় গর্ভাঙ্কে প্রহসনটির নাটকীয় পরিবর্তন ও পরিণতি
ঘটে। এ দৃশ্যেই নাটকটি ক্লাইমেক্স বা চূড়ান্ত পর্যায়ে উঠে আসে। এছাড়া দীনবন্ধু
ইংরেজি সাহিত্যের স্বনামধন্য বিভিন্ন লেখকের লেখা থেকে বহুল প্রচলিত উদ্ধৃতি
ব্যবহার করেছেন। ড. ক্ষেত্রগুপ্ত এসব উদ্ধৃতি উল্লেখ করে দেখিয়েছেন যে, ইংরেজি
সাহিত্য থেকে চল্লিশটি উদ্ধৃতি ব্যবহার করা হয়েছে এ প্রহসনে। এ উদ্ধৃতিগুলো
নিমচাদের সংলাপে প্রকাশ পায়। তাছাড়া এ প্রহসনে বাংলা লোকসাহিত্যের অনেক
উপাদানেরও বহুল ব্যবহার লক্ষ করা যায়। যেমন:

প্রবাদ-প্রবচন:

ক. ঠক্ বাচ্‌তে গাঁ উজুড়।

3. ধরে বেঁধে পীরিত আর ঘষেমেজে রূপ কখনই হয় না।

ও তিলটি পড়লে তালটি পড়ে।

ঘ ভায়েতের ঘরের ঢেঁকি।

কি ছাঁ-ই বেরালে মেরেচে।

৮. হবোচন্দ্র রাজার গবোচন্দ্র মন্ত্রী।

ছ যার ধন তার ধন নয় নেতো মারে দোই।

জ. বাঘের ঘরে ঘোগের বাসা।
মুখের সঙ্গে লোক স্বর্গে যায় না।

আনাড়ির ঘোড়া লয়ে অপরেতে চড়ে

ধনবানে কেনে বই, জ্ঞানবানে পড়ে।|
টগোরুর বাঁটে গোবর দেওয়া।

ঠ. কুলে কালি দেওয়া।

৬. গলায় মরা সাপ দেওয়া।

৮. কুলের কুচ্ছ ব্যক্ত করা কাপুরুষের কাজ।
ধাধা--
ক. নাই যাই খাচ্চো তাই থাকলে কোথা পেতে?
কহে কৰি কালিদাস পথে যেতে যেতে।

ও. এটকনি পোলাগুয়া জলে নাও শেচে,।
চিনা জোহে কামড় দিলা তুড়তুড়াইয়া নাচে |

ছড়া:

ক. কড়ি দিয়ে কিনলেম,

দড়ি দিয়ে বাঁদ্‌লেম,

হ্রাতে দিলেম মাক,

একবার ভ্যা কর তো বাপ ।

প্রহসনের প্লট, অঙ্ক বিভাগ, ক্লাইমেক্স তৈরি, হাস্যরসের সৃষ্টি, কাহিনির
পরিণতিদান এ সবই প্রহসনের আঙ্গিক। সে আঙ্গিকের অন্যতম অলঙ্কার তার চরিত্র,
চরিত্রের মুখের ভাষা, ভাষার মধ্যে নির্বাচিত ও স্বতঃস্ফূর্ত শব্দের। এসবের সংযোগে এ
প্রহসন হয়ে ওঠে শিল্পীর সামাজিক ও শিল্পস্বার্থের অন্যতম বাহন। এ বাহনে 'সধবার
একাদশী'র সারথি নাট্যকার দীনবন্ধু ‘যেন রঙের পিচকারি দিয়া সমাজের চতুর্দিকে
ইতস্তত তরল রঙ ছড়াইয়া দিয়াছেন, এবং যাহারাই রঞ্জিত হইয়াছে তাহারা যেন
লজ্জিত, অপ্রতিভ ও হাস্যস্পদ হইয়া পলায়ন করিতেছে'। হাস্যরসই তাই এ প্রহসনের
প্রাণ। সেই প্রাণে আছে সামাজিক অসঙ্গতির প্রলেপ। সে প্রলেপে সধবাদের একাদশী
পালনের দুঃখ আছে, দীনবন্ধুর আছে দয়া। আর এই দুঃখ-দয়ার ভেতর দিয়ে
অবারিতভাবে খুলে গেছে হাস্যরসের দ্বার। দীনবন্ধু মিত্র সেখানেই সার্থক আর তার
শিল্পও সেখানে সত্য। ওয়াল্ট হুইটম্যানের মতো দীনবন্ধু মিত্রের সে শিল্পসত্যে
প্রস্ফুটিত হয় সেই ধ্বনিপ্রতিভাস

I am not the poet of goodness only.
I do not decline to be the poet of wickedness also.
সধবার একাদশী

"O thou invisible spirit of wine, if thou hast no name to be known by,
let us call-Devil!-Shakespeare.

Xouch not, taste not, smell not. drink not any thing that intoxi-cates.
Elibu Burret

Ah! why was ruin so attractive made.
or why tbnd so easily betray'd"-Collins.

চরিত্র 

পুরুষ-চরিত্র

জীবনদন্দ্র (ধনবান ব্যক্তি)। অটলবিহারী (জীবনচন্দ্রের পুত্র)। গোকুলচন্দ্ৰ
(অটলের খুড়শ্বশুর)। নকুলেশ্বর (উকিল) । নিমচাঁদ, ভোলা (অটলের ইয়ার)।
রামমাণিক্য (বাঙ্গাল)। দামা (অটলের ভৃত্য)। কেনারাম (ডিপুটি মাজিস্ট্রেট)।
(ব্রাহ্মণ পণ্ডিত)। রামধন রায় (অটলের পিতৃব্য)।
বৈদিক

স্ত্রী-চরিত্র

গিন্নী (জীবনচন্দ্রের স্ত্রী ও অটলের মাতা)। সৌদামিনী (অটলের ভগ্নী) কুমুদিনী
(অটলের স্ত্রী)। কাঞ্চন (বেশ্যা))।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ