Hot Posts

6/recent/ticker-posts

কৃষ্ণকুমারী নাটক আলোচনা

 

((কৃষ্ণকুমারী নাটক আলোচনা

মাইকেল মধুসূদন দত্ত 

krishnokumari natok

Michel modhushudon dotto কৃষ্ণকুমারী নাটক চরিত্র  টডের কাহিনী গঠনকৌশল ভীমসিংহ কৃষ্ণা)) 

বিঃদ্র-বাংলা বিভাগের সকল পড়াশোনা পেতে ব্লগটিতে যুক্তথাকুন https://monoweredu13.blogspot.com/?m=1 

পাত্র-পাত্রী

ভীমসিংহ--উদয়পুরের রাজা

বলেন্দ্ৰসিংহ...রাজভ্রাতা

সত্যদাস,------ রাজমিস্ত্রী 

জগৎসিংহ----- জয়পুরের রাজা

নারায়ণ মিশ্র--- রাজমিস্ত্রী 

ধনদাস----রাজসহচর

অহল্যাদেবী---- ভীমসিংহের পাটেশ্বরী 

কৃষ্ণকুমারী----ভীমসিংহের দুহিতা।

তপস্বিনী, বিলাসবতী, মদনিকা, ভূত্য, রক্ষক, দূত, সন্ন্যাসী ইত্যাদি ।

ভূমিকা---

হাজার বছরের বাঙলার কবিতার ইতিহাসকে যিনি সম্পূর্ণভাবে পাল্টে দিয়েছিলেন

তিনি হলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত (১৮২৪-১৮৭৩)। বাঙালির মধ্যে তিনি সর্বপ্রথম

বিশ্ব সাহিত্যের বীজ বপন করেছিলেন। যে বাঙালি ভারতবর্ষের বাইরের সাহিত্য সম্পর্কে

সম্পূর্ণ অজ্ঞ ছিলো, সেই বাঙালিকে তিনি গ্রিক, ইংরেজি, ফরাসি প্রমুখ ভাষার সাথে

ঘনিষ্ঠ পরিচয় করে দিলেন। তাঁর একক প্রচেষ্টায় বাঙালি প্রাচ্যের সাথে প্রতীচ্যের

সেতুবন্ধন তৈরি করেছিলেন। যে বাংলা ভাষা ছিল গতিহীন ও স্থবির সেই বাংলা ভাষায়

আনলেন পাশ্চাত্যের গতি ও আঙ্গিকে অভিনবত্ব।


মধুসুদনের আগে কোনো বাঙালি সাহিত্যের এত নিরীক্ষা করেন নি। তাঁর মাধ্যমেই

বাংলা সাহিত্য বিশ্বসাহিত্যের দ্বারে পৌঁছতে সক্ষম হয়েছিল। সেদিন যদি মাইকেল

মধুসূদন দত্ত বাংলা সাহিত্যে আি না হতেন তবে আজকের বাংলা সাহিত্য এই

অবস্থায় পৌঁছতে পারতো না। এই প্রসঙ্গে এ কথাটুকু বলা প্রয়োজন তিনি যদি সেদিন

খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ না করতেন তাহলে লাতিন, গ্রিক, হিব্রু ভাষা শিখতে পারতেন না এবং

বাংলা সাহিত্যের এই শ্রীবৃদ্ধি হতো না। মধুসূদনের খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ বাংলাসাহিত্যের পক্ষে

মঙ্গলজনক হয়েছিল। বাংলা সাহিত্যে তিনি সর্বপ্রথম মহাকাব্য, সনেট, অমিত্রাক্ষর ছন্দ,

পত্রকাব্য, প্রথম সার্থক নাটক ও প্রহসন ধর্ম নাটক রচনা করেন। মধুসূদনের পূর্বে

বাঙালি সাহিত্যের বৈচিত্র পথে নব ধারা সৃষ্টি করতে পারেন নি।


রেনেসাঁসের প্রাণপুরুষ মাইকেল মধুসূদন দত্ত য়ুরোপের প্রাণচাঞ্চল্য ও

মানবতাবাদী আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে সাহিত্যের প্রেরণা স্বীকরণ করে পূর্ব নির্দিষ্ট শ্লথ গতি ও

প্রাচীন প্রথা পরিহার করে স্বকীয় প্রতিভাবলে নিজস্ব পথ সৃষ্টি করলেন। রাজনারায়ণকে

লিখিত একটি পত্রে তিনি নিজেকে tremendous Literary rebel রূপে অভিহিত

করিয়াছেন। গৌরদাসের কাছে লিখিত এক পত্রেও তার রোমান্টিক মনোভাবনার পরিচয়

পাওয়া যায় "Super abundance of the imaginative faculty"। নব সাহিত্যের

সংস্পর্শে আসার ফলে বাঙালি যুবকদের মনে নবদিগন্ত উন্মোচিত হয়েছিল। উনিশ

শতকের প্রথম দিকে যুবকদের মধ্যে আশা-আকাঙ্ক্ষা জাগলেও মাতৃভাষাকে ভাব

প্রকাশের বাহন করে তোলবার সাধনা দেখা যায়নি। তবে য়ুরোপের মানস প্রকৃতির

সংস্পর্শে যা ঘটেছিল তা বিস্ময়কর। বাঙালি যুবকদের মধ্যে নবচেতনা জাগ্রত করেছিল

এবং তা ছিল সর্বপ্রকার সংস্কার হতে মুক্ত হবার যুগ।

মধুসুদনের কবি আত্মা ছিল আত্মধর্ম ও অতিমাত্রায় সংবেদনশীল। তাঁর বাস্তবধর্মীমহাকাব্যে [মেঘনাদবধ কাব্য] রোমান্টিক মানসিকতার পরিচয় পাওয়া যায়। তিনি

য়ুরোপের জীবনধর্ম ও মানবতাবাদকে গ্রহণ করেছিলেন। জীবন প্রেমিক কবি বলে

মেঘনাদবধ কাব্যে রাবণ নায়ক নির্বাচিত হয়েছেন এবং ইন্দ্রজিৎ হয়েছেন কবিরমানসপুত্র। দেবকুল প্রিয় রামচন্দ্রকে তিনি গ্রহণ করেন নি। লঙ্কেশ্বর রাবণের মধ্যে আছে

জীবনাবেগের প্রাচুর্য। 'মেঘনাদবধ কাব্যে রাবণের বিলাপে ও সীতার বেদনায় লিরিকের

প্রকাশ থাকলেও মহাকাব্য রচনার জন্য কবিকে বস্তুধর্মী হতে হয়েছিল। কিন্তু ব্রজাঙ্গনা,

বীরাঙ্গনা ও সনেটে তিনি তাঁর গীতিধর্মিতা প্রকাশ করেছেন।

“মেঘনাদবধ” কাব্যে যে গাম্ভীর্য ও ঐশ্বর্য আছে যাকে আডিসন মিল্টনের মহাকাব্য

প্রসঙ্গে বলেছেন "an unquestionable magificence in every part"—তা গীতি

কবিতায় থাকার কথা নয়, কিন্তু সেখানে পরিদৃষ্ট হয় কবি আত্মার প্রবার স্বচ্ছন্দ বিহার।

ট্যাসোর কাব্য পাঠ করে মধুসূদন লিখেছিলেন "Oh! what luscious poetry" এর

তাৎপর্য আমরা বীরাঙ্গনা কাব্যে পাই। বিষয়বস্তুতে তিনি রোমান্টিক হলেও রীতির দিক

হতে তিনি ছিলেন ক্লাসিকধর্মী। ভাষার শ্রীবৃদ্ধি সাধনে তিনি ছিলেন তৎপর ও এর অন্তর

সৌন্দর্য উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। তিনি একটি পত্রে রাজনারায়ণকে লিখেছিলেন

"Really what rapid advances our languages (I feel tempted to us the word of

Alfiery and say

"Nostra divinalingua is making towards perfection and low it is shaking

off its sleep of ages."

মধুসদনের শুরু ছিলেন পাশ্চাত্যের বিখ্যাত কবি মিল্টন। কাব্যের স্টাইলের ক্ষেত্রে

তিনি মিল্টনের কাছে ঋণী ছিলেন। কাব্যের ভাব প্রকাশের জন্য মধুসূদনকে নব ছন্দরীতি

অমিত্রাক্ষর ছন্দের দ্বারস্থ হতে হয়েছিল। কবি রঙ্গলাল বঙ্গোপাধ্যায়ের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল

যাঁরা ইংরেজি বুঝতে পারবে না তাদের পক্ষে blank verse-এর মহিমা উপলব্ধি করা

সম্ভব নয়। কিন্তু মধুসূদনের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল বাংলা ভাষায় এ ছন্দ অসম্ভব জনপ্রিয়তা লাভ

করবে। তিনি কেশবচন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায়কে লিখেছিলেন—

"Take my word for it, that blank verse will do splendidly in Bengali"

ক্লাসিক রীতির প্রধান দুটো বৈশিষ্ট্য হল ব্যাপকতা ও সর্বজনীনতা–এই দুটো গুণই তাঁর

মধ্যে ছিল।মাইকেল মধুসূদন দত্তের 'মেঘনাদবধ' কাব্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র ছিল রাবণ ।

রাবণ চরিত্রের মধ্যে দিয়ে বাঙালির জীবনজিজ্ঞাসা ব্যক্ত হয়েছে। তিনি খাঁটি বাঙালির

প্রতিনিধিত্বকারী। শ্রেষ্ঠকাব্যের তিনটি গুণ হল প্রাচুর্য, বিস্তীর্ণতা ও ঐক্য। মধুসূদন তাঁর

তিন বৎসর ব্যাপী সাহিত্য জীবনে যা লিখেছেন তার কোনটিই উপেক্ষণীয় হচ্ছে না

বিস্তীর্ণতা অর্থে বুঝতে হবে তাঁর সহানুভূতি, মানসিক ব্যাপ্তি এবং জীবনকে জানবার

গভীর আগ্রহ। ঐক্য অর্থে বুঝতে হবে যে, তিনি জীবনের তাৎপর্য পারস্পর্যের ধারায়

বিশ্লেষণ করেছেন।বাঙালির সার্বভৌম কবি রবীন্দ্রনাথ একবার টেনিসের জীবনী সম্পর্কে মন্তব্য

করেছিলেন কবির প্রকৃত জীবনচরিত্র হল তাঁর কাব্য। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের এই মন্তব্যের

সাথে আমরা একমত নই। কবিকে পুরোপুরি জানতে হলে তাঁর কবি জীবন ও কাব্যকে

জানতে হবে। এ দুটো বিষয় অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত।

জন্ম ও শৈশব: যশোর জেলার সাগরদাঁড়ি গ্রামে ১৮২৪ সালের ২৫ জানুয়ারি

বাংলা সাহিত্যের প্রথম আধুনিক কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত জন্মগ্রহণ করেন। সেই

সময়ের প্রথা অনুযায়ী মধুসূদনের পিতা মৌলভীর সঙ্গে ফারসি শেখার জন্য

পাঠিয়েছিলেন। এবং তিনি ফারসি ভাষায় দক্ষতা অর্জন করেছিলেন। তাঁর লব্ধপ্রতিষ্ঠ

পিতা সেই সময়ে কলকাতায় আইনজীবী পেশায় প্রচুর অর্থ উপার্জন করেছিলেন।

অত্যল্প সময়েই তাঁর পিতা কলকাতা খিদিরপুরে দোতলা বাড়ি কিনে বসবাস করতেন।মধুসূদনের বয়স সেই সময়ে মাত্র সাত বৎসর ছিল।

শৈশবে মধুসূদনের শিক্ষার গোড়াপত্তন হয়েছিল মাতা জাহ্নবী দেবীর কাছে।

বাল্যকালেই মায়ের মুখে রামায়ণ-মহাভারতের কাহিনি শুনে তাঁর সাহিত্যের বীজ বপন

হয়েছিল।


হিন্দু কলেজ : কলকাতায় এসে কবি হিন্দু কলেজে ভর্তি হলেন। ১৮৩৩ সালে তিনি

কলেজের ডিপার্টমেন্টের সর্বনিম্ন শ্রেণীতে প্রবেশ করলেন। ১৮৩৪ সালের ৭ মার্চ তিনি

কলেজের পুরস্কার বিতরণ সভায় ইংরেজি নাটক থেকে আবৃত্তি করেছিলেন। এই

কলেজে অধ্যয়নকালে মধুসূদনের কবি প্রতিভার উন্মেষ ঘটে। এই কলেজের বিখ্যাত

অধ্যাপক রিচাডসন, গণিত শাস্ত্রবিদ রিজ, হালফোর্ড এবং ক্লিল্ট অধ্যাপনা করতেন।

বিশেষ করে অধ্যাপক রিচার্ডসনের অনুপ্রেরণায় কবির মধ্যে কবি খ্যাতি লাভ করবার

মনোবাসনা জাগ্রত হয়। তিনি একটি কবিতায় ইংলন্ডে যাবার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করেন।


I sighTo cross the vast Atlantic waves

For glory, Or a nameless grave,


হিন্দু কলেজে অধ্যয়নরত অবস্থায় 'জ্ঞানান্বেষণ' 'Bengal spectator' 'literacy

Gleaves' 'Literary Blossom' প্রভৃতি পত্রিকায় তাঁর কবিতা প্রকাশিত হয়। প্রথম

জীবনে প্রকাশিত কবিতা নিয়ে মধুসূদনের গর্বের কোনো সীমা পরিসীমা ছিল না। তিনি

যে, বিলেতে গমন করলেই বিখ্যাত কবি হবেন, এ ধরনের অদ্ভুত ধারণা মনের মধ্যে

গেঁথেছিল। তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু গৌরদাস বসাককে এক চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন—

"I am reading Tom Moore's Life of my favourite Byron a Splendid book

upon my word! Oh! how should I like to see you writing my life if I happen

to be a great poet-which I am almost sure.

খ্রিস্টধর্ম : হঠাৎ একদিন মধুসূদন নিরুদ্দেশ হলেন। তাঁকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

পরে জানা গেল তিনি খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করলেন। সেই সময়টি ছিল ১৮৪৩ সালের ৯

ফেব্রুয়ারি। মধুসূদনের খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ নিয়ে নানা ধরনের বিতর্ক রয়েছে। তবে যে দুটো

কারণ সমালোচকরা চিহ্নিত করেছেন (১) ইংরেজ কবি হবার বাসনা (২) গ্রাম্যবালিকার সঙ্গে বিবাহের কথা।-গৌরদাস বসাক মধুসূদনের খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করা প্রসঙ্গে রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহলের

প্ররোচনাকে দায়ী করেন। নিজের পছন্দমতো শিক্ষক তরুণীর পাণিগ্রহণের বাসনা

I shall be if I can go to England. ঐই সময়ে প্রকাশিত বিভিন্ন কবিতায় বায়ন


ওয়ার্ডসওয়ার্থ ও কিটসের প্রভাব লক্ষ করা যায়। একটি কবিতায় মধুসূদন লিখেছেন...

The silver Rill that gaily warbling flows,


And even the dark and ever lasting sea,


All, all these bring oblivion for my woes,


And all these have transcendent charms fame!


এভাবে হিন্দু কলেজের উজ্জ্বল ছাত্রের প্রতিভার বিচ্ছুরণ ঘটে। অবশেষে ১৮৪২

সালে তার জীবনে এক গুরুতর পরিবর্তন ঘটে।


বিশস কলেজ : হিন্দু কলেজের নিয়ম ছিল হিন্দু ছাড়া অন্য ধর্মাবলম্বীরা একলেজে অধ্যয়ন করতে পারবে না। সেই কলেজে রীতি অনুযাযী মধুসূদনকে কলেজ

পরিত্যাগ করতে হল। খ্রিস্টধর্মের দু বছর পর তিনি শিবপুরে বিশপস কলেজে ভর্তি

হলেন। ধর্মান্তরিত পুত্রের অধ্যয়নের খরচ দিতেন রাজনারায়ণ। বিশপস কলেজেঅধ্যয়নকালে তিনি ক্লাসিক ভাষা (গ্রিক, লাতিন ও হিব্রু) শেখার সুযোগ পেলেন। আর

কুমার স্বামীর কাছে সংস্কৃত।

"Here (Bishop's college) he remained for four years and learnt Greek

and latin. In this college his reading was extensive and multi farious."


বিশস কলেজে য়ুরোপীয় ছাত্রদের সাথে ভারতীয় ছাত্রদের সহবাসের ফলে নানা

ধরনের সমস্যার সৃষ্টি হতো। খাবার টেবিলে আহার বিষয়ে পক্ষপাত দেখা দিলে

মধুসূদন এর প্রতিবাদ করেন। শেষ পর্যন্ত কলেজ কর্তৃপক্ষ বৈষম্য দূর করতে বাধ্য

হয়েছিলেন। শেষোক্ত ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে কৃষ্ণমোহন বলেছিলেন—

"He was a person of great intellectual power-some what flying in his


imagination, strong in his opinions and sentiments of an independant mind


and very tenacious of personal rights."

কয়েক বছর বিশপস কলেজে থাকার পর তিনি মাদ্রাজে চলে যান। কেন তিনি

১৮৪৮ সালে মাদ্রাজে গমন করলেন তাঁর কোনো সঠিক তথ্য পাওয়া যায়নি ৷

মাদ্রাজ পর্ব : কপর্দকশূন্য অবস্থায় তিনি ১৮৪৮ সালে মাদ্রাজ গমন করেন। তিনি

- দেশীয় খ্রিস্টান এবং অ্যাংলো ইন্ডিয়ান সম্প্রদায়ের সহায়তায় অনেক কষ্টে মাদ্রাজ সেল

অরফ্যান এসাইলাম নামক বিদ্যালয়ে ইংরেজি বিষয়ের শিক্ষক পদে চাকরি পান।

মাদ্রাজে তিনি সাত বছর শিক্ষকতা করেন। কবি ও সাংবাদিক হিসেবে তিনি

মদ্রাজে পরিচিতি লাভ করেন। মাদ্রাজ প্রসঙ্গে তাঁর দাম্পত্য জীবনের দিক দিয়ে এ

গুরুতর আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিল। মাদ্রাজ প্রবাসের প্রথম দিকে রেবেকা ম্যাক টাভিসকে

বিবাহ করেন। রেবেকার সাথে সাত বছরের দাম্পত্যজীবনের অবসানের পর অধ্যাপক

কন্যা হেনারিয়েটাকে স্ত্রী রূপে গ্রহণ করেন।


মাদ্রাজে থাকার সময় তিনি Capitive Indie, Vision of the past ও পশুকাব্য

Rizia রচনা করেন। Visions of the past কাব্যে তিনি অরণ্য সমান্ন রৌদ্রতপ্ত

বটচ্ছায়া শীতল বঙ্গদেশের চিত্র অঙ্কন করেছেন। 'ক্যাপটিভ লেডি' মাদ্রাজে প্রশংসিত

হলেও কলকাতায় সমাদৃত হল না। মধুসূদন প্রেরিত ‘ক্যাপটিভ লেডি' পাঠ করে গভর্নর

জেনারেলের ব্যবস্থা সচিব ও শিক্ষা সমাজের জে. ই. ডি. বেথুন তাঁকে মাতৃভাষায়

সাহিত্য চর্চা করতে পরামর্শ দিয়েছিলেন। বেথুন সাহেবের পরামর্শ ও ঘনিষ্ঠ বন্ধু

গৌরদাসের উৎসাহে তিনি বাংলায় সাহিত্যচর্চার প্রতি অনুরাগ প্রকাশ করলেন। তিনি

গৌরদাসকে অনুরোধ করলেন..


"Can't you send me a copy of the Bengali translation of the mahahbrat

ed, by casidoss as well as a ditto of the Ramayan-Serampore edition. I am

losing my Bengali faster than I can mention. Won't you oblige me, old

friend, eh, old Grow Das Bysack?"

কলকাতা পর্ব : সৃজনশীলতার চমোৎকার ১৮৫৬ হতে ১৮৬২ ছিল তাঁর সাহিত্য


পর্বের চূড়ান্ত শীর্ষদেশ। তাঁর জীবন যশ ও খ্যাতির তুঙ্গে উপনীত হয়েছিল ।


১৮৫৬ সালের ২রা ফেব্রুয়ারি মধুসূদন কলকাতায় পৌছেন। বন্ধুদের আপ্রাণ

প্রচেষ্টায় তিনি পুলিশ কোর্টের কেরানীপদ ও পরে দ্বিভাষিক পদলাভ করেন। একবার

মধুসূদন প্যারীচাঁদ মিত্রের ভাষার সম্পর্কে বলেছিলেন Fishermen language |

পরবর্তীতে দেখা গেল মধুসূদনের চেয়ে প্যারীচাদদের ভাষা রীতি জয়ী হয়েছিল। নাটকে

মধুসূদনের আবির্ভাব অনেকটা অপ্রাত্যাশিত পাইক পাড়ার বিদ্যুৎ সাহী রাজাদের

অনুরোধে তিনি রামনারায়ণ তর্করত্নের 'রত্নাবলী' নাটকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেন।

পাইকপাড়ায় বিদ্যোৎসাহী রাজারা মধুসূদনের অনূদিত নাটকে চমৎকৃত হয়ে

পারিতোষিক প্রদান করেন। রাঢ়বঙ্গের লোক এই ধরনের অলীক নাট্যোমজে দেখে

মধুসূদন তাঁর বন্ধু গৌরদাস বসাকের কাছে আক্ষেপ করেছিলেন। তাঁর বসু গৌরদাসের

অনুরোধে বাংলা নাটকের দুর্নাম ঘোচানোর জন্য ১৮৫৯ সালে 'শর্মিষ্ঠা নাটক রচনা

করেন। পরবর্তীতে তাঁর এটি নাটক তথা কথিত সংস্কৃত পণ্ডিতদের কাছে সমাদৃত না

হলেও শিক্ষিত বাঙালির দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছিলো। তৎকালীন সময়ে

রাজেন্দ্রলাল মিত্র মন্তব্য করেছিলেন—“প্রকাশিত সকল বাঙ্গালি নাটকের মধ্যে ইহা

নিঃসন্দেহে শ্রেষ্ঠ।”


১৮৫৯ সালে, শর্মিষ্ঠা নাটকটির বেলগাছিয়া নাট্যশালায় মঞ্চস্থ হয়। মধুসূদন

গৌরদাস বসাককে লিখেছিলেন—"Sermista has turned out to be a most delightful girl, if I am to believe

those who have already inspected her."


পাইকপাড়ার রাজাদের অনুনয় ও বিনয়নে 'বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ' ও 'একেই কি

বলে সত' নামক দুটো প্রকাশ করেন। তা ১৮৬০ সালে প্রকাশিত হয়। এই বৎসরে

তিনি 'পদ্মাবতী' নাটক রচনা করেন।


১৮৬০ সালে মাইকেলের প্রথম কাব্য “তিলোত্তমাসম্ভব" প্রকাশিত হয়। তার পরে

প্রকাশিত হয় ১৮৬১ সালে বাঙালি জাতির জীবনে যে মহাকাব্যটি এখনো আলোড়ন সৃষ্টি

করেছে, সেটি হল ‘মেঘনাদবধ' কাব্য। মাইকেল মধুসূদন দত্ত প্রথম অমিত্রাক্ষর ছন্দ

প্রবর্তন করলেন। তারপর 'মেঘনাদবধ' কাব্যে এবং চূড়ান্ত প্রয়োগ করলেন 'বীরাঙ্গনা'

কাব্যে। মাইকেল মধুসূদন দত্তের মহাকাব্যটি প্রচণ্ড আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলো। সময়ের

বিদ্যোৎসাহীরা তাঁকে এই কাব্য রচনার জন্য অর্থ ও খ্যাতি দিয়েছিল। একটি যুগের

মানুষের জীবন জিজ্ঞাসা গভীর অনুভূতি প্রাণের দীপ্তি ও মনের নিগূঢ় প্রশ্ন এই কাব্যে

যেভাবে ঘটেছে তা বর্তমানে দুর্লভ। এই কাব্যটি সম্পর্কে অসাধারণ মন্তব্য করেছিলেন

“মেঘনাদবধের মত দ্বিতীয় কাব্য বাঙ্গালী ভাষাতে ত নাই-ই, সমগ্র ইউরোপেও অমন

। ইদানিং পাওয়া দুর্লভ।” ১৮৬০ সালে রচনা করেন 'ব্রজাঙ্গনাকাব্য' “বৈষ্ণব

কবিদিগের প্রাণহারা সুর মধুসূদনের ব্রজাঙ্গনাতেই সংস্কৃত হয়েছে সেই সুন্দর অতীতের

চিরমধুর গীতধ্বনি। ব্রজাঙ্গনা' কাব্যে আর কোথাও শ্রুত হইল না। অপার্থিব প্রেমে

বিভোর স্ত্রীরাধিকার উক্তিটি গ্রহণযোগ্য—


কেনে এত ফুল তুলিলি, স্বজনি—


ভরিয়া ডালা?


মেঘাবৃত হলে পরে কি রজনী

তারার মালা?

আর কি যতনে

কুসুম রতনে


ব্রজের বলো।


১৮৬১ সালে দীনবন্ধু মিত্রের 'নীলদর্পন' নাটকের ইংরেজি অনুবাদ করেন এবং এই

বৎসরের শেষ দিকে তিনি তাঁর শ্রেষ্ঠ ট্রাজেডি কৃষ্ণকুমারী' প্রকাশ করেন। এটি বাংলা

ভাষার প্রথম সার্থক নাটক। ১৮৬২ সালে বাংলা ভাষার প্রথম পত্রকাব্য ‘বীরাঙ্গনা' রচনা

করেন। এই কাব্যে প্রথম নারীর স্বাধিকার চেতনা প্রকাশিত হয়েছে। ফ্রান্সের ভার্সাই

নগরীতে থাকার সময় তিনি রচনা করেন “চতুর্দশপদী কবিতাবলি।


য়ুরোপ প্রবাস : ১৮৬২-১৮৬৬। এই সময় তাঁর জীবনে গভীর বিষাদ নেমে আসে।

মধুসূদন চরম অর্থসংকটে পড়লেন। স্ত্রী-পুত্র কন্যার জন্য অর্থের যে ব্যবস্থা করিয়াছিলেন

তা ফলপ্রসূ হলো না। ১৮৬৩ সালে সপরিবারে ফ্রান্সে গেলেন। প্রথমে পারিতে

পরবর্তীতে ভার্সাই নগরে। ঋণের দায়ে জর্জরিত হয়ে জেলে যাওয়ার উপক্রম হন।

মাঝে মাঝে এমন অবস্থা হল এক প্রকার অনশনের মধ্যে দিন কাটতে লাগল।

বিদ্যাসাগরের কাছে পত্র দিলেন অর্থ প্রেরণ করতে। বিদ্যাসাগর পত্র পাওয়া মাত্র দেড়হাজার টাকা পাঠিয়ে দিলেন। পরে অনুকুলচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের কাছে তিন হাজার টাকা

এবং পরবর্তীতে শ্রীশচন্দ্র মহাশয়ের কাছে পাঁচ হাজার টাকা সংগ্রহ করলেন।

বিদেশের লাঞ্ছনা-গঞ্জনায় অপমানিত হয়ে মধুসূদন এত তীক্ত বিরক্ত হয়েছিলেন


তাঁর প্রমাণ পাওয়া যায় নিম্নের উক্তিটিতে...

"If we perish. I hope our blood will cry out to God for a revenge against


our murderes"


য়ুরোপ প্রবাসে মধুসূদনের জীবনের স্মরণীয় ঘটনা হচ্ছে “চতুর্দশপদী কবিতাবলী"

রচনা ১৮৬৫ সালে ফ্রান্সের ভার্সাই নগরীতে থাকার সময় এই কবিতাগুলো রচনা

করেন। ফরাসি কবি লা-ফঁতেন এর অনুসরণে মধুসূদন নীতিবিষয়ক কবিতা রচনা

করেন।


ফ্রান্সের ভার্সাই নগরীতে অবস্থানের সময় মধুসূদন দত্তের ষষ্ঠ জন্মশতবার্ষিকি

উপলক্ষে সনেট রচনা করে ইতালির রাজা ভিক্টর ইমানুয়েলের কাছে পাঠিয়ে দেন।


আমদের ভাবতে বিস্মিত লাগে যে মধুসূদন বিদেশে এত দুরবস্থার মধ্যে ছিলেন,

সেই অবস্থার ভেতরও তার আধুনিক য়ুরোপীয় ভাষা শেখা চলছে। তিনি বলেছেন—

"Though I have been very unhappy and full of anxiety here. I have very

nearly mastered French. I speak it will and write it better. I have also com


menced Italian and mean to add German to my stock of languages-if not


spainish and portugeese before I leave Europe."


স্বদেশ প্রত্যাবর্তন : ১৮৬৭ সালের প্রথম দিকে কলকাতা ফিরে আসলেন। আইন

ব্যবসা শুরু করলেন। কিন্তু কলকাতা পেলেন না। নানাভাবে বাঁচার চেষ্টা করলেন।

জীবন সন্ধ্যায় দীপ নির্বাপিত হবার আগে তিনি স্মরণ করলেন তাঁর জীবন সঙ্গিনীকে।


প্রেমের প্রতিমা তুমি, আলোক আঁধারে

অধিষ্ঠাত্রী নিত্য তব স্মৃতি মঠে

সতত সঙ্গিনী মোর সংসার মাঝারে ।


ঋণভারে জর্জরিত। রোগ-ব্যাধিতে ক্লান্ত মধুসূদনের জীবন নিঃশেষিত প্রায়। এই

পর্যায়ে তিনি রচনা করেন হেক্টরবধ (১৮৭১) । মায়াকানন (১৮৭৩) ও অসম্পূর্ণ নাটক

বিষ না ধনৰ্গুন” (১৮৭৩)। ১৮৭৩ সালে এর ২৬ জুন হেনরিয়েটা পরলোক গমন

করলেন। স্ত্রীর প্রতি গভীর ভালোবাসার কারণে তার মাত্র তিন দিন পর (২৯ জুন তিনি

হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন।


বঙ্গের পঙ্কজরবি গেলা অস্তাচলে।


নাটকের উৎস : মাইকেল মধুসূদন দত্ত বাংলার অলীক কুনাট্য দেখে অত্যন্ত

বেদনাবোধ প্রকাশ করেছিলেন তাঁর বন্ধু কাছে। তিনি বাংলা ভাষায় মহৎ নাটক রচনা

করার জন্য মনস্থির করলেন। প্রথমে তিনি 'রিজিয়া'র কাহিনী অবলম্বন করে নাটক রচনা

করার জন্য পরিকল্পনা করলেন। কিন্তু বেলগাছিয়া থিয়েটারের আপত্তির মুখে এই

পরিকল্পনা স্থগিত করলেন প্রখ্যাত অভিনেতা কেশব গঙ্গোপাধ্যায় তাঁকে রাজপুত্রের

ইতিহাস অবলম্বন করে নাটক রচনার জন্য পরামর্শ দিলেন। পরবর্তীতে তিনি টডের

লিখিত রাজপুত্রের ইতিহাস অত্যন্ত গভীরভাবে পঠন-পাঠন করে তাঁর নাটকের উপাদান

সংগ্রহ করলেন। তাঁর বন্ধু রাজনারায়ণ বসুকে কবি চিঠিতে জানালেন.....


....... I have been dramatizing writing aregular tragedy in-prose. The

plot is taken from Tod"


কেশবচন্দ্রকে লিখিতভাবে কবি 'কৃষ্ণকুমারী' রচনার প্রেরণা ব্যাখ্যা করেন। তিনি

দুই রাত্রি ব্যাপী টডের রাজস্থানের ইতিহাস পাঠ করেছেন। এর বিষয়বস্তু কবিকে উৎফুল্ল

করেছিলো। তিনি লিখেছিলেন "What a romantic tragedy it will make." রোমান্টিক

ট্রাজেডি বলতে তিনি শেক্‌সপিরীয় ট্রাজেডির রোমিও জুলিয়ের্ট, ওথেলো, ক্লিওপট্রাকে

বুঝিয়েছেন। রাজনারায়ণ বসুকে লেখা চিঠিগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়

‘মেঘনাদবধ' কাব্য রচনার পাশাপাশি 'কৃষ্ণকুমারী' রচনায় হাত দেন। ৩ আগষ্ট ১৮৬০

সালে কাবোর দ্বিতীয় সর্গ লেখা হয়েছে কবি বন্ধুকে বলেন। কিছুকাল পরে আরেকটি

চিঠিতে জানা যাচ্ছে 'কৃষ্ণকুমারী' নাটক লেখা সমাপ্ত হয়েছে এবং মেঘনাদবধ কাব্য

লেখা আরম্ভ হয়েছে তৃতীয় পর্ব থেকে। এবং তার বন্ধুকে এও বলেছিরেন যে পূর্ববর্তী

দুটো নাটক (শর্মিষ্ঠা, পদ্মাবতী) থেকে উৎকৃষ্ট হবে।


মধুসূদনের দৃঢ় ইচ্ছা ছিল বেলগাছিয়া রঙ্গমঞ্চে তার নাটক অভিনীত হবে। কেশব

গঙ্গোপাধ্যায়কে লিখিত এক পত্রে তিনি লিখে ছিলেন ""What I want to have it

acted and acted by such an actor as your noble self. তাঁর মতে এ নাটকে ঘটনার

বিরলতা থাকলে ও অভিনয়ের যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে। বেলগাছিয়ার রাজা ঈশ্বরচন্দ্রের

মৃত্যুর পর এই নাটকে রঙ্গমঞ্চ বন্ধ হয়েছে। তিনি রাজার মৃত্যুর পর রাজনারায়ণ বসুকে

পত্রে শোক জ্ঞাপন করে বলেছিলেন—"What shall we look upon his like again."

age for the drama to flourish."


বেলগাছিয়া রঙ্গমঞ্চ হবার নিশ্চিত সম্ভাবনায় সানন্দে মন্তব্য করেছেন—"This is not the


১৮৬৭ সালের ফেব্রুয়ারি শোভা বাজারের নাট্যশালায় এই নাটক মঞ্চস্থ হয় । তিনি

তখন বাংলার বাইরে ছিলেন। বেলগাছিয়া বন্ধ হবার পর তিনি আর নাটক লিখেননি।

যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর তাঁর প্রতিভা সম্পর্কে শ্রদ্ধাবান ছিলেন। কৃষ্ণকুমারী প্রকাশিত হবার

পরে তিনি উৎকন্ঠার সাথে লিখেছিলেন "You cannot conceive-my dear sir, how

anxious I am see your epic and your new drama."


মূল কাহিনি : মাইকেল মধুসূদন দত্ত তাঁর 'কৃষ্ণকুমারী' নাটকের ইতিহাস সংগ্রহ

করেছিলেন টডের ইতিহাসের প্রথম খন্ডের ৪৬১পৃঃ বর্ণিত কাহিনি হতে ।


মধুসূদন দত্ত ইতিহাসে বর্ণিত ঘটনাসমূহ পরিবর্তিত বা বিকৃত না করে সম্পূর্ণ গ্রহণ

করেছেন। উদয়পুরের শোচনীয় অবস্থা ইতিহাসে যা বর্ণিত হয়েছে তা রানা ভীমসিংহ

স্ত্রীকে বলেছেন— 'দেখ আমার ধনাগার অর্থশূন্য; সৈন্য বীর শূন্য সুতরাং আমিঅভিমুন্যর মতন এ সপ্তরথীর মধ্যে নিরস্ত্র হয়ে রয়েছি। মহারাষ্ট্রের অধিপতি ত্রিশ লক্ষ

মুদ্রার বিনিময়ে ফেরতের আশ্বাস দিলেও ধনের অভাব ঘটলে তার পুনরাগমনের

সম্ভাবনা, কোন কোন সাগরে ঝড়ের বিক্ষোভের মত উদয়পুরেও বার বার আক্রমণের

নিশ্চিত সম্ভাবনার ভীতি, কুমারী কৃষ্ণার বিবাহকে কেন্দ্র করে জয়পুর ও মাড়রায়ের মাঝে

ক্ষুদ্র। মহারাষ্ট্র দ্বারা দেশে চরম বিশৃংখলা সৃষ্টির সম্ভাবনা, জয়পুরের রাজদূতকে বিদায়

দেওয়ায় জয়পুর রাজের ক্রোধ, মানসিংহের পক্ষে আমীর চাঁদ ও মহারাষ্ট্রপতি মাধজীর

যোগান ইতিহাসে বর্ণিত এসব তথ্যাবলি মধুসুদন তাঁর নাটকে সঠিকভাবে প্রয়োগ

করেছেন।


তবে মূল কাহিনীতে রয়েছে পাঠান সর্দার আমীর খাঁ ও অজিত সিংহ হয়

মানসিংহের সাথে কৃষ্ণার বিবাহ না হয় তার প্রাণনাশের দাবী জানানো হয়েছিল।

কিন্তু নাটকে আমীর খাঁ-র মানসিংহের পক্ষে যোগদানের কথা উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু


তার সাথে রাজকুমারীর বিবাহ, না হয় মৃত্যুর দাবীর কথা নেই। এক অজ্ঞাতনামা ব্যক্তির


পক্ষে কৃষ্ণার মৃত্যুর কথা রয়েছে। রানা মন্তব্য করেছেন—


দেখ, মন্ত্রী এ চিকিৎসক অতি কুট ঔষধের ব্যবস্থা দেয় বটে, কিন্তু এ দেখছি, রোগ

নিবারণ কত্যে সুনিপুণ।"

মন্ত্রী শ্রী উত্তর দিয়েছেন—“আর বোধ হয়, এ রোগের এই ভিন্ন আর কোন ঔষধ

নেই।' মূল কাহিনীতে কৃষ্ণার বিষপানে মৃত্যুর কথা রয়েছে, কিন্তু নাটকে রানী পদ্মিনীর


অশরীরী বাণীর আহ্বানে রাজাকুমারী খড়গাঘাতে আত্মহত্যা করেছে।

কাহিনিটি ইতিহাস হতে গৃহীত হয়েছে কিন্তু মধুসূদন এখানে ইতিহাসের ওপর

রোমান্টিক প্রলেপ দিয়েছেন। কৃষ্ণকুমারীর শোকাবহ কাহিনি তাঁর শিল্পীমনকে আকৃষ্ট

করে ছিল। তিনি নাটকের মধ্যে যুদ্ধবিগ্রহ ও রাজনৈতিক বিতর্ক এনে দর্শক ও

পাঠকমনকে হতচকিত করতে চাহেন নি। এই কারণে তিনি কেশবচন্দ্রকে লিখিত পত্রে

একে "historical one'—রূপে ব্যাখ্যা করলেন ও ঐতিহাসিক ঘটনাসমূহকে পুরোপুরি

আনেন নি। টডের ইতিহাসে জগৎসিংহের রক্ষিতার নাম কপুরমঞ্জুরী। মধুসূদন তাঁর নাম

পরিবর্তন করেছেন। বিলাসবতীর সখী মদনিকা নামে এক চরিত্র সৃষ্টি করে নাটকে

হাস্যরসের অবতারণা করেছেন। তপস্বিনী চরিত্র নাটকের আখ্যান বৃত্ত রচনার জন্য সৃষ্টি

করেছেন।


মূল কাহিনি হতে আরেকটি স্বাতন্ত্র্য এই নাটকে লক্ষণীয়। টডের ইতিহাসে বাইরের

শত্রুর প্ররোচনায় উদয়পুর, রানা ও তাঁর পরিবরের করুণ কাহিনী বর্ণীত হয়েছে। এই

কাহিনীকে গ্রহণ করলে কৃষ্ণকুমারী গ্রিক নাটকের মত একমুখীন হয়ে পড়ত। কিংবা

শেক্‌সপিরীয় ধারায় চারিত্রিক ত্রুটি লক্ষিত হয়নি। এখানে আঘাত এসেছে বাইরের

লোভ ও লোভের দুর্নিবার আকর্ষণ ও জাতি বৈরিতার দ্বন্দ্ব ও ঈর্ষা প্রকাশে৷


নাটকে ঘটনায় মানসিকতার জন্য নাট্যকার ট্রাজেডি ও কমেডি দুই ধারায় মিশ্রণ


ঘটিয়েছেন। "Never strive to be comic in tragedy" – কিন্তু নাটকে হাস্যরস সৃষ্টির


যদি অবকাশ থাকে, তাও পরিহার করা উচিত নয়। বৈচিত্র্য সৃষ্টির জন্য নাটকে কমগুরুত্বপূর্ণ দৃশ্যে কমেডির অবতারণা করা যেতে পারে। মধুসূদনের মতে এ ছিল

শেক্‌সপিয়রের পরিকল্পনা। তবে তিনি তাঁর ট্রাজেডিতে ইচ্ছাপূর্বক কমেডির সুর আনতে

চেষ্টা করেন নি। নাটকে বৈচিত্র্য সৃষ্টির জন্য তিনি প্রথম ও চতুর্থ অঙ্কে লঘু রসাত্মক

জয়পুররাজ, ধনদাস, বিলাসবতী ও মদনিকার কাহিনি এনেছেন।


ট্র্যাজেডি : আধুনিক বাংলা সাহিত্যের পিতৃপুরুষ বা প্রবাদপুরুষ মাইকেল মধুসূদন

দত্ত (১৮২৪–১৮৭৩) বাংলা কাব্যের মত নাট্যসাহিত্যে ও পাশ্চাত্য তথা য়ুরোপীয়

নাট্য সাহিত্যের আঙ্গিককে সচেতনভাবে অনুসরণ করে মৃত্যুঞ্জয়ী নাট্যকার হতে

চেয়েছিলেন। আর সে উদ্দেশ্যেই রচনা করেছিলেন 'কৃষ্ণকুমারী' (১৮৬১)) "If this

tragedy be success. It must ever remain as the foundation stone of our

national theatre


সার্থক ট্র্যাজেডি নাটক রচনার কৃতিত্ব অর্জনের আগ্রহে মধুসূদন মেঘনাদবধ কাব্য,

রচনা স্থগিত রেখেই কেশব গঙ্গোপাধ্যায়ের নির্দেশে এক মাসের মধ্যে রাজস্থানের একটি

কাহিনী অবলম্বন করে তিনি 'কৃষ্ণকুমারী' নাটক রচনা করেন। তিনি য়ুরোপীয় ট্র্যাজেডি

নাটকের রূপ-রীতি, ভাব-ভাবনা ও রস সচেতনভাবে আত্মস্থ করে ছিলেন। বিশেষ করে

এরিস্টটলের সাহিত্য সম্পর্কে তাঁর জ্ঞান যেমন ছিল সুগভীর, তেমনি অনুরাগ ও ছিল


এরিস্টটলের সাহিত্য আদর্শকে তিনি আদর্শরূপে গ্রহণ করেছিলেন এর প্রমাণ

পাওয়া যায় রাজনারায়ণ বসুর প্রতিলিখিত তাঁর চিঠিতে। সে চিঠিতে তিনি এরিস্টটলের...

সাহিত্য তত্ত্বের অনুসরণে কাহিনী, চরিত্র, ভাব ও ভাষার বিশ্লেষণই বেশি পছন্দ করতেন

এবং সেই অনুসারেই তিনি যে তাঁর ট্রাজেডি নাটকের কাহিনী, চরিত্র, ভাব ও ভাষা সৃষ্টি

করতেন একথা বলাই বাহুল্য |


এরিস্টটলের মতে, ট্র্যাজেডি হলো নির্দিষ্ট দৈর্ঘ্য বিশিষ্ট, স্বয়ংসম্পূর্ণ ও গম্ভীর ঘটনার

অনুসরণ ৷ এই ঘটনাকে নাট্যকার কার্যকারণ ধারায় উপস্থাপিত করেন এবং পরিণামে

তা দর্শক মনে ভীতি ও করুণার সৃষ্টি করে মানসিক সাম্য আনয়ন করেন। এরিস্টটলের

মতে, ট্র্যাজেডির নায়ক অসাধারণ গুণবান ও ন্যায়পরায়ণ হবেন না। তিনি হবেন "The

intermediate of person age"| অর্থাৎ মাঝামাঝি স্তরের ব্যক্তি। আর শেক্সপীয়রের

নাটকে অভিজাতও সংশজাত। গ্রিক ট্র্যাজেডিতে নিয়তি দ্বারা নায়কের জীবনের

মর্মান্তিক বিপর্যয় নেমে আসে। এর প্রমাণ ইডিপাস নাটকের নায়ক ইডিপাসের

পিতৃহত্যা ও মাতাকে বিবাহ। আর শেক্সপীয়রের রীতিতে শুভ ও অশুভের মধ্যে দ্বন্দ্ব

সংঘটিত হয়। শুভ শক্তির আত্মদানের ও বিপর্যয়ে শেষ পর্যন্ত অশুভ শক্তির পরাজিত


শেক্সপিয়র ট্যাজেডিতে নায়ক চরিত্রের একদেশ-দর্শিতা নায়কের বিপয়ের মূল

কারণ নায়ক চরিত্রের সামান্য ভুল-ত্রুটি তার জীবনকেই বিপর্যস্ত করে তোলে।


মধুসূদন তাঁর পত্রাবলিতে বারংবার শেক্সপিয়রের নাটকের কথা উল্লেখ করেছেন

কিন্তু কখনো গ্রিক নাটকের প্রসঙ্গ উল্লেখ করেননি। অথচ তাঁর নাটকে গ্রিক ট্র্যাজেডির

প্রভাব অধিকতর। গ্রিক নাটকে কাহিনির একমুখীন প্রবাহ, বিষাদের সুর পরিব্যাপ্ত এবং

নিয়তির অদৃশ্য অঙ্গুলিসংকেত অনিবার্য পরিণতি এ নাটকের মূল কাহিনীতে প্রত্যক্ষ করা

যায়। এ নাটকের ‘কৃষ্ণকুমারী' 'ও ভীমসিংহ; বিষাদের প্রতিমূর্তি। সমগ্র নাটকের মধ্যে

কৃষ্ণকুমারীর নিয়তি যেন অদৃশ্য একটি পরিত্ররূপে অবস্থান করেছেন এবং তারই চক্রান্তে

রাজকুমারীর শোচনীয় মৃত্যু, কৃষ্ণকুমারী চেয়েছে মানসিংহকে পতিরূপে পেতে

চেয়েছিল, কিন্তু এই প্রত্যাশা এনে দিয়েছে সম্পূর্ণ বিপরীত ফল – যার কাছে সে একান্ত

অসহায়। দুর্ভাগ্য যেন কৃষ্ণাকে আরম্ভ থেকেই নিজের জন্য চিহ্নিত করে রেখেছে।


এ নাটকের নাট্যকার ধনদাস মদনিকার চরিত্রের মাধ্যমে বিচিত্রমুখিতা সৃষ্টি

করেছেন বটে, কিন্তু তারা মূল কাহিনীর সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে সংশ্লিষ্ট নয়, প্রাসঙ্গিক নয়।

মূল কাহিনি প্রথম হতে অনিবার্য প্রবাহে পরিণামের দিকে অগ্রসর হয়েছে। গ্রিক

ট্র্যাজেডিতে কোনো গৌণ কাহিনী মূল প্রবাহে আক্ষিপ্ত হয়ে কোনো তরঙ্গমালা সৃষ্টি করে

না। এই নাটকের প্রথমেই আমরা রাজমহিষী ও রানী ভীমসিংহের মুখে বিষাদের ছাপ

সুস্পষ্ট। মহিষী অজ্ঞাতসারে পদ্মিনী দেবীর প্রসঙ্গ উত্থাপন করে নিয়তির বাণী ব্যক্ত

করেছেন। রাজা ভীমসিংহ ও তার পরিবারের ও দেশের আসন্ন দুর্যোগের ইঙ্গিত

দিয়েছেন। কুমারী কৃষ্ণাকে মধুসূদন বলেছেন— Dignified yet gentled এ নাটকে

মদনিকা অত্যন্ত চাতুর্যতার সঙ্গে মানসিংহের প্রতি কুমারী কৃষ্ণার মনকে ধাবিত করেছে।

এর ফলে কৃষ্ণকুমারীর যে বিপদ দেখা দিবে তা উপলব্ধি করে শঙ্কিত চিত্তে মদনিকা

বলেছেন এ যেন দাবানলের রূপ ধরে এ সুলোচনা কুরুঙ্গিনীকে দগ্ধ না করে।

এখানে ও সেই বিষাদের সুর ও নিয়তির সংকেত। ট্রাজেডির পক্ষে যে সংঘাত কাম্য,

তার প্রকাশ হয়েছে মেবারের রা ভীমসিংহের কন্যা বিবাহোপলক্ষে জগৎসিংহ ও

মানসিংহের বিরোধের মধ্যে দিয়ে। এই বিরোধ সমগ্র দেশ ও জাতিকে বিচলিত করেনি।

নাটকের পক্ষে চরিত্রের যে পরিবর্তন বা বিকাশ সাধন একান্ত প্রয়োজন, সে সম্পর্কে

মধুসূদন সতর্ক ছিলেন না। ফলত ঐতিহাসিক ট্র্যাজেডির বিস্তৃতি একদিকে যেমন

কৃষ্ণকুমারী' নাটকে নেই, ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডির গভীরতাও তেমনিভাবে পরিস্ফুট হয়নি।


কুমারী কৃষ্ণা ছিলেন পরমা সুন্দরী। তার সম্পর্কে রাজা জগৎসিংহের মন্তব্য

করেছেন তা অপূর্ব–“কোন ঋষি বধের অভিশাপে এ জলধিতলে এসে বাস করেছেন।

কিংবা মদনিকা ও বিলাসবতীর ভাষায় “আমি বলি, এমন রূপ লাবণ্য পৃথিবীতে আর

কোথাও নাই । অথচ এরকম সুন্দরী নারীর জীবনে হঠাৎ করে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তির পত্র

কৃষ্ণার জীবনে হঠাৎ অভিসম্প্রাতের মতো দুর্বিপাক নেমে এসেছে। শয়ন মন্দিরে

** খুড়তাত বলেন্দ্র সিংহের আবির্ভাবেও তার নিকট হতে উদয়পুরের বিপদ হেনে তিনি

পদ্মিনীর নির্দেশ মতো আপনার জীবন বিসর্জন দিলেন। পিতা-মাতার শত চেষ্টাতেও

কন্যাকে রক্ষা করা সম্ভব হয়নি। মৃত্যু তার নিকট বিভীষিকার বস্তু নয়। 'সকলের ভাগ্যে

মৃত্যু যশোদায়ক হয় না, সেই মৃত্যু তাঁর নিকটে অমরত্বের বার্তাবহ রূপে দেখা দেয়ায়

তিনি প্রসন্ন চিত্তে গ্রহণ করলেন। এভাবে কৃষ্ণকুমারীর আত্ম বলিদানে নাটকের

পরিসমাপ্তি হয়েছে। এ নাটকের সঙ্গে ইউরিপিডিসের Iphigenia in Sulas নাটকের

ইফিজেনিয়ার সঙ্গে কৃষ্ণকুমারী প্রবল সাদৃশ্য রয়েছে। কিন্তু গ্রিক নাটকে জীবনের মূলে

গভীর একটা বেদনাবোধ, যা প্রচ্ছন্নভাবে নিঃসহায়তার ভীতিরূপে আত্মপ্রকাশ করেছে,তা 'কৃষ্ণকুমারী' নাটকে অনুপস্থিত। আগামেনন, ক্লাইটেমনেস্টা ও ইফিজেনিয়ার সামনে

যে জটিল সমস্যা এবং দিগন্ত ব্যাপী জীবন-জিজ্ঞাসা তার উত্তর দিয়েছেন ইউরিপিদিস

এবং চরিত্রগুলো সেখানে বিভিন্ন প্রবৃত্তির সংঘাতে এবং মগ্নচেতন জৈব বৃত্তির বলিষ্ঠ

প্রকাশে ভার।


রানাডীমসিংহ প্রথম হতেই আমরা দেখতে পাই তিনি অসহায় ও দুর্বল চিত্তের

মানুষ। তিনি নাটকের নায়ক। কিন্তু তার চরিত্রে না আছে একদেশ দর্শিতা, না আছে

বিরূপ ভাগ্যের বিরুদ্ধে তীব্র সংগ্রাম। তাঁর চরিত্রের মধ্যে ট্র্যাজিক নায়কের একমুখিতা

নেই; আবার অন্যদিকে যুক্তিতর্ক, দার্শনিক উপলব্ধিও নেই। অর্থাৎ কিংলিয়র বা

হ্যামলেটের সঙ্গে তাঁর সাদৃশ্য অসম্ভব। অথচ ভীমসিংহের কাতর পিতৃহৃদয়, রাজকর্তব্য

ও বাৎসল্যের অন্তর্দ্বন্দ্বতার মধ্য দিয়ে সার্থকভাবে তা দেখানো যেত। প্রতিরোধ শক্তির

অভাবে ভীমসিংহ ট্র্যাজেডি অভীস্পিত ট্র্যাজিক ব্যক্তিত্ব লাভ করেনি।


অবশ্য নাটকের গঠনে মধুসূদন ট্র্যাজেডির ভাব যথাসাধ্য রক্ষা করেছেন।

রাজনারায়ণ বসুকে লেখা চিঠিতে দেখা যায় "There is some attempt at pathes in

that book also.!' কৃষ্ণকুমারী নাটকের শেষাংশে ভীমসিংহের উন্মতায়, কৃষ্ণকুমারীর

আত্মহননে এবং দৃশ্যের অন্তরালে অহল্যাদেবীর মৃত্যুতে শোকভাব উত্তাল প্রভৃতি বিষয়

নাটকের শোকান্ত পরিণামের প্রস্তুতি হিসেবে প্রশংসনীয় নয়। নাট্য পরিকল্পনায় কোথায়

যেন একটা ত্রুটি আছে বলে মনে হয়। সম্ভবত দর্শকের কথা ভেবেই ধনদাস

মদনিকারের দৃশ্যগুলোকে কিছুটা কৌতুকপূর্ণ করে তোলা হয়েছে—কিন্তু মধুসুদন

নৈপুণ্যের সঙ্গে দৃশ্যগুলোকে ভাববস্তুর সাথে যুক্ত করে দিয়েছেন এবং মদনিকার প্রতি

তাঁর ব্যক্তিগত পক্ষপাত থাকা সত্ত্বেও তাকে একটা জায়গায় থামিয়ে দিয়েছেন।


‘কৃষ্ণকুমারী, নাটক সার্থক ট্র্যাজেডি নয়, কিন্তু নাটক হিসেবে ব্যর্থ হয়নি । মধুসূদন

সাহিত্যের অন্যতর ক্ষেত্রে স্বকীয় প্রদর্শন প্রকাশে সক্ষম হয়েছেন। কিন্তু নাটকে তার

অভাব রয়েছে আসলে মধুসূদন তাঁর স্বীয় প্রতিভা যা বন্ধনমুক্তি এবং বিদ্রোহের মধ্যে

সমুজ্জ্বল তার প্রকাশ হয়নি। তিনি এর জন্যে আমাদের সমাজের অভিনেতা ও মঞ্চকে

দোষ দিয়েছেন এবং এই অভিযোগ কিছুটা প্রাসঙ্গিকও বটে। মেঘনাদবধ কাব্যের চরিত্র

সৃজনে তিনি আপন হৃদয়ের অভিজ্ঞতা এবং কবি প্রাণের বেদনাও উল্লাসকে প্রকাশ

করেছেন; সেখানে তার স্বকীয়তার স্বতঃপ্রকাশ রয়েছে; কিন্তু 'কৃষ্ণকুমারী' নাটকে

য়ুরোপীয় ট্র্যাজেডির প্রচলিত নকশার উপর হাত মক্স করা হয়েছে। পরবর্তী বাংলা

নাট্যকাররা একই ভ্রান্তির শিকার হয়েছেন। এর ফলে কাহিনীর ভেতরে জীবন ও জগৎ

সম্পর্কে সর্বোব্যাপী হাহাকার কখনও বাংলা ট্র্যাজেডিতে ফুটে ওঠেনি। মধুসূদন অবশ্য

ট্র্যাজেডীর একটি উন্নততর আদর্শ প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু বহিরঙ্গে ক্ষেত্রে

তিনি সফল হয়েছেন (মধুসূদন 'কৃষ্ণকুমারী' নাটকের এ ব্যর্থতা সম্পর্কে অবহিত ছিরেন

তার প্রমাণ আছে তাঁর পত্রাবলিতে।উপযুক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায়, মধুসূদন বাংলা সাহিত্যে ট্রাজেডির নাটক

রচনায় সাফল্য লাভ করতে না পারলেও বাংলা নাটকের একটি উন্নতরূপ দিতে সক্ষম

হয়েছেন। তিনিই প্রথম বাংলা নাটকে সচেতনভাবে ট্র্যাজেডির বিষয়ও আঙ্গিক নিয়ে

পরীক্ষা করেছেন।


গঠনকৌশল :

 'কৃষ্ণকুমারী' নাটকের পুর্বে বাংলা সাহিত্যে যে সব নাটক রচিত

হয়েছে, সে সব নাটকের গঠনকৌশল অত্যন্ত ত্রুটি ছিল। সেগুলোর বেশির ভাগই

সংলাপ সর্বস্ব আখ্যান মাত্র। কাহিনী বৃত্ত রচনার কোন প্রয়াস দেখা যায় না। কতকগুলো

বিন্নি দৃশ্য পরম্পরায় সমাবেশ যার মধ্যে অন্তর্নিহিত কোন যোগ সূত্র নেই। উপন্যাসের

গঠন শিথিল হতে পারে, সেখানে একটি চরিত্রকে অবলম্বন। কিন্তু নাটকের মধ্যে পূর্ব

পরিকল্পনা মতো কাহিনী বৃত্ত রচনা করা প্রয়োজন। সাধারণত কেন্দ্রীয় দ্বন্দ্ব বস্তুকে

অনুসরণ করে কাহিনীর অগ্রসর এবং নাটকের বিচ্ছিন্ন দৃশ্যগুলো অন্তরঙ্গ সম্পর্কে

সংযুক্ত। উদ্দেশ্যমূলক নাটকে অবশ্য অনেক সময়ে বিশেষ একটি দৃশ্যের জন্যেই একটি

দৃশ্যের রচনা, যেমন—“নীলদর্পণ” কিন্তু এর ফলে নাটক হিসেবে তা দুর্বল হতে বাধ্য ।

ঘটনার পরম্পরাই নাটকে বৃত্ত রচনা করে। মধুসূদনের কৃষ্ণকুমারী নাটকে আমরা

সর্বপ্রথম নাটকীয় কাহিনীর সাক্ষাৎ পেলাম এবং কৃষ্ণকুমারী নাটকের গঠনে স্থাপত্য

সুলভ অঙ্গ সৌষ্ঠব বিদ্যমান রয়েছে।


কৃষ্ণকুমারী মূলত ট্র্যাজেডি নাটক। প্রথম অঙ্কের প্রথম গর্ভাঙ্কের জগৎসিংহ

কৃষ্ণকুমারীর চিত্রপট দর্শন করে তাকে বিবাহ করায় বাসনা ব্যক্ত করলেন; কিন্তু বিচক্ষণ

মন্ত্রী নারায়ণ মিশ্র জানতেন অরুদেশের অধিপতি মানসিংহ তৃষ্ণকুমারীর পাণিপ্রার্থী

জগৎসিংহের সাথে মানসিংহের এমনিতেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা রাখছে এর সাথে সংযুক্ত হলো

এই ঘটনা। জগৎসিংহ মন্ত্রীর সৎ পরামর্শ অগ্রাহ্য করে মানসিংহের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত

হতে কুণ্ঠা প্রকাশ করলেন না এখানেই ট্র্যাজেডির বীজ উপ্ত করা হলো। এই বীজ

অঙ্কুরিত, পল্লবিত ও ফুলে ফলে শোভিত হওয়ায় ব্যাপারে মদনিকা ও ধনদাস সহায়তা

করেছে। এই বিরোধেরাই অনিবার্য ফলাফল বতিয়েছে কৃষ্ণার মৃত্যুতে।


কৃষ্ণকুমারী নাটকের কাহিনী বৃত্ত পাঁচ অঙ্কে বিভক্ত এবং সাধারণভাবে বলা যায়

নাটকের পঞ্চসঞ্চি পাঁচটি অঙ্কে অবস্থান করেছে। কাহিনীর পরিণাম সুনিশ্চিতভাবে সূচিত

হয়েছে তৃতীয় অঙ্কে, যেখানে কৃষ্ণকুমারীর মনে মানসিংহের প্রতি অনুরাগ ভীম সিংহের

কাছে মানসিংহের দূত প্রেরণ / মহারাষ্ট্রের অধিপতি মানসিংহের পক্ষে যোগদান এবং

সর্বোপরি স্বপ্নে পদ্মিনী কর্তৃক আত্মবিসর্জনে উৎসাহ প্রদান নাটকের Turning point

নির্দেশ করেছে। চতুর্থ অঙ্কে বিমর্ষ সত্তা এবং পঞ্চম অঙ্কে সমাপ্তি উপসংহতি।

মধুসূদন গর্ভাঙ্কের বৈচিত্র পছন্দ করতেন। আবার স্থান ও কালের ঐক্য সম্পর্কে

তিনি লিখেছেন—Yet I like to preserve unity of place and as for as I can that

of time also. প্রথম অঙ্কের দুটি গর্ভাঙ্কের স্থান (জয়পুর। প্রথমটি রাজগৃহ ও দ্বিতীয়টিবিলাসরতীর গৃহ। এ দুটি দৃশ্যের কাল একটি দিন। জগৎসিংহ ধনদাসকে বলেছেন—

(তুমি মন্ত্রীর নিকট গিয়েই অদ্যেই যাতে যাত্রা করা হয় এমন উদ্যোগ করগে ।”

দ্বিতীয়াঙ্কের তিনটি গর্ভাঙ্কের স্থানও উদয়পুর। এখানেও কালগত ঐক্য রক্ষিত

হয়েছে। একটি দিনের মধ্যে ঘটনাবলি অনুষ্ঠিত হয়েছে, চতুর্থাঙ্কের তিনটি গর্ভাঙ্কের_


ঘটনাস্থল জয়পুরের রাজগৃহ বিলাসবতীর গৃহ ও নগর প্রান্তের রাজপথ, সম্মুখে,


দেবালয়। এই অঙ্কে ঘটনাবলি তিনদিনে অনুষ্ঠিত হয়েছে।


পঞ্চমাঙ্কের তিনটি গর্ভাঙ্কের স্থান উদয়পুর। এই অঙ্কে বর্ণিত ঘটনাবলি সকাল

থেকে রাত্রি, দুই প্রহরের মধ্যে অনুষ্ঠিত হয়েছে ।


বিভিন্ন অঙ্কে ঘটনাবলির সংস্থাপনের মধ্যে নাট্যকারের চাতুর্যের পরিচয় পাওয়া

যায়। প্রথম অঙ্কে মধুসূদন অত্যন্ত সুকৌশলে মূল কাহিনী উপস্থাপিত না করে,

উপকাহিনী সৃষ্টি করেছেন এবং এর মাধ্যমে মূল কাহিনীতে উদয়পুরের রাজপরিবারের

আসন্ন দুর্যোগের ইঙ্গিত দিয়েছেন। জয়পুরের মন্ত্রী জগৎসিংহকে অন্তর্দ্বন্দ্বে নিজেকে

জড়াতে বারণ করেছেন। কিন্তু ধনদাসের চাতুর্যে তিনি সংঘর্ষ করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা ঘোষণা

করলেন। ফলে নাটকের গতিপ্রবাহ জয়পুর হতে উদয়পুরের দিকে ধাবিত হলো।

নাটকটির প্রথম অঙ্কে লালসা, ধনলোভী, প্রেম, ঈর্ষা ও রাজমর্যাদার প্রতিষ্ঠা ইত্যাদির

বিষয় নাটকে ধীর গতিতে শুরু হলেও মানসিংহের প্রতিদ্বন্দ্বিতার আভাস পাওয়া যায় ।


দ্বিতীয়াঙ্কের উদয়পুরের রাজমহিষীর কাছে ভীমসিংহের নিরূপায় অবস্থা জানা যায় ।

মহিষী ও তপস্বিনী কৃষ্ণার বিবাহের বিষয় উত্থাপন করলেন। ইতোমধ্যে জয়পুরের

দূতের আগমন ঘোষিত হলো। জগৎসিংহ কৃষ্ণার প্রতি পাণিপ্রার্থী হবার মনোভাব ব্যক্ত

করেছেন। অন্যদিকে মানসিংহের আকর্ষণ সৃষ্টি করেছে। রাজকুমারীর পাণিগ্রহণ করার

জন্য দুই রাজার প্রতিযোগিতা এই নাটকের ঘটনা প্রবাহের আবর্ত সৃষ্টি করেছে। এই

ইঙ্গিত পাওয়া যায় ভীমসিংহের উক্তিতে— “আমি শুনেছি যে কোন কোন সাগরে ঝড়

অনবরতই থাকে; তা এদেশেরও কি সেই দশা ঘটল]”


দ্বিতীয়াঙ্কের ঘটনাপ্রবাহ হতে আমরা তৃতীয়াঙ্কের চরম উৎকর্ষে উপনীত হই।

ঘটনার প্রবাহ এখানে আরো দ্রুত ও আবর্ত সংকুল এবং অনির্দেশক পরিণামের দিকে

ধাবমান। তপহিনী দুশ্চিন্তাগ্রস্ত এবং মদনিকা তার কৃতকর্মের জন্য শঙ্কিত। মহারাষ্ট্রের

অধিপতি মানসিংহের পক্ষ অবলম্বন করায় উদয়পুরে নতুন বিপদ ঘনীভূত হয়েছে।

কৃষ্ণার সামনে পদ্মিনীর আবির্ভাব ও কুলের মর্যাদা রক্ষাকল্পে তাকে উৎসাহ প্রদান

নাটকের মধ্যে মৃত্যুর ছায়া সঞ্চারিত করেছে। অর্থলোভী ধনদাস জগৎসিংহের দূত রূপে

উদয়পুরে এসেছিল। সুতরাং বিবাহ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান হওয়ার ফলে তার মনে মহারাজার

মর্যাদা হানি নিয়ে কোন বিরূপ মনোভাব দেখা যায় নি।


চতুর্পাঙ্কের রাজা জগৎসিংহের মানসিক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। ধনুদাসের চাতুর্য

ধরা পরায় রাজা তাকে দেশ হতে বহিষ্কারের নির্দেশ দেন। বিলাসবতী রাজার প্রতি

গভীর অনুরাগ ও ধনদাসের বিপর্যয় বর্ণিত হয়েছে। এর সাথে মূল কাহিনীর কোন

সংযোগ নেই। তৃতীয়াঙ্কের চরম উৎকর্ষের পরে মানসিক বিশ্রামের জন্য এই অঙ্কটি

নাট্যকার এনেছেন। কার্যকারণ সূত্রে এই অঙ্ক বিবৃত না হওয়ায় নাট্যগত ঐক্য সমগ্র পূর্ণ

হয়ে উঠতে পারে নি।


পঞ্চম অঙ্কে ভীমসিংহের অসহায় অবস্থা, রানার মানসিক অস্থিরতা, প্রকৃতির রূপ

পরিবর্তন, ভয়াল মূর্তি ধারণ, পদ্মিনীর পুনরাবির্ভাব, বলেন্দ্রসিংহের রাজ্যাদেশ পালনে

অসামর্থ, কৃষ্ণকুমারীর আত্মহত্যা ও মহিয়সীর মৃত্যু— এদের মাধ্যমে বেদনা আক্ষিপ্ত হয়ে

এক অতিতীব্র ও গভীর কারুণ্য পাঠক মনকে অভিভূত করে ফেলে।(


ঐতিহাসিক নাটক : রেনেসাঁসের সাথে গভীরভাবে জড়িত ঐতিহ্যচেতনা, অতীত

জিজ্ঞাসা। জগৎ ও জীবনের পরিধি বিস্তীর্ণ ক্ষেত্রে প্রসারিত হয়, প্রাচীনের সাথে

বর্তমানের যোগাযোগ ঘটে। ঊনবিংশ শতাব্দিতে বাংলাদেশে রেনেসাসের পূর্ণ প্রকাশ

প্রত্যাশিত নয়। তবুও তার আংশিক লক্ষণাতেও অতীত সম্বন্ধে কৌতূহল প্রবলভাবে

লক্ষিত হয়েছে। এলিজাবেথীয় রেনেসাঁসে ইতিহাসের প্রতি আগ্রহ প্রকাশ পায় এবং

টিলিয়ার্ড এর দুটি প্রধান কারণ নির্দেশ করেছেন। প্রথম অতীত ইতিহাস অবলম্বনে

ভবিষ্যৎ জানবার চেষ্টা, অর্থাৎ ইতিহাসের সতর্কবাণীতে গ্রহণ এবং দ্বিতীয়ত অতীতের

গৌরবোজ্জ্বল চরিত্র ও ঘটনাকে স্মরণের মধ্য দিয়ে আদর্শবাদের প্রচেষ্টা।


আমরা জানি ইতিহাস কাহিনী থেকে ঘটনা, চরিত্র ও বিষয় গ্রহণ করে যে নাটক

রচিত হয় তাকে ঐতিহাসিক নাটক বলে ইতিহাস স্থান-কাল-পাত্রের গন্ডিতে আবদ্ধ।

একটি সীমিত কালের সাময়িক অভিজ্ঞতাকে প্রকাশ করা ইতিহাসের মধ্যে। ঐতিহাসিক

নাটক লিখতে হলে ইতিহাসের স্বরূপ-প্রকৃতি, তার মর্মরহস্য ও বিপুল প্রবাহকে যেমন

হৃদয় দিয়ে অনুভব করে অনুভূতির সত্যে পরিণত করতে হবে। তেমনি ভাবতে হবে

সেই দূরকালের নরনারীর আনন্দ বেদনার কথা। ইতিহাসের বিশেষ তথ্যকে সাহিত্যের

নির্বিশেষ মতো পরিণত করেন শিল্পী। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন ইতিহাসের সত্য ও

সাহিত্যের সত্য এক নয়। ইতিহাসের সত্য, রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, “বিশেষ সত্য'

অন্যদিকে সাহিত্য (নিত্য সত্যে'র প্রকাশ। ঐতিহাসিক উপন্যাস বা নাটকে ইতিহাসের

সত্যকে অবিকৃত রেখে সাহিত্যের রস পরিবেশন করতে হবে। বরীন্দ্রনাথের মতে,

(ঐতিহাসিক রস সঞ্চার করার সাফল্যের উপরেই ঐতিহাসিক নাটকের কৃতিত্ব নির্ভর

করে এই ঐতিহাসিক রসের সংমিশ্রণেই প্রাত্যহিক ও পরিচিত সত্যগুলি চিত্ত বিস্ফোরক

দূরত্বও বৃহত্তর লাভ করে। সাহিত্যে “ঐতিহাসিক রস” সৃষ্টির নিমিত্তে প্রয়োজন কবি

কল্পনা। যদিও রবীন্দ্রনাথ বলেছেন—“সেই সত্য যা রচিবে তুমি—ঘটে যা তা সব সত্য,

নহে। কবি, তব মনোভূমি রামের জন্মস্থান, অযোধ্যার চেয়ে সত্য জেনো “ঐতিহাসিক

উপন্যাস বা নাটককে ইতিহাস অবলম্বন মাত্র ইতিহাসের সত্যকে পরিবর্তন করা যাবে

না। কিন্তু ইতিহাসের সম্ভাবনার সদ্ব্যবহার করতে হবে। ইতিহাসের মধ্যে যে অংশগুলো

ফাঁকা, স্বাধীন করার যোজনায় তাকে ভরাট করতে হবে।

শেক্সপিয়রের ঐতিহাসিক বা বঙ্কিমচন্দ্রের ঐতিহাসিক উপন্যাস আজও আমাদের

আকর্ষণ করে কেন? শেক্সপিয়র তার ঐতিহাসিক নাটকগুলোতে ব্যক্তিগত পক্ষপাতের

পরিচয় দেননি এবং ইতিহাসের বিবৃতিমূলক কাহিনিতে তিনি সৃজনীকল্পনার সাহায্যে শুষ্ক

তথ্যকে জীবনরসে মণ্ডিত করেছেন। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ইতিহাসের কাঠামো বা

পটভূমির ওপর মানবজীবনের যে ছবি এঁকেছেন। তার জন্যই তাঁর উপন্যাস কালজয়ী,

ঐতিহাসিক তথ্য চিত্রণের জন্য নয়। ইতিহাসে যাঁর উল্লেখ মাত্র নেই, তাকে ইতিহাসের

তথ্য তাঁর শিল্পাদর্শের নির্মোঘ নিয়মানুষী সৃষ্টি করার মধ্য দিয়েই তাঁর দিব্য দৃষ্টির পরিচয়।

পাওয়া যায়। বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রে যে ইতিহাস কথাটি সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তার

করেছে তা হলো কর্নেল জেমস টডের লেখা অ্যানালস অ্যান্ড অ্যান্টিকইটস অফ

জমনী এই গ্রন্থটি অবলম্বনে রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায় “পদ্মিনী উপ্যান ই প্রথম

ইতিহাস অশ্রয়ী বাংলা আখ্যান কাব্য এবং এই ধারা অনুসারেই পরবর্তীকালে কাব্য

নাটক ও উপন্যাস রচিত হয়ে থাকে।


– মধুসূদন রঙ্গলালকে গভীরভাবে চিনতেন। অভিনেতা কেশব গঙ্গোপাধ্যায়

মধুসূদনকে রাজপুত জীবন নিয়ে নাটক লিখতে অনুরোধ করেছিলেন। মধুসূদন প্রথম

বাংলা ভাষায় ঐতিহাসিক নাটক রচনা করলেন, “কৃষ্ণকুমারী” নাটক। রাজনারায়ণ

বসুকে মধুসূদন বলেছিলেন, ("The plot is taken from tod. VOL. I. P-461USuppose

you are well acquainted with the story of the unhappy princes kissen

kumassh মধুসূদন “কৃষ্ণকুমারী” নাটক রচনাকালে যতদূর সাধ্য টডের বর্ণিত

আখ্যানকে অনুসরণ করেছেন এবং তাঁর পক্ষে অন্যতর কোন সূত্র থেকে ঐতিহাসিক

তথ্য সংগ্রহ সম্ভব ছিল না। মধুসূদন গভীর নিষ্ঠার সাথে টডের ইতিহাস অনুসরণ

করেছেন যেখানে তাঁর বিচ্যুতি ঘটেছে তা নাটকের প্রয়োজনে ঘটেছে। তবে তিনি কোন

গটনাকে পরিবর্তন করেন নি। তিনি কেশবচন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায়কে কৃষ্ণার জীবনাবসান

ঘটল তার পরিচয় মধুসূদন রহস্যাবৃত রেখেছেন। কিন্তু এ ছিল নবাব আমির খাঁ

প্রেরিত। বলাবাহুল্য ইতিহাসের পটভূমি, চরিত্র এবং কাহিনীর ফলশ্রুতি মধুসূদন

অবিকৃত রেখেছেন, কাজেই “কৃষ্ণকুমারী নাটক”কে ঐতিহাসিক নাটক বলা যায় ।


জগৎসিংহ সম্পর্কে মধুসূদন বলেছেন, "I have tried to represent juggat sing_

as I find him in history.] আসলে ধনদাসকে তিনি শেক্সপিয়রের উথেলো নাটকের

ইয়াগোর মত সৃষ্টি করেন নি তার প্রমাণ মধুসূদনের মন্তব্য— "As for Dhanadass, I

never dreamt of making him the counterpart of yago. আখ্যানে এরূপ চরিত্র

সৃষ্টির ও কোন অবকাশ নেই। পূর্বেই উল্লেখ করেছি ধনদাস একজন সাধারণ দুষ্ট

প্রকৃতির ধনলোভী মানুষ। বলেন্দ্রসিংহকে তিনি শেক্সপীয়রের "King John" নাটকের

Bastard রচতি সাদৃশ্যে অঙ্কিত করেছেন রানা ভীমসিংহের মহিষী গম্ভীর ও বিষাদে পূর্ণ

চরিত্র এবং কুমারী কৃষ্ণা অভিজাত বংশের কোমল চরিত্র। ইফেজেনিয়া চরিত্রের সাথে

কৃষ্ণকুমারীর সাদৃশ্য রয়েছে।মানসিংহকে না দেখে তাঁর প্রতি কৃষ্ণার আকর্ষণ মধুসূদনের কল্পিত। তিনি লিখেছেন যে, এই জাতীয় কাহিনী, is by no means uncommon in our own ancient or fable কৃষ্ণকুমারী চরিত্রকে মানবিক গুণে পরিপূর্ণ করার জন্য তিনি এ history ধরনের কাহিনী সৃষ্টি করেছেন। এতে ইতিহাসের ঘটনা সমৃদ্ধতর হয়েছে।


মধুসূদন টডের ইতিহাস হতে মেবারের এমন এক সংকটপূর্ণ অধ্যায় নির্বাচন করেছেন, যা তার চরম দুর্ভাগ্যের কাহিনি ব্যক্ত করে। কৃষ্ণার অকালমৃত্যু শোকাবহ ও নিষ্ঠুর ঘটনা সন্দেহ নেই; কিন্তু এর ব্যঞ্জনা ব্যাপকতর। এর মধ্য দিয়ে মেবারের নির্বাপিত প্রায় শেষ ম্লান রশ্মিটুকুর মিলিয়ে যাবার করুণ কাহিনী ব্যক্ত হয়েছে। কৃষ্ণার আত্মবিসর্জন জাতির চরম সংকটের সাথে সমন্বিত হয়ে এই নাটকের ট্র্যাজেডির রস পরিণামকে কারুণ্যে ও ভীতিতে পূর্ণ করে তুলেছে। রানা ভীমসিংহ স্বখেদে তপস্থিনীকে বলেছেন—'ভগবতী, এ ভারতভূমির কি আর সে শ্রী আছে। এদেশের পূর্বকালীন বৃত্তান্ত সকল স্মরণ হলো, আমরা যে মনুষ্য, কোন মতেই এ বিশ্বাস হয় না। বলেছেন— "To complicate the plot by the introduction of one or two more charactes (male), would be complicate it in every sense of the word; for you must remenber that the play is a historical one and to introduce battles and political discus sions would be to astonish the weak senses of the audience and the reader."


রাজা ভীমসিংহ ইতিহাসের ব্যক্তিত্ব নিয়েই “কৃষ্ণকুমারী নাটকে” উপস্থিত হয়েছেন—বিষাদমগ্ন, গম্ভীর, কৃষ্ণকুমারী সরলা কুসুম কোমল বালিকা। জগৎসিংহ লঘু প্রকৃতি বিলাসী। বলেন্দ্ৰসিংহে গাম্ভীর্য ও লঘুতার মিশ্রণ। ধনদাস চতুর দুর্বৃত্ত। ভীমসিংহের পত্নী রানী অহল্যা প্রথম থেকে পর্যন্ত ভীমসিংহ, বেদনা ভারাক্রান্ত। বিলাসবতী প্রেমবিলাসী। মদনিকা অস্থির প্রাণোচ্ছল অসাধারণ বুদ্ধিমতি | তপস্বিনীর চরিত্র অপরিস্ফুট তবে নাটকীয় কাহিনীর পক্ষে তাঁর প্রয়োজন আছে।


** জয়পুরের রাজা জয়সিংহের একজন উপপত্নী ছিল। টডের কাহিনীতে তার নাম কর্পূর মঞ্জুরী। মধুসূদন তার নাম দিয়েছেন বিলাসবতী। তার চরিত্রে অভিমান ও ঈর্ষা সৃষ্টি করে তাকে নায়িকা কৃষ্ণকুমারীর বিপরীত দিকে স্থাপন করেছেন। মধুসূদন কাহিনীকে জটিল করার জন্য বিলাসবর্তী চরিত্রটিকে প্রাধান্য দিয়েছেন; বিলাসবতীর স্বার্থেই মদনিকার চক্রান্ত, মানসিংহ কর্তৃক কৃষ্ণাকে বিবাহের ইচ্ছা প্রকাশ, দ্বন্দ্বের সূচনা ও তীব্রতা । বিলাসবর্তী চরিত্রটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক নয়। মধুসূদন পত্রে লিখেছেন—"This জগৎসিংহ of জয়পুর had a favourite mistress Tod gives her name as the Essence of comphor, I think we may bring her in and allow her jealousy full play"


এ নাটকে মদনিকা যে দাবানল সৃষ্টি করেছে তা কল্পিত কাহিনী। কিন্তু উভয় রাজার মধ্যে কৃষ্ণকুমারীকে লাভ করবার আশায় যে সংঘর্ষ বেঁধেছিল তা টড বর্ণনা করেছেন। আবার মানসিংহের সাথে নবাব আমীর খাঁ আর মহারাষ্ট্রপতি মাধবজী যোগদান করে উদয়পুর রাজ্যে চরম বিপর্যয় সৃষ্টি করেন। যে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তির পত্র নিয়ে রাজকুমারী

ইউরিপিসিয়ে তাঁর The Trojan Women'1 নাটকে ব্যক্তিজীবনকে আশ্রয় করে যেরূপ

সুন্দরী ট্রয়নগরীর পতন কাহিনী রচনা করেছেন, মধুসূদনও সে রকম কৃষ্ণকুমারীর

কাহিনির আশ্রয়ে মেবার বা চরম দুর্ভাগ্যের চিত্র অঙ্কন করেছেন।

(অহল্যা উপস্থিনী, ধনদাস এরা ঐতিহাসিক চরিত্র নয়। কিন্তু ঐতিহাসিক সম্ভাবনা

প্রসূত। কাহিনীর অগ্রগতিতে এদের প্রয়োজন অনস্বীকার্য। এর কখনো নিজেদের সীমা


অতিক্রম করেনি।

মধুসুদনের মদনিকা_ চরিত্রটির ব্যবহার সম্পর্কে সংগত প্রশ্ন উঠতে পারে। এই

অনৈতিহাসিক চরিত্রকে তিনি এত বেশি প্রাধান্য দিলেন। দুরাজার চক্রান্তের প্রত্যক্ষ

ফলের জন্য না অন্য কারণে। আসলে মদনিকার চরিত্রটি সম্পর্কে মধুসূদনের দুর্বলতা

ছিল। তিনি একটি পত্রে লিখেছি লেন—That madanika is my favourite. এই

মদনিকা মধুসূদনকে মুগ্ধ করেছে, বিপথে চালিত করেছে। মধুসূদন অবশ্য ভেবেছিলেন

ঐতিহাসিক চরিত্রের ক্ষেত্রেই কল্পনার আশ্রয় নেওয়া দোষের, অনৈতিহাসিক চরিত্রের

ক্ষেত্রে কল্পনার অবাধ বিস্তার ক্ষমাই। পরবর্তীকালেও বাংলা ঐতিহাসিক নাটকের

অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই নীতির প্রয়োগ দেখি।


আসলে “কৃষ্ণকুমারী” নাটকের সবচেয়ে দুর্বলতা নাট্যকারের ইতিহাস বোধের

অভাব। মধুসূদন অবশ্যই টডের কাহিনিকে বিকৃত করতে চাননি, কিন্তু সেই কাহিনির

নাট্য—সম্ভাবনাকেও তিনি কাজে লাগাতে সক্ষম হননি | ঐতিহাসিক নাটকের সার্থকতা

বর্তমানের সাথে যোগ্য তা না হলে সে কাহিনির কোন ঐতিহাসিক মূল্য নেই।

"কুষ্ণকুমারী নাটক" এর ঐতিহাসিক চরিত্রগুলোকে মধুসূদন ব্যক্তিত্ব মণ্ডিত করে

তোলেননি।


নাট্যকারের কল্পনা সম্ভবত উদ্দীপ্ত হয়নি বলেই হৃদয়ের উত্তাপে সজ্জীবিত হয়ে উঠে

না। ইতিহাসের সাথে যেন এই চরিত্রগুলোর যোগ নিতান্ত শিথিল। এবং এখানেই

নাটকটির শোচনীয় ব্যর্থতা মধুসূদন টডের রাজস্থান থেকে শুধু কাহিনি অংশটুকুই গ্রহণ

করেছিলেন, কিন্তু তার প্রকৃত তাৎপর্য যে রাজপুত্র জীবন সন্ধ্যায় বিলীয়মান সূর্যরশ্মির

রক্তিমাভা। তা নাটকে সঞ্চারিত করতে পারেনি।


“কৃষ্ণকুমারী নাটক” এ রাজপুত ইতিহাসের অষ্টাদশ শতাব্দির সেই ঝঞা বিক্ষুব্ধ

আবহাওয়া ফোটেনি, গৃহবিবাদ, ব্রহিঃশত্রুর আক্রমণ, অস্তিত্ব রক্ষার প্রাণান্তকর চেষ্টা,

একদিকে অপমানের গ্লানি, অন্যদিকে আত্মসম্মান বোধ এসব কিছু মিলে অতি তীব্র

সংঘাতপূর্ণ সেই যুগকে মধুসূদন পটভূমি হিসেবে স্থাপন না করে, সামাজিক জীবনের

ছোটখাট লোভ, ঈর্ষা, বিবাদ বিসংবাদকে নাটকের পটভূমি হিসেবে গ্রহণ করেছেন ফলে

“অ্যান্টনি এবং ক্লিওপেট্টা” নাটকে রবীন্দ্রনাথ যে, একটি চিত্ত বিষ্কারক দূরত্ব ও বৃহত্ত্ব।

লক্ষ্য করেছেন “কৃষ্ণকুমারী নাটক” তা থেকে বঞ্চিত। “কৃষ্ণকুমারী নাটক” এ

ঐতিহাসিক আবহাওয়া সৃষ্টি হয়নি ফলে কাহিনির মধ্যে শুধু চমৎকারিত্বের অভাব

ঘটেনি, সেই সাথে নাটকীয়তার ও অভাব অনিবার্য হয়েছে।

পরিশেষে আমরা বলতে পারিম মাইকেল মধুসূদন দত্তের “কৃষ্ণকুমারী" ঐতিহাসিক

নাটক হিসেবে সম্পূর্ণ সার্থক না হলেও নাটক হিসেবে তা সার্থক একথা নির্দ্বিধায় বলা

যায়।


অগ্রধান চরিত্র:

 মানব-মনীষার তীক্ষ্ণ ক্ষুরধার কবি ও নাট্যকার মাইকেল মধুসূদন

দত্ত সম্পূর্ণ নতুন আঙ্গিকে বাংলা সাহিত্যে তাঁর পদচারণা শুরু করেন। যে বাঙালি সমাজ

অলীক ও কুনাট্যে মশগুল থাকত সেই বাঙালি সমাজের সম্মুখে বাস্তব ও সুনাট্য উপহার

দিলেন। মধুসূদন নাটক রচনার পূর্বে পাশ্চাত্য নাটক বিশেষত গ্রিক ও শেক্সপিরীয়

ট্রাজেডি নাট্যতত্ত্ব অত্যন্ত মনোযোগ সহকারে পাঠ করেছিলেন এবং তা ভালভাবে আত্মস্থ

করেছিলেন। তিনি সর্বপ্রথম বাংলা সাহিত্যে ট্র্যাজেডি নাটকের রূপ ও রস জেনে

“কৃষ্ণকুমারী" নাটক রচনায় প্রবৃত্ত হন। যদিও তিনি তা সফলতার সঙ্গে প্রয়োগ করতে

পারেননি। এজন্য অবশ্য তিনি দায়ী করেছেন বাঙালি অভিনেতা, মঞ্চ ও সমাজকে। এ

নাটকে যে সমস্ত ঘটনার উল্লেখ রয়েছে। তা ঘটেছিল ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে বা

অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগে। এ নাটকটি মধুসূদনের শ্রেষ্ঠ নাটক। নাটকে চরিত্র

চিত্রণের জন্য মধুসূদন 'টডের ইতিহাস' থেকে কৃষ্ণকুমারী, ভীমসিংহ, জগৎসিংহ ও

বলেন্দ্র সিংহকে নিয়েছেন। কিন্তু এসব চরিত্র অঙ্কনে মধুসূদন সফলতা লাভ করতে

পারেননি। অথচ যে দুটি চরিত্র তিনি ইতিহাস থেকে ঋণ নেননি | দুটি চরিত্র অর্থাৎ

ধনদাস ও মদনিকা চরিত্রাঙ্কনে সফলতা পেয়েছেন।


ধনদাস : ‘কৃষ্ণকুমারী’ নাটকে ঘটনার গতি প্রধানত নিয়ন্ত্রণ করেছে অলক্ষিত দৈব

শক্তি,—কিন্তু মঞ্চে যারা সবচেয়ে সজীব, চমৎকারিত্ব সৃষ্টিতে অপার উদ্যম,

অনৈতিকহাসিক চরিত্র হয়েও যারা মূল কাহিনিকে বহুলাংশে পরিচালিত করেছে তারা

হলো–ধনদাস ও মদনিকা। জগৎসিংহের তাবৎ দুষ্কর্মের সহায় ও তাঁর স্তাবক ধনদাস ।

ধনদাসই কৃষ্ণকুমারীর চিত্রপট এনে জগৎসিংহের মনে রূপ-লালসা সৃষ্টি করেছে এবং

তার ফলে কৃষ্ণকুমারী জীবনে বিপর্যয় নেমে এসেছে। ধনদাস অত্যন্ত বুদ্ধিমান, নিজের

বুদ্ধির উপর তার গভীর আস্থা রয়েছে। তার চরিত্রের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে—

অর্থলোলুপতা। এর প্রমাণ পাওয়া যায় তার উক্তিতে—


* 'আমরাও রাজ অনুচর; তা আমরা যদি রাজপূজায় অর্থ লাভ না করি তবে আর

কিসে করব।' এ নাটকে ধনদাস কৃষ্ণকুমারীর ক্ষতি করতে চায়নি ঠিকই, কিন্তু অর্থের

জন্য তাও করতে বিমুখ হতো না। সততা, কৃতজ্ঞতা, নীতিবোধ প্রভৃতি কিছু তার চরিত্রে

বিদ্যমান ছিল না। তার জীবনদর্শন ভারি চমৎকার–


“আরে এ কালে কি নিতান্ত সরল হলে কাজ চলে, কখন বা লোকের মিথ্যা গুণ

গাইতে হয়, কখন বা অহেতু দোষারোপ কত্যে হয়; কারও বা দু'টো অসত্য কথায় মন

রাখতে হয় আর কারু মধ্যে বিবাদ বাধিয়ে দিতে হয়......... অর্থাৎ যেমন করে হৌক

আপনার কার্য উদ্ধার করা চাই।'

এই ব্যবহারিক বুদ্ধি দিয়েই ধনদাস জিততে চেয়েছিল। জগৎসিংহকে কৃষ্ণকুমারীর

প্রতি অনুরক্ত করার পেছনে অর্থ লাভের সঙ্গে সঙ্গে আরও একটি উদ্দেশ্য ছিল, তা হে

নিরাশ্রয় বিলাসবতীকে লাভ। কিন্তু উদয়পুরের মদনিকা তার কাল হয়ে দাঁড়ায়। জগৎ

সিংহের বিবাহ অভিলাষ ব্যর্থ করার জন্য সে যেমন কৃষ্ণার মানসিংহের প্রতি অনুকূল

করেছে, তেমনি অন্যদিকে ধনদাসকে ছদ্মবেশে ঠকিয়ে অঙ্গুরীয়টিকে হাত করেছে। যে

ধনদাস দম্ভে মনে মনে বলত


[যাকে বিধাতা বুদ্ধি দেন, তাকে সকলেই দেন। কিন্তু প্রকৃতির কি লীলা –

মদনিকার বুদ্ধির কাছে ধনদাস পরাস্ত হল। মদিনকা–ধনদাসকে ে


এখন টের পেলেও, যে সকলেরই উপর আছে ।।

বিলাসবতীর প্রতি ধনদাসের আকাঙ্ক্ষার মূলেও রয়েছে ধনলোভ। বলেছে

এ মাগীর কাছে রাজদত্ত যে সকল বহুমূল্য রত্ন আছে তার কাছে সে কোথায়


বিলাসবতী যখন মনস্থির করলো ধনদাসের কৃতকর্ম সম্পর্কে রাজাকে জ্ঞাত করবে


তখন সে বলেছে


“এখন যে তুমি এই রাজ্যে ইন্দ্রানীর সুখ ভোগ কচ্যো, সেটি কার প্রাসাদে?”]

ধনদাস দুষ্ট বেদের ন্যায় তার পাখাটিকে ফাঁদ পেতে সোনার পিঞ্জরে আবদ্ধ করে

রেখেছে।


রাজার কাছ থেকে অহঙ্কারী ধনদাসের মনে গভীর অনুশোচনা সৃষ্টি হয়েছে। সে

নিজের আত্মবিশ্লেষণ করে বলেছে—'আমারই কর্মের দোষ। পাপ কর্মের প্রতিফল এই

রূপেইত হয়ে থাকে । হায়! হায়। লোভে মদে মওঁ হলে লোকের কি জ্ঞান থাকের


ধনদাসের মনোজগতে এত বিরাট পরিবর্তন আমাদের মনে প্রশ্ন সৃষ্টি করে।

মধুসূদন ধনদাস চরিত্রের এই পরিবর্তনকে কেন অনিবার্য মনে করলেন? নীতি উপদেশ

দেয়াই কি মধুসূদনের উদ্দেশ্য ছিল? শিল্পীর যে নিরাসক্তি, যে নির্মমতা মধুসূদনের

অন্যান্য চরিত্রে লক্ষ্য করা গেছে কিন্তু, ধনদাস চরিত্র সৃষ্টিতে তার অভাব অত্যন্ত স্পষ্ট।

ধনদাসের নীচতা ও ক্ষুদ্রতাকে তিনি ক্ষমা করতে পারেননি, সেজন্য বিধাতার কাছে

ক্ষমতা প্রার্থনা করিয়েছেন। ধনদাস চরিত্রের মধ্যে দিয়ে দুর্বৃত্ত চরিত্রের যে আদর্শ তিনি

স্থাপন করতে পারতেন, তা থেকে তিনি বিরত রইলেন। ফলে কৌতুক সৃষ্টি ছাড়া অন্য

কোনো উদ্দেশ্যই ধনদাস সিদ্ধ করতে পারেনি ।।


মদনিকা : কৃষ্ণকুমারীর শোচনীয় পরিণতিকে তরান্বিত করতে ধনদাসের চেয়ে

মদনিকাই বেশি সক্রিয় ও সফল ভূমিকা পালন করেছে। সে কৃষ্ণকুমারীর নামে রাজা

মানসিংহকে জাল প্রেমপত্র লিখেছে; রাজা মানসিংহের জাল চিত্রপট দিয়ে কৃষ্ণকুমারীকে

প্রতারিত করেছে। তার ভাষায়—(ত্র ও মানসিংহের কোন পুরুষের প্রতিমূর্তি নয়। নাই বা হল, বয়ে গেল কি?

কাটের বিড়াল হৌক না কেন, ইঁদুর ধরতে পাল্যেই হয় |


ধনদাস ও মরুদেশের দূতের মধ্যেও সে বিবাদ সৃষ্টি করেছে। এ কাজগুলো

নীতিসঙ্গত এমন বলতে পারি না। কিন্তু তা সত্ত্বেও মদনিকার প্রতি নাট্যকারেরসহানুভূতি অতিপ্রগাঢ় হওয়ার ফলে তার প্রতি দর্শক কোনো বিদ্বেষ অনুভব করেনি।

এবং এই সহানুভূতি প্রকাশ পেয়েছে মদনিকার অন্তর্জগতের রূপায়ণে। মদনিকা

বিলাসবতীর সহৃদয় সখী; এ নাটকে আমরা দেখতে পাই মদনিকা যা কিছু করেছে তা **

নিজের উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য নয়, বিলাসবর্তীর মঙ্গলের জন্য। বিলাসবতীর *

দুঃখে তার দুঃখবোধ স্বতঃস্ফূর্ত ও অকৃত্রিম। কৃষ্ণকুমারীর বিপদ আশঙ্কা করেও সে

‘বাহ কি গোলযোগই বাধিয়ে দিয়েছে। তখন জগদীশ্বর এই করুণ যেন এতে

রাজনন্দিনীর কোন ব্যাঘাত না জন্মে।......... কিন্তু এসুকুমারী রাজকুমারীর প্রকৃতি দেখে

আমার মনটা এমন হলো কেন?'—অন্যত্র

হে পরমেশ্বর, এই যে আমি বনে আগুন লাগিয়ে চললেম, এ যেন দাবানলের রূপ –

ধরে এ সুলোচনা কুরঙ্গিনীকে দগ্ধ না করে। প্রভু, তুমিই একে কৃপা করো।

এইখানেই মদনিকা চরিত্রের বিশিষ্টতা। মদনিকা নিজের বুদ্ধি সম্পর্কে গৌরব বোধ

করে। ধনদাসকে পর্যুদস্ত করায় তার পরম আনন্দ। মদনিকা শুধু নিজের বুদ্ধির গৌরবে

গৌরবান্বিত নয়, হয়তো তার নিজের মনের অগোচরে হৃদয়ের গৌরবও প্রকাশ পেয়েছে

এবং এই উভয়ের মিশ্রণেই মদনিকা অসামান্য হয়ে উঠেছে। যে মদনিকা ধনদাসকে

লাঞ্ছিত করার মধ্যে সুখবোধ করে, সেই মদনিকা ধনদাসের দুঃখে দুঃখবোধ ব্যক্ত করে।মদনিকার উক্তিতে

"তোমার দুঃখে আমি যে কি পর্যন্ত দুঃখী হয়েছি, তা তোমাকে আর কি বলবো?

ধনদাস,

আমি ভাই সতী স্ত্রী নই বটে, কিন্তু আমার নারীর প্রাণ বটে—হাজার হউক,

পরের দুঃখ দেখলে আমার মনে বেদনা হয়।”


মদনিকা ন্যায় পথে, সত্য পথে না চললে, তার অন্তরে কিছু সদৃদ্গুণ লুক্কায়িত

অবস্থায় ছিল—"There is some soul of goodness in things evil, would men

observingly distance it out'— এই কারণেই কৃষ্ণকুমারী নাটকের সমালোচকেরা

একটি গুরুতর ভ্রান্তির বশবর্তী হয়েছেন, তাঁদের মতে—

‘মদনিকা চরিত্র মধুসূদনের প্রিয় ছিল বলিয়া সে গুরুতর অন্যায় করা সত্ত্বেও শেষ

পর্যন্ত তিনি তাহাকে শাস্তি দেন নাই, অথচ ব্যর্থ ও বিফল ধনদাসকে অপমানিত, শাস্তি

ও বিপর্যস্ত করিয়াছেন।” মদনিকার প্রতি নাট্যকারের সহানুভূতির কথা আমরা পূর্বে

উল্লেখ করেছি, কিন্তু ধনদাস নিজে অর্থাৎ ধনদাসের মধ্যে "We are shown a thing

absolutely evil, and what is more dreadful power.] এবং এ থেকে আমরা বুঝতে


পারি মদনিকা কেন মধুসূদনের বেশি প্রিয় ছিল।

অঘটন ঘটন পটিয়সী মদনিকা চরিত্রের প্রভাবে পরবর্তীকালে বঙ্কিমচন্দ্রের

'রাজসিংহ' উপন্যাসের নির্মলকুমারী চরিত্র অঙ্কিত হয়। গিরিশচন্দ্রের ‘সিরাজদৌল্লা’


নাটকের দরিয়া বিবি চরিত্রের মধ্যে ও অসংখ্য প্রভাব আছে।


উপর্যুক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায়, ‘কৃষ্ণকুমারী’ নাটকের কাহিনীতে ধনদাস

–ও মদনিকা চরিত্র দুটি যেখানে প্রয়োজন সেখানেই শেষ হয়েছে, সেখানেই এদের কথা

ও সমাপ্ত হয়েছে। মধুসূদন এ দুটি চরিত্র অঙ্কনে সবচেয়ে বেশি সফলতা অর্জন করেছেন

এবং এ দুটি চরিত্রের মাধ্যমে তৎকালীন সমাজ মানসের চিত্র পরিস্ফুটিত হয়েছে।

-পরিচয়


রচনাকাল–সেপ্টেম্বর, ১৮৬৯ খ্রীঃ।


প্রকাশকাল–১ম সংস্করণ– ১২৬৮ খ্রী, আগষ্ট।


৩য় সংস্করণ–১৮৬৯ খ্ৰীঃ আগষ্ট।

মুদ্রণ ব্যয় মহারাজা যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর বহন করেন।


অভিনয়


১। শোভাবাজার নাট্যশালা-৮ই ফেব্রুয়ারী, ১৮৬৭, খ্ৰীঃ


২। জোড়াসাঁকো নাট্যশালা


৩। ন্যাশনাল থিয়েটার-২২শে ফেব্রুয়ারী, ১৮৭৩ খ্ৰীঃ

৪। গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটার ২৪শে জানুয়ারী, ১৮৭৪ খ্ৰীঃ

প্রেরণা—মধুসূদন বেলগাছিয়া নাট্যশালার সর্বপ্রধান অভিনেতা কেশবচন্দ্র

গঙ্গোপাধ্যয়ের অভিনয়নৈপুণ্য ও নাটকীয় দোষ-গুণ-বিচার-শক্তিতে মুগ্ধ ছিলেন।

কেশববাবু মধুসূদনকে লিখিয়াছিলেন—“রাজপুত জাতির ইতিহাস এরূপ বিস্তৃত ও

বৈচিত্র্যপূর্ণ যে মধুসূদনের ন্যায় প্রতিভাবনা পুরুষ তাহা হইতে অনায়াসেই গ্রন্থ রচনার

উপযোগী উপাদান সংগ্রহ করিতে পারেন।” ইহা হইতেই মধুসূদন 'কৃষ্ণকুমারী’ রচনায়

প্রণোদিত হইয়াছিলেন।


সঙ্গীতাংশ—'...Set Jotinder Buboo (মহারাজ যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর) to write the

songs. He is sure to do justice to the play-Don't depend upon me, for I am

going to plunge deep into Heroie Petry again."


–কেশবচন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায়ের নিকট মধুসূদনের পত্র ।

পরিকল্পনা—"In the Sarmista, I often stepped our of the path of the


Dramatist, for that of the mere poet. I often forgot the real in search of the

poetical. In the present play I mean to establish a vigilant guard over myself.

I shall not look this way or that way for poetry; if I find her before me I shall

not drive her away; and I fancy. I may safely reckon upon coming across her

now and then. I shall endeavour to creat characters who speak as nature sug

gests and not mouth-mere poetry."

"I write under very different circumstances. Our social and moral devel

opments are of a different character.-But hang all Philosophy. I shall put

down on paper the thoughts as they sproing up in me, and let the world say

what it will."


—মধুসূদনের পত্রাবলী

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ