Hot Posts

6/recent/ticker-posts

লালসালু উপন্যাসের আলোচনা

 

---লালসালু উপন্যাসের আলোচনা 

লালসালুর চরিত্র 

lalshalu uponnash alochona সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ 

Lalshalu বাংলা উপন্যাস উপন্যাসের বিষয়বস্তু  মজিদ চরিত্র জমিলা ----

**বিঃদ্র-বাংলা বিভাগের সকল পড়াশোনা পেতে ব্লগটিতে যুক্তথাকুন https://monoweredu13.blogspot.com/?m=1 

লালসালু ও সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্

'লালসালু' সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর প্রথম উপন্যাস – কিন্তু এই রচনাটিকে আমরা একজন

উচ্চাভিলাষী লেখকের দুঃসাহসী প্রচেষ্টা বলে অভিহিত করতে পারি। আধুনিক ও

নাগরিক রুচি ও মননের অধিকারী লেখক তখন কলকাতার অভিজাত ইংরেজি সংবাদপত্র

Statesman-এর সাংবাদিক এবং ঐ সময়ে নাগরিক মধ্যবিত্তের জীবন নানা ঘাতপ্রতিঘাতে

অস্থির ও চঞ্চল। স্বাধীনতা ও পাকিস্তান আন্দোলন, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, দেশ বিভাগ,উদ্বাস্তু সমস্যা আবার একই সঙ্গে নতুন রাষ্ট্র গঠনের উদ্দীপনা সব মিলিয়ে মধ্যবিত্তের জীবনে এক দুরন্ত ক্রান্তিকাল । ঐ সময় একজন নবীন লেখকের পক্ষে তাঁর চারদিকের

পরিচিত জীবন ও মানুষ নিয়ে উপন্যাস লেখাই স্বাভাবিক ও সহজতর ছিলো। কিন্তু সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ সে পথে গেলেন না। তিনি এমন একটি পটভূমি ও মানুষের সমাজ

বেছে নিলেন যার অবস্থান সমসাময়িকতা থেকে যেমন, তেমনি প্রত্যক্ষতা থেকেও দূরের।

শহরবাসী মধ্যবিত্ত জীবনের ঘাতসংঘাতময় বিষয়গুলোর সঙ্গে বাংলা সাহিত্যের একটি সহজ যোগাযোগ আছে। সাহিত্যের জগতে মধ্যবিত্ত জীবন খুবই পরিচিত। কিন্তু সেটিই সমগ্র দেশের পরিচয় নয়। গ্রাম প্রধান আমাদের বৃহত্তর দেশ ও সমাজ। বেশির

ভাগ লোকই গ্রামে থাকে সেখানেই তাদের বাঁচা-মরা এবং জীবনযাপন । সেই সমাজে

এমন এক রীতিনীতি ও ধারণা বিশ্বাস জন্ম লাভ করে লালিত হয়ে চালু থাকে যাশহরবাসী শিক্ষিত লোকের অভিজ্ঞতার বাইরে। অথচ দুঃসাহসী লেখক তাঁর প্রথম

উপন্যাসের পটভূমি চরিত্র এবং বিষয় সবই গ্রহণ করলেন সেই গ্রামীণ জীবন থেকে।তাঁর উপন্যাসের পটভূমি প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল এবং তার সমাজ চরিত্র, একদিকে

কুসংস্কারাচ্ছন্ন ধর্মভীরু শোষিত দরিদ্র গ্রামরাসী, অন্যদিকে শঠ, প্রতারক ধর্মব্যবসায়ীএবং শোষক ভূস্বামী। আর তাঁর উপন্যাসের বিষয় যুগ যুগ ব্যাপী শিকড়-গাড়া

কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস ও ভীতির সঙ্গে সুস্থ জীবনাকাঙ্ক্ষার দ্বন্দ্ব ।'লালসালু তে প্রত্যক্ষ বাস্তবতাই প্রধান লেখক আমাদের এমন এক গ্রামীণ সমাজে

নিয়ে যান যেখানে যুগ যুগ ধরে মানুষের মনের চারিদিক ঘিরে আছে অসম্ভব শক্ত অথচ অদৃশ্য একটি বেষ্টন মানুষ যেখানে সমস্ত কিছুই ভাগ্য বলে মেনে নেয়। অলৌকিকত্বে

যেখানে তার অগাধ বিশ্বাস সমস্ত ঘটনার মধ্যেই দৈবশক্তির লীলা দেখতে পায় সে,আর তাতে ভয় পায় এবং শ্রদ্ধা ভক্তিতে কখনো কখনো আপ্লুতো হয়ে পড়ে। কাহিনি যতোই উন্মোচিত হতে থাকে ততোই দেখা যায় “শস্যের চাইতে টুপীর সংখ্যা বেশি।”কেবলি কুসংস্কার আর অন্ধ বিশ্বাস সেই সঙ্গে তার অনিবার্য পরিণতি ভীতি এবং

আত্মসমর্পণ। বিরুদ্ধে যায় না কেউ গেলে তার ধ্বংস অনিবার্য হয়ে ওঠে। লেখক

দেখান, এ এমনই সমাজ যার পরতে পরতে কেবলি শোষণ আর শোষণ দেশের, মনের এবং সামগ্রিক জীবনের প্রতারণা, শঠতা আর শাসনের জটিল এবং সংখ্যাবিহীন শিকড় জীবনের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত ছড়ানো। আর ঐসব শিকড় দিয়ে জীবনের প্রাণরস কেবলি

শুষে নেয়া হয়। আনন্দ, প্রেম, প্রতিবাদ, সততা এই সব বোধ এবং বুদ্ধি ঐ অদৃশ্য দেয়াল ঘেরা সমাজের ভেতরে প্রায়শই গ্রাসিত হয়ে হজম হয়ে যায়। দেখা যাবে, অন্য

কোথাও নয়, আমাদের দেশেরই ভেতরে এ সমাজের অবস্থান। বাংলাদেশের যে কোনো প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে সমাজের ভেতর ও বাইরের চেহারা এই রকমই।

আবার এই সামাজিক অবস্থারও একটি বিপ্রতীপ দিক আছে। আর তা হলো মানুষের প্রাণধর্মের দিকটি। মানুষের প্রাণধর্মটি কী? না মানুষ ভালোবাসে, স্নেহ করে, কামনা

বাসনার উদ্বেল হয় আবার ক্ষেত্র বিশেষে উল্লাসে উচ্ছ্বাসে একবারে ফেটে পড়ে। নিজের

স্বাভাবিক ইচ্ছা ও বাসনার কারণেই সে নিজেকে আলোকিত ও বিকশিত করতে যায়।সংস্কার যতো শক্ত হোক, অন্ধ বিশ্বাস যতো দৃঢ় হোক, ভীতি যতো আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধেরাখুক প্রাণ ধর্মের সহজ প্রেরণা সমস্ত কিছু ছিঁড়ে ফেড়ে বেরিয়ে আসবে। যদি সফল নাও

হয় দ্বন্দ্বটি কখনোই পরিত্যক্ত হয় না। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে চলতে থাকে হয়তো মুখোমুখি দ্বন্দ্বটা আমরা হতে দেখি না তবে হয়। মানব সম্পর্কের ভূমিতে হয়, দৈনন্দিন ও পারিবারিক জীবনে হয় এবং কখনো কখনো হয় একই ব্যক্তির মনোলোকেও।

এমতাবস্থায় সংস্কারের ও অন্ধবিশ্বাসের প্রতারণার এবং শোষণের সামাজিক অবস্থানটি

যদি বাস্তব হয়, তাহলে তার বিরুদ্ধে মানবিক প্রাণধর্মের স্বাভাবিক উত্থান-জনিত দ্বন্দ্বটি অধিকতর বাস্তব। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ এই দ্বন্দ্বময় সামাজিক বাস্তবতার চিত্রই এঁকেছেন তাঁর 'লালসালু' উপন্যাসে।

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ মানবতাবাদী লেখক। মানুষের মুক্তি এবং বিকাশ হোক এই আকাঙ্ক্ষা যে তাঁর সাহিত্য রচনার পশ্চাতে সক্রিয় ছিল এ বিষয়ে দ্বিমতের অবকাশকম। আমাদের দেশের সামাজিক বাস্তবতায় যা মানুষের বিকাশের পথে অন্তরায়

সেগুলোকে তিনি চিহ্নিত করেছেন, দেখিয়েছেন কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাসের কি প্রচণ্ড দাপট। সরল ও ধর্মপ্রাণ মানুষকে কীভাবে বিভ্রান্ত ও ভীত করে শোষণের প্রক্রিয়া চালুরাখা হয় তারই বর্ণনা তিনি দিয়েছেন 'লালসালু' উপন্যাসে। তাঁর আক্রমণের লক্ষ্য ধর্মবিশ্বাস নয়— ধর্মের নামে প্রচলিত কুসংস্কার। তিনি সেই সমাজের বর্ণনা দেন যেখানে

মুসোর চেয়ে টুপী বেশি, ধর্মের আগাছা বেশি ধর্ম মানুষকে কল্যাণের পথে নিয়েএসেছে কিন্তু কুসংস্কার এবং অন্ধবিশ্বাস ধর্মের মূল ভিত্তিটাকেই করে দিয়েছে দুর্বল।

মানুষের মনকে আলোকিত তো করেই ন রং করে তুলেছে অন্ধকারাচ্ছন্ন এবং ভীত।সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর আঘাত সেইখানে। স্বার্থ এবং লোভের বশবর্তী হয়ে একশ্রেণীর

লোক যে কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাসকে টিকিয়ে রাখার জন্য –লেখক সামাজিক বাস্তবতার সেই চিত্রটি তাঁর 'লালসালু' উপন্যাসে দেখিয়েছেন।


গভীর মনোযোগ এবং অত্যন্ত যত্নের কাজ এই 'লালসালু'। গতানুগতিক ঘটনা নির্বাচন ও বিন্যাসের পথ ধরে অগ্রসর হননি লেখক। নরনারীর প্রেমের ঘটনা নেই

একটিও। দুই প্রতিপক্ষের প্রত্যক্ষ দ্বন্দ্ব-সংঘাতের ঘটনাবহুল কাহিনীও ফুটিয়ে তোলা

হয়নি এই উপন্যাসে। অথচ জীবনেরই চেহারা দেখাতে চান তিনি। মানুষেরই কাহিনি বলবেন বলে তাঁর অভিলাষ। ফলে চরিত্র ও ঘটনার সেই সব গূঢ় ও রহস্যময় ক্রিয়া

প্রতিক্রিয়াগুলো দেখতে ও দেখাতে হয়েছে তাঁকে যা জীবনকে চালায় এবং থামায়। যে ঘটনা বাইরে ঘটে তার উৎস কোথায়? না মানুষের মনে লোভ, ঈর্ষা, বিশ্বাস, ভয়,

প্রচুর কামনা এইসব প্রবৃত্তি ও বাসনা মানুষের মনে আছে বলেই বাইরের বিচিত্র সব ঘটনা ঘটে। ধর্ম ব্যবসায়ীকে ভয় পায় মানুষ। কেন? না তাঁর বিশ্বাস, লোকটির পেছনে

রহস্যময় একটি দৈবশক্তি কাজ করছে। আবার ধর্ম ডগুটির ভয় কিসে? না কে জানে,

কখন কোন মানুষ স্বাভাবিক প্রেরণা ও বুদ্ধিবলে তার প্রতাপ ও প্রতিষ্ঠার ভিত্তিটাকে

ধসিয়ে দেবে। মানুষের মনের নানান প্রবৃত্তির ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াগুলোই লেখকের বর্ণনার

বিষয় হয়ে ওঠেছে 'লালসালু'তে।

এমনিতেই উপরি কাঠামোর সাধারণ বিচারে আমরা বলতে পারি যে 'লালসালু'

একখানি সামাজিক সমস্যামূলক উপন্যাস। অশিক্ষিত দরিদ্র ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন গ্রামবাসীর

সরলতা ও ধর্ম বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে এক ভণ্ড ধর্ম ব্যবসায়ী তার জটিল কুটিল ছলনাজাল বিস্তার করে কীভাবে নিজের শাসন ও শোষণের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করেছে তারই

বিবরণ দেয়া হয়েছে 'লালসালু' উপন্যাসে। কাহিনিটি বড় নয়— কিন্তু এর বিন্যাসটিএকই সঙ্গে জটিল এবং মজবুত ঘটনা বেশি নেই, কিন্তু এমন ধরনের বিশ্লেষণমূলক

বিস্তার লক্ষ করা যায় প্রতিটি ঘটনার পেছনে যে, তাতেই সাধারণ কাহিনি এবং ঘটনা

দুই-ই অসামান্য এবং তাৎপর্যময় হয়ে ওঠে।


উপন্যাসের চরিত্র চিত্রণ, সামাজিক প্রেক্ষাপট ইত্যাদি সম্পর্কে আলোচনা---

লালসালুর নায়ক মজিদ

মজিদ নামক শীর্ণদেহ ব্যক্তিটির একদিন নাটকীয়ভাবে আগমন ঘটলো মহ্বতনগর

গ্রামে। তার আগমনটি নাটকীয় এইজন্য যে তাকে যখন মাছ ধরার সময় প্রথম দেখে

তাহের ও কাদের, তখন সে “মতিগঞ্জ সড়কের উপরেই... আকাশ পানে হাত তুলে

মোনাজাত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে।” ঐ লোকটিকেই ফের দেখা যায় গ্রামের মাতব্বর

খালেক ব্যাপারীর ঘরে। সে তখন সমবেত গ্রামবাসীকে ক্ষিপ্ত হয়ে ভৎসনা করছে,

কারণ তারা এক বুজর্গের মাজার অনাদরে অবহেলায় ফেলে রেখেছে। তার গালাগালের

প্রতিবাদ কেউ করে না। বরং লজ্জায় আধোমুখ হয়ে থাকে সবাই মনে হয়, সমগ্র

গ্রামখানিই যেন অপরাধ রোধে আক্রান্ত।

মজিদ ঐ সময় নিজের আগমনের কারণ বোঝাবার জন্য একটি গল্প ফাঁদে। তাতে


জানায় যে, সে গারোদের দেশে পরম সুখে ধর্মকর্ম নিয়ে দিনাতিপাত করেছিলো,

একদিন এক বুজর্গ ব্যক্তি স্বপ্নে দেখা দিয়ে তার মাজারের দুরাবস্থার কথা জানালে সে

আর স্থির থাকতে পারেনি সুখের জীবন ত্যাগ করে চলে এসেছে এই অচেনা

জায়গায়। এই গল্পটি জানানো হয়ে গেলে সে গ্রামপ্রান্তে জোপ জঙ্গলের মধ্যে একটি

ভাঙ্গা পরিত্যক্ত কবর আবিষ্কার করে সেটিকে 'লালসালু'তে ঢেকে দেয় এবং গ্রামের

লোকদের বোধবুদ্ধি স্তম্ভিত করে অতি সহজেই সকলের মনকে নিজের কব্জায় এনে

ফেলে। কবরটির ওপর যেমন, তেমনি নিজের ওপরেও সে অলৌকিকত্ব আরোপ করে।

ফলে অতি সহজেই তার আয়ত্তের মধ্যে এসে যায় প্রভাব প্রতিপত্তি এবং প্রতিষ্ঠা।

গ্রামের দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় তার এখন উপস্থিতি এবং সকল ক্ষেত্রে তার শাসন প্রায়

অনিবার্য হয়ে ওঠে। খালেক ব্যাপারীর সঙ্গে স্বার্থ এবং সখ্যতার সম্পর্ক নিবিড় হতে

দেরি হয় না। কারণ স্বার্থের ব্যাপারে তারা একাট্টা পথ তাদের এক। “একজনের

আছে মাজার, একজনের আছে জমিজোত প্রভাব প্রতিপত্তি।"


সম্পদের মালিক হতে মজিদের দেরি হয় না লম্বা চওড়া রহীমা নায়ী একটি

স্ত্রীলোককে সে বিয়েও করে ফেলে। এই মহিলাটি শক্তিমতী হলেও শীর্ণদেহ মজিদকে

ভয় ও শ্রদ্ধা করে। কারণ লোকটির পিছনে মাছের পিঠের মতো মাজারের ছায়াটিকে

দেখতে পায় সে। শুধু রহিমাই নয়, বলা বাহুল্য ঐ ছায়াটিকে গ্রামবাসী সকলেই

দেখতে পায়। ফলে মানুষের ধর্মবিশ্বাস, ঐশী শক্তির প্রতি ভক্তি ও আনুগত্য, ভয় ও

শ্রদ্ধা, ইচ্ছা ও বাসনা চলে যায় ঐ মাজারটির প্রতি এবং সেই সুবাদে মজিদের

নিয়ন্ত্রণে। সে প্রথমেই কাদের-তাহেরের বাবাকে এমন এক বিপাকে ফেলে যে সে

“নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। তার দ্বিতীয় কাজ, আওয়ালপুরের পীর সাহেবের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায়

নামা। ব্যাপারটি রক্তপাত পর্যন্ত গড়ায় এবং পীরসাহেবকে শেষ পর্যন্ত পশ্চাদপসরণ

করতে হয়। তার তৃতীয় কাজ, খালেক ব্যাপারীর সন্তানকামী প্রথম স্ত্রীকে তালাক

দেয়ানো। তার চতুর্থ কাজ, আক্কাস নামক একটি নবীন যুবক স্কুল প্রতিষ্ঠার আয়োজন

করলে তাকে বিদ্রূপ করে, শাসন করে ধমক দিয়ে গ্রাম ত্যাগ করানো। এই ভাবেই সে

নিজের প্রভাব এবং প্রতিষ্ঠা নিরঙ্কুশ রাখে।


লালসালুর নায়িকা জমিলা


বলাবাহুল্য, এসব ঘটনা বাইরের সমাজের। কিন্তু তার পারিবারিক জীবনে একটি

সংকট তৈরি করে ফেলে সে অল্পবয়সী একটি মেয়েকে বিবাহ করে। জমিলা চঞ্চল

সহজ স্বচ্ছন্দ স্বভাবের মেয়ে। রহীমার সঙ্গে তার সম্পর্ক হয়ে যায় স্নেহের। মজিদ তার

চঞ্চল উচ্ছলতা শাসন করতে চায় কিন্তু পারে না। জমিলার ওপর বল প্রয়োগ করতে

গেলে সে স্বামীর ওপর থুথু নিক্ষেপ করে একেবারে এবং এই ঘটনাটি মজিদকে প্রায়

ক্ষিপ্ত করে তোলে। সে প্রচার করে যে জমিলার ওপর দুষ্ট জীনের আছর হয়েছে।এইজন্য সে বাড়িতে জিকিরের আসর বসায়। জিকিরের ধ্বনি জমিলার স্নায়ুমণ্ডলীকে

বিপর্যন্ত করে দেয় তার আচরণ হয়ে ওঠে পাগলের মতো। কিন্তু ঐ অসহায় অসংলগ্ন

আচরণকেই মজিদ মনে করে ধর্ম বিশ্বাসের প্রতি উপেক্ষা এবং তাচ্ছিলা। সেই কারণে

সে জমিলাকে মাজার ঘরের অন্ধকারে একটি খুঁটিতে বেঁধে রাখে। ইতোমধ্যে প্রবল ঝড়

ও শিলাবৃষ্টি শুরু হয়ে যায়। বৃহীমার মাতৃহৃদয় ব্যাকুল হয়ে ওঠে কন্যা সদৃশ সতীনটির

জন্য। জমিলার প্রতি যে অমানবিক আচরণ করে মজিদ তাতেই তার অন্তরাত্মায় যেন

• কোথায় একটা পরিবর্তন ঘটে যায়। মজিদের প্রতি যে-রহীমার বিশ্বাস ছিলো পর্বতের

মতো অটল এবং ধ্রুবতারার মতো অনড়' সেই রহীমাই মজিদের আদেশ উপেক্ষা এবং

অগ্রাহ্য করে। বোঝা যায়, মজিদের প্রতিষ্ঠার ভিতে প্রকাণ্ড একটি ফাটল ধরেছে।

ইতোমধ্যে আবার শিলাবৃষ্টিতে ফসলের বিপুল ক্ষতি হয়েছে গ্রামবাসীর ঘরে ঘরে

হাহাকার। মজিদের কাছে তারা প্রতিকার চায়, আশ্রয় চায়, সান্ত্বনা চায়। কারণ তাদের

বিশ্বাস, মজিদ অলৌকিক শক্তি বলে বিপর্যয়ের মধ্যেও তাঁদের রক্ষা করবে। কিন্তু

মজিদের দিক থেকে ক্রুদ্ধ ধমক ছাড়া কিছুই আসে না। সে কঠিনভাবে বলে,

“নাফরমানি করিও না। খোদার উপর তোয়াক্কেল রাখো।” এইভাবে মজিদের বিপর্যস্ত

পারিবারিক জীবন, বিধ্বস্ত ফসলের ক্ষেত এবং দরিদ্র গ্রামবাসীর হাহাকারের মধ্য দিয়ে

'লালসালু' উপন্যাসের কাহিনি সমাপ্ত হয়।


বাংলা উপন্যাসে লালসালুর চরিত্র আলোচনা


লক্ষ করলেই দেখা যায় এ উপন্যাসের কাহিনি নির্মাণে ঘটনা বিন্যাসের ভূমিকা

যতোখানি না-তার চাইতে চরিত্র বিশ্লেষণের ভূমিকা অনেক বেশি। 'লালসালু' এদিক

দিয়ে চরিত্র নির্ভর উপন্যাস। আর একটিই এ উপন্যাসের চরিত্র যাকে লেখক বরাবর

অনুসরণ করেছেন। দেখা যায়, যতো কিছু ঘটে এবং তাতে অন্যান্য চরিত্রের মধ্যে যে

ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয় সমস্ত কিছুর পশ্চাতে প্রত্যক্ষেহোক, পরোক্ষে হোকমজিদের নিয়ন্ত্রণ মানুষের ধর্মকর্মের ক্ষেত্রে শুধু নয় তার সামাজিক পারিবারিকক্ষেত্রেও মজিদের প্রবল উপস্থিতি। তাহের-কাদেরের বাবাকে সে প্রায় পাগল বানিয়েফেলে। খালেক মাতব্বরের সঙ্গে তার স্বার্থের গাঁটছড়া বাঁধা। খালেক ব্যাপারীর সাধ্য

নেই যে সে তার সন্তান কামনায় অস্থির স্ত্রীর বন্ধ্যাত্বঘোচাবার জন্য আউয়ালপুরের পীর

সাহেবের কাছ থেকে পড়া পানি এনে খাওয়ায়। বরং সে নিজেই এমন অনুগত হয়েপড়ে যে মজিদের কথামতো দীর্ঘকালের দাম্পত্য জীবনকে অস্বীকার করে নিজের স্ত্রীকেতালাক পর্যন্ত দিয়ে দেয়।

কুসংস্কার, শঠতা, প্রতারণা এবং অন্ধবিশ্বাসের প্রতীক হয়েওঠে মজিদ। প্রথাকে

সে টিকিয়ে রাখতে চায়, প্রভু, হতে চায়, চায় অপ্রতিহত ক্ষমতার অধিকারী হতে।এজন্য সে হেন কাজ নেই যা করে না। নিজেরই ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে সে একেকবার ভাবে,মাজার ছেড়ে দূরে কোথাও চলে যাবে। কিন্তু এসব চিন্তা তার ক্ষণিকের। সজ্ঞানে সে

প্রতারণা করে কিন্তু তার মানে এই নয় যে সে ঈশ্বর বিশ্বাসীনয়। বিশ্বাস তারদৃঢ় এবং সে মনে করে, প্রতারণা ডামি যে ভাবেই হোক, মাজার এবং ধর্মীয়

বিশ্বাসকে তার টিকিয়ে রাখতে হবে। প্রতাপ এবং প্রতিষ্ঠার ওপর আঘাত কোনদিক

থেকে আসতে পারে সে বিষয়ে সে সব্জাগ। সে জানে, স্বাভাবিক প্রাণধর্মই তার শাসন

এবং শোষণের অদৃশ্য বেড়াজাল ছিন্নভিন্ন করে দিতে পারে। ফসল ওঠার সময় যখন

গ্রামবাসীরা আনন্দে গান গেয়ে ওঠে তখন সেই গান তাকে বিচলিত করে দেয়। সে ঐ

গান বন্ধ করার জন্য তৎপর হয়ে ওঠে। রহীমার স্বচ্ছন্দ চলাফেরায় সে বাধা দেয়।

আধুনিক যুবক আক্কাস আলী স্কুল প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হলে সর্বসমক্ষে লাঞ্ছিত অপমানিত

করে তাকে গ্রাম থেকে বিদায় করে দেয়। কেন করে সে এসব? করে নিজের প্রতিষ্ঠার

ভিতটিকে মজবুত করার জন্যে। এ সবই তার হিসেবী বুদ্ধির কাজ। অর্থাৎ তার

আগমন অবস্থান এবং প্রতিষ্ঠা প্রতি পর্যায়েই হিসেব মতো চলে সে।


প্রশ্ন উঠতে পারে মজিদের মধ্যে কি স্বাভাবিক মানবিক আবেগ অনুভূতি নেই? সে

শুধুই কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস, স্বার্থপরতা আর শোষণের প্রতিভূ? আমরা দেখি, মজিদ

পুরোপুরি প্রতীক চরিত্র নয়। তার কামনা-বাসনা আছে। অল্পবয়সী মেয়েকে বিবাহ করে

সে—খালেক ব্যাপারীর বউয়ের নরম সুন্দর পা দেে

তার মনে ঈর্ষার আগুন জ্বলে

ওঠে—দুর্বিনীতা তরুণী স্ত্রী তার মুখের ওপর থুথু দিলে সে ভয়ানক ক্রুদ্ধ হয়ে তাকে

কঠিন শাস্তি দেয়। এসব কারণেই মজিদ চরিত্রটি হয়ে উঠেছে মানবিক অন্তর্দ্বন্দ্ব ও

সংঘাতে জীবন্ত। সংস্কার এবং প্রাণধর্মের দ্বন্দ্বটিকে এক পর্যায়ে আমরা মজিদের মধ্যে

তীব্র হয়ে উঠতে দেখি। মৃত প্রায় জমিলাকে মাজার ঘর থেকে নিয়ে আসার পর রহীমা

তার শুশ্রুষা আরম্ভ করে—পরম স্নেহে জমিলার গায়ে হাত বোলাতে থাকে। ঐ দৃশ্যটি

মজিদের মনে তুমুল আলোড়নের সৃষ্টি করে। মজিদের মনে হয় মুহূর্তের মধ্যে

কেয়ামত হবে। মুহূর্তের মধ্যে মজিদের ভেতরেও কী ওলটপালট হয়ে যাবার উপক্রম

করে। একটা বিচিত্র জীবন আদিগন্ত উন্মুক্ত হয়ে ক্ষণকালের জন্যে প্রকাশ পায় তার

চোখের সামনে, আর একটা সত্যের সীমানায় পৌছে জন্ম বেদনার তীব্র যন্ত্রণা অনুভবকরে সে মনে মনে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত টাল খেয়ে সে সামলে নেয় নিজেকে।” অর্থাৎ

মজিদ সংস্কার ও স্বার্থের বন্ধন মুক্ত প্রাণময় জীবনের কাছাকাছি পৌঁছে জন্মবেদনার

তীব্র যন্ত্রণাটি পর্যন্ত অনুভব করে কিন্তু শেষ পর্যন্ত নবজন্ম হয় না তার। কুসংস্কারভীতি আর মিথ্যার অদৃশ্য দেয়ালের ভেতরেই থেকে যেতে হয় তাকে। মানবিকমমত্ববোধের দৃশ্য তার মনের উপরকার মিথ্যা পাথরটিকে টলিয়ে দিলেও শেষ পর্যন্ত

উৎখাত করতে পারে না। মজিদ থেকে যায় তার জীবনবিরোধী শোষক এবং উওপ্রতারকের ভূমিকায়।

আমাদের বুঝতে অসুবিধা হয় না যে মজিদ আসলে ভয়ানক নিঃসঙ্গ। তার কোনআপনজন নেই। কারণ যার যার সঙ্গে তার সম্পর্ক হয়,তারা সবাই তার প্রতাপ ওপ্রতিষ্ঠার শিকার অথবা সহায়ক। সম্পর্কটা সর্বদাই বাইরের প্রয়োজনের, কখনোইঅন্তরের নয়। সে কখনোই সৎ এবং আন্তরিক হতে পারে না কারণ সে জানে,

আন্তরিক হলেই, তার সত্য স্বরূপটি প্রকাশ হয়ে পড়লেই তার দুর্বলতা, তার ভণ্ডামি,তার মিথ্যাচার সবই প্রকাশ হয়ে পড়বে আর তাতে তার প্রতাপ ও প্রতিষ্ঠার ভিতটি

ধসে যাবে যার অর্থ তার নিজের অস্তিত্ব নিশ্চিহ্ন হয়েযাওয়া। তাই কোন কোন দুর্বলমুহুর্তে মনের আবেগ প্রকাশ হওয়ার উপক্রম হলেই সেতার দমন করে। তার এই


বিচিত্র আচরণের কারণেই সবাই তাকে অসাধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন অলৌকিক পুরুষ বলে..

মনে করে। সে নিজেও সুকৌশলে কথাবার্তা এবং আচরণের মধ্য দিয়ে নিজের

অলৌকিক ব্যক্তির ইঙ্গিত দিয়ে এসেছে বরাবর। ফলে সহজ ও স্বাভাবিকভাবে আন্তরিক

হওয়া তার পক্ষে সম্ভব হয় না কখনোই। এমনকি নিজের স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলার সময়ও

তাকে গাম্ভীর্যের মুখোেস এঁটে থাকতে হয়। তার এই তৈরি করা আবরণটি এতোই শক্ত

যে তা ভেদ করা কারো পক্ষেই কখনো সম্ভব হয়নি।


তবু সে যে আসলেই দুর্বল এবং নিঃসঙ্গ, এই সত্যটি একেবারে গোপন থাকে না।

তার আভাস ধরা পড়ে রহীমার কাছে। জমিলাকে শাসনে রাখার ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়ে সে

বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে। কী ভাবে প্রাণধর্মে উচ্ছল ও দুর্বিনীতা তরুণী বধূটিকে সে নিয়ন্ত্রণে

রাখবে সেই চিন্তায় সে দিশেহারা বোধ করে এবং জীবনে প্রথম হয়তো কোমল হয়ে

এবং নিজের সত্তার কথা ভুলে গিয়ে সে রহীমাকে বলে “কও বিবি কী করলাম?

আমার বুদ্ধিতে যানি কুলায় না। তোমারে জানাই, তুমি কও?”] * **


ঐ ঘটনাতেই রহীমা যেন বুঝতে পারে তার স্বামীর দুর্বলতা কোথায় এবং তখন

ভয়, শ্রদ্ধা এবং ভক্তির পাত্রটি হয়ে যায় তার কাছে করুণার পাত্র। এরপর যদিও সে

জমিলার ওপর অমানুষিক অত্যাচার করেছে কিন্তু তখন আর তার সেই প্রতিষ্ঠিত

সংকল্পবদ্ধ নির্বিকার আচরণ নেই। জমিলা তার মুখে থুথু দিলে সে ক্ষেপে ওঠে। এই

ক্ষিপ্ততা যতোখানি না তার পৌরুষের প্রতি অপমানের কারণে, তার চাইতে বেশি তার

মনের ভেতরকার ভয়ের কারণে। সে জমিলাকে পাজাকোলা করে মাজার ঘরে এনে

ধপাস করে বসিয়ে দেয়। “তারপর হঠাৎ যেন ঝড় ওঠে। অদ্ভুত ক্ষিপ্রতায় ও দুরস্ত

বাতাসের মতো বিভিন্ন সুরে মজিদ দোয়া-দরূদ পড়তে শুরু করে। বাইরের আকাশ

নীরব কিন্তু ওর কণ্ঠে জেগে ওঠে দুনিয়ার যতো অশান্তি আর মরণভীতি, সর্বনাশা ধ্বংস

থেকে বাঁচাবার তীব্র ব্যাকুলতা ।।


মজিদ চরিত্রের এই দিকটি উদঘাটিত হয়ে যাওয়ায় একটি বিষয় আলোকিত হয়ে

ওঠে যে মজিদ শেষ পর্যন্ত মানুষই, যদিও শেষ পর্যন্ত সে মানবতার পক্ষে আসতে পারে

না, দয়ামায়া ও স্নেহমমতায় প্রাণধর্মের বিপক্ষেই থেকে যায়, তবু সে মানুষই। তবে

কেমন মানুষ? না মানবতা বিরোধী মানুষ। যে পক্ষ মানুষের বিকাশের অন্তরায়, সেই

পক্ষের মানুষ। রহীমার কাছে নিজের দুর্বলতা প্রকাশ হয়ে পড়লেও রহীমা তার নির্দেশ

অমান্য করলেও ভণ্ডামি ও কুসংস্কার দিয়ে বাঁধানো নিজের প্রতাপ এবং প্রতিষ্ঠার

ভিতটিকে সে শেষ পর্যন্ত অটুট রাখার চেষ্টা করে। ফলে মজিদ চরিত্রটি মানবিক হওয়া

সত্ত্বেও তার কোনো প্রকার উত্তরণ ঘটে না। উপন্যাসের প্রথমে যে মজিদের আবির্ভাব

হয়েছিল, মধ্যবর্তী অবকাশে, নানাবিধ ঘটনা ঘটবার পরও উপন্যাসের সমাপ্তিতে সে সেই

মজিদই থেকে যায়। এদিক থেকে বিচার করে দেখলে বলা যায় 'লালসালু' উপন্যাসের

মজিদ চরিত্র মানবতা বিরোধী শক্তির যথার্থ প্রতিভূ। তার দয়া নেই, মায়া নেই, ভালবাসা

নেই– এক কথায় কল্যাণকর ও মঙ্গলময় কোনো প্রাসঙ্গিকতাকেই তার সঙ্গে যুক্ত করা

যায় না। সে কুসংস্কারের অকল্যাণ এবং শোষণের যুগযুগান্তর ব্যাপী চালু প্রক্রিয়াটির

ধারক বাহক এবং রক্ষক – সে একাকী, মানুবিক দায়বিহীন, নিঃসঙ্গ একটি অস্তিত্ব ।

চরিত্র চিত্রণে ওয়ালীউল্লাহর সার্থকতা


সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ চরিত্র নির্মাণে যে অসাধারণ কুশলী তার প্রমাণ 'লালসালু'

উপন্যাসের বিভিন্ন চরিত্র। মজিদ চরিত্র তার উপন্যাসের স্তম্ভ বিশেষ। কিন্তু সে ছাড়াও

অন্যান্য চরিত্রও কম আকর্ষণীয় নয়। উপন্যাসের প্রথমেই একটি বুদ্ধ পুরুষ চরিত্রের

সাক্ষাৎ পাই আমরা। সে হলো তাহেরের বাবা। নাম বিহীন এই চরিত্রটিকে স্বল্পক্ষণের

জন্যে পাই আমরা। কিন্তু ঐ স্বল্পক্ষণের চরিত্রটিই আমাদের মনে স্থায়ী দাগ কেটে যায়।

তাহেরের বাপ বদরাগী এবং জেদী। এককালে সে স্বাভাবিক এবং বুদ্ধিমান লোকই

ছিলো কিন্তু দুষ্টু প্রকৃতির এক বৈমাত্রেয় ভাইয়ের সঙ্গে জোতজমি নিয়ে মারামারি ও

মামলা-মোকদ্দমা করে শেষ বয়সে সে সব দিক দিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েছে। তার তিন

ছেলে, কিন্তু তারা সংসারে আয় বাড়াতে পারে না, ফলে দারিদ্র্যের পীড়ন বুড়োর

সর্বক্ষণের সঙ্গী। বৃদ্ধা স্ত্রীর সঙ্গে অষ্টপ্রহর সে কলহ করে কখনো কখনো স্ত্রীকে সে

প্রহারও করে। তার সংসার একটি দোজখ বিশেষ স্বামীর আচরণ অসহ্য বোধহলেও

বৃদ্ধা স্ত্রী স্বামীকে কুৎসিত ভাষায় গালাগাল করে এক পর্যায়ে সে স্বামীর পুরুষত্ব

সম্পর্কে কটাক্ষ করে বলে যে তার সন্তানেরা বৃদ্ধের ঔরসজাত নয়। এই ঘটনাটি এতোই

কুৎসিত যে নিজ মেয়ে হাসুনির মা এর একটা বিহিতপ্রার্থনা করে মজিদের কাছে।

যথাসময়ে সামাজিক বিচার বসে এবং তাহেরের বাপের কাছে কৈফিয়ৎ তলব করা হয়।যৌবনকালে স্ত্রী ছিলো রূপসী ও চঞ্চলা। তাঁর অনুপস্থিতিতে অন্য পুরুষ মানুষের

সঙ্গে স্ত্রীর সম্পর্ক হয়েছিল এমন একটি কুৎসা তার বৈমাত্রেয় ভাইয়েরা প্রচারওকরেছিলো। ঐ সময় সে কথাটা বিশ্বাস করেনি কিন্তু বৃদ্ধ বয়সে, নিঃস্ব অবস্থায়,

দেহ-মন যখন বিপর্যস্ত তখন তার মনে সংশয় দেখা দেয়মিথ্যাই সত্য হয়ে উঠতে

চায় তার কাছে। সে ক্ষিপ্ত হয়, স্ত্রীকে প্রহার করে, গালাগাল করে। কিন্তু এসবই তার

নিজের সংসারের ঘটনা, তার অন্তঃপুরের ব্যাপার, বাইরের লোকের নাক গলাবারকোনো অধিকার নেই এ ব্যাপারে। একজন প্রকৃত পুরুষ মানুষের মতোই ব্যাপারটি সেচিন্তা করে। কিন্তু যখন টের পায় সে যে সামাজিক বিচারের অনুষ্ঠানটির পেছনে আছে

তার নিজেরই মেয়ে হাসুনির মা তখন সে মেয়েকে যতেচ্ছা মার দেয়।পুনরায় বিচার বসে এবং মজিদ বুড়োর মনের ভেতরে যেখানে দুর্বল ক্ষত সেই

খানে খোঁচায়। এক মুহূর্তে তার পৌরুষের অহমিকাকে ধুলিসাৎ করে দেয়।

মজিদ বারবার জিজ্ঞেস করে বুড়ির কথা সত্য কি না। কেন সে বুড়ির সঙ্গে তারবিবাদের কারণটি ঢেকে রাখতে চায়? এই প্রশ্ন যেন তার পৌরুষের ওপর আঘাত, তার

পারিবারিক সম্ভ্রমের ওপর আঘাত। সে বলে, “এইটা কি কওনের কথা? বুড়ী মাগী

ঝুটমুট একখান কথা কয়—তাবইলা আমি কি পাড়ায় ঢোলসোহরত দিমু?

তার দুর্বিনীত উত্তর শুনে সমাজ প্রধানেরা ক্রুব্ধ হয়। কিন্তু তাতেও তাহেরের বাপের

বেপরোয়া ভাব যায় না। তখন তাকে বলা হয়, মেয়েকে সে কেন ঠেঙিয়েছে, তখনও তারমুখ দিয়ে তেজী উত্তরবেরিয়ে আসে। সে বলে, আমার মইয়ারে আমি ঠেঙ্গাইছি।ঐ কথার মধ্য দিয়ে সে প্রত্যাঘাত করতে চায়। যেন বলতে চায় তার অধিকারেরওপর অনধিকার হস্তক্ষেপ যেন সে সহ্য করবে না।কিন্তু মজিদের কৌশলের কাছে তার এই জেদ এই পৌরুষ এবং সাহসিকতা এক

পর্যায়ে পরাস্ত হয়ে যায়। মজিদ দোয়া-দরুদ পড়ে, সুরা আবৃত্তি করে। তারপর হযরত

আয়েশার জীবনের একটি ঘটনার কথা বয়ান করে সমবেত মানুষদের মধ্যে একটি অন্য

ধরনের ভাব সঞ্চারিত করে নেয়। বুড়োর মনে ধর্মের প্রতি যে শ্রদ্ধা ও ভক্তিভাব আছে

মজিদের কথাবার্তা সেখানে একটি প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। ধর্মের দাবিতেই যেন মনের

কথা খুলে বলতে হবে এই রকম পরিস্থিতির সম্মুখীন হয় সে বিভ্রান্ত অবস্থায় পরাস্ত

হয় এবং কাঁদতে থাকে। প্রকারান্তরে সে স্বীকার করে স্ত্রীর মিথ্যে প্রচারটি এবং মেয়ের

কাছে মাফ চাওয়ার অঙ্গীকার করে সে বাড়ি আসে। মেয়ের কাছে সে মাফও চায়—

কিন্তু তারপর গৃহত্যাগ করে সে কোথায় যায়, তার আর হদিস পাওয়া যায় না।


খালেক ব্যাপারী: লালসালুর প্রধান পুরুষ চরিত্র.

খালেক ব্যাপারী 'লালসালু' উপন্যাসে অন্যতম প্রধান পুরুষ চরিত্র। সে মহব্বতনগর

গ্রামের মাতব্বর । বাংলাদেশের গ্রামীণ অর্থনীতি কৃষিনির্ভর এবং উৎপাদন ব্যবস্থা সামন্ত

-বাদী হওয়ায় যার জমি যতো বেশি তার প্রভাব প্রতিপত্তিও সেই রকম বেশি। জমির

মালিকানা যাদের বেশি তারাই গ্রামীণ সমাজের নেতা। গ্রামীণ মানুষের সামাজিক সকল

ক্রিয়াকাণ্ড এই মাতব্বরদের নির্দেশেই পরিচালিত হয়। তাদের উৎসব-পার্বণ, ধর্ম-কর্ম,

শিক্ষাদীক্ষা সমস্ত ব্যাপারেই এই মাতব্বরদের নিয়ন্ত্রণ। মহব্বতনগর গ্রামে এসে মজিদ

প্রথমে মাতব্বর খালেক ব্যাপারীর বাড়িতেই আশ্রয় নেয়। মানুষের ধর্ম বিশ্বাসকে

অবলম্বন করে মজিদ মহব্বতনগরে তাঁর নিজের প্রভাব বিস্তৃত করে ও প্রতিপত্তি

প্রতিষ্ঠিত করে। এ ব্যাপারে খালেক ব্যাপারী কখনোই তার বিরোধিতা করেনি। বরং

সকল ব্যাপারেই মজিদকে সহযোগিতা দান করেছে।


এই-ই নিয়ম। সামন্তবাদী সমাজে ভূমি মালিকদের সঙ্গে ধর্মীয় পুরোহিতদের যে

পরস্পর নিবিড় সম্পর্ক থাকবার কথা এক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। খালেক ব্যাপারী জানে

যে “অজান্তে অনিচ্ছায় ও দু'জনের পক্ষে উল্টো পথে যাওয়া সম্ভব নয় । একজনের

আছে মাজার, আরেকজনের জমিজোতের প্রতিপত্তি। সজ্ঞানে না জানলেও তারা

একাট্টা, পথ তাদের এক " ভূমি মালিকদের যথেচ্চ শোষণ ও অপকর্মের দোসর ভণ্ড

ধর্মব্যবসায়ীরা। তারা মানুষের মনের ভেতরকার কুসংস্কার এবং অন্ধবিশ্বাস জিইয়ে

রাখে মানুষের চেতনাকে বিকশিত হতে দেয় না অধিকারবোধ জাগ্রত হওয়ার পথে

বাধার সৃষ্টি করে আর করে বলেই জমির মালিকেরা কৃষককে শোষণ করতে পারে।

সুতরাং খালেক ব্যাপারী এবং মজিদ মিয়ার সম্পর্ক খাপে খাপে মিলবার, বিচ্ছিন্ন হবার

নয়। এই কারণে মজিদ গ্রামের লোকদের সমাবেশে যা যা বলেছে সবই শেষে সমর্থন

জানিয়েছে খালেক ব্যাপারী। মজিদের কোনো কথারই সে কখনো অন্যথা করেনি। তার

প্রভাব প্রতিপত্তি ছাপিয়ে ওঠেছে মজিদের প্রভাব প্রতিপত্তি এই বাস্তব সত্যটিও যেন

সে মেনে নেয়। এক পর্যায়ে দেখতে পাওয়া যায় যে, খালেক ব্যাপারী মজিদকে ভয়

পেতে শুরু করেছে এবং এও দেখা যায় যে, মজিদ মিয়ার পরামর্শে সে তার প্রথমা

সতীসাধ্বী স্ত্রীকে পরিত্যাগ করে ফেললো।

এদিক দিয়ে দেখলে খালেক ব্যাপারীকে দুর্বল চরিত্রের লোকই বলতে হবে।

কারণ নিয়ম হলো এই যে, সামন্তপ্রভুর অনুগত হবে পুরোহিত। খালেক ব্যাপারীর

চরিত্রে দৃঢ়তা আমরা কখনোই লক্ষ করি না। বরঞ্চ দেখি প্রায় সব ক্ষেত্রেই মজিদের

কথার সুরে সুর মেলাতে। মজিদ যখন মূর্খ গ্রামবাসীকে ধমক দেয়—খালেক ব্যাপারীও

সেই ধমকই দেয় কিন্তু একটু জোরালো গলায়। প্রথমা স্ত্রী সন্তান কামনায় পার্শ্ববর্তী

গ্রাম আওয়ালপুরের পীর সাহেবের কাছ থেকে পড়া পানি এনে দিতে বললে সে

মজিদকে লুকিয়ে ঐ পড়া পানি আনবার ব্যবস্থা করে। তার এই গোপন অভিসন্ধি ফাঁস

হয়ে গেলে সে মজিদের কাছে অপরাধ বোধে আক্রান্ত মানুষের মতো ব্যবহার করে

এবং শেষে মজিদ যখন বলে যে তাকে স্ত্রী ত্যাগ করতে হবে তখন সে সেই আদেশও

নির্বিবাদে মেনে নেয়–তেরো বছরের দাম্পত্য জীবনের সকল অঙ্গীকার ধুলোয় লুটিয়ে

দিয়ে নিজের প্রথমা স্ত্রীকে ত্যাগ করে খালেক ব্যাপারী চরিত্রটির অবস্থান উপন্যাসের

দীর্ঘ সময়ব্যাপী হলেও তার ভূমিকা কখনোই সুস্পষ্ট এবং ব্যক্তিত্বসম্পন্ন হয়ে ওঠেনি।

লেখক এই চরিত্রটির যথাযোগ্য বিকাশ ঘটিয়েছেন এমন কথা আমরা বলতে পারি না।


'লালসালু’র নায়িকা চরিত্র আলোচনা


লালসালু উপন্যাসের নায়ক চরিত্র নিঃসন্দেহে মজিদ। কিন্তু নায়িকা চরিত্র কে? এ

প্রশ্নের জবাব আমাদের বিবেচনা করে নিতে হয়। কারণ যেহেতু উপন্যাসের প্রায় সমগ্র

বিস্তৃতি জুড়ে মজিদের প্রথমা স্ত্রী রহীমার অবস্থান এবং মজিদের সামাজিক প্রতিষ্ঠায়

তার একটি সহায়ক ভূমিকা আছে সেইহেতু তাকেই উপন্যাসের নায়িকা বলে আমাদের

মনে হতে পারে। কিন্তু গভীরতর বিবেচনায় দেখা যাবে জমিলার গুরুত্ব অনেক বেশি।

যদিও তার আবির্ভাব উপন্যাসের দ্বিতীয়ার্ধে এবং বয়সে সে নিতান্তই কিশোরী, তবুসে-ই পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বেশি। মজিদের জীবনবৃত্তে কোনো প্রতিপক্ষ আমরা

লক্ষ করি না। মজিদকে কেউ বিচলিত করতে পারেনি কখনো। কিন্তু আমরা দেখি এইকিশোরী বধূটিই মজিদকে ভীত, উত্তেজিত ও ক্ষিপ্ত করে তুলতে সক্ষম হয়েছে। তার

আগমনেই মজিদের সুখের সংসার ওলটপালট হয়ে যায়, তার দুর্বলতা প্রকাশ হয়েপড়ে এবং তার প্রতাপ ও প্রতিষ্ঠার ভিত ধসে পড়ার উপক্রম হয়। কাহিনি বিন্যাসেদ্বন্দ্ব-সংঘাত অবতারণার জন্যে এমন একটি চরিত্র অপরিহার্য ছিলো একথা আমরা

নির্দ্বিধায় বলতে পারি। সর্বোপরি বলা যায় জমিলা চরিত্রের আবির্ভাব না ঘটলে মজিদচরিত্রের প্রকৃত স্বরূপটিই অনুদঘাটিত থেকে যেতো। এইসব বিবেচনা করেই আমরাসিদ্ধান্তে আসতে পারি যে, 'লালসালু' উপন্যাসে জমিলাই, নায়িকা /লেখক জমিলার পিতৃপরিচয় আমাদের জানাননি। এমনকি বিবাহ পূর্বকালে তারজীবন-যাপন পিতৃগৃহে কী রকম ছিলো লেখক আমাদের তাও জানাননি। আমরা কল্পনা

করে নিতে পারি যে সে দরিদ্র ঘরের সন্তান আর সে কারণেই তার দারিদ্র্য পীড়িতপিতা একজন প্রৌঢ় এবং বিবাহিত মানুষের সঙ্গে কিশোরী কন্যার বিবাহ দিয়েকন্যাদায়গ্রস্ত থেকে মুক্ত হয়েছেন। সে যখন মজিদের সংসারে আসে তখন তাকে দেখে

দুর্বল বেড়াল ছানাটির মতো মনে হতো। মজিন এমন একটি বউ ঘরে আনতে

চেয়েছিলো যে খোদাকে ভয় করবে। জমিলাকে দেখে মনে হয়েছিলো খোদাকে শুধু

নয়, সমস্ত কিছুকেই সে ভয় করবে। যদি কেউ তাকে হেসে আদর করতে চায়

তাহলেও সে ভয়ে কেঁপে সারা হয়ে যাবে


কিন্তু বাস্তবে দেখা গেলো ধারণা ভুল। জমিলা উচ্ছল হাসি হাসে। কৌতুককর কথা

বলে, স্বামী-বয়স নিয়ে কটাক্ষ করে এবং স্বামীর রক্তচক্ষু-শাসন মানুতে চায় না। তার

হাসি জাতের শীতল স্বীকৃত ও শ্রদ্ধা ভীতির জগতে একটি চিড় ধরিয়ে দেয়। তাকে

করা হয়। কিন্তু তবু তার হাসি থামে না। তাকে চৌকাঠে বসে থাকতে নিষেধ করা

হয়। কিন্তু সে নিষেধ উপেক্ষা করে। ক্রুদ্ধ অধৈর্য স্বামী বিকট স্বরে ধমক দিলে সে পরম

হেলা ভরে ওঠে গোয়াল ঘরের দিকে চলে যায়। স্পষ্টতই দেখা যায় জমিলা স্বামীকে

উপেক্ষা করেছে। স্বামীর বিছানা পরিহার করে রহীমার বিছানায় গিয়ে শোয়। নামাজ না

পড়েই একদিন সে ঘুমিয়ে পড়ে। জোর করে ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলে নামাজ পড়ছে কি

না জিজ্ঞেস করা হলে সে কোনো জবাব দেয় না। নামাজ পড়েছে, এই কথাটি সে মুখ

দিয়ে বের করে না। বোঝা যায় তার মনে বিদ্রোহ জেগেছে


হাসামুখরা চপলা জমিলা যেমন, তেমনি এই নীরব বিদ্রোহী জমিলাও স্বামী-মজিদের

কাছে ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কারণ এই যে, তার আচরণের মধ্য দিয়ে স্বাভাবিক প্রাণ

ধর্মের প্রকাশ দেখা যাচ্ছে। খুশিতে কৌতুকে জমিলা উচ্ছল হাসি হাসে এ যেমন

স্বাভাবিক প্রাণধর্মের সহজ প্রকাশ, তেমনি শাসন পীড়ন হলে সে যে সেটা উপেক্ষা করে

ও নীরব প্রতিবাদ জানায় এও সেই স্বাভাবিক প্রাণধর্মেরই সহজ প্রকাশ। আর এইখানেই

মজিদের আতঙ্ক। ভীতি আত্মবিশ্বাস আর কুসংস্কার দিয়ে গড়ে তোলা মজিদের প্রতারণা

আর শোষণের শীতল সাম্রাজ্যে যদি এই রকম প্রাণধর্মের সহজ প্রকাশ ঘটতে থাকে, যদি

এ ভাবে তার প্রতাপ আর প্রতিষ্ঠার প্রতি অবহেলা আর উপেক্ষা প্রদর্শিত হয়, তাহলে

তার নিজের অস্তিত্বই বিপন্ন হয়ে পড়বে। বাইরের আক্রমণ সে প্রতিহত করতে পারে।

কূট কৌশল প্রয়োগ করে সে প্রবল প্রতাপান্বিত পীরসাহেবকে পশ্চাদপসরণে বাধ্য

করেছে, খালেক ব্যাপারীর মতো মাতব্বরের আনুগত্যএখন তার হাতের মুঠোয়, শিক্ষা

বিস্তারে আগ্রহী আধুনিক তরুণ আক্কাস আলীকে গ্রাম থেকে সহজেই সে বিতাড়িতকরেছে কিন্তু জমিলার বিরুদ্ধে কী করবে? সে ভেবে পায় না। জমিলা তো বুদ্ধি কিংবাকৌশল দিয়ে বাইরে থেকে তাকে আঘাত করে না, করে তার সহজ প্রাণধর্মের প্রকাশ

দেখিয়ে তার নিজেরই অন্তঃপুরের ভেতর থেকে। এমন প্রতিপক্ষের সঙ্গে কখনো সে

প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামেনি এ প্রতিদ্বন্দ্বিতার কৌশলও সে জানে না। মোট কথা জমিলা তার

ক্ষুদ্র দেহ, অপরিণত মন এবং একাকী অস্তিত্ব নিয়ে তার স্বামীর প্রবল প্রতিপক্ষ হয়েপীড়ায় তার শক্তি শুধু একটিই—সেটি হলো তার সহজ প্রাণধর্ম। খুশি হলে সে হাসে

আর ঘা খেলে তার রাগ হয়, সে প্রতিবাদ করে।

ফলে যে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয় সেটি বলা যায় প্রায় আবহমানকালের। এর শুরু মানব

সভ্যতার সূচনাকাল থেকে হৃদয় ধর্ম বড় না প্রথামূলক ধর্ম বড়? মানুষের সহজ সৃজনশীল

প্রাণময় জীবন বড়, না প্রথাবদ্ধ অন্ধবিশ্বাস আর কুসংস্কারের ভারে ন্যুব্জ ও বন্ধ্যা জীবন

বড়? এই রকম প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয় পাঠককে। এ প্রসঙ্গে সে রক্ত করবীর নন্দিনীর

কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। ঐ প্রতীক নাটকে নায়িকার জয় হয়েছে। অত্যাচার শোষণ এবং

প্রথার ভেতর ওপর গড়ে তোলা অচলায়তনের সিংহ দুয়ার ভেঙ্গে রাজা অবশেষে রাজপথে

জনতার মধ্যে বন্দিনীর সঙ্গে মিলিছেন। কিন্তু সামাজিক বাস্তবতা ভিত্তিক 'লালসালু'

উপন্যাসে জমিলার সেই সৌভাগ্য হয়নি। তার প্রতিপক্ষ মাজারের স্তূপটি ভেঙ্গে, সকল

ভঞ্জমি, শোষণ এবং অদ্ধবিশ্বাস তুচ্ছ করে জমিলার সঙ্গে মিলিত হয়নি কিংবা প্রকাশ্যেও

সহজ ও সৃজনশীল প্রাণধর্মের মাহাত্ম্যও প্রচার করেনি। বরঞ্চ দেখি, প্রতিপক্ষের অত্যাচারে

সংজ্ঞাহীন জমিলা সংজ্ঞাহীনই থেকে গেছে। তবে তার অর্থ এই নয় যে দ্বন্দ্বের অবসান

হয়েছে, জমিলা আত্মসমর্পণ করেছে। বরং দেখি, জমিলার বিদ্রোহ রহীমার মনেরও সহজ

প্রাণধর্মের প্রেরণা জাগিয়ে দিয়েছে। ফলে জমিলা হয়ে উঠেছে অন্যায়, শোষণ, ভণ্ডামী

কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাসের দ্বন্দ্বের প্রতিপক্ষের বিদ্রোহের প্রতীক। এই রকম একটি

বিদ্রোহী বালিকা বধূকে সমগ্র বাংলা-সাহিত্যে খুঁজে পেতে হলে বিস্তর খুঁজতে হবে ।


রহীমা : অন্যতম প্রধান নারী চরিত্র


রহীমা 'লালসালু' উপন্যাসে অন্যতম প্রধান নারী চরিত্র। কারণ নায়ক মজিদের সে

প্রথম স্ত্রী এবং উপন্যাসের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তাঁর উপস্থিতি। কিন্তু শক্তিময়ী লম্বা

চওড়া এই রমণীকে তার সম্ভাবনাময় ব্যক্তিত্ব নিয়ে দৃঢ়ভাবে দাঁড়াতে দেখা যায় না।

লেখক নিজেই বলেছেন “তার শক্তি, তার চওড়া দেহ—তা বাইরের খোলসমাত্র,

আসলে সে ঠাণ্ডা ভিত মানুষ " তার এই ঠাণ্ডা স্বভাবেরও আবার কারণ আছে। আর তা

হলো, “মজিদের প্রতি তার সম্মান, শ্রদ্ধা ও ভয়"—কেন না [“শীর্ণ মানুষটির (মজিদ)

পেছনে "সে মাছের পিঠের মতো মাজারটির বৃহৎ ছায়া দেখে।

ফলে প্রথম থেকেই সে বিশ্বাসে স্বামীর একান্ত অনুগত। স্বামী তাকে ধীর পায়ে

নিঃশব্দে হাটতে বললে, সে তা-ই করে, আস্তে কথা বলতে বললে সে প্রতিবাদ করে না

এবং মাজার সম্পর্কে ধর্ম-কর্ম সম্পর্কে সত্য-মিথ্যা যা যা বলে সবই সে যেন নির্বিকারে

বিশ্বাস করে নেয়। রহস্যময় মাজারটির নিচে অলৌকিক একটি শক্তি আছে বলে তার

অন্ধবিশ্বাস। আর এই সুবাদেই তার ধারণা, যে তার স্বামী মজিদ একজন অলৌকিক

শক্তিসম্পন্ন পুরুষ—পৃথিবীর কোনো সমস্যার সমাধান তার অসাধ্য নয়। এ রকম

ধারণা ও বিশ্বাসের কারণেই তার দিনানু দৈনিক সাধনা ছিলো কী ভাবে সে স্বামীর যোগ্যসহধর্মিণী হবে। এই লক্ষ্য সামনে রেখেই সে মহব্বতনগর গ্রামের অন্তঃপুরগুলোতেমজিদের প্রতাপ ও প্রতিষ্ঠা বিস্তৃত করে দেয়।

রহীমার দৈহিক শক্তি বিপুল, সাংসারিক কাজেকর্মেও সে অসাধারণ পারদর্শী।

কিন্তু এই বিপুল শক্তি ও পারদর্শিতা তার মনে স্বাতন্ত্র্যের কোনো চেতনা জাগায় না।স্বামীর আদেশ পালন এবং তার মনকে তুষ্ট রাখা ছাড়া তার অন্য কোনো কাজ আছে

বলে সে মনে করে না।

কিন্তু সে-ও মানুষ এবং মেয়ে মানুষ। নারীত্বের পরিপূর্ণ বিকাশ মাতৃত্বে, কিন্তু তার

কোলে সন্তান নেই, এই মর্মবেদনার ভার তাকে বহন করতে হয় সন্তান লাভের

আকাঙ্ক্ষা অর্থাৎ মাতৃস্নেহ, স্বাভাবিক প্রতিবেশী সুলভ সৌজন্য, দরিদ্র ও ক্লিষ্ট মানুষের

প্রতি মায়া-দয়া—এইসব মানবিক গুণাবলিও তার মধ্যে যথেষ্টই দেখা যায়। হাসুনীর

মায়ের দুঃখের সমব্যথী একমাত্র সে-ই, আর কেউ নয়। খালেক ব্যাপারীর স্ত্রী সন্তান

কামনায় রোজা রেখে মাজার প্রদক্ষিণ করার সময় অজ্ঞান হয়ে পড়লে তার সেবা শুশ্রুষা

করার জন্য রহীমাকেই আমরা ছুটে আসতে দেখি, নারীর জীবনে সর্বাপেক্ষা ঘৃণা ও

ঈর্ষার পাত্রী তার সতীন, কিন্তু সেই সতীনকে সে গভীর স্নেহ মমতায় জড়িয়ে ধরে।

কিশোরী বধূ জমিলাকে কাছে পেয়ে তার তৃষাতুর মাতৃহৃদয় তৃপ্তির সন্ধান পেয়ে যায়।

জমিলার নানান দোষ ত্রুটি, নানা ছেলেমানুষী, মজিদের সংসারে বেমানান নানান

আচরণ—সবই সে স্নেহের পরশে ঢেকে রাখে।


তবু আমরা জানি তার অস্তিত্বের সমস্তটাই ছিলো এক রকমের নিঃশর্ত আনুগত্য।

তার ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখ, সংসারের চিন্তা, জীবন-যাপন সবার ঊর্ধ্বে ভেবে নিয়েছিলো

স্বামীর শাসন এবং নির্দেশকে। বলা যায় নিজের সত্য পরিচয়টাও তার অজানা ছিলো।

কিন্তু তার মাতৃত্বের অনুভূতি তাকে পূর্ণাঙ্গ ব্যক্তিত্বে পরিণত করে দেয়। যখন দুর্বিনীত

জমিলাকে শাসতি দিতে আরম্ভ করে মজিদ তখনই তার অন্তরাত্মা বিদ্রোহ করে।

তখনো স্বামীর দুর্বলতা তার চোখে ধরা পড়েনি। প্রাণধর্মের সহজ উচ্ছলতা দেখে

মজিদকে চিন্তিত হতে দেখে সে বুঝে যায় কোথায় মজিদের দুর্বলতা। কুসংস্কার এবং

অন্ধবিশ্বাসের প্রকাণ্ড দেয়ালটা তার মনের ভেতরে আর অটুট থাকে না, মজিদ সম্পর্কে

যে রহস্যময়তা ছিলো, ভয় ছিলো তাও যেন তার কতকাংশে কেটে যায়। এই অবস্থায়

বরং মজিদের প্রতি তার মায়া হয়। ঐ মুহূর্তে প্রাকৃতিক দুর্যোগ আরম্ভ হলে তাকে

নামায পড়তে বলা হয়, কিন্তু স্বামীর সেই নির্দেশ সে উপেক্ষা করে। ঐ মুহূর্তটিতে

মাজার ঘরের অন্ধকারে বেঁধে রাখা জমিলার জন্যেই তার প্রাণ কেঁদে ওঠে। শিলাবৃষ্টিতে

ফসল নষ্ট হবার আশঙ্কা আছে একথা মজিদ স্মরণ করিয়ে দিলে, রহীমা যেন গা ঝাড়া

দিয়ে সোজা হয়ে বসে। তারপর স্বামীর পানে তাকিয়ে পরিষ্কার গলায় বলে—


"ধান দিয়ে কি হইব, মানুষের জান যদি না থাকে? আপনে ওরে নিয়া আসেন ভেতরে।"

আমরা অবাক বিস্ময়ে দেখি, “যে রহীমার বিশ্বাস পর্বতের মতো অটল, যার


আনুগত্য ধ্রুবতারার মতো অনড় সে-ই যেন হঠাৎ মজিদের আড়ালে চলে যায়, তার

কথা বোঝে না। রহীমা বরং স্বামীকেই হুকুম করে। রহীমার এই শক্তি আসে কোন

উৎস থেকে? আমাদের বুঝতে অসুবিধা হয় না যে উৎস একটাই— আর সেটা হলোমানবিক প্রাণধর্ম। প্রাণধর্মের প্রেরণাতেই তার মনে মাতৃত্বের জাগরণ এবং সেই

মাতৃত্ববোধই তার ব্যক্তিত্বের চূড়ান্ত বিকাশ ঘটিয়েছে। তার এই অনুভূতি বেরিয়েএসেছে কুসংস্কার অন্ধবিশ্বাস এবং ভয়ের প্রাচীর চূরমার করে। এদিক থেকে রহীমা

জমিলা চরিত্রের পরিপূরক বলে মনে করা যেতে পারে। মজিদ, জমিলা, তাহেরের বাবা

এসব চরিত্র আসলেই টাইপ চরিত্র। এক অবস্থা থেকে অন্য অবস্থায় মানসিক উত্তরণের

যে একটি ব্যাপার থাকে উপন্যাসের চরিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রে একটি বাদে 'লালসালু'

উপন্যাসের প্রায় সকল চরিত্রেই সেটি অনুপস্থিত। এই উজ্জ্বল ব্যতিক্রমটি হচ্ছে রহীমা।

মানব জীবনে প্রগতি ও প্রতিক্রিয়ার দ্বন্দ্ব যে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে চালু থাকবে এই

সত্যটিকে সে ধারণ করে আছে। সে-ই প্রমাণ করে যে, জমিলারা নিঃশেষিত হয়ে যায়

না, তারা রহীমাদের মধ্যে বেঁচে থাকে এবং সংখ্যায় ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পায়।


সামাজিক উপন্যাস হিসেবে 'লালসালু'র সার্থকতা

'লালসালু' সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র প্রথম উপন্যাস, আমরা প্রথমেই উল্লেখ করেছি যে এটি

দুঃসাহসী প্রয়াস। জীবন বাস্তবতা যেমন তেমনি সামাজিক বাস্তবতাও এর ভিত্তি। গ্রামীণ

জনজীবনকে এবং তার মানসিক, চিন্তা-ভাবনা, সুখ-দুঃখ ও বিশ্বাস সংস্কারগুলোকে

উপাদান হিসেবে ব্যবহার করে এই উপন্যাস রচিত হয়েছে এবং উপন্যাসের মধ্য দিয়ে

একটি সুস্পষ্ট বক্তব্যেও পৌঁছতে হয়েছে লেখককে। এই কারণে উপন্যাসের শিল্পরূপটি

যাতে সুসামঞ্জস্য হয় সেদিকে লেখক দৃষ্টি রেখেছিলেন। এর ভাষা সহজ কিন্তু ব্যঞ্জনাময়।

আঞ্চলিক শব্দ নিরাক, বতোর, মগরা ইত্যাদি যেমন ব্যবহার করেছেন, তেমনি পাশাপাশি

ও কাছাকাছি তৎসম, অর্ধতৎসম, আধুনিক শব্দও সুন্দর ও মানানসইভাবে ব্যবহৃত

হয়েছে। প্রতীক ও উপমা ব্যবহারের ক্ষেত্রেও লেখকের মাত্রাবোধ লক্ষ করার মতো।

কোন প্রকার নাগরিক প্রসঙ্গ আসেনি— সবই তুলে এনেছেন তিনি গ্রামীণ সমাজ ও

পটভূমি থেকে। উপন্যাসের যে কাহিনিগত কাঠামো, সেটিও লক্ষ করার মতো।

তাহেরের বাপের বিচার, আওয়ালপুরের পীর সাহেবের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা, আক্কাস

আলীর স্কুল প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা এসব ঘটনা বাইরের, সামাজিক এবং পরস্পর থেকে

বিচ্ছিন্ন। কিন্তু এই বিচ্ছিন্নতার ফাঁক পূরণ করা হয়েছে মজিদের পারিবারিক ঘটনা ও

চিন্তা-ভাবনার কথা সাজিয়ে। ঘটনাবলি বাইরের দিক থেকে সম্পর্কবিহীন থাকা সত্ত্বেও

'লালসালু' যে একটি সুসংহত শিল্পরূপ তার কারণ লেখকের শিল্পী মনের সজাগ

অভিনিবেশ। একজন লেখকের প্রথম উপন্যাসে এ ধরনের শিল্প ও আঙ্গিকগত বাঁধুনি

বিস্ময়ের উদ্রেক করে। এই কারণেই 'লালসালু' উপন্যাসখানি, লেখকের প্রথম রচনা

হলেও বাংলা সাহিত্যের বিশাল ও বিস্তৃত ভূমিতে বিশেষভাবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে

সামাজিক উপন্যাস হিসেবে।।।

প্রকাশ সংক্রান্ত তথ্য 

লালসালু আজো পর্যন্ত বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ উপন্যাস বলে সুধীমহলে স্বীকৃত। তেমনি

কথাশিল্পী হিসেবে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর শ্রেষ্ঠত্বেও প্রায় কেউই দ্বিমত পোষণ করে না।

অল্পপরিসর পটভূমিকায় উপন্যাসের মৌলিক চরিত্র ও ধর্মরক্ষা এক কঠিন কাজ।

সেই কঠিন কাজে লালসালুর লেখক সফল হয়েছেন, এ-কথা দ্বিধাহীন চিত্তে বলা চলে।

মানুষের জীবন জিজ্ঞাসা নানা পথে নানা মাধ্যমে উত্তর খুঁজতে থাকে। জীবন

নিঃশেষ হতে থাকে জীবনের ঘাটে ঘাটে, কিন্তু জিজ্ঞাসার উত্তর তবু পাওয়া যায় না।

প্রশ্ন থেকে প্রশ্নোত্তরে যে ব্যাকুল হৃদয় আত্মপ্রতিষ্ঠার সন্ধান চায়, যে-হৃদয়ের সান্ত্বনামেলে না শেষ পর্যন্ত কোথাও।


লালসালুর রক্ত রঙিন আবরণে ঢাকা থাকে বহু বেদনা বহু বঞ্চনার কাহিনী লেখা

থাকে বহু ব্যর্থ কামনার ইতিহাস। লোভী ও কামাকাঙ্ক্ষী এক অতৃপ্ত মনের হাহাকার!

সেই ইতিহাসের নগ্ন বিধৃতি সমগ্র লালসালুতে।


অন্ধকার ঝোড়ো রাত্রির প্রান্তিক নির্জনতায় এক রহস্যময় গোরস্থানে মুক্তবক্ষ

জমিলার ঋজু-নগ্ন পায়ের ইঙ্গিত প্রতারক, ভণ্ড মজিদের সমস্ত জীবনের ব্যর্থতাকে


সাহঙ্কারে চিহ্নিত করে রাখল। সেই চিহ্নিত ব্যর্থতার করুণ ইতিহাস লালসালু ।

বাংলাদেশের মৌলিক সাহিত্যকর্ম আমাদের রাষ্ট্রসীমার বাইরে খুব বেশি সংখ্যক

পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণের সুযোগ লাভ করেনি। কিন্তু সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র লালসালুরফরাসি অনুবাদ ‘ট্রি উইদাউট রুট' বিদেশে উল্লেখযোগ্য খ্যাতির গৌরব অর্জন করতে

সমর্থ হয়েছে। ফ্রান্স, বেলজিয়াম ও সুইজারল্যান্ডের বিদগ্ধ পাঠক সমাজেৱ মন জয়করেছে এই বইখানি। পর্যায়ক্রমে ইংরেজি, ফরাসি, জার্মান ও চেক ভাষায় অনূদিত

হয়ে সমাদৃত হয়েছে লালসালু ।

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র বাংলা উপন্যাস লালসালু ঢাকায় প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৪৮

সালে। ১৯৬৪ সালে ফ্রান্সের প্রথম শ্রেণীর প্রকাশক এডিশন্স দ্য সেউইল 'ট্রি উইদাউট

রুট' নামে উপন্যাসটির অনুবাদ প্রকাশ করেন। তখন থেকেই বইটি বিদেশে সমাদৃত

হয়ে আসছে। ফ্রান্সের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ও বেতারে বইটির যে-সব সমালোচনা

প্রকাশিত ও প্রচারিত হয় তাতে বইটির আশাতীত সাফল্য প্রমাণিত হয়েছে ।বৃটেন ও যুক্তরাষ্ট্রেও লালসালু প্রকাশের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে ইউনেস্কো

প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে।

খ্যাতনামা ফরাসি সাহিত্য সাপ্তাহিকী 'লা নভেলা'য় 'ট্রি উইদাউট রুট' সম্পর্কে

মন্তব্য করতে গিয়ে বলা হয় সিংযত ও মহিমান্বিত ভাষাতরঙ্গে সুগ্রথিত এই কাব্যময়

উপন্যাসটি এক উন্নত শ্রেণীর সুজনি শিল্পকর্ম


"লা গচা'তে নিম্নলিখিত কয়েকটি শব্দে বইটির প্রশংসা করা হয়। “গ্রন্থকারের গল্প

বলার যে প্রতিভা মূর্ত হয়েছে তাতে পাঠকমাত্রই চমৎকৃত না হয়ে পারেন না। পাক

ভারত উপমহাদেশের উৎকৃষ্ট কাহিনি সৃষ্টির জন্যে যশস্বী লেখকদের সঙ্গে অনায়াসেই

তুলনা করা চলে।

এসপেকটস দ্য লা ফ্রান্স' পত্রিকায়ও উপন্যাসটির প্রশংসা করে বলা হয় “বছর

শেষে সাহিত্য বিচারকগণ আমাদের দেশে যে-সকল বই বাছাই ও মনোনীত করেন

আলোচ্য বইটি নিশ্চয়ই সেগুলোর অধিকাংশ থেকে উন্নত মানের ”


জেনেভার “লে জর্নাল" পত্রিকায় বলা হয় : “যার সঙ্গে আপনার দেখা হবে

তাকেই জিজ্ঞেস করুন, আপনি কি ওয়ালীউল্লাহ্র বই পড়েছেন? হৃদয়স্পর্শী রচনাশৈলী

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র কাহিনীকে এমন কাব্যিক পরিমণ্ডলে উন্নীত করেছে যেখানে জীবস্ত

বাঙ্ময় প্রকৃতির সমন্বয় ঘটেছে মানব অনুভূতির— যেখানে ধর্মীয় বিশ্বাসের নিভৃত

পদচারণা সে বিশ্বাস খাঁটিয়ে হোক অথবা প্রেরণাসঞ্জাত আবেগেই হোক, আমাদের

কাছে সূক্ষ্ম মনস্তাত্ত্বিক উপলব্ধিতে তার বহিঃপ্রকাশ।


বিখ্যাত বেলজিয়াম দৈনিক “লা লিবার বেলজিক” মন্তব্য করেছে : “... উপন্যাসটি

সমসাময়িক কালের যে কোন বইয়ের সমতুল্য। সেই সঙ্গে এ যেন প্রমত্ত ও শান্ত বায়ু

প্রবাহের মধ্যে দ্বৈরথ যুদ্ধ, যেখানে শ্রেষ্ঠ ও নিকৃষ্ট ধরনের মানুষ পারস্পরিক

বিরোধিতায় লিপ্ত।"


লালসালুর আলোচ্য অনুবাদ গ্রন্থটি সম্পর্কে এমনি প্রশংসাসূচক বহু মন্তব্যের

কয়েকটি নিম্নে দেয়া হলো :

" ‘ট্রি উইদাউট রুট’ . একটি বলিষ্ঠ ও মনোরম সামাজিক চিত্র যেখানে ঘৃণা হচ্ছে

প্রেমেরই চিত্রান্তর।” ওরিয়েন্ট


"বইটির পাতায় পাতায় একটি দেশ ও দেশ প্রথা এমন সূক্ষ্ম কারুকার্যের সঙ্গে চিত্রিত

যে তাতে মানব মনের চিরন্তন প্রকৃতি মূর্ত হয়ে উঠেছে! –অক্স ইকোটস দ্য মন্দি।

‘ট্রি উইদাউট রুট' একটি অচল ও নিঃশঙ্ক বৃক্ষের বিবর্ণ প্রত্যাশার কাহিনি।

উপন্যাসটির বর্ণনভঙ্গি মনোরম। মানবিক বাস্তবতাবোধ সম্পর্কে লেখক অত্যন্ত সচেতন–

লেট ক্রুই।

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র 'ট্রি উইদাউট রুট' আপনাকে আনন্দ দেবে।" রেডিওযসানী।

ফরাসি দৈনিক “লা প্রোগ্রেস ডিমাশো"-এর প্রশংসায় প্রত্যেক বাঙালি বুক গর্ব ও

আনন্দে ফুলে উঠবে। পত্রিকাটিতে বলা হয় “ফ্রান্সে বাংলা সাহিত্যের সার্থক উত্তরণ"।।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ