Hot Posts

6/recent/ticker-posts

পথের পাঁচালী উপন্যাস আলোচনা /চরিত্রসমুহ


---পথের পাঁচালী উপন্যাস আলোচনা /চরিত্রসমুহ পথের পাঁচালী উপন্যাস আলোচনা চরিত্রসমুহ পথের পাঁচালী এর বিষয়বস্তু সামাজিক চিত্র পথের পাঁচালী প্রশ্ন উওর অপু চরিত্র দুর্গা চরিত্র পথের পাঁচালী উপন্যাসের উক্তি---

**বিঃদ্র-বাংলা বিভাগের সকল পড়াশোনা পেতে ব্লগটিতে যুক্তথাকুন   https://monoweredu13.blogspot.com/?m=1 
 

সাহিত্যের অন্যতম শাখার মধ্যে উপন্যাস একটি বিশেষ শাখা।সাহিত্যশিল্পী রা উপন্যাসের মাধ্যমে মানুষের মনস্তাত্ত্বিক, সামাজিক ও মানবিক বিষয়গুলো খুব সুন্দর ভাবে তুলে ধরেন।উপন্যাস যেন হয়ে উঠে মানুষের কিংবা সমাজের প্রতিবিম্ব। বাংলা সাহিত্যে যে সকল উপন্যাসিক পাওয়া যায় তাদের মধ্যে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় অন্যতম।তার সাহিত্য কর্মে শহরের চেয়ে পল্লিকেন্দ্রিক বিষয়  বেশি ফুটে উঠেছে। তার লেখা উপন্যাসগুলোর মধ্যে "পথের পাঁচালী" উপন্যাসটি অন্যতম।‘বিচিত্রা'-র দ্বিতীয় বর্ষের প্রথম সংখ্যা (আষাঢ়, ১৯৩৫) থেকে 'পথের পাঁচালী' নিয়মিত কিস্তিতে প্রকাশিত হতে শুরু হয় এবং সমাপ্ত হয় ১৩৩৬ সালের আশ্বিন মাসে।'পথের পাঁচালী' বিভূতিভূষণের প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ।'পথের পাঁচালী' উপন্যাসখানিকে লেখক তিনটি পর্বে ভাগ করেছেন এবং তাদের নামকরণ করেছেন-'বল্লালী বালাই', 'আম-আঁটির ভেঁপু', ও 'অক্রূর সংবাদ'। পুরো উপন্যাসে ৫ টি প্রধান চরিত্র পাওয়া যায়। অপু,দুর্গা,ইন্দিরঠাকরুন,সর্বজয়া,হরিহর।


**পথের পাঁচালী উপন্যাস আলোচনাঃ-

তিনটি ভাগে  বিভক্ত উপন্যাসটিতে গ্রামীণ জীবনযাত্রার চিত্র ফুটে উঠেছে। তিনটি ভাগে যা পাওয়া যায়ঃ-

(১)বল্লালী বালাই পর্বঃ-

 কিংবদন্তী প্রচলিত আছে যে আমাদের দেশে কৌলীন্য প্রথার প্রবর্তন করেন রাজা বল্লাল সেন। সেই প্রথা অনুসারে নামজাদা নৈকষ্য কুপীনেরা এক একজন বহু কন্যার পাণিপীড়ন করতে পারতেন—পঞ্চাশ, ষাট, সত্তর এমন কি শতাধিক স্ত্রীর কুলীন স্বামীর কথাও শোনা যায়। অতি বৃদ্ধ কুলীনের বালিকা বা তরুণী বিবাহও খুব দুর্লভ ব্যাপার ছিল না। এই সব কুলীন জামাই পালা করে এক এক শ্বশুরবাড়ী আসতেন এবং মোটা পাওয়া-গন্ডা আদায় করে পরের দিনই অন্য শ্বশুরবাড়ী রওনা হতেন। স্ত্রীরা সকলেই যে-যার বাপের বাড়ীতেই অবস্থান করত। পিতামাতার মৃত্যুর পর এদের দুর্দশার আর অবধি থাকত না। ভাইয়ের অথবা অন্যান্য আত্মীয়ের গলগ্রহ স্বরূপ এরা দুমুঠা অন্নের জন্য সংসারের 'বালাই হয়ে পড়ে থাকত। ইন্দির ঠাকরুণ এমনি কোন মহাকুলীণের অন্যতমা পত্নী, বল্লাল সেনের প্রতিষ্ঠিত যূপকাষ্ঠের অন্যতম বলি। তিনিই 'পথের পাঁচালী'-র 'বল্লালী বালাই'।

উপন্যাসের প্রথম ছয়টি পরিচ্ছেদ নিয়ে এই পর্বটি গড়ে উঠেছে। ইন্দির ঠাকরুণের কাহিনী এতখানি বিশদ ও বিস্তৃত ভাবে বর্ণনা করার একাধিক কারণ আছে। প্রথম কারণটি ঘটনা সংস্থানের যৌক্তিকতা সংক্রান্ত। 'পথের পাঁচালী'-তে অপুর 'মনের আনন্দের প্রগতির ইতিহাস, তার ক্রমবর্ধমান চেতনার ইতিহাস' বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু এই ইতিহাস নবজাত অপুকে নিয়ে শুরু হতে পারে না, কারণ তখনও তার আনন্দ অথবা চেতনা কিছুই প্রয়োজনীয় পরিমাণে সুপরিণত হয় নি। সেজন্য কিছু সময়ের প্রয়োজন। ইন্দির ঠাকুণের জীবন ও মৃত্যু কাহিনীর মধ্যে এই সময়টুকু আমরা পাই এবং বুঝতে পারি যে এই অবকাশে অপু একটু বড় হয়ে উঠেছে—ছয়-সাত বছরের বালকের পক্ষে উপন্যাসের কেন্দ্র-চরিত্র হতে কোন বাধা নেই।

দ্বিতীয় কারণটি চরিত্র-সংক্রান্ত। এই পর্বেই আমরা হরিহরের অবৈষয়িক মনোভাবের ও সংসার সম্বন্ধে ঔদাসীন্যের সামান্য কিছু আভাস পাই। আর পাই দুর্গার চরিত্রের কিছু পরিচয়। অসহায়ের প্রতি তার ভালোবাসা ও অবাঞ্ছিতের প্রতি তার সমবেদনা পরিস্ফুট হয়ে উঠেছে ইন্দির ঠাকরুণের সঙ্গে তার সম্পর্কের মধ্যে দিয়ে। এই সহায়-সম্বলহীনা সংসারের 'বালাই'-স্বরূপিনী পিসিমাটির দৈন্য-দুর্দশায় ও ব্যথা-বেদনায় বার বার তার চোখে জল এসেছে; লাঞ্ছিতা ও উৎপীড়িতা বৃদ্ধার জন্য তার মমতার অন্ত নাই। তা ছাড়া সৰ্ব্বজয়ার চরিত্রের একটা দিকও এই অংশে প্রকাশিত হয়েছে। সর্বজয়াকে লেখক মহীয়সী মহিলারূপে চিত্রিত করেন নি। সে নিতান্তই সাধারণ নারী— একদিকে যেমন গরীবের ঘরের সুগৃহিনী ও পরম স্নেহময়ী জননী, অপরদিকে তেমনি কলহপরায়ণা ও নিষ্ঠুরপ্রকৃতি; আশ্রয়হীনা বৃদ্ধা ননদের প্রতি তার বিন্দুমাত্র মমতা বা সহানুভূতি নেই। তারই জন্য ইন্দির ঠাণকে বাড়ী ছেড়ে চলে আসতে হয়েছে এবং শোচনীয় অবস্থায় মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে।

তৃতীয় কারণটি গূঢ়তর তাৎপর্যবহ। উপন্যাসে বিভূতিভূষণ যে পথের পাঁচালী গেয়েছেন তা শুধু অপুর জীবনেই সীমাবদ্ধ নয়। অতীত ও ভবিষ্যৎ দুই দিকেই তার অন্তহীন বিস্তৃতি। ‘অপরাজিত’ উপন্যাসের উপসংহারে আমরা তার ভবিষ্যৎ বিস্তৃতির আভাস পাই; অতীত বিস্তৃতির আংশিক বর্ণনা পাই এই ‘বল্লালী বালাই’ অংশে। চলমান কালপ্রবাহের সুরই 'পথের পাঁচালী'-র মূল সুর। প্রথম ছয়টি পরিচ্ছেদের মধ্যেই লেখক তাঁর একতারাটিকে সেই সুরে বেঁধে নিয়েছেন। “ইন্দির ঠাকরুণের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে নিশ্চিন্দিপুর গ্রামে সেকালের অবসান হইয়া গেল”—এই কথাগুলির মধ্য দিয়ে লেখক এই কালপ্রবাহের দিকে, অর্থাৎ তাঁর উপন্যাসের সত্যকার তাৎপর্যের দিকে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন।


(২)"আম আঁটির ভেঁপু" পর্বঃ-

আম খেয়ে তার আঁটি কিছুদিন মাটিতে ফেলে রাখলে তা শুকিয়ে যায়। তখন তার দুদিকের শক্ত খোলা টেনে খুলে ফেলে দিলে ভিতরে একটা নরম 'কষি' পাওয়া যায়। এই কষির একদিক একটু ট্যারছা ভাবে পাকা বাড়ীর দেওয়ালে বা থামে, ছ্যাঁচা বেড়ার গায়ে অথবা যে কোন বন্ধুর বা অমসৃণ স্থানে ঘধে নিয়ে এক ধরনের বাঁশি তৈরি করে ছেলেমেয়েরা। শহরের শিশুরা এ বাঁশি কোন দিন বাজায় নি, বোধ হয় চোখেও দেখে নি' কিন্তু পাড়াগাঁয়ের দরিদ্র সংসারের বালক-বালিকারা এখনও এ বাঁশি তৈরি করে এবং বাজিয়ে। আনন্দ লাভ করে। এই 'আমের আঁটি থামে ঘষে' বানানো নি-খরচার বাঁশিকেই বিভূতিভূষণ 'আম-আঁটির ভেঁপু' আখ্যা দিয়েছেন এবং পল্লীবালকের সরল আনন্দের প্রতীক রূপে ব্যবহার করেছেন।

‘আম-আঁটির ভেঁপু’ পর্বটির বিস্তৃতি বাইশ পরিচ্ছেদব্যাপী (সপ্তম থেকে অষ্টাবিংশ পরিচ্ছেদ পর্যন্ত)। 'পথের পাঁচালী'র এইটিই দীর্ঘতম পর্ব ও সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ। এর মধ্যেই আমরা শিশু অপুর আনন্দময় চেতনার বিকাশ ও বিবর্তনের ইতিহাস লিপিবদ্ধ দেখতে পাই। এর মধ্যে আরও পাই নিশ্চিন্দিপুরের প্রকৃতির সঙ্গে তার আত্মার নিগূঢ় সম্পর্কে কাহিনী এবং নিশ্চিন্দিপুরের নানা নরনারীর সাহচর্যে ও সংঘাতে তার মনে একটা বিশেষ রঙ ধরার কাহিনী। তা ছাড়া হরিহর- সর্বজয়ার অভাব-অনটন কি ভাবে ক্রমশঃ তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে উঠল এবং কি ভাবে শেষ পর্যন্ত তাদের গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য করল তার বর্ণনাও আমরা এই পর্বে পাই। তাদের নিশ্চিন্দিপুর পরিত্যাগের কাহিনীতেই এ পর্বের সমাপ্তি।

'পথের পাঁচালী'-র নাম করলেই বাংলাদেশের গ্রাম-প্রকৃতির কথা মনে পড়ে। সেই প্রকৃতির বর্ণনা ও অপুর মনের উপর তার প্রভাবের কথা আমরা ‘আম-আঁটির ভেঁপু’-তেই পাই। পর্বটির কাব্যসৌন্দর্য ও অসাধারণ। অপু সত্যই ‘জাত কবি'—তার চোখ দিয়ে জগৎকে দেখার ফলে লেখক তার সমগ্র শৈশব-জীবনটাকেই এক অপরূপ কাব্যে পরিণত করে ফেলতে সক্ষম হয়েছেন।


(৩) "অক্রুর সংবাদ" পর্বঃ-

শ্রীকৃষ্ণের এক পিতৃব্যের নাম অক্রূর। মথুরায় যখন অত্যাচারী রাজা কংসের কুশাসন ও প্রজাপীড়ন সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে উঠেছে তখন সর্ববাদিসম্মতরূপে স্থির হল যে কংসনিধনের জন্য ও মথুরায় রাজসিংহাসন অধিকার করে সেখানে পুনরায় শান্তি ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার জন্য বসু দেবনন্দন কৃষ্ণকে বৃন্দাবন থেকে অবিলম্বে নিয়ে আসা প্রয়োজন। এই উদ্দেশ্যে রথ নিয়ে বৃন্দাবনে যান এবং ব্রজ গোপিনীদের সকাতর অনুরোধ, মিনতি ও ক্রন্দন উপেক্ষা করে তাঁকে রথে চড়িয়ে মথুরায় রওনা হয়ে যান। এইভাবে কৃষ্ণের বৃন্দাবনে বাল্যলীলার অবসান হয়। 'পথের পাঁচালী' র ছয় পরিচ্ছেদব্যাপী এই তৃতীয় পর্বটিতে ও অপুর বাল্য লীলার অবসান ও নিশ্চিন্দিপুর পরিত্যাগ বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু প্রকৃত বিদায়দৃশ্যটি আমরা দেখতে পাই 'আম-আঁটির ভেঁপু'-র শেষ পরিচ্ছেদে। তৃতীয় পর্বের সবটাই অপুদের কাশীবাসের ও কোন এক অজ্ঞাতনামা শহর প্রবাসের কাহিনী। সুতরাং আমার মতে এর নাম 'অক্রূর সংবাদ' না দিয়ে 'মাথুর' দিলেই বোধ হয় বেশি যুক্তিযুক্ত হত।—তবে অপুর মাথুর-পর্ব শ্রীকৃষ্ণের মাথুরের মত সুখ ও ঐশ্বর্যের কাহিনী নয়, একটানা অভাব-অনটন ও দুঃখ-বেদনার কাহিনী।

ইংরাজী, ফরাসী, জার্মান ও রুশ চারটি ভাষার অনুবাদেই 'অক্রূর সংবাদ' পরিত্যক্ত হয়েছে। এর কারণ খুঁজে পাওয়া ও খুব কষ্টসাধ্য নয়। কাহিনীর দিক দিয়ে বিচার করলে এ পর্বটির কোন শিল্প-সার্থকতা নেই। 'পথের পাঁচালীকে যদি স্বয়ংসম্পূর্ণ উপন্যাস বলে বিবেচনা করা যায় তাহলে অপুদের নিশ্চিন্দিপুর পরিত্যাগেই তার সমাপ্তি। কিন্তু আমরা সবাই জানি তার কাহিনী ‘পথের পাঁচালী'র গন্ডি পেরিয়ে 'অপরাজিত'-র ভিতর দিয়ে আরও বহুদূর বিস্তৃত হয়ে গেছে। (বিদেশী পাঠকদের তা জানা সম্ভব নয়, কারণ ছায়াচিত্রের মাধ্যমে, ‘পথের পাঁচালী' ইউরোপ-আমেরিকায় যে সর্বজন-পরিচিতি অর্জন করেছে। ‘অপরাজিত' তা করতে পারে নি।) অপুর পথ যে এই গ্রন্থেই ফুরিয়ে যায় নি গ্রন্থের উপসংহারে লেখক তা বেশ স্পষ্ট করেই বুঝিয়ে দিয়েছেনঃ “পথের, দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন—মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি...পথ আমার চলে গেল সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...চল এগিয়ে যাই।”

কিন্তু ‘অক্রূর সংবাদ' পর্বের আরও কিছু সার্থকতা আছে। এই পর্বে অপু পিতৃহীন হল, অন্নাভাব ও অনাহারের কষ্ট অনুভব করতে শিখল, অবশেষে অনাত্মীয় ধনীর গৃহে অবাঞ্ছিত গলগ্রহ রূপে বাস করতে বাধ্য হল। মনে হয় যেন তাকে নিয়ে অদৃষ্ট-দেবতার একটা এক্সপেরিমেন্ট চলছে—দুঃখের আগুনে পুড়িয়ে তাকে ক্রমে ক্রমে পাকা সোনায় পরিণত করা হচ্ছে। অবশ্য এই পর্বে তার দুটো বড় বড় লাভও হয়েছে। প্রথমতঃ এই পর্বে তার সঙ্গে লীলার আলাপ-পরিচয় ঘটেছে—যে লীলা তার জীবনের একমাত্র নারী, যাকে ভালোবেসে এবং যার ভালবাসা পেয়ে পরবর্তীকালে তার জীবন ধন্য হয়েগেছে।— আর দ্বিতীয়তঃ এই পর্বেই সে নিশ্চিন্দিপুরের সঙ্গে, তার নিসর্গ ও নরনারীর সঙ্গে একটা অতি নিবিড়, অতি ঘনিষ্ঠ নাড়ীর যোগ, একটা বিচিত্র মায়াবন্ধনের অস্তিত্ব সম্বন্ধে সচেতন হয়ে উঠেছে। এ বন্ধন থেকে জীবনে সে কোনদিন মুক্তি পায় নি, বোধ হয় মুক্তি চায়ও নি।


'পথের পাঁচালী'-র সত্যকার বিষয়বস্তু অপুর “মনের আনন্দের প্রগতির ইতিহাস, তার ক্রমবর্ধমান চেতনার ইতিহাস।" এইদিক দিয়ে বিচার করলে 'বল্লালী বালাই-কে উপন্যাসের বিষয়বস্তু থেকে বিচ্ছিন্ন অন্যতর-উদ্দেশ্য প্রণোদিত মুখবন্ধ বলে বিবেচনা করাই সঙ্গত, কিন্তু 'অক্রূর সংবাদ' এই আনন্দচেতনার ক্রমবিকাশেরই একটি অতিপ্রয়োজনীয়, অপরিত্যাজ্য অংশ। কোন কোন সমালোচক 'পথের পাঁচালী'-র অপুকে অপরিণত শিশু মাত্র বলে মনে করেন এবং কাহিনীর কেন্দ্রে স্থাপন করেন সর্বজয়াকে। তাঁরা এ উপন্যাসে নিরবচ্ছিন্ন ট্রাজেডি ছাড়া আর কিছুই দেখতে পান না। তাঁদের সমালোচনা ভ্রান্ত সমালোচনা। এ উপন্যাসের মধ্যমণি অপু। তার উপর নানা প্রভাব কার্যকরী হয়েছে—পিতামাতার প্রভাব, ভগিনী দুর্গার প্রভাব, পাড়া প্রতিবেশীদের প্রভাব, এবং সর্বোপরি পল্লীপ্রকৃতির প্রভাব। ফলে তার মন ধীরে ধীরে অপরিণতি থেকে বিবর্তিত হয়ে একটা বিশিষ্ট রূপ ও রঙ্ অর্জন করেছে, এবং এই বিবর্তনের প্রক্রিয়াটি আনন্দের মাধ্যমেই সাধিক হয়েছে। শিশু ও বালক অপুর এই মানসিক বিবর্তনের কাহিনী 'পথের পাঁচালী'র প্রধান ও প্রায় একমাত্র উপজীব্য।নিশ্চিন্দিপুরের নিসর্গেও অসাধারণ কিছু নেই—সেই পুরাতন গাছ-লতাপাতা, পাখি-ফুলফল, নদী-মাঠ। কিন্তু বিভূতিভূষণের কবিদৃষ্টির আলোয় সব কিছুই, সমস্ত পল্লীপ্রকৃতি ও পল্লীজীবন, এক অত্যাশ্চর্য ও অসাধারণ উদ্ভাসে মধুর ও মায়াময় হয়ে উঠেছে। এই ঐন্দ্রজালিক শক্তিই তাঁর প্রকৃতি বর্ণনার উৎস—এই শক্তিই বাংলার একটা সাধারণ গ্রামকে সৌন্দর্যের মায়াপুরীতে পরিণত করেছে, সাদামাটা বর্ণনার ভাষাকে রহস্যময়পাবে না—বিশেষ করে যদি অপুকে এর কেন্দ্র-চরিত্র হিসাবে ধরা যায়। সমগ্র 'বরাণী বালাই' অংশে অপু হয় অনুপস্থিত নয়তো নেহাৎ শিশু মাত্র। আম আঁটির ভেঁপু' অংশে যেটুকু কাহিনী আছে, অর্থাৎ যে সব ছোটখাটো বিচ্ছিন্ন প্রসঙ্গের বর্ণনা আছে—যেমন চালভাজা খাওয়ার কথা, যাত্রা দেখার কথা, যজমানবাড়ী যাওয়ার কথা, রেলগাড়ী দেখতে যাওয়ার কথা, আতুরী বুড়ীর সঙ্গে সাক্ষাৎকার, দুর্গার সোনার কৌটা চুরির কথা—সবই চেতনা বিবর্তন ভিত্তিক, সব কিছুরই উদ্দেশ্য অপুর মনের পরিপুষ্টি সাধন। সত্যকার ঘটনাভিত্তিক কাহিনী শুরু হয়েছে 'অক্রূর সংবাদ' থেকে।—এটা যে একটা ত্রুটি তাতে কোন সন্দেহ নেই, কিন্তু মনে হয় যেন এ ত্রুটি বিভূতিভূষণের ইচ্ছাকৃত।'পথের পাঁচালী'-র ভাষা সম্বন্ধে তার চেয়ে বিশেষ বেশি কিছু বলার প্রয়োজন নেই। রোমান্টিক কাব্যসৌন্দর্যমন্ডিত রূপালঙ্কার-সমৃদ্ধ ভাষা এবং নিরাভরণ বস্তুনিষ্ঠ আটপৌরে ভাষা—দ্বিবিধ ভাষা ব্যবহারেই বিভূতিভূষণ সমান সুদক্ষ ছিলেন। কোন প্রকার ভাষাই তিনি আত্মসচেতনভাবে শুধু ভাষার খাতিরে ব্যবহার করতেন না; বর্ণনীয় বিষয়বস্তুর টানে প্রয়োজনীয় ভাষা তাঁর কলমে আপনিই এসে দেখা দিত। 'আম-আঁটির ভেঁপু' অংশের ভাষা প্রথম জাতের, 'বল্লালী বালাই’ ও ‘অক্রুর সংবাদ’-এ অন্যবিধ ভাষা ব্যবহৃত হয়েছে। অপু ও গ্রামপ্রকৃতি যেখানে একত্র মিলিত হয়েছে সেখানকার অন্তর্দৃষ্টিরআলোকোত্তাসিত ভাষা এবং বাস্তব জীবনচরিত্রের আনুষঙ্গিক realistic ভাষা-উপন্যাসের ভাববস্তুর দিক দিয়ে বিচার করলে এরা পরস্পর থেকে পৃথক নয়। গঙ্গা-যমুনা সঙ্গমের মত এরা একই খাতে প্রবাহিত, এদের উদ্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুও এক।


**অন্যান্য উপন্যাসের আলোচনার জন্য লিংক এ ক্লিক করুনঃ-

https://monoweredu13.blogspot.com/2022/01/blog-post_21.html?m=1


***'পথের পাঁচালী'ঃ পাঁচটি চরিত্রঃ-

(১)অপুঃ-

'অপরাজিত' উপন্যাসে যে কিশোর ও যুবক অপুর ছবি আঁকা হয়েছে 'পথের পাঁচালী'-তে তার সূচনা মাত্র আমরা পাই। অপুর শৈশব এ উপন্যাসের একমাত্র না হলেও সর্বপ্রধান উপজীব্য। তার চরিত্রে অসাধারণত্ব আছে সত্য, কিন্তু সে বাংলাদেশের সাধারণ পল্লীশিশুও বটে। অপুর সাধারণত্বের প্রমাণ আমরা পাই তার চালভাজা বা পানসে পায়েস খাওয়ার অবোধ আনন্দে, তাজবিবিধ ছবি দেখার আগ্রহে, বাবার অনুপস্থিতিতে লেখাপড়া ফেলে গুলি খেলতে বেরিয়ে পড়ায়, সামান্য সামান্য খাদ্যবস্তু বা বুনো ফলমূলের প্রতি লোভের আতিশয্যে—দেখলেই মনে হয়, একে তো আমরা চিনি, পাড়াগাঁয়ের পথে-ঘাটে একে তো বহুবার দেখেছি। আর তাকে অসাধারণ করে তুলেছে তার কল্পনাপ্রবণ সৌন্দর্যদৃষ্টি। সে যাত্রা দেখতে দেখতে যাত্রার ঘটনার সঙ্গে একাত্ম হয়ে যায়, সান্ন্যাল মহাশয়ের দেশভ্রমণের গল্পের প্রত্যেকটি কথা যেন দুর্ভিক্ষের ক্ষুধার আগ্রহে’ গিলতে থাকে, 'সর্বদর্শন সংগ্রহ' পড়তে পড়তে মনে মনে পারা-ভরা শকুনির ডিম মুখে পুরে আকাশে উড়ে বেড়ায়। সবচেয়ে বড় কথা, এই অসাধারণ কল্পনাপ্রবণতাই তাকে নিশ্চিন্দিপুরের নিসর্গ-স্বর্গের অন্তর্লোকে প্রবেশের ছাড়পত্র দিয়েছে, এই গুণেই সে হয়েছে উঠেছে “অর্ধেক মানব আর অর্ধেক প্রকৃতি"।

অপু নিশ্চিন্দিপুরকে ভালোবাসে—কিন্তু নিশ্চিন্দিপুরের এই আকর্ষণ গ্রাম বাংলার কোমল-মধুর নিসর্গ-সৌন্দর্যের আকর্ষণ মাত্র নয়। অপুর কাছে নিশ্চিন্দিপুর গ্রামজীবনের প্রতীক-স্থানীয় বস্তু নয়। ঠিক অপু যেমন অপু, অন্য কেউ নয়, তেমনি নিশ্চিন্দিপুরও একটা বিশিষ্ট বস্তুসত্তা ও ভাবসত্তা বাংলাদেশের যে কোন একটা গ্রাম মাত্র নয়। বিভূতিভূষণ প্রকৃতি-প্রেমিক ছিলেন; তাঁর অপুও প্রকৃতি-প্রেমিক—পরবর্তী জীবনে বিশ্ব-প্রকৃতির বৈচিত্রময়সৌন্দর্য তাকে মুগ্ধ করেছে, অভিভূত করেছে। কিন্তু তার সঙ্গে নিশ্চিন্দিপুর ও নিশ্চিশিপুরের নিসর্গের যে সম্পর্ক তা ওয়ার্ডসওয়ার্থীয় প্রকৃতি প্রেমিকের সঙ্গে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সম্পর্ক মাত্র নয়। এ সম্পর্ক একান্তভাবে ব্যক্তিগত সম্পর্ক-জননী ও সন্তানের সম্পর্কের মত, প্রেমিক ও প্রেমিকার সম্পর্কের মত গোপন ও অন্তরঙ্গ সম্পর্ক-mystic, esoteric সম্পর্ক। সব গ্রাম অপুর ভাল লাগে না, কারণ সব গ্রাম তো নিশ্চিন্দিপুর নয়। 'অপরাজিত' উপন্যাসে মনসাপোড়া গ্রাম সম্বন্ধে কথাটি বেশ স্পষ্ট করেই বলা হয়েছে ? "অপুর কেমন মনে হয় নিশ্চিন্দিপুরের সে অপূর্ব মায়ারূপ এখানকার কিছুতেই নেই।”

শিশুকাল থেকেই অপু ভাবপ্রবণ ও কল্পনা-বিলাসী, অথাৎ সে কবি। তাই তার নিসর্গদৃষ্টি প্রধানতঃ কবিদৃষ্টি। তার কাব্য মাধুর্যের কাব্য; তার গানের সুর রাখালিয়া বাঁশির অথবা বৈষ্ণবের একতারার সুর। কিন্তু তবু তার ক্ষুদ্র বালুকণার মধ্যে বিশ্বরূপ দর্শনের ক্ষমতা আছে—এবং এই ক্ষমতা আছে বলে এই অপরিণতবুদ্ধি বালক আমাদের এমন রহস্যময়ভাবে আকর্ষণ করতে পারে। অপুর চরিত্রেরও একটা mystic দিক আছে।

বড় হবার পর অপু একটা বিষয় অন্তর্দ্বন্দ্বে ভুগেছিল অনেকদিন ধরে। একদিকে বাইরের টান, বেরিয়ে পড়ার আহ্বান বৃহত্তর সাধনা ও বৃহত্তর সিদ্ধির ইঙ্গিত, অন্যদিকে নিশ্চিন্দিপুরের মমতামেদুর কেন্দ্রাভিগ আকর্ষণ। শিশু অপু একান্তভাবে নিশ্চিন্দিপুরেরই, কিন্তু তবু এই বহির্মুখী আকর্ষণ এর মধ্যেই বীজাকারে দেখা দিয়েছে তার চরিত্রে। এই জন্যই সে যাত্রাদলে যোগ দিয়ে দেশ ছেড়ে চলে যেতে চায়; এই জন্যই ‘মহারাষ্ট্র জীবন-প্রভাত' ও 'রাজপুত জীবন-সন্ধ্যা' পড়তে পড়তে তার মন চলে যায় “রাজ বারার মরুপর্বতে, দিল্লী আমার রঙ মহালে শিমহালে"; এই জন্যই ভ্রমণবীর সান্যাল মহাশয়কে পাঠ শালায় আসতে দেখলে সে “অসীম আহাদে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে; এই জন্যই 'সীতার বনবাস'-এ 'জনস্থান মধ্যবর্তী প্রস্রবণগিরি' বর্ণনার মৃদঙ্গ-নির্ঘোষ শুনতে শুনতে তার মন কোন অজ্ঞাত দেশের আকাশে পাখা মেলে উধাও হয়ে যায়।

কাহিনীর দিক দিয়ে 'পথের পাঁচালী' স্বয়ংসম্পূর্ণ উপন্যাস নয়— মানসিক প্রবণতার বিচারে অপুও স্বয়ংসম্পূর্ণ চরিত্র নয়; 'অপরাজিত'-র সঙ্গে মিলিয়ে না পড়লে তার অনেকখানিই আমাদের বুদ্ধির অগম্য রয়ে যায়।


(২)দুর্গাঃ-

বিভূতিভূষণ নিজেই বলেছেন যে তিনি যখন প্রথম 'পথের পাঁচালী' লেখেন তখন তাতে শুধু অপুই ছিল, দুর্গা ছিল না। আমাদের পক্ষে অবশ্য আজ দুর্গাহীন অপুকে কল্পনা করাও দুঃসাধ্য। এর কারণ খুঁজে বের করা খুব একটা দুরূহ ব্যাপার নয়। আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় অপু ও দুর্গা বিপরীতধর্মী চরিত্র অপুর চোখে যে কবিদৃষ্টি আছে, অপুর মনে যে রোমান্টিক বিস্ময় আছে, দুর্গার মধ্যে তার ছিটেফোঁটাও নেই। সে পাড়াগেঁয়ে Tomboy মাত্র—জৈব আনন্দে ও প্রাণশক্তির চাঞ্চল্যে ভরপুর। অপু introvert, দুর্গা extro vert, কিন্তু তথাপি এরা পরস্পর-বিরোধী চরিত্র নয়, পরস্পর পরিপূরক চরিত্র। জনৈক সমালোচক এর একটি অতি চমৎকার ব্যাখ্যা দিয়েছেন : “শিশু মনের দুটি সাধারণ সত্তা আছে। একটি চঞ্চল অবাধ্য উদ্দাম, অন্যটি শান্ত স্বপ্নমুগ্ধ বিস্ময়-বিহ্বল। 'পথের পাঁচালী'-র দুর্গা ও অপুর চরিত্রের মধ্যে চিরন্তন শিশুর এই দ্বৈত সত্তার দুটির স্বতন্ত্র রূপ চোখে পড়ে” (শ্রীগোপিকানাথ রায়চৌধুরী)।

দুর্গা বনে-জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতে ভালোবাসে, কিন্তু প্রকৃতির অন্তর্লোকের কোন খবর রাখে না। অথচ সে-ই অপুকে প্রকৃতির সঙ্গে পরিচিত করে দিয়েছিল— তার হাত ধরেই অপু নিসর্গ সৌন্দর্যের মায়ালোকে প্রবেশ করেছিল। অপুর প্রকৃতি-সন্দর্শন প্রক্রিয়ার সে-ই হল পথপ্রদর্শক।


দুর্গা বেপরোয়া স্বভাবের মেয়ে। মায়ের নিষ্ঠুর ভর্ৎসনা ও নির্মম প্রহার, প্রতিবেশীদের নিন্দামন্দ, কিছুই সে গ্রাহ্য করে না; অত্যন্ত লোভী—পরের বাগানের ফলপাকুড় থেকে পরের ঘরে সোনা পর্যন্ত লোভের বশবর্তী হয়ে কিছুই তার চুরি করতে বাধে না।—অথচ এই দুর্গটি স্নেহ ও মমতার প্রতিমূর্তি হয়ে দেখা দেয় মাঝে মাঝে। অপুর প্রতি স্নেহের তার অন্ত নেই। অন্নন্দা রায়ের পুত্রবধূকে সে ভালোবাসে। বাবা-মাকেও না ভালবেসে সে থাকতে পারে না—যদিও বাবাকে ও দেখতে পায় কালেভদ্রে, আর মায়ের হাতের মার না খেয়ে একটা দিনও কাটে না। তা ছাড়া যে ইন্দির ঠাকরুণ সকলের অবাঞ্ছিত সংসারের বালাই, তাকেও সে ভালোবাসে—এত ভালোবাসে যে লোকের মনে হয় পূর্ব জন্মে সে বোধ হয় বুড়ীর মেয়ে ছিল। এই ভালোবাসার জোরেই দুর্গা আমাদের চিত্তজয় করেছে। যতদিন বেঁচে

ছিল এক মুহূর্তও তাকে ভুলে থাকতে পারি নি, মরে গিয়েও উপন্যাসের শেষ পৃষ্ঠাখানি পর্যন্ত স্মৃতির সৌরতে সমাচ্ছন্ন করে রেখেছে।


(৩)ইন্দির ঠাকরুণঃ-


একটা মেয়েলী কথা আছে, “অল্প দুঃখে কাতর, অনেক দুঃখে পাথর"। কথাটা ইন্দির ঠাকরুণ সম্বন্ধে বড় মর্মান্তিক ভাবে সত্য। বহু দুঃখ-বেদনার আগুনে পুড়ে আজ সে মানসিক স্থাবরত্বে এসে পৌঁছেছে। তার মধ্যে কোন রকম চরিত্র বিবর্তন প্রত্যাশা করা বৃথা। এই পঁচাত্তর বৎসরের বৃদ্ধা বেঁচে আছে শুধু নিশ্চিন্দিপুরের অতীত ইতিহাসের একমাত্র সাক্ষীরূপে। ঘরে-বাইরে অপমান ও হেনস্থা, শুধু দূর-দূর ছাই ছাই। যে হরিহরকে সে এত ভালোবাসত তার বউ সর্বজয়া তাকে দুচক্ষে দেখতে পারে না, দুবেলা তাকে নানা রকম অকথা কুকথা বলে। সবই আজ যেন তার গা-সওয়া হয়ে গেছে—দুঃখ ছাড়া জীবনের কাছে তার যে আর কিছু প্রাপ্য থাকতে পারে সেকথা আজ সে একেবারে ভুলে গেছে। কিন্তু এত দুঃখের মধ্যেও তার একটা সান্ত্বনার স্থল আছে, সে দুর্গা। এই পিসী-ভাইঝির মধ্যেকার মধুর সম্পর্কটিকে বিভূতিভূষণ অতি অল্প কথায় যে ভাবে আমাদের সামনে উপস্থাপিত করেছেন তা সত্যই অবিস্মরণীয়।

ইন্দির ঠাকরুণের জীবন-মৃত্যুর নিঠুর চিত্রকে অনেক আধুনিক পাঠক ও সমালোচক অতিরঞ্জিত বলে মনে করেন। তাঁদের অবগতির জন্য জানাতে চাই যে মাত্র ষাট-সত্তর বৎসর পূর্বে বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ ও কৌলীন্যপ্রথার যুগে বাংলার পল্লীতে পল্লীতে এমন অনেক ইন্দির ঠাকরুণকে দেখা যেত। “ইন্দির ঠাকরুণের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে নিশ্চিন্দিপুর গ্রামে সেকালের অবসান হইয়া গেল”—কথাটার ঐতিহাসিক তাৎপর্য এই তথ্যের মধ্যেই নিহিত।


(৪)সর্বজয়াঃ-

হরিহর-সর্বজয়ার সংসার দরিদ্রের সংসার। অভাব-অনটন দুঃখকষ্ট তাদের নিত্য-সঙ্গী। কিন্তু এ দুঃখ অপুকে বা দুর্গাকে স্পর্শ করতে পারে না—শিশুরা স্বভাবতঃই দারিদ্র্যের দুঃখ সম্বন্ধে সচেতন নয়। হরিহরের গায়েও এ দুঃখের বেদনা তেমন বেঁধে না, প্রধানতঃ দুটি কারণে। প্রথমতঃ সে সুযোগ পেলেই সংসার থেকে পালিয়ে যায়, অভাব-অভিযোগের নাগালেরআর দ্বিতীয়তঃ তার গায়ে আছে যুক্তিহীন আশাবাদের দুর্ভেদ্য বর্ম। সংসারের সমস্ত ধকল পোহাতে হয় সর্বজয়াকে। সে-ই সংসারের সবখানি জুড়ে আছে, তাই 'পথের পাঁচালী'র সে-ই সবচেয়ে ট্র্যাজিক চরিত্র।

সর্বজয়া মহীয়সী মহিলা নয়। তার অনেক দোষ আছে। সে মুখরা, স্বার্থপর, সঙ্কীর্ণচিত্ত, সর্বপ্রকার শিক্ষাদীক্ষাহীন। ইন্দির ঠাকরুণের সঙ্গে সে অকারণে কলহ করে, তার প্রতি নিষ্ঠুর দুর্ব্যবহার করে, ছেলেমেয়ে পরের বাগান থেকে ফলমূল চুরি করে আনলে তাদের তিরস্কার করে না। কিন্তু এত ত্রুটি-বিচ্যুতি সত্ত্বেও বিভূতিভূষণ তার মাতৃমহিমাকে ক্ষুণ্ন করে দেখান নি। সে আদর্শ জননী নয়—তার অপত্যস্নেহে ঔদার্য, ব্যপ্তি বা মহত্ত্ব কিছুই নেই; তার স্নেহ অন্ধ, সংকীর্ণ ও একদেশদর্শী, কিন্তু তা যেমন গভীর তেমনি প্রগাঢ়। সর্বজয়া যে আমাদের মনকে এতখানি নাড়া দিতে পারে, আমাদের মনের উপর এত গভীর ছাপ রেখে যেতে পারে তার একমাত্র কারণ তার মাতৃত্বের মহিমা, অপুর প্রতি তার ভালোবাসার গভীরতা ও তীব্রতা।


(৫)হরিহরঃ-

কোন কোন সমালোচক হরিহরকে ডিকেন্সের মিকবার চরিত্রের সঙ্গে তুলনা করেছেন। দুজনের মধ্যে সাদৃশ অবশ্যই কিছু আছে—মিকবারের মত হরিহরও আশা-মরীচিকার ছলনায় বার বার বিভ্রান্ত হয়, কিন্তু কিছুতেই তার শিক্ষা হয় না। এইবার ঠিক একটা কিছু হয়ে যাবে’, ‘শীঘ্রই সুদিনের মুখ দেখতে পাব’, ‘এত কষ্ট, এত অভাব আর থাকবে না'—আশার তার অন্ত নেই। কিছুই হয় না, সুদিন আসে না, অভাব ঘোচে না, কিন্তু হরিহরের অপরাজেয় আশাবাদে একটুও টোল খায় না। তবু হরিহর মিকবার নয়। এর দুটি কারণ আছে—একটি ঘটনাগত, একটি চরিত্রগত। দুজনেই দেশত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিল; কিন্তু মিকবার অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে অবস্থা ফিরিয়ে ফেলতে পেরেছিল, হরিহর কাশীতে গিয়ে তা পারে নি, শোচনীয় দারিদ্রের মধ্যেই তার জীবনাবসান হয়েছিল। তা ছাড়া দুটি চরিত্রও ভিন্ন জাতের—মিকবার আমাদের হাসায়, হরিহর কাঁদায়। তার বাউন্ডুলে প্রায়-যাযাবর জীবনের মধ্যে এমন একটা কিছু আছে যা আমাদের সহানুভূতি ও করুণা আকর্ষণ করে।

একজন তীক্ষ্ণধী সমালোচকের রচনা থেকে একটা উদ্ধৃতি দিয়ে হরিহর প্রসঙ্গ শেষ করবঃ “হরিহরের মধ্যেও একটা শিল্পীমন ছিল। তার কথকবৃত্তি,তার গ্রন্থসংগ্রহের প্রবণতা সেই দিকেই ইঙ্গিত করে। তার মধ্যেও একটা সুদূরতৃষ্ণা ও রোমান্স পিপাসা ছিল, যার জন্যে সে বিবাহোত্তর দশটি বছর নিরুদ্দেশে কাটিয়েছে।... অপু যত বড় হয়েছে, হরিহরের এই রূপটিকে সে তত ভালো করে উপলব্ধি করেছে। হরিহরের জীবনসংগ্রামে পরাজিত মূর্তি অপুর মনে বিশেষ কোন ছাপ রাখে নি। বাবা যে তাকে অর্থ-স্বাচ্ছন্দ্য দিয়ে যায় নি, এজন্য তার কোন ক্ষোভ ছিল না, কারণ অর্থে সে অতৃষ্ণ। বাবার কথকশিল্পী-রূপই তার মনে সাড়া জাগিয়েছে।” (শ্রীচিত্তরঞ্জন ঘোষ) নিজের প্রকৃতি-প্রীতি ও রোমান্স পিপাসারও মূল সে খুঁজে পেয়েছে পিতৃচরিত্রের উত্তরাধিকারের মধ্যে।


***তথ্যসংগ্রহঃ-

"পথের পাঁচালী"--বিভূতিভুষণ বন্দ্যোপাধ্যায়--মনজুর রহমান(ভুমিকাল

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ