Hot Posts

6/recent/ticker-posts

চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের কাহিনী /কালকেতু উপখ্যান এর কাহিনী


----চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের কাহিনী /কালকেতু উপখ্যান এর কাহিনী ধনপতি সদাগরের কাহিনী কবিকঙ্কণ মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর কবি প্রতিভা, সার্থকতা ও সামাজিক, রাজনৈতিক, প্রাকৃতিক চিত্রাবলী------

**বিঃদ্র-বাংলা বিভাগের সকল পড়াশোনা পেতে ব্লগটিতে যুক্তথাকুন https://monoweredu13.blogspot.com/?m=1 
 


বাংলা সাহিত্যে মুলত তিনটি যুগের সন্ধান পাওয়া যায়। 

(১)প্রাচীন যুগ

(২)মধ্য যুগ 

(৩)আধুনিক যুগ 

মধ্য যুগের বাংলা সাহিত্যের সাহিত্য কর্ম গুলোর মধ্যে মঙ্গলকাব্য অন্যতম।

চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের ধারাটি মঙ্গলকাব্যের অন্যতম প্রধান শাখা। অন্য শাখাগুলো মনসামঙ্গল ও ধর্মমঙ্গল। এছাড়াও আরও নানা ধরনের মঙ্গলকাব্য রয়েছে।‘মঙ্গলকাব্যের দিক থেকে দেখলে ষোড়শ শতাব্দী আসলে মনসামঙ্গলের যুগ। নয়, চণ্ডীমঙ্গলের যুগ। চণ্ডীমঙ্গলের কাহিনী এ কালে সর্বাধিক প্রসার লাভ করেছে, আর সর্বশ্রেষ্ঠ মহিমা লাভ করেছে মুকুন্দরাম চক্রবর্তী 'কবিকঙ্কণের' 'শ্রী শ্রী চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে। ১১ কিন্তু ড. সুকুমার সেনের মতে, 'মুকুন্দের কাব্যে পদাবলীর ভণিতায় কোন সুনির্দিষ্ট একটি নাম ব্যবহৃত নয়। 'অভয়ামঙ্গল', 'অম্বিকামঙ্গল', 'চণ্ডিকামঙ্গল' অথবা 'হৈমবতীশঙ্কর মঙ্গল', নূতন মঙ্গল', 'চণ্ডিকার ব্রতকথা' ইত্যাদি পাই ভণিতায়। কাব্যটিতে যে তিনটি কাহিনী বর্ণিত আছে তাহাতে দেবী অভয়ার পূর্ব ইতিহাস এবং মর্ত্যভূমিতে তাঁহার পূজা প্রচারের কথা পাই। দেবী চণ্ডী এখানে মঙ্গলময়ী, তিনি অভয়ধাত্রী মঙ্গলচণ্ডী। তাই এমন দেবীমাহাত্ম্য কাব্য 'চণ্ডীমঙ্গল' নামেই সমধিক পরিচিত হইয়া এসেছে। বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগের বিশিষ্ট সৃষ্টি মঙ্গলকাব্য।


**চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের কাহিনীঃ-


চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের মধ্যে যে কাহিনীটি রূপায়িত হয়ে উঠেছে তা দুই খণ্ডে বিভক্ত। এর প্রথম খণ্ডের নাম আক্ষেটিক খণ্ড এবং দ্বিতীয় খণ্ডের নাম বণিক খণ্ড। আক্ষেটিক বা ব্যাধ কালকেতুর উপাখ্যান নিয়ে প্রথম খণ্ড আর দ্বিতীয় বণিক খণ্ডে বর্ণিত হয়েছে বণিক ধনপতি সদাগরের কাহিনী।


**কালকেতু-উপাখ্যানঃ-


কবিকঙ্কণ মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের প্রথম কাহিনীটির নাম কালকেতু-উপাখ্যান। কালকেতু নামে একজন ব্যাধ বা পশুশিকারির কাহিনী এতে বর্ণিত হয়েছে। কাহিনীটি এ রকম :

কলিঙ্গ নামক রাজ্যের সীমান্তে এক অরণ্য। সেখানে বনদেবীর নাম চণ্ডী। চণ্ডীদেবীর দয়ায় বনের পশুরা পরম সুখে দিন কাটায়। এক সময়ে সে বনে এল কালকেতু নামে এক পশুশিকারি। সে ব্যাপকভাবে পশু শিকার করতে লাগল। তার অত্যাচারে পশুরা অতিষ্ঠ হয়ে উঠল। তারা বাঁচার কোন উপায় না দেখে সবাই চণ্ডীদেবীর শরণাপন্ন হল। তাদের আকুল আর্তনাদে চণ্ডীদেবীর মনে দয়া হল। তিনি পশুদের অভয় দান করলেন। পরদিন কালকেতু বনে পশু শিকার করতে এলে চন্ডীদেবী ছলনা করে সকল পশু লুকিয়ে রাখলেন। শিকারি কালকেতু শিকার করার মত কোন পশু পেল না। শুধু পেল একটি স্বর্ণগোধিকা। আর কিছু না পেয়ে সে এই স্বর্ণগোধিকাকে ধরে নিয়ে বাড়ি গেল।


দেবী চণ্ডীই এই স্বর্ণগোধিকার রূপ ধারণ করেছিলেন। কালকেতু তা মোটেই বুঝতে পারে নি। কালকেতু তাকে বাড়িতে আটকে রেখে বাজারে গেছে। তখন স্বর্ণগোধিকারূপিণী চণ্ডীদেবী সুন্দরী তরুণীর রূপ ধারণ করে। কালকেতুর স্ত্রী ফুল্লরা ঘরের মধ্যে সুন্দরী তরুণীকে দেখে আতঙ্কিত হয়। সে ভাবে তার স্বামী বুঝি তাকে নিয়ে এসে ঘরে তুলেছে।


কালকেতু এসে পরিস্থিতি দেখে বিচলিত হয়। তখন দেবী নিজের পরিচয় দিয়ে কালকেতুকে সাত ঘড়া ধন এবং একটি মহামূল্যবান আংটি দান করলেন। দেবীর আদেশে কালকেতু গুজরাটে বন কেটে এক নগর তৈরি করল। সে নগরে নানা ধরনের লোক এসে বসতি স্থাপন করেন গরটিকে পরিপূর্ণ করে তুলল। সেখানে ভাঁড়ুদত্ত নামে এক ধূর্ত লোকও এল। সে এসে কালকেতুর আশ্রয়ে থেকে নগরের প্রজাদের ওপর নানা রকম অত্যাচার শুরু করল। কালকেতুর কাছে এই অত্যাচারের কথা জানানো হলে সে ভাঁড়ুদত্তকে তাড়িয়ে দিল। ভাঁড়ুদত্ত প্রতিশোধ পরায়ণ হয়ে প্রতিবেশী কলিঙ্গ রাজের কাছে গেল। রাজার কাছে অভিযোগ জানিয়ে কালকেতুর রাজ্য আক্রমণের জন্য তাঁকে প্ররোচিত করল। ফলে কালকেতু ও কলিঙ্গ রাজের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হল। ভাঁড়ুদত্তের চক্রান্তে কালকেতু পরা- জিত ও বন্দী হল। কিন্তু চণ্ডীভক্ত কালকেতু চণ্ডীদেবীকে স্মরণ করায় চণ্ডীদেবীর চেষ্টায় কালকেতু মুক্তি লাভ করে। তারপর অনেক দিন রাজত্ব করে এবং পুত্র পুষ্পকেতুর হাতে রাজ্য সমর্পণ করে কালকেতু ও তার স্ত্রী ফুল্লরা স্বর্গে চলে যায়। কালকেতু আগে ছিল স্বর্গের ইন্দ্রপুত্র নীলাম্বর এবং ফুল্লরা ছিল নীলাম্বর পত্নী ছায়া। তারা অভিশপ্ত হয়ে মর্ত্যে ব্যাধের ঘরে জন্ম নিয়েছিল। চণ্ডীদেবী পৃথিবীতে নিজের পূজা প্রচার করতে চেয়েছিলেন। ইন্দ্রের পুত্র নীলাম্বরকে এ কাজের ভার দিতে চেয়েছিল। শিবকে এ কথা জানালে শিব অস্বীকৃতি জানায়। কিন্তু চণ্ডীদেবী ষড়যন্ত্র করে নীলাম্বরকে অভিশপ্ত করে এবং নীলাম্বর পৃথিবীতে আসতে বাধ্য হল। পৃথিবীতে কালকেতু নামে জীবনলীলা প্রকাশ করে।


**ধনপতি সদাগরের কাহিনীঃ-


উজানি নগরে বসবাস করে ধনপতি সদাগর নামে এক বিলাসী যুবক। তার প্রথমা স্ত্রীর নাম লহনা। সে নিঃসন্তান। ধনপতি শ্যালিকা সম্পর্কিতা খুল্পনার প্রতি প্রেমে আসক্ত হয়ে তাকে বিয়ে করে। বিয়ের পর খুল্পনাকে লহনার কাছে রেখে ধনপতি সদাগর রাজার আদেশে সোনার পিঞ্জর আনার জন্য গৌড়দেশে গেল। লহনা তখন সতীনের প্রতি ঈর্ষাকাতর হয়ে খুল্পনাকে নানা ধরনের অত্যাচার করতে লাগল। লহনার আদেশে খুল্পনা বনে গিয়ে ছাগল চরাতে লাগল। সেখানে খুল্লনা চণ্ডীদেবীর পূজার নিয়ম শিখে চণ্ডীর পূজা সম্পন্ন করে। এতে চণ্ডীদেবী খুলনার প্রতি খুব খুশি হয়। চণ্ডীদেবীর স্বপ্নাদেশ পেয়ে ধনপতি সদাগর দেশে ফিরে আসে। ধনপতি সদাগর দেখল যে খুল্লনা চণ্ডীদেবীর পূজা করছে। তা দেখে রাগ করে ধনপতি সদাগর পূজার ঘট পায়ে ঠেলে ফেলে দিল।এদিকে খুলনা বনে ছাগল চরাত বলে স্বজাতিরা তার চরিত্র সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করে অভিযোগ তুলল। খুল্লনা তার সতীত্বের পরীক্ষা দিতে ইচ্ছা প্রকাশ করল। খুল্লনাকে পানিতে ডোবানো হল, সাপ দিয়ে কামড়ানো হল, প্রজ্জ্বলিত লোহার দণ্ডে তাকে বিদ্ধ করা হল, শেষে জতুগৃহে আটকে ঘরে আগুন দেওয়া হল। কিন্তু কোন কিছুতেই খুল্লনার কোন ক্ষতি হল না। সে সতী হিসেবে বিবেচিত হল।কিছুদিন পর ধনপতি সদাগর বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে সিংহল যাত্রা করল। পথে সাগরে কালিদহে কমলে কামিনী মূর্তি দেখতে পেল।

সেখানে এক অপরূপ সুন্দরী তরুণী পদ্মের ওপর বসে এক বিরাট হাতি গিলছে আর উগড়ে ফেলছে। এই আশ্চর্য দৃশ্যের কথা ধনপতি সদাগর সিংহল রাজাকে জানালে রাজা তা দেখতে চাইলেন। কিন্তু চণ্ডীদেবীর মায়ায় ধনপতি তা দেখাতে পারল না। সিংহলে আসার আগে ধনপতি সদাগর খুল্লনার চণ্ডীপূজার ঘট লাথি মেরে ভেঙেছিল বলে চণ্ডীদেবী তার ওপর রাগ করে এবং মায়া সৃষ্টি করে। কমলে কামিনী দেখাতে ব্যর্থ করে । সিংহলের রাজা ধনপতি সদাগরকে শাস্তি দিয়ে কারাগারে বন্দী করে রাখে।

এরমধ্যে খুলনার এক পুত্রসন্তান জন্ম গ্রহণ করেছে। তার নাম শ্রীমন্ত। বড় হয়ে সে তার পিতা ধনপতির খোঁজে সিংহল যাত্রা করে। সমুদ্রপথে শ্রীমন্ত কমলে কামিনী মূর্তি দেখতে পেল। কিন্তু সিংহলরাজ দেখতে চাইলে তা দেখাতে পারল না। রাজা অসন্তুষ্ট হয়ে শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ করলেন। তখন শ্রীমন্ত চণ্ডীদেবীর স্তব করে এবং এতে চণ্ডীদেবী খুশি হয়ে তাকে বাঁচানোর ব্যবস্থা করে। চণ্ডীর দয়ার পিতা ধনপতি সদাগরের সঙ্গে পুত্র শ্রীমন্তের মিলন হল। সিংহল রাজকন্যার সঙ্গে শ্রীমন্তের বিয়ে হল। ধনপতি সদাগর পুত্র ও পুত্রবধূ সঙ্গে নিয়ে দেশে ফিরে আসে। উজানি নগরে এসে শ্রীমন্ত রাজাকে কমলে কামিনীর মূর্তি দেখিয়ে মুগ্ধ করল এবং রাজার কন্যা জয়াবতীকে বিয়ে করল। তারপর স্বর্গভ্রষ্ট ব্যক্তিবর্গ স্বর্গে ফিরে গেল।


**কবিকঙ্কণ মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর কবি প্রতিভা, সার্থকতা ও সামাজিক, রাজনৈতিক, প্রাকৃতিক চিত্রাবলীঃ--


মুকুন্দরামের জন্ম ও তাঁর কাব্যের রচনাকাল সম্পর্কে পণ্ডিতদের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে। ড. দীনেশচন্দ্র সেনের মতানুসারে আনুমানিক ১৫৩৭ সালে অর্থাৎ ষোল শতকের পূর্বভাগে কবি জন্মগ্রহণ করেছিলেন। কাব্যসমাপ্তির প্রকৃত কাল সম্পর্কে নানাপ্রকার মতবিরোধ থাকলেও ষোল শতকের শেষ দশকে এ কাব্যের রচনা সমাপ্ত হয়েছিল বলে অনেকে সিদ্ধান্ত করেন। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতে কাব্য রচনার কাল ১৫৯৪ সালের শেষ থেকে ১৬০৩ সালের মধ্যে। মুকুন্দরামের কাব্যে উল্লেখিত বাংলার সুবাদার মানসিংহের শাসন কাল বিবেচনা করে এ সিদ্ধান্তে পৌঁছানো হয়েছে। বসন্তকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে ১৫৯৪ বা ১৫৯৫ সাল কাব্যরচনার সমাপ্তি কাল। ড. আশুতোষ ভট্টাচার্য এ মত সমর্থন করেছেন।


কবির আত্মবিবরণীটিতে নিজের কথা ও দেশের কথা চমৎকারভাবে বর্ণিত হয়েছে :


শুন ভাই সভাজন,, ৷   কবিত্বের বিবরণ,

 ৷      এই গীত হৈল যেন মতে।

উরিয়া মায়ের বেশে,     কবির শিয়র দেশে

         চণ্ডিকা বসিল আচম্বিতে

সহর সিলিমাবাজ,  তাহাতে সজ্জন রাজ

         নিবসে নিয়োগী গোপীনাথ। 

তাঁহার তালুকে বসি,, দামিন্যায় চাষ চষি,

             নিবাস পুরুষ ছয়।


কবিকঙ্কণ মুকুন্দরাম চক্রবর্তী কবি প্রতিভার স্বরূপ নির্ণয়ে ড. শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় মন্তব্য করেছেন, 'শিথিল, ঢিলে-ঢালা, হাই তোলা-আড়ি মোড়া কাবাদর্শের মধ্যে মুকুন্দরামই প্রথম এক সদাজাগ্রত শিল্পবোধ ও চারুত্ব সৃষ্টির প্রবর্তন করিলেন। এমন কি দেববন্দনার মধ্যেও দেবমাহাত্ম্যজ্ঞাপক বিশেষণ নির্বাচনেও তাঁহার পরিমিতিজ্ঞান ও প্রয়োগসার্থকতার নিদর্শন মিলে। অতিপল্লবিত, অহেতুক বিস্তারের স্থলে অর্থঘন সংক্ষিপ্তি, অনিয়ন্ত্রিত ভাবাবেগ ও ভক্তি বিহ্বলতার অস্বচ্ছতার স্থলে মিতভাষিতা ও তীক্ষ্ণ ভাস্বরতা, নির্বিচার প্রথানুবর্তনের স্থলে বাস্তবস্বীকৃতির প্রখর মৌলিকতা, অর্ধ-যান্ত্রিক পূর্বরোমন্থনের স্কুলে নতুন অনুভূতির দীপ্ত ঝলক-এই সমস্তই তাঁহার রচনারীতির বৈশিষ্ট্য। তাঁহার রচনার উপর এক সচেতন, সমগ্রপ্রসারিত মননশক্তির পরিচয় দেদীপ্যমান। তাঁহার শিল্পবোধ মার্জিত, জীবনবাদসম্ভূত রসিকতা তাঁহার পূর্ববর্তীদের গ্রাম্য ভাঁড়ামো হইতে স্বতন্ত্র-জাতীয়। তাঁহার কৌতুকরস কেবল কথায় সীমাবদ্ধ নহে, তাঁহার বঙ্কিম কটাক্ষ, অর্থগূঢ় মন্তব্য ও সমগ্র মনোভাব ও জীবনদর্শনের নানামুখী বিস্তার হইতে ইহা তির্যক রেখায় ঠিকরাইয়া পড়িয়াছে। বারমাস্যার দুঃখবর্ণনাতেও তিনি।

চোখ হইতে প্রথাবদ্ধতার ঠুলি সরাইয়া ব্যাসজীবনের নানা বাস্তব দুর্ভোগের প্রতি দৃষ্টিক্ষেপ করিয়াছেন, তাঁহার বর্ণমাকে কাবাবেষ্টনী হইতে উদ্ধার করিয়া প্রত্যক্ষ জীবনের সহিত সংযুক্ত করিয়াছেন।


মুকুন্দরাম তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ শক্তির অধিকারী ছিলেন। চারদিকের জীবনের বিচিত্র পরিচয় তাঁর কাব্যে বিধৃত। মুসলমান জীবনের বর্ণনা :


ফজর সময়ে উঠি,,     বিছায়ে লোহিত পাটী

             পাঁচ বেরি করয়ে নমাজ।

সোলেমানী মালা করে,    জপে পীর পেগম্বরে পীরের                           মোকামে দেয় সাঁজ

দশ বিশ বেরাদরে,     বসিয়া বিচার করে।

            অনুদিন কেতাব কোরান।

কেহ বা বসিয়া হাটে,,   পীরের শীরিনি বাঁটে

            সাঁজে বাজে দগড় নিশান।।


এ ধরনের কৌতুককর বর্ণনা পাওয়া যায় পূজারী ব্রাহ্মণ সম্পর্কে। যেমন :


মূর্খ বিপ্ল বৈসে পুরে,    নগরে যাজন করে

             শিখিয়া পূজার অনুষ্ঠান। 

চন্দন তিলক পরে,   দেব পূজে ঘরে ঘরে

          চাউলের কোচরা বাঁধে টান।।


এমনি অসংখ্য বাস্তব চিত্র মুকুন্দরামের কাব্যে লক্ষ করা যায়। ভূদেব চৌধুরী মন্তব্য করেছেন, 'এ বর্ণনা যেমন সরস, তেমনি জীবন্ত এবং বাস্তব। এই সৃষ্টির পশ্চাৎপটে নিহিত কবি-চেতনার অন্তর্দৃষ্টি যত মর্মপ্রসারী ছিল, তার প্রকাশও তেমনি নিখুঁত এবং সর্বাবয়ব সম্পূর্ণ হয়েছে।

তাছাড়া, হিন্দু সমাজ ও তার অন্তর্বর্তী শাখা-সমষ্টি বর্ণনাতেও যে অনুপুঙ্খতা এবং বাস্তব অভিজ্ঞতার পরিচয় রয়েছে, তার গভীরে মুকুন্দরামের সমাজনিষ্ঠ মানসভঙ্গির বৈশিষ্ট্যই স্পষ্ট। অন্যপক্ষে এই একই বর্ণনার মধ্যে স্মার্ত-পৌরাণিক জাতিভেদপ্রথা সত্ত্বেও 'গুণ-কর্মবিভাজিত' অসাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী-জীবনের প্রতি কবিচিত্তের আন্তরিক নিষ্ঠার পরিচয় সর্বাপেক্ষা প্রকট হয়ে উঠেছে। 

কবি মুকুন্দরাম দেবতা ও মানুষের কথা বলতে গিয়ে বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দিয়েছেন। দেবদেবীর মধ্যে মেনকা ও গৌরীর কলহ, শিবের ভিক্ষা, শিব-গৌরীর বিবাদ—এ সবের মধ্যে যেমন জীবন -রস-রসিকতার পরিচয় পাওয়া যায়, তেমনি পশুদের কাতর ক্রন্দনে, কালকেতুর জীবন যাত্রায় ফুল্লরার প্রার্থনায়, কালকেতুর রাজ্যপত্তনে—সর্বত্র কবির বাস্তব চিত্রাঙ্কন প্রতিভার যথার্থ পরিচয় মিলে। তিনি দেব চরিত্রে মানবিকতা আরোপ করে সজীব ও স্বাভাবিক করে তুলেছেন।

চরিত্র চিত্রণের ব্যাপারে কবি বিশ্বয়কর সার্থকতার নিদর্শন রেখেছেন। একদিকে তাঁর হাতে যেমন স্বামীগতপ্রাণা বিড়ম্বিতা খুল্লনার চরিত্রটি জীবন্ত হয়ে উঠেছে তেমনি অন্যদিকে মূর্ত বর্ণিক মুরারি শীল ও জুয়াচোর ভাঁড়দত্তের চরিত্রও একান্ত বাস্তব হয়ে দেখা দিয়েছে। বুলান মণ্ডল, দুর্বলা দাসী প্রভৃতি চরিত্রের মাধ্যমে কবি বাঙালি জীবনের চিত্র অঙ্কন করেছেন। বাস্তবতা, সূক্ষ্ম দর্শনশক্তি, অভিজ্ঞতা, সহানুভূমি—এ সব বৈশিষ্ট্য মুকুন্দরামের রচনায় ফুটে উঠেছে।

 

কালকেতুর খাদ্য গ্রহণের বর্ণনা :-


মোচাড়িয়া গোঁফ দুটা বান্ধিলেন ঘাড়ে। 

এক শ্বাসে সাত হাঁড়ি আমানি উজাড়ে !

 চারি হাণ্ডি মহাবীর খায় খুদ-জাউ

ছয় হাঁড়ি মসুর-সুপ মিশ্যা তথি লাউ। 

ঝুড়ি দুই তিন খায় আলু ওল পোড়া।

 কচুর সহিত খায় করঞ্জা আমড়া।


ধূর্ত বণিক মুরারি শীল কালকেতুর মূল্যবান অঙ্গুরী ঠকিয়ে নেওয়ার যে পরিকল্পনা করেছিল তাতে তার চরিত্রের স্বরূপ প্রকাশ পেয়েছেঃ-


সোণা রূপা নহে বাপা এ বেঙ্গা পিতল।

ঘসিয়া মাজিয়া বাপু করেছ উজ্জ্বল !


ধূর্ত বেনের স্পষ্ট পরিচয় এতে ফুটে উঠেছে। মুরারি শীল যখন কালকেতুকে প্রতারণা করতে সক্ষম হল না, বরং কালকেতুর কাছে তার ধূর্ত রূপটি ধরা পড়ে গেল তখন মুরারি শীল হেসে বলল, 'এতক্ষণ পরিহাস করিলাম তোমারে। মঙ্গলকাব্যের ধরাবাঁধা কাহিনীর মধ্যে কবিমনের ব্যক্তিপ্রতিভা বিকাশের অবকাশ কম হলেও মুকুন্দরামের প্রবল সৃজনী প্রতিভা যে অনবদ্য অবদান রাখতে পারে মুরারি চরিত্র তার জীবন্ত নিদর্শন।

ভাঁড়দত্ত চণ্ডীমঙ্গলে এমনি একটি বিস্ময়কর চরিত্র। ড. সুকুমার সেনের মতে, ‘মুকুন্দরামের লেখনীতে ভাঁড়দত্ত আরত্ব লাভ করিয়াছে। পুরানো বাংলা সাহিত্যে এমন উজ্জ্বল জীবন্ত পাষণ্ড চরিত্র আর নাই।' স্বার্থসিদ্ধির জন্য তার তৎপরতা তাকে বিশিষ্ট করে তুলেছে। তার কপট মনের পরিচয় তার কথায়:


""তিন গোটা শর ছিল একগোটা বাঁশ।

 হাটে হাটে ফুল্লরা পসরা দিত মাস !""


তার কাজে, কথা বলার কৌশলে ও কূটবুদ্ধিতে সে অনন্য। স্বার্থহানি ঘটলেই তার স্বরূপ প্রকাশ পায়। ভাঁড়দত্ত ক্রোধের আতিশয্যে বলে :


"হরিদত্তের বেটা হই জয়দত্তের নাতি।

হাটে লয়্যা বেচাইব বীরের ঘোড়া হাতী ॥ 

তবে সুশাসিত হবে গুজরাট ধরা।

পুনর্বার হাটে মাংস বেচিবে ফুল্লরা"।


কালকেতুর সর্বনাশ সাধনে সে তৎপর। কিন্তু ধরা পড়লেই তার স্বরূপ বদলে যায়। মিথ্যার মুখোশ পরে ভাঁড়ুদত্ত নিজের স্বার্থসাধনে সচেতন থাকে। ভাঁড়ুদত্ত নিঃস্ব ও নীচাত্মা, শঠ ও ধূর্ত। কালকেতু একটি ধনু ও তিনটি শর নিয়ে বনে শিকার করত, পত্নী ফুল্লরা হাটে হাটে মাংস বিক্রি করত। কিন্তু দৈববলে সে বড় হল, আর ভাঁড় যেমন ছিল তেমনি রয়ে গেল— এ অসহ্য দুঃখ ভাঁড়কে ঈর্ষান্বিত করেছে। কবি অতিশয় দক্ষতার সঙ্গে ভাঁড়দত্তের মনোভাব ব্যক্ত করেছেন।

দুঃখবর্ণনায় মুকুন্দরাম যে কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন সে সম্পর্কে ড. দীনেশচন্দ্র সেন লিখেছেন, 'কবিকঙ্কণ সুখের কথায় বড় নহেন, দুঃখের কথায় বড়। বড় বড় উজ্জ্বল ঘটনার মধ্যে অবিরত ফল্গুনদীর ন্যায় এক অন্তর্বাহী দুঃখ সংগীতের মর্মস্পর্শী আতধ্বনি শুনা যায়। সুশীলার বারমাস্যা হইতে ফুল্লরার বারমাস্যা হৃদয়কে গভীরতর রূপে স্পর্শ করে। নিঃশব্দ করুণরস কাব্যখানিকে বিয়োগান্ত নাটকের গূঢ়-মহিমাপূর্ণ করিয়াছে—সুখবসন্তকাল বর্ণনায়ও কবিরপ্রেমণীতির মলয় বায়ু পরাভূত করিয়া উদর-চিন্তার আক্ষেপবাণী উঠিয়াছে। নানাবিধ দুঃখের কথা তাঁহার প্রতিভার চরণ নূপুর কাড়িয়া লইয়া যেন গতি মন্থর করিয়া দিয়াছে।"

শব্দসংগ্রহে, শব্দযোজনায় ও অলঙ্কারের নিপুণ পরিবেশনে মুকুন্দরামের রচনা সর্বত্রই সমৃদ্ধ। পল্লীসাহিত্যের মাধুর্য যেমন তাঁর কাব্যে স্থান পেয়েছে তেমনি সংস্কৃত শব্দের প্রতিও কবি আকর্ষণ অনুভব করেছেন। পল্লীভাষার সহজস্বরূপ ও পল্লী-উৎপ্রেক্ষা তাঁর কাব্যে অনবদ্যভাবে প্রকাশমান। কাব্যের এই সব গতানুগতিকতারহিত বৈশিষ্ট্যের জন্য তাঁকে প্রাচীন ও নতুন যুগের সন্ধিস্থলের কবি বলে মনে করা চলে।



তথ্য-নির্দেশঃ-


(১)ড. সুকুমার সেন সম্পাদিত চণ্ডীমঙ্গলকাব্য, ,

(২) চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, চণ্ডীমঙ্গল-বোধিনী

(৩)মাহবুবুল আলম, বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস,  

(৪) ড.. আশুতোষ ভট্টাচার্য, বাংলা মঙ্গলকাব্যের ইতিহাস

(৫)ড. অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত, ২য় খণ্ড,


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ