Hot Posts

6/recent/ticker-posts

মোতাহার হোসেন চৌধুরীর প্রবন্ধ আলোচনা

মোতাহের হোসেন চৌধুরী (১৯০৩-১৯৫৬)  শিক্ষাবিদ, ও লেখক।  নোয়াখালী জেলার কাঞ্চনপুর গ্রামে তাঁর জন্ম। 

ধর্ম এবং সংস্কৃতি দুটি ভিন্ন ধারার চেতনাপ্রবাহ। ধর্ম সম্পর্কে শাস্ত্র রয়েছে কিন্তু সংস্কৃতি সম্পর্কে সেরকম কোন শাস্ত্রীয় গ্রন্থ নেই। অশিক্ষিত, অল্পশিক্ষিত এবং মুখোশ-শিক্ষিত জনগোষ্ঠী নিয়ে আমরা অন্তঃসারশূন্য এক সমাজ বিনির্মাণ করেছি। মোতাহের হোসেন চৌধুরী (১৯০৩-১৯৫৬) প্রথাগত এরূপ সমাজের বিবিধ অসঙ্গতি নিয়ে চিন্তন জগতের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম অনুভূতির বিশ্লেষণ করে সংস্কৃতি-কথা প্রবন্ধগ্রন্থ রচনা করেছেন। গ্রন্থটিতে মোতাহের হোসেন চৌধুরীর ব্যক্তি-দর্শন নিপূণভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। গ্রন্থটিতে বিবিধ মাত্রার প্রবন্ধ থাকলেও অনেকগুলো প্রবন্ধে তিনি দেখিয়েছেন কীভাবে সংস্কৃতিবান হয়ে ওঠা যায় তার একটি সরল বিশ্লেষণ । গ্রন্থটির প্রথম প্রবন্ধেই তিনি সংস্কৃতি কথা সম্পর্কে সম্যক ধারণা দিয়েছেন এবং সেই পথে চলতে গেলে যে সকল প্রতিবন্ধকতা থাকতে পারে সে সকল দিক নির্দেশ এবং প্রতিবন্ধকতা থেকে উত্তরণের পথ রচনা করেছন। যারা মুক্তবুদ্ধির চর্চা করতে আগ্রহী তাদের কাছে এ বইটি অশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। আমাদের নিজেদের মানসিক উৎকর্ষের প্রয়োজনেই সংস্কৃতি-কথার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ পরিচয় আবশ্যক। মতৈক্য সঞ্চার এই বইয়ের উদ্দেশ্য নয়- কারণ মত নয় মনই এর লক্ষ্য। আর সেই সঙ্গে প্রথাগত সমাজের আষ্ঠে-পৃষ্ঠে যে ধর্মবোধের বুনন, মোতাহের হোসেন চৌধুরী সেই প্রথাগত বোধের মূলে মার্জিত ভাবে আঘাত করেছেন। ব্যক্তির ভেতরে যে আমি থাকে আর সেই আমি যখন চালিকা শক্তি হয়ে দাঁড়ায় তাকে সর্বদাই তিনি ধর্মের উপরে স্থান দিয়েছেন। সেই আমিকে কখনো তিনি তুলনা করেছেন আল্লাহর সাথে কখনো নবীর সাথে। ধর্মের বাইরে থেকেও যে নিটোল সৌন্দর্যের সমাজ গড়ে উঠতে পারে মোতাহের হোসেন চৌধুরী সেই সত্যের দ্বার উন্মোচন করেছেন। সংস্কৃতিবানদের জন্য ধর্ম একটি অসার প্রক্রিয়া। তারপরও সাধারণদের জন্য তার প্রয়োজনীয়তা আছে। তিনি সকল মতবাদকেই সংস্কৃতিবান হওয়ার পথে অন্তরায় হিসেবে বিবেচনা করেছেন। কারণ সকল মতবাদই ব্যক্তির বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করে। ধর্মও একটি মতবাদ। কোন নির্দিষ্ট মতবাদের ভিত্তিতে নিজেকে প্রস্তুত করাটা আরোপিত বিষয়। মোতাহের হোসেন চৌধুরী আরোপিত যে কোন কিছুরই বিরোধিতা করেছেন। কারণ আরোপিত ধারণা সংস্কৃতিবানদের নিকট প্রতিবন্ধকতা বিশেষ- ‘নকল যীশু, নকল বুদ্ধ, নকল মার্কস বা নকল লেনিন হওয়া তার মনঃপূতঅনুকরণ করে কারো মত হওয়ার পরিবর্তে মৌলিক কিছু হওয়ার চেষ্টাতে থাকাই সংস্কৃতিবানের কাজ। জীবনের প্রকাশ হবে বহুভঙ্গিম। একজন সংস্কৃতিবানের সঙ্গে অন্য একজন সংস্কৃতিবানের মিল নাও হতে পারে। জীবনকে বিচিত্র করে দেখাটাই এমনকি জীবন নিয়ে নীরিক্ষা করাটাই সংস্কৃতিবানের মূল প্রচেষ্টা। তারা বিষয়ের আরাধনা করে না, করে অমৃতের আরাধনা। ধার্মিক মানুষেরা যে হেতু স্বর্গের ইতর লোভ এবং দোযখের ভীতি থেকে ধর্মব্রত পালন করে তাই তাদের পক্ষে সংস্কৃতিবান হওয়া অসম্ভব। কেউ কেউ হয়ত ধর্মের মধ্যে থেকেও সংস্কৃতিবান হওয়ার চেষ্টা করতে পারে। কিন্তু মোতাহের হোসেন চৌধুরী মনে করেন যে ধর্মের মধ্যে থেকে সংস্কৃতিবান হওয়া অসম্ভব। ধর্ম ব্যক্তির বিকাশকে রোধ করে।

ব্যক্তি ও সংস্কৃতি, অথবা ব্যক্তির সংস্কৃতি:

 মোতাহের হোসেন চৌধুরীর ভাবনার সান্দ্র সারৎসার হচ্ছে এ-ই। ব্যাক্তিতা সাচীকৃত হলে দেশসমাজের উন্নয়ন অসম্ভব; দেশসমাজ ব্যতিগ্রথিত; এবং এই ব্যক্তি তার উদ্বোধনের জন্যে সংস্কৃতির উপর নির্ভরশীল। সংস্কৃতি বলতে তাই তিনি বুঝেছেন ব্যক্তিবিকাশের যাবতীয় শর্তসমূহ: সুন্দর রুচি, মনন বিচিত্রতা, শ্রেয়বোধ প্রভৃতি; ব্যক্তির জন্যে সংস্কৃতি, ব্যক্তির জন্যে সমাজ, ব্যক্তির জন্যে রাষ্ট্র। 

‘সংস্কৃতি-কথা' প্রবন্ধে মোতাহের হোসেন চৌধুরী মানুষদের দুটি শ্রেণিতে বিভক্ত করেছেন। এক শ্রেণির মানুষ রয়েছেন যারা ধার্মিক আর এক শ্রেণির মানুষ রয়েছে যারা সংস্কৃতিবান। সংস্কৃতিবান বলতে কী বোঝায় তিনি তার সম্যক ধারণা দিয়েছেন। সঙ্গীত-নৃত্য যেগুলোকে আমরা সংস্কৃতি বলি সেগুলো পালন করলেই শুধু সংস্কৃতিবান হওয়া যায় তা নয়। বরং সেগুলো সংস্কৃতিবান হওয়ার উপায় মাত্র। মোতাহের হোসেন চৌধুরী 'সংস্কৃতি-কথা' প্রবন্ধে অত্যন্ত সহজ ভাষায় সরল পথে বিষয়ের গভীরে পৌঁছে সংস্কৃতিবান হওয়ার রূপরেখা বোঝানোর চেষ্টা করেছেন। প্রবন্ধের শুরুতে তিনি বলেছেন- 'ধর্ম্ম সাধারণ লোকের কালচার, আর কালচার শিক্ষিত মার্জিত লোকের ধর্ম্ম। কালচার মানে উন্নততর জীবন সম্বন্ধে চেতনা সৌন্দর্য্য, আনন্দ ও প্রেম সম্বন্ধে অবহিতি। সাধারণ লোকেরা ধর্মের মারফতেই তা পেয়ে থাকে। তাই তাদের ধর্ম থেকে বঞ্চিত করা আর কালচার থেকে বঞ্চিত করা এক কথা।

মোতাহের হোসেন চৌধুরী তার এ প্রবন্ধের মধ্যে ধার্মিকদের চেয়ে অনেক উঁচুতে স্থান দিয়েছেন সংস্কৃতিবানদের। 'মূলত সংস্কৃতিবান ব্যক্তি-সৌন্দের্যের মধ্যে ছিল মোতাহের হোসেন চৌধুরীর চিরায়ত অধিষ্ঠান। ধার্মিকদের জীবনাচরণ, তাদের স্বরূপ এবং তাদের ধর্মব্রত পালনের নিছক উদ্দেশ্যকে তিনি অনেকটা কটাক্ষ করেছেন। তিনি 'সংস্কৃতি-কথা' প্রবন্ধটি এমন একটি সময়ে লিখেছেন যে সময়ে বাঙালি মুসলমানেরা নিজেদের প্রথমত বাঙালি কিংবা মানুষ পরিচয় দেওয়ার পরিবর্তে মুসলমান পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ বোধ করত। যে জীবন পরিবেশে মোতাহের হোসেন চৌধুরী ছিলেন সে গৃহে লোকের ভীড় ছিল কিন্তু সঙ্গী ছিল না।সত্যকে জীবনের ক্ষেত্রে পরীক্ষা-নীরিক্ষা করে নেয়ার মতো দৃঢ় আত্মপ্রত্যয় তার ছিল, তাই তিনি আপন পরিবেশের ঊর্ধ্বে নিজেকে স্থাপন করেছিলেন। 

মুসলমানদের প্রগতিশীল করে গড়ে তোলার জন্য ১৯২৬ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ'। প্রায় ১২ বছর স্থায়ী হয়েছিল এ সংগঠনটি। মোতাহের হোসেন চৌধুরী এই সংগঠন দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। মুসলিম সাহিত্য সমাজ' এর প্রতিষ্ঠালগ্নে তিনি ছিলেন চব্বিশ বছরের যুবক ও কুমিল্লার মতো মফস্বল শহরের অধিবাসী। কিন্তু এই সাহিত্য প্রতিষ্ঠানের আদর্শ তাঁকে এতই অনুপ্রাণিত করেছিল যে তিনি এর বিভিন্ন অধিবেশনে যোগ দেবার জন্য ঢাকায় ছুটে আসতেন। 'মুসলিম সাহিত্য সমাজ'-এর কাছে তিনি এভাবেই মুক্তবুদ্ধির দীক্ষা গ্রহণ করেছিলেন। সেই সাথে তিনি ছিলেন 'শিখাগোষ্ঠীর অনির্বাণ দীপ। সমাজ জীবনের গতি হয়ত কখন ঢিমা কখন দ্রুত, কিন্তু ছন্দ ঠিকই থাকে। মোতাহের হোসেন সেই অন্ধকার যুগেও নিজের ঘাঁটি থেকে পশ্চাদপসরণ করেন নি। তাঁর প্রকাশিতব্য গ্রন্থ সংস্কৃতি-কথায় তার প্রচুর প্রমাণ আছে।” একটি অনগ্রসর সময়ে তিনি প্রেম এবং কামের মধ্যে যে তাত্ত্বিক সম্পর্ক স্থাপন করেছেন এবং সমাজ প্রেমকে দমিয়ে রেখে কামকে বাঁচিয়ে রাখার যে নিরন্তর চেষ্টায় রত সে কথা তিনি খুব পরিষ্কার করে বলেছেন। বর্তমানে বাঙালি মুসলমান মেয়েদের চলাফেরা অনেকটাই অবাধ হয়েছে। পাশ্চাত্যের বয় ফ্রেন্ড, গার্ল ফ্রেন্ড জাতীয় শব্দের মাধ্যমে নিজেদের মধ্যে অনেকখানি অবাধ সম্পর্ক স্থাপনে সচেষ্ট হচ্ছে। তারপরও সমাজ কিন্তু প্রেমকে সম্পূর্ণরূপে মেনে নেয় নি। প্রেম এখনো অনেকাংশে সমাজনিষিদ্ধ। মোতাহের হোসেন চৌধুরী বলতে চেয়েছেন যে কাম কখনো রোধ করা যায় না। প্রকৃত অর্থে কাম রোধ করার কোন উপায়ও নেই। কারণ কামবোধ একই সঙ্গে জৈবিক এবং সহজাত। তাই তিনি বলেছেন- 'কামকে দমাতে গিয়ে ধর্ম্ম ও ধৰ্ম্ম সৃষ্ট সমাজ প্রেমকেই দমায়। প্রেম মরে যায়, কাম গোপনতার আশ্রয় গ্রহণ করে টিকে থাকে- মুখ নীচু করে চোরের মতো চলে। সমাজ তাতেই খুশী।

মোতাহের হোসেন চৌধুরী ধর্মের সীমাবদ্ধতার উপর আলোকপাত করেছেন। ধর্ম যেহেতু শাস্ত্র দ্বারা পরিচালিত হয় এবং শাস্ত্রের বাইরে যাওয়ার তার কোন পথ নেই তাই ধার্মিকের ধর্মের নির্দিষ্ট কিছু সীমারেখা মেনে চলতে হয়। এই সব মেনে চলার বাধ্যবাধকতার মধ্যে ধর্মের কঠোর নীতির সমালোচনা করেছেন তিনি। সংস্কৃতিবান হওয়ার জন্যে যে উদারতার প্রয়োজন হয় ধর্মের মধ্যে সেই উদারতা অনুপস্থিত। যে সকল সাধারণ মানুষ নিজের মধ্যে একটি চালিকা শক্তি তৈরি করে নিতে পারে নি তাদের জীবনের শৃংঙ্খলার জন্য ধর্মের অপরিসীম ভূমিকার কথা তিনি স্বীকার করে নিয়েছেন। ধর্ম যে সর্বৈব সত্য নয়, তার মধ্যে যে সীমাহীন সীমাবদ্ধতার বীজ উপ্ত করা আছে সে কথা তিনি যৌক্তিক ভাবেই উপস্থাপন করেছেন। তিনি বলেছেন“ধৰ্ম্ম চায় মানুষকে পাপ থেকে, পতন থেকে রক্ষা করতে, মানুষকে বিকশিত করতে নয়। জীবনের গোলাপ ফোটানের দিকে তার নজর নেই, বৃক্ষটিকে নিষ্কণ্টক রাখাই তার উদ্দেশ্য। 

অপর পক্ষে সংস্কৃতিবান মানুষেরা নিজেদের পাপ পূণ্যের তোয়াক্কা না করেই জীবনকে তারা বিকশিত করে তুলতেই ব্যস্ত। ধার্মিকেরা 'স্বর্গে একটি প্রথম শ্রেণীর সিট'১১ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ধর্ম পালন করে থাকে। সংস্কৃতিবানেরা স্বর্গ-নরকের বিবেচনাবোধ থেকে অনেক দূরে। কারণ তাদের সামনে ব্যক্তির ভেতরের আমিকে সুন্দর করে তোলাই তার কাজ। ধার্মিকেরা যেখানে পঞ্চ ইন্দ্রীয় সংযত রাখতে সচেষ্ট সেখানে সংস্কৃতিবানেরা পঞ্চ ইন্দ্রীয় জ্বালিয়ে রাখার কাজটি করে চলেছেন। কারণ, কোন কিছুকে রোধ করে কখনো বিকশিত হওয়া যায় না। তাই সংস্কৃতিবান ব্যক্তিরা ইন্দ্রীয় সাধনাকে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করে থাকেন। সংস্কৃতিবান হওয়ার জন্য মূল্যবোধ থাকাটা প্রধান শর্ত। মূল্যবোধ এবং মুক্তচিন্তা ব্যতিত সংস্কৃতিবান হওয়া অসম্ভব। সংস্কৃতিবান মানুষেরা সামাজিকের সাথে অসংখ্য বন্ধনে আবদ্ধ থাকেন। সমাজের প্রতি তাই তাদের দায়িত্বটাও অনেক বেশি। তারা কখনো ব্যক্তিতান্ত্রিক নয় সমাজতান্ত্রিক। সমাজের প্রয়োজনে তারা জীবন বিসর্জন করতেও প্রস্তুত। ব্যক্তির নিজের ভেতরের অহম বোধের বিনাশ সাধন করা সংস্কৃতিবানের অন্যতম চেষ্টা। ব্যক্তিকে কখনো কঠিন করে তোলাটা তাদের কাজ নয়। বরং কঠিন হওয়া প্রসঙ্গে প্ৰাবিন্ধক বলেছেন- 'কালচার্ড লোকেরা সবচেয়ে বেশি ঘৃণা করে অন্যায় আর নিঠুরতাকে; অন্যায় নিষ্ঠুরতাকে তো বটেই, ন্যায় নিষ্ঠুরতাকেও। মানুষকে ন্যায়সঙ্গতভাবে শাস্তি দিতেও তাদের বুক কাঁপে। ১২ সংস্কৃতিবানেরা পরিমিত মাত্রায় মানবিক। মোতাহের হোসেন চৌধুরী যথার্থই বলেছেন- 'কামের চেয়ে প্রেম বড়, ভোগের চেয়ে উপভোগ এ- সংস্কার না জন্মালে সংস্কৃতি হয় না। 

সংস্কৃতি-কথা প্রবন্ধগ্রন্থে যে প্রবন্ধগুলো রয়েছে তার মধ্যে নামপ্রবন্ধ 'সংস্কৃতি-কথা' এর মধ্যে গ্রন্থের মূল সুর অঙ্কিত হয়েছে। রীতিবদ্ধ ও প্রথাগত সমাজ ভাবনার বাইরে এসে তিনি অনন্য এক সমাজের সন্ধান দিয়েছেন। যেখানে মানুষের মানসিক গঠন এবং ব্যক্তির পরিচ্ছন্ন ভাবনার শতভাগ গুরুত্ব রক্ষিত হয়।

‘আমাদের দৈন্য' প্রবন্ধে মোতাহের হোসেন চৌধুরী বিভিন্ন রকমের দৈন্যের কথা উল্লেখ করেছেন। তার মধ্যে অর্থনৈতিক দৈন্য, শিক্ষাগত দৈন্য, ধর্মীয় দৈন্য, দৈন্যবোধের দৈন্য উল্লেখযোগ্য। তিনি আলোচ্য প্রবন্ধে উল্লিখিত দৈন্যের মাধ্যমে মানুষের সংস্কৃতিবান হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে যে সকল প্রতিকূলতা রয়েছে সে সকলই মূলত উপস্থাপন করেছেন। 'সংস্কৃতি-কথা' প্রবন্ধে একজন মানুষের সংস্কৃতিবান হওয়ার প্রয়োজনীয়তা এবং সংস্কৃতিবান হওয়ার রূপরেখা তিনি উপস্থাপন করেছেন। আর ‘আমাদের দৈন্য' প্রবন্ধে সেই মূলসুরের বিস্তার ঘটেছে। সংস্কৃতিবান হয়ে

অন্যতম কাজটি হচ্ছে ব্যক্তির চিন্তা-চেতনার বিকাশ। আরোপিত কোন বিধান কিংবা মতবাদের দ্বারা নয় ব্যক্তির স্বতঃস্ফূর্ত বিকাশই হচ্ছে সংস্কৃতিবানের অন্যতম প্রচেষ্টা। প্রাবন্ধিক তাই স্পষ্টতই বলেছেন।


সভ্যতার যা লক্ষণ, ইন্দ্রিয়াতীত আহ্বা অথবা মনের আহারের সন্ধানে যাবিত হওয়া তা আমাদের জীবনে একেবারেই অনুপস্থিত। তবে আর্থিক সৈন্য যে একবারে অবহেলিত হবার মত কিছু নয় সে ধারণা আমাদের আছে। মানুষের মধ্যে যে-টুকু পত, সে-টুকু একোবরে অবজ্ঞা করা চলে না। কিন্তু যে-টুকু দেবত্ব, সে-টুকুর পূর্ণ বিকাশের বন্দোবস্ত করা দরকার- এই-ই আমি বলতে চাই। ১৪


মোতাহের হোসেন চৌধুরী কখনোই আর্থিক দৈন্যকে ক্ষুদ্রার্থে বিবেচনা করেন নি। আর্থিক দৈন্যের সঙ্গে আমাদের প্রয়োজনীয় দৈহিক চাহিদা মেটানের বিষয়টি জড়িত। তাকে কোন অবস্থাতেই উপেক্ষা করা চলে না।


সংস্কৃতির রঙে নিজেকে রাঙিয়ে নিতে হলে শিক্ষা অপরিহার্য। মূলত সংস্কৃতি ভাবনার সঙ্গে শিক্ষার অনিবার্য রূপটি সকল সময়ে অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার অসারতার কারণে প্রকৃত শিক্ষা অর্জন করা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। বাঙালি মুসলমান শিক্ষার্জন করতে শুরু করেছে যে লক্ষ্য থেকে সেই লক্ষ্যের মধ্যেই ছিল গলদ। ফলে শিক্ষাব্যবস্থা বাঙালি মুসলমানদের আলোকিত করার পরিবর্তে আর্থিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট করে তুলেছে। বাঙালি মুসলমানেরা শিক্ষা অর্জন করা থেকে নিজেদের দূরে রেখেছিল। চাকুরি প্রাপ্তির সম্ভাবনা থেকে এই দূরত্ব দূর হয়। ফলে প্রকৃত জ্ঞান চর্চা সেখানে ব্যহত হয়। লেখক তাই তাদের উদ্দেশ্য করে বলেছেন:

"কিন্তু তাদের দেখে মনে হয়, ক্লাসে খুব ভালো হয়ে চলে কোনপ্রকারে একটা চাকরি বাগানই যেন তাদের শিক্ষার উদ্দেশ্য। মহৎ ও বৃহৎ জীবন যাপনের জন্য সরকারী যে পীড়া আর বেদনা, শিক্ষা যেন তাদের জীবনে তা সৃষ্ট করতে সম হয় নি।"

মানুষ যে অন্য প্রাণি থেকে আলাদা, মানুষের যে দুবার জন্ম হয় শিক্ষার আলো তার মধ্যে না থাকলে তা বোঝা যায় না। মোতাহের হোসেন চৌধুরী পশু এবং মানুষের মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি করেছেন এভাবে যে, পশুর কোন দায়িত্ব নেই কিন্তু মানুষের দায়িত্ব আছে। সেই দায়িত্ব হচ্ছে নিজেকে সৃষ্টি করা। নিজেকে সৃষ্টি করার জন্য শিক্ষা প্রয়োজন। প্রাবন্ধিক 'সংস্কৃতি-কথা' প্রবন্ধে নিজের মধ্যে একজন আল্লা সৃষ্টি করে নেওয়ার কথা বলেছেন। আর আমাদের দৈন্য প্রবন্ধে বলছেন শিক্ষার দ্বারা নিজেকে সৃষ্টি করার কথা। বিষয়টি পক্ষান্তরে একই চেষ্টার দুই রকম অভিব্যক্তি। শিক্ষার উদ্দেশ্য নিজেই ফলতে চাওয়া। কারণ নিজে সমৃদ্ধ না হলে কোন কিছুই শিক্ষার আলো দ্বারা গ্রহণ করা সম্ভব নয়। কিন্তু বাস্তবতা দাঁড়িয়েছে যে ফল লাভ

করাই শিক্ষার উদ্দেশ্য। তাই প্রচলিত শিক্ষা নিজেকে সৃষ্টি করার পথ রেখেছে অবরুদ্ধ করে। মোতাহের হোসেন চৌধুরী তার অধিকাংশ রচনার মাধ্যমে বড় রকমের চেষ্টা করেছেন ব্যক্তির বিকাশের গুরুত্ব তুলে ধরতে। সে বিকাশ কীভাবে বাধ্যযস্ত হয় এবং সেই বিকাশের পথের অন্তরায় দূরীকরণের কী উপায় রয়েছে সে পথ নির্দেশনা তিনি সব সময়ই দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। স্বতন্ত্র চিন্তা মানুষের মধ্যে সক্রিয় না থাকলে সে কখনোই সংস্কৃতিবান হতে পারে না। প্রকৃত শিক্ষার কাজ হচ্ছে ব্যক্তির মধ্যে সেই স্বাতন্ত্র্যবোধ সৃষ্টি করা- 'স্কুল-কলেজের ছাত্রগুলি যেন দর্জির দোকানের কাপড়ের মত এক-ছাঁটে-ছাঁটা মানুষ- শিক্ষা যেন তাদের স্বকীয় বৈশিষ্ট্যের বিকাশ সাধনে মোটেই সহায়তা করছে না।

শিক্ষার্থীকে শেখানোর ক্ষেত্রে গুরুর কাজ কী হওয়া প্রয়োজন সে কথাও তিনি এখানে উল্লেখ করেছেন। মানুষের ভেতরে একজন মানুষকে জাগিয়ে তোলাই হচ্ছে গুরুর কাজ। সংস্কৃতিবান মানুষেরা ভেতরের মানুষটি দ্বারা পরিচালিত হন। শিক্ষার্থী বাইরের কোন গুরুর দ্বারা পরিচালিত হবেন না। বাইরের গুরুর কাজ হচ্ছে ভেতরের গুরুকে জাগিয়ে তোলা। অর্থাৎ ব্যক্তির আমিত্বের উদ্বোধনই হচ্ছে শিক্ষার মূল কাজ। সেই আমিত্বই হচ্ছে সংস্কৃতিবানের চালক।

আমাদের জীবনে ধর্মের প্রভাব অনেকখানি। শাস্ত্রের দ্বারা পরিচালিত হওয়ার প্রবণতা রয়েছে যথেষ্ট। মোতাহের হোসেন চৌধুরী মানুষের আত্মাকে জাগিয়ে তোলার ক্ষেত্রে ধর্মের বাধা এবং ধর্মের প্রয়োজনীয়তা উভয় দিকই তুলে ধরেছেন। তিনি বলেছেন- 'ধর্ম বলতে আমি মনে করি, প্রেমপূর্ণ সৎ ও সুন্দর জীবন যাপন করা। প্রত্যেক ধর্ম-শাস্ত্রের ভিতরের কথাটি তাই। কিন্তু ভাব বাদ দিয়ে ধর্মের খোসাটা দেখি বলেই আমরা এ কথাটি বুঝতে পারিনে।

‘আমাদের দৈন্য' প্রবন্ধে মোতাহের হোসেন চৌধুরী যেহেতু সংস্কৃতিবান মানুষের পথ চলার ক্ষেত্রে তার ভিতরের মানুষকে প্রাধান্য দেওয়ার কথা বলেছেন সেহেতু তিনি শাস্ত্রের আক্ষরিক অর্থের পরিবর্তে ধর্মের ভাবকে গ্রহণ করার ক্ষেত্রে অধিক গুরুত্ব দিয়েছেন। শাস্ত্রকে তিনি উপেক্ষা করতে বলেন নি কিন্তু গ্রহণ করতে বলেছেন ধর্মের ভাবকে। সকল ধর্মের ভাবগত ঐক্য আছে বলে তিনি মনে করেন। প্রেমপূর্ণ সৎ ও সুন্দর জীবন যাপন করাকে তিনি বলেছেন ধর্ম। এবং এই প্রেমপূর্ণ সৎ ও সুন্দর জীবন যাপনকেই আবার সংস্কৃতিবানের জীবন যাপন বলেছেন। আলোচ্য প্রবন্ধে মূলত মোতাহের হোসেন চৌধুরী সংস্কৃতিবান এর দর্শনকে ধর্মীয় দর্শনের সাথে এক করে তুলবার চেষ্টা করেছেন। সংস্কৃতির সাথে যেহেতু মতবাদের একটি বিরোধীতা রয়েছে এবং যে কোন মতবাদই যে ব্যক্তির বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করে তোলে সে ব্যাপারটি তিনি পরিষ্কার করে বলেছেন। সে কারণেও তিনি শাস্ত্রকে গুরুত্ব দিতে পারেন নি।অর্থনৈতিক দৈন্য, শিক্ষাগত দৈন্য এবং ধর্মীয় দৈন্য ছাড়াও শিল্প-সাহিত্য সম্পর্কিত। জ্ঞানের দৈন্যও রয়েছে। তবে তিনি সকল দৈন্য সম্পর্কে আলোকপাত করলেও দৈন্য উপলব্ধি করতে না পারার দৈন্যকে বড় দৈন্য বলে অভিহিত করেছন। সকল দৈন্য সম্পর্কে অসচেতন হলে দৈন্য থেকে মুক্তি পাওয়া অসম্ভব।

মোতাহের হোসেন চৌধুরীর সংস্কৃতি-কথা গ্রন্থের নামপ্রবন্ধে সংস্কৃতিবান হওয়ার বিষয়ে যে বিবিধ প্রকরণ উপস্থাপন করেছেন তা তার অনেকগুলো প্রবন্ধে আরও বিস্তৃতি লাভ করেছে। সে রকম একটি প্রবন্ধ হচ্ছে 'মনুষ্যত্ব'। এ প্রবন্ধে তিনি মানুষের মনুষ্যত্ববিষয়ক দীর্ঘ আলোচনা করেছেন। যে আলোচনার মাধ্যমে তিনি বোঝাতে চেয়েছেন যে একজন মানুষ যদি মনুষ্যত্বলোকে উত্তীর্ণ হতে না পারে তাহলে সে অন্য সব প্রাণীর মতই থেকে যায়। আর সেই মনুষ্যত্বলোকে উত্তীর্ণ মানুষের যে পৃথিবীর কথা বলা হয়েছে তা মূলত সংস্কৃতিবান মানুষেরই পৃথিবী। তাই বলা যায় যে মনুষ্যত্ব প্রবন্ধের মাধ্যমে মানুষকে সংস্কৃতিবান হিসেবে গড়ে তোলার এক অসামান্য প্রচেষ্টাই ব্যপ্তি লাভ করেছে।

জগতের সকল মানুষকে তিনি দুটো শ্রেণিতে ভাগ করেছেন। এক হচ্ছে যারা প্রাণিত্বকে ধারণ করে বেঁচে আছে আর অন্য শ্রেণির মানুষ হচ্ছেন নিজেদের আত্মার মুক্তি দেওয়া মানুষ। বিষয়টিকে অত্যন্ত সরলীকরণের মাধ্যমে তিনি ব্যাখ্যা করেছেন। মানুষের জীবনকে তিনি একটি দ্বিতল ঘরের সঙ্গে তুলনা করেছেন। নিচতলার ঘরকে তিনি বলেছেন শারীরিক ভাবে বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় সকল প্রচেষ্টা আর দ্বিতলকে বুঝিয়েছেন মানুষের মনোলোক। নিচতলার ঘরকে তিনি সবিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। কারণ শারীরিকভাবে সুস্থ না থাকলে দ্বিতল ঘরে যাওয়া কিংবা সে ঘরের লাবণ্যকে উপভোগ করা যায় না। কিন্তু শুধু শুধু নিচতলার ঘর নিয়ে ব্যস্ত থাকলে এবং উপর তলার ঘর সম্পর্কে উদাসীন থাকলে সে জগতের অন্য সব প্রাণী থেকে আলাদা হতে পারে না। নিচতলা থেকে উপর তলায় উঠবার জন্য সিঁড়ি বিশেষ হচ্ছে শিক্ষা। শিক্ষা উপর থেকে টেনে তুলতে পারে। নিচতলার ঘর ঠিক রাখাটা প্রয়োজন। এই প্রয়োজনের মাধ্যমে প্রাণিত্বকে বাঁচিয়ে রাখা যায়। আর দ্বিতল ঘরের বিষয়টি যতই অপ্রয়োজনীয় হোক না কেন তা-ই হচ্ছে মনুষ্যত্ব। প্রাবন্ধিক তাই বলেছেন:

"অপ্রয়োজনের জগতই মনুষ্যত্বের জগত: এখানেই মানুষ আত্মার লাবণ্য উপভোগ করে। প্রেম সৌন্দর্য ও আনন্দ না হলেও প্রাণ ধারণের ক্ষতি হয় না; বাঁচার জন্য এরা একান্ত প্রয়োজনীয় নয়। কিন্তু মানুষের মতো বাঁচতে হলে এ সব না হলে চলে না। তাই একান্ত প্রয়োজনীয় না হলেও প্রেম, সৌন্দর্য ও আনন্দেই মনুষ্যত্বের বিকাশ। এ সব নিয়ে মানুষ বাঁচে না, কিন্তু এ সবের জন্য বাঁচে।"

‘সংস্কৃতি-কথা' প্রবন্ধে যে আনন্দ, সৌন্দর্য প্রেম নিয়ে সংস্কৃতির রূপরেখা দাঁড় করানো হয়েছে সেই আনন্দ, সৌন্দর্য এবং প্রেম এখানেও পুনর্বার উচ্চারিত হয়েছে। শুধু তাই নয় সংস্কৃতিবান হওয়ার অর্থ যে মনুষ্যত্বের বিকাশ তাও এখানে পুনর্বার উচ্চারিত হয়েছে। আলোচ্য প্রবন্ধে মনষ্যত্বের জয়গান গাওয়ার ভেতর দিয়ে সংস্কৃতিবানদের জয়গান গাওয়া হয়েছে। একজন মানুষ কী কী উপায়ে সংস্কৃতিবান হয়ে উঠতে পারে সেই নির্দেশনাই মূলত এ প্রবন্ধে লক্ষ করা যায়।

সমাজের মধ্যে যারা নিচতলার জীব-সত্তার ঘরে থাকে, কিন্তু উপর তলার মানব সত্তার ঘরে উন্নীত হওয়ার কোন চেষ্টা করে না অর্থাৎ যারা সংস্কৃতিবান হওয়ার চেষ্টা করে না তাদেরকে লেখক মার্জিত ভাষায় বিদ্রুপ করে তাদের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছেন এই বলে যে- কারারুদ্ধ আহারভৃপ্ত মানুষের মূল্য কতটুকু? সংস্কৃতিবান মানুষ নিজেকে প্রকাশ করে থাকে। নিজে অধীনতা পছন্দ করেন না। নিজের ভেতরে সৃষ্টি করে নেওয়া শক্তির দ্বারা তিনি পরিচালিত হন। বস্তুগত পৃথিবীর চেয়ে অবস্তুগত ভাবনার জগত তার নিকট অপরিমেয় গুরুত্ব বহন করে। মোতাহের হোসেন চৌধুরী তাই বলেছেনঃ

"অন্নবস্ত্রের প্রাচুর্যের চেয়েও মুক্তি অনেক বড়, এই বোধটি মানুষের মনুষ্যত্বের পরিচয়। চিন্তার স্বাধীনতা, বুদ্ধির স্বাধীনতা, আত্মপ্রকাশের স্বাধীনতা যেখানে নেই, সেখানে মুক্তি নেই। মানুষের অন্নবস্ত্রের সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করতে হবে এই মুক্তির দিকে লক্ষ্য রেখে।"

এই প্রবন্ধেও প্রাবন্ধিক মানুষের চেতনালোকে উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য শিক্ষার প্রতি অত্যন্ত গুরুত্বারোপ করেছেন। মানুষ যে শিক্ষার দ্বারা মানব-সত্তার ঘরে উন্নীত হতে না পারে তাকে অসার শিক্ষা এবং সেই শিক্ষাব্যবস্থার সীমাবদ্ধতাকে তিনি দায়ী করেছেন। বর্তমানে শিক্ষার্জনের উদ্দেশ্য হিসেবে সকলেই প্রায় অর্থপ্রাপ্তিকে মুখ্য করে বিবেচনা করে থাকেন। এই উদ্দেশ্য যে শিক্ষার উদ্দেশ্য নয় সে কথাও প্রাবন্ধিক বলেছেন। শিক্ষা মানুষকে তার মনুষ্যলোকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবে। এটা শিক্ষার একটি অনেক বড় কাজ। একজন মানুষ যখন মানব-সত্তার ঘরে পৌঁছতে সক্ষম হবে তখন সে চালিত হবে রূপবোধ, রসবোধ এবং মূল্যবোধ দ্বারা। যতক্ষণ পর্যন্ত তা না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত সে চালিত হবে ইন্দ্রীয়-এর দ্বারা। শারীরিক তৃপ্তি ছাড়া আত্মার যে তৃপ্তি তা উপলব্ধি করা যায় সাহিত্য-শিল্প সহযোগে। শিল্প সাহিত্যের অনুশীলন একজন জীব-সত্তার ঘরে থাকা মানুষকে কখন যে মানব-সত্তার ধরে নিয়ে যাবে তা সে নিজেও উপলব্ধি করতে পারবে না। ফলে সংস্কৃতিবান হতে হলে এবং নিজেকে মনুষ্যত্বলোকে নিয়ে যেতে চাইলে শিল্প-সাহিত্যের চর্চাও প্রয়োজন। মোতাহের হোসেন চৌধুরীর ভাষায়:

"রূপলোক ও বসলোক আমাদের উন্নত করতে পারে শিক্ষা। তাই শিক্ষার একটি উদশা, এবং সবচেয়ে বড় উদ্দেশ্য মনের চোখ ওরসনা সৃষ্টি করা। যেখানে তা হয় নি সেখানে শিক্ষা ব্যর্থ। মনুষ্যত্বের সাধনা জীবনে লঘুভার হওয়ার সাধনা, আর প্রেম-সৌন্দর্য ও আনন্দের তাগিদেই আমরা লঘুভার হতে পারি। শিক্ষা আমাদের এই প্রেম সৌন্দর্য ও আনন্দের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে মনুষ্যত্বের সাধনায় তথা জীবনে লঘুভার হওয়ার সাধনায় সহায়তার করে। ক্ষুৎপিপাসায় কাতর রূপ ও রসের জন্য কল্যাণ, কল্যাণের জন্য রূপ ও রস নয়, এই বোধ থাকে না বলে শিল্প সাহিত্যের এত অপব্যবহার ঘটে। শিক্ষার কাজ সেই মানুষটির সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দেওয়া।"

মোতাহের হোসেন চৌধুরীর ‘আদেশপন্থী ও অনুপ্রেরণাপন্থী' প্রবন্ধের মধ্যে লেখক দুই ধরনের মানুষের উল্লেখ করেছেন। 

জগতের সকল লোক দুটো শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত। এক শ্রেণির মানুষ যারা ধর্মশাস্ত্রের নির্দেশে নিজের জীবন পরিচালিত করে। আর এক শ্রেণির মানুষ আছে যারা নিজের ভেতরের সূক্ষ্ম আদেশের দ্বারা পরিচালিত হন। নিজের জীবনকে সুন্দর করে গড়ে তোলার জন্য তাদের বাইরের আদেশের প্রয়োজন হয় না। নিজের ভেতরের আদেশের দ্বারা পরিচালিত হয় বলে নিজে সৃষ্টিশীল হয়ে ওঠেন। অন্যদিকে বাইরের অন্ধ আনুগত্য থাকার কারণে নিজের ভেতরের সৃষ্টিশীল ক্ষমতা নষ্ট হয়। যারা আত্মিক শক্তির দ্বারা পরিচালিত হন তাদেরকে বাইরের আদেশ দ্বারা পরিচালিত হতে হলে আত্মার মৃত্যু হয়। শিল্প সাহিত্যের সৃষ্টিও হয়।

অনুপ্রেরণাপন্থী মানুষের দ্বারা মোতাহের হোসেন চৌধুরীর ভাষায়: কিন্তু আদেশপন্থী মানুষেরা এই সৃজনেচ্ছাকে টুটি চেপে মারবার জন্য প্রস্তুত। কেননা আদেশপন্থী অনুকারক, আর অনুকারক নিজে যেমন সৃষ্টি করতে পারে না অন্যের সৃজনতায়ও সে তেমনি আস্থাবান নয়। বাইরের অনুজ্ঞার অতিরিক্ত নির্ভর করেতে করতে অন্তরের সহজ উপলব্ধি হারিয়ে বসেছে বলেই আদেশপন্থী সৃজনশক্তিহীন, আর অন্তরের স্বাভাবিক অনুভূতি হারায় নি বলেই অনুপ্ররণাপন্থী স্রষ্টা। 

মোতাহের হোসেন চৌধুরী 'সংস্কৃতি-কথা' প্রবন্ধে যে সংস্কৃতিবান হওয়ার ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন সেই গুরুত্বারোপ আলোচ্য প্রবন্ধেও শাস্ত্রপন্থী এবং অনুপ্রেরণাপন্থী মানুষের পার্থক্যকরণের মাধ্যমে এখানে নতুন ব্যাখ্যায় সেই কথাই বলবার চেষ্টা করেছেন। সংস্কৃতিবান হওয়ার জন্য নিজের মধ্যে একজন আল্লা সৃষ্টি করে নেওয়ার যে প্রয়োজনীয়তার কথা তিনি পূর্বেই উপস্থাপন করেছেন সেই কথাই তিনি এখানে অনুপ্রেরণাপন্থী হওয়ার মধ্যে প্রকাশ করেছেন। সংস্কৃতিবান মানুষ পরিচালিত হন তার নিজের ভেতরে সৃষ্টি করে নেওয়া একজন স্রষ্টার মাধ্যমে আর অলোচ্য প্রবন্ধে সেই কথাই বলা হয়েছে নিজের ভেতরের অন্তরের আদেশে পরিচালিত হয় অনুপ্রেরণা পন্থী মানুষ।

মূলত সংস্কৃতিবান হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে যে প্রতিবন্ধকতাগুলো রয়েছে তার একটি অন্যতম কারণ হিসেবে তিনি শাস্ত্রকে উল্লেখ করেছেন। শাস্ত্রের আদেশে যারা নিজেদের জীবন পরিচালিত করেন তাদের অনেকেই জানে না যে অন্তরের আদেশ বলে একটা কিছু রয়েছে। বরং তাদের মধ্যে একটি দাসবৃত্তি গড়ে ওঠে। সংস্কৃতিবান মানুষের প্রধান লক্ষ্যই হচ্ছে নিজেকে বিকশিত করা। শাস্ত্রপন্থী মানুষের নিকট এই প্রচেষ্টা নিষিদ্ধ। নিজেদের মত করে বিকশিত হতে গিয়ে যদি কেউ কোন ভুল করে তাকেও মোতাহের হোসেন চৌধুরী সমর্থন করেছেন। শাস্ত্রপন্থার থ্যেও মানুষের কল্যাণ নিহিত। কিন্তু যে শাস্ত্রের এসে মানব কল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত রাখতে পারে তাকে শাস্ত্রের মধ্যে টানতে গেলে বিপত্তি বাধে। বৃহৎ ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন মানুষ সমাজে তখন তৈরি করা সম্ভব হয় যখন কেউ অন্তরের আদেশে পরিচালিত হন। অন্যদিকে শাস্ত্র গতানুগতিক ধারাকে সমর্থন করে, প্রতিনিয়ত নতুনের বিপক্ষে তার অবস্থান। সে কারণে সমাজে বৃহৎব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ সৃষ্টি হয় না। মোতাহের হোসেন চৌধুরী সমাজে বিদ্যমান সকল মানুষকে নিবিড়ভাবে পাঠ করেছেন। ফলে সাধারণ মানুষের সীমাবদ্ধতাগুলোকে তিনি সহজেই চিহ্নিত করেতে পেরেছেন। সংস্কৃতিবান মানুষ হয়ে ওঠার জন্য প্রয়োজনীয় পথ নির্দেশ করা ছাড়াও তাই তিনি এ পথের প্রতিবন্ধকতাও উল্লেখ করেছেন। প্রাবন্ধিক জগতের সকল মানুষকে অনুপ্রেরণাপন্থী এবং আদেশপন্থী বলে দুটো শ্রেণীতে বিভক্ত করেছেন। এ ছাড়াও তিনি আরও একটি শ্রেণির মানুষের কথা উল্লেখ করেছেন। মূলত এ শ্রেণির মানুষও আদেশপন্থী মানুষের শ্রেণিভুক্ত।

মোতাহের হোসেন চৌধুরীর ভাষায়:--

"আদেশ-পন্থা ও অনুপ্রেরণা-পন্থা সম্বন্ধে আলোচনা করেছি। কিন্তু এ ছাড়া আর এক প্রকার লোক আছে যাদের নাম দেওয়া যেতে পারে যুক্তিবাদী শাস্ত্ৰপন্থী। এরা শাস্ত্রের একটি বিশেষ মতকে মেনে নিয়ে সেই নেওয়া মতটিকে যুক্তিতর্কের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করে। প্রত্যেক মতের পক্ষেই কিছু না কিছু বলা যায়। যুক্তিবাদী শাস্ত্রপন্থীও তার স্বমতের পক্ষে অনেক কিছু বলতে চেষ্টা করে। কিন্তু মুশকিল এই যে, যুক্তির চাইতে গোঁজামিলই দেয় তারা বেশী। শাস্ত্রের মধ্যে বর্তমানে যে সব মত দেখতে পাওয়া যায়, যদি তাদের ঠিক উল্টো মতও থাকতো তাহলে সেগুলি সম্বন্ধেও যুক্তিতর্কের অবতারণা করতে তারা কুণ্ঠিত হত না। "

সংস্কৃতিবান মানুষ ধর্মীয় সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে থাকেন। ধর্মীয় মতবাদ যে এক ধর্মকে অন্য ধর্ম থেকে আলাদা করে থাকে ভারও মূলে রয়েছে আদেশপন্থীদের কার্যকলাপ। যদি সমাজ হয়ে উঠত অনুপ্রেরণাপন্থী মানুষের সমাজ তাহলে ধর্মনির্বিশেষ মানুষের জয়ধ্বনি ঘোষিত হয়। প্রচলিত সমাজ সংস্কৃতিবানদের জন্য অনুকূল নয়।“মোতাহের হোসেন চৌধুরী, তাই সাধারণের ঊর্ধ্বে উঠে অসাধারণত্ব অর্জনের জন্য। 'ধর্ম'কে অতিক্রম করে 'কালচার' এর সঙ্গে সংলগ্ন হওয়ার কথা বলেছেন, অসাধারণের মধ্যেও বিশিষ্ট তথা' দশের মধ্যে এগারো' হওয়ার লক্ষ্যে মতবাদ এর বদলে 'কালচার' সাধনার তাগিদ দিয়েছেন।

মোতাহের হোসেন চৌধুরীর সংস্কৃতি বিষয়ক ভাবনার পূর্ণ বিকাশ সাধিত হয়েছে সংস্কৃতি-কথা গ্রন্থের অনেকগুলো প্রবন্ধের মাধ্যমে। এখানে 'সংস্কৃতির রুচিজ্ঞানকে অব্যর্থ যুক্তিতে প্রতিষ্ঠিত করেছেন তিনি। ২৪ সংস্কৃতিবান মানুষ বোঝাতে তিনি বিভিন্ন রূপে তার ব্যাখ্যা দাঁড় করেছেন। সংস্কৃতিবান মানুষের সঙ্গে সাধারণ মানুষের পার্থক্য বোঝাতে গিয়ে কখনো তিনি পার্থক্য করেছেন সংস্কৃতিবান এবং ধার্মিক দুই শ্রেণির মানুষ বলে, আবার কখনো পার্থক্য করেছেন জীব-সত্তা এবং মানব-সত্তা আখ্যা দিয়ে আবার কখনো শাস্ত্রপন্থী এবং অনুপ্রেরণাপন্থী বলে। উল্লিখিত বিভক্তির মাধ্যমে তিনি জগতের সকল মানুষকে দুটো শ্রেণিতেই বিভক্ত করেছেন। যার মধ্যে এক শ্রেণির মানুষ হচ্ছেন সংস্কৃতিবান। এই সংস্কৃতিবান মানুষই হচ্ছেন মোতাহের হোসেন চৌধুরীর অভীষ্ট লক্ষ্য। সংস্কৃতিবান হতে হলে সমাজবাস্তবতার অনেকগুলো প্রতিকূলতা অতিক্রম করতে হয়। মানুষকে কেন সংস্কৃতিবান হওয়া প্রয়োজন সেই কথা বলতে গিয়ে তিনি সংস্কৃতিবানের স্বরূপ তুলে ধরেছেন। সংস্কৃতি-কথা গ্রন্থটি সংস্কৃতিবান হয়ে ওঠার একটি যথার্থ সিঁড়ি বিশেষ।


তথ্যসূত্র ১. অসিতকুমার ভট্টাচার্য, ‘মোতাহের হোসেন চৌধুরী ও তাঁর সংস্কৃতি-কথা', সংস্কৃতি সাধক মোতাহের হোসেন চৌধুরী, মুহম্মদ সাইফুল ইসলাম সম্পা., (ঢাকা: কথাপ্রকাশ, ২০০৭), পৃ. ৮২

মোতাহের হোসেন চৌধুরী, ‘সংস্কৃতি-কথা', মোতাহের হোসেন চৌধুরী রচনাবলী-১,

পূর্বোক্ত, পৃ. ৫ ৫. তিতাশ চৌধুরী, 'মোতাহের হোসেন চৌধুরীর সমাজমনস্কতা', মোতাহের হোসেন চৌধুরী। জীবন ও সাহিত্য (ঢাকা শোভাপ্রকাশ, ২০১১), পৃ. ৪০ ৬. অজিতকুমার গুহ, 'মোতাহের স্মৃতি, সংস্কৃতি-সাধক মোতাহের হোসেন।

ড. আবু ছালেহ মোহাম্মদ ওয়াদুদুর রহমান

লেখকনাম: ড. তুহিন ওয়াদুদ

সহকারী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ