Hot Posts

6/recent/ticker-posts

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এর ছোট গল্প আলোচনা


 মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্পে বাস্তবতা ও ফ্রোয়োডীয় মননঃ-

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়(১৯০৮-১৯৫৬) বাংলা সাহিত্যে এক অনবদ্য নাম।তিনি তার সাহিত্য কর্মের দ্বারা বাংলা সাহিত্যে নতুন মাত্রা যোগ করেছেন। বিশেষ করে বাংলা কথাসাহিত্যে তিনি তৃণমূল পর্যায়ের মানুষদের যে জীবনের ব্যাবচ্ছেদ করেছেন তা পাঠক কে গভীর ভাবে চিন্তা করতে সাহায্য করে।পুর্ববতী অনেক সাহিত্যক রা ফ্রয়েডীয় মতবাদ কে শুধু সমাজের উচ্চ বিত্ত এবং ক্ষমতাবান মানুষদের সাথে দেখিয়েছিলেন,তবে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় সেই ধারা ভেঙে দিয়ে, তৃণমূল পর্যায়ে তা প্রয়োগ করে দেখিয়েছেন।জৈবিক কামনা বাসনা,কিংবা যৌনতা,কোনো জাত পাতকে কেন্দ্র করে পরিচালিত হয়না সেটিও তিনি প্রমাণ করে দেখিয়েছেন। 

নিচে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এর কিছু শ্রেষ্ঠ গল্পের আলোচনা দেওয়া হলো।

'প্রাগৈতিহাসিক'

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'ছোটগল্প সংকলনের প্রথম গল্প 'প্রাগৈতিহাসিক'। এটি তাঁর একটি অন্যতম শ্রেষ্ঠ গল্প। এই গল্পে লেখক মানব প্রকৃতি ও মানুষের মনোবিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন যে, কামনা-বাসনা, অর্থনৈতিক দুর্নীতি, বৈষম্য ইত্যাদি মানবজীবনের উপর গভীর প্রভাব ফেলে। 'প্রাগৈতিহাসিক' গল্পে ফ্রয়েডীয় তত্ত্বের সন্ধান মেলে। এ গল্পের প্রধান চরিত্র ভিখু। সে ডাকাত। জাকাতি তার পেশা হলেও নারীসঙ্গ লাভ তার নেশা। নারীসঙ্গহীন জীবন তার কাছে অসহ্য মনে হয়। তাই ডাকাতি করতে গিয়ে শুধু টাকা- পয়সা, অলংকারই সে লুট করেনি সুযোগ বুঝে নারীর ইজ্জতও লুন্ঠ করেছে।

'প্রাগৈতিহাসিক, গল্পের ভিখু নারীলোলুপ, অকৃতজ্ঞ, বীরসোপীড়িত, বিবেকহীন আদিম মানুষ। সভ্যতার ছোঁয়া সে পায়নি। ডাকাতি করতে গিয়ে বর্শার আঘাত খেয়ে

তার একটি হাত অকেজো হয়ে যায়। তখন সে ভিক্ষা বৃত্তিকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করে। পেশার পরিবর্তন হলেও নেশার কোনো পরিবর্তন হয় না। তার বন্ধু পেহলাদ তাকে শুধু সহযোগিতাই দেয়নি, অসুস্থ ভিখুকে সে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নিজ বাড়িতে ঠাঁই নিয়েছে। সে এবং তার স্ত্রী মিলে সেবা দিয়ে তাকে সুস্থ করে তুলেছে। কিন্তু তার মধ্যে কোনো কৃতজ্ঞতাবোধ ছিল না। পেহলাদের বউয়ের প্রতি তার লোলুপ বাসনা লক লক করে ওঠে। সে তার প্রতি কামনার হাত বাড়ায়। পেহলাদ তা জানতে পেরে তাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেয়। ভিখু প্রতিশোধ নেয় পেহলাদের ঘরে আগুন দিয়ে।

নারীসঙ্গহীন জীবন ভিখুকে অস্থির করে তোলে। নদীর ধারে খেয়াঘাটে বিনু মাঝির একচালার নিচে সে আশ্রয় নেয়। গ্রামের মেয়েরা নদীতে স্নান করতে গেলে সে তীরে দাঁড়িয়ে দুর্বিনীত ইতর হাসি হাসে। দুনিয়ার সব মেয়ে মানুষকে সে পাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করে। ভিক্ষাবৃত্তির কৌশলগুলো সে আয়ত্ব করে নেয় অল্প সময়ে। তাতে তার ক্ষুধা নিবৃত্তির অসুবিধা হয় না। কিন্তু যৌন উন্মত্ততা তাকে চঞ্চল করে তোলে। পাঁচী নামক এক ভিখারিণীর সঙ্গ চায় সে। পাঁচী পাত্তা দেয় না তাকে। অন্য এক ভিখারী বশির মিঞার সাথে তার সম্পর্ক। তাতে ভিখুর উন্মত্ততা বাড়ে। এক রাতে বশির মিঞার ডেরায় ঢুকে সে তাকে হত্যা করে এবং পাঁচীকে কাঁধে তুলে নিয়ে অনিশ্চিতের পথে পা বাড়ায়।

'প্রাগৈতিহাসিক' গল্পে ফ্রয়েডীয় তত্ত্বের অবতারণা করে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এ গল্পের কাঠামো গড়ে তুলেছেন। তিনি তাঁর গল্পে যৌন আকর্ষণের রূঢ় ও বাস্তব দিকটি নগ্ন করে দেখিয়েছেন। এ গল্পে ভিখু চরিত্রের আদিমতাকে তুলে ধরতে গিয়ে গল্পকার অসভ্য, অসংস্কৃতি, অমানবিক জীবনবোধের জাগরণ ঘটিয়েছেন। তাই এ গল্পের নাম হয়েছে 'প্রাগৈতিহাসিক'। 'বাংলা সাহিত্যে ছোটগল্প ও গল্পকার' গ্রন্থে শ্রীভূদের চৌধুরী লিখেছেন, “দারিদ্র্য, সামাজিক অসাম্য ও পারিপার্শ্বিক নির্যাতনের পঙ্কিল স্রোতে বলিষ্ঠ বেগে উজাড় ঠেলে সুন্দর প্রেমের তীরে শিল্পী তাঁর গল্পের তরী বেয়ে চলেছিলেন। বস্তুত প্লটের শরীরে পচনশীল জীবনের দেগ্লানি যা কিছু উৎকট হয়ে উঠেছে 'প্রাগৈতিহাসিক' গল্পের কাল থেকে। অনেকটা এই কারণেই মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্পসাহিত্যে এক নূতন দিগন্ত উন্মোচনের সময় গণনা করা হয় ঐ গল্প থেকেই। অথচ মনে হয়, এই বহুজন-সংবর্ধিত গল্প রচনার লগ্ন থেকেই শিল্পীর প্রতিভা যেন অজ্ঞাতেই নিজের নেমিসস- এর অভিমুখী হয়েছে প্রথম।” 'প্রাগৈতিহাসিক' গল্পের শুরু এ রকম :

“সমস্ত বর্ষাকালটা ভিখু ভয়ানক কষ্ট পাইয়াছে। আষাঢ় মাসের প্রথমে বসন্তপুরের বৈকুণ্ঠ সাহার গদিতে ডাকাতি করিতে গিয়া তাহাদের দলকে দল ধরা পড়িয়া যায়। এগার জনের মধ্যে কেবল ভিখুই কাঁধে বর্শার খোঁচা খাইয়া পলাইতে পারিয়াছিল। রাতারাতি দশ মাইল দূরের মাথাভাঙা পুলটার নিচে পৌঁছিয়া অর্ধেকটা শরীর কাদায় ডুবাইয়া শরবনের মধ্যে দিনের বেলাটা লুকাইয়া ছিল। রাত্রে আরো নক্রোশ পথ হাঁটিয়া একেবারে পেহলাদ বাগদীর বাড়ি চিতলপুরে। পেহলাদ তাহাকে আশ্রয় দেয় নাই । "

'

সরীসৃপ'


'ছোটগল্প' সংকলনের তৃতীয় গল্প 'সরীসৃপ'। এটি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'সরীসৃপ' নামক গল্পগ্রন্থের শেষ এবং শিরোনাম গল্প। 'সরীসৃপ' গল্পগ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছে ১৯৩৯ সালে। তাঁর ছোটগল্প আলাদা বৈশিষ্ট্যের পরিচয়বাহী। বাংলা সাহিত্যের অনন্যমনা বামাচারী কবি ও সমালোচক মোহিতলাল মজুমদার 'বর্তমান বাংলা সাহিত্য' গ্রন্থে তাঁরঅভিমত প্রকাশ করেছেন এভাবে, “প্রথম দিকের গল্পগুলিতে কাব্যকল্পনা ও মনস্তত্ত্বের যে সমন্বয় এবং নারী চরিত্র বিশ্লেষণে যে অপূর্ব ভঙ্গির পরিচয় পাইয়াছিলাম, লেখকের বয়সের তুলনায় তাহা বিস্ময়কর বটে। কিন্তু পরে সৃষ্টি-কল্পনাকে বিদায় দিয়া তিনি সেই দৃষ্টি হারাইয়াছেন—চিনায় বাস্তবের পরিবর্তে জড়বাস্তবের উপাসনা তাঁহাকে পাইয়া বসিয়াছে।"

এ প্রসঙ্গে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'সরীসৃপ' গল্পটির কথা স্মরণ করা যেতে পারে। 'প্রাগৈতিহাসিক' যেমন অমার্জিত আদিম জীবনের গহবরলীন তমসাখণ্ডকে উদগীরণ করেছে, তেমনি 'সরীসৃপ'-এর মধ্যে রয়েছে শিক্ষিত, মার্জিত রুচিসম্পন্ন গৃহস্থঘরে গৃহিণী এবং জননী নারীর অন্ধকার ভজনার দৃঢ় কঠিন চিত্র। চারু ছিল প্রচুর বিত্তশালী গৃহবধু। পাগল স্বামী ঘরে তার নৈতিক বিশুদ্ধতার তদারকি করার জন্যে কিশোর বনমালীকে কৌশলে নিয়োগ করেছিলেন চারুর শ্বশুর। সেই ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যচারণ বনমালীর মনে যৌন আক্ষেপ জাগিয়ে তুলেছিল— চারু তাকে নিয়ে খেলা করত, ধরা দিত না কখনো। ভাগ্যচক্রে-স্বামী-শ্বশুরের মৃত্যুর পর সর্বস্ব হারিয়ে এই বনমালীর আশ্রিত হয়েছিল চারু, তার মানস রুগ্নতাবিশিষ্ট ছেলেকে নিয়ে। চারুর সদ্যোবিধবা ছোট বোন পরীও সেই আশ্রয়ে এসে ধরা দেয়। শিশুপুত্রসহ ছেলের ভবিষ্যৎ নিয়ে দুই বোনে অদ্ভুত প্রতিযোগিতার মানসিক লুকোচুরি খেলা চলে। পরী শেষ পর্যন্ত যৌবনোচ্ছ্বসিত শরীরের বিনিময়েও বনমালীকে ধরে রাখতে চায়, চারু তারেকেশ্বর থেকে কলেরা রোগের বীজাণুমণ্ডিত প্রসাদ এনে খেতে দেয় পরীকে— কিন্তু কলেরায় মরতে হয় চারুকেই। চারুর অন্তর্ধান পটে নিজের যৌবন-ক্ষুধার আক্ষেপকে আবার নতুন করে নিজের মধ্যে আবিষ্কার করে বনমালী। পরী ততদিনে নিঃশেষ হয়ে গেছে তার কাছে আগাগোড়া পড়ে- শেষ করা পুরনো পুথির মতো। শেষ পর্যন্ত বোকা মানসরোগী চারুর ছেলেকে ভুলিয়ে নিরুদ্দেশ মৃত্যুর পথে ঠেলে দেয় পরী, আর পরীকে নীচের আশ্রিতাদের মহলে নির্বাসিত করে বনমালী। কিন্তু পরিণামে সকল মানব-বৃত্তির সম্ভাবনাকে ছাড়িয়ে প্রবৃত্তির নির্মায়িক নির্লিপ্তিই একমাত্র হয়ে ওঠে বনমালীর মধ্যে। সেই চরম অভিব্যক্তির লগ্নে, শিল্পী বলেন:


“ঠিক সেই সময় মাথার উপর দিয়া একটা এরোপ্লেন উড়িয়া যাইতেছিল। দেখিতে দেখিতে সেটা সুন্দরবনের উপরে পৌঁছিয়া গেল। মানুষের সঙ্গ ত্যাগ করিয়া বনের পশুরা সেখানে আশ্রয় লইয়াছে।"


মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের অননুকরণীয় অতুল্য রূপ-প্রকৃতির আর এক উপাদান সাঙ্কেতিকতা। এই সংকেতশৈলীই মানবজীবন-চেতনা সম্পর্কে শিল্পীর অনুভবের একআশ্চর্য বিগাঢ়-ব্যঞ্জনা অনুরণিত করেছে শেষের ঐ একটি মন্তব্যে। জীবনের সত্যকে অন্ধকার হলেও এক অবিচল সত্যানুভবকে আয়ত্ত করা চলে 'সরীসৃপ' গল্পে। সেই সঙ্গে মনস্তত্ত্ব এবং নারী-চরিত্র বিশ্লেষণের তীক্ষ্ণ চকিত জীবন্ত দৃষ্টি— সব কিছু মিলে এক দৃঢ়-কঠিন শক্তির বিস্ময়কর মহিমা গল্পে দীপ্ত হয়ে আছে। 'সরীসৃপ' গল্পে মনস্তাত্ত্বিক ঘাত-প্রতিঘাতের পূর্ণ বিকাশ ঘটেছে।

আজকাল পরশুর গল্প


মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটা গল্পগ্রন্থের নাম 'আজ কাল পরশুর গল্প'। গ্রন্থটি প্রকাশিত হয় ১৯৪৬ সালে। এটি গ্রন্থের নাম গল্প। পঞ্চাশের মন্বন্তর, কালোবাজারি, অনাহারে বহু লোকের মৃত্যু এবং চোরাকারবারিদের সামাজিক প্রতিজ্ঞা এই গল্পের পটভূমি। 'আজ কাল পরশুর গল্প'র তেমনি একটি চরিত্র ঘনশ্যাম। শ্রীভূদেব চৌধুরী বলেন, “মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সকল রচনাতেই প্রতিভার সমান উজ্জ্বলতা রক্ষিত হতে পারেনি। কিন্তু তার শক্তির প্রাচুর্য-চিহ্নিত মহাকালের জটার জট গল্পের চরিত্রায়ন ও প্লট সম্পর্কেও একই কথা বলতে হয়। নিয়ত প্রাণনের প্রতিশ্রুতি সম্বদ্ধ সজীব শিল্পী-আত্মা এই বর্হিভারে স্বভাবতই আড়ষ্ট হয়ে পড়ে। বস্তু এবং তথ্য-তত্ত্বের ভার থেকে সত্রের জগতে সে মুক্তি কামনা করে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ও তাই করেছিলেন। কিন্তু সেও আসলে বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব আর যৌনতথ্যের জগৎ থেকে বিশেষ রাজনৈতিক মতবাদের নিকট ক্লান্ত শিল্পীমানসের আত্মদান। মতবাদ বিশেষের দোষগুণের বিচার সাহিত্য-সন্ধিৎসুর নয়। কিন্তু সাহিত্যের নির্মাণশালা মতবাদের লৌহবাসরে নয়, আত্ম-উপলব্ধির নন্দনলোকে; তথ্য এবং তত্ত্বের বোঝাকে শিল্পমন্দিরের বহিঃপ্রাঙ্গণে ফেলে কেবল সত্যানুভবের সঞ্চয় নিয়ে সৃষ্টির আনন্দলোকে শিল্পীর প্রবেশাধিকার।

প্রতিভার স্বধর্মবশে কাপালিকের যে শ্মশান-সাধনায় মানিক স্বেচ্ছাবৃত হয়েছিলেন, চারপাশের বাধা বিরুদ্ধতা— শিল্পীর ব্যক্তিজীবনের হতাশা, অসাফল্য এবং ক্রূর বঞ্চনালাভের কথাও এই প্রসঙ্গে অবিস্মরণীয়—তার উজান ঠেলে বহুদূর এগিয়ে যাবার উপায় বুঝি অতবড় প্রতিভারও ছিল না। ফলে মুক্তির আকাঙ্ক্ষায় নূতন যে পথে ব্যক্তি- শিল্প পাড়ি দিলেন, তাঁর সৃজনশীল আত্মার বন্ধন তাতে ঘুচল না। তাই 'আজকাল পরশুর গল্পে'র মত প্রখ্যাত রচনাতেও জীবন অনুপস্থিত, সুস্থ আশাবাদের বলিষ্ঠ অভিব্যক্তির আকাঙ্ক্ষায় প্লট এবং চরিত্রগুচ্ছ এক বিশেষ মতবাদের জ্যামিতিক প্রতিপাদ্যের প্রজেকশন হিসেবেই যেন যান্ত্রিক পরিণামের পথে এগিয়ে যায়। "

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন মানবতাবাদী লেখক। তাই মন্বন্তরের ভয়াবহ দৃশ্য তাঁর মনকে ক্ষতবিক্ষত করেছিল। সমাজের সাধারণ মানুষের সর্বনাশের ঘণ্টাধ্বনি তিনি শুনেছেন। তিনি দেখেছেন ঘনশ্যামের নেতিবাচক চরিত্র আর প্রভাব। মানসুফিয়া গ্রামের হতদরিদ্র রামপদর বউ মুক্তা মন্বন্তরের সময় বেঁচে থাকার আশায় শহরে গিয়ে খাতায় নাম লিখিয়েছিল। গ্রামের অনেক কৃষক পরিবারের মেয়ে পেটের দায়ে দেহকে জীবিকার উপকরণ করতে বাধ্য হয়েছিল। তারই মর্মান্তিক বাস্তবচিত্র 'আজকাল পরশুর গল্প'।


'হারানের নাতজামাই"


মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন সমাজ ও রাজনৈতিক দিক থেকে সচেতন ব্যক্তি। তাঁর লেখায়ও তার প্রতিফলন ঘটেছে। 'হারানের নাতজামাই' গল্পেও তার প্রমাণ মেলে। এটি তাঁর শ্রেষ্ঠ দুটি রাজনৈতিক গল্পের একটি। এই গল্পটি গল্পকারের 'ছোট বড়' শীর্ষক গল্পগ্রন্থের অন্তর্গত। ১৯৪৮ সালে প্রকাশিত এই গ্রন্থের গল্পগুলোতে প্রাধান্য পেয়েছে সমকালীন দেশ-কাল-রাজনীতি। এ গল্পের চরিত্র সংগ্রামী চেতনায় উজ্জীবিত কৃষকশ্রেণির মানুষ। কৃষক নেতা ভুবন মণ্ডলের নেতৃত্বে তেভাগা সংগ্রামে লিপ্ত সালিগঞ্জ গ্রামের কৃষকশ্রেণি। আর জমিদার জোতদারেরা তাদের অধিকার বজায় রাখার জন্যে নৃশংস নির্যাতন চালায় কৃষকদের ওপর । পুলিশি হয়রানি চালায়। ভুবন মণ্ডলের বিরুদ্ধে পুলিশের হাতে গ্রেফতারি পারোয়ানা থাকলে সে অনায়াসে প্রশাসনকে গুরুত্ব না দিয়ে ঘুরে বেড়ায় কিন্তু সালিগঞ্জ গ্রামে যেদিন সে হারানের বাড়িতে আশ্রয় নেয় সেদিন পুলিশ খবর পেয়ে মাঝরাতে ঐ গ্রামে হানা দেয়। কিন্তু ময়না আর তার মা, নকল বৃদ্ধ বাবা সাজা হারানের (ভুবন) চালাকির কাছে পুলিশ সহ সকলেই বোঝা হয়ে ফিরে যায়। এভাবে গল্পটি আমাদের বাস্তব জীবনের সাথে মিশে গিয়েছে। 


ছোট বকুলপুরের যাত্রী


'ছোট বকুলপুরের যাত্রী' মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত একটি রাজনৈতিক গল্প। গল্পটি প্রকাশিত হয়েছে ১৯৪৯ সালে। হাওড়া জেলার বাগনানের কাছাকাছি বড়া-কমলাপুর অঞ্চলকে পটভূমি করে গল্পটি রচিত। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছোটগল্পে এই বড়া- কমলাপুরই ছোট বকুলপুর নামে পরিচয় লাভ করেছে। 'ছোট বকুলপুরের যাত্রী' নামে গল্পকারের একটি গল্পগ্রন্থও আছে। তারই নামগল্প এটি। গল্পটি শুরু হয়েছে এভাবে : “গাড়িটা ঘণ্টাখানেক লেট করেছে।


ঠিক সময়ে পৌঁছলেও অবশ্য প্রায় সন্ধ্যা হয়ে যায়, স্টেশনের তেলের বাতিগুলি তার আগেই জ্বালানো হয় প্ল্যাটফর্মে অল্প কয়েকজন মাত্র যাত্রী গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছিল, শঙ্কিত ও স্তব্ধভাবে। আরো গভীর রাত্রের ট্রেনের জন্যও এ স্টেশনে সাধারণত আরো অনেক বেশি যাত্রী জড়ো হতে দেখা যায়। আজ একদল সিপাই প্ল্যাটফর্মে যাত্রীর অভাব পূর্ণ করেছে।


গাড়ি দাঁড়ায় মিনিট দেড়েক। এই সময়টুকু ব্যস্ততা এবং কলরবও আজ স্টেশনে ঝিমানো মনে হয়, তারপর গাড়ি ছেড়ে যাবার দু-চার মিনিটের মধ্যেই অদ্ভুতভাবে স্টেশন এলাকা যাত্রীশূন্য হয়ে ছমছমিয়ে আসে। গাড়ি থেকে যারা নেমেছে তারা কোনো দিকে না তাকিয়ে তাড়াতাড়ি গেটে টিকিট দিয়ে পথে নেমে যায়— এত লোকে যে টিকিট কাটে এবং সদর গেটে টিকিট দাখিল করে স্টেশন ছাড়ে এও এক অসাধারণ ব্যাপার বটে।”


'ছোট বকুলপুরের যাত্রী' গল্পের শুরু থেকেই এক ধরনের ভয়ঙ্কর পরিবেশের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। একটা গা-ছমছম ভাব। তাই দেখা যায়, গাড়ি থেকে নেমেই যাত্রীরা এক মুহূর্ত দেরি না করে দ্রুত স্টেশন ত্যাগ করার জন্যে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। মুহূর্তের মধ্যে স্টেশন জনশূন্য হয়ে গেলে সাদা পোশাকের গোয়েন্দারা ঘোরাফেরা করে। অস্ত্রসহ সৈন্যদলও আছে। স্টেশনের পাশেই ছোট একটা কারখানায় ধর্মঘট চলছিল। ধর্মঘটের নেতৃত্বে যারা ছিল তাদের মধ্যে তিনজনকে ধরে ট্রেনে চালান দেওয়ার সময় শত শত শ্রমিক এসে তাদের ছিনিয়ে নিতে চেয়েছিল। তখন গুলি চালানো হয় এবং রক্তপাত হয়। এ রকম এক ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যে হাওড়ার এক কারখানা থেকে ছাঁটাই হওয়া শ্রমিক দিবাকর তার স্ত্রী আন্নাকে নিয়ে স্টেশনে নামে। ট্রেনস্টেশন তখন জনশূন্য। তারা ছোট বকুলপুরের যাত্রী। স্টেশন থেকে বাইরে এসে তারা গরুর গাড়ি খোঁজে। ছোট বকুলপুর গ্রামটিকে পুলিশ ও গোয়েন্দারা ঘেরাও করে রেখেছিল বলে কেউ সেখানে যেতে চায় না। শেষ পর্যন্ত গরুর গাড়ি যেতে রাজি হলে তারা ছোট বকুলপুরে হাজির হয়। কিন্তু গ্রামটিকে যারা পাহারা দিচ্ছিল দিবাকর ও আন্নাকে তারা সন্দেহ করে। ভাবে কোনো বিপ্লবী নেতা ছদ্মবেশে বকুলপুরে এসেছে। এই সন্দেহ দূর করার জন্যে তারা দিবাকরের সব কিছু দেখে নেয়। গোয়েন্দারা তার আসল পরিচয় পেয়ে বিস্মিত হয়। এভাবেই গল্পটি পরিণত লাভ করে।


মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় জীবনশিল্পী। তাঁর ছোটগল্প সম্পর্কে জনৈক সমালোচক বলেছেন, 'তাঁর লেখায় আধুনিকতা অত্যন্ত প্রবল এবং প্রায় কনভেনশনের মতো। গোড়ার দিকে রচনায় যৌনবিষয়ে যে উৎকট বে-অন্ধ্র মনোভাব দেখা যায় তা এই কনভেনশনেরই দায়ী।' 'ছোটগল্প' সংকলনের গল্পগুলো সে দৃষ্টান্ত বহন করে ।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ