Hot Posts

6/recent/ticker-posts

তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় এর ছোট গল্পে অন্তঃজ /লোকজ শ্রেণির মানুষের বর্ণনা

তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়

 (১৮৯৮-১৯৭১) কথাসাহিত্যিক, রাজনীতিবিদ। ১৮৯৮ সালের ২৩ জুলাই পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার লাভপুর গ্রামে এক জমিদারবংশে তাঁর জন্ম।তিনি তার সাহিত্য কর্মে অন্তঃজ শ্রেণির মানুষদের তুলে এনেছেন। রাঢ় বাংলায় বেড়ে ওঠা লেখক, প্রতিটি মানুষকে উপলব্ধি করেছেন খুব কাছে থেকে।তাদের জীবন জীবিকা তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন তার ছোট গল্প গুলোতে।নিম্নবর্গের মানুষ রা হয়ে উঠেছে তার গল্পের প্রধান উপজীব্য। নিজে লোকজ সংস্কৃতি এবং মানুষদের সাথে তার গল্পের মেলবন্ধন দেখানো হলোঃ-

তথ্য সংগ্রহঃ- Dhaka University Institutional Repository


বেদে

বেদে সম্প্রদায় সম্পর্কে তারাশঙ্করের কৌতূহল ছিল প্রচুর। তাঁর স্মৃতিকথায় জানা যায়:

""বেদিয়ারা আসত। দেশী বেদিয়া সাপুড়ে। এরা সাধারণত আসত বর্ষার সময়, মাঠে আল-কেউটে ধরতে। গ্রামে সাপ দেখিয়ে গান গেয়ে ভিক্ষা করত, বাঁদরও নাচাত, আর চলত। ওরা যেত] মেদিনীপুর পর্যন্ত। ""


বাংলায় সাপ সম্পর্কে প্রচলিত ধারণা আদিম বিশ্বাস-জাত। সাপের দেবী মনসা বহু পূজিত লৌকিক দেবী। সাপ সম্পর্কিত বহু ব্রতকথা, উপকথা, অভ্যাস, পেশা, লৌকিক বিশ্বাস তারাশঙ্করের ছোটগল্পে পাওয়া যায়। "সৰ্প-অভিপ্রায় (Snake Motif) সমস্ত পৃথিবীর একটি অতিপ্রচলিত লৌকিক সংস্কৃতির প্রধানতম বিষয়, পৃথিবীর বহু আদিবাসীর মধ্যে সর্প অভিপ্রায় আছে।” ১০ 'বেদেনী' 'নারী ও নাগিনী', 'বেদের মেয়ে', 'যাদুকরী' প্রভৃতি গল্পে বেদেদের চিত্র ফুটে উঠেছে। 'বেদেনী' গল্পে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন এরা নিজেদের মুসলমান হিসেবে পরিচয় দিলেও এদের নাম- আচার হিন্দুদের মতো। হিন্দুদের ব্রত পালন করে, হিন্দু দেব-দেবীর পূজা করে। সাপ ধরে, সর্পদংশনের ঔষধ বিক্রি করে, সাপ-বাদর দিয়ে খেলা দেখিয়ে এরা জীবিকা নির্বাহ করে। সাপুড়ে-বেদের কথা আছে 'নারী ও নাগিনী'তে। সাপুড়ে বেদেদেরই একটি শ্রেণী। মেটেল, মাল, মাঝি, বিষবেদে এই বিভিন্ন প্রকার বেদেদের কথা তারাশঙ্করের অন্য কিছু রচনায় পাওয়া যায়। বিষবেদেরা সর্পদংশিত ব্যক্তির চিকিৎসাও করে, সাপের বিষ নির্গত করে কবিরাজের কাছে বিক্রিও করে। এই বেদে শ্রেণী যাযাবর, কোনো স্থায়ী ঠিকানা না থাকায় এরা এক স্থান থেকে অন্য স্থানে ভ্রমণ করে।


বাজিকর


তারাশঙ্কর বেদে সম্প্রদায়ের মতো

"" আরেকটি যাযাবর শ্রেণী তাঁর ছোটগল্পে উপস্থাপন করেছেন, এরা হল বাজিকর গোষ্ঠী।  আমাদের অঞ্চলে বাজীকর বলে। এরা ম্যাজিক দেখায়। মেয়েরা নাচে, গান গায়। পুরুষেরাও ঢোলক বাজিয়ে গান গায় সমসাময়িক ঘটনা নিয়ে এরা গান বাঁধে। 

এই বক্তব্যে বাজিকর শ্রেণীর পোষাক, সাজসজ্জা, নাচ, গান সবকিছুই স্পষ্ট রূপ লাভ করেছে। এই বাজিকর শ্রেণী রাঢ় বাংলার লোকায়ত জীবনের একটি অংশ। 'নারী ও নাগিনী', 'যাদুকরী', 'বেদেনী', 'সাপুড়ের গল্প', 'মরুর মায়া', 'পিঞ্জর', 'যাদুকরের মৃত্যু', 'আফজল খেলোয়াড়ী ও রমজান শের আলী' প্রভৃতি গল্পে লেখক সাপুড়ে বেদে, বাজিকর, যাযাবর শ্রেণী, বাজি বা সার্কাস প্রদর্শনকারী প্রভৃতি গোষ্ঠীর জীবনাচরণ প্রত্যক্ষভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। যাযাবর শ্রেণীর লোকজন বিভিন্ন পেশা গ্রহণ করত। ক্ষণস্থায়ী জীবনে এরা কেউ কৃষিকাজ করত, কেউ কেউ দৈহিক কসরত প্রদর্শন করত, কেউ কেউ ভেল্কিবাজি, শিকারও করত। স্থায়ী কোন ঘর ছিল না বলে তাদের হাঘরে বলে চিহ্নিত করা হত। এই হাঘরে আদিম গোষ্ঠীবদ্ধ শ্রেণী রাঢ় বাংলায় তারাশঙ্করের সময়েও ছিল। ১৯৯৪ সালের লাভপুরের রেললাইনের ধারেও তাদের দেখা গিয়েছে।


বাউল, বৈষ্ণব, শাক্ত


অপ্রধান ধর্মাবলম্বীদের গ্রামীণ পটভূমিতে লোকসমাজের অন্তর্গত হিসেবে ধরা হয়। বৈষ্ণব, বাউল, শাক্ত এসব গোষ্ঠীবদ্ধ শ্রেণীকে লোকায়ত গোষ্ঠী হিসেবে গণ্য করা হয়। এরা কৃষি নির্ভর নয়, ভিক্ষাবৃত্তি করে জীবিকা নির্বাহ করে। অপরদিকে শাক্তরা কৃষিকর্ম বা কুটির শিল্পে নিয়োজিত থেকে কিংবা সন্ন্যাসী হয়ে জীবিকা নির্বাহ করে। এরা ধর্ম-সম্পৃক্ত প্রথা মেনে চলে। ধ্রুবকুমার মুখোপাধ্যায় বলেছেন। “বৈষ্ণবধর্মের শক্তি হ্লাদিনী শক্তি, সে শক্তি বলরূপিনী নয়। বৈষ্ণবরা ভগবানের সঙ্গে জগতের দ্বৈত বিভাগ স্বীকার করেছেন। শাক্ত ধর্মের মত বৈষ্ণব ধর্মে ভেদকে প্রাধান্য দেওয়া হয়নি। তাঁরা এই ভেদকে নিত্য মিলনের উপায়রূপে স্বীকার করেছেন। বৈষ্ণব ও শাক্ত উপাসকের বিশ্বাস, সংস্কার ও পূজা পদ্ধতির মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। বৈষ্ণবরা শ্রীকৃষ্ণ, গৌরাঙ্গ ও রাধাকেই উপাসনা করেন; শাক্তদের উপাস্য হলেন কালী, তারা, মহাবিদ্যা, দুর্গা, অম্বিকা, চণ্ডিকা। বৈষ্ণবদের কাছে সাধনার উপকরণ হল তুলসীবৃক্ষ, তুলসীপত্র ও তুলসীমালা। বিপরীত দিকে শক্তি সাধকেরা বিশ্বপত্র, বিশ্ববৃক্ষ, রুদ্রাক্ষ মালা ও জবাকেই গ্রহণ করেছেন।"

তারাশঙ্কর "রাইকমল' উপন্যাসের তৃতীয় মুদ্রণে উপন্যাসের প্রারম্ভে রাঢ়ভূমির কেন্দ্রবিন্দুকে বৈষ্ণব সংস্কৃতির লীলাক্ষেত্র বলে চিহ্নিত করেছেন। বৈষ্ণবরাই বোষ্টম হিসেবে পরিচিত হয়েছে পরবর্তীকালে। ব্রাহ্মণদের কাছে এরা অস্পৃশ্য, ব্রাহ্মণ্য রীতি-নীতি এরা মান্য করে না। বিবাহ বর্হিভূত যৌন সম্পর্ক বৈষ্ণবদের কাছে অবৈধ নয়, স্বাভাবিকভাবে এসব তারা গ্রহণ করে। মালাচন্দন বা কণ্ঠীবদল করে এরা বিবাহ করে। সামাজিকভাবে অবৈধ সন্তানকেও তারা স্বীকৃতি দিয়ে থাকে।

শাক্ত সমাজে বা তান্ত্রিক সাধনায় আত্মার চেয়ে দেহের প্রাধান্য বেশি থাকে। লোকায়ত সমাজের শাক্তরা তথ্য তান্ত্রিকেরা মনে করেন যে দেহ ছাড়া আত্মার কোন অস্তিত্ব নেই। এদের মধ্যে নারীদের বিশেষ প্রাধান্য দেখা যায়। নারীর প্রতি দুর্ব্যবহার করলে প্রকৃতি ক্রুদ্ধ হয় এটা শাক্তরা বিশ্বাস করে। বাংলার শাক্তরা একারণেই দেবী কালীর পূজা করে থাকে। বৈষ্ণব-বাউল-শাক্ত এই অপ্রধান ধর্মে স্থিত হয়ে থাকে অন্য ধর্মচ্যুত বা পালিয়ে আসা মানুষ। তন্ত্র সাধনায় শবসাধনা, বামাচার, ব্যভিচার প্রভৃতি অনুষঙ্গ স্বাভাবিক ব্যাপার। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'রসকলি', 'হারানো সুর', 'রাইকমল', 'প্রসাদমালা', 'মালাচন্দন', 'সর্বনাশী এলোকেশী', 'বাউল', 'ট্রিটি', 'ছলনাময়ী', 'একরাত্রি', 'ট্যারা’ প্রভৃতি গল্পে রাঢ় বাংলার বৈষ্ণব, বাউল ও শাক্তদের লোকজীবন রূপায়িত হয়েছে।


গোপ, সগোপ


 আরেকটি গোষ্ঠী হল সদগোপ। প্রাচীনকালে রাঢ় বাংলায় বিস্তীর্ণ গড়জঙ্গল এলাকায় যারা গরু পালন করে জীবিকা নির্বাহ করত তাদের বলা হত গো-পালক বা সংক্ষেপে গোপ সম্প্রদায়। এই সম্প্রদায়ের মধ্যে যারা পরবর্তীকালে কৃষিকাজে আত্মনিয়োগ করে। তাদের বলা হল সদগোপ এবং যারা শুধু গো-পালন ও দোহনের উপর নির্ভর করে তাদের নাম হয় গোপ বা গোয়ালা। বর্তমানে অবশ্য রাঢ়ের সকল ধর্ম ও সম্প্রদায়ের মানুষ কৃষিকাজ ও গরু পালন করে। কিন্তু জাতের উপাধি ও পদবীর মধ্যে দিয়ে প্রাচীন কালের গোষ্ঠীর কর্ম ও বর্ণভেদের পরিচয় পাওয়া যায়। তুর্কি আক্রমণের পরেও রাঢ়ের বিভিন্ন এলাকায় উগ্র ক্ষত্রিয়, কায়স্থ কৈবত, ব্ৰাহ্মণ, বাগদি যেমন সামন্তরাজা রাজত্ব করতেন তেমনি গোপ সম্প্রদায়ও গড়জঙ্গলের গোপভূমিতে রাজত্বকরতেন। রাজা গোপচন্দ্র তার প্রমাণ। সেই গোপ বা সগোপ বা গোয়ালারা রাঢ়ের লোকজীবনের একটি বিশাল অংশ জুড়ে রাঢ়ের কীর্তিগাথাকে উজ্জ্বল করে রেখেছে। প্রকৃত পক্ষে গোপভূম ছিল বর্ধমান, বীরভূম, মুর্শিদাবাদ ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকা জুড়ে অরণ্যময় এক বিশাল ভূখণ্ড। ভারতের গোপ সম্প্রদায় আহার ও পল্লব নামে দুটি ভাগে বিভক্ত হয়েছিল। রাঢ়ের ভিতরে পল্লব গোপদেরই আধিক্য দেখা যায়। এছাড়া গোপেরা উজানী, মধু, যাদব ও গোয়ালা ইত্যাদি ভাগে বিভক্ত এবং কৃষিকাজে নিযুক্ত যারা তারা চাষা সদগোপ নামে পরিচিত হয়। সদৃগোপনের পদবী হল মণ্ডল বা মোড়ল।


পটুয়া


বীরভূমের পটুয়ারা অন্য এলাকার যেমন মেদিনীপুর ও কলকাতার পটুয়াদের চেয়ে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। বিজ্ঞজনের মতে আদিতে এরা পশ্চিমবঙ্গের সীমান্তবর্তী নিষাদ জাতির শ্রেণী ছিল, পরে হিন্দু সমাজের নিম্নগোত্রীয় স্তরে স্থান পায় এবং কালক্রমে মুসলমান হয়। তবু এরা হিন্দুদের আচার-সংস্কার পালন করে। পূজা করে, নামাযও পড়ে, মেয়েরা শাখা সিঁদুর পরে। উনিশ শতকের ত্রিশ ও চল্লিশের দশকে বীরভূমের অনেক গ্রামে বিশ ঘরের মতো পটুয়া বাস করত। পরবর্তীতেও বীরভূমের সিউড়ি, পাকুড়হাস, পানুড়ে, ইটাগড়িয়াতেও কিছু পটুয়ার বাস ছিল। তারাশঙ্করের সমকালীন সময়ে গৃহস্থ বন্ধুরা পটুয়া নারীদের দিয়ে কাঁথায় নকশা করিয়ে নিত কিন্তু পটুয়ারা নিম্নস্তরের বলে তাদের স্পর্শ বাঁচিয়ে চলত। 'কামধেনু', 'রাঙাদিদি' গল্পে তারাশঙ্কর পটুয়া শ্রেণীর জীবন অঙ্কন করেছেন। মালাকার শ্রেণীরা প্রতিমা, দেবতার মূর্তি অঙ্কন করত, নকশা করত, প্রতিমা তৈরি করত। এই শ্রেণীও রাঢ় বাংলার লোকগোষ্ঠীর ঐতিহ্যময় অংশ।


কাহার


হরিজনদের মধ্যে যারা পালকি বহন করে তাদের কাহার সম্প্রদায় বলা হয়ে থাকে। বাগদিদের মধ্যে যারা পালকি বহন করে তাদের বলে বাগদি কাহার, যারা করে না তাদের শুধু বাগদি বলা হয়। কাহার গোষ্ঠী পুরুলিয়া, বীরভূম, বাঁকুড়া, বিহার এলাকায় বসবাস করে। ভারবহন, চাষাবাদ, পালকি বহন, ভূত্যের কাজ করে কাহার সম্প্রদায় জীবিকা নির্বাহ করে। হাসুলীবাঁকের কাছে মণ্ডলী ও কাদপুর গ্রামে তিনশ জন বাগদি কাহার বাস করে। কাহার জাতি অতিলৌকিক জগৎ সম্পর্কে সচেতন থাকে সবসময়। কাহারদের বিশ্বাস তাদের পাপের কারণে প্রাকৃতিক বিপর্যয়, দুর্ঘটনা, মহামারী ঘটে থাকে।

বিশেষ গাছ, সাপ, মেঘ ইত্যাদিতে তারা দেবমাহাত্ম্য আরোপ করে। স্থানীয়ভাবে কাহার সম্প্রদায় বেহারা ও আটপৌরে দুটি ভাগে বিভক্ত। এদের সমাজ ব্যবস্থা কঠিন, নিয়ম-নিষেধের আবেষ্টনে ঘেরা। কাহার সম্প্রদায় আগে অর্থের বিনিময়ে নীলকরদের লাঠিয়াল হয়ে কাজ করত। নীলকরেরা চলে গেলে কাজের অভাবে চুরি ডাকাতি শুরু করে। কাহারদের নিজস্ব সাতটা উৎসব রয়েছে, যেমন ধর্মপূজা, পৌষলক্ষ্মী, নবান্ন, গাজন, মনসাপূজা, ভাঁজো পরব, অম্বুবাচী। কোঠা বা দালান করলে মৃত্যু হয় অথবা জাত বা ধর্ম নষ্ট হয়। এই বিশ্বাসে আস্থাশীল কাহার সম্প্রদায়।


রাঢ় বাংলার সাঁওতাল


রাঢ়ের এক বিশাল অংশ জুড়ে রয়েছে সাঁওতাল জনগোষ্ঠী। বর্ধমান, মেদিনীপুর, বীরভূম, বাঁকুড়া জেলায় সাঁওতাল জনসমষ্টির চার ভাগের তিন ভাগ রয়েছে। অনুমান করা হয়, ১৯৩১ সালে বীরভূমের মোট জনসংখ্যার ৭.৫ শতাংশ ছিল সাঁওতাল। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রত্যক্ষ পরিচয় ছিল এসব সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর সঙ্গে। স্থানীয় বাঙালিদের চেয়ে সাঁওতালরা স্বাস্থ্যের দিক দিয়ে সবল, কর্মঠ, কষ্টসহিষ্ণু বলে কৃষি ও শিল্পকালে শ্রমিক হিসেবে তাদের চাহিদা বেশি ছিল। রাঢ় বাংলার লৌকিক সংস্কৃতিতে সাঁওতাল সম্প্রদায়ের অনেক অবদান রয়েছে। শান্ত ও সহিষ্ণু স্বভাবের জন্য তারা উচ্চবর্ণের শোষণের শিকার হয়েছে এবং প্রতারিত হয়েছে। তারাশঙ্কর তাঁর পিসিমার কাছে বাল্যকালে সাঁওতাল বিদ্রোহের কথা শুনেছেন। নব্য ব্যবসায়ীদের দ্বারা লাঞ্ছিত হয়ে সাঁওতালরা তাদের বহু শ্রমে করা আবাদী জমি ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়। 'শিলাসন', 'কমল মাঝির গল্প', 'একটি প্রেমের গল্প", 'ঘাসের ফুল' প্রভৃতি গল্পে সাঁওতালদের জীবন তুলে ধরেছেন লেখক।


গন্ধবণিক


বীরভূমের কীর্ণাহার অঞ্চলে এবং দামোদর ও অজয় নদের উভয় তীরে গন্ধবণিকদের বসবাস। রাঢ়ের পল্লীসমাজে তাদের যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে। রাঢ় বাংলায় তুর্কি আগমনের পর গন্ধবণিকরা তুর্কিদের প্রিয় হয়ে ওঠে এবং ব্যবসা প্রসারের ফলে সমৃদ্ধি অর্জন করে। তাদের বীরভূমের রেশম ও রেশম কাপড়ের ব্যবসা ছিল। ব্রাহ্মণদের সামাজিক প্রতিপত্তি ও মর্যাদা বৃদ্ধি পেলে গন্ধবণিকদের গৌরব হ্রাস পায় এবং এই অবনতি বীরভূমের নবাবের কারণে তরান্বিত হয়। অনেক প্রাচীনকাল থেকে রাঢ় অঞ্চলে এই গন্ধবণিকদের ঐতিহ্য রয়েছে। 'ভুবনপুরের হাট' ও 'পদচিহ্ন' উপন্যাসে তারাশঙ্কর গন্ধবণিকদের কথা বলেছেন।

বাগদি, ভগ্না, লেট


রাঢ় বাংলার লোকায়ত সমাজে বাগদি, ভল্লা ও লেট গোষ্ঠী নিজস্ব ঐতিহ্য নিয়ে অবস্থান করেছে। বাগদিরা বাঁকুড়া, বীরভূম, বর্ধমানের অধিবাসী; বীরভূমের প্রাচীনতম অধিবাসী এরা। চাষবাস করা, নৌকা চালানো, মাছ ধরা এদের পেশা। বাগদি শ্রেণীর মধ্যে যারা সবচেয়ে উঁচু তাদেরকে তেঁতুলিয়া বলা হয়। অতীতকালে বাগদিরা দক্ষ লাঠিয়াল হিসেবে নিযুক্ত হত এবং পেশা হিসেবে চুরি ডাকাতিকে বেছে নিত। বাগদিদের একটি শাখা হল ভরা গোষ্ঠী। বাইরের দিক দিয়ে ভরারা শান্ত হলেও একসময় তারা ভয়ঙ্কর দুর্ধর্ষ ছিল। দেহের শক্তি ও লাঠি চালনায় তারা পারদর্শী। বাগদিদের লেট নামে আরেকটি শাখা আছে। তবে লেটরা তা অস্বীকার করে, বাগদিদের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্কও তারা করে না। এরা জাল বোনে, মাছ ধরে, কৃষিকাজ করে, চৌকিদারি বা দিনমজুরি করে আবার কেউবা ডাকাতিও করে। হিন্দু ধর্মাবলম্বী বলে মনসা ও ধর্মরাজের পূজা করে এবং ধর্মরাজকে বৈশাখ ও জ্যৈষ্ঠ মাসে পূর্ণিমার রাতে তাড়ির ভোগ দেয়।


ডোম, হাড়ি, বাউরি


রাঢ় বাংলার জনজীবনে ডোম হাড়ি-বাউরি এরা বেশিরভাগ সময়ে লাঠিয়াল হিসেবে জীবিকা নির্বাহ করত। কাজের অভাব হলে চুরি-ডাকাতি করত। সুহলকুমার ভৌমিক ডোমদের প্রসঙ্গে বলেছেন:


সম্ভবত গোড়ার দিকে ডোমদের কাজ ছিল বাজনা বাজানো এবং অবসর সময়ে বাঁশের চুপড়ি ইত্যাদি তৈরি করে গ্রামে বিক্রয়। পরবর্তীকালে মৃতব্যক্তির জিনিসপত্র পরিষ্কার ও নগরের আবর্জনা পরিষ্কারের কাজে নিযুক্ত হয়। ফলে অনেকে বাগুড় ইত্যানির সঙ্গে অভিন্ন ভেবে এদের দ্রাবিড়গোষ্ঠীর মনে করেন। কিন্তু মূলত ডোমেরা কোলগোষ্ঠীর। Cold well এর মতে দ্রাবিড়-পূর্ব জাতির ডোমরা কোলগোষ্ঠীর একটি শাখা। সাঁওতালদের বিবাহে ডোমদের বাজনার বিশেষ স্থান আছে।


ডোমদের তিনভাগের দুভাগ বাস করে বীরভূম, বর্ধমান, বাঁকুড়ায়। ডোমদের মেয়েরা ধাইয়ের কাজ করে। ডোম গোষ্ঠী ঝুড়ি তৈরি করে এবং কৃষিকাজ করে। তারাশঙ্করের সময়ে লাভপুর গ্রামে হাড়ি গোষ্ঠী ছিল। হাড়িদের মধ্যে যারা ভূঁইমালী নামে পরিচিত তারা কৃষিকাজ করে এবং ফুলহাড়ি নামে যারা আছে তারা ধাইয়ের কাজ করে। বাউরিরা সাধারণত জমি-জমা চাষাবাদের কাজ করে। এরা শারীরিকভাবে অন্য গোষ্ঠীর লোকদের তুলনায় দুর্বল। গায়ের রং সাধারণত কালো হয়, শারীরিক গঠনের দিক থেকে এরা ছোটখাট এবং শীর্ণ। বাউরি গোষ্ঠীর নারীরা বাসা-বাড়িতে কাপড় কাচা,বাসন মাজার কাজ করে। ঠ্যাঙাড়ে নামে আর একটি লোকগোষ্ঠী রয়েছে রাঢ় বাংলায়, এরা মানুষের কাছ থেকে অর্থ, অলঙ্কার, মূল্যবান সম্পদ লুটপাট করার উদ্দেশ্যে হত্যা করে নির্জন জায়গায় ফেলে রেখে যেত। ময়ূরাক্ষীর ওপারে তাদের বাস ছিল। এই ঠ্যাঙাড়ে গোষ্ঠী পুর্বে 'মানষুড়ে' মুসলমান দল হিসেবে পরিচিত ছিল।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ