***ভুমিকা,,, ****ভারতচন্দ্রের মানসিংহ ---,,,, ***মানসিংহ ভবানন্দের কাহিনী
--মানসিংহ -ভবানন্দ উপাখ্যান আলোচনা
মানসিংহ ভবানন্দের কাহিনী
মানসিংহ ভবানন্দ
মানসিংহ কে
মানসিংহ প্রতাপাদিত্যের যুদ্ধ
মানসিংহ ভবানন্দ উপাখ্যান এর কাহিনী--
**বিঃদ্র-বাংলা বিভাগের সকল পড়াশোনা পেতে ব্লগটিতে যুক্তথাকুন https://monoweredu13.blogspot.com/?m=1
ভূমিকা---
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে মঙ্গলকাব্য একটি উল্লেখযোগ্য শাখা।মধ্যযুগে চারশো বছরেরও অধিককালব্যাপী বহ, কবি বিভিন্ন ধরনের মঙলকাব্য রচনা করেছেন। বিভিন্ন শ্রেণীর মঙ্গলকাব্যের মধ্যে মনসামঙ্গল, চণ্ডীমঙ্গল, ধর্মমঙ্গল ও অন্নদামঙ্গলই প্রধান। এ-সব মঙ্গলকাব্য মূলতঃদেবনির্ভর ও সগোত্রীয় দেবতাদের পূজার প্রচলনকল্পে লিখিত হ'লেও একাব্যগুলোর মধ্যে তদানীন্তন বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের পারিবারিক,
সামাজিক ও দৈনন্দিন জীবনের এবং ক্ষেত্রবিশেষে রাষ্ট্রীয় জীবনের যে ছবিপাওয়া যায় বৈষ্ণব চরিতশাখা বাদে অন্য কোনো কাব্য-সাহিত্য শাখায় তারকণা-মাত্রও পাওয়া যায় না। সেজন্যে বাংলা সাহিত্য, বাংলাদেশের ইতিহাসও সমাজ বিজ্ঞানের ছাত্রদের নিকট মঙ্গলকাব্যগ্লির পঠনপাঠনের গুরুত্বঅপরিসীম।
মঙ্গলকাব্যের এবং মধ্যযুগেরও সর্বশেষ কবি ভারতচন্দ্র। তাঁর জীবনকাল ১৭১২–১৭৬০ খ্রীষ্টাব্দ। ভারতচন্দ্রের হাতে মঙ্গলকাব্য চরম উৎকর্ষলাভ করে। ১৭৫৭ খ্রীষ্টাব্দে পলাশীর যুদ্ধে বাংলাদেশের স্বাধীনতাসর্যঅস্তমিত হয়। পলাশীর যুদ্ধের পাঁচ বৎসর পূর্বে ভারতচন্দ্র অন্নদামঙ্গল'লিখে শেষ করেন এবং তার তিন বৎসর পর ১৭৬০ খৃীষ্টাব্দে তিনি মৃত্যু
মুখে পতিত হন। ১৭৬০ থেকে ১৮৬০ খৃষ্টাব্দ এই একশো বছর আধনিক বাংলা সাহিত্যের প্রস্তুতির কাল। সেজন্যে এ সময়ট,ককে ক্লান্তিকালওবলা হয়। এ সময়ে বাঙালীদের জ্ঞাত ও অজ্ঞাতসারে তাদের জীবনে ওসাহিত্যে পাশ্চাত্ত্য প্রভাব অনুপ্রবিষ্ট হতে থাকে। পাশ্চাত্য প্রভাব সমন্বিতপ্রথম সার্থক রচনা মাইকেল মধুসূদনের মেঘনাদবধকাব্য ১৮৬১ খ্রীষ্টাব্দেপ্রকাশিত হয়।সুতরাং বিদেশী প্রভাব মুক্ত বাংলাদেশের সর্বশেষ কবি ভারতচন্দ্র।
বিবর্তনের পথ ধ'রে মঙ্গলকাব্যের ধারা এবং বাংলা ভাষা তাঁর হাতে আশ্চর্যপরিণতি লাভ করে। তাঁর মতো শব্দ-কশলী ভাষাশিল্পী কবি শব্,ে মধ্যযাগে কেন, সমগ্র বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে দুলাভ। ভারতচন্দ্র সম্পর্কে
প্রমণ চৌধুরীর চিরস্মরণীয় একটি উদ্ভি:- Bharat Chandra, as
supreme literary craftsman, will ever remain a master to us
writers of the Bengali language.
তিনি কুফনগরের রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সভাকবি ছিলেন। সেকালের বুড়ি ও
পরিবেশ তাঁর কাব্যে যেমন অবলীলায় মূর্ত হয়ে উঠছে হেনান খাঁটি
বাংলা ভাষার সাবলীল শ্রী ও মর্যগণ তাঁরই হাতে প্রথমবারের মতো
সার্থক ভাবে ধরা পড়েছে। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় রাজসভাকবি ভারতচন্দ্রের
"অন্নদামঙ্গল গান রাজকন্ঠের মণিমালার মতো, যেমন তাহার উজ্জ্বলতা
তেমনি তাহার কার কার্য।।
চণ্ডী ও অন্নদা অভিন্ন—একই দেবী ঐ দাই নামে, এবং আরো অনেকনামে পরিচিত হয়ে থাকেন। সামান্য এট, তথ্য জানাথাকলেই একটাস্বাভাবিক প্রশ্ন মনে উদিত না হয়ে পারে না যে, মঙ্গলকাব্যের একই শাখারঅন্তর্গত হয়েও মুকুন্দরামের সঙ্গে ভারতচন্দ্রের কাহিনীগত এতো পার্থক্য
কেন? 'পদ্মপুরাণ' এবং 'মনসামঙ্গল'—এই উভয় নামে প্রচলিত হয়েও মনসামঙ্গলের কাহিনী সর্বত্রই একই মতো থেকে গেছে। অতএবচণ্ডী ও অম্লদাএই নাম-পার্থক্য তাঁদের কাহিনগিত পার্থক্যের কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণমুসলমানদের এদেশে আগমনের পূর্বে, লক্ষ করি, মানুষের কথাও যেলিখে রাখা যায়- এই বিশ্বাস এদেশবাসীর মনে মারাত্মকভাবে অনুপস্হিতছিল। এদেশে দেবতাদের কাহিনী লিখে রাখার রেওয়াজ ছিল, রচিত হয়েছিল তাই অসংখ্য পরাণ। মুসলমানেরা এসে মানুষের কথাও লিখে রাখতেলাগলেন—এদেশের ইতিহাস গড়ে উঠতে লাগল, সাহিত্যেও স্হান পেতেলাগল মানুষে। এই পরিবর্তন এ দেশের দেবনির্ভর সমাজে খুব সামান্যব্যাপার ছিল না। তব্ব, এ পরিবর্তনকে তাঁরা অস্বীকার করতেও পারেননি।
দেবভাষা পরিত্যাগ করে মানুষের মুখের ভাষাকেই শব্দে, স্বীকার করলেননা তাঁরা তাঁদের রচনার ব্রুম-বর্ধমান মানব-প্রাধান্য ও লক্ষ করা যেতে লাগল।মঙ্গলকাব্য দেব-দেবীর মাহাত্ম্যপ্রচার-মূলেক কাব্য হয়েও সেখানে মতজীবনের সংখ-দুঃখের ছবি ফুটে উঠতে লাগল বেশী পরিমাণে। এই ভাবেই
শেষ পর্যন্ত ভারতচাদে এসে লক্ষ করব, চীমালের কাল্পনিক নায়ক
নায়িকাতে তিনি আর তুষ্ট হচ্ছেন না-দেবী-মাহাত্ম্য প্রচারের উদ্দেশ্যটকই
শব্দে অথম রেখে কাহিনীকে আমূল পরিবর্তিত ক'রে নিচ্ছেন তিনি।
কাল্পনিক নায়ক-নায়িকা পরিত্যাগ ক'রে ভবানন্দের মতো একজন ইতিহাসে
উল্লেখিত ব্যক্তিকে নায়কের স্হানে বসিয়ে, জাহাঙ্গীর মানসিংহ প্রতাপআদিত্য প্রভৃতি ঐতিহাসিক চরিত্র আমদানি করে সামগ্রিকভাবে মধ্যযুগীয়বাবধারাতেই ভারতচন্দ্র একটি তুলনা-রহিত পরিবর্তন নিয়ে এলেন।ভারতচন্দ্রের এই অসাধারণত্ব মনে রেখেই আমরা এই গ্রন্হ-সম্পাদনায় প্রবৃত্তহয়েছি।
কাব্যের নায়ক ভবানন্দ মজুন্দারের জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি অংশটক,পৃথক করে নিয়ে সম্পাদনা করা গেল। প্রথম দিকের বিভিন্ন দেবদেবীবন্দনা ও পৌরাণিক হর-গৌরী উপাখ্যান এবং মাঝখানের বিদ্যাসন্দরকাহিনী বর্জিত হয়েছে। দেবদেবী-বন্দনা ও হরগৌরী উপাখ্যান প্রত্যেকমঙ্গলকাব্যের সাধারণ বর্ণনীয় বিষয়। কিন্তু বিদ্যাসন্দের উপাখ্যান মঙ্গলকাবা ধারায় একটি অভিনব আমদানি। ভারতচন্দ্রের পূর্বেই অবশ্য কালিকামঙ্গলের মধ্যে বিদ্যাসুন্দর কাহিনী স্হান পেয়েছিল। সেদিক থেকে ভারতচন্দ্রে অভিনবত্ব আরোপ করা যায় না তা সত্য।এখানে মনে রাখতে হবে,মূল কাহিনীর মধ্যে এমনি একটি স্বতন্ত্র স্বয়ংসম্পূর্ণ উপাখ্যান জুড়েদেওয়ার ব্যাপারটা ছিল বাংলা সাহিত্যে নতুন, যদিও ফারসী সাহিত্যে এবংপ্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্যে তা অপরিচিত ছিল না। মহাভারত,আলিফলায়লা ওয়া লায়লা প্রভৃতি গ্রন্থে এর উদাহরণ অজস্র ছড়িয়ে আছে।ভারতচন্দ্র ফারসী ও সংস্কৃত উভয় ভাষাতেই পণ্ডিত ছিলেন।সংক্ষেপে অন্নদামঙ্গলের আখ্যায়িকা এক্ষণে অনুধাবন করা যেতে পারে।প্রথমেই গণেশায় নমঃ নমঃ' ব'লে ভারতচন্দ্র তাঁর কাব্য শশূর, করেছেন, তারপর শিব, সংর্য, বিষ, লক্ষ্মী প্রভৃতি দেবদেবী-বন্দনা সমাপ্ত ক'রে গ্রহসূচনা' করেছেন। 'গ্রন্থসূচনা' অংশটি কাহিনীর অপরিহার্য অঙ্গ বিবেচনাকরে আমরা সংকলন-মধ্যে গ্রহণ করেছি। মধ্যযুগীয় কাব্যরীতি অনুসরণ করে ভারতচন্দ্র এখানে গ্রহ-রচনার মূলে দেবীর স্বপ্নাদেশ-কথা বর্ণনা
করেছেন, কিন্তু সেই সঙ্গে তৎকালীন রাষ্ট্রনৈতিক গোলযোগের বর্ণনাওএখানে পাওয়া যায়।
গ্রহসচেনার পর মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের সভা বর্ণনা। তারপর গাঁতারম্ভ।
সৃষ্টির প্রথম প্রকাশ-কালে দেবী অন্নপূর্ণা মহামায়া গর্ভধারণ ব্যতিরেকেইব্রহ্মা বিষ্ণু, শিব—এই তিনজনকে প্রসব করেন। তখন সমস্ত সৃষ্টিই জল
প্লাবিত ছিল। সেই জলে দুর্গন্ধ শব রূপে ভাসতে ভাসতে দেবী প্রথমেবির কাছে যান, তারপর ব্রহ্মার কাছে। এরা দু'জনেই পচা গন্ধে বিরক্তিপ্রকাশ করে সেই শবকে অবহেলা করেন। তখন দুর্গন্ধ শবরূপী দেবীধান শিবের কাছে। শিব মহাজ্ঞানী ছিলেন, তিনি সেই শবকে গ্রহণ করলেন।দেবী তখন শিবের পত্নীত্ব স্বীকার ক'রে দৃষ্টিতে মনোযোগ দিলেন। পরবর্তীজন্মে দেবী দক্ষের ঘরে সতী নাম নিয়ে জন্ম গ্রহণ করলে যথারীতি আবারশিবের সাথেই সভাঁর বিবাহ হ'ল। কিন্তু দক্ষ জামাতার প্রতি সন্তুষ্ট নন।তাই দক্ষ-আয়োজিত যজ্ঞে শিব নিমন্ত্রিত হলেন না। এতে শিব ক্রুদ্ধ হয়েসতীকেও বাপের বাড়ি যেতে নিষেধ করলেন। তখন দেবী তাঁর দশমহাবিদ্যা‘রূপ প্রকাশ ক'রে শিবকে স্তম্ভিত ক'রে দিলেন। এইভাবে স্বামীকে ভয়দেখিয়ে দেবী পিতৃগৃহে গমনের অনুমতি পেলেন। সেখানে সতী স্বামীনিন্দা শ্রবণমাত্র দেহত্যাগ করেন। তার ফলেই শত্রু হ’ল ক্রোধে উন্মত্ত শিবের
দক্ষযজ্ঞ নাশ ও রোদন। বেদনাবির শিব কিছুতেই সতীদেহ ছাড়বেন না।তখন বিষ্ণুচক্র দ্বারা সতীদেহ খণ্ডিত ক'রে একান্ন স্হানেছড়িয়ে দেওয়াহ'ল, সেই একান্ন স্হানে গ'ড়ে উঠল দেবীর একান্ন পাঁঠ। ভারতচন্দ্র এইএকান্ন পাঁঠের নাম ও বিবরণ দান করেছেন।
সতী পরজন্মে হিমালয়ের ঘরে জন্ম নিলে তাঁর নাম হ'ল পার্বতী। বয়সহ'লে পার্বতী শিবকেই স্বামীরূপে পেতে চাইলেন। কিন্তু শিব ধ্যানস্হছিলেন ব'লে কামদেবকে নিযুক্ত করা হ’ল শিবের ধ্যান ভঙ্গ করার কাজে। এর
পরেই যথারীতি মদনভস্ম ও রতিদেবীর বিলাপ বর্ণিত হয়েছে। তারপরশিব-পার্বতীর বিবাহ। বিবাহের পর হর-গৌরীর অভাব ও কলহপূর্ণেদাম্পত্য জীবনের সন্দীর্ঘ বর্ণনা।—এইভাবে কাহিনীমোটামুটিভাবে গতানুগতিক পুরাণ কথাকেই অনুসরণ ক'রে অগ্রসর হয়েছে। এর অংশেপূর্ববর্তী কবিদের সঙ্গে ভারতচন্দ্রের একটা মোটামটি সাধারণ ঐক্য লক্ষকরা যাবে। কিন্তু তার পরেই ভারতচন্দ্রের নিজস্বতা প্রকাশ পেতে শুরুকরেছে।
বিমোহিত হয়ে সেখানে নির্মাণের জন্য বিশ্বকর্মীকে আদেশ করলেন। আপূর্ণাদরীও নির্মিত হ'ল। তারপর সেখানে দেবগণ নিমস্থিত হলেন। সেখানে আগর্ণোমূর্তি দেখে দেবগণ মো করতে লাগলেন। শিব বললেন, আন্নপূর্ণার পরী ও প্রতিমা নির্মিত হয়েছে বটে, কিন্তু সেই প্রতিমায় দেবীর অধিষ্ঠান যদি না হয় তবে তো সকলি যথা। অতএব শিব তপস্যায় বসলেন, সেই সঙ্গে রপ্তাদি দেবগণও তপদপ মূব্দ করলেন। তাঁদের তপস্যায় তুষ্ট হয়ে তখন
"""অবতীর্ণ। অন্নপূর্ণা হইলা কাশীতে।
প্রতিমায় ভর করি লাগিলা হাসিতে।"""
প্রতিমাপ্রভাবে যত দেবঋষিগণ। ভূতলে পড়িলা সবে হয়ে অচেতন।
এইভাবে দেবীর কাশীতে অধিষ্ঠানের ফলে কাশীমাহাত্ম্য বৃদ্ধি পেয়েছে। পূর্ববর্তী কোন চণ্ডীমঙ্গলে এমনি কাশীমাহাত্মা লক্ষ করা যাবে না। দেবী চণ্ডা আর বাঙালীর নিজস্ব লৌকিক দেবী নন, এখন তিনি কাশীতে আপন অবস্হান সুদৃঢ় ক'রে নিয়ে সর্বভারতীয় হয়ে উঠতে চান।
এর পর ব্যাসদেব প্রসঙ্গ দেখতে পাই। ব্যাসদেব সকলকে শিবপঞ্জা নিষেধ ক'রে বেড়াচ্ছেন। তাঁর যুক্তি এই, নিরাকার ব্রহ্ম সত্ত, রজ, তম এই তিন গুণের তিন সাকার রূপ ধারণ করেন। এখন যদি তাঁকে কোনো সাকার রূপে পূজা করতেই হয় তবে তমগুণের আধার শিবকে পূজা করা কেন? তাঁর মতে—
""সত্তগুণে তত্তত্ত্বজ্ঞান করতলে মুক্তি। ""
অতএব হরি ভজ এইসার যুক্তি।ব্যাসদেবের কথা শুনে দেবতারা বললেনএই কথা কহ যদি কাশী মাঝে গিয়া। তবে সবে হরি ভজি হনেরে ছাড়িয়া।ব্যাসদেব তখন কাশী গিয়ে হরিনাম সংকীর্তন শুরু করলেন এবং শর করলেন শিবনিন্দা। শিব এতে রুদ্ধ হয়ে ব্যাসদেবের বাক্ ও চলৎশক্তি
বরণ করলেন। ব্যাসদেনের সঙ্কট দেখে সেখানে বিষ্ণু উপস্থিত হয়ে বলতেলাগলেন
"""যেই শিব সেই আমি যে আমি সে শিব।
শিবেরে করিলা নিন্দা কি আর বলিব |
শিবের প্রভাববলে আমি চক্রধারী।
শিবের প্রভাব হৈতে লক্ষ্মী মোর নারী ৷৷
শিবেরে যে নিন্দা করে আমি তারে রুষ্ট।
শিবেরে যে পড়ো করে আমি তারে তুষ্ট৷
মোর পূজা বিনা শিবপূজা নাহি হয়।
শিবপূজা না করিলে মোর পূজা নয় ॥""
এর ফলে বেদব্যাস শিবভক্ত হলেন। এবং বিষ্ণকে একেবারে পরিত্যাগ করলেন। তখন আবার শিব বললেন
"""মোর ভক্ত হয়ে যেবা নাহি মানে হরি।
আমি ত তাহার পূজা গ্রহণ না করি ।""
""হরি হর মোরা দাই অভেদ শরীর।
অভেদে যে জন ভজে সেই ভক্ত ধীর॥""
অর্থাৎ বিষ, ছেড়ে পরোপরি শিবভক্ত হয়েও ব্যাসদেব শিবকে খুশী
করতে পারলেন না। শিব কাশীতে ব্যাসের ভিক্ষা বারণ করে দিলেন। ভিক্ষানা পেয়ে ক্ষুধার্ত ব্যাস কাশীবাসীকে শাপ দিলে শিব হলেন আরো কুদ্ধ,কিন্তু অমদা শিবকে বেশি কিছু করতে দিলেন না, বরং অন্ন দান ক'রে বেদ
ব্যাগের ক্ষধা-ক্লান্তি দূর করলেন। তারপর শিবনিন্দার অপরাধে ব্যাসকেবের করে দেওয়া হ’ল কাশী থেকে। ব্যাস তখন কাশী ছাড়া হ'য়ে দ্বিতীয়কাশী নির্মাণের উদ্যোগ করতে লাগলেন। সে উদ্দেশ্যে গঙ্গা ও বিশ্বকর্মারসহায়তা প্রার্থনা করলেন, কিন্তু ব্যর্থ হলেন সহায়তালাভে। তখন তিনিব্রহ্মার সহায়তা আশা করে তপস্যারত হ'লেন। কিন্তু ব্রহ্মা ব্যাসকে দেখাদিয়ে জানিয়ে দিলেন যে, শিবকে লঙ্ঘন করে তিনি কোনো বর দান করতেপারবেন না। ব্রহ্মা স্পষ্টই ব'লে দিলেন--
"""আমি যে বিধাতা শিব আমারো বিধাতা।"""
এই ভাবেই ব্ৰহ্মা সহ সকল দেবতার উপর শিবের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত।হয়েছে। তারপর শিবের উপর প্রাধান্য লাভ করেছেন দেবী অন্নপূর্ণা। ব্যাসদেব শেষ পর্যন্ত অন্য উপায় না দেখে দেবী অন্নপূর্ণার আশ্রয় নিয়েছেন।অন্নপূর্ণা ব্যাসদেবের তপস্যায় চঞ্চল হয়ে জরতী বেশে তাঁর সম্মূখে
আবির্ভর্তে হলেন। জানতে চাইলেন, তাঁর এই দ্বিতীয় কাশীতে মরলেকি ফল লাভ হয়। পর পর সাতবার ব্যাসের কাছে গিয়ে একই কথা জানতেচাইলে ব্যাস ক্রুদ্ধ হয়ে বলে উঠলেন- এখানে মরলে সে গদাভ হয়। দেবীতৎক্ষণাৎ বমূর্তি ধারণ করে ব্যাসের উত্তি সত্য হবে-এই কথা বলেঅন্তর্ধান করলেন। পরে দৈববাণী যোগে ব্যাসকে দেবী জানিয়ে দিলেন
""ইতঃপর ভেদ বন্দর ছাড়হ সকল।
জ্ঞানের সন্ধান কর অজ্ঞানে কি ফল।
হরি হর বিধি তিন আমার শরীর।
অভেদ যে জন ভজে সেই ভক্ত ধীর।"""
দেবীর আদেশে ব্যাসদেব তাঁর দ্বিতীয় কাশী নির্মাণের পরিকল্পনা
ত্যাগ করলেন। এই অংশে বৈষ্ণব, শৈব ও শাক্ত মতের সমন্বয়-প্রয়াসও
সবিশেষ লক্ষণীয়।
এর পর এসেছে হরি হোড় কাহিনী। দেবী নরলোকে পূজা প্রকাশকরবার জন্য বন্দ্বেরকে শাপ দিয়ে মর্ত্যলোকে পাঠালেন। বিষ্ণু হোড়ের ঘরেহরি হোড় নাম নিয়ে বসন্ধের জন্মগ্রহণ করলেন। হরি হোড়ের বাপ-মা ছিলঅত্যন্ত দরিদ্র, মাঠে-বনে কাঠ ঘাটে প্রভৃতি কুড়িয়ে তারি বিক্রয়-লঞ্চ অর্থেসে বাপ-মায়ের ভরণ-পোষণ চালাতে থাকে। শেষে দেবীর কৃপায় এই হরিহোড় একদিন প্রচুর ধন-রত্নের মালিক হয়ে ওঠে এবং নিয়মিত দেবীপূজাকরতে থাকে। এই সময় বসন্ধেরের স্ত্রী বসন্ধেরাও সোহাগী নাম নিয়ে
ঝড়, দত্তের কন্যারূপে জন্মগ্রহণ করে। ঝড়, দত্ত হচ্ছে সুবিখ্যাত ভাঁড়,দত্তের বংশধর। সোহাগীর সাথে হরি হোড়ের বিয়ে হ'ল—অবশ্য ইতিপূর্বেআরো তিনবার বিয়ে হয়েছে হরি হোড়ের। সোহাগী এসে হরি হোড়েরসংসারে একটা তুমুল ঝগড়া-বিবাদের সূত্রপাত করলে সেই কলহের সংসারেদেবী আর তিষ্ঠাতে রাজি হলেন না। তখন নলকবেরকে শাপ দিয়ে ভবানন্দ
মজহুন্দার নামে মর্তে প্রেরণ করলেন। নলকবরের দুই শাঁও মর্তে জন্মনিলেন চন্দ্রমুখী ও পদ্মমূখী নাম নিয়ে। দেবী তখন হরি হোড়কে ছেড়েভবানন্দ মজুন্দারের ঘরে অধিষ্ঠিতা হলেন। এই ঘটনার কিছুকাল মধ্যেমানসিংহ এলেন বাংলায়। যশোহরের রাজা প্রতাপআদিত্য স্বাধীনভাবেরাজত্ব শুরু করলে তাঁকে দমন করার জন্যে দিল্লীর সম্রাট জাহাঙ্গীর মানসিংহকে প্রেরণ করলেন। এরই পরবর্তী কাহিনী হচ্ছে মানসিংহ-ভবানন্দ
মজুদার উপাখ্যান। মধ্যে অতি সংকৌশলে বিদ্যাসন্দর কাহিনী সন্নিবিষ্টহয়েছে। মানসিংহ বর্ধমানে উপস্হিত হয়ে সেখানে একটি সড়ঙ্গ দেখেডার ইতিবৃত্ত জানতে চাইলে ভবানন্দ মজুন্দার মানসিংহের নিকট বিদ্যাসুন্দর উপাখ্যান বিবৃত করেন।
কাব্যধারার ও বাংলাভাষার বিবর্তনের দিক থেকে ভারতচন্দ্রের পঠনপাঠন বাংলাভাষা ও সাহিত্যের ছাত্রছাত্রীদের পক্ষে অপরিহার্য। কিন্তু দঃখেরবিষয় নানা কারণে পূর্ব পাকিস্তানে ভারতচন্দ্রের কাব্য আজ দুষ্প্রাপ্য।সেজন্যে অন্নদামঙ্গল কাব্য থেকে আমাদের পাঠ্য তালিকাভুক্ত অংশটটুক,মানসিংহ-ভবানন্দ উপাখ্যান নামে সম্পাদন করে প্রকাশ করা গেল।
ভারতচন্দ্রের মানসিংহ----
ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গলের অন্তর্গত বিদ্যাসুন্দর কাব্যের প্রারম্ভেইআমরা রাজা প্রতাপাদিত্যের এইরূপ পরিচয় পাইয়া থাকি-যশোহর নগরে‘বগজ কায়স্হ' প্রতাপাদিত্য নামে এক রাজা ছিলেন। তিনি ছিলেন প্রবলপ্রতাপান্বিত : কেহ তাঁহাকে আটিয়া উঠিতে পারিত না, সকল ভূপতি ভয়েতাঁহার দ্বারস্থ হইয়া থাকিত এবং তিনিও ‘পাতশাহ’কে বড় বেশী মান্যকুরিতেন না। তাঁহার 'বায়ান্ন হাজার ঢালী', 'ষোড়শ হলকা' হাতী এবং‘অহৃত তরঙ্গ সাথী' ছিল। তাঁহার খলতাত পরাক্রান্ত বসন্ত রায়কে তিনিসবংশে নিহত করেন। বসন্ত রায়ের এক পুত্র কচ, রায় প্রতাপের রাণীর
কৃপায় কোনরুমে বাঁচিয়া গিয়া বাদশাহ জাহাঙ্গীরকে প্রতাপ-বৃত্তান্ত অবগতকরান। জাহাঙ্গীর ক্রোধান্বিত হইয়া তাঁহার বিখ্যাত সেনাপতি মানসিংহকেপ্রতাপ-দমনে পাঠাইলেন | মানসিংহও কচু, রায়ের সঙ্গে বর্ধমানে আসিয়াউপনীত হইলেন। ভবানন্দ মজুমদার নামক এক ব্যক্তি তখন বর্ধমানেরকানুনগো ছিলেন। তিনি মানসিংহের বর্ধমানে আগমন বৃত্তান্ত অবগত
হইয়া 'নানা দ্রব্য ডালা' লইয়া মানসিংহকে উপহার দিবার জন্য সেখানেউপস্হিত হইলেন। মানসিংহ বাংলার সমূহ বৃত্তান্ত মুজমদারের নিকট
জানিতে পারিলেন।
তাঁহার 'মানসিংহ' কাব্যে পাই—অতঃপর মানসিংহ বর্ধমান হইতে নবদ্বীপে আগমন করেন এবং সেখান হইতে বাগোয়ানে মজমদারের গৃহ দেখিবার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেন। মজুমদারও সাগ্রহে তাঁহাকে লইয়া আসেন।এমন সময়ে কয়েকদিন (৭ দিন) ধরিয়া ঝড়বৃষ্টি ইত্যাদি প্রাকৃতিকদুর্যোগে মানসিংহ তাঁহার সৈন্যসামন্ত লইয়া বিপদগ্রস্ত হইয়া পড়িলেভবানন্দ মহমদার তাঁহাকে রসদাদি দানে বিবিধ প্রকারে সাহায্য করেন।এখান হইতে অতঃপর তিনি তাঁহার সৈন্য-সামন্ত সমভিব্যাহারে প্রতাপ
দমনে যশোহর যাত্রা করেন। এই যাত্রার সময় ভবানন্দ মজুমদারই ছিলেনমানসিংহের প্রধান পথ-প্রদর্শক। কারণ আমরা দেখি:
“আগে পাছে দুই পাশে দু'সারি লম্বর
চলিলেন মানসিংহ যশোহর নগর"""
মন্দারে সঙ্গে নিলা ঘোড়া চড়াইয়া
কাছে আছে অশেষ বিশেষ জিজ্ঞাসিয়া।”
যশোহরে উপস্হিত হইয়া মানসিংহ প্রতাপের নিকট ‘বেড়ী ও তলওয়ার’ফরমান পাঠাইলেন। প্রতাপ বশ্যতা স্বীকারের প্রতীক বেড়ী প্রত্যাখ্যান
করিয়া যুদ্ধে সম্মতি জ্ঞাপনের চিহ্নস্বরূপে তরবারি গ্রহণ করিলেন এবংদত্তের সম্মূখেই মোগলের কর্মচারী রাজপতে মানসিংহকে তিরস্কার করিয়াছাড়িলেন। মানসিংহ ও প্রতাপে যুদ্ধ হইল। প্রতাপ যুদ্ধে পরাস্ত হইয়াপিঞ্জরাকথ হইলেন। মানসিংহ বসন্ত রায়ের পত্র কটা রায়কে যশোহর রাজ্য প্রদান করিয়া তাঁহাকে 'যশোরপতি' উপাধি দিয়া পিঞ্জরাবদ্ধ প্রতাপকে লইয়াদিল্লী অভিমুখে যাত্রা করিলেন। পথে প্রতাপাদিত্য অনাহারে মৃত্যুমুখে
পতিত হইলেন। মানসিংহ মৃত প্রতাপকে ঘতে ভাজিয়া লইয়া গিয়াজাহাংগ রিকে উপহার দিলেন।
প্রতাপ-দমনে ভবানন্দ মজুমদার মানসিংহকে বিবিধ প্রকারে সাহায্যকরায় পূর্ব প্রতিজ্ঞামত মানসিংহ জাহাঙ্গীরের নিকটে মজুমদারকে কিছু
জমি জায়গীর দিবার জন্য সপারিশ করেন। 'পাতশাহ’ জাহাঙ্গীর বিধর্মীভবানন্দকে জায়গাঁর দেওয়া ত দূরের কথা, তাঁহার ধর্ম ও দেবদেবীর প্রতি
রোধান্বিত হইয়া নানাপ্রকারে দেব নিন্দা করিলেন। ভবানন্দ মজুমদারওতাহার যথাযথ উত্তর দিলেন। পরে জাহাঙ্গীর মজুমদারকে কারাবদ্ধ করিলেন। কারাগারে মজুমদার দেবী অন্নদাকে স্তবে তুষ্ট করিয়া অভয় প্রাপ্ত
হইলেন। দিল্লীতে দেবীর ভূত-পিশাচ ইত্যাদির নানাবিধ উপদ্রব আরম্ভহইল। জাহাঙ্গীর দেবীর নিকটে নত হইলেন এবংমজুমদারের আদেশেঅন্নদার পূজা করিলেন। মজুমদার এইবারে জায়গীর ও বিবিধ উপঢৌকনসহ ফরমান পাইয়া স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করিলেন।
ভারতচন্দ্রের প্রদত্ত উপরিউক্ত বিবরণে ঐতিহাসিক সত্য কতটটুক, রক্ষিত
•হইয়াছে বা আদৌ কোন ঐতিহাসিক সত্য আছে কিনা আমরা এক্ষণে তাহারআলোচনা করিতেছি।
সতীশচন্দ্র মিত্র বিরচিত যশোহর ও খুলনার ইতিহাসে' ভারতচন্দ্র প্রদত্ত‘বাজ কায়হ’ প্রতাপের এইরূপ পরিচয় পাই—আদিশূরের সময়ে আগতপলুকায়হের মধ্যে বিরাটগহ একজন। তাঁহার অধস্তন নবমপর্যায়স্হ অশ্ব
গতি বা আশগুহ বঙ্গ কায়স্হগণের এক বাঁর পুরুষ। আশগুহের একপৌত্রের নাম রাম রামচন্দ্রের ভিন্ন প্রদত্ত হইয়াছিল—ভবানন্দ, গুণানন্দ ওশিবানর। ভবানন্দের পত্র শ্রীহরি সম্ভবতঃ গৌড়েশ্বর বাহাদুর শাহের
রাজত্বকালে বিক্রমাদিতা' উপাধি লাভ করেন। এই সময়ে তাঁহাদের পরিবার
বর্গ গৌড়ে আনতি হয়। আনুমানিক ১৫৬০ খ্রীষ্টাব্দে বা তাহার কিছু
পরে শ্রীহরির এক পত্রে হয়। এই পত্রই ইতিহাস বিখ্যাত প্রতাপাদিতা নাম
গ্রহণ করিয়াছিলেন। প্রতাপ যে বঙ্গীয় কাজহ কলোডের সেই ঐতিহাসিক
সত্যটুকু ভারতচন্দ্র অক্ষুন্ন রাখিয়াছেন।
ভারতচন্দ্র ভবানন্দ মজুমদারের এইরূপে পরিচয় দিয়াছে—কবরের সূত্র
নলকুবের দেবী অন্নপূর্ণার শাপে স্বর্গভ্রষ্ট হইয়া বাগোয়ান পরগণান্তগতিআদুলিয়া গ্রাম নিবাসী। শ্রোতীয় কেশরী গাই রাষ্ট্রীয় ব্রাহ্মণ রাম সমাদ্দারের
পুত্ররূপে জন্মগ্রহণ করেন। ইতিহাসে ভবানন্দ মজুমদারের এইরূপ পরিচয়পাই—শাণ্ডিলা গোত্রীয় ভট্রনারায়ণের অষ্টাদশ পুরুষ কাশীনাথ নদীয়ারঅনন্তর্গত কাকদী পরগণার জমিদার ছিলেন। বাগোয়ানের অন্তর্গত আন্দুল
বাড়িয়ায় তাঁহার নিবাস ছিল। কাশীনাথের পুত্র রামচন্দ্র দৈবক্রমে অপপুত্রক
হরেকৃষ সমাদার নামক এক ব্যক্তির উত্তরাধিকারী হন। সমাদরের উত্ত
রাধিকারী বলিয়া লোকে তাঁহাকে রাম সমান্দার বলিয়া ডাকিত। রামসমান্দারের পুত্র দুর্গাদাস পরে ভবানন্দ নামে অভিহিত হন এবং হুগলীরকানুনগো দপ্তরের মহরিপদ হইতে (১৬১৩ খ্রীষ্টাব্দে কান্নগো পদে উন্নতি হন। তখন তাঁহার উপাধি হয় মজুমদার। এই ভবানন্দ মজুমদারই কৃষ্ণনগর রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা
প্রত্যেক মঙ্গলকাব্যের নায়কই স্বর্গভ্রষ্ট হইয়া বিশিষ্ট কোন দেবদেবীরপূজা উপচারের জন্য মর্তলোকে জন্মগ্রহণ করে। মঙ্গলকাব্যের বৈচিত্র্যহীনগতানুগতিকতার মধ্যে এই বৈশিষ্ট্যটুকই আমরা লক্ষ করিয়া থাকি।সুতরাং ভারতচন্দ্রের কাল্পনিক ও গতানুগতিক অংশটুক, বাদ দিলে ভবানন্দ মজুমদারের জন্মবত্তান্তের পরবর্তী অংশটুকুরে ঐতিহাসিক সত্য
অক্ষুণ্ণ রহিয়াছে দেখিতে পাই।
বঙ্গের বার ভাইয়াদের অন্যতম এই প্রতাপকে লইয়া নানাবিধ উপন্যাসও কাল্পনিক গল্প সৃষ্টি হইয়াছে। রামরাম বসরে প্রতাপাদিত্য চরিত্রেভাতরচন্দ্রের অন্নদা মঙ্গলে, ঐতিহাসিক
নিখিলনাথ রায়ের 'প্রতাপাদিত্য'নামক জ্ঞাতবাতথ্যে এবং সতীশচন্দ্র মিত্রের যশোহর ও খুলনার ইতিহাসেপ্রতাপাদিত্য সম্বন্ধে ঐতিহাসিক সত্যের যথেষ্ট অভিরঞ্জন দেখা যায়।
কাতল, খাঁ এবং পরবর্তীকালে তাঁহার স্হলবর্তী সুলেমান, ওসমানপ্রমুখের সহিত মোগল সেনাপতিগণের যুগ্ম-কাহিনীর বিস্তৃত বিবরণ'আকবর নামা', 'ইকবাল নামা-ই জাহাঙ্গির বদায়নীর মুরাবাহভাওয়ারিখ, মির্জানাখনের বাহার-ই-স্তান’ ও ‘মাখজান-ই-আফগান' ইত্যাদিপম্ভকে সংকলিত রহিয়াছে। 'আকবর-নামা'ই সম্রাট আকবরের রাজত্বের এক
মাত্র বিশ্বাসযোগ্য ইতিহাস। আকবর নামা'তে এই সকল স্বন্দের সংক্ষ্যোতিসক্ষ্যে বিবরণও পাওয়া যায়। শব্দে আফগানগণের সহিত নহে, ঈশা খাঁমসনদ-ই আলি এবং বিক্রমপুরের কেদার রায়ের সহিত মোগলের বন্দেরও
সবিস্তৃত বিবরণ আকবর নামা' এবং উপরিউক্ত পতকগুলিতে লিপিবন্ধ
রহিয়াছে। অথচ এই গুলির একখানাতেও যশোহর রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হইবার
পরে শ্রীহরি (বিক্রমাদিত্য) বা তাঁহার পরে প্রতাপাদিত্যের সহিত সংঘর্ষের
কোন উল্লেখ নাই।
১৫৭৬ খ্রীষ্টাব্দে যশোহর রাজ্যের সূচনা হয়। একমাত্র প্রামাণিক ও
বিবরণবহল ইতিহাস ‘আকবর নামা’তে যখন অন্যান্যবিদ্রোহিগণের সঙ্গেযোগলের সংঘর্ষের উল্লেখ আছে অথচ প্রতাপাদিত্য বা তাঁহার পিতৃপুরুষেরকাহারও সঙ্গে কোন প্রকার সংঘর্ষের উল্লেখ নাই তখন আমরা অনুমানকরিতে পারি যে, গৌড়ের পতনশীল পাঠানরাজের ও পাঠান ওমরাহ্ গণেরগচ্ছিত ধনসম্পত্তির পৃষ্ঠপোষকতায় যশোহর রাজ্যের উৎপত্তি হইয়াছিলএবং মোগলদিগের আন্কলোই তাহার রক্ষা হইয়াছিল। ইতিহাস আলোচনা
করিলে এই অনুমানের কারণও যথেষ্ট পাওয়া যায়।
মানসিংহ (১৫৯৪ ষ্টাব্দে ৫ই মে বাংলার সংবাদার হইয়া আসেন।
১৫৯৯ মাস্টাব্দের শেষভাগে তিনি আজমীর চলিয়া যান। এই সময়েবাংলাদেশে মোগল প্রভুত্ব প্রায় লোপ পায়। ১৬০১ খ্রীষ্টাব্দে পুনরায়তিনি বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করেন এবং আফগান ও ভৌমিক দমনে আত্য
নিয়োগ করেন। এইবারের অভিযানে কেদার রায়ের পতন হয়। ১৬০৪খ্রীস্টাব্দের মাঝামাঝি মানসিংহ আগাতে প্রহান করেন। ঘটনাবহুল১৫৯৪–১৬০৪ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে কোন মুসলমান লেখকের ইতিহাসে
মানসিংহ ও প্রতাপের সংঘর্ষের কোন উল্লেখই পাওয়া যায় না। 'আকবরনামা'র কথা না হয় না-ই বলিলাম।
সম্রাট আকবরের মৃত্যু হয় ১৬০৫ খৃষ্টাব্দে। তাঁহার মৃত্যুর পরজাহাঙ্গীর দিল্লীর সম্রাট হন। প্রধান সেনাপতি মানসিংহকে জাহাঙ্গীরকৃতকগুলি কারণে পুনরায় বাংলার সংবাদার করিয়া পাঠান। মানসিংহ এইদ্বিতীয়বারের সবোদারীতে ১৬০৫–১৬০৬ খৃষ্টাব্দের মধ্যে মাত্র আটমাসকাল বাংলা দেশে ছিলেন। অনেকে মনে করিয়াছেন প্রতাপের সঙ্গেমানসিংহের এই সময়েই যুদ্ধ হইয়াছিল। জাহাংগীরের রাজত্বের বিস্তৃত
বিবরণ 'ইকবাল নামা-ইলাহা ও তুই জাহাঙ্গিরী ইত্যাদি
পত্তকে লিপিবদ্ধ আছে, কিন্তু এখানেও মানসিংহ-প্রতাপের কোন সংঘর্ষের
উল্লেখ নাই।
মির্জানাখনের 'বাহার-ই-স্তানেই প্রতাপের পতনের যথেষ্ট বিবরণপাওয়া যায়। (১৬৮) খাস্টাব্দে জাহাঙ্গীরের রাজত্বের প্রধান উদ্যোগীইসলাম খাঁ বাংলায় আসেন। ১৬১১ খ্রীষ্টাব্দের শেষভাগে ইসলাম আরসঙ্গে ময়মনসিংহ জেলার বোকাই নগর কেল্লায় যুদ্ধে পরাস্ত হইয়া ওসমান
শ্রহিটে পলাইয়া যান। এই যুদ্ধে প্রতাপ ইসলাম থাঁকে কোন প্রকারে সাহায্যকরেন নাই। এইজনা প্রতাপের বিরুদ্ধে ইসলাম খাঁর অভিযান আরম্ভ হয়।১৬১২ খ্রীষ্টাব্দে ইসলাম খাঁর সেনাপতি কর্তৃক যুদ্ধে পরাজিত হইয়া
প্রতাপাদিত্য নিহত হন। সতীশ মিয়ের যশোহর ও খুলনার ইতিহাসেপাওয়া যায় প্রতাপাদিত্য ইসলাম খাঁর সেনাপতিগণের হাতে যুদ্ধে পরাস্তহুইয়া ইসলাম খাঁর সহিত সন্ধি করিবার জন্য এনায়েত থাঁকে সঙ্গে লইয়াঢাকা আসেন। সেখানে সবাদার ইসলাম খাঁ প্রতাপকে হাতেপাইয়া শৃঙ্খলা
বুদ্ধ করিয়া জাহাঙ্গীরের নিকটে দিল্লী প্রেরণ করেন; পথিমধ্যে প্রতাপেরমৃত্যু হয়।
অনেকে মনে করিতে পারেন ‘তুজক-ই-জাহাগিরী' ইত্যাদি পুস্তকেমানসিংহ-প্রতাপের সংঘর্ষের কোন কথার যেমন উল্লেখ নাই, ইসলাম খাঁ ওপ্রতাপাদিত্যের সংঘর্ষেরও তেমন কোন বিবরণ নাই অথচ, সেখানে ওসমানের
সহিত ইসলাম খাঁর যুদ্ধের কথা উল্লিখিত হইয়াছে। সুতরাং মানসিংহেরসহিত প্রতাপাদিত্যের যুদ্ধও হইয়া থাকিতে পারে। ডাক্তার শ্রীযুক্ত নলিনীকান্ত ভট্টশালী ইহার উত্তর দিয়াছেন,—“আসল কথা এই যে, জাহাঙ্গীরেররাজত্বের ১ম-২য় বৎসরে মানসিংহ যে আট-নয় মাস বাংলায় ছিলেন, সেকয়মাস তিনি কি করিয়াছিলেন, তাহার কোন বিশেষ বিবরণ পাওয়া যায়না। আর ১৬১২ খ্রীষ্টাব্দে বিশেষ আয়াস ছাড়াই এত কালের অনুগতপ্রতাপের যখন পতন হইল, সেই ঘটনা জাহাঙ্গীরআত্মজীবনীতে লিখিয়া
রাখিবার মত বড় ঘটনা বলিয়া মনে করেন নাই। আফগান দাবানলের শেষস্ফুলিঙ্গ ওসমানের দমন জাহাঙ্গীরের নিকট ঢের বেশী বড় ঘটনা বলিয়া
প্রতিভাত হইয়াছিল।"ইহা কেমন টূক্তি ভাল বোধগম্য হইতেছে না। 'আকবর-নামায়' মানসিংহের সহিত ও অন্যান্য যোগল সেনাপতিগণের সহিত 'চনোপ' টীটিরপর্যন্ত যুদ্ধের উল্লেখ আছে, অথচ তাঁহার পত্র সম্রাট জাহাঙ্গীর প্রতাপাএকজন প্রতাপশালী ভাইয়ার পরাজয়কে (বিশেষতঃ তাঁহারপ্রধান সেনাপতি মানসিংহের হাতে নিজের জীবন-চরিতে লিখিয়া রাখিলেন না ইহাই আশ্চর্য বোধ হইতেছে। অতএব ধরা যাইতে পারে, মানসিংহের হাতে প্রতাপের পতন হয় নাই।সতীশ মিত্রের যশোহর ও খলনার ইতিহাসে দেখা যায় মানসিংহ
১৫৮৯ হইতে ১৬০৪ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত বাংলার সুবাদার ছিলেন। তাঁহারসবেদারীর শেষ বছর অর্থাৎ Stog) ষ্টীষ্টাব্দে তাঁহার সহিত প্রতাপেরযুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধে প্রতাপ পরাজিত হন এবং মানসিংহের সঙ্গে তাঁহারসম্পি হয়।
আবদুল লতিফের ভ্রমণ কাহিনীতে এবং মির্জানাথনের 'বাহার-ই-স্তানে'যেখানে প্রতাপাদিত্যের পতন-প্রসঙ্গ আছে, সেখানে এমন কোন কথা নাইযে, প্রতাপ পূর্বে একবার বিদ্রোহী হইয়াছিলেন এবং পূর্বে তাঁহাকে একবার
দমন করা আবশাক হইয়াছিল। সতীশ বাব, কোথা হইতে তাঁহার প্রদত্ত এইবিবরণ পাইলেন আমরা জানি না।।
তাহা হইলে দেখা যাইতেছে, মানসিংহের সহিত প্রতাপাদিত্যের কোনযন্ধই হয় নাই, আর যদি বা হইয়াই থাকে, তবে এ কথা নিশ্চিত যে,তাঁহার হাতে প্রতাপ পরাজিত হইয়া পিঞ্জরাবন্ধ হন নাই এবং তাঁহার দেহহতে ভাঙ্গিয়া লইয়া সম্রাট জাহাষ্পীরের নিকট উপঢৌকনও দেওয়া হয় নাই।প্রতাপ পরাজিত হইয়া মৃত্যুমুখে পতিত হইয়াছিলেন ইসলাম যাঁর সেনাপ্রতিমাণের হাতে। প্রতাপের এই পতন ও মৃত্যু ভারতচন্দ্রের কবি-কল্পনায়রূপান্তরিত হইয়া মানসিংহের হাতে তাঁহার পতন ও তাঁহার শবদেহ যতেভাল ইত্যাদি অবস্হায় বর্ণিত হইয়াছে। ইহাতে কোন ঐতিহাসিক সত্য
নাই।
প্রতাপ দুর্ধর্ষ জমিদার ছিলেন, তাহা ইতিহাসেও যেমন পাই, ভারতচন্দ্রেও তেমনি পাই। তিনি তাঁহার স্নেহপরায়ণ পিতৃবা বসন্ত রায়কে
(জানকীবলভ) হত্যা করিয়াছিলেন এবং নিজেকে প্রবল প্রতাপান্বিতভাবিয়া মোগলের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করিয়াছিলেন, ভারতচন্দ্রের এই
বর্ণনার সমর্থন ইতিহাসে রহিয়াছে।কৃষ্ণনগর রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা ভবানন্দ মহমদার বাল্যকাল হইতে
যশোহর রাজপরিবারে সুপরিচিত ছিলেন। সম্ভবতঃ বসন্ত রায়ের হত্যা:সম্পর্কিত ব্যাপারে প্রতাপের সহিত তাঁহার মনোমালিন্য হইয়া থাকিতে পারেএবং সেইজন্যই ন্যায়পরায়ণ ভবানন্দ বসতে রায়ের পর কচ, রায় (রাঘব,
রায়) -এর সহায়তায় মানসিংহকে প্রতাপের বিরুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করিয়া থাকিতে
পারেন, এই ছগিত আমরা সতীশ মিত্রের ইতিহাসে পাই। আমরা পূর্বেইবলিয়াছি সতীশ মিত্রের প্রকল্পিত মানসিংহের সহিত প্রতাপের যুসব্বির তেমন কোন নির্ভরযোগ্য প্রমাণ নাই। অতএবপ্রতাপের বিরুদ্ধে
মানসিংহকে ভবানন্দ মজুমদারের এই সর্ববিধ সহায়তা ও প্রতাপের পতনেবি গিয়া বাদশা জাহাংগীরের সহিত ধর্মসংক্রাতে ঝগড়ায় লিত হওয়া
এবং বাদশার দ্বারা শেষে দেবী অ্যাপর্ণোর পূজা করাইয়া লওয়া সম্পর্ণেত
ভারতচন্দ্রের কাল্পনিক সৃষ্টি।
ভারতচন্দ্রের জীবনী হইতে আমরা জানি, তিনি ফারসীতে পণ্ডিত
ছিলেন। আরবী-ফারসী মিশ্রিত বাংলা ভাষায় তাঁহার অদ্ভুত
দেখাইবার জন্যই বোধ হয় তিনি জাহাংগীর বাদশাহ ও ভবানন্দ মজুমদারের মুখে ঘাবনী মিশাল"। বাংলা ভাষার অবতারণা করিয়াছিলেন। এ বিষয়েওযে তাঁহার থবে বেশী নতনত্ব আছে তাহা বলা যায় না কারণ তাঁহার বহুপূর্বে কৃষ্ণদাস কবিরাজের চৈতন্য চরিতামৃতে'ও আমরা আরবী-ফারসী
'মিশাল' বাংলা ভাষা দেখিয়া থাকি। অবশ্য এ প্রসঙ্গ এখানে ওঠে না।ভারতচন্দ্র তাঁহার কোন উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য ঝগড়ার অবতারণা করিয়াছিলেন আমরা জানি না, কিন্তু এ কথা আমরা জানি উহা কাব্য সৃষ্টির প্রের
গাতেই বটে; উহাতে ইতিহাসের কোন সত্য নাই। তবে ঝড়-বৃষ্টি ইত্যাদিদৈবদ, বিপাকে ভবানন্দ মজুমদার হয়ত কোন প্রকারে মানসিংহকে সাহায্যকরিয়া থাকিতে পারেন। যাহার ফলে মানসিংহ সাম্প্রসন্ন হইয়া দিল্লী-সম্রাটজাহাঙ্গীরের নিকট হইতে ভবানন্দকে কিছু ভূমি জায়গীর লইয়া দিয়াকৃষ্ণনগর রাজবংশের পথ প্রশস্ত করিয়া দিয়াছিলেন।রবীন্দ্রনাথ ঐতিহাসিক উপন্যাসের আলোচনায় বলিয়াছেন,—“ইতিহাসের সংস্রব উপন্যাসে একটা বিশেষ রস সঞ্চার করে, ইতিহাসের সেই রসটাকার প্রতি ঔপন্যাসিকের লোভ, তাহার সত্যের প্রতি তাহার কোন খাতিরনাই। ...তাই বলিয়া রামচন্দ্রকে পামর এবং রাবণকে সারূপে চিহ্নিতকরিলে অপরাধ নাই? অপরাধ আছে। কিন্তু তাহা ইতিহাসের বিরুদ্ধেঅপরাধ নহে, কাব্যেরই বিরুদ্ধে অপরাধ। সর্বজনবিদিত সত্যকে একেবারেউল্টা করিয়া দাঁড় করাইলে রসভঙ্গ হয়, হঠাৎ পাঠকদের যেন মাথায় বাড়িপড়ে।ভারতচন্দ্র ঐতিহাসিক নহেন, তিনি কবি। সুতরাং ইতিহাসের শঙ্কসত্য তাঁহার কাব্যের উপজীব্য বলিয়া গ্রহণীয় হইতে পারে না, সে কথা মানি,কিন্তু তিনি, সর্বজনবিদিত কি-না বলিতে পারি না, তবে ইতিহানবিদিত
ইসলাম খাঁর হাতে প্রতাপের পরাজয় ও মৃত্যুকে মানসিংহের ঘাড়ে চাপাইয়াদিয়া শব্দে অনৈতিহাসিকতারই সৃষ্টি করেন নাই, অধিকন্তু মনে হয় তিনিযেন পতি-জনসমাজে তাঁহার কাব্যের রসভঙ্গই করিয়াছেন।
0 মন্তব্যসমূহ