((সাজাহান নাটক আলোচনা
shajahan natok
Dl ray সাজাহান নাটকের বিষয়বস্তু সাজাহান নাটকের চরিত্র ডি এল রায়ের ঐতিহাসিক নাটক সাজাহান নাটকের রচয়িতা নারী চরিত্র))
বিঃদ্র-বাংলা বিভাগের সকল পড়াশোনা পেতে ব্লগটিতে যুক্তথাকুন https://monoweredu13.blogspot.com/?m=1
দ্বিজেন্দ্রলালের সাজাহান ----ভূমিকা
সংস্কৃত আলংকারিকগণ নাটককে দৃশ্যকাব্য বলে অভিহিত করেছেন। তবে নটিক যে দৃশ্য ও শ্রব্যকাব্যের সমন্বয়ে রঙ্গমঞ্চের সাহায্যে গতিমান মানব জীবনের প্রতিচ্ছবি আমাদের সামনে মূর্ত করে তোলে সেটাই বড় কথা। Elizabeth Drew বলেন Drama is the creation and representation of life in terms of the রঙ্গমঞ্চ ভিন্ন নাটক অপরিস্ফুট। কুশীলবগণ অভিনয়ের নৈপুণ্যে নাটকের theatre কঙ্কালদেহে প্রাণ সঞ্চার করে থাকেন। অর্থাৎ নাটক রঙ্গমঞ্চে মঞ্চায়ন ব্যতীত তার মূল্য অধিক নয়।
থিয়েটারের উদ্ভব গ্রীক সভ্যতার স্বর্ণযুগে। আড়াই হাজার বছর পূর্বে গ্রীসের লৌকিক দেবতা ডিয়োনাইসাসের উৎসব থেকে থিয়েটারের শুরু ঠিক থিয়েটার নয়, থিয়েট্রিকাল বা নাট্যিক কর্মকাণ্ড আদিম সাম্যবাদী সমাজেও ছিল। মিসরিও সভ্যতায়ও ওসিরিসের জীবন বৃত্তান্ত নিয়ে নাটক হতো। রোমানরাও গ্রীসের অনুকরণে নাট্যচর্চা করেছিলেন। ভারতবর্ষে প্রাচীনকালে সংস্কৃত নাটক অভিনীত হত।
*বাংলা অন্যান্য নাটক এর আলোচনা জানতে এখানে ক্লিক করুন
পূর্বরঙ্গ বা মঙ্গলাচরণ, সভাপূজা, নাটকীয় বিষয় কথন এবং প্রস্তাবনার মাধ্যমে সংস্কৃত নাটক গড়ে উঠেছিল। সংস্কৃত নাটকে বিদ্বানপুরুষ সাধারণত সংস্কৃত, বিদুষী মহিলাগণ সৌরসেনী, রাজপুত্র ও শ্রেষ্ঠীগণ অর্ধমাগধী, বিদুষক প্রাচ্যা এবং ধূর্ত অবস্তিক ভাষা ব্যবহার করতো। নাটকের বিষয় বস্তু সংগৃহীত হত রামায়ণ, মহাভারত কিংবা প্রসিদ্ধ কোন কাহিনী থেকে। এ নাটকে পাত্রপাত্রী যেমন শ্রেণীভিত্তিক ভাষা ব্যবহা করতেন তেমনি নায়কও বিশেষ শ্রেণীভূক্ত থাকতেন। বিশেষ রস নির্ভর এসব নাটক জনপ্রিয়তা লাভ করতো অভিনয়গত কারণে।
**নুরজাহান নাটক আলোচনা জানতে এখানে ক্লিক করুন
নাটকে সাধারণত Unity of time, Unity of place, Unity of Action নীতি মেনে চলার প্রবণতা লক্ষ্যণীয়। অনেক সমালোচক মনে করেন সময় স্থান ও ঘটনার ঐক্যসাধন সনাতনপন্থীদের মতবাদ। Classical নাটক উপরোক্ত বিষয় তিনটির দাবি করে কিন্তু Romantic নাটক সে দাবিকে অগ্রাহ্য করে। তবে মনে রাখা আবশ্যক, প্রত্যেক নাট্যকারই Plot, Action সৃষ্টি করার জন্যে Charactereisation, Dramatics personac ও Dialogue এবং দরকার হলে Local Colour, Style এবং ব্যক্তিগত জীবনাদর্শন সম্পর্কে অবহিত করেন। নাটকে প্রারম্ভ, প্রবাহ, উৎকর্ষ, গ্রন্থিমোচন ও উপসংহার এই পাঁচটি অংক বিভাজন থাকে। প্রথম অঙ্কে আখ্যানভাগের সূচনা, দ্বিতীয় অঙ্কে তার জটিলতা সৃষ্টি, তৃতীয় অঙ্কে নাটকীয় ঘটনার ঘনীভূত অবস্থা বা চরম উৎকর্ষ, চতুর্থ অঙ্কে জটিলতা মুক্তি এবং পঞ্চমাঙ্কে সমাপ্তি বা উপসংহার। সংস্কৃত অলংকারশাস্ত্র নাটকে অপরিহার্য শর্ত হিসেবে মুখ,
প্রতিমুখ, গভ, বিমর্থ ও নির্বহণ—এই পাঁচ বিভাগের কথা বলেছে। বিষয়বস্তু এবং তার পরিণতি বিবেচনায় নাটককে নিম্মোক্ত ভাবে বিভক্ত করা হয়।
**বাংলা উপন্যাসের এবং নাটকের বুক রিভিউ আলোচনা জানতে এখানে ক্লিক করুন
যেমন—বিয়োগাত্মক নাটক বা Tragedy, মিলনাস্ত নাটক বা comedy এবং হস বা Farce. শ্রীশচন্দ্র বলেন- "আন্দ্বে পরাভূত বা অভিভূত মানব জীবনের করুণ কাহিনীকে সাধারণত Tragedy বলা হয়। সেক্সপীয়ারের ট্রাজেডিতে কোন খ্যাতিমান বিশিষ্ট ও উচ্চপদস্থ ব্যক্তির পতন দেখান হয়। এই জাতীয় নাটকে নায়কের ব্যক্তিগ দুর্বলতা বা সামান্য ভুল ভ্রান্তির জন্য জীবনে অনৰ্থ আসিয়া পড়ে, কখনো দৈব বা অদৃষ্ট, পীড়িত হইয়া তাহাকে কালগ্রাসে পতিত হইতে হয়। নাট্যকার বিশেষ গরুগল্পীর বাণীভঙ্গিতে নায়কের জীবনের নিদারুণ বেদনাকে রূপদান করেন। নায়ক গভীর অন্তর্থস্থ ও বহির্দ্বন্দু দ্বারা ক্ষত বিক্ষত হইতে থাকে, একদিকে তাহার আপনার সঙ্গে আপনার দ্বন্দ (Internal conflict), অপরদিকে বাহিরের ঘটনাপুঞ্জের সহিত তাঁহার দ্বন্দ্ব (external conflict) । এই দ্বিবিধ দ্বন্দ্ব মূলত একই দ্বন্দুের দুইটি দিক। চারিত্রিক ব্যক্তি-স্বাধীনতা (Freedom within) ও আত্ম নিরপেক্ষ নিয়তি-লীলার (Necessity without) দ্বন্দ্ব যুদ্ধে বার বার পরাজিত হইয়াও যে শুধু will to power এ অনুপ্রাণিত হইয়া নায়ক আত্ম প্রতিষ্ঠা করিতে চায়, তাহাই তাহাকে নায়ক সুলভ বৃহৎ মর্যাদা দান করে।” একথাকে কবি সমালোচক মোহিতলাল মজুমদার বলেছেন চমৎকার করে। তিনি বলেন
“দেবতা-দোসর বীর, তারি পরাজয় কথা
লে হৃদয় সাগর মন্থন, নীলাকাশে ঊষাসসম গরলে অমৃত রাগ
মৃত্যুজয়ী জীবন কাহিনী ।"
**চর্যাপদ এর নানা প্রশ্ন উওর জানতে এখানে ক্লিক করুন
সেক্সপীয়ার ট্রাজেডিতে চরিত্রকে প্রাধান্য দিয়েছেন আর Aristotle আখ্যান বস্তু বা Plot কে প্রাধান্য দিয়েছেন। Aristotle এর মতে "Tragedy is an imitation of an action that is serious complete and of a certain magnitude; in Language embellished with each kind of artistic ornament, the Several kinds being found in separate parts of the play, in the form of action, not of narrative, through pity and fear effecting the proper purgation of there emotion." তিনি আরো বলেন, সৎচরিত্রের অধিকারী নায়কের জীবনে ভুলভ্রান্তির বশে ও নিয়তি পীড়িত কারণে ট্রাজেডি নেমে আসতে পারে। বলা যায় আখ্যান বস্তুই গ্রীক ট্রাজেডির কারণ আর সেক্সপীয়ার বলেন চরিত্রই ট্রাজেডি ঘনিয়ে আনে। মনে রাখতে হবে ট্রাজেডিতে মৃত্যুই একমাত্র বিষয় নয়।
নায়ক অপরদিকে কমেডি হচ্ছে, জীবনের লঘু দিকটার আনন্দোচ্ছল রূপায়ণ নায়িকার মিলন মাধুর্য। আর সমাজের কু-কীর্তি শোধন কল্পে রহস্যজনক ঘটনার সমাবেশে, হাস্য রসের মাধ্যমে যদি একাঙ্ক নাটক হয় তবে তাকে প্রহসন বলা যায়।
**বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস জানতে এখানে ক্লিক করুন
মধুসুদনকে কেউ কেউ The type of drama stuffed with low humour and extravagant wit' বলে মন্তব্য করেছেন। সংস্কৃত আলংকারিকরা বলেন নাটকের শ্রেণী বিভাজন নিয়ে মতভেদ আছে বহুপূর্ব থেকেই। তবে কমেডি বা ট্র্যাজেডির মত পরিণতি বিবেচনা করে গত দিক থেকে নিম্মোক্ত শ্রেণীতে বিভক্ত করা যেতে পারে। কাব্যধর্মী, সামাজিক, চক্রান্তমূলক, কল্পনাত্মক, ভাবপ্রবণ,
অদ্ভুতাত্মক, বিদ্রুপাত্মক, ভাবপ্রধান, ঐতিহাসিক পৌরাণিক, গীতিনাট্য, নৃত্যনাট্য,চরিত নাটক, উপন্যাস নাটক, অতিনাটক, সাঙ্কেতিক নাটক, সমস্যামূলক নাটক)
ইত্যাদি ভাগে নাটককে বিভক্ত করে রচিত হচ্ছে।
(4) গদ্য সাহিত্য, সাহিত্যিক মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হবার পর নাটক রচিত হতে থাকে। বাংলা নাটক যাত্রার বিবর্তনে সৃষ্টি কিংবা সংস্কৃত নাটকের অনুকরণে জাত এমনটি মনে করার কারণ নেই। বাংলা নাটকের সূচনা হয় ১৭৯৫ খ্রীষ্টাব্দে রুশ যুবক হেরাসিম লেবেডফের মাধ্যমে। তিনি কলকাতায় 'বেঙ্গল থিয়েটার' নামে একটি মঞ্চ স্থাপন করে, সেখানে 'The Disguise' এবং 'Love is the best Doctor' মঞ্চস্থ করেন। এ দুই নাটকের তিনি ভাষান্তর করেন ও এদেশীয় পাত্রপাত্রী দিয়ে অভিনয় করান। ইংরেজি নাটকের রস আহাদন করে এ দেশের শিক্ষিত জনেরা নাটকের অনুপ্রেরণা লাভ করেন। এর ফলশ্রুতিতে ১৮৩১ খ্রীষ্টাব্দে প্রসন্নকুমার ঠাকুর কলকাতায় হিন্দু থিয়েটার' নামক রঙ্গালয় তৈরি করে, ভারতচন্দ্র রায় গুণাকরের অন্নদামঙ্গল কাব্যের বিদ্যাসুন্দর অংশের নাট্যরূপ উপস্থাপন করেন। সমালোচকবৃন্দ মনে করেন প্রকৃত পক্ষে এখান থেকেই বাংলা নাটকের সূচনা। ১৮৭২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় পাবলিক থিয়েটার। এই পাবলিক থিয়েটার প্রতিষ্ঠিত হবার পর বাংলা নাট্যাভিনয়ের শখের পর্বের অবসান ঘটে।
বাংলা মৌলিক নাটকের সূত্রপাত হয় ১৮৫২ সালে যোগেন্দ্র চন্দ্রগুপ্ত রচিত “কীর্তিবিলাস’ এবং তারাচরণ শিকদারের 'ভদ্রার্জুন' প্রকাশিত হয় এই বছর। এই বছর প্রকাশিত অনুবাদ নাটক হরচন্দ্র ঘোষের 'ভানুমতী চিত্তবিলাস' (মার্চেন্ট অব ভেনিস; সেক্সপীয়ার)। 'কীর্তিবিলাস' নাটকে বিয়োগাত্মক পরিণতির সচেতন প্রয়াস লক্ষ্য করা যায় এবং ভদ্রার্জুনে মিলনাত্মক পরিণতি সৃষ্টি করা হয়। এসময়ও বাংলা নাটকের অস্থিরতা বিদ্যমান ছিল। অস্থিরতা কাটিয়ে ওঠে রামনারায়ণ তর্করত্নের হাতে। সামাজিক নাটক রচনায় তিনি সমধিক খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। ১৮৫৪ সালে তর্করত্ন মহাশয় রচনা করেন মঞ্চসফল নাটক 'কুলীনকুলসর্বস্ব।' তাঁর অনূদিত নাটক সমূহ হচ্ছে বেণীসংহার (১৮৫৬), রক্মাবলী (১৮৫৮) অভিজ্ঞান শকুন্তলা (১৮৬০), মালতীমাধব (১৮৬৭), পৌরাণিক নাটক হচ্ছে রুক্মিণীহরণ (১৮৭১) কংসবধ (১৮৭৫), ধর্ম বিজয় (১৮৭৫)। রামনারায়ণ তর্করত্ন কিছু প্রহসন, রোমান্টিক নাটক রচনা করেন। সেগুলি হল— যেমন কর্ম তেমন ফল (১২৭৯ বঙ্গাব্দ), উভয় সংকট (১৮৬৯), চক্ষুদান (১৮৬৯), স্বপ্নধন (১৮৭৩), সম্বন্ধ সমাধী (১৮৬৭)। তাঁর সৃষ্টিকর্মের মধ্যে পূর্ণ নাট্য
মুখাদা পাবার যোগ্য নাটক নাটক (১৮৬৬)। বাংলা নাট রামনারায়ণ তর্করত্নের অবদান কেবল অসংখ্য নাটক রচনায় নয়। বিষয় বৈচিত্র্যা, উপস্থাপন কৌশল, ইত্যাদি ব্যতীত আছে নাট্যদর্শক সৃষ্টি ও নাট্যরচনায় অনুপ্রাণিত করা। তাঁর সৃষ্ট পথ ধরে বাংলা নাটকের উৎকর্ষ সাধিত হয়েছে। আবির্ভাব হয়েছে প্রথম সার্থক বাংলা নাটকের।।
মাইকেল মধুসূদন দত্ত রচিত শর্মিষ্ঠা (১৮৫৯) নাটক বাংলা নাট্য সাহিত্যে নবীন প্রাণের সঞ্চার করে। পূর্ববর্তী নাট্যকার প্রণীত নাটকের সবচেয়ে বড় অসঙ্গতি ছিল স্থল। ● অপ্রাসঙ্গিক কৌতুক রস পরিবেশন, অবিন্যস্ত কাহিনী এবং অ-বিকশিত চরিত্রসমূহ উপস্থিত করা। কলকাতার বেলগাছিয়ার নাট্যশালায় মধুসূদন এসেছিলেন নাটক দেখতে। সেদিন অভিনীত হচ্ছিল রামনারায়ণ তর্করত্নের রত্নাবলী নাটক। বাংলা নাটকের দৈন্যদশা দেখে আহত হয়ছিলেন মধুসূদন। এক রকম চ্যালেঞ্জের বশবর্তী হয়ে নাটক রচনায় হাত দিয়েছিলেন তিনি। সংস্কৃত নাটকের রক্ষণশীলতা পরিহার করে, পাশ্চাত্য ভাবাদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে, ভারতীয় পৌরাণিকতাকে বিষয় করে তিনি নাট্য রচনা শুরু করেন। স্থবির ও স্কুল বাংলা নাটক তাঁর হাতে গতি ও সজীবতা পেল। মধুসূদন রচনা করলেন পদ্মাবতী (১৮৬০), কৃষ্ণকুমারী (১৮৬১), প্রহসন একেই কি বলে সভ্যতা (১৮৬০), বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রো (১৮৬০)। মধুসূদনের হাতেই কৃষ্ণকুমারী'র মাধ্যমে প্রথম সার্থক বাংলা ট্রাজিক নাটক পথ চলা শুরু করে।
এরপর নাট্যচর্চায় আবির্ভূত হন দীনবন্ধু মিত্র। তাঁর প্রথম নাটক নীল দর্পণ (১৮৬০) বেনামীতে মুদ্রিত হয়। নবীন তপস্বিনী (১৮৬৩), সধবার একাদশী (১৮৬৬), বিয়ে পাগলা বুড়ো (১৮৬৬), লীলাবতী (১৮৬৭), জামাই ফরিক (১৮৭২), কমলে কামিনী (১৮৭৩) দীনবন্ধু মিত্র রচিত নাটক। দীনবন্ধু মিত্র বাংলা নাট্য সাহিত্যের এক বিশিষ্ট নাম। তিনি নাটকের গঠন কৌশলগত দিকে এমন কোন উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্যের সংযোজন করেন নি তবে তিনি বাংলা নাটকে গণচেতনার বৈশিষ্ট্যকে যুক্ত করতে সক্ষম হয়েছেন। তাঁর অধিকাংশ নাটকই ছিল মঞ্চে অসম্ভব জনপ্রিয় নাটকের চরিত্রমুখে দ্রোহের ও সংগ্রামের কথা শুনতে পাওয়া যায় আর এ ধরনের চরিত্রগুলির অধিকাংশই এসেছে সমাজের নিচু শ্রেণী থেকে দীনবন্ধু মিত্র নিচু শ্রেণীর চরিত্র রূপায়ণে যথেষ্ট মুন্সীয়ানার প্রমাণ রাখলেও, উচু শ্রেণী চরিত্র চিত্রণে সে পরিমাণ ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন।
বাংলা নাটকের সমৃদ্ধিসাধনে গিরিশচন্দ্র ঘোষের অবদান কম নয়। অভিনেতা, নাট্যকার ও নাট্য নির্দেশক – এই তিন প্রতিভার সমন্বয় হয়েছিল গিরিশচন্দ্র ঘোষের মধ্যে। তিনি রচনা করেন ৭৯টি নাটক ও প্রহসন। তাঁর উল্লেখযোগ্য নাটক হচ্ছে, রাবণবধ, রামের বনবাস, প্রফুল্ল হারানিধি, বেল্লিক বাজার, সভ্যতার পাঞ্জ ইত্যাদি। তার নাট্য সাহিত্যকে সমালোচকবৃন্দ চার শ্রেণীতে বিভক্ত করেছেন। ক) ঐতিহাসিক রাজনৈতিক বিষয়ের নাটক (খ) পৌরাণিক ভক্তিমূলক নাটক 'গ) সামাজিক পারিবারিক
মাট ৩) গ্রহসন। সেন্সপীয়ারের অনুসারী নাট্যকার গিরিশ ঘোষ বাংলা নাটকের জন্যতম প্রধান পুরুষ। তিনি দেশীয় ও জাতীয় ভাবকেই অধিক আশ্রয় করেছেন তাঁর
সে সময়কালের আরেকজন উল্লেখযোগ্য নাট্যকার মনোমোহন বসু। পাশ্চাত্য ভাবাদর্শে অনুপ্রাণিত না হয়ে তিনি গ্রাচ্যের ভাবধারাকে অবলম্বন করে নাটক রচনা করেছেন। পৌরাণিক নাটক রচনায় তিনি সমাধিক সাফল্য দেখিয়েছিলেন। মনোমোহন হসু রচিত উল্লেখ যোগ্য নাটক হচ্ছে সতী, হরিশচন্দ্র, আনন্দ নাটক/ইত্যাদি।
মুসলমান নাট্যকারদের মধ্যে সর্বপ্রথম নাটক রচনায় সার্থকতা দেখান মীর মশাররফ হোসেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য নাটক ও প্রহসন হচ্ছে— বসন্তকুমারী নাটক, জমিদার দর্পণ, বেহুলা গীতাভিনয়, ভাই ভাই এইতো চাই ইত্যাদি। রবীন্দ্র অগ্রজ জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর ঐতিহাসিক নাটক রচনার মাধ্যমে জাতীয় জীবনে প্রাণস্পন্দন সৃষ্টির প্রয়াস পেয়েছিলেন। তবে তিনি ইতিহাসের চরিত্রের রূপায়ণে অনেক অনৈতিহাসিক উপাদানকে ব্যবহার করেছিলেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য নাটক হচ্ছে পুরু বিক্রম, সরোজিনী, অশ্রুমতি, স্বপ্নময়ী ইত্যাদি। প্রহসন রচনায়ও তাঁর কৃতিত্ব লক্ষ্যণীয়। অভিনেতা নাট্যকার অমৃত লাল বসু, বাংলা নাট্য সাহিত্যের এক উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব। প্রবল হাস্যরসের মাধ্যমে জীবনের বিপর্যয় ও বিকৃতিকে তুলে এনেছিলেন তিনি। নাটক রচনা অপেক্ষা প্রহসন রচনায় তাঁর সাফল্য অধিক। তাঁর উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি তরুবালা, আদর্শ বন্ধু, নব যৌবন, বিবাহ বিভ্রাট, কালাপানি, বাবু, একাকার, বৌমা, বাহবা বাতিক, খাস দখল ইত্যাদি।'
বাংলা নাট্য সাহিত্যের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ঘটনা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাটক রচনা। বাহ্য সংঘাত নির্ভর দ্বন্দুময় নাটক রচনায় প্রচলিত ধারার বিরোধীতা করে, রবীন্দ্রনাথ রচনা করেন চরিত্রের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব সংঘাতের চিত্র। ফলে বাংলা নাটকের অবয়ব বদলে যায় সহসা। রচনারীতির এই পরিবর্তন সাধন করতে পেরেছিলেন তুলনারহিত প্রতিভার গুণে ও মঞ্চঘনিষ্টতার জন্যে। এছাড়া তাঁর নাটকে খুঁজে পাওয়া যায় তাঁরই জীবনাদর্শন। তাঁর আদর্শবাদ ও ধর্মনির্ভর দুরূহ জীবনতত্ত্বের প্রকাশ লক্ষ্য করা যায় সাঙ্কেতিক নাটক সমূহে। ভাষা ব্যবহারেও তিনি অসাধারণ শিল্প কুশলতার পরিচয় দিয়েছেন। যার জন্যে তাঁর নাটক বিষয়ানুযায়ী আবেগ প্রকাশে যথার্থ সার্থক।
রবীন্দ্র নাটককে কয়েকটি শ্রেণীতে বিভক্ত করা যায়। যথা— গীতিনাট্য, কাব্যনাট্য, সাঙ্কেতিক নাটক, সামাজিক নাটক, নৃত্যনাট্য, প্রহসন প্রভৃতি। তাঁর রচিত বিখ্যাত নাটকগুলি হচ্ছে– মায়ার খেলা, প্রকৃতির প্রতিশোধ, রাজা রাণী, বিসর্জন, রাজা, অচলায়তন, ডাকঘর, মুক্তধারা, চিত্রাঙ্গদা, রক্তকরবী, তাসের দেশ, শ্যামা, চিরকুমার সভা ইত্যাদি। সাঙ্কেতিক নাটক রচনায় রবীন্দ্র প্রতিভার বিকাশ লক্ষ্যণীয়। যেহেতু তিনি কবি ছিলেন সেহেতু তাঁর নাটকে কবিসুলভ বৈশিষ্ট্যও ফুটে উঠেছে। তবে তা কখনোই নাটকীয় বৈশিষ্ট্যকে ম্লান করে নয়। রবীন্দ্রনাথ নাটকের প্রচলিত ধারণাকে ভেঙে দিয়ে নতুন ধারার সৃষ্টি করেছিলেন, আর সেখানেই তাঁর কৃতিত্ব।
'হাসির গানের রাজা' নামে অধিক পরিচিত দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের জন্য নদীয়া জেল তৃষানগরে ১৮৬৩ সালে ১৯শে জুলাই, ১২৭০ বঙ্গাব্দের ৪ঠা শ্রাবণ তাঁর পিতার ম কার্তিকেয়চন্দ্র রায় ও মাতার নাম প্রসন্নময়ী দেবী। কৃষ্ণনগরের মহারাজার দেওয়ান। কার্তিকেয়চন্দ্র সামাজিক ভাবে ছিলেন প্রতিষ্ঠিত ও প্রভাবশালী সঙ্গীত পিপাসু আত্মজীবনীকার ও উদার মন মানসিকতা সম্পন্ন কার্তিকেয়চন্দ্র, তাঁর নিজের পরিবারটিকে গড়েও তুলেছেন নিজের উপযোগী করে দেওয়ানজী যেমন ছিলেন বিভিন্ন ভাষা ও সাহিত্যের অনুরাগী পাঠক তেমনি ছিলেন বিদগ্ধ লেখক। গীতি সংগ্রহ ও আত্মজীবনী রচনা প্রকাশিত হবার পর, তাঁকে চেনা যায় নতুন ভাবে।
কার্তিকেয়চন্দ্র ছিলেন কৌতুকপ্রিয়, পণ্ডিত, শিল্পানুরাগী ও তেজস্বি। এসব গুণের প্রভাব পড়েছিল দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ওপর। স্বয়ং দ্বিজেন্দ্রলাল রায় 'দুর্গাদাস' নাটকের, ভূমিকায় বলেন— “...যাঁহার দেব চরিত্র সম্মুখে রাখিয়া আমি এই দুর্গাদাস চরিত্ব অঙ্কিত করিয়াছি, সেই চির আরাধ্য পিতৃদের... পিতৃপ্রভাব যে তাঁর ওপর কতটুকু পড়েছিল, তাঁর যথেষ্ট স্বাক্ষর পাওয়া যায় পেশাগত জীবনের দ্বিজেন্দ্রলালকে জানলে। দ্বিজেন্দ্রলালের মা প্রসন্নময়ী দেবী ছিলেন সে সময়ের বিখ্যাত পণ্ডিত বংশের কন্যা। তাঁর মা সহজাতভাবে অর্জন করেছিলেন পাণ্ডিত্য। যার প্রভাব ছিল পুত্রের জীবনে।
মেধাবী ছাত্র হিসেবে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের খ্যাতি ছিল ছোটবেলা থেকেই। কিন্তু ছাত্র অবস্থায় কোন পরীক্ষাতেই তিনি তেমন আশানুরূপ ফল দেখাতে পারেননি কখনো। কারণ প্রায় সময়ই তিনি অসুস্থ থাকতেন। ছোটবেলা থেকেই তিনি স্থায়ী ম্যালেরিয়া রোগে আক্রান্ত ছিলেন। এম. এ. পরীক্ষার পূর্বে ম্যালেরিয়া রোগে আক্রান্ত হয়ে দেওঘর গিয়েছিলেন হাওয়া বদল করতে। সেখানে গিয়ে তিনি পরিচিত হন মনীষী রাজনারায়ণ বসুর সাথে।
১৮৭৮ সালে তিনি কৃষ্ণনগর কলেজিয়েট স্কুল থেকে দ্বিতীয় বিভাগে এনট্রান্স পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৮৮০ সালে কৃষ্ণনগর কলেজ থেকে দ্বিতীয় বিভাগে এফ.এ পাশ করেন। ১৮৮৩ সালে হুগলী কলেজ থেকে বি. এ. পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন এবং প্রেসিডেন্সী কলেজ থেকে ১৮৮৪ সালে ইংরেজি সাহিত্যে এম.এ. পরীক্ষায় অংশ গ্রহণ করেন।
বি. এ. ক্লাসের ছাত্র থাকাকালীন দ্বিজেন্দ্রলালের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ১৮৮২ সালে আর্যগাথা প্রথম ভাগ প্রকাশিত হয়। পূর্বেই আলোচিত হয়েছে যে, তাঁর পারিবারিক পরিবেশ ছিল সাহিত্যচর্চার অনুকূল। এর সাথে যুক্ত ছিল উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের সাধনাও। সঙ্গতকারণে শৈশবেই তিনি আসক্তি অর্জন করেন সাহিত্য ও সঙ্গীতে । একথা মনে করা স্বাভাবিক যে, দ্বিজেন্দ্রলালের প্রতিভার পরিপূর্ণ বিকাশে তাঁর পিতা মাতা ও পরিবার যথেষ্ট ভূমিকা রেখেছিল।
এম. এ. পাশ করার পর দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের জীবনে নতুন মাত্রা যুক্ত হয়। কৃষিবিদ্যা শিক্ষার উদ্দেশ্যে ১৮৮৪ সালে তিনি বিলেত যাত্রা করেন। প্রবাসজীবনে তাঁর প্রতিভা বিকশিত হয় ধীরে ধীরে। 'বিলাতের পত্র' নামের কতিপয় পত্র একটি সাপ্তাহিকীতে তিনি এসময়ে প্রকাশ করেন। এগুলোতে তাঁর মেধার ও সৃষ্টিশীলতারপাওয়া যায়। প্র তিনি পাশ্চাত্য সঙ্গীতে বিশেষ জ্ঞান অর্জে গ্রন্থ প্রকাশ করেন। জেন্দ্রলাল রায় বলেন “বিলাত গিয়া ইংরাজি কত লিখতে আরম্ভ করি এবং সেই কবিতাগুলিকে একত্রিত করিয়া স্যার এডুইন আর্মকে উৎসর্গ করিবার অনুমতি চাই এবং তৎসঙ্গে কবিতাগুলির পাণ্ডুলিপি পাঠাই। তিনি কবিতা প্রকাশ সম্বন্ধে আমাকে উৎসাহিত করিয়া লেখেন ও সেই কবিতাগুলি তাহাকে উৎসর্গ করিবার অনুমতি সাগ্রহে দান করেন। তখন সেই কবিতাগুলিকে Lyric of Ind. আখ্যা দিয়া প্রকাশ করি।”
প্রবাসী জীবনে দ্বিজেন্দ্রলাল রায় সঙ্গীত ও সাহিত্যে বিশেষ জ্ঞান অর্জন করে স্বকীয় আনন্দ অঙ্গন তৈরি করেন। বিলাতে তিনি প্রচুর নাটক দেখেন । বহু বিখ্যাত অভিনেতা, অভিনেত্রীর অভিনয় দেখে, মঞ্চনাটক সম্পর্কে পড়াশুনা করে এবং গুণীজনদের সান্নিধ্যে থেকে নাটক সম্পর্কে অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। এখানেই তাঁর নাটক রচনার অনুপ্রেরণা সৃষ্টি হয়। তিনি বিলেতে থাকার সময় খবর পান, তাঁর মা বাবার মৃত্যু হয়েছে। মৃত্যুর পরপরই দেশে ফিরে আসা তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি। আর এই অজুহাতে বাঙালি রক্ষণশীল হিন্দু সমাজ তাঁকে বর্জন করে। বিনা প্রায়শ্চিত্তে সমাজ তাঁকে গ্রহণ করতে রাজি হয়নি। এই অন্যায় তাঁর মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। যার প্রকাশ ঘটেছে 'একঘরে' রচনার মধ্যে।
দ্বিজেন্দ্রলাল রায় দেশে ফিরে সরকারী চাকুরীতে যোগদান করেন। ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের মত পদে অধিষ্ঠিত থাকার পরও তোষামদ করে কর্তাব্যক্তিদের তুষ্ট করতে পারেননি বলে, কর্মজীবনে তাঁর তেমন উন্নতি হয়নি। নিয়মনিষ্ঠ ও নীতিবাদী ছিলেন বলে ইংরেজ প্রভুরা কখনোই তাঁর ওপর সন্তুষ্ট থাকেননি। ফলে একই পদে দীর্ঘকাল থাকার কারণে চাকুরী বিষয়ে অনাগ্রহ ও অশ্রদ্ধা জন্ম লাভ করে।
সে সময়ের প্রখ্যাত হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক ডা. প্রতাপচন্দ্র মজুমদারের জ্যেষ্ঠা কন্যা সুরবালা দেবীর সাথে ১৮৮৭ সালে দ্বিজেন্দ্রলাল রায় বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাঁদের দাম্পত্য জীবন ছিল খুবই সুখের। পারষ্পরিক বোঝাপড়া ও প্রেমময় সম্পর্কে সুদৃঢ় দাম্পত্যজীবন তাঁর প্রতিভা বিকাশে সর্বাত্মক সাহায্য করেছে। এ সময় তিনি একের পর এক রচনা করেন প্রহসন, হাসির গান, কাব্যনাট্য, রোমান্টিক গীতিকবিতা ইত্যাদি। সৃষ্টির বিপুল উচ্ছাসে উদ্ভাসিত তিনি, মগ্ন থেকেছেন নবীন সৃষ্টির আকাঙ্ক্ষায় । বিখ্যাত দ্বিজেন্দ্র গবেষক ডঃ রথীন্দ্রনাথ রায় এ সময়কালকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন—“নবপরিণীতা পথীকে ঘিরে তাঁর হৃদয়োচ্ছ্বাস গীতিকবিতার স্ফটিকপাত্রে স্বর্ণমদিরার মতো বিহ্বল ও উজ্জ্বল হয়ে আত্মপ্রকাশ করেছে। কবি দ্বিজেন্দ্রলালের মানসজীবনে এই দু'টি ধারা লক্ষ্য করা যায় একদিকে আত্মমুগ্ধ প্রেম বিহ্বল স্বপ্নাতুর কবিচিত্ত আর একদিকে সামাজিক অসঙ্গতিতে ক্ষুদ্ধ সামাজিক মানুষ। কখনও কখনও এই বিরুদ্ধ ধারা একত্রিত হয়ে কবিতার ভাব ও রূপের ক্ষেত্রে বিচিত্রমুখী জটিলতার সৃষ্টি করেছে। অবশ্য এই দু'টি ধারাই কবির স্বভাবগত বৈশিষ্ট্য। পত্নী সুরবালার প্রেম এবং দাম্পত্যরস ও অপরকোটিতে সামাজিক নির্যাতন—এই দু'টি ব্যাপার একত্রিত হয়ে কবিমানসের এই স্বরূপধর্মকে তীব্রতর ও ত্বরান্বিত করেছে।”• মানব জীবন বোধকরি সমান্তরাল নয়। বক্র এবং উত্থান-পতন সেখানে স্বাভাবিক। আনন্দ আর কান্নার সহ-অবস্থান। তাই দেখা যায় দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের সুখী জীবনে নেমে আসে হঠাৎ বিপর্যয়। স্ত্রী সুরবালা দেবীকে আশ্রয় করে কবি জীবন হয়ে উঠেছিল পূর্ব বিকশিত ও উদ্ভাসময়। সেই প্রিয়তমা স্ত্রী একটি মৃত কন্যা সস্তান প্রসব করে মৃত্যুবরণ করেন ১৯০৩ সালের ২৯শে নভেম্বর। পারিবারিক এই বিপর্যয়ে হতোদ্দাম হয়ে যা তিনি। হতাশাগ্রস্থ জীবনে অবলম্বন থাকে কেবল পুত্র দিলীপকুমার ও কন্যা মায়া দেবী। পুত্র কন্যার প্রতি গভীর মমত্ববোধই তাঁকে শারীরিক ভাবে বাঁচিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছিল। কিন্তু স্ত্রী বিয়োগের সাথে সাথেই তাঁর মনের মৃত্যু হয়েছিল। যার কারণে স্ত্রীর মৃত্যুর পর তাঁর রচনায় পূর্বের কৃতিত্ব লক্ষ্য করা যায়নি।
স্ত্রী বিয়োগ ব্যথায় আক্রান্ত দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, স্ত্রী স্মৃতিকে অম্লান রাখার উদ্দেশ্যে সাহিত্যমধ্যে পরোক্ষভাবে উপস্থাপন করেছেন দাম্পত্য প্রেমকে। আবার বিয়োগ ব্যথা বিস্তৃত হবার জন্যে নিজের বাড়ি 'সুরধাম' এ ১৯০৫ সালে 'পূর্ণিমা মিলন' নামে এক সাহি সম্মেলনের প্রতিষ্ঠা করেন। এখানে তৎকালীন বহু বিদগ্ধজন উপস্থিত থেকে নিয়মিত আসরে অংশগ্রহণ করতেন। সাহিত্য, সঙ্গীত, জ্ঞান ও বিজ্ঞান বিষয়ক আলোচনায়, বিভিন্ন সাহিত্য কর্ম নিয়ে সমালোচনায় মুখরিত হয়ে থাকতো সন্ধ্যায় সুরধাম। সুরধাম যখন যথার্থই পূর্ণিমার বিপুল জ্যোৎস্নায় প্লাবিত তখন বঙ্গীয় রাজনীতিতে নেমে আসে দুর্যোগ। ১৯০৫ সালে সমগ্র বাংলাদেশ উত্তাল হয় বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন নিয়ে। এই আন্দোলনের প্রচণ্ড বিক্ষোভ কবিচিত্তকে আলোড়িত করে তোলে। ফলে তাঁর সাহিত্যে দেশপ্রেম প্রত্যক্ষ ও উগ্রভাবে প্রকাশ পায়। দেশাত্মবোধক সঙ্গীত ছাড়া ঐতিহাসিক নাটকেও দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবোধের সুস্পষ্ট ছাপ দেখা যায় ।
দ্বিজেন্দ্রলাল রায় জীবনের শেষ প্রান্তে এসে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে মতবিরোধে জড়িয়ে যান। এ মতবিরোধ তাঁদের ব্যক্তিজীবনেও বেশ প্রভাব ফেলেছিল। অবশ্য শেষ অবধি সম্পর্ক পুনরায় স্বাভাবিক হয়েছিল। সম্পর্ক স্বাভাবিক করার ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের উদ্যোগই সর্বাগ্রে উচ্চারিত।
দ্বিজেন্দ্রলাল রায় চাকুরি থেকে অবসর নেন ১৯১৩ সালে। এর সামান্য পূর্বে তিনি ‘ভারতবর্ষ' নামক পত্রিকা প্রকাশের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। কিন্তু পত্রিকা প্রকাশের পূর্বে ১৯১৩ সালের ১৭ই মে সন্ন্যাসরোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের সাহিত্যচর্চার কাল সময়ের বিচারে দীর্ঘ না হলেও বৈচিত্র্যের বিচারে প্রাচুর্যে তা বিপুল ও বিশাল। বিলেত থাকাকালীন সময়ে সূচনা এবং মৃত্যু অবধি নিরবচ্ছিন্ন ভাবে চর্চা করার ফলে সাহিত্য কর্ম হয়ে উঠেছে সংখ্যায় অধিক। গুণগত মানে সবগুলিই যে শ্রেষ্ঠ বা উৎকৃষ্ট এমন দাবি করা অন্যায়। তবে তাঁর স্বকীয়তা প্রকাশের জন্যে সেগুলিই যথেষ্ট। অধ্যাপক সুকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন— “তাঁর রচনাবলীকে মোটামুটি তিন শ্রেণীতে ভাগ করা চলে। প্রথমতঃ গদ্য রচনা, দ্বিতীয়তঃ কাব্য কবিতা ও গান রচনা, তৃতীয়তঃ নাটক রচনা গদ্য রচনার ক্ষেত্রে তাঁর কৃতিত্ব থাকলেও চর্চার অভাবে এই শ্রেণীর রচনা তেমন সার্থকতা লাভ করেনি বা স্থায়ী চিহ্ন রেখে যেতে পারেনি। কাব্য রচনার ক্ষেত্রে দ্বিজেন্দ্রলালের প্রতিভার প্রকাশ ঘটলেও সর্বত্র
তা সমানভাবে সাধারণ পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারেনি। অবশ্য রবীন্দ্র কাব্য প্রতিভার ঔজ্জ্বল্যও তাঁর কবিশক্তির যথাযথ স্বীকৃতির পথে অনেকখানি অন্তরায় হয়ে দাড়িয়েছিল। সে জন্যে নাটক রচনাতেই দ্বিজেন্দ্র প্রতিভা যথার্থরূপে আত্ম-প্রকাশ করেছে। নাটক ও প্রহসন রচনায় তিনি যথেষ্ট খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। আমাদের কাছে তিনি স্মরণীয় হয়ে আছেন, তাঁর হাসির গান ও নাটকের জন্য।”
দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের প্রকাশিত প্রথম গ্রন্থ আর্যগাথা (১ম ভাগ)। এটি কবিতা ও গানের সংকলন। আর্যগাথা সম্পর্কে তিনি নিজেই বলেন—শৈশব হইতেই আমি গান ও কবিতা রচনা করিতাম। আর্যগাথা ১ম ভাগ-এ ১৮৮২ খ্রীষ্টাব্দে প্রকাশিত নক্ষত্র বিষয়ক গীতটি আমি দ্বাদশ বর্ষে রচনা করি। ১২ বৎসর হইতে ১৭ বৎসর পর্যন্ত রচিত আমার গীতগুলি ক্রমে 'আর্যগাথা' নামক গ্রন্থের আকারে প্রকাশিত হয়। তখন কবিতাও লিখিতাম। কিন্তু তখন কোন কবিতা প্রকাশিত হয় নাই। কেবল 'দেবঘরে সন্ধ্যা' নামক *ং প্রণীত একটি কবিতা নব্য ভারতে প্রকাশিত হয়। ১৮৯৩ সালে প্রকাশিত হয় আর্যগাথা ২য় ভাগ। গীতিকবি হিসেবে যথার্থ-পরিচয় পাওয়া যায় একাব্য দু'টিতে। আর্যগাথার ভূমিকায় তিনি বলেন— “যাহারা একমাত্র মনুষ্য-প্রেম-গীতিকেই গীত মনে করেন, আর্যগাথা তাহাদিগের জন্য রচিত হয় নাই। এবং তাহাদিগের আদর প্রত্যাশা করে না। যদি কেহ প্রকৃতির অপার্থিব সৌন্দর্য ও লাবণ্যে কখন কখন বিমুগ্ধ হইয়া থাকেন, যদি কেহ প্রকৃতিতে দেখিতে দেখিতে কখন কখন প্রকৃতি রচয়িতার অনন্ত মহিমায় স্তব্দ হইয়া থাকেন, যদি কেহ শোক-জরা সংকুল জগতে দুঃখাবসন্ন হইয়া কখন কখন নীরবে অশ্রুবারি বর্ষণ করেন। যদি কাহার অধঃপতিতা হতভাগিনী দুঃখিনা মাতৃভূমির নিমিত্ত নেত্রপ্রান্ত কখনও সিক্ত হইয়া থাকে, আর্যগাথা তাহারই আদর চাহে।” আর্যগাথার বিষয় বৈচিত্র্যকে চারভাগে ভাগ করা হয়। যথা–ক) প্রকৃতি প্রীডি খ)
ঈশ্বর প্রশংসা গ) বিষাদাত্মক ঘ) দেশাত্মবোধক। উপরের শ্রেণী বিভক্তি কেবল প্রথম ভাগ আর্যগাথার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। ২য় ভাগ ভিন্ন প্রকৃতির। ডঃ রথীন্দ্রনাথ রায় বলেন— “দ্বিজেন্দ্রলালের মানসলোকে যে রোমান্টিক সৌন্দর্যানুভূতি ছিল, তাই বিবাহ-পরবর্তী জীবনে, সৌন্দর্য ও প্রেমের নিবিড় উচ্ছ্বাসে ভরে উঠেছে। আর্যগাথা (২য় ভাগ) কাব্যের মূল উৎস নারীপ্রেম ।...কবির স্বপ্ন বিহবল মনের এমন সুরধর্মী ও আত্ম-তন্ময় প্রকাশ তাঁর পরবর্তী কাব্যগুলির মধ্যেও দুর্লভ। বিশ্ব প্রকৃতিও প্রেমের রসে সঞ্জীবিত হয়ে উঠেছে।” বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত বিখ্যাত প্রবন্ধগ্রন্থ আধুনিক সাহিত্যে' আর্যগাথা কাব্যের প্রশংসা করা হয়েছে।
প্রবাসী জীবনে রচিত কাব্যগ্রন্থ Lyric of Ind. এরপর রচনা করেন হাস্যরসাত্মক ও ব্যঙ্গ রসাশ্রিত গ্রন্থ আষাঢ়ে (১৮৯৯) ও হাসির গান (১৯০০)। রবীন্দ্রনাথ 'আধুনিক সাহিত্য' গ্রন্থে বলেন—“তিনি সে সকল বাঙালিকে হাসাইবার জন্য আসেন নাই, সেই সঙ্গে তাহাদিগকে যে ভাবাইবেন এবং মাতাইবেন এমন আশ্বাস দিয়াছেন। এ প্রসঙ্গে ড. রথীন্দ্রনাথ রায় বলেন—“নির্মম ব্যঙ্গ বিদ্রূপই দ্বিজেন্দ্রলালের হাসির গানের মূল সুর নয়, কারণ দ্বিজেন্দ্রলালের মধ্যে একটি সহানুভূতিপ্রবণ আবেগময় কবিচিত্ত ছিল.... তাঁর হাসি স্পষ্ট, উজ্জ্বল ও সশব্দ। জীবনের সত্য নিষ্ঠুরতম করুণতম সত্য তাঁর
হাসির গানের মধ্যে যখন উদ্ভাসিত হয়, তখন তারই আলোকে আমাদের মুখচ্ছবিঃ বিবর্ণতা ধরা পড়ে, তখন হাসতে গিয়ে নিজের হাসির শব্দে অন্তরাত্মা কেঁদে ওে দিজেন্দ্র লালের হাস্যরসের বহু উপকরণই স্কুল, কিন্তু সেই দৈনন্দিন জীবনের উপকরণগুলিকেই তিনি উন্নত শিল্পমর্যাদা দিয়েছেন, এখানেই তাঁর কৃতিত্ব।” ১৯০২ সালে 'ম' এবং ১৯০৭ সালে 'আলেখ্য', ১৯১২ সালে 'ত্রিবেণী' কাব্যগ্রন্থ
প্রকাশিত হয়। এ কাব্য তিনটি সম্পর্কে দ্বিজেন্দ্রলাল গবেষক ডঃ রথীন্দ্রনাথ রা বলেন—“মন্দ্ৰকাবো কবি যে শক্তি অর্জন করেছেন, দ্বিজেন্দ্র কবি জীবনে সেই হলো চূড়ান্ত সিদ্ধি....….. এই কাব্যে কোথাও ভাবালুতার অস্পষ্টতা নেই, প্রকাশরীতির দ্বি নেই—এক জড়তামুক্ত ও ভাবাবেগমুক্ত বুদ্ধিগম্য স্পষ্টালোকিত জগৎ ‘মন্দ্র' কাব্যের কাব্য পটভূমি।...মন্দ্ৰ কাব্যের কাব্যরীতি ও কলাবিধিতে সর্বপ্রথম একটি। ব্যক্তিত্ব-প্রকাশক স্টাইল দেখা দিয়েছে। 'মন্দ্ৰ' কাব্য দ্বিজেন্দ্র জীবনের শুধু নয়, দ্বিজেন্দ্র কবি জীবনেরও শ্রেষ্ঠ মুহূর্তের সমাপ্তিচিহ্ন।... আলেখ্য কাব্যের সুরে একটি বিষাদময় অনুভূতি জড়িত আছে। এর জন্য কবির পদ্মীবিয়োগের ব্যাপারটি নিঃসন্দেহে অনেকখানি দায়ী।... ত্রিবেণী কাব্যে লঘুচিত্ত পরিহাস ও শ্লেষ বিদ্রুপের ভ্রূভঙ্গি নেই বললেই হয়। কাব্যটির সুর প্রশান্ত গভীরই নয়, গভীরও বটে।... ত্রিবেণী' কাব্যে কবি প্রিয়া আর গৃহ পরিজন-পুত্র-কন্যার সংসার সীমায় আবদ্ধ নন,—তিনি স্মৃতির তীর্থে নৈর্ব্যক্তিক ভাবরহস্যে অধিষ্ঠিত।”
দ্বিজেন্দ্র প্রতিভার প্রকাশ নাটক ও গীতিকবিতায় যতটুকু লক্ষ্য করা যায়, গদ্য রচনার ক্ষেত্রে তেমনটি লক্ষ্য করা যায় না। সাহিত্য বিষয়ক প্রবন্ধাবলী ও পত্র সাহিত্যের মধ্যে তাঁর গদ্য রচনা সীমাবদ্ধ। পরিচ্ছন্ন ও স্পষ্ট চিন্তার প্রকাশ এবং যুক্তিসিদ্ধতা এ দ্বিজেন্দ্রলালের গদ্যকে বিশিষ্ট করেছে। তবে সে গদ্য তৎসম বহুল, অব্যয় নির্ভর ও জটিল বাক্যে বিন্যস্ত।
দ্বিজেন্দ্রলাল অদ্যাবধি পাঠক চিত্তকে অধিকার করে আছেন তাঁর নাটকের জন্যে। নাটক রচনার মাধ্যমে তিনি বাংলা নাট্য সাহিত্যকে যথেষ্ট পরিমাণে সমৃদ্ধ করেছেন। তিনি নিজেই নিজের নাটক সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। তিনি 'আমার নাট্যজীবনের আরম্ভ' প্রবন্ধে বলেন— “বাল্যাবধি কবিতা ও নাটক পাঠে আমার অত্যন্ত আসক্তি ছিল।...বিলাতে যাইবার পূর্বে আমি হেমলতা নাটক ও নীলদর্পণ নাটকের অভিনয় দেখিয়াছিলাম মাত্র আর কৃষ্ণনগরের এক সৌখিন অভিনেতৃদল কর্তৃক অভিনীত 'সধবার একাদশী’ ও গ্রন্থকার নামক একখানি প্রহসনের অভিনয় দেখি, আর Addison এর cato এবং Shakespeare এর Julius Caesar এর আংশিক অভিনয় দেখি। সেই সময় হইতে অভিনয় ব্যাপারটিতে আমার আসক্তি হয়।... ক্রমেই অভিনয় ব্যাপারটি আমার কাছে প্রিয়তর হইয়া উঠে। বিলাত হইতে ফিরিয়া বঙ্গভাষায় লিখিত নাটকগুলির সহিত আমার পরিচয় হয়।...প্রহসনগুলির অভিনয় দেখিয়া সেগুলির স্বাভাবিকতায় ও সৌন্দর্যে মোহিত হইতাম বটে, কিন্তু সেগুলির অশ্লীলতা ও কুরুচি দেখিয়া ব্যথিত হই। ঐ সময়ে ‘কল্কি অবতার' নামে একখানি প্রহসন গদ্যে রচনা করিয়া ছাপাই। পরে আমার পূর্ব রচিত কতকগুলি হাসির গান একত্রে গাঁথিয়া 'বিরহ' নাটক রচনা করি ....... তৎপরে
উক্তরূপে 'ব্র্যহস্পর্শ রচনা করি...... প্রায়শ্চিত্ত রচনা করি....... সঙ্গে সঙ্গে আমার গম্ভীর রচনাও চলিতেছিল। মৎপ্রণীত 'সীতা' নাট্যকাব্য..... পরে 'পাষাণী' নাটক প্রকাশ করি। তৎপরে আমি 'তারাবাঈ' নাটক প্রকাশ করি। যে কারণে আমি প্রহসন লিখিতে প্রবৃত্ত হইয়াছিলাম, তাহার অনুরূপ কারণে আমি নাটক লিখিতেও প্রবৃত্ত হইয়াছিলাম। বাঙলা ভাষায় নাট্য সাহিত্যে স্বাভাবিকতা ও আখ্যানবস্তু গঠনে অসাধারণ নৈপূণ্য দেখিতাম কিন্তু তাহাতে কবিত্বের অভাব বোধ হইত। আমার কাব্যশক্তি (যাহা কিছু ছিল) আমি আমার নাটকে প্রকটিত করিতে প্রবৃত্ত হইলাম। প্রথমে Shakespeare এর অনুকরণে Blank verse এ নাটক আরম্ভ করি।..... তারাবাঈ প্রকাশিত হইবার পরে...নবীনচন্দ্ৰ সেন...এই মত প্রকাশ করেন যে এ নূতন ধরনের অমিত্রাক্ষর—মাইকেলের ছন্দোমাধুরী ইহাতে নাই–এ অমিত্রাক্ষর চলিবে না। সেই সঙ্গে স্বর্গীয় মাইকেল মধুসূদনের দৈববাণী মনে হইল যে—অমিত্রাক্ষরে নাটক এখন চলিতে পারে না। দীর্ঘ বক্তৃতা অমিত্রাক্ষরে চলে ৷ কিন্তু দ্রুত কথোপকথনে কথা তো গদ্যের মত হইতেই হইবে।... পদ্যের ঝংকার গদ্যে দেওয়া যায় কিন্তু গদ্যের স্বাধীনতা ও স্বেচ্ছাগতি পদ্যে নাই। বঙ্কিম বাবুর গদ্য অনেক স্থলে তো পদ্য...তদুপরি নাটক নাটক অভিনয় করিবার জিনিস। অভিনয়ের ঘটনাগুলি যত প্রত্যক্ষবৎ হয় ততই ভাল। সেইজন্যই উক্তিগুলি যত স্বাভাবিক হয় (ভাষার মর্যাদা রক্ষা করিয়া অবশ্য) ততই শ্রেয়। লোকে কথাবার্তা পদ্যে করে না, গদ্যে করে। অতএব পদ্যে নাটক রচনা করিলে উক্তিগুলি অস্বাভাবিক ঠেকিবেই ।
....এই সকল বিবেচনা করিয়া আমি তখন হইতে নাটকগুলি গদ্যে রচনা করিতে মনস্থ করিলাম। সেই জন্যই আমি আমার তারাবাঈ এর পরবর্তী নাটকগুলি (রানা প্রতাপ, দুর্গাদাস, নূরজাহান, মেবারপতন ও সাজাহান) যথাক্রমে গদ্যেই রচনা করি। কিন্তু কবিতায় আমার অত্যাধিক আসক্তি থাকায় আমি গদ্যের ভাষাকে কবিতার সামনে বসাইবার প্রলোভন পরিত্যাগ করিতে পারি নাই। অথচ যেখানে সংস্কৃত শব্দ অপেক্ষা প্রচলিত শব্দ বেশি জোরের সহিত ভাব প্রকাশ করে বলিয়া বোধ হইয়াছে, সেখানে প্রচলিত শব্দই ব্যবহার করিয়াছি। যখন উক্ত গদ্য নাটকগুলি রচনা করিতেছিলাম, তখন একখানি অপেরা (সোরাবরুস্তম) পদ্যে গদ্যে রচনা করি ।...মাঝে মাঝে কবিতায় দুই একখানা নাটক লিখিবার লোভ সংবরণ করিতে পারি নাই।”
দ্বিজেন্দ্রলাল রায় নাটক, প্রহসন রচনা করেছেন কুড়িটা। এসব নাটকে বিষয় হিসেবে যেমন এসেছে সমকালীন সমাজ বাস্তবতা তেমনি এসেছে মধ্যযুগের ইতিহাস উপাখ্যানকে আশ্রয় করে পারিবারিক ও রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র। নাট্যশিল্পের আদর্শ অনুসরণ করেও মার্জিত রুচিতে উপস্থাপন করেছেন সে সব বিষয়কে ।
দ্বিজেন্দ্রলালের প্রথম প্রহসন 'কল্কি অবতার' বা 'সমাজ বিভ্রাট' প্রকাশিত হয় ১৮৯৫ সালে। যদিও এর পূর্বে রচনা করেন 'এক ঘরে'। সমকালে বিরল বিষয়বস্তু হবার কারণে ‘কল্কি অবতার' বেশ জনপ্রিয়। এরপর রচিত হয় ‘ত্র্যহস্পর্শ,' 'বিরহ। বিরহের ভূমিকায় নাট্যকার লেখেন—“সত্ব বিষয়ের দুটি দিক আছে। একটি গম্ভীর ও অপরটি লঘু। 'বিরহ' এরও তাহা আছে। হাস্যরস দুই প্রকারে উৎপাদন করা যাইতে পারে ।এব—সভাকে প্রকৃত পরিমাণে বিকৃত করিয়া আর এক প্রকৃতিগত অ করিয়া।"
১৯০০ সালে রচিত হয় 'পাগাণী' গীতিনাট্য। পুরাণের বিষয়কে নতুন আঙ্গি উপস্থাপন করেন তিনি। এরপর রচনা করেন 'প্রায়শ্চিত্ত' প্রহসন যা 'বহুত আচ্ছা" অভিনীত হয়। ইতিহাস আশ্রিত নাটক 'তারাবাঈ' রচনা করেন ১৯০৩ সালে। 'টঙ' 'এ্যানালস এর ব্র্যান্টিকইটিজ অফ রাজস্থান' গ্রন্থ থেকে ‘তারাবাঈ' নাটকের উপাদ সংগ্রহ করেছিলেন নাট্যকার। ১৯০৫ সালে প্রকাশিত হয় 'রানা প্রতাপ সিংহ'। রথীন্দ্রনাথ রায় বলেন—“স্বদেশী আন্দোলনের উন্মাদনায় বাঙালি চিত্তের যে অভি জাগরণ হয়েছিল, দ্বিজেন্দ্রলাল তাকে তাঁর ঐতিহাসিক নাটকের মধ্যে রূপ দেওয়ার করেছেন। অতীতকে তিনি যুগঞ্জীবনের সমস্যার সঙ্গে সমন্বিত করে নূতন ধরনে ঐতিহাসিক নাটক পরিবেশন করেছেন। দ্বিজেন্দ্রলাল ইতিহাসকে জীবন্ত করে তুলে পারতেন। দ্বিজেন্দ্রলাল অতীত ইতিহাসের চরিত্রগুলির মধ্যে তীব্র অস্তদ্বন্দ্ব করেছেন। ঊনিশ শতকের শেষার্ধ থেকেই আমরা বাঙলা ঐতিহাসিক নাটকের পরিক্ষ পেয়েছি। যার মধ্যে সবিশেষ উল্লেখযোগ্য জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের ঐতিহাসিক নাটক কিন্তু বিশ শতকের প্রথম দশকে দ্বিজেন্দ্রলাল যে সমস্ত ঐতিহাসিক নাটক রচনা করেন তাঁর ভাবাদর্শ সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র । ঐতিহাসিক নাটক হিসাবে ‘রানা প্রতাপ সিংহ' মোটামুটি স্মরণযোগ্য। যদিও নাটকীয় আঙ্গিক নৈপুণ্যে এর অনেক ত্রুটি লক্ষ্য করা যায়।”
‘দুর্গাদাস' নাটক রচিত হয় ১৯০৬ সালে। এ নাটকে নাটকীয় গুণের সমাবেশ স্বয় হলেও, সংলাপে শাশ্বত সত্য বাণী উচ্চারিত হয়েছে। যেমন——“হিন্দু মুসলমান একবর জাতিদ্বেষ ভুলে পরষ্পর পরষ্পরকে ভাই বলে আলিঙ্গন করুক....সে দিন হিমালয় হয়ে কুমারিকা পর্যন্ত এমন এক সাম্রাজ্য স্থাপিত হবে যা সংসারে কেহ কখনও দেখে নাই।” বাঙালি চিত্তের অস্থিরতা, জাতীয়তাবোধ জাগ্রত সত্তাকে এ নাটকে উপস্থাপন কর হয়েছে।
'নূরজাহান' রচিত হয় ১৯০৮ সালে তিনটি কারণে এ নাটকটি অদ্যাবধি স্মরণী হয়ে আছে। এক–দোষগুণ সমন্বিত মানুষ চরিত্র, দুই–বাহ্য দ্বন্দ্ব অপেক্ষা অন্তর্দ্বন্দুই প্রকট, তিন—দ্বিতীয় কোন ব্যক্তির সামনে স্বগতোক্তি পরিহার। এ নাটে শেক্সপীয়ারের নাট্যরীতির যথেষ্ট প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। ১৯০৮ সালে রচিত "সে৷ স্তম' যাত্রাপ লা, সীতা নাট্যকাব্য, ও ‘মেবার পতন’ নাটক ‘সাজাহান’ রচন করেন ১৯০৯ সালে। এটি তাঁর রচিত নাটক সমূহের মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ নাটক ১৯১১ সালে রচনা করেন 'চন্দ্রগুপ্ত'। হিন্দু যুগাশ্রিত এ নাটকে কাহিনীর শৈথিল থাকলেও চরিত্র চিত্রণে অসাধারণ সাফল্য দেখিয়েছেন। বিশেষ করে চাণক্য চরি বাংলা নাট্য সাহিত্যের এক অমর চরিত্র। এ বছর রচনা করেন প্রহসন 'পুনর্জন্ম'। 'আনন্দ বিদায়।' রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে আক্রমণ করে রচিত প্রহসন। 'আনন্দ বিদা সাহিত্যকর্ম হিসেবে অসফল। নাট্যকারের জীবদ্দশায় প্রকাশিত হয় সর্বশেষ নাট ‘পরপারে' ১৯১২ সালে। মৃত্যুর পরে একাশিত হয় ১৯১৫ সালে 'সিংহল বিজয়' ১৯১৬ সালে 'বঙ্গনারী'। 'ভীষ্ম' নামক একটি পৌরাণিক নাটকও এসময়ে প্রকাশিহয়। তবে এসব নাটক দ্বিজেন্দ্রলালের নামাঙ্কিত হলেও, তাঁর নাট্য প্রতিভার প্রকাশ লক্ষ্য করা যায় না। কাহিনীর গাথুনীতে শৈথিল্য, নাটকীয় গুণের অভাব কবিরায়ণ ইত্যাদি কারণে এগুলি ব্যর্থ নাটক হিসেবেই চিহ্নিত। کراس
দ্বিজেন্দ্রলাল রায় রচিত 'সাজাহান' (১৯০৯) শুধু নাট্যকারের সাহিত্যকীর্তির মধ্যে নয়, বাংলা নাট্য সাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ। মোগল সম্রাট সাজাহানের রাজত্বকাল ৩৮ বছরেরও অধিক। তাঁর রাজত্বকালের দ্বন্দ্বমুখরতা এবং জীবনের শেষ আট বছরের দ্বন্দ্ববহুল ঘটনাবলী এ নাটকের উপজীব্য। নাটকের সময়কাল ১৬৫৭ সালের নভেম্বর ডিসেম্বর থেকে আরম্ভ করে ১৬৬৬ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত বিস্তৃত।
১৬৫৭ সালের ৭ই মার্চ সম্রাট সাজাহানের রাজক্ষমতা অর্জনের ত্রিশ বছর পূর্ণ হয়। এ বছর তাঁর বয়স হয় ৬৭ বছর। পারস্য ও আরব দেশ থেকে বহু পর্যটক আসেন প্রজাবৎসল ও বিবেচক সম্রাট সাজাহানের ভারতবর্ষ দর্শনে। এ বছরের ৬ই সেপ্টেম্বর সম্রাট মুত্রকন্দ্রতা ও কোষ্ঠ্যকাঠিন্য রোগে গুরুতর রূপে আক্রান্ত হন এবং রাজকার্য পরিচালনায় অসামর্থ্য হয়ে পড়েন। তার রোগমুক্তির জন্যে চিকিৎসা করা হয় এবং দান খয়রাত দেওয়া হয়। ১৪ই সেপ্টেম্বর সামান্য সুস্থ হয়ে তিনি ব্যাকুল প্রজাকুলকে এসাদের বারান্দা থেকে দর্শন দেন। কিন্তু তিনি অনুভব করেন, এই সামান্য সুস্থতা সাময়িক। তাই তিনি উত্তরাধিকারী মনোনীত করবার জন্যে রাজ্যের প্রধান ব্যক্তিদের সভা আহবান করেন এবং জ্যেষ্ঠপুত্র দারাকে উত্তরাধিকারী হিসেবে ঘোষণা করেন।
এসময় গুজব রটে যায় যে সাজাহান মৃত। এ গুজবকে মিথ্যে প্রমাণ করবার জন্যে সাজাহান জানালা থেকে প্রজাদের দর্শন দিলেন। কিন্তু সন্দেহ তাতে গেল না। কেউ কেউ মনে করলো মৃত সাজাহানকে জীবিত প্রমাণ করবার জন্যে দারা কৌশলে কোনো খোজাকে সম্রাটের পোষাক পরিয়ে প্রজাদের অভিবাদন গ্রহণ করাচ্ছেন। এই রটনা অতিরঞ্জিত হয়ে দাক্ষিণাত্যে ঔরংজীবের কাছে গুজরাটে মোরাদের কাছে এবং বাংলাদেশে সুজার কাছে পৌঁছালো। মৃত্যু অত্যাসন্ন অনুমান করে সাজাহান দিল্লী ত্যাগ করে আগ্রা যাত্রা করেন। মৃত্যু অবধি সম্রাট আগ্রা দুর্গে অবস্থান করেন এবং প্রায় নিঃসঙ্গ জীবন যাপন করেন। দারা সম্রাটের নামে ফরমান জারি করতেন।
মৃত্যুপূর্ব কয়েক বছর সাজাহান আগ্রায় বন্দী জীবন যাপন করেছেন। এ সময় ঔরংজীবের পুত্র মুহম্মদ পিতামহের খোঁজখবর রাখতেন। মুহম্মদ অন্যত্র চলে গেলে, এক খোজা সাজাহানের দেখাশুনা করতো। খোজা, বন্দী, অসুস্থ ও অসহায় সম্রাটের সাথে ক্রীতদাসের মতো আচরণ করতো। এই দুর্গেই ১৯৬৬ সালের ২২ শে জানুয়ারি সম্রাট সাজাহান মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুপূর্বে ভ্রাতৃদ্বন্দ্বে বিজয়ী পুত্র ঔরংজীবের সাক্ষাৎ প্রার্থনা করেছিলেন সম্রাট। ঔরংজীব উপদেষ্টাদের পরামর্শে সম্রাটের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। ঔরংজীব আগ্রা দুর্গ অবরোধ করলে, সাজাহান তিনদিনের বেশি দুর্গকে রক্ষা করতে পারেননি। ঔরংজীর দুর্গে পানি সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছিলেন। শয্যাগত অসহায় বন্দীদশায় পীড়িত সম্রাট সাজাহান অপেক্ষা করেছেন মৃত্যুর। অপরদিকে ঔরংজীব ভগ্নিজাহানারার শাস্তি প্রস্তাব প্রত্যাখান করে, পিত প্রস্তাবকেও ফিরিয়ে দেন এবং ইতিহাসের এই নির্মম কাহিনীকে সযত্নে নাটকে পরিবেশন করেছেন নাট্যকার রক্ষিত সমুদয় ধনরত্ন হস্তগত করে।
দ্বিজেন্দ্রলাল রায়। সম্রাটের অসুস্থতার সূত্র ধরে চার পুত্রের মধ্যে রাজক্ষমতা দখলের হীন। ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত এবং অবশেষে সম্রাটের বন্দীদশা ও ঔরংজীবের বিজয়ই নাটকের কাহিনী অধ্যাপক সুকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় 'সাজাহান' নাটকে ব্যবহৃত ঐতিহাসিক উপাদানের একটি তালিকা প্রস্তুত করেছেন। তালিকাটি নিম্নরূপ। (১) জয়হি ও দিলীর ঘার সহযোগিতায় সোলেমান বাহাদুরপুরে সুজাকে পরাজিত করেন (১/৩)। (২) ধর্মাটের যুদ্ধে যশোবন্ত সিংহ ও কাশিম খা ঔরংজীব ও মোরাদের কাছে পরাজিত হয়। (১/২)। (৩) ২৯ শে মে আমার কাছে সামুগড়ের যুদ্ধে দারা ঔরংজীব মোরাদের কাছে সম্পূর্ণরূপে পরাজিত হন। পুরে মথুরায় ঔরংজীব মোরাদকে মদ্যপান করিয়ে অবস্থায় বন্দী করে গোয়ালিয়র দুর্গে পাঠিয়ে দেন। (২/১)। (৪) দারার পরাজয়ের আগ্রার দুর্গ ঔরংজীবের অধীনে যায় এবং মহম্মদের ওপর বন্দী সাজাহানের দেখাশোনার ভার পড়ে। (১/৭)। (৫) ওদিকে পরাজিত দারা স্ত্রীপুত্র নিয়ে রাজপুতানার কাছে। দোয়ারের দিকে পালিয়ে যান (২/৩) (৬) সোলেমান জয়সিংহ ও দিলীর খাঁর বিশ্বাসঘাতকতার জন্যে যথাসময়ে দারাকে সাহায্য করার জন্যে অগ্রসর হতে পারেননি। দারাকে আমেদাবাদে আশ্রয় দেওয়া হয় বটে কিন্তু আজমীরের কাছাকাছি দেওয়াবের যুদ্ধে দারা পরাজিত হন। আমেদাবাদের শাসনকর্তা ঔরংজীবের শ্বশুড় শাহনওয়াজ দারার পক্ষে যোগ দেন। (৩/৩)। (৭) ওদিকে সোলেমান শ্রীনগরের রাজার আশ্রয় পেয়ে সেখানে কিছুদিন থাকার পর অবশেষে গাড়োয়ালের পার্বত্য প্রদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন। তবে শেষ অবধি ঔরংজীবের হাতে বন্দী ও নিহত হন। (৮) বোলান গিরি সংকটের কাছে দাদার নামক স্থানে যাত্রার পথে নাদিরার মৃত্যু হয়। দাদারের মালিক জীহন খাঁর প্রাণ রক্ষা করেছিলেন দারা, সম্রাটের কাছে অনুরোধ করে। কিন্তু এই জীহন খাই অর্থের লোভে দারা ও তাঁর পুত্রকন্যাদের ঔরংজীবের কাছে ধরিয়ে দেয়। (৪/৩)। (৯) দারার হত্যা-দৃশ্যে বালক পুত্র সিপারকে জোর করে ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনা (১০) ঔরংজীব যখন দারার পশ্চাদ্ধবনে ব্যস্ত, সে সুযোগে সুজা আগ্রা অভিমুখে যাত্রা করেন এবং একে একে চুনার, বারানসী, এলাহাবাদ প্রভৃতি দখল করেন। খবর পেয়ে ঔরংজীব খাজোয়ার যুদ্ধে সুজাকে সম্পূর্ণভাবে পরাজিত করেন। এর আগে সুজার সঙ্গে যশো সিংহের বিশ্বাসঘাতকতার পরিচয় নাটকে পাওয়া যায় । (৩/১)। (১১) খাজোয়ার যুদ্ধের পর সুজা মুঙ্গেরে পালিয়ে আসেন (২/৪)।(১২) জয়সিংহের সহযোগিতায় ঔরংজীব যশোবন্ত সিংহকে হস্তগত করতে সমর্থ হন। যশোবস্তকে হস্তগত করার পরে ঔরংজীব দারা ও শাহনওয়াজকে পরাজিত করেন। (১৩) ৮ই জুন ১৬৫৯ সুজার শিবির যখন টুন্ডায় ছিল তখন মহম্মদ সুজার পক্ষে যোগদান করেন। কিন্তু পরে বিপক্ষে যেতে বাধ্য। হন, কারণ ঔরংজীব তাঁকে গোয়ালিয়র দুর্গে বন্দী করে রাখেন। মালদহের কাছে জুমলা সুজাকে পরাজিত করেন ও জামাতা মহম্মদ সুজার পক্ষ ত্যাগ করেন (8/১)। (১৪) সুজা প্রথমে ঢাকায় এবং পরে আরাকানে পালিয়ে যান। আরাকানে এসে তিনি
সেখানকার রাজাকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করেন। কিন্তু শেষে রাজা সুজাকে হত্যা করার চেষ্টা করেন। (৫/২)। (১৫) সুজা প্রাণভয়ে জঙ্গলে পালিয়ে যান, সেখানে মগেরা তাঁকে হত্যা করে। এর পূর্বে সোলেমান যখন পশ্চাদ্ধাবন করছিলেন, তখন খবর পেলেন ঔরংজীবের হাতে দারার শোচনীয় পরাজয় ঘটেছে। এই খবর পেয়ে তিনি সুজার সঙ্গে বৃদ্ধি করে প্রত্যাবর্তন করলেন। সোলেমানের অনুরোধে দিলীর খা যেতে রাজি হলেও জয়সিংহ রাজি হলেন না। (১/৬)। (১৬) সোলেমানের সৈন্যবল কমে যাওয়াতে এবং যাত্রাপথ অবরুদ্ধ হওয়াতে তিনি কাশ্মীরের রাজার কাছে আশ্রয় নেন। কিন্তু শেষে কিছুদিন নিশ্চিন্তে থাকার পর ঔরংজীবের অনুচরদের হাতে সোলেমান ধৃত হন। (১৭) গোয়ালিয়রের দুর্গে সোলেমানকে আফিং খাইয়ে হত্যা করা হয়। (৫/৪)। মহম্মদ সুজার পৃক্ষে যোগ দেন কারণ সুজার কন্যার সঙ্গে তাঁর প্রণয় ও পরিণয় হয়। কিন্তু ঔরংজীবের কৌশলে আবার তিনি মোগল শিবিরে ফিরে আসেন। সুজা ও পিয়ারার সংলাপের মধ্যে আমরা জানতে পারি মহম্মদ সুজাকে ত্যাগ করেছেন। মহম্মদ অপরাধের শাস্তি হিসেবে গোয়ালিয়রে বন্দী জীবন যাপন করেন। (৫/৪)। (১৮) জয়সিংহ, যশোবন্ত সিংহ ও দিলীর খার ভূমিকা, যশোবন্ত স্ত্রীর দুর্গদ্বার বন্ধ করে দেওয়া (১/৪)। (১৯) পিতার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন ঔরংজীব এবং ভগ্নি জাহানারার মধ্যস্থতায় পিতা-পুত্রের মধ্যে সমঝোতা হয়।
সাজাহান নাটকের অধিকাংশ চরিত্র এবং উপাদানই ইতিহাস থেকে সংগৃহীত হয়েছে। তবে কতিপয় চরিত্র এবং কিছু ঘটনা যে নাট্যকারের কল্পনাপ্রসূত তা নিঃসন্দেহে বলা যায়। যেমন দিলদার, মহামায়া ও পিয়ারা চরিত্র কাল্পনিক। এছাড়া সোলেমান কর্তৃক কাশ্মীরে অবস্থানকালে কাশ্মীর নর্তকীদের কাছে প্রেম নিবেদন করা অনৈতিহাসিক ঘটনা।
‘সাজাহান’ নাটক ঐতিহাসিক নাটক এ বিষয়ে কোন বিতর্কের অবকাশ নেই। কারণ ঐতিহাসিক নাটকে যা আবশ্যক বৈশিষ্ট্য তাঁর সবই পাওয়া যায়। সাজাহান নাটকের ঐতিহাসিকতা বিচারের পূর্বে জেনে নেওয়া দরকার, আমরা ঐতিহাসিক নাটক কাকে বলবো।
ইতিহাসের খ্যাতনামা কোন ব্যক্তি বা ব্যক্তিগণকে অবলম্বন করে, তার জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনাবলী অবলম্বনে ইতিহাসের পরিচিত ঘটনাবলীর সঙ্গে ইতিহাসের অকথিত ঘটনাকে কল্পনার সাহায্যে পূর্ণ করে যে কাহিনী গড়ে ওঠে, তাকেই সাধারণত ঐতিহাসিক কাহিনী বলা হয়। আবার ইতিহাসের বিশেষ কোন যুগকে অবলম্বন করে সেই যুগের আশা-আকাঙ্ক্ষা ও অন্তর্নিহিত তাৎপর্যকে যদি ঐতিহাসিক ঘটনা ও চরিত্রের সাহায্যে ফুটিয়ে তোলা যায়, যা মূল বক্তব্যের বিরোধিতা না করে পরিপূরক হয়ে ওঠে, তাকেও ঐতিহাসিকতার মর্যাদা দেওয়া হয়। আর এমন বিষয় যদি কোন নাটকে উপস্থাপিত হয় তবে তাকে ঐতিহাসিক নাটক বলা হয়।শ্রীশচন্দ্র দাশ ঐতিহাসিক মাটককে সম্ভ্রায়িত করতে গিয়ে বলেন — "ঐতিহাসিক নাটক (Historical Drama) অতীত ইতিহাসের কোন অধ্যায় অবলম্বন করিয়া লিস্থিত। ইহাতে নাট্যকার ঐতিহাসিক সত্যকে ক্ষুণ্ন না করিয়া শুধু সাহিত্যিক বা নাটকীয় প্রয়োজনানুযায়ী দুই ঘুরিটি কল্পিত চরিত্র বা কল্পিত কাহিনীর সমাবেশ করিতে পারেন। তারা হিসাবে সর্বাঙ্গ সুন্দর করিতে হইলে সমগ্র ইতিহাসকে অবিকৃতভাবে গ্রহণ” করা যায় না। শুধু লক্ষ্য রাখিত হইবে যে, অতীতের যুগচিত্র হিসাবে নাটকখানি যেন ভাবসত্যের অপলাগ না করে।"
এখানে মনে রাখা কর্তব্য, নাটকে যে ঐতিহাসিক সত্যকে উপস্থিত করা হয় তা চিরকালের সত্য হবেই এমন নিশ্চয়তা প্রদান করা অসম্ভব। কারণ আজ যা সত্য, আগামীতে তা গবেষণার ফলাফলে অসত্য হয়ে যেতে পারে। এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেন— অতীতের পটভূমিকায় মানব জীবন-সত্যকে আবিষ্কার করাই বড় কথা। ইতিহাসের ঘটনার ঘনঘটার অন্তরালে জীবনের অনাবিষ্কৃত দিকগুলিকে বিদ্যুৎচমকের দ্বারা আলোকিত করিতে পারার মধ্যেই ঐতিহাসিকতার সার্থকতা। ...সাধারণ ইতিহাসের একটি গৌরব আছে। কিন্তু স্বতন্ত্র মানব জীবনের মহিমাও তদপেক্ষা ন্যূন না। ইতিহাসের উচ্চচূড় রথ চলেছে, বিস্মিত হয়ে দেখা যায়, সমবেত হয়ে মেতে ওঠো, কিন্তু সেই রথচক্রতলে যদি একটি মানবহৃদয় পিষ্ট হয়ে ক্রন্দন করে মরে যায়, তবে সেই মর্মান্তিক আতধ্বনিও, রথের চূড়া যে গগনতল স্পর্শ করছে, সে গগন পথে উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে, হয়তো সে রথচূড়া ছাড়িয়ে চলে যায়, অর্থাৎ ইতিহাসের বিশেষ সত্য ও সাহিত্যের নিত্য সত্য যদি সমান মর্যাদায় রক্ষিত হয় তবেই কেবল ঐতিহাসিক নাটক রচিত হতে পারে।
সাজাহান নাটকে ঐতিহাসিক উপাদান ব্যবহৃত হয়েছে এবং তার একটি তালিকা পূর্বেই চয়ন করা হয়েছে। এসব ঐতিহাসিক উপাদান নাটকে নাট্যরস সৃষ্টি করেছে। অধ্যাপক সুকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন— “সাজাহান নাটকের উপাদান নিয়ে দ্বিজেন্দ্রলাল ইতিহাসকে সজীব করে তুলতে পেরেছেন। মোগল সিংহাসন নিয়ে ভ্রাতৃদ্বন্দ্ব ও কুটিল ষড়যন্ত্রের বিষবাষ্প সমগ্র ভারতবর্ষে যে প্রভাব ফেলেছিল, সেই আলোড়ন ও ভ্রাতৃদ্বন্দ্বের উত্তেজনা নাট্যকার দর্শকচিত্তে সঞ্চারিত করতে পেরেছেন। ইতিহাসের এই প্রচণ্ড তরঙ্গ বিক্ষোভকে চিত্রিত করেও মানব হৃদয়ের কতকগুলি শাশ্বত অনুভূতি দ্বিজেন্দ্রলাল নাজাহান নাটকে চিত্রিত করেছেন। এখানেই তাঁর কৃতিত্ব। শুধু ইতিহাসের তরঙ্গ বিক্ষোভ নয়, মানব হৃদয়ের সুখ দুঃখ, মিলন বিরহের নানা উত্থান-পতনের মানবিক অনুভূতির বিচিত্র চিত্র প্রকাশে সাজাহান নাটক বিশেষ যুগের ইতিহাস হওয়া সত্ত্বেও চিরন্তন মানব হৃদয়ের বাণী ধ্বনিত করেছে। তাই ইতিহাসের বহিরঙ্গিক ঘটনা প্রবাহে মানব হৃদয়ের হৃদস্পন্দন এখানে অনুভব করা যায়। ইতিহাসের সাজাহানের মধ্যে সম্রাটত্বের অস্তরালে পুত্রদ্বন্দ্বে কাতর পিতার হৃদয় ও পিতার কর্তব্য অসহায়ভাবে ঘটনার প্রবাহকে পর্যবেক্ষণ – মানুষ সাজাহানকে প্রকাশ করেছে। ইতিহাসের ঔরংজীব যতখানি নৃশংস ও মানবিক অনুভূতি বর্জিত, নাট্যকার ঔরংজীবের চরিত্রকে জীবন্ত করতে গিয়ে তাঁর মধ্যে বিবেকের দ্বন্দ্ব, অনুতাপদগ্ধ চিত্র অঙ্কিত করেছেন।
ভাষার ব্যক্তিজীবনের বেদনাদপ্ত বৃত্তান্ত, জাহানারার কঠোর কোমল হৃদয়ের উত্তাপ, সম্রাট সাজাহানের ক্রোধ ও মমতা যুক্ত হয়েছে ইতিহাসের উপাদানের সাথে। আর তাই সৃষ্টি হয়েছে মানব জীবনের চিরন্তন সত্য ও ইতিহাসের সত্যর মিশ্রণে এক সার্থক ঐতিহাসিক নাটক। ডঃ সুকুমার সেন সাজাহানকে ঐতিহাসিক নাটক হিসেবে স্বীকৃতি দিতে চাননি এবং না দেওয়ার পেছনে কোন শক্ত যুক্তিও দাঁড় করতে পারেননি। ডঃ সাধন কুমার ভট্টাচার্য অবশ্য যুক্তি দিয়ে প্রমাণ দিয়ে সাজাহানকে নাটক হিসেবে ঐতিহাসিক প্রমাণ করেছেন। এক্ষেত্রে শ্রীদেব কুমার রায় চৌধুরীর মন্তব্য উল্লেখযোগ। তিনি বলেন— "তাহার ঐতিহাসিক নাটকগুলি অতি সাবধানতার সহিত লিখিত। কোনও স্থানেই তিনি ইতিহাসকে একেবারে অতিক্রম করেন নাই। যেখানে ইতিহাসকার নীরব, মাত্র সেখানেই তাঁর মোহিনী কল্পনা অতি নিপুণতার সহিত বর্ণপাত করিয়াছে।
ট্রাজিক রসে সিক্ত সাজাহান নাটক—এ বিষয়ে কোন দ্বিমত নাই। কিন্তু মতপার্থক্য আছে ট্রাজেডির স্বরূপ নিয়ে। প্রশ্ন ওঠে নাটকে ট্রাজিডি কার এবং কেন? ট্রাজেডির ধরনটা কী? চরিত্রগত না ঘটনাগত? শ্রী নবকৃষ্ণ ঘোষ বলেন—“দারার মৃত্যুই সাজাহান নাটকের চরম ট্রাজেডি চূড়ান্ত ঘটনা। অর্থাৎ নাট্যকারের উদ্দেশ্য দারার ট্রাজেডি দেখান। এ মত গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ দারার ভাগ্য বিপর্যয়ের ওপর নাটকের মূল ঘটনাবর্ত গ্রথিত নয়।
উঃ সুকুমার সেন সাজাহান নাটকের ট্রাজেডি নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্য করেছেন। উঃ অজিত কুমার ঘোষ ঔরংজীব চরিত্রকে নাটকের সব চেয়ে সক্রিয় চরিত্র বলেছেন এবং এ চরিত্রের সামান্য অন্তর্দ্বন্দুকে ট্রাজিক রসাসিক্ত বলে মনে করেননি। জাহানারা বলিষ্ঠ চরিত্র। তিনি কোন ঘটনার জন্ম দেননি। এবং তাঁর ফল ভোগও করেননি । বস্তুত
নাটকের ট্রাজেডি ঘনিভূত হয়েছে সাজাহানের ওপর। সাজাহান নিষ্ক্রিয় চরিত্র, তাঁকে অবলম্বন করে ট্রাজেডি সংঘটিত হওয়া কতটুকু সঙ্গত—এ প্রশ্ন তুলেছেন কোন কোন সমালোচক। আমাদের মনে রাখা কর্তব্য দ্বিজেন্দ্রলালের ট্রাজেডির আদর্শ শেক্সপীয়ার সাজাহান এর সাথে একই সমান্তরালে দাঁড়িয়ে আছেন। Lear তাই King Lear যখন— বারবার আঘাতপ্রাপ্ত হচ্ছেন এবং তিনি নিষ্ক্রিয় সাক্ষী হয়ে থাকছেন তখন লক্ষ্য করলেই দেখা যায় বন্দী সাজাহানও আঘাত প্রাপ্ত হচ্ছেন এবং নিষ্ক্রিয় থাকছেন। তাঁরা উভয়েই Tragedy of Suffering বৃদ্ধ সাজাহান বাহ্য দিকে তেমন সক্রিয় নন। তাঁর অন্তরে দ্বন্দ্ব ছিল। তাঁর স্নেহের
প্রবল ধারার দুর্বলতার পথ ট্রাজেডি তরান্বিত হয়েছে। পিতা সাজাহান নিষ্ঠুর ও অন্যায়কারী পুত্রের বিরুদ্ধে কঠোর হতে পারেননি। তাঁর এই চারিত্রিক দুর্বলতার সুযোগে ট্রাজিক পরিণতি নেমে এসেছে। পিতা সাজাহান ও সম্রাট সাজাহান – দ্বন্দ্ব হয়েছে এ দু’য়ের । এ দ্বন্দ্বে ক্ষত বিক্ষত হয়েছেন সাজাহান ।
নাটকে সাজাহানের পরিণতি মৃত্যু নয়, ক্ষমার মাধ্যমে। তা হলে ট্রাজেডি কী হয়েছে—প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে। মনে রাখতে হবে মৃত্যু মানেই ট্রাজেডি নয়। আবার
মৃত্যুহীন পরিণতি ট্রাজেডি নয় এটাও ঠিক নয়। সফোক্লিসের 'রাজা ইডিপাস' নাটকে ইডিপাসের পরিণতি মৃত্যু নয়। কিন্তু মৃত্যুর জন্যে সিথাইরান পূর্বতে তিল তিল প্রতীক্ষা মৃত্যু অপেক্ষা অধিক বেদনার সাজাহানের মৃত্যু হয়নি, হলে তাঁর বেদনার সমাপ্তি হতো। তাঁকে মৃত্যুর মাধ্যমে বেদনা মুক্তির জন্যে অপেক্ষা করতে হচ্ছে। এটি কম ট্রাজেডির বিষয় নয় ।
উঃ রথীন্দ্রনাথ রায় বলেন'— “সাজাহান নাটকে সাজাহানের মৃত্যু হয়নি, এমনকি স্পষ্টত কোনো বিপত্তিজনক সমাধান হয়নি। কিন্তু তার জন্যে সাজাহান চরিত্রের ট্রাজিক ব্যঞ্জনা ক্ষুণ্ন হয়নি। সাজাহানের ট্রাজেডি বিশ্লেষণ করতে গেলে তাঁর বিভক্ত সত্তার নিম্নলিখিত পর্যায় লক্ষ্য করা যায়। ১। সম্রাট সাজাহান ও পিতা সাজাহানের দ্বন্দ্ব, ২। সাজাহানের বন্দীদশা ও ঔরংজীব সম্রাট নাম গ্রহণ করার পর সম্রাট সাজাহানের বিলুপ্তি ৩। পিতা সাজাহানের মধ্যে এবার দু'টি সব্জ প্রকাশিত হলঃ দারা, সুজা ও মোরাদের পিতা এবং তাঁদের হত্যাকারী ঔরংজীবের পিতা। ঔরংজীব যেমন তাঁর (সাজাহান) তিন পুত্রের হত্যাকারী, তেমনি তিনি পুত্র বিয়োগের বেদনায় অধীর, উন্মাদ, অন্যদিকে সেই পুত্রঘাতী পুত্র ঔরংজীবের প্রতি তাঁর পিতৃহৃদয়ের অপার মমতা রাৎসল্য বৃত্তির মধ্যে সূক্ষ্ম ভেদ সৃষ্টি করে নাট্যকার সাজাহানের বিভক্ত আত্মার আত্মক্ষয়কারী চিত্র এঁকেছেন ৷ শেষ দৃশ্যে ঔরংজীবকে মার্জনা করার সময় সাজাহানের এই বাৎসল্য বৃত্তির ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া লক্ষ্যণীয়ঃ না, আমি আর সম্রাট হয়ে বসতে চাই না। আমার সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে—এ সাম্রাজ্য তুমি ভোগ কর পুত্র ‘এ মণিমুক্তা মুকুট তোমার! আর মার্জনা! ঔরংজীব—ঔরংজীব । না, সে সব মনে করব না। ঔরংজীব! তোমার সব অপরাধ ক্ষমা করলাম। — সাজাহানের এই উক্তি নাটকের মৃত্যু পরিণাম বা বিপত্তি সমাধান থেকে অনেক বেশি মর্মান্তিক। শুধু মর্মান্তিক বা শোকাবহ বললে যথেষ্ট বলা হবে না, এই মিতাক্ষর মন্তব্যের পেছনে আছে সাজাহানের বিভক্ত আত্মার অপচয়ের বেদনা। উক্তিটির আরম্ভ হয়েছে আত্মগতভাবে—অদূরবর্তী জীবন সন্ধ্যার দিকে চেয়ে পিতার মৃত্যুবরণের নীরব প্রস্তুতি—পুত্রকে সাম্রাজ্য ও ঐশ্বর্য দিয়ে যাচ্ছেন। ঠিক সেই মুহূর্তেই মৃত পুত্রদের কথা তাঁর মনে হয়েছে— কণ্ঠস্বরে ফুটে উঠেছে জ্বালা। এই জ্বালা নিয়েই শেষ পর্যন্ত তিনি ঔরংজীবের সব অপরাধ ক্ষমা করেছেন। ঔরংজীবকে মার্জনা করার ঘটনা সাধারণ ঘটনামাত্র নয়। এ পরিণতির বাইরে মিলনের প্রলেপ থাকলেও আসলে ঐ উক্তির মধ্যে
যে সুর ধ্বনিত হয়েছে, তা মর্মান্তিক ট্রাজেডির।" ‘সাজাহান' নাটকটি বারংবার পাঠ করলে এ বিষয়টি স্পষ্ট হবে নাটকের যে বিষাদ পাঠককে সিক্ত করে তা সাজাহানের, অন্যকারো নয়। দারার বিষাদ আছে তবে তা সাজাহানের বিষাদকে গভীর করবার উপাদান মাত্র। ঔরংজীবের বিষাদ আমাদেরকে আকর্ষণ করে না। সাজাহানের মধ্যে শেক্সপীয়ারের স্বীয় দুর্বলতা জনিত বিপর্যয়কে চিত্রিত করে পাঠকের সহানুভূতিকে আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছেন নাট্যকার। সাজাহানের বিপর্যয় তাঁর চরিত্রকে গৌরবান্বিত করেছে। সাজাহানের পতন হৃদয়কে দ্বিখণ্ডিত করে দেয়, বেদনায় নীল হয়ে যায় চিত্ত। তাই তাঁর চরিত্রই নাটকের ট্রাজেডি। এবং এই ট্রাজেডি নাটকটিকে সার্থক ট্রাজিক নাটকে পরিণত করেছে।‘সাজাহান' নাটকের নামকরণ নিয়ে নানা রকম মতামত প্রচলিত আছে। কারো কারো মত নাটকটির নাম হওয়া উচিৎ ছিল ঔরংজীব আবার কেউ বলেন জাহানারা। আবার কেউ বলেছেন নাটকটির অন্তর্নিহিত তাৎপর্যকে আশ্রয় করে হলেই শ্রেয় হতো। কারণ তাদের কাছে নাটকের প্রধান চরিত্র নিয়ে সংশয় আছে। তারা সাজাহান ন ঔরংজীবকেই প্রধান চরিত্র হিসেবে গণ্য করছেন।
নামকরণের সার্থকতার সন্ধান করবার পূর্বে মিমাংসা হওয়া প্রয়োজন নাটকের প্রধান চরিত্র কে? নাটকের মূল বক্তব্য যে চরিত্রের মাধ্যমে প্রকাশিত ও উদ্ভাসিত হয় তাকেই প্রধান চরিত্র হিসেবে বিবেচনা করা হয়। যদি কোন চরিত্র সক্রিয়তার দ্বারা কাহিনীতে প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করে তারপরও সে প্রধান চরিত্র নয়। এটিই প্রচলিত মত এবং প্রতিষ্ঠিত সত্য ।
সাজাহান নাটকের বিষয়বস্তু সম্রাট সাজাহানের জীবনের শেষ আট বছরের বিষাদঘন বেদনাদায়ক কাহিনী (পিতৃ-দৃষ্টির সামনে 'পুত্রে পুত্রে সংঘাত, রক্তপাত। প্রিয় পুত্রের মৃত্যু বিদ্রোহী পুত্রের হাতে। উভয় পুত্রই সাজাহানের কাছে স্নেহাষ্পদ। কারণ তিনি পিতা—অশেষ স্নেহ তাঁর সঞ্চিত। পিতা সাজাহান ও সম্রাট সাজাহানের দ্বন্দ্বই নাটকের প্রধান কথা। বিজয় হয় শাশ্বত সত্য পিতৃহৃদয়ের পিতা সাজাহানের কাছে পরাজিত হন সম্রাট সাজাহান।
বাহ্য দিকে ঔরংজীব সক্রিয় এবং সাজাহান নিষ্ক্রিয় চরিত্র। তবে নাটকের মূল বক্তব্য উপস্থাপনে আশ্রয় করতে হয়েছে সাজাহানকে। আর সে বিবেচনায় অবশ্যই কেন্দ্রীয় চরিত্র সাজাহান। সাজাহানের নামানুসারেই নাটকের নামকরণ করা হয়েছে আর সেটাই সঙ্গত ।
(ঝ)
বাংলা নাটকে সংগীত সংযোজন প্রবণতা লক্ষ্য করা যায় নাটকের সূচনা কালেই। প্রাথমিক অবস্থায় যাত্রার ঢঙে গান যুক্ত হতো। পরবর্তিতে ভাবুকে আশ্রয় করে নাটকের স্বার্থেই সংগীতের ব্যবহার শুরু হয়। সুকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন—“নাটকে সংগীত উপস্থাপনার কতকগুলি বিশেষ সার্থকতা আছে। প্রথমত, কোন শ্বাসরুদ্ধকারী বা ট্রাজিক ঘটনার পর বিরতির জন্যে (dramatic relief) বা দর্শকের মানসিকতাকে চিন্তা করবার অর্থাৎ দম নেবার কিছু অবকাশ দেবার জন্য নাটকে সংগীতের প্রয়োজন ঘটে। এ ধরনের গান অনেক ক্ষেত্রেই নিছক প্রমোদমূলক হয়। দ্বিতীয়ত, নাটকীয় চরিত্রের অন্তর্নিহিত অনেক তাৎপর্য সংগীতের মধ্য দিয়ে ফুটিয়ে তোলা সম্ভব। তৃতীয়ত, সংগীতের সাহায্যে নাটকীয় পরিস্থিতি ও ঘটনাকেই ব্যক্ত করা সম্ভব (চতুর্থত, নাটকের মধ্যবর্তী অনেক ঘটনাবলী যার উপস্থাপনা নাটকে হয়ত নেই, নাট্যকার সংগীতের মধ্য দিয়ে সেই অদৃশ্য ঘটনাবলী জানিয়ে দেন বা পুর্বে ঘটে যাওয়া ঘটনার উল্লেখ এই সংগীতের দ্বারাও সাধিত হতে পারে। পঞ্চমত, পাত্রপাত্রীর মানসিক দ্বন্দ্ব, আবেগ উচ্ছ্বাস, আনন্দ-দুঃখ ইত্যাদি অনুভূতি যা স্বগতঃ উক্তির দ্বারা কিছুটা প্রকাশিত হতে
পারত, তা আরও সুষ্ঠুভাবে প্রকাশিত হয় সংগীতের মাধ্যমে।" নাটকে তাই সংগীতের উপস্থাপনা বিশেষ অর্থবহ না হয়ে নিতান্তই যদি
আনন্দদানের জন্যে হয়, যার সঙ্গে নাটকের কোন ভাবেই কোন যোগ নেই, তবে তা নিতান্তই নাটকীয় ত্রুটি। ঐ ধরনের সংগীত বাহুল্য আমরা পুরনো দিনের যাত্রার মধ্যে লক্ষ্য করি। কারণ আমরা জানি, নাটকে সংগীত শুধু চিত্তবিনোদনের জন্য নয়। তা ঘটনার গতি প্রকৃতির আভাস দেয় চরিত্রের মানসিকতাকে ব্যক্ত করে, নাট্যকারের উদ্দেশ্যকে প্রকাশ করে। অবশ্য একথা ভুললে চলবে না, সে ক্ষেত্রেও সংগীতকে পরিবেশগত সামঞ্জস্যকে বজায় রাখতে হবে।"
নাটকে সংগীত ব্যবহারে নাট্যকারকে অবশ্যই লক্ষ্য রাখতে হয় কাব্যমূল্য ও নাট্যমূল্যের দিকে। সংযোজিত সংগীতটির কাব্যমূল্য যথার্থ কিনা এবং নাটকে তাঁর আবশ্যিকতা কিনা। সাজাহান নাটকে ব্যবহৃত নয়টি সংগীত কাব্যমূল্য ও নাট্যমূল্যে সার্থক। এই নয়টি গানের মধ্যে দুটি বৈষ্ণব কবি জ্ঞানদাস ও চণ্ডীদাস রচিত ] বাকী সাতটি দ্বিজেন্দ্রলালের রচনা। পাঁচটি গান গীত হয়েছে পিয়ারার কণ্ঠে যার দুটি বৈষ্ণব গীতি । মহামায়ার চারণী ও চারণ বালকরা গায় দুটি মোরাদের নতকীগণ গায় একটি এবং কাশ্মীরের প্রমোদ উদ্যানে রমণীগণ কর্তৃক গীত হয় একটি। ‘সাজাহান' নাটকে ব্যবহৃত গানগুলির মূল্যায়ন করলেই অনুধাবন করা যাবে এর যৌক্তিকতা ও সার্থকতা।
এ জীবনে পুরিল না সাধ ভালবাসি।
ক্ষুদ্র এ হৃদয় হায় ধরে না ধরে না তার আকুল অসীম প্রেমরাশি।'
নাটকের প্রথম অঙ্ক তৃতীয় দৃশ্যে গীত হয়েছে সুজার স্ত্রী পিয়ারার কণ্ঠে। নায়িকার হৃদয়ের অতৃপ্ত প্রেম বাসণ, বাস্তব জীবনের সীমাকে অতিক্রম করে প্রেমের এক নিবিড় অনুভূতিতে অসীমে বিলীন হতে চায়। পিয়ারা ও সুজার মধ্যে গভীর প্রেম থাকা সত্ত্বেও, বিরাজমান দূরত্বকে নির্দেশ করা হয়েছে এখানে।
২. ‘সেখা গিয়াছেন তিনি সমরে, আনিতে জয় গৌরব জিনি
সেথা গিয়াছেন তিনি মহা আহবানে মানের চরণে প্রাণ বলিদানে,
মধিতে অমর মরণ সিন্ধু আজি গিয়েছেন তিনি।'
প্রথম অংক চতুর্থ দৃশ্যে মহামায়া ও চারণীগণ কর্তৃক গীত হয়। যুদ্ধের বর্ণনায় ও দৃঢ় মানসিকতার প্রকাশে অনন্য এ সংগীত। রাজপুত রমণীদের বীররসে ভাস্বর এ গান। ৩। 'আজি, এসেছি—আজি এসেছি, এসেছি বঁধু হে
নিয়ে এই হাসি, রূপ গান ।
আজি, আমার যা কিছু আছে, এনেছি তোমার কাছে
তোমায় করিতে সব দান।
দ্বিতীয় অঙ্ক প্রথম দৃশ্যে গীত হয়েছে নর্তকীদের দ্বারা মোরাদকে বন্দী করার পূর্ব মুহূর্তে গাঁত এই সংগীতটি একটি বিখ্যাত প্রেমসঙ্গীত। মানুষের শাশ্বত বাসনালোকে যে অর্ধ জাগরিত মুহূর্তের সৃষ্টি হয়, তারই প্রকাশ ঘটেছে এখানে।
" সুখের লাগিয়া এ ঘর বাঁধিনু |
অনলে পুরিয়া গেল""
দ্বিতীয় অঙ্কের চতুর্থ দৃশ্যের সূচনায় পিয়ারা বৈষ্ণব পদাবলীয় এ প্রসিদ্ধ সংগীতটি জ্যোত্স্না রাতে গেয়েছেন। সুজার সংসারে আসন্ন বিপর্যয়ের ধারতাকে প্রকাশ করতে
গীত হয়েছে। 'আমি সারা সকালটি বসে বসে এই সাধের মালাটি গেঁথেছি।
আমি পৱাৰ বলিয়ে তোমারি গলায় মালাটি আমার গেঁথেছি। তৃতীয় অঙ্কের দ্বিতীয় দৃশ্যে বিজুয়ায় সুজার শিবিরে সন্ধ্যাবেলা পিয়ারা কণ্ঠে গীত হয় গানটি। পিয়ারা মালা হাতে নিয়ে মানচিত্র দেখতে ব্যস্ত সুজার কাছে আসেন এবং মালা সুজার গলায় পরিয়ে দেন গান গাইতে গাইতে পিয়ারা মালা পরিয়ে দেন। প্রকৃতির মায়াঘন পরিবেশে প্রেম নিবেদনের প্রকাশে এই গানটি সংযোজিত হয়েছে । ৬। তুমি বাঁধিয়া কি দিয়ে রেখেছ হৃদি এ
(আমি) পারি না যেতে ছাড়াতে, এ যে বিচিত্র নিগূঢ় নিগড় মধুৱ—
(কি) "প্রিয় বাঞ্জিত কারা এ।" তৃতীয় অঙ্কের দ্বিতীয় দৃশ্যে পিয়ারা কণ্ঠে গীত হয় এ গান প্রেমিকার আত্মসমর্পণ ও আত্ম নিবেদনের পরম তৃপ্তি প্রকাশ করা হয়েছে এ সংগীতে।
৭। 'বেলা বয়ে যায়
ছোট্ট মোদের গানসী তরী সঙ্গেতে কে যাবি আয়।"
তৃতীয় অঙ্কের চতুর্থ দৃশ্যের গান এটি। কাশ্মীরের মহারাজা পৃথ্বীসিংহের প্রমোদোদ্যানে সন্ধ্যায় সোলেমান একাকী পায়চারি করেছেন। তখন একটা সজ্জিত নৌকায় রমণীগণ গাইতে গাইতে নৌকা নিয়ে এসেছে কাছে প্রণয় নিবেদনের ভাব
প্রকাশার্থে গীত হয় গানটি।
৮। 'ধনধান্য পুষ্পভরা আমাদের এই বসুন্ধরা
তাহার মাঝে আছে দেশ এক সকল দেশের সেরা"
তৃতীয় অঙ্কের ষষ্ঠ দৃশ্যে চারণ বালকগণের কণ্ঠে গীত হয় এই দেশাত্মবোধক
গানটি । মহামায়া চরিত্র পরিকল্পনায় রাজপুত রমণীদের বীররসকে প্রকাশ করার জন্যে গানটি সংযোজিত হয়েছে। এছাড়া এ গানের মাধ্যমে হ্রদেশপ্রীতির উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করা হয়েছে। সর্বকালের সর্বদেশের সকল মানুষকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করতে - এ গানের তুলনা নেই।
সই কেৱা শুনাইল শ্যাম নাম! কানের ভিতর দিয়া মরমে পশিল গো
আকুল করিল মোর প্রাণ।
চতুর্থ অঙ্কের প্রথম দৃশ্যের সূচনাতে, টান্ডায় সুজার প্রাসাদ কক্ষে সন্ধ্যা বেলায় পিয়ারা কণ্ঠে এ গানটি গীত হয়। বৈষ্ণব পদাবলীর উল্লেখযোগ্য এ সঙ্গীতটি দিয়ে অনুরাগমুগ্ধা পিয়ারার রমণীচিত্তের ব্যকুলতা ব্যঞ্জিত হয়েছে। প্রেমপূর্ণ হৃদয় নিয়ে,
প্রেমিক স্বামীকে অনুভব করার প্রবণতা প্রকাশিত হয়েছে এখানে। সাজাহান নাটকে ব্যবহৃত গানগুলি নিয়ে সমালোচকগণ অভিযোগ তুলেছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য দুটি অভিযোগ হচ্ছে— বৈষ্ণব পদাবলীর গান ব্যবহার রাজপুতদের ধানক্ষেত বর্ণনা। বলা হয়, মুসলিম হারেমে বৈষ্ণৰ সঙ্গীত সঙ্গত আমাদের মনে রাখতে হবে, স্বীয় ধর্মের প্রতি প্রবল অনুরাগ থাকা সত্ত্বেও মধ অনেক মুসলমান বৈষ্ণব পদাবলী রচনা করেছেন এবং তাদের কণ্ঠে গী পদাবলী। এছাড়া সুজা প্রায় বিশ বছর বাংলায় ছিলেন। সে সময় বৈষ্ণব সঙ্গীত বাং সর্বধর্মের মানুষের কাছেই জনপ্রিয় ছিল এবং সুজা সঙ্গীত অনুরাগী ছিলেন। ফলে বেগম কণ্ঠে বৈষ্ণব সঙ্গীত অস্বাভাবিক মনে করা যায় না।
অবশ্য রাজপুতদের মধ্যে দেশপ্রেম ছিল প্রবল। সেখানকার চারণ বাল দেশের বন্দনায় নানারকম সঙ্গীত পরিবেশন করতো, তবে সে সঙ্গীতে হরিৎজে আকাশ তল, ধানের ওপর ঢেউ খেলে যায় বাতাস' ইত্যাদি উপমাকে অসঙ্গত মনে হ পাহাড় ধূম্ৰ বর্ণনাকে অসঙ্গগত মনে না হলেও বাকীটাকে রাজপুতদের দেশ বলে হয় হয় না। মনে হয় বাংলাদেশ। বস্তুত বাংলাই দ্বিজেন্দ্রলালের সঙ্গীতে ভর করেছে পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষিত হয়নি। তারপরও বলা যায়, সাজাহান নাটকে ব্যবহা সঙ্গীত যথেষ্ট মুন্সীয়ানায় প্রতিষ্ঠিত ।
সাজাহান নাটকের নাট্যকার দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, কিন্তু নাটক পাঠ করলে প্রায়ই ভ্রম হচ্ছে পারে যে, নাট্যকার যতটা উপস্থিত তার চেয়ে অধিক উপস্থিত কবি। এটি মনে হবর কারণ তাঁর ভাষা। অলংকারে সজ্জিত আবেগময় ভাষায় নাটকের সংলাপ বারবার এখানে উচ্চারিত হয়েছে। এ ক্ষেত্রে তিনি Shakespeare, carlyle, schillen Lessing, Ibsen, Moliere ও বঙ্কিমচন্দ্র দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। যার কারণে তাঁর ভাষা আকৃতিতে গদ্য হলেও প্রকৃতিতে কবিতা। মূলত দ্বিজেন্দ্রলাল দু-ধরনের সংলাগ ব্যবহার করেছেন—গদ্যসংলাপ ও কাব্যসংলাপ। তাঁর কাব্য সংলাপের ভাষা সাধারণ কথোপকথনের সময় অসংগত মনে হয় এবং গদ্যভাষা প্রাত্যহিক জীবনের আটপৌরে গদ্য নয়। অলংকার ভারে আক্রান্ত। নাটকে কাব্যগুণ থাকা অস্বাভাবিক নয় কিন্তু যদি নাট্যগুণকে অস্বীকার করে মাত্রাতিরিক্ত ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠে তা হলে নাটক দু হয়ে যায় ।
দ্বিজেন্দ্রলাল উপমা-উৎপ্রেক্ষা দিয়ে চিত্রধর্মীতার সৃষ্টি করেছেন নাটকে। সংক্ষিপ্তরূপের ক্রিয়াপদ ব্যবহার করলেও তাঁর গদ্য ওজনহীন নয়। তৎসম শব্দবহুল সমাসবদ্ধ শব্দ আধিক্য তাঁর ভাষাকে সাধুভাষার কাছাকাছি নিয়ে গেছে। ডঃ রথীন্দ্র রায় বলেন — “দ্বিজেন্দ্রলালের গদ্যে কাব্যধর্মীতার সঙ্গে ওজোগুণের সমন্বয় ঘটেছি তাঁর নাটকের মঞ্চ সাফল্যের অন্যতম কারণ, এই ঐশ্বর্যশালী দৃপ্ত ভাষা। তাঁরা সংলাপ তীব্র অন্তর্দাহ, উচ্ছ্বসিত হৃদয়াবেগ ও মর্মভেদী শোকোচ্ছ্বাস প্রকাশ কর উপযুক্ত ভাষা। তাই চরিত্রের ঘাত প্রতিঘাত ও হৃদয়বৃত্তির আলোড়ন ফুটিয়ে তুলতে ভাষার উপযোগিতা অস্বীকার করা যায় না। শব্দ-সংস্থানের কৌশল, পদ বিন্যা রীতি ও আলংকারিক কারুকার্য নাটকীয় সংলাপের মধ্যে এক সাংগীতিক মূর্ছনার সৃষ্টি করেছে।... দ্বিজেন্দ্রলাল যেন ক্ষণিকের জন্যে ভুলে যান একা নয়, নাটক। তাছাড়া এই বিশিষ্ট রীতিটি ভিন্ন আর কোন ভঙ্গি তাঁর সংলাপে রূপায়িত হয়ে ওঠেনি। কিন্তু একই ভঙ্গি যত্রতত্র প্রয়োগ শেষ পর্যন্ত মুদ্রাদোষে পরিণত হয়। তা ছাড়া কাটাকাটা রেজী ঘেঁষা সংলাপ অনেক সময় শ্রুতিকটু হয়েছে... এই জাতীয় অসমাপ্ত কাটাকাটা বাক্যাংশের অতিরিক্ত প্রয়োগ অনেক সময় সংলাপকে অস্বাভাবিক করে তুলেছে। দ্বিজেন্দ্রলালের কাব্যধর্মী অলংকার বহুল সংলাপের মধ্যে এটি হল একটি প্রধান ত্রুটি।”
"ভাষা প্রয়োগের ক্ষেত্রে তিনি সর্বত্র সামঞ্জস্য রক্ষা করতে পারেননি। চরিত্র ভেদে ভাষার বিভিন্নতাই স্বাভাবিক কিন্তু তিনি তা দিতে ব্যর্থ হয়েছেন। যার কারণে সাজাহান, জাহানারা, জহরত সবার ভাষাই এক রকমের। এছাড়া এ ভাষা অনুভূতির সূক্ষ্ম দিক প্রকাশে যথাপোযুক্ত বলে মনে হয় না। এ ভাষা অনেক ক্ষেত্রেই নাট্যধর্মকে বিঘ্নিত করেছে।
ভাষার ক্ষেত্রে দ্বিজেন্দ্রলালের সার্থকতা যেমন আছে তেমনি অসফলতাও আছে। তবে সংলাপ রচনায় তাঁর মৌলিকত্ব অনন্য। তিনি স্বগতোক্তি বর্জন করেছেন। কোন চরিত্রের মানসিক দ্বন্দ্ব প্রকাশ করতে গিয়ে, চরিত্রটিকে একাকী মঞ্চে উপস্থিত করেছেন। চরিত্র আপন মনে কথা বলেছে। সাজাহান, ঔরংজীব, দিলদার, সোলেমান, জয় সিংহ চরিত্রের সংলাপে বিষয়টি প্রকাশিত হয়েছে। তিনি Shakespeare এর গুণমুগ্ধ অনুসারী হলেও Shakespeare এর স্বগতোক্তি পদ্ধতি গ্রহণ না করে একক ভাষণ জাতীয় পদ্ধতি ব্যবহার করেছিলেন। তিনি প্রথম বাংলা নাটকে স্বগতোক্তি বর্জন
‘সাজাহান’ নাটকে হাস্যরসের অভাব লক্ষ্য করা যায়। দিলদার ও পিয়ারা চরিত্রের মাধ্যমে যেটুকু প্রকাশ পেয়েছে তা খুবই সামান্য। সুকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন-" দিলদারের হাস্যরস ব্যঙ্গ নিপুণ অর্থবহ। নিছক হাস্যরস সৃষ্টির জন্যে দিলদার লঘু আচরণ করেন। দিলদার শ্রেণীর চরিত্রকে দিয়ে যথার্থ হাস্যরস সৃষ্টি করা যায় না। দিলদারের আচরণ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। নিজে বোকা সেজে মোরাদের নির্বুদ্ধিতাকে দিলদার যে ভাবে ব্যঙ্গ করেছেন, মোরাদকে সচেতন করে দেওয়ার জন্য তাঁর যে প্রয়াস তা ঔরংজীবের দৃষ্টি এড়াতে পারেনি। তাই লঘু সংলাপের দ্বারা দিলদার যতই রসিকতা করুন না কেন, তা নির্মল হাস্যরস হয়ে উঠতে পারেনি। প্রথম সাক্ষাতে দিলদার নিজের পরিচয় দিয়েছেন। আমি মুখে মোরাদের বিদূষক, আমি হাস্য পরিহাস করতে যাই— সে ব্যঙ্গের ধুম হয়ে ওঠে। মুর্খ তা বুঝতে পারে না। আমার উক্তি অসংলগ্ন মনে করে হাসে। এবং তাঁর শেষ আত্মপ্রকাশে দিলদার সত্যরূপে প্রকাশ পেয়েছেন। সুতরাং দিলদারের যা কিছু সংলাপ তা যতই হাল্কা বলে মনে হোক, তা যথার্থ অতখানি নির্মল নয়। এ প্রসঙ্গে মোরাদের সঙ্গে তাঁর নানা ধরনের ব্যঙ্গ নিপুণ সংলাপের কথা স্মরণ করা যেতে পারে। সেদিক দিয়ে বরং পিয়ারা চরিত্রটি এই শ্বাসরুদ্ধকারী ভ্রাতৃদ্বন্দ্বের গুরুগম্ভীর পরিবেশে একটুখানি অবকাশ নেবার মাধ্যম। প্রেমময়ী পিয়ারা সংগীতে কৌতুকে সুজার জীবনকে ভরিয়ে রেখেছেন। পিয়ারার হাস্য-পরিহাস নিতান্তই হাস্যরস সৃষ্টির প্রয়াস, কোনো বিশেষ উদ্দেশ্য প্রণোদিত নয়। ফলে হাস্যের এই সজীবতা পিয়ারাকে যেমনদুঃখ জয়ের শক্তি দিয়েছে, তেমনি দর্শকও প্রসন্নচিত্তে পিয়ারার লঘু পরিহাসকে উপভোগ করেছে। পিয়ারার সংলাপে দর্শকচিত্ত হাস্যে উচ্চকিত হয়ে ওঠে না, পিঁ হাস্যের প্রসন্নতায় দর্শক সত্যকার Dramatic relief বোধ করে।"
সাজাহান নাটক ভাষায় যেমন ভারাক্রান্ত সংলাপে তেমন প্রাঞ্জল। লক্ষ্যণীয় বিষয় হাস্যরসের সীমাবদ্ধতায় নাটকটি নীরস হতে পারতো কিন্তু নাট্যকারের রচনারীতি সংলাপের চাতুর্যে তা হতে পারেনি। অবশ্য সম্রাটের অসহায়ত্ব ভ্রাতৃসংঘাত, নির্মমতা ও ষড়যন্ত্র নাটকটিকে গুরুগম্ভীর করে রেখেছে রেখেছে বেদনায় আচ্ছন্ন করে। ফলে কখনো কখনো পাঠক বা দর্শকের মধ্যে স্থবিরতা এসে পড়ে।
সাজাহান নাটকে মুখ্য চরিত্র সংখ্যা নারী-পুরুষ মিলিয়ে যোল । এর মধ্যে পুরুষ চরিত্র এগার এবং নারী চরিত্র পাঁচ। এ ছাড়া আছে একদল চারণ বালক ও নর্তকীবৃন্দ। প্রধান ও অপ্রধান মিলিয়ে যে সব চরিত্র নাটকে আগমন করেছে তাদের একটি সক্রিয় ভূমিকা কাহিনীতে আছে। সাজাহান নাটকে নাট্যকার এমন কোন চরিত্র সৃষ্টি করেন নি যার প্রয়োজন ছিল না। কোন কোন সমালোচক দিলদার চরিত্রকে অবাঞ্চিত বলে বিবেচনা করেছেন। কিন্তু নাটকে Dramatic relief এর স্বার্থে দিলদারের প্রয়োজন ছিল। নতুবা সাজাহান নাটকটি সাধারণের বোধের বাইরে চলে যেত।
“সাজাহান নাটকের প্রধান চরিত্র সম্রাট সাজাহান। বিশাল মোগল সাম্রাজ্যের অধিপতি, পরাক্রমশালী ও অনন্ত প্রেমিক সাজাহান। নাটকের সূচনাতেই তিনি পুত্রদের মধ্যে উত্তরাধিকার নিয়ে দ্বন্দ্বের ও সংঘাতের কথা শ্রবণ করেছেন। তাঁর চিত্ত অস্থি হয়েছে, আহত হয়েছে। নাটকের শেষ দৃশ্য পর্যন্ত তাঁর এই আহত চিত্তের বেদনার লাঘব হয়নি। তাই মনে হয় সাজাহান স্বয়ং যেন বেদনার আরেক নাম।
অভিযোগ আছে সাজাহান দ্বন্দ্বহীন চরিত্র। কিন্তু নাটকে দেখা যায় সম্রাট সাজাহান ও পিতা সাজাহানের দ্বন্দুই কাহিনীর প্রাণ। এ দ্বন্দ্বের পথ ধরে এগিয়েছে সকলে। একদিকে পুত্র দারার প্রতি প্রবল স্নেহ অপরদিকে বিদ্রোহী পুত্রদের প্রতি দুর্বলতা। সাজাহান বলেন—“ঈশ্বর পিতাদের এই বুকভরা স্নেহ দিয়েছিলে কেন? কেন তাদের হৃদয়কে লৌহ দিয়ে গড়নি?” অন্যত্র সাজাহান বলেন— “বেশ, তাই হোক! তারা জানুক যে সাজাহান শুধু পিতা নয়, সাজাহান সম্রাট |” সাজাহান পিতৃত্বের স্নেহবাধ অতিক্রম করে সম্রাট হতে চান কিন্তু পরক্ষণেই আবার স্নেহশীল পিতা চরিত্রে আর্বিভূত হন। তিনি বলেন- – Jএ শাস্তি তাদের একার নয়, এ শাস্তি আমারও। পিতা যখন পুত্রকে শাসন করে, পুত্র ভাবে যে পিতা কি নিষ্ঠুর। সে জানে না যে পিতার উদ্যত বেত্রের অর্ধেকখানি পড়ে সেই পিতারই পৃষ্ঠে। রাজ্যশাসনের স্বার্থে পিতা যতই নির্মম ও নিষ্ঠুর হতে চান না কেন পিতৃত্বের বাঁধন তিনি ছিন্ন করতে পারেন না। যার কারণে নাটকে সাজাহানকে পাওয়া যায় আত্মদ্বন্দ্বে পরাভূত সম্রাট সাজাহান রূপে এবং সে রূপকে ম্লান করে আবির্ভূত হন পিতা সাজাহান।
পুত্র ঔরংজীব রাজনৈতিক কৌশল প্রয়োগ করে ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করে শঠতা ও প্রতারণা করে ভাইদের পরাজিত ও হত্যা করেছেন। সাজাহান পুত্র হত্যা সংবাদ প্রবণ করে ব্যথিত হয়েছেন। কিন্তু অবাধ্য পুত্র ঔরংজীবের বীরত্বে গর্ববোধ করেছেন। তাই আহত পিতৃহৃদয় ও গৌরবান্বিত পিতৃহৃদয়ে সাজাহান অস্থির হয়েছেন। তাঁর Bত্তমাঝে এই মিশ্র প্রতিক্রিয়ায় দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়েছে। তিনি অনায়াসে সরল বিশ্বাসে লেছেন- আসুক সে, আমি তাঁকে স্নেহ দিয়ে বশ করব। মূলত; কঠিন সত্যের মুখোমুখি হয়ে তিনি কখনো উত্তপ্ত রুদ্র আবার কখনো বিনীত অনুরোধের সাহায্যে স্বীয় অক্ষমতার ক্ষোভে আত্ম পীড়ন করেছেন। অনেক সময় হতাশাগ্রস্ত হয়ে আবার ঝলসে উঠবার অঙ্কুম ক্রোধ প্রকাশ করেছেন। এসব ঘটেছে প্রিয় পৌত্র মহম্মদের কাছে বন্দী থাকার সময়। তাই সাজাহান বলেন— “আমি আজ শীর্ণ, পক্ষাঘাতে পঙ্গু বটে, কিন্তু সম্রাট সাজাহান এ ভারতবর্ষ এতদিন ধরে এমন শাসন করে এসেছে যে, যদি একবার তার সৈন্যদের সম্মুখে খাড়া হয়ে দাঁড়াতে পারে, তা হলে শুদ্ধ তাদের মিলিত অগ্নিময় দৃষ্টিতে শত ঔরংজীব ভষ্ম হয়ে পুড়ে যাবে। আমি স্বয়ং সম্রাট সাজাহান...এ বাতুলের প্রলাপ নয় ।... পিতা সব, আর নিজে না খেয়ে পুত্রদের খাইও না, বুকের উপর রেখে ঘুম পাড়িও না, তাদের হাসিটি দেখার জন্যে স্নেহের হাসিটি হেসো না। তাঁরা সব কৃতঘ্নতার অঙ্কুর, তাঁরা সব শিশু শয়তান। তাদের আধপেটা খাইয়ে মানুষ কোরো, তাদের সকালে বিকালে জোরে কশাঘাত কোরো, তাদের সারাজীবনটা চোখ রাঙ্গিয়ে শাসিয়ে রেখো.....তাদের এই শাস্তি দিতে যদি তোমাদের বুকে ব্যথা লাগে তো বুক ভেঙ্গে ফেলো, চোখে জল আসে তো চোখ উপড়ে তুলে ফেলো, আর্তনাদ করতে ইচ্ছে হয় তো নিজের টুটি চেপে ধরো।" বিনাশ আর প্রতিষ্ঠার মধ্যে দ্বন্দ্ব ছিল তাঁর ভেতর, তাই আত্ম শাসনের নামে স্বীয় অকৃত্রিম স্নেহকাতরতাই প্রকাশ করেছেন।
নাটকে সাজাহান চরিত্রের সম্রাটত্বের মহিমা ও বিশ্বাস ভেঙ্গে গেছে। তিনি নিঃস্ব হয়ে গেছেন। তিনি বিশ্বাস হারিয়েছেন সংসারের প্রতি; এমনকি ঈশ্বরের প্রতিও খানিকটা। নাটকের শেষ দিকে তিনি বিকারগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। তাঁর পেছনে কারণ দ্বৈত সত্তার তীব্র দ্বন্দ্বের পরিণতি। এ দ্বন্দ্বের জন্যে তিনি মৃত্যুকে কামনা পর্যন্ত করেছেন। আবার ঔরংজীব তাঁর কাছে ক্ষমা চাইলে, তাঁকে ক্ষমা করে দেন। এই ক্ষমার মাধ্যমে সাজাহানের যেমন গভীর মমতা প্রকাশ পায় তেমনি জীবনের শেষ বেলার অবলম্বন সন্ধানও প্রকাশ করে । বস্তুতঃ আত্মদ্বন্দ্বে সাজাহানের সূচনা আর পরিণতিও আত্মদ্বন্দ্বে
ঔরংজীব 'সাজাহান' নাটকের প্রতিনায়ক ও প্রধান চরিত্র। তিনি মেধার বলে রাজ ক্ষমতা অধিকার করেছিলেন। সুকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন—“রাজনীতি সম্পর্কে তাঁর জ্ঞান, কূটনৈতিক কলাকৌশল ও অভিজ্ঞতা তাঁর করায়ত্ত শক্তির চেয়েও ছলে বলে কৌশলে স্বার্থসিদ্ধি করাই তাঁর একমাত্র লক্ষ্য। কপটতা, মিথ্যাচারিতা কিছুই তাঁর কাছে পরিত্যাজ্য নয়। যশোবন্ত সিংহের অধীনস্থ মোগল সৈন্যদের ধর্মের দোহাই দিয়ে তিনি যেমন বশ করে যুদ্ধে জয়লাভ করেছেন, সেই ভাবেই নানা কৌশলে তিনি একটার পর একটা যুদ্ধে জয়ী হয়েছেন । লোক চরিত্র সম্পর্কে তাঁর এমনই একটি অন্তর্দৃষ্টি ছিল যে,
ডন সহজেই মানুষের মনোভাব টের পেতেন। এই অসাধারণ দক্ষতা, বুদ্ধি, বিচ
বিশ্লেষণ শক্তি থাকার জন্যই তিনি তাঁর উদ্দেশ্য সম্পর্কে কখনও নিষ্ফল হন নি। কার্যোদ্ধারই ছিল তাঁর লক্ষ্য। যে কোন উপায়ই তাঁর জন্য গ্রহণীয় বলে তিনি মনে করতেন। নিজের প্রতি বিশ্বাস এবং দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার দক্ষতা থাকায় ঔরংজীব নান জটিল সমস্যার মধ্য দিয়েও নিজেকে কাটিয়ে তুলতে পেরেছেন।”
‘সাজাহান' নাটকে ঔরংজীব চরিত্র বিকশিত হয়েছে নেতিবাচক বৈশিষ্ট্য নিয়ে। নীতিবোধহীন স্বার্থাদ্ধ ও দুর্ধর্ষ রাজনীতিক হিসেবেই তিনি অধিক স্বীকৃত। সুরা পা করিয়ে বন্দী করেছেন মোরাদকে, ক্ষমতার লোভে মক্কা যাত্রার ভান করেছেন অনায়াসে, অর্থাৎ ধর্মকে রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে নিজেকে নিষ্কণ্টক রাখতে প্রয়াস পেয়েছেন। সুরলতার, স্থিরতার, মধুরতার ও সদাহাস্যের বাহ্য আবরণের অন্তরালে তাঁর ছিল ক্রুর, পাষণ্ড ও বিষাক্ত রূপ | ডঃ সাধন কুমার ভট্টাচার্য বলেন “নিয়তির মত কঠিন, হিংসার মত অন্ধ এবং শয়তানের মত ক্রুর না হইতে পারিলে নাকি ঔরংজীবের সমকক্ষ হওয়া যায় না।
ঔরংজীব চরিত্রে যেমন নেতিবাচক বৈশিষ্ট্য প্রকট তেমনি ইতিবাচক বৈশিষ্ট্যঙ লক্ষ্যণয়। তাঁর ভেতর দ্বিধা ও দ্বন্দ্বও দেখা যায়, দারার মৃত্যুদণ্ডকে ঘিরে বিবেকের সামান্য প্রকাশ লক্ষ্য করা যায়, সুজার মৃতদেহ ও মোরাদ প্রশ্নে তাঁর চিত্ত চাঞ্চল্য ও ভ্রাতৃপ্রেমের ক্ষীণ লক্ষণ তাঁকে মানবিক চরিত্র হিসেবে প্রকাশ করলেও, পাঠক সহানুভূতি তিনি কখনোই পান না।
অধ্যাপক সুকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন— “সমগ্র নাটকের চরিত্রগুলি বিশ্লেষণ করলে আমরা লক্ষ্য করি ঔরংজীব সর্বাপেক্ষা সজীব চরিত্র। তাঁর শঠতা কপটতা আমাদের সহানুভূতি আকর্ষণ না করতে পারে, কিন্তু তাঁকে রক্তমাংসের জীবন্ত গতিশীল মানুষ রূপে গড়ে তুলেছে। ঔরংজীবের প্রত্যেক আচরণ ও কথাবার্তা সুনিয়ন্ত্রিত ও পরিমিত যে তা আবেগ বর্জিত, বাহুল্য বর্জিত। জাগতিক ভোগের প্রতি ঔরংজীবের সংযম ইতিহাস স্বীকৃত। ফলে নারী ও সুরা ঔরংজীব নিজে স্পর্শ না করলেও রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে সহজেই ব্যবহার করে মোরাদকে খতম করেছেন। তাঁর অভিধানে স্বার্থসিদ্ধির জন্য মন্দকর্ম বলে কিছু নেই। সিংহাসন লাভের পথে যে কোন বাধাকে সরাতে যে কোন পন্থা অবলম্বনে ঔরংজীব রাজি। মক্কার প্রতি আসক্তি যেমন তাঁর আন্তরিক নয়, তেমনি সিংহাসন লাভ করে তিনি নিজের ব্যক্তিসত্তার প্রতিষ্ঠা চেয়েছেন। তাঁর রাজনৈতিক জ্ঞানের পরিতৃপ্তি ঘটেছে, কিন্তু জাগতিক ভোগের প্রতি অনীহা তাঁর মত চরিত্রে বিস্ময়কর ব্যতিক্রম।”
ঔরংজীব সকল বিষয়েই সংশয়হীন নন। তাই স্বীয় পুত্রকেও তিনি পরিপূর্ণভাবে বিশ্বাস করেন না। রাজনীতি, সমরনীতি, সকল ক্ষেত্রেই তাঁর দক্ষতা লক্ষণীয়। তিনি নিজেকে ব্যতীত অপর কাউকে কখনোই ভালবাসতে পারেন নি। এই আত্মপ্রীতির কারণে একসময় তিনি নিজের হৃদয়ের কাছেই নিজে পরাজিত হয়েছেন। তবে এমন বুদ্ধিমান রাজনৈতিক শঠ এবং আত্মবিশ্বাসে দৃঢ় চরিত্র বাংলা নাটকে বিরল।জাহানারা এই নাটকের অন্যতম প্রধান নারী চরিত্র। তিনি দারার সমর্থক এবং সম্রাটের মুখপাত্ররূপে নাটকে আত্মপ্রকাশ করেছেন। বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন নারী যুক্তিনিষ্ঠ বক্তব্য উপস্থাপনে ছিলেন অসাধারণ। বিশ্লেষণে নিরপেক্ষ ও কঠোর-কোমলে মিশ্রিত জাহানারা দর্শক শ্রদ্ধায় সিক্ত হয়েছেন প্রথমে থেকেই। ইতিহাসের প্রকৃত নারী জাহানারা, নাটকে উপযুক্ত সম্রাট দুহিতা হিসেবেই প্রকাশিত। রাজনীতির নোংরা খেলায় যুক্ত না হয়ে তিনি জননীর স্নেহে সামলে রাখতে চেয়েছেন। অসহায় রুগ্ন পিতাকে। পিতার সকল বিপর্যয়ে সাথী হয়ে প্রেরণা দিয়েছেন তিনি। বুগিয়েছেন সাহস। বলেছেন—“এই কারাগারের কোণে বসে অসহায় শিশুর মত ক্রন্দন করলে কিছু হবে না, পদাহত পশুর মত বসে দত্তে দস্ত ঘর্ষণ করে অভিশাপ দিলে কিছু হবে না। পাপী মুমূর্যের মত অস্তিমে একবার ঈশ্বরকে দয়াময় বলে ডাকলে কিছু হবে না। উঠুন, দলিত ভুজঙ্গের মত ফণা বিস্তার করে উঠুন, হৃতশাবক ব্যাঘ্রীর মত প্রচণ্ড বিক্রমে গর্জে উঠুন, অত্যাচারে ক্ষিপ্ত জাতির মত জেগে উঠুন।”
জাহানারা সকল বিপন্ন ও বৈরী সময়েও প্রবল দৃঢ়তায় ও বলিষ্ট ব্যক্তিত্বে প্রকাশিত হয়েছেন। নতজানু হয়ে, কাতর হয়ে করুণা প্রত্যাশা করেননি। অন্তঃপুরবাসিনী রমণী দিল্লীর দরবারে প্রকাশ্যে দাঁড়িয়ে প্রবল ক্ষমতাশালী ঔরংজীবের বিরুদ্ধে বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন। তবে তাঁর আবেগস্পন্দিত হৃদয়স্পর্শ সকলকে মুগ্ধ করে। সমালোচক তাই যথার্থ বলেছেন— “তাঁর ধীরতা, বাস্তব বুদ্ধি, চারিত্রিক স্নিগ্ধতা ও দৃঢ়তার চরম পরীক্ষা ঘটেছে অস্তিম দৃশ্যে, সাজাহানের অনুরোধে ঔরংজীবের প্রতি ক্ষমা বাক্য উচ্চারণে। হত্যা, সন্দেহ, ষড়যন্ত্র, কৃতঘ্নতা, অবিশ্বাসের নিত্য আবর্তমান ঘূর্ণীর কেন্দ্র মোগল অন্তঃপুরে যার আশৈশব অধিষ্ঠান, শোণিত ধারার মধ্য দিয়ে যে সহজে তৈমুর বংশের দোষগুণের উত্তরাধিকার লাভ করেছেন, প্রত্যক্ষ রাজনীতির সঙ্গে যার জীবন সাজাহানের রাজত্বকালে জড়িয়ে গিয়েছিল, তিনি যে কেমন করে নারীসুলভ শুচিতা, স্নিগ্ধতা ও কোমলতা এবং সেবা-শুশ্রুষা ও আত্মত্যাগের শ্লাঘণীয় বৃত্তিগুলিকে বিসর্জন দেন নি তা ইতিহাসের বিস্ময়। নাটকেও এই জাহানারাকেই নাট্যকার স্থান নিয়েছেন।”
সম্রাট সাজাহানের জ্যেষ্ঠ পুত্র দারা। প্রিয় পুত্র হিসেবে সম্রাটের সান্নিধ্যেই তাঁর— অধিক সময় অতিবাহিত হয়েছে। রুগ্ন সম্রাটের শয্যাপার্শ্বে উপস্থিত থেকে, সম্রাটকে সাহচার্য দিয়ে তিনি অনুপ্রাণিত করেছেন সম্রাটকে। পিতৃভক্ত দ্বারা সম্রাট ঘোষিত দিল্লীর উত্তরাধিকারী এবং সম্রাটের পক্ষে ফরমানজারীকারী। রাজনীতির কুটকৌশল তাঁর কাছে অপরিচিত ছিল না তবে সে বিষয়ে তাঁর সীমাবদ্ধতা ছিল। সমগ্র নাটকে তাঁকে মাত্র একবার কৌশল প্রয়োগ করতে দেখি। তিনি সুকৌশলে ব্যবস্থা করেছিলেন, যাতে রাজধানীর কোন চিঠি ভাইদের কাছে না পৌছায়। চিঠি হস্তগত করার কৌশল গ্রহণের কলে গুজব রটে সম্রাট মৃত এবং ক্ষতি হয় দারার) এক্ষেত্রে তিনি পরিপূর্ণ সফল নন। দারা আস্তিক ও উদার। সকল ধর্মের মিলন প্রত্যাশী দারা সংসারবিমুখ ও বৈরাগ্য স্থানসিকতাসম্পন্ন। পিতার স্নেহতলে থেকে শাসন ক্ষমতা অর্জন করেছেন অনুগ্রহে। তাঁর প্রত্যক্ষ যুদ্ধ বা সংগ্রামের অভিজ্ঞতা নাই। সাধারণ মানুষের মত মানবিক অনুভূতি সম্পন্ন
দারা সরল ভাবে বিচার করেছেন সব কিছুকে। তাই তাঁর জীবন হয়ে উঠেছে ট্রাজিক।
নাটকের সর্বত্র পিতৃভক্ত দারা, পুত্র স্নেহকাতর দারা করুণ রসের সৃষ্টি করেছে। প্রেমিক
ও স্বামী হিসেবে তাঁর বিকাশ অনন্য। কবি-মন সমৃদ্ধ দারা ক্ষুধায় তৃষ্ণায় সপরিবারে আত্মহত্যা করতে উদ্ধ্যত হলেও ঈশ্বরে বিশ্বাস হারান না। দারা সম্রাটপুত্র হিসেবে তেমন কোন দৃঢ়তা প্রদর্শন করেন না। বরং স্নেহপ্রীতি পরিবেষ্টিত সাধারণ মানুষ হিসেবেই তাঁর প্রকাশ। নাটকে ট্রাজিক আবহ সৃষ্টিতেই তাঁর ভূমিকা অধিক। তিনি সুন্দরের সাধনায় নিমগ্ন থাকতে গিয়ে অসুন্দরের হাতে বদি
হয়েছেন।।
সাজাহানের দ্বিতীয় পুত্র সুজা দীর্ঘকাল শাসন করেছেন বাংলাকে। বাংলার অনাবিল তরঙ্গস্রোত তাঁকে অলস ও বিলাসী করে দিয়েছিল। যার কারণে শাসকের দৃঢ়তা তাঁর চরিত্রে অনুপস্থিত থেকেছে। তিনি লঘুচরিত্রের সঙ্গীতপ্রিয়, যুদ্ধোন্মাদ ও দাম্ভিক হিসেবে উপস্থিত হয়েছেন। এ ক্ষেত্রে তাঁর যুদ্ধবাজ মানসিকতাকে অবদমিত করে রেখেছে স্ত্রী পিয়ারা। স্ত্রীপ্রেম তাঁকে রক্ষা করেছে সব সময়।
সুজার ভেতর যে যুদ্ধোন্মাদ প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়, তা আরাকান রাজার বিরুদ্ধেই কেবল ব্যবহৃত হয়েছে। বাকী সকল সময় পিয়ারার লঘু ও চপল আলাপচারিতায় তা নিবৃত্ত হয়েছে। দৃঢ়তাহীন, বিলাসপ্রিয় সুজা, স্ত্রী ব্যতীত স্নান এক চরিত্র হিসেবেই নাটকে প্রকাশিত হয়েছেন।
সাজাহানের কনিষ্ঠ পুত্র মোরাদ লম্পট ও অপদার্থ হিসেবেই নাটকে পরিচিত হয়েছেন। সুকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন—“তাঁর মধ্যে যেটুকু সাহস ও বীরত্ব ছিল, সেটুক লুপ্ত হয়েছিল তাঁর ভোগবিলাসিতা, নির্বুদ্ধিতা ও অসংযত জীবন যাপনের জন্যে। ফলে কুটকৌশলী ঔরংজীবের বুদ্ধির কাছে মোরাদ সহজেই বলি প্রদত্ত ।....নাটকে দিলদারের উক্তির মধ্যে মোরাদ-চরিত্রের এই স্বরূপই ধরা পড়েছে। এই মূর্খ ও বর্বর মোরাদ সম্পর্কে দিলদার বলেছেন, “মোরাদ একদিকে যুদ্ধোন্মাদ আর একদিকে সম্ভোগমজ্জিত, মনোরাজ্য ওর কাছে একটা অনাবিষ্কৃত দেশ। মোরাদ শাসনকর্তা হিসাবে নিজের অপদার্থতাই প্রতিপন্ন করেছে। এই নির্বোধ বিবেচনাবর্জিত স্থূল রুচিসম্পন্ন, অসংযত জীবন যাপনে অভ্যস্ত মোরাদ স্থূল বুদ্ধিসম্পন্নও বটে। তাই দিলদারের ব্যঙ্গ বিদ্রুপ মিশ্রিত সতর্কতা মোরাদকে সচেতন করতে পারেনি। মোরাদ তাঁকে বিদূষকের অসংলগ্ন উক্তি বলে মনে করেছেন। তাই তাঁর সাহস ও শৌর্য যতই থাক, স্থুলবুদ্ধি তাঁকে শোচনীয় পরিণামের দিকে এগিয়ে নিয়ে গেছে।” দিলদার চরিত্রটি অনৈতিহাসিক হলেও ইতিহা।ে তার অস্তিত্বের ক্ষীণ প্রমাণ পাওয়া যায়। নাটকে তিনি ছদ্মবেশী জ্ঞানী রূপে পরিচয় পেয়েছেন। দিলদার বিচিত্র চরিত্র হিসেবে আবির্ভূত হয়ে নাটকে 'নাটকীয় অব্যহতি' প্রদান করে। তিনি ঔরংজীবের চাটুকার দলভুক্ত কিন্তু পাপকর্মের সমর্থক নন।
নিঃসঙ্গ ও দার্শনিক মানসিকতাসম্পন্ন দিলদার দারার প্রতি প্রবল অনুরাগ যেমন প্রকাশ করেছেন তেমনি মৃত্যুকে নিয়ে করেছেন রোমান্টিক বিলাস। জীবনের প্রতি অনাসক্ত হওয়া সত্ত্বেও দিলদার ঋজু চরিত্র। ডঃ সাধন কুমার ভট্টাচার্য বলেন—দিলদার চরিত্রে বাক্তের সহজগতি অপেক্ষা অব্যক্তের নেপথ্য জিয়াই বিলক্ষণ হইয়া দেদার তাই অস্পষ্ট ও রহস্যাচ্ছন্ন।" মূলত র কী বুদ্ধিসম্পন্ন পণ্ডিত । ভারতীয় নারী আদর্শের মূর্ত প্রতীক নাদিরা দারার স্ত্রী, মেময়ী ও জনশ্রী হিসেবে সার্থক। দাম্বিকতা শূন্য সাধারণ নারী নাদিরা ধীর ও গম্ভীর। স্বামীর প্রকৃত অর্ধাঙ্গী
হিসেবে সুখে দুঃখে সমান অংশীদার হয়েই বেঁচে থাকতে চেয়েছেন। অকারণ ঔদ্ধত্য ও
মহীঘীর অহংকার তাঁর চরিত্রে সম্পূর্ণরূপে অনুপস্থিত। শাশ্বত ভারতীয় নারীর অকৃত্রিম
প্রেম ও মমতায় সমুজ্জ্বল নাদিরা আবেগে উচ্ছ্বসিত ও সংস্কারে আবদ্ধ । পিয়ারাও তেমনি পতিপ্রেমে, সতীত্বে ও সততায় ভাস্বর। ভোগবিলাসী সুজার স্ত্রী হয়েও তিনি জীবনের অনাকাঙ্ক্ষিত ও অবাঞ্চিত দুঃখকে হাসির বন্যায় ভাসিয়ে দিয়েছেন। লঘু ও চপল রসিকতায় অন্তর বেদনায় মলিন সময়কে চন্দ্রালোকে উদ্ভাসিত করেছেন। নাটকের শেষে বিপর্যয়ের চরম মুহূর্তে পিয়ারা প্রেমময় রূপ পরিবর্তন করে শক্তিময়ী রূপে আবির্ভূত হয়েছেন। প্রকৃতপক্ষে স্বামীকে চালিত করার মধ্যেই তাঁর সার্থকতা প্রকাশিত হয়েছে। স্বামীকে নেতিবাচক পথ থেকে ইতিবাচক পথে ধাবিত করেছেন তিনি। অফুরন্ত প্রেম প্রবাহে নিয়ত প্রবহমান করেছেন স্বামীকে। পিয়ারা মোগল হেরেমের এক বিচিত্র বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত রমণী।
যোধপুরপতি যশোবন্ত সিংহের স্ত্রী মহামায়া। রাজপুত রমণীর আদর্শের প্রতীক মহামায়া বীরাঙ্গনা রূপে নাটকে আবির্ভূত হয়েছেন। পরাজিত স্বামীর প্রত্যাবর্তন তাঁর কাম্য নয়। দেশপ্রেমিক হিসেবেই তাঁর প্রতিষ্ঠা। (দারার পুত্র সোলেমান পিতৃভক্ত ও বীর যোদ্ধা সে। তাঁর সবচেয়ে বড় যোগ্যতা
তিনি ইন্দ্রিয় বাসনাকে দমন করতে পারেন। কাশ্মীরের প্রধানা নর্তকীর আহবানকে উপেক্ষা করার মত নৈতিক দৃঢ়তা তাঁর ছিল। আদর্শবাদ দ্বারা পরিচালিত যোদ্ধা সোলেমান বলেন—“ক্ষান্ত হও হত্যার প্রতিশোধ হত্যা নয়। পাপে পুণ্যের প্রতিষ্ঠা নয়। সিপার দারার বালক পুত্র। তবে তাঁর কথাবার্তাকে পরিণত ও বয়কের কথা বলেই মনে হয়। পিতৃভূক্ত সিপারকে খনিকটা অস্বাভাবিক বলে ভ্রম হয় । যেমন হয় দারার কন্যা জহরউন্নিসাকে। তিনি বালিকা অথচ সংলাপে তাঁকে পরিণত ও অভিজ্ঞা বলে মনে হয়। তিনি সব সময় উচ্ছ্বাসের চড়া পর্দায় বাঁধা থেকেছেন। অতিনাটকীয় সংলাপের কারণে তিনি দর্শকপ্রীতি লাভ করেন না। ঔরংজীব পুত্র মহম্মদ পিতৃভক্ত তবে প্রতারক পিতার কর্মের বিরুদ্ধে দাঁড়াবার মত নৈতিকতা তাঁর ছিল। তিনি সৎ, সত্যবাদী এবং কোনদিনই তাঁর চরিত্রে শঠতার ছাপ পড়েনি। মহম্মদের পিতৃভক্তি আবেগ নির্ভর নয় যুক্তিসিদ্ধ
যোধপুরাধিপতি যশোবন্ত সিংহ সাহসী ও বীর, তবে তাঁর বেপরোয়া মানসিকতার নিশ্চিত করেছে। জয়পুর অধিপতি জয়সিংহ আদর্শ অপেক্ষা ব্যক্তি স্বার্থকেই অধিক জন্যে তাঁকে বিশ্বাসঘাতক হিসেবেই চিহ্নিত করা যায়। তাঁর দোলাচল মনোবৃত্তিই তাঁকে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করে বিশ্বাসঘাতক হিসেবে পরিচিত হয়েছেন। সুবিধাভোগী এচরিত্র রাজপুতদের কলংক। এ ছাড়া নাটকে আছেন দিলীর খ ও জিহন কাহিনীতে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছেন মাত্র স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে আত্মপ্রকাশ করতে পারেনি।
১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের ব্যর্থতার মধ্য থেকে উনোষ হয় জাতীয়তাবোধের। এই বোধজাগ্রত সময়ে জন্মগ্রহণ করেন দ্বিজেন্দ্রলাল রায়। কিন্তু জাগ্রত জাতীয়তাবোধের মধ্যে সংকীর্ণতাও দানা বেঁধেছিল। দ্বিজেন্দ্র মানস জাতীয়তাবোধকে ধারণ করেছিলো কিন্তু সংকীর্ণতা দ্বারা আচ্ছন্ন থাকেনি।
বৃঙ্গভঙ্গ আন্দোলনে যে জাতীয়তাবাদের প্রত্যক্ষ প্রকাশ লক্ষ্য করা যায় তাঁর পরোক্ষ প্রকাশ দেখা যায় দ্বিজেন্দ্রলালের নাটকে। যেখানে তিনি ঐতিহ্যকে শ্রদ্ধার সঙ্গে উপস্থাপন করেছেন। ধর্মীয় ক্ষুদ্রতা দ্বারা আক্রান্ত হননি। 'সাজাহান' তাঁর সেই ঐতিহ্য নির্ভর সত্যনিষ্ঠ নাটক যা উগ্র বা সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদ দ্বারা রোগাক্রান্ত নয়।
জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে প্রেম প্রবাহিত করেছেন দ্বিজেন্দ্রলাল রায়। তাই সাজাহান নাটকে নাট্যকারের প্রেমধারায় অভিসিক্ত হয় সাজাহান, দারা, মহম্মদ, সোলেমান প্রমুখ। আবার নিন্দিত হয় ঔরংজীব, যশোবন্ত সিংহ, জয়সিংহ প্রমুখ। সততা ও বীরত্বের প্রতি প্রেম আর শঠতা ও রাজনৈতিক নীচুতার প্রতি ঘৃণা তিনি প্রকাশ করেছেন নাটকে।
বস্তুত দ্বিজেন্দ্রলাল রায় রচিত সাজাহান নাটক বিচিত্র চরিত্র সৃষ্টি, রাজনীতির জটিল সংকটাবর্তে পতিত মানবাত্মার করুণ রসঘন চিত্র রূপায়ণে এবং ইতিহাসের সফল অনুকরণে সার্থক। সার্থক দেশপ্রেমের উজ্জ্বল দৃষ্টান্তে, অসাধারণ সংগীতে এবং নব্য নাট্যক ক্রিয়ায়।
0 মন্তব্যসমূহ