Hot Posts

6/recent/ticker-posts

কালকেতু উপখ্যান আলোচনা কালকেতু উপাখ্যান এ সমাজচিত্র


*কালকেতু উপখ্যান আলোচনা কালকেতু উপাখ্যানে সমাজচিত্র
kalketu upakkhan
কালকেতু উপাখ্যান 
কালকেতু উপাখ্যান এর চরিত্র
মঙ্গলকাব্য  মনসামঙ্গল কাব্য চণ্ডীমঙ্গল কাব্য আলোচনা 
চণ্ডীমঙ্গল)) 
*বিঃদ্র-বাংলা বিভাগের সকল পড়াশোনা পেতে ব্লগটিতে যুক্তথাকুন https://monoweredu13.blogspot.com/?m=1 

**কালকেতু উপাখ্যান এ সমাজচিত্র--

**কালকেতু উপাখ্যান আলোচনা ---

মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে মঙ্গলকাব্য একটি উল্লেখযোগ্য শাখা। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস পড়তে গিয়ে আমাদের অনার্স ও এম-এ শ্রেণীর ছাত্রদের এ শাখার কবি, তাঁদের কাব্য ও বিষয়বস্তুর সঙ্গে পরিচিত হতে হয়। তা যেন নিছক নাম মাত্র পরিচয়ে পর্যবসিত না হয় সেজন্য আমাদের জীবনদর্শন ও রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণের পরিবর্তন সত্ত্বেও দু'একটি মঙ্গলকাব্য অনার্সের পাঠ্য তালিকাভুক্ত রাখার প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য হয়ে ওঠে।


মধ্যযুগে ষোড়শ শতাব্দীর (১৫৪০? ১৬০০?) কবিকঙ্কণ মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর মতো এতবড় বাস্তবধর্মী জীবনবাদী কবি আর কেউ জন্মগ্রহণ করেন নি। মঙ্গলকাব্যের দেবনির্ভর গতানুগতিক বিষয়বস্তুর ভেতর দিয়ে পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতাব্দীর বাংলাদেশ ও নাম গোত্রহীন সাধারণ বাঙালিদের রাজনৈতিক, সামাজিক ও পারিবারিক জীবনের পরিচয় তিনি তুলে ধরেছেন সমগ্র মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে তার দৃষ্টান্ত বিরল। এ কারণে মুখ্যতঃ কবিকঙ্কণ মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর প্রতিভার সঙ্গে এবং গৌণতঃ মঙ্গল কাব্যের সঙ্গে আমাদের ছাত্রদের পরিচিত করার জন্যে তাঁর চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের ‘কালকেতু’ অংশটি আমাদের অনার্সের পাঠ্য তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। অনিবার্য কারণে বাংলাদেশে এসব কাব্য এখন দুষ্প্রাপ্য। আমাদের ছাত্রদের পাঠ্য তালিকাভুক্ত এসব বইয়ের অভাব পূরণ উদ্দেশ্যে কবিকঙ্কণের চণ্ডী মঙ্গলকাব্যের 'কালকেতু উপাখ্যান' অংশটি সম্পাদনা করে প্রকাশ করা হল।

কবিকঙ্কন মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর ‘চন্ডীমঙ্গল’ মধ্যযুগের একখানি সুবৃহৎ ও

সবিশেষ উল্লেখযোগ্য কাব্য। সেই সুবৃহৎ 'চন্ডীমঙ্গল’ প্রধানতঃ তিন ভাগে বিভক্ত

করা যেতে পারে (১) [দেবখণ্ড (২) (আক্ষেটিক খণ্ড (৩) বণিক খন্ড৷ দেবখণ্ড

স্বর্গলোকের কাহিনী, কিন্তু বাকি দু'খণ্ডের কাহিনী মর্তলোকের। আক্ষেটিক খণ্ড হচ্ছে

কালকেতু-ফুল্লরা উপাখ্যান এবং বণিক খণ্ডের কাহিনী ধনপতি-খুল্লনাকে নিয়ে।

দেবখণ্ডের প্রথমেই আছে গণেশ, মহাদেব, সরস্বতী, লক্ষ্মী প্রভৃতি দেব-দেবীর

বন্দনা-চৈতন্য-বন্দনাও আছে। তারপরেই সৃষ্টি প্রকাশ-কিভাবে প্রজাপতির সৃষ্টি লীলা

শুরু হল তারই বর্ণনা। এই সৃষ্টিধারার শুরুতেই শিবের শ্বশুর দক্ষের সঙ্গে শিবের

বিরোধের চিত্র আছে। দক্ষ-যজ্ঞে শিব-নিন্দা শুনে তাঁর স্ত্রী সতী দেহ ত্যাগ করলেন,

তার ফলেই সংঘটিত হলো শিবের দক্ষ-যজ্ঞ নাশ। সতী পুনর্বার হিমালয়ের ঘরে

জন্ম নিলেন গৌরী নামে, হিমালয় পর্বতের কন্যা বলে তাঁকে পার্বতীও বলা হয় । এইপার্বতী বা গৌরী বয়ঃপ্রাপ্তা হলে আবার শিবকেই স্বামী হিসেবে পেতে চাইলেন, কিন্তু পল্লী হারা শিব তখন তপস্যায় রত ছিলেন। এই স্থানে কালিদাসের কুমারসম্ভবের প্রভাব আছে, কালিদাসের অনুসরণে এইখানে তারকাসুরাধের জন্য কুমার-জন্যের আবশ্যকতা বর্ণিত হয়েছে। সেজন্য তাপস্যারত শিবকে সংসারী হতে হয়। অতএব ওপস্যাভঙ্গের জরুরী প্রয়োজনে মদনকে পাঠানো হ'ল। মদনদের গৌরীকে সহায়তা করতে এসে শিবের তৃতীয় নয়ন বিচ্ছুরিত অগ্নিরাশিতে ভস্মীভূত হলেন। শুরু হল মদন শল্পী রতি দেবীর বিলাপ এবং গৌরীর তপস্যা। তপস্যায় তুষ্ট হয়ে অবশেষে শিব গৌরীকে স্ত্রী হিসেবে বরণ করলেন। বিয়ের পর স্ত্রীকে নিয়ে শ্বশুর বাড়িতে বসবাস শুরু করলেন শিব। গণেশ কার্তিকের জন্ম হল। কিন্তু ঘরজামাই থাকার কুফল শীঘ্রই দেখা দিল, মা মেনকার সঙ্গে কন্যা গৌরীর কিছুতেই বনিবনা হয় না। কন্যা-জামাতা কোনোই কাজ করেন না, কেবলি বসে বসে খান— এটি মেনকার অসহ্য। অগত্যা স্বামীসহ গৌরী কৈলাস যাত্রা করলেন। এই সব অংশ অনেকখানি তৎকালীন বাঙালি জীবনের বাস্তব আলেখ্য হয়ে উঠেছে ।

কৈলাসে গিয়ে এই গৌরীই দূর্গা, চন্ডী, কালি ইত্যাদি নামে পরিচিতা হয়েছেন। দেবলোকে থাকতে থাকতে দেবতাদের মতোই দূর্গা, বা চণ্ডীদেবীর মনেও সাধ জাগল যে তিনিই মর্তবাসীদের দ্বারা পূজিতা হবেন। মর্তে পূজা পেলেন কেবল কলিঙ্গ রাজার এবং পশুদের কাছে। সার্বজনীন পূজা পেতে হলে কোনো দেৱতাকে শাপ দিয়ে মর্তে পাঠাতে হয়, তিনি মর্তে গিয়ে দেবী পূজা করলে তবেই সর্বস্তরে তাঁর পূজা প্রচলিত হবে। দেবী বেছে বেছে ইন্দ্রপুত্র নীলাম্বরকে মর্তে পাঠানোর জন্য মনস্থ করলেন, কিন্তু দেবীর অনুরোধেও শিব বিনা অপরাধে তাঁকে শাপ দিতে পারবেন না বলে জানালেন। চণ্ডী তখন কীটরূপ ধারণ করে ফুলের মধ্যে লুকিয়ে রইলেন। নীলাম্বর সেই ফুল শিবের পূজা দিলে ফুল থেকে বেরিয়ে কীট শিবকে দংশন করল এবং কীট থাকা ফুলে পূজো দেবার অপরাধে শিব নীলাম্বরকে অভিশাপ দিলেন-মর্তলোকে গিয়ে ব্যাধরূপে জন্ম নাওগে। নীলাম্বর তখন কালকেতু নাম নিয়ে ধর্মকেতুর ঘরে জন্ম নিলেন, তার স্ত্রী ছায়া ফুল্লরা নামে জন্ম নিলেন অন্য এক ব্যাধের ঘরে। এইখান থেকেই মর্তলোকের কাহিনী শুরু।


মতলীলা শেষ করে কালকেতু স্বর্গলোকে গমন করলে দেবী আবার ইচ্ছা করলেন এইবার স্বর্গের কোনো অপ্সরাকে মর্তে পাঠিয়ে তার দ্বারা আপন পূজো আরো ভালোভাবে প্রচার করবেন। কিছুদিনের মধ্যেই সুযোগ পাওয়া গেল। ইন্দ্রের নর্তকী রত্নমালা নৃত্যের তাল ভুল করলে তাকে অভিশাপ দিয়ে মর্তে পাঠানো হল খুল্লনা নাম ধারণ করে লক্ষপতির ঘরে জন্ম নিলেন তিনি, সূচনা হল ধনপতি খুল্লনা উপাখ্যানের। চুধীমঙ্গল কাব্যের এই বিপুল বিস্তৃত বিচিত্র কাহিনীর মধ্য থেকে কালকেতু উপাখ্যানটুকু অর্থাৎ কালকেতুর জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত অংশটুকু

পৃথকভাবে সঙ্কলন করে প্রকাশ করা হল। প্রার্থনা এবং গ্রন্থ উৎপত্তির কারণ অধ্যায় দুটি রয়ে গেল কেবল মধ্যযুগীয় কাব্যের ও দুটি অপরিহার্য অঙ্গ বলে। অতঃপর মকুন্দরাম চক্রবর্তীর কাব্য আস্বাদনের ইচ্ছা যাঁদের আছে, অথচ মধ্যযুগীয় মানসিকতার অভাবে সে ইচ্ছা কাব্য পাঠে প্রবৃত্ত হওয়া মাত্রই দেব বন্দনা ও পুরাণ কাহিনীর একঘেয়েমী লেগে ক্ষয় পেতে পেতে বিতৃষ্ণায় রূপান্তরিত হয়ে যায় । সেই পাঠকদের পক্ষে মুকুন্দরামকে আস্বাদন করা সহজসাধ্য হবে। মধ্যযুগের কবিকে কাব্য প্রকরণগত নানাবিধ প্রচলিত রীতিনীতি মেনে চলতে হত যার ফলে সেখানে বহু জিনিসের সমাবেশ হত কেবল সেই রীতি রক্ষার খাতিরেই। মূল কাহিনীর পক্ষে একেবারে অবাস্তব সেই সব অংশ আজকের পাঠকের কাছে বিরক্তিকর এবং কাব্যপাঠের পক্ষে বাধা স্বরূপ। মঙ্গলকাব্য মাত্রেই কয়েকটি পালায় বিভক্ত হয়ে কয়েকদিন ধরে গীত হত; চন্ডীমঙ্গল কাব্য এক মঙ্গলবারে শুরু হয়ে আর এক মঙ্গলবারে আট দিনের দিন শেষ হত। আট দিনের উপযোগী করার জন্য কাহিনীকে নানাভাবে টেনে বাড়িয়ে নিতে হত কবিকে। -এইসব নানাবিধ প্রতিবন্ধকতার মধ্যে কাব্য রচনা করতে গিয়ে স্বাভাবিক কবিত্বের বিকাশ সম্ভাবনা কম ছিল। এরই মধ্যে যারা সৃষ্টিক্ষমতায় স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল হয়ে আছেন, কবিকঙ্কণ তাঁদের মধ্যে একজন। আমরা বিশেষভাবে কবিকঙ্কণের প্রতিভার সঙ্গে পাঠকের পরিচয় করিয়ে দেবার উদ্দেশ্য নিয়ে এই কাব্য সঙ্কলনে প্রবৃত্ত হয়েছি। তাই বিভিন্ন দেবদেবী-বন্দনা, শিব পার্বতী সংবাদ, চৌতিশা স্তব প্রভৃতি যেসব অংশ কেবল মঙ্গলকাব্যের রীতি রক্ষার খাতিরেই রচিত হয়েছিল সেগুলি এখানে বাদ দেয়া হয়েছে। কাহিনীর নিজস্ব প্রয়োজনে নয়, তাকে আট দিনের উপযোগী করার জন্য বা কেবলি একটা গতানুগতিক রীতি রক্ষার খাতিরে যেসব অংশ অকারণে পল্লবিত করা হয়েছে, অথচ কাব্য সৌন্দর্যও সেগুলি নিম্নমানের এমন কিছু কিছু অংশ, যেমন, বিভিন্ন যুদ্ধ বর্ণনা, কাঁচুলি নির্মাণ প্রভৃতি সংক্ষিপ্ত করে নেয়া হয়েছে। তবে যে সব অংশ কবিত্বে, অথবা সমসাময়িক স্থান কালের পরিচয়ে সমৃদ্ধ সেগুলি কাহিনীর পক্ষে অপ্রয়োজনীয় বিবেচিত হলেও বাদ দেয়া হয়নি। এ কারণেই বনকর্তন, গুজরাট নগরে বিভিন্ন জাতির আগমন প্রভৃতি অংশ হুবহু রেখে দেয়া হল। ঐসব অংশে সেকালের বাংলাদেশের মানুষ ও প্রকৃতি জগতের বহু তথ্য লাভ করে এ যুগের পাঠক পুলকিত হবে। গুজরাট নগরে নানা ধর্মাবলম্বী ও বিভিন্ন বৃত্তিকারী নরনারীর আগমনকে উপলক্ষ করে লেখক মধ্যযুগের বাঙালি জাতির সমাজ বিন্যাসের যে চিত্র তুলে ধরেছেন তা অনন্য উদাহরণ না হলেও সর্বাধিক প্রশংসার যোগ্য তাতে সন্দেহ নেই। এখনও কথায় কথায় আমরা ছায়া ঢাকা পাখি ডাকা আমাদের এই পূর্ব পাকিস্তানের কথা বলে গর্ব অনুভব করি, কিন্তু আমাদের একালের সাহিত্যে বাংলাদেশের কটি গাছ বা পাখির সাক্ষাৎ আমরা পাই? শুধু রবীন্দ্রনাথ-জীবনানন্দ-জসীমউদ্দীন প্রভৃতি স্বল্পকয়েকজন কবির কাবোই বাংলাদেশ নামে একটা দেশের অস্তিত্ব টের পাওয়া যায়। কবিকঙ্কনের 'বনকর্তন' অধ্যায়ে এদেশের উদ্ভিদ জগতের যে পরিচয় মেলে তা বিস্ময়কর । কবিকঙ্কন যতো গাছের উল্লেখ করেছেন তার মধ্যে কয়েকটি সঠিক কি গাছ বা কোন ধরনের গাছ তা আমরা অনেক চেষ্টা করেও উদ্ধার করতে পারিনি। সম্ভবত সেকালের কোনো স্থানীয় নাম কবি ব্যবহার করে থাকবেন।

এই গ্রন্থ সঙ্কলনের ব্যাপারে আমরা ছাপার অক্ষরে প্রকাশিত বিভিন্ন 'কবিকঙ্কণচণ্ডী' পরীক্ষা করে দেখেছি এবং বিভিন্ন পাঠান্তর মিলিয়ে যে পাঠ যুক্তিসঙ্গত মনে হয়েছে তাই গ্রহণ করেছি। পাদটীকায় যথাসম্ভব পাঠভেদত্ত উল্লেখ করা হয়েছে। ইতিপূর্বে যারা এই গ্রন্থ হাতে লেখা পুথি থেকে সঙ্কলন করেছিলেন, কেউই তাঁরা পাঠ-ভেদ সম্পর্কে কোনো ঐক্যমতে পৌঁছতে পারেননি, পারা সম্ভবও ছিল না। কবিকঙ্কনের কাব্যের আদি অকৃত্রিম রূপ উদ্ধার করা এখন এক প্রকার অসম্ভব বললেই চলে। কাব্যখানি অশেষ জনপ্রিয় হওয়াই বহুবার লিপিকারের দ্বারা নকল করানো হয়েছে এবং প্রত্যেকবারই লিপিকারের হাতে তার কিছু না কিছু পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে যে, মধ্যযুগের সব কবির ক্ষেত্রেই এমনটি ঘটেছে। সেকালের কোনো লিপিকারই এমন নিষ্ঠার পরিচয় দেননি যাতে কোনো মধ্যযুগীয় কবি তাঁর আদি ও অকৃত্রিম রূপে আমাদের কাছে পৌছতে পারতেন। পূর্বে বলা হয়েছে যে কবিকঙ্কনের 'চণ্ডীমঙ্গল' কাব্যের অন্তর্গত নানাগুণে সমৃদ্ধ কালকেতু-উপাখ্যানটিকেই তুলে ধরা আমাদের উদ্দেশ্য। আমরা আশা করি আমাদের সম্পাদিত এ অংশটুকু থেকে কবি মুকুন্দরামের কাব্য আস্বাদনে পাঠকের কোনো অসুবিধা হবে না।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ