Hot Posts

6/recent/ticker-posts

মরুশিখা কাব্য আলোচনা

 

((মরুশিখা  কাব্য আলোচনা

 দুঃখবাদী কবি

মরুশীখা কাব্য

morushikha kabbo যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত মরুশিখা কাব্য দুঃক্ষবাদী কবি কাকে বলা হয়))) 

*বিঃদ্র-বাংলা বিভাগের সকল পড়াশোনা পেতে ব্লগটিতে যুক্তথাকুন https://monoweredu13.blogspot.com/?m=1 

ভূমিকা: যতীন্দ্রনাথের জীবন ও কবিতা----

রবীন্দ্রনাথ জন্মেছিলেন ১৮৬১ খ্রিষ্টাব্দে। তাঁর প্রয়াণ ঘটে ১৯৪১-এ। দীর্ঘ আশি বছরের জীবনে বাঙলা কবিতার মহত্তম ব্যক্তিত্ব তিনি। বিশ শতকের চারটি দশকের কিছু বেশি সময় জুড়ে সারা পৃথিবীজোড়া আর্থ-সামাজিক এবং রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের মাঝখানে তাঁর নিজের কবিতায় এসেছে নানা বাঁক, এসেছে নতুন নানা ধরন-ধারন। আধুনিক এই জীবনের পরিবর্তিত মূল্যবোধের নানা চলচ্চিহ্ন অঙ্গীকার করে তাঁর কবিতায় ঘটেছে নানা বিবর্তন, নানা ঋতু ও রীতি পরিবর্তন। তারই মাঝখানে তাঁর অনুযাত্র যে সব কবিদের আমরা দেখেছি, তাঁদের একদলকে মোটা দাগে আমরা চিহ্নিত করেছি— রবীন্দ্রানুসারী' আর অন্যদের 'রবীন্দ্রোত্তর' হিসেবে। এইসব কবিদের অবস্থানগত বিশিষ্টতার কথা বলবার আগে একটু দেখে নেওয়া যেতে পারে তাঁদের জন্মের বছরগুলো। যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত জন্মেছিলেন ১৮৮৭-তে। রবীন্দ্রনাথের থেকে, বয়সে তিনি ছাব্বিশ বছরের ছোট। রবীন্দ্রনাথের পরে আর যে-সব কবিরা এসেছেন বাঙলা কবিতার ক্ষেত্রে, তাঁরা হলেন করুণানিধান বন্দ্যোপাধ্যায় (জন্ম ১৮৭৭), যতীন্দ্রমোহন বাগচী (জন্ম ১৮৭৮), সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত (জন্ম ১৮৮২), মোহিতলাল মজুমদার (জন্ম ১৮৮৮), কালিদাস রায় (১৮৮৯) এবং কুমুদরঞ্জন মল্লিক (জন্ম ১৮৮৯)। যতীন্দ্রমোহন এবং মোহিতলালকে বাদ দিয়ে করুণানিধান যতীন্দ্রমোহন, সত্যেন্দ্রনাথ, কুমুদরঞ্জন এবং কালিদাস রায়— এই পাঁচজন কবিকে একসঙ্গে ধরে তাঁদের চিহ্নিত করা হয় ‘কবিপঞ্চক’ নামে ৷


মোটামুটিভাবে উনিশ শতকের শেষ দশক থেকে রবীন্দ্রপ্রয়াণ পর্যন্ত পঞ্চাশ বছরের মতো সময়টাকে বলা হয়ে থাকে 'রবীন্দ্রযুগ'। মনে রাখতে হবে, তারই মধ্যে কিন্তু রবীন্দ্রোত্তর আধুনিক বাঙলা কবিতার নানা পর্ব আর নতুন পালা। সেইসব পর্বকে আবার গুণগত লক্ষণ এবং বিবর্তনের ভিত্তিতে আধুনিক বাঙলা কবিতার প্রথম দ্বিতীয় তৃতীয় ইত্যাদি নানা পর্যায় নামে চিহ্নিত করেছেন ড. শশিভূষণ দাশগুপ্ত। এই যে পাঁচজন কবি, এঁরা তাঁদের কাব্যে মানবজীবনের শুদ্ধশীল নানা পুণ্যগাথা, সহজ সরল লোকায়ত. আদ-বেদনার মামা টুকরো ছবি, প্রকৃতির, বিশেষ করে চেনা বাংলাদেশের পল্লীপ্রকৃতি, এবং হিন্দু বৌদ্ধ শাক্ত এবং বেশ একটা বড় অংশ জুড়ে বৈষ্ণব ঐতিহ্যেকে লোকপ্রিয় এক মরমিয়া সারল্যের স্লিপ্ত আন্তরিকতায় ফুটিয়ে তুলেছেন। রবীন্দ্রনাথের বনস্পতি-সদৃশ বিশাল মহিমার তুলনায় এঁরা অবশ্যই অনেকটা তথাকথিত 'মাইনর পোয়েট।' প্রমথনাথ বিশীর ভাষায় : 'রবীন্দ্রনাথ শাখা-প্রশাখা বহুল বিরাট বনস্পতি, পত্রপল্লবপূর্ণ শাখাগুলো যেন গ্রহ্যস্তরে গিয়ে ঠেকেছে আশেপাশে এমন সর বৃক্ষ, তুলনায় যারা অনেক ছোট- তাদের ... পার্থিব আকাশ ছাড়িয়ে উঠতে পারেনি। কিন্তু কি বড়, কি ছোট ...রস আহরণ করেছে এক মৃত্তিকা থেকে। মাটির ভিতরকার রহস্য সন্ধান করলে ধরা পড়বে যে সেখানেও ছোট বড় আছে- কারো শিকড় প্রবিষ্ট কারো শিকড় চলে গিয়েছে রসাতলে। সমালোচকের কর্তব্য হবে, এই সাম্য ও অসাম্যের রহস্যভেদ- সাম্য সমাজ-প্রেরণার, অসাম্য ব্যক্তিগত বিভূতিতে [ভূমিকা: কুমুদরঞ্জনের কাব্যবিচার: ক্ষেত্র গুপ্ত] আসলে এমনভাবে না দেখে বেশ একটু তুচ্ছতাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে, এঁদের খাটো করে দেখবার একটা চেষ্টা আমাদের সমালোচনায় চোখে পড়ে। এঁদের সিদ্ধির কথাগুলো সরিয়ে রেখে, সীমাবদ্ধতার কথাগুলোকেই বড় করে তুলে ধরে তাই সমালোচককে মন্তব্য করতে শুনি যে, এঁদের রচনা 'এমন সমতলকরন সদৃশ, এমন আশুক্লান্ত, পাণ্ডুর মৃদুল’ এবং এঁদের কবিতে কবিতে ভেদচিহ্ন এতই অস্পষ্ট যে, এঁরা সবাই মিলে নিতান্তই ভ্রান্ত রবীন্দ্রনুসারী মাত্র। ফলে, তাঁদের লেখায় তা দেখা দিল সেই ফেনিল সেই অসহায় অসংবৃত উচ্ছ্বাস, যা ভাব-কবির কুলক্ষণ— শৈথ্যিলকে স্বত:স্ফূর্তি বলে, আর তন্দ্রালুতাকে তন্ময়তা বলে ভুল করলেন তাঁরা; আর ইতিহাসে শ্রদ্ধেয় হলেন এই কারণে যে, তাঁরা পরিতাপে আত্মাহুতি দিয়ে পরবর্তীদের সতর্ক করে দিয়ে গেছেন।' [বুদ্ধদেব বসু সাহিত্যচর্চা, রবীন্দ্রনাথ ও উত্তরসাধক] 'রবিতাপে আত্মাহুতি দিয়ে' আমাদের সতর্ক করে দেওয়াটাই যে এঁদের একমাত্র কবির ভূমিকা এবং এরকম বিচারই যে পরম শ্রদ্ধেয় বিচার, সে কথাটা সবাই যে নির্বিচারে মেনে নেবেন এ কথাটা হয়তো ঠিক নয়। বিশ শতকের প্রথম তিন দশকের প্রতিবাদী স্পর্ধিত আধুনিকতার মাঝখানে বসে এইসব কবিরা বৃহত্তর বাঙালি পাঠকসমাজকে দিয়েছেন রসের আর অন্য আর এক ভোজ্য। তা কি নেহাতই ফেলে দেবার মতো আবার এ ক্ষেত্রে প্রমথনাথ বিশীর অত্যন্ত সঙ্গত মন্তব্যটি স্মরণ করা যেতে পারে এঁরা দীর্ঘকাল বাঙালী পাঠককে কাব্যরসের মোটা ভাত কাপড় যুগিয়ে এসেছেন এক সময়ে এই কাজ

করেছেন মঙ্গলকাব্য-প্রণেতাগণ ও কৃত্তিবাস কাসিরামদাস। তাছাড়া এদের কাব্য প্রাচীন বাঙলা কাব্যের সঙ্গে নব্য বাঙলা কাব্যের যোগ রক্ষা করে এসেছে। এঁরা না থাকলে দুই কালের কাব্যের মধ্যে আরও অনেক দুস্তর হয়ে উঠতে পারত।' [ভূমিকা কুমুদরঞ্জনের ... ক্ষেত্র গুপ্ত]। উত্তরকালের ভ্রান্তিমান এই ঐতিহাসিক সত্যের কাব্য রচনা করতে পারে, কিন্তু তার দ্বারা এইসব কবিদের মুছে ফেলা যায় না। তাই বারবার উত্তরকাল ফিরে ফিরে উপভোগ আর যাচাই করতে চায় এইসব কবিকৃতি কখনও বা বেরোয় এইসব কবিদের নির্বাচিত কবিতার সংকলন, আবার কখনও তাঁদের প্রতিনিধিস্থানীয় সমস্ত ভালো কবিতার সঙ্গে তাঁদের অন্যান্য কবিতাগুলি একসঙ্গে করে যে সমস্ত 'কাব্যসমগ্র' প্রকাশিত হয় তার মধ্য থেকে উত্তরকালের জমিতে দাঁড়িয়ে আমরা নতুন করে বুঝে নিতে চাই তাঁদের ভালোমন্দকে, তাঁদের সত্যিকার ঐতিহাসিক গুরুত্ব। কোনও প্রত্নকৌতূহল থেকে নয়, এই ঐতিহাসিক গুরুত্ব চর্যার দিক থেকেই তাই সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, মোহিতলাল মজুমদার, করুণানিধান বন্দ্যোপাধ্যায় এঁদের কাব্যসমগ্রের পাশাপাশি এই যতীন্দ্রনাথ-কাব্যসম্ভারের প্রকাশ বাস্তবিকই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রসঙ্গ।


রবীন্দ্রনাথের থেকে আটত্রিশ বছর এবং উল্লিখিত কবিপঞ্চকের বহির্ভূত এবং যতীন্দ্রনাথ-মোহিতলালেরও থেকে এগারো-বারো বছরের ছোট নজরুল ইসলাম যে কবিধর্মে এবং প্রকাশভঙ্গির নানা দিক থেকে একেবারে আলাদা সে কথা রবীন্দ্রনাথকে প্রণিপাত এবং পরিপ্রশ্নকারী বরীন্দ্রদ্রোহী তরুণ আধুনিকেরাও স্বীকার করেছেন। নানা ভাবে, অব্যবহিত দুই অগ্রজ পূর্বসুরি মোহিতলাল এবং যতীন্দ্রনাথকে তাঁরা আধুনিকতার পুরোধা বলে মেনেছিলেন। 'কল্লোল' পত্রিকাকে ঘিরে সেদিন বহুস্বরা আধুনিকতার যে বিচিত্র প্রকাশ, তারই অন্যতম অগ্রণী প্রতিনিধি অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত লিখছেন, 'মোহিতলালকে আমরা আধুনিকতার পুরোধা মনে করতাম। এক-কথায় তিনিই ছিলেন আধুনিকোত্তম। মনে হয়, যজন যাজনের পাঠ আমরা তাঁর কাছ থেকেই প্রথম নিয়েছিলাম। আধুনিকতা যে অর্থে বলিষ্ঠতা, সত্যভাষিতা বা সংস্কাররাহিতা, তা আমরা খুঁজে পেয়েছিলাম তাঁর কবিতায়।' তিনি আরও লিখছেন 'মোহিতলালের মত যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত আমাদের আরাধনীয় ছিলেন। ভাবের আধুনিকতার দিক থেকে যতীন্দ্রনাথের দু:খবাদ বাঙলা সাহিত্যে এক অভিনব অভিজ্ঞতা। [কল্লোল যুগ: অচিন্তকুমার সেন গুপ্ত।] তারপর শনিবারের চিঠিকে ঘিরে একদিনের এইমৈত্রী কিভাবে মনাস্তরের নানা বাঁকে কিরকম সব চেহারা এবং চরিত্র লাভ করলো সেই ইতিহাসের মধ্যে কোনওদিন ছিলেন না যতীন্দ্রনাথ। তবু ও যেমন তাঁর ঐ সব অগ্রজ এবং সহযাত্রী কবিদের সম্পর্কে, তেমনি স্বভাব স্বতন্ত্র যতীন্দ্রনাথ সম্পর্কে তাঁর প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে বুদ্ধদেব বসু লিখেছেন, রবীন্দ্রনাথের কাব্যের 'মায়াজাল' থেকে মুক্ত হবার ইচ্ছে জাগা সেই 'আলো আঁধারি' দিনগুলিতে 'রবীন্দ্রনাথ ও আধুনিক কবিদের মধ্যে উজ্জ্বলতম সেতু-র মত কবি নজরুলের দৃপ্ত কণ্ঠস্বরের পাশাপাশি মোহিতলাল ও যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের কবিতার মধ্যে এই শতকের তরুণ কবিদের কাব্যচর্চা পেয়েছিল নতুন ইঙ্গিত। তাঁর মতে, মোহিতলালের ‘বিস্মরণীর বড়ো বড়ো তাল, ঢেউয়ের মতো গড়িয়ে-চলা কল্লোল-এর পাশাপাশি যতীন্দ্রনাথ আমাদের অভিনিবেশ দাবি করলেন প্রায় উল্টো রকমের সুর শুনিয়ে- সহজ টাটকা আটপৌরে, এবড়ো-খেবড়ো মাঠের উপর দিয়ে চৈত্র মাসের শুকনো হাওয়ার মধ্যে খুব কষে গোরুর গাড়ি চালিয়ে নেবার মতো সুর। তিনি আরও লিখেছেন 'যতীন্দ্রনাথের কাছে কী পেয়েছিলাম আমরা? পেয়েছিলাম এই আশ্বাস যে আবেগের রুদ্ধশ্বাস জগৎ থেকে সাংসারিক সমতলে নেমে এসেও কবিতা বেঁচে থাকতে পারে। পেয়েছিলাম একটি উদাহরণ যে পরিশীলিত ভাষা ও সুবিন্যস্ত ছন্দের বাইরে চলে এলেও কবিতার জাত যায় না। ...আরো কিছু পেয়েছিলাম। প্রথমত, প্রবন্ধধর্মী যুক্তিতর্কের ফাঁকে ফাঁকে হঠাৎ এক-একটি আলো জ্বলা, রেশ তোলা পংক্তি (রাঙা সন্ধ্যার বারান্দা ধরে রঙিন বারাঙ্গনা') -বিরল বলেই তাদের চমৎকারিত্ব যেন বেশি। ভিন্ন মানে অবশ্য রবীন্দ্রনাথের জীবনদর্শন থেকে ভিন্ন। যেমন রবীন্দ্রনাথের অবিরল অতীন্দ্রিয়তার পরে মোহিতলালের নির্ভয় দেহাত্ববোধে আমরা উৎসাহ পেয়েছিলাম, তেমনি অন্যদিক থেকে যেন একটা নিঃশ্বাস ফেলা নিষ্কৃতি ছিলো যতীন্দ্রনাথের সরল, বৈঠকী দু:খবাদে। সৃষ্টির আনন্দময় অভিনন্দনে আবাল্য অভ্যস্ত আমরা সেই প্রথম শুনলুম ব্যঙ্গোক্তি, সংশয়, নেতিবাদ। বুদ্ধদেব বসু আরও বলেন, যতীন্দ্রনাথের এই দৃষ্টিভঙ্গির থেকে কোনো গতিশীল চিন্তার সূত্রপাত হতে পারে না' এবং তাঁর সিদ্ধান্ত এই যে, সমসাময়িক বাঙলা কাব্যের উপরে যতীন্দ্রনাথের প্রভাব পড়েছিল, রূপের দিক থেকে, ভাবের দিক থেকে নয়, এবং সে প্রভাবও 'ক্ষণিক ও অদূরস্পর্শী। এতেই বোঝা যায় তাঁর দু:খবাদ বা নেতিবাদের প্রধান গুণ ছিল- অনুপ্রেরণার শক্তি নয়, শ্রান্তিহারক রমণীয়তা'। বুদ্ধদেবের ‘কালের পুতুল' বই-এর ‘যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত' শীর্ষক লেখাটির এই দীর্ঘ উল্লেখ করলাম এ কারণেই যে, যতীন্দ্রনাথের

কবিকর্মের কিছু ইতিবাচক ভূমিকার পাশাপাশি তিনি একটু তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতেই তাঁর যে বৈঠকী দুঃখবাদ' এবং তাঁর লেখার যে 'শ্রান্তিহারক রমণীয়তার কথা বলেছেন, সেটা তাঁর ব্যক্তিগত নিরঙ্কুশ বিচার, কিন্তু নিরপেক্ষ মূল্যায়ন নয়। সে বিচার যে হয়নি তা নয়। তাঁর মৃত্যুর পর ড. শশিভূষণ দাশগুপ্ত এবং ড. অমরেন্দ্র গণাই দুটি পূর্ণাঙ্গ বই লিখে যতীন্দ্রের কবিকর্মের এবং সমকাল ও উত্তরকালের কবিদের সঙ্গে তার মিল-অমিলের প্রসঙ্গগুলি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন কবি 'যতীন্দ্রনাথ ও আধুনিক বাঙলা কবিতার প্রথম পর্যায়' এবং 'যতীন্দ্রনাথের কবিকৃতি। তাঁর নির্বাচিত কবিতার দুটি সংকলন প্রকাশিত হয়েছে ('অনুপূর্বা ও যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের কবিতা সংকলন’) তাঁর ছুটি কাব্যর সমস্ত কবিতা নিয়ে যতীন্দ্রনাথ কাব্যসম্ভার প্রকাশিত হয়েছে, ১৯৮৭-তে তাঁর জন্মশতবার্ষিকীতে তাঁর ‘কাব্য-সংগ্রহ'-এর প্রথম খণ্ড মরীচিকা, মরুশিখা এবং মরুমায়া এই তিনটি কাব্যগ্রন্থ নিয়ে) প্রকাশিত হয়েছে এবং ১৯৮৬ তে তাঁর একটি গদ্যরচনারও সংকলন প্রকাশিত হয়েছে- তাঁর এইসব পূর্ব প্রকাশিত বইগুলি এখন আর পাওয়া যায় না। এ কি তাঁর কাব্যের তথাকথিত 'বেঠকী দুঃখবাদ' আর 'শ্রাস্তিহারক-রমণীয়তা সম্পর্কে কাব্যরসগ্রাহী নবীনতর প্রজন্মের শীতল অনাসক্তি? কিন্তু ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকারের সম্পর্ক সূত্রটির নাড়ীর যোগে যাঁরা আস্থাবান, তাঁরা তো বারবার ফিরে ফিরে চান এঁদের সমগ্র কাব্য ভুবনটিকে ধারাবাহিক পরম্পরার মধ্য দিয়ে জানতে, বুঝতে এবং আস্বাদন করতে। তাঁর জন্মশতবার্ষিকীতে প্রকাশিত শত বর্ষের আলোকে কবি যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত গ্রন্থে নতুন করে যাচিয়ে নেবার চেষ্টা হয়েছে তাঁর সৃজনী প্রতিভাকে। কিন্তু সে বইটিও এখন আর পাওয়া যায় না। মোহিতলাল মজুমদার এবং করুণানিধান বন্দ্যোপাধ্যায়ের সুমুদ্রিত এবং সুসম্পাদিত কাব্যসংগ্রহ-এর পর সেই অভিপ্রায় থেকেই ‘ভারবি’ এই নতুন ‘যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের কাব্যসংগ্রহ' প্রকাশনায় উদ্যোগী হয়েছেন। এজন্য রসগ্রাহী পাঠকের কৃতজ্ঞতা তাঁদের প্রাপ্য।

করুণানিধান বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাব্যসংগ্রহ-এর ভূমিকায় অলোক রায় জানিয়েছিলেন, 'কবিকে তাঁর জীবনচরিতের মধ্যে পাওয়া যাবে কি না তা নিয়ে সংশয় থাকতে পারে। কবিকে জানতে হলে তাঁর কবিতাই পড়তে হবে। কিন্তু বঙ্কিমচন্দ্রের মনে হয়েছে 'যিনি ওই কীর্তি রাখিয়া গিয়াছেন, তিনি কি গুণে, কি প্রকারে এই কীর্তি রাখিয়া গেলেন- তাও বুঝতে হবে।' এই বোঝার ক্ষেত্রে কবি জীবনের বাইরের পরিচয়টাও তাই একটু দেখে নেওয়া যেতে পারে।

বাঙলা ১৩৫৬ সালে বিপ্রতীপ গুপ্ত ছদ্মনামে মাসিক বসুমতী কাগজের শ্রাবণ সংখ্যায় 'স্মৃতিকথা' নামে যতীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন তাঁর একটি অত্যন্ত অন্তরঙ্গ আত্মস্মৃতি। পরবর্তীকালে ১৯৮৭-তে কলকাতার বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সাহিত্যসাধক চরিতমালার ১৩১ সংখ্য গ্রন্থ হিসেবে যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত' নামক জীবনীগ্রন্থটি লেখেন কবির জ্যেষ্ঠপুত্র অধ্যাপক সুনীলকান্তি সেন। কবির জন্মশতবার্ষিকীর ঐ একই বছরে সাহিত্য আকাদেমি থেকে বেরোয় ইংরেজিতে লেখা তাঁরই যতীন্দ্রনাথের জীবন ও কাব্যের সুন্দর পরিচায়িকামূলক যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত নামক বইটি। ড. অমরেন্দ্র গণাইও তাঁর গ্রন্থে প্রসঙ্গক্রমে যতীন্দ্রনাথের জীবনকথা-র অবতারণা করেছেন। এইসব লেখাগুলির তথ্যের ভিত্তিতে সংক্ষেপে যতীন্দ্রনাথের জীবনের লেখালেখাটি এরকম।


বাঙলা ১৯২৪ সালের ১৩ আষাঢ়, ইংরেজি ২৬ জুন ১৮৮৭ বর্ধমান জেলার পাতিলপাড়া গ্রামে তাঁর মামার বাড়িতে জন্ম হয় কবি যতীন্দ্রনাথের। তাঁর বাবার নাম দ্বারকানাথ সেনগুপ্ত, মা মোহিতকুমারী দেবী। কবির পৈতৃক নিবাস ছিল নদীয়া জেলার শান্তিপুর থেকে প্রায় আড়াই মাইল দূরে হরিপুর গ্রামে। তাঁর একটি অপ্রকাশিত রচনা ‘বিস্মৃতিকথায়’ যতীন্দ্রনাথের পিতৃভূমি হরিপুর গ্রামের একটি সুন্দর ছবি দেখতে পাই। গ্রামের দক্ষিণ দিকে দু'চারটি আমবাগান। তার পরেই খোলা মাঠ। মাঝখান দিয়ে চলেছে ধুলাভরা প্রশস্ত পল্লীপথ। দুপাশে স্বর্গীয়া ও জীবিতা পুন্যাধিনীদের প্রতিষ্ঠা করা অশ্বথের সারি। মাঠ শেষ না হতেই হঠাৎ চোখে পড়ে প্রায় দুই ক্রোশ দীর্ঘ বিল। কাকচক্ষুর মত স্বচ্ছ কালো জল টলটল করছে। জলে নেমে বুক ডুবিয়ে দাঁড়ালে বালুকাতল চোখে পড়ে। বিলের ওপারে ক্রোশাধিক উন্মুক্ত চর। তার পরেই গঙ্গা। দিনরাত হু হু করে খোলা বাতাস বইছে, যেন সমুদ্রের আহ্বান।‘ত্রিযামা' কাব্যগ্রন্থের 'আমার বসন্ত' কবিতায় কবি তাঁর ওই গ্রামের আর এক ছবি এঁকেছেন এইভাবে


আম জাম কাঁঠাল বাগান


মাছরাঙা চিল


দোয়েল পাপিয়া কাক


ছাতার কোকিল বুলবুল,


সজিনা বাতাবী ভাঁট চম্পর্ক বকুল, পাড়ায় পাড়ায় ঘেঁষাঘেঁষি ধুলাভরা পথ, দোল, রথ, মহরম

বিবাদী নির্বাদী

জনকত আত্মীয়-স্বজন প্রতিবেশী

স্বল্পপুঁজি দোকানের প্রগলভ দোকানি বাঙলার ক্ষুদ্র গ্রামখানি।

এবার, এ জনমের মত

এই ত ধরণী মোর এই স্বর্গ মানি।


যতীন্দ্রনাথের পিতা দ্বারকানাথ ছ'টি পুত্রকন্যার জনক ছিলেন বটে কিন্তু যতীন্দ্রনাথ ছাড়া আর কেউই শৈশব উত্তীর্ণ হননি। অর্থাৎ তিনিই পিতার একমাত্র জীবিত সন্তান। পাঁচু ঠাকুরের কাছে মানত ছিল বলে তাঁর ডাক নাম ছিল পঞ্চু বড় হওয়ার পরে তাঁকে এই নামে আর কেউ ডাকেনি। সেদনি বাঙলাদেশের আর পাঁচটা গ্রামের মতো হরিপুর গ্রামেও ম্যালেরিয়ার প্রকোপ বড় কম ছিল না। কবিও খুবই ভুগতেন এই ম্যালেরিয়া পরবর্তী জীবনের স্মৃতিকথায় নিজের তির্যক কবিধর্মের কথা বলতে গিয়ে তিনি কৌতুক করে এই ম্যালেরিয়া জ্বরের কথা বলেছেন।

হরিপুর গ্রামেই কবির জীবনের প্রথম বারো বছরের মত সময় কাটে। দেশের আর পাঁচটা গ্রামের মতো এখানেও বসতো রামায়ণ গান, যাত্রা, আর পাঁচালী গানের আসর। এ সবের দুর্বার আকর্ষণে গুরুজনদের নিষেধ অমান্য করে শুধু নিজেদের গ্রামেই নয়, গ্রামান্তরেও চলে যেতেন ...পাড়ার অন্য ছেলেদের সঙ্গে। তাঁর এই প্রথম জীবনের আকর্ষণ মনে খুব গভীর ছাপ ফেলেছিল তাঁর মনে। শোনা যায়, প্রথম জীবনে নাকি ও জাতীয় কিছু কিছু গান লেখবারও চেষ্টা করেছিলেন। তাঁর প্রথম লেখা কবিতার

পান্ডুলিপির মধ্য থেকে যে এই প্রবণতার কিছু হদিস শুধু তাই নয়, তাঁর উত্তরজীবনের কবিতার মধ্যেও এই ধারাটির যোগসূত্র পাওয়া যেতে পারে। নিজে গান ভালোবাসতেন, ভালো গানও গাইতে পারতেন বলে জানা যায়। গীতরসিক এই মানুষটির আরও কিছু পরিচয় নিহিত আছে তাঁর কাব্যগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত তাঁর নিজের লেখা গানগুলির ভিতরে।

কবির লেখাপড়া শুরু হয় তাঁর গ্রামের স্কুলেই। বারো বছর বয়সে ছাত্রবৃত্তি পাশ করে তিনি কলকাতায় যান তাঁর মেজকাকা কবিরাজ সতীশচন্দ্র সেনগুপ্তের কাছে পড়াশুনার জন্য। সতীশ চন্দ্র সে সময় থাকতেন ক্রস স্ট্রিট (এখনকার যমুনারাল বাজাজ স্ট্রিট)। সেখানে থেকে কবি পড়াশোনা করতেন ওরিয়েন্টাল সেমিনারী স্কুলে। বছর দেড়েক এই স্কুলে পড়বার পর তিনি ভয়াবহ বিউবনিক প্লেগে আক্রান্ত হন|(১৯০০ খ্রিস্টাব্দে)। এই ভয়ংকর রোগ থেকে বেঁচে ওঠার পর মাস ছয়েকের মধ্যেই আবার তিনি আক্রান্ত হন টাইফয়েড রোগে। এবারও বেঁচে গিয়ে যতীন্দ্রনাথ ফিরে এলেন হরিপুরে এবং পাশের গ্রামের হাইস্কুলে ভর্তি হলেন। তাঁর বাবা তখন ভগ্নস্বাস্থ্য একমাত্র পুত্র সন্তানটিকে নিয়ে যান নিজের কর্মস্থল ওড়িশার বালেশ্বরে। সেখানে যতীন্দ্রনাথের শরীরের কিছুটা উন্নতি হলেও ১৯০১-এ তাঁর বাবার অস্থায়ী করণিকের চাকরিটি কিন্তু চলে যায়। আবার ফিরে আসেন যতীন্দ্রনাথ এবং ওরিয়েন্টাল সেমিনারীতেই নতুন করে ভর্তি হন। এই স্কুলেই সহপাঠী ভোলানাথ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর পরিচয় এবং আজীবন বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ১৯০৩-এ এই স্কুল থেকেই ‘এন্ট্রাস পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে পাশ করার পর তিনি জেনারেল এ্যাসেম্বলি (এখনকার স্কটিশ চার্চ, কলেজ) থেকে এফ, এ (ফার্স্ট আর্টস) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এ বছরই তিনি শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তি হন এবং ১৯১১ খ্রিস্টাব্দে বি. ই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ছাত্রাবস্থাতেই ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে (২২ ফাল্গুন ১৩১৪) তাঁর বিবাহ হয় হাজারিবাগের প্রতিষ্ঠিত আইনজীবী চারুচন্দ্র গুপ্তের মধ্যমা কন্যা জ্যোতিলতা দেবীর সঙ্গে। এই জ্যোতিলতা দেবী অসীম ধৈর্যে এবং গভীর সহমর্মিতায় কবির ব্যক্তিজীবনে ও সৃষ্টির জগতে একটি পরম প্রেরণাসঞ্চারী ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন।

১৯১২ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাসে ইস্ট ইন্ডিয়ান রেলওয়ের সার্ভেয়ার হিসেবে শুরু হয় তাঁর কর্মজীবন। কিন্তু মাত্র ১২ দিন চাকরি করার পর এই কাজে তিনি ইস্তফা দেন। পরের বছর ১৯১৩-র এপ্রিল মাসে কৃষ্ণনগরেনদীয়া জেলা বোর্ডের ওভারসিয়ার হিসেবে তাঁর আসল কর্মজীবনের শুরু হয় এবং ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি ডিস্ট্রিক্ট ইঞ্জিনিয়ার পদে উন্নীত হন। ১৯১৩ থেকে ১৯২০ পর্যন্ত কৃষ্ণনগরে তাঁর জীবনের পর্বটি কাটে বেশ ভালোভাবেই। সেখানকার সাংস্কৃতিক জীবনের সঙ্গে তিনি যুক্ত ছিলেন। তাঁরই প্রযোজনায় কৃষ্ণনগরে 'দ্বিজেন্দ্র মেমোরিয়াল ক্লাব'-এর পক্ষ থেকে ‘সাজাহান’ ‘চন্দ্রগুপ্ত' 'বঙ্গনারী' প্রভৃতি নাট্যাভিনয় হয়। তিনি নিজেও সাজাহান নাটকে ‘ঔরঙ্গজেব' 'বঙ্গনারী' নাটকে কেদার এবং 'চন্দ্রগুপ্ত' নাটকে চাণক্যের ভূমিকায় অভিনয় করেন। তাঁর সে অভিনয় সেদিনকার নাট্যরসিক দর্শক শ্রোতাদের বিপুল প্রশংসা লাভ করেছিল। তিনি যে ভালো গান গাইতে পারতেন তার প্রমাণ মেলে সাজাহান নাটক শুরুর আগে বাউল বেশে একতারা হাতে নিয়ে তাঁর গাওয়া এবার তোমার কোন সুরেতে বাজবে বীণা' গানটি গাওয়ার প্রসঙ্গে। এই গান শুনে শ্রোতারা সেদিন মুগ্ধ হয়েছিল। এই কৃষ্ণনগরেই সাহিত্যনুরাগীদের সাহিত্য-সমিতিতে তিনি তাঁর নিজের লেখা নানা প্রবন্ধ পাঠ করতেন- জানিয়েছেন তাঁর জীবনীকার পুত্র। একদিকে যেমন কৃষ্ণনগরের বিদগ্ধ মানুষজনদের নিকট সান্নিধ্যে ও সাহচর্য তাঁর কবি-প্রতিভা বিকাশে খুবই অনুকূল ভূমিকা গ্রহণ করেছিল, তেমন জীবিকাগত প্রয়োজনে গ্রামের পর গ্রাম তিনি ঘুরেছেন প্রত্যক্ষ করেছেন তার হতশ্রী দারিদ্র্যদীর্ণ বাস্তব রূপটি দেখেছেন রোগজীর্ণ খেটে-খাওয়া মানুষজনের বিপন্ন বেদনাময় করুণ জীবন। ছোটবেলায় যে পল্লীজীবনকে তিনি দেখেছিলেন, তাঁর সেই কথাটা আরও অনেক ব্যাপ্তি এবং গভীরতা পেল তাঁর এই গ্রাম থেকে গ্রামান্তরের চাকরি জীবনকে উপলক্ষ করে। তাঁর ‘পথের চাকরি’ কিংবা 'ফেমিন রিলিফের' মতো কবিতার উৎসে আছে তাঁর এই কর্মজীবনের অভিজ্ঞতা।তাঁর এই কৃষ্ণনগর বাসকালেই যতীন্দ্রনাথের জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হল তাঁর পরবর্তী বাকি জীবনের অন্তরঙ্গ বন্ধু, তাঁর 'মিতা' অগ্রজ কবি যতীন্দ্রমোহন বাগচীর সঙ্গে পরিচয়। 'মানসী' পত্রিকায় পাঠানো যতীন্দ্রনাথের ‘শিবের গাজন' কবিতাটি পড়ে খুব ভালো লেগেছিল যতীন্দ্রমোহনের। কি জীবনাচরণে, কি কবিধর্মে দুটি মানুষ ছিলেন একেবারেই আলাদা, কিন্তু তবুও তাঁদের এই আমরণ সখ্যের প্রসঙ্গটি এখানে স্মরণীয়। যতীন্দ্রনাথের স্বয়ংসিদ্ধ স্বাতন্ত্র্যের সেই কুণ্ঠিত আত্মপ্রকাশের দিনগুলিতে মিতা যতীন্দ্রমোহনের 'প্রবল বন্ধুপ্রীতি' তাঁকে অবশ্যই উৎসাহ ও আত্মপ্রত্যয় দিয়েছিলো।'

এই কৃষ্ণনগরেই কবির সঙ্গে পরিচয় সেখানকার বিশিষ্ট রাজনৈতিক ও সামাজিক ব্যক্তিত্ব হেমন্তকুমার সরকারের। এই দুটি পরিচয় ছাড়াও তিনি ছিলেন একজন সতর্ক সাহিত্যরসগ্রাহী। সেকালের যমুনা পত্রিকায় বাঙলা কাব্যের একটি নতুন সুর' নামে একটি প্রবন্ধ লিখে যতীন্দ্রনাথের কাব্যের ‘বিশেষ সুরটি' তাঁর মৌলিকতাটি তিনি ধরিয়ে দিতে চেয়েছিলেন পাঠকদের। প্রসঙ্গত স্মরণ করা যেতে পারে, এই হেমন্তকুমার সরকারই যতীন্দ্রনাথের প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করেন বাঙলা ১৩৩০, ইংরেজি ১৯২৩, খ্রিস্টাব্দে।

১৯২০-তেই কবির জীবনে ঘটলো একটি বেদনাবহ অভিজ্ঞ । এই বছরে যতীন্দ্রনাথের দ্বিতীয় পুত্র ৪ বছর ৭ মাস বয়সে কলেরায় আক্রান্ত হয়ে মারা যায় কৃষ্ণনগরেই। একদিকে এই শোকবেদনায় যেমন তিনি অত্যন্ত বিচলিত, তেমনি নিজেও খুবই অসুস্থ হয়ে পড়েন। এর সঙ্গে যুক্ত হল তাঁর প্রধান ইঞ্জিনিয়ারের চাকরি সংক্রান্ত জটিলতা। সর মিলিয়ে গভীরভাবে বিচলিত ও বিব্রত যতীন্দ্রনাথ দীর্ঘ ছুটি নিয়ে হরিপুরে চলে আসেন। কিছুটা সুস্থ ও আত্মস্থ হয়ে একদিকে যেমন স্বদেশী ভাবনায় নিজের গ্রামে দেশি দেশলাই তৈরির উদ্যোগে তেমনি অন্যদিকে গান্ধীজির আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে চরকা চালানো, খদ্দর বোনা কেনাবেচার কাজে তিনি আত্মনিয়োগ করেছেন। আদর্শের টানে যতই এ সব কাজ করুন না কেন, এসব উদ্যোগ তো তাঁর পারিবারিক ভরণপোষণের পক্ষে আদৌ অনুকূল ছিল না। ‘স্মৃতিকথা’য় তিনি লিখেছেন, 'স্বগ্রামে বসে যতীন চরকা চালায়, খদ্দর বোনায় কিন্তু জেল খাটে না। একটি দেশলাই-এর হাতকল কিনে, গ্রামস্থ বালক-শ্রমিকদের সাহায্য নিয়ে ভাবে এতই দুই কুটির শিল্পের দৌলতে গ্রামের উপকার এবং তারও জীবিকার সংস্থান হবে। খদ্দরে আর দেশি দেশলাই-এ যে পেট ভরবে না, সে কথা সবাই বুঝছে, যতীন বুঝছে না।' হয়তো বা নিজের চোখে গ্রামবাঙলার যে দুর্গত অবস্থা তিনি দেখেছিলেন, নিজের সীমিত সাধ্যে সেই দূর্গতি মোচনের সামান্য একটু চেষ্টা তিনি করেছিলেন তাঁর এই স্বদেশি স্বনির্ভরতার উদ্যোগের মধ্য দিয়ে কিন্তু আজীবন সত্য ও আদর্শনিষ্ঠ এই মানুষটির পক্ষে এই ধরনের কর্মব্রত পালনের দক্ষতা ও যোগ্যতা হয়তো ছিল না। শেষ পর্যন্ত নদীয়া জেলা বোর্ডের চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে, ১৯২০ থেকে ১৯২৩ এই তিন বছরের স্বদেশি উদ্যোগের মাঝখানে তিনি কিন্তু একটিও কবিতা লেখেননি।খোশগল্প যখন প্রবল হয়ে উঠলো, তখন যতীন্দ্রনাথ এই বৈঠকে যাওয়া প্রায় বন্ধ করেছিলেন। তার আগে সেই যে শরীরটা তাঁর ভেঙ্গে গিয়েছিল তার ফলে কলিকের ব্যথা, বুক ধড়ফড়ানির যন্ত্রণা এসব ব্যাধি ছিল তাঁর নিত্যসঙ্গী।কলকাতার সাহিত্যিক মহলে তেমন যাতায়াত ছিল না তাঁর। যতীন বাগচি ও কালিদাস রায় ছাড়া তাঁর বাড়িতে মাঝে মধ্যে আসতেন উত্তরা পত্রিকার সম্পাদক সুরেশ চক্রবর্তী, কবি সাবিত্রীপ্রসন্ন চট্টোপাধ্যায়, সরোজকুমার রায়চৌধুরী, গোবিন্দগোপাল সেনগুপ্ত এবং কবি বিমলচন্দ্র ঘোষ প্রমুখেরা। মোহিতলাল মজুমারের সঙ্গে তাঁর হঠাৎ-ই একবার মাত্র দেখা হয় প্রকাশক জেনারেল প্রিন্টার্সের দফতরে। আর রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে একবারই মাত্র তাঁর দেখা হয় যতীন বাগচীর বাড়ি 'ইলাবাস-ঐ'। আর কখনও রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়নি— রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশায় কখনও তিনি শান্তিনিকেতনে যাননি, কিংবা তাঁর নিজের লেখা কোনও বই পাঠিয়ে তাঁর আশীর্বচন প্রার্থনা করেননি।যে তেরো বছর কলকাতায় ছিলেন যতীন্দ্রনাথ, তখন সেটি ছিল সারা পৃথিবীজোড়া অর্থনৈতিক মন্দা, স্বাধীনতা আন্দোলনের নানা মত ও পথের আবর্তনে এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের উত্তরঙ্গ নানা অভিঘাতে উত্তাল এক সময়। আদৌ রাজনীতি বিমুখ ছিলেন না কবি। তবে তাঁর নিজস্ব কিছু মতামত ও ধ্যানধারণা ছিল। অন্তরঙ্গ বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে রাজনীতি সম্পর্কে মাঝে মধ্যে তর্কবিতর্ক হলেও গান্ধী জীবনদর্শন এবং গান্ধীবাদী রাজনীতিতে আস্থাশীল যতীন্দ্রনাথ নিজে খদ্দর পরতেন এবং চরকা কাটতেন। নিজের হাতে কাটা সুতোর বিনিময়ে ভবানীপুরের খাদি প্রতিষ্ঠান থেকে তিনি কাপড় কিনে আনতেন। হয়তো তাদের মত ও পথের সমর্থক ছিলেন না, তবুও দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের ওই দিনগুলিতে যে সমস্ত ছেলেগুলো প্রাণের প্রমত্ত আবেগে কারাবরণ করেছিলো তাঁদের কথা ভেবে তাঁর 'ক্ষণিকের জাগরণ” কবিতায় বিভক্ত আত্মগ্লানিতে তিনি লিখেছেন : বোকা বোকা ছেলে চলে যাক জেলে আমরা বাহিরে আছি,কাগজে দেখিব এলো কিনা দেশ স্বরাজের কাছাকাছি।' যতীন্দ্রনাথের যে কতখানি জাগ্রতচক্ষু এবং মুক্তবুদ্ধি মানুষ ছিলেন, তার প্রমাণ হিসেবে এই সময় লেখা তাঁর দুটি গদ্যরচনার কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। [হিজলী বন্দীনিবাসে রাজনৈতিক বন্দীদের অমানবিক বর্বর নির্মম হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে লেখা 'শনিবারের চিঠি'র ১৩৩৮-এর আশ্বিন সংখ্যায় কহিলেন, হে কনিষ্ঠবল! অর্থাৎ রাজা কহিলেন হে কনিষ্ঠবল, রাজধর্মের পরম পারদর্শী তুমিই আমার চরমবন্ধু, অতএব তুমি শিষ্ট। আমি তোমায় শেষ পর্যন্ত পালন করিব। দুষ্টের দমনে তুমি আমার চিরসহায় থাকিও। দেখিও, পরম পবিত্র রাজধর্ম পালন হইতে আমি যেন ভ্রষ্ট না হই।' (সজনীকান্ত দাস প্রণীত ‘আত্মস্মৃতি' গ্রন্থ থেকে উদ্ধৃত)। কাশিমবাজারের মহারাজার জমিদারি কাজকর্ম দেখাশোনা করার জন্য বাঙলার রঙপুর, কুড়িগ্রাম, নীলফামারি, নাটোর, ফ্রেজারগঞ্জ এবং বিহার ও উড়িষ্যার নানা জায়গায় যেতে হয়েছে। কাশিমবাজার রাজ স্টেটের চাকরির প্রথম পর্বে নাটোর এস্টেটের ইঞ্জিনিয়রের কাজও তিনি চালাতে থাকেন ৷

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের শেষদিকে কলকাতায় জাপানি বোমাবর্ষণের ভয়ে সন্ত্রস্ত মানুষজন যখন দলে দলে কলকাতা ছেড়ে পালাতে শুরু করেছে, তখন কাশিমবাজার রাজ এস্টেটের দফতর আবার ফিরে এলো বহরমপুরে। চাকরি জীবনের এই শেষপর্বে ১৯৪২ থেকে ১৯৫৩ পর্যন্ত এই এগারোটা বছর তিনি দ্বিতীয়বার কাটালেন বহরমপুরে। বহরমপুরে যতীন্দ্রনাথ প্রথমে ছিলেন কাদাই অঞ্চলে, পরে লালদিঘি অঞ্চলে চলে যান। সেখানে তাঁর প্রতিবেশী ছিলেন উত্তরকালের আর এক বিশিষ্ট কবি মনীশ ঘটক।

১৯৫৩ সালে বহরমপুর ছেড়ে অল্প কিছুকাল তিনি সিন্ধিতে তাঁর মধ্যমপুত্র অরুণকান্তির কাছে যান, এবং পরে ১৯৫৪ সালে তাঁর জ্যৈষ্ঠপুত্র খড়গপুর আই. আই. টি-র অধ্যাপক সুনীলকান্তি সেনের কাছে যান। সেখানেই ১৯৫৪-র ১৫ সেপ্টেম্বর তাঁর মৃত্যু হয়।।।

(ঐতিহাকে আত্মসাৎ ও অতিক্রম করে প্রত্যেক বড় কবির যে নিজস্ব যা ১৯১২ থেকে ১৯২৩-এর মধ্যে লেখা যতীন্দ্রনাথের 'মরীচিকা'র কবিতাগুলির মধ্যেই তার প্রমাণ মিলবে। তাঁর আর পাঁচজন অগ্রজ এবং অনুযাত্র কবিদের মতো তিনি নিতান্তই সেই সময়ের বাঙলা কবিতার সম্পন্নতম উত্তমর্ণ রবীন্দ্রনাথের ভাব এবং ভাবনার চারপাশে আবর্তমান একজন 'মাইনর পোয়েট' মাত্র নন। যথার্থই একজন মেজর পোয়েট' সে কথাটা নিঃশব্দে অথচ প্রবলভাবে জানান দিলেন তিনি। পূর্বসুরি দ্বিজেন্দ্রলাল, প্রমথ চৌধুরী, সত্যেন্দ্রনাথ এবং সহযাত্রী মোহিতলালের মধ্যে রবীন্দ্রপ্রভাবের অনপনেয় ছায়ার মাঝখানে জীবন ও জগৎ সম্পর্কে আলাদাভাবে আলাদা কিছু কথা বলার স্বতন্ত্র একটি কবিতার জগৎ গড়ে উঠেছিল, তাঁদের পাশাপাশি যতীন্দ্ৰনাথ শোনালেন রোমান্টিকতাবিরোধী দুঃখবাদ কিন্তু কোন নেতিবাদী নৈরাশ্যপীড়িত তাঁর জীবানুভব নয়, মানুষের প্রতি সুতীব্র ভালোবাসায় উজাগর এক বিশিষ্ট জীবনদৃষ্টি

যতীন্দ্রনাথের ছ'টি কাব্যগ্রন্থের মধ্যে স্পষ্টত বিভাজনরেখা আমাদের চোখে পড়ে। মরীচিকা, মরুশিখা, মরুমায়া প্রথম পর্বের এই তিনটি কাব্যগ্রন্থের ১১৮টি কবিতার মধ্যে তাঁর প্রথম জীবনের ‘দুঃখবাদী' পরিচয়টি যেমন নিহিত আছে, তেমনি তাঁর সায়ম, ত্রিযামা এবং নিশান্তিকা কাব্যের (অনুবাদগুলি বাদ দিয়ে) কবিতাগুলিতে তাঁর দ্বিতীয় জন্মের পরিচয়টি প্রথিত।

যে সময়পর্বটি জুড়ে গীতাঞ্জলি-গীতিমাল্য আর গীতালির রবীন্দ্রনাথ শোনাচ্ছেন পরম আস্তিক্যের বাণী শোনাচ্ছেন ‘জগতে আনন্দযজ্ঞে’র নিমন্ত্রণে ধন্য তাঁর মানবজীবনের কথা, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের রক্ষক্ষয়ী অভিজ্ঞতার মাঝখানেও শোনাচ্ছেন রোমান্টিক সুদূরাভিসারের কথা তাঁর সহযাত্রী অনুজেরাও যেখানে সমস্বরে তারই প্রতিধ্বিনি শুনিয়ে চলেছেন তাঁদের কবিতায়, সেই জিজ্ঞাসা এবং প্রশ্ন সংকুল দিনগুলিতে, পুরনো বিশ্বাসের হেলে পড়া মিনারের মাঝখানে দাঁড়িয়ে যতীন্দ্রনাথ দেখা দিলেন আর এক আলাদা কবির পরিচয় নিয়ে। 'বিদ্রোহীর শিরোপাটি আমরা সেটে দিয়েছি কবি নজরুলের গায়ে। কিন্তু তাঁরও আগে ঈশ্বর পৃথিবী আর ভালোবাসা-সংক্রান্ত তীক্ষ্ণ প্রশ্ন পরায়ণে নানা জিজ্ঞাসা নিয়ে 'বিদ্রোহী' যতীন্দ্রনাথের আবির্ভাব। বাস্তবিকই নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের এই মন্তব্যটি

খুবই সঙ্গত বলে মনে হয় যে, তাঁর ভাষায়, বক্তব্যে, উপমা-অলংকার চিত্রকল্পে এবং সর্বোপরি একটি নিজস্ব দার্শনিকতায় যতীন্দ্র নাথ) সেনগুপ্ত রবীন্দ্রযুগের প্রথম বিদ্রোহী কবি)' ('কচি ডাব'-এর কবি সাহিত্য ও সাহিত্যিক : নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় ||

এই যে বিদ্রোহী যতীন্দ্রনাথ, তিনি নিজেই নিজেকে বলেছেন মরুকবি বলেছেন 'দুঃখবাদী বৈরাগী। কেন তিনি দুঃখবাদী, কি তাঁর দুঃখবাদের স্বরূপ- তার সঙ্গে দার্শনিক শোপেনহাওয়ার, ইতালিয়ান কবি লিওপার্দি, ইংরেজি সাহিত্যের বেকন, ডন ডান বা টমাস হার্ডির দর্শন ও মনোধর্মের কিংবা আমাদের ভারতীয় সাংখ্য বৌদ্ধ দর্শনের কোনও মিল অমিল খুঁজে পাওয়া যায় কিনা, এসব প্রসঙ্গ নিয়ে ভেবেছেন বিদগ্ধজনেরা। কিন্তু আমরা সাদা চোখে একটু দেখি, যতীন্দ্রনাথ এই বিশ্বপ্রবঞ্চ জুড়ে দেখেছিলেন এক অন্ধ জড় শক্তির স্বেচ্ছাচারী ভূমিকা। দেখেছেন, 'বধির বিধাতাও যেন সেই জড়েরই মতো নির্বিকার; দেখেছেন প্রকৃতির রূপ বৈভবকে ঘিরে কবিদের মূঢ় আতিশয্যপ্রবণ 'বাস্পবিলতা’, দেখেছেন চতুর্দিকে বঞ্চনা এবং মূঢ়তার সহস্রবাহু বিস্তার। এসব কিছু দেখেই তথাকথিত কবি হতে পারলেন না তিনি হলেন 'দুঃখবাদী বৈরাগ্য।'

‘দুখবাদী বৈরাগী' কবি হিসেবে যতীন্দ্রনাথের এই যে আলাদা পরিচয় ও প্রতিষ্ঠা সে আরম্ভেরও আগের যে আরম্ভ তার কথা বলতে গিয়ে, আমরা ছোটোবেলায় তাঁর কবিগান, তর্জাগান ইত্যাদি শোনা এবং পরবর্তী কবি জীবনে তার অনুসূত্রের কথা বলেছি। আর ছোটবেলায় বেশ কয়েকবার তিনি পড়েছিলেন কাশীদাসী মহাভারত। তারও অনুসৃতি তাঁর কবিতার জগতে চারিয়ে আছে নানাভাবে। স্কুল পেরিয়ে কলেজজীবনে ঢুকে যতীন্দ্রনাথ বিক্ষিপ্তভাবে পড়েছিলেন নবীন সেনের কুরুক্ষেত্র, মেঘনাদবধ-এর নির্বাচিত অংশ আর হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'অশোক-তরু’-প্রভৃতি দশ-বিশটা কবিতা। তখন তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে, নবীন সেনের কবিতাই বোধহয় কবিতা সম্পর্কে শেষ কথা। প্রায় কুড়িতে পা দেওয়া বয়সে এক রবীন্দ্র প্রেমিক বন্ধুর নির্বন্ধে প্রথম পরিচয় হয়েছিলো তাঁর রবীন্দ্রনাথের কবিতার সঙ্গে। এই তাঁর অভিজ্ঞতা, তারই ফলে ঘটলো তাঁর চেতনার নবজন্ম। তবে ‘বাল্যে বা কৈশোরে’ তাঁর 'কবিতারোগ' না ধরলেও প্রথম যৌবনে তাঁর কবিতা লেখা শুরুর সেই দিনগুলিতে যে সব কবিতা তিনি লিখেছিলেন, তাঁর সেই সব অমুদ্রিত পাণ্ডুলিপির কবিতাগুলির মধ্যে যে ভবিষ্যৎ কবি যতীন্দ্রনাথের কোনও চিহ্নই ছিল না, সে-কথা জানিয়েছেন তাঁরই জীবনীকার পুত্র। জীবনীকারের নিরাসক্ত বিচারে সুনীলকান্তি সেন লিখেছেন- 'The poems are cffusive outpourings in the worst romantic manner, couched in a sitted romantic languge using outworm rehctorical tricks' [Jatindhranath Sengupta: Sunilkanti Sen. Shaitya Academy 1987] এই 'কাব্য সংগ্রহ পরিশিষ্টে সংযোজিত যতীন্দ্রনাথের এই পর্বে লেখা দুটি কবিতা কিংবা ‘যতীন্দ্রনাথের কাব্যবিচার-গ্রন্থে উদ্ধৃত কয়েকটি কবিতাংশের দিকে তাকালে এই মন্তব্যটির সঙ্গতি বুঝে নেওয়া যেতে পারে।যতীন্দ্রনাথের প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'মরীচিকা’ বেরোয় বাঙলা ১৩৩০ সাল, ইংরেজি ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে। কৃষ্ণনগরের বিশিষ্ট নাগরিক দেশবৎসল সাহিত্য প্রেমী হেমন্তকুমার সরকার যতীন্দ্রনাথের কবিতায় খুঁজে পেলেন এক নতুন কাব্যভাষা; তাঁর কবিতার মধ্যে তিনি আবিদার করলেন এক নতুন কবিকে। তাঁরই উদ্যোগে প্রকাশিত হল 'মরীচিকা'। এই গ্রন্থে সংকলিত ৪৩টি কবিতার মধ্যে সবচেয়ে পুরনো লেখাটির রচনাকাল সম্ভবত ১৯১০। সবগুলিই রচনাকাল ১৯১০ থেকে ১৯২২। সেকালের প্রতিভা' 'মানসী' ‘মানসী ও মর্মবাণী’ 'যমুনা' প্রভৃতি পত্রিকায় প্রকাশিত হয় তাঁর এইসব কবিতাগুলো৷ ‘মরীচিকা' প্রকাশের আগে 'যমুনা' পত্রিকায় এই বইটির একটি তাৎপর্যপূর্ণ বিজ্ঞাপন বেরিয়েছিল। হেমন্তকুমার সরকার তাঁর একটি প্রবন্ধে এই বিজ্ঞাপনটি ব্যবহার করেছিলেন। ড. শশিভূষণ দাশগুপ্ত তাঁর বইতে এই প্রবন্ধাংশটি পুনরুদ্ধৃত করেছেন। সেটি এরকম: কবিরাজ শ্রীযতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত মহাশয় কাব্য কালান্তক রস আবিষ্কার করিয়া যমনায় কিছুকাল আগে এক বিজ্ঞাপন দিয়াছিলেন। ইহাতে নতুন কবিতা, পুরাতন কবিতা, ঘুষঘুষে কবিতা, প্রবল-কম্প কবিতা, পালা কবিতা, বিষম কবিতা, ধোঁয়া-ধোয়া কবিতা, চাকরী-চাপা কবিতা প্রভৃতি যেরূপ কবিতা রোগই হউক না কেন, নিশ্চয় ফল পাওয়া যাইবে বলিয়া আশ্বাস দিয়াছিলেন। বুকজ্বালা, হু হু করা চোখে ঝাপসা দেখা, প্রাণ কেমন করা, রাত্রে-নিদ্রা-না আসা, পেট ফাপা, মাঝে-মাঝে হাত-শুড়-শুড়-শুড় করা ইত্যাদি উপসর্গ এক বটিকা সেবনেই সুশমিত হইবে। বিশেষ চেষ্টায় বেতস, বিছুটি-প্রভৃতি শাস্ত্রোক্ত কয়েকটি দেশীয় গাছগাছড়ায় এই মহৌষধ প্রস্তুত। পথ্যের কোন ধরাকাট নাই। কেবল ঔষধ ব্যবহারের সময় ও পরেও একমাস জোস্না লাগান, ফুল শোঁকা এবং মাসিকের সম্পাদকের সহিত পত্র বিনিময় নিষিদ্ধ।' (উৎস: 'হোম-শিখা' পত্রিকা: ফাল্গুন ১৩৬১) সমস্ত রকমের কাব্যিক বাষ্পাবিলতার বিরুদ্ধে শস্ত্রলেখনী যতীন্দ্রনাথের কবি-স্বভাবের বিশিষ্টতাটিকে চিএেই বিজ্ঞাপনটির মধ্য থেকে। তবে মনে স্বাতভোর পরিচায় য, মরীচিকার সব কটি কবিতাই কিন্তু তাঁর এই প্রভাব • যতীন্দ্রনাঘ তাঁর এই 'মরীচিকা' উৎসর্গ করেছিলেন তাঁর কবিবন্ধু যতীন্দ্রমোহন বাগচিকে/ উৎসর্গপত্রে তিনি লিখেছেন, 'দাহন রসের গহন সাধন, উষর তুষার সজল স্বপন / মরুমমের মরীচিকা-ধন' তিনি অর্পণ করেছেন তাঁর কথিবন্ধুর হাতে। কি তাঁর এই দাহন রসের গহন সাধন উষর তুষার সজল স্বপন' কিংবা তার 'মরুমমের মরীচিকা ধন' তাঁর এই কাব্যের প্রতিনিধি স্থানীয় কবিতাগুলিই খুব স্পষ্টভাবে চিনিয়ে দেয় তাকে। তার কথা বলার আগে আমাদের চোখে পড়ে বইয়ের শুরুতেই উদ্ধৃত। রবীন্দ্রনাথের ‘উৎসর্গ' কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া এই কবিতাংশটি—‘মরীচিকা’ লয়ে জুড়াব নয়ন/ আপনারে দিব ফাকি।/ সে আলোটুকুও হারায়েছি আজ| আমরা খাঁচার পাখি।' উৎসর্গ' কাব্যগ্রন্থের অন্য আর সব কবিতাগুলির মধ্যে ‘রসতীর্ঘ পথের পথিক' রবীন্দ্রনাথের পরম আস্তিক্যদীপিত যে কণ্ঠস্বরটি আমরা শুনতে পাই, তারই মধ্যে এই পিঞ্জরান্তরীণ একটি পাখির রূপকের মধ্য দিয়ে মানব-অস্তিত্বের যে বেদনার্ত উচ্চারণ ধ্বনিত হয়েছে তার ‘বন্ধু’র, তার ‘হৃদয় বন্ধুর' উদ্দেশ্যে, সেটি একটি বিরল ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত। ইতিপূর্বে ‘মরীচিকা’র আর-একটি বাকপ্রতিমা রবীন্দ্রনাথ ব্যবহার করেছেন এই গ্রন্থের ৭ সংখ্যক কবিতায়। সেখানে তিনি লিখছেন, 'বক্ষ হইতে বাহির হইয়া/ আপন বাসনা মম / ফিরে মরীচিকা সম'। আর এই কবিতায় যে পাখিটির মনে হয়, আজ কি ঘোর প্রলয়রাত্রি ঘনিয়ে এলো, চিরদিবসের আশ্বাস কি ঘুচে গেল? এই গহন কালিমালিপ্ত আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে বন্দী বিহঙ্গসমাজের প্রতিনিধি হিসেবে এক আর্ত পাখির কণ্ঠে আমরা কবির উচ্চারণ শুনি, ‘দেবতার কৃপা আকাশের তলে কোথা কিছু নাহি বাকি?' একদিন যখন সমাসন্ন ফাল্গুন দিনে দক্ষিণাপবন সুদূর কুঞ্জভবন থেকে সুবাস বহন করে নিয়ে আসত, তার মধ্যে খাঁচার পাখি খুঁজে পেত এক অপূর্ব আশা। আর রাত্রি প্রভাত হলে, উদ্ভাসিত আলোর কোন মায়ামন্ত্রে ঘন অন্ধকারে-আঁকা তার লোহার শলাকা রঞ্জিত করে তুলতো ‘সোনার সুধায়’। সে যেন তার মধ্যে অনুভব করতো সারা বিশ্বের স্পর্শ! আর আজ, এই অবগাঢ় অন্ধকারের মধ্যে পূর্বাচলে দেখা যায় না আলোকাদ্ভাসিত কোনও স্বর্ণরেখা, তাই খাঁচার পাখি তার হৃদয়বন্ধুর কাছে যখন জানায়, ‘আজি শৃঙ্খল বাজে অতি সুকঠোর, তখন তার এই খাঁচার বাঁধনকে ভোলাবার

মতো কোনো কিছুই তো নেই; তাই অন্তরে বাহিরে কাকে সে আজ খুঁজে ফিরবে? ওই যে ক্ষণজীবি সোনার আলো, সে তো মরীচিকারই মতো, –সেটুকু নিয়েও যে সে নিজেকে ভোলাবে, নিজেকে সান্ত্বনা দেবে, তা ও তো নেই। তাই তার মনে হয়, এই মায়ামরীচিকার মতো আলোকটুকুও আজ আমরা হারিয়েছি- 'সে আলোটুকুও হারায়েছি আজি আমরা খাঁচার পাখি। এই কবিতার শেষ স্তবকে খাঁচার পাখি তার হৃদয়বন্ধুর উদ্দেশ্যে বলে যে, তাদের এই আর্দ্র ভীতিবিহ্বল বেদনা যেন তাঁর হৃদয়ে কোনও বেদনা সঞ্চারিত না করে তাঁর পায়ে তো নেই কোনও লোহার বাঁধন; অতএব তিনি যেন খাঁচার পাখির এই পিঞ্জরদ্বারে বসে তাদের জন্য অশ্রুমোচন না করেন। তিনি যেন সমাকীর্ণ মেঘের উর্ধ্বে উড়ে গিয়ে নির্মল শূন্যতার মাঝখানে শোনান তাঁর দিব্য তান, যে তানে ধ্বনিত হোক পরম আস্তিক্যের এই বাণী- যে, না, নিভে যায়নি প্রভাতসূর্যের আলো; আর নিরুদ্ধে নেত্রে খাঁচার পাখিরা শুনতে থাকুক সেই বিশ্বাসী আলোর গান। কবিতাটির শেষাংশের বক্তব্য কি রবীন্দ্রনাথের বহুশ্রুত প্রত্যয়সিদ্ধ আস্তিক্যের? না কি ঈষৎ শ্লেষতীষ্ম এক বিচলিতবিশ্বাস কবির ভিন্ন কণ্ঠস্বর? আমাদের মনে হয়, দ্বিতীয়টাই। আর হয়তো এই উৎস থেকেই কবি যতীন্দ্রনাথের নিজস্ব উজানযাত্রা।

‘মরীচিকা’র শুরু থেকেই এই খাঁচার পাখির নতুন মরুযাত্রা। তাই তাঁর কাব্যগ্রন্থ শুরু হয় 'বহ্নিস্তুতি' দিয়ে। সারাবিশ্ব চরাচর-পরিব্যাপী এই বহ্নিজালার মধ্যেই তিনি খুঁজে পান তাঁর অন্বিষ্ট জীবনসত্যাকে। এ জীবনসত্য তথাকথিত সত্য-শিব-সুন্দরের প্রথাসিদ্ধ অনুধাবন নয়; তাঁর কাব্যের আরাধ্য দেবতা যে শিব তিনি তো রুদ্র। সেই রুদ্রের বহ্নিজ্বালাই তো তিনি দেখতে পান সর্বত্র। তাই তাঁর ‘বহ্নিস্তুতি’-তে শুনি : 'তপনতপ্ত চির অতৃপ্ত অনন্তরূপবহ্নি!/ শিবললাটিকা, প্রলয়াত্মিকা তুমি দীপশিখা তন্ত্রী।/ রক্তবসন, ভস্মআসন, বিশ্বশাসন জ্যোতি,/ কান্ত ভয়াল, আঁধারের আলো তোমারে করি গো নতি। বিদ্যুতে তব ইঙ্গিত ঝলে, বজ্রে জাগিছে বাণী,/ মানবচিত্তে আণবনৃত্যে তোমারি সে টানাটানি। এমনি করে পুরো কবিতাটি জুড়ে যে বহ্নির বন্দনা, সেই বহ্নির মধ্যেই তো তিনি খুঁজে পান তাঁর চির-চেনা-আরাধ্য দেবতা বিভূতিভূষণ শঙ্কর'-কে। 'বহ্নিস্তুতি' দিয়ে শুরু, তাঁর 'মরীচিকা' কাব্যের শেষ কবিতা ‘আহুতি'-তে সেই বহ্নির উদ্দেশ্যেই তিনি নিবেদন করেন তাঁর অর্ঘ্য। 'তোমাতে দিলাম আমার আহুতি হে চির বহ্নিশিখা / সকল ব্যর্থ প্রয়াস যেখানে লিখিছে মৃত্যুলিখা।...

স্বর্ণ আপনি হয়ে উজ্জ্বল তোমারে করিয়া ম্লান,/ আমারি মতন অঙ্গারে দহি •আছে গো জ্যোতিষ্মান।... বলে উঠ তব আহুতি লইয়া আজি আছে মোর যাহা / তোমাকে দিলাম তোমাকে দিলাম, ওঁ স্বধা, ওঁ স্বাহা।সমগ্র সৃষ্টি প্রপঞ্চের অনিবার্ণ জ্বালার মধ্যে কবি অনুভব করেন, 'সকল জালার সব দীপ্তির পরিণাম শুধু ছাই”। আর তার ফলেই এই জ্বালা আর দীপ্তির ভিতরে কবি শুধু দেখেন অনিঃশেষ দুঃখ এবং যন্ত্রণা। তার আরাধ্য অধিদেবতা এই যে দেবাদিদেব বিভূতিভূষণ শিব, ‘শিবের গাজন’ কবিতায় মরা বছরের বুকের উপর তাঁর প্রলয়-ছন্দ এবং সৃজনানন্দের যে নৃত্যপাগল মৃত্যুঞ্জয়-মূর্তিটি ফোটে, তার মধ্যে পৌরাণিক শিব ধরা পড়েছেন আমাদের এই লোকায়ত প্রত্যক্ষ জীবনেরই পটে। তাঁর ব্যক্তিগত বেদনার অনুষঙ্গে পৌরাণিক সমুদ্রমন্থনের কাহিনীও ‘লক্ষ্মীর উদ্ধার' কবিতায় যেন পেয়ে যায় একটি নতুন মাত্রা। কিন্তু কবির বিশিষ্ট জীবনদৃষ্টির পরিচয় সবচেয়ে বেশি করে পাওয়া যাবে, যে কবিতাটির মধ্যে, সেটি হল সাতটি ‘ঝোঁক’ চিহ্নিত তাঁর ‘ঘুমের ঘোরে’ নামের পরস্পরসম্পৃক্ত এবং পরস্পরের পরিপূরক কবিতাগুলি। যে ঈশ্বর পৃথিবী আর ভালোবাসাকে ঘিরে আমাদের বহুমানিত উচ্ছ্বাস এবং অতীন্দ্রিয়তার অমিত উচ্চারণ, শাণিত-বিদ্রূপ আর সুতীক্ষ শ্লেষে বারবার নানা বিতর্কবন্ধুর প্রশ্নবাণে ছিন্নভিন্ন করেছেন তিনি তাদের। বিশ্বচরাচরের অসঙ্গতিকীর্ণ জীবনের এই বিচিত্র রূপ দেখে তাঁর মনে হয়, 'জগৎ একটা হেঁয়ালি/ যত না নিয়ম তত অনিয়ম গোঁজামিল খামখেয়ালি।' দেবতা? তিনি তো : ‘তুমি শালগ্রাম শিলা / শোয়াবসা যায় সকলি সমান, তারে নিয়ে রাসলীলা!' তাই তাঁর প্রশ্ন, 'তবে জয়-জয় চারিদিকে হয়, আলোক পাইল লোক / শুধাই তোমায় কি আলো পেয়েছে জন্মান্ধের চোখ?’... চেরাপুঞ্জির থেকে,/ একখানা মেঘ ধার দিতে পার গোবি সাহারা রসহস্র অসঙ্গতির মাঝখানে যে কবি তাঁর হৃদয়বন্ধু ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা জানান সব কিছু ভুলিয়ে দেওয়া ঘুমের তাঁর এই ঘুমিওপ্যাথির নব্য নিদানের প্রার্থনা বাস্তবিকই চিরকালের বাঙালি-কাব্যপাঠের এক অসামান্য অভিজ্ঞতা ও উপার্জন। এ তো শুধু নিতান্তই দুঃখের পাঁচালী শোনানো এক কবির উচ্চারণ নয়- স্রোতের বিরুদ্ধে যাওয়া জীবন ও মানুষকে ভালোবাসা এক নি:সঙ্গ যোদ্ধার বহুমাত্রিক প্রকাশ। শেষপর্যন্ত যে স্রষ্টার সঙ্গে ‘অশ্রুপরশি' 'আধাসন্ধি' করেন কবি, তিনি নিজেই তো বিশ্বপ্রপঞ্চের দু:খ বুকে-বওয়া অসহায় ঈশ্বর-আর কবির কল্পনায় বারবার তিনি ফিরে-ফিরে

আসেন, দুঃখের দেবতা কবির আরাধ্য শিবের মূর্তিতে। এই বইয়ের 'চামড়ার কারখানা' সর্ষেফুল' 'সার্থক' ইত্যাদি নিশ্চয়ই কবিতা হিসেবে উঁচুদরের নয়-তবে তাঁর এই বিশিষ্ট মানসিকতারই পরিচয়বাহী।‘মরীচিকা'র অন্তর্গত আর কিছু কবিতায়, গড়নের দিক থেকে যতীন্দ্রনাথের অনুশীলিত পারিপাট্যের পরিচয় মিলবে কিন্তু এ সব কবিতাও তাঁর মরু কবি পরিচয়ের সঙ্গে আদৌ সম্পৃক্ত নয়। 'বউ কথা কও' ‘পল্লীর দোকানি' 'আত্মজগৎ' 'শেষযাত্রী' ‘অকাজের জীবন’ ‘বংশীধারী’ 'রূপহীনা' 'স্বামী-দেবতা' 'সাদা-পাতা' 'সংশয়'-এমনি সব কবিতার কথা এক্ষেত্রে উল্লেখ করা যেতে পারে। যে রোমান্টিকতার বিরুদ্ধে তাঁর বিদ্রোহ, যতীন্দ্রনাথের অন্তরশায়ী আর এক নিভৃত রোমান্টিক কবিও কিন্তু মাঝে মাঝে উঁকি দিয়েছে এইসব কবিতার ভিতর থেকে। 'মরীচিকা’র ‘মন-কবি’ নামের কবিতায় তিনি সুনিশ্চিতভাবে চিনিয়ে দেন তাঁর অবস্থানটিকে। নিজেকে তিনি প্রশ্ন করেন : /তুইও তাই বলবি; -বাঁধা পথে চলবি-/ আগে পিছে আগাগোড়া আপনাকে ছলবি!’ না, আত্মছলনার বাঁধা-সড়কের যাত্রী তিনি নন- নিজের চোখে দেখা বঞ্চিত লাঞ্ছিত মানুষের বিপন্ন বেদনাময় জীবনের ছবির এবং তাদের প্রতি এক গভীর মমতায় সহমর্মিতার সুর আমরা শুনতে পাই তাঁর এই বইয়ের ‘মানুষ’ ‘চাষার বেগার’ ‘পথের চাকরি’ এমনি-সব কবিতায়। আবার 'বারনারী' কবিতায় সমাজের অস্তেবাসিনী তথাকথিত ঘৃণিতা নারীদের প্রতি তাঁর যে সশ্রদ্ধ প্রণতি, সেখানে কবির তথাকথিত ‘দুঃখবাদী, নয় দু:খীবাদী পরিচয়টিই বড়ো ওঠে আমাদের সামনে। ‘মরীচিকা’র ‘নব-নিদাঘ’ এবং ‘শীত’ কবিতা দুটিও যতীন্দ্রনাথের কবিসত্তার এক গুরুত্বপূর্ণ পরিচয়বাহী সৃষ্টি ।

কবির দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ 'মরুশিখা' বেরোয় বাঙলা ১৩৩৪ সালে, ইংরেজি ১৯২৭-এ। এই কাব্যগ্রন্থের প্রথম কবিতা 'শিবস্ত্রোত্র'। যে ‘বিভূতিভূষণ শঙ্কর-এর কথা আর শিবের গাজনের কথা তিনি শুনিয়েছিলেন 'মরীচিকা’য় ঘুমের ঘোরের 'সপ্তম ঝোকে, যে অনন্ত ব্যথার অধীশ্বরের সঙ্গে তাঁর অশ্রুমন্থ 'আধাসন্ধি' তিনিই তো এখানে তাঁর আরাধ্য শিব। তবে এখানে তিনি 'কৃপাময়' মৃত্যুঞ্জয়, সর্বদু:খত্রাতা, চিরসুন্দর, শুভঙ্কর, ব্যথাহারী, চন্দ্রশেখর, পাপ-তাপহর, ভব-কাণ্ডারী শিব নন। কেননা, তিনি বলেন, এসব মন্ত্রে, জাগে না হৃদয়, লাগে যেন পরিহাস; / ব্যথার দেবতা কহ গো.….. গোপন বেদনার ইতিহাস। তাঁর মনে হয়েছে 'সুখের দেবতা মরে যুগে যুগে তুমি চির দু:খময়,/ সুখ বাঁচে মরে দু:খ অমর-তুমি মৃত্যুঞ্জয়। এই যেমৃত্যুঞ্জয় শিষ, যিনি তাঁর 'বিরাট বক্ষে চিরনিরুপায় বিশ্বের ব্যথা' বহন করে মাঝে মাঝে জেগে ওঠেনি বিদ্রোহী মূর্তিতে। আর যেদিন এই মহারুদ্র জেগে উঠবেন তাঁর সর্ববিধ্বংসী প্রলয়ংকর মূর্তিতে, সেই দিনের প্রত্যাশায় কবির কণ্ঠে বেজে ওঠে এই উচ্চারণ- জয় শঙ্কর, প্রলয়ংকর, জয় দুঃখের রাজা।

এই দু:খের রাজা'র বন্দনাকারী কবি তাঁর আত্মপরিচয় দেন নিজেকে 'দুঃখবাদী' বলে। এই কাব্যের 'দুখবাদী' কবিতাটি তাঁর কবিচারিদ্র্যের সেই বিশিষ্ট অভিজ্ঞানেরই পরিচায়ক না, দুঃখবাদের কোনও তাত্ত্বিক কবিভাষ্যের কথা বলেননি তিনি এই কবিতায় প্রকৃতি-মুগ্ধ রোমান্টিক প্রকৃতি স্তাবকদের বিপরীত কোটিতে দাঁড়িয়ে তিনি বলেন : 'বাহিরের এই প্রকৃতির কাছে, মানুষ শিখিবে কিবা?/ মায়াবিনী মরে বিপথযাত্রী করিছে রাত্রি দিবা।” তাঁর মনে হয়েছে, 'বজ্র লুকায়ে রাঙা মেঘে মেঘ হাসে পশ্চিমে আনমনা / রাঙা সন্ধ্যার বারান্দা ধরে রঙিন বারাঙ্গনা! / খাদ্যে-খাদকে বাদ্যে-বাদকে প্রকৃতির ঐশ্বর্য,/ ষড়ঋতুর ছলে ষড়রিপু খেলে কাম হতে মাৎসর্য। তাই স্বেচ্ছাচারী ঈশ্বর ও অদ্ধ জড়শক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে কালের সাক্ষী এই কবি শোনান তাঁর সমকালের মৃত্যুত্তীর্ণ বন্দীর বন্দনা : 'শুনহ মানুষ ভাই!/ সবার উপরে মানুষ শ্রেষ্ঠ, স্রষ্টা আছে বা নাই।/ যদিও তোমারে ঘেরিয়া রয়েছে মৃত্যুর মহারাত্রি,/ সৃষ্টির মাঝে তুমিই সৃষ্টিছাড়া দুখপথযাত্রী।' এই দুখ-পথ-যাত্রী 'নবপন্থা'র কবি তাঁর ‘বন্ধু’ এ কার পাপ?/ এত দোষ ত্রুটি, এত অন্যায়, এত যে দু:খ তাপ!' আর এই প্রশ্নাতুর মানবতান্ত্রিক কল্পনা ও বাস্তবের বিপুল অসঙ্গতির মাঝখানে দাঁড়িয়ে একদিকে অকরুণ দৈব এবং অন্যদিকে নিপীড়িত মানুষের অসহায় বেদনার ছবি ফুটিয়ে তোলেন তাঁর ‘মৃরুশিখা’র ‘লোহার ব্যথা' 'খেজুর বাগান’ ‘কাণ্ডারী' কিংবা ‘রাশির গল্প’র প্রতিবাদী অশ্রুপুত রূপকের মধ্য দিয়ে। তাঁর 'দুখবাদী ই ভিন্নমাত্রিক আর-এক উচ্চারণ শুনি তাঁর এই কাব্যেরই ‘কবির কাব্য' নামক কবিতাটির মধ্যে।

ভণ্ড দেশহিতৈষীদের বিরুদ্ধে তাঁর শাণিত বিদ্রুপের পরিচয় মিলবে এই কাব্যের ‘দেশোদ্ধার' কবিতায়। 'মরুশিখা'র মোট ৪১টি কবিতার মধ্যে নানা যতীন্দ্রনাথের আরও বিচিত্র পরিচয় ছড়িয়ে থাকলেও তাঁর এই কাব্যের কেন্দ্রে যার অধিষ্ঠান সে হল মানুষ। দু:খসম্ভব মানবজীবনের ব্যথার ভাষাকার এই কবি ‘মর্ত্য হইতে বিদায় (প্রভাসে শ্রীকৃষ্ণ)' কবিতায় পুরাণের নবভাষ্য রচনাতেই হোক, কিংবা অকিঞ্চিৎকর ‘গাড়োয়ান' বা 'গোরালা’র গল্পেই হোক, সর্বত্রই বলেন জীবনের কথা বলেন মানুষেরই কথা।কবির তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ 'মরুমায়া' বেরোয় বাঙলা ১৩৩৭ সালে, ইংরেজি ১৯৩০-এ। এই বইয়ের মোট ৩০টি কবিতার মধ্যে 'মরীচিকা' এবং 'মরুশিখা'র কবির কণ্ঠস্বর যে পরিণতি অর্জন করেছে তার মধ্যেই নিহিত রয়েছে তাঁর পরবর্তী স্বরাস্তরের ইতি। এখানেও আছে তাঁর আপন 'দাহন গর্বে’ ‘বন্ধু’র অন্বেষণ, আছে তাঁর রুদ্র দেবতার ‘শিবতাণ্ডব' আছে যুধিষ্ঠির স্বর্গারোহণ' 'বিভীষণ' কিংবা শরশয্যায় ভীষ্ম'-এর মতো কবিতায় পুরাণের আত্মভাষা রচনা। এরই মধ্যে 'মুক্তিঘুম' কিংবা 'লীলাকীর্তন'-এর মতো কবিতায় যেমন অতীন্দ্রিয় মুক্তির ধারণার বিরুদ্ধে তাঁর যুক্তিশাণিত তির্যক বাকভঙ্গি তেমনি ওই একই পরিহাসবিজল্পিত বিদ্রূপে যাবতীয় লৌকিক ও অতিলৌকিক সৌন্দর্যের ধারণাটিকে তিনি অনাবৃত করে দেখিয়েছেন। এখানে যেমন আছে, 'ফেমিন রিলিফ'-এর মতো কবিতায় একদিকে দুর্ভিক্ষের রিলিফের টাকায় আবাল-বৃদ্ধবনিতা সব ধরনের দুর্গত মেহনতি মানুষের মাটি-কাটার কাহিনী, কিংবা, উপঝরণ বর্ষণমন্ত্রিত শ্রাবণের একটি দিনে বিধবা ভিখারি পাঁচীর একমাত্র ছেলের সাপের কামড়ে মর্মান্তিক মৃত্যুর কথা তার মধ্যে আমরা খুঁজে পাই লোকোত্তর নয়, এই লোকায়ত জীবনেরই মানবপ্রেমির কবি যতীন্দ্রনাথকে। এই কাব্যেরই অন্য দুটি কবিতা ‘পাষাণ পথে' এবং 'কেতকী' যতীন্দ্রমানসের বিশিষ্টতাবাহী স্মরণীয় দুটি সৃষ্টি। পাষাণপথের 'বকুল' এবং 'কেতকী' কবিতার কেতকীর পরিণামের মধ্য দিয়ে আসলে তিনি মানব অস্তিত্বেরই যেন ভিন্নতর আর এক রূপক রচনা করেছেন। দেশোদ্ধারেরই অন্য আর একটি মাত্রা দেখি আমরা তাঁর ‘পিছুহটার গান'-এ। তবুও কোথায় যেন একটা 'ছুটি'র সুর বাজে তাঁর কবিতা। এ বুঝি তাঁর আসন্ন 'সায়ম' এর নন্দীবাক!প্রথম তিনটি কাব্যে নানা রূপকে প্রতীকে বারবার নানাভাবে ফিরে-ফিরে এসেছে কবির বিতর্কশাণিত শ্লেষতীষ্ম প্রতিবাদী বক্তব্যগুলি। তার মধ্যে কেউ কেউ দেখেছেন ‘বৈচিত্র্যহীন ক্লান্তিকর একমুখিতা, কেউবা দেখেছেন 'শোচনীয় আত্মনুকরণ,' কেউবা একে মনে করেছেন 'কাব্যের দিগদর্শনের দিক দিয়ে ....কিন্তু জীবনায়নের দিক থেকে এই বীররস পরিত্যাজ্য'। আবার কারও কাছে মনে হয়েছে, তাঁর প্রথম দিককার কাব্যে, এই ঘোষণা, বড় বেশি প্রগলভ। এসব কথার মধ্যে যে যেমনভাবে সত্য খুঁজে পান না কেন, তাঁর এই তিনটি কাব্য কি নিতান্তই বৈচিত্র্যহীন? যে কবি আর পাঁচজনের হাঁটা পথের সহযাত্রী নন, যাঁকে গড়ে তুলতে হয় আপন অন্বিষ্ট কাব্যদর্শ— নানাভাবে তাঁর এই বক্তব্যকে প্রতিষ্ঠা দেবার বহুধাবিস্তৃত প্রয়াস ও প্রযত্ন কি নিতান্তই বৈচিত্রহীন? এই কাব্য তিনটির সচেতন পাঠক হয়তো এই মতের সঙ্গে সহমত পোষণ করবেন না বলেই আমাদের ধারণা।তাঁর চতুর্থ কাব্যগ্রন্থ 'সায়ম' প্রকাশিত হয় বাঙলা ১৩৪৮ সালে, ইংরেজি ১৯৪১-এ। কবির বয়স তখন ৪৮ বছর। আসন্ন প্রৌঢ়ত্বের দরজায় দাঁড়িয়ে কবি যেন তাঁর জীবনসন্ধ্যার এক নতুন সুর শোনাতে চাইলেন তাঁর এই কাব্যের কবিতাগুলিতে। এই কাব্যগ্রন্থে তাঁর আরাধ্য ইষ্ট-দেবতা শঙ্কর সম্ভর্যণের ভূমিকায় এখানে ব্রাত্য মানুষের সহযাত্রী ‘লোকনাথ' শিব। দরিদ্র কৃষিলগ্ন মানুষের দেবতা এই শঙ্কর তাদেরই সঙ্গে নতুন ফসল ফলানোর দেবতা। 'অঘ্রাণের শ্বাসরোধী' এক 'ধূম্রগন্ধা সন্ধ্যায় তাঁর এই নটরাজ কবির কাছে দেখা দেন ন্যূজদেহ বৃদ্ধ এক 'কচি ডাব-বিক্রেতার রূপমূর্তিতে। দুঃখাভিহত জীবন ও মানুষের কবি যতীন্দ্রনাথ সারাজীবন ধরে ধরে যে নীলকণ্ঠ শিবের প্রসাদকামী, এক দারুণ শীতের সন্ধ্যাবেলা তাঁর কাছে তিনি দেখা দিলেন এই দরিদ্র ডাব-বিক্রেতার রূপে। যে সুন্দরের প্রতি এর আগে কবির গভীর অনাস্থা, আজ সেই সুন্দরের আসন্ন কোন পদধ্বনি তিনি শুনতে পান তাঁর মর্মের গভীরে। প্রেম এবং প্রকৃতিকে ঘিরে তাঁর কবিকণ্ঠের এক বিনম্র উচ্চারণ আমরা শুনতে পাই এই গ্রন্থের 'বেদেনী' ‘সুন্দর’ ‘কুরঙ্গিণী, ‘বরনারী' 'বোঝা' 'মন্ত্রহীন' প্রভৃতি কবিতায়। এই কাব্যে ৩৮ টি কবিতা সবই কি তাঁর সন্ধ্যাসংগীত? অবশ্যই তা নয়। তবুও তাঁর এই আর্ত জিজ্ঞাসা তো শুনি তাঁর এই কাব্যের সুন্দরের উদ্দেশ্যে উচ্চারিত প্রশ্নে— ‘ওগো সুন্দর আমার জীবনে/ আনন্দরূপে ফুটিবে না কি? তাই ‘নাস্তিক’ কবিতায় কবির কণ্ঠে শুনি—'মহাশূন্যে ধরণীর এই ভগ্ন নায়ে/ আমার শেষের দিন আসিছে ঘনায়ে । ... তোমারে পাইনি বন্ধু, পাব না তোমায়।/ সকলের আছ তুমি, আমার যে নাই,/ হেঁয়ালির দু:খ মোর কাকে বা জানাই!’ –একদিকে এই আর্ত প্রশ্ন অন্যদিকে মহাভারতের ‘কৃষ্ণা’-কে নিয়ে যেমন শুনি তাঁর মৃত্যুঞ্জয়ী প্রতিবাদী নারীসত্তার এক নতুন ভাষা, তেমনি তাঁর ‘মন্ত্রহীন' কবিতায় দাম্পত্যের বন্ধনে বাঁধা আত্মজীবনের পটে আপন মর্ম এবং মর্মসঙ্গিনী পত্নীকে ঘিরে উচ্চারিত হয়েছে তাঁর নারীবন্দনার এক আশ্চর্য জীবনমন্ত্র।যতীন্দ্রনাথের পঞ্চম কাব্যগ্রন্থ 'ত্রিযামা' প্রকাশিত হয় বাঙলা ১৩৫৫ সাল, ইংরেজি ১৯৪৮-এ। এই বইয়ের ৭৭টি কবিতার মধ্যেও আমরা শুনি প্রেম প্রকৃতি এবং সুন্দরের জন্য তাঁর তৃষ্ণার এক নতুন সুর, আর দেখি কবিতার এক নতুন বাঁক। আজ 'হেমন্তসন্ধ্যায়' তাঁর কণ্ঠে শুনি : 'বসন্তে উপেখিনু ফুলে-ফুলে মিনতি,/ বর্ষার মেঘে মেঘে আহ্বান,/ হেমন্তসন্ধ্যায় মাঠে-মাঠে মন ধায়/ কোন সুন্দরে করি সন্ধান!' কিংবা 'হিমভূমি' কবিতায় আমরা শুনি: ‘এত শীত,-/ আমার অন্তরে এত শীত!'... 'হাতে ধনু পৃষ্ঠে তৃণ/ কিশোর ফাল্গুন, কত দূর? –এই প্রশ্নাতুর কবির কণ্ঠে পালাবদলের যে নতুন সুর আমরা শুনি, তাঁর 'বকুলতলীর ঘাটে' কবিতায় বেজে উঠে কবিমর্মরে অন্য এক স্বরধ্বনি। তিনি বলেন, 'রূপনদীতটে বকুলতলীর ঘাটে / সকাল আমার সন্ধ্যা হইয়া যায়,/ সিনান সারিয়া ফিরিল যে ছায়াবটে/ সে অপরূপার নির্মম নিরাশায়। এই রূপনদী পিছনে ফেলে যে কবি ফিরে গিয়েছিলেন আপন নির্জনে, আর পাঁচজন মুগ্ধ কবির সাধ্য-সাধনাকে যিনি অবহেলাভরে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন, আজ জীবনের শেষ প্রহরে কবির মনে হয় ‘সকাল হইতে সে অপরূপার / ধ্যেয়ানে ঘনালো সন্ধ্যা আমার,/ রূপনদীতীরে তারি নিরাশার/ আশ্বাসে বেলা কাটে,/ বকুলগন্ধে ভরা গো শূন্য/ বকুলতলীর ঘাটে'। যে কবি তাঁর যৌবনে একদিন দৃপ্ত অহংকারে ঘোষণা করেছিলেন, 'প্রেম বলে কিছু নাই,/ চেতনা আমার জড়ে মিশাইলে সব সমাধান পাই।' আজ চেতনার কুজ্ঝটি কূলে/ নির্বাপিত ও তব চিতামূলে/ যৌবন-বেচা জরা বিনিময়ে জড়ত্ব বরিয়াছি/ কুক্ষণে কহা এ মুখের কথা/ এত কালে এ কপালে ফলিল তা,/ প্রার্থিত সেই শেষ সমাধান আসিয়াছে কাছাকাছি।' কি সেই সমাধান? কবির কণ্ঠে শুনি সেই সমাধানের বাণী : 'তুমি নাই তুমি নাই তুমি নাই,— উঠে ঢেউ পড়ে ঢেউ,-/ চেতনে ও জড়ে কাঁদে গলা ধরে,/ দরদী নাহিবা কেউ'/ নতুন জীবনের যে ব্যাকুলতা আজ কবির কণ্ঠে তাঁর ‘রোগশয্যায় কবিতায় শুনি সেই মৃত্যুঞ্জয় জীবনের কথা কবি লিখেছেন, আকাশ নিতান্ত নীল মৃত্যুমদিরায় / জীবনের নেশা কাঁপে তারায় তারায়।' একদিন যে প্রেমকে কবি সবল প্রবলভাবে অস্বীকার করেছিলেন, আজ জীবনের হেমন্ত সন্ধ্যায় কবি তাঁর ‘শপথভঙ্গ' এবং 'মনোরমা' কবিতায় তাঁর সেই অপগত ভালোবাসার উদ্দেশ্য বেদনার অর্ঘ্য নিবেদন করেছেন কবি। আজ জীবনের হেমন্ত সন্ধ্যায় কবি তাঁর উত্তরসন্ততি ‘তনয়-তনয়া তনুসুষমায়' খুঁজে পান তাঁর অপগত যৌবনের এক অপরাহ্নিক সান্ত্বনা।

‘ত্রিযামা’র এই ৭৭টি কবিতার মধ্যে কবি যতীন্দ্রনাথের শেষ-বেলাকার আরও যে কত পরিচয় নিহিত রয়েছে, তার একটি অসাধারণ দৃষ্টান্ত হিসেবে নেওয়া যেতে পারে এই বইয়ের 'ভিখারিণী' নামক কবিতাটিকে। এক অবমানিতা ছিন্নবাসা ভিখারিণীর সহোদরা হিসেবে কবি কল্পনা করেছেন দিব্যমনা মহাকালিকাকে। 'বারনারী' 'ভিখারিণী পর্যন্ত যতীন্দ্রনাথেরনারীভাবনার এক আশ্চর্য পরিচয় আমরা পাই। 'ত্রিযামা’র ‘সমাপ্তি' কবিতায় যতীন্দ্রনাথ লিখেছেন, 'মরমীয়া বন্ধুর মরুময় সন্ধান :- ছুটোছুটি কেটে গেল চৌপর দিনমান।/ ঘনাইল ত্রিযামা যামিনী অমাবস্যায়,/ আকাশে অসংখ্য অসূর্যস্পশ্যা।/ ঝিকিমিকি তারা ভরা ডুব-জল নাবছি/ এ শেষ জলাঞ্জলি কে ধরবে ভাবছি।'

গঙ্গা, যমুনা, গোদাবরী, সরস্বতী, সিন্ধু, কাবেরী, নর্মদা, তাপ্তী সমস্ত নদীর কাছে 'ত্রিযামা' যামিনীর ধ্যাব্রত এই কবি তাঁর প্রার্থনা জানিয়েছিলেন এই বলে 'স্নাতকে দেহ গো আজি স্নিগ্ধ সমাপ্তি।' তাঁর সেই স্নিগ্ধ সমাপ্তির পরিচয় আছে তাঁর এই রাত্রির তপস্যান্তিক কাব্যগ্রন্থ 'নিশান্তিকা'য়। তাঁর এই ষষ্ঠ ও শেষ কাব্যগ্রন্থটির নামকরণ করেছিলেন কবি নিজে। যদিও কাব্যটি প্রকাশিত হয় তাঁর মৃত্যুর পরে বাঙলা ১৩৬৪, ইংরেজি ১৯৫৭ খ্রিষ্টাব্দে। এই কাব্যের ৪৬টি কবিতার মধ্যে কবির পূর্বতন ভাবনারই অনুবর্তন আমরা লক্ষ্য করি নানাভাবে। ঈশ্বর পৃথিবী এবং ভালোবাসা সম্পর্কে তাঁর বিবর্তিত বোধের পরিচয় এখানেও নানাভাবে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর নানা কবিতায়। 'নিশান্তিকা'র প্রথম কবিতা ‘গন্ধধারা’য় তাঁকে বলতে শুনি ফুলের গন্ধ বাজে মোর বুকে,-/ বন্ধু, তোমারে কয়েছি আগে,/ এখন গন্ধ মন্দ লাগে না,/ ফুলের গন্ধ ভালোই লাগে। জীবনের এই শেষ-বেলায় যাবার বেলায় তাই ফুল আনি,/ যতনে সাজাই ভাঙ্গা ফুলদানি/ মহাত্মষাতুর এই মহাপ্রাণী,/ রসের পেয়ালা চাহে।' আজ কবির কণ্ঠে ধ্বনিত হয় এই ব্যাকুল প্রার্থনা : ‘দেখা দাও দেখা দাও।/ আলো নিবিবার আগে একবার/ সুন্দর, মোরে দেখা দাও/ তুমি রয়ে গেলে দেখার অতীত / সবকিছু তাই দেখি কুৎসিত/ দেখার এ দোষ যাবে না যদি না / দেখা দাও।... সারা জীবনের নয়নাশ্রুতে/ চিরসুন্দর, দেখা দাও।' তাঁর এই ব্যাকুল প্রার্থনার পাশাপাশি তাঁর চিরজীবনের স্বাতন্ত্র্যচিহ্নিত কবিস্বভাবটিকেও তিনি চিনিয়ে দিতে ভুল করেন না তাঁর জীবনের এই শেষ প্রহরেও ‘কবি নহি’ কবিতায় তাঁর এই স্পষ্ট স্বীকারোক্তি : কবি নহি আমি, কবি নহি তথাকথিত,/ যে ব্যথা জীবনের সব ছন্দের অতীত-/ আমি, সে ব্যথায় ব্যথিত।' তাঁর অন্তরের বহ্নিমান 'অনির্বাপ্য শিখা' নিয়ে একদার এই মরু কবি আজও অকল্পিত বিশ্বাসে লেখন : 'কবি নহি আমি, করিনি ছন্দে প্রথিত/ যে বিধি বিধান প্রতিবিধানের অতীত:/ আমি মহাবন্ধনে ব্যথিত। নিশিকান্তা'য়, আমরা দেখি তাঁর বন্ধুর সঙ্গে এক নব দ্বৈরথ। হয়তো তাঁরই আজ এই হাতে তাঁর 'পরাভব'জয়। তবুও অনমা মেরুদন্ডী কবির এই অহংকৃত উচ্চারণ: তবু যে বুঝেছি/ 'জাজও যুঝিতেছি সেই মোর গৌরব;/ মানুষের মত মানুষেরই হয়/ বারবার পরাজব।' আর মৃত্যুর কয়েকমাস আগে লেখা তাঁর ‘আসছে জন্মে' কবিতার মধ্যে রোঢ়াবাধের এক শীতের বিকেলবেলার অনুভবে তাঁর মনে তাঁর জাগে অন্তর্হিত অন্তর্যামীর উদ্দেশ্যে এই প্রশ্নময় অনুভব আসছে জন্মে তিনি কি হবেন 'চিরচল পায়ে শৃঙ্খল' একশ বছরে ওই অচল অশথগুঁড়ি, নাকি 'দুধের বদলে জাবনা' পাওয়া 'সদগোপেদের নধর চিকন কালো দুধেলো গাইটি""

এ কবিতাটি কবির শ্লিষ্ট কৌতূকে লেখা এক অসাধারণে আত্ম উন্মোচন । তাঁর 'খোলা চিঠির' কবিতার এই অকপট স্বীকারোক্তি প্রসঙ্গে নিশান্তিকার ভূমিকায় অতুলচন্দ্র গুপ্ত লিখেছিলেন: ছন্দে গাঁথা সত্যের ভীষণতায় নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে।’ ‘ত্রিযামা'-তেই ছিল সদ্য স্বাধীনতা পাওয়া দেশের তথাকথিত দেশপ্রেমিকদের নিয়ে রূঢ় বিদ্রূপে লেখা কয়েকটি কবিতা। নিশান্তিকা'য় তারও পরবর্তীকালের কয়েকটি ছোট-বড়ো কবিতায় স্বাধীনতা পরবর্তী এই সময়ের নানা দুর্নীতি-কলঙ্কিত বাস্তবের কথায় কবির শ্লেষতীক্ষ্ণ উচ্চারণের স্পষ্টতা এক চড়া সুরে বেজেছে যে, সাময়িকের ভাষা হিসেবে তারা স্মরণীয় কিন্তু ভালো কবিতার ধর্ম থেকে বঞ্চিত। 'নিশিকান্তা'য় আর কিছু কবিতায় ‘নানা রস ও বহু রঙ্গ' থাকলেও সেগুলিও কবির এই বিবর্তিত মনোধর্মের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। সেগুলি কবির বহুমুখী পরীক্ষা নিরীক্ষার কথাই আমাদের মনে করিয়ে দেয়। ‘সায়ম’ থেকে ‘নিশান্তিকা পর্যন্ত “শতিদ্রোহ” এই কবি মানুষটির যে বিচিত্র পরিচয়, তা যেমন কবিতার বাণীতেই তেমনি তার শৈলীতে- তারও যে রূপান্তরের নানা কারুকৃতি তাও তাঁর সচেতন এবং সতর্ক পাঠকের এক স্বতন্ত্র অভিনিবেশের বিষয়।ব্যক্তিজীবনে মানুষ হিসেবে যে যতীন্দ্রমোহন আদৌ স্রোতাপন্ন নন, নি:সঙ্গ স্বাতন্ত্র্যে যিনি আলাদা ধাতুতে গড়া অন্য ধরনের এক মানুষ, কবি হিসেবেও তাঁর সেই স্বাতন্ত্র্য তাঁর আপাত রবীন্দ্রদ্রোহী স্বরস্বাতন্ত্র্যে। কিন্তু একটু তলিয়ে দেখলে দেখতে পাবো, আদৌ রবীন্দ্রবিদ্বেষী বা রবীন্দ্রদ্রোহী ছিলেন না তিনি। জীবনের প্রথম প্রহরে সেই যে রবীন্দ্রনাথের প্রতি সশ্রদ্ধ এক অনুরাগ জন্মেছিল তাঁর মনে, সারাজীবন তাকেই তিনি আত্মসাৎ ও অঙ্গীকার করেছেন। তাঁর কবিতায় এবং ব্যক্তিগত জীবনেও। তাঁর এই ছটি কাব্যগ্রন্থে রবীন্দ্রানুভাবিত বিভিন্ন কবিতা এবং রবীন্দ্রনাথের উদ্দেশ্যে নিবেদিত তাঁর কবিতাগুলিও তার প্রমাণ। হয়তো এবারের সেই মুখোশধারীর/ মায়াযুদ্ধেরই 

রবীন্দ্রোত্তর আধুনিক বাঙলা কবিতার সূচনালগ্নে যারা বৈতালিক, সেই সত্যেন্দ্রনাথ, মোহিতলাল মজুমদার এবং উত্তরসুরি নজরুল ইসলামের পাশাপাশি যতীন্দ্রনাথও তাঁদেরই একজন সম্পন্ন সহযাত্রী একথা বিস্তারিতভাবে বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন শশিভূষণ দাশগুপ্ত তাঁর কবি যতীন্দ্রনাথ ও আধুনিক বাঙলা কবিতার প্রথম পর্যায়' নামক গ্রন্থে। আর উত্তরকালের আধুনিকদের সঙ্গে যতীন্দ্রনাথের ভাব এবং ভাষাবন্ধের মিল অমিলের নানা সূত্র দেখিয়ে সুধীন্দ্রনাথ দত্ত থেকে সুকান্ত ভট্টাচার্য পর্যন্ত কবিদের নানা প্রসঙ্গ উত্থাপন করে দেখিয়েছেন ড. অমরেন্দ্র গণাই।কোনও কবির সমস্ত কবিতাই তো সমান মানোত্তীর্ণ হয় না। যতীন্দ্রনাথের পৌনে তিনশো কবিতারও নিশ্চয়ই সে দাবি নেই। তবে ব্যঙ্গশাণিত, শ্লেষতীক্ষ্ম আবার কোমল কণ্ঠস্বরের বাদী-বিবাদী নানা সুরের সমন্বয়ে তৎসম, তদ্ভব এবং একান্ত লোকায়ত নানা দেশজ শব্দের অসাধারণ প্রয়োগের নিপুণতায়, ছন্দের প্রধানত সরল কলাবৃত্ত ছন্দের চমৎকার প্রয়োগ-স্বাতন্ত্র্যে, বাকপ্রতিমার এবং অলংকারের আশ্চর্য ব্যবহারে যতীন্দ্রনাথ নিতান্তই এক তৎসাময়িকের কবিমাত্র নন, তাঁর কবিতার ‘শ্রান্তিহারক রমণীয়তা’ এবং ‘বৈঠকী দু:খবাদই যে তাঁর কবিতা সম্পর্কে শেষ কথা নয়, জীবন ও মানুষের প্রতি দায়বদ্ধ এই কবির ‘কাব্যসংগ্রহ’-এর বিচিত্রস্বাদী কবিতাগুলিই তার প্রমাণ দেবে। সচেতন পাঠকের আনন্দিত আবিষ্কারেই কালজয়ী স্বাতন্ত্র্য ও মহিমা নিয়ে এই যতীন্দ্রনাথ অবিস্মরণীয় গৌরবে বেঁচে থাকবেন বলেই আমাদের বিশ্বাস।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ