Hot Posts

6/recent/ticker-posts

অর্কেস্ট্রা কাব্য আলোচনা

 



 ((অর্কেস্ট্রা কাব্য আলোচনা  
অর্কেস্ট্রা কাব্যের বৈশিষ্ট্য 
অর্কেস্ট্রা কাব্যorkestra kabbo alochona
সুধীন্দ্রনাথ দত্তের কাব্য  আধুনিক বাংলা কাব্য)

**বিঃদ্র-বাংলা বিভাগের সকল পড়াশোনা পেতে ব্লগটিতে যুক্তথাকুন https://monoweredu13.blogspot.com/?m=1 

***অর্কেস্ট্রা কাব্য আলোচনা  ----
এই বইয়ের কবিতাগুলি যাঁর রচনা, তিনি বিশ শতকের একজন শ্রেষ্ঠ বাঙালি, তাঁর মতো নানাগুণসমন্বিত পুরুষ রবীন্দ্রনাথের পরে আমি অন্য কাউকে দেখিনি। বহুকাল ধ'রে তাঁকে প্রত্যক্ষ দেখেছিলুম ব'লে, তাঁর মৃত্যুর পর থেকে একটি প্রশ্ন মাঝে-মাঝে আমার মনে জাগছে যাকে আমরা প্রতিভা বলি, সে বস্তুটি কী? তা কি বুদ্ধিরই কোনো উচ্চতর স্তর, না কি বুদ্ধির সীমাতিক্রান্ত কোনো বিশেষ ক্ষমতা, যার প্রয়োগক্ষেত্র এক ও অনন্য? ইংরেজি 'Genius' শব্দে অলৌকিকের যে আভাস আছে, সেটা স্বীকার্য হ'লে প্রতিভাকে এক ধরনের আবেশ বলতে হয়, আর সংস্কৃত ‘প্রতিভা' শব্দের আক্ষরিক অর্থ অনুসারে তা হ'য়ে ওঠে বুদ্ধির দীপ্তি, মেধার নামান্তর। যদি প্রতিভাকে অলৌকিক ব’লে মানি, তাহলে বলতে হয় যে সহজাত বিশেষ একটি শক্তির প্রভাবেই উত্তম কবিতা রচনা সম্ভব, রচয়িতা অন্যান্য বিষয়ে হীনবুদ্ধি হতে পারেন এবং হ'লে কিছু এসে যায় না, উপরন্তু ঐ বিশেষ ক্ষমতাটি শুধু দৈবক্রমে সহজাতভাবেই প্রাপণীয়। পক্ষান্তরে, প্রতিভাকে উন্নত বুদ্ধি ব'লে ভাবলে কবি হ'য়ে ওঠেন এমন এক ব্যক্তি যার ধীশক্তি কোনো কোনো ব্যক্তিগত বা ঐতিহাসিক কারণে কাব্যরচনায় নিয়োজিত হয়েছিলো, কিন্তু সেই কারণসমূহ ভিন্ন হ'লে যিনি বণিক বা বিজ্ঞানী বা কূটনীতিজ্ঞরূপে বিখ্যাত হতে পারতেন। এই দুই বিকল্পের মধ্যে কোনটা গ্রহণীয়।

বলা বাহুল্য, এই প্রশ্ন আমরা শুধু উত্থাপন করতে পারি, এর উত্তর দেয়া সকলেরই সাধ্যাতীত। কেননা ইতিহাস থেকে দুই পক্ষেই বহু সাক্ষী দাঁড় করানো যায়, তাঁরা অনেকে আবার স্ববিরোধে দোলায়মান বহুমুখী গ্যেটে ও রবীন্দ্রনাথের ‘বিরুদ্ধে’ আছেন একান্ত হ্যেল্ডার্লিন ও জীবনানন্দ, মনীষী শেলি ও কোলরিজের পাশে উন্মাদ ব্লেক ও অশিক্ষিত কীটস, উৎসাহী বোদলেয়ারের পরে শীখর ও নিরঞ্জন মালার্মে। জগতের কবিদের মধ্যে এত বিভিন্ন ও বিরোধী ধরনের চরিত্র দেখা যায়, এত বিচিত্র প্রকার কৌতূহলে বা অনীহায় তাঁরা আক্রান্ত, এত বিভিন্নভাবে তাঁরা কর্মিষ্ঠ ও নিষ্ক্রিয় এবং উৎসুক ও উদাসীন ছিলেন যে, ঠিক কোন লক্ষণটির প্রভাবে তাঁরা সকলেই অমোঘভাবে কবিতা হয়েছিলেন, তা আবিষ্কার করার আশা শেষ পর্যন্ত ছেড়ে দিতে হয়। এবং কবিত্বের সেই সামান্য লক্ষণ— যদি বা কিছু থাকে- তা আমার বর্তমান নিবন্ধের বিষয়ও নয়; এখানে আমি বলতে চাচ্ছি যে সুধীন্দ্রনাথ দত্ত এমন একজন কবি যাঁর প্রতিভার প্রাচুর্যের কথা ভাবলে প্রায়
অবাকই লাগে যে কবিতা লেখার মতো একটি নিরীহ, আসীন ও সামাজিক অর্থে নিষ্ফল কর্মে তিনি গভীরতম নিষ্ঠায় আত্মনিয়োগ করেছিলেন। কেননা সুধীন্দ্রনাথ ছিলেন বহুভাষাবিদ পণ্ডিত ও মনস্বী, তীক্ষ্ণ বিশ্লেষণী বুদ্ধির

অধিকারী, তথ্যে ও তত্ত্বে আসক্ত, দর্শনে ও সংলগ্ন শাস্ত্রসমূহে বিধান; তাঁর পঠনের পরিধি ছিলো বিরাট, ও বোধের ক্ষিপ্রতা ছিলো অসামান্য। সেই সঙ্গে যাকে বলে কাণ্ডজ্ঞান, সাংসারিক ও সামাজিক সুবুদ্ধি, তাও পূর্ণমাত্রায় ছিলো তাঁর, কোনো কর্তব্যে অবহেলা করতেন না, গার্হস্থ্য ধর্মপালনে অনিন্দনীয় ছিলেন, ছিলেন আলাপদক্ষ, রসিক, প্রখর ব্যক্তিত্বশালী, আচরণের পুঙ্খানুপুঙ্খে সচেতন, এবং সর্ববিষয়ে উৎসুক ও মনোযোগী। এই বর্ণনা থেকে বোঝা যাবে যে, একটু চেষ্টা করলেই, বাংলা সাহিত্যের চাইতে আপাতবৃহত্তর কোনো ব্যাপারে নায়ক হতে পারতেন তিনি; আমার এক তরুণ বন্ধুর সঙ্গে এ বিষয়ে আমি সম্পূর্ণ একমত যে সুধীন্দ্রনাথ রাজনৈতিক হ'লে অনিবার্যত নেতৃপদ পেতেন, বা আইনজীবী হ'লে সেই পেশার উচ্চমত শিখরে পৌছতে তাঁর দেরি হ'তো না; তাঁকে অনায়াসে কল্পনা করা যেতো রাজমন্ত্রী বা রাষ্ট্রদূতরূপে, তচিন্তায় নিবিষ্ট হ'লে নতুন কোনো দর্শনের প্রতিষ্ঠা করতে পারতেন না তাও নয়। অথচ এর কোনোটাই তিনি করলেন না, কবিতা লিখলেন। পিতার কাছে আইনশিক্ষা আরম্ভ করে শেষ করলেন না; এম. এ. পড়া আরম্ভ ক'রেই ছেড়ে দিলেন; সুভাষচন্দ্র বসুর ‘ফরওয়র্ড' পত্রিকার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হ'য়েও রাজনৈতিক কর্মের দিকে প্রবর্তনা পেলেন না; বীমাপ্রতিষ্ঠানে কর্মজীবন আরম্ব ক'রেও লক্ষ্মীর বাসস্থানটিকে পরিহার করলেন। এ কি এক তরুণ ধনীপুত্রের খেয়ালমাত্র, না কি এর পিছনে কোনো প্রচ্ছন্ন উদ্যম কাজ করে যাচ্ছে? কেউ-কেউ বলেছেন যে তিনি যেমন তাঁর পিতার বৈদান্তিক আতিশয্যে' উত্ত্যক্ত হয়ে ‘অনেকান্ত জড়বাদে'র আশ্রয় নিয়েছিলেন, তেমনি তাঁর দেশহিতৈষী কর্মবীর পিতাকে থিয়সফিতে আত্মবিলোপ করতে দেখে সমাজসেবায় তাঁর আস্থা ভেঙে যায়। এই যুক্তিকে আর-একটু প্রসারিত ক'রে হয়তো বলা যায় যে দেশ, কাল ও পরিবারের আপতিক সন্নিপাতের ফলে জনকর্মে উৎসাহ হারিয়ে তিনি বেছে নিলেন সেই একটি কাজ, যা শব্দময় হ'য়েও নীরব, এবং সর্বজনের প্রতি উদ্দিষ্ট হ'লেও নিতান্ত ব্যক্তিগত। কিন্তু সত্যি কি তা-ই? না কি তাঁর নাড়িতেই কবিতা ছিলো, দেহের তস্তুতে ছিলো বাক্ ও ছন্দের প্রতি আকর্ষণ, তাই অন্য কোনো পথে যাবার তাঁর উপায় ছিলো না, অন্যান্য এবং অধিকতর প্রভাবশালী বৃত্তির দিকে স্পষ্ট সম্ভাবনা নিয়েও তাই তাঁকে কবি হ'তে হ'লো? তিনি কি অন্যবিধ কীর্তির আহ্বান উপেক্ষা ক'রে কবিতা লিখতে বসেছিলেন, না কি মন্ত্রমুগ্ধ কান নিয়ে অন্য কোনো আহ্বান তিনি শুনতেই পাননি? মূল্যবান জেনেও কোনো কিছু ত্যাগ করেছিলেন, না কি বর্জন করেছিলেন শুধু সেই সব, যা তাঁর কাছে অকিঞ্চিৎকর, বরণ করেছিলেন শুধু তা-ই, যেখানে তাঁর সার্থকতা নিহিত?

এ-কথার উত্তরে আমি বলতে বাধ্য যে জগতের অন্যান্য উত্তম কবিদের মতো সুধীন্দ্রনাথও ছিলেন স্বভাবকবি নন, স্বাভাবিক কবি। তা যদি না হতো, তাহলে
তাঁর মতো মেধাবী ব্যক্তি কবিতা-নামক বায়বীয় ব্যাপার নিয়ে প্রৌঢ়বয়স পর্যন্ত প্রাণপাত পরিশ্রম করতেন না। তাঁর সামনে, রবীন্দ্রনাথের মতো সুযোগ ছিলো অপর্যাপ্ত ব্যক্তিত্বে যাঁদের স্বাভাবিক কবি বলছি আর তাঁরা ছাড়া সকলেই অকবি তাঁরা লোকমানসে কবিরূপেই প্রতিভাত হ'য়ে থাকেন, তাঁদের ক্ষমতার অন্যান্য বিকিরণ শেষ পর্যন্ত সেই একই অগ্নিতে লীন হয়ে যায়। গ্যেটেকে জগতের লোক কৰি ছাড়া অন্য কিছু ব'লে ভাবে কি? জমিদার, ধর্মগুরু, শিক্ষাব্রতী, দেশপ্রেমিক, গ্রামসেবক, বিশ্বপ্রেমিক- রবীন্দ্রনাথ তো কত কিছুই ছিলেন, কিন্তু তাঁর একটিমাত্র মৌলিক পরিচয়ের মধ্যে অন্য সব গৃহীত হ'য়ে গেলো। তেমনি, সুধীন্দ্রনাথের অন্য যে-সব চরিত্রলক্ষণ উল্লেখ করেছি, বা করিনি-তাঁর অধীত জ্ঞান, মনীষিতা, আলাপ-নৈপুণ্য, অসামান্য প্রফুল্লতা ও সামাজিক বৈদগ্ধ, সম্পাদক ও গোষ্ঠীনায়ক হিশেবে স্মরণীয় কৃতিত্ব তাঁর এই সবই তাঁর কবিত্বের অনুষঙ্গ, তাঁর কবিতার পক্ষে অনুকূল বা বিরোধী ধাতু হিশেষে প্রয়োজনীয়; যদি তিনি কবি না হতেন, তাহ'লে তাঁর জীবন ও ব্যক্তিত্ব এরকম হ'তো না, এবং যদি ভিন্ন ধরনের কবি হতেন তাহলে তাঁর জীবন ও ব্যক্তিত্ব ভিন্ন ধরনের হ'তো।

শ্রীমতী রাজেশ্বরী দত্তের সৌজন্যক্রমে সুধীন্দ্রনাথের অনেকগুলি পাণ্ডুলিপিপুস্তক দেখার সুযোগ আমার হয়েছে। ছাপার অক্ষরে তাঁর যে-সব কবিতার সঙ্গে আমরা পরিচিত, সেগুলির আদি ও পরবর্তী লেখন সবই রক্ষিত আছে, তাছাড়া আছে দুটি প্রাথমিক খাতা, যাতে তাঁর কাব্যরচনার সূত্রপাত হয়েছিলো। সর্বপ্রথম খাতাটির তারিখ বঙ্গাব্দ ১৩২৯, অর্থাৎ খৃষ্টাব্দ ১৯২২, সুধীন্দ্রনাথের বয়স তখন একুশ। নামপত্রে লেখা: 'শ্রী শ্রী দুর্গামাতা সহায় শ্রীসুধীন্দ্র নাথ দত্ত। ১৩৯ কর্ণওয়ালিস স্ত্রীট, কলিকাতা।' (মূলের বানান উদ্ধৃত হ'লো।) ভিতরের পাতাগুলোতে আছে কম্পু হাতে মেলানো পদ্য, ছয় বা আট পংক্তি থেকে দু-তিন পৃষ্ঠা পর্যন্ত ব্যাপ্তি তাদের, তাতে বানান অস্থির ও ছন্দ ভঙ্গুর; বাংলা ভাষা ও বাংলা ছন্দ-এই দুই অনমনীয় উপাদানের সঙ্গে সংগ্রামের চিহ্ন সর্বত্র ছড়িয়ে আছে। হস্তলিপিও কাঁচা, এবং সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের, অক্ষরগুলি কোণবহুল ও বিশ্লিষ্ট, তাতে রবীন্দ্রনাথের প্রভাব একেবারেই নেই, এবং আমাদের পক্ষে তা সুধীন্দ্রনাথের ব’লে ধারণা করা সহজ নয়। এটা কেমন ক'রে সম্ভব হ'লো যে সুধীন্দ্রনাথ, একুশ বছর বয়সে, যখন রবীন্দ্রনাথের 'বলাকা' পর্যন্ত ও সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের প্রায় সমগ্র কবিতা বেরিয়ে গেছে, তখন ঐ রকম কাঁচা লেখা লিখেছিলেন?

এর উত্তরে আমি এই তথ্যটি উপস্থিত করবো যে সুধীন্দ্রনাথের প্রথম যৌবনের বাংলা ভাষা তাঁর অন্তরঙ্গ ছিলো না। তাঁর বাল্যশিক্ষা ঘটেছিলো কাশীতে: আনি বেসান্ট কর্তৃক স্থাপিত সেই বিদ্যালয়ে তিনি সংস্কৃত ও ইংরেজি ভালোভাবে শিখেছিলেন, কিন্তু বাংলা চর্চার তেমন সুযোগ পাননি। শুনেছি, কৈশোরে কলকাতায় ফিরে মাঝে-মাঝে মাতার সঙ্গে হিন্দিতে কথা বলতেন। মাতৃভাষাকে স্বাধিকারে আনতে তাঁর যে কিছু বেশি সময় লেগেছিলো তাতে অবাক হবার কিছু নেই; যা লক্ষনীয়- এবং বর্তমান ও ভাবীকালের তরুণ লেখকদের পক্ষে শিক্ষণীয় তা এই

তাঁর মতো মেধাবী ব্যক্তি কবিতা-নামক বায়বীয় ব্যাপার নিয়ে প্রৌঢ়বয়স পর্যন্ত
প্রাণপাত পরিশ্রম করতেন না। তাঁর সামনে, রবীন্দ্রনাথের মতো সুযোগ ছিলো
অপর্যাপ্ত ব্যক্তিত্বে যাঁদের স্বাভাবিক কবি বলছি-আর তাঁরা ছাড়া সকলেই
অকবি-তাঁরা লোকমানসে কবিরূপেই প্রতিভাত হয়ে থাকেন, তাঁদের ক্ষমতার
অন্যান্য বিকিরণ শেষ পর্যন্ত সেই একই অগ্নিতে লীন হ'য়ে যায়। গ্যেটেকে জগতের
লোক কবি ছাড়া অন্য কিছু ব'লে ভাবে কি? জমিদার, ধর্মগুরু, শিক্ষাব্রতী,
দেশপ্রেমিক, গ্রামসেবক, বিশ্বপ্রেমিক- রবীন্দ্রনাথ তো কত কিছুই ছিলেন, কিন্তু তাঁর
একটিমাত্র মৌলিক পরিচয়ের মধ্যে অন্য সব গৃহীত হয়ে গেলো। তেমনি,
সুধীন্দ্রনাথের অন্য যে-সব চরিত্রলক্ষণ উল্লেখ করেছি, বা করিনি-তাঁর অধীত জ্ঞান,
মনীষিতা, আলাপ-নৈপুণ্য, অসামান্য প্রফুল্লতা ও সামাজিক বৈদগ্ধ, সম্পাদক ও
গোষ্ঠীনায়ক হিশেবে স্মরণীয় কৃতিত্ব তাঁর এই সবই তাঁর কবিত্বের অনুষঙ্গ, তাঁর
কবিতার পক্ষে অনুকূল বা বিরোধী ধাতু হিশেবে প্রয়োজনীয়; যদি তিনি কবি না
হতেন, তাহলে তাঁর জীবন ও ব্যক্তিত্ব এরকম হাঁতো না, যদি ভিন্ন ধরনের
কবি হতেন তাহলে তাঁর জীবন ও ব্যক্তিত্ব ভিন্ন ধরনের হতো।

শ্রীমতী রাজেশ্বরী দত্তের সৌজন্যক্রমে সুধীন্দ্রনাথের অনেকগুলি পাণ্ডুলিপিপুস্তক
দেখার সুযোগ আমার হয়েছে। ছাপার অক্ষরে তাঁর যে-সব কবিতার সঙ্গে আমরা
পরিচিত, সেগুলির আদি ও পরবর্তী লেখন সবই রক্ষিত আছে, তাছাড়া আছে দুটি
প্রাথমিক খাতা, যাতে তাঁর কাব্যরচনার সূত্রপাত হয়েছিলো। সর্বপ্রথম খাতাটির
তারিখ বঙ্গাব্দ ১৩২৯, অর্থাৎ খৃষ্টাব্দ ১৯২২, সুধীন্দ্রনাথের বয়স তখন একুশ।
নামপত্রে লেখা : 'শ্রী শ্রী দুর্গামাতা সহায়। শ্রীসুধীন্দ্র নাথ দত্ত। ১৩৯ কর্ণওয়ালিস
ট্রীট, কলিকাতা।' (মূলের বানান উদ্ধৃত হ'লো। ভিতরের পাতাগুলোতে আছে
কন্দ্র হাতে মেলানো পদ্য, ছয় বা আট পংক্তি থেকে দু-তিন পৃষ্ঠা পর্যন্ত ব্যাপ্তি
তাদের, তাতে বানান অস্থির ও ছন্দ ভঙ্গুর; বাংলা ভাষা ও বাংলা ছন্দ-এই দুই
অনমনীয় উপাদানের সঙ্গে সংগ্রামের চিহ্ন সর্বত্র ছড়িয়ে আছে। হস্তলিপিও কাঁচা,
এবং সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের, অক্ষরগুলি কোণবহুল ও বিশ্লিষ্ট, তাতে রবীন্দ্রনাথের
প্রভাব একেবারেই নেই, এবং আমাদের পক্ষে তা সুধীন্দ্রনাথের ব’লে ধারণা করা
সহজ নয়। এটা কেমন ক'রে সম্ভব হ'লো যে সুধীন্দ্রনাথ, একুশ বছর বয়সে, যখন
রবীন্দ্রনাথের ‘বলাকা' পর্যন্ত ও সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের প্রায় সমগ্র কবিতা বেরিয়ে গেছে,
তখন ঐ রকম কাঁচা লেখা লিখেছিলেন?

এর উত্তরে আমি এই তথ্যটি উপস্থিত করবো যে সুধীন্দ্রনাথের প্রথম যৌবনের
বাংলা ভাষা তাঁর অন্তরঙ্গ ছিলো না। তাঁর বাল্যশিক্ষা ঘটেছিলো কাশীতে; আনি
বেসাণ্ট কর্তৃক স্থাপিত সেই বিদ্যালয়ে তিনি সংস্কৃত ও ইংরেজি ভালোভাবে
শিখেছিলেন, কিন্তু বাংলা চর্চার তেমন সুযোগ পাননি। শুনেছি, কৈশোরে কলকাতায়
ফিরে মাঝে-মাঝে মাতার সঙ্গে হিন্দিতে কথা বলতেন। মাতৃভাষাকে স্বাধিকারে
আনতে তাঁর যে কিছু বেশি সময় লেগেছিলো তাতে অবাক হবার কিছু নেই; যা
লক্ষনীয় এবং বর্তমান ও ভাবীকালের তরুণ লেখকদের পক্ষে শিক্ষণীয়-তা এই
যে মাতৃতাষাকে স্ববশে আনবার জন্য ও নিজের কবিত্বশক্তিকে উদ্বুদ্ধ করার জন্য, দিনে অনলসভাবে অনবরত তিনি 'উদ্যমের ব্যথা সহ্য করেছিলেন। তাঁর খাতাগুলিতে দেখা যায়, বাংলা ভাষার কবিতার পংক্তিকে ইংরেজি ধরনে বিশ্লেষ করে তিনি বাংলা ছন্দের প্রকৃতি বুঝে নিচ্ছেন, কোথাও দেখা দিচ্ছে পঠিতব্য পুস্তকের তালিকা, কোথাও পর-পর কতগুলো মিল লিখে রাখছেন। এরই পরিণতিস্বরূপ পরবর্তীকালে আমরা দেখতে পাই, 'পথ' নামক কবিতার আদি লেখনের প্রতিটি পংক্তি উচ্ছেদ ক'রে তারই ফাঁকে ফাঁকে এক-একটি নতুন পংক্তি রচনা করেছেন। দেখতে পাই 'সংবর্তে'র ঈশিত্ব, 'যযাতি’র অতুলনীয় কলাকৌশল। আমার বিশ্বাস, সুধীন্দ্রনাথের প্রবন্ধ প'ড়ে আমি যা বুঝিনি, তাঁর পাণ্ডুলিপিপুস্তকের

সঙ্গে চাক্ষুষ পরিচয়ের ফলে তাঁর সেই গোপন কথাটি আমি ধরতে পেরেছি। বুঝতে পেরেছি, কেন জীবনের শেষ পর্যায়ে তাঁর একাত্মবোধ ঘটেছিলো-ধরা যাক তাঁরই মতো বেদনাবর্ণিল পোল ভেরলেনের সঙ্গে নয়-স্বভাবে যিনি তার একেবারে বিপরীত, সেই নিরঞ্জন মালার্মের সঙ্গে। সুধীন্দ্রনাথ কবিতা লিখতে আরম্ভ করেছিলেন তাঁর স্বভাবেরই প্রণোদনায়, কিন্তু তাঁর সামনে একটি প্রাথমিক বিঘ্ন ছিলো ব’লে; এবং অন্য অনেক কবির তুলনায় যৌবনেই তাঁর আত্মচেতনা অধিক জাগ্রত ছিলো ব'লে, তিনি প্রথম থেকেই বুঝেছিলেন যা আমার উপলব্ধি করতে অন্তত কুড়ি বছরের সাহিত্যচর্চার প্রয়োজন হয়েছিলো—যে কবিতা লেখা ব্যাপারটা আসলে জড়ের সঙ্গে চৈতন্যের সংগ্রাম, ভাবনার সঙ্গে ভাষার, ও ভাষার সঙ্গে ছন্দ, মিল, ধ্বনিমাধুর্যের এক বিরামহীন মল্লযুদ্ধ। তাঁর প্রবৃত্তি তাঁকে চালিত করলে কবিতার পথে-সে-পর্যন্ত নিজের উপর তাঁর হাত ছিলো না, কিন্তু তারপরেই বুদ্ধি বললে, 'পরিশ্রমী হও'। এবং বুদ্ধির আদেশ শিরোধার্য ক'রে অতি ধীরে সাহিত্যের পথে তিনি অগ্রসর হলেন, আত সুচিন্তিতভাবে, গভীরতম শ্রদ্ধা ও বিনয়ের সঙ্গে। তাঁর প্রথম খাতায় অঙ্কিত সেই মর্মস্পর্শী 'শ্রীশ্রীদুর্গামাত সহায়' তাঁর রক্ষণশীল হিন্দু বাঙালি পরিবারের সেই স্বাক্ষরটুকু এতেও বোঝা যায় কী রকম নিষ্ঠা নিয়ে, আত্মসমর্পনের নম্রতা নিয়ে, তিনি কাব্যরচনা আরম্ভ করেছিলেন। এই পর্যায়ের রচনার মধ্যে অনেক ছোটোগল্প বা উপন্যাসেরও খশড়া পাওয়া যায়, তার কোনো কোনোটি সমাপ্ত ও ঔৎসুক্যজনক। সাত বছরের অনুশীলনের ফলে পৌছলেন ‘তন্ত্রী’ পর্যন্ত, যে-পুস্তক, তার বিবিধ আকর্ষণ সত্ত্বেও, তাঁর পরবর্তী কবিতাসমূহের তুলনায় আজকের দিকে কৈশোরক রচনা বলে প্রতিভাত হয়।

১৯২৯-এ প্রথমবার তিনি দেশান্তরে গেলেন, প্রায় সংবৎসরকাল প্রবাসে কাটলো, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে জাপানে ও আমেরিকায়, তারপর একাকী য়োরোপে। এই সময়টি তাঁর কবিজীবনের ক্রান্তিকাল; এই সময়েই, তিনি যাকে অভিজ্ঞতা বলতেন, তা তাঁর কবিতার মধ্যে প্রবেশ করে। সঙ্গে খাতাপত্র নিয়েছিলেন, জাপানের জাহাজে আরম্ভ করলেন একটা ভ্রমণবৃত্তান্ত, পেনসিলে ও কালিতে বিবিধ গদ্য-পদ্য রচনা, দেখে মনে হয় রোজই কিছু-না-কিছু লিখছেন। আমরা সাগ্রহে লক্ষ করি, ভাব বদলাচ্ছে, দেখা দিচ্ছে ভাবুকতা ও সংহতি, সুন্দরভাবে রূপান্তরিত হচ্ছে হস্তাক্ষর। তারপর
রোমাঞ্চিত হ'য়ে আবিষ্কার করি আমাদের বহুপরিচিত কতিপয় কবিতা- 'অর্কেস্ট্রা'র পর্যায়ভুক্ত কোনোটির রচনাস্থল আমেরিকা থেকে ফ্লোরোপগামী তরণী, কোনোটির বা রাইনের তীরবর্তী কোনো নগর। ইতিমধ্যে কিছু একটা ঘ'টে গেছে: ভূলোক হয়েছে আরো বাস্তব, দ্যুলোক উজ্জ্বলতর: জেমস জয়েস যাকে 'এপিফ্যানি' বলেছিলেন আর রবীন্দ্রনাথ 'স্বপ্নভঙ্গ', তেমনি কোনো উন্মীলনের প্রসাদ তিনি লাভ করেছেন; প্রকৃতি ও সুধীন্দ্রনাথ দত্তের সহযোগে ও চক্রান্তে বাংলা ভাষায় আবির্ভূত হয়েছেন এক নতুন বাকসিদ্ধ পুরুষ।

তিনি কি বুঝেছিলেন যে তাঁর সাতবৎসরব্যাপী পরিশ্রম এবারে পুরস্কৃত হয়েছে? বোঝেননি তা তো হতে পারে না, কেননা তাঁর নিরন্তর সাধনা ছিলো আত্মোপলব্ধি। আর সেইজন্যেই, তৃপ্তির তিলতম অবকাশ নিজেকে না দিয়ে তিনি আরো ব্যাপকভাবে প্রস্তুতির আয়োজন করলেন; প্রকাশ করলেন 'পরিচয়', পাঠ করলেন যা-কিছু পাঠযোগ্য, বৈঠক জমালেন শুক্রবারে, বন্ধু বেছে নিলেন সাহিত্যিক ও মনীষীদের মধ্যে, লিখলেন পুস্তক-সমালোচনা, প্রবন্ধ ও ছদ্মনামে ছোটোগল্প, তিনটি য়োরোপীয় ভাষা থেকে কবিতা ও গদ্য অনুবাদ করলেন। আর তাঁর নিজের কবিতা? এই সবই তো তাঁর কবিতারই ইঙ্কন, এই সমস্ত কিছুর প্রভাব ও অভিঘাত, উদ্বৃত্ত ও অনুষঙ্গ, তাদের যোগ ও বিয়োগের অঙ্গে সর্বশেষ যে-ফলটুকু দাঁড়ায়, তাঁর কবিতা তো তা-ই। তাঁর ‘পরিচয়’ পত্রিকা তাঁর কবিতার পাঠক সৃষ্টি করেছে, কবিতার শ্রীবৃদ্ধি করেছে তাঁর উদ্ভাবিত শব্দসমূহ, দার্শনিক প্রবন্ধসমূহ স্থাপন করেছে সমকালীন জগতের সঙ্গে তাঁর কবিতার সম্বদ্ধ, সাহিত্যিক প্রবন্ধসমূহ বুঝিয়ে দিয়েছে তাঁর কবিতার আদর্শ কী এবং সিদ্ধি কোনখানে, এবং অনুবাদগুচ্ছ বর্ধিত করেছে স্বাধীন রচনার উপর তাঁর কর্তৃত। সবই কবিতার জন্য। সুধীন্দ্রনাথ দত্ত সম্বন্ধে ন্যূনতম কথা এই বলা যায় যে তাঁর মতো বিরাট প্রস্তুতি নিয়ে আর কেউ বাংলা ভাষায় কবিতা লিখতে অগ্রসর হননি; আর অন্য একটি কথা উচ্চতম কিনা জানি না যা আমরা বলতে বাধ্য, তা এই যে এক অবোধ্য, নির্বোধ ও দুঃশাসন বিশ্বের বুকে মানুষের মন কেমন কাঁরে অঙ্কিত ক'রে দেয় তার ইচ্ছাশক্তিকে, স্থাপন করে শব্দের প্রভাবে এমন এক শৃঙ্খলা ও সার্থকতা, যা একাধারে ক্ষণকালীন ও শাশ্বত-এই লোমহর্ষক প্রক্রিয়াটিকে সুধীন্দ্রনাথের কবিজীবনে আমরা প্রত্যক্ষ করি। কোনো কোনো কবি প্রক্রিয়াটিকে গোপন রেখে যান, কিন্তু সুধীন্দ্রনাথ তাঁর সংগ্রামের চিহ্ন বীরের মতো তাঁর অঙ্গে ধারণ করেছেন। জয়ী হয়েও তিনি এ-কথা ভোলেননি যে শান্তি দেবতারই ভোগ্য, মানুষের জীবনকে অর্থ দেয় শুধু প্রচেষ্টা। আর এইজন্যেই প্রৌঢ়বয়সে তিনি বলেছিলেন যে মালার্মের কাব্যাদর্শ তাঁর ‘অন্বিষ্ট'; এইজন্যেই প্রেরণার বিরুদ্ধে তাঁর অভিযান এমন পৌনঃপুনিক। তাঁর কবিতা কোনো দিক থেকেই মালার্মের মতো নয় তা নয় ব’লে আমি অন্তত খেদ করি না; ভুল হবে তাঁকে 'সিম্বলিষ্ট' ব'লে ভাবলে; তাঁর সঙ্গে মালার্মের একমাত্র সাদৃশ্য দৈববর্জনের সংকল্পে, স্বায়ত্বশাসনের উৎকাঙ্ক্ষায়। কিন্তু মানুষের পক্ষে দৈববর্জন কি সম্ভব? অন্ততপক্ষে সুধীন্দ্রনাথ প্রসঙ্গে আমি নিশ্চয়ই বলবো যে তাঁর প্রতিজ্ঞাবদ্ধ অধ্যবসায়ের শক্তিও দৈবের দান, সেই প্রথম কাঁচা হাতের খাতা থেকে ‘সংবর্ত' ও
'দশমীতে তাঁর এক স্বচ্ছ মুহূর্তেই তিনি নিজের বিষয়ে লিখেছিলেন 'আমি অন্ধকারে বদ্ধমূল, আলোর দিকে উঠছি। বলা বাহুল্য, এই উক্তির প্রথমার্ধ সব কবির বিষয়েই প্রযোজ্য, কিন্তু দ্বিতীয়ার্ধ সত্য শুধু তাঁদের বিষয়ে, যাদের মনের প্রয়াসপ্রসূত ঊর্ধ্বতন তাঁদের আয়ুর সঙ্গেই পা মিলিয়ে চলতে থাকে। আমাদের এই দেশে ও কালে অনেক কবির মধ্যপথে অবরোধ ও অনেক প্রতিশ্রুতির তুচ্ছ পরিণাম দেখার পরে, সুধীন্দ্রনাথের এই বিরতিহীন পরিণতি আমাদের বিস্ময় ও শ্রদ্ধার বস্তু হ'য়ে রইলো।

য়োরোপ থেকে প্রত্যাবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সুধীন্দ্রনাথের সবচেয়ে সৃষ্টিশীল পর্যায় আরম্ভ হ'লো, তার অপর সীমা দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সূত্রপাত। ১৯৩০ থেকে ১৯৪০ : এই দশ বৎসর তাঁর অধিকাংশ প্রধান রচনার জন্মকাল : প্রায় সময় 'অর্কেস্ট্রা', 'রুদসী' ও 'উত্তরফাল্গুনী', প্রায় সমগ্র 'সংবর্ত সমগ্র কাব্য ও গদ্য অনুবাদ, ‘স্বগত’ ও ‘কুলায়’ ও ‘কালপুরুষে'র প্রবন্ধাবলি সব এই একটিমাত্র দশকের মধ্যে তিনি সমাপ্ত করেন। পরিচয়ের সবচেয়ে প্রোজ্জ্বল পর্যায়, ১৯৩১-১৯৩৬ -তাও এই অধ্যায়ের অন্তর্ভূত। এই পাঁচ বৎসরের মধ্যে এমনও দিন গেছে যখন তিনি এক দিনে সাতটি শেক্সপীয়র-সনেট অনুবাদ করেছেন, একই দিনে রচনা করেছেন কবিতা ও গদ্য, কোনো লেখা শেষ করামাত্র আর একটিতে হাত দিয়েছেন। এক প্রবল আবেগ তাঁকে অধিকার করেছিলো এই সময়ে, এক স্মৃতি তাঁকে আবিষ্ট ক'রে রেখেছিলো, কোনো এক অপূরণীয় ক্ষতির পরিপূরণস্বরূপ অনবরত ভাষাশিল্প রচনা ক'রে যাচ্ছিলেন : জগতে ভগবান যদি না থাকেন, প্রেম ও ক্ষমা যদি অলীক হয়, তাহ'লেও মানুষ তার অমর আকাঙ্ক্ষার উচ্চারণ ক'রেই জগকে অর্থ দিতে পারে। এই আবেগের পরম ঘোষণা ১৯৪০-এ লেখা 'সংবর্ত কবিতা; ঐ কবিতাটি রচনা করার পর তিনি যেন মুক্তিলাভ করলেন, কবিতার দ্বারা পীড়িত অবস্থা তাঁর কেটে গেলো।

মুক্তি? না। মায়াবিনী কবিতার দেখা একবার যে পেয়েছে, সে কি আর মুক্ত হতে পারে। রচনার পরিমাণ হ্রাস পেলেও, আরাধ্যা সেই দেবীই থাকেন। জীবনের শেষ দুই দশকে সুধীন্দ্রনাথ কবিতা বেশি রচনা করেননি, কিন্তু অনবরত নতুন ক'রে রচনা করেছেন নিজেকে, এবং সেটিও কবিকৃত্যের একটি প্রধান অঙ্গ। পুরোনো রচনার তৃপ্তিহীন পরিবর্তন ও পরিমার্জনা তাঁর- যা বন্ধু মহলে মাঝে-মাঝে সরোষ প্রতিবাদ জাগালেও অনেক স্মরণীয় পংক্তি প্রসব করেছে; তাঁর নতুন সংস্করণের ভূমিকা; ‘দশমী'র কবিতাগুচ্ছ; এবং তাঁর আলাপ-আলোচনা এই সব কিছুর মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হয়েছে এমন একজন মানুষ, জগতের সঙ্গে যার ব্যবহার বহুমুখী হ'লেও যাঁর ধ্যানের বিষয় বাণীমাধুরী। কবিতার প্রকরণগত আলোচনায় দেখেছি তাঁর অফুরন্ত উৎসাহ; 'আজি' ও 'আজিই' শব্দের উচ্চারণগত পার্থক্য তাঁকে ভাবিয়েছে; বানান ও ব্যাকরণ বিষয়ে তাঁকে আমরা অভিধানের মতো ব্যবহার করেছি-আমার সমবয়সী বাঙালি লেখকদের মধ্যে তিনিই একমাত্র, যিনি উত্তরজীবনে বাংলা ও বাংলায় ব্যবহারযোগ্য প্রতিটি সংস্কৃত শব্দের নির্ভুল বানান জানতেন, এবং শব্দতত্ত্ব ও ছন্দশাস্ত্র বিষয়ে যার ধারণায় ছিলো জ্ঞানাশ্রিত স্পষ্টতা। এই শব্দের প্রেমিক শব্দকে
প্রতিটি গম্ভবপর উপায় উপার্জন করেছিলেন; জীবনব্যাপী সেই সংসর্গ ও অনুচিস্তনের ফলেই সম্ভব হয়েছিলো 'দ্বিধা-মলিদা' বা 'গুরু-অগুরু'র মতো বিস্ময়কর অথচ সম্পূর্ণ স্বাভাবিক অন্ত্যানুপ্রাস। সাহিত্যের তত্ত্ব বিষয়ে অনেকেই কথা বলতে পারেন ও বলে থাকেন, কিন্তু কতোগুলো অস্পষ্ট ও অনিচ্ছুক ভাবনা-বেদনাকে ছন্দ ও ভাষায় নিগড়ে বাঁধতে হ’লে যে-সব সমস্যা প্রত্যক্ষ হ'য়ে ওঠে, তা নিয়ে আলোচনা হতে পারে শুধু এক কবির সঙ্গে অন্য কবির : এবং এই রকম আলোচনার পক্ষে সুধীন্দ্রনাথের শূন্য স্থান পূরণ করার কেউ নেই বলে, আজ আরো স্পষ্ট বুঝতে পারি যে ‘কবি’ শব্দের প্রতিটি অর্থ সুধীন্দ্রনাথের রচনা ও জীবনের মধ্যে মূর্ত হয়েছিলো।

তাঁর বিষয়ে অনেকেই ব'লে থাকেন যে তিনি বাংলা কবিতায় 'ধ্রুপদী রীতির প্রবর্তক'। এই কথার প্রতিবাদ ক'রে আমি এই মুহূর্তেই বলতে চাই যে সুধীন্দ্রনাথ মর্মে-মর্মে রোমান্টিক কবি, এবং একজন শ্রেষ্ঠ রোমান্টিক। এর প্রমাণস্বরূপ আমি দুটিমাত্র বিষয় উল্লেখ করবো : প্রথমত, তাঁর প্রেমের কবিতায় আবেগের তীব্রতা, বাসনা ও বেদনার অলজ্জিত ও ব্যক্তিগত চীৎকার- যার তুলনা আবহমান বাংলা সাহিত্যে আমরা খুঁজে পাবো না, না বৈষ্ণব কবিতায়, না রবীন্দ্রনাথে, না তাঁর সমকালীন কোনো কবিতে। দ্বিতীয়ত, ভগবানের অভাবে তাঁর যন্ত্রণাবোধ- এটিও একটি খাঁটি রোমান্টিক লক্ষণ। তিনি ভগবানের অভাব কবিতা দিয়ে মেটাতে চাননি, জনগণ বা ইতিহাস দিয়েও না : তাই, তিনি নিজেকে জড়বাদী ব'লে থাকলেও, তাঁর কবিতা আমাদের বলে দেয় যে তাঁর তৃষ্ণাছিলো সেই সনাতন অমৃতেরই জন্য। তিনি ছিলেন না যাকে বলে 'মিনারবাসী’, স্বকালের জগৎ ও জীবনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে লিপ্ত হয়ে আছে তাঁর কবিতা; কিন্তু যেহেতু তাঁর স্বকালে ভগবান মৃত, তাই কোনো মিথ্যা দেবতাকেও তিনি গ্রহণ করেননি; যারা প্রফুল্ল মনে ‘সমস্বর নামসংকীর্তনে যোগ দিয়ে নিশ্চিন্ত হয়, তাদের বীভৎসতার পাশে নিজের স্বর্গের কল্পনাটিও রেখে গেছেন। যা মর্ত্যভূমিতে সম্ভব নয় তা যার গভীরতম আকুতি, তাঁকে কী ক'রে জড়বাদী বলা যায়?

আর একটি কথা বহু বছর ধরে শুনে আসছি: সুধীন্দ্রনাথের কবিতা দুর্বোধ্য। এ বিষয়ে একটি পুরোনো লেখায় যা বলেছি, এখানে তার পুনরুক্তি করা ভিন্ন উপায় দেখি না। সুধীন্দ্রনাথের কবিতা দুর্বোধ্য নয়, দুরূহ; এবং সেই দুরূহতা অতিক্রম করা অল্পমাত্র আয়াসসাপেক্ষ। অনেক নতুন শব্দ বা বাংলায় অপ্রচলিত সংস্কৃত শব্দ তিনি ব্যবহার করেছেন : তাঁর কবিতার অনুধাবনে এই হ'লো একমাত্র বিঘ্ন। বলা বাহুল্য, অভিধানের সাহায্য নিলে এই বিঘ্নের পরাভবে বিলম্ব হয় না। এবং অভিধান দেখার পরিশ্রমটুকু বহুগুণে পুরস্কৃত হয়, যখন আমরা পুলকিত হ'য়ে আবিষ্কার করি যে, আমাদের অজানা শব্দসমূহের প্রয়োগ একেবারে নির্ভুল ও যথাযথ হয়েছে, পরিবর্তে অন্য কোনো শব্দ সেখানে ভাবাই যায় না। সুধীন্দ্রনাথের কবিতার গঠন এমন যুক্তিনিষ্ঠ, এমন সুমিত তাঁর বাক্যবিন্যাস, পংক্তিসমূহের পারস্পট এমন নির্বিকার, এবং শব্দপ্রয়োগ এমন যথার্থ, যে মাঝে-মাঝে দুরূহ শব্দ ব্যবহার না করলে, তাঁর কবিতা হ'তো না অমন সুমিত ও যুক্তিসহ, অমন ঘন ও সুশৃঙ্খল
চরিত্রই প্রকাশ পেতো না। আর এই দুরূহতা নিয়ে আপত্তি- পঁচিশ
বছর আগেকার তুলনায় তা এখন অনেক মৃদু হওয়া উচিত, কেননা ইতিমধ্যে তাঁর
প্রবর্তিত বহু শব্দ লেখক ও পাঠক সমাজে প্রচলিত হয়ে গেছে। অল্পবয়সীরা হয়তো
জানেনও না যে 'অন্বিষ্ট', 'অভিধা', 'ঐতিহ্য', 'প্রমা', 'প্রতিভাস', 'অবৈকল্য',
'ব্যক্তিস্বরূপ', বহিরাশ্রয়', 'কলাবৈকল্য' প্রভৃতি শব্দ ও শব্দবন্ধ যা তাঁরা হয়তো
কিছুটা যথেচ্ছভাবেই ব্যবহার করেছেন- এগুলোর প্রথম ব্যবহার হয় কবিতায় ও
প্রবন্ধে, এমনকি 'ক্লাসিকাল' অর্থে 'ধ্রুপদী' শব্দটিও তাঁরই উদ্ভাবনা। এই ধরনের
শব্দ-সমবায়ের সাহায্যে তিনি যুগল সিন্ধিলাভ করেছেন একটিও ইংরেজি শব্দ
ব্যবহার না-করে, বা অগত্যা চিন্তাকে তরল না ক'রে, লিখতে পেরেছেন জটিল ও
তাত্ত্বিক বিষয়ে প্রবন্ধ, এবং তাঁর কবিতাকে দিয়েছেন এমন এক শ্রবণসুভগ সংগতি
ও গাছীর্ষ, যাকে বাংলা ভাষায় অপূর্ব বললে বেশি বলা হয় না। এবং এই সব শব্দ
রচনার দ্বারা, বাংলা ভাষার সম্পদ ও সম্ভাবনাকে তিনি কতদূর বাড়িয়ে দিয়েছেন,
তা হয়তো না বললেনও চলে। আধুনিক বাংলার ও আমার ঈর্ষাভাজন, আর যাঁরা
চেনা কবিতার সঙ্গে নিবিড়তর সম্বন্ধস্থাপনের জন্য এগিয়ে আসবেন, আমি নিজেকে
তাঁদেরই সতীর্ঘ ব'লে মনে করি, কেননা আমি জানি যে আমার অবশিষ্ট আয়ুস্কালে
স্বল্প যে-ক'টি গ্রন্থ আমার নিত্যসঙ্গী হবে, এটি তারই অন্যতম।

এই গ্রন্থের ব্যবস্থাপনা বিষয়ে দু-একটি কথা বলা দরকার। অর্কেস্ট্রা' থেকে
'দশমী পর্যন্ত কালানুক্রমে সাজিয়ে, ‘তম্বী’কে স্থান দেয়া হ'লো 'দশমী’র পরে।
কেননা, আমার বিশ্বাস, সুধীন্দ্রনাথ বেঁচে থাকলে আদ্যন্ত পরিশোধন না-ক'রে
“তন্ত্রী'র পুনঃপ্রকাশে রাজি হতেন না; এবং বর্তমান অবস্থায়, ঐতিহাসিক অর্থে
সুধীন্দ্রনাথের প্রথম পুস্তক ব'লে, এর বিষয়ে আগ্রহান্বিত হবেন তাঁরাই, যাঁরা
লেখকের পরবর্তী রচনাসমূহের সঙ্গে পরিচিত। তাই 'ভম্বী'কে এই গ্রন্থের প্রথমে
স্থান দিতে আমার বিবেকে বাধলো; মনে হলো, অন্যান্য রচনা পড়ে আসার পরে
‘তম্বী’তে পৌঁছানো পাঠকের পক্ষে অধিক সংগত হবে। পরিশিষ্ট অংশে স্থান পেলো
দুটি অপ্রকাশিত কবিতা ('পুরস্কার' ও 'অমৃত'), তাঁর সর্বশেষ সমাপ্ত অনুবাদ
কবিতা, হান্স এগন হোল্টহুজেন-এর 'মৃত্যুর সময়', ও 'বাল্ট্ নর্টন'-এর প্রথম
অনুচ্ছেদের দুটি অনুবাদ;- এই ক-টি পংক্তি সুধীন্দ্রনাথের সর্বশেষ রচনা। মৃত্যুর
আগে সুধীন্দ্রনাথ 'অর্কেস্ট্রা' ও 'ক্রন্দসী'র নতুন সংস্করণ প্রস্তুত করছিলেন, পা
পৃষ্ঠার শাদা অংশে কিছু-কিছু সংশোধন ও পরিবর্তন রচিত হয়েছিলো। সেই সব
নূতন লেখন এই গ্রন্থে সন্নিবিষ্ট ক'রে 'পরিশিষ্টে' প্রাক্তন পাঠ উদ্ধৃত করা হ'লো।
সংশোধনকালে সুধীন্দ্রনাথ বানানে যে-সব পরিবর্তন করেছিলেন, আধুনিক পাঠকের
অভ্যাসের সঙ্গে সংগতি রেখে সেগুলিও এই গ্রন্থে যথাসম্ভব গ্রহণ করা হয়েছে।


পিতৃদেব ছিলেন নিশ্চিন্ত বৈদান্তিক; এবং আকৈশোর অদ্বৈতের অনির্বচনীয়
আতিশয্যে উত্ত্যক্ত হয়ে, আমি যদিও অল্প বয়সেই অনেকান্ত জড়বাদের
আশ্রয় নিয়েছিলুম, তবু বিচারবুদ্ধির স্বাতন্ত্র্য আজও আমার অধিকারে এসেছে
কিনা সন্দেহ। এখন ভাবতে আশ্চর্য লাগে যে একদা আমার কলমও চলত
অবাধে; এবং বোধ হয় সেই জন্যে, প্রেরণাতে অলৌকিকের আভাস আছে
ব’লে, সাহিত্য-সৃষ্টির উক্ত উপকরণ আমি সাধ্যপক্ষে মানতে চাইনি, তার
বদলে আঁকড়ে ধরেছিলুম অভিজ্ঞতাকে। অবশ্য বর্তমানে, লেখনীর পক্ষাঘাত
সত্ত্বেও, স্বপ্নচারী পথিককে যেমন, অনুপ্রাণিত কবিকে আমি তেমনই ডরাই;
এবং কালের বৈগুণ্যে ইন্দ্রিয়-প্রত্যক্ষের মূল্য বাড়ছে বই কমছে না। কিন্তু
ক্রোচে-র নন্দনতত্ত্বে আধ্যাত্মিক অভিনিবেশ থাক বা না থাক, উক্তি ও
উপলব্ধির যে-অভেদে তিনি বিশ্বাসী, তার সঙ্গে বস্তুনিষ্ঠার বিবাদ আর আমার
চোখে পড়ে না; এবং যত দিন যাচ্ছে, তত বুঝছি যে অনুরূপ অন্তর্দৃষ্টি
ব্যতীত, শুধু কাব্যরচনা কেন, স্বায়ত্বশাসনও দুষ্কর ।

শারীরবৃত্তে ক্ষুধা
অন্ত্রের
প্রসার-সংকোচ-মাত্র;
এবং
এ-কথা
দেহাত্মবাদীরও স্বীকার্য যে উক্ত প্রক্রিয়া গবেষকের বোধগম্য বটে, কিন্তু
বুভুক্ষ্যার ব্যক্তিগত অনুভব একেবারে আলাদা জাতের। উপরন্তু একজন
জড়বাদী বৈজ্ঞানিকই দেখিয়েছেন যে শিক্ষার গুণে বেদনার স্বভাবসিদ্ধ
প্রবর্তনা বদলানো আদৌ শক্ত নয়, বরঞ্চ সমাজমুক্ত মানুষের পক্ষে তার
অন্যথাই অভাবনীয়; এবং সেই জন্যে ক্ষুধার মতো মৌল অভিজ্ঞতা সুদ্ধ
সংস্কার-সংক্রমিত। অবশ্য অনেক দার্শনিক ও অধিকাংশ মনোবিজ্ঞানীর মতে
সামান্যের উপলব্ধি অসম্ভব; এবং সংস্কার যদিও গোষ্ঠীগত, তবু অনুভূত
সংস্কার স্পষ্টতই প্রাতিম্বিক। তবে এখানে অন্বীক্ষার কূট তর্ক তুলে লাভ নেই
: সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ-ব্যতিরেকেও ধরা পড়ে যে স্থুল ভাষায় আমরা যাকে
অভিজ্ঞতা বলি, তাতে বেদনার বৈশিষ্ট্য আর ভাবনার সাধারণ্য প্রায় সমান
অনুপাতে বিদ্যমান; এবং উক্তি ও উপলব্ধি যখন অবিচ্ছেদ্য, তখন অন্তত
অভিজ্ঞাতপ্রধান লেখা পড়লে, বোঝা উচিত তার কুতটুকু রচয়িতার নিজস্ব
আর কতখানি গতানুগতিক।
দুৰ্ভাগ্যবশত উল্লিখিত সিদ্ধান্তে পৌঁছবার অনেক আগেই ‘অর্কেস্ট্রা’ রচিত ও প্রকাশিত; এবং তখন, পরবর্তী কবিতাগুলোয় অভিজ্ঞতা প্রেরণার স্থান নিয়েছে ব’লে, বেশ খানিকটা গর্ববোধ করেছিলুম। কিন্তু অভিজ্ঞতাও প্রেরণার মতো উপাত্তমাত্র; এবং শিল্প সচেতন রূপকারের অভূতপূর্ব সৃষ্টি। অর্থাৎ শিল্পসামগ্রীর উপাদান যদিও সনাতন ও সার্বজনীন সংসারেই আহরণীয়, তবু যে-অসামান্য বিন্যাসে সেই চিরপরিচিত উপকরণসমূহ আমাদের বিস্ময় জাগায়, তার উৎপত্তি শিল্পীর একাগ্র সংকল্পে; এবং এই দিক থেকে শিল্পবস্তু আমার মতে ব্যক্তির সঙ্গে তুলনীয়। কারণ দার্শনিক পরিভাষায় যার নাম বিশেষ, সে-রহস্যও আসলে হয়তো অসংখ্যাত সাধারণের অনন্য সমষ্টি; এবং তাই যেমন মানুষে মানুষে আদান-প্রদান সম্ভব, তেমনই এক ইন্দ্রিয়ের উপলব্ধি অপর ইন্দ্রিয়ের দ্বারা গ্রাহ্য। অন্ততপক্ষে নিপট নৈয়ায়িক ছাড়া আর সকলেই মানবেন যে ব্যক্তিগত অনুভূতির পাঞ্চজন্য অভিব্যক্তি বিপ্রলাপ নয়; এবং সাহিত্যে ওই অঘটন সংঘটক মূলত বেদনা সাপেক্ষ। ভাষার সামঞ্জস্য

বলা বাহুল্য উক্ত সমীকরণ একা প্রতিভার কর্ম নয়, অক্লান্ত পরিশ্রম ও নিরন্তর প্রযত্নের পুরস্কার; এবং যারা ভাবতে অভ্যস্ত যে কাব্য প্রেরণা বা অভিজ্ঞতার লীলাভূমি, তাঁদের বিচারে অনুরূপ বিশ্বাস ছাড়তে পারেননি; এবং একদিন ‘উড়ে চ'লে গেছে'- এই অপিরচ্ছন্ন ক্রিয়ার ‘উড্ডীন' বিশেষণে রূপান্তরের চেষ্টায় আমাকে সারা সন্ধ্যা কাটাতে দেখে, তিনি খুশী হয়েছিলেন বটে, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে সাবধান ক'রেও দিয়েছিলেন যে যদি ওইভাবে, অত আস্তে আস্তে লিখি, তবে আমার কলম অচিরে একেবারে থেমে যাবে। উপরন্তু ‘অর্কেস্ট্রা’-র বিষয়বস্তু তাঁর সুরুচিতে বাধলেও, এ-বইয়ে তিনি যেহেতু লেখকের অকপট অভিজ্ঞতা খুঁজে পেয়েছিলেন, তাই এর প্রকাশে তাঁর অসম্মতি ছিল না; এবং বই বেরোনোর পরে তাঁর মত বদলে থাক বা না থাক, মনে আছে পাণ্ডুলিপি প'ড়ে ‘অর্কেস্ট্রা’-র পূর্ববর্তী আমার প্রায় সকল কবিতা তাঁর কাছে কৃত্রিম লেগেছিল।

অবশ্য তখনও জানতুম যে ওই মন্তব্যে স্নেহের ভাগ বিবেচনার চেয়ে বেশী; এবং আজ সমালোচনার অংশে আত্মপ্রসাদের কণাও মেলে না, বুঝি যে তাতে কাব্য-জিজ্ঞাসার অভাবই সুপ্রকট। কারণ যে-কবিতা অভিজ্ঞতার নিজস্বে সমৃদ্ধ, তার অভিব্যক্তি স্বতই স্বকীয়; এবং 'অর্কেস্টা'-য় রবীন্দ্রনাথের একাধিক পঙ্ক্তি তো, জ্ঞানে বা অজ্ঞানে, এসে গেছেই, এমনকি সাধু ও প্রাকৃতের মধ্যবর্তী যে-সান্ধ্য ভাষায় সে-কালের অধিকাংশ বাংলা কবিতা লেখা হত, তাই এ-গ্রস্থের বাহন। তাছাড়া অন্ত্যানুপ্রাসের চাহিদায়, তথা ছন্দোরক্ষার প্রয়োজনে, শব্দের বিকৃতি, পাদপূরণের জন্যে ক্রিয়াপদের গ্রাম্য রূপ অর্থবা বর্ণ-সংকোচ ও বৃদ্ধি, হওয়া ও করা ধাতুর পৌনঃপুন্য, সম্বোধনের অনাবশ্যক বাহুল্য ইত্যাদি বাংলা পদ্যের সুপ্রচলিত যথেচ্ছাচার ‘অর্কেস্ট্র'-র
সর্বত্র ছড়িয়ে ছিল। এবং এর নায়িকা যদিও বিংশ শতাব্দীরই তরুণী, তবু
তার অঙ্গে যেমন নূপুরাদি প্রাচীন ভূষণের প্রাদুর্ভাব, তেমনই তার সঙ্গে
আলাপে ও আচরণে সংস্কৃত অলংকারশাস্ত্রের প্রভাব প্রায়ই সুস্পষ্ট।
এলিয়ট্ কবিকে ঘটক আখ্যা দিয়েছেন এবং আমিও মনে করি যে
ব্যক্তিগত মনীষায় জাতীয় মানস ফুটিয়ে তোলাই কবিজীবনের পরম
সার্থকতা। কিন্তু আপন কালের স্বধর্ম ভুললেই, সে-সমস্বয় সহজ হয় না,
যিনি উক্ত সংগমের দিকে এগোতে চান, নিজেরঅভিজ্ঞতাকে, তথা জাতিগত
চৈতন্যকে, প্রতীক-রূপে দেখতে তিনি বাধ্য; এবং ওই দিব্য দৃষ্টি যার
অধিকারে, তাঁর কাছে আমার প্রিয়া আর কালিদাসেরকান্তা এক বটে, তবু
সে-অভেদের ভিত্তি ব্যতিহার্য ছদ্মবেশ নয়, প্রেমানুভূতির নৈর্ব্যক্তিক স্বরূপে।পক্ষান্তরে 'অর্কেস্ট্রা'-র অভিজ্ঞতা নির্বের ধার ধারে না; তার পুঙ্খানুপুঙ্খও
যাতে স্মৃতিপটে চিরমুদ্রিত থাকে, সেই জন্যে তার চতুর্দিকে মনের এই
অবিরাম পরিক্রমা; এবং তার প্রতি লেখকের মমতা আত্যন্তিক ব'লেই, সে
তিলোত্তমার স্বতন্ত্র সত্তা সে-দিন ধরা পড়েনি। অর্থাৎ 'অর্কেস্ট্রা'-য় উক্তি ও
উপলব্ধির সাযুজ্য অনুপস্থিত; এবং তাই তীব্র ও সংক্ষিপ্ত আবেগের প্রণোদনা
সর্ব্বেও, এ-বইয়ের মুক্ত ছন্দ প্রায়ই শিথিল।
আমার বিশ্বাস যে তদানীন্তন কাব্যাদর্শে মারাত্মক ভুল না থাকলে,অর্কেস্ট্রা’-য় এত ত্রুটি জমতে পারত না; এবং এ-কথা নিশ্চয় করে বলতে
পারি যে রচনাকালেও অনেক দোষই আমাকে পীড়া দিয়েছিল। কিন্তু সকলরোগের প্রতিকার তখন আমার সাধ্যে কুলায়নি; এবং কোনও কোনও
কবিতায় ভাবের অগতি ও ছন্দের অসংগতি দেখেও, সংস্কারের চেষ্টা করিনি, পাছে আপাতস্বচ্ছন্দ অভিজ্ঞতার অপঘাত ঘটে, সেই জনশ্রুত ভয়ে। আজ
যদিও জানি না ইতিমধ্যে লিপিচাতুর্যে সত্যই এগিয়েছিকিনা, তথাচ আমার
বিচারবুদ্ধি সন্নিকর্ষের ফলে আর ব্যাহত নেই; এবং সেই জন্যে বিনাসংশোধনে 'অর্কেস্ট্রা'-র পুনর্মুদ্রণ আমার বিবেকে বাধল। তবে সর্বত্র,
এমনকি যেখানে সমস্ত উলটে পালটে গেছেসেখানেও,প্রয়াস পেয়েছি যাতে
বর্তমান পরিবর্তন, তখন যে ক্ষমতাটুকু ছিল, তাকে ছাড়িয়ে না যায়; এবং
সংগতির তাগিদে মাঝে মাঝে চিত্রকল্প আগা-গোড়াবদলেছি বটে, তবু
জ্ঞানত কোথাও অর্থ-গৌরব বাড়াতে চাইনি।
অনেকের ধারণা এবং তাঁদের মধ্যে লব্ধপ্রতিষ্ঠ সাহিত্যিকের অভাব
নেই- প্রকাশিত রচনা যেহেতু লেখকের অধিকারবহির্ভূত, তাই তার রূপান্তরঅনুচিত, এমনকি অবশ্যদণ্ডনীয়; এবং য়েট্স প্রভৃতি একাধিক মহাকবির মত
যদিচ একেবারে বিপরীত, তবু আমি প্রথম পক্ষের সমর্থনে এই পর্যন্ত মানতে
প্রস্তুত যে অতীত বৈকল্যের অস্বীকার, শুধু অপলাপের নয়, স্বাবমাননারও
চূড়ান্ত। কারণ ব্যক্তিস্বরূপ পরিণতিসাপেক্ষ: উত্তরাধিকারসূত্রে আমরা পাই
এবং সেই বহু দিন সংকল্পিত উদ্দেশ্যের দিকে
এগোতে থাকে, ততই আম। অন্তত তাই হেগেল-এর
সিদ্ধান্ত। এবং সেই নির্দেশের অনুসারে হর্নট,
সয়- পরিণামী ব্যক্তিস্বরূপে আস্থা হারিয়েই, বাগদেবীর ত্যাজ্যপুত্রহয়েছিলেন। সুতরাং অ্যারিস্টটলীয় ভগবানের মতো আপন পরিপূর্ণতার
ধ্যানে ডুবে গেলে, কবিপ্রতিভার সর্বনাশ অনিবার্য এবং উপনিষসে
পরমাত্মার অন্যতম উপাধি কবি বোধহয় এই জন্য যেজন্মান্তরীণ
অভিব্যক্তিবাদ হিন্দু বিশ্ববীক্ষার মূল সূত্র।
কিন্তু কপট বিনয়ীর আত্মলাঘর আর অনুব্যবসায়ীরআত্মশুদ্ধি অস্বয়
ব্যতিরেকী সম্বন্ধে সংযুক্ত, এবং 'অর্কেস্ট্রা'-র স্খলন-পতনত্রুটি আজ আমার
কাছে যতই লজ্জাকর ঠেকুক না কেন, তদস্তগত কবিতাবলীর পুনর্মুদ্রণে বাধা
দিলে, যেমন অমূলক আত্মমর্যাদাই প্রকাশ পেত, এগুলোর সংস্কার সাধনেবিরত থাকলে, তেমনই সূচিত রূপকারী বিবেকের অভাব, তথা পাঠকের
প্রতি অবজ্ঞা। কেননা আমরা বই ছাপাই পাঠকেরইপ্রত্যাশায়, আমাদের
লেখায় চেষ্টার অভাব মার্জনা করতে তিনি মোটেই বাধ্য নন। পক্ষান্তরে
'অর্কেস্ট্রা'-কে আমার বর্তমান রচনার পর্যায়ে তুলতে আমি অসম্মত এবং
আমার বিশ্বার এই বিকলাঙ্গ কাব্যসংগ্রহ ঐতিহাসিক মূল্যে একেবারে বঞ্চিত
নয়। আগেই বলেছি যে রৈবিক উদ্ধৃতি এ-গ্রন্থের অনেক জায়গা জুড়ে আছে;
এবং যেখানে সে-ঋণ ইচ্ছাকৃত, হয়তো সেখানেই আমার বক্তব্য বিশেষতঅতিরাবীন্দ্রিক। তাছাড়া বাংলা কবিতার পদলালিত্য এ-গ্রন্থে প্রত্যাখ্যাত;
এবং এতে রোমান্টিক সৌন্দর্যবোধের ব্যবহার বিরূপ বিশ্বের পৃষ্ঠপোষকহিসাবে।
বুঝি বা সেই জন্যে যে-সংগতি পাশ্চাত্য সিম্ফনিক সংগীতের প্রধান লক্ষ্য,
তার ইঙ্গিতও ‘অর্কেস্ট্রা'-র প্রথম সমালোচকেরা নাম কবিতায় খুঁজে পাননি;
এবং তাঁদের মন্তব্যে যদিচ সাংগীতিক সামঞ্জস্যের সঙ্গে মানসিক নির্দ্বন্দ্বের
পার্থক্য বোঝার চেষ্টা পর্যন্ত দেখি না, তবু আজ আমি মুক্ত কণ্ঠে মানি যে,
সার্থক কবিতা যে-অমায়িক অভিজ্ঞার অমোঘ অভিব্যক্তি, তার আভাস সুদ্ধ
পরবর্তী রচনাগুলোর একটাতেও নেই। কিন্তু 'অর্কেস্ট্রা' অভিধেয় বহুরূপী
লেখাটা, বাক্যের অসহযোগ সত্ত্বেও, কায়-মনের সপ্তপদী; এবং তার সাত
কাণ্ড যেমন গতিমূলক পরাকাষ্ঠার সোপানপরম্পরা, তেমনই প্রত্যেক পর্ব
আবার ত্রিবিধ উপলব্ধির তাত্কালিক সমন্বয়। অর্থাৎ প্রতি ভাগে ঘুরে ঘুরে
এসেছে রঙ্গালয়ের অভ্যন্তরীণ দৃশ্য, শ্রাব্য ঐকতানের অতিশ্রুতি ব্যঞ্জন, আর
শ্রোতৃবিশেষের সমবায়ী ভাবানুষঙ্গ এবং সমগ্র কবিতার ত্রিবেণীতে এক
দিনের সাত প্রহরব্যাপী অভিজ্ঞতাই কৈবল্যপ্রার্থী নয়, তাতে সম্ভবত গ্রন্থের
অন্যত্রও বহিঃপ্রকৃতি ও অন্তরাত্মার, তথ্য লোকায়ত ও লোকোত্তরের,
অবৈকল্যও অদ্ভুত উহ্য আছে।
উল্লিখিত সংগতির দ্বিরুবীয় ক্ষেত্রে সত্যসন্ধানীর বিহার প্রশস্ত কিনা, সে প্রশ্নের উত্তর 'অর্কেস্ট্রা'-র লেখক হিসাবে আমার দেয় নয়। এবং আজ আমার পক্ষে শিশুশিক্ষার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ অনাবশ্যক বটে, কিন্তু এখনও কবি ও অবকার পক্তিভোজন আমার জাতিবিচারে বাধে। সে যাই হোক, আমি ভাবতে পারি না যে প্রাণযাত্রার পথনির্দেশে আমার লেখা বা কাব্যাদর্শ আর্য প্রয়োগের উপযুক্ত; এবং এ-কথাও বোধহয় ঠিক যে, গুরুগম্ভীর তত্ত্বে বঞ্চিত ব’লৈই, 'অর্কেস্ট্রা' স্বাভাবিক। পক্ষান্তরে রিল্কে-র মতে অল্প বয়সের কবিতামাত্রেই শূন্যগর্ভ; এবং সুদীর্ঘ জীবনের সমস্তটা তাৎপর্য ও মাধুর্যের ধ্যানে কাটালে, তবে হয়তো অন্তিমে দশটা সার্থক পদ কলমের মুখে জোটে; আর তত দিন শুধু মনে রাখা যথেষ্ট নয়, ভোলা দরকার, যাতে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত স্মৃতির পরিণতি ঘটে ধমনীর রক্তে, চোখের চাওয়ায়, এমনকি আপতিক অঙ্গভঙ্গীতে-অর্থাৎ আমাদের অনামিক একাস্তে, ক্রোচে-প্রদর্শিত উক্তি ও উপলব্ধির অদ্বৈতে।

ওই কথাটাকেই ঘুরিয়ে বলা যায় যে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা আর কাব্যগত অভিজ্ঞা এক নয়, প্রথম যেখানে সারা, সেখানেই দ্বিতীয়ের শুরু; এবং যে পর্যন্ত কবিতারচনা না ফুরায়, সে পর্যন্ত শেষোক্তের বিকাশ তো চলে বটেই, উপরন্তু, কাব্যবিশেষের সমাধানেও, তার উন্মুদ্রণ অনেক সময়ে থামে না। ফলত গ্যেটে-প্রমুখ কবিদের অভিজ্ঞা আমরণ বাড়তে থাকে, আর সঙ্গে সঙ্গে বদলায় অতীত অভিজ্ঞতার অর্থ; এবং আমি যদিও সে গোষ্ঠীর মানুষ নই, তবু তাঁরাই যেহেতু আমার ঈর্ষার পাত্র, তাই বোধহয় আমার লেখা আজ অবধি স্থায়িত্ব পায়নি। ইতিমধ্যে, রবীন্দ্রনাথের ভবিষ্যদ্বাণী সফল ক'রে, আমার লেখনী প্রায় অচল হয়েছে; এবং সে জন্যে মাঝে মাঝে যেমন আত্মধিক্কার জাগে, তেমনই এ-সত্যেও কেবলই ফিরে আসি যে তাঁর আর আমার ধর্ম আকাশ-পাতালের মতো পৃথক। তিনি সূর্য, উদয়াস্ত নির্বিকার : আমি অন্ধকারে বদ্ধমূল, আলোর দিকে উঠছি; সদ্‌গতির আগেই হয়তো তমসায় আবার তলাব।

কখনও যদি লেখবার মতো কথা মানসে জমে, তবে তার উচ্চারণপদ্ধতিও আপনি যোগাবে, এবং তত দিন আমি বাক্‌সংবরণ করলে, আর যার ক্ষতি হোক, বঙ্গসাহিত্য রসাতলে যাবে না। কারণ এ দেশে স্বভাবকবির অভাব নেই; এবং, কথ্য ভাষ্য কোন্ ছার, লিখিত গদ্যের সঙ্গেও নাড়ির সম্পর্ক কাটিয়ে, আমাদের পদ্য অদ্যাবধি নিজেকে অবাধ রেখেছে। উপরন্তু ভারতচন্দ্র, মধুসূদন, রবীন্দ্রনাথ ইত্যাদির উদ্যমে গীত বাংলা কবিতার অপটু ছন্দঃপ্রকরণে যে-সুব্যবস্থা এসেছিল, তাও, তথা ব্যাকরণ, বর্তমান কবিপ্রণতির অন্তরায়; এবং আমি যেহেতু উচ্ছ্বসিত আত্মপ্রকাশের বয়স পেরিয়েছি, তাই স্বরচিত নিয়মের অঙ্গীকারেই আমার মুক্তি। পক্ষান্তরে অসমাপ্ত স্বায়ত্বশাসনের অন্যতম বিড়ম্বনা বৈফল্যবোধ; এবং সঙ্গিলগ্নের
প্রতীক্ষায় বেলা ফুরাতে দেখে, অহংকার যেই অতীতে তাকায়, অমনই
বেরিয়ে পড়ে পুরাতন রচনাবলীর সংস্কারসাধ্য দোষ। সে-সকল ত্রুটির কিছুও
শোধরাতে পারছি কিনা, তা অবশ্য পাঠকেরই বিচার্য; কিন্তু আমার দিকে
চেষ্টার কার্পণ্য নেই।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ