((উপন্যাস এর পরিচয়
বাংলা উপন্যাস
উপন্যাসের শ্রেণিবিভাগ
উপন্যাস কি উপন্যাস কাকে বলে উপন্যাস এর বৈশিষ্ট্য
উপন্যাস কাকে বলে
উপন্যাস লেখার নিয়ম))
**বিঃদ্র-বাংলা বিভাগের সকল পড়াশোনা পেতে ব্লগটিতে যুক্তথাকুন https://monoweredu13.blogspot.com/?m=1
উপন্যাসের সংজ্ঞা ও গঠন কৌশল
‘উপন্যাস' শব্দটি নিজেই একটি সংস্কৃত শব্দ। সংস্কৃত মহাকবি কালিদাসের কাব্যে
শব্দটির প্রথম প্রয়োগ লক্ষ করা যায়। 'উপন্যাস' শব্দের আক্ষরিক অর্থ 'কল্পিত কাহিনি'।
কিন্তু আধুনিক পরিভাষায় 'উপন্যাস' শব্দটি অনেক বিষয়কে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে।
তাই বলা যায় যে, উপন্যাসমাত্রই কল্পিত কাহিনি; কিন্তু কল্পিত কাহিনিমাত্র উপন্যাস নয়।
এ যুগে 'উপন্যাস' কথাটির অর্থ অনেক ব্যাপক, অনেক বিস্তৃত। সংস্কৃতে উপন্যাস
শব্দটির ব্যুৎপত্তি এই রকম: উপ-নি-অস+অ (ঘঞ))। শব্দটির অর্থ উিপস্থাপন। এর
আরেক অর্থ অস্বাভাবিক কল্পিত উপাখ্যান। আবার বলা হয়েছে উপন্যাসের অর্থ
কথারম্ভ শ্রোতা বা পাঠকের মনোরঞ্জনার্থে কল্পিত গল্প'। ইংরেজি ভাষায় উপন্যাসের
প্রতিশব্দ Novel-এর অর্থ করা হয়েছে a fictitious prose narrative or tale presenting
a picture of real life of the men and women portrayed. আবার বলা হয়েছে,
Novel 2 Prose narrative of sufficient length to fill one or two volumes
উপন্যাস বা Novel শব্দটির আভিধানিক অর্থ বিশ্লেষণ করলে আমরা বুঝতে পারি, যে
কল্পিত দীর্ঘ উপাখ্যান গদ্যে লিপিবদ্ধ ও পাঠকের মনোরঞ্জনার্থে বিশেষ কৌশলে
উপস্থাপিত করা হয় তা-ই উপন্যাস। একজন বিখ্যাত ইংরেজ উপন্যাস লেখক এই
সংজ্ঞাটিকেই মোটামুটিভাবে গ্রহণ করেছেন। তবে এই সঙ্গে তিনি উপন্যাসের দৈর্ঘ্য
সম্পর্কে নিজের অভিমত জুড়ে দিয়েছেন। তাঁর মতে কমপক্ষে ৫০ হাজার শব্দ দিয়ে
উপন্যাস রচিত হওয়া উচিত।
উপন্যাস সম্বন্ধে প্রাথমিক আলোচনা---
উপরের অভিমতগুলো বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায় উপন্যাসের মধ্যে মূলত কাহিনিই
প্রধান। উপন্যাসের মধ্যে কম হোক, বেশি হোক, কাহিনি থাকবেই। লেখক শিল্পগত
দিক থেকে যতো নিরীক্ষাই করুন, যতো অভিনবত্বই আনুন, উপন্যাসে তাঁকে শেষ
পর্যন্ত এক বা একাধিক কাহিনিই লিপিবদ্ধ করতে হয়। কাহিনি দীর্ঘ ও জটিল হওয়াতে
বিরক্তি বা ক্লান্তিকর বোধ হওয়ার কথা। কিন্তু তা হয় না। কারণ কাহিনি বর্ণনায় ও
উপস্থাপনে লেখক এমনই কৌশল অবলম্বন করেন যে তাতে কাহিনির দীর্ঘতা বিরক্তিকর
না হয়ে উপভোগ্য হয়ে ওঠে। আরবি ভাষায় রচিত কাহিনিমালা 'আলেফ লায়লা ওয়া
লায়লা কৈ এই কারণেই উপন্যাসের মর্যাদা দিতে চান অনেক পণ্ডিত। যদিও হাজার এক
রাত্রি জুড়ে এই কাহিনিমালার বিস্তার তবু তাতে পাঠকের কিংবা শ্রোতার মন ক্লান্ত হয়।
না। কারণ প্রতিরাতে নতুন কাহিনি আরম্ভ হয় এবং তা শেষ পর্যায়ে পৌঁছাতে পৌছাতে
রাত ফুরিয়ে ভোর হয়ে আসে। আর এ সময়ই কাহিনির মূল নায়িকা শহরজাদী
(Scheherzade) এমন এক কৌতূহলোদ্দীপক প্রসঙ্গ দিয়ে তার সেদিনকার কাহিনি শেষ
করেন যে তাতে প্রধান শ্রোতার কৌতূহল অতৃপ্ত থেকে যায়। তাঁকে প্রতীক্ষায় থাকতে হয়।
পরবর্তী রাত্রি এবং সেই সঙ্গে নতুন গল্পটি আরম্ভ হওয়ার জন্য। এইভাবে ক্রমান্বয়ে
চলতে থাকে হাজার এক রাত্রির গল্পমালা। বাদশাহ নিয়ম করেছিলেন প্রতিদিন একজন
তরুণীকে বিবাহ করবেন এবং পরের দিন সকালে সেই নববিবাহিতা পত্নীকে কতল করা
হবে । উজির কন্যা শহরজাদীর বেলাতে তা আর পারেন না।
কারণ এই তরুণী বধূটি তাঁকে প্রতিদিন নতুন একটি গল্প শোনাচ্ছে। শহরজাদীর
গল্প হাজার এক রাত্রি অতিবাহিত হওয়ার পর শেষ হয়— ততদিনে নারী জাতির প্রতি
বাদশাহের মনে যে ক্রোধ এবং ঘৃণা ছিলো তা অপসৃত হয়েছে এবং শেষে দেখা যায়
যে শহরজাদী তার মহিষী হয়ে রয়ে গেলেন।
পাঠকের কৌতূহল ও আগ্রহ জাগিয়ে তুলে ক্রমে ক্রমে তা তীব্রতর করা এবং শেষ
পর্যন্ত টিকিয়ে রাখার কৌশলের মধ্যেই কাহিনিকারের কৃতিত্ব। এই একই কৌশলে
কাহিনী রচনা করেছেন ইংরেজ লেখক চসার, ইতালীয় লেখক বোকাচ্চিও এবং
স্পেনীয় লেখক সারভেন্তেস। আমরা দেখি সবাই মনোজ্ঞ কাহিনিই রচনা করতে
চেয়েছেন। যদি প্রশ্ন করা হয় যে, কাহিনিগুলো কেমন এবং কী নিয়ে? তাহলে তার
উত্তরে বলতে হবে ঐ সব কাহিনি অসাধারণ কৌতূহলোদ্দীপক এবং মনোরম আর
সেগুলো রচনা করা হয়েছে মানুষকে নিয়ে। মানুষের জীবনের ঈর্ষা-ঘৃণা-প্রেম-স্নেহ
মমতা-প্রতারণা-বন্ধুতা-জিঘাংসা এক কথায় মানব চরিত্রের যাবতীয় প্রবৃত্তি এবং প্রেরণা,
তার চিন্তা ও আচরণ, তার জীবনাসক্তি আর হতাশা সবই উপরোক্ত কাহিনিগুলোতে
বলা গল্পের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে।
মানুষের গল্প শোনার আগ্রহ খুবই প্রাচীন। কখন থেকে তা সঠিক বলা মুশকিল।
তবে গুহাবাসী মানুষ যে গল্প বলতো এবং সাগ্রহে শুনত তা প্রাগৈতিহাসিক গুহা
চিত্রগুলোর কথা স্মরণ করলেই আমরা অনুমান করতে পারি। অনুমান করতে অসুবিধা
হয় না যে গল্পের মধ্য দিয়েই আদি কাহিনিকার তার শ্রোতাদের কাছে নিজের
অভিজ্ঞতা, চিন্তা, কল্পনা, স্বপ্ন ও বিশ্বাসের কথা ব্যক্ত করত। ঐসব গল্পে বীর এবং
দেবতাদেরই ছিলো প্রাধান্য লিপি আবিষ্কার এবং তার ব্যবহার শুরু হতে হতে বহু
শতাব্দী পার হয়ে যায়। ততদিনে মানব সমাজে দেবতা এবং রাজার সর্বময় কর্তৃত্ব
প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ফলে কাহিনি গড়ে ওঠতে থাকে দেবতা, রাজা এবং পুরোহিতদের
নিয়ে। কাহিনি বর্ণনার কৌশলেও ততদিনে বৈচিত্র্য এসেছে। গান এবং কবিতা হয়ে
ওঠেছে তখন কাহিনি বর্ণনার মাধ্যম, কাব্য, মহাকাব্য ও নাটকের এই সূত্রেই
আবির্ভাব। দৈনন্দিন জীবন যাপনের ভাষা গদ্যের মাধ্যমে কাহিনী লেখক হয়েছে—
অনেক পরে। মহাকাব্যে বিচিত্র এবং বিপুল সংখ্যক কাহিনী ও চরিত্র থাকে—ঘটনাও
থাকে অসংখ্য, কিন্তু তবু কাব্যের ভাষা মানুষের যাপনীয় জীবনের অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণও
তার মানসিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার খুঁটিনাটি বিবরণ ব্যক্ত করতে পারে না। উপরন্ত
পরিচিত ও সম-সাময়িক জীবন ও জগৎ মহাকাব্যে উপস্থাপিত হয় না। ফলে গল্পের
মধ্য দিয়ে মানুষের নিজেকে এবং নিজের পরিচিত জগৎকে জানবার আগ্রহ মহাকাব্যের
পক্ষে নিবৃত্ত করা প্রায় অসম্ভব। নাটকের ক্ষেত্রে আরেক মুশকিল এই যে ঘটনা এবং
চরিত্রকে চোখের সামনে দেখা যায় কিন্তু ঐসব ঘটনা ও চরিত্রের আচরণের পশ্চাতে
কী আছে তা জানা যায় না। উপরন্তু নাটক মঞ্চসাপেক্ষ জিনিস হওয়ার জন্য একাকী...
স্বাধীনভাবে, ইচ্ছেমতো তার স্বাদ গ্রহণ করা যায় না। সুতরাং দৈনন্দিন জীবন-যাপনের
ভাষা গদ্যে পরিচিত জগৎ ও মানুষের কাহিনি রচনার অবকাশ শিল্প ক্ষেত্রে একসময়
স্বাভাবিকভাবেই দেখা দিয়েছিলো। আর তারই ফলে উপন্যাসের সৃষ্টি।
আমরা গদ্যে রচিত কাহিনি 'আলেফ লায়লা'র কথা উল্লেখ করেছি। ঐ কাহিনিমালা
রচিত হওয়ার স্থান আরবভূমির বাগদাদ নগরী এবং সময় ইসলামের আলোকে
আলোকিত আব্বাসীয় খলিফাদের শাসনামল'। বোকাচ্চিও তাঁর 'ডেকামেরন' রচনা করেন
ইয়োরোপীয় রেনেসাঁ বা নবজাগরণের ঊষাকালে। সময়টা অন্ধবিশ্বাস কুসংস্কার এবং
পুরোহিততন্ত্রের বিরুদ্ধে উত্থানের সূচনা কাল। ষোড়শ শতাব্দী নাগাদ ইয়োরোপে বিজ্ঞান
ও শিল্পচর্চা বিশেষ গুরুত্ব লাভ করে। সপ্তদশ শতাব্দীতে ব্যবসায়ী পুঁজি শিল্প পুঁজিতে
রূপান্তরিত হতে আরম্ভ করে এবং অষ্টাদশ শতাব্দী জুড়ে চলে শিল্প বিপ্লব এবং এই
বিপ্লবের ফলে ধনতন্ত্রের চূড়ান্ত বিকাশ হয়—পুরোহিততন্ত্র নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়, রাজতন্ত্র
সামন্ত্রতন্ত্রের ভিত ধসে যায়। ১৭৮৯ সালের ফরাসি বিপ্লব 'সাম্য মৈত্রী ও স্বাধীনতা’র
বাণী সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দেয় এবং ইয়োরোপের মানুষ ব্যক্তির অধিকার প্রতিষ্ঠায় উন্মুখ
হয়ে ওঠে। গোটা ঊনবিংশ শতাব্দী জুড়ে সমগ্র ইয়োরোপ নানান দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিক
চিন্তা-ভাবনা, নতুন আবিষ্কার, বিদ্রোহ-বিপ্লব ও যুদ্ধ-বিগ্রহে বিপুলভাবে আন্দোলিত হয়।
তারপর বিংশ শতাব্দীতে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অভিজ্ঞতা হয় বিশ্ববাসীর। ঐ সময়ই ১৯১৭
সালে রুশ দেশে শ্রমিক শ্রেণী একই সঙ্গে ধনতন্ত্র এবং রাজতন্ত্রের উচ্ছেদ করে শ্রেণীহীন
সমাজব্যবস্থা পত্তনের সূচনা করলে মানব সভ্যতায় এক নতুন পর্যায় শুরু হয় ।
চতুর্দশ/পঞ্চদশ শতাব্দীর রেনেসা থেকে আরম্ভ করে বিংশ শতাব্দী পর্যন্ত সভ্যতা
ও সংস্কৃতিক্ষেত্রে যে বিকাশ আমরা লক্ষ করি তাতে দেখা যায় যে সর্বক্ষেত্রে শেষ পর্যন্ত
মানুষের জীবনের সর্বাঙ্গীণ মুক্তিই হয়ে ওঠেছে একমাত্র লক্ষ্য এবং এই একই সূত্রে
দেখতে পাই আধুনিককালে দেবতা নয়, রাজা নয়, পুরোহিত কিংবা ধর্ম নয় মানুষ এবং
তার জীবনই হয়ে ওঠেছে সাহিত্যের প্রতিপাদ্য বিষয়। কোন মানুষ? না ব্যক্তি মানুষ—
যে মানুষ নিজ সত্তার স্বাধীন অস্তিত্ব নিয়ে মানবসমাজে সকল অধিকার ভোগ করে
বাঁচতে এবং বিকশিত হতে চায়। আর কোন জীবন? না, যে জীবন মানুষ যাপন করে
সেই জীবন। ব্যক্তির সঙ্গে সমাজের, রাষ্ট্রের এবং ব্যক্তির সম্পর্ক, এসব সম্পর্ক থেকে
উদ্ভূত নানা ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া এক কথায় তার চিন্তা ও কল্পনা, তার প্রতিদিনের আপস
ও সংগ্রাম, তার বাইরের জীবন ও তার মনোলোক, তার আশা ও হতাশা, তার সংকট
ও সমাধান সবই হয়ে ওঠে উপন্যাসের বিষয়। “অপরোক্ষ অনুভূতির সঙ্গে পরোক্ষ .
বিশ্লেষণ কাহিনীর ধারাবাহিকতার সঙ্গে আত্মস এবং বিচার তার (লেখক)
কাছে কিছুই অপাংতের উপর মতোখানি ব্যাপক
এবং সূক্ষ্মাতিযুদ্ধ অন্বেষণ ও উদঘাটন সম্ভব, অন্য যে কোনো শিল্প রূপেরই তা অনায়
এবং এই সম্ভাবনাই উপন্যাসে মননশীলতার প্রাধান্যের হেতু। এদিক থেকে বিচার
করে দেখলে দেখা যাবে উপন্যাস রচনার কাজ অন্য যে কোন শিল্পকর্মের চাইতে
মানসিক দিক থেকে অধিকতর কষ্ট সাধ্য। ছন্দে ভাষায় সাজিয়ে একটি ভাবোচ্ছ্বাসকে
প্রকাশ করতে পারলেই কবির কাজ হয়ে গেল। একই সঙ্গে কল্পনার উচ্চমার্গে এবং
কঠিন ও কাজের বাস্তব জগতে অবস্থান করার প্রয়োজন তার হয় না। কিন্তু উপন্যাস
লেখককে একই সঙ্গে নিতে হয় কল্পনা ও বাস্তবতার জগতে অবস্থান, বাস্তবতার কঠিন
উপাদান ব্যবহার করে তাঁকে রচনা করতে হয় নমনীয় শিল্পকলা।
আধুনিক উপন্যাস, অর্থাৎ যে উপন্যাসে সমাজ ও ব্যক্তির বহির্জীবন ও অন্তর্জীবন
একত্রে সংশ্লিষ্ট হয়ে পূর্ণাঙ্গ কাহিনি রচনা করে, তার আবির্ভাব ফরাসি ভাষায় বলে
পণ্ডিতেরা মনে করেন। স্বাধাল এবং দিদারো নামক দুই ফরাসি লেখককে আধুনিক
উপন্যাস রচনার ক্ষেত্রে পথিকৃতের সম্মান দেয়া হয়ে থাকে। সামাজিক বাস্তবতার মধ্যে
ব্যক্তির অবস্থানগত ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া এবং বিভিন্ন সম্পর্ক তারা লিপিবদ্ধ করেছেন। এ
প্রসঙ্গে ইংরেজ লেখক্ হেনরি ফিল্ডিং এর নামও শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণীয়। তবে মানুষের
ব্যক্তি জীবনের যন্ত্রণা ও আকাঙ্ক্ষা এবং সেই সঙ্গে তার বাস্তব পরিবেশ বিশ্লেষণের
ক্ষেত্রে পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছেন রুশ লেখকরা। ঊনবিংশ শতাব্দীর দুই মহান রুশ লেখক
উপন্যাস রচনার ক্ষেত্রে যে অবদান রেখেছেন তার তুলনা নেই। তলস্তয় ও দস্তয়েভস্কি
এখনো পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ উপন্যাস লেখক বলে সম্মানিত। বিশেষত তলস্তয়ের ‘ওয়ার
এ্যান্ড পীস' নামক গ্রন্থখানি যে এযাবৎ কাল পর্যন্ত রচিত বিশ্বের মহৎ উপন্যাসগুলোর
মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ এ বিষয়ে কোনো দ্বিমত কেউ পোষণ করে না।
বাংলা উপন্যাসের বিভিন্ন সূত্র---
উপন্যাসের সংজ্ঞা ও গঠন কৌশলকে সামনে রেখে উপন্যাসতত্ত্ববিদ, পণ্ডিত ও সমালোচকরা
উপন্যাসের পাচটি সূত্র বিবৃত করেছেন। যেমন—
১.প্রস্তাবনা
২. সমস্যার উপস্থাপনা;
৩. আখ্যানভাগের মধ্যে জটিলতার প্রবেশ;
৪. চরম সংকট মুহূর্ত:
৫. সংকট বিমোচন বা উপসংহার।
গঠন রীতির বিভিন্ন শর্তের কথা মনে রেখেও সব ক্ষেত্রেই মনে রাখতে হবে যে,
উপন্যাসকে অবশ্যই উপভোগ্য হতে হবে। বিশ্ববিখ্যাত ইংরেজ সাহিত্যিক ও
সমালোচক William Somerset Maugham যথার্থই বলেছেন, “"Finally a novel
should be entertaining it is an essential quality, without which no other
quality is of any use" সমারসেট মম এখানে সঠিক কথাটিই বলেছেন। বাস্তবিকই
উপন্যাস হবে উপভোগ্য, আনন্দসঞ্চারী ও আনন্দদানকারী। উপন্যাস মূলত আনন্দের
সামগ্রী, আনন্দের সাথী। অবশ্যই তা মানসিক আনন্দ। আর যে কোন মহৎ উপন্যাসই
পাঠকের হৃদয়মনকে এক মহৎ আনন্দে আপ্লুত করে জীবন ও জগৎ সম্পর্কে এক মহৎ
উপলব্ধিতে পরিপূর্ণ করে তোলে।
উপন্যাস বিভিন্ন প্রকার হয়ে থাকে। তা কখনো হয় কাহিনিনির্ভর কখনো হয়
চরিত্রনির্ভর কখনো হয় মনস্তাত্ত্বিক, কখনো হয় নীতিকথামূলক, আবার কখনো হয়
বক্তবাধর্মী। তবে যে রকমই হোক না কেন, সার্থক উপন্যাস সৃষ্টি করতে উপন্যাসের
সংজ্ঞা ও গঠনশৈলীকে বিশ্বস্ততার সাথে অনুসরণ করতেই হবে।
বাংলা উপন্যাসের শ্রেণীবিভাগ
বিষয়বস্তু ও প্রবণতা অনুসারে উপন্যাসকে অন্ততপক্ষে নয়টি ভাগে ভাগ করা যায়। যথা—
১. ঐতিহাসিক উপন্যাস;
২. সামাজিক-পারিবারিক উপন্যাস:
৩. কাব্যধর্মী উপন্যাস;
৪. মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস;
৫. ব্যঙ্গরসাত্মক উপন্যাস:
৬. গোয়েন্দা উপন্যাস;
৭. আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস;
৮. আত্মজীবনীমূলক ভ্রমণোপন্যাস;
৯. আঞ্চলিক উপন্যাস।
কোন কোন সমালোচক উপন্যাসের সাথে নাটকের মিল দেখেন। নাটকে যেমন
আখ্যান, চরিত্র, দৃশ্য, সংলাপ ইত্যাদি থাকে, উপন্যাসেও তেমনি এসব রয়েছে। সে
কারণে বলা যায় ঔপন্যাসিক তাঁর উপন্যাসে নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে মানব জীবনকে
নাটকের মত করে উপস্থাপন করে থাকেন। সেজন্য উপন্যাসকে পকেট থিয়েটার বলেও
অভিহিত করা হয়ে থাকে ||
লেখক কখনো কখনো নিজের ভাষায় পরের উক্তিতে উপন্যাসের কাহিনী উপস্থাপন
করেন, আবার কখনো বা নিজের ভাষায় নিজের কাহিনীও উপন্যাসের মত করে উপস্থাপন
করেন। তবে সকল ক্ষেত্রেই শর্ত একটাই যে, বর্ণনা ও উপস্থাপনা হবে উপভোগ্য।
এখন উপন্যাসের নয়টি শ্রেণী সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করা যাক।
১. ঐতিহাসিক উপন্যাস
ঐতিহাসিক উপন্যাস সম্পর্কে অতি সংক্ষেপে এ কথা বলা যায় যে, ইতিহাসকে
অবলম্বন করে যে উপন্যাস রচিত হয়, তা-ই ঐতিহাসিক উপন্যাস। কিন্তু এ প্রসঙ্গে
আরো কিছু কথা থেকে যায়। তা হচ্ছে, ইতিহাসকে যথাযথভাবে অনুসরণ করে সেই
যুগ ও সেই কালের প্রেক্ষাপটকে যদি যথাযথভাবে উপস্থাপন করা না হয়, তা হলে তা
সার্থক ঐতিহাসিক উপন্যাস বলে বিবেচিত হবে না। এ জন্যই বিশ্ববিখ্যাত ইংরেজ
সমালোচক Dr. Johnson বলেছিলেন যারা ইতিহাস জানতে চান, তাঁরা যেন স্কটের
'আইভানহো' উপন্যাস না পড়েন উল্লেখ্য যে, আইভানহো একটি বিশ্ববিখ্যাত জনপ্রিয়
ঐতিহাসিক উপন্যাস অথচ তাতে ইতিহাসের চরম অবমাননা করা হয়েছে। তাই সার্থক
ঐতিহাসিক উপন্যাসের শর্ত হল তা মূল ইতিহাসকে যথাযথভাবে অনুসরণ করবে।
সেখানে মিথ্যার বেসাতি থাকবে না।
ঐতিহাসিক উপন্যাস ইতিহাসের মূল কাহিনীকে অনুসরণ করবে। জাতীয় জীবনের
অতীত ইতিহাস, অতীতের আর্থ-সামাজিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে তৎকালীন সংস্কার ও
রীতিনীতিকে বিশ্বস্তভাবে অঙ্কন করতে হয় ঐতিহাসিক উপন্যাসে। বলা চলে ইতিহাসের
কঙ্কালকে ঔপন্যাসিক মানবীয় অনুভূতিতে পরিপূর্ণ একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনসত্তায় রূপান্তরিত
করেন। মূল কাহিনির সঙ্গে লেখকের কল্পনা সংযোজিত হয়ে উপন্যাসটি প্রাণবন্ত হয়ে
ওঠে। মনে হবে যেন, সেই যুগ আর সেই সময়কালটা যেন পাঠকের চোখের সামনে
ভেসে উঠছে। এখানেই ঐতিহাসিক উপন্যাসের সার্থকতা। স্যার ওয়াল্টার স্কটের লেখা
বিখ্যাত ইংরেজি ঐতিহাসিক উপন্যাস 'আইভানহো'র প্রসঙ্গ পূর্বে উল্লেখিত হয়েছে।
বিশ্বখ্যাত রুশ সাহিত্যিক ভাসিলি ইয়ানের ‘চেঙ্গিস খান' একটি বিখ্যাত সার্থক
ঐতিহাসিক উপন্যাস লিও টলস্টয়ের 'ওয়ার অ্যান্ড পীস'-এর কথা বলাই বাহুল্য। বাংলা
সাহিত্যে ভূদেব মুখোপাধ্যায় (অঙ্গুরীয় বিনিময়), রমেশচন্দ্র দত্ত (মহারাষ্ট্র জীবন প্রভাত,
রাজপুত জীবন-সন্ধ্যা), বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (রাজসিংহ, আনন্দমঠ, চন্দ্রশেখর ইত্যাদি)
প্রমুখ সাহিত্যিকরাও ঐতিহাসিক উপন্যাস লিখেছেন। মীর মশাররফ হোসেন ঊনবিংশ
শতকের শেষ পাদে সার্থক ঐতিহাসিক উপন্যাস 'বিষাদসিন্ধু' লেখেন। বাংলা সাহিত্যে
ঐতিহাসিক উপন্যাস রচনার ধারা আজও অব্যাহত রয়েছে।
২. সামাজিক-পারিবারিক উপন্যাস
পরিবার ও সমাজ জীবনের নানা বিষয়বস্তু, ঘটনা ও ঘাত-প্রতিঘাতকে অবলম্বন করে এ
ধরনের উপন্যাস লেখা হয়ে থাকে। এতে মানবজীবনের সাথে একান্তভাবে জড়িত
আর্থ-সামাজিক, ধর্মীয়, রাষ্ট্রীয় প্রভৃতি নানা প্রাসঙ্গিক বিষয়ে জীবনঘনিষ্ঠ উপস্থাপনা
থাকে। তা ছাড়া পারিবারিক নানা বিষয়, যেমন সহায়-সম্পত্তি বিষয়ক জটিলতা,
আর্থিক টানাপোড়েন, সাংসারিক সুখ-দুঃখ, স্নেহপ্রীতিপ্রেম ইত্যাদি অবলম্বন করে
পারিবারিক উপন্যাস লেখা হয়ে থাকে।
বাংলা সাহিত্যে এ ধরনের উপন্যাসের অনেক দৃষ্টান্ত দেয়া যায়। যেমন, বাংলা
সাহিত্যের প্রথম সার্থক ঔপন্যাসিক বঙ্কিমচন্দ্রের 'কৃষ্ণকান্তের উইল' ও 'বিষবৃক্ষ', বিংশ
শতাব্দীর বিশিষ্ট লেখক মোহাম্মদ নজিবর রহমান সাহিত্যরত্নের লেখা 'আনোয়ারা',
‘প্রেমের সমাধি' প্রভৃতি উপন্যাস পারিবারিক উপন্যাসের বিশিষ্ট উদাহরণ। বাংলা
সাহিত্যের সব চাইতে জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের অনেক উপন্যাস
পারিবারিক-সামাজিক উপন্যাস। তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনার মধ্যে রয়েছে 'পল্লীসমাজ',
'গৃহদাহ', 'দেনা পাওনা', 'চরিত্রহীন', 'বামুনের মেয়ে', 'অরক্ষণীয়া' ইত্যাদি। কাজী
ইমদাদুল হকের 'আবদুল্লাহ্ সামাজিক উপন্যাসের একটি সার্থক উদাহরণ ।
৩. কাব্যধর্মী উপন্যাস
যেসব উপন্যাসে কাহিনি ও চরিত্রচিত্রণ অপেক্ষা লেখকের কাব্যদৃষ্টি প্রাধান্য পায় এবং
বর্ণনায় ও ভাষারীতিতে তা ফুটে ওঠে, সে ধরনের উপন্যাসকে কাব্যধর্মী উপন্যাস বলা
হয়ে থাকে। বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'শেষের কবিতা' ও কাজী নজরুল
ইসলামের 'ব্যথার দান', বুদ্ধদেব বসুর 'যে দিন ফুটল কমল’, ‘সাড়া’, ‘তিথিডোর’
ইত্যাদি কাব্যধর্মী উপন্যাসের বিশিষ্ট উদাহরণ।
৪. মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস
যে উপন্যাসের উপাখ্যানে পাত্র-পাত্রীদের মনোবিশ্লেষণ লেখকের কাছে মুখ্য হয়ে
ওঠে সে ধরনের উপন্যাসকে মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস বলা হয়ে থাকে। এ ধরনের
উপন্যাসে কাহিনি হয় অবলম্বন মাত্র, কিন্তু এর প্রকৃত উদ্দেশ্য থাকে মানবমনের জটিল
দিকগুলোর সার্থক বিশ্লেষণের মাধ্যমে উপস্থাপন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'চোখের বালি',
'ঘরে বাইরে' এবং মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'দিবারাত্রির কাব্য' মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাসের
উৎকৃষ্ট উদাহরণ।
৫. ব্যঙ্গাত্মক উপন্যাস
সামাজিক মানুষের নানা অসঙ্গতিকে তীব্র ব্যঙ্গ ও হাস্যরসের মাধ্যমে যে উপন্যাসে
উপস্থাপন করা হয় তাকে ব্যঙ্গাত্মক উপন্যাস বলে। বাংলা সাহিত্যে পরশুরাম, শিবরাম
চক্রবর্তী ও সৈয়দ মুজতবা আলী এ ধরনের রচনায় বিশেষ সাফল্য দেখিয়েছেন।
৬. গোয়েন্দা উপন্যাস
বিভিন্ন অপরাধমূলক ঘটনাকে অবলম্বন করে সার্থক গোয়েন্দা চরিত্র সৃষ্টি করে এ
ধরনের উপন্যাস লেখা হয়ে থাকে। এর কাহিনি হয় খুবই জটিল ও লোমহর্ষক। লেখক
অদ্ভুত লিপিকুশলতায় পাঠকমনকে সব সময় উৎকণ্ঠার মধ্যে রেখে পাঠককে আনন্দ
দিতে দিতে নানা রহস্যের সন্ধান দিয়ে কাহিনি শেষ করেন। বলা হয়ে থাকে যে, এ
ধরনের উপন্যাস পাঠে পাঠকের কূটবুদ্ধির প্রসার ঘটে। গোয়েন্দা উপন্যাসের পাঠকেরা
প্রধানত তরুণ-তরুণীই। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়, নীহাররঞ্জন সেনগুপ্ত, সত্যজিৎ রায়
বাংলা সাহিত্যের বিশিষ্ট গোয়েন্দা উপন্যাস রচয়িতা।
৭. আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস
বিশ্বসাহিত্যে আত্মজীবনীমূলক উপন্যাসের একটি বিশাল ধারা রয়েছে। বাংলা সাহিত্যেও
তা যথেষ্ট পরিপুষ্ট। ঔপন্যাসিক তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের নানা ঘাত-প্রতিঘাতকে অদ্ভুত
রচনাশৈলী ও লিপিকুশলতার মধ্য দিয়ে উপভোগ্য উপন্যাসে রূপদান করেন। এ ধরনের
উপন্যাসকে বলা হয় আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস। জনপ্রিয় কথাশিল্পী শরত্চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের
চার খণ্ডে লেখা 'শ্রীকান্ত' আত্মজীবনীমূলক উপন্যাসের একটি শ্রেষ্ঠ উদাহরণ। তা ছাড়া
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'পথের পাঁচালী'কে অনেকে আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস
বলে অভিহিত করে থাকেন।
৮. আত্মত্মজীবনীমূলক ভ্রমণোপন্যাস
কোন ভূপর্যটক, ভ্যাগাবণ্ড বা ভবঘুরে লেখক তাঁর ভ্রমণ-পথের বিচিত্র অভিজ্ঞতাকে
আত্মজীবনীর আদলে যখন উপন্যাসের মতো সরস ও উপভোগ্য করে লেখেন, তখন
তাই হয় আত্মত্মজীবনীমূলক ভ্রমণোপন্যাস। বাংলা সাহিত্যে সৈয়দ মুজতবা আলীর
'দেশে-বিদেশে' আত্মজীবনীমূলক ভ্রমণোপন্যাসের একটি শ্রেষ্ঠ উদাহরণ। এ প্রসঙ্গে
অন্নদাশঙ্কর রায়ের 'পথে প্রবাসে', প্রবোধ কুমার সান্ন্যালের 'মহাপ্রস্থানের পথে' ও
মুহম্মদ আবদুল হাইয়ের বিলেতে সাড়ে সাত শ দিন' গ্রন্থগুলোও উল্লেখযোগ্য।
৯. আঞ্চলিক উপন্যাস
বিশেষ কোন অঞ্চল ও সে অঞ্চলের নির্দিষ্ট এলাকা ও পরিসরের মানুষের সুখ-দুঃখ,
হাসি-কান্না মিশ্রিত যে কাহিনি বা উপন্যাস তা-ই আঞ্চলিক উপন্যাস বলে পরিচিত।
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'কবি' ও 'হাঁসুলি বাঁকের উপকথা', মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের
‘পদ্মানদীর মাঝি', অদ্বৈত মল্লবর্মণের 'তিতাস একটি নদীর নাম', সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র
'লালসালু', সমরেশ বসুর 'গঙ্গা' বাংলা সাহিত্যের বিখ্যাত আঞ্চলিক উপন্যাসগুলোর
নাম উল্লেখযোগ্য।
আধুনিক উপন্যাস সম্বন্ধে আলোচনা
দেখা যাচ্ছে আধুনিক উপন্যাসে কাহিনি বর্ণনাই লেখকের একমাত্র কর্তব্য নয়।
উপন্যাসে কাহিনি অবশ্যই থাকে। কিন্তু সেই সঙ্গে চেষ্টা থাকে মানুষের সামগ্রিকজীবনের পরিচয় তুলে ধরার। জীবন কীভাবে প্রবাহিত হয়ে এক স্তর থেকে পৌছায়
আরেক স্তরে—এই চিত্রই থাকে উপন্যাসের কাহিনি জুড়ে। উপন্যাসের কাহিনি কেবল
সরল বর্ণনা নয়। দেখা যাচ্ছে, কাহিনি নির্মিত হয় ঘটনা দিয়ে। একটি ঘটনার যৌক্তিকক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াই জন্ম নেয় নতুনতর ঘটনা বা ঘটনালির। এভাবে ক্রমান্বয়ে ঘাতপ্রতিঘাত ও ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার পথ ধরে ঘটনা থেকে ঘটনান্তরের মধ্য দিয়ে উপন্যাসের
কাহিনি পূর্ণাঙ্গ হয়ে ওঠে। এক্ষেত্রে লক্ষণীয় এই যে, যৌক্তিকতার ভিত্তিতে লেখককে
ঘটনাবলির বিন্যাস তৈরি করতে হয়। এই বিন্যস্তঘটনাবলিকেই সমালোচকের ভাষায়বলা হয় প্লট। লেখক প্লটের মাধ্যমেই তাঁর কাহিনি নির্মাণ করেন।
এখন ঘটনা ঘটায় কে? না মানুষ। এক কিংবা একাধিক ব্যক্তির আচরণ ও
ক্রিয়াকাণ্ডই ঘটনার জন্ম দেয়। তাহলে ব্যক্তির আচরণ এবং ক্রিয়াকাণ্ডের উৎস কোথায়?
অবশ্যই তার মনে মনে বিশেষ প্রবণতা এবং অবস্থা তার চিন্তা-ভাবনার প্রক্রিয়াটি
নিয়ন্ত্রণ করে। মনের বিশেষ অবস্থায় বাইরের জগতের সংস্পর্শে এলে যে ক্রিয়া
প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয় তারই ফলে যে কর্মে প্রবৃত্ত হয় অথবা নিবৃত্ত থাকে, তার আর এই
সক্রিয়তা অথবা নিষ্ক্রিয়তাই নতুন থেকে নতুনতর ঘটনার জন্ম দেয়। জন্ম দেয় বিরোধ
কিংবা শান্তির—ঘৃণার কিংবা প্রেমের। সুতরাং উপন্যাস লেখককে মনোযোগী হতে হয়
চরিত্র নির্মাণ সম্পর্কে। ব্যক্তির কল্পনা এবং বিশ্বাস, আচরণ এবং কথাবার্তা, তার প্রেমঘৃথা তার ভেতর এবং বাইরের সমস্তটুকুই লেখককে খুঁজে বের করতে
হয়। না হলে চরিত্র পড়ায় এবং সেই চরয়ের সঙ্গে ঘটনার সামঞ্জস্য থাকে না আর
তা না থাকলে, উপন্যাসের কাহিনি নির্মাণ বিফলে যায়। অতএব উপন্যাস লেখকের
কাহিনি এবং প্লটের সঙ্গে সঙ্গে আবশ্যিক কর্তব্য হচ্ছে চরিত্র নির্মাণ
এখানে একটি আলোচ্য বিষয় এই যে, মানুসের অস্তিত্ব এবং অবস্থান সামাজিক
পরিবেশে। সুতরাং চরিত্র নির্মাণের সঙ্গে সঙ্গে তার সামাজিক পরিবেশটিকেও লেখকের
তুলে ধরা কর্তব্য। চরিত্রের যতো রকম অনুষঙ্গ থাকতে পারে, সে যতোরকর্ম সম্পর্কেসম্পর্কিত হতে পারে সবই উপন্যাস লেখককে জানতে হবে। একজন রাজনৈতিককর্মী যদি উপন্যাসের নায়ক হয় তাহলে তার ব্যক্তি জীবনকে লেখক তো বিশ্লেষণ
করবেনই, সেই সঙ্গে তার সমকালীন প্রচলিত রাজনৈতিক তত্ত্ব ও আন্দোলনগুলোসম্পর্কেও লেখককে আলোকপাত করতে হবে। অর্থাৎ সমাজকে ভালোভাবে না জানলে
লেখক ব্যক্তিকে এবং তার সামাজিক সম্পর্ককে দেখাতে পারছেন না। সামাজিকসচেতনতা তাই উপন্যাসের আবশ্যিক শর্ত।তাহলে কাহিনি, প্লট ও চরিত্র নির্মাণ এবং সেই সঙ্গে সামাজিক সচেতনতা বিধৃত
থাকলেই কি উপন্যাস হবে? আমরা জানি না, তাহলে হবে না। কারণ উপন্যাস রচনার
ক্ষেত্রে খুব বড় একটা শর্ত পাঠকের মনোরঞ্জন। উপাদানসমূহের বিশেষ কৌশলে
উপস্থাপনার মধ্য দিয়ে একটি মনোগ্রাহিতার শুণ সাধারণভাবেই সৃষ্টি হওয়ার কথা।
তবে সে ব্যাপারে লেখকের সজাগ ও সচেতন প্রয়াস থাকা আবশ্যক। এই প্রয়াস
থাকতে হবে উপন্যাস রচনা প্রক্রিয়ার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত। উপন্যাস লেখকের
উপাদানসমূহ, যেমন এর কাহিনি, প্লট, চরিত্র সবই বাস্তবতানির্ভর এবং এর প্রকাশ
মাধ্যমও গদ্য, সুতরাং রচনাটি উপভোগ্য করার জন্য তাঁকে যথার্থ মাত্রার ভাষা ব্যবহার
করতে হবে। যে ভাষায় প্রসাদ গুণ আছে এবং যা তাঁর কাহিনি প্লট ও চরিত্রের সকল
উপাদানকে সুসামঞ্জস্যভাবে বুনন করতে পারে–লেখককে সেই ভাষা আবিষ্কার করতে
হবে এবং যথার্থ মাত্রায় প্রয়োগ করতে হবে। সেসব শব্দ তিনি প্রয়োগ করবেন চরিত্রের
সংলাপে, ঘটনার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে এবং প্রকৃতি-পরিবেশ বর্ণনায় যা উপন্যাসের কাহিনি
ও চরিত্রকে একটি সামগ্রিক শিল্পরূপের মধ্যে ধরে রাখে। বলা বাহুল্য ভাষা, কাহিনি,
প্লট, চরিত্র সবই সৃষ্টি হয় লেখকের বিশ্বাস, জীবনোপলব্ধি, রুচি ও শিল্পচেতনার প্রকৃতিঅনুযায়ী। ফলে, যেহেতু ভিন্ন রুচিহি লোকাঃ, সেহেতু একই উপন্যাস সব পাঠকের
মনোরঞ্জন নাও করতে পারে। আবার এমনও হয়,লেখকের জীবৎকালে তাঁর উপন্যাস
পাঠকের মনোরঞ্জন করতে পারলো না, কিন্তু পারলো লেখকের মৃত্যুর পরে। সুতরাংউপন্যাসের মনোগ্রাহিতার বৈশিষ্ট্যই কালভেদে পাত্রভেদে পৃথক হয়ে যেতে পারে।
এক্ষেত্রে বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে লেখক তাঁর রচনাকে মনোগ্রাহী করে তোলার জন্য প্রয়াসী
ছিলেন কিনা। পাঠের সময় আমরা উপন্যাসের জগতের মধ্যে প্রবেশ করি, সেখানে
অবস্থান করি এবং তারপর নতুন চিন্তা-ভাবনা অথবা আনন্দ উপলব্ধি নিয়ে সমাপ্তিতে
উপন্যাসের জগৎ থেকে নিষ্ক্রান্ত হই। এ রকম একটি কাণ্ড ঘটবার কারণ উপন্যাসের
মনোগ্রাহিতা।
আসলে উপন্যাসে লেখক কল্পনা এবং ভাষার সাহায্যে একটি মায়ালোক সৃষ্টি
করেন। সেটি এমনই এক জগৎ যার ভেতরে প্রবেশ করলে পাঠকের মনে হবে
তো আমার চেনা জগৎ-এর চরিত্রগুলো তো আমারই চেনা-জানা মানুষ-জন এবং এর
চরিত্রগুলোর সুখ-দুঃখ-সমস্যা-সংকট আমারই সুখ-দুঃখ-সমস্যা-সংকটের মতো। কল্পনা
দিয়ে তৈরি হলেও সে জগৎ হবে বাস্তবতারই জীবন্ত প্রতিচ্ছবি। এরকম না হলে কোনো
দীর্ঘ গদ্য কাহিনিকে উপন্যাস বলা যাবে না।
উপন্যাসের কাছে পাঠকের শেষ দাবি একটি বক্তব্য উপন্যাস পাঠ শেষ হলে
পাঠকের মনে প্রশ্ন জাগবে, লেখক তাঁর কাহিনির মধ্য দিয়ে কী বলতে চেয়েছেন? বলা
বাহুল্য প্রশ্নের উত্তর উপন্যাসের মধ্যেই দেয়া থাকবে। এই বক্তব্য গভীর জীবনোপলব্ধির
সঙ্গে সম্পর্কিত হতে পারে কিংবা হতে পারে সামাজিক জীবনের কোনো সমস্যার প্রতি
অঙ্গুলি নির্দেশ। অথবা নিতান্তই সাদামাটাভাবে 'পাপের পরাজয় ও পুণ্যের জয়'- এ
ধরনের বক্তব্যও থাকতে পারে। তবে বক্তব্যটি পাঠকের গভীর উপলব্ধিতে পৌঁছোতে
হবে। 'পাপকে ঘৃণা করো, পাপীকে নয়' দস্তয়েভস্কির এই বক্তব্য সমন্বিত উপন্যাস
“ক্রাইম এ্যান্ড পানিশমেন্ট" বহুকাল ধরে বিশ্বের মানুষকে মানবতাবাদী ও মানব
প্রেমিক হওয়ার প্রেরণা যুগিয়ে চলেছে। বর্তমান শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে রচিত মার্কিন
লেখক আর্নেস্ট হেমিংওয়ের ক্ষুদ্র উপন্যাস 'ওল্ড ম্যান এ্যান্ড দ্য সী'র বক্তব্যটিও আমরা
এ প্রসঙ্গে স্মরণ করতে পারি। বড়ো জেলে সান্তিয়াগোর একাকী একটি প্রকাণ্ড সামুদ্রিক
মাছ শিকারের কাহিনি বর্ণনার মধ্য দিয়ে পাঠককে যে গভীর উপলব্ধিতে পৌঁছে দেন
লেখক, তাকে জীবনোপলব্ধির সারৎসার বলা যেতে পারে। 'মানুষকে ধ্বংস করা যায়
কিন্তু কখনোই পরাজিত করা যায় না" এইরকম একটি উপলব্ধি মানুষকে সাহসী
এবং সংগ্রামী করে তুলতে পারে। আমরা জানি, সাহস এবং সংগ্রামবিহীন জীবন আর
যারই হোক প্রকৃত মানুষের নয় ।
বাংলা উপন্যাস সম্বন্ধে সংক্ষিপ্ত পরিচিতি--
বাংলা ভাষায় উপন্যাস লেখার সূচনা আধুনিক কালে। আমরা জানি গদ্যই হলোউপন্যাসের একমাত্র প্রকাশ মাধ্যম। সুতরাং গদ্য সৃষ্টি না হলে উপন্যাস রচনার প্রশ্নই
ওঠে না। ১৭শ শতাব্দীর মধ্য ভাগে বাংলা গদ্য রচনার উন্মেষকাল বলে মনে করাহলেও গদ্য রচনার সংগঠিত প্রয়াস ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে ফোর্টউইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠিত
হওয়ার পর। সামাজিক জীবনের জটিলতা ব্যাখ্যাওবিশ্লেষণের কাজে প্রথম গদ্যব্যবহৃত হয়—এক্ষেত্রে সংবাদপত্রের ভূমিকা বিশেষভাবে স্মরণীয়। তবে সাহিত্যশিল্পের মাধ্যম হয়ে ওঠতে গদ্যের কিছুটা বেশি সময় লাগে। ১৮৫৮ সালে প্রকাশিতপ্যারীচাঁদ মিত্রের গদ্যে রচিত 'আলালের ঘরের দুলাল' নামক কাহিনি গ্রন্থে আধুনিকউপন্যাসের লক্ষণাদি প্রথম দৃষ্টিগোচর হয়। তবে বাংলা সাহিত্যে প্রথম সার্থক
উপন্যাসলেখক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। ব্যক্তি মানুষের সুখ-দুঃখের পূর্ণাঙ্গ কাহিনি
তিনিই সাফল্যের সঙ্গে লিপিবদ্ধ করেন। প্লট ও চরিত্র নির্মাণসহ উপন্যাস রচনার সকল
আঙ্গিক সম্পর্কে সচেতন হয়ে বক্তব্যসমন্বিত ব্যক্তি মানুষের কাহিনি তিনিই প্রথম যথার্থ
ভাষায় উপস্থাপন করেন। তবে বঙ্কিমচন্দ্রের অধিকাংশ উপন্যাসেই দূর অতীতের কল্পনা
বেশি—সমকালীন জীবন প্রায় অনুপস্থিত। কেবল 'বিষ বৃক্ষ' ও 'কৃষ্ণকান্তের উইল' এই
দু'খানি উপন্যাসে সমকালীন জীবন বাস্তবতা সুস্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। বিধবা
রমণীর প্রণয় এবং বিবাহ, সামাজিক ও পারিবারিক জীবনে কী রকম জটিল সমস্যা ও
তীব্র সংকট সৃষ্টি করতে পারে তারই কাহিনি তিনি উক্ত উপন্যাস দু'খানিতে লিপিবদ্ধ
করেছেন। বলা বাহুল্য তাঁর বক্তব্য বিধবা নারীর মানবিক অধিকার স্বীকার করেনি।
তবু, রক্ষণশীল দৃষ্টিভঙ্গি থাকা সত্ত্বেও বলতে হবে বঙ্কিমচন্দ্রই বাংলা উপন্যাসের
বিকাশের পথটি খুলে দিয়েছেন। তার পরে রবীন্দ্রনাথ সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক সংকটাপন্ন
ব্যক্তি জীবনের কাহিনিগুলো রচনা করেন 'চোখের বালি', 'ঘরে বাইরে’, ‘যোগাযোগ’
প্রভৃতি উপন্যাসে। বস্তুত রবীন্দ্রনাথই বাংলা উপন্যাসে আধুনিক চিন্তা-ভাবনার প্রসার
ঘটান। উদার মানবতাবাদী জীবনাদর্শে বিশ্বাসী লেখকের দৃষ্টিতে বিধবার প্রণয় পাপ
কার্য বলে ধিকৃত হয়নি এবং সেই কারণে প্রণয়িনী বিধবাকে প্রাণ দিয়ে পাপের
প্রায়শ্চিত্ত করতে হয়নি। সংস্কার, ধর্ম ও আদর্শের চাইতে মানুষের জীবন যে অনেক
বেশি মূল্যবান এই বিবেচনার শিল্পরূপ রবীন্দ্রনাথের প্রায় সকল উপন্যাসেই উপস্থিত।
‘গোরা’, ‘চার অধ্যায়' প্রভৃতি উপন্যাসে আবার বিদেশী শাসন থেকে মুক্তির অভিপ্রায়
ব্যক্ত হয়েছে। ব্যক্তি জীবনের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম অভিপ্রায় ও বাসনার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া যেমন
ব্যক্ত হয়েছে তেমনই জগও বৃহত্তর জীবনের যাবতীয় প্রসঙ্গ রবীন্দ্রনাথের গল্প ও
উপন্যাসের শিল্পরূপের মধ্যে আমরা প্রতিফলিত হতে দেখি।
বাংলা উপন্যাসে জনপ্রিয়তার কাল
বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশক নাগাদ বাংলা উপন্যাস অসাধারণ জনপ্রিয়তা অর্জন করে।
এই ঘটনার কৃতিত্ব শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের। বাঙালি মধ্যবিত্ত হিন্দু সমাজে গার্হস্থ্য
জীবনের সুখ-দুঃখের কাহিনি এমন অন্তরঙ্গ ভাষায় ও কৌশলে লিপিবদ্ধ করেছেন তিনি
যার তুলনা খুব কম। সামাজিক সংস্কারের পীড়নে নারীর অসহায়তার এমন করুণ চিত্রও
আর কোনো লেখক আঁকেন নি। একদিকে এই সামাজিক বাস্তবতা আর অন্যদিকে এই
বাস্তবতা থেকে উদ্ভূত মানব মনের জটিল-কুটিল ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া এই দুটি দিকের
আশ্চর্য সমন্বয় দেখা যায় শরৎচন্দ্রের গৃহদাহ, শ্রীকান্ত, চরিত্রহীন প্রভৃতি উপন্যাসে ।রবীন্দ্রনাথ ও শরৎচন্দ্রের উপন্যাসে যে সামাজিক বাস্তবতা প্রতিফলিত তা ইতোমধ্যেদ্রুত বদলে যাচ্ছিল। শিক্ষা প্রসার বিশেষ করে নারীর শিক্ষার প্রসার এবং অর্থনৈতিক
সংকট একই সঙ্গে মানুষের পারিবারিক জীবনকে জটিল করে তুলছিলো— এইএকদিক, আর অন্যদিকে রাজনৈতিক কারণে সমাজের নিম্নকোর্টীর মানুষ ক্রমেই হয়েউঠছিলো অধিকার সচেতন। এই নতুন সামাজিক বাস্তবতার মধ্যে সাহিত্য ক্ষেত্রে নতুনদিগন্ত সন্ধানের তীব্র আকাঙ্ক্ষা নবীন লেখকদেরএকদিকে মানুষের জটিল মনোলোকের
রহস্য সন্ধানে আগ্রহী করে তোলে, আবার অন্যদিকে তাঁদের কাছে সমাজের নিম্নশ্রেণীর
অবজ্ঞাতে মানুষ এবং তাদের জীবন সাহিত্যের প্রধান উপাদান হয়ে ওঠে। ক্ষুধা,
শোষণ ও বঞ্চনা মানুষের মন ও বাইরের জীবনকে কী রকম দুমড়ে-মুচড়ে বিকৃত করে
দেয় তারই বিশ্বস্ত কাহিনি বাংলা উপন্যাসের মধ্যে প্রতিফলিত হতে আরম্ভ করে।
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় ও মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এই দুই লেখক রবীন্দ্রনাথ ও
শরৎচন্দ্রের পর বাংলা সাহিত্যে প্রধান উপন্যাসকার হয়ে ওঠেন। এই দু'জন লেখকের
সহযাত্রী আরেকজন, তিনি বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। জগৎ ও জীবনের অনন্ত স্রোেত
প্রবাহে ব্যক্তিমানুষের সামিল হওয়ার অসামান্য কাহিনি লিখেছেন তিনি তার 'পথের
পাঁচালী' উপন্যাসে। প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের নিবিড় একাত্মতার এই কাহিনি বাংলা
সাহিত্যে তুলনারহিত।
বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে মাত্র ২৫ বছরের ব্যবধানে দুটি বিশ্বযুদ্ধ সংঘটিত হয়ে
যাওয়ায় বিশ্বব্যাপী মানুষের সামাজিক ও পারিবারিক জীবনে নানাবিধ সংকটের সৃষ্টি
হয়। পুরাতন মূল্যবোধের আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যের মহিমা
কীর্তনের আড়ালে ধনতন্ত্রের সর্বগ্রাসী লোভকে আর লুকিয়ে রাখা সম্ভব হয় না। এটা
আর গোপন থাকে না যে পুঁজিবাদের মুনাফা অব্যাহত রাখা এবং বাড়িয়ে তোলার
জন্যই কাঁচামাল আহরণ ও শিল্পজাত পণ্য বিক্রয়ের বাজার দরকার। আর সেই বাজার
দখলের প্রতিযোগিতার ফল প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। বিশ্বের পরাধীন অন্যান্য দেশের
জনগণের মতো ভারতীয় উপমহাদেশের জনগণও স্বাধীনতা আন্দোলন আরম্ভ করে
বর্তমান শতাব্দীর সূচনাকাল থেকেই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে হতবল বৃটিশ রাজ্যের
সামর্থ্যে কুলায় না যে ভারতবর্ষকে আর পরাধীন করে রাখবে। ততদিনে ভারতীয়
উপমহাদেশে মধ্যশ্রেণী রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করেছে এবং এই
মধ্যশ্রেণীর সহায়তায় সাম্প্রদায়িক স্বার্থভিত্তিক রাজনৈতিক আন্দোলন তখন চূড়ান্ত
পর্যায়ে পৌঁছেছে। এই অবস্থায় ১৯৪৭ সালে হিন্দু ও মুসলমান এই দুই সম্প্রদায়ের
স্বার্থের দিকে লক্ষ্য রেখে ভারতীয় উপমহাদেশকে বৃটিশ শাসন মুক্ত করা হয় এবং
মুসলমানদের জন্য পাকিস্তান ও হিন্দুদের জন্য ভারত নামক দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের পত্তন
হয়। বাংলা ভাষাভাষী ভূখগুটি দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পশ্চিমাঞ্চল ভারতের ও পূর্বাঞ্চল
পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়। এই ঘটনার ফলে বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রও বিভক্ত হয়ে পড়ে।
পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত মুসলমান প্রদান পূর্ববাংলায় শিল্পকলা ও সাহিত্য নির্মাণের নতুন
আয়োজন আরম্ভ হয় নতুন রাষ্ট্রের প্রাদেশিক রাজধানী ঢাকা নগরীকে কেন্দ্র করে।
আধুনিক উপন্যাসের কাল
পাকিস্তান রাষ্ট্র টেকেনি। ঐ নবীন রাষ্ট্রে বাঙালিরাই ছিলো সংখ্যাগরিষ্ঠ, তবু উর্দুকে
রাষ্ট্রভাষা করার ফলে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে পূর্ববাংলায় ব্যাপক গণআন্দোলন শুরু হয়ে যায় পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পাঁচ বছরের মধ্যেইএই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায় অর্থনৈতিক ওরাজনৈতিক দাবিসমূহ। অবশেষে
১৯৭১ সালে বাঙালিরা মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত করে।আধুনিক বাঙালি মুসলমানের বাংলা সাহিত্য চর্চায় অংশগ্রহণ সাধারণভাবেইকম—উপন্যাস রচনার ক্ষেত্রে আরো কম। ফলে প্রথম যুগের বাংলা উপন্যাসে বাঙালি
মুসলমান সমাজের প্রতিফলন নেই বললেই চলে। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে মীর
মোশাররফ হোসেন একমাত্র গদ্য লেখক যিনি উপন্যাস রচনা করেছেন। তার পরে।
বর্তমান শতাব্দীর প্রথম দিকে মোজাম্মেল হক, কাজী ইমদাদুল, নজিবর রহমান প্রমুখ
লেখকের আবির্ভাব হয়। এঁদের প্রয়াসে নীতি শিক্ষামূলক কাহিনি সৃষ্টি হয়েছে কিংবা
কখনো কখনো কাহিনিতে সমাজ সংস্কারের পক্ষে আদর্শ প্রচার করা হয়েছে। সামাজিক
বাস্তবতা কিংবা চরিত্রের অন্তর্লোকের প্রবেশের দিকে তত মনোযোগী এঁরা হতে পারেন
নি। অধিকতর সফল উপন্যাস আমরা পাই কাজী আব্দুল ওদুদ, হুমায়ুন কবীর, আবুল
ফজল প্রমুখের রচনায়। সাহিত্যক্ষেত্রে এঁদের উত্তরসূরি শওকত ওসমান, আবু রুশদ
এবং সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্। এঁরা আধুনিক চিন্তা ও মননের মানুষ সেই কারণে এঁদেরই
রচনায় আধুনিকতার বৈশিষ্ট্যসমূহ যথার্থভাবে উপস্থাপিত হতে দেখা যায়। সমাজকে,ব্যক্তিকে এবং সেই সঙ্গে সামগ্রিক জীবনকে বিশ্লেষণ করে এঁরা উপন্যাসের শিল্পরূপের
মধ্যে তা ধারণ করেছেন। বলা যায়, এই প্রজন্মের মুসলমান লেখকরাই পরিণতমনস্ক
উপন্যাসশিল্পী হয়ে ওঠতে পেরেছেন।
0 মন্তব্যসমূহ