Hot Posts

6/recent/ticker-posts

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের "রক্ত করবী" নাটকের বিষয়বস্তু ও নামকরণের সার্থকতা

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের "রক্ত করবী" নাটকের   নামকরনের সার্থকতা :

লিখেছেন :-

সুমাইয়া জামান জুঁই 

বাংলা বিভাগ 

বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়,রংপুর। 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১ - ১৯৪১) বাংলা সাহিত্যের এক অনবদ্য নাম যিনি সাহিত্যের মোটা- মুটি সকল শাখাতেই রেখেছেন ইক্সসযোগ্য অ দান। বাংলা নাটকের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম নয়। বাংলা নাটকের ধারায় তাঁর অনবদ্য সংযোজনে হলো 'রক্তকরবী'। 

'রক্তকরবী নাটকের পটভূমিতে রয়েছে সমসাময়িক সময়ের বস্তুবাদী ধনতন্ত্রবাদ ও ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার মুঝিলে আবদ্ধ  ও উৎকট সংগ্রাহী সমাজব্যবস্থা। মূলত সমকালে পাশ্চাত্যৈ বানিজ্য পুঁজি ও শিল্প পুঁজির প্রসারে মানুষে ঐশ্বর্যনিশা ও বিজ্ঞশালীদের অর্থমাসুদা মানবিক জীবনকে কিভাবে পর্যুদস্ত করেছিল এবং এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ কীরূপ আকার ধারন করতে পারে তাই রূপাৱন ঘটেছে এ নাটকে। রুপায়ন করতে গিয়ে নাট্যকার মে নামকরনের আশ্রয় নিয়েছেন তা মূলত হয়ে উঠেছে ব্যাতিক্রম যা প্রতীক হয়ে উঠে কখনো হয়ে উঠেছে প্রেমযৌবনের পরিচয়কে কখনো বা হয়ে উঠেছে বিযোজন পরিচায়ক, যা প্রচলিত ব্যবস্থাকে ভেঙে  নতুনত্বের আস্বাদ দিতে সক্ষম হয়েছে, প্রানের সন্ধান ঘটিয়ে নাটকটিকে পাঠকের সামনে অর্থ- পূর্ণ করে তুলেছে। আর এরই ফল জাতিতে নাট্য- কার পেয়েছেন নামকরণের সার্থকতা ।

"রক্ত করবী :- নাটকের নামকরনের সার্থকতা: 

'রক্তকরবী - নাট্যকারের একটি ধারাকে সাংকেতিক আবার এক প্রকার তত্ত্ব নাটক হিসেবে বলা যেতে পারে।' নামকরণের মাধ্যমে গূঢ় অর্থকে, নাট্যকারের নিজস্ব চিন্তা চেতনাগুলো কে তুলে ধরেছেন।  প্রচলিত সমাজব্যবস্থা সম্পর্কে নিজের ক্ষোভ ও তা থেকে উত্তোরনের আশা আকাঙ্খা কে পাঠকের সামনে উপস্থাপন করেছেন। আর এ উপস্থাপনার একটি অন্যতম অংশ হল নাটকের মানুষীর স্বর্ণ উত্তোলনের ঘটনা।

স্বর্ণ উত্তোলনের এই যে স্থান সজনী যেখানে পুঁজিবাদী সমাজের আবার যা আধার, ও যেখানে মনুষ্যত্বের পূর্ণ বিকাশ অসম্ভব সেখানেই এই পুঁজিবাদ বিরোধী চরিত্রে হিসেবে নাট্যকার এনোমনে নন্দিনীকে এই মানবীয় চরিত্র নন্দিনী স্বভাবগুনেই চার এই ব্যবস্থা তথা সমাজ ব্যবস্থাকে ভাঙতে। অস্ত্রের জোরে নয় মানের জোরে। অর্থাৎ নন্দিনী হলো যক্ষপুরীর ক্ষেত্রে এক ধরনের আলো মা যক্ষপুরীর সাথে একেবারেই সামন্তস্য নয় । অধ্যাপকের উক্তিতে নন্দিনী সম্পর্কে

"সকালে ফুলের বনে যে আলো আসে তাতে বিস্ময় নেই, কিন্তু পাকা দেয়ালের ফাটল দিয়ে সে আগে আসে সে আর এক কথা। যক্ষপুরে তুমি সেই আচমকা আলো ।'

নন্দিনী যেন সত্যিকারার্থেই আলো নিয়ে আসছে জালে আবদ্ধ। লুব্ধ যক্ষপুরীতে নন্দিনীকে উপস্থাপন করান নাট্যকার। অর্থাৎ যক্ষ্মপু যক্ষপুরীর অদ কারে একরাশ আলোর মতো হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়েছে নন্দিনী । আর এ নন্দিনীর গহনাই ছিল রক্তআভাময় রক্তকরবী । নন্দিনীর মতো এরূপ আলো বয়ে নিয়ে আসা নারীর গহনাশিখন নাট্যকার :রক্তকরবীকেই বেছে নিবেন সেখানেই যেন প্রশ্ন উঠে যায় । মূলত রক্তকরবীর লালএকদিকে হয়ে উঠেছে বিদ্রোহের প্রতীক আরেকদিকে যৌবনের প্রতীক । তার লাল রঙের আভায় তাই সকলেরই বিস্ময় । রাজা বিস্মিত অধ্যা- পক বিষ্মিত। নন্দিনী ও অধ্যাপকের সংলাপে- অধ্যাপক: কতবার ভেবেছি, তুমি যে রক্তকরবীর আভরন পর, তার একটা কিছু মানে আছে । নন্দিনী : আমি তো জানি নে কী মানে ।

অধ্যাপক : হয়তো তোমার ভাগ্য পুরুষ জানে । ঐ রক্ত আভায় এক ভয়-লাগানো রহস্য আছে। শুধু মাধুম নয় ...... সুন্দরের হাতে রক্তের তুলি দিয়েছেন বিধাতা। জানিনে রাঙা রঙে তুমি কী লিখতে এসেছ । মালতী ছিল। মল্লিকা ছিল। ছিল চামেলী সব বাদ দিয়ে এ ফুল কেন বেছে নিয়ে ।

নাট্যকার রক্তকরবীর এই যে অন্তর্নিহিত একটি ব্যঞ্জনাধর্মী অথচ বিষয়কে সম্পূর্ণ ধারণা করে না এরূপ বৈশিষ্ট্যকে ইঞ্জিতে ইঙ্গিত করেছেন। যেখানে রক্তকরবীর লাল আভা যক্ষপুরীর পুঁজিবাদী করা মানসিকতার ব্যক্তিদেরবিষায়ের সৃষ্টি করেছে । আর এ ফুল নন্দিনী রঞ্জন নামের প্রতিবাদী চরিত্রের জন্যই রাখে যে ছিল নন্দিনীর প্রানের শক্তি - শ্রমিক মুক্তির মন্ত্রে দীক্ষিত চরিত্র, যে শ্রমিক বিদ্রোহ করতে মৃত্যুকেও তুচ্ছ জ্ঞান মনে করে । এরকম একটি চরিত্রকে নাট্যকার নন্দিনীর ভালবাসার মানুষ রূপে দেখিয়েছেন যার পছন্দ ছিল রক্তকরবী । এখানেই যেন রক্তকরবীর লাল আভা এক অর্থে বিদ্রোহ বিপ্লবের এক রূপ আবার যৌবনেরও প্রেমের প্রতীক হিসেবে পরিগণিত। নন্দিনীর উকতিতে-

রঞ্জন আমাকে কখনো কখনো আদর করে বলে রক্তকরবী । জানিনে কেমন মনে হয়। আমার রঞ্জনের ভালবাসার রঙ রাঙা, সেই রঙ নাম পরেছি, বুকে পরেছি, হাতে পড়ে পরেছি ।

রঞ্জনের ও নন্দিনীর এ ভালবাসার মধ্যে রক্তকরবী যেন অন্যতম একটি বিষয় হয়ে উঠেছে । যেখানে নন্দিনী তো এক শক্তিই যা প্রানের শক্তি মনুষ্যত্বের শক্তি অন্যদিকে রঞ্জনকে যেন নাট্যকার এমন ভাবে গড়ে তুলেছেন যে কিনাবিধাতার হাসি হয়ে ভয় পাইয়ে দিতে পারে সেইসব ব্যক্তিদের যারা আকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন, মাটির মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন সর্বোপরি এক প্রবল মানবিকতা থেকে বিচ্ছিন্ন। নন্দিনীর মুখের তাইতো শোনা যায়-

"ওরা জানেনা ওরা অদ্ভুত । ওদের মাঝখানে বিধাণ যদি খুব একটা হাসি হেসে ওঠেন, তা হলেই ওদের চটকা ভেঙে যেতে পারে। রঞ্জন বিধাতার সে হাসি ..... আমার রঞ্জনের জোর তোমাদের শঙ্খিনীনটি নদীর মতো ঐ নদীর মতোই সে যেমন হাসতে পারে তেমনি ভাঙতেও পারে । '

নাট্যকার এখানেই চমৎকৃত ও অদ্ভুত করে তুলে- ছেন নাটকটির নামকরনে। বিদ্রোহ-আনের মনুষ্যত্বের যে সঞ্চারক রঞ্জন তারই পছন্দের ফুল এই রক্তকরবী, আবার তারই প্রেমিকা নন্দিনীর গহনা এই রক্তকরবী । আর এ রক্তকরবীর আভা যেন রাজায় পায়না । অধিক রাজশক্তি থাকা শ সত্ত্বেও মর্তেও সেটি তার জন্য জোটেনা । মূলত জালে আবদ্ধ রাজা যেমন বাইরে থেকে জানে বন্দি তেমনিমনের দিক থেকেও যেন বন্দি। তাঁর চারপাশের পুঁজিবাদীতার যে জান তাঁকে আষ্টেপৃষ্ঠে রেখেছে তা থেকে মুক্ত হওয়ার এক সুক্ষ্ম দ্বন্দ্ব রাজার হৃদয়ে ক্রিয়াশীল । আর নন্দিনীর রূপ আর রক্তকরবীর আভা সে পায়না। বরং এই রক্তকরবীর আভাই তার জন্য এক বিষয় হয়ে উঠেছে যা তারই রক্ত-আলোর মানিগ্রহতাকে নির্দেশ করে। রাজার ভাষ্যে-

'ঐ ফুলের গুচ্ছ দেখি আর মনে হয়, ঐ যেন আমারি রক্ত-আমোর শনিগ্রহ ফুলের রূপ ধরে এসেছে। কখনো ইচ্ছে করছে, তোমার কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে ছিঁড়ে ফেলি, আবার ভাবছি নন্দিনী যদি কোনোদিন নিজের হাতে ঐ মঞ্জরী আমার মাথায় পরিয়ে দেয় -

জালে আবদ্ধ রাজাও নন্দিনীর ভালবাসা পেতে চায় কিন্তু এক নিয়মের মধ্যে আবদ্ধ থেকে সেও দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভুগতে থাকে । আর রক্তকরবীর যে বাহক নন্দিনী সেও যেন রাজার এল দ্বিধা-দ্বন্দ্ব কাটাতেই সর্বদা তৎপর হওয়ার ভূমিকা পালন করে। রক্তকরবীর আভার রঙ্গে উজ্জ্বলনন্দিনী চাইছে জোর মতো শক্তিশালী ব্যক্তি কেও শুনিয়ে দিয়েছে কঠিন কথা। জালে আবদ্ধ থাকার বিষয়েও জানিয়েছে বলিষ্ঠ ভাষায়

ভয় দেখাবার ব্যবসা এখানকার মানুষে। তোমাকে তাই তারা জাল দিয়ে ঘিরে অদ্ভুত মাজিয়ে রেখেছে । এই জুজুর পুতুল সেজে থাকতে লজ্জা করে না ?

রাজা বন্দি। তার নিজের গড়া ওই ব্যবস্থার ভেতরে । সে নিঃসঙ্গ। তপ্ত, রিক্ত ক্লান্ত । থাকে লোহার তৈরি জালের ভিতরে । যে সর্দার ও মোড়লেরা তাঁর পাশে রয়েছে তারা পক্ষে কাজ করে আবার তাকে পাহারাও দেয় যাতে সে বেরিয়ে যেতে না পারে। অর্থাৎ শুনো রাজশক্তি ও এর কর্মচারীদের মধ্যেই রক্তকরবী বাহক নন্দিনী একেবারেই বেখাপ্পা। নন্দিনী চায় এ নিষ্ঠুর ব্যবস্থাকে ভেঙো দিয়ে, যান্ত্রিকন করল থেকে মানুষকে মুক্তি দিয়ে ভ্রূনের জয় ঘটাতে। অধ্যাপকের উক্তিতে- -

'পৃথিবীর প্রাণভরা খুশিখানা নিজের সর্বাঙ্গে টেনে নিয়েছে। ঐ আমাদের নন্দিনী। এই যক্ষপুরে সদার আছে, মোড়লআছে। খোদাইকার আছে আমার মতো পন্ডিত আছে। কোতোয়াল আছে, জল্লাদ আছে, মুর্দা পরাম আছে, সব মিশ খেয়ে গেছে। কিন্তু ও একেবারে বেখাপ। চার দিকে হাটের চেঁচামেচি ও হল সুরবাঁধা তম্বুরা ।”

প্রাণের সঞ্চারক নন্দিনী সত্যিকারণেই বেমানান সেই পুঁজিবাদী যান্ত্রিক ব্যবস্থায় । এ যান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাজার অঙ্কো যুক্ত হয়েছে মোড়ল সর্দার অধ্যাপক সহ আরো অনেকে । আর তাদেরই বিরোধী রূপ হিসেবে উক্ত নাটকে রঞ্জনের ভালবাসার রক্তকরবীর আড়ালে নন্দিনীই প্রকাশিত হয়েছে বারবার তার নিজস্ব শক্তি দিয়ে, যা ভেঙো চূড়রা চূরমার করার মতো সাহস হৃদয়ে ধারণ করে । তাইতো তাকে বলতে দেখা যায়

আমি নারী বলে আমাকে ভয় করেনা ? বিদ্যুৎ শিখার হাত দিয়ে ইন্দ্র তাঁর বজ্র পাঠিয়ে দেন আমি সেই বজ্র বয়ে এনেছি। ভাঙবে তোমার শনির সোনার চূড়া।

এই বজ্র বয়ে নিয়ে আসা নন্দিনীরই আরেক প্রতীক হিসেবে নাট্যকার রক্তকরবীকেই একেছেন। যেখানে রক্তকরবী একবার হয়ে উঠেছে নন্দিনীর

নন্দিনীর বিপ্লবের পরিচায়ক। ভালবাসার অনুষঙ্গ কখনোবা এই ফুল দিয়েই সে তার রক্তন কে খবর পাঠায় ৷ কিশোরের সাথে নন্দিনীর সংলাপে -

কিশোর : নন্দিনী বিদায় নিঝুম । রঞ্জনের সঙ্গে দেখা হলে তোমার কোন কথা তাকে জানাব ।

নন্দিনী ঃ কিছু না । তাকে এই রক্তকরবীর গুচ্ছ দিলেই আমার সব কথা জানানো হবে।

বিদ্রোহের শক্তি রঞ্জনের সাথে আনের সঞ্চারক নন্দিনীর যোগাযোগের মাধ্যমরূপে নাট্যকার রক্তকরবীকেই এনেছেন । রক্তকরবীর লাল আভা, 1 লাল রঙটাই যেন সবকিছুকে রাঙিয়ে তোলার আভা, যে আভা রাজশক্তির অন্তর্ভুক্ত মানুষগুলো কে বিস্মিত করে ভয় পাইয়ে দেয় অর্থাৎ নন্দিনীর বাহন হিসেবে নন্দিনী চরিত্রের গূঢ় অর্থকে প্রকাশ করে । পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থার জন্য সেটি ভয়াবহতার সৃষ্টি করলেও নন্দিনীর কাছে তা মিলনের রঙ। যার ফলেই রঞ্জনের প্রতীক্ষায় নন্দিনীকে বারবার রক্ত করবীর গহনা পরে থাকতে দেখা যায় । এই মিলনের

রঙে তাই প্রকৃতিও যেন রাঙা হয়ে ওঠে । নন্দিনীর উক্তিতে

দেখতে দেখতে সিঁদুরে মেঘে আজকের গোধূলি রাঙা হয়ে উঠল। ঐ কি আমাদের মিলনের রঙ । আমার সিঁথের সিঁদুর যেন সমস্ত আকাশে ছড়িয়ে গেছে।

প্কৃতিকে রাঙা করে দেয়া এবং যেমন রক্তকরবীর সাথে সামঞ্জস্য, তেমনি রক্তকরবীর এ সং শই নন্দিনীর ভিতরকার আভা মা চারি ঐ দিকের পীড়নের ভিতর দিয়ে আত্মপ্রকাশ করে । মূলত নন্দিনী এবং রক্তকরবী একই, তারা স্বাভাবিক ও আনবন্ত । প্রানবন্ত তো বটেই যে যক্ষপুরীর লোকেরা উৎপাটিত, পরস্পর বিচ্ছিন্ন যান্ত্রিক আত্মপরিচয় বিলুপ্ত, যেখানে স্বর্ণখোদাইকারকেরা নিজের নামে পরিচিত নয়। পরিনত হয়ে সংখ্যায় অর্থাৎ যেখানে মানুষ যন্ত্রে পরিনত হয়েছে নন্দিনী সেখানেই প্রানের সঞ্চারক । নন্দিনী ও রক্তকরবীর আভা- লাল রং দুটোই যেন সেই ব্যবস্থাকে পরিবর্তন করে। জাল ছিঁড়ে আনের, মনুষ্যত্বের মুক্তি ঘটাতে সর্বদা তৎপর ছিল। প্রতীক রূপে ছিল রক্তকরবী আর তারই বাহকছিল নন্দিনী । তাইতো নন্দিনীর মাধ্যমে উচ্চারিত হয় তীব্র মর্মভেদী উক্তি -

:"তোমাদের ঐ ঋজদণ্ডের দেবতা, সে কোনো দিনই নরম হবে না। কিছু জানের আড়ালের মানুষ চিরদিনই কি জানে বাঁধা থাকবে । যাও, যাও । মানুষের প্রাণ ছিঁড়ে নিয়ে তাকে নাম দিয়ে ভোলাবার ব্যবসা তোমার ।"

নন্দিনীর মধ্য দিয়েই নাট্যকার সেই যান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার অকৃত পরিচয়কে উন্মোচন করলেন। কিন্তু নন্দিনী ছিল মূলত এ ব্যবস্থাকে ভেঙো দিতে রক্তকরবীর লাল আভায় সবকিছু রঙিন করে দিয়ে সমাজ ব্যবস্থাকে পরিবর্তন করার এক অভিনব চরিত্র । আর তার এ কাজের সাথে যেমন যুক্ত ছিল রঞ্জন তেমনি রণ্ডতেনের বিদ্রোহের পরেই রঞ্জন সেই রক্তকরবীর মঞ্জুরী হাতে নিয়ে মৃত্যুবরন করে । নন্দিনীর উক্তিতে - .

বীর আমার নীলকণ্ঠ পাখির পালক এই পরিয়ে দিলুম তোমার চূড়ায় । তোমার জয়মাত্রা আজ হতে শুরু। সেই মাত্রার বাহন আমি- আহা এই যে ওর হাতে সেই আমার রক্তকরবীর মজুরী ।"নাট্যকার এখানেই আনলেন স্বাতন্ত্র্যতা। নন্দিনীর প্রানের শক্তি। বিদ্রোহী সত্তা রঞ্জনের মৃত্যুতেও যে বিদ্রোহ আর থেমে গেলনা, বিদ্রোহের প্রতিবাদের বাহন হলো নন্দিনী, জয়যাত্রা যেন নতুন করে শুরু হলো আবার এ জয়যাত্রার মাঝেই অবস্থান করল রক্তকরবীর মঞ্জুরী। রক্তকরবীর লাল আভা, বিদ্রোহ, প্রেমের প্রতীক তা নিঃশেষিত হয়ে গেলোনা বরং নন্দিন নীর মধ্য দিয়েই আরাবো সামনে এগিয়ে গেল । সত্যিই এগিয়ে গেলো বলেই রাজশক্তির সেই মকর কাজ ও যেন তাঁর সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে চলে গেলেন, ভেঙে দিলেন জালের আব্দ আবদ্ধ রূপ, হুকুম দিলেন সর্দারকে ধরে আনতে বলিষ্ঠ কন্ঠে বললেন— নন্দিনী কোথায় যাব ?

রাজা : আমার বিরুদ্ধে লড়াই করতে। কিন্তু আমারই হাতে হাত রেখে । বুঝতে পারছনা ? সেই লড়াই শুরু হয়ে গেছে । এই আমার ইজা। আমি ভেঙে ফেলি ওর দন্ত, তুমি ছিঁড়ে ফেলো ওর বেতন । আমারই হাতের মধ্যে তোমার হাত এসে আমাকে মানুক, মারুক, মারুক। সম্পূর্ণ মাবুক তাতেই আমার মুক্তিশুধু রাজাই নন খোদাইকর ফাগুলাল, অধ্যাপক বিষ্ণু ও তার কারিগরেরা সকলে মিলে বন্দিশালা ভাঙতে বের হয়। সর্দাররা সৈনিক নিয়ে রাজাকে ধরার জন্য আসলেও রাজ্য ততক্ষনে নন্দিনীর মাত্রার একজন হয়ে পড়ে। জয় হয়ে যায় নন্দিনীর। অর্থাৎ প্রানের । আর এই নন্দিনীর সৌন্দর্যের, প্রেমের বিদ্রোহের প্রতীক রূপে উঠে এসেছে রক্তকরবী ।

রক্তকরবী যার গহনা ছিল সেই নন্দিনী যেন পৃথিবীর সকল জ্ঞানময় মানুষের প্রতিনিধি- যে সব মানুষ জীবনকে চাহিদা দিয়ে নয়- পার আনন্দ দিয়ে অনুভব করতে শিখেছে। রক্তকরবী বিশুদ্ধতা লাভর প্রতীক। মধু আর বিষের আধার যেন এই ফুল । রাজবাড়ির লোহার জান থেকে মুক্তির জন্য নন্দিনী নামক আনন্দের শক্তি আর যন্ত্রনা থেকে মুক্তিলাভের জন্য রক্তকরবীর বীজের বিষরস পানের প্রয়োজনীয়তার গল্পও বোধ কবি রবীন্দ্রনাথ পাঠককে শোনাতে চেয়েছেন। লোহার জাল ছিন্ন করে করবী গাছ তার রক্তাক্ত বিদীর্ণ বুক নিয়ে বেড়ে উঠেছে। তার মানে আনের কা জড়ের পরাজয় নিশ্চিত। যন্ত্রমানব যতই শক্তি বিস্তার করুক না কেন প্রাকৃতিক উৎপাদন শক্তি ও মাহাত্ম্যের কাছে তাকে একদিন না একদিন।

পরাজয় মানতেই হবে- এ সত্যই বোধকরি করি দার্শনিক-নাট্যনির্মাতা রবীন্দ্রনাথ পাঠকদের। সত্যকে ভুলে থাকা মানুষদের নাটকের কথামালার আড়ালে ব্যঞ্জনাধর্মী এ নামকরনের মাধ্যমেই মনে করিয়ে দিতে চেয়েছেন । সেক্ষেত্রে বলাই যেতে পারে, 'রক্তকরবী নাটকটি নামকরনের দিক থেকে অনেকাংশেই সার্থকতা লাভ করেছে ।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ