মানুষের ভাব প্রকাশের মাধ্যমকে বলা হয় ভাষা।ভাষার মাধ্যমে মানুষ একজন থেকে অন্যজন এর সাথে যোগাযোগ সম্পন্ন করে থাকে।সময়ের সাথে সাথে ভাষার পরিবর্তন, পরিমার্জন হয়েছে। তবে সঠিক,সাবলিল,স্পষ্ট এবং প্রায়োগিক ভাষা শিখনের জন্য কিছু সূত্র অনুসরণ করা হয়।এইসব সূত্র কে ভাষা শিখন সূত্র বলা হয়।নিচে বিভিন্ন ভাষা শিখন সূত্র উপস্থাপন করা হলো :--
ভাষা সুত্র কি?? ভাষা সুত্রের ব্যাবহার...
ভাষা শিক্ষাদান
ভাষা শিক্ষাদান সূত্রাবলী
ভাষা শিক্ষাদানের আধুনিক প্ৰক্ৰিয়া
ভাষা শিক্ষাদান পদ্ধতি
ভাষা শিখন সূত্রাবলী:--
(১)লেখার পূর্বে কথা
সকলেই স্বীকার করেন যে ভাষা শিক্ষার ক্ষেত্রে লেখার আগে কথা শেখাতে হবে। আগে কথা শেখানোর পেছনে দুটি যুক্তি কাজ করে— ঐতিহাসিক যুক্তি এবং ব্যক্তি পর্যায়ের যুক্তি। পৃথিবীতে ভাষার বিকাশের ইতিহাসে দেখা যায়, মানুষ আগে কথা বলতে শিখেছে, লেখা তথা লিপি শিখেছে অনেক পরে। এ ছাড়া মানুষ যখন প্রথম ভাষা অর্জন করে তখন সে আগে বলার দক্ষতা অর্জন করে, পরে শেখে লেখা। কাজেই দ্বিতীয় ভাষা শিক্ষার ক্ষেত্রেও আগে কথা, পরে লেখা শেখাতে হয়।
২. মৌল বাক্য
মৌল বাক্যগুলো সাধারণত গঠনে এবং অর্থে ছোট হয়ে থাকে। ভাষা শেখাতে গেলে শিক্ষার্থীকে বড় বাক্য নয়, ছোট মৌল বাক্যগুলো প্রথমে শেখাতে হবে। এতে শিক্ষার্থীরা বাক্য সংগঠন যেমন শিখবে তেমনি বাক্য সম্প্রসারণের কৌশলও শিখে ফেলবে।
৩. ছক অভ্যাস
ভাষা মাত্রই সীমাহীন ; ভাষাতে রয়েছে অজস্র বাক্য, অসংখ্য বৈচিত্র্য। কোনো ভাষায় সব কিছু বর্ণনার মাধ্যমে কাউকে ভাষা শেখানো সম্ভব নয়। ভাষা শেখাতে শিক্ষার্থীকে ভাষার কিছু ছক শেখাতে হয় এবং তা অভ্যাস করাতে হয়—এটাই ছক অভ্যাস নামেপরিচিত। বর্ণনামূলক প্রশ্নবোধক, আদেশমূলক, অনুরোধমূলক ইত্যাদি বাক্যের ছক শেখানো হবে। যে কোনো ভাষায় ৩০/৪০ রকমের ছক থাকে, এসব ছক শেখার অভ্যাস করলেই শিক্ষার্থী ভাষাটি শিখতে পারবে। এসব ছক মৌল বাক্য দিয়ে গঠিত এবং প্রতিটি ভাষায় কতগুলো মৌলবাক্য ছক থাকে। যেমন :
1. SAAD = Simple Active, Affirmative, Declarative
2. SAAQ Simple, Active, Affirmative, Question. এখানে SAAD এবং SAAg ছক। ভাষার এসব ছক শিখিয়ে দিলেই শিক্ষার্থী এসব ছকে ফেলে অনেক নতুন বাক্য বলতে পারবে। তবে মনে রাখতে হবে, ভাষাহচ্ছে pattern বা ছকের সমষ্টি। Pattern-এ গোলমাল হলে ত্রুটিযুক্ত সংজ্ঞাপন হবারসম্ভাবনা থাকে।
৪. ধ্বনি পদ্ধতির ব্যবহার
পৃথিবীর সব ভাষায় ধ্বনি বৈশিষ্ট্য এবং পদ্ধতি স্বতন্ত্র। ভাষা শিক্ষায় ধ্বনি অভ্যাস খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ভাষা-শিক্ষায় ভাষার ধ্বনি সম্পর্কে কেবল তাত্ত্বিক জ্ঞান দান করলেই হবে না, ধ্বনি পদ্ধতি ব্যবহারের মাধ্যমে ধ্বনিগুলো আয়ত্তে আনতে হবে। এটাই ধ্বনি পদ্ধতির ব্যবহার। ধ্বনি পদ্ধতির ব্যবহার করতে হবে অনুকরণের মাধ্যমে এবং মনে রাখার মাধ্যমে।
৫. শব্দাবলি নিয়ন্ত্রণ
যে-কোনো ভাষায় অসংখ্য শব্দ থাকে, সব শব্দ শেখানো সম্ভব নয়। ব্যবহার উপযোগিতা নির্ধারণ করে পৌনঃপুনিকতার ভিত্তিতে ক্রম অনুযায়ী শব্দ শেখানো হয়। ভাষা শেখাতে কতগুলো বাক্য শেখানো হয়। কিন্তু বাক্যের শব্দ অনিয়ন্ত্রিতভাবে রাখলে ভাষা শেখানো যাবে না, বাক্যে শব্দ নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। এটাকেই বলা হয় শব্দাবলি নিয়ন্ত্রণ। তবে শব্দ শেখানোর ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীর প্রয়োজনের উপর নির্ভর করে শব্দ নির্বাচন করতে হবে।
৬. সমস্যাবলি শিক্ষাদান
প্রতিটি ভাষায় ধ্বনি, শব্দ, বাক্য এবং অর্থ পর্যায়ে কিছু অবয়বগত সমস্যা থাকে। এসব সমস্যা চিহ্নিত করে, সমস্যা আকারে, সূত্র হিসেবে শিক্ষার্থীকে শেখাতে হবে, নিয়মে কিংবা ব্যতিক্রম হিসেবে এসব শেখানো যাবে না। এটাই সমস্যাবলি সাধারণ শিক্ষাদান। যেমন ঃ ইংরেজি সাধারণ নিয়ম 'ed' যোগে verb-এর past tense হয়।
কিন্তু 'go'-এর past tense' went হচ্ছে। বাংলায় খেয়েছিলাম হচ্ছে, কিন্তু যেয়েছিলাম না হয়ে গিয়েছিলাম হচ্ছে। শিক্ষার্থীকে এসব সমস্যা শেখানো এবং নিয়ন্ত্রণের একমাত্র উপায় অনুশীলন।
৭. বাক প্রতিনিধি হিসেবে লিপি
এটা ভাষার অন্যতম সমস্যার মধ্যে পড়ে। কারণ ভাষার কথন পদ্ধতির জগৎ যত ব্যাপক লিখন পদ্ধতির জগৎ তত ব্যাপক নয়। অর্থাৎ লিপিতে তত ব্যাপ্তি আনা সম্ভব নয়। তাই লিপির ভাষা মৌখিক ভাষার চেয়ে অনেক সীমিত। ভাষা শিক্ষার ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীকে ধ্বনি ও লিপির পার্থক্য জানাতে হবে, এদের মধ্যে যে অসঙ্গতি আছে তা জানাতে হবে এবং এই অসঙ্গতিটাকে ভাসঙ্গতি হিসেবেই শেখাতে হবে, সংশোধন করা চলবে না। আসলে বাক-প্রতিনিধি হিসেবে লিপি সর্বদা পূর্ণাঙ্গরূপে গ্রহণযোগ্য নয়। তবুও ভাষাকে সংরক্ষণের জন্য, ধরে রাখার জন্য একটি কৌশল হিসেবে শিক্ষার্থীকে বাক প্রতিনিধি হিসেবে লিপি শিখতে হবে।
৮. ব্রুমান্বিত ছক ( Graded Pattern )
ক্রম অর্থ পর্যায়। ক্রম অনেক রকমের হতে পারে, এর সীমা পরিসীমা নেই। এখানে রুম ব্যবহৃত হচ্ছে ভাষার স্তর এবং শিক্ষাদানের পদ্ধতির মধ্যে যে সমন্বয় থাকে সে অর্থে। জগতের সব কিছুই সম্পর্কিত, ভাষায়ও তাই। শব্দের জগতে একটা শব্দ বললে সম্পর্কিত অনেক শব্দ মনে পড়ে। তবে ভাষা শেখানোর ক্ষেত্রে শব্দের বেলায় মনে রাখতে হবে, শব্দগুলো যেন অর্থের দিক থেকে সম্পর্কিত হয়।
ভাষা শেখাতে গেলে প্রথমে বাক্য শেখানো হয়। এই বাক্য শেখাতে হয় ক্রম অনুসারে। প্রথমে মৌল বাক্য, তারপর সম্প্রসারিত বাক্য। প্রথমে শিক্ষক বাক্য উৎপাদন করবে, তারপর শিক্ষার্থী সেটা পুনরুৎপাদন-এর মাধ্যমে আয়ত্ত করবে। বাক্য শেখা হয়ে গেলে বাক্য সম্প্রসারণ শেখাতে হবে। বাক্য সম্প্রসারণের বহু দিক আছে। কিন্তু সবচেয়ে সহজ দিকটি নির্ধারণ করে শিক্ষককে সে অনুযায়ী শিক্ষার্থীর জন্য কোর্স তৈরি করতে হবে। বাক্য সম্প্রসারণের দ্বারা শিক্ষার্থীকে বাক্য, উপবাক্য গঠন ও তার সঙ্গে মূল বাক্যের সম্পর্ক ইত্যাদি শেখানো হবে।
৯. ভাষা- অভ্যাস বনাম তরজমা
আগে মনে করা হতো এক ভাষা থেকে অন্য ভাষায় অনুবাদ বা তরজমা করতে পারলেই ভাষা শেখা হয়ে গেল। শিক্ষার্থীকে জানাতে হবে তখনকার ভাষাভ্যাস বনাম তরজমার যে তাত্ত্বিক ব্যাপারটি ছিল, তার পুরোটাই ভুল এবং ভাষা শিক্ষার ক্ষেত্রে এই পদ্ধতি অসঙ্গত। পৃথিবীর কোথাও এ পদ্ধতি এখন স্বীকৃত নয়। ভাষাভ্যাস বনাম তরজমা হচ্ছে তরজমা দিয়ে ভাষা শেখানো। আসলে তরজমা বা অনুবাদ এবং ভাষা শেখা দুটি আলাদা ব্যাপার। একটি ভাষার বিষয় বা Content, আরেকটি ভাষায় স্থানান্তর। স্থানান্তর করার নাম তরজমা। ভাল তরজমা হলো স্থানান্তর করার দক্ষতা। আর ভাষা শেখা মানে বলা, বোঝা, পড়া, লেখা—এই চারটি Skill বা দক্ষতা অর্জন করা।
১০. কর্তৃত্বশীল প্রমিত ভাষারূপ
যে-কোনো ভাষাই বৈচিত্র্যপূর্ণ এবং বহুরূপী। ভাষার এই বহু রূপের মধ্যে যেটি বেশি কর্তৃত্বশীল প্রমিত, সেটাই শিক্ষার্থীকে শেখাতে হবে এবং এটাই কর্তৃত্বশীল প্রমিত ভাষারূপ। যেমন : বাংলার বহু রূপের মধ্যে একসময় সাধুরীতি ছিল কর্তৃত্বশীল প্রমিত ভাষা। বর্তমানে সে স্থান দখল করেছে শিষ্ট চলিতরীতি। ভাষার বহু রূপের মধ্যে কর্তৃত্বশীল প্রমিত রীতিই আলোচিত এবং সর্বত্র গ্রহণযোগ্য। ভাষা শিক্ষার ক্ষেত্রে কর্তৃত্বশীল প্রমিত ভাষারূপ শিক্ষা দেওয়া হয়।
১১. অভ্যাস
ভাষা শেখানোটা আসলে অভ্যাস শেখানো। ভাষাবিজ্ঞানী Fries-এর গবেষণায় দেখা গেছে, কোনো ভাষা শেখাতে গেলে শিক্ষার্থীকে ৮৫% অভ্যাস করানো দরকার ১৫% শিক্ষকের বক্তৃতা বা ব্যাখ্যার জন্য দরকার। তা হলেই ভাষা শেখানো সফল হবে এবং ভাষা রপ্ত করা সম্ভব হবে।
১২. সাড়া-রূপায়ণ ( Shaping of responses )
সাড়া-রূপায়ণ হচ্ছে শিক্ষার্থীকে বাতলে দেওয়া, ধরিয়ে দেওয়া। সাড়া-রূপায়ণ ভাগ করার একটা ব্যাপার আছে। একটা শব্দ বা সাড়া বড় হলে সেটা ভাগ করে অল্প অল্প করে শিক্ষার্থীকে শিখিয়ে তা অভ্যাস করাতে হবে। সাড়া-রূপায়ণ হচ্ছে সঠিক পথে আহ্বান।
(১৩)দ্রুতি হচ্ছে কথনকাল।
প্রথম ভাষার চেয়ে দ্বিতীয় ভাষায় দ্রুতি কম থাকে। এই কমতির স্বাভাবিকতা আছে। স্বাভাবিকতা বিঘ্নিত হলে বাক্যের মাঝে বিরাট বিরতি সৃষ্টি হবে, যা ভাষার অর্থের ক্ষেত্রে বিঘ্ন সৃষ্টি করবে। কাজেই শিক্ষককে শিক্ষার্থীর দ্রুতির প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে। শেখার প্রথম দিকে দ্রুতি হ্রস্ব থাকলেও আস্তে আস্তে বাক্যের মাঝের বিরতিগুলো কমিয়ে আনতে হবে, নইলে তার কথা বোঝা যাবে না।
১৪. তাৎক্ষণিক ঘাটতি পূরণ ( Immediate Reinforcement )
ভাষা-শিক্ষার ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীকে যা শেখানো হয়, সে তার চেয়ে বেশি বলতে চায়। শিক্ষার্থী যখন সৃজনশীলতার অভ্যাস করে তখন সে তাৎক্ষণিকভাবে অনেক শব্দ খুঁজে পায় না। ভাষা-শিক্ষায় তাৎক্ষণিক যে ঘাটতি হয়, সেটা শিক্ষককে পূরণ করতে হয়। এটাই তাৎক্ষণিক ঘাটতি পূরণ।
১৫. উদ্দিষ্ট সংস্কৃতির প্রতি মনোভঙ্গি
ভাষা শেখা মানে একটা সংস্কৃতি শেখা। শিক্ষার্থী যে সংস্কৃতি শিখছে, তার প্রতি তার মনোভঙ্গি খুব গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষককে এই মনোভঙ্গিটা জানতে হবে। এই মনোভঙ্গির উপরই শিক্ষকের সফলতা নির্ভরশীল। মনোভঙ্গির ক্ষেত্রে আলবার্টো সিন্ড্রম বলে একটি কথা আছে। আলবার্টো-মার্কা শিক্ষার্থী কিছুতেই ভাষা শিখতে পারে না, কারণ তার ভাষা শেখার বিন্দুমাত্র উৎসাহ নেই, শুধু সময় কাটানোর জন্য সে ক্লাসে যায় ।
১৬. বিষয়
ভাষা শেখার ক্ষেত্রে বিষয় ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। ভাষা শিক্ষায় কোনো-না-কোনো বিষয় সম্পর্কে বলা হয়। সেই বিষয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শব্দমালা সব Content থাকে। যেমন : ‘একুশে ফেব্রুয়ারি' বিষয় হলে এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শব্দগুলো সর Content হবে এবং তা শিক্ষার্থীকে শেখাতে হবে। বিষয়হীন ভাষা শেখানো হলে অর্থহীন, তাৎপর্যহীন হবে। সহজভাবে বলা যায়, ভাষা-শিক্ষার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সংস্কৃতি শিক্ষার্থীকে জানতে হয়। কেননা সংস্কৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন করলে ভাষার কিছু বোঝা যাবে না, শিক্ষার্থী ভাষা শিখতে পারবে না। এই সংস্কৃতিটাই হচ্ছে ভাষার বিষয় ।
১৭. শেখা = ক্রান্তিক উৎপাদন ফল
শিক্ষার্থীকে উপরের সূত্রাবলির সাহয্যে ভাষা শেখানোর পর ভাষা শেখার চূড়ান্ত কী, যা শেখানো হয়েছে তা শিক্ষার্থী কতোটা কার্যকর করে তুলেছে—এসব শিক্ষক বিচার করে দেখতে হবে। এই ধরনের মূল্যায়নই ক্রান্তিক উৎপাদন ফল।
তথ্য সংগ্রহ :-
প্রায়োগিক ভাষাতত্ত্বের রূপরেখা
মনসুর মুসা...
0 মন্তব্যসমূহ