Hot Posts

6/recent/ticker-posts

লাহোর প্রস্তাবের পটভূমি, কারণ ও লাভ

লাহোর প্রস্তাব কী

লাহোর প্রস্তাব কে উত্থাপন করেন লাহোর প্রস্তাব লাহোর

Lahore - City in Pakistan লাহোর প্রস্তাব পেশ করেন কে

লাহোর প্রস্তাব কত সালে হয় লাহোর প্রস্তাবের বৈশিষ্ট্য লাহোর প্রস্তাব বলতে কি বুঝ

লাহোর প্রস্তাব কী ব্যাখ্যা কর লাহোর প্রস্তাব কে উত্থাপন করেন

#১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাব (Lahore Resolution:):-  

১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর সভাপতিত্বে লাহোরে অনুষ্ঠিত নিখিল ভারত মুসলিম লীগের ২৭তম কাউন্সিল অধিবেশনে ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব গৃহীত হয়। লাহোর প্রস্তাব উত্থাপন করেন বাংলার অদ্বিতীয় জনপ্রিয় নেতা ও মুখ্যমন্ত্রী শের-এ বাংলা এ. কে. ফজলুল হক।প্রস্তাব অনুযায়ী ভারতের উত্তরপশ্চিম ও পূর্বাঞ্চলে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলসমূহে কমপক্ষে দুটি রাষ্ট্র গঠনের প্রত্যাশা করা হয়েছিল। এজন্য বলা হয়, লাহোর প্রস্তাবের মধ্যে স্বাধীন বাংলাদেশের বীজ নিহিত ছিল।লাহোর প্রস্তাব পাকিস্তান প্রস্তাব নামেও পরিচিত। কারণ এটি পাকিস্তান দাবির মূলভিত্তি।

**লাহোর প্রস্তাবের পটভূমি

লাহোর প্রস্তাবের মূলভিত্তি মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর দ্বিজাতিতত্ত্ব।১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের আওতায় ১৯৩৭ সালে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে প্রাদেশিক ক্ষমতা নিয়ে হিন্দু প্রভাবিত কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগের মধ্যে তিক্ততার সৃষ্টি হয়। এরই পরিণতিতে মোহাম্মদ আলী বিল্লাহ ১৯৪০ সালের ২২ মার্চ তাঁর দ্বিজাতিতত্ত্ব ঘোষণা করেন।

১. মুসলিম পণ্ডিতদের চিন্তাভাবনা : 

স্যার সৈয়দ আহমদ ও আল্লামা ইকবালসহ বিভিন্ন মুসলিম চিন্তাবিদ ও পণ্ডিতদের লেখালেখি এবং চিন্তাভাবনা ভারতীয় মুসলমানদের মধ্যে মুসলিম জাতীয়তাবাদী মনোভাব তৈরি করে।১৯৩০ সালে আল্লামা ইকবাল এলাহাবাদে এক ভাষণে মুসলমানদের জন্য পৃথক রাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাব করেন। এজন্য আল্লামা ইকবালকে পাকিস্তান রাষ্ট্রের স্বপ্নদ্রষ্টা বলা হয়।

২. বঙ্গভঙ্গ ও বঙ্গভঙ্গ রদের প্রতিক্রিয়া: 

১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ অনুষ্ঠিত হয়।বঙ্গভঙ্গকে বিশেষ করে বাংলা অঞ্চলের মুসলমান সম্প্রদায় আশীর্বাদ হিসেবে গ্রহণ করেছিল। কিন্তু হিন্দু সম্প্রদায় এর তীব্র বিরোধিতা করে। এ নিয়ে তারা বিভিন্ন প্রতিবাদ এমনকি সরকারবিরোধী সশস্ত্র কার্যক্রমও পরিচালনা করে। বিলেতি দ্রব্য বর্জন এবং স্বদেশি আন্দোলনের ফলে অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলা এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটে। কংগ্রেস নেতৃবৃন্দও বঙ্গভঙ্গকে মেনে নেয়নি।

৩.ব্রিটিশ সরকারের ভূমিকা: 

ব্রিটিশদের শাসন কৌশলের একটি অন্যতম নীতি ছিল, 'ডিভাইড এন্ড রুল পলিসি'। এ নীতির ভিত্তিতে ব্রিটিশরা ক্ষমতা দখলের প্রথম দিকে হিন্দুদের বিশেষ সুযোগ সুবিধা প্রদান করে। কিন্তু এক পর্যায়ে, বিশেষ করে সিপাহিবিদ্রোহের পর তারা মুসলিম সম্প্রদায়কে তোষণনীতি অনুসরণ করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ১৯০৫ সালে বঙ্গতন, ১৯০৯ সালের মর্লি-মিন্টো সংস্কার আইনে আইনসভায় মুসলমানদের জন্য পৃথক প্রতিনিধি নির্বাচনের সুযোগ প্রদান করে। আইনটি পাসের সময় লর্ড মর্নি ব্রিটিশ আইনসভার উচ্চ কক্ষ লর্ড সভায় ঘোষণা করে, ভারতীয় মুসলমানরা শুধু একটি পৃথক ধর্ম অনুসরণ করে তা নয়, সামাজিক আচরণ ও জীবনযাত্রার দিক থেকে তারা একটি পৃথক জাতির সমতুল্য। সরকারের এরূপ কর্মকাণ্ড মুসলমানদের মনে স্বাতন্ত্র্যবোধের সৃষ্টি করে।

৪.খিলাফত আন্দোলন:

 এই সময় মহাত্মা গান্ধি ছিলেন কংগ্রেসের কর্ণধার। তিনি খিলাফত আন্দোলনের গুরুত্ব উপলব্ধি করে একই সাথে খিলাফত ও অসহযোগ আন্দোলনের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। ইতোমধ্যে তুরস্কে মোস্তফা কামাল পাশার নেতৃত্বে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন শুরু হয় এবং তিনি ১৯২৪ সালে সুদীর্ঘকালের মুসলিম ঐতিহ্যের প্রতীক 'খিলাফতের' অবসান ঘোষণা করলে খিলাফত আন্দোলনের অবসান ঘটে।

৫.১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন : 

১৯৩২ সালে ব্রিটেনে প্রথমবারের মতো শ্রমিকদলের নেতা রামজে ম্যাকডোনাল্ডের নেতৃত্বে সরকার গঠিত হয়। শ্রমিক দল ভারতের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারে বিশ্বাসী ছিল বিধায় তারা ১৯৩২ সালে 'সাম্প্রদায়িক রোয়েদাদ' ঘোষণা করেন। এর মাধ্যমে ভারতের মুসলমানদের জন্য পৃথক নির্বাচনাধিকারের এবং বিধান পরিষদগুলোতে সংখ্যালঘুদের জন্য আসন সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৩৫ সালে 'ভারত শাসন আইন' প্রণয়ন করা হয়।

৬. দ্বিজাতিতত্ত্ব : 

১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের আওতায় ১৯৩৭ সালে ভারতে প্রাদেশিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশে কংগ্রেস এবং মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশে মুসলিম লীগের মন্ত্রিসভা গঠিত হয়। কংগ্রেস যেসব প্রদেশে ক্ষমতায় ছিল, সেসব প্রদেশে বসবাসকারী মুসলমানদের ওপর তারা অবিচার ও নিপীড়ন চালাতে থাকে। এর ফলে উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে পুনরায় সাম্প্রদায়িকতা মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। এরূপ পরিস্থিতিতে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ তাঁর বহুল আলোচিত 'দ্বিজাতিতত্ত্ব' ঘোষণা করেন। এ তত্ত্বের দ্বারা তিনি জোর দিয়ে বলেন যে, এ উপমহাদেশে হিন্দু ও মুসলমান দুটি প্রধান ও স্বতন্ত্র জাতি। এদের জীবনদর্শন সম্পূর্ণ ভিন্ন। সুতরাং তাদের আবাসভূমিও হবে ভিন্ন। জিন্নাহর দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতেই মূলত লাহোর প্রস্তাব রচিত হয়।

#লাহোর প্রস্তাবের ধারা বা বৈশিষ্ট্য:

প্রস্তাবটি বিশ্লেষণ করলে এর নিম্নলিখিত বৈশিষ্ট্য বা ধারা লক্ষ করা যায়- 

১. ভৌগোলিক অবস্থান অনুযায়ী পাশাপাশি অবস্থিত এলাকাগুলোকে অঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত করতে হবে।

২. প্রয়োজনে এ অঞ্চলগুলোর সীমানা এমনভাবে পরিবর্তন করতে হবে যাতে করে ভারতের উত্তরপশ্চিম ও পূর্বাঞ্চলের যেসব স্থানে মুসলমানগণ সংখ্যাগরিষ্ঠ সেসব অঞ্চলে স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহ প্রতিষ্ঠা করা যায় ।

৩. এভাবে গঠিত রাষ্ট্রসমূহের অঙ্গরাজ্যগুলো হবে স্বায়ত্তশাসিত ও সার্বভৌম।

৪. এসব অঞ্চলের সংখ্যালঘুদের ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও অন্যান্য অধিকার এবং স্বার্থ রক্ষার জন্য শাসনতন্ত্রে কার্যকর পদক্ষেপ থাকতে হবে এবং ভারতের যেখানে মুসলমানগণ সংখ্যালঘু সেখানেও শাসনতন্ত্রের অনুরূপ বিধানের মাধ্যমে মুসলমানদের রাজনৈতিক অধিকারগুলো রক্ষা করতে হবে।

 ৫. দেশের যে কোনো ভবিষ্যৎ শাসনতান্ত্রিক পরিকল্পনায় উক্ত বিষয়গুলোকে মৌলিক নীতি হিসেবে গ্রহণ করতে হবে।


#লাহোর প্রস্তাবের গুরুত্ব:

অবিভক্ত ভারতের শেষ দশকের রাজনীতিতে লাহোর প্রস্তাবই ছিল মূল নিয়ামক।নিম্নে এ প্রস্তাবের গুরুত্ব আলোচনা করা হলো :

১. মুসলিম লীগের গুরুত্ব বৃদ্ধি পায়।

২.মুসলিম জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটে।

৩.দ্বিজাতিতত্ত্ব স্বীকৃতি লাভ করে।

৪.মুসলমানদের মধ্যে রাজনৈতিক উৎসাহ উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়।

৫.১৯৪৬ এর নির্বাচনে মুসলিম লীগের বিপুল বিজয় অর্জিত হয়।

৬.সর্বশেষ পাকিস্তান নামের একটি দেশ প্রতিষ্ঠিত হয়।


#বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে লাহোর প্রস্তাবের প্রভাব: 

বাংলার মুসলমানরাও ব্যাপকভাবে পাকিস্তান আন্দোলনে শামিল হয়েছিল এই আশায় যে, পাকিস্তান রাষ্ট্রের মধ্যেই তারা পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন ভোগ করবে। কারণ লাহোর প্রস্তাবে প্রদেশগুলোর পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন দেওয়ার কথা সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ ছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্য পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টির অল্পদিনের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মোহ ভাঙতে শুরু করে। দুই পাকিস্তানের মধ্যকার ব্যাপক বৈষম্য, পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা এবং পূর্ব পাকিস্তানিদের প্রতি বিমাতাসুলভ আচরণ তাদের মধ্যে ক্ষোভের জন্য দেয়। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতি এই অঞ্চলের জনগণ ও নেতৃবৃন্দের একটাই প্রাণের দাবি ছিল- লাহোর প্রস্তাবভিত্তিক পূর্ণ প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন। ১৯৪৯ সালে আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার পর দলটি সরকারের নিকট স্বায়ত্তশাসনের দাবি উত্থাপন করে। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনের প্রাক্কালে যে ২১ দফা দাবি উত্থাপন করে তার ১৯ দফায় লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের দাবি জানানো হয়। ষাটের দশকে স্বায়ত্তশাসন আন্দোলন শুরু হলে পুনরায় লাহোর প্রস্তাবের বাস্তবায়নের দাবি ওঠে। ১৯৬২ সালে মওলানা ভাসানী 'দেশের সমস্যা ও সমাধান" নামক পুস্তিকায় বলেন, “একমাত্র পাকিস্তানের মূলভিত্তি লাহোর প্রস্তাব কার্যকরী করলেই ৫ কোটি মুসলমানের দাবি স্বীকৃতি পাবে।” অনুরূপভাবে ১৯৬৪ সালে মওলানা ভাসানী কর্তৃক উত্থাপিত ৫ দফা কর্মসূচির এক দফায় বলা হয়েছে, “ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের জন্য আপসহীন সংগ্রামের মধ্যেই পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যকার পর্বত প্রমাণ অর্থনৈতিক বৈষম্য, আঞ্চলিকতা ও সর্বপ্রকার বৈষম্যমূলক আচরণ হতে পূর্ব পাকিস্তানের সাড়ে পাঁচ কোটি তথা সমগ্র পাকিস্তানের দশ কোটি মানুষের সত্যিকার মুক্তি নিহিত আছে।” ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক উত্থাপিত ৬ দফার প্রথম দফায় লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে পাকিস্তানকে একটি প্রকৃত যুক্তরাষ্ট্র হিসেবে গঠনের দাবি জানানো হয়। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের সময় ছাত্রদের ১১ দফা দাবিতেও লাহোর প্রস্তাবভিত্তিক স্বায়ত্তশাসন প্রদানের দাবি জানানো হয়।এভাবে দেখা যায়, ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত বাঙালির আন্দোলন সংগ্রামের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল লাহোর প্রস্তাবে উল্লিখিত স্বায়ত্তশাসন। মূলত এই স্বায়ত্তশাসন আন্দোলনই চূড়ান্ত পর্যায়ে স্বাধীনতা সংগ্রামে পরিণত হয়। অবশেষে মুক্তিকামী মানুষ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে বাংলাদেশ নামক স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্ম দেয়। এই জন্য যুক্তিসংগতভাবে বলা যায়, লাহোর প্রস্তাবের মধ্যে স্বাধীন বাংলাদেশের বীজ নিহিত ছিল।


তথ্য সংগ্রহ : স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস বই, অনার্স ১ম বর্ষ।

ড.এ.কে.এম. শওকত আলী খান

এ.বি.এম. গোলাম ফারুক

ড.এ.এস.এম. রফিকুর রহমান

মোহাম্মদ সানাউল্যাহ

ড.মো: আবদুল মালেক সরকার

ড.মো: মাসুদুর রহমান। 


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ