১. মঙ্গলকাব্যের পরিচয় ---
মধ্যযযুগীয় বাংলা সাহিত্যের একটি বড় বৈশিষ্ট্য হল মঙ্গলকাব্য।পঞ্চদশ শতক থেকে অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত—এমন কি তারও পরে অনেকমঙ্গলকাব্য রচিত হয়েছে। গোটা বাংলাদেশেই এই মঙ্গলকাব্যসমূহের অসাধারণপ্রভাব দেখা যায়। এখনও পল্লী অঞ্চলে মঙ্গলকাব্যের কোন কোন দেবদেবীরঘটা করে পূজা হয়। এই উপলক্ষে দেবদেবীর মহিমাবিষয়ক গান করা হয়।বিভিন্ন দেবদেবীর পূজা প্রচারসম্বন্ধীয় একপ্রকার আখ্যানকাবাকে মঙ্গলকাব্যবলে। এই দেবদেবীদের অনেকেই আর্য পরিমণ্ডলের নন, বাংলার গ্রাম্য পরিবেশে ও সমাজে এদের আবির্ভাব ও প্রতিষ্ঠা। তাই এরা লৌকিক ওঅপৌরাণিক গ্রামীণ আদর্শ থেকেই উদ্ভূত। এদেশে আর্যসংস্কৃতি ও দেবদেবী-তত্ত্ব দৃঢ়মূল হবার আগে অস্ট্রিক গোরসম্ভূত আর্যেতর জাতি বাস করততা আমরা ইতিপূর্বে বলেছি। পরে আর্য হয়ে যাবার পর প্রাচীন বাঙালীতার পুরাতন সংস্কার ভুলে গেল, অতি দ্রুত আর্য শিক্ষাসংস্কৃতিতে দীক্ষা নিল,আর্য দেবদেবীকে নিজেদের উপাস্য দেবতা বলে গ্রহণ করল। এই ব্যাপারসমাধা হতে বহ, সময় অতিবাহিত হয়েছে। তব, পরাতন আর্যেতর দেববিশ্বাস বাঙালীর মন থেকে পুরোপরি মুছে যায়নি। বিশেষতঃ সমাজেরনিম্নস্তরে এবং স্ত্রী-সমাজে, যেখানে আর্য প্রভাব পৌঁছতে অনেক বিলম্বহয়েছিল, সেখানে তথাকথিত অনার্য প্রভাব বিশেষতঃ দেবদেবীদের প্রভাবঅনেক দিন প্রচ্ছন্নভাবে বর্তমান ছিল। এখনও বাংলার পল্লীতে নানা গাছতলায় যে সমস্ত দেবদেবী মহিলাসমাজ কর্তৃক পূজিত হন, তাঁদের কেউ-ইসংস্কৃত মন্ত্রের দ্বারা পরিশদ্ধে নন। পুরাণ গ্রন্থে তাঁদের ঠাঁই মেলেনি। চণ্ডী,মনসা, বাশলী, ধর্ম, পঞ্চানন প্রভৃতি লৌকিক অর্থাৎ গ্রামের দেবদেবী বাঙালীরআর্যেতর সংস্কার বহন করছেন।
বিপদে-আপদে পড়লে মানুষে ভয়ে ভক্তিতে দেবদেবীর শরণ নেয়। বাংলারমঙ্গলকাব্যের দেবদেবীদের উৎপত্তির মূলে এই রকম নানা ধরনের আধিভৌতিক আপদ-বিপদের প্রভাব আছে। হিংস্র শ্বাপদের মুখে থেকে বাঁচবারজন্য চণ্ডীদেবীর পরিকল্পনা, সাপের বিষদন্ত থেকে আত্মরক্ষা করবার জন্যসঙ্গের অধিষ্ঠাত্রী দেবী মনসার পরিকল্পনা। বসন্ত রোগ থেকে মুক্তি পাবারজন্য শীতলার উৎপত্তি এমন কি বাঘের অত্যাচার থেকে রক্ষা পাবার জন্যনিম্নবর্গে বাঘের দেবতা দক্ষিণরায়ের মূর্তি গড়িয়ে পড়ার ব্যবস্থা করাহয়েছে। মঙ্গলকাব্যের দেবদেবী অনেক পূর্ব থেকে ছড়ায়, পাঁচালীতে,মেয়েলী ব্রতকথায় নিজ নিজ অস্তিত্ব রক্ষা করেছিলেন। কিন্তু পঞ্চদশ শতকেসাহিত্য ও সমাজে নতুন করে তাঁদের প্রভাব দেখা গেল।তখনবাংলাদেশেপাঠান আমল চলেছে, তারপর এল মুঘল আমল। ফলে সামাজিক ও রাষ্ট্রিকদারণে বিপর্যয়ের ফলে সাধারণ বাঙালী হিন্দুর মনে শান্তি ছিল না। তারাতখন এই সমস্ত উপদ্রব থেকে রক্ষা পাবার জন্য এমন শক্তিশালী দেবদেবীর কাছেপ্রার্থনা জানাতে লাগল, যাঁদের স্বল্পতম কৃপাকটাক্ষ লাভ করলে ফকিরওরাজা হতে পারে, মূর্খ ব্যাধও বন কেটে রাজত্ব ফদিতে পারে। তাই মঙ্গলকাব্যের দেবদেবী, বিশেষতঃ দেবীরা, ভক্তের কাছে বরাভয় মূমূর্তিতে হাজিরহয়েছেন। ভক্তের জন্য তাঁরা পারেন না, এমন কোন কাজ নেই। ভক্তের জন্যতাঁরা ন্যায়-অন্যায়বোধ পর্যন্ত বিসর্জন দিয়ে ভক্তের শত্রুর বিরুদ্ধে বিনা কারণেখড়গহস্ত হয়েছেন। তাই তাঁদের রুষ্টি-তুষ্টি বড়ো ভয়ঙ্কর। এই সমস্তদেবদেবীর পরিকল্পনার মূলে কিঞ্চিৎ বুঢ়-রক্ষে আর্ষের্তর প্রভাব আছে তাঅস্বীকার করা যায় না। অবশ্য পঞ্চদশ-ষোড়শ শতাব্দীর সমাজে পৌরাণিকপ্রভাব গভীরভাবে অনুপ্রবিষ্ট হলে মঙ্গলকাব্যের দেবদেবীরাও জাতে উঠতেলাগলেন। আদিতে চণ্ডী ছিলেন অনার্য ব্যাধ জাতির দেবী। কিন্তু ক্রমে ক্রমেতিনি শিবের গৃহিণী পার্বতীর সঙ্গে এক হয়ে গেলেন। সাপের দেবীভয়ঙ্করী মনসা যে আর্যমণ্ডল-বহির্ভূত তাতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তুসমন্বয়ের যুযুগে তাঁকে শিবের মানসকন্যা বলে প্রচার করা হল। পুরুষে-দেবতাধর্মঠাকুর পৌরাণিক না হলেও তাঁকে প্রায় বিষ্ণু করে তোলা হয়েছে। তাইএকদা এই সমস্ত আর্ভের গ্রাম্য দেবদেবী নিম্নসমাজে পূজিত হলেও খ্রীষ্টীয়পঞ্চদশ শতক থেকে সমন্বয়ের যুগ শুরু হলে তাঁরা উচ্চ বর্ণেরও শ্রদ্ধা লাভকরলেন। ব্রাহ্মণ কবিরা পূর্বতন সংস্কার বিস্তৃত হয়ে চণ্ডী-মনসা-বাশলীধর্ম ঠাকুরের আরাধনা ও তাঁদের মহিমা-প্রচারক কাব্য রচনায় মহানন্দে আত্মনিয়োগ করলেন।
সাধারণতঃ অধিকাংশ মঙ্গলকাব্যে দেবদেবীর পূজা প্রচারিত হয় আর সেইপ্রচারকার্য সমাধা হয় দেবীর কোন ভক্তের দ্বারা-যিনি পূর্বে ছিলেন স্বর্গেরঅধিবাসী। তাঁর দ্বারা মর্ত্যধামে পূজা প্রচারের জন্য দেবী তাঁকে বিনাঅপরাধে বা সামান্য অপরাধে শাপ দিয়ে মর্ত্যে মানুষে-জন্ম গ্রহণ করতে বাধ্যকরেন। মর্ত্যে দেবীর পূজা প্রচারের পর তবে শাপভ্রষ্ট দেবকুমার বা স্বর্গেরকোন নত′কী মতদেহ ত্যাগ করে পুনরায় স্বর্গে ফিরে যাবার অনুমতি পান।তাই মঙ্গলকাব্যের খানিকটা অংশে দেবকাহিনী, বাকি অংশে মার্কাহিনীবর্ণিত হয়, প্রধান প্রধান মঙ্গলকাব্যের প্রারম্ভ ভাগে শিবের ঘরগৃহস্থালীজীবন্তভাবে বর্ণিত হয়েছে। অবশ্য এই শিবের গ্রাম্য মানসিকতা বেশী লক্ষ্যকরা যায়। মনে হয়, বাঙালীর আর্ষের্ভর সংস্কারের সঙ্গে শিবের যোগাযোগবহ দিন পূর্ব থেকেই চলে আসছে। মঙ্গলকাব্যের প্রধান দেবদেবী মনসা,চণ্ডী, ধর্ম ও শিবকে কেন্দ্র করেই অনেকগুলি আখ্যানকাব্য রচিত হয়েছে।একদা এ'দের ভক্তসংখ্যা ছিল অনেক—এখনও গাছতলে ও পুরাতন মন্দিরেএদের শিলামূর্তি বা মন্ময় মূর্তির পূজা হয়, সেই পূজা উপলক্ষে দেবদেবীর মহিমাবিষয়ক মঙ্গলকাব্য পঠিত ও গীত হয়। বর্তমানকালে গ্রামে মনসাও ধর্মঠাকুরের খবে ঘটা করে পূজা-অর্চনা হয়ে থাকে। অন্যান্য মালকাব্যের দেবদেবীদের মহিমা এখন নিষ্প্রভ হয়ে গেলেও মনসা ও ধর্মঠাকুর এবংউক্ত দেবদেবীর মহিমাজ্ঞাপক মগলকাবা জনসাধারণের মধ্যে বেশ উৎসাহ স্যারকরে। এর ওপরে আর্য-সংস্কার ও পৌরাণিক ঐতিহ্যেরপালিশপড়লেওপুরাতন আর্যেতর সংস্কার দুর্নিরীক্ষা নয়। চণ্ডী, মনসা ও ধর্মঠাকুরের
লীলাবাহিনী বিষয়ক মঙ্গলকাবাগুলি সাহিত্যের দিক থেকে প্রশংসনীয় বলেআমরা এই গ্রন্থে প্রধানতঃ এই তিন শ্রেণীর মঙ্গলকাব্য আলোচনা করব।পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষভাগে বা ষোড়শ শতাব্দীর একেবারে গোড়ার দিকেকয়েকখানি মনসামঙ্গল কাব্য লেখা হয়েছিল বলে এই অধ্যায়ে শব্দ মনসা
মঙ্গলের পরিচয় দেওয়া যাচ্ছে।
""""মনসাদেবী ও মনসামঙলের কাহিনী------"""""
মনসামঙ্গল বা পদ্মাপরাণ কাব্যের অধিষ্ঠাত্রী দেবীর নাম মনসা, কেতকা,পদ্মাবর্তী। তাই এই কাবাঁকে মনসামঙ্গল বা পদ্মাপরাণ বলে। মনসাভক্তকবিরাও নিজেদের কেতকাদাস বলতেন। পশ্চিমবঙ্গের মনসামঙ্গলের একজনবিখ্যাত কবি ক্ষেমানন্দ নিজের নামের সঙ্গে কেতকাদাস শব্দটি ব্যবহারকরেছেন। তাঁর পুরো নাম কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ। মনসাদেবী সর্পেরঅধিষ্ঠাত্রী দেবী : লৌকিক ভয়-ভীতি থেকেই তাঁর আবির্ভাব এবং সর্পসকুল পূর্ববঙ্গ যে দেবীর প্রধান পীঠস্থান তাতে কোন সন্দেহ নেই। অবশ্যসারা বাংলাদেশ জড়ে, এমন কি বাংলার প্রান্তীয় অঞ্চলেও মনসার প্রভাব ওমনসামঙ্গলের আখ্যান প্রচলিত আছে। কোন কোন অর্বাচীন সংস্কৃত পুরাণেতাঁকে শিবের মানস-কন্যা বলা হয়েছে। কিন্তু কোন প্রাচীন পুরাণে মনসারবা শিবের কোন মানস কন্যার উল্লেখ নেই। অবশ্য কোন কোন প্রাচীন হিন্দুও বৌদ্ধ গ্রন্থে সর্পের দেবীর বর্ণনা আছে। বৌদ্ধ গ্রন্থেই যেন সর্পের দেবীরবেশী উল্লেখ আছে। বিনয়বস্তু’ ও ‘সাধনমালা' নামে দু'খানি বৌদ্ধ গ্রন্থে সর্পেরদেবীর স্পষ্ট বর্ণনা আছে। 'সাধনমালা'য় দেবীকে 'জাঙ্গলি' বা 'জাঙ্গুলিতারা'বলা হয়েছে। প্রাচীন যুগে সাপের রোঝাকে বলা হত 'জাঙ্গলিক'। প্রাচীন পুরাণও মহাভারতে যে সর্পের দেবীর উল্লেখ আছে, তিনি হচ্ছেন জরৎকার, আস্তিকতাঁর ছেলে। বাংলার মঙ্গলকাব্যে জরৎকার, ও মনসাকে এক করে ফেলা হয়েছে।পদ্মপুরাণ, দেবী-ভাগবত ও ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে মনসার উল্লেখ আছে। বাংলাদেশেও দশম-একাদশ শতাব্দী থেকে সর্পভূষণা মনসার প্রস্তরমমূর্তি পাওয়াযাচ্ছে। আদিবাসীদের মধ্যেও মনসাদেবীর পূজোপাসনা প্রচলিত আছে।দক্ষিণ ভারতে 'মাম্মা নাম্নী সর্পের দেবী ও বাংলার মনসার মধ্যে শব্দগতসাদৃশ্য আছে। এই সব তথ্য থেকে দেখা যাচ্ছে বৈদিক ও বৌদ্ধযুগে বিষনাশিনী সর্পের দেবী অজ্ঞাত ছিলেন না। মনসা নামটি কোন কোন অর্বাচীনপুরাণেও পাওয়া যায়। প্রাচীন পুরাণে যেখানে মনসা নাম ব্যবহৃত হয়েছে,সেখানে তা পরবর্তী কালে প্রক্ষিপ্ত হয়েছে বলে মনে হয়। বাংলার মনসাদেবীআবেতের অস্ট্রিক সংস্কার থেকেই আবির্ভূত হয়েছেন, পরে তাঁকে আর্যদেবমণ্ডলে স্থান দেবার জন্য পৌরাণিক কাহিনী, বিশেষতঃ শিবের সঙ্গে মনসারপিতাপত্রীর সম্পর্ক' জড়িত করে কাব্যাদি রচিত হয়।
(মনসামঙ্গল কাব্যেই দেবীর যথার্থ স্বরূপ ফুটে উঠেছে। সর্পের দেবীযে কিছু, কোপনস্বভাব উগ্নমূর্তি হবেন তাতে আর আশ্চর্য কি? তাঁর পূজাপ্রচারের জন্য মনসামঙ্গলে যে কাহিনী বিবৃত হয়েছে, তাতে দেখা যাচ্ছে, পদ্মবনে শিবের মন থেকে মনসার জন্ম হয়। তাই তিনি শিবের মানসকন্যা।কোপনস্বভাব মনসার সঙ্গে বিমাতা চণ্ডীর কলহের ফলেতাঁর একটি চোখকানা হয়ে যায়। তাই তিনি চদিসদাগরের বাবা গালিচ্ছলে 'কানী' বলে নিন্দিতহয়েছেন। মর্ত্যো কি করে তাঁর পূজা প্রচারিত হয়। এজন্য তিনি প্রথমে রাখলেপ্রভৃতি নিম্নবর্ণের কাছ থেকে বলপূর্বক পূজা আদায় করলেন। কিন্তু তখনউচ্চতর সমাজে স্ফী-দেবতার পূজা প্রচলিত ছিল না, সমাজে সম্পন্ন বলতে বণিকদের বোঝাত সেই বণিকদের প্রধান চাঁদসদাগর ধর্মমতে ছিলেন শৈব।তিনি যদি মনসার পূজা করেন, তবে বণিক সমাজে সহজেই দেবীর প্রাধান্যস্থাপিত হবে। কিন্তু শিবের ডক্ত চাঁদসদাগর নিজ প্রতিজ্ঞায় অটল রইলেন।দেবীর প্রচণ্ড আক্রোশ অবহেলা করেও তিনি শিবের পূজা করতে লাগলেন,দেবীকে অশিষ্ট ভাষায় গালি দিলেন, এমন কি তাঁকে শারীরিক নিগ্রহকরতেও পিছপা হলেন না। মনসার কোষে চাঁদের ছ'টি পত্র মরে গেল, তাঁরসর্বনাশ হল, ব্যবসা-বাণিজ্যে গিয়ে নৌকাডুবির ফলে তিনি নানা নির্যাতনভোগ করে সর্বস্বান্ত হয়ে দেশে ফিরলেন। ইতিমধ্যে তাঁর একটি পত্র হয়েছে।তার নাম লখীন্দর। পত্র বয়ঃপ্রাপ্ত হলে তিনি তার সঙ্গে একটি সুলক্ষণাকন্যা বেহলার বিয়ে দিলেন। পাছে মনসা তাঁর এই পত্রটিকেও বিনাশ করেন।এই আশঙ্কায় তিনি সাতালি পর্বতে লোহার বাসরঘর নির্মাণ করিয়ে তারমধ্যে পূর্ব-পুত্রবধূকে বাসরযাপন করতে পাঠালেন। কিন্তু দেবতার সঙ্গেমানুষের বিরোধে মানুষ কি জয়ী হতে পারে? লোহার বাসরের একস্থানেএকটি সূচীভেদ্য সূক্ষ্ম ছিদ্র ছিল। মনসা তা জানতেন।বাসরে লখীন্দরও বেহলা ঘুমিয়ে পড়লে দেবী, তাঁর অনচের কালনাগকে পাঠিয়ে দিলেন।বিষধর কালনাগের দংশনে বাসরেই লখীন্দরের মৃত্যু হল। চারিদিকে হাহাকারপড়ে গেল, মা সনকা তারম্বরে কাঁদতে লাগলেন, অনেকে নতুন বউকে অলক্ষণেমনে করে বেহলার নিন্দায় জলে উঠল। কিন্তু জেদী চাঁদের চোখের জল মহাক্রোধে আগন হয়ে জলতে লাগল। 'কানী'র উচ্ছিষ্ট পুত্রকে ঘরে রেখেকি হবে? কলার ভেলায় করে লখীন্দরের শবদেহ নদীতে ভাসিয়ে দেওয়ারউদ্যোগ হতে লাগল। তখন সতীশিরোমণি বেহলা ঐ ভেলায় স্বামীর শব্রেপাশে ঠাঁই করে নিল। তার পণ–সে স্বর্গে গিয়ে স্বামীর জীবন ফিরিয়ে
আনবে, তা নইলে আর ফিরে আসবে না।জলপথে বেহলাকে নানা বিপদে পড়তে হল, 'মনসার ক্লোষও তাকেঅনসূরণ করতে লাগল। নানা প্রলোভন জয় করে অসাধারণ সতীধর্মের জোরেবেহলা স্বর্গে গিয়ে পৌঁছল, তারপর দেবতাদের নৃতাগীতে তুষ্ট করে স্বামীরজীবনভিক্ষা চাইল। শিবের নির্দেশে অনিচ্ছার সঙ্গে মনসা লখীন্দরের জীবনফিরিয়ে দিতে সম্মত হলেন। তবে তিনিও বেহলাকে দিয়ে প্রতিজ্ঞা করিয়েনিলেন, বেহলা ফিরে গিয়ে শ্বশুরকে দিয়ে মনসার পূজা করিয়ে নেবে। কারণচাঁদসদাগর দেবীর পূজা না করলে মতো উচ্চবর্ণের মধ্যে মনসার পূজা প্রচারিতহবার সম্ভাবনা ছিল না। বেহলা তাতেই সম্মত হল। তার স্বামী লখীন্দরবেচে উঠল, ছয় ভাশরে প্রাণ ফিরে পেল, বন্দরের নিমজ্জিত বাণিজ্যেরনৌকাও ভেসে উঠল। জয়ধ্বনিসহ সে স্বামীকে নিয়ে শ্বশ্বরবাড়ী হাজির হল।চাঁদের পরিবারে চাঁদের হাট বসল। প্রথমটা চাঁদসদাগর মনসার পূজা ব্যাপারেবোকে দাঁড়িয়েছিলেন। কিন্তু মনসার রক্তচক্ষকে অবহেলা করলেও তিনি পূর্ববন্ধু বেহুলোর অশ্রুকাতর মিনতি এড়াতে পারলেন না-মনসার পূজোয় কোনওপ্রকারে রাজী হয়ে গেলেন। অবশ্য শেষ পর্যন্ত তাকে স্নেহের কাছে পরাজয়স্বীকার করতে হলেও, তিনি খুব যে একটা ভক্তির সঙ্গে মনসার পূজা করেছিলেন, তা মনে হয় না। তিনি ডান হাত দিয়ে দেবীর পূজা করতে কিছুতেইরাজী হলেন না। ও হাতে তিনি মহাদেবের পূজা করেন, ওর দ্বারা তিনিশ্রীদেবতার পূজা কি করে করবেন? তাই বাম হাত দিয়ে দেবীর উদ্দেশে ফলফেলে দিলেন। অবশ্য তাতেই দেবীকে খংশী হতে হল—কারণ এর ফলে তিনিউচ্চ সমাজে প্রবেশের ছাড়পত্র পেলেন। বেহুলা-লখীন্দরের বারা দেবীর পূজামর্ত্যধামে প্রচার লাভ করল। কিন্তু আসলে বেহ,লা-লখীন্দর স্বর্গের দেবদেবী (ঊষা ও অনিরুষ) দেবীর অভিশাপে মর্ত্যজন্ম গ্রহণ করে তারা মনসারপূজা প্রচারে সাহায্য করল, তারপর শাপের অবসানে স্বর্গের দেবদেবী স্বর্গে
ফিরে গেল। এই হল মনসামঙ্গলের কাহিনীর সূত্র।বাংলার নানা অঞ্চলে এবং বাংলার বাইরে এ কাহিনীর অল্প-স্বল্প বৈচিত্র্যআছে। দক্ষিণ ভারতের লোকসাহিত্যেও মনসামঙ্গলের অনুরূপ একটি কাহিনীপ্রচলিত আছে। বিহারে মনসামঙ্গলের যে আখ্যান হিন্দীভাষায় প্রচলিতআছে, তাও অনেকটা বাংলার মতো,বোধ হয় বাংলার প্রভাবেই পরিকল্পিত।বাংলায় মনসামঙ্গলের তিনটি ধারা দেখা যায়। (১) রাঢ়ের ধারা (বিপ্রদাস,কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ, সাঁতারামদাস, রসিক মিশ্র, প্রভৃতি কবি), (২) পূর্ববঙ্গের ধারা, প্রায়শই যা পদ্মাপুরাণ নামে পরিচিত (নারায়ণদেব, বিজয়গপ্তপ্রভৃতি), (৩) উত্তরবঙ্গ ও কামরূপের ধারা (তা-বিভূতি, জগজ্জীবন ঘোষালপ্রভৃতি)। কাহিনীর দিক থেকে উত্তরবঙ্গের ধারা একট, পৃথক ধরনের। এতেধর্মমঙ্গলের বেশ প্রভাব আছে।
কেউ কেউ মনসামঙ্গলের কাহিনীর মধ্যে মহাকাব্যের লক্ষণ ও ঐতিহাসিকতথ্যের সন্ধান পেয়েছেন। অবশ্য বেহলার অপূর্ব সতীধর্ম এবং চাঁদসদাগরেরঅনমনীয় পৌরুষ মহাকাব্যেরই উপযুক্ত। কিন্তু এই বিষয়বস্তুকে মঙ্গলকাব্যও পাঁচালীর গ্রাম্য স্তর থেকে মহাকাব্যের রসে উন্নীত করার মতো মহাকবিরপ্রতিভা মনসামঙ্গলের কোন কবিরই ছিল না কোন মঙ্গলকাব্যেই মহাকাব্যেরলক্ষণ বড়ো একটা পাওয়া যায় না। মনসামঙ্গলের কাহিনীটি ঐতিহাসিককিনা সে বিষয়েও যথেষ্ট সন্দেহ আছে। বাংলার প্রায় গ্রামেই চাঁদসদাগরেরভিটে ও বেহলার ঘাট আছে। সুতরাং এ রকম লোককাহিনীর পশ্চাতে কোনসদর যুগের কোন ঐতিহাসিক কাহিনী প্রচ্ছন্ন থাকলেও থাকতে পারে, কিন্তুএখন আর তার কোন সন্ধান পাওয়া যায় না।
****----মনসামপালের কয়েকজন কবি--------
--------বিজয়গুপ্ত --------
বরিশাল জেলার আধুনিক গৈলা গ্রামে (প্রাচীন নাম
ফলশ্রী) বিজয়গুপ্তের জন্ম হয়। তাঁর আবির্ভাবের সন-তারিখ সম্বন্ধে কোনইঙ্গিত পাওয়া যায় না। তাঁর কোন কোন পথিতে পথিসমাপ্তির শকাব্দের উল্লেখআছে বটে। তাই থেকে মনে হয় কবি পঞ্চদশ শতকের মাঝামাঝি জন্মগ্রহণ,করেন। তাঁর পিতার নাম সনাতন, জননী রুক্মিণী—এর বেশী কোন পরিচয়কবি দেননি। শোনা যায়, তিনি নাকি স্বগ্রামে মনসার মন্দির ও মূর্তি প্রতিষ্ঠাকরেছিলেন—এখনও তার নিদর্শন পাওয়া যায়। বরিশাল থেকে বাংলা ১৩০৩সালে সর্ব প্রথম বিজয়গুপ্তের পদ্মাপরাণ ছাপার অক্ষরে প্রকাশিত হয়, তারপরএর একাধিক পুনমন্ত্রণ হয়েছে। অবশ্য মুদ্রিত গ্রন্থের ভাষা বিশেষ প্রাচীননয়, এর মধ্যে বিজয়গুপ্তের ভণিতার সঙ্গে আরও অনেকের ভণিতা আছে।সতরাং কোন কোন সমালোচক বিজয়গপ্তের প্রামাণিকতায় সন্দেহ প্রকাশকরেছেন। তবে এ সন্দেহ অমূলক। কারণ বিজয়গুপ্তের পথি কলকাতাবিশ্ববিদ্যালয়ে আছে। আমরা মুদ্রিত কাব্য ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পথির পাঠেরতুলনামূলক আলোচনা করে দেখছি, ছাপাগ্রন্থের অনেক জায়গায় কলম চালানোহয়েছে। সুতরাং বিজয়গুপ্তের পথি যে হবে বিশৃদ্ধ ও প্রাচীন তা মনে হয়না। এর ভাষা অনেক স্থলে আধুনিক কালের মতো, কোথাও কোথাও পশ্চিমবঙ্গীয় বাগ্ধারার প্রভাবও আছে। মনসামঙ্গল কাব্যগুলির মধ্যে পশ্চিমবঙ্গেরকেতকাদাস ক্ষেমানন্দ ও পূর্ববঙ্গের বিজয়গুপ্তের কাব্যের সমধিক সমাদরহয়েছিল। এই দ'খানা কাব্য মনসামঙ্গলের কাব্যের মধ্যে সর্বপ্রথম মুদ্রেণের
গৌরব লাভ করে। অত্যধিক জনপ্রিয়তার জন্য বিজয়গুপ্তের ভাষার নানাপরিবর্তন হয়েছে। তাই বলে তাঁর কাবাকে অপ্রামাণিক বলে তাচ্ছিল্য করাযুক্তিযুক্ত নয়। কোন মধ্যযযুগীয় কারোই বা হস্তক্ষেপ হয়নি? কৃত্তিবাসীরামায়ণ ও চণ্ডীদাসের পদাবলী তার উৎকট দৃষ্টান্ত। কৃত্তিবাসী রামায়ণেবহু পরিবর্তন হয়েছে বলে কি তাঁর কাব্যকে আমরা বাংলা সাহিত্যের প্রাঙ্গণথেকে বহিষ্কৃত করতে পারি? বিজয়গুপ্তের পদ্মাপরাণ সম্বন্ধে আমরা একইযমুক্তি পেশ করতে চাই।
বিজয়গুপ্তের পথির সংখ্যা খুব বেশী নয়। যে পথিগুলি পাওয়াগেছে, তার কয়েকখানিতে কাব্যরচনার শকাব্দের উল্লেখ আছে হেয়ালিরভঙ্গিতে, এবং হোয়ালির ভাষাও সব পথিতে এক নয়। সেই হেয়ালিরমর্মোদ্ঘাটন করলে এই খ্রীস্টাব্দগুলি পাওয়া যাবে ১৪৯৪, ১৯৭৮,১৪৮৪ অব্দ। তাঁর কাব্যের একস্থলে সুলতান হহুসেন শাহের উল্লেখ আছে।১৪৭৮ বা ১৪৮৪ খ্রীঃ অব্দে বাংলার সিংহাসনে হাসেন শাহকে পাই না।তিনি ১৪৯৩ খ্রীঃ অব্দে বাংলার সিংহাসন অধিকার করেন। তাই মনে হয়বিজয়গুপ্তের কাব্য হহুসেন শাহের সিংহাসন লাভের পর রচিত হয়–১৪৯৪খ্রীঃ অব্দে হলেও হতে পারে।
বিজয়গুপ্ত সম্বন্ধে অনেকে খুব প্রশংসাসূচক বাক্য ব্যবহার করেন বটে,কিন্তু বিশদ্ধে কাব্যলক্ষণের বিচারে তাঁর কাব্য বিশেষ প্রশংসা পাবে না।মনসার ঈর্ষাকুটিল বিষাক্ত চরিত্রটি মোটামটি মন্দ হয়নি। শিবের হাস্যকরভাঁড়ামি ধূলিধসের মঙ্গলকাব্যের আদর্শকেই স্মরণ করিয়ে দেয়। চাঁদসদাগরেরচরিত্রে প্রচণ্ড পৌরুষের সঙ্গে স্থূলতার সমাবেশে এর মহিমা ক্ষুণ্ন হয়েছে।তবে বেহলার চরিত্রাঙ্কনে কবি সমস্ত মাধর্য ও পবিত্রতা ঢেলে দিয়েছেন।স্থূল রঙ্গরসে বৈদ্য-কবির বিশেষ কৃতিত্ব ছিল, তা স্বীকার করতে হবে। সেযাই হোক, কাব্যটি যতটা জনপ্রিয় হয়েছে ততটা কাব্যগণের অধিকারী নয়।
*****-----বিপ্রদাস পিপ্প্লাই------***
॥ প্রায় সমসাময়িক কবি বিপ্রদাস পিপ্প্লাই যে মনসামঙ্গল কাব্য রচনা করেন তার নাম 'মনসাবিজয়'। এই কবি সম্বন্ধে কিছুকালপূর্বেও অনেকে কিছু জানতেন না। এ'র খান চারেক পুথি পাওয়া গেছে,তাই থেকে এর কাব্যের পরিচয় উদ্ধার করা হয়েছে। অবশ্য একখানি বাদেআর সমস্ত পথি এত গোলমালে ভরা যে, কবির যথার্থ কাব্যরূপ নির্ধারণকরাই কঠিন হয়ে পড়ে।
বিপ্রদাস বসিরহাটের নিকট (চব্বিশ পরগণা) বাদাড়িয়া গ্রামে জন্মগ্রহণকরেন। তাঁর পথিগুলিও কলকাতার নিকটবর্তী অঞ্চল থেকেই উদ্ধার করাহয়েছে। তিনি যে পশ্চিমবলোর কবি তাতে কোন সন্দেহ নেই। কাব্যেরপ্রারম্ভে কবি সংক্ষেপে আত্মপরিচয় দিয়েছেন।
তাতে দেখা যাচ্ছে নাদভ্যাবটগ্রাম, মতান্তরে বাদুড়িয়া গ্রামে পিপ্প্লাই শাখা-ভূক্ত ব্রাহ্মণবংশে কবি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মকুন্দ পণ্ডিত। কবি ১৪৯৫ খ্রীঃ অব্দে কাব্যসমাপ্ত করেন। পথিতে যে সন-শকাব্দের উল্লেখ আছে, তা থেকেই এই খ্রীস্টাব্দপাওয়া যায়। কিন্তু পূথির ভাষা প্রাচীন নয়, কোন কোন স্থানে উৎকটআধুনিক বাক্যবিন্যাসও আছে। বিজয়প্ত সম্বন্ধে সংশয় উত্থাপিত হলেবিদাস সম্বন্ধেও অনুরূপ সংশয় অনায়াসেই উঠতে পারে। বিশেষতঃ এ কাব্যে
এমন কতকগুলি আধুনিক স্থানের উল্লেখ আছে যে, এর প্রাচীনত্বে কিছু সংশয়জন্মায়। কবি যেভাবে কলকাতা ও খড়দহের উল্লেখ করেছেন, তাতে তাঁকেউত্তর-চৈতনাযাগের কবি বলে মনে হয়। তবে এই উল্লেখ প্রক্ষিপ্তও হতে পারে।প্রাপ্ত পথিগুলির পাঠেও বিভ্রান্তি অপনোদিত হতে চায় না। সুতরাং তাঁরপথিগুলি সম্বন্ধে নিশ্চয়ই সন্দেহের অবকাশ আছে।
কবি প্রাচীন হলেও ইদানীং তাঁর পথি আবিষ্কৃত হয়েছে এবং কিছুকালপূর্বে করি ছাপার অক্ষরে উঠেছেন। ডক্টর সুকুমার সেন মহাশয় এই গ্রন্থসম্পাদনা করেছেন। কাহিনী ও চরিত্র-চিত্রণে বিপ্রদাসের কৃতিত্ব বিজয়গুপ্তেরচেয়ে বেশী তা স্বীকার করতে হবে। বিশেষতঃ হাসান-হাসেন পালায় তিনিযেভাবে মুসলমান সমাজের বর্ণনা করেছেন, তাতে মকুন্দরামকে ছেড়ে দিলেএই সম্বন্ধে তাঁর সমান বিচক্ষণ কবি আর খুঁজে পাওয়া যায় না। এই প্রসঙ্গেকবি কিঞ্চিৎ কৌতুকরসেরও আমদানি করেছেন—যদিও কবি বড় গম্ভাঁর প্রকৃতিরছিলেন, তাঁর কাবো বিজয়গুপ্তের মতো হাস্যতরল বর্ণনা নেই বললেই চলে।বেহলা, সনকা, চাঁদ সদাগরের চরিত্রগুলি মন্দ হয়নি। কিন্তু কবির বক্তব্যচাকুত্ববর্জিত—নিতান্তই সাদাসিধে ধরনের। চাঁদের বাণিজ্য প্রসঙ্গে কবি যেপথঘাটের উল্লেখ করেছেন, পূর্ববঙ্গীয় কবির চেয়ে সে বর্ণনা অধিকতর বাস্তবনিষ্ঠ হয়েছে কারণ তিনি ছিলেন স্থানীয় কবি। তাঁর এই পথের বর্ণনায়ভাটপাড়া, মুলাজোড়, পাইকপাড়া, ভদ্রেশ্বর, রিসড়া, খড়দহ, কামারহাটী,এ‘ড়েদহ, ঘড়ি, চিতপুর, বেতড় ও কলকাতার উল্লেখ আছে—এবং উল্লেখআছে বলেই এ কাব্যের প্রাচীনতায় ও প্রামাণিকতায় বিশেষ সন্দেহ জন্মে। সেযাই হোক, সহজ বর্ণনায় বিপ্রদাসের মনসাবিজয় নিতান্ত মন্দ হয়নি, মনসারচরিত্রের রক্ষ নির্মমতাও অনেকটা অন্তর্হিত হয়েছে। কিন্তু তাই বলে কবিকেঅতিপ্রশংসার বিবদলে পূজা করবারও প্রয়োজন দেখি না। সর্বোপরি কবি রথির পাঠ সম্বন্ধে নানা গণ্ডগোল আছে বলে তাঁর প্রতিভা সম্পর্কে চূড়ান্ত
কথা বলা যায় না।
*****নারায়ণদেব -----------***||
মনসামঙ্গলের কবিদের মধ্যে নারায়ণদের বিশেষ স্থান দাবীকরতে পারেন। একমাত্র তাঁর কাবাই বাংলা ও আসামে প্রচার লাভ করেছে।তাঁর পরা ভণিতা সকবিবল্লভ নারায়ণদেব। অনেকে মনে করেন সংকবিবল্লভও নারায়ণদেব দুজন পৃথক কবি। কিন্তু এ অনুমোন যুক্তি দ্বারা সমর্থিতহয় না। তাঁর পদ্মাপরাণের ভণিতা থেকে সকবিবল্লভ' বা কবিবল্লভ' খেতাববলে মনে হচ্ছে। ইনি যে একজন অতি প্রাচীন কবি, তার প্রমাণ ১৬৯৫ খ্রীঃঅব্দে নকলকরা তাঁর একখানি পথি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে আছে। তাঁরএ কাবোর আরও অনেক পথি পাওয়া গেছে। কাজেই কবি একদা ময়মনসিংহও শ্রীহট্টে অত্যন্ত জনপ্রিয় কবি ছিলেন তাতে সন্দেহ নেই। তাঁর পাখিতেসংক্ষেপে যে আত্মপরিচয় দেওয়া হয়েছে, তাতে দেখা যাচ্ছে, তাঁর পূর্বপুরুষেরআদিনিবাস রাঢ়ভূমি। তাঁরা দেব-উপাধিক কায়স্থ। তাঁর বৃদ্ধ পিতামহউদ্ধারণদেব রাঢ়দেশ ছেড়ে ময়মনসিংহ জেলার কিশোরগঞ্জের অন্তর্ভুক্ত বোরগ্রামে বসতি স্থাপন করেন। ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে অবস্থিত বোরগ্রাম এখনময়মনসিংহের অন্তর্ভুক্ত হলেও একদা নাকি এই গ্রাম শ্রীহট্টের মধ্যে ছিল।
শ্রীহয়ে তাঁর কাবা বেশ প্রচারিত আছে। এখনও ছাপা হয়। কেবিবল্লভ নারায়ণভণিতাটি শ্রীহট্টীয় উপভাষায় সান্নিতে পরিণত হয়েছে।এখন শ্রীহট্টেসুনামির যে পদ্মাপরাণ পাওয়া যায় তার সঙ্গে ময়মনসিংহের নারায়ণদেবেরকাব্যের সামান্য স্থানীয় উপভাষা ছাড়া আর কোন বিষয়ে কোন পার্থক্য নেই।তাই অনুমান হয় শ্রীহট্ট ও ময়মনসিংহের বোরগ্রামের ভৌগোলিক নৈকট্যের জন্য
নারায়ণদেবের কাবা শ্রীহট্টেও বেশ প্রচার লাভ করেছিল এবং সেইজন্যশ্রীহট্টীয়ে কবিকে নিজেদের অঞ্চলের কবি বলে দাবি করেছেন যদিও সে
দাবি যুক্তির বারা সমর্থিত নয়।নারায়ণদেবের সময় সম্বন্ধে কোন সুনিশ্চিত প্রমাণ পাওয়া যায় না। তাঁরকোন পাখিতে কালনির্ণয়-সংক্রান্ত কোন ইঙ্গিত নেই।
অবশ্য বাংলাদেশবিভক্ত হবার আগে ঐ গ্রামে তাঁর বংশধারা বর্তমান ছিল। তাঁদের কাছে রক্ষিতবংশতালিকা থেকে অনুমান হয় কবি পঞ্চদশ শতকের মাঝামাঝি বর্তমানছিলেন। তা হলে তাঁর কাব্য বিজয়গুপ্ত-বিপ্রদাসের সমকালেরই হতে পারে।তবে এ-ও আমাদের অনুমোন মাত্র। কবি হুসেন শাহের সময়ে কাব্য রচনা করলেপ্রবলপ্রতাপান্বিত সুলতানের নাম উল্লেখ করতে ভুলতেন না, বিজয়গুপ্ত ওও বিপ্রদাস দ'জনেই মূলতানের নাম করেছেন। কেউ কেউ তাঁকে বিপ্রদাসেরপরবর্তী বলতে চান। আমরা এ অননুমানও সমর্থন করি না। কারণ বিপ্রদাসেরভাষার চেয়ে তাঁর ভাষায় প্রাচীনত্বের অধিকতর লক্ষণ আছে—যদিও তাঁর কাবাবহুবার নকল হয়েছে। বেশী জনপ্রিয় বা নকল হলে কাব্যের ভাষা বদলে গিয়েযুগোপযোগী রূপ ধারণ করে। নারায়ণদেবের ভাষা কিন্তু সেই দিক দিয়ে
অনেকটা প্রাচীন।নারায়ণদেব যে একজন শক্তিশালী কবি ছিলেন, তা তাঁর বিরাট পথিথেকেই বোঝা যায়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনেক দিন আগে তাঁর যেকাব্য প্রকাশিত হয়েছিল, তাতে পালাবিন্যাসে নানা গণ্ডগোল আছে সেইগ্রন্থ থেকে কবিপ্রতিভার সম্যক পরিচয় পাওয়া যাবে না। নারায়ণদেব লৌকিকমঙ্গলকাব্য ফদিলেও সংস্কৃত সাহিত্যে বিশেষ অভিজ্ঞ ছিলেন, তার নানা প্রমাণসমগ্র কাব্যের মধ্যেই ছড়িয়ে আছে। তিনি একট, পুরাণ-ঘেঁষা কবি ছিলেন,লৌকিক মনসাকাহিনীর চেয়ে পৌরাণিক দেব-দেবীর লীলার প্রতি অধিকগুরুত্ব দিয়েছেন। মহাভারত, শৈব পূরাণ, কালিদাসের কুমারসম্ভব প্রভৃতিসংস্কৃত উপাদান থেকে তাঁর দেবখণ্ডের কাহিনী সংগৃহীত হয়েছে। হরপাবর্তীলালায় বহ,স্কলে কুমারসম্ভবের সাক্ষাৎ প্রভাব আছে। রঙ্গব্যঙ্গ ও করুণরসে তাঁর সমান অধিকার বিস্ময়কর, বিশেষতঃ, বাঙ্গের তির্যকতা তাঁর কাব্যের
একটি বিশিষ্ট লক্ষণ। বণিক সম্বন্ধে তাঁর ব্যঙ্গোত্তি চমৎকার :
"""কাক হন্তে সেয়ানা জে বানিয়া ছাওয়াল
বানিআ হন্তেধুত্ত যেই তারে সেই পানি"""
স্বামীর মৃতদেহ সঙ্গে নিয়ে অঞ্চল সমূদ্রে ভাসতে ভাসতে বেহলার বিলাপ খুবেই মর্মস্পর্শী হয়েছে:
""""ভাগ প্রভু কালিন্দী নিশাচরে।
খঁচাও কপট নিম্নাস সাগরে""
প্রভু রে তুমি আমি দুই জন।
তুমি তো আমার প্রভু আমি যে তোমার।
মড়া প্রভু নহ রে তুমি গলার হার ॥
জানে তব সর্বজন ॥"""
চরিত্রসদৃষ্টি, রসবৈচিত্র্য ও কাহিনী গ্রন্থনে নারায়ণদেব বিশেষ প্রতিভার পরিচয়দিয়েছেন। এদিক থেকে তাঁর স্থান বিজয়গুপ্ত ও বিপ্রদাসের চেয়ে অনেকউচুতে। কেউ কেউ তাঁর কাব্যের বিস্তার করণে রস ও চরিত্র-চিত্রণ স্মরণকরে তাঁকে মহাকবি আখ্যা দিতে চান,—এ-সবঅতিভক্তির বাড়াবাড়ি। মধ্যযুগে
একজনও মহাকবি জন্মাননি। মাইকেল মধুসূদন দত্ত ছাড়া বাংলাদেশে, কিমধ্যযযুগ, আর কি আধুনিক যুগ—দ্বিতীয় কোনো মহাকবির আবির্ভাবহয়নি।
এখানে মধ্যযুগের আদিপর্ব' অর্থাৎ প্রাক্চৈতন্যযুগের আলোচনা শেষহল। এই সামান্য পরিচয় থেকে নিশ্চয় বোঝা যাবে, এই যুগে বাংলা সাহিত্যের শুরু হয়েছে, কিন্তু তখনও পরো উৎকর্ষ লাভ হয়নি। পঞ্চদশ শতকের শেষপ্রান্তে চৈতন্যাবির্ভাবের পর থেকে তাঁর প্রভাবে বাংলা সাহিত্যের যে অভূতপূর্বউন্নতি হল, পরের পর্বে আমরা তার সংক্ষিপ্ত পরিচয় দেব।
****তথ্য সংগ্রহ
১.বাংলা সাহিত্যের সম্পুর্ন ইতিবৃত্ত(ড.অসীতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়)
0 মন্তব্যসমূহ