Hot Posts

6/recent/ticker-posts

গৃহদাহ উপন্যাস, গৃহদাহ উপন্যাস (প্রশ্ন/উওর)

 


গৃহদাহ উপন্যাস,  গৃহদাহ উপন্যাস (প্রশ্ন/উওর) ---

পশ্ন ১---

****নিষিদ্ধ প্রেমের বিষয় সংবলিত উপন্যাস হিসেবে 'গৃহদাহ' শরত্চন্দ্রেরসর্বাপেক্ষা তাৎপর্যপূর্ণ উপন্যাস। আলোচনা কর।

****প্রচলিত সামাজিক মূল্যবোধের বিরুদ্ধে 'গৃহদাহ' এক সুস্পষ্ট প্রতিবাদ।আলোচনা কর।


***শরৎচন্দ্রের উপন্যাসে যদি মনন ও হৃদয়াবেগের কিছুটা সমন্বয় হয়ে থাকে তা হল গৃহদাহ -ব্যাখ্যা কর।

****উপন্যাস হিসেবে 'গৃহদাহ'র সার্থকতা বিচার কর ।


উত্তর ---

শরৎচন্দ্রের সৃষ্টিতে 'গৃহদাহ'র একটি বিশিষ্ট স্থান আছে। সাধারণভাবে বস্তুবাদএবং আদর্শবাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব শরৎচন্দ্রের উপন্যাসে একটা পরিচিত বিষয়। এ দু'য়েরসংঘাত শিল্পীসত্তাকে নানাভাবে আক্রমণ করেছে, অথচ বাস্তববাদী বলে তাঁর খ্যাতি সমগ্রবাংলা সাহিত্যে বিদ্যমান। যে তৃপ্তি বাঙালি পাঠককুলে বঙ্কিমচন্দ্রে মেলে নি, রবীন্দ্রনাথেওনা- সেই ঘরের কথা, তুচ্ছাতিতুচ্ছ জীবনবোধের কথা, নিত্যদিনের গ্লানি লাগা সত্যগুলো

স্পষ্ট হয়ে উঠেছে তাঁর রচনায়।

যে উপন্যাসগুলোতে শরৎচন্দ্রের অভিনবত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করে তার মধ্যে 'গৃহদাহ'অন্যতম। কল্লোল ও কল্লোল-উত্তর ঔপন্যাসিকদের দিক পরিবর্তনের প্রতীক হয়ে দেখাদিয়েছিল উপন্যাসটি। নিগূঢ় মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস 'গৃহদাহ' শ্রেষ্ঠ উপন্যাসের গুণসমন্বিত।নারী মনস্তত্ত্ব, নারী মনের প্রেমবাসনা গৃহবাসনা, তার ত্যাগ-তিতিক্ষা শরৎচন্দ্রের অধিকাংশউপন্যাসের বিষয়বস্তু। কিন্তু অটবিস্তৃত মনোলোকের গভীরতা সর্বত্র বর্তমান নয়।গৃহদাহের অচলা শরৎচন্দ্রীয় নারীর গণ্ডির বাইরে বেরিয়ে এসেছে। শুধু বিবাহিত নারীরঅন্য পুরুষের আসক্তি নয়, অন্য পুরুষকে নিয়ে সারাজীবন চলার বাসনা, দু’পুরুষেরআকাঙ্ক্ষার সম্পূর্ণতা তাকে স্বাতন্ত্র্য দান করেছে। যে ইচ্ছে কোন কোন নারীর জীবনে সত্য,অথচ প্রকাশের সুযোগ বা সাহস নেই, সেই সুযোগ ও সাহস দুই-ই তৈরি করে নিয়েছেএক নারী তার একক সামর্থ্যে। এক পুরুষ একাধিক নারী নিয়ে ঘর করে, সেটা না পারলেওঅচলা দুই পুরুষকে ভালবাসতে সমর্থ হয়েছে।

আধুনিক নারী যখন বলে,

 “আমরা কেন দু’পুরুষকে বিয়ে করতে পারব না। ঠিক আছে আমরা দু'জনকে ভালবাসব।"

অচলা সেই আধুনিক নারীর

অগ্রপথিক। এ জাতীয় চরিত্রশাংসাহিত্যে প্রথম এবং একক। এ উপন্যাসে সুরেশ ও মহিম দুই চরিত্রকে নির্মাণহয়েছে বিপরীতমুখী চরিত্র হিসেবে। আবার মৃণাল ও অচলা দুই মেরুর দুই নারী চরিত্র।সৃষ্টি নয়, সমতা উপন্যাসটিই অভিনব। এর কাহিনী, মূল মনস্তত্ত্ব,নারী স্বভাব,ঘটনা পরিবেশ, একের পর এক আছড়ে পড়া ঘটনার প্রবাহ সচকিত করে দেয়ার বিষয়টিআগডুক। আকস্মিকভার ফলে উপন্যাসটি নাটকীয়তাপ্রাপ্ত হয়েছে। উপন্যাসটির পরতেকরতে অপেক্ষা করে আছে বিষয়। যেমন- ব্রাহ্ম বিদ্বেষী সুরেশের ব্রাহ্ম অচলাদের বাড়িযাওয়া, সেখানে খাওয়া। মহিমের হাতে অচলার আংটি পরানো। অচলার দাম্পত্য জীবনেসুরেশের রাজপুরে যাওয়া, মহিমের ঘরে আগুন লাগা, বায়ু পরিবর্তনের সময় সুরেশকেসাথে নেয়া, মোগলসরাইতে অচলাকে নিয়ে সুরেশের নেমে পড়া, মৃত্যুর পূর্বে মহিমেরকাছে সুরেশের দলিল হস্তান্তর। আকস্মিকতার কারণে উপন্যাসে চমৎকারিত্বের সৃষ্টিহয়েছে। পর মুহূর্তে কী ঘটবে তা পূর্বে আদৌ আঁচ করা যায় না। ব্যক্তি বা পরিবেশেরপ্রভাবে কেন্দ্রীভূত বিষয় নতুন বাঁক নিয়েছে। স্তম্ভিত করে দেয়ার মত পরিবেশ, ফলেচরিত্রসমূহ পাক খেতে শুরু করে ঘটনার পরিবেশের অভিঘাতে। খুব সূক্ষ্ম ওবিবেচনাপ্রসূত ছকের মাধ্যমে ঔপন্যাসিককে সৃজনকর্মে ব্যাপৃত থাকতে হয়েছে। মূলকাহিনীর সাথে উপকাহিনীর মেলবন্ধন ঘটেছে অদৃশ্য সুতার টানে, ঘটনার আকস্মিকতারসাথে পরস্পর সংযোজিত হয়েছে অনিবার্যভাবেই।

বিবাহিত নারীর অন্য পুরুষে আসক্তি, বন্ধুপত্নীকে ঘিরে ত্রিকোণ প্রেম এগুলো সবইপুরনো বিষয়, কিন্তু উপস্থাপনার বিশেষত্বে তা গৃহদাহে অভিনব ও আপন গৌরবেসমুজ্জ্বল। বাংলা উপন্যাসের লালিত আবেগকে মস্তিষ্কের নৈকট্যে আনার দায়িত্বনিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। শরৎচন্দ্র সম্পূর্ণভাবেই আবেগসম্ভূত। “গৃহদাহ' উপন্যাসেআবেগের বাহুল্য বর্তমান, তথাপি যথেষ্ট মনস্তাত্ত্বিক প্রক্রিয়ার প্রয়োগে উপন্যাসটি আবেগও মস্তিষ্কের সমন্বয়ে নতুন ধরনের সংযোজন সন্দেহ নেই। এ বিষয়ে গৃহদাহ শরৎ আকাশেমধ্যাহ্ন সূর্যের মত একাকী ও আপন মহিমায় সমুজ্জ্বল।

উপন্যাসের পরিণতি বিষয়ে যতই সন্দেহ থাকুক, সমগ্র উপন্যাসের কায়া গঠনে দুর্লভ।কৃতিত্বের পরিচয় যে লৈখক দিয়েছেন তাতে সন্দেহ নেই। গৃহদাহ বিষয়টি ঘটনাসূত্রেএসেও তা প্রতীকী তাৎপর্যমণ্ডিত। অসুস্থ মহিমকে সুস্থ করার মধ্য দিয়ে দাম্পত্য জীবনেরসরলতা দেখিয়ে সহজ কাহিনী নির্মাণ করা যেত। কিন্তু জব্বলপুরের যাত্রা ডিহরীতে এসেপৌঁছলে সমস্ত কাহিনী নতুন বাঁক নিল। অসুস্থ মহিম রইলো সেবার বাইরে চলন্ত গাড়িতে,বিপথগামী দুই নর-নারী, উদভ্রান্তি বিচিত্র পথগামী করে তুলল তাদের, ছিন্ন হল গৃহডোর,পুষ্পিত বৃক্ষে ঝড় বয়ে গেল। সুরেশ ভেবেছিল শরীর টানলে মন কাছে আসে, আসলে তানয়। এ সভ্য ভাস্বর হতে হতে উপন্যাসে জটিলতা ও বৈচিত্র্য এসেছে এবং ট্র্যাজিক যন্ত্রণাভাবাবেগের পথ ছেড়ে নতুন খাতে প্রবাহিত হয়েছে।

শরৎ উপন্যাসে গৃহদাহ-এর পূর্বে নারী কখনো নিজেকে পুরুষের সমান ভাবতে পারে নি।নিজেদেরকে সংসারে দ্বিতীয় শ্রেণীর জীব বোধ করেছে। কিরণময়ীর মত নারীও উপেনেরভালবাসায় বেঁচে থাকতে চেয়েছে। না পেয়ে নিজের সর্বনাশের পথ প্রশস্ত করেছে। কিন্তুঅচলার ক্ষেত্রে তা ঘটে নি। অচলার আকাঙ্ক্ষার কথা শিল্পী বলতে পেরেছেন। নিশ্চিতনীড়ের সম্ভাবনাকে ধূলিসাৎ করে উত্তেজনা উদ্দীপক অসংযমী প্রেমের দিকে ধাবিত।এখানেই গৃহদাহ শরৎ উপন্যাসে দলছুট ও একক। জীবনভর দুই পুরুষের মধ্যে তারচলাফেরা অর্থাৎ পেণ্ডুলামের মত তার দোলায়মানতা তাকে স্থিতি দেয় নি। একের আশ্রয়েথেকে অপরের জন্য মন তার কেমন করেছে। এ বিষয়টি উপন্যাসটিকে পৃথক গুরুত্বেরদাবিদার করে এবং নিষিদ্ধ প্রেমের বিষয় সংবলিত উপন্যাস হিসেবে আলাদা জাতেরশিল্পকর্ম হয়ে গৃহদাহ সমস্ত শরৎসাহিত্যের ধারায় আপন বৈশিষ্ট্য উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।'গৃহদাহ' উপন্যাসে শিল্পী-মনন ও হৃদয়াবেগের সমন্বয় ঘটিয়ে কাহিনী, উপকাহিনী,কেন্দ্রগত হয়, উপন্যাসের পরিধি বিস্তৃতি একপয়ে একতালে সম্পূর্ণতা লাভ করেছে।নিঃসন্দেহে এ উপন্যাসের মূলকাহিনী মহিম, অচলা ও সুরেশকেন্দ্রিক। উপকাহিনীর প্রয়োজনীয়তার দাবি মিটিয়েছে মৃণালের কাহিনী। তবে এখানে উপকাহিনী মূল কাহিনীর মিনি সংস্করণ উপকাহিনীর শক্তির উপর মূল কাহিনী দাঁড়িয়ে। অচলার দাম্পত্য জীবনেধূমকেতুর মত মৃণালের আবির্ভাব ঘটলেও অচলার জীবনের দোলাচল ও ট্র্যাজেডির বীজমৃণালের মধ্যেই উত্ত ছিল। মৃণালের ঠাট্টা তার তারিখবিহীন চিঠি কাহিনীর মূল ঘটনাকেকীভাবেই না নিয়ন্ত্রণ করে। তাছাড়া প্লট যেখানেই শিথিল হবার উপক্রম হয়েছে সেখানেইনাটকীয় আকস্মিকতা ব্যবহার করে শিল্পী কাহিনীর বুনন ঋদ্ধ করেছেন। চরিত্র এবংকাহিনীকে শিল্পী ব্যাখ্যা করেছেন নাটকীয়ভাবে। মানুষের জীবনে নিয়তির ভূমিকাকেঅভ্রান্ত করেছেন প্রাকৃতিক পটে।গতিসম্পন্ন সরল গদ্য ভাষা নির্মাণে শরৎচন্দ্র যে অনন্য, তা তাঁর বড় শত্রুও স্বীকারকরবেন। এই সহজতা গঠন সৌকর্যের পরিপন্থী, কিন্তু সরলকথা সরল পদ্ধতিতে বলারমধ্যে যে অহংকার আছে, সে গুণে ঋদ্ধ শরৎচন্দ্র। অচলার জটিল মনোজগৎ, সুরেশেরআবেগ আধিক্য, উচ্ছ্বাস বাহুল্য, সংযমহীনতা, মহিমেরস্বল্পবাক প্রভৃতি চরিত্রানুগ ভাষাব্যবহার করার সাথে সাথে প্রয়োজনীয় পরিবেশ নির্মাণে তার শব্দের খেলা মনোরম ওচমৎকারিত্বের দাবিদার।উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়- কাহিনী-উপকাহিনীর বিন্যাস, মনস্তাত্ত্বিকজটিলতা, ভিন্নমুখী চারিত্রিক মুখিনতা, ভাষা প্রতিবেশ প্রভৃতি বিষয় বিবেচনায় শরৎচন্দ্রের'গৃহদাহ' শরৎ সাহিত্যের অনবদ্য সৃষ্টি নিঃসন্দেহে।।।

॥ 'গৃহদাহ' উপন্যাসের নামকরণের সার্থকতা বিচার কর।


উদ্ভর শিল্পের নামকরণ নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ ও মনন-সাত। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন

নামকে যাঁরা নামমাত্র মনে করেন আমি তাঁদের দলে নই। তথ্য নামকরণের উপর তিনি

বিশেষ প্রযত্নে বিশ্বাসী। নামকরণ এমন হওয়া প্রয়োজন যা থেকে সৃষ্টিকর্নের চেহারাটা

বুঝা যায়। আয়নায় যেমন নিজের প্রতিবিধ বিঘ্নিত হয়, নামকরণেও তেমনি শিল্পের মৌল

উপজীব্য বিঘ্নিত হয়। তাই শিল্প সাহিত্যের ভেতরকার আহ্বানটির দিকে মনোযোগ রেখে

নামকরণ করাই শিল্পসম্মত। মূলত নামকরণ একটা শিল্পায়ন।


শরত্চন্দ্র মনে করেন বিষয়বস্তুর সাথে নাম বদলায়, ছাঁদ বদলায়। তাঁর শিল্পের নামকরণ

বেশ তাৎপর্যবহ। চরিত্রহীন, তাই চরিত্রবানের উপন্যাস; পথের দাবিতে দাবি আছে পথ

নেই, শেষ প্রশ্নে. প্রশ্ন উঠেছে বিস্তর সাথে সাথে আছে উত্তর। গৃহদাহ উপন্যাস কেবল

শহরে নয়, বাংলা উপন্যাস সাহিত্যের মধ্যে বিশেষ অভিধায় চিহ্নিত।

গৃহদাহ উপন্যাসের যে গৃহ অনেকটা সুরেশের জন্য নষ্টনীড়ে পরিণত হয়েছিল,

পরিণতিতে এসে তা আর পুরোপুরি নষ্টনীড় থাকে না। অচলা মহিমের হাত ধরে বলেছে,


“আমি আর দুর্বল নই, তোমার হাত ধরে যত দূরে বল যেতে পারব।”


গৃহদাহ উপন্যাসে শিল্পী দেখাতে চেয়েছেন দুই পুরুষ ও এক নারীর ভুলের জন্য একটিদাম্পত্য জীবনের স্বপ্ন চুরমার হয়ে গেল। বহু কাঙ্ক্ষিত নীড় ভুলের তীব্র স্রোতাঘাতেবিধ্বস্ত হয়ে পড়ে।মহিম ও সুরেশ উভয়ই অচলার হৃদয়ে ঠাঁই নেয়। মহিমকে স্বামী হিসেবে গ্রহণ করার পরঅচলা মহিমের বাড়িতে যায় (একবার মাত্র); সুরেশও সেখানে গিয়ে হাজির। মহিমের ঘরেসে সময় হঠাৎ রাতে আগুন লাগে। সে আগুনের বিকিরণ দেখা যায় সুরেশের চোখেমুখে,অচলার দ্বৈধ সত্তায়, মৃণালের লেখায়, মহিমের নির্লিপ্ত দার্শনিকতায়।মহিম যখন আগুনের ভেতর ঘরে ঢুকে অচলার গহনার বাক্স আনতে উদ্যত তখন অচলামাহিমের হাত ধরে বলল কিছুতেই ওর মধ্যে তোমাকে আমি যেতে দেব না। আগুন ওধোঁয়ার মধ্যে মহিমকে আগুনে ঝাঁপ দিতে নিষেধ যেমন সত্য, তেমনি সত্য মহিমেরদেখাদেখি সুরেশ যখন আগুনের মধ্যে যেতে পা বাড়ায় তখন অচলা সুরেশের কোঁচার বুটধরে তাকে কঠোরভাবে নিষেধ করে বলে, "আপনাকে যেতে আমি কোন মতেই দেব না।শিল্পী পরোক্ষভাবে নাহের ইতিহাস হিসেবে ওই সংকেতটুকুই আমাদের দিয়েছেন মাত্র। এউপন্যাসে গৃহদাহ ঘটনাটি আকস্মিক। গ্রামবাসীরা ঘরে আগুন দেয় নি কারণ মহিমেরসাথে এমন কোন শত্রুতা গ্রামবাসীর নেই, সুরেশও আগুন দেয় নি বলেই আমাদেরধারণা। সে ধারণা মহিমেরও। কারণ মহিম সুরেশকে বলেছে, 

“যাকে ক্রাইম বলে, সে

আমি কোনদিন করতে পারব না বলে আজও আমি বিশ্বাস করি, মহিমেরও এ ধারণাঅমূলক নয়।” যদিও অচলা সুরেশকে বলেছে, “তুমি সব পারো। আমাদের ঘরে আগুনদিয়ে তুমি তাকে (মহিম) পুড়িয়ে মারতে চেয়েছিলে।” 

অচলার এ সংলাপ হঠাৎএ উত্তেজনারই ফল। সুতরাং সুরেশ ঘরে আগুন দেয় নি একথা অনস্বীকার্য।

উপন্যাসের মাঝামাঝি স্থানে মহিমের ঘর পুড়িয়ে দিয়ে লেখক কাহিনীর প্রথম পর্বেরঘটনাবলির একপ্রকার ছেদ টেনেছেন। উপন্যাসের ভূগোল বদলে দিয়েছেন। একটু লক্ষ্যকরলে দেখা যাবে গৃহদাহের পরই মৃণালের স্বামীর মৃত্যু। 'গৃহদাহ' পরিকল্পনার মধ্য দিয়েশরত্চন্দ্র তিন চরিত্রের নাটকীয় পরিবর্তনের ধারাটি অব্যাহত রেখেছেন।

মহিমের গ্রামের বাড়িতে খড়ের ঘরে আগুন লাগা বাহ্যিক ব্যাপার। মূলত মহিমের গৃহজতুগৃহ হয়েছিল তার বিয়ের কিছু আগে, বিয়ের অব্যবহিত পরে অচলাসহ গ্রামের বাড়িতেআসার পর সেখানে সুরেশের আগমনে, মহিমের সাথে মৃণালের পূর্ব সম্পর্কের উল্লেখ করে গ্রাম্য কুষ্টিকর কথাবার্তা মৃণালের চিঠিতে, দাম্পত্য কলহে উত্তপ্ত হৃদয়ে আগুন লেগেছে।মহিমের মীর্ঘ কুটিরটিকে পুড়িয়ে শিল্পী পাঠককে অত্যন্ত মোটা দাগে একটা ইঙ্গিতদেয়ার চেষ্টা করেছেন এবং নিঃসন্দেহে তাতে অনেকটা সফল হয়েছেন। গৃহদাহের জন্যনারী মূলত অংগার মন। অচলা মহিম সুরেশ উভয়ের প্রতি আকর্ষণ অনুভব করে।অচনা কখনো তার মনকে স্থির করতে পারে নি। মহিমকে যেমন টেনেছেসুরেশকেওতেমনি। তার মানসিক দোলাচল বৃত্তির কারণে ছোট ছোট ভুল তার গৃহদাহের কারণঅচলা কোনদিনই স্থিরচিত্ত ছিল না। সে নিজেকে স্পষ্ট চিনতে পারে নি কখনো। সুরেশেরমৃতদেহ সৎকারের পর মহিম অচলাকে জিজ্ঞাসা করেছিল "এখন তুমি কি করবে।ইন্নাদনের মত আলা বলেছিল, আমি? আমি ভেবে পাইনে। আসলে অচলা তারনিজেকে চিনতে পারে নি। সুরেশের মতে সে ভালবাসত মহিমকে, কিন্তু অচলা তা বুঝতেপারে নি। সুরেশের বিত্ত বৈভব, মহিমের নীরবর্তা ও দরিদ্র মৃণালের চিঠি, "সেজদা শাযো! করছ কিন্তু পরশু থেকে তোমার পথ চেয়ে তোমার মৃণালের দুটি চোখ ক্ষয়ে গেল যেরামবাবুর অনুরোধ সব মিলিয়ে অচলার জীবনটা কিরকম যেন গুলিয়ে ওঠে। আমাদেরপ্রশ্ন জাগে অৰ্চনার এই অস্থির ও ঘোলাটে জীবন কী গৃহদাহের মূল ভিত্তি নয়,মূলত দাহ অচলার হৃদয়ে। অচলার দোলাচল বৃত্তিতে। ড. নীলিমা ইব্রাহিম বলেন যে,অচনা চরিত্রের দ্বৈধ সত্তাকে অবলম্বন করেই এ উপন্যাসের আরম্ভ ও সমাপ্তি। আরএকটু এগিয়ে বলা যায় এ উপন্যাসে অচলার গৃহদাহ হয়েছে। তবে বাহ্যিক গৃহদাহের

অন্তরালে অচলার হৃদয়েরই দাহ ঘটেছে।দিগদর্শন যন্ত্রের কাঁটার মত অচলার মন একদিকে কখনো স্থির থাকে নি। মহিম ও সুরেশদুই প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বীর আকর্ষণে অচলার মন দ্বিধার দোলায় সর্বদাই দোদুল্যমান। একদিকেমহিমের শান্ত, একান্ত ভাবাবেগহীন, প্রস্তর কঠিন আবেদন, পুত্তুরে সুরেশের ব্যায় ব্যাকুলউন্মুক্ত আবেগ- এই দুই বিরুদ্ধ শক্তির মাঝে অচলার হৃদয় দ্বিধাবিভক্ত।সুরেশের প্রতি পিতার পক্ষপাত ও মহিমের প্রতি সম্মুখ অবজ্ঞায় অচলা মহিমের হাতেনিজেকে সমর্পণ করে দেয়। কিন্তু পল্লীগ্রামের নির্বাসন দুঃখ, পল্লী সমাজের নিরানন্দ

পরিবেশ, মৃণাল ও তার স্বামীর সম্বন্ধে তার কদর্য সন্দেহ, সর্বোপরি মহিমের নিঃসন্দেহ,কঠোর কর্তব্যপরায়ণ তামূলক ব্যবহার, পল্লীভবনে সুরেশের অনাহূত আগমনে স্বামী-স্ত্রীর

সম্পর্কে দাহের সৃষ্টী।

উপন্যাসে বলা যায় চারটি প্রধান চরিত্র। মহিম, সুরেশ, অচলা ও মৃণাল। সুরেশ বিশালধনী সুরম্য অট্টালিকায় বাস করে বটে কিন্তু সারাজীবনে তার ঘর বাঁধা হল না। মহিমদরিদ্র, রাজপুর পল্লীতে তার জীর্ণ ঘর, তবে অচলাকে বিয়ে করে সে ঘর বাঁধতেচেয়েছে অচলা ঝোঁকের মাথায় তা করলেও ঘর তাদের করা হয় নি। স্বাভাবিক নারীরজীবনে স্বামী-সন্তান নিয়ে ঘর বাঁধার যে স্বপ্ন তা অচলার দোলাচল বৃত্তিতে বিনষ্ট হয়েছে।সে পেন্ডুলামের মত একবার মহিমের দিকে আবার সুরেশের দিকে ঝুঁকেছে। সত্যি বলতেব্যসনার সোনা দিয়ে যে ঘর নির্মাণ তা তার হয় নি। মৃণাল মহিমকে ছেলেবেলা থেকেইভালবাসে কিন্তু সে ঘর করেছে এক মৃত্যুপথযাত্রী বৃদ্ধের সাথে। মূলত এ উপন্যাসেসবগুলো প্রধান চরিত্রেরই গৃহদাহ হয়েছে নানা কারণে।

অচলা নির্ভর গৃহদাহ উপন্যাসটির নামকরণ মূলত অচলাকে ঘিরেই। অচলার জীবনে কোনপ্রভাব নেই আছে শুধু অন্ধকার, নিঃসীম শূন্যতা। অচলা ক্ষতবিক্ষত। সম্ভার গভীরেপ্রত্যেক নারীর মধ্যে গৃহের একটা স্বপ্ন থাকে, সে স্বপ্ন অচলার ভেঙে চুরমার। অচলা সূর্যেরদিকে তাকিয়ে সূর্যমুখী হতে পারে নি। ফুল আর পাথরের মধ্যে সে ফুল চিনতে পারে নি।অচলা না পেল বর, না পেল ঘর। দুই মেরুর আকর্ষণে অচলা তছনছ হয়ে গেছে। অচলারভয়ংকর নিঃসঙ্গতায় উপন্যাসের পরিসমাপ্তি ঘটেছে।উপন্যাসের কাহিনীতে মহিমের গৃহে আগুন লেগেছে। নামকরণের ব্যাপারে ঘটনাটিতাৎপর্যপূর্ণ হলেও গৃহদাহ নামের প্রতীকী অর্থটি লেখকের অভিপ্রায় ছিল। 'গৃহদাহ'নামকরণে শিল্পী বিশেষ এক বাজনা ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছেন। অচলার দোলাচলতার মধ্যেগৃহদাহের বীজটি কাহিনীর শুরুতেই বপন করা হয়েছে। মহিমের ঘরে আগুন লাগতে সেইবীজটির পুষ্টি সাধন হয়েছে।উপন্যাসের অন্তিম পরিণতিতে সুরেশের মৃত্যু। অচলার অসহনীয় অস্তিত্বের মধ্যেগৃহদাহের তীব্র জ্বালাময় অনুভূতি পাঠকের মনেও সংক্রামিত Doing এবং Suffering

তার যে অভিজ্ঞতায় উপন্যাসের পরিসমাপ্তি ঘটেছে তাতে উপন্যাসের নামকরণটি অর্থবহতাৎপর্যমণ্ডিত হয়েছে সন্দেহ নেই। মৃণালের মুখে অচলার আশ্রয় পাবার একটা কথা শোনাগেলেও গৃহদাহের আঁচ থেকে পাঠক কখনই মুক্তি পায় না। এখানেই উপন্যাসেরনামকরণের বিশেষ সফলতা।


প্রশ্ন ৩---


****শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের 'গৃহদাহ' উপন্যাস অবলম্বনে সুরেশ চরিত্র

অঙ্কন কর।


****'গৃহদাহ'র সুরেশ দুর্বল চরিত্র হিসেবে চিত্রিত আলোচনা কর।

উত্তর ----

ধনীর বেখেয়ালি সন্তান, পিতৃমাতৃহীন সুরেশ পিসির কাছে মানুষ। সে ডাক্তার।আবাল্য বন্ধুবৎসল সুরেশ বন্ধুত্বের জন্য জীবন পর্যন্ত দিতে পারে। সে ভগবান মানে না,অর্থাৎ নাস্তিক। কিন্তু সমাজের প্রতি শ্রদ্ধাশীল এবং মানুষকে পূজা করে। পরের জন্য তারমাথাব্যঘাটা উৎকট। সে যাকে ভালবাসে তার বিপদে কাজ্ঞান থাকে না, তার জন্য কীকরতে পারে তা কল্পনা করাও কঠিন। তার গায়ে জোর ছিল অসাধারণ। অন্যদিকে অন্তরটাছিল কোমল ও স্নেহশীল। তবে সে অসংযত, অসংযমী ও খামখেয়ালি মেজাজের। সেকোন কিছু গোপন রাখতে পারে না। তার বাইরেরটা ভারি শক্ত হলেও ভেতরটা বড্ড

ডাক্তার হলেও তাকে একবার মাত্র পত্রিকার পাতায় খবর হিসেবে ডাক্তারি করতে দেখাযায়। ফয়জাবাদ শহরে প্রজ্বলিত ঘরের মধ্যে আটকেপড়া স্ত্রীলোককে বাঁচাতে সুরেশনিজের প্রাণ তুচ্ছ করে আগুনে ঝাঁপ দেয় এবং সেখানকার প্লেগে অর্থ দিয়ে, ঔষধপথ্যদিয়ে, দেহ দিয়ে রোগীর সেবা করে। তাই অচলার বাবা কেদারবাবুর কাছে সুরেশমহৎপ্রাণ এবং দেবতা। সুরেশের প্রতিপালিকা পিসি বলেছে, "সুরেশ কারুর দুঃখকষ্ট,

কারুর আপদবিপদ সহ্য করতে পারে না।"

আবাল্য বন্ধু মহিম। মহিমকে সে নানাভাবে সাহায্য করেছে। দু' দু'বার মরার হাত থেকেবাঁচিয়েছে। এবার ব্রাহ্ম মেয়ে অচলার হাত থেকে হিন্দু ব্রাহ্মণ বন্ধুকে বাঁচাতে গিয়ে নিজেইঅচলার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়েছে। ব্রাহ্ম সমাজ সম্পর্কে তার একটা বিরূপ ধারণা ছিল।সেটা অচলার কারণে অনায়াসেই কেটে গেছে। নেশাগ্রস্তের মত তার দেহমন টলতে শুরুকরেছে। সামান্য পরিচয়েই অচলা তার মনে ভূমিকম্পের সৃষ্টি করেছে। সুরেশ অচলাকেবলেছে, “অচলা একটিবার ভূমিকম্পের এই প্রচণ্ড স্পন্দন নিজের দুটি হাতে অনুভব করে।দেখ কি ভীষণ ভাঙব এই বুকের ভেতরটায় তোলপাড় করে বেড়াচ্ছে। এটি পৃথিবীর কোনভূমিকম্পনের চেয়ে ছোট? বলতে পার অচলা, পৃথিবীতে কোন জাতি কোন ধর্ম কোনমতামত আছে, যা এই বিপ্লবের মধ্যে পড়ে ও ডুবে রসাতলে যাবে না। ব্রাহ্মবিদ্বেষীসুরেশ ব্রাহ্ম বাড়িতে খেতে রাজি হয়েছে। তারস্বরে সে আত্মপ্রচার করেছে, "জানো অচলা

দিন ঘণ্টা মিনিট দিয়ে মাপা যায় কিন্তু সুরেশকে যায় না। সে স্থান কালের অতীত।”

নারীলোলুপ সুরেশ নারীর রূপে তলিয়ে যাওয়া এক রসাতলগামী চরিত্র। টাকায় সেপছন্দসই নারীমাংস কিনতে প্রস্তুত। অপারগতায় সে টাকার জন্য হীন, নীচ ও জঘন্যআবার সে দক্ষ অভিনেতাও। একটু সহানুভূতি, একটি প্রিয়বাক্যে সামান্য করুণ কথাতেইসরেশ চোখের জলে বিগলিত হতে পারে। সে অচলাকে জানিয়েছে যে সে বড় দুর্বল, বড়আঘাত সে সইতে পারে না, তার বুক ফেটে যায়। অচলা তার নয়, অন্য কারও, অচলাকেপারে না মনে হলেই তার পায়ের নিচের মাটি পর্যন্ত যেন টলতে থাকে।এমনি এক স্ববিরোধী চরিত্রের অধিকারী সুরেশ গৃহদাহে বিস্তার লাভ করেছে। শরৎচন্দ্র

তাঁর রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসে প্রভাবিত হয়ে তাঁর উপন্যাসের বিভিন্ন কাহিনী ও চরিত্র নির্মাণকরেছেন। সেদিক বিচারে সুরেশ 'ঘরে বাইরে' উপন্যাসের সন্দ্বীপের আদলে গড়া। তবেসন্দীপের বাকচাতুর্য, সুগ্ম রসবোধ, ক্ষুরধার উপস্থিত বুদ্ধি, সম্মোহন ক্ষমতা সুরেশেঅনায়ও। সুরেশের আবেগ অভিমান, গায়ের জোব, অসংযম, অশ্রুসিক্ত আঁখি, হ্যাংলামিসবই মোটা তুলিতে আঁকা।সত্যি সত্যি সুরেশ যদি সময়ের মাপকাঠিতে মাপার ঊর্ধ্বে অধিষ্ঠিত হতো, তবে সে হতোউচ্চাঙ্গ ও শ্রেষ্ঠ চরিত্রের অধিকারী। তাকে নিয়ে গর্ব করা যেত যদি সে সত্যিই ভূমিকম্পের

মত্ত আগ্রাসী হতো সর্বস্তরে। কিন্তু তার চরিত্রের প্রধান দুর্বলতা বা নীচুতা এখানে যে, সে

অচলাকে চুরি করেছে, ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে ডিহরীতে নিয়েছে।তার এ নীছড়া পূর্বেই আভাসিত। বন্ধুর হবু স্ত্রীকে পাবার জন্য মহিম সম্পর্কে নানা অপবাদ

দিয়ে শেষে অচলাকে বলেছে- "ভাকে (মহিমকে) নিয়ে আপনি কি সুখী হতে পারবেন?”অতঃপর কোন ভূমিকা ছাড়াই সে অচলাকে দাবি করেছে।পাবে না বলে তার পায়েরনিচের মাটি পর্যন্ত টলেছে এমনি দুর্বল সে। অচলার বিয়েরপর নির্লজ্জের মত সে মহিমের

গ্রামের বাড়িতে গিয়ে হাজির হয়েছে। সেখানেও ভিখেরির মত, হ্যাংলার মত অচলাকেডিতে চেয়েছে। আবার মহিমের বন্দুককে সে ভয় পেয়েছে। সে এজিদের মত দয়িতাকেপাবার জন্য বীরদর্পে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয় নি। তাই সুরেশের ভালবাসায় কোন মহত্ত্ব নেই,নেই শৌর্য-বীর্য তার চরিত্রের মৌল উপপাদ্য কাপুরুষতা।শিল্পী সুরেশ চরিত্রকে প্রত্যাশিত লক্ষ্যে পৌঁছে দিতে তার তিনটি যোগ্যতা দিয়েছেন


(i) সুরেশের অর্থবিত্ত। ঈঙ্গিত লক্ষ্যে পৌঁছতে সে অর্থকে বেহিসাবির মত খরচ করতে

পারে। (ii) বালকসুলভ সরলতা ও সামান্যতেই চোখে জল আনার ক্ষমতা।

(!!!) পরোপচিকীর্ষা-ফয়জাবাদ মাঝুলিতে সেবা করার ঝুঁকি নেওয়া। যখনই সুরেশ তার

অভীষ্টচ্যুত হয়েছে তখনই প্রয়োজন অনুসারে উপর্যুক্ত তিনটি উপকরণের একটি ব্যবহার

করেছে।

সুরেশের শক্তি, তার করুণা, বন্ধুবাৎসল্য উপন্যাসে উচ্চারিত হলেও তা অনালোকিত।সুরেশ যত কথাই বলুক না কেন তার অধিকাংশই প্রগলভতা। তাছাড়া তার কথা ও কাজেবৈপরীত্য স্পষ্ট। নিজেকে নিয়ে যতই সে সাফাই গাক না কেন, আসলে সে অচলাকে বুঝেনি। তার মনে হয়েছে অচলা ছলনাময়ী, পাষাণ প্রতিমা। কিন্তু অচলাকে ভোগ করার ইচ্ছেতার প্রবল। নিষাদের (ব্যাধ) ফাঁদে যখন অচলা ধরা দেয় নি তখন সে চৌর্যবৃত্তির আশ্রয়

নিয়েছে। অচলাকে হরণ করার পর হিস্টিরিয়া রোগীর মত সুরেশ ঠকঠক করে কেঁপেছে।

মুখে যা আসে তাই বলেছে। অচলাকে সামলে নিতে সুরেশ বলেছে, "আমি ব্রহ্মজ্ঞানী নই,আমি নাস্তিক। আমি পাপপুণ্যের ফাঁকা আওয়াজ করিনে, আমি নিরেট সত্যিকার সর্বনাশেরকথাই ভাবি।" "ময়ূরপুচ্ছ পাখায় গুজে দাঁড়কাক কথনো ময়ূর হয় না অচলা। ও চাহনিআমি চিনি, কিন্তু সে তোমাকে সাজে না। যাকে সাজতো, সে মৃণাল, তুমি নও।

“আসলে তুমি একটা গণিকা, তাই তোমাকে ভুলিয়ে এনেছি।" সুরেশের এসব কথা কেবলনিজের দুর্বলতা ঢাকবারই উপায়।

এ পর্যন্ত সুরেশ চরিত্রের যে অর্থই হোক এক ধরনের স্পন্দন ছিল। কিন্তু এরপর তার চরিত্রও আচরণ আর কোন জটিলতার মধ্যে প্রবেশ করে নি। সে আর অচলার কাছে ঘেঁষতেসাহস পায় নি বরং অচলাকে একা ফেলে ডিহরীর পথে পথে ঘুরে বেড়িয়েছে। হঠাৎআকস্মিকভাবে অচলাকে একা পেয়ে চুম্বনে চুম্বনে তাকে বিবশ করেছে। রামবাবুরসহায়তায় ঝড়জলের রাতে অচলাকে সুরেশ নিজের বিছানায় পেয়ে ঘটিয়েছে দেহমিলনের সর্বনাশটি। অতঃপর অচলা তার কাছে হয়ে উঠেছে ভূতের বোঝা। আত্মহননেরপথ বেছে নিয়েছে সুরেশ। আত্মহত্যা দুর্বল চরিত্রেরই পরিচায়ক। মৃত্যুর মধ্য দিয়েও সেআত্মপ্রচার চেয়েছে। ফয়জাবাদের মত মাঝুলিতেও সেনিজের প্রচার চেয়েছিল। তাই

অচলার হাতে উইল তুলে দিয়েও সে বলেছে- টাকা সম্পত্তি বিলিয়ে দিয়েছে। এ মূলতনার্সিসাসের একটা দিক। সত্যি সত্যি সুরেশ মহিমকে তো ভালবাসেই নি, এমনকিঅচলাকেও না। সে ভালবেসেছে নিজেকে, আর অচলার দেহকে।

উপন্যাসে সুরেশ ডাক্তার হলেও ডাক্তার হিসেবে তার তেমন সক্রিয়তা নেই। শিল্পী তাকেযুবক বললেও সে কখনো বা প্রৌঢ়। সুরেশকে শিল্পী কখনো বলেছেন হিন্দু, কিন্তু অচলাকেসুরেশ নিজে বলেছে সে নাস্তিক মৃণালকে বলেছে সে ভগবান মানে না। রামবাবুরচোখে সে পৈতাধারী ব্রাহ্মণ। তাছাড়া ব্রাহ্মের হাত হতে বন্ধু মহিমকে বাঁচাতে তার দায়ওকম ছিল না। কোন নারীকে সত্যি সত্যি বুঝে ওঠার মত মন তার ছিল না। উপন্যাসেসুরেশ অনর্গল কথা বলেছে, কিন্তু কোন কথাই বিশেষ তাৎপর্যে পৌঁছে না। তার চরিত্রকোন বিশ্বাস বা বিশেষ আশ্রয়ে পৌঁছে না। সুরেশের চরিত্রে শেষ পর্যন্ত যেটি প্রধান হয়েউঠছে তা উচ্ছৃপদ ধনীর দুলালের চিত্র। উড়তে উড়তে উড়াতে উড়াতে ফুরিয়ে যাওয়া।

পত্র : বাংলা উপন্যাস-২: গৃহদাহ


তার স্বভাব। অবশ্য নববাবু চরিত্রেও শিল্প থাকে, বেহিসাবি চরিত্রের একটা মহত্ত্ব থাকে


যা দেবদাসেরও ছিল, তাও সুরেশের নেই। এজিদ রূপজমোহে উদ্ভ্রান্ত চরিত্র- তারও


বিশেষ শৌর্য ও অহংকার ছিল, তাও সুরেশ চরিত্রে নেই। সুরেশ যেটা পেয়েছে সেটা হল

অচনার জীবন তরীতে সে শ্বেত পাল তুলে দিয়েছে তাতে কলঙ্কের কালিমা ঢেলে তাকে

ছিন্ন ভিন্ন করেছে।

মূলত সুরেশের উজ্জ্বল, অবিবেচনাপ্রসূত কর্ম, স্ববিরোধী সক্রিয়তা দেখাতে শিল্পী নিজেই

আবেণের শিকার। তাই সুরেশ ডাক্তার, শিক্ষিত, কখনো পরোপকারী কিন্তু অনেক কষ্টেও

তাকে বিদ্যাবুদ্ধির ধারে কাছে খুঁজে পাওয়া যায় না। অচলার সাথে পরিচয়ের প্রথম পর্বে


অন্যের (বিশেষত বন্ধুর) বাগদত্তা এবং গভীর প্রণয়ে লজ্জারূপ প্রেমিকাকে দেখেও উৎকট


প্রেম সম্ভাষণে সে দ্বিধাহীন। শিল্পী সুরেশকে Extreme চরিত্রের অঙ্কুর রোপণ করে


বিশ্বাসের সীমা লঙ্ঘন করেছেন।


সুরেশের অসংযম ও জীবনবিমুখতার রূপের মধ্যে খুব স্পষ্ট তার ভোগের আকাঙ্ক্ষা কিন্তু

ভোগের জন্য যে প্রতীক্ষার প্রয়োজন, অপরের হৃদয়ের উত্তাপের সাথে মথিত হবার

প্রয়োজন তার সন্ধান সুরেশ জানত না। সে ভোগলোলুপ, ভোগ বলতে সে নিছক দৈহিক

সম্ভোগকেই বুঝে, আত্মা মানে না, ভগবানে বিশ্বাস করে না। পাপ-পুণ্যের ফাঁকা আওয়াজ

করে না। অচলাকে সে চেয়েছিল, তার মধ্যে হৃদয় বিনিময়ের আকাঙ্ক্ষাও ছিল, কিন্তু তার

কাছে বেশি কাম্য ছিল অচলার দেহ।


যে সুরেশ হয়ে উঠতে পারত 'ঘরে বাইরে'র সন্দীপ বা বিষাদসিন্ধুর এজিদের মত শৌর্য

বীর্যসম্পন্ন ব্যক্তিত্ববান চরিত্রের অধিকারী সে চরিত্র শেষ পর্যন্ত দৃঢ়তার অভাবে হয়ে উঠেছে

দুর্বলতর চরিত্রের জ্ঞাপক। শিল্পী সুরেশকে যেমন দেবতা করে তুলেছেন, আবার পিশাচও

করে তুলেছেন, ফলে চরিত্রটি ভারসাম্য হারিয়েছে। সুরেশ চরিত্রকে সার্থক করে তোলার

সমূহ সুযোগ থাকা সত্ত্বেও শিল্পী সে সুযোগ গ্রহণে ব্যর্থ হওয়ায় গৃহদাহ উপন্যাসে সুরেশ

হয়ে উঠেছে অনুজ্জ্বল চরিত্রের দ্যোতক।


প্রশ্ন ॥ ০৪ঃ

 ****শরত্চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত 'গৃহদাহ' উপন্যাস অবলম্বনে 'মহিম' চরিত্রঅঙ্কন কর।

***অথবা, 'গৃহদাহ' উপন্যাস অবলম্বনে 'মহিম' চরিত্রের বৈশিষ্ট্য আলোচনা কর।


উত্তরঃ--- 

 'গৃহদাহ' উপন্যাসের প্রধান চরিত্রত্রয়ের একটি চরিত্র মহিম।

দরিদ্র ব্রাহ্মণেরছেলে। রাজপুর গ্রামেই মহিমের শিকড় ছড়ানো। সেখানে যৎসামান্য বিষয়সম্পত্তির মালিকসে। তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু সুরেশ বড্ড ধনী। মহিম মেধাবী এম. এ. বি. এল. ক্লাসে বরাবরপ্রথম হত। সে স্কলারশিপ পেয়ে থাকে। টাকার অভাবে সে মেডিকেলে ভর্তি হয় না, বি.এ. এম. এ. পড়ে। বন্ধু সুরেশ তাকে অর্থ সাহায্য করতে চাইলেও সে তার দৃঢ়ব্যক্তিত্বেরকারণে তা গ্রহণ করে না। মহিমকে তার সঙ্কল্প হতে টলানো অসাধ্য। সে কপট নয়, তারবড় শত্রুও তাকে কপটতার দোষ দিতে পারে না। মহিম কখনো মিথ্যা বলে না।

সে ধীর-স্থির-নিস্তব্ধ-নিশ্চুপ চরিত্রের অধিকারী। কোন ধরনের দুঃখ-কষ্টের বিরুদ্ধে তারনালিশ নেই। ভাল-মন্দ, সুখ-দুঃখ সমস্তই তার একার। কাউকে কোনদিন তার ভাগ দেয়না। চাপা প্রকৃতির মানুষ। কোন বিষয়ে কারও কথা সে রাখেও না। নিজের সিদ্ধান্তে সেঅটল। স্ত্রী হয়েও অচলা কোনদিন স্বামী মহিমের দুঃখ-দুশ্চিন্তার ভাগ নেবার সুযোগ পায়নি। কৃপণের ধনের মত নিজেকে নিজে ঘিরে রাখে। ফলে তার দুঃখ-দুঃসময়ে কারওসাহায্য করা দূরে থাক কী যে তার অভাব, কোথায় তার ব্যথা, কোনদিন সে টেরও পায়

নি। সে স্বল্পভাষী।সুরেশের মত ছড়ানো চরিত্র না হলেও মিতবাক মহিমই উপন্যাসের প্রধান পুরুষ চরিত্র।গৃহদাহ হয়েছে তার, স্ত্রী অপহৃতা হয়েছে তারই। শিল্পী মহিমকে স্বল্পালোকিত করলেওস্তিমিত দীপালোকে আমরা প্রায় পূর্ণাঙ্গ একটি মানুষ দেখতে পাই। আরম্ভ থেকেই মহিমপাঠকের সমর্থন, দরদ, করুণা ও সম্মান আদায় করে নেয়। সুরেশ ও অচলার বাবামহিমের দারিদ্র্য ও দায়িত্বহীনতা নিয়ে নানা কথা বললেও মহিমের অটল গাম্ভীর্য ক্ষুণ্ন হয়না। মহিমের ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে অভিজ্ঞান দিতে পারে অচলা- কেননা অচলা মহিমেরব্যক্তিত্বে বিমোহিত। অচলার মতে- মহিম মিথ্যে বলে না, সে কসাই নয়, স্বল্পভাষী ওকাজপাগল। তাই সুরেশের উচ্ছলতাকে পরিহার করে স্বচ্ছন্দে সে মহিমের হাতে আংটিপরিয়ে দেয় এবং মহিমকে অচলা বিয়ে করে। শিল্পী এ পর্যন্ত মহিম চরিত্রের ভাবমূর্তিঅম্লান রেখেছেন।

বিয়ের পর মহিম চরিত্র অস্বচ্ছ। বিবাহ-পূর্ব জীবনে মহিম অচলার মনে ঝংকার তুলেছিল।কিন্তু দাম্পত্য জীবনের শুরুতে রাজপুরে তার স্বাদ ফ্যাকাশে। এ ফাঁকে প্রবেশ করে সুরেশ।মহিম হয়ে উঠেছে নিষ্প্রাণ পাথরের মত। ফলে চরিত্রটি তার স্থিতিস্থাপকতা হারায়। কিছুটাউদাসীন, আবার সামান্য সতর্কও। সারাদিন মাঠে মাঠে ঘোরে। অসংলগ্নভাবে পিস্তল বেরকরে, কখনো লাঠিগাছ তুলে ধরে কোন ব্যাপারেই তার তেমন উৎসাহ নেই। অচলা নাজানলেও মহিম একেবারে নিরাসক্ত নয়, বরং বিশেষ সতর্ক। মৃণালের লেখা চিঠি দেখেঅচলা বিষিয়ে ওঠে, তদুপরি সুরেশকে কাছে পেয়ে অচলা মহিমের উপর বিষিয়ে ওঠার

সুযোগ পায়। মহিমও ভুল ভাঙিয়ে দিতে সক্রিয় হয় না।

মহিমের অসুস্থতাকে কেন্দ্র করে শুরু হয় তার চরিত্রের তৃতীয় অধ্যায়। "অচলা ভেতরে

ভেতরে আমি বড় দুর্বল,

বড় অসুস্থ।"- অচলাকে উদ্দেশ্য করে স্বল্পভাষী মহিমের এইএকটি উক্তি তাকে বিশাল মাত্রা দিয়েছে। তাছাড়া গ্রামের লোক যখন ব্রাহ্ম মেয়ে বিয়েকরাকে গৃহদাহের কারণ বলে উল্লেখ করেছে, তখন মহিম সমাজপতিদের সামনে বলেছে

“আমি যাকে ঘরে এনেছি, তার পুণ্যে ঘর থাকে ভালই, না হয় বার বার পুড়ে যায় সেও

আমার সহ্য হবে।”- উক্তিটি মহিমের চরিত্রের দৃঢ়তা ও অচলার প্রতি তার ভালবাসা ওশ্রদ্ধার দ্যোতক।

সে উদার। অচলাকে বলেছে, “যাকে ভালবাস না, তারই ঘর করতে হবে, এত বড় অন্যায়উদ্ভব আমি স্বামী হলেও তোমার ওপর করতে পারব না।" সুরেশের বাড়িতে অসুস্থমহিম-অচলা সর্বপ্রথম সত্যিকারের দাম্পত্য বন্ধন উপলব্ধি করেছিল। দম্পতি খুঁজেপেয়েছিল সামঞ্জস্য ও সমাধানের পথ। কিন্তু মহিমের তৎপরতার অভাবে তা মাটি হয়েযায়। আবার সুরেশের মৃত্যুর পর রামবাবু কাশী যাচ্ছে- অপত্যবোধের স্থলে এসেছেধর্মবোধ। সে মনে করেছিল সুরেশ অচলার স্বামী, আজ দেখছে মহিম তার স্বামী। কলেপ্রায়শ্চিত্ত ছাড়া কোন পথ নেই। মহিম রামবাবুকে বলেছে যে ধর্ম স্নেহের মর্যাদা রাখতেদিল না, নিঃসহায় আর্ত নারীকে মৃত্যুর মুখে ফেলিয়া যাইতে এতটুকু দ্বিধাবোধ করিল না,আঘাত খাইয়া যে ধর্ম এত বড় স্নেহশীল বৃদ্ধকেও এমন চঞ্চল প্রতিহিংসায় এরূপ নিষ্ঠুরকরিয়া দিল, সে কিসের ধর্ম? -এখানেই মহিম প্রগতিশীল। স্বল্পরেখ চরিত্র হয়েও

এখানেসে সকলকে অতিক্রম করেছে। সমীক্ষা চালিয়েছে সে নিজের উপরও। নিজের পলায়নতা

ও নির্জীবতাতে নিজেই লজ্জিত হয়েছে।

জীবনে সংযম প্রার্থিত সত্য কিন্তু অতিনৈষ্ঠিক কর্মধারা হৃদয় ধর্মের সাথে সংযোগহীন,আবেগহীন মানবতা বিরোধী জীবনের সংরাগ সেখানে শূন্যতায় পর্যবসিত। এ জাতীয়লোককে সহজে শ্রদ্ধা করা যায়। পাথরের মূর্তির মত পূজা করা যায় কিন্তু ভালবাসা দুরূহ।কারণ ভালবাসা আদান-প্রদান রসে সঞ্জীবিত থাকে। নিত্যদিনের ঘরকন্যার মধ্যে যেআবেগ প্রয়োজন তা মহিমের ছিল না। এই আবেগহীনতা অচলার নারীজীবনকে কীভাবেখণ্ড-বিখণ্ড করেছে তার দিকে তার দৃষ্টি নেই। যে অচলা বাবার শত অনুরোধেও সুরেশেরসঙ্গ ত্যাগ করে মহিমের হাতে আংটি দিল, সে অচলা মহিমের পাষাণ বর্মে এতটুকুও দাগকাটতে পারে নি।

সে অবিচলিত, স্বৈর্যের প্রতিভূ, বিবেচনাপ্রসূত- কিন্তু দস্যু বন্ধুর হাত থেকে অসহায় স্ত্রীকেউদ্ধারের এতটুকু চেষ্টাও সে করে নি, শুধু তাই নয়- উপন্যাসের শেষাংশে তার বিবেচনাকী চমৎকার? সুরেশের মৃত্যু হয়েছে। রামবাবু ধর্মের কারণে অচলার প্রতি কঠোর হয়েছে।সে প্রায়শ্চিত্রের জন্য কাশীমুখে যাত্রা করে এই অসহায় অবস্থায়ও মহিমের অন্তরএতটুকুও দ্রবীভূত হয় নি। কৃতকর্মের অনুশোচনায় দগ্ধ অচলা স্বামীর পায়ে নিজেকেসমর্পণ করেছে, তার ধারণা মহিম পাথরের দেবতা হলেও এবার নিশ্চয়ই তার উদ্ধারের পথপরিষ্কার করে দেবে, কিন্তু তা সে করে না।সুরেশের মৃত্যুশয্যায় মহিম অচলাকে জিজ্ঞেস করেছিল- এখন সে কী করবে? জবাবেঅচলা বলেছিল যে, মহিম তাকে যা হুকুম করবে অচলা তাই করবে। অচলা তাকেআশ্রমের কথা বললে মহিম তা খুঁজে দেবে বলেছে। মহিমের অর্থহীন নির্বিকার গাম্ভীর্যেরকারণে সে সর্বতোই অনিকেত। রাজপুর পল্লীতে বা অন্যত্র, কোথাও কাউকে সেশুভানুধ্যায়ী মনে করে নি। তাই সে সমাজভীরু, কারও দায়িত্ব গ্রহণে ব্যর্থ, এমনকি নিজেরস্ত্রীরও। সে সিদ্ধান্ত নিতে জানে না, পারে না দুঃসময়ে কাউকে সহায়তা দান করতে।তাপিতকে শান্তি, অসুস্থকে নিরাময়ের পথ নির্দেশ করতে জানে না- মূলত মহিম দুর্বল

চরিত্রেরই দ্যোতক।মহিম সুরেশের মত দেবতাও নয়, পিশাচও নয়, আবার মৃণালের মত সচল আশ্রম নয়।তাছাড়া শিল্পী অচলার সাথে মহিমের তিল তিল ভালবাসার ইতিহাস দেখ নি। মহিমকেকলকাতার সাথে তেমন যুক্ত করে নি, আবার রাজপুরের সাথেও না। সে সমাজ সাপেক্ষনয় বরং স্বশাসিত। ফলে চরিত্রটি সে অর্থে আকর্ষণীয় ও ব্যাপকতা পায় নি।বস্তুত বারংবার মহিমের অর্থহীন গাম্ভীর্য হাস্যকর প্রতীতী জন্মায়, যে গাম্ভীর্য নিজের ওপার্শ্ববর্তী চরিত্রকে জীবনপথে উন্নীত করার পক্ষে কোন প্রয়োজনে আসে না, তাকেই শিল্পী

মহৎ করে গড়ে তুলতে চেয়ে ব্যর্থ হয়েছেনসুরেশ অধম, নিজের স্বার্থে এমন কোন হীন কর্ম নেই যা সে করে নি। কিন্তু উপন্যাসেমহিমও তেমন কোন মহৎ কাজ করে নি। কসাই বন্ধুর হাত থেকে নিজেকে বাঁচাবার জন্যঅচলা স্বয়ং প্রবৃত্ত হয়ে তার আঙুলের আংটি খুলে মহিমকে পরিয়ে দিয়েছিল কিন্তুঅচলাকে বাঁচাবার জন্য মহিম কোন উদ্যোগ গ্রহণ করে নি বরং নির্লিপ্ততা দিয়ে নির্জীবতও কাপুরুষত্বকে ঢেকে রেখেছে। শিল্পী সচেতনভাবে মহিমকে তার মানসপুত্র করতেচেয়েছিলেন। মহিমকে শিল্পী ব্যক্তিত্বের ঘেরাটোপ দিয়ে অন্যদের থেকে স্বতন্ত্র করে তুলতেচেয়ে নির্লিপ্ততা ও ব্যক্তিত্বের রঙটা এমনভাবে চড়িয়েছেন যা পোড়া পিঠের মত অখাদ্য ওঅপাঙ্ক্তেয় হয়ে উঠেছে। অন্যভাবে মহিমের অন্তরে বিশেষভাবে কলুপ এঁটে চাবিটা শিল্পীনিজেই লুকিয়ে রেখেছেন এমনভাবে যে- প্রয়োজনে তা হারিয়ে ফেলেছেন, ফলে চরিত্রটিশেষ পর্যন্ত কাজে লাগে নি। বাস্তবত চরিত্রটি ব্যর্থ হয়েছে।


প্রশ্ন ৫---


****শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের 'গৃহদাহ' উপন্যাস অবলম্বনে অচলা চরিত্র অঙ্কন কর।

**গৃহদাহ উপন্যাস অবলম্বনে অচলার ট্রাজেডির কারণ বিশ্লেষণ করো 

***"অচলা' বাংলা সাহিত্যের অন্যতম অবিস্মরণীয় চরিত্র। বিশ্লেষণ কর।

***'গৃহদাহ' উপন্যাস অবলম্বনে ‘অচলা' চরিত্রের বৈশিষ্ট্য আলোচনা কর।


উত্তর----

 

শরৎচন্দ্রের বিশিষ্ট উপন্যাসগুলোর অধিকাংশই চরিত্রকেন্দ্রিক। চরিত্র সৃষ্টিরনাটকীয়তা শরৎচন্দ্রের শিল্পদৃষ্টিকে একটা চিরকালীন মূল্য প্রদান করেছে। অচলা চরিত্রটিকেবল শরৎসাহিত্যেই নয় বরং বাংলা সাহিত্যে বহুল আলোচিত, নিন্দিত এবং নন্দিত।অচলা বঙ্কিমচন্দ্রের রোহিণী এবং রবীন্দ্রনাথের বিনোদিনী বিমলার অনুজা এবং শেষপ্রশ্নেরকমলের জ্যেষ্ঠা। অচলাকে ঘিরেই উপন্যাসের মূল কাহিনী ও আর তার চরিত্রেরা আবর্তিতও বিবর্তিত। চরিত্রটি মনস্তাত্ত্বিক জটিল ও অন্তর্মুখী।শিল্পী দু'একটি কালির আঁচড়ে প্রথম শ্রেণীর চরিত্র আঁকেতে সক্ষম হলেও তাঁর সমগ্রসৃষ্টিমালায় অচলাকে তিনি একবারে আঁকেন নি, অন্তত দু'বারে এঁকেছেন। উপন্যাসেরশুরুতে শিল্পী অচলার যে ছবি আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন তাতে অচলা অপরূপা ওআকর্ষক। “ছিপছিপে পাতলা গঠন, কপোল, চিবুক, ললাট মুখের ডৌল সুশ্রী, সুকুমার।চোখ দুটির দৃষ্টিতে একটি স্থির বৃদ্ধির আভা।" ব্রাহ্মবিদ্বেষী যে সুরেশ একদিন বলেছিল,শুকনো কাঠপনা চেহারা, বই মুখস্থ করে গায়ে কোথাও এক ফোঁটা রক্ত পর্যন্ত নেই, গলারস্বরটা চি চি করে।” অথচ অচলাকে দেখার পর সেই সুরেশের ঘুম কেড়ে নেয়, সে সাথেপাঠকেরও।মাতৃহারা ব্রাহ্ম নারী অচলা তার অসাধারণ সংযমের বলে পুরুষকে বশ করতে পারেসহজে। সে শান্ত হয়েও দৃঢ়, সব জেনেও নির্বাক। অচলা বিশেষ শিক্ষা ও সংস্কারের মধ্যেবড় হয়ে বিশেষ ব্যক্তিত্বময়ী হয়ে উঠেছে।অচলা উদার ব্রাহ্ম পরিবেশে বেড়ে ওঠায় হয়ে উঠেছে সুরুচিসম্পন্না। সংস্কারমুক্ত প্রকৃতিরসাথে অচলার প্রাণ যুক্ত হওয়ায় তার চরিত্র পেয়েছে শুদ্ধতা। সে সর্ববন্ধনমুক্ত বিহঙ্গ। তারচরিত্রে কোন মুখোশের আড়াল নেই। পোশাকি জৌলুসেঅন্যকে ভোলাবার মত কপট সেনয়। তার রুচি ও ব্যক্তিত্বে ছিল সুশিক্ষার সুস্পষ্ট ছাপ। অতিথিপরায়ণতা তার বিশেষগুণ। অচলা কাপড়ের জমিনে সুচ-সুতা দিয়ে সুন্দর ফুল সেলাই করতে পারলেও নিজেরজীবন জমিনে অংকন করতে পারল না জীবনপদ্মকে। বিচিত্র মুগ্ধতা, কৃতার্থতা, বিশ্বয়করপবিত্রতা সব মিলিয়ে অপরূপা। কোন কলুষতা দিয়ে সে রূপ ধরা যায় না। রঙ তার ফিকে

হয়ে এসেছে। শেষ পর্যন্ত।অচলা ভালবাসে মহিমকে। সুরেশ যখন মহিম সম্পর্কে নানা অপবাদ দেয়, তখন অচলাঅভ্যস্ত ঠাণ্ডা মাথায় তা মোকাবিলা করেছে। সে বলেছে, "তিনি কখনো মিথ্যা বলেন না।"অচলা এক মুহূর্তের জন্যও সুরেশকে অশ্রদ্ধা করে নি। আঘাত দেওয়ার পরিবর্তে সুরেশেরহাত দু'টি ধরে শুভার্থীর প্রতি গভীর মমতা দেখিয়েছে। সুরেশ অচলাকে ছিন্নমূল করে।বুকের কাছে টেনে নেয়, কিন্তু বুদ্ধিমতি অচলা বিচলিত হয় না। ব্রাহ্ম বাড়িতে সুরেশেরখাওয়ার প্রশ্নে অচলা বলেছে, “আমাদের ব্রাহ্ম বাড়িতে যেতে হয়তো এর বিশেষ বাধাআছে। তাছাড়া অপ্রবৃত্তির ওপর খেলে অসুখ করতে পারে।" তির্যক শেষ করতে অচলার

অচলার বাবাকে সাহায্য করার বদ্ধপথে সুরেশ অচলাকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। অচলা তানাকচ করে দেয়। কেননা তার জীবনের সন্ধিস্থলে পাশাপাশি দু'জনের একজনকে তোসরাতেই হবে। তবে সুরেশের দুঃখ ঘোচাতে তার গাড়িতে বসে চোখের জল মুছিয়ে দেয়,আবার মহিমের হাত টেনে নিয়ে পরিয়ে দেয় পরিণয়সূচক আংটি- “এইবার যা করবার

তুমি করো।”

উপন্যাসের শুরুতে অচলা অষ্টাদশী। এ বয়সে নারীর কাছে আবেগের বিশেষ মূল্য থাকে।মহিম নিজের বৌদ্ধিক সত্তার প্রেরণায় অচলাকে চেয়েছে তাতে আবেগ ছিল না। সুরেশেরআচরণে আবেগের মাত্রাহীন প্রকাশ থাকায় তাতে সাড়া না দিয়ে অচলা পারে নি। অথচশিক্ষিতা, সংস্কৃতিমনা, রুচিবান ব্রাহ্মকন্যার কাছে মহিমের বৌদ্ধিক সত্তাও কাম্য। অচলারআত্যন্তিক প্রবৃত্তিদ্বয় পরিতৃপ্ত হয়েছে ভিন্নধর্মী দুই পুরুষ দ্বারা। তাই অচলার মধ্যে জন্মনিয়েছে দ্বিখণ্ড মানসিকতা। এক মানসিকতায় অচলা আবেগপ্রবণ নারী-তখন সুরেশই তারকাম্য পুরুষ। অন্য মানসিকতায় সুরেশের আবেগপ্রবণতায় নীচতার প্রকাশে সে আতঙ্কিতা,তখন সে মহিমের আশ্রয় খোঁজে। তার এ দুটো চাওয়াই সত্য।

ব্রাহ্ম মেয়ে হয়েও শুভদৃষ্টির সময় অচলা মহিমের উদ্দেশ্যে মনে মনে বলেছে- “স্বামীরসাথে যেখানেই থাকি না কেন সেই আমার স্বর্গ, তার কুটিরই আমার রাজপ্রাসাদ।" কিন্তুঅচলা তার প্রতিজ্ঞা রক্ষা করতে পারে নি। অচলার ভাগ্যবিধাতা তাকে টলিয়ে দিয়েছে।মহিমের বাড়িতে সুরেশের পদচিহ্ন পড়েছে। সে সেখানে দাবি করেছে অচলাকে। অচলারদাম্পত্য জীবনের সূচনায় ঐক্য যোজিত হয় নি। মহিমকে লেখা মৃণালের চিঠিতে তারমনের ঈশ্বর ভেঙেছে- “সেজদা মশাই গো, করছ কি? পরশু থেকে তোমার পথ চেয়েতোমার মৃণালের দুটি চোখ ক্ষয়ে গেল যে।” মৃণাল নিজ মুখে অচলাকে বলেছে যেমহিমের সাথে মৃণালের বিয়ের কথা ছিল। অতঃপর মহিমের গৃহদাহ, সুরেশের সাথেঅচলার কলকাতা প্রত্যাবর্তন, সুরেশের সাথে তার লুকোচুরি, গাড়ি বদল- অচলার চরিত্রকেবদলে দিয়েছে। ডিহরীতে সুরেশের সাথে অবস্থান, মহিমের নিরন্তর নীরবতা অচলারজীবনে নতুন পথ তৈরি করে দিয়েছে।

অচলা বুঝতে পেরেছে সব নারীর ভাগ্যে গৃহ জোটে না। তার জীবনে কোন প্রভাত নেই,আছে শুধু অন্ধকার। তার স্বামীর মনে আলাদা কোন স্থান নেই তার জন্য। অচলা তা নিয়েক্ষত-বিক্ষত হয় নি। সত্তার গভীরে প্রত্যেক নারীর মধ্যে গৃহের একটা স্বপ্ন থাকে, সে স্বপ্নভেঙে গেলে নারীর আহত মন সংসারে ওলট-পালট ঘটাতে চায়। অচলা সে প্রকৃতির নয়।স্বপ্ন ভাঙায় অচলা বিচলিত নয়, কেননা দোলাচল বৃত্তির জন্যে অচলার মনে নীড় বাঁধারস্বপ্ন কখনো প্রগাঢ় হয় নি। (সুরেশের সঙ্গে তাঁর ব্যবহার স্মর্তব্য) অচলা সূর্যের দিকেতাকিয়ে সূর্যমুখি হতে পারে নি, সে হতে পারে নি মরুভূমির ক্যাকটাস। ডিহরীতে ঝড়জলের রাতে সুরেশের সাথে দেহমিলনের পর অচলার পরিণতি নির্দিষ্ট হয়ে যায়। অচলাপৌঁছে যায় প্রত্যাবর্তনহীনতার জগতে। ফুল আর পাথরের মধ্যে সে ফুল চিনতে পারে নি।তাই সে শশ্মশানভূমিতে বিশীর্ণ রজনীগন্ধার মত অনিকেত।উপন্যাসের শেষে সুরেশের মৃত্যুতে অচলার বাঁচার পথ সৃষ্টি হয়েছে বটে, মহিমের হাতধরে বলেছে- যতদূর বল যেতে পারব। কিন্তু স্পষ্টভসে যাওয়ার মধ্যে ছন্দ নেই। মহিমের

আশ্রয় হয়তো সে পেয়েছে কিন্তু সে কেবল আশ্রয়ই জীবনের স্পন্দন সেখানে ধ্বনিত হয়না। কেবল ধূসর প্রাণহীন, চেতনাহীন জগতে অচলার বাসস্থান নির্দিষ্ট হয়ে যায়।অচলা হিন্দু ও ব্রাহ্মের মিশু চৈতন্যজাত। যার মর্ম জংগমতা, ধর্ম আধুনিকতা, পরিণতিধূপছায়া। তার চারিত্রিক ঐশ্বর্য বহুধা বিভাজিত। বিশ্বয়ের জাগরণ, জীবনের আনন্দ,আশা-নৈরাশ্য ও অন্তর্মুখিতায় তার চরিত্র ঋদ্ধ। আধুনিক সংঘাতের অভিঘাত, ক্লান্তি,নৈরাশ্যবোধ, আত্মবিরোধ, অনিকেত, প্রেমসুন্দর, সংশয় এবং তদসঞ্জাত অনিশ্চয়তারউদ্বেগে আক্রান্ত। অথচ তির্যক ও দুরূহ। সকল বিধ্বংসী দুরূহ কামনার মানস বিধ্বস্তঅচলা। দ্রৌপদীর শাড়ির মত এক এক করে শিল্পী উন্মোচন করেছেন অচলার সকলঅশান্ততা, বিক্ষুব্ধতা। জীবনের শুমরানো ব্যথা অতৃপ্তির অগ্ন্যুদগার। অচলার চরিত্রে পরিপূর্ণনারীর ক্ষতবিক্ষত রক্তাক্ত পরিচয় ফুটে উঠেছে। তার অন্তর্লোকে যে সমুদ্র মন্থন চলেছে,তারই উগলানো বিষ তাকেই পান করে নীলকণ্ঠ হতে হয়েছে। জীবনের অচরিতার্থতা,সমৃদ্ধতা, পূর্ণতর জীবনের আশা- সবই সংমিশ্রিত তার জীবনে। তার ভাগ্য চক্রাকারেআবর্তিত। তার জীবনে একটি ঢেউয়ের পরে সৃষ্টি হয়েছে আর একটি ঢেউয়ের, এমনিভাবেতার জীবনে এসেছে চলমানতা। উচ্চারিত হয়েছে শ্রেষ্ঠ ও ভ্রষ্ট নারীর আর্তনাদ। স্বর্গচ্যুতঅথচ মর্তে জ্বালাময়ী। বিজ্ঞতা আছে, শান্তি নেই। তার চরিত্র শেষ পর্যন্ত আশ্বাসের আশ্রয়েপৌঁছে না। পরিণতিতে তাই এক নিঃসঙ্গ চূড়ায় দাঁড়িয়ে নিঃসীম শূন্যতা ও নৈরাশ্যভরাতুরা নয়নে সবকিছু সহ্য করেছে।

মহিম ও সুরেশের ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তিত্বের টানাপোড়েনে একসময় অচলার ভেতরকার বিশ্বাসমাটির পুতুলের মত ভেঙে যায়। অন্ধ জীবনের গভীর তলদেশিক স্রোতে ভেসে যায় সে।অচলা চরিত্রের বন্ধুরতা ও দ্বৈধতা প্রকটভর। তার চরিত্রের মানসিক জটিলতা বিশেষ নারীচরিত্রের মাধ্যমে চিহ্নিত হলেও তার সংকট মূলত সমগ্র মানবমনের সংকটেই বিধৃত ওঅনুসৃত।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ