Hot Posts

6/recent/ticker-posts

চণ্ডীমঙ্গল কাব্য আলোচনা /চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের কাহিনী


---চণ্ডীমঙ্গল কাব্য আলোচনা চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের কাহিনী 
 চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের আলোচনা, 

চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের কাহিনী,

চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের রচয়িতা কে, 

কবিকঙ্কণ মুকুন্দরাম

চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের  আদি কবি কে--

**বিঃদ্র-বাংলা বিভাগের সকল পড়াশোনা পেতে ব্লগটিতে যুক্তথাকুন https://monoweredu13.blogspot.com/?m=1 

***চণ্ডীমঙ্গলের কাহিনী


যতগুলি বাংলা চণ্ডীমঙ্গল (ভবানীমঙ্গল নামেও উল্লিখিত)পাওয়া গেছেতাদের প্রত্যেকটিতেই দদুটি কাহিনী লক্ষ্য করা যায়—একটি আক্ষেটি খণ্ড,অর্থাৎ বাধে কালকেতুর গল্প, আর একটি বণিক খণ্ড, অর্থাৎ বণিক ধনপতিরগ্রুপের অর্বাচীন সংস্কৃত পরাণেও এই দই কাহিনীর উল্লেখ আছে—মুলআখ্যানে এই দুটি গল্প ছিল বলে মনে হয়।প্রথম আখ্যানে কালকেতুর গল্পে দেবী কর্তৃক অনার্য ব্যাধসমাজে সব—প্রথম পূজা গ্রহণের কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। মনে হয় গোড়ার দিকে চণ্ডীঅনার্য ব্যাধ-শবরেরই দেবী ছিলেন। কাহিনীর গোড়ার দিকে হর-পার্বতীর ঘরগৃহস্থালীর অল্পস্বল্প কাহিনী আছে। তারপরে ব্যাধপ্রসঙ্গআরম্ভ হয়েছে।ইন্দ্রপত্রে নীলাম্বর সামান্য অপরাধের জন্য মর্ত্যে ব্যাধের ঘরে কালকেতু নামেজন্মগ্রহণ করল, তার স্ত্রী ছায়াও স্বামীর অননূমৃতা হয়ে মর্ত্যে ফল্লরা ব্যাধিনীরূপে জন্ম নিল। উভয়ের যথারীতি বিবাহ হল। তারা কিন্তু পূর্বস্বরূপ

'সম্পূর্ণ ভুলে গেল। দেবী এই নির্লোভ ব্যাধদম্পতির দ্বারা প্রথম পূজা প্রচারেরজন্য সচেষ্ট হলেন। একদিন দেবী কালকেতুর পথের মধ্যে স্বর্ণ গোধিকা(গো-সাপ) হয়ে পড়ে রইলেন। কালকেতু সেদিন শিকার পেল না। সে মনেকরল, এই স্বর্ণ গোধিকার অশভ দর্শনেই সে শিকারে ব্যর্থ হয়েছে। রেগেগিয়ে স্বর্ণ গোধিকাকে দড়ি দিয়ে বেধে বাড়ী নিয়ে এল, ইচ্ছে—পড়িয়ে খাবে।এই ভেবে সে বাইরে গেল। ইতিমধ্যে দেবী স্বর্ণ গোধিকামূর্তি ছেড়ে অপূর্বরূপসীর রূপে ধরে ব্যাধের কুটীর আলো করে রইলেন। এদিকে কালকেতু ফুল্লরা এ ব্যাপার দেখে তো অবাক। যাই হোক, তাদের সরল ব্যবহারে তাদেরস্বারাই পূজা প্রচারে ইচ্ছক দেবী তাদের কৃপা করলেন, বহ, ধনসম্পত্তিদিলেন। সেই ধনের দ্বারা ব্যাধ কালকেতু বন কেটে গজরাট নগর তৈরী করল,সে রাজা হল। তার রাজ্যে বহ, প্রজা এসে সম্মুখে বাস করতে লাগল, সেমহানন্দে দেবীর পূজা করল। কিন্তু তার কাছে ভাঁড়দত্ত বলে একজন অতিধুর্ত খলপ্রকৃতির লোক এসে বাক্‌চাতুরীতে তাকে মুগ্ধ করে নিজের কাজগুছিয়ে নিতে লাগল। এ কথা জানতে পেরে কালকেতু তাকে খুব ভৎসনাকরল। এতে অপমানিত ভাঁড়দেত্ত পাশের রাজ্য কলিঙ্গে গিয়ে সে দেশেররাজাকে কালকেতুর বাড়বাড়ন্তের সংবাদ দিল। এতেকলিঙ্গরাজ রষ্ট হয়েব্যাধরাজা কালকেতুর বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করলেন। কালকেতু খুব বীরের মতো

 লড়লেও ভাড়ুদত্ত কৌশলে তাকে ধরিয়ে দিল। কলিপ্সবাজ কাল

কেতুকে কারাগারে নিক্ষেপ করলেন। কারাকছে কালকেতু দেবীর সহবস্তুতিকরলে তিনি তাকে সান্ত্বনা দিয়ে রাতে ফলিপারাজকে দুঃস্বপ্ন দেখলেন এবংভীষণ ভয় পাইয়ে দিলেন। তখন বরেতে পারলেন, কালকেতু নেবার পরম তত্ত্ব। তখন তিনি সসম্মানে কালকেতুতে মুক্তি দিলেন এবংতাকে রাজটীকা দিয়ে সর্বসমক্ষে রাজা বলে শাকির করে নিলেন। কালকেতু মহাসমারোহে নিজ রাজ্যে ফিরে এল। ওদিকে ভয় দেখল পাশা উল্টে গেছে।সে তাড়াতাড়ি কালকেতুর কাছে এসে মনরাখা কথা বলতে লাগল। কিন্তু এবার কালকেতু আর তার বাকুচাতুরীতে ভূল না, তাকে খুব অপদস্থ ও অপমান করে তাড়িয়ে দিল। তারপরে তাকে নানাভাবে উৎপীড়িত হতে দেখে কালকেতু দয়াবশত আবার তার ঘরবাড়ী ফিরিয়ে দিল। রুমে কাল পূর্ণ হল। মতোকালকেতুর দ্বারা দেবীর পূজা প্রচারিত হল। বর্গের নীলাম্বর ও ছায়া মর্ত্যকুয়া ভাগ করে আবার স্বপ্নে ফিরে গেলে।তদের সন্তান সম্পর্কের জন্মসময়ে গজরাটে রাজ্যপাট চালাতে লাগল। এই হল ব্যাধের যারা সর্বপ্রথমচণ্ডীর পূজা প্রচারের কাহিনী। এর পর দ্বিতীয় কাহিনী ধনপতি আখ্যান আরম্ভ হয়েছে। প্রথম কাহিনীটি বেশ ঘন এবং সংহত। দ্বিতীয়কাহিনী এর চেয়ে অনেক বড়ো কিন্তু বড়ো বলেই কিছু শিখিল বলে মনে হয়।

ব্যাবের দ্বারা দেবীর পূজা মর্তো প্রচার লাভ করল। কিন্তু তখনসমাজের শীর্ষস্থানে রয়েছে বণিক সম্প্রদায়। সেই বণিকদের নেতা ধনপতি।যদি তার বার মতো দেবীর পূজা প্রারিত হয়, তাহলে সমাজের প্রধানসম্প্রদায় বণিকদের মধ্যেও তাঁর প্রাধান্য বিস্তার লাভ করবে। ধনপতিরএ আধ্যানটি অনেকটা মনসামঙ্গলের চাঁদসদাপ্তরের অনুরূপ। চাঁদের শিব উপাসনা,দেবতা পূজার আপত্তি, সমকার গোপনে মনসাপুজা, ক্রোধের বশে দেবীকেচাঁদের অমর্যাদা প্রভৃতির আদশেই ধনপতির কাহিনী গড়ে উঠেছে। শৈব।ধনপতিও শ্রীচণ্ডীর পূজা করতে চায়নি, চার্জীর ঘটে পদাঘাত করেদেবীর তোর উক্ত করেছিল। অবশ্য সে তার স্ত্রী না ও পত্রে শ্রীমন্তেরজন্য দারুণ বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে।

স্বর্গের নাকী বিমোলা নাচের সময় ভাল ভুল করার জন্য অভিশপ্ত হয়েমতো তুলনারূপে জন্মগ্রহণ করল। দেবী তার ধারা নিজের মূল প্রচারেরহলেন। নবপ্রাপ্ত হলে ধনপতি সাগর তাকে দেখে মুগ্ধ হয়ে বিবাহ করে। ধপর আরও এক স্বী ছিল, তার নাম লহনা) বিয়েরপর ধনপতি কিছুকাপের জন্য গৌছে গেলে লহনা সতীন খলনার ওপর অত্যাচার শুরু করল। তার সৌন্দর্য নষ্ট করে দেবার জন্য সে স্বামীর নামেলিখে তার সাহায্যে ধবতী রেনাকে বনে বনে ছাগল চরাতেনিযুক্ত করল, ঢেকিশালে শর্তে দিল, খাওয়া-পরা দারুণ কষ্ট দিতে লাগল।এদিকে না চোখের জল ফেলে সেই কাজই করতে লাগল। একদিন সেবনের মধ্যে চণ্ডীপূজা দেখে নিজেও ধীর পূজা করল, ইনে তারদিন শেষ হল, লহনা নিকার্যের জন্য অনুতপ্ত হয়ে তাকে আবারঠাঁই দিল। ধনপতি বাড়ী ফিরে এই খবর জানতে পেরে লহনাকে খুব ভৎসনা করল,খুল্লনার করার আদর বেড়ে গেল। কিছুকাল পরে ধনপতিকে রাজারম্ব। খল্পনা স্বামীর মঙ্গল কামনায় একদিন ঘট পেতে মঙ্গলঘটে পদাঘাত করল। তার জন্য বাণিজ্যে বেরিয়ে তাকে খুবে শাস্তি ভোগ করতেহল, ঝড়ে তার অনেক নৌকা ডুবে গেল। সে কোনক্রমে সিংহলে উপস্থিতহল। পথে কালীদহে সে এক অদ্ভূত দৃশ্য দেখল। ফোটা পদ্মফুলের উপরবসে এক অপূর্ব সন্দরী রমণী একটা হাতীকে গিলে ফেলছেন, আবারতৎক্ষণাৎ তাকে উদগাঁরণ করে দিচ্ছেন। এই মূর্তির নাম কমলে-কামিনী।সিংহলে গিয়ে এই অদ্ভুত দৃশ্যের কথা সে সিংহলরাজের কাছে ব্যাখ্যান করলেরাজা তো এ ঘটনা বিশ্বাস করতেই চাইলেন না। তখন ধনপতিরও রোখ চেপেগেল। সে বললে যে, রাজাকে যদি এ দৃশ্য না দেখাতে পারে তবে সে সারাজীবনরাজার কারাগারে বন্দী হয়ে থাকবে। সে দম্ভভরে এ দৃশ্য দেখাতে গিয়ে ব্যর্থহল, তাকে সিংহলের কারাগারে মিথ্যাবাদীর পাওনা শাস্তি ভোগ করতে হল।ইতিমধ্যে অনেক দিন কেটে গেছে, তার ছেলে শ্রীমন্ত রুমে বড় হয়েছে।বহুদিন যাবৎ পিতার কোন সংবাদ না পেয়ে সে মায়ের কাছে অনুমতি চেয়েনিয়ে নৌকা সাজিয়ে পিতার সন্ধানে সিংহল যাত্রা করল। শ্রীমন্ত কিন্তুমালাধর নামে স্বর্গের এক অধিবাসী। সেও অভিশপ্ত হয়ে মর্ত্যে সেনারপত্রেরূপে জন্মগ্রহণ করে। পথিমধ্যে শ্রীমন্ত ধনপতির মতো 'কমলে কামিনীদেখতে পেল এবং রাজার কাছে এসে সেই দৃশ্যের গল্প করল। তার পরেরঘটনা ধনপতির ঘটনারই পুনরাবৃত্তি। এবার রাজা মিথ্যাবাদীকে শূলে দিতেচাইলেন। কিন্তু দেবীর অনুগৃহীত এবং স্নেহের পাত্র শ্রীমন্ত দেবীর কৃপাতেইরক্ষা পেল, সিংহলরাজ নিজের ভুল বুঝতে পেরে অতিশয় অনুতপ্ত হলেন।কারাগারে বড় মর্মান্তিক দৃশ্যের মধ্যে পিতাপুত্রের মিলন হল। অবশেষে সবকিছু ভালোর দিকে চলল। সিংহলরাজ-কন্যা সুশীলার সঙ্গে শ্রীমন্তের মহাধূমধাম করে বিয়ে হল। কিছুকাল সিংহলে অতিবাহিত করার পর ধনপতিপর-পরবধূ, নিয়ে দেশে ফিরল—এবার সে পরমভক্তিভরে দেবীর পূজা করল-মর্ত্যে উচ্চ সমাজে সহজে দেবীর পূজা প্রচারিত হল। তার পরে কাল পর্ণেহলে স্বর্গের রত্নমালা ও মালাধর স্বর্গে ফিরে গেল, মর্ত্যে ধনপতি বিলাপকরার জন্য পড়ে রইল। আখ্যানটি নানা বৈচিত্র্যে পূর্ণ হলেও প্রথমটির মতোসংহত নয় বলে পড়তে পড়তে একট, ক্লান্তি বোধ হয়। কিন্তু এই আখ্যানরসেরবৈচিত্র্য বিশেষভাবে স্মরণীয়। এবার ষোড়শ শতাব্দীর চণ্ডীমঙ্গলের কবিদেরসম্বন্ধে সংক্ষেপে কিছু আলোচনা করা যাক।


***--কয়েকজন কবি----

****মানিকদও-- 

মনসামঙ্গলের তথাকথিত আদিকবি কানা হরিদত্তের বিশেষকোন কাবা পাওয়া যায়নি। কিন্তু চণ্ডীমঙ্গলের আদিকবি বলে পরিচিতমাণিবদত্তের কাব্যের পংখি পাওয়া গেছে এবং বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে তাপ্রকাশিত হয়েছে। মকুন্দরাম চক্রবর্তী তাঁর প্রসিদ্ধ কাব্য চণ্ডীমঙ্গল বাঅভয়ামপালে একাধিকবার আদিকবি মাণিকদত্তের নাম উল্লেখ করে তাঁকে শ্রদ্ধা করেছেন। এতে মাণিকদত্তকে চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের প্রাচীনতম কবি বলেই মনেহচ্ছে। তাঁর সম্বন্ধে মুকুন্দরাম বলেছেন, “যাহা হৈতে হৈল গতিপথ পরিচয়"-অর্থাৎ মাণিকদত্তই সর্বপ্রথম চণ্ডীর গান বেধেছিলেন। মাণিকদত্তের যেপদখিলি পাওয়া গেছে, তার কোনখানিই পরাতন নয়। আধুনিকালে কয়েকজন লেখক মাণিকদত্ত সম্বন্ধে যে সমস্ত প্রবন্ধ লিখেছেন তা থেকে দুটি তথ্যপাওয়া যাচ্ছে—মাণিকদা মালদহের কবি এবং তাঁর কাব্যে বৌদ্ধ প্রভাব আছে।যে পাখি দুখানি পাওয়া গেছে তার মধ্যে ঘটনাগত নানা বিশৃঙ্খলা রয়েছে,ভাষাও একেবারে হাল আমলের মতো। তাই ভাষা দেখে মাণিকদত্তকেপ্রাচীন বলা যায় না। উপরন্তু তাঁর কাব্যে চৈতন্যদেব ও চৈতন্য-অনুচরদেরবিস্তারিত বর্ণনা আছে বলে কবি ও কাব্যের প্রামাণিকতা অত্যন্ত সংশয়জনক।ভণিতা থেকেও সংশয়ের কোন নিষ্পত্তি হয় না। কেউ কেউ দ'জন মাণিকদত্তের অস্তিত্বের কথা বলেছেন—আমাদের মতে তাও ঠিক নয়। কাব্যের গোড়ার দিকে কবির জবানীতে যে আত্মপরিচয় সংযোজিত হয়েছে তাও তাঁর রচিত কিনা সেবিষয়ে গভীর সন্দেহ আছে। মনে হয় কবি মালদহের ফুলবাড়ী গ্রামে সন্মগ্রহণ করেন, কারণ তাঁর কাব্যে ঐ অঞ্চলের নানা স্থান ও গ্রামজনপদেরউল্লেখ আছে। কাব্যে সৃষ্টিতত্ত্ব প্রসঙ্গে খানিকটা বৌদ্ধ প্রভাব, খানিকটা ধর্মমঙ্গলের প্রভাব আছে। এই সৃষ্টিতত্ত্বে ধর্ম-নিরঞ্জন আদ্যাকে সৃষ্টি করলেন এবংদ্যাদেবীই পরে চণ্ডীতে রূপান্তরিত হলেন। তারপর ধর্ম রহ্মা-বিষ্ণুমহেশ্বরকে সৃষ্টি করলেন এবং আদ্যা-চণ্ডীকে বিবাহ করতে মহাদেবকে নির্দেশদিলেন। এইভাবে ধর্মমণ্ডলের সৃষ্টিতত্ত্ব, তারপর পৌরাণিক হর-পার্বতীরকাহিনী আরম্ভ হয়েছে। অতঃপর কবি হবে সংক্ষেপে কালকেতু ও ধনপতিরউপাখ্যান বিবৃত্ত করেছেন। পরবর্তী কালেও চণ্ডীমঙ্গলের কাহিনীগুলি এইধারাই অনূসেরণ করেছে। ভাঁড়দত্তের চরিত্রটি কিঞ্চিৎ উল্লেখ দাবী করতেপারে। তাকে বাদ দিলে মাণিকদত্তের কাব্য ছড়াপাচালী ছাড়িয়ে মঙ্গলকাব্যে

রূপান্তরিত হতে পারেনি, তা স্বীকার করতে হবে। কুদ্ধাবেশিনী চ'ডীরএই হেয়ালিটি বেশ মুখরোচক হয়েছে:


""আমারে বোল ডান বুড়িরে আমারে বোল ডান

কার থাইন, ডাতারপতে কার করিন, হানঃ

ডান নই রে ডান নই হইএ মুসারী।

বারে, বসি খাই, মুঞি চোেদ্দ ঘর পড়শী।"""


******কবিকঙ্কণ মুকুন্দরাম চক্রবর্তী-------


 শধ্যে মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যের নয়,সমগ্র বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে মকুন্দরামের একটি বিশিষ্ট স্থান নির্দিষ্টহয়েছে। বৈষ্ণব পদাবলী ও চৈতনা জীবনীকাবা বাদ দিলে মধ্যযুগে মৌলিকপ্রতিভার গৌরব একমাত্র মুকুন্দরামই দাবী করতে পারেন। কোন কোন দিকদিয়ে তাঁর সঙ্গে যেন আধুনিক মনের একটা আত্মীয়তার সম্পর্ক দেখা যায়।তিনি দেবীমাহাত্ম্যবিষয়ক মধ্যযুগীয় মঙ্গলকাব্য রচনা করলেও মর্ত্যমানবেরসুষদঃখের চিত্র তাঁর কাবো যতটা জীবন্ত হয়ে ফটেছে মধ্যযুগীয় কবির আরকোন কাবো তা প্রাণরসে ততটা উজ্জজ্জ্বল হতে পারেনি। এদিক থেকে এইমানববাদী কবি যেন আমাদের কালে এসে পড়েছেন। কাহিনী-গ্রন্থন, চরিত্র

বিন্যাস, রচনারীতি, জীবন সম্বন্ধে প্রসন্ন ভাবগম্ভীর অথচ বাস্তবনিষ্ঠ দৃষ্টিভঙ্গী বিচার করলে তাঁর ভালে অনন্যসাধারণত্বের টাঁকা পরিয়ে দিতেই হবে।পুরাতন যুগে জন্মেও তিনি যেন আমাদের কালে এসে পড়েছেন।

তাঁর কাবা সাধারণতঃ 'অভয়ামঙ্গল' নামে পরিচিত। এর গোড়ার দিকেকবি যে আত্মকাহিনী সংযোগ করেছেন, তা যেমন তথ্যবহ, বাস্তবধর্মী, তেমনিঐতিহাসিক পটভূমিকা হিসেবে অতিশয় মূল্যবান। এতে তাঁর জীবন ওতৎকালীন রাষ্ট্রসংকটের নির্মম বাস্তবচিত্র এমন নিষ্ঠার সঙ্গে বর্ণিত হয়েছে।যে, বাংলার সামাজিক ইতিহাসের উপাদান হিসেবে এর মূল্যে অসাধারণ। এইবর্ণনা থেকে দেখা যাচ্ছে মুঘল-পাঠানের সংঘর্ষের পটভূমিকায় কবির আবির্ভাবহয়েছিল। বর্ধমানের দামিন্যা গ্রামে তাঁদের অনেককালের বাস। কৃষির বারাতাঁদের সাংসারিক অবস্থা মোটামটি মন্দ ছিল না। ইতিমধ্যে গৌড় থেকেকররানি বংশের শাসন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ল, মুঘল অভিযান শুরু হয়ে গেল। এবং সে এক বিশৃঙ্খল পরিবেশ সৃষ্টি হয়ে ছিলো। পেয়েছেন যখন কবি দ্বীপত্রের হাত ধরে পথে বেরিয়েছিলেন। এ বিষয়ে কোনসুচিন্তিত সিদ্ধান্তে পৌছানো সহজ নয়। তবে নানা উল্লেখ থেকে মনে হচ্ছেতাঁর চণ্ডীমপাল) ষোড়শ শতাব্দীর শেষের দিকেই সম্পূর্ণতালাভ করেছিল- অবশ্য কাব্যরচনা আরম্ভ হয়েছিল এর অনেক আগে। কারণএত বড়ো একখানি কাব্য রচনায় অনেক সময় লেগেছিল এই রকম অনুমানই

মানুষরাম দুইখণ্ডে (কালকেতু ও ধনপত্তির আধ্যান) চণ্ডীমশালেরবিশাল পরিকল্পনা করেছিলেন—লোকপ্রচলিত কাহিনীই তাঁর অবলম্বন, তাঁরপূর্ববর্তী কবি মাণিকদত্তের কাহিনীও তাঁকে কিঞ্চিৎ সাহায্য করে থাকবে।কালকেতুর কাহিনী যখন অতিশয় নিপুণ হয়েছে। কিন্তু ধনপতির কাহিনঅনাবশাক বর্ণনার দূরভাবে পীড়িত, কাহিনীও স্থানে স্থানে অভিশয় শিথিল।তবে চরিত্রসৃষ্টিতে তাঁর কৃতিত্ব মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যে অতুলনীয়। বাস্তবঅভিজ্ঞতা ও জীবনের প্রতি প্রসন্নতা তাঁকে অসাধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন চরিচয়টাপরিণত করেছে। কালকেতু-ফল্লরা-ভাঁড়স, গহনা-না-পূর্ব লা-শ্রীমতপ্রভৃতি চরিত্রগুলি এখনও যেন আমাদের প্রতিবেশী ও অতিপরিচিত চরিত্র বলেমনে হয়। এদের পাঁচাপাচি সাধারণ জীবন প্রতিদিনের অভিজ্ঞতা ও বাস্তববোধের মযারা নিয়ন্তিত হবার ফলে এরা বিরাট কোন আদর্শের জন্য নয়, সহজমানবিক গুণেই আমাদের কালে এসে পৌঁছেছে। বাস্তবতা ও মানবধর্ম মধ্যযুগীয় এই ব্রাহ্মণকবিকে একেবারে আধুনিক সাহিত্যিকদের পাশে স্থাপনকরেছে। সরল পরিহাস, সংখদঃখের ছোট ছোট ছবি, হাসি-কান্নার 'ধপেছায়া' :প্রভৃতি বৈশিষ্ট্য কবির বিশাল কাব্যকে যে বাদতো দিয়েছে মধ্যযুগের কাব্যেতা দুর্লভ। চরিত্রে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যা আরোপ তার বিশেষ কৃতিত্বের পরিচায়ক-যাআধুনিক সাহিত্যের অন্তর্ভুক্ত। তাই কোন কোন সমালোচক তাঁর রচনার মধ্যেউপন্যাসের লক্ষণ আবিষ্কার করেছেন। কেউ কেউ এমন কথাও বলেছেন যে,এযুগে জন্মালে মুকুন্দরাম কাব্য না লিখে উপন্যাস লিখতেন। কথাটা সত্য।তবে মধ্যযুগের অনেক কবি সম্বন্ধেই একথা বলা যায় বিশেষতঃ মঙ্গলকাব্যেরকবিদের সম্পর্কে। সে যহুগে সাহিত্যের বাহন হিসেবে গদ্য পরিচিত ছিল না।বলেই অনেকে গদ্যাত্মক ব্যাপারও পয়ারে-বিপদীতে বর্ণনা করেছিলেন এযুগে জন্মালে এরা অনেকেই গদ্যভাষা ব্যবহার করতেন। তবে উপন্যাসের যেপ্রধান লক্ষণ বাস্তবতা ও চরিত্রসৃষ্টি–মুকুন্দরামের কাব্যে তার প্রচুর নিদর্শন আছে। সর্বোপরি এই কাব্য দূরবিস্মত কালে স্থাপিত হলেও এতেও ষোড়শ শতাব্দীর বাঙালী সমাজেরই ছবি ফটেছে, তার ঐতিহাসিক রূপ যে-কোনইতিহাসগ্রন্থের চেয়ে অধিকতর নির্ভরযোগ্য। তৎকালীন বাংলার সমাজজীবন সম্বন্ধে কিছু জানতে হলে মকুদরামেরই শরণ নিতে হবে। অবশ্য যাকেবিশুদ্ধ শিল্পলক্ষণ বলে বা বাকুরীতির মার্জিত ভাব বলে মুকুন্দরামের রচনায় সব সময়ে তা পাওয়া যায় না। বরং ভারতচন্দ্রের শিল্পকলাগত কৃতিত্বঅধিকতর প্রশংসনীয়। সে যাই হোক, মুকুন্দরাম নিজের মানসিক উদার্থেআমাদের কালে এসে পড়েছেন, দেবদেবীর মশালকথা লিখলেও তিনি মানব

মঙ্গলের কবি-একথা আজকের দিনের সমালোচকও স্বীকার করবেন। সেইদিক থেকে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে ও পাঠকমনে তাঁর যে স্থান মমূদ্রিত হয়েছে তা কোন দিনই পান হবে না।


এই প্রসঙ্গো সমসাময়িক আর কয়েকটি চণ্ডীমঙ্গল ও একখানি কালিকামঙ্গালের উল্লেখ করা যেতে পারে। অবশ্য ষোড়শ শতাব্দীতে উল্লিখিত মঙ্গলকাবাগ্গুলি বাদ দিলে, আর যে দ" একখানি মঙ্গলকাব্য রচিত হয়েছিল, তারবিশেষ কোন কাব্যমূল্য নেই। দ্বিজ জনাদন এবং বলরামের যে দংখানি চন্দ্রীঙ্গল পাওয়া গেছে তা ষোড়শ শতাব্দীর রচনা বলে মনে হচ্ছে। জনাদনেরপাখিটি ছড়াজাতীয় অকিন্ডিৎকর রচনা; এর প্রাচীনত্ব ও প্রামাণিকতা সংশয়াতীত নয়। এর একটা বৈশিষ্ট্য, এতে ধনপতি সদাগরের কাহিনী বিস্তারিত আকারে বর্ণিত হয়েছে, কালকেতুর আখ্যান প্রসঙ্গক্রমে নামমাত্র উল্লিখিত হয়েছে। কারা হিসেবে এর কোন গৌরব নেই। মেদিনীপুরের বলরাম কবিকঙ্কণ নামক এক কবির চণ্ডীমঙ্গলের সন্ধান পাওয়া গেলেও এ সম্বন্ধেযৎসামান্য নমুনা পাওয়া গেছে বলে এ বিষয়ে বিশেষ কিছু আলোচনার অবকাশনেই।

বিজমাধবের 'গঙ্গামঙ্গল' এই সময়ের রচনা হতে পারে। কিন্তু মধ্যযযুগেঅনেকগুলি কবির নাম ছিল বিজমাধব বা মাধব আচার্য। এটি কোন বিজমাধবের রচনা তা নির্দেশ করা দূরূহ। এতে প্রাণের অনুসরণে পৌরাণিককাহিনী বিবৃত হয়েছে। এর ভাষা প্রভৃতি দেখে কবিকে আরও পরবর্তী কালেআবির্ভূত বলে মনে হচ্ছে। কারও কারও মতে পূর্ববঙ্গে কবিকঙ্ক নামে এককবি বিদ্যাসন্দরের পালা লিখেছিলেন এই শতাব্দীতে। এর কোন পাখি পাওয়া যায়নি বলে এ সিদ্ধান্ত প্রমাণসহ নয়। গোবিন্দদাস নামে আর এক কবির কালিকামঙ্গল বা বিদ্যাসান্দর পাওয়া গেছে কোন কোন লেখক এ'কেও খুবপ্রাচীন কবি বলতে চান। কিন্তু কবির আবির্ভাব বা কাব্য সম্বন্ধে বিশ্বাসযোগ্য কোন সন-তারিখ পাওয়া যায়নি, উপরন্তু তাঁর ভাষা ও ভাবভঙ্গী মোটেই প্রাচীন যুগের নয়। সে যাই হোক, ষোড়শ শতকে মঙ্গলকাব্যের যে বেশ শ্রীবৃদ্ধি হয়েছিল তা স্বীকার করতে হবে। সমাজে ও জীবনে চৈতন্যদেবের প্রভাব কতটা গভীর হয়েছিল, তা এই মঙ্গলকাব্যগুলি থেকেই বোঝাযাবে। কবিরা শাক্ত মঙ্গলকাব্য লিখলেও চৈতনাপ্রভাবে বৈষ্ণব মতের প্রতি

বিশেষ অনুকূলতা দেখিয়েছেন, কেউ কেউ অন্যান্য দেবদেবীর সঙ্গে চৈতন্যদেবের বন্দনাও সেরে নিয়েছেন। সর্বোপরি ষোড়শ শতাব্দীর মঙ্গলকাব্যেসমসাময়িক দেশ ও কালের যে জীবন্ত ছবি ফুটে উঠেছে, নানা দিক দিয়ে তারমূল্য অসাধারণ।


**তথ্যসংগ্রহ....

বাংলা সাহিত্যের সম্পুর্ন ইতিবৃত্ত (ড.অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়)

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ