বাংলা নামের উৎপত্তি সম্পর্কে টিকা লিখ--
**বিঃদ্র-বাংলা বিভাগের সকল পড়াশোনা পেতে ব্লগটিতে যুক্তথাকুন https://monoweredu13.blogspot.com/?m=1
***বাংলা নামের উদ্ভব -----
ইংরেজ শাসনকালের 'বেঙ্গল' (Bengal), যা ১৯৪৭ পর্যন্ত প্রযুক্ত ছিল, উপরেআলোচিত ভূখণ্ডকেই বোঝাতো। ইংরেজদের 'বেঙ্গল' অন্যান্য ইউরোপীয়দের (বিশেষকরে পর্তুগীজদের) 'বেঙ্গালা' থেকেই নেয়া হয়েছে। এই নামটিই তারা আধিপত্যবিস্তারের সময় পেয়েছিল বা এই ভূভাগ ইউরোপীয়দের কাছে এই নামেই পরিচিত ছিল।ষোল ও সতেরো শতকে ইউরোপীয়দের লেখনীতে ‘বেঙ্গালা' নামে দেশের উল্লেখ পাওয়াযায়। সীজার ফ্রেডারিক (১৫৬৩–১৫৮১) ‘বেঙ্গালা' রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত চাটিগানের ১২০মাইল দূরে অবস্থিত 'সোন্দিব' দ্বীপের উল্লেখ করেছেন। ডুজারিক (১৫৯৯) প্রায় ২০০লীগ উপকূল বিশিষ্ট ‘বেঙ্গালা' দেশের উল্লেখ করেছেন। স্যামুয়েল পচার্স (১৬২৬)-এরবর্ণনায়ও 'বেঙ্গালা' রাজ্যের উল্লেখ রয়েছে। র্যাল্ফ ফিচ্ (১৫৮৬) 'বেঙ্গালা' দেশে‘চাটিগান’, ‘সতগাম' (সপ্তগ্রাম), 'হুগেলি' (হুগলি) এবং 'তাঙা' (রাজমহলের নিকটবর্তী)শহরের উল্লেখ করেছেন। পূর্ববর্তী ইউরোপীয় ভ্রমণকারীরা ‘বেঙ্গালা/বেঙ্গেলা/বাঙ্গালা'রাজ্য ও ঐ নামের একটি শহরের কথা উল্লেখ করেছেন। এছাড়া মার্কোপোলো (১৩শতক), ওডিংটন, ব্যুভ (১৬৫০) এবং সসেন (১৬৫২) 'বেঙ্গালা' শহরের উল্লেখকরেন। রেনেল এই নামের শহরের উল্লেখ করেছেন কিন্তু এর অবস্থিতি সম্পর্কেনিঃসন্দেহ ছিলেন না। গ্যাস্টলদি (১৫৬১) তাঁর মানচিত্রে চাটিগামের পশ্চিমে ‘বেঙ্গালা'রঅবস্থিতি দেখিয়েছেন। পর্তুগীজ ভার্থেমা, বারবোসা (১৫১৪) বা জোয়াও দ্য ব্যারোসের(১৫৫০) বর্ণনায় 'বেঙ্গালা' রাজ্য ও ‘বেঙ্গালা' শহরের উল্লেখ রয়েছে। 'বেঙ্গালা' শহরেরঅবস্থিতি সম্পর্কে পণ্ডিতবর্গের মধ্যে মতবিরোধ থাকলেও 'বেঙ্গালা' রাজ্য যে 'বাংলা'দেশঅঞ্চলকে বোঝাতো সে বিষয়ে তেমন কোন সন্দেহ নেই।বাংলা নামের উৎপত্তিমোগল আমলে এই ভূ-ভাগই 'সুবা বাঙ্গালা' বলে চিহ্নিত হয়েছিল। আবুল ফজলএই প্রদেশের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন যে, বাঙ্গালা পূর্ব-পশ্চিমে অর্থাৎ চট্টগ্রাম থেকে।তেলিয়াগড় পর্যন্ত ৪০০ ক্রোশ এবং উত্তর-দক্ষিণে, অর্থাৎ উত্তরে পর্বতমালা হতে দক্ষিণেহুগলি জেলার মন্দারণ পর্যন্ত ২০০ ক্রোশ বিস্তৃত ছিল। এই ‘সুবা' পূর্বে ও উত্তরেপর্বতবেষ্টিত এবং দক্ষিণে সমুদ্রবেষ্টিত ছিল। এর পশ্চিমে সুবা বিহার। কামরূপ ওআসাম সুবা বাঙ্গালার সীমান্তে অবস্থিত ছিল। আবুল ফজল 'বাঙ্গালাহ' নামের ব্যাখ্যাদিয়েছেন : 'বাঙ্গালাহ'র আদি নাম ছিল 'বঙ্গ'। প্রাচীনকালে এখানকার রাজারা ১০ গজ উঁচুও ২০ গল্প বিস্তৃত প্রকাশ 'আল' নির্মাণ করতেন; এ থেকেই 'বাঙ্গাল' বা 'বঙ্গালাহ' নামেরউৎপত্তি। অবশ্য আবুল ফজলের এই ব্যাখ্যা সবাই স্বীকার করে নেননি। রমেশচন্দ্রমজুমদার মনে করেন, প্রাচীন কাল হতে 'বঙ্গ' এবং 'বঙ্গাল' দুটি পৃথক দেশ ছিল।'বঙ্গাল' দেশের নাম হতেই কালক্রমে সমগ্র দেশের বাংলা' নামকরণ হয়েছে।বর্তমানকালে বাংলাদেশের অধিবাসীদেরকে যে 'বাঙ্গাল' নামে অভিহিত করা হয়, তা সেইপ্রাচীন 'বঙ্গাল' দেশের স্মৃতিই বহন করছে।
রমেশচন্দ্র মজুমদারের অনুমানও যে নিঃসন্দেহ নয়, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।বাংলার প্রাচীন জনপদসমূহের মধ্যে 'বঙ্গাল'-এর তুলনায় 'বঙ্গ' অধিক খ্যাতিমান ওগুরুত্বপূর্ণ ছিল সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই এবং 'বঙ্গ' জনপদের মধ্যেই দক্ষিণ-পূর্ববাংলার অনেক ভৌগোলিক সত্তাই অন্তর্ভুক্ত ছিল (এর মধ্যে ছিল বঙ্গাল, সমতট, চন্দ্রদ্বীপএমনকি সম্ভবত হরিকেল)। তাই 'বঙ্গ' থেকে না 'বঙ্গাল' থেকে সারা দেশের নাম'বাঙ্গালা' হয়েছে এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোন সিদ্ধান্ত করা সম্ভব নয়। নীহাররঞ্জন রায় অবশ্যআবুল ফজলের ব্যাখ্যাকে একেবারে অযৌক্তিক মনে করেননি। নদীমাতৃক বারীবহুলদেশে বন্যা ও জোয়ারের স্রোত রোধের জন্য ছোট বড় বাঁধ (আলু) নির্মাণ কৃষি ওবাস্তুভূমির যথার্থ পরিপালনের পক্ষে অনিবার্য। সুতরাং 'বঙ্গ'-এর সঙ্গে 'আল' যুক্ত হয়ে‘বঙ্গাল’ বা ‘বাঙ্গাল' বা 'বাঙ্গালা' নামকরণ খানিকটা যুক্তিসঙ্গত ।মোগলপূর্ব যুগে 'বাঙ্গালা' সমস্ত ভূখণ্ডের নাম সূচনা করতো কি ? এই প্রশ্নের উত্তরেদেখা যায় যে, বখতিয়ার খলজি কর্তৃক বাংলা বিজয়ের সময় 'বাঙ্গালা' নামে একক কোনদেশ ছিল না। ঐতিহাসিক মিনহাজ-ই-সিরাজ মুসলমানদের বাংলা বিজয়ের ইতিহাসরচনার সময় 'বাঙ্গালা' নামের উল্লেখ করেন নি; বরং বরেন্দ্র, রাঢ় এবং বঙ্গ নামে বাংলারবিভিন্ন অঞ্চলকে চিহ্নিত করেন। মিনহাজের বর্ণনায় বাংলা সম্বন্ধে তাঁর ভৌগোলিকজ্ঞানের সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়। তিনি লখনৌতি ও বঙ্গকে পৃথক পৃথকভাবে উল্লেখকরেছেন এবং যথাক্রমে উত্তর ও উত্তর-পশ্চিম বাংলা এবং পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব বাংলাকেবুঝিয়েছেন। বঙ্গের সাথে সমতট (সকনত)-এর উল্লেখও তিনি করেছেন।মিনহাজের পরবর্তী ঐতিহাসিক জিয়া-উদ-দীন বারণী সর্বপ্রথম' 'বাঙ্গালা' শব্দ ব্যবহারকরেছেন, কিন্তু সমগ্র দেশ নয়, এর অংশ বিশেষের উল্লেখ প্রসঙ্গে। পরবর্তী ঐতিহাসিকশামস্-ই-সিরাজ আফীফ সুলতান শাম্স-উদ্দ-দীন ইলিয়াস শাহকে 'শাহ্-ই-বাঙ্গালা','শাহ-ই-বাঙ্গালিয়ান' বা 'সুলতান-ই-বাঙ্গালা' রূপে আখ্যা দিয়েছেন। সুলতান ইলিয়াসশাহ সমস্ত বাংলায় একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করেন। তাঁর পূর্বে অন্য কোন মুসলমানশাসক দীর্ঘকাল বাংলার সমগ্র ভূখণ্ড শাসন করেছেন একথা জোর দিয়ে বলা যায় না।ইলিয়াস শাহ বাংলার তিনটি শাসনকেন্দ্রেই (লখনৌতি, সাতগাঁও ও সোনারগাঁও) নিজআধিপত্য বিস্তার করেন এবং বাংলায় স্বাধীন সুলতানির প্রকৃত ভিত্তি স্থাপন করেন। এইস্বাধীনতা প্রায় দু'শো বছর ধরে অক্ষুণ্ণ ছিল। তাই ইলিয়াস শাহ্ মুসলমান সুলতানদেরমধ্যে প্রকৃত অর্থেই প্রথম 'শাহ্-ই-বাঙ্গালা' বা 'সুলতান-ই-বাঙ্গালা'।সুতরাং একণা নিঃসন্দেহে বলা চলে যে, আফীফ 'বাঙ্গালা' বলতে সারা বাংলাকেঅর্থাৎ আবুল ফজলের 'বাঙ্গালা' বা ইউরোপীয়দের ‘বেঙ্গালা’, ‘বেঙ্গল'-কে বুঝিয়েছেন।তাই ইলিয়াস শাহের সময় থেকেই প্রথম 'বাঙ্গালা' তার ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।এর আগে, এমনকি মুসলমান-পূর্ব যুগে, এই ব্যাপক অর্থে 'বাংলা' বা 'বাঙ্গালা'র ব্যবহারপাওয়া যায় না। ঐ সময়ে 'বঙ্গ' বা 'বঙ্গাল' দ্বারা বাংলার অংশবিশেষকে নির্দেশ করাহতো। তাই 'বাঙ্গালা' নামের প্রচলন ইলিয়াস শাহ্-এর সময় থেকেই শুরু হয়েছে একথানিঃসন্দেহে বলা চলে। সুকুমার সেন 'বঙ্গ' থেকে 'বাঙ্গালা' বা 'বাঙ্গালাহ্'র উৎপত্তিহয়েছে, 'বাঙ্গালা' নামটি মুসলমান অধিকারকালে সৃষ্ট এবং ফারসি 'বাঙ্গালাহ্' থেকেপর্তুগীজ 'বেঙ্গালা' ও ইংরেজি ‘বেঙ্গল' এসেছে বলে মত প্রকাশ করেন।
***বাংলার ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য***---
ভূ-প্রাকৃতিক গঠন বৈশিষ্ট্যের আলোকে বাংলার পাঁচটি ভাগ ধরা যায় : উত্তর বাংলার পাললিক সমভূমি; ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা অন্তবর্তী ভূভাগ; ভাগীরথী-মেঘনা অন্তর্বর্তী ব-দ্বীপ; চট্টগ্রামের অনুচ্ছ পার্বত্য এলাকা এবং বর্ধমানাঞ্চলের অনুচ্চ পার্বত্য এলাকা । বাংলার ভূ-প্রকৃতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নদীর। বাংলার বিস্তীর্ণ ভূভাগ
নদীবাহিত পলি দ্বারা গঠিত এবং পশ্চিম, উত্তর ও পূর্ব বাংলার কিছু অংশ ছাড়া বাংলার প্রায় সবটাই ভূতত্ত্বের আলোকে নবসৃষ্ট (new alluvium) । পশ্চিম, উত্তর ও পূর্বদিকের সীমান্তবর্তী পর্বতমালা ছাড়া বাকি সবটাই সমতলভূমি এবং এই সমগ্র ভূ-ভাগই নদীমালার ব-দ্বীপ বা 'ডেল্টা' বলে অনেকেই মত প্রকাশ করেছেন। ওল্ডহাম পশ্চিমে হুগলি নদী থেকে পূর্বে মেঘনা নদী পর্যন্ত বিস্তীর্ণ ভূ-ভাগকেই গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র নদীমালার ‘ডেল্টা' বলে উল্লেখ করেছেন। বাংলার ভূমি গঠনের ভূ-তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করে কোন্ অংশ মূলত ‘ডেল্টা' সে বিষয়ে কে. বাগচী আরও তথ্য পরিবেশন করেন। বাঁকুড়া, বর্ধমান, বীরভূম এবং মেদিনীপুর জেলার পশ্চিমাংশ, ছোট নাগপুর পর্বত শাখারই বিস্তৃতি, এই ভূ-ভাগের অন্তঃস্থলে কঠিন উপরিভাগে সামান্য পলি; মেদিনীপুরের পূর্বাংশ ‘পিডমন্ট' (Pledmont) সমভূমি। উত্তরে তরাই অঞ্চল থেকে দক্ষিণে পদ্মার প্রবাহ এবং পশ্চিমে গঙ্গা-পদ্মা থেকে পূর্বে ব্রহ্মপুত্র পর্যন্ত ভূ-ভাগ, কিংবা ব্রহ্মপুত্র-সুরমা অন্তর্বর্তী ভূ-ভাগ মূলত পাললিক প্রকৃতির, তবে অপেক্ষাকৃত প্রাচীন। উত্তর-পূর্ব ও পূর্বে অবস্থিত সিলেট ত্রিপুরা-চট্টগ্রাম পর্বতমালা ‘টারশিয়ারী' পাহাড়। উত্তরে পদ্মা, পশ্চিমে ভাগীরথী, পূর্বে মেঘনা এবং দক্ষিণে সাগর পর্যন্ত বিস্তৃত ভূ-ভাগ মূলত প্লাবন সমভূমি এবং গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র দ্বারা গঠিত ব-দ্বীপ বা 'ডেল্টা'।
0 মন্তব্যসমূহ