***বাংলার জনপদ
প্রাচীন বাংলার জনপদ প্রাচীন বাংলার জনপদের গুরুত্ব পুণ্ড্রবর্ধন বরেন্দ্র
সুক্ষ রাঢ় গৌড় বঙ্গ
বঙ্গাল সমতট হরিকেল---
**বিঃদ্র-বাংলা বিভাগের সকল পড়াশোনা পেতে ব্লগটিতে যুক্তথাকুন https://monoweredu13.blogspot.com/?m=1
***বাংলার জনপদ---
বাংলার প্রাচীন জনপদসমূহের ভৌগোলিক অবস্থিতি অনেকাংশে, ভূ-প্রকৃতি এবংবিশেষ করে নদীর স্রোতধারা দ্বারা নির্ধারিত হয়েছে। প্রাচীন
যুগে বাংলা বলতে সমগ্র দেশকে বোঝাতো না। এর বিভিন্ন অংশ বিভিন্ন নামে পরিচিতছিল। নামগুলি বেশির ভাগই প্রাচীন জনগোষ্ঠীর নামানুসারে প্রচলিত নাম। এরভৌগোলিক পরিমণ্ডল প্রাকৃতিক পরিবর্তনের সঙ্গে পরিবর্তিত হয়েছে। আবার রাজনৈতিকক্ষমতার বিস্তার বা হ্রাসও এদের পরিমণ্ডল পরিবর্তন করেছে। নিচে এই জনপদগুলিসম্পর্কে একে একে আলোচনা করা হলো।
(ক) পুণ্ড্রবর্ধন, বরেন্দ্র--
পুত্র/পৌণ্ড্র পূর্বাঞ্চলীয় জনপদসমূহের মধ্যে সুপ্রাচীন নাম। পুণ্ড্রদের আবাসস্থলই পুণ্ড্রবা পুণ্ড্রবর্ধন নামে খ্যাত হয়েছিল। আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীর মহাস্থানব্রাহ্মীলিপিতে উল্লিখিত ‘পুদনগল' (পুণ্ড্রনগর) ও বগুড়ার মহাস্থান যে অভিন্ন এবং পুণ্ড্রনগরযে পুণ্ড্রদের আবাসস্থল পুণ্ড্রবর্ধনের কেন্দ্র সে সম্পর্কে সন্দেহের অবকাশ নেই। পুণ্ড্রবর্ধনেরঅবস্থিতি অত্যন্ত স্পষ্টভাবে ধরা পড়েছে সপ্তম শতাব্দীর চৈনিক ভ্রমণকারী য়ুয়ান চোয়াংএর বর্ণনায়। তিনি গঙ্গা অতিক্রম করে ৬০০ লি যাওয়ার পর ‘পুন-ন-ফ-তন-ন' দেশেপৌঁছেন এবং সেখান থেকে ৯০০ লি পথ পূর্বদিকে গমন করে 'ক-মো-লু-গো' দেশেপৌঁছেন, পথে তাঁকে একটি বড় নদী পার হতে হয়েছিল। 'পুন-ন-ফ-তন-না দেশেররাজধানী শহরের ২০ লি পশ্চিমে 'পো-শিপ-পো' বিহারের উল্লেখ রয়েছে। কানিংহামঅনেক আগেই অনুমান করেছিলেন যে 'পুন-ন-ফ-তন-ন' (পুণ্ড্রবর্ধন) ও মহাস্থান অভিন্ন
এবং মহাস্থানের ৪ মাইল পশ্চিমে 'বাসু বিহার'ই যুয়ান চুয়াং-এর ‘পো-শিপ-পো' বিহার।বর্তমানে প্রত্নতাত্ত্বিক খননের ফলে বাসু-বিহারের ধ্বংসাবশেষ উদ্ঘাটন করা হয়েছে এবংকানিংহামের সনাক্তকরণ এখন নিঃসন্দেহ। রাজমহলের ১৮ মাইল দক্ষিণে কজঙ্গলথেকে পুণ্ড্রবর্ধন হয়ে করতোয়া নদী পার হয়ে য়ুয়ান-চুয়াং কামরূপ গিয়েছিলেন। কজঙ্গলও করতোয়ার মধ্যবর্তী ভূ-ভাগই পুণ্ড্রবর্ধন এবং এই এলাকার কেন্দ্র পুণ্ড্রনগর মহাস্থান যারউপকণ্ঠে ছিল বাসু বিহার। কজঙ্গল থেকে গঙ্গা পার হয়ে বুয়ান চুয়াং পুণ্ড্রবর্ধনে প্রবেশকরেছিলেন; তাই বলা যায় পশ্চিমে গঙ্গা (পদ্মা স্রোত) থেকে পূর্বে করতোয়া পর্যন্তভূভাগই পুণ্ড্রবর্ধন। রাজনৈতিক ক্ষমতার সম্প্রসারণ অনেক সময় ভৌগোলিকঅস্তিত্বসমূহের পরিমণ্ডল বৃদ্ধি করেছে – এ সত্যের এক উজ্জল দৃষ্টান্ত পুণ্ড্রবর্ধন।
পুণ্ড্রের সাথে সহ-অবস্থান করছে আর একটি প্রাচীন ভৌগোলিক সত্তা: বরেন্দ্র বাবরেন্দ্রী। 'ত্রিকাগুশেষ' অভিধানে বরেন্দ্রী ও পুণ্ড্র অভিন্ন বলা হয়েছে। বেশ কয়েকটি লিপিপ্রমাণে একথা বলা যায় যে বরেন্দ্র পুণ্ড্রবর্ধনেরই অংশবিশেষ। 'রামচরিত' কাব্যে পালদের‘জনকভু’ বরেন্দ্রীর বর্ণনা দিয়ে বলা হয়েছে যে, এর দক্ষিণে ছিল গঙ্গা ও পূর্বে করতোয়াএবং ‘পুণ্ড্রবর্ধনপুর' ছিল বরেন্দ্রের প্রধান নগর। মিনহাজের ‘ডাবকাৎ-ই-নাসিরি' গ্রন্থে‘বারিন্দ্র' বলে (বরেন্দ্র) লখনৌতি রাজ্যের (মুসলমানদের প্রাথমিক সাম্রাজ্য নিঃসন্দেহে
উত্তর বাংলা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল) গঙ্গা-পূর্ববর্তী এলাকাকে নির্দেশ করা হয়েছে।
(খ) সুহ্ম ও রাঢ়----
খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীর পতঞ্জলীর মহাভাষ্যে বঙ্গ ও পুণ্ড্রের সাথে 'সুহ্ম'-এর উল্লেখরয়েছে। মহাকাব্যে ও পুরাণসমূহে প্রাচ্যদেশে 'সুহ্ম'-এর নাম পাওয়া যায়। ভীম তাঁরপূর্বদেশ বিজয়াভিযানে ‘বঙ্গ’দের পরাজিত করে একে একে তাম্রলিপ্ত, কর্বট, সুহ্মরাজকেপরাজিত করেন এবং সমুদ্রোপকূলবর্তী জনগোষ্ঠীকে পদানত করেন। এই উল্লেখ থেকেসুক্ষের অবস্থিতি সম্পর্কে এ ধারণা করা সম্ভব যে সুগ্ধ সমুদ্রোপকূল ও তাম্রলিপ্তিরনিকটবর্তী ছিল। তাম্রলিপ্তি বন্দরও সম্ভবত সুহ্মেরই অন্তর্ভুক্ত ছিল। ত্রয়োদশ শতাব্দীর
‘পবনদৃত' কাব্যে সুহ্মদেশের বিবরণ পাওয়া যায়। হুগলি জেলার ত্রিবেনী এলাকাইসুহ্মদেশ ছিল বলে পবনদূত' সূত্রে অনুমিত হয়। মোটামুটিভাবে 'সুহ্মদেশ' বলতেপশ্চিম বাংলার দক্ষিণাঞ্চলকেই বোঝাতো। যদিও এর সীমা নির্ধারণ করা সম্ভব নয়।সুখের সঙ্গে সম্পর্কিত ভূছিল রাঢ় যা জৈন সূত্রে 'লাঢ়' বলেও উল্লিখিতহয়েছে। 'সুগ' ছিল সম্ভবত রাঢ়েরই অংশবিশেষ এবং সম্ভবত দক্ষিণাংশ যা পরবর্তীকালে‘দক্ষিণ রাঢ়' বলে অভিহিত হয়েছে। শ্রীলংকার বৌদ্ধ ঐতিহ্য-সংবলিত গ্রন্থ 'দীপবংশ' ও'মহাবংশ'-এ লাল (রাঢ়) এর সিংহপুরের রাজা বিজয় কর্তৃক শ্রীলংকায় উপনিবেশস্থাপনের কথা আছে। বাংলার সেন রাজাদের পূর্বপুরুষ দাক্ষিণাত্য থেকে এসে প্রথমে'রাঢ় অঞ্চলে বসতি স্থাপন করেছিলেন। 'তারকাৎ-ই-নাসিরি' গ্রন্থে 'রাল' (রাঢ়) গঙ্গানদীর পশ্চিমে অবস্থিত লখনৌতি রাজ্যের বাম দিকের অংশ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে।জাও দ্য ব্যারোসের নশায় বর্তমানের বর্ধমান বিভাগের বিশাল ভূভাগ এবং ভাগীরথীরপশ্চিমে এই ভূভাগ (রাঢ়) গৌড়েরও পশ্চিমে (দক্ষিণ-পশ্চিমও বলা যেতে পারে)অবস্থিত ছিল বলে দেখানো হয়েছে।
দশম শতাব্দী থেকে বিভিন্ন লিপি ও সাহিত্যিক সূত্রে রাঢ়ের দুটি অংশের উল্লেখপাওয়া যায় : উত্তর রাঢ় ও দক্ষিণ রাঢ়। দাক্ষিণাত্যের ঢোল সম্রাট রাজেন্দ্র চোলের
(১০১২–১০৪৪ খ্রিস্টাব্দ) তিরুমুলাই লিপিতে তাঁর উত্তর ভারত অভিযানের যে বিবরণরয়েছে তা থেকে রাঢ়ের দুটি অংশ ও তাদের অবস্থান সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা করা যায়।লিপিসূত্রে যেসব তথ্য পাওয়া যায় তা থেকে এটুকু ধারণা করা সম্ভব যে, উত্তর রাঢ়মুর্শিদাবাদ জেলা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল এবং সম্ভবত অজয় নদী উত্তর রাঢ় ও দক্ষিণ রাঢ়-এরমধ্যে সীমা নির্দেশ করতো। মোটামুটিভাবে একথা বলা যেতে পারে যে, ভাগীরথীরপশ্চিম তীরে মুর্শিদাবাদ জেলা থেকে দক্ষিণে সমুদ্র পর্যন্তই হয়তো বিস্তৃত ছিল রাঢ় দেশ।
(গ) গৌড়------
'গৌড়' নামটি সুপ্রাচীন ও সুপরিচিত হলেও এর অবস্থিতি সম্পর্কে সঠিক ধারণা করাকষ্টসাধ্য। বাংলার প্রাচীন জনপদসমূহের যুগে যুগে পরিমণ্ডল সম্প্রসারণের এক উজ্জ্বলদৃষ্টান্ত 'গৌড়'। এর খ্যাতি এতোই বৃদ্ধি পেয়েছিল যে সমস্ত বাংলাকেই গৌড়দেশ বলেসময়ে সময়ে আখ্যা দেওয়ার দৃষ্টান্ত রয়েছে। পূর্ব ভারতীয় দেশসমূহের সামগ্রিক নামহিসেবে এমনকি উত্তর ভারতের আর্যাবর্তের নাম হিসেবেও গৌড়ের ব্যবহার দেখা যায়।বাংলা-বিহার অঞ্চলের অনেক নরপতিই 'গৌড়েশ্বর' নামে খ্যাত ছিলেন। সেনবংশীয়রাজারা 'গৌড়েম্বর' উপাধি ধারণ করেছিলেন। ব্যাপক অর্থে ‘গৌড়’ বলতে অনেক সময়বাংলা ভাষা-ভাষী সমগ্র অঞ্চলকে বোঝাতো। আদি গৌড়াঞ্চলের রাজনৈতিক ক্ষমতার
সম্প্রসারণই (শশাঙ্ক থেকে পাল যুগ পর্যন্ত) এই ব্যাপকতা দানের প্রধান কারণ।
সংকীর্ণ অর্থে আদিকালে গৌড় বলতে বর্তমানের মুর্শিদাবাদ জেলা ও মালদা জেলারদক্ষিণাংশকে বোঝাতো। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে বঙ্গ ও পুণ্ড্রের সঙ্গে গৌড়ের উল্লেখ আছেলিপি প্রমাণে গৌড় সমুদ্রোপকূল পর্যন্ত ছিল বলে অনুমান করা যায়। য়ুয়ান চোয়াংশশাঙ্ককে কর্ণসুবর্ণ দেশের সম্রাট বলে উল্লেখ করেছেন। আবার 'হর্ষচরিত' গ্রন্থেশশাঙ্ককে 'গৌড়াধিপতি' বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে কর্ণসুবর্ণদেশ ও গৌড়দেশ অভিন্ন। রাজধানী শহর কর্ণসুবর্ণকে বর্তমানে সনাক্ত করা সম্ভবহয়েছে। মুর্শিদাবাদের ১২ মাইল দক্ষিণে, বেরহামপুরের ৬ মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে, চিরুটিরেল স্টেশনের দেড় মাইল দূরে ভাগীরথীর ডান তীরে রাঙামাটি ও য়ুয়ান চোয়াং-এর‘রক্তমৃত্তিকা বিহার’ অভিন্ন বলে প্রমাণিত হয়েছে। শশাংকের সাম্রাজ্য সম্প্রসারণের সঙ্গেসঙ্গে হয়তো 'গৌড়' দেশ অধিকতর ব্যাপ্তি লাভ করেছে।'গৌড়' জনপদ সম্পর্কে একথা বলা যায় যে, প্রাথমিক পর্যায়ে এর অবস্থিতি ছিলপশ্চিম বাংলার অংশ বিশেষে। মালদা-মুর্শিদাবাদ-বীরভূম-বর্ধমান অঞ্চলকে কেন্দ্র করেইএর আদি পরিচিতি। কোন সময় হয়তো দক্ষিণ দিকে সমুদ্র পর্যন্ত এর বিস্তৃতি ঘটেছিল।শশাঙ্কের রাজত্বকালেই এর বিস্তৃতি; হয়তো উত্তর বাংলা এবং উড়িষ্যা পর্যন্ত গৌড়
রাজ্যের বিস্তৃতি এ সময়েই ঘটে। এর বিস্তৃতি প্রসূত খ্যাতিই পরবর্তীকালে পাল রাজাদেরবিদেশী সূত্রে 'গৌড়েশ্বর' বা গৌড়রাজ' বা 'গৌড়েন্দ্র' বলে উল্লেখের কারণ। গৌড়েরসাংস্কৃতিক কৃতিত্বের প্রমাণ স্বরূপই 'গৌড়ীয় রীতি', যা সংস্কৃত সাহিত্য সৃষ্টিতে স্বীকৃতি
পেয়েছিল।
(ঘ) বঙ্গ----
উপজাতীয় নাম হিসেবে 'বঙ্গ'-এর প্রাচীনতম উল্লেখ ‘ঐতরেয় আরণ্যক' গ্রন্থেযেখানে 'বঙ্গ' ও 'মগধ'দের কথা বলা হয়েছে। বৌধায়ন ধর্মসূত্র'-এ আর্যসভ্যতা বহির্ভূতএবং কলিঙ্গদের প্রতিবেশী হিসেবে 'বঙ্গ'-এর উল্লেখ করা হয়েছে। পুরানে প্রাচ্যদেশেরতালিকায় বঙ্গের উল্লেখ রয়েছে। রামায়ণে অযোদ্ধার সঙ্গে মৈত্রীসূত্রে আবদ্ধ বলে বঙ্গদেরউল্লেখ করা হয়েছে। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে বঙ্গের শ্বেত-স্নিগ্ধ বস্ত্রের উল্লেখ আছে।মহাভারতের ‘দিগ্বিজয়' অংশে ভীমের 'পুত্র' থেকে বঙ্গদের আক্রমণের কথা রয়েছে।উপরে উল্লেখ থেকে মনে হয়, 'বঙ্গ' ছিল পূর্বাঞ্চলীয় সুপরিচিত একটি দেশ।
কালিদাসের 'রঘুবংশ' কাব্যে বঙ্গের অবস্থান সম্পর্কে কিছু তথ্য পাওয়া যায়। রঘু‘সুহ্ম'দের পরাজিত করে 'বঙ্গ'দের উৎখাত এবং 'গঙ্গাস্রোতোহন্তরেষু অঞ্চলে জয়স্তম্ভ
স্থাপন করেন। একই স্লোকে 'বঙ্গ'দের 'নৌসাধনোদ্যতান' বলে আখ্যা দেওয়া হয়েছে।‘গঙ্গাস্রোতোহন্তরেষু’র ব্যাখ্যা হিসেবে একথা স্বীকৃতি পেয়েছে যে, এতে গঙ্গা-স্রোতঅন্তবর্তী ভূ-ভাগকেই বোঝানো হয়েছে। গঙ্গার দুই প্রধান স্রোত অর্থাৎ ভাগীরথী ও পদ্মারস্রোত-অন্তর্বর্তী এলাকা যে ত্রিভুজাকৃতি ব-দ্বীপ সৃষ্টি করেছে তাই 'বঙ্গ'দের অঞ্চল,যেখানে রঘু নৌসাধনোদ্যত বঙ্গদের পরাস্ত করে জয়স্তম্ভ স্থাপন করেছিলেন। এই অঞ্চলই
সম্ভবত টলেমীর ‘গঙ্গারিডাই'।
অষ্টাদশ শতাব্দীর একটি সূত্রে সাগর থেকে ব্রহ্মপুত্র পর্যন্ত বিস্তৃত ভূভাগ 'বঙ্গ' বলেবর্ণিত হয়েছে। ব্রহ্মপুত্র নদীর যে প্রবাহ ময়মনসিংহের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হতো,সম্ভবত এই প্রবাহই বঙ্গের উত্তর ও পূর্বসীমা নির্ধারণ করতো। এই সূত্রে বঙ্গের সীমাদক্ষিণে সুন্দরবনাঞ্চলের পূর্বপ্রান্ত থেকে উত্তরে ময়মনসিংহ জেলার ব্রহ্মপুত্র প্রবাহ পর্যন্তনির্ধারণ করা সম্ভব। আবার বিশ্বরূপ সেনের সাহিত্য পরিষদ লিপিতে বঙ্গের নাব্যভাগেরউল্লেখ থেকে অনুমান করা যায় ঢাকা-ফরিদপুর-বরিশাল এলাকা বঙ্গের অন্তর্ভুক্ত ছিল।‘বৃহৎ সংহিতা' ভারতের দক্ষিণ-পূর্ব ভাগে 'উপবঙ্গ' জনপদের উল্লেখ করেছে। সতেরোশতকের 'দিগ্বিজয় প্রকাশ’ গ্রন্থের উল্লেখ থেকে 'উপবঙ্গ' বলতে যশোর ও তৎসংলগ্নবনভূমিকে (সম্ভবত সুন্দরবন) বোঝাতো বলে মত প্রকাশ করা হয়েছে। এখানে উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক হবে যে, বাংলায় মুসলমান শাসন বিস্তারের প্রাথমিকপর্যায়ে 'বঙ্গ' বলে বাংলার দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব অংশকেই বোঝানো হতো। মিনহাজেরবর্ণনায় লক্ষণ সেনের 'বঙ্গ' ও সকনতে (সমতটে) আশ্রয় নেয়ার কথা কিংবা গিয়াসউদ্দীন ইওজ কর্তৃক 'বঙ্গ' থেকে কর আদায় করার যে সব উল্লেখ রয়েছে তা সবইদক্ষিণ-পূর্ব বাংলাকে নির্দেশ করতো। সুতরাং বঙ্গের এই ভৌগোলিক পরিচিতি হিন্দুবৌদ্ধ যুগ পেরিয়ে মুসলিম যুগের প্রাথমিক পর্যায়ে তো ছিলই, খুব সম্ভবত 'বাঙ্গালাহ'নামের বিকাশ পর্যন্তই ছিল।
ঙ.বঙ্গাল-----
বঙ্গের সঙ্গে আর একটি নাম সাধারণত বলা হয়ে থাকে—বঙ্গাল। ধ্বনিগত দিকথেকে উভয়ের মিল আছে এবং সম্ভবত বঙ্গেরই অংশবিশেষ ছিল বঙ্গাল। 'বঙ্গ'-এর সঙ্গেপ্রাকৃত 'আল' যোগ করে 'বঙ্গাল' হয়েছে এবং বঙ্গের অন্তর্ভুক্ত কোন বিশেষ এলাকারঅর্থে বঙ্গাল।
বঙ্গাল-এর ব্যবহার মূলত দক্ষিণী লিপিতে। রাজেন্দ্র চোলের তিরুমুলাই লিপিতেউল্লিখিত চোল অভিযান দক্ষিণ রাঢ় থেকে বঙ্গাল দেশে এসেছিল (যেখানে বৃষ্টি কখনোথামে না) এবং গোবিন্দচন্দ্রকে পরাজিত করেছিল। দ্বাদশ শতাব্দীর দুই/একটি লিপিতেবঙ্গ ও বঙ্গালের পাশাপাশি উল্লেখ দেখা যায়। এই সব উল্লেখ থেকে পণ্ডিতগণ 'বঙ্গাল'কে বঙ্গের অংশ বা বঙ্গের সমুদ্র তটশায়ী দক্ষিণভাগ বা সমস্ত পূর্ব বঙ্গ বলে মনেকরেছেন, কিন্তু বঙ্গালের অবস্থিতি নির্দিষ্ট করা সম্ভব হয়নি। তবে একথা বলা বোধ হয় খুবঅযৌক্তিক হবে না যে বাংলার বাইরে বিশেষ করে দক্ষিণ ভারতে, বঙ্গ ও বঙ্গাল খুবএকটা পৃথক চিন্তায় ব্যবহৃত হয়নি। বঙ্গ বলে যে বিস্তীর্ণ ভূ-ভাগকে চিহ্নিত করা সম্ভবতাই ‘বঙ্গাল' বলে উল্লিখিত হয়েছে; এই উল্লেখ যে খুব একটা বিশেষ অঞ্চল নির্দেশক
ছিল এমন কথা জোর দিয়ে বলা সম্ভব নয়।
(চ) সমতট : পট্টিকেরা---
দক্ষিণ-পূর্ব বাংলার আর একটি জনপদ সমতট। নামটি বর্ণনাসূচক। চতুর্থ শতাব্দীরসম্রাট সমুদ্রগুপ্তের এলাহাবাদ প্রশস্তিতে তাঁর রাজ্যের পূর্ব সীমান্তে অবস্থিত করদ
রাজ্যসমূহের মধ্যে নেপাল, কর্তৃপুর, ডবাক, কামরূপ ও সমতটের উল্লেখ রয়েছে।কালিদাসের 'রঘুবংশ'-এর কাব্যের নায়ক সমুদ্রগুপ্ত ছিলেন বলেই মনে করা হয় এবং
তাহলে সমুদ্রগুপ্ত 'বঙ্গ' এলাকা জয় করেছিলেন বলে ধরতে হবে। সেক্ষেত্রে পূর্বসীমান্তবর্তী সমতট বঙ্গের পূর্বে অবস্থিত বলেই নির্দেশ করতে হয়। বৃহৎসংহিতায় পুণ্ড্র,তাম্রলিপ্তক, বর্ধমান এবং বঙ্গের সঙ্গে 'সমতট জনপদের উল্লেখ আছে। সপ্তম শতাব্দীরসমতটে এসেছিলেন য়ুয়ান চোয়াং। কামরূপ থেকে দক্ষিণ দিকে ১২০০/১৩০০ লি দূরেসমুদ্রোপকূলে অবস্থিত নিচু ও আর্দ্র সমতটের কেন্দ্র শহরের পরিধি ছিল ২০ লি। তিনি
বৌদ্ধ সংস্কৃতির বিদ্যমান অবস্থার যে বর্ণনা রেখে গেছেন তা থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যেতিনি কুমিল্লার লালমাই অঞ্চলে বৌদ্ধ সাংস্কৃতিক কেন্দ্রেই এসেছিলেন এবং এই অঞ্চলেইদানীং প্রত্নতাত্ত্বিক খনন ও আবিষ্কার এই বৌদ্ধ সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের বিস্তারিত চিত্রআমাদের সামনে উদ্ঘাটিত করেছে।
সমতটের ভৌগোলিক অবস্থান সম্পর্কে আরও স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায় ইৎ সিং প্রণীতছাপ্পান্ন জন চৈনিক বৌদ্ধ ভ্রমণের ভারত পরিভ্রমণের বিবরণে। ইৎ সিং তাঁর বিবরণেসপ্তম শতাব্দীর শেষার্ধে শেংচি নামক শ্রমণের ভ্রমণ-বৃত্তান্ত লিপিবদ্ধ করেছেন, যিনিসমতট অঞ্চলে রাজভট নামক রাজার কথা উল্লেখ করেছেন। এই রাজভট ও খডুগরাজবংশ সম্ভৃত 'রাজরাজভট্ট’ এক ও অভিন্ন এবং খডুগ বংশ তাদের রাজধানী কর্মান্ত
(কুমিল্লা শহরের ১২ মাইল পশ্চিমে অবস্থিত বড় কামৃতা) থেকে শাসন করতো বলেমনে করা হয়। কুমিল্লা শহরের ১৪ মাইল দক্ষিণে অবস্থিত দেউলবাড়ি গ্রামে প্রাপ্ত ‘শর্বাণী'মূর্তি লিপি প্রমাণে এই সনাক্তকরণ আরো দৃঢ় হয়।
কুমিল্লা শহরের ১৮ মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত কৈলান গ্রামে প্রাপ্ত শ্রীধারণরাতেরতাম্রলিপিতে তাঁদেরকে ‘সমতটেশ্বর' বলে আখ্যা দেওয়া হয়েছে। তাঁদের রাজ্যেরকেন্দ্রস্থল ছিল 'ক্ষীরোদা' নদীর তীরবর্তী 'দেবপর্বত'। খড়্গ-পরবর্তী যুগে কুমিল্লা অঞ্চলেশাসন করতো 'দেব' রাজবংশ এবং তাঁদের লিপিতেও ক্ষীরোদা তীরবর্তী দেবপর্বতেরউল্লেখ রয়েছে। এই অঞ্চলে পরবর্তী রাজবংশ ‘চন্দ্র'দের তাম্রলিপিতেও সমতট ওদেবপর্বতের উল্লেখ পাওয়া যায়। এইসব লিপি প্রমাণ পর্যালোচনা করে দেবপর্বত ওক্ষীরোদা নদী সনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে। দেবপর্বত' খুব সম্ভবত নিকটবর্তী মরা নদী
‘ক্ষীরা’ যার খাতের কিছু চিহ্ন এখনও বিদ্যমান।
(ছ) হরিকেল----
হরিকেল জনপদের প্রথম লিপি উল্লেখ পাওয়া যায় কান্তিদেবের, চট্টগ্রামে প্রাপ্ততাম্রলিপিতে (নবম শতাব্দীর)। পরবর্তীকালে চন্দ্রবংশীয় লিপিতেও হরিকেল রাজ্যেরউল্লেখ আছে। চন্দ্রবংশীয় প্রথম রাজা ত্রৈলোক্যচন্দ্রের (৯০০-৯৩০ খ্রি.) উত্থানের বর্ণনায়বলা হয়েছে তিনি চন্দ্রদ্বীপের নৃপতি হওয়ার পূর্বে হরিকেল রাজ্যের ক্ষমতার আধারছিলেন।
ইৎসিং সিংহল থেকে সমুদ্রপথে হরিকেল এসেছিলেন এবং হরিকেল ছিল পূর্বভারতের (জম্বুদ্বীপের) পূর্বপ্রান্তে। হরিকেল রাজ্য সপ্তম শতাব্দীতে বর্তমান বাংলাদেশেরপূর্ব, দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্তে ছিল (কুমিল্লা-নোয়াখালি অঞ্চলের দক্ষিণ-পূর্বে) বলে অনুমানযুক্তিসঙ্গত বলেই মনে হয়। চট্টগ্রামে কাস্তিদেবের তাম্রলিপি প্রাপ্তি এই অনুমানকেজোরদার করে। যদি চন্দ্র তাম্রশাসনে উল্লিখিত রোহিতাগিরি লালমাই অঞ্চল হয় তাহলেমনে করতে হবে যে নবম শতাব্দীর শেষভাগে হরিকেল রাজ্যের পরিধি কুমিল্লা পর্যন্তবিস্তৃত ছিল এবং ত্রৈলোক্যচন্দ্র সেই কারণেই হরিকেল রাজ্যের ক্ষমতার 'আধার' ছিলেন।
এই প্রসঙ্গে ‘হরিকেল’ নামাঙ্কিত মুদ্রারও উল্লেখ করা যেতে পারে। বাংলাদেশেরবিভিন্ন অঞ্চলে (চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, সিলেট) এবং ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের বেলেনিয়াঅঞ্চলে বেশ কিছু সংখ্যক রৌপ্য মুদ্রা পাওয়া গেছে যার একদিকে অর্ধশায়িত অবস্থায়ষাঁড়ের প্রতিকৃতি ও অপরদিকে ‘ত্রিশূল' আকৃতির চিহ্ন রয়েছে। এই মুদ্রাসমূহের যে লিপিরয়েছে তার সাথে আরাকানীয় লিপির মিল পাওয়া যায় এবং এই সূত্রেই মুদ্রার লিখন
‘হরিকেল’ বলে নিঃসন্দেহভাবে পড়া সম্ভব হয়েছে। মুদ্রার লিপির এই মিল থেকেহরিকেল আরাকান সংলগ্ন চট্টগ্রাম অঞ্চলকেই চিহ্নিত করতো বলে মত প্রকাশ করা
হয়েছে।
আনুমানিক অষ্টম শতাব্দীতে রচিত 'আর্যমঞ্জুশ্রীমূলকল্প' গ্রন্থে বঙ্গ, সমতট এবংহরিকেল তিনটি স্বতন্ত্র কিন্তু প্রতিবেশী জনপদ বলে উল্লিখিত হয়েছে। চন্দ্র বংশের ক্ষমতাসমতট বঙ্গ এলাকায় বিস্তার লাভ করার ফলে হয়তো দশম-একাদশ শতাব্দীতে 'হরিকেল'নামের পরিধি বিস্তার লাভ করেছিল এরূপ মনে করার যথেষ্ট যুক্তি রয়েছে। ঢাকাবিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারে রক্ষিত দুটি প্রাচীন গ্রন্থের পাণ্ডুলিপিতে হরিকোল (হরিকেল) ওশ্রীহট্ট অভিন্ন বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
সুতরাং এমন মনে করলে খুব অসঙ্গত হবে না যে, বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্তে
চট্টগ্রাম অঞ্চলেই ‘হরিকোল' জনপদের আদি অবস্থিতি। পরবর্তীকালে হরিকোল রাজাদেরশাসনকালে (নবম শতাব্দী) সমতট (কুমিল্লা-নোয়াখালি) অঞ্চল পর্যন্ত হরিকেলের পরিধিবিস্তার লাভ করে এবং চন্দ্র রাজাদের ক্ষমতা বিস্তার এর ভৌগোলিক পরিধি হয়তো আরো প্রসারিত করেছিল।
0 মন্তব্যসমূহ