---ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আধিপত্য বিস্তার
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রতিষ্ঠা
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বানিজ্যিক বিস্তার---
**বিঃদ্র-বাংলা বিভাগের সকল পড়াশোনা পেতে ব্লগটিতে যুক্তথাকুন https://monoweredu13.blogspot.com/?m=1
***ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি -----
বাংলাদেশে ইংরেজ রাজত্ব একদিনে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। তা মনে করা ভুল যে, পলাশীরবিপর্যয় একটি মাত্র বিশ্বাসঘাতকতার ফল। যখন থেকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এদেশেপ্রথম বাণিজ্য কুঠি স্থাপন করে (১৬৩৩ খৃষ্টাব্দ), তখন থেকেই রচিত হতে থাকেপলাশীর পটভূমি। কিন্তু কিভাবে? এদেশের সঙ্গে ইংরেজের বাণিজ্যিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠাসমকালীন ইউরোপে ভৌগোলিক আবিষ্কার ও তৎপ্রসূত বাণিজ্যিক বিপ্লবের ফল এবংসেই বাণিজ্যিক বিপ্লবের উপর ভিত্তি করে যে শিল্পবিপ্লব ও তৎপ্রসূত ঔপনিবেশিকতা দানাবেঁধে ওঠে, তারই পরিণতি পলাশী। এই তত্ত্বের বিস্তারিত আলোকপাত না করে এখানেশুধু কোম্পানির আধিপত্য বিস্তারের প্রধান প্রধান ধাপসমূহ সংক্ষেপে আলোচনা করা হবে।
১৬৩৩ সনের মে মাসে মহানদীর মুখে হরিহরপুরে ইংলিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিপ্রথম বাণিজ্য কুঠি স্থাপন করে। দীর্ঘকাল পর তারা ১৬৫১ সনে হুগলী শহরে আরেকটিকুঠি স্থাপন করে। ঐ বৎসর বাংলার সুবাদার শাহজাদা সুজা ইংরেজদের এদেশে বিনাশুল্কে অবাধ বাণিজ্য করার অধিকার দেন। শর্ত ছিল এই যে, কোম্পানি সরকারকেবাৎসরিক মাত্র তিন হাজার টাকা রাজস্ব দেবে। অবাধ বাণিজ্য করার সুযোগ লাভ করে।কোম্পানি তার বাণিজ্য দ্রুত সম্প্রসারণ করতে থাকে। যেসব স্থানে নতুন কুঠি স্থাপন করা।খৃষ্টাব্দ),হয়, তাদের মধ্যে প্রধান হচ্ছে কাসিমবাজার (১৬৫৮ খৃষ্টাব্দ), পাটনা (১৬৫৮ঢাকা (১৬৬৮ খৃস্টাব্দ), রাজমহল ও মালদহ। ১৬৮০ সন নাগাদ কোম্পানির বাণিজ্যদেশের সর্বত্র বিস্তার লাভ করে। বাণিজ্য বৃদ্ধির সঙ্গে বৃদ্ধি পায় সরকারের বিরুদ্ধেকোম্পানির নানা অভিযোগ। কোম্পানির অভিযোগ ছিল যে, সরকারি কর্মচারীরা কোম্পানির
কর্মচারীদের অযথা হয়রানি করে, উৎপীড়ন করে উৎকোচ দিতে বাধ্য করে ইত্যাদি।সরকারেরও অভিযোগ ছিল যে, কোম্পানি শর্ত মোতাবেক বাণিজ্য না করে অসদুপায়
অবলম্বন করছে।
এসব অভিযোগ এবং পাল্টা অভিযোগকে কেন্দ্র করে ১৬৮৬ সনে মুঘল সরকার ওকোম্পানির মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়। ১৬৮৯ সন পর্যন্ত জলে ও স্কুলে এই যুদ্ধ চলে। ১৬৯০সনে কোম্পানি সম্রাট আওরঙ্গজেবের সঙ্গে একটি শান্তিচুক্তি করে। সেই চুক্তি মোতাবেককোম্পানি সারাদেশে বাৎসরিক তিন হাজার টাকা রাজস্বের বিনিময়ে বিনা শুল্কে বাণিজ্যকরার অধিকার পায়। কোম্পানির এজেন্ট জব চার্নক সুতানটি নামক গ্রামে তাঁর দফতরস্থাপন করে ভবিষ্যৎ কলকাতা নগরী ও বৃটিশ সাম্রাজ্যের ভিত্তি স্থাপন করেন ১৬৯৮ সনেকোম্পানি কলকাতা, সুতানটি ও গোবিন্দপুর এই তিনটি গ্রামের জমিদারি সনদ লাভ
করে। সরকার বার্ষিক বার হাজার টাকা রাজস্ব লাভ করেন। একই সনে অর্থাৎ ১৬৮৯সনে কলকাতায় ইংলন্ডের তৎকালীন রাজা উইলিয়মের নামানুসারে ফোর্ট ইউলিয়ামনামক দুর্গ নির্মিত হয়। মুঘল সরকার তখন বুঝতে পারেননি যে, এই জমিদারি ধীরেধীরে প্রসারিত হয়ে একদিন সারা দেশই কোম্পানির রাজত্বে পরিণত হবে।
কোম্পানির আধিপত্য বিস্তারের পরবর্তী গুরুত্বপূর্ণ ধাপ সম্রাট ফররুখশিয়ারের নিকটথেকে ফরমান লাভ (১৭১৭) ) আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর (১৭০৭ খৃস্টাব্দ) পর থেকে
সিংহাসন ও অন্যান্য উচ্চপদ নিয়ে বিবাদ ও গৃহযুদ্ধ ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। কোম্পানিপ্রত্যেককে প্রয়োজনীয় উৎকোচ ও পুরস্কার দিয়ে নানা রকম সুযোগ সুবিধা আদায় করারচেষ্টা করে। ১৭১৩ সনে গৃহযুদ্ধের মাধ্যমে ফাররুখশিয়ার সম্রাট হলে কোম্পানি তাঁকেপ্রচুর পুরস্কার দান করে এবং পরিবর্তে লাভ করে অভূতপূর্ব বাণিজ্যিক ও অন্যান্য সুযোগসুবিধা সংবলিত ফরমান। ফররুখশিয়ারের ফরমানের প্রধান ধারাগুলি নিম্নরূপ :
১.কোম্পানি সরকারকে বাৎসরিক মাত্র তিন হাজার টাকা রাজস্ব দানেরপরিবর্তে সারাদেশে বিনা শুল্কে অবাধ বাণিজ্য করবেন।
২.কোম্পানির মালামাল কোথাও চুরি হলে সরকার তা ফিরিয়ে দেওয়ারচেষ্টা করবে বা সমমূল্যের ক্ষতিপূরণ দিবে।
৩.কোনো শুল্ক চৌকিতে কোম্পানির নৌকা-জাহাজ কোনো রকম অজুহাতে আটক করা যাবে না।
৪.মুর্শিদাবাদের টাকশালে কোম্পানি তার নিজস্ব টাকা তৈরি করবে।
৫.সুবাদার কলকাতার আশে পাশে আরও আটত্রিশটি গ্রামের উপর জমিদারি সনদ কোম্পানিকে দেবে।
৬.কোম্পানির অধীনস্থ কর্মচারীদের বিচার করার অধিকার কোম্পানির থাকবে।
ফরকখশিয়ারের ফরমান দ্বারা দেশের সার্বভৌমত্তুকে আংশিকভাবে বিলিয়ে দেওয়াহয়েছিল, বলা যেতে পারে। কিন্তু সৌভাগ্যগ্রমে বাংলার শাসন তখন কেন্দ্রের মতো দুর্বলছিল না। মুর্শিদ কুলী খানের সবল ও দক্ষ শাসনের ফলে কোনো বৈদেশিক শক্তি দেশেরঅভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে পারছিল না। কোম্পানি সম্রাট ফররুখশিয়ারের নিকটথেকে সুযোগ সুবিধার ফরমান লাভ করলেও মুর্শিদ কুলী খান সেই ফরমান কার্যকরকরতে অস্বীকৃতি জানান। তাঁর পরবর্তী সুবাদার সুজাউদ্দীন খান (১৭২৭-১৭৩৯ খৃষ্টাব্দ)ও আলীবর্দী খানের (১৭৪০-১৭৫৬ খৃষ্টাব্দ) সময়ও অনুরূপ নীতি অনুসৃত হয়। সেজন্যমুর্শিদ কুলী খানের আমল থেকে প্রত্যেক সুবাদারের বিরুদ্ধে কোম্পানির অভিযোগ ছিল।এই যে, তাঁরা ফরমান মোতাবেক কাজ না করে কোম্পানির প্রতি ইচ্ছাকৃত বৈরীভাবপোষণ করছেন। কিন্তু প্রত্যেক সুবাদার অতি কৌশলে কোম্পানির সঙ্গে সরাসরি দ্বন্দ্বএড়িয়ে চলেন। কিন্তু আলীবর্দী খানের মৃত্যুর (১৭৫৬ খৃস্টাব্দ) পর সেই কৌশলেররাজনীতির অবসান ঘটে এবং সেই সঙ্গে শুরু হয় এই দেশে কোম্পানির আধিপত্যস্থাপনের তৃতীয় পর্যায়।
মুর্শিদ কুলী খানের পর থেকে শুরু হয় প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের যুগ এবং সেই ষড়যন্ত্রেরঘোলা পানিতে মাছ ধরার চেষ্টা করে কোম্পানি। মুর্শিদ কুলী খান তদীয় কন্যার পুত্রসরফরাজ খানকে উত্তরাধিকারী করেন। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর জামাতা সুজাউদ্দীনখান ষড়যন্ত্র করে নিজ পুত্র সরফরাজ খানকে উৎখাত করে নিজে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যারমসনদে বসেন। ১৭৩৯ সনে সুজাউদ্দীন তাঁর পুত্র সরফরাজ খানকে (যাকে তিনি উৎখাতকরেছিলেন) উত্তরাধিকারী করে মারা যান। আবার শুরু হয় ষড়যন্ত্র। প্রাসাদ ষড়যন্ত্রীরাসরফরাজকে উৎখাত করে আলীবর্দী খানকে মসনদে বসান। আলীবর্দী খানেরউত্তরাধিকারী সিরাজউদ্দৌলার বিরুদ্ধেও শুরু হয় একই ষড়যন্ত্র। এহেন ষড়যন্ত্রমূলকপরিবেশে কোম্পানির নিয়ত চেষ্টা ছিল এমন দলকে সহযোগিতা করা, যারাফররুখশিয়ারের সেই ফরমান বাস্তবায়িত করতে সাহায্য করবে। সেই দলটি কারা ?
সপ্তদশ শতকের শেষ নাগাদ ইউরোপের প্রায় প্রতিটি বাণিজ্যিক জাতি বাংলাদেশেরসঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক স্থাপন করে। অষ্টাদশ শতকের প্রথম থেকে দেখা যায় যে, পাশ্চাত্যকোম্পানিগুলির, বিশেষভাবে ইংলিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে জড়িত দেশীয় বানিয়ামুত্সুদ্দীরা প্রচুর ধনার্জন করে এক মহাপ্রভাবশালী বাণিজ্যিক পুঁজিপতি শ্রেণীতে পরিণতহয়। এই নব পুঁজিপতি শ্রেণী অচিরেই রাজনৈতিক ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। আপন শ্রেণীরস্বার্থে, পুঁজির স্বার্থে ও মহাপুঁজিপতি কোম্পানির স্বার্থে যখন যা প্রয়োজন তা সাধনে তারাপ্রবৃত্ত হয়। মুর্শিদ কুলী খানের পর থেকে তাঁরাই মসনদে নবাব বসান, নবাব উঠান।সিরাজউদ্দৌলার ক্ষেত্রেও তাই হয়। সিরাজউদ্দৌলার পতনের কথা পূর্ববর্তী একপরিচ্ছেদে বিস্তারিত বলা হয়েছে। এখানে শুধু এতটুকু বলাই যথেষ্ট যে, পলাশীর মাধ্যমে।ফররুখশিয়ারের ফরমান পূর্ণভাবে বাস্তবায়িত হয়। শুধু তাই নয়, কোম্পানিকে কলকাতার দক্ষিণে কল্পি পর্যন্ত জমিদারি সনদ দান করা হয় এবং কোম্পানির অনুমতি ব্যতিরেকে নবাব অন্য কোনো রাষ্ট্রের সঙ্গে কোনো চুক্তি করতে পারবেন না—এই মর্মে একটি
সন্ধিও করা হয়। অর্থাৎ কোম্পানি এখন অদ্বিতীয় শক্তি হিসেবে বাংলার রাজনীতিতেআবির্ভূত হলো।
পলাশীর যুদ্ধের ফলে কোম্পানি অনেক সুযোগ সুবিধা লাভ করে, অকল্পনীয় প্রভাববিস্তার করে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে রাজ্য স্থাপন করতে পারেনি। রাজ্য স্থাপনের প্রক্রিয়া শুরুহয় পলাশীর পর থেকে। মীরজাফর ভেবেছিলেন, তিনি সুজাউদ্দীন খান ও আলীবর্দীখানের মতো বিপ্লব করে নিজে স্বাধীন নবাব হবেন। কিন্তু তাঁর নির্মাতা ক্লাইভের ইচ্ছাছিল অন্যরূপ। ক্লাইভ ভারতে বৃটিশ সাম্রাজ্য স্থাপনের সমস্ত উপাদান নিশ্চিত করেন।কোম্পানির জমিদারি আরও বিস্তার করে চব্বিশ পরগনা জেলা এর অন্তর্গত করা হয়।দেশরক্ষার দায়িত্বভার কোম্পানি গ্রহণ করে। সমগ্র দেশে বিনা শুল্কে বাণিজ্য করারঅধিকার শুধু কোম্পানিই পায়নি, কোম্পানির কর্মচারীদের ব্যক্তিগত ব্যবসাও বিনা শুল্কেকরার অলিখিত অধিকার তারা পায়। অর্থাৎ মীরজাফর কোম্পানির ক্রীড়নক ছাড়া আর
কিছুই ছিলেন না। ১৭৬০ সনে কোম্পানি বর্ধমান, মেদিনীপুর ও চট্টগ্রাম জেলারওজমিদারি লাভ করে। এভাবে বাংলার প্রায় অর্ধেক রাজস্বভূমি কোম্পানির করতলগত হয়।চার বৎসর যাবৎ উক্ত তিন জেলার উপর জমিদারি শাসন করে কোম্পানি দেশের সম্পদসম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভ করে। অবশেষে বসারের যুদ্ধের পর ১৭৬৫ সনে রবার্টক্লাইভ সমগ্র বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার দীউয়ানি সনদ লাভ করে দক্ষিণ এশিয়ায় বৃটিশসাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার সুদৃঢ় ভিত্তি স্থাপন করেন। ১৬৫১ সনে শাহ সুজা ইংরেজদের সুযোগসুবিধা দিয়ে যে সনদ দান করেন, তারই শেষ পরিণতি ১৭৬৫ সনের দীউয়ানি সনদ। এইশত বৎসর ব্যবধানে অনেক সংঘর্ষ, অনেক চুক্তি, অনেক ষড়যন্ত্র ও হঠকারিতা হয়েছে।সব ঘটনার লক্ষ্য ছিল একই–এদেশে কোম্পানির আধিপত্য বিস্তার।
***তথ্যসংগ্রহ
(বাংলা দেশের ইতিহাস /ড.মুহাম্মদ আব্দুর রহিম, ড.আবদুর মমিন চৌধুরী, ড.এ.বি.এম.মাহমুদ, ড.সিরাজুল ইসলাম)
0 মন্তব্যসমূহ