---জমিদার,রায়ত
রায়ত কাদের বলা হয় প্রজা শ্রেণী বাংলাদেশে জামিদার এর ইতিহাস, জমিদারদের অত্যাচার তালুক কি
সামাজিক ভুমিকা
জমিদারি প্রথা
জমিদারি ব্যাবস্তা--
**--জমিদার শ্রেণীর গঠন ও পরিবর্তন-----
১৭৯৩ সালে যাদের সঙ্গে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করা হয়, তারা ছিল পূর্বেকার পুরাতনজমিদার। মোঘল আমল থেকে এরা জমিদারি দায়িত্ব পালন করে আসছে। কিন্তু চিরস্থায়ীবন্দোবস্তের পর জমিদার শ্রেণীর মধ্যে আসে বিপুল পরিবর্তন।জমিদার ব্রিটিশ উপনিবেশিক শাসনের পূর্বেও ছিল। মুঘল শাসন আমলে জমিদারের ছিল অনেক ক্ষমতা ও দায়িত্ব। বহু পুরাতন জমিদার পরিবার ধ্বংস হয়ে যায় এবং তাদের জমিদারি অসংখ্য নতুনপরিবারের মধ্যে হস্তান্তরিত হয়। এই হস্তান্তরপালা কখনও শেষ হয় না। ফলে পুরাতনজমিদার শ্রেণীর মধ্যে সব সময়ই অনুপ্রবেশ করেছে নতুন পরিবার। তাছাড়া নতুন আইনেজমিদারি উত্তরাধিকারসূত্রে সন্তানদের মধ্যে ভাগাভাগি হতে থাকে। এইরূপ উত্তরাধিকারআইনের ফলে কয়েক পুরুষের মধ্যেই সব কয়টি জমিদারি আকারে ছোট হয়ে যায়। এককথায়, ঊনবিংশ ও বিংশ শতকে জমিদারির আকার ছোট হয়ে বেড়ে যায় জমিদারেরসংখ্যা। তাই দেখা যায় যে, ঊনবিংশ শতকের শেষে তাদের সংখ্যা ছিল গোটা গ্রামীণসমাজের দশ ভাগের একভাগ। অর্থাৎ, সমাজের এক দশমাংশ জমিদার সমাজের সদস্যহিসেবে পরিগণিত হয়। এ সময়ে জমিদারের অধীনে একটি মধ্যস্বত্ব শ্রেণীর বিকাশ লাভকরে। এরাও ছিল ভূ-স্বামী শ্রেণীর সদস্য। মধ্যস্বত্বভোগী এবং জমিদার—এই দুইউপাদান মিলে সমাজের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ লোক ভূ-স্বামী শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত হয়।সামাজিকভাবে এই পরিবর্তন অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।
চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের নিয়মাবলিতে জমিদারের কোনো রাজনৈতিক, প্রশাসনিক, পুলিশি বাঅন্য কোনো ভূমিকা থাকেনি। তাদের একমাত্র কাজ ছিল রাজস্ব সংগ্রহ করা এবংসরকারকে নিয়মিত রাজস্ব প্রদান করা। কিন্তু আইনে জমিদারের ক্ষমতা যাই থাকুক নাকেন, সামাজিকভাবে জমিদারের ক্ষমতা থাকে অক্ষুণ্ণ। জমিদার সমাজের প্রভু, সমাজেরস্বাভাবিক প্রাকৃতিক নেতা। এইটাই ছিল সত্য। সাধারণ রায়তের চোখে জমিদার ছিলসর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ। জমিদারের নেতৃত্ব উপেক্ষা করা সাধারণ মানুষের ধারণার বাহিরে
ছিল। সমাজের ঘটনাবলি জমিদারকে কেন্দ্র করে বা জমিদারের ইচ্ছাতেই প্রবাহিতহতো। জমিদারে জমিদারে লড়াই ছিল সমাজে সবচেয়ে বড় ঘটনা।বিভিন্ন ক্ষেত্রে জমিদারের ভূমিকা
(ক) শিক্ষাক্ষেত্রে
বৃটিশ শাসক শিক্ষা বিস্তারে কোনো লক্ষণীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। ১৮৩৫-১৮৫০ সনপর্যন্ত সরকার শিক্ষানীতির ব্যাপারে বিভিন্ন ঘোষণা জারি করেন। কিন্তু এই শিক্ষানীতিবাস্তবায়নে সরকার কখনও ব্যাপক পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। শিক্ষা বিস্তারের জন্য সরকার নির্ভর করেছে প্রাইভেট সেক্টরের উপর (বা ব্যক্তিগত উদ্যোগের উপর)। কিন্তু ব্যক্তিগত উদ্যোগে স্কুল-কলেজ প্রতিষ্ঠা করার মতো ধনিক শ্রেণী সমাজে ছিল না। সামাজিকভাবে সচ্ছল ছিল একমাত্র স্থানীয় জমিদার। জমিদারগণ যেন শিক্ষাবিস্তারে এগিয়ে আসেন,সেইজন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর নির্মাতাদের সরকার রাষ্ট্রীয়ভাবে সম্মানিত করতেন। সেসজমিদার স্কুল-কলেজ স্থাপন করতেন, তাদের সামাজিক অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপরায়বাহাদুর, খানবাহাদুর, নবাব, ব্রাজা, মহারাজা প্রভৃতি উপাধিতে ভূষিত করতেন।সরকার কর্তৃক অনুপ্রাণিত হয়ে অনেক জমিদার স্থানীয়ভাবে স্কুল-কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন।বিংশ শতকের প্রারম্ভে দেখা যায় যে, সরকারি স্কুল-কলেজের ছাত্রসংখ্যার চেয়েবেসরকারি স্কুলের ছাত্রসংখ্যা ছিল তিনগুণ বেশি। এসব স্কুল-কলেজের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেনবেশির ভাগই জমিদার। ঔপনিবেশিক যুগে জমিদার পরিবারের সন্তানেরা উপযুক্ত সরকারিচাকরি না পেয়ে অনেকেই স্কুল-কলেজের শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন।অতএব দেখা যাচ্ছে যে, শিক্ষাবিস্তারে জমিদারের ভূমিকা ছিল বিশাল।
(খ) সমাজকল্যাণ
শিক্ষাবিস্তারের ন্যায় সমাজকল্যাণেও জমিদার পরিবার স্থানীয়ভাবে অগ্রণী ভূমিকা পালনকরে। সমাজকল্যাণমূলক সভা-সমিতি গঠন করা, সাহিত্য পত্র-পত্রিকা প্রকাশ করা,পাড়ায় লাইব্রেরি স্থাপন করা, উন্নয়নমূলক কাজ করা প্রভৃতি ব্যাপারে জমিদারদের অবদানছাড়া কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না। শিক্ষকের মতো সমাজকল্যাণমূলককর্মকাণ্ডেও দেখা যায় জমিদার পরিবারের সদস্যদের অগ্রণী ভূমিকা ছিল।
(গ) গ্রাম পঞ্চায়েত
সামাজিক আইন শৃঙ্খলা, বিবাহ উৎসব, সামাজিক উৎসব, ধর্মীয় উৎসব এবং সামাজিকরীতি-নীতির ব্যাপারে একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ ছিল জমিদারের। জমিদার প্রতি গ্রামে পঞ্চায়েতগঠন করতেন, ঐসব ব্যাপারে লক্ষ্য রাখার জন্য। গ্রামের সম্মানিত ধনী বা প্রভাবশালীব্যক্তিদের নিয়ে এই পঞ্চায়েত গঠিত হতো। ব্যক্তিতে, পরিবারে, মে, ঝগড়া-বিবাদ বাঅন্য কোনো অসন্তোষ দেখা দিলে, এসব সমাধানের দায়িত্ব ছিল পঞ্চায়েতের উপর।পঞ্চায়েত ব্যর্থ হলে সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ হিসেবে পঞ্চায়েত জমিদারের শরণাপন্ন হতো।জমিদারের কাচারি ছিল একাধারে খাজনা সংগ্রহের অফিস, অপরদিকে দেশের সর্বোচ্চশালিস। জমিদার প্রয়োজনে শাস্তি দিতে, পুরস্কৃত করতে এবং তিরস্কৃতও করতেপারতেন। তাদের আদেশের উপরে আর কোনো অভিযোগ করার ক্ষমতা সাধারণ
মানুষের ছিল না।
(ঘ) রাজনৈতিক ভূমিকা
ঊনবিংশ শতকের শেষে ও বিংশ শতকের প্রারম্ভে বাংলার রাজনীতিতে নেতৃত্ব দেয়জমিদার শ্রেণী। উল্লেখ্য, এই সময়ে বাংলায় যে মধবিত্ত শ্রেণী বিকশিত হয়, তা ছিলমূলত জমিদার শ্রেণী থেকে আগত। সচ্ছল ব্যক্তি হিসেবে জমিদারেরা তাদের সন্তানদেরউচ্চ শিক্ষা দিতে সক্ষম হয়। এবং এই উচ্চ শিক্ষিত ছেলেরাই গঠন করে রাজনৈতিকদল। তাদের রাজনৈতিক দর্শন ছিল বৃটিশদের প্রতি আনুগত্য। পৌরসভা, ইউনিয়ন বোর্ড,জেলা বোর্ড এবং সরকারি আইনসভা প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানের নির্বাচনে জমিদাররাই বেশির ভাগঅংশগ্রহণ করে।
****-প্ৰজা শ্ৰেণী-----
চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পূর্বে প্রজারা (রায়ত নামে পরিচিত ছিল। রায়ত ও প্রজার মধ্যেপার্থক্য এই যে, রায়ত ছিল ভূমির ভোগদখলদার | বংশানুক্রমিকভাবে তারা জমি ভোগকরতে পারত। ভূমিদার ছিল সরকারের বংশানুক্রমিক কর সংগ্রহকারী স্থানীয় এজেন্ট।ভূমিতে রায়তের অধিকার ছিল প্রথাভিত্তিক। জমিদার সেই অধিকার থেকে রায়তকে কখনও বঞ্চিত করতে পারত না। কিন্তু চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের আইনে জমির উপর জমিদারের একচ্ছত্র মালিকানা প্রতিষ্ঠার ফলে রায়ত পরিণত হয় প্রজায়। মালিক হিসেবে জমিদার প্রজাকে ইচ্ছামতো জমিতে দখল দিতে বা উচ্ছেদ করতে পারতেন। ইচ্ছামতোখাজনার হার পরিবর্তন করতে পারতেন। প্রজা নির্দিষ্ট শর্তে খাজনা প্রদান করে জমি চাষকরতে পারত, কিন্তু বিনা অনুমতিতে জমিতে কোনো পুকুর কাটতে বা পাকা বাড়ি নির্মাণকরতে পারত না, বৃক্ষ কর্তন করতে পারত না। এমনকি কোনো কোনো অঞ্চলে বিয়েশাদির জন্যও পর্যন্ত জমিদারের পূর্ব অনুমতি নিতে হতো।কিন্তু এই অবস্থা জমিদার সমাজ দীর্ঘসময় টিকিয়ে রাখতে পারেনি। প্রজাদের প্রতিবাদ, প্রতিরোধ ও ঘন ঘন বিদ্রোহের ফলে অবশেষে ঔপনিবেশিক সরকার চিরস্থায়ীবন্দোবস্তের আইন সংশোধন করতে বাধ্য হয়। প্রথম সংশোধন আসে ১৮৫৯ সনের
দশম আইনের মাধ্যমে। এই আইনের অধীনে অধিকার সংক্রান্ত ব্যাপারে প্রজাকে তিনটিশ্রেণীতে ভাগ করা হয়।
প্রথম শ্রেণীর প্রজা নির্দিষ্ট হারে জমি ভোগ করার অধিকার লাভ করে।
দ্বিতীয় শ্রেণীরপ্ৰজা জমিতে স্থায়ী দখল লাভ করে, কিন্তু তাদের খাজনার হার নির্দিষ্ট নয়। জমিতে যাদেরকোনো অধিকার নেই, এবং যাদের খাজনার হার ইচ্ছামতো কমানো বা বাড়ানো যায়,তারা ঘোষিত হয় স্বত্বহীন প্রজারূপে।
কিন্তু ১৮৫৯ সনের আইন প্রজা শ্রেণীকে বিভক্ত করেছে বটে, কিন্তু প্রজা অসন্তোষ হ্রাস করতে পারেনি। ১৮৬০ সনের নীল বিদ্রোহ, ১৮৭০ দশকের ব্যাপক কৃষক বিদ্রোহ,বিশেষ করে পাবনা ও তুষখালীর বিদ্রোহ সরকারকে বাধ্য করে প্রজাকে অধিকতর অধিকার দিতে। ১৮৮৫ সনে সরকার জমিদার ও প্রজার অধিকার ও দায়িত্ব সংজ্ঞায়িতকরে একটি বিস্তারিত আইন পাশ করে। 'বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইন' নামে পরিচিত এইআইনবলে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সংবিধানে ব্যাপক পরিবর্তন আনয়ন করে। এই আইনেরমাধ্যমে জমিদারের স্বৈরাচারী ক্ষমতা সংকুচিত করা হয়। এর ফলে প্রজারা আংশিকভাবেজমিদারের অনুমতি সাপেক্ষে জমি হস্তান্তরের অধিকার লাভ করে। এই আইনে বার বছরবা ততোধিক সময়কাল যাবৎ জমি দখলে ছিল, এমন সকল প্রজাকে দখলিস্বত্ব প্রদান করাহয়। এই আইনের ফলে কারণ দর্শানো ছাড়া জমিদার খাজনা বৃদ্ধি করার অধিকার হারায়।এক কথায়, বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইনের মাধ্যমে প্রজা শ্রেণী পূর্বের রায়তি অধিকারআংশিকভাবে ফিরে পেতে সক্ষম হয়।১৮৮৫ সনের বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইনের সংশোধন করা হয় ১৯২৮ সনে। এইসংশোধনের ফলে প্রজারা জমি হস্তান্তরের পূর্ণ অধিকার লাভ করে। তবে জমি হস্তান্তরেরজন্য জমিদারকে বিক্রয় মূল্যের শতকরা পঁচিশ ভাগ সেলামি দিতে হতো।
0 মন্তব্যসমূহ