--বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন সমুহ
ফকির সন্ন্যাসী আন্দোলন
রংপুর বিদ্রোহ কেন হয়েছিল
রংপুর বিদ্রোহ বলাকী শাহ বিদ্রোহ চাকমা বিদ্রোহ তিতুমীরের বিদ্রোহ পাগলপন্থী বিদ্রোহ ---
**বিঃদ্র-বাংলা বিভাগের সকল পড়াশোনা পেতে ব্লগটিতে যুক্তথাকুন https://monoweredu13.blogspot.com/?m=1
**উত্তর বঙ্গের ফকির সন্ন্যাসী বিদ্রোহ(১৭৬০-১৮০০)----
১৭৫৭ সালে পলাশির প্রান্তরে বাংলার স্বাধীনতার সুর্য অস্তমিত হয়েছিল। যে সাম্রাজ্যবাদী মনোভাব নিয়ে বৃটিশ রা এদেশে এসেছিলো তার ই বিজয় হয়েছিল ১৭৫৭ সালে।পুরো বাংলা জুরে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিলো। তাদের পুজি আহরণ এর মুল উপায় ছিলো রাজস্ব আদায়।আর সেই রাজস্ব আদায় করা হতো সাধারণ খেটে খাওয়া রায়তদের কাছে থেকে। আর সেই দায়িত্ব তথাকথিত জমিদার এবং অঞ্চল ভিত্তিক।রাজাদের ওপর ন্যস্ত ছিল। সেই সকল জমিদার এবং রাজারা এদেশের রাজনীতির উপর নির্মম অত্যাচার এবং শোষণ এর মাধ্যমে সেই সকল রাজস্ব এবং জমি থেকে খাজনা আদায় করে নিত। আর এই খাজনা আদায়ের বিষয়টি একসময় অসহনীয় মাত্রায় চলে যায় যার কারণে রায়ত শ্রেণী এবং সাধারণ জনগন সশস্ত্র আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। সেই সময় যেসকল বিদ্রোহ হয়েছিল তার মধ্যে উত্তরবঙ্গের ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহ অন্যতম। অনেকের মনে ফকির-সন্ন্যাসীদের নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্ন উঠতে পারে যেমন তারা আধ্যাত্মিক চিন্তায় লিপ্ত থেকে কিভাবে সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য প্রশিক্ষণ পেল। বর্তমান যুগে আমরা
ফকির-সন্ন্যাসীদের যে অবস্থায় দেখি, সে মাপকাঠিতে অষ্টাদশ শতকের ফকির সন্ন্যাসীদের পরিমাপ করলে ভুল হবে। সে যুগের ফকির-সন্ন্যাসীরা ছিল বিভিন্ন ভ্রাম্যমাণ সংঘে বিভক্ত। সংঘের সব সদস্য এক সঙ্গে সারা বৎসর দেশের এক তীর্থস্থান থেকেঅন্য তীর্থস্থানে ঘুরে বেড়াত। ফকির এবং সন্ন্যাসী উভয়েই উলঙ্গ বা প্রায় উলঙ্গ থাকত।উভয়েই সংসার জীবন থেকে ছিল পলাতক। অবিবাহিত, সংসারত্যাগী, বিবস্ত্রাবস্থায়,ভ্রাম্যমাণ ছিল ফকির এবং সন্ন্যাসীদের জীবনধারা। উভয় দলই ছিল সশস্ত্র। নানা ধরনের হালকা অস্ত্র বহন করা ছিল উভয় দলের আধ্যাত্মিক অঙ্গ। ভিক্ষা ও মুষ্টি সংগ্রহে বাধাপ্রাপ্ত হলে বা আন্তঃতীর্থস্থান ভ্রমণে বাধাপ্রাপ্ত হলে সেই অস্ত্র ব্যবহার করা ছিল ফকির ওসন্ন্যাসীদের স্বভাব। এদের এই সামরিক চরিত্র আমরা লক্ষ করি সুলতানি আমল থেকেই। অষ্টাদশ শতকের রাজনৈতিক অস্থিরতার পরিবেশে ফকির-সন্ন্যাসীদের সামরিক কর্মকাণ্ড বিশেষভাবে বৃদ্ধি পায়। কোম্পানির সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করতে নবাব মীরকাসিম ফকির-সন্ন্যাসীদের আহ্বান করেছিলেন এবং তাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে ফকির সন্ন্যাসীরা তাঁদের পক্ষে যুদ্ধ করেছিল। যুদ্ধে পরাজিত হয়ে মীর কাসিম পলায়ন করেন,কিন্তু ফকির-সন্ন্যাসীরা তাদের বৃটিশবিরোধী তৎপরতা অব্যাহত রাখে। এর কারণ,ইংরেজ সরকার তাদের অবাধ গতিবিধিতে বাধা সৃষ্টি করে, ভিক্ষা ও মুষ্টি সংগ্রহকে বেআইনি বলে ঘোষণা করে, ডাকাত দস্যু বলে আখ্যায়িত করে। সরকার তাদের দমনেরজন্য জমিদারদের সহযোগিতা কামনা করে। ইতিপূর্বে কোনো সরকার তাদের কর্মকাণ্ডে বাধা সৃষ্টি করেন নি।ফকির দলের নেতৃত্ব দেনফকির মজনু বুরহানা। সন্ন্যাসীদের দলের নেতৃত্ব দেন ভবানী পাঠক।
১৭৬০ সনে বর্ধমান জেলায় সন্ন্যাসীরা বৃটিশদের বিরুদ্ধে প্রথম সংগ্রাম শুরু করে।১৭৬৩ সনে বাকেরগঞ্জে একদল ফকির কোম্পানির কুঠি লুট করে। কুঠির অধিনায়ক মি কেলী পলায়ন করে প্রাণ বাঁচান। সেই বৎসরই ফকিরেরা কোম্পানির ঢাকা ফেক্টরি আক্রমণ করে। ফেক্টরির প্রধান মি. লিস্টার ফকিরদের আক্রমণের মুখে পলায়ন করেন।ফকিরেরা বিনা বাধায় ফেক্টরি লুট করে এবং প্রচুর মালামাল ও কিছু নগদ অর্থ নিয়ে ঢাকাপরিত্যাগ করে। ১৭৬৩ সনে সন্ন্যাসীরা রাজশাহীতে কোম্পানির ফেক্টরি আক্রমণ করে।ফেক্টরির অধিকর্তা মি. বেনেটকে তারা বন্দী করে এবং পাটনায় নিয়ে পরে তাঁকে হত্যা করা হয়। ১৭৬৯ সনে রংপুরে সন্ন্যাসীদের দমন করার জন্য ক্যাপ্টেন মেকেনজির নেতৃত্বে এক অভিযান প্রেরণ করা হয়। সেই অভিযানের অপারেশনে সন্ন্যাসীদের হাতে লেফটেন্যান্ট কিথের মৃত্যু ঘটে। ১৭৭০-৭১ সনে দিনাজপুরে ফকিরদের সঙ্গেকোম্পানির বাহিনীর সংঘর্ষ হয় এবং কোম্পানির সিপাহিরা হটে আসে। ১৭৭১ সনে ফকিরমজনু শাহ সারা উত্তর বঙ্গব্যাপী এক বড় রকমের বৃটিশবিরোধী তৎপরতা শুরু করেন।তার মোকাবেলার জন্য দিনাজপুর ও রংপুরে অতিরিক্ত বৃটিশ সৈন্য ও সিপাহি প্রেরণ করাহয়। ১৭৭২ সনে দুই হাজার সশস্ত্র অনুসারী নিয়ে মজনু রাজশাহী আক্রমণ করেন।১৭৭৩ সনে এক সন্ন্যাসীদের হাতে ক্যাপ্টেন টমাস পরাজিত ও নিহত হন।
১৭৬৫ সনে ওয়ারেন হেস্টিংস ফকির-সন্ন্যাসীদের দমন করার জন্য বিশেষ ব্যবস্থাগ্রহণ করেন। সেই বৎসর মজনু শাহর সঙ্গে কয়েক দফা কোম্পানির সৈন্যের সংঘর্ষ হয়।কিন্তু কোম্পানির পক্ষে তখনও তাঁকে চূড়ান্তভাবে পরাজিত করা সম্ভব হয়নি। ১৭৭৭ সনথেকে ১৭৮৬ সন পর্যন্ত ফকির মজনু শাহর বাহিনীর সঙ্গে কোম্পানির সৈন্যের বহু সংঘর্ষ হয়। রংপুর, রাজশাহী, দিনাজপুর ও ময়মনসিংহ জেলায় এসব সংঘর্ষ ঘটে। ঐসব সংঘর্ষে মজনুর রণকৌশল ছিল অতর্কিত আক্রমণ ও নিরাপদে পলায়ন। ১৭৮৭ সনে মজনু শাহর মৃত্যু হয়। তাঁর মৃত্যুর পর ফকিরদের নেতৃত্ব দেয় মুসা শাহ, চেরাগ আলীশাহ, সোবহান শাহ, মাদার বক্স, করিম শাহ ইত্যাদি ফকিরগণ। মজনু শাহর মৃত্যুর পর একাধারে ফকিরদের মধ্যে নেতৃত্বের কোন্দল, অপরদিকে বৃটিশদের সেনাবাহিনী বৃদ্ধি ফকির প্রতিরোধ আন্দোলনকে ক্রমশ দুর্বল করে তোলে। ১৮০০ সনের নাগাদ ফকিরেরা চূড়ান্তভাবে পরাজিত হয়। এখানে মনে রাখা উচিত যে, উত্তর বঙ্গের ফকির আন্দোলন যারা সংগঠন করেছিলেন, তাঁরা সবাই ছিলেন অবাঙালি এবং তাদের অপারেশনে স্থানীয়লোকের সহযোগিতা ছিল খুব কম। ভ্রাম্যমাণ ফকির হিসেবে স্থানীয় লোকের সঙ্গে তাদের পরিচয়ও ছিল কম। তাছাড়া মুষ্টি সংগ্রহে ফকিরেরা যথেষ্ট অত্যাচার করত বটে,ফলে স্থানীয় সমর্থন লাভে ফকিরেরা ব্যর্থ হয়েছিল। তারা বৃটিশদের বিরুদ্ধে লড়েছিল,যেহেতু বৃটিশ শাসনে তাদের অবাধ গতিবিধি ও যথেচ্ছভাবে মুষ্টি ও চাঁদা সংগ্রহ করা
কঠিন হয়ে পড়েছিল। তাঁদের পেশাগত স্বার্থ সংরক্ষণের জন্যই তাঁরা সশস্ত্র সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। দেশরক্ষা বা জাতীয়তাবাদ তাদের লক্ষ্য ছিল না।
****রংপুর বিদ্রোহ ১৭৮৩-----
১৭৮৩ সনের জানুয়ারি মাসে রংপুর জেলার জোতদার ও রায়তেরা বিদ্রোহ ঘোষণা করে।এই বিদ্রোহের কারণ সরকারের অত্যাচারমূলক রাজস্ব নীতি। ১৭৬৯-৭০ সনের মহাদুর্ভিক্ষে রংপুর জেলার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ লোক নিশ্চিহ্ন হয়। কৃষি শ্রমিকের অভাবে বিস্তীর্ণ কৃষি জমি পতিত পরিণত হয়। জেলার আয় কমেছিল বটে, কিন্তু বেড়েছিল কৃষকের উপর খাজনার চাপ। প্রতি বছর ভূমিরাজস্ব বৃদ্ধি করা ছিল কোম্পানির সরকারি রাজস্ব নীতি।
১৭৮১ সনে রাজা দেবী সিংহ জেলার রাজস্ব সংগ্রহের ত্রি-বর্ষীয় ইজারা লাভ করেন।১৭৮০ সনে জেলার সদর জমা অর্থাৎ সরকারকে দেয় রাজস্বের পরিমাণ ছিল আট লক্ষ এগার হাজার টাকার সিক্কা টাকা। ১৭৮১ সনে রাজা দেবী সিংহ আট লক্ষ পঁচাত্তর হাজার টাকায় অর্থাৎ চুয়ান্ন লক্ষ টাকা অধিক রাজস্বে ইজারা নেন। এই বাড়তি রাজস্ব সংগ্রহকরার জন্য দেবী সিংহ কৃষকের উপর নানা রকম নতুন কর আরোপ করেন এবং ঐসবকর আদায়ের জন্য জঘন্য বল প্রয়োগ করেন। রায়তেরা জেলা কালেক্টারের নিকট দেবী সিংহের অন্যায় ও অত্যাচারমূলক করের বিরুদ্ধে বিচার প্রার্থনা করে। কিন্তু কালেক্টার তাদের প্রার্থনায় কর্ণপাত না করে বরং দেবী সিংহকেই সমর্থন করে।উপায়ান্তর না দেখে অবশেষে রায়তেরা সংঘবদ্ধভাবে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। প্রথম সংগ্রাম শুরু হয় কাজীর হাট, কংকনিয়া ও টেপায়। ক্রমশ বিদ্রোহ অন্যান্য জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে। বিদ্রোহীরা তাদের একজনকে নবাব ঘোষণা করে নতুন নবাবের প্রতি আনুগত্য ঘোষণার জন্য সারা দেশের প্রতি আহ্বান জানায়। বিদ্রোহের ফলে দেবী সিংহের গোমস্তারা মফস্বল থেকে পলায়ন করে। কয়েকজন বিদ্রোহীদের হাতে ধৃত ও নিহত হয়।বিদ্রোহ দমন করার জন্য সরকার সেনাবাহিনী মোতায়েন করে। সেনাবাহিনীর কামানের গোলার মুখে বহু বিদ্রোহী কৃষক নিহত হয়। বিদ্রোহ দমনের পরে সরকার রাজা দেবী সিংহকে বন্দী করে এবং রাজস্ব হ্রাস করে সারা রংপুর জেলায় নতুন করে বন্দোবস্ত করাহয়।
বলাকী শাহর বিদ্রোহ ১৭৯১-৯২
বলাকী ছিলেন একজন ফকির। কিন্তু উত্তর বঙ্গের ফকির-সন্ন্যাসীদের ন্যায় তিনি ভবঘুরে ভ্রাম্যমাণ ছিলেন না। উত্তর বঙ্গের ফকিরদের প্রধান আড্ডা ছিল বিহারের কানপুর জেলার মাখনপুরে।
ফকিরদের দুই ভাগে ভাগ করা যেতে পারে—ভবঘুরে ভ্রাম্যমাণ ফকির, যারা ছিল সম্পূর্ণ সংসারত্যাগী, আর আবাসিক ফকির, যারা স্থায়ী দরগাস্থাপন করে সংসারত্যাগী না হয়েওআধ্যাত্মিক জীবন যাপন করত। বলাকী শাহ ছিলেন দ্বিতীয় দলের ফকির। তাঁর বাসস্থানছিল বাখেরগঞ্জ জেলার সলিমাবাদ পরগনার অন্তর্গত ঘাগড়ী গ্রামে। বিভিন্ন সুবি তাঁর সম্প্রদায়ের কোনো শ্রেণীর ফকির ছিলেন তিনি, এ সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায়নি।বিদ্রোহ উত্তর বঙ্গের ফকির বিদ্রোহের সঙ্গে তুলনীয় নয়, কেননা উত্তর বঙ্গের ফকির বিদ্রোহ ছিল মাদারিয়া ফকির সম্প্রদায়ের কর্মকাণ্ডে বৃটিশ সরকারের হস্তক্ষেপের প্রতিবাদ।আর বলাকী শাহের বিদ্রোহ ছিল বৃটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সচেতন রাজনৈতিক সংগ্রাম।কোম্পানির অপরিণামদর্শী রাজস্ব শাসনের ফলে কৃষক শ্রেণীর অর্থনীতি ভেঙে পড়ে, বেড়েওঠে কৃষকের প্রতি বৃটিশ আনীত ইজারাদার রাজস্ব ফটকাবাজদের অত্যাচার।
সলিমাবাদ, চন্দ্রদ্বীপ ও সুজাবাদ পরগনার কৃষকদের অনেকেই ছিল বলাকী শাহর শিষ্য। বৃটিশপোষ্য ইজারাদারদের অত্যাচার থেকে কৃষকদের রক্ষা করার জন্য বলাকীশাহ তাঁর পাঁচ হাজার সশস্ত্র শিষ্য নিয়ে ১৭৯১ সনের ডিসেম্বর মাসে বিদ্রোহ ঘোষণাকরেন। চন্দ্রদ্বীপ ও সলিমাবাদ পরগনার বহু অত্যাচারী জমিদার, তালুকদার ওইজারাদারদের তিনি বন্দী করেন। শাহ বন্দর নামে একটি বাজার প্রতিষ্ঠা করে সেখানে তিনি একটি মাটির দুর্গ স্থাপন করেন। মুঘল আমলের সুজাবাদ দুর্গের বহু অচল কামান সংগ্রহ করে তিনি সেগুলি মেরামত করেন এবং আরও অনেক কামান বন্দুক গোলাবারুদ সংগ্রহ করে তিনি তাঁর নব নির্মিত শাহ বন্দর দুর্গকে অস্ত্রসজ্জিত করেন।বলাকী শাহ সব রণ-প্রস্তুতি সম্পন্ন করে প্রায় পাঁচ হাজার শিষ্য-সৈন্য বলে ১৭৯১সনের ডিসেম্বর মাসে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। তাঁর স্বাধীনতা ঘোষণায় বলা হয় যে, এখন থেকে যারা ফিরিঙ্গি সরকারকে রাজস্ব দেবে, তাদের সমুচিত শাস্তি দেওয়া হবে। আরও ঘোষণা করা হয় যে, কোনো জমিদার তালুকদার প্রজাদের নিকট থেকে জমির খাজনা কানি প্রতি দুই টাকার ঊর্ধ্বে দাবি করতে পারবে না।
ঢাকায় বলাকী শাহর বিদ্রোহ পৌঁছার পর জেলা কালেক্টার উইলিয়াম ডগলাস বলাকী তাকে দমন করার জন্য 48 জন সিপাহিদের অন করেন এবং 1792 সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বলা কিসা এক রক্তাক্ত সমরে পরাজিত ও বন্দী হন এবং তাকে আজীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়।
***--আগা মোহাম্মদ রেজার বিদ্রোহ ----
সিলেটের একজন আবাসিক ফকির ছিলেন আগাম আহমদ রেজা তার সম্পর্কে বিস্তারিত তেমন কিছু জানা যায়নি। তিনি জাতিতে মুঘল এবং সিলেটে অবস্থানকারী একজন ফকির। 1799 খ্রিস্টাব্দে আগাম আহমদ রেজার বিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছিল।
আগা মোহাম্মদ রেজা বিশ্বাস করতেন যে, এদেশে ফিরিঙ্গি রাজত্ব মাত্র চল্লিশ বছর টিকবে এবং এর পর আবার মুসলমান রাজত্ব কায়েম হবে। কিন্তু কার্যত তিনি যখন দেখেন যে, ইংরেজ রাজত্ব অবসানের কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না, তখন তিনি নিজেই ইংরেজ-খেদাও আন্দোলন শুরু করেন। প্রায় সাত হাজার সশস্ত্র শিষ্য-ফকির নিয়ে তিনি কোম্পানির রাজত্বের বাইরে কাছারে গিয়ে ঘাঁটি স্থাপন করেন। সেখান থেকে তিনি সিলেট জেলার সমস্ত মুসলমান জমিদারদের নিকট আহ্বান জানান, ইংরেজ সরকারকে উৎখাত করার উদ্দেশ্যে তাঁকে আর্থিক ও সামরিক সাহায্য দানের জন্য। কিন্তু জমিদার সমাজ তখন চূড়ান্তভাবে ইংরেজ সরকারের করতলগত। ১৭৯৯ সনের ১৪ই জুলাই মোহাম্মদ রেজা পাঁচ হাজার সশস্ত্র অনুসারী নিয়ে সিলেট আক্রমণ করেন। কোম্পানির সেনাবাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ সমরে মোহাম্মদ রেজা পিছু হটতে বাধ্য হন। সেই যুদ্ধে রেজার৭০ জন শিষ্য সৈন্য নিহত হন। তাছাড়া পাঁচটি কামান ও অনেক গোলাবারুদ কোম্পানির হস্তগত হয়। কোম্পানি তাঁকে চূড়ান্তভাবে দমন করার জন্য এক পুরাদস্তুর সামরিক অভিযান প্রেরণ করে। ১৭৯৯ সনের ১৪ই আগস্টে রেজা ত্রিপুরা রাজ্যে পলায়নের পথেধৃত হন । সেই বৎসরই তাঁকে যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড হয়।
**---চাকমা বিদ্রোহ, (১৭৭৭-৮৭) খৃস্টাব্দ-----
মুঘল সরকারের সঙ্গে পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমা রাজার সম্পর্ক ছিল সৌহার্দ্যপূর্ণ। এর কারণ রাজার অভ্যন্তরীণ অর্থনীতি ও রাজনীতিতে কেন্দ্রীয় সরকারের হস্তক্ষেপ না করার নীতি। তখন পার্বত্য চট্টগ্রামের অর্থনীতিতে মুদ্রার প্রচলন ছিল না। দ্রব্য-বিনিময় ছিল বাণিজ্যের রীতি। বশ্যতার স্বীকৃতি স্বরূপ মুঘল সরকারকে যে নামেমাত্র কর প্রদান করা হতো তাও ছিল দ্রব্যে, মুদ্রায় নয়। ১৭৬০ সনে চট্টগ্রাম জেলা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নিকট হস্তান্তরিত করা হয়। চট্টগ্রাম জেলার অঙ্গ হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রামও কোম্পানির অধীনে আসে। ১৭৬১ সন থেকে নতুন কোম্পানি সরকার বার বার রাজস্বের পরিমাণ বৃদ্ধি করতে থাকে। ১৭৭২-৭৩ সনে চাকমা রাজা জোয়ান বক্শকে মুদ্রায় রাজস্ব দিতে বাধ্য করা হয় এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে মুদ্রা অর্থনীতি প্রচলনের জন্য নানা প্রকার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। এর ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামের সনাতন সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনে অস্থিরতা দেখা দেয় এবং ক্রমশই কোম্পানি সরকারের প্রতি অসন্তোষ বৃদ্ধি পেতে থাকে।
স্থানীয়ভাবে রাজস্ব সংগ্রহ করার ভার ছিল রাজার
প্রধান নায়েব রুনু খানের উপর। উদাদারের চুক্তিমাফিক রাজস্ব সংগ্রহ করতে ব্যর্থ হয়ে রুনু খান রাজা জোয়ান বখ্শের সম্মতিক্রমে কোম্পানির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন।১৭৭৭ সনে এপ্রিল মাসে শুরু হয় বিদ্রোহ। রুনু খান স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন করেন।এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম ও ঐ অঞ্চল-ঘেষা নিম্নাঞ্চল থেকে কোম্পানির কর্মচারী ও অনুগত্য লোকদের বিতাড়িত করেন।
রুনু খানকে দমনের জন্য কোম্পানি বারবার সৈন্য প্রেরণ করে, কিন্তু প্রত্যেক বার কোম্পানির বাহিনীকে ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসতে হয়। রুনু খানের রণকৌশল ছিল গেরিলা পদ্ধতির সম্মুখ যুদ্ধে কোম্পানির সৈন্যকে পরাস্ত করা ছিল অসম্ভব। তাই তার কৌশলছিল অতর্কিতে আক্রমণ ও পলায়ন। গেরিলা কৌশলে যুদ্ধ করার জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম ছিল আদর্শ স্থান। যুদ্ধের চিরাচরিত নিয়মে রুনু খানকে দমন করতে ব্যর্থ হয়ে কোম্পানি ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে। ১৭৮১ সনে পার্বত্য চট্টগ্রামকে ব্লকেড (Blocade) বা অর্থনৈতিকভাবে বিছিন্ন করা হয়। লবণ, মাছ, শুটকি, লৌহজাত দ্রব্য, মৃৎপাত্র প্রভৃতি দ্রব্যের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম নির্ভর করত চট্টগ্রামস্থ পরিবেশকদের উপর। এইসব দ্রব্যের সাপ্লাই সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করা হয়। কোম্পানির ব্লকেডের জবাবে রুনু খানও পাল্টা ব্লকেড ঘোষণা করেন। চট্টগ্রাম ছিল কোম্পানির লবণ তৈরির কেন্দ্র। কোম্পানির আয়ের তালিকায় লবণ ছিল ভূমি রাজস্বের পরেই। সেই লবণ তৈরি করতে যে জ্বালানি কাঠ ব্যবহৃত হতো, তার প্রায় ষোল আনাই আসত পার্বত্য অঞ্চল থেকে। রুনু খান জ্বালানি কাঠ সাপ্লাই বন্ধ করে দেন। এমনিভাবে যুদ্ধ চলে প্রায় দশ বৎসর। অবশেষে ক্লান্ত হয়ে কোম্পানির সরকার ১৭৮৭ সনে চাকমা রাজার সঙ্গে সন্ধি স্থাপন করে। সেই সন্ধিতেপার্বত্য চট্টগ্রামের রাজার অভ্যন্তরীণ স্বাধীনতা স্বীকার করা হয়।
****পাগলপন্থী বিদ্রোহ,( ১৮২৫-৩৩ খৃস্টাব্দ--)---
অষ্টাদশ শতকের শেষ পর্বে করিম শাহ নামক এক ভ্রাম্যমাণ ফকির শেরপুরে (বর্তমান জামালপুর জেলায়) তাঁর খানকা স্থাপন করেন। তিনি ছিলেন মাদারিয়া শ্রেণীর সুফি এবংফকির মজনু শাহর নিকট-সঙ্গী ও শিষ্য। শিষ্যকরণে করিম শাহর কোনো জাতিভেদ ছিলনা। তাঁর ভক্তদের মধ্যে ছিল সব ধর্মের লোক—মুসলমান, হিন্দু, গারো, হাজং সবাই।তিনি ধরাবাঁধা শাস্ত্রীয় নিয়মে বিশ্বাস করতেন না। প্রচলিত ধর্মীয় ও সামাজিক রীতিনীতি পরিহার করে আপন মনের অনুশাসনে চলাই ছিল করিম শাহ ও তাঁর অনুসারীদের ধর্ম।অন্যান্য ফকিরদের ন্যায় তিনি নিজেকে পারস্য কায়দায় মাস্তানা বা দীওয়ানা না বলে।বলতেন পাগল। মাস্তানা ও দীওয়ানা পদবির শাব্দিক অর্থও পাগল। করিম পাগলের
বিরোধী সশস্ত্র প্রতিরোধ আন্দোলন
শিষ্যরা ছিল পাগলপন্থী নামে পরিচিত। করিম পাগলের মৃত্যুর পর তদীয় পুত্র টিপু শাহ খালুকায় গদিনসিন হন। টিপু শাহ বা টিপু পাগলের সময়ে প্রথম প্রথম জমিদার ও পরে বৃটিশদের সশস্ত্র যুদ্ধ বাঁধে।
যুদ্ধের মূল কারণ জমিদার কর্তৃক প্রজা পীড়ন। শেরপুর অঞ্চল ছিল পূর্বে নাটোরের জমিদারির অন্তর্গত। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পর নাটোরের জমিদারি রাজস্ব অনাদায়ে নিলামে বিক্রি হয়ে যায়। কলকাতার কতিপয় ব্যবসায়ী শেরপুর অঞ্চল নিলামে ক্রয় করে।ব্যবসায়ী নতুন জমিদারেরা ঘন ঘন খাজনা বৃদ্ধি করতে থাকে। খাজনা বৃদ্ধি ছাড়াও নানা রকম চাঁদা, সেলামি, নজরানা, উপরি, তুহুরী প্রভৃতির নামে বলপূর্বক অর্থ সংগ্রহ করতে থাকে। এহেন অত্যাচার থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য প্রথমে প্রজারা বৃটিশ সরকারের মুখাপেক্ষী হয়, কিন্তু যেহেতু খাজনা বৃদ্ধি করার আইনগত অধিকার জমিদারদের আছে,সেহেতু সরকার প্রজাদের সাহায্যে এগিয়ে আসতে অস্বীকৃতি জানায়। বাধ্য হয়ে প্রজারা টিপু পাগলের শরণাপন্ন হয়। নির্যাতিত প্রজাদের মধ্যে অনেকেই ছিল টিপুর শিষ্য। টিপুতাঁর শিষ্যদের নির্দেশ দেন চিরাচরিত হারের উর্ধ্বে খাজনা না শোধ করার জন্য। টিপুর আহ্বানে সব প্রজারা সাড়া দেয় এবং তাদের অধিকার সংরক্ষণের জন্য প্রয়োজন হলে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে অবতীর্ণ হওয়ার প্রতিজ্ঞা ঘোষণা করে। ১৮২৫ সনের জানুয়ারি মাসে টিপুর সশস্ত্র শিষ্যরা নতুন জমিদারদের বাড়ি লুট করে এবং কয়েকজন গোমস্তাকে হত্যা করে। জমিদারেরা প্রাণ রক্ষার্থে ময়মনসিংহ শহরে পলায়ন করে। টিপু স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং নিজেকে ঐ অঞ্চলের শাসক হিসেবে প্রচার করেন। অচিরেই সরকারি বাহিনীএসে টিপুকে পরাস্ত ও বন্দী করে। কিন্তু পাগলপন্থীদের চাপের মুখে টিপুকে সরকার মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। সরকার-বিরোধী কার্যকলাপের জন্য ১৮২৭ সনে আবার টিপুকে বন্দী করা হয়। ধীরে ধীরে প্রজা ও পাগল অসন্তোষ আরও বৃদ্ধি পায়। ১৮৩৩ সনে তিন হাজার সশস্ত্র পাগলপন্থী ও প্রজা শেরপুর শহর আক্রমণ করে এবং সব কয়টি সরকারি ভবন ওপুলিশ স্টেশন জ্বালিয়ে দেয়। শেরপুর থেকে গারো পাহাড় পর্যন্ত সমস্ত এলাকাকে পাগল রাজ্য বলে ঘোষণা করে। বিদ্রোহীদের দমন করার জন্য ঢাকা থেকে অতিরিক্ত সেনা আনতে হয়। সারা বৎসরব্যাপী ঘরে ঘরে বৃটিশ সেনারা তল্লাশি চালায় এবং পাগলদের দৃষ্টান্তমূলক সাজা দেয়। ১৮৩৩-এর অপারেশনে বহু সশস্ত্র ও নেতৃস্থানীয় পাগল আত্মরক্ষার্থে শেরপুর ছেড়ে নিরাপদ স্থানে পলায়ন করে।।
****তিতুমীরের বিদ্রোহ,( ১৮৩১ খৃষ্টাব্দ)-----
নিসার আলী ওরফে তিতুমীর ছিলেন চব্বিশ পরগনার বারাসাত মহকুমার চাঁদপুর গ্রামের অধিবাসী। প্রথম জীবনে তিনি ছিলেন একজন লাঠিয়াল। কোনো এক ফৌজদারি মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হয়ে যখন তিনি কারাবন্দী হন, তখন তাঁর মন ধর্মের দিকে ঝুঁকে পড়ে। বন্দী
জীবনের মেয়াদ শেষে তিনি মক্কায় হজ্জ্ব করতে যান। মক্কায় তিনি সৈয়দ আহমদ শহীদের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। মক্কা থেকে প্রত্যাবর্তনের (১৮২৭) পর তিনি নারিকেলবাড়িয়ার নিকটবর্তী হায়দারপুরে খানকা স্থাপন করেন এবং সৈয়দ আহমদ শহীদের তরিকা মোহাম্মদিয়া সুন্নি মতবাদ প্রচার শুরু করেন। অচিরেই তিনি একটি শক্তিশালী সংগঠন ভিত্তিক সামাজিক ও ধর্মীয় আন্দোলনের নেতা হিসেবে স্থানীয় হিন্দু জমিদার ও মোহাম্মদিয়া বিরোধী মুসলমানদের ঈর্ষা ও ভয়ের কারণ হয়ে ওঠেন। সেই ভয় থেকে শুরু হয় তিতুমীর বনাম জমিদারদের সশস্ত্র দ্বন্দ্ব এবং ঐ আঞ্চলিক দ্বন্দ্বেরই পট পরিবর্তন হয়ে শেষ পর্যন্ত সরকার-বিরোধী সংগ্রামে রূপান্তরিত হয়।
তিতুমীরের পক্ষে নির্যাতিত প্রজারা যোগদান করে। আরও যোগ দেয় কতিপয় সশস্ত্র ফকির দল। সবার সক্রিয় সমর্থনে তিতুমীর ১৮৩১ সনের ৬ই ডিসেম্বরে একটি হিন্দু মন্দির আক্রমণের মাধ্যমে জমিদার ও বৃটিশ-বিরোধী সংগ্রাম শুরু করেন। প্রতিরক্ষার জন্য নারিকেলবাড়িয়ায় একটি বাঁশের কেল্লা নির্মাণ করেন তিনি। নারিকেলবাড়িয়ার একদফা যুদ্ধে তিতুমীর জয়ী হন। ১৭ই নভেম্বর তাঁর বিরুদ্ধে এক পুরাদস্তুর সামরিক অভিযান প্রেরণ করা হয়। তিতুমীর ও তাঁর অনুসারীগণ সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধ করেন বটে, কিন্তু বৃটিশের কামান-গোলার মুখে তিনি সহজেই পর্যুদস্ত হন। তবে বৃটিশের কাছে আত্মসমর্পণের চেয়ে তিনি ও তাঁর নিকট-অনুসারীগণ যুদ্ধ করে শাহাদাৎ বরণ বেছে নেন।১৯শে ডিসেম্বর তাঁর চূড়ান্ত পতন ঘটে। তিতুমীর ও তাঁর চল্লিশজন সঙ্গী নিহত হন।যুদ্ধবন্দীদের বিচারে তিতুমীরের বাহিনীর অধিনায়ক গোলাম মাসুমকে ফাঁসি দেওয়া হয়।এবং বাকি প্রায় দেড়শত ধৃত ভক্তকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়।
****তথ্যসংগ্রহ
(বাংলা দেশের ইতিহাস /ড.মুহাম্মদ আব্দুর রহিম, ড.আবদুর মমিন চৌধুরী, ড.এ.বি.এম.মাহমুদ, ড.সিরাজুল ইসলাম)
0 মন্তব্যসমূহ