ভাষা আন্দোলন ও বাংলা সাহিত্য/বাংলাদেশের সাহিত্যে ভাষা আন্দোলনের প্রতিফলন----
বাংলাদেশের ইতিহাসে ভাষা আন্দোলন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ভাষার জন্য বাংলার মানুষের ত্যাগ কখনোই ভুলবার নয়।এই ভাষা আন্দোলন কে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে বাংলা সাহিত্যের এক বিশাল ভান্ডার। ভাষা আন্দোলন বাঙালিকে দিয়েছে নতুন পথেরসন্ধান, নির্মাণ করেছে বাঙালি জাতীয়তাবাদের নতুন সড়ক। ভাষাভিত্তিক একটি জাতিহিসেবে বাঙালির ঐতিহাসিক জাতপ্রকাশের ইতিহাসে বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি যথার্থইএকটি মহত্তম দিন। একুশে ফেব্রুয়ারি বাঙালির আত্মজাগরণের দিন, স্বাধিকারের স্বপ্নবপনের দিন, আপন সত্তাকে বিপুল মহিমায় ঘোষণা করার দিন, সমশক্তিতে উদ্বুদ্ধ হয়েশোষকের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ উচ্চারণের দিন। বাস্তিল দিবসে ফরাসি জাতি শত বছরের গ্লানিমুছে যেমন লাভ করেছিল নবজন, তেমনি একুশে ফেব্রুয়ারিতে বাঙালি জাতি ছুঁজে পেয়েছিলতার আত্মপরিচয়ের সূর্যকরোজ্জ্বল নতুন ঠিকানা।একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, আমাদের সংস্কৃতির অন্তর্ভুবনে ভাষাআন্দোলনেরমতো প্রস্তাবসঞ্চারী কোনো অনুষঙ্গ নেই। উনিশশ' বায়ান্ন সালে বাঙালি জাতির রক্তাক্তউজ্জীবনের অব্যবহিত পরেই আমাদেরসাহিত্যেরবিভিন্ন শাখায় তার প্রতিথাকে। বাংলাদেশের এমন কোনো লেখক হয়তো নেই, যিনি ভাষা-আন্দোলন নিয়ে একটিকবিতা-নাটক-ছোটগল্প-উপন্যাস-ছড়া কিংবা প্রবন্ধ লেখেন নি। ভাষা-আন্দোলনের ভৌগচেতনা আমাদের লেখকদের সাহিত্যচর্চায় উদ্বুদ্ধকরেছে। একুশে ফেব্রুয়ারি তাঁদের শুনিয়েছে
অন্ধকার থেকে আলোর দিকে এগিয়ে যাওয়ার প্রয়াস।ভাষা আন্দোলন কে কেন্দ্রীয় করে যেমন সাহিত্য রচিত হয়েছে, তেমনি আবার ভাষা আন্দোলনের মৌল চেতনাকে মর্মে ধারণ করে আমাদের সাহিত্যে লেগেছে নতুন হাওয়া। বস্তুত, ভাষা আন্দোলনই আমাদের সাহিত্যিকদের সামনে তুলে ধরে জাতিসত্তার মৌল পরিচয়, আমাদের গন্তব্যের সঠিক ঠিকানা। তাই সাহিত্যে তার প্রতিফলন ছিল একান্তই স্বাভাবিক ও প্রত্যাশিত।
বিগত পঞ্চান্ন বছরের (১৯৫২-২০০৭) বাংলাদেশের সাহিত্যে জড়িয়ে আছে স্যাম ও সাহস ও সঙ্ঘশক্তির বিমিশ্র অভিব্যক্তি, যা একান্তই আমাদের ভাষা আন্দোলনের গর্বিত উত্তরাধিকার। অর্ধ-শতাব্দী ধরে বাংলাদেশের সাহিত্যে ভাষা-আন্দোলনের যে প্রতিফলন ঘটেছে, তার স্বরূপ ও বৈশিষ্ট্য, রূপ ও রূপান্তর অঙ্কনই বর্তমান প্রবন্ধের অন্বিষ্ট বিষয়। তবে সংক্ষিপ্ত পরিসরের একটি প্রবন্ধে অর্ধ-শতাব্দীর সাহিত্যে ভাষা-আন্দোলনের প্রতিফলনের বগ ও ভূপান্তর অঙ্কন প্রায় অসম্ভব এক বিষয়। তাই বর্তমান নিবন্ধে বিগত অর্ধ-শতাব্দীতে বাংলাদেশের সাহিত্যে ভাষা-আন্দোলনের চারিত্র্য ও চেতনা যেভাবে প্রতিফলিত হয়েছে, তার একটি সংক্ষিপ্ত রূপরেখা অঙ্কিত হয়েছে। অপ্রধান অনেক বিষয়কে সজাগ থেকেই, আমি আলোচনায় অনুক্ত রেখেছি; অনুপস্থিত থেকে গেছেন অনেক সাহিত্যিক—বিশেষত কবি, অনেকের নামই এখানে উচ্চারিত হয় নি। আমি ধরতে চেয়েছি মূল স্রোতধারা, দেখাতে চেয়েছি অর্ধ-শতাব্দীর সাহিত্যে ভাষা আন্দোলনের প্রতিফলনের প্রধান প্রবণতাসমূহ। এ কারণে জেনে-শুনেই আমাকে মেনে নিতে হয়েছে সংক্ষিপ্তির আপাত অপূর্ণতা।সূচনা-সূত্রেই উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলাদেশের সাহিত্যে ভাষা-আন্দোলনের প্রতিফলন ঘটেছে বহুমাত্রিক ব্যঞ্জনায়। আমাদের সাহিত্যে ভাষা-আন্দোলনের বিভিন্ন অনুষঙ্গ কীভাবে এবং কোন মাত্রায় প্রতিফলিত হয়েছে, তা শনাক্তির জন্যে এবার দৃষ্টি দেওয়া যাক। আলোচনার সুবিধার্থে আমরা অগ্রসর হতে পারি নিম্নোক্ত ক্রমসূত্রে— ক. কবিতা, খ. উপন্যাস, গ. ছোটগল্প, ঘ. নাটক এবং ঙ. অন্যান্য। লক্ষণীয়, এখানে কেবল সৃষ্টিশীল রচনার কথাই উল্লেখ করা হয়েছে, বাদ গেছে প্রবন্ধ। প্রবন্ধও, আমি বিবেচনা করি, সৃষ্টিশীল রচনা; তবু এখানে প্রবন্ধকে অন্তর্ভুক্ত করি নি, কারণ প্রবন্ধে প্রতিফলন থাকে না, থাকে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ বিবেচনা।আমাদের সাহিত্যের অন্যান্য শাখা অপেক্ষা কবিতাতেই ভাষা আন্দোলনের প্রতিফলন ঘটেছে সবচেয়ে বেশি। ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে রচিত কবিতার সংখ্যা এখন হিসেবের বাইরে। তবে ঐতিহাসিক গুরুত্বের কথা বিবেচনা করে আমরা প্রথমেই উল্লেখ করতে চাই হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত একুশে ফেব্রুয়ারী গ্রন্থে সঙ্কলিত কবিতাগুচ্ছের কথা। ওই সংকলনে পত্রস্থ হয়েছিল এগারটি কবিতা, আর কবিরা ছিলেন— শামসুর রাহমান, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, আবদুল গনি হাজারী, ফজলে লোহানী, আলাউদ্দিন
আল আজাদ, আনিস চৌধুরী, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, জামালুদ্দিন, আতাউর রহমান,সৈয়দ শামসুল হক এবং হাসান হাফিজুর রহমান। এইসব কবির সম্মিলিত শব্দস্রোতেউদ্ভাসিত হয়েছে একুশে ফেব্রুয়ারির কালজয়ী তাৎপর্য, সমবায়ী জাগরণ, উজ্জ্বল ভবিষ্যতেরঅভ্রান্ত ইঙ্গিত আর অত্যাচারীর বিরুদ্ধে সপ্তাশক্তির প্রতিবাদের উত্তাপ। স্মরণ করা যায়পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী কর্তৃক একুশের প্রথম স্মৃতিস্তম্ভ ভেঙে ফেলার পর আলাউদ্দিন
আল আজাদের ছন্দোবদ্ধ প্রতিবাদ উন্নখিত জাগরণ---
"স্মৃতির মিনার ভেঙেছে তোমার? ভয় কি বন্ধু, আমরা এখনো,
চারকোটি পরিবার হীরার মুকুট নীল পরোয়ানা খোলা তলোয়ার ঘুরের ঝটিকা ধূলায় চূর্ণ যে পদ প্রান্তে
যারা বুনি ধান।
শুন টানি, আর তুলি হাতিয়ার হাপর চালাই
সরল নায়ক আমরা জনতা সেই অনন্য।
ইটের মিনার ভেঙেছে, ভাঙুক।
ভয় কি বন্ধু, দেখ একবার আমরা জাগরী খাড়া রয়েছি তো।
যে-ভিৎ কখনো কোনো রাজন্য পারেনি ভাঙতে চারকোটি পরিবার।
(আলাউদ্দিন আল আজাদ/‘স্মৃতিস্তত্ত')
—একুশে ফেব্রুয়ারি বাঙালি জাতিকে যে ঐক্যবদ্ধ করেছে, তাদের মধ্যে জাগ্রত করেছে যেজাতীয়তাবাদী চেতনা; উপর্যুক্ত কবিতাংশে তারই সংহত উদ্ভাসন ঘটেছে।হাসান হাফিজুর রহমানের ‘অমর একুশে' কবিতায় শিল্পিত হয়েছে বাঙালিরআত্মজাগরণের ইতিহাস। বরকত সালাম রফিক জব্বার—এইসব থোকা থোকা জ্বলন্ত নামকীভাবে বাঙালির হৃদয়ে বর্শার ফলার মতো গেঁথে আছে, হাসান হাফিজুর রহমানেরকবিতায় তার পরিচয় উদ্ভাসিত। দেশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তকে উন্মাতাল করেছে এইসবশহীদের নাম—যে নাম কখনো বাঙালির হৃদয় থেকে, বাংলাভাষী মানুষের মন থেকে মুছেযাবার নয়। এই সব নামের মহিমাই উচ্চারিত হয় হাসানের কবিতায়—
বাংলাদেশের সমস্ত প্রান্তকে উন্মাতাল করে দেওয়া একুশের ভিন্নতর এক ব্যঞ্জনা প্রকাশিত হয়েছে আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর কোনো এক মাকে' কবিতায়। খোকা, যে শহীদ হয়েছে ভাষা-আন্দোলনে, আর যে কখনো উড়কি ধানের মুড়কি হাতে প্রতীক্ষারত মায়ের কাছে ফিরে আসবে না, সে-কথা তার মা কিছুতেই বুঝতে চায় না। এ কবিতার শরীরে ওসভায় প্রবহমাণ শহীদের রক্ত-নিঙড়ানো আবেগ, যে-আবেগের ধারাজলে স্নাত হয়ে খোকার মা হয়ে যায় দেশজননী।
""""কুমড়ো ফুল শুকিয়ে গেছে,শুকিয়ে পড়েছে ডাঁটা;
পুঁইলতাটা নেতানো –
“খোকা এলি?”—
ঝাপসা চোখে মা তাকায় উঠোনে,
উঠোনে যেখানে খোকার শব, শকুনিরা ব্যবচ্ছেদ করে।
এখন,মা'র চোখে চৈত্রের বোন পুড়িয়ে দেয় শকুনিদের।।
তারপর,দাওয়ায় বসে বিন্নি ধানের খই ভাজে,
মা আবার ধান ভানে,
খোকা তার কখন আসে। কখন আসে।
মার চোখে শিশির ভোর,
স্নেহের রোদে ভিটে ভরেছে।
(আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ/ কোনো এক মাকে)"""
এইভাবে ভাষা-আন্দোলন আমাদের সামূহিক কবি-চৈতন্যে নিয়ে আসে নতুন মাত্রা;ভাষা আন্দোলন হয়ে ওঠে বাংলাদেশের কবিদের অবিনাশী শিল্প-আয়োজন। যখনিশৃঙ্খলমুক্তির প্রয়োজন আসে, যখনি প্রয়োজন শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ উচ্চারণ, কিংবাজনস্রোতের জোয়ার ভাষা আন্দোলন আর তার শহীদেরা তখনি দ্রোহের ভূমিকায় হয়অবতীর্ণ। ওই অবিনাশী শক্তি-উৎস তাই বায়ান্ন উত্তর বাংলাদেশের কবিতার এক প্রধান
অনুষঙ্গ। নির্দিষ্ট কোনো কবি নয়, সকলের ক্ষেত্রেই একথা সত্য, যেমন সত্য শামসুররাহমানের 'ফেব্রুয়ারী, ১৯৬৯' কবিতায়—
"""বুঝি তাই উনিশশো ঊনসত্তরেও
আবার সালাম নামে রাজপথে, শূন্যে তোলে ফ্ল্যাগ
বরকত বুক পাতে ঘাতকের খাবার সম্মুখে।
সালামের বুক আজ উন্নখিত মেঘনা
সালামের চোখ আজ আলোকিত ঢাকা
সালামের মুখ আজ তরুণ শ্যামল পূর্ববাংলা।
(শামসুর রাহমান/ ফেব্রুয়ারী, ১৯৬৯')
এইভাবে উনিশশো বায়ান্ন-উত্তর কালগতে একুশে ফেব্রুয়ারি হয়ে ওঠে বাঙালি জাতির প্রতিদিনের পথ চলার পাথেয়। একুশের আর এক নাম হয়ে ওঠে সংক্ষোভ, একুশের অর্থদাঁড়ায় মাথা-মত-না-করা, একুশ হয়ে ওঠে স্বপ্ন আর সম্ভাবনার প্রতীক। অনেক কবিইএকুশকে কবিতায় ব্যবহার করেছেন প্রতীক হিসেবে, যেমন করেন মহাদেব সাহা তাঁর'একুশের গান' কবিতায়—
""একুশ মানেই আসছে, স্বপ্ন আসছে, ভবিষ্যৎ আসছে
একুশ মানে অতীত নয়, আগামী
মৃত্যু নয়, জন্ম:
একুশ মানে শহীদদের পায়ের শব্দ
একুশ মানে অক্ষর, অমর, অবিনশ্বর।
(মহাদেব সাহা/ 'একুশের গান)""
গ্ৰাক-মুক্তিযুদ্ধ কালখণ্ডে ভাষা আন্দোলনের এই প্রতিবাদী চেতনা মধ্য-আশির স্বৈরবৃত্ত সময়ে স্তব্ধ হয়ে পড়ে; ধাতব অস্ত্রধারী শাসকের কাছে একুশে ফেব্রুয়ারি হয়ে ওঠেভীতির কারণ, যেমন ভীত হয়েছিল পঞ্চাশ-ষাটের পাকিস্তানি সামরিক শাসকরা। একুশেফ্রেব্রুয়ারি তখন রূপান্তরিত হয় স্মৃতির অনুষঙ্গে। কালিক এই প্রবণতাই কবির শব্দস্রোতে অভিব্যক্ত হয় রূপক ব্যঞ্জনায়—
""মাটিতে ভায়ের লাশ পড়ে গিয়ে করে যেন নিমেষে নিঃশেষ,
তাদের দেহের মেদ, সকল লাবণ্য মিশে হয়েছে উর্বর
এ বাগান, হায় আমাদের এই জীবনের সকল বাগান।
কবি ও কুকুরদের এইখানে আসতে দিও না।
ওদের নখরে শুধু উঠে আসে স্মৃতির কবর থেকে মৃত
ভায়ের বোনের লাশ, আমাদের সমাহিত স্মৃতির কাফন।
(খোন্দকার আশরাফ হোসেন/ ফেব্রুয়ারিতে জনৈক বাগান মালিক)""""
কবিতার মতো পরিমাণে বিপুল না হলেও, বাংলাদেশের উপন্যাসেও ভাষা-আন্দোলনেরবহুমাত্রিক প্রতিফলন ঘটেছে। ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে লেখা উপন্যাসসমূহে মূলতশিল্পিত হয়েছে সঙ্ঘবদ্ধ বাঙালির প্রতিবাদী চেতনা। ভাষা আন্দোলন নিয়ে প্রথম উপন্যাসরচনা করেছেন জহির রায়হান। তাঁর আরেক ফাল্গুন (১৯৬৮) ভাষা আন্দোলনের উপন্যাসহিশেবে যেমন যুগন্ধর সৃষ্টি, তেমনি একই সঙ্গে যুগোত্তীর্ণ নির্মাণ। সামরিক শাসনেরনিগ্রহের মধ্যে বাস করেও, একুশের মর্মকোষ উৎসারিত আরেক ফাল্গুন পাঠ করে আমরাহয়ে উঠি সাহসী মানুষ; আসাদ-মুনিম রসুল সালমার মতোই অভীক-চিত্তে আমরাও বলে উঠি—'আসছে ফাল্গুনে আমরা কিন্তু দ্বিগুণ হবো।' জহির রায়হানের এই পূর্বাভাস যে কত সভ্য, ভাষা-আন্দোলনের পঞ্চাশতম বার্ষিকী আসার পূর্বেই আমরা তা প্রত্যক্ষ করেছি।ভাষা আন্দোলন তথা একুশে ফেব্রুয়ারির রক্তাক্ত ইতিহাস আজ বিশ্ব মানবের গৌরবোজ্জ্বল উত্তরাধিকার। ইউনেস্কো ঘোষিত আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ভাষা আন্দোলনকে নতুন তাৎপর্যে অভিষিক্ত করেছে, যার পূর্বাভাস আমরা পেয়েছিলাম আরেক১৮৫৭ সালের রক্তাক্ত স্মৃতি উন্মোচনের মধ্য দিয়ে আরেক ফাল্গুন-এর সূত্রপাত।বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের ধারায় গৌরবোজ্জ্বল সব ইতিহাসকে স্মরণ করে লেখক এউপন্যাসকে পৌঁছে দিয়েছেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের আসন্ন প্রভাতে। ১৯৫৫ সালেরএকুশে ফেব্রুয়ারি পালনের একটি কাহিনী নিয়ে গড়ে উঠেছে এ উপন্যাস। ভাষা আন্দোলনবাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনা বিকাশের পথ উন্মুক্ত করে দেয়। জাতীয়তাবাদী এই চেতনাইরচনা করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের ভিত্তি। জহির রায়হান এ উপন্যাসে ভাষাআন্দোলনের রক্তাক্ত উজ্জীবন এবং বাঙালি জাতিসত্তার অনিঃশেষ শক্তি-উৎসের শিল্পরূপনির্মাণ করেছেন।ভাষা-আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে শওকত ওসমান লিখেছেন আর্তনাদ (১৯৮৫) উপন্যাস।আলোচ্য উপন্যাসেও মূলত শিল্পিত হয়েছে বাঙালি জাতিসত্তার সমুখিত উজ্জীবনের রক্তাক্তআবেগ। 'এত রক্ত জননী বাংলা ভাষা, এত রক্ত ছিল ও শীর্ণ শরীরে?'—এই জিজ্ঞাসাধর্মীশব্দগুচ্ছের পৌনঃপুনিক উচ্চারণের মাধ্যমে শিল্পিত হয়েছে বাঙালির দ্রোহ-বিদ্রোহআত্মসমীক্ষা ও আত্মজাগরণের ইতিহাস। ভাষা আন্দোলনে নিহত শহীদের পিতার নিঃশব্দআর্তনাদ ব্যক্তি অভিজ্ঞতার সীমানা ছাড়িয়ে উপন্যাসের সমাপ্তিতে দেশমাতৃকার উজ্জীবনেরসমগ্রতায় বিস্তার লাভ করেছে। উপন্যাসের 'কোরাস' অংশে পুত্রহারা পিতার দীর্ঘশ্বাস ওআর্তনাদের সঙ্গে একাত্ম হয়েছে বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের রক্তাক্ত ধারা। একুশে ফেব্রুয়ারিরপ্রেক্ষাপটে রচিত হলেও, এ উপন্যাসেও আমরালক্ষ করি, যেমন লক্ষ করেছি আরেক ফাল্গুনউপন্যাসে, বাঙালি জাতিসত্তার প্রতিবাদী চেতনা উন্মোচনই শওকত ওসমানের কেন্দ্রীয়
উদ্দেশ্য। ওদের ভাষায় আমি মৃতদেহ, মূর্খ মূর্খ পঞ্চান্ন হাজার বর্গমাইল আমার আয়তন–শহীদের আত্মবিস্তারধর্মী এই সংলাপের মধ্যেই প্রতিভাসিত হয়েছে আলোচ্য উপন্যাসেরমৌল চেতনা।আর্তনাদ উপন্যাসে শওকত ওসমানের ইতিহাসজ্ঞান, সমাজ-অভিজ্ঞতা এবং প্রগতজীবনদৃষ্টির সুস্পষ্ট ছায়াপাত ঘটেছে।।
ভাষা-আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে সেলিনা হোসেন রচনা করেছেন দু'টি উপন্যাস—যাগিত জীবন (১৯৮১) এবং নিরন্তর ঘণ্টাধ্বনি (১৯৮৭)। যাপিত জীবন উপন্যাসে ১৯৪৭ সালেরদেশ বিভাগের পরবর্তী সময় থেকে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন পর্যন্ত ঘটনাধারাকেঔপন্যাসিক-অবয়ব দান করা হয়েছে। উপর্যুক্ত সময়ের উন্মাতাল ইতিহাস যাপিত জীবনএর শব্দস্রোতে বন্দি হয়ে আছে। এই উন্মাতাল সময় ব্যক্তি ও সমষ্টি-অস্তিত্বকে কীভাবেরূপান্তরিত করে দেয়, তারই শিল্প-স্বাক্ষর যাপিত জীবন। এ উপন্যাসে সমষ্টি-অস্তিত্বেরএই রূপ-রূপান্তরকে ধারণ করে আছে কেন্দ্রীয় চরিত্র জাফর। পশ্চিমবঙ্গের বহরমপুর থেকে১৯৪৭ সালে পূর্ববাংলায় স্থানান্তরিত জাফর বছর না ঘুরতেই নতুন জিজ্ঞাসায় আলোড়িতহতে থাকে। “পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু" শীর্ষক পুস্তিকা পাঠের পর প্রতিবাদেরকড় ওঠে জাফরের মনোলোকে। এই প্রতিবাদী চেতনাই ভাষা-আন্দোলনের মৌল প্রেরণা।ভাষা-আন্দোলনের এই প্রেরণাকে ধারণ করে আছে যাপিত জীবন-উপন্যাস।ভাষা আন্দোলনের অনুষঙ্গে রচিত বেশ কিছু ছোটগল্পের নাম আমরা এখানে উল্লেখকরতে পারি। শওকত ওসমানের 'মৌন নয়', সাইয়িদ আতীকুল্লাহর 'হাসি',আনিসুজ্জামানের 'দৃষ্টি', মিন্নাত আলীর ‘রুম বদলের ইতিকথা', সরদার জয়েন উদ্দীনের‘খরস্রোত', নূরউল আলমের ‘একালের রূপকথা', মঈদ-উর-রহমানের 'সিঁড়ি', রাবেয়াখাতুনের ‘প্রথম বধ্যভূমি’, সেলিনা হোসেনের ‘দীপান্বিতা’, শহীদুল্লা কায়সারের 'এমনিকরেই গড়ে উঠবে', মুর্তজা বশীরের ‘কয়েকটি রজনীগন্ধা', সৈয়দ শামসুল হকের ‘সম্রাট’,বশীর আলু-হেলালের ‘বরকত যখন জানত না সে শহীদ হবে', শওকত আলীর ‘অবেলায়পুনর্বার’, রাজিয়া খানের ‘শহীদ মিনার’, রিজিয়া রহমানের ‘জোৎস্নার পোস্টার', মাহমুদুলহকের ‘ছেঁড়া তার', রশীদ হায়দারের ‘সুদূরের শহীদ', মঈনুল আহসান সাবেরের ‘মরেযাওয়ার সময় হয়েছে এবং জহির রায়হানের ‘একুশের গল্প’, ‘সূর্যগ্রহণ’, ‘কয়েকটি সংলাপ'ইত্যাদি ছোটগল্প ভাষা আন্দোলনের বহুমাত্রিক শিল্পকথা হিসেবে উল্লেখযোগ্য নির্মাণ।এসব ছোটগল্পে ভাষা-আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে মানুষের জীবনের এক একটি খণ্ড ছবি অঙ্কিত হয়েছে, যে-সব খণ্ড ছবির মৌল প্রত্যয় বাঙালির সত্তাগত রূপান্তর। ভাষা আন্দোলন
বিষয়ক গল্পে যে-মৌল প্রত্যয় শিল্পিত হয়েছে, জহির রায়হানের কয়েকটি সংলাপ' থেকেএকটি অংশ উদ্ধৃত করে আমরা তা এভাবে উপস্থাপন করতে পারি—
"""পদত্যাগ চাই।
ওদের পদত্যাগ চাই।
বরকতের খুন আমরা ভুলব না।
রফিক আর জব্বারের খুন আমরা ভুলব না।
বিচার চাই।
ফাঁসি চাই ওই খুনীদের।
ভাইসব। সামনে এগিয়ে চলুন।
ওদের গোলাগুলি আর বেয়নেটকে উপেক্ষা করে এগিয়ে চলুন।
জহির রায়হান/ ‘কয়েকটি সংলাপ')"""
—সপ্তাশক্তির প্রেরণায় শোষকের বিরুদ্ধে মুক্তির সংগ্রামে এগিয়ে যাওয়ার আহ্বানই ভাষাআন্দোলনকেন্দ্রিক গল্পসাহিত্যের মৌলবাণী।ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে শিল্পসফল নাটকের সংখ্যা খুবই কম—মাত্র দুটি— মুনীর
চৌধুরীর কবর (রচনাকাল ১৯৫৩, প্রকাশকাল ১৯৬৬) এবং মমতাজউদ্দীন আহমদের,বিবাহ (১৯৮৮)। বিষয়ের গৌরব এবং আঙ্গিকের অভিনবত্বে কবর নাটক এক অসামান্য নির্মাণ। সংক্ষিপ্ত পরিসরের এই একাঙ্কিকায় মুনীর চৌধুরী ধারণ করেছেন বাঙালি জাতিসত্তার সম্মিলিত জাগরণের রৌদ্রোজ্জ্বল চেতনা। কবর-ই বাংলাদেশের সাহিত্যে প্রথম প্রতিবাদী নটক। সাম্প্রদায়িকতা, সামন্তপ্রথা, ঔপনিবেশিক শোষণ এবং সব ধরনের অত্যাচারের বিরুদ্ধে এখানে উচ্চারিত হয়েছে প্রতিবাদের শ্লোগান। মুর্দা ফকিরের আচরণএবং শহীদদের কবরে না-যাওয়ার প্রতীকী ব্যঞ্জনায় এখানে শিল্পিত হয়েছে সঙ্ঘশক্তির জাগরণ। তাই হাইকোর্টের কেরানি হয়েও মূর্তি-২ কেন ছাত্রদের মিছিলে এল, আর কেনই
বা এখন সে কবরে যাচ্ছে না, নেতার এই প্রশ্নের উত্তরে কেরানি যা বলে, তাতে উদ্ভাসিত
হয় সম্প্রশক্তির উত্তাপ—
""""নেতা। ...কে? তুমি কে?
মূর্তি (২)। নাম বললে চিনতে পারবেন না। হাইকোর্টের কেরানি ছিলাম। তখন টের পাই নি। ফুসফুসের ভেতর দিয়ে চলে গিয়েছিল। এপিঠ-ওপিঠ।বোকা ডাক্তার খামোকা কেটেকুটে গুলিটা খুঁজে খুঁজে হয়রান হয়েছে।
জমাট রক্তের মধ্যে ফুটো নজরেই পড়ে নি প্রথমে।
নেতা। তুমিও এই দলে এসে জুটেছো নাকি?
মূর্তি (২)। গুলি দিয়ে গেঁথে দিয়েছেন। ইচ্ছে করলেও আলগা হতে পারবো না।"""
—অত্যাচার আর নির্যাতন, শাসন আর শোষণই নিপীড়িত জনতাকে সঙ্ঘবদ্ধ করে, মূর্তি(২)-এর সংলাপে এ সত্যই প্রকাশিত। মুর্দা ফকিরের সংলাপেও রূপান্বিত হয়েছে প্রতিবাদী
জীবনচেতনা—'
"""বাসি মরার গন্ধ আমি চিনি না? এ লাশের গন্ধ অন্য রকম। ওষুধের,গ্যাসের, বারুদের গন্ধ। এ মুর্দা কবরে থাকবে না। বিশ-পঁচিশ-ত্রিশ হাত যত নিচেই মাটিচাপা দাও না কেন—এ মুর্দা থাকবে না। কবর ভেঙে বেরিয়ে চলে আসবে। উঠে আসবে"""""
মমতাজউদ্দীন আহমদের বিবাহ নাটকেও আছে ভাষা আন্দোলনের অবিনাশীআয়োজনের শব্দ-ছবি। সখিনা নামের এক নারীর বর শহীদ হয়েছে ভাষা আন্দোলনের
বায়ান্ন-উত্তর বাংলাদেশের ছড়া এবং সংগীতেও ভাষা আন্দোলনের প্রতিবাদী চেতনাপ্রতিফলিত হয়েছে। একুশে ফেব্রুয়ারি নিয়ে অনেক লেখক ছড়া লিখেছেন, একুশের ছড়ায়ভাষা-আন্দোলনের শহীদেরা, বাংলা ভাষা আর বাংলা বর্ণমালা নতুন ব্যঞ্জনায় রূপ পরিগ্রহকরেছে। প্রসঙ্গত উদ্ধৃত করা যায় আল মাহমুদের সেই বিখ্যাত ছড়া—
"""ফেব্রুয়ারির একুশ তারিখ
দুপুর বেলার অজ্ঞ
বৃষ্টি ঝরে, বৃষ্টি কোথায়
বরকতেরই রক্ত।
(আল মাহমুদ/‘একুশের ছড়া)""
একুশকে নিয়ে লেখা অনেক কবিতাই উত্তরকালে সংগীতের রূপ পরিগ্রহ করেছে।তাৎক্ষণিক আবেগে রচিত একুশের কবিতা গান হয়ে বাঙালির কণ্ঠে কণ্ঠে হয়েছে ধ্বনিতপ্রতিধ্বনিত। এ প্রসঙ্গেই স্মরণীয় আবদুল ফার চৌধুরীর বিখ্যাত রচনা ‘একুশে ফেব্রুয়ারি'
"""আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি
ছেলেহারা শত মায়ের অশ্রু-গড়া এ ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি
(আব্দুল গাফফার চৌধুরী /একুশে ফেব্রুয়ারী) """
অসীম সমুদ্রে ভাসমান দূরগামী জাহাজের নাবিকের কাছে বাতিঘরের আলোক-স্তম্ভেরমতো, ভাষা আন্দোলন বাঙালিকে প্রতিনিয়ত শোনাবে আশা আর আকাঙ্ক্ষা আর সাহসেরবাণী। ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে যেমন সাহিত্য রচিত হয়েছে, ভবিষ্যতেও তেমনিঅনেক সাহিত্যকর্ম নির্মিত হবে। ভাষা আন্দোলন তথা একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিকমাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পাবার ফলে দেখা দিয়েছে নতুন দাবি। এ দাবির ফলেকেবল বাঙালি সাহিত্যিক নয়, হয়তো অন্য ভাষার কোনো লেখকের সৃষ্টিতেও ভাষাআন্দোলন নতুন তাৎপর্যে অভিব্যঞ্জিত হয়ে উঠবে।।১৯৫২ সালে যে সব প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ কারণে ভাষা-আন্দোলন সংঘটিত হয়েছিল,সে-কারণগুলো এখনো দূরীভূত হয়নি। এ কারণেই ভাষা-আলোলন এখনো আমাদেরকাছে প্রতিদিন প্রাসঙ্গিক। নিয়ত এই প্রাসঙ্গিকতাই ভাষা-আলোপনের কালোত্তীর্ণতার প্রধানশক্তি-উৎস। আমাদের সৃষ্টিশীল সাহিত্যিকদের রচনাকর্মে ভাষা আন্দোলনের এই অবিনাশীপ্রাসঙ্গিকতা বহুমাত্রিক ব্যঞ্জনায় কুসুমিত হয়ে উঠুক, পুষ্পিত হোক ভাষা আন্দোলনেরপ্রতিবাদীচেতনা—এই-ই আগন্তুক কালের শিল্পীর কাছে আমাদের প্রত্যাশা।
তথ্যনির্দেশ
সাঈদ-উর রহমান পূর্ব বাংলার রাজনীতি-সংস্কৃতি ও কবিতা (ঢাকা: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়,
(১৯৮৩), পৃ. ২৮৬
রফিকুল ইসলাম, অমর একুশে ও শহীদ মিনার (ঢাকা: পরমা, ২০০০), পৃ. ৭০
আনিসুজ্জামান, “একুশে ফেব্রুয়ারি ও আমাদের সাংস্কৃতিক চেতনা", অমর একুশের প্রবন্ধ
(মুস্তাফা নূরউল ইসলাম ও অন্যান্য কর্তৃক সম্পাদিত, ঢাকা: বাংলা একাডেমী, ২০০০), পৃ.
২৫৮
পূর্বোক্ত, পৃ. ২৬০
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী “বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন", অমর একুশের
প্রবন্ধ, পূর্বোক্ত, পৃ. ২৪৮
2 মন্তব্যসমূহ
ভালো লিখেছিস।
উত্তরমুছুনধন্যবাদ🤎🤎
মুছুন