Hot Posts

6/recent/ticker-posts

বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস(প্রাচীন যুগ)**প্রশ্ন/উওর।


(((বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস
 চর্যাপদ 
চর্যাপদের রচনাকাল
চর্যাপদের ভাষা
বাংলা প্রাচীন সাহিত্য
বাংলা সাহিত্যের যুগ বিভাজন 
প্রাচীন সাহিত্য 
প্রাচীন যুগ)))
প্রশ্ন ১ঃ 

**বাংলা সাহিত্যের যুগবিভাগ সম্পর্কে ঐতিহাসিকগনের মতামত বিশ্লেষণ কর।

**বাংলা সাহিত্যের যুগবিভাজন বলতে কি বুঝ??আলোচনা কর।


উত্তর  : কাল মূলত নিরন্তর। বিশাল কালকে একসাথে পর্যালোচনা কষ্টসাধ্য।

ভাই বুঝবার এবং বোঝাবার সুবিধার্থে আমরা সময়কে খণ্ড করে নিই। ফলেরাজনৈতিক, সামাজিক ও সাহিত্যিক ইতিহাস পঠনপাঠনে যুগবিভাগ অপরিহার্য। বাংলাসাহিত্যের ইতিহাস আলোচনায় সাহিত্যের ঐতিহাসিক বিবর্তনের ধারা অনুসরণ করেএকে বিভিন্ন যুগে ভাগ করা হয়েছে।কিন্তু যুগের এই বিভাজনে যুগের লক্ষণ, কালসীমা, নামকরণ ইত্যাদি নিয়ে ঐতিহাসিকদেরমধ্যে মতবিরোধ রয়েছে। মূলত এই মতবিরোধের মূল কারণ তথ্য প্রমাণের অপ্রতুকেননা ইতিহাসবিমুখ বাঙালির অনেক তথ্যই অন্ধকারে ঢাকা। তবে এ কথা অনস্বীকার্য যে, সুদূর অতীত হতে বর্তমান পর্যন্ত বাংলা সাহিত্য নানা শাখা-প্রশাখায় পল্লবিত হয়েছে।বিচিএ বাক মোড় পালাবদল ঘটেছে। পরিবর্তন হয়েছে আঙ্গিক ও ভাবের।তবে বাংলা সাহিত্যের । প্রাচীনকাল থেকে বর্তমান সময়কে সকল গবেষকই তিনটি

প্রধান যুগে বিভক্ত করেছেন- প্রাচীন যুগ, মধ্যযুগ ও আধুনিক যুগ। তবে যুগের অভ্যন্তরীণ বিভাজন নিয়ে নানা মুনি নানা মত দিয়েছেন।।

বাংলা সাহিত্যের প্রথম সাহিত্যিক নিদর্শন চর্যাপদ। চর্যাপদের রচনাকাল থেকেই প্রাচীনযুগের শুরু। কিন্তু চর্যার রচনাকাল নিয়ে নানা মতবাদের কারণে প্রাচীন যুগের শুরু নিয়ে

পন্ডিতদের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে। কিন্তু সবাই এক বাক্যে স্বীকার করেছেন যে, প্রাচীনযুগের শেষ সীমানা ১২০০ খ্রিস্টাব্দ। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ চর্যাপদের রচনাকাল

৬৫০-১২০০ খ্রিস্টাব্দ বলে প্রমাণ করেছেন। ড. সুনীতিকুমার বলেছেন ৯৫০-১২০০ খ্রীস্টাব্দ। ফলে বাংলা সাহিত্যের শুরু নিয়ে মতান্তর রয়েছে।বাংলা সাহিত্যের যুগবিভাগ নিয়ে বিশিষ্ট গবেষকদের মতামত নিম্নে প্রদান করা হল  -----

পন্ডিতরামগতিন্যায়রত্ন ১৮৭৩ সালে তাঁর "বাঙালা ভাষা ও বাঙালা সাহিত্য বিষয়ক

প্রস্তাব" শস্থে যুগবিভাগ করেছেন নিম্নরূপ


ক. আদ্যকাল অর্থাৎ প্রাকচৈতন্য পর্ব (বিদ্যাপতি, চণ্ডীদাস, কৃত্তিবাস)।

খ.মধ্যকাল অর্থাৎ চৈতনা যুগ থেকে ভারতচন্দ্রের পূর্ব পর্যন্ত।

গ.ইদানীত্তন কাপ অর্থাৎ ভারতচন্দ্র থেকে বর্তমান পর্যন্ত।


প্রখ্যাত গবৈষক দীনেশচন্দ্র সেন তাঁর বঙ্গভাষা ও সাহিত্য (১৯৯৬) গ্রন্থেকালানুক্রমিক পদ্ধতি গ্রহণ করে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসকে পাঁচটি যুগে ভাগ করেছেন

ক. হিন্দু বৌদ্ধ যুগ (৮০০-১২০০ খ্রিঃ)।

খ.গৌড়ীয় যুগ বা চৈতন্য-পূর্ব যুগ (১২০১-১৫০০

গ.শ্রীচৈতন্য সাহিত্য বা বা নবদ্বীপের প্রথম যুগ (১৫০১-১৬০০ খ্রিঃ)।


ঘ.সংস্কার যুগ (১৬০১-১৭০০ঃ)।

ঙ. কৃষ্ণচন্দ্রীয় যুগ বা নবযুগের দ্বিতীয় যুগ (১৭০১-১৭৬০) 


 তিনি প্রাচীন ও মধ্যযুগকে বিভাজন করেছেন মাত্র। মূলত তিনি ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে যেবিভাগ করেছেন তা অবৈজ্ঞানিক।

সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় বাংলা সাহিত্যকে পাঁচটি যুগে বিভক্ত করেছেন


ক.প্রাচীন বা মুসলমান-পূর্ব যুগ (৯৫০-১২০০ খ্রঃ)।

খ. তুর্কি বিজয়ের যুগ (১২০১-১৩০০ খ্রিঃ)।

গ.আদি-মধ্য বা প্রাকচৈতন্য যুগ (১৩০১-১৫০০ খ্রিঃ)।

ঘ.অন্ত মধ্যযুগ-----

(1) চৈতন্য যুগ বা বৈষ্ণব সাহিত্য যুগ (১৫০১-১৭০০ খ্রঃ)।।

(11) নবাবী আমল (১৭০১-১৮০০ খ্রঃ)।

ঙ.আধুনিক বা ইংরেজি যুগ (১৮০১- বর্তমান পর্যন্ত)।


গোপাল হালদার মধ্যযুগকে তিন পর্বে ভাগ করেছেন—


ক. প্রাকচৈতন্য পর্ব (১২০০-১৫০০ খ্রিঃ)।

খ চৈতন্য পর্ব (১৫০১-১৭০০ খ্রঃ)।

গ. নবাবী আমল (১৭০১-১৮০০ খ্রিঃ)।


ড. অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় মধ্যযুগকে চারটি পর্বে ভাগ করেছেন—

ক. প্রথম পর্ব । প্রাকচৈতন্য যুগ (চতুর্দশ শতাব্দী)।

খ.দ্বিতীয় পর্ব : চৈতন্য যুগ (ষোড়শ শতাব্দী)।

গ. তৃতীয় পর্ব : চৈতনা-উত্তর যুগ (সপ্তদশ শতাব্দী)।

ঘ.চতুর্থ পর্ব : অষ্টাদশ শতাব্দী।


মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতে


ক. প্রাচীন যুগ (৬৫০-১২০০ খ্রিঃ)।

খ.মধ্যযুগ--

 (1) পাঠান আমল (১২০১-১৫৭৬ খ্রিঃ)।

(ii) মোগল আমল (১৫৭৭-১৮০০ খ্রঃ)।

ড. এনামুল হক মধ্যযুগকে তিন ভাগে ভাগ করেছেন


ক. তুর্কি যুগ (১২০০-১৩৫০ খ্রিঃ)।

খ.সুলতানী যুগ (১৩৫১-১৫৭৫ খ্রিঃ)।

গ.মোগলাই যুগ (১৫৭৬-১৭৫৭ খ্রিঃ)।


আহমদ শরীফের যুগবিভাগ—

ক. প্রাচীন যুগ (মৌর্য-গুপ্ত-পাল-সেন শাসনকাল)।

খ.আদি-মধ্যযুগ (তের-চৌদ্দ শতক) তুর্কি-আফগান মুঘল শাসনকাল।

গ্. মধ্যযুগ (পনের-আঠার শতক)।

ঘ আধুনিক যুগ- ব্রিটিশ শাসনকাল।

ঙ.বর্তমান কাল স্বাধীনতা-উত্তরকাল।


ড. ওয়াকিল আহমদের যুগবিভাগ—

ক. উন্মেষের যুগ (আট বার শতক) আদি

খ.শূন্যতার যুগ (তের-চৌদ্দ শতক) মধ্য মধ্যযুগ।

গ.মধ্যযুগ

ঘ.বিকাশের যুগ (পনের শতক) মধ্য মধ্যযুগ

ঙ.সমৃদ্ধির যুগ (ষোল-সতের শতক) মধ্য মধ্যযুগ

চ.অবক্ষয়ের যুগ (আঠার শতক) অন্ত্য-মধ্যযুগ।

উপর্যুক্ত বিভিন্ন পতিতের যুগবিভাগকে পর্যালোচনা করলে দাঁড়ায় যে, রামগতি ন্যায়রত্নেরযুগবিভাগ সীমাবদ্ধ। দীনেশচন্দ্র সেন কোন একটি স্থির মানদণ্ডের সাহায্যে যুগবিভাগকরেন নি, কখনো বা ধর্ম, কখনো বা শাসককে অবলম্বন করেছেন, এখানেই তাঁরযুগবিভাগের ত্রুটি। সুনীতি বাবুর যুগবিভাগে মুসলমান পূর্ব যুগ কথাটির সাথে তুর্কি।বিজয়ের যুগ সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। তাঁর 'নবাবী আমল' এবং ইংরেজি যুগা এভাবে বলাওমক্তিযুক্ত নয়। তাঁকে যে কোন এক পন্থা অবলম্বন করতে হত এক শাসকের নাম বললেঅন্য শাসকদেরও নাম বলতে হত। অথবা বৈষ্ণব সাহিত্য যুগ বললে চর্যাপদের যুগবলাই শ্রেয় ছিল। গোপাল হালদার, অসিতকুমার প্রমূখ যখন চৈতন্য যুগ বলেন তখন ঐসময়ের অন্য সাহিত্যের যেমন মঙ্গলকাব্যের অস্তিত্বকে ব্যাখ্যা করা যায় না, এটা বড়রকমের ত্রুটি।

বিভিন্ন পণ্ডিতের যুগবিভাগ থেকে দেখা যায় যে, প্রাচীন ও আধুনিক যুগ সম্পর্কে তেমন

মতভেদ না থাকলেও মধ্যযুগ সম্পর্কে নানা মুনির নানা মত। এসব মতপার্থক্য দূর করেকেউ কেউ মধ্যযুগকে আদি-মধ্যযুগ (১২০১-১৫০০ খ্রিঃ) এবং অন্ত্য-মধ্যযুগ (১৫০১-১৮০০ খ্রিঃ) এ দুই ভাগে ভাগ করেছেন।

উপর্যুক্ত সকল জটিলতা পরিহার করে ড. সুকুমার সেন বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসকে

কালানুক্রমিক ও বস্তুগতভাবে তুলে ধরে তিনটি ভাগে ভাগ করেছেন

ক. আদি পর্যায় প্রাক্‌-তুর্কি আগমন (১২০০ খ্রিঃ পর্যন্ত)।

খ.মধ্য পর্যায় : তুর্কি আগমনের পরবর্তী কাল (১২০১-১৮০০ খ্রিঃ)।

গ আধুনিক পর্যায় : ইংরেজ প্রভাবিত কাল (১৮০১-বর্তমান)।

মূলত সাহিত্যের যুগবিভাগে জাতিগত, ধর্মীয় বা শাসক সম্পর্কীয় নামকরণ যুক্তিসঙ্গতনয়। কেননা সাহিত্য কোন ব্যক্তি, ধর্ম বা শাসক প্রভাবিত নয়। সাহিত্য হচ্ছে সমাজপ্রভাবিত। তাই হিন্দু যুগ, মুসলিম যুগ, বৌদ্ধ যুগ বা পাঠান আমল, মোঘল আমল, বৌদ্ধআমল, সেন আমল, ইংরেজ আমল ইত্যাদি নামকরণ যুক্তিযুক্ত নয়। বাংলা সাহিত্যকেকালগত ও বিষয়গত বৈশিষ্ট্যের পরিপ্রেক্ষিতে প্রাচীন যুগ, মধ্যযুগ ও আধুনিক যুগ—এইতিন ভাগে ভাগ করা যুক্তিযুক্ত। যেহেতু প্রথমেই বলা হয়েছে বিশাল কালকে একই সাথেতুলে ধরা কষ্টসাধ্য, তাই মধ্যযুগকে আদি-মধ্যযুগ এবং অন্ত্য-মধ্যযুগ এ দু ভাগে ভাগকরা যেতে পারে। তাই আমার মতে, বাংলা সাহিত্যের পঠনপাঠনের সুবিধার্থে বাংলা

সাহিত্যের ইতিহাসকে চারটি যুগে ভাগ করা যুক্তিযুক্ত

১. প্রাচীন যুগ (৬৫০-১২০০ খ্রিঃ)।

২. আদি-মধ্যযুগ (১২০১-১৫০০ খ্রিঃ)।

৩. অন্ত্য-মধ্যযুগ (১৫০১-১৮০০ খ্রিঃ)।

৪. আধুনিক যুগ (১৮০১-বর্তমান পর্যন্ত)।


প্রশ্ন ২ঃ

***চর্যাপদ রচনার পটভূমি বিশ্লেষণ কর এবং বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসেচর্যাপদের স্থান নির্ণয় কর।

***প্রাচীন যুগের নিদর্শন এর পরিচয় দাও।

**যে বিশেষ ধর্মীয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পটভূমিতে বাংলা চর্যাপদ রচিত হয়েছিল, তা বিশ্লেষণ কর।

***কোন বিশেষ রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পটভূমিতে প্রাচীন যুগেরবাংলা সাহিত্যে চর্যাপদের সৃষ্টি হয়েছিল, তা সবিস্তার আলোচনা কর।


উত্তরঃ

 বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাসে চর্যাপদ এক মাইলস্টোন'। হয়তোপ্রাচীনতম এবং প্রথমতমও। সংগত কারণেই বলা যায় এখান থেকেই বাঙলা সাহিত্যেরবিভিন্ন দিক থেকে চর্যাপদের আবিষ্কার বাঙালির সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাসে একগুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। ভাষা বিচার, সাংস্কৃতিক পরিচয় প্রাচীনকালের বাঙালির জীবন ওসমাজ সমীক্ষা, তাদের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক শ্রেণীসংগ্রাম এবং ধর্ম দেশনায় চর্যাগানেরমূল্য বহুকৌণিক।বাঙলা ভাষা ও সাহিত্যের উদ্ভবের উৎস অনুসন্ধানে চর্যাপদের গুরুত্ব অপরিসীম। নব্যভারতীয় আর্যভাষাসমূহের বিবর্তন ধারায় বাঙলা ভাষা প্রাদেশিক ভাষানিচয়ের মধ্যেঅর্বাচীন নয়। তা এর নমুনা থেকেই বিশেষভাবে প্রমাণিত। সাড়ে ছেচল্লিশটি চর্যাগীতির

অবয়বে প্রাচীন বাঙলার শব্দ সম্পদ, ধ্বনিতত্ত্ব, রূপতত্ত্ব ও ব্যাকরণগত বৈশিষ্ট্যসমূহউত্তীর্ণ। বাঙলা কবিতার ছল, পরিভাষা, রূপক, রূপকল্পনা, বাক্যগঠন রীতি, বাগ বৈদগ্ধ,কাঠামো ও ভাবাকাশ পরিচিতির ক্ষেত্রেও চর্যাপদ বিশেষ মূল্যবান।প্রান্ত পুঁথি বাঙলা। তাই বাঙলা লিপির ইতিহাস নির্ণয়ে চর্যাপদ যথেষ্ট মূল্যবান। বাঙলাসংগীত রীতির ইতিহাসেও চর্যাগান অমূল্য সম্পদ—অনেক লুপ্ত ঐশ্বর্যের বার্তাবহ। বেশকিছু অজ্ঞাত তথ্যের পরিচিতির উৎস হিসেবে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে চর্যাপদ ভিত্তিহিসেবে বিশেষ মর্যাদার স্থানে অধিষ্ঠিত। চর্যায় বিধৃত বাঙালির জীবন ও প্রতিবেশ প্রাচীনযুগীয় বাঙালি সংস্কৃতির পরিচয় প্রদান করায় চর্যা প্রাচীন সমাজের সামাজিক, অর্থনৈতিকও রাজনৈতিক তথ্যের উৎস হিসেবে বিশেষ গুরুত্বের অধিকারী।

চর্যার কবিদের জীবনকাল ও পাল সাম্রাজ্যের বিভিন্ন শাসকের শাসনকাল মেলালে এটাস্পষ্ট হয় যে, চর্যাপদসমূহ মোটামুটি পাল সাম্রাজ্যের গৌরবময় কালে বিরচিত।আলোচ্য সময়ের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় অবস্থার অনুসন্ধান করলে দেখা যায়ধর্মপালের সময় পাল সাম্রাজ্যের রাষ্ট্রীয় চরিত্র প্রজাতান্ত্রিক ছিল। রাজার উপর মন্ত্রী, ব্রাহ্মণও ভিক্ষুদের প্রভাব ছিল অধিক। রাজ্যের সকল ভূমির একমাত্র মালিক ছিলেন রাজা।প্রজার অনুমতি সাপেক্ষে রাজা প্রজাদের মধ্যে জমি বণ্টন করতেন। পাল রাজারা সমগ্ররাজ্যটাকে বংশগত সম্পত্তি বলে ভাবতেন না। জনসাধারণ কর্তৃক মনোনীত রাজা ছিলেন।তাদের মতে রাজ্য প্রজাদের। সকল ধর্মাবলম্বীর জন্যই রাজা নির্দিষ্ট। কাজেই নিজের ধর্মনিজেরই। কিন্তু নানা কারণে এ আদর্শ ধীরে ধীরে বিনষ্ট হয়।

পাল আমলে সংস্কৃতের পাশাপাশি অন্যান্য ভাষায়ও সাহিত্য চর্চা বৃদ্ধি পায়। অন্য ভাষারমধ্যে 'বঙ্গ কামরূপী' ভাষা সাহিত্যিক ভাষায় পরিণত হয়। চর্যার কবিরা প্রাকৃত ও সংস্কৃতউভয় ভাষায় সাহিত্য চর্চা করেন। এ সময় তান্ত্রিক বজ্রযান বৈদিক ব্রাহ্মণ্য ধর্মের সাথেবৌদ্ধ ধর্মের নৈকট্য গড়ে ওঠে। রাজা ও সামন্ত অভিজাত পুরোহিত শ্রেণীর মধ্যে এ অন্বয়সাধিত হলেও প্রজাপুঞ্জের দরিদ্র শ্রেণীর মধ্যে এমনটি হয় নি। অর্থশালী অভিজাতবৌদ্ধেরা যত ব্রাহ্মণ্য ধর্মের নৈকট্য লাভের প্রয়াস পেয়েছে, দরিদ্র শ্রেণীর উপর,ক্ষেত্রকরগণের উপর শোষণের শেকল ততই দৃঢ় হয়ে চেপে বসেছে। সমাজে শ্রেণীদ্বন্দ্ব ওঅর্থনৈতিক শ্রেণীসংগ্রাম ততই তীব্রতা লাভ করেছে। ফলে, শোষিত সাধারণ মানুষ বেশিকরে তান্ত্রিক আচারের দিকে ঝুঁকেছে।সমাজতান্ত্রিকদের ধারণা-ঐ সময় তন্ত্রের মধ্য দিয়েই শোষিত বাঙলাদেশের জনগণঐক্যবদ্ধ হবার প্রয়াস পায়। এরূপে সমাজে অর্থনৈতিক শ্রেণীসংগ্রামের পাশাপাশি একটিধর্মীয় শ্রেণীসংগ্রামের ধারাও প্রবাহিত হয়। পাল রাজাদের বিপর্যয়কালে এ দ্বিতীয় ধারাপ্রথম প্রবাহকে আচ্ছন্ন করে সমগ্র বাঙলায় বিকৃত বজ্রযান ও তা থেকে উৎপন্ন সহজযানধর্ম ছড়িয়ে দেয়। চর্যাপদ এ ধরনের সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং ধর্মীয়আবহাওয়ায় রচিত। এ জন্য চর্যার অবয়বে সেকালের সামাজিক-অর্থনৈতিক বাতাবরণের

বিশেষ চিহ্ন বিদ্যমান।র্যাপদ মূলত ধর্ম সংগীতের আবরণে সামাজিক কবিতা। ধর্মই ছিল সেকালের মানুষেরপ্রধান সামাজিক চেতনা। শুধু চর্যার রচনাই নয় বরং তখন সমস্ত ঘটনার মূল হল ভূমিরউপর ব্যক্তিমালিকানার অভাব। রাজা বা সম্রাটই সমস্ত দেশের ভূমির একমাত্র মালিক।রাজা সে জমি ইজারা দিতেন, দেবতার নামে মঠ ও মন্দিরের জন্য, বিয়ের জন্য বা যজ্ঞ,পূজার্চনা প্রভৃতির দক্ষিণা স্বরূপ ব্রাহ্মণ পুরোহিতদের উপহার দিতেন। এর জন্য প্রজাদেরআপত্তি করার কিছু থাকত না। তাদের সম্মতি গ্রহণেরও কিছু আবশ্যক হত না।

ভূমির উপর কার্যত প্রজাদের এ অনধিকার থেকে সমগ্র প্রাচ্য দেশীয় জনগণের যে দুঃখ তাথেকে চর্যার কবিরা মুক্ত ছিলেন না। এ অনুভূতি থেকেই তাদের মধ্যে জন্ম হয়েছিল ধর্মসংগীতের। চর্যার কবিরা তাই ধর্মসংগীত রচনায় আত্মনিয়োগ করতে গিয়ে নিজেদেরসামাজিক জীবনের দুঃখকে উপেক্ষা করতে পারেন নি। কারণ, তারা ভূমিহীন বিক্ষুব্ধ কৃষকসমাজের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে অবস্থান করতেন। তাদের সুখ-দুঃখ, আশা-আকাঙ্ক্ষা ওদ্বন্দ্ব-সংঘাতের সাথে কবিদের একান্ত পরিচয় ছিল। পাল আমলের আদি মধ্য ভাগ থেকেঅর্থনৈতিক শ্রেণীসংঘর্যের পাশাপাশি যে ধর্মীয় কলহ শুরু হয় চর্যার কবিরা সে কলহে

সামস্ত পুরোহিত শ্রেণীর বিপরীতে অন্ত্যজ শ্রেণীর প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন। চর্যাপদে তাইসামন্তদের প্রতি ও তাদের ধর্মের প্রতি প্রবল ঘৃণা বিদ্যমান। চর্যায় রাজা, উজির, ব্রাহ্মণ,পুরোহিতদের প্রতি অবজ্ঞা সীমাহীন। বেদ, ব্রাহ্মণ ও তাদের উপাস্য দেবতা থেকে মুখফিরিয়ে চর্দার কবিরা সহজ সাধনা, সাম্য ও প্রীতির ধর্ম প্রচার করেছেন।পাল রাজাদের বিকৃত রূপের ফলশ্রুতিতে উচ্চবিত্তদের প্রাপ্ত সুযোগ সুবিধা প্রকারান্তরেনিম্নবিত্তের জন্য দুঃসহ অবস্থার সৃষ্টি করে, তা থেকে নব ধর্মীয় চেতনা ওজীবনাচরণের পটভূমিতে চর্যার কবিরা বলিষ্ঠ সমাজচেতনা ও বিস্ময়কর বাস্তববোধ থেকেচর্যার সৃষ্টি করে। চর্যার পটভূমিতে এ শ্রেণীরদ্ ও দ্বন্দ্ব সংঘাড় অনুভূতিই উচ্চারিত হয়েছে।


প্রশ্ন ৩ঃ

****বিভিন্ন পণ্ডিতের মতামত আলোচনা করে চর্যাপদের রচনাকাল নির্ণয় কর।

****অথব চর্যার রচনাকাল নির্ণয় কর।

অথবা,

 ***সাহিত্যের প্রাচীন যুগের সময়সীমা নির্ধারণ কর।


উত্তর-----

 বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস হাজার বছরের অধিক সময়ের পুরাতন বলে মনেকরা হয়। তবে এ সাহিত্যের অতীত ইতিহাস সম্পর্কে যথেষ্ট তথ্যের অভাবে বাংলা ভাষার

উদ্ভবকাল সম্পর্কে সুস্পষ্ট করে কিছু বলা যায় না বলে এ ব্যাপারে নানা মুণি নানাভাবেবলেছেন। বাংলা ভাষা পূর্ববর্তী রূপ অপভ্রংশ থেকে কোন মুহূর্তে স্ব-পরিচয়ে চিহ্নিতহয়েছে তা বিতর্কমূলক হলেও সবাই চর্যাপদকে বাংলা সাহিত্যের আদি গ্রন্থ হিসেবেস্বীকার করেছেন। তাই বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস ও চর্যাপদের রচনাকাল সমান্তরালড. সুনীতিকুমার ঠাপাধ্যায় চর্যার রচনাকাল দশম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যে সীমাবদ্ধবলে মনে করেন। এ মত কলকাতার সকল পণ্ডিতই বিনা দ্বিধায় মেনে নিয়েছেন। কিন্তুকলকাতার বাইরে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এবং রাহুল সাংকৃত্যায়ণ প্রমাণ করেছেন- লুইপাদএবং সরহপাদ এ দুজন প্রাচীন সিদ্ধাচার্য রাজা ধর্মপালের সময়ে (৭৬৯ খ্রি. – ৮০৯ খ্রি.)বর্তমান ছিলেন। তাই ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ চর্যাপদের রচনাকাল সপ্তম শতাব্দীর মধ্যভাগথেকে দ্বাদশ শতাব্দী মনে করেন।মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী লুইপাকে আদি সিদ্ধাচার্য মনে করেন। তিনি লুইপারসময়কাল নির্দেশ করেছেন ৯৫০ থেকে ১০৫০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। তাঁর মতে লুইপার একখানাগ্রন্থ 'অভিসমর বিভঙ্গা' রচনাকালে দীপংকর শ্রীঘ্রান লুই পারে সাহায্য করেছিলেন।অতএব লুই পা এবং দীপংকর সমসাময়িক ছিলেন। ১০৩৮ খ্রিস্টাব্দে ৫৮ বছর বয়সেদীপংকর তিব্বত গিয়েছিলেন তার ঐতিহাসিক প্রমাণ মেলে। এই হিসেবে দীপংকরের জন্ম

৯৮০ খ্রিস্টাব্দে। অর্থাৎ লুই পার জন্মও এ সময়ে।ভাষা ও বচয়িতাদের সম্ভাব্য আবির্ভাবকাল ধরে চর্যাসমূহের রচনাকাল নির্ধারণের চেষ্টাহয়েছে। ভাষার কথা বলতে গিয়ে ড. সুনীতিকুমার মত দিয়েছেন যে, চর্যার ভাষায় দ্বাদশশতকের প্রোচীন বাংলার রূপ বর্তমান। তিনি শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের ভাষায় আদি মধ্য বাংলার যেরূপটি প্রত্যক্ষ করেছেন, চর্যার ভাষাকে তদপেক্ষা দেড় বা দুশো বছরের প্রাচীন হতে পারেবলে মনে করেন। শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের ভাষাকে চতুর্দশ শতাব্দীর ধরে নিয়ে চর্যার ভাষাকেদ্বাদশ শতাব্দীর বলে মনে করেন। অবশ্য সবকটা চর্যাই দ্বাদশ শতাব্দীতে রচিত এ কথাতিনি বলেন নি। প্রাচীন চর্যাগুলোর রচনাকাল দশম শতাব্দীর দিকে বলে তিনি স্বীকারকরেনতিনি আরো বলেন "হবজ্র পঞ্জিকা যোগ রত্নমালা' নামে যে পুঁথি তাঁর হাতে এসেছে তাগোবিন্দের রাজত্বকালে ৩৯ অব্দে (১১১৯) মগধে লেখা হয়েছিল। পুঁথিখানি মগধ থেকেনেপালে যায় এবং নেপাল থেকে সংগৃহীত হয়ে কেম্ব্রিজে আসে। সুতরাং সিদ্ধাচার্য কাহ্নপাদদ্বাদশ শতকের শেষ দিকে বর্তমান ছিলেন। ড. সুনীতিকুমার লুইপাদকে দশম শতাব্দীর

বলে মনে করেন।

ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ মনে করেন, বাংলা সাহিত্যের উৎপত্তিকাল সপ্তম শতক এবং বাংলাভাষা অন্তত আরো একশত বছর পূর্বের। তিনি সামেন্দ্রনাথকে প্রথম বাঙালি কবি বলে মনেকরেন এবং প্রমাণ করেন যে, সামেন্দ্রনাথ সপ্তম শতকে জীবিত ছিলেন। তিনি বলেন ফরাসী কবি সিলভালেভার মতে সামেন্দ্রনাথ ৬৫৭ খ্রিস্টাব্দে রাজা নরেন্দ্র দেবের রাজত্বকালেনেপালে গমন করেন। এ থেকে আমরা ৬৫০ খ্রিস্টাব্দকে বাংলা সাহিত্যের আরম্ভকাল বলে

ধরতে পারি।চর্যাপদ যে সপ্তম শতকের দিকে রচিত এর যুক্তিস্বরূপ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন, ৮নং

চর্যাগীতির রচয়িতা কম্বলাম্বর ইন্দ্রভূতি ও জালন্ধরী শুরু ছিলেন। বজ্রযোগীনি শুরু পরম্পরারমতে ইন্দ্রভূতির শুরু কুক্কুরী পা, তার গুরু লুই পা। জার্মান পণ্ডিত Schlaginfweil-এরমতে ইদ্রভৃতির পালিত পুত্র পদ্মসম্বর ৭২১-৭২২ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। পদ্মসম্বরের শুরু

গোরক্ষনাথ, গোরক্ষনাথের শুরু সামেন্দ্রনাথ। গোরক্ষনাথের সমকালীন জালস্কপার শিষ্যছিলেন কাহ্নপা। এ সমস্ত তথ্য থেকে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ প্রমাণ করেছেন সামেন্দ্রনাথ,গোরক্ষনাথ, গোপিচাদ, লুইপা, কম্বলাম্বরপা, কুক্কুরীপা, জালন্ধরীপা সপ্তম শতকের

দ্বিতীয়ার্ধের লোক ছিল।

ড. সুনীতিকুমারের মতে মীননাথের শিষ্য গোরক্ষনাথ দ্বাদশ শতকের লোক। অতএবমীননাথও দ্বাদশ শতকের লোক হবেন। অধ্যাপক নলিনীনাথ দাশগুপ্ত সামেন্দ্রনাথকে দশমশতাব্দীর শেষার্ধের লোক মনে করেন।কিন্তু ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ নাথ গীতিকার গোপীনাথ এবং চর্যাপদের লুইপাদের সময়কাল

আলোচনা করে দেখিয়েছেন যে, সামেন্দ্রনাথের সময়কাল সপ্তম শতকের পরে হতে পারে।না। সুতরাং ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মত অনুসরণে আমরা বলতে পারি যে, চর্যাপদ শুরুসপ্তম শতকের মধ্যভাগ থেকে। অর্থাৎ চর্যাপদের রচনাকাল ৬৫০ থেকে ১২০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত।।। 


প্রশ্ন ৪ঃ

**-“চর্যাপদের ভাষা বাংলা "—এই উক্তি কতদূর সত্য আলোচনা কর।

***“চর্যার ভাষা বাংলা ভাষার প্রাচীনতম নিদর্শন।" — এই মন্তব্যের পক্ষে ওবিপক্ষে যেসব ভাষাতাত্ত্বিক যুক্তি আছে সেসব আলোচনা করে তোমারমতামত ব্যক্ত কর।


***চর্যাপদগুলোর ভাষা যে বাংলা তা ভাষাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণের সাহায্যে প্রমাণ কর।

***চর্যাপদের ভাষা যে বাংলা, এ সম্পর্কে পণ্ডিতগণের মতামত আলোচনা কর।

**-*'চর্যাপদের ভাষা' শীর্ষক একটি নিবন্ধ রচনা কর।


***"চর্যাপদের মধ্যে এমন কতকগুলো বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায় যার দ্বারা বুঝাযায় এগুলি বাংলা ভাষারই প্রাচীনতম নিদর্শন।" আলোচনা কর।

***চর্যাপদের ভাষা কি বাংলা? আলোচনা কর।

****ব্যাকরণগত বৈশিষ্ট্য আলোচনা করে প্রমাণ কর যে, চর্যাপদের ভাষাবাংলা।


উত্তরঃ---


বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাসে চর্যাপদ একটি মাইলস্টোন। হয়তোপ্রাচীনতম ও প্রথমও। এখান থেকেই বাংলা সাহিত্যের শুরু।চর্যার প্রাপ্ত পুঁথির লিপি বাঙলা। নব্য ভারতীয় আর্য ভাষাসমূহের বিবর্তন ধারায় বাংলাপ্রাদেশিক ভাষানিচয়ের মধ্যে অর্বাচীন নয়।পাঞ্জাবের মহারাজা রণজিৎ সিংহের পুরোহিত পুত্র রাধাকিষণ ১৮৬৮ খ্রিস্টাব্দে ভারতেরসকল ভাষার পুঁথি সংরক্ষণের জন্য লর্ড লরেন্সকে অনুরোধ জানায়। লরেন্স প্রাদেশিকগভর্নরদের সাথে পরামর্শ করে পুঁথি সংগ্রহের ব্যবস্থা করেন। বংগীয় এশিয়াটিক সোসাইটি

ড. রাজেন্দ্রলাল মিত্রের সাহায্যে পুঁথি সংগ্রহের কাজ শুরু করে। তাঁর মৃত্যুতে ১৮৯১-এমহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর উপর এ কাজের ভার পড়ে। তিনি বেশ কিছু পুঁথিআবিষ্কার করেন, যেমন ধর্মমঙ্গল, শূন্যপুরাণ

বংগীয় এশিয়াটিক সোসাইটি প্রদত্ত দায়িত্ব পেয়ে মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রীধর্মমঙ্গল, শূন্যপুরাণের মত কিছু পুঁথি সংগ্রহ করেন। বৌদ্ধ ধর্ম ও বাঙলার বৌদ্ধ সাহিত্যসম্পর্কে তার জানার আগ্রহের কারণে তিনি নেপাল যান ১৮৯৭ ও ১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দে।ডাকার্নব সুভাষিত সংগ্রহ দোহাকোষ পঞ্জিকা ইত্যাদি নকল তিনি নেপাল থেকে সংগ্রহকরেন। ১৯০৭ সালে আবার নেপাল যান। সেখানে 'চর্য্যাচর্যবিনিশ্চয়' দোহাকোষ

ইত্যাদির নকল নিয়ে আসেন।১৯১৬ সালে তাঁরই সম্পাদনায় “হাজার বছরের পুরাণ বাঙ্গালা ভাষায় বৌদ্ধ গান ওদোহা" নামে গ্রন্থ বের করেন। এ গ্রন্থের অন্তর্গত সকল গ্রন্থেরই ভাষা বাঙলা নয়, একমাত্রচর্যাপদ-এর ভাষা বাংলা। চর্যাপদ আবিষ্কারের পর পণ্ডিতদের মধ্যে এর ভাষা নিয়ে বিতর্কদেখা দেয়। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী সংকলিত চারটি গ্রন্থই হাজার বছরের পুরাণ বাংলায় রচিতবলে অভিমত দেন। তিনি ভাষাতাত্ত্বিক নন, ভাষাবিদদের দৃষ্টিতেও তিনি সংকলনটি বিচারকরেন নি। তবে মুহম্মদ শহীদুল্লাহ Outlines of An Historical Grammar of the

Bengali Language শীর্ষক বক্তৃতায় বাংলা ভাষার আমি, তুমি, তুই, আপনি, কাণ্ডারি,কেডুয়াল ও করিস শব্দসমূহের প্রাচীন রূপ চর্যায় প্রদর্শন করেন। বাংলা সাহিত্যে এসবশব্দের ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতাও দেখানো হয়, তবে বিজয়চন্দ্র মজুমদার চর্যার ভাষাকেখিচুড়ি ভাষার সমষ্টি বলে মত প্রকাশ করেন। তবে সেখানে হিন্দির প্রাধান্য বেশি বলেতিনি মনে করেন। ১৯২৬ সালে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় তার 'বাঙলা ভাষার উৎপত্তি ওবিকাশ' বিষয়ক গবেষণা গ্রন্থে চর্যাপদ বাংলা ভাষায় রচিত বলে প্রমাণ দেন। অতঃপর

ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ চর্যার ভাষা সম্পর্কে স্বমত ব্যক্ত করেন।হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর বিশ্বাস যাঁরা এ পদগুলো লিখেছেন তারা বাঙালি। যদিও অনেকের ভাষারএকটু একটু প্রভেদ আছে, তবুও চর্যাপদ বাঙলা ভাষায় রচিত। মূলত ব্যাকরণে তাঁর এমনবুৎপত্তি ছিল না, ফলে বিভিন্ন ভাষার রচয়িতার স্থান ও কিছু সংখ্যক শব্দ দেখে কোনরচনার জাত নির্ণয় সঠিক হয় না। বিজয়চন্দ্র মজুমদার বলেছেন- চর্যার ভাষার সাথেউড়িয়া ও মৈথিলা ভাষার মিশ্রণ লক্ষণীয় ১ নং চর্যায় বি, পইঠো- হিন্দি শব্দ। হাঁড়িতেভাত নাই- এই খাঁটি বাংলা বাক্যটি উড়ি বা হিন্দি বাক্যের অন্তর্গত। 'দুহিল দুধকথাটি হয় উড়িয়া বা বিহারী, কইসে/কইসন, জইসা, তইসে প্রভৃতি উড়িয়া, জহি তাহ,এঠু প্রভৃতি উড়িয়া ভাষারই রূপ। বিজয় মজুমদার এমনি কিছু শব্দ ধরে দেখিয়েছেন, চর্যারউপর হিন্দি ও উড়িয়া ভাষার প্রভাব বেশি।

বিজয়চন্দ্র ভাষার ব্যাকরণ না ধরে বিচ্ছিন্ন শব্দ ধরে প্রমাণে অগ্রসর হয়েছেন। নব্যভারতীয় আর্য ভাষার প্রথম স্তরের অন্তর্গত উপভাষাসমূহের রূপ মোটামুটি এক ছিল। একেঅপভ্রংশ স্তর বলা হয়। বাংলা, আসামি, উড়িয়া, মগধী, মৈথিলী ভোজপুরিয়া- এ স্তরেরঅন্তর্ভূক্ত। ফলে শুধু শব্দ নিয়ে প্রথম স্তরের যে কোন ভাষাকে অন্য ভাষা বলে দেখানোসহজ। শুধুমাত্র দু'চারটে শব্দ ধরেই হিন্দি, উড়িয়া বলা যাবে না। কারণ এদের মূল

যেহেতু সংস্কৃত, ফলে এসব শব্দের বাংলায় প্রবেশ করাও অসম্ভব নয়। ফলে বিজয়চন্দ্রমজুমদারের সিদ্ধান্ত অযৌক্তিক।সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় চর্যার ভাষা নিয়ে বাঙলা ভাষার উৎপত্তি ও বিকাশ বিষয়কগবেষণা গ্রন্থে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। তাঁর মতে চর্যাপদের ভাষা প্রাচীন বাংলা।

চর্যার ভাষার মধ্যে বাংলার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয়

যেমন---

সম্বন্ধ পদে এর, অর, সম্প্রদান কারকে রে, অধিকরণে তে, অতীত এবং ভবিষ্যৎ কালের হল

বা ইব, অল এবং অব বিহারী রূপ নয়, বর্তমানে ক্রিয়া নির্দেশক অন্ত, সংযোজক অব্যয়ে

ইঅ, শর্তযুক্ত সংযোজক অব্যয়ে ইলে, অকর্মক ধাতুতে ইঅ-মধ্যযুগের বাংলাতেও যার

অবশেষ বিদ্যমান। বিশেষ্যবাচক ধাতুরূপে আছ এবং থাক, মৈথিলীর থিক বা উড়িয়ার থানয়, আরও বহু সংখ্যক বাংলা প্রবচন। চর্যাপদের ভাষার ভিত্তি মূল বাংলাদেশেরই নিজস্বভাষায় ।

চর্যার ভাষা নব্য ভারতীয় স্তরের। শব্দরূপ নব্য ভারতীয় আর্য ভাষান্তর অপেক্ষা মধ্য

ভারতীয় আর্য ভাষাত্তরের বেশি নিকটবর্তী, যদিও নব্য ভারতীয় আর্য ভাষার পূর্ববর্তীঅবস্থার সাক্ষাৎ চর্যাপদে পাওয়া যায়তবে তিনি বলেছেন চর্যার ভাষার উপর শৌরসেনী অপভ্রংশের সামান্য প্রভাব আছে। তবেতিনি দৃঢ়তার সাথে চর্যাপদকে বাংলা ভাষায় রচিত বলে নির্দেশ করেছেন। ১৯২০ সালে ড.মুহম্মদ শহীদুল্লাহ চর্যাপদ বাংলা ভাষায় রচিত বলে অভিমত দেন। কিন্তু বিজয়চন্দ্রমজুমদার ও সুনীতিকুমারের আলোচনা প্রকাশিত হলে বাংলার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের অধিবাসীচর্যাপদকে তাদের স্ব স্ব ভাষায় রচিত বলে দাবি করেন।

ড. সুকুমার সেন বলেছেন, “সুর্নীতি বাবুর ইঙ্গিত বুঝিতে না পারিয়া এবং নিজ নিজপ্রাদেশিক ভাষায় গৌরব বাড়াইতে গিয়া বাংলার প্রতিবেশীরা এখন চর্যাগীতি লইয়ারীতিমত মামলা বাধাইয়াছেন। হিন্দি ভাষী, মৈথিলী ভাষী, উড়িয়া ভাষী, আসামি ভাষী,চর্যাপদ তাদের নিজ নিজ ভাষায় রচিত বলে দাবি করছে।"ফলে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ চর্যার ভাষাবিষয়ক বিতর্ককে সাতটি শ্রেণীতে সজ্জিত করে

বিচার করেছেন।

১. চর্যার ভাষা কি খিচুড়ি ভাষা : মূলত সাতচল্লিশটি বৌদ্ধ গান বাইশ জন কবির রচনা।মধ্যে সময় ও স্থানের ব্যবধান রয়েছে। সুতরাং সকলের ভাষা যে এক রকম নয়সেটাই স্বাভাবিক। তবে এটা ঠিক যে, তাদের যে ভেদাভেদ তা প্রাচ্য ভারতীয় আর্যভাষাগোষ্ঠির নব্য ভারতীয় আর্য ভাষাভেদ। এ বিষয়েএদের ভাষার ঐক্য আছে। ফলেচর্যার ভাষা খিচুড়ি নয়। তাঁর মতে চর্যার ভাষা না বলে লুইপাদের ভাষা বা কাহ্নপার ভাষা


২. চর্যার ভাষা কি অপভ্রংশ চর্যার ভাষা অপভ্রংশ নয়, নব্য ভারতীয় আর্য ভাষার পূর্ববর্তীস্তর অপভ্রংশ। অপভ্রংশ স্তরে যুগ্ম ব্যঞ্জন নব্য ভারতীয় স্তরে একক ব্যঞ্জনে পরিণত হয়এবং সাধারণত পূর্ব স্বর দীর্ঘ হয়। যেমন- পাস, রাতি, বাকল, দাহিন, ছাড়অ, বাট প্রভৃতিশব্দের অপভ্রংশ রূপ যথাক্রমে পাস, রতি, বককল, দকখিন, ছড়ই, বটুট প্রভৃতি। চর্যায়একশ যুগ্ম বাজনে শব্দের প্রয়োগ নেই। তবে প্রাচীনত্বের কারণে, ভাষায় অপভ্রংশেরবিভক্তি সপ্তমীতে হি হি প্রভৃতি রক্ষিত। ফলে চর্যার ভাষা অপভ্রংশ নয়।

৩. চর্যার ভাষা কি হিন্দি হিন্দি (উর্দু), রাজস্থানী প্রভৃতি ভাষা নব্য ভারতীয় আর্য ভাষার

হবাগোষ্ঠির অন্তর্গত। মগধী (বিহারী) উড়িয়া, বাংলা ও আসামি প্রাচ্যগোষ্ঠির অন্তর্গত।প্রাচাগোষ্ঠির বিশিষ্ট লক্ষণ অতীতে 'ল', ভবিষ্যতে ‘ব', কর্তায় ও অধিকরণে এ বিভক্তি,বর্তমানকালে প্রথম পুরুষের বহুবচনে অস্থি (মাগধীতে অথি) প্রভৃতি। চর্যাপদের ভাষায়

প্রাচ্যগোষ্ঠির সকল বিশিষ্ট লক্ষণ থাকায় তা হিন্দিতে রচিত বলা যায় না।


৪. চর্যার ভাষা কি মৈথিলী : মৈথিলী ভাষার বিশিষ্ট লক্ষণ অতীতকালে 'অল' (অন্যসহোদরা ভাষায় ইল), ভবিষ্যতে অব' (অন্য সহোদরা ভাষায় ইব), বর্তমানকালের প্রথমপুরুষে 'অথি' (অন্য সহোদরা ভাষায় অন্তি) প্রভৃতি চর্যার কবিদের মধ্যে শাস্তিপাদেরভাষায় মৈথিলী ভাষার লক্ষণ আছে, অন্য কবিদের পদে মৈথিলীর লক্ষণ নেই। ফলেশান্তিপাদ ব্যতীত অন্যদের ভাষা মৈথিলী নয়।

৫. চর্যার ভাষা কি উড়িয়া? : উড়িয়া ভাষার বিশেষ লক্ষণ হচ্ছে অধিকরণে 'রে, আছ'

ধাতুর অতীতকালে 'থিল' প্রভৃতি। আর্য দেবের ভাষা ব্যতীত অন্য কারও ভাষা উড়িয়া

ভাষায় হতে পারে না।

৬. চর্যার ভাষা কি আসামি : আসামির বিশিষ্ট লক্ষণ বহুবচনের বিভক্তি বোর, ইত, বিলাক

প্রভৃতি। তাছাড়া কর্মে 'ক', অধিকরণে 'ত' প্রভৃতি প্রাচীন বাংলা ও আসামির সাধারণ

লক্ষণ। চর্যার কোন কবির ভাষায় আসামির সাধারণ লক্ষণ দেখা যায় না। ফলে চর্যার

ভাষা আসামি নয়।

৭. চর্যার ভাষা কি বাংলা বাংলা ভাষার বিশিষ্ট লক্ষণ বহুবচনে রা বিভক্তি, ক্রিয়াপদে

অতীতকালে ইল প্রত্যয়, অধিকরণে এ বিভক্তি, করণে ও কর্তৃকারকে এ বিভক্তি এবংপ্রাচীন বাংলার রূপ লো অ ক্ষুদ্রত্ববাচক 'উলী' প্রত্যয়। বাস্তবিক চর্যার পদকর্তাদেরঅধিকাংশের অধিকাংশ পদই বাংলা ব্যাকরণসম্মত। এমনকি আর্যদেবের ভাষায়ও বাংলারপ্রভাব বেশি। তাঁর পদও বাংলা ভাষায় রচিত বলে বলা যায়।বাংলা কথাকে সাহিত্যিক রূপদানের আদি প্রয়াস আমরা চর্যায় পাই। তবে বাংলা

একেবারেই তার নিজস্বতা নিয়ে চর্যায় আসতে পায়নি। কারণ, বাংলার চেয়ে অধিকতরসমর্থ ও প্রতিষ্ঠিত পূর্ববর্তী ও সমকালীন ভাষার প্রভাব এ ভাষার অবয়বে প্রভাব বিস্তারকরেছে। সরুল বাংলা ভাষাভাষী পদকর্তাদের সামনে সমৃদ্ধিশালী সংস্কৃত, নানাবিধসাহিত্যিক প্রাকৃত, আর শৌরসেনী অপভ্রংশ ছিল। এদের মধ্যে গঠন, প্রতিপত্তিতেশৌরসেনী অত্যন্ত বর্ধিত সাহিত্যের ভাষা'। স্বাভাবিকভাবে সে ভাষা প্রাচীন বাঙলারউপর প্রভাব বিস্তার করে। কিন্তু সেটি বাংলাই, বিভিন্ন ভাষায় অপছায়া জড়িত কোন কৃত্রিমভাষা নয়। কারণ চর্যার ভাষার ব্যাকরণে এমন কিছু নেই যা মধ্যযুগ ও আধুনিক যুগেরবাংলা ব্যাকরণের সাহায্যে ব্যাখ্যা করা যায় না।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ