Hot Posts

6/recent/ticker-posts

মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক বাংলা ছোটগল্প /বাংলা ছোটগল্প


(মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক বাংলা ছোটগল্প 
বাংলা ছোটগল্প 
বাংলা ছোট গল্পের উদ্ভব ক্রমবিকাশ 
বাংলা ছোটগল্পের ইতিহাস 
বাংলা ছোট গল্পের বৈশিষ্ট্য) 

**বিঃদ্র-বাংলা বিভাগের সকল পড়াশোনা পেতে ব্লগটিতে যুক্তথাকুন https://monoweredu13.blogspot.com/

মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক বাংলা ছোটগল্প /বাংলা ছোটগল্প ---

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক সংগঠনে সূচিত হলো।মৌল পরিবর্তন, চেতনার ক্ষেত্রেও ঘটলো গুণগত বিকাশ।সমাজজীবনের অন্তর্গঠনের রূপপরিবর্তন অভ্যন্তর নিয়মেই রূপান্তরিত করে সমাজের বহির্গঠন তথা চৈতন্যপ্রবাহ। এজন্যেই মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত একটি দেশের স্বাধীনতা সমগ্র জাতিকে রূপান্তরিত সভায়করে পুনর্জাত। স্বাধীনতার সোনালি প্রভায় আমাদের মন আর মননে যে নতুন চেতনা জাগ্রতহয়েছে, ছোটগল্পে তার প্রতিফলন ছিল একান্তই প্রত্যাশিত। কিন্তু আমাদের অধিকাংশছোটগাণিক যুদ্ধোত্তর জাতীয় হতাশা এবং অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের শব্দচিত্র অঙ্কনেই হলেনঅধিক আগ্রহী; দ্রোহ-বিদ্রোহ-প্রতিবাদে উচ্চকিত হবার পরিবর্তে অনেকেই যেতে চাইলেননির্বেদ-নিরানন্দের অতল গহ্বরে; এবং সবাই মিলে সম্মিলিত সাধনায় লিখলেন মাত্র একটিছোটগল্প, যার মৌল বিষয় নাস্তি—নিখিল নাস্তি। তবে একই সঙ্গে এ কথা অনস্বীকার্য যে,স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের ছোটগল্পে জড়িয়ে আছে সংগ্রাম ও বিজয়ের বিমিশ্র অভিব্যক্তি,যা একান্তই আমাদের মুক্তিযুদ্ধের উত্তরাধিকার। মুক্তিযুদ্ধোত্তর ছোটগল্পসাহিত্যের আশাব্যঞ্জক দিক। স্বাধীনতা-উত্তরকালে যে-সব গল্পকার

বাংলাদেশের সাহিত্যে আবির্ভূত হন, তাঁরা হচ্ছেন মালিহা খাতুন (১৯২৮), হেলেনা

(১৯২৯), কাজী ফজলুর রহমান (১৯৩১-), আবুবকর সিদ্দিক (১৯৩৪–), আবুল

পায়ের মুসলেহউদ্দীন (১৯৩৪), রাবেয়া খাতুন (১৯৩৫-), রাবেয়া সিরাজ (১৯৩৫-)

খালেদা সালাউদ্দিন (১৯৩৫), মকবুলা মনজুর (১৯৩৮), আল মাহমুদ (১৯৩৮),

খালেদা এদিব চৌধুরী (১৯৩৯-২০০৮), নাজমা জেসমীন চৌধুরী (১৯৪০-১৯৮৯), নয়ন

বহমান (১৯৪০), জুবাইদা গুলশান আরা (১৯৪২-), আমজাদ হোসেন (১৯৪২), আবু

কায়সার (১৯৪৫-), হুমায়ুন আহমেদ (১৯৪৮-), আবুল হাসান (১৯৪৭-১৯৭৫), শহিদুর

বৃহমান, জুলফিকার মতিন, আরেফিন বাদল, বুলবুল চৌধুরী, শান্তনু কায়সার, আফসান

চৌধুরী, তাপস মজুমদার, সৈয়দ ইকবাল, ইমদাদুল হক মিলন, আতা সরকার, আবু সাঈদ

জুবেরী, মঞ্জু সরকার, হরিপদ দত্ত, শহীদুল জহির, মামুন হুসাইন আহমদ বশীর, মুস্তাফা

পদ্মা, সিরাজুল ইসলাম, জাফর ভালুকদার, সেলিম রেজা, কাজী শামীম, মঈনুল আহসান

সাবের, ইসহাক খান, হসান চৌধুরী, সাইয়িদ মনোয়ার, ইমরান নূর, সারোয়ার কবীর,

রেজোয়ান সিদ্দিকী, সুশান্ত মজুমদার, সুকান্ত চট্টোপাধ্যায়, হারুন হাবীব, ভাস্কর চৌধুরী,

বিপ্লব দাশ, ইসমাইল হোসেন, শাহনাজ মুন্নী, মহীবুল আজিজ, নকীব ফিরোজ, রায়হান

রাইন, মনি হায়দার, লুৎফর রহমান রিটন প্রমুখ শিল্পী।


স্বাধীনতা-উত্তরকালে মুক্তিযুদ্ধের অনুষঙ্গ ও উপাদানগুঞ্জ ব্যবহার করে ছোটগল্প রচনায়বাংলাদেশের নবীন-প্রবীণ শিল্পীদের মাঝে দেখা দেয় ব্যাপক উৎসাহ। আমাদেরগল্পকারদের অনেকেই মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে ছিলেন জড়িত। মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতাযুদ্ধোত্তর কালে তাঁদের কাছে বিপুল অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে দেখা দেয়। দীর্ঘ সিকি শতাব্দীধরে নিজেকে শনাক্ত করার যে সাধনায় বাংলাদেশের শিল্পীরা ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ, তারসাফল্যে ছোটগল্পের ভাব-ভাষা-প্রকরণশৈলিতে যুদ্ধোত্তর কালে এসেছে নতুন মাত্রা। বিষয়ও ভাবের দিক থেকে বাংলাদেশের ছোটগল্পে যেমন মুক্তিযুদ্ধের প্রতিফলন ঘটেছে; তেমনিভাষা-ব্যবহার এবং অলঙ্কার-সৃজনেও মুক্তিযুদ্ধের অনুষঙ্গ উপস্থিত। ছোটগল্পে মুক্তিযুদ্ধেরপ্রতিফলন ঘটেছে বিভিন্নভাবে। কখনো সরাসরি যুদ্ধকে অবলম্বন করে ছোটগল্প রচিতহয়েছে, কখনো-বা ছোটগল্পের মৌল-ভাব সৃষ্টি হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সমৃদ্ধ হয়ে।কোন কোন ছোটগল্পে স্বাধীনতার স্বপক্ষীয়দের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা এবং বিপক্ষীয়দেরপ্রতি ঘৃণাবোধ উচ্চারিত হয়েছে। আবার কোথাও-বা ছোটগল্পের বহিরঙ্গে লেগেছেমুক্তিযুদ্ধের স্পর্শ। মুক্তিযুদ্ধের উপাদানপুঞ্জ ব্যবহার করে বাংলাদেশের প্রায় সব গল্পকারইরচনা করেছেন ছোটগল্প। শুধুমাত্র মুক্তিযুদ্ধের গল্প নিয়ে যাঁদের গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে,তাঁদের মধ্যে আছেন— বশীর আল হেলাল (প্রথম কৃষ্ণচূড়া, ১৯৭২), হাসান আজিজুল হক(নামহীন গোত্রহীন, ১৯৭৫), সৈয়দ শামসুল হক (জলেশ্বরীর গল্পগুলো, ১৯৯০), বিপ্রদাস

বড়ুয়া (বুয়ের গল্প, ১৯৯১), কাজী ফজলুর রহমান (যোগই ডিসেম্বর ও মুক্তিযুদ্ধের গল্প১৯৮৮), সৈয়দ ইকবাল (একদিন বঙ্গবন্ধু ও অন্যান্য গল্প, ১৯৮৬), এহসান চৌধুরী(একরের, ১৯৮৬), শওকত ওসমান (জন্ম যদি তব বঙ্গে, ১৯৭৫), আলাউদ্দিন আলআব্বাণ (আমার রক্ত স্বপ্ন আমার, ১৯৭৫), আবু জাফর শামসুদ্দীন (রালেন ঠাকুরেরতীর্থযাত্রা ১৯৭৭), আবুবকর সিদ্দিক (মরে বাঁচার স্বাধীনতা, ১৯৭৭), সাদেকা শফিউল্লাহ

(মুফ অবশেষে ১৯৮০), খালেদা সালাহউদ্দিন (যখন রুদ্ধশ্বাস, ১৯৮৬) প্রমুখ। এছাড়মুক্তিযুদ্ধের অনুষঙ্গে যে-সব গল্পের কথা বিশেষভাবে স্মরণীয়, লেখকনামসহ তার তালিকাটিএরকম— সত্যেন সেন (পরিবানুর কাহিনী), তাজুল ইসলাম ফিরোজ (সপ্তর্ষী অনেক দূরে),মঞ্জু সরকার (শান্তি বর্ষিত হোক), শওকত আলী (সোজা রাস্তা, আকাল দর্শন), আফসানচৌধুরী (ফাটা শহরের গম), সিরাজুল ইসলাম (দূরের খেলা), রাহাত খান (মধ্যিখানের চর,রশীদ হায়দার (কল্যাণপুর, এ কোন ঠিকানা), মীর নূরুল ইসলাম (স্বৈরিণী ফিরে এসো),কায়েস আহমেদ (আসন), আখতারুজ্জামান ইলিয়াস (অপঘাত, সেলিগ হোসেন (আমিনা ওমদিনার গল্প), মাহমুদুল হক (কালো মাফলার, মঈনুল আহসান সাবের (কবেজ লেঠেল,ভুল বিকাশ), সুচরিত চৌধুরী (নিঃসঙ্গ নিরাশ্রিত), আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী (কেয়া, আমিএবং জারমান মেজর), জহির রায়হান (সময়ের প্রয়োজনে), শামসুদ্দীন আবুল কালাম (দুইভালিমের কাব্য), আমজাদ হোসেন (উজানে ফেরা), হুমায়ুন আহমেদ (শীত, উনিশ শএকাত্তর), রিজিয়া রহমান (ইজ্জত), হুমায়ুন আজাদ (যাদুকরের মৃত্যু), মামুন হুসাইন (মৃতবড় ও বাঙাল একজন) প্রভৃতি। মুক্তিযুদ্ধের নানা অনুষঙ্গ-উপাদান নিয়ে রচিত হয়েছে এসবগল্প। মুক্তিযুদ্ধের গল্প নিয়ে প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য কয়েকটি সঙ্কলন গ্রন্থের কথাও এখানেঘরণীয়— আবদুল গাফফার চৌধুরী সম্পাদিত বাংলাদেশ কথা কয় (১৯৭১), আবুলহাসনাত-সম্পাদিত মুক্তিযুদ্ধের গল্প (১৯৮৩), হারুন হাবীব-সম্পাদিত মুক্তিযুদ্ধের নির্বাচিতগল্প (১৯৮৫), বিপ্রদাস বড়ুয়া-সম্পাদিত মুক্তিযোদ্ধার গল্প (১৯৯১) প্রভৃতি। এ সব গ্রন্থেঅন্তর্ভূত গল্পসমূহে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের নানা ঘটনা ও অনুষঙ্গ শৈল্পিক ব্যঞ্জনায় হয়েছে

মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে অনেক গল্প রচিত হলেও, আমরা এখনো পাইনি এমন একগুচ্ছকালজয়ী গল্প, যা মুক্তিযুদ্ধের সময় বাঙালির সম্মিলিত চৈতন্যের জাগরণকে যথাযথভাবেপ্রতিমায়িত করতে সক্ষম হয়েছে। এর কারণ বহুবিধ। প্রথমত, আমাদের মুক্তিযুদ্ধেরস্বল্পস্থায়িত্ব এটিকে যথার্থ জনযুদ্ধে পরিণত হতে দেয়নি, ফলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাও হয়নিসর্বব্যাপ্ত এবং এরই শিকার, অধিকাংশ বাঙালির মতো, বাংলাদেশের ছোটগারিকরাও।দ্বিতীয়ত, মুক্তিযুদ্ধ এখনো অত্যন্ত কাছের একটি ঘটনা, এবং এজন্যই অধিকাংশছোটগাপ্পিকের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আবেগ-উচ্ছ্বাসতাড়িত, সেখানে স্বভাবতই ফুটে ওঠেশৈল্পিক নিরাসক্তির অভাব সময় পেরিয়ে যখন আসবে নতুন প্রজন্মের ছোটগামিক, হয়ততাদের হাতেই লেখা হবে আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে লেখা একগুচ্ছ কালোত্তীর্ণস্বাধীনতা-উত্তর ছোটগল্পে আঙ্গিকের পরীক্ষা-নিরীক্ষা অনেকটা কমেছে,তুলনামূলকভাবে বেড়েছে বিষয়ের বৈচিত্র্য। এ পর্বে অধিকাংশ ছোটগাল্পিক যুদ্ধোত্তরহতাশা-অবক্ষয় আর নৈরাজ্যের শব্দরূপ নির্মাণে সচেষ্ট হলেন; উৎসাহী হলেন যন্ত্রণাদগ্ধভারুণ্যের নষ্ট-জীবনের শিল্পমূর্তি-সৃজনে। সত্তুরের দশকের বাংলাদেশের ছোটগল্পেরমৌল–প্রবণতা ওই দশকেরই একজন প্রধান গল্পকারের দৃষ্টিতে ধরা পড়েছে এভাবে

সত্তরের গল্পকাররা প্রত্যেকে বয়সে নবীন। কিন্তু সমাজ, মানুষ, পারিপার্শ্বিক প্রেক্ষাপটবিবেচনা করে গল্প রচনায় নবীন নন। স্বাধীনতা-পরবর্তী ঘটনার প্রতি রয়েছে তাঁদেরতীব্র চাউনি। যুদ্ধোত্তর সংকট, দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রে ব্যর্থতা, '৭৪-এর দুর্ভিক্ষ,রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড, সামরিক অভ্যুত্থান এবং শাসকশ্রেণীর প্রতারণার বাস্তবতাসত্তরের গল্পকারণের জীবন্ত বিষয়। লেখকদের মধ্যে যাঁরা সমাজ সজ্ঞান তাঁরাবুর্জোয়া রাজনীতির সীমাবদ্ধতা ও স্খলন ছোটগল্পে চিত্রিত করেন। সত্তরের রোমান্টিকধারার গল্প লেখকরাও সামাজিক অসাম্য অস্থিরতা চিত্রিত করেছেন তাঁদের গল্পে। ...এই দশকে গল্পলেখকদের গল্প পাঠে দেখা যায়, তাঁরা যে যে অবস্থার মুখোমুখিহয়েছেন তার সব কিছু আত্মসাৎ করেছেন ছোটগল্পে। গ্রাম ও শহর উভয়বিধ পটভূমিউঠে এসেছে ছোটগল্পের জমিতে। 

স্বাধীনতা-উত্তরকালে বাংলাদেশের ছোটগল্পে যে সব শিল্পীর আবির্ভাব ঘটেছে, তাঁদেরমধ্যে বুলবুল চৌধুরী, আল মাহমুদ, আবুবকর সিদ্দিক, আতা সরকার, আহমদ বশীর, মঞ্জুসরকার, সৈয়দ ইকবাল, হরিপদ দত্ত, শহীদুল জহির, মামুন হুসাইন, সুশান্ত মজুমদার,সুকান্ত চট্টোপাধ্যায়, মুস্তাফা পাড়া, মঈনুল আহসান সাবের, জাকির তালুকদার, প্রশান্ত মৃধা,শাহনাজ মুন্নী, মহীবুল আজিজ, সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, রায়হান রাইন প্রমুখ শিল্পী প্রকৃতঅর্ধেই রেখেছেন প্রাতিস্বিকতার স্বাক্ষর।সাবলীল গদ্যে মানুষ ও সমাজের তলদেশ উদ্ভাসনে বুলবুল চৌধুরীর নৈপুণ্য সবিশেষ

উল্লেখযোগ্য। মানুষের আদিম জৈবকামনার নিরাভরণ চিত্র প্রতীকী ব্যঞ্জনা এবং আবেগ্রীপরিচর্যায় অঙ্কিত হয়েছে আল মাহমুদের ছোটগরে। পানকৌড়ির বক্তা কিংবা “জলবেশ্যার মতো দুঃসাহসী গল্পে কাম-বাসনার পটে মানব-মনস্তত্ত্বের জটিলতা উন্মোচনে বিশেষকৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন আল মাহমুদ।

স্বাধীনতা-উত্তরকালের যুগসঙ্কট এবং রাজনৈতিক সংক্ষোভ-সংগ্রাম নিয়ে গল্পলিখেছেন আবুবকর সিদ্দিক। বিষয় ও প্রকরণে তাঁর গল্প বিশিষ্ট ও স্বাতন্ত্র্যপ্রত্যাশী।রাজনৈতিক অনুষঙ্গ নিয়ে গল্প রচনায় সৈয়দ ইকবালও সমধিক উৎসাহী। স্বাধীনতাউত্তরকালের বিপন্নতা ও নির্বেদ নিয়ে বেশ কিছু নিরীক্ষাসফল গল্প লিখেছেন তিনি। সুকান্তচট্টোপাধ্যায়ের গমে জীবন ও প্রকৃতির মনোময় একাত্মতা বাংলাদেশের ছোটগমে সংযোজনকরেছে নতুন মাত্রা। এ প্রসঙ্গে তাঁর "ভগবান", "জটাধারীর বল্লী”, “উজানিভাটালি” প্রভৃতিগল্প বিশেষভাবে স্মরণীয়। রাজনৈতিক কূট-তর্ক, তত্ত্বসঙ্কট এবং সামরিক শাসনের পটে গল্পলিখেছেন আতা সরকার। সত্তুর দশকের রাজনীতি যেন বন্দি হয়ে আছে আতা সরকারের

আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের মতো আহমদ বশীরও ঢাকার জনজীবন নিয়ে গল্প লিখেবিশিষ্টতার পরিচয় দিয়েছেন। মঞ্জু সরকারের গল্পে রূপান্বিত হয়েছে উত্তরবাংলার রুক্ষপ্রকৃতি, বিষাপ্ত জনপ্রদ, বিপন্ন সমাজ আর সঙ্ঘামী জনগোষ্ঠী। রাজনৈতিক সচেতনতারপরিচয়ও ফুটে আছে মঞ্জু সরকারের গল্পে।

শ্রেণীসচেতন রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণে শোষকের পতন আর শোষিতের উত্থান নিয়ে গল্প

লিখেছেন হরিপদ দত্ত। খেটে খাওয়া নিপীড়িত মানুষের প্রতিবাদী চেতনাই তাঁর গল্পেরকেন্দ্রীয় বিষয়। চড়া সুরে বাঁধা হরিপদ দত্তের গল্প। চলিত ও আঞ্চলিক ভাষা প্রয়োগে হরিপদত্তর সাফল্য বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। মুস্তাফা পান্নার গল্পেও আছে আঞ্চলিক ভাষাব্যবহারে শৈল্পিক সিদ্ধির স্বাক্ষর। দক্ষিণবাংলার গ্রামীণ জনগোষ্ঠী আর তাদের সংগ্রামশীলজীবনই মুস্তাফা পান্নার গল্পের মৌল বিষয়। হরিপদ দত্তের মতো মুস্তফা পান্নার গল্পেরঅন্তর্ষোতেও সর্বদা বহমান শ্রেণীচেতনা। মানবমনের অন্তগূঢ় রহস্য উন্মোচনই মঈনুলআহসান সাহেবের ছোটগল্পের মৌল অনিষ্ট। শহরজীবনের ক্লেদ-স্খলন-নির্বেদ নিয়ে গল্প

রচনায় তিনি সিদ্ধহস্ত।

স্বাধীনতা-উত্তরকালের বাংলাদেশের ছোটগল্পের অন্যতম বৈশিষ্ট্য, বোধ করি এই যে,এ সময় আমাদের ছোটগাল্পিক চেতনা হয়ে উঠে অনেক বেশি রাজনীতিসচেতন ওজনজীবনমূল-অন্বেষী ‘সত্তর দশকের সমস্ত গল্প লেখকের গল্পের বিষয় মুক্তিযুদ্ধ এবংমুক্তিযুদ্ধের চেতনাসম্বলিত কথাবন্ধু।' ২ বস্তুত, আশির দশকের গল্পসাহিত্যের ক্ষেত্রেওএকথা সমান প্রযোজ্য। স্বাধীনতা-উত্তরকালে পাঠকপ্রিয়তার লোভে এবং বাণিজ্যলক্ষ্মীরআরাধনায় কয়েকজন শক্তিমান গল্পকার সৃষ্টি করেছেন একটা ‘জলো, অসার, বারোয়ারিকেচ্ছা' লেখার ধারা, যা ক্রমশ স্ফীতোেদর হচ্ছে, ধ্বংস করছে গল্পসাহিত্যের শিল্পিতবিকাশের যাত্রাপথ। ষাটের দশকে যে আঙ্গিক সচেতনতার সূত্রপাত, আশিতে এসে তাব্যাপকভাবে বাধাগ্রস্ত হয়েছে। এখন অনেকেই পাঠকরুচির কাছে বিসর্জন দিচ্ছেনশিল্পমানকে, সরস বক্তব্যভুক পাঠকের মনোরঞ্জনের জন্যেই তাঁরা যেন সর্বদা সচেষ্ট।

উপর্যুক্ত আলোচনায় আমরা বাংলাদেশের ছোটগল্পের বিকাশরেখা সংক্ষেপে তুলে ধরার চেষ্টাকরেছি। বিস্তৃতির অবকাশ না-থাকার কারণে, অনেক ক্ষেত্রেই আলোচনাকে করতে হয়েছেসংক্ষিপ্ত, এবং এ কারণেই অনেক অপ্রধান ছোটগান্নিকের রচনা হতে পারেনি আলোচনারঅন্তর্গত। বাংলাদেশের ছোটগল্পের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে যে সত্য প্রতিষ্ঠা পায় তা এইযে, আমাদের সাহিত্যের অন্যান্য শাখার তুলনায় ছোটগল্প দাবি করতে পারে গৌরবেরআসন। তবে বর্তমান সময়ে ছোটগল্পের ক্ষেত্রে চলছে এক ধরনের বন্ধ্যাত্ব। বাংলাদেশ

কিংবা ভারতীয় বঙ্গ—উভয় ক্ষেত্রেই বিশুদ্ধ ছোটগাপ্পিকের আবির্ভাব এখন ক্বচিৎ-কদাচিৎ। ইতঃপূর্বে যাঁরা ভালো গল্প লিখেছেন, তাঁরা অনেকেই হাত গুটিয়ে নিয়েছেন, আসছে না নবীন কোন ছোটগাত্মিক। প্রবীণরা, অনেকেই, পূর্বে-লেখা গল্পগুলো একটু ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নতুন ভাষ্যে করছেন উপস্থাপন। বোঝা যায়, ফুরিয়ে গেছে তাঁদের প্রতিভার দীপ্তি।

পঞ্চাশ-ষাট-সত্তুরের দশকে ছোটগল্পের মূল বাহন পত্র-পত্রিকা ও সাময়িকীর অভাব ছিল একট। তবু ছোটগল্প রচিত হয়েছে। বর্তমানে পত্র-পত্রিকার অভাব নেই, অভাব ভালো ছোটগল্পের। মানুষের সময়ধারণার পটভূমিতে জন্ম হয়েছিল ছোটগল্পের। সময়ের শাসন এখন ঊনবিংশ শতাব্দীর তুলনায় আরো প্রকট। তাহলে বাংলা ছোটগল্পের এই দৈন্যদশা কেন? নাকি পাঠকপ্রিয়তা ও বাণিজ্যবুদ্ধির প্রেরণায় রচিত ষাট থেকে আশি পৃষ্ঠার উপন্যাস নামের বড় গল্পগুলো বাধাগ্রস্ত করছে ছোটগল্পের বিকাশ? পাঠক-রুচির কাছে লেখক বিসর্জন দিচ্ছেন কি আপন প্রতিভা? প্রকাশক যে কাটতি না থাকলে ছোটগল্পের বই প্রকাশ করবেন না— একথা তো লেখাই বাহুল্য। তবু তো কথা থেকে যায় কোন কোন সৎ প্রকাশকের কাছে। আমরা আশা করবো, সেইসব নবীন-প্রবীণ ছোটগাল্পিক, যাঁদের ক্ষমতা আছে, তাঁরা এগিয়ে আসবেন ভালো ছোটগল্প রচনায়; সম্মিলিত সাধনায় তাঁরা আবার আনবেন বাংলাদেশের ছোটগল্পের পঞ্চাশ-ষাট-সত্তুরের সেই স্বর্ণালি আভা, একবার, আরও একবার।


তথ্যনির্দেশ


রথীন্দ্রনাথ রায় : ছোটগল্পের কথা (কলকাতা, ১৯৮৮), প৬

সৈয়দ আকরম হোসেন : বাংলাদেশের সাহিত্য ও অন্যান্য প্রসঙ্গ (ঢাকা, ১৯৮৫),


রাজীব হুমায়ুন: আবুল মনসুর আহমদের ব্যঙ্গ রচনা (ঢাকা, ১৯৮৫) পৃ. ১২-১৯ সৈয়দ আকরম হোসেন : সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ (ঢাকা, ১৯৮৮), পৃ. ৭৫, ৭৭ 

আহমদ কবির : “স্বাধীনতা-উত্তর বাংলা সাহিত্যের রূপান্তর : বিষয় ও প্রকরণ : প্রসঙ্গ

ছোটগল্প", একুশের প্রবন্ধ ৮৮ (বাংলা একাডেমী, ঢাকা, ১৯৮৮), পৃ. ৩৮ মুহম্মদ আবদুল হাই ও সৈয়দ আলী আহসান : বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত (আধুনিক যুগ),

(ঢাকা ১৩৮৫), পৃ. 880

অসীম সাহা: “এ-দেশের গল্প/পূর্ণতা-অপূর্ণতা", কণ্ঠস্বর (সম্পাদক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ), ঢাকা, দশম বর্ষ : তৃতীয় সংখ্যা, সেপ্টেম্বর ১৯৭৫, পৃ. ২৭ রফিকউল্লাহ খান : "হাসান হাফিজুর রহমানের ছোটগল্প", সাহিত্য পত্রিকা, (সম্পাদক মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান), অষ্টাবিংশ বর্ষ : দ্বিতীয় সংখ্যা, ফাল্গুন ১৩৯১, পৃ. ২৪১

অসীম সাহা : “এ দেশের গল্প / পূর্ণতা অপূর্ণতা", পূর্বোক্ত, পৃ. ২১ মুহম্মদ আবদুল হাই ও সৈয়দ আলী আহসান বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত (আধুনিক যুগা পূর্বোক্ত, পৃ. ৪৪২

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ