**--নীলদর্পণ নাটক আলোচনা
দীনবন্ধু মিত্রের নীলদর্পণ নাটক আলোচনা
নীলদর্পণ নাটক কি ট্রাজেডি?
ঐতিহাসিক নাটক হিসেবে নীলদর্পণকতটা সার্থক
নামকরণের সার্থকতা--**
**বিঃদ্র-বাংলা বিভাগের সকল পড়াশোনা পেতে ব্লগটিতে যুক্তথাকুন https://monoweredu13.blogspot.com/?m=1
---দীনবন্ধু মিত্র(১৮৩০-১৮৭৩) বাংলা সাহিত্যে এক বিশেষ স্থান দখল করে আছেন। বিশেষ করে বাংলা নাটকে তার পদচারণা প্রশংসা যোগ্য। নাটক রচনার জন্য যে জাতীয় বৈশিষ্ট্য অপরিহার্য, জীবন সম্পর্কে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা, বস্তুনিষ্ঠ মনোভাব ও সর্বব্যাপী সহানুভূতি, দীনবন্ধু মিত্রের মধ্যে এই সকলগুণ বর্তমান ছিল।
বাংলাদেশের উর্বরা জমি নীলচার্যের পক্ষে বড় সহায়ক ছিল। নীলরঙে বিলাতের ঘর-বাড়ী বাঙাইবার উদ্দেশ্য নীলচাষ ব্যাপকরূপে এই দেশে শুরু হয়। বাংলাদেশের গ্রামে গ্রামে কুঠি নির্মাণ করিয়া বিভিন্ন অঞ্চলে কৃষকদের সালন লইতে বাধ্য করিয়া নীলকর সাহেবগণ নীলচাষ শুরু করেন ও প্রভূত মুনাফা করেন। লাভের হার যত বাড়িতে অক্ষয়কুমার দত্ত 'তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায়' ১৮৫৮ খীষ্টাব্দে মন্তব্য করেন যে, নীলকরদিনের অত্যাচার ভূস্বামিগণ অপেক্ষা অনেক বেশি ও ইহার ফলে প্রজাকুল নির্মূল হইবার উপক্রম হইয়াছে। 'নীলকরদিগের কার্যের আদ্যোপান্ত আলোচনা করিয়া দেখিলে স্পী প্রতীত হয় যে, প্রজাপীড়ন করিয়া স্বকার্য উদ্ধার করাই তাঁহাদের সংকল্প। দেখ, প্রজারা আপন অধিকারস্থ না হইলে, তাহাদের উপর সম্পূর্ণ বল প্রকাশ ও স্বেচ্ছানুরূণ অত্যাচার করা সম্ভাবিত হয় না। অতএব তাঁহারা স্বীয় স্বীয় কুটীর সন্নিহিত গ্রামের সকল ইজারা লইয়া থাকেন এবং তদ্দারা তাহাদিগকে স্বীয় লোভ-স্বর্গরে পতিত করিয়া মনস্কামনা সিদ্ধ করেন। করিলে তাঁহারা এই কৌশল যারা ভূস্বামীদিগের সদৃশ প্রবল প্রভাগ ও প্রভূত পরাক্রম প্রাপ্ত হয়েন এবং বাস্তবিক আপনাদিগকে স্বাধিকারের সম্রাটম্বরূপ জ্ঞান করিয়া প্রজাপীড়নে কৃতসঙ্কল্প হইয়া তদনুযায়ী ব্যবহার করেন'।
নীলকর সাহেবদের অত্যাচারের বিবরণ 'সংবাদ প্রভাকরের অনেক সংখ্যায় লিপিবদ্ধ হইয়াছে। ১৮৫৪ খ্রীষ্টাব্দের সম্পাদকীয়তে লিখিত হইয়াছে , নীলকরগণ . দুঃখী প্রজাদিগকে বেগার ধরিয়া নীপবীজ বপন ও অগসেচন প্রভৃতি কার্য করান ও তাহাদিগকে পারিশ্রমিক দেন না। 'বলের দ্বারা জমিদারের ভূমিতে চাষ করিয়া লাঠির বলে তাহা কাটিয়া লয়েন'। 'মফস্বলে যে সমস্ত খোদাবদ ধর্মাবতারেরা অসংখ্য প্রজার
ধন-প্রাণের উপর কর্তৃত্ব করিতেছেন, এবং যাঁহারা বিচারক নামে বিখ্যাত, তাঁহারা প্রায় ভাবতেই নীলকরের বাধ্য, জিলার অবস্থা দর্শন অথবা শিকারে গমন করিলে নীলকুঠিতেই ভোজন, শয়ন ও নীলকর সাহেবদিগের কন্যাপুত্র ও প্রেয়সীর সহিত আমোদ-প্রমোদ ও নীলকরের হস্তীতেই আরোহণপূর্বক ব্যাঘ্র, হরিণ, মহিষ ও শূকরাদি পশু হনন করিয়া থাকেন। সুতরাং, নীলকরের মোকদ্দমায় পক্ষপাত করিতে হইলেও অনায়াসে করিয়া বসেন'। এমতাবস্থায় প্রজামণ্ডলী ‘মনের আগুন মনেই নির্বাণ করিয়া ঊর্ধ্ব নিশ্বাস ত্যাগ করিতেছে। ১৮৫৮ খ্রীষ্টাব্দে নীলকরের দৌরাত্ম্যে রাইয়ৎ লোকের সর্বনাশ' সম্পাদকীয় প্রবন্ধে লিখিত হইয়াছে 'বাঙ্গাল গবর্ণমেন্টের অধীনস্থ প্রায় সমস্ত জিলার সংবাদ লইয়া থাকি তাহাতে প্রায় সমস্ত স্থানেই নীলকুঠির সমান দৌরাত্ম্যই দেখিতে পাই । স্থান বিশেষে কেবল দুই একজন ধার্মিক সাহেব আছেন, নচেৎ তাবতেই এক ধর্মাক্রান্ত। যে স্থানে দারোগা অত্যাচারের সংবাদ করিতে অতিশয় ভীত এবং বিচারপতি সমূদয় বুঝিতে পারিয়াও অবহেলা করেন, সে স্থানে ধর্ম কখনই অবস্থান করিতে পারে না, সুতরাং ধর্ম প্রস্থান করিলেই অধর্মের প্রাদুর্ভাব হইয়া থাকে । --- নীলকুঠী সংক্রান্ত নিষ্ঠুরতা ও হত্যাঘটিত মোকদ্দমা কতবার সুপ্রিম কোর্টে উপস্থিত হইল, সদর নিজামতের ঘর নথিতে পরিপূর্ণ হইয়াছে কিন্তু তাহাতে এ পর্যন্ত কোন উপকার হইল না'। ১৮৬০ খ্রীষ্টাব্দে 'হিন্দু পেডিয়ট' পত্রিকায় নদীয়া জেলার অন্তঃপাতী খালবুলিয়ার নীলকুঠির অধীন বগুলা নামক অপর এক কুঠির সন্নিহিত গোয়াপোতা, শ্যামনগর, বড়ঢুলুরি নামক তিনটি গ্রামে নীল গাছ বড় হইলে গোমস্তা আদেশ দিল যে, চাষীগণ নীলক্ষেত্রের নিড়ান করিবে ও নিজেদের ক্ষেতের কাজ করিতে পারিব না। প্রজাগণ পূর্ব বৎসরে ন্যায় নিড়ানের প্রতিশ্রুতি দিয়া তাহার পূজার নিমিত্ত তিনশত টাকা দিতে সম্মত হইল। কালু মণ্ডল যেহেতু অপর প্রজাগণের নিকট হইতে টাকা আদায়ে সম্মত হয় নাই সেইজন্য তাহাকে ও মজুদ্দিন নামক অপর এক বৃদ্ধকে ধরিয়া লইয়া নির্যাতন করা হইল। প্রজারা সংঘবদ্ধ হইয়া তাহাদিগকে উদ্ধার করিল। ভাজন কুঠির অধ্যক্ষ টুইড সাহেব প্রজাদিগকে পাঠাইলেন । তাহারা ধনাঢ্য ব্যক্তি বৃন্দাবন সরকারের শরণাপন্ন হইল। কিন্তু তাঁহার সহিত নীলকরদিগের মামলা হেতু বিচারপতিদের পক্ষপাতিত্বের কথা স্মরণ করিয়া প্রজাদিগের পার্শ্বে দাঁড়াইতে তিনি সাহস পাইলেন না। প্রজাগণ ম্যাজিস্ট্রেটের নিকটে গেলে তিনি কুঠিয়াল সাহেবের অস্ত্রধারী লোকের সাহায্য প্রার্থনা মঞ্জুর করিলেন। নীলকর সাহেব প্রজাপীড়নে প্রবৃত্ত হইলেন।
১৮৬৩ খ্রীষ্টাব্দের 'সংবাদ প্রভাকরের' সম্পাদকীয় স্তম্ভে নীলকরগণ কর্তৃক দরিদ্র প্রজাগণকে বলপ্রয়োগে ক্ষেত্রের কার্যে নিযুক্ত ও তাহাদের সঙ্ঘবদ্ধ হইয়া ধর্মঘটের সংবাদ লিখিত হইয়াছে । উভয়পক্ষের এই প্রকার প্রতিজ্ঞার জন্য স্থানে স্থানে বিবাদ বিসংবাদ এবং দাঙ্গাহাঙ্গামা হইতেছে। নীলকরদিগের বাহুবল অত্যন্ত প্রবণ, তাঁহাদিগের ভিন্ন ভিন্ন কুঠিতে বিস্তর যষ্টিধারী লোক আছে। তাহারা সাহেবের গোমস্তা মহাশয়ের অনুমতি পাইলে অনায়াসে গ্রাম মধ্যে প্রবেশপূর্বক প্রজাদিগকে বন্ধনবিস্থায় আনয়ন করে'। আবার, | বিশেষে এইরূপ একতা হইয়াছে যে, কুঠির লাঠিয়ালরা সেখানে যাইতে পারে না। 'সোমপ্রকাশে' প্রকাশিত হইয়াছিল যে, দাদনের মত প্রজাদিগের নিকট হইতে গৃহীত হইত। স্যার পিটার গ্রাণ্ট প্ৰজাদিগকে কার্য করিবার স্বাধীনতা দান করেন। যদি তাহারা দাদন না লইয়া নীলের চাষ করিতে সম্মত না হয় তবে তাহাদের বাধ্য করা যাইবে না। আমেরিকার ক্রীতদাসদিগের তুলনায় এই দেশের প্রজাগণের অবস্থা ছিল নিকৃষ্ট। গভর্ণর বিডন আসিয়া পীটার গ্রাস্টের মানবতাধর্মী আইনটি তুলিয়া দেন।
আশানুরূপ ফসলের জন্য নীলচাষে প্রজাদের বাধ্য করা, নীলকরদের জমিদারী ও তালুকদারী ক্রয়, প্রজাদের বিনা পারিশ্রমিকে বেগার খাটান, চাষীদের কুটীতে কয়েদ রাখা—এই জাতীয় অত্যাচার দেশের মধ্যে অসন্তোষ ও বিদ্রোহের ভাব পুঞ্জীভূত করিয়া তুলিয়াছিল। নীলকরগণ কেহ কেহ এ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতা লাভ করায় প্রজাদের দুঃখ আরও বাড়িয়া গেল। বুকানন হামিলটনের লেখা হইতে জানা যায় যে, নীলকরেরা দাদন লওয়া চাষীদের ক্রীতদাসের ন্যায় ব্যবহার করিত। টাকা শোধ দেওয়ার সুযোগ তাহাদের দেওয়া হইত না, জমির মাপে ও ফসলের মাপে তাহাদের প্রতারিত করা হইত। মূর্শিদাবাদ, যশোহর, পাবনা, রাজসাহী, ফরিদপুর, ময়মনসিংহ প্রভৃতি অঞ্চলে নীল চাষ হইত ও সেই উপলক্ষে প্রজাদিগের উপরে অত্যাচার বেশী হইত। নালিশ করিলে বিচার হইত না, কেননা, সাদা হাকিমদের দ্বারা নীলকর সাহেবগণ শাসিত হইত না। ইহাদের অত্যাচার প্রশমিত করিবার জন্য বাংলার মধ্যবিত্তশ্রেণী যথেষ্ট সহায়তা করিয়াছিল ।
প্যারীচাঁদ মিত্রের 'আলালের ঘরের দুলাল' গ্রন্থেও (১৮৫৬ খ্রীষ্টাব্দে) নীলকরদিগের অত্যাচারের বিবরণ লিপিবদ্ধ হইয়াছে। তিনিও লিখিয়াছেন ‘নীলকর বেটাদের জুলুমে মুলুক খাক হইয়া গেল!— প্রজারা ভয়ে ভয়ে ত্রাহি ত্রাহি করিতেছে । হাকিমরা স্বজাতীয়গণকে দণ্ড দেন না, আবার আইনের ফাঁকে তাহাদের পলাইবার পথও বিলক্ষণ আছে। বারাসাতের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এ্যাসলি ইডেন হুকুমনামা জারি করিয়াছিলেন যে, নিজের জমিতে নীল চাষ কৃষকদের ইচ্ছাধীন। নীলচাষীগণের মধ্যে যে প্রতিরোধ আন্দোলন গড়িয়া উঠে যশোহরে তাহার নেতৃত্ব করিয়াছিলেন বিষ্ণুচরণ ও দিগম্বর বিশ্বাস। স্যার জন পিটার গ্রান্টের নিকটে হাজার হাজার নরনারী প্রার্থনা জানায় যেন, তাহাদের নীলচাষে বাধ্য না করা হয়।
নীলচাষের ইতিহাস হইতে জানা যায় যে, মঁসিয়ে ল্যুই বোনার নামক এক ফরাসী ভদ্রলোক ভারতবর্ষে প্রথম নীলচাষ প্রবর্তন করেন। ইহা অষ্টাদশ শতকের শেষার্ধে শুরু হয়। প্রথমে তিনি হুগলি জেলার তালভাঙ্গায় একটি ছোট নীলকুঠি স্থাপন করেন। পরে ইহা চন্দননগরের গোঁদলপাড়ায় স্থানান্তরিত হয়। ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি প্রিন্সেট নামক নীলকর সাহেবের সঙ্গে ১৭৭৯ খ্রীষ্টাব্দে নীল সরবরাহের চুক্তি করে । লর্ড কর্ণয়ালিসের ‘মিনিট’ পাঠে জানা যায় C4, আঠার শতকের শেষ পর্বে নীলচাষ বাংলাদেশে ভালভাবে প্রচলিত হয়। প্রথমদিকে নীলকরদের ৫০ হইতে ৭৫ বিঘার
বেশী জমি নীলচাষের জন্য দেওয়া হইত না। পরে তাহারা কুঠির সংলগ্ন জাম দখল করিয়া ও চাষীদের প্রলোভন দেখাইয়া নীলচাষ ব্যাপকভাবে শুরু করে। দেশীয় জমিদাররাও মুনাফার লোভে নীলচাষের দিকে ঝুঁকিয়া পড়েন। বিদেশীগণের তুলনায় ইহারাও কম অত্যাচারী ছিলেন না।ডাক বিভাগের সুপারিনটেণ্ডেন্টরূপে দীনবন্ধু নীল চাষীদের দুরবস্থা নিজে প্রত্যক্ষ করেন। এই অভিজ্ঞতার ফল হইল তাঁহার 'নীলদর্পণ' নাটক। ইহার ইংরেজী অনুবাদ করেন মাইকেল মধুসূধন ও প্রকাশিত করেন পাদরি জেম্স লঙ। বিচারে লঙের একমাস কারাদণ্ড ও হাজার টাকা জরিমানা হয়। কালীপ্রসন্ন সিংহ ঐ টাকা আদালতে তৎক্ষণাৎ জমা দেন। শোনা যায় যে, মধুসূদনকেওহেতু সরকারী কার্য ত্যাগ করিতে হয়। প্রজাগণের দরদী বন্ধু হরিশচন্দ্র মিত্র, 'হিন্দু পেট্রিয়টের' সম্পাদক,| গেলে কবিতা রচিত হয়:--
""নীলবানরে সোনার বাঙ্গালা করল এবার ছারেখার। অসময়ে হরিশ মল লঙের হ’ল কারাগার। প্রজার আর প্রাণ বাঁচানো ভার ।""
আর একটি গানে লেখা হইয়াছেঃ
""ইণ্ডিগো রিপোর্ট পড়ে, কেনা অন্তরে পোড়ে,
তবু নীলীরা নড়ে চড়ে, পোড়ার মুখ দেখাতেছে।
বলতে দুখে বুক বিদরে, ওয়েলস অবিচার করে, নির্দোষী লঙকে ধরে, একটি মাস ম্যাদ দিয়েছে""।
নীলচাষের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ ও অসন্তোষের ফলে সরকার বিচারের জন্য জেলাগুলিকে বেশী সংখ্যক মহকুমায় বিভক্ত করিয়া আদালত স্থাপন করেন, এবং হাঙ্গামা দমনের জন্য সৈন্য মোতায়েন করেন। নীলকরগণও প্রজাদিগের বিরুদ্ধে চুক্তিভঙ্গের মোকদ্দমা দায়ের করিয়া তাহাদের সর্বস্বান্ত করে। যাহাই হউক, ১৮৬৮ খ্রীষ্টাব্দে 'নীলচুক্তি আইন' রদ করা হয়। এই শতকের শেষে ১৮৯২ খ্রীষ্টাব্দে রাসায়নিক প্রস্তুত হইলে নীলচাষ রহিত হয়।
ঐতিহাসিক গুরুত্ব-বিচারঃ----
বঙ্কিমচন্দ্র 'নীল-দর্পণে'র পরিচয় দিয়া মন্তব্য করিয়াছিলেন ‘অন্য নাটকের অন্য গুণ থাকিতে পারে, কিন্তু নীল-দর্পণের মত শক্তি আর কিছুতেই নাই' । এই বক্তব্যটি সর্বাংশে সত্য। টম কাকার কুটির' যেমন আমেরিকার কাফ্রিদিগের দাসত্বমোচনে সহায়তা করিয়াছিল, নীল-দর্পণ ও তদ্রূপ বিদেশী শাসকবর্গের প্রশ্রয়পুষ্ট অর্থলিপ্সু, অত্যাচারী, ধর্মবুদ্ধিহীন নীলকরগণের সত্যকার রূপ উদ্ঘাটিত করিয়া দেশে ও বিদেশে আলোড়ন সৃষ্টি করিয়াছিল। ইহাতে অত্যাচার একেবারে রুদ্ধ না হইলেও বহুলাংশে প্রশমিত হইয়াছিল ।যেহেতু নাটকটি লেখকের সমাজজ্ঞতার ফল এবং নিপীড়িতগণের দুঃখ বর্ণনায় তিনি হৃদয়ের মমতাকে লেখনীমুখে নিঃসৃত করিয়াছিলেন। সেইহেতু 'নীল দর্পণের মত শক্তি তার কিছুতেই নাই'। তাঁহার এই নাটক সেকালের ন্যায় একালেও দর্শকমন ও পাঠকচিত্তকে অভিভূত করিয়া রাখে ।
‘নীল-দর্পণ' রচনার পূর্বে স্বদেশবৎসল ব্যক্তিগণের মধ্যে নীলকরগণের অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ উত্থিত হইয়াছিল। সেকালের সংবাদপত্রে নীলকরগণের কার্যের তীব্র সমালোচনা করিয়া উদার মনোভাবাপন্ন শাসকবর্গের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হইয়াছিল। এই সংবাদপত্রসমূহ নীলকরগণের অত্যাচার সবিস্তারে বর্ণনা করিয়া দেশবাসীর চিত্তকে উদ্বুদ্ধ করিয়া তুলিয়াছিল। তবে নীলকরগণও বসিয়া ছিল না। তাহারাও সংবাদপত্রে মিথ্যা প্রচার চালাইয়াছিল। তৃতীয় অঙ্কের প্রথম গর্ভাঙ্কে গোপীনাথ উড সাহেবকে বলিয়াছে আপনাদের কাগজের কাছে উহাদের কাগজ
দাড়াইতে পারে না, তুলনা হয় না, ঢাকাহ, জালার কাছে ঠাণ্ডা স্তুতিবাদ থাকিলেও অর্থব্যয়ে সংবাদপত্র হস্তগত করিবার সংবাদটি সত্য।
ন্যায়নীতিবর্জিত, ধর্মজ্ঞানশূন্য নীলকরগণের অত্যাচার অসহায় প্রজাবর্গের উপরে নানা ভাবে চলিত। তাহাদের নিযুক্ত কর্মচারিগণেরও জমি দখল, স্ত্রী-হত্যা, ঘর জ্বালান প্রভৃতি অঙ্গের আভরণ হইয়া উঠিয়াছিল। আবার তাহাদের যদি কাহারও জেল হইত, তবে বাকী মাহিয়ানা দেওয়া হইত না। গোপীনাথ তাই অনুযোগ করিয়াছে 'ধর্মাবতার, চাকর কয়েদ হলে বিচার, এই'? সংবাদপত্রে সকল ঘটনা প্রকাশিত হইত না। যাহা হইত তাহাও বৃহত্তর জনসমাজে পৌছাইত না। কিন্তু 'নীল-দর্পণ' অভিনয়ে সকল ঘটনা প্রত্যক্ষ করিয়া সমগ্র দেশ বিক্ষুদ্ধ হইয়া উঠিল। এইখানে এই নাটকের ঐতিহাসিক গুরুত্ব। এই কারণে বঙ্কিমচন্দ্র মন্তব্য করিয়াছেন যে, ইহা 'নীলদাসদিগের দাসত্ব মোচনে অনেকটা কাজ করিয়াছে। যে রচনা চিত্তকে উদ্বুদ্ধ করিয়া দর্শক সাধারণের মনে আত্মমর্যাদাবোধ ও স্বাধীন কর্মস্পৃহার প্রেরণা আনিয়া দেয় তাহাকে শক্তিশালী বলিয়া বর্ণনা করা সঙ্গত।তথাপি ‘নীল-দর্পণ’কে ঐতিহাসিক নাটক বলা যাইবে না, কারণ ইতিহাসের কোন বিশেষ ঘটনা অবলম্বনে ইহা রচিত হয় নাই এবং এখানে ঐতিহাসিক পাত্র-পাত্রী কেহ নাই । এখানে বর্ণিত কাহিনী কাল্পনিকও নহে। দীনবন্ধু নদীয়া জেলার অধিবাসী ছিলেন। এই নদীয়া জেলার চৌগাছা গ্রামের বিষ্ণুচরণ বিশ্বাস ও পোড়াগাছা গ্রামের দিগম্বর বিশ্বাস নীলকরগণের বিরুদ্ধে দণ্ডায়মান হন। তাঁহারা অসমসাহসিকতার পরিচয় দিয়া শেষ পর্যন্ত জয়যুক্ত হন। 'ভারত-সংস্কারক' পত্রিকা দীনবন্ধুর পরলোক গমনের পরে ১৮৭৩ সালের ৭ই নভেম্বর সম্পাদকীয় প্রবন্ধে লেখেন 'নদীয়ার অন্তর্গত গুয়াতোলির মিত্র পরিবারের দুর্দশা নীলদর্পণের উপাখ্যানটির ভিত্তিভূমি'। যে ঘটনাবলী ভিত্তি করিয়া নাটকটি রচিত হইয়াছে তাহাদের ঐতিহাসিক মূল্য আছে, কিন্তু তথায় ইতিহাসের নির্বিশেষে পরিচয় ব্যক্ত হইয়াছে। দীনবন্ধুর উদ্দেশ্য হইল অত্যাচারে পীড়িত বাঙ্গালীর সমাজ-জীবনের পরিচয় দান করা। তিনি এখানে অর্থনৈতিক পীড়ন ও শোষণের রূপটি অঙ্কিত করিয়াছেন। নবীনমাধব উপদ্রুত দরিদ্র প্রজাগণের রক্ষায় দীক্ষিত হইয়াছেন । এই দিক হইতে বিচার করিলে নাটকটিকে বিগত যুগের সামাজিক জীবনের দলিলরূপে অভিহিত করা সঙ্গত হইবে।
নীল-দর্পণ ট্র্যাজেডি না বিষাদান্ত নাটকঃ---
শেকস্পীয়রের নাটক হইতে আমাদের দেশে ট্রাজেডির ধারণা আসিয়াছে ও ধারাও প্রবর্তিত হইয়াছে। কিন্তু শেক্সপীয়রের সৃষ্টিতে যে উত্তাপ ও সংঘর্ষ, হৃদয়মন্থনজাত বিষামৃত ও আনন্দ-বেদনার সমাবেশ, দুঃখকর পরিণাম ও নিয়তির বিরুদ্ধে পৌরুষের সংগ্রাম লক্ষ্য করা যায়, আমাদের দেশের নাটকে তাহা পরিলক্ষিত হয় না। ইহার কারণ মধুসূদন ব্যাখ্যা করিয়া একটি পত্রে লিখিয়াছিলেন যে, আমাদের দেশে নাটক অতিমাত্রায় কোমল ও রোমান্স কল্পনায় পূর্ণ। যে উদাত্ত সৃষ্টিধর্মী কল্পনায় নাট্যকার কার্য-কারণ সম্পর্কের সূত্রে বাস্তবজীবনের ঘটনাবলীকে তগত দৃষ্টিতে প্রত্যক্ষ করিয়া বিচ্ছিন্ন জীবন হইতে অখণ্ড কল্পনার সহযোগে রস আহরণ করিয়া লন, আমাদের দেশে শেকস্পীরিয় প্রভাব সত্ত্বেও তাহা ঘটে নাই। বস্তুনিষ্ঠ দৃষ্টিভঙ্গী থাকিলেও কল্পনার অভাব ঘটে, আবার হয়ত কবিকল্পনার আধিক্য বাস্তববোধকে আচ্ছন্ন করে।
সংস্কৃত নাটকের প্রভাবও নাট্যকারের সৃষ্টিতে ছায়াপাত করিয়াছে। সংস্কৃত নাটকে ট্রাজেডি নাই, কেননা তথায় জীবনকে খন্ডদৃষ্টিতে না দেখিয়া তাহাকে সমগ্র জীবন-প্রবাহের আলোকে উপলব্ধি ও গ্রহণ করা হইয়া থাকে। যেখানে পূর্ণতার আদর্শে বিশ্বাস ও জন্মাত্তরীণ কর্মফলের উপরে প্রত্যয় সুগভীর তথায় ট্রাজেডি সৃষ্টি হইতে পারে না। আস্তিক্যবোধের সহিত ট্রাজেডি পরিকল্পনার বিরোধ আছে। মানুষের দুঃখ ও দুর্ভাগ্যকে যদি দৈবলীলা বলিয়া ব্যাখ্যা করা হয় সেখানে করুণ রস সৃষ্টি হইতে পারে, কিন্তু ট্র্যাজেডি রচনা করা যায় না।
দীনবন্ধু তাঁহার নাটক রচনায় শেকস্পীরিয় আদর্শে অনুপ্রাণিত হইয়াছিলেন।
সন্দেহ নাই। তথাপি তাঁহার নীল-দর্পণ করুণ-রসাত্বক হইলেও ট্রাজেডির মহিমা
হইতে বঞ্চিত হইয়াছে।
মধ্যযুগে য়ুরোপে ট্রাজেডির আদর্শ ছিল যে, দুর্ভাগ্য অকস্মাৎ আসিয়া গর্বিত মানুষকে বিপর্যন্ত করিয়া দেয়। ভাগ্যের লীলা বড় দুর্জেয়। চসার তাঁহার Monk's Tale- এ বর্ণনা করিয়াছেন ৪ For whan men trusteth hire, thanne wol she faille. And covere hire brighte face with a clowde. এই পরিকল্পনা গ্রীক নাটকের আদর্শ হইতে স্বতন্ত্র। শেকস্পীরিয় নাটকে ট্রাজেডির বীজ নায়ক চরিত্রে উত্ত থাকে। তিনি বহুগুণের আধার হইলেও তাঁহার ত্রুটির জন্য (আরিস্টটল এই ত্রুটিকে বলিয়াছেন Hamartia অর্থাৎ Error of Judgement) বিপর্যয় নামিয়া আসে। হ্যামলেটের অভিনেতা রাজা ইহাকে ব্যাখ্যা করিয়াছেন 'Our thoughts are ours, their ends none of our own.' এই বিপর্যয় এত আকস্মিক ও গভীর যে, তাহা দর্শক মনে শুধু ভীতি ও অনুকম্পা নহে, প্রীতি ও শ্রদ্ধাবোধ নায়কের প্রতি জাগিয়া উঠে। ইহার কারণ হইল যে, তিনি প্রতিকূল ঘটনার বিরুদ্ধে মানসিক দৃঢ়তা লইয়া সংগ্রাম করে ও তাঁহার পরাভব সত্ত্বেও জীবনের অপরাজেয় মহিমা ধ্বনিত হইয়া উঠে। মৃত্যু ট্রাজেডির বড় কথা নহে, ব্রাডলের মতে the central feeling is the impression of waste.' জীবনের সকল সম্ভাবনার শোকাবহ অপচয়ের কারুণ্য ট্রাজেডির সুর ও জীবনের মহিমাদীপ্ত রূপ ইহার ফল। নিয়তি মানুষের জীবনে প্রাধান্য বিস্তার করে কি না, এই প্রশ্ন বিচার করিলে দেখা যায় যে, মানুষ তাহার মানসিক প্রবণতা অনুযায়ী প্রচলিত সমাজ-ব্যবস্থা বা জাগতিক নৈতিক নিয়মের বিরুদ্ধে কাজ করিয়া নিজের দুর্ভাগ্যকে সৃষ্টি করিয়া থাকে। এই নৈতিক নিয়ম এমন এক নীতি যাহা পাপ সম্পর্কে উদাসীন নহে, বা দোষীকে ক্ষমা করিতেও প্রস্তুত নহে। গ্রীক নাটকে এই জাগতিক নীতি প্রাধান্য লাভ করিয়াছে।
রাজা অয়দিপাউস সজ্ঞানে কোনো অপরাধ করেন নাই। তথাপি পিতৃহত্যা এবং জননী ইয়োকাস্তেকে বিবাহ করিয়া তিনি যে জাগতিক নীতি লঙ্ঘন করিয়াছেন, তাহার ফলে তাঁহার জীবনে চরম বিপর্যয় নামিয়া আসিয়াছে। ইহাকে বাধা দিবার বা রুদ্ধ করিবার কোনো উপায় নাই। ইহার নিকটে পৌরুষ ব্যর্থ।
নীল-দর্পণে ট্রাজেডির উপকরণ আছে। অসহায় প্রজাবৃন্দের উপরে ন্যায় নীতি বর্জিত নীলকরগণের অত্যাচার এই নাটকের বর্ণনীয় বিষয়। নবীনমাধরের পরিবার ও সাধুচরণের পরিবার নীলকরগণের অত্যাচারে বিধ্বস্ত হইয়াছে। নীলকর উড সাহেব লাঠির আঘাতে নবীনমাধবের মস্তক বিদীর্ণ করিয়া দিলে রক্তক্ষরণ হেতু তাহার মৃত্যু হয়। এই শোকাবহ ঘটনায় জননী সাবিত্রী মানসিক ভারসাম্য হারাইয়া পুত্রবধূ সরলতার জীবনহানি করেন এবং পরে প্রকৃতিস্থ হইয়া মৃতমুখে পতিত হন। ইহার পূর্বে বসু পরিবারের কর্তা ও নবীনমাধবের পিতা মিথ্যা মামলায় কারাগারে নিক্ষিপ্ত হন। লাঞ্ছনা সহ্য
করিতে না পারিয়া ধর্মভীরু এই বৃদ্ধ উদ্বুদ্ধনে প্রাণ ত্যাগ করেন। বসু পরিবারের শোকাবহ পরিণামের সঙ্গে সাধুচরণের কন্যা রোগ সাহেব কর্তৃক ধর্ষিতা ক্ষেত্রমনির অকালে গর্ভপাতহেতু মৃত্যু হয়। এই দুইটি পরিবারের মর্মদ্ভদ পরিণাম লইয়া যে বস্তুনিষ্ঠ কাহিনী নাট্যকার রচনা করিয়াছেন তাহা গভীর কারুণ্য সৃষ্টি করিয়াছে।
নীল-দর্পণ সার্থক ট্রাজেডি হইতে পারে নাই। ইহার কারণ হইল নাটকের যদ- অসমভিত্তিক। একদিকে চলিয়াছে ক্ষমতামত্ত, শাসকগণের আশ্রয়পুষ্ট এবং বিচারকগণের পক্ষপাতিত্ত্বলাভে শক্তিশালী নীলকরগণের অবাধ অত্যাচার এবং অন্যদিকে অসহায় প্রতিকারে অসমর্থ অন্তহীন প্রজাসাধারণের নিপীড়ন ও অশেষ দুর্গতি। নাটকে সংঘর্ষ যদি তীব্র হয়, এবং তাহার ক্ষেত্র বিস্তৃত হয়, তবে নাট্য-কাহিনী পাঠকমনকে আলোড়িত করিয়া তোলে। তাহাদের মনে নাট্য পরিণাম সম্পর্কে গভীর উৎকণ্ঠা জাগিয়া ওঠে এবং তাহার পরিণাম সম্পর্কে উৎসুক হয়। কিন্তু এই নাটকের সংঘাত অসমভিত্তিক হওয়ায় ঘটনাপ্রবাহ পাঠকমনকে ভীতি-বিহবল ও অভিভূত করিয়া রাখে। সেই ক্ষেত্রে করুণরস উচ্ছ্বসিত হইয়া পাঠকের মনকে অভিভূত করে ।
ট্রাজেডি নাটক মূলত চরিত্রকেন্দ্রিক। ট্রাজেডির চরিত্রসমূহের মধ্যে, বিশেষতঃ নায়ক চরিত্রে, পরিলক্ষিত হয় অনমনীয় সংকল্প এবং দৃঢ়তা। অধ্যাপক নিকল মন্তব্য করিয়াছেন, There is always something stern and majestic about the highest tragic art.' সুতরাং এই নায়ক চরিত্রকে কেন্দ্র করিয়া ট্রাজেডি গড়িয়া উঠে। নাটকে বর্ণিত করুণরসের সহিত ট্রাজেডি ও তাহার পরিণামের কোন সম্পর্ক নাই। কেননা, করুণরস ট্রাজেডির রস তুলনায় নিম্নস্তরের। ট্রাজেডিতে বর্ণিত নায়ক চরিত্রে এবং অন্যান্য চরিত্রেও যে দৃঢ়তা ও আভিজাত্য থাকে, তথায় আমরা তাঁহাদের পরিণাম প্রত্যক্ষ করিয়া ভীতি-মিশ্রিত আবেগে (awe and admiration) বিহ্বল হইয়া পড়ি। আগামেমনন, অরদিপাউস, বা আন্তিগোনে সম্পর্কে আমাদের মনে অপার বিস্ময়বোধ এবং ভীতিবিহ্বল মনোভাব উদিত হয়। তাঁহারা তাঁহাদের চারিত্রিক গুণাবলি হেতু আমাদের জীবন হইতে এতদূরে অবস্থিত যে, তাঁহাদের দুর্ভাগ্যের সঙ্গেএকাত্মতাবোধ করিলেও আমরা ঠিক যেন করুণা বা মমতা প্রকাশ করিতে পারি না। শেক্সপীয়রের চরিত্রে ট্রাজেডির উপাদানসমূহ আছে। মানসিক অপ্রকৃতিস্থতা হেতু লিয়রের নিঃসংগ অবস্থায় প্রান্তরে ভ্রমণ, ও গ্লস্টারের প্রতি নিষ্ঠুর আচরণের পরে বৃদ্ধ রাজা জাগ্রত হয়ে দেখতে পেলেন যে, তাঁর কনিষ্ঠা কন্যা কর্ডেলিয়া তাঁর উপরে আনত হয়ে আছে। এই দৃশ্য আমাদের মনে ভীতি ও মমতা জাগ্রত করে এবং এক সুগভীর কারুণ্যে আমাদের মন অভিভূত হইয়া পড়ে। ওফেলিয়া বা দেসদিমনার প্রতি আমাদের মমতা জাগে, কিন্তু লিয়র অথবা ও থেলো কিম্বা জ্যামলেটের প্রতি আমাদের অপরিসীম বিস্ময় ও শ্রদ্ধার মনোভাব জাগ্রত হয়। তাঁহাদের চরিত্রে যে বজ্রকঠোর দৃঢ়তা আছে, তাহা আমাদের মনকে অভিভূত করিয়া রাখে। নিকলের মন্তব্য Tragdy has for its aim not the arousing of pity but the conjuring up of a feeling of awe allied to lofty grandeur'
নবীনমাধব, নীলদর্পন নাটকের নায়ক। তাহার চরিত্রে নৈতিক গুণাবলীসমূ অপরাপর গুণের সহিত বর্তমান। তিন তী। অত্যাচারিত রাইয়তগণের পাশে তনি তাহাদের দুর্ভাগ্যে আগিয়া গাঁড়ান। তাহারার পঙ্গপালক নবীনমাধবকে অপরিসীম শ্রদ্ধা করে। ইচ্ছা করিলে তিনি তাহার নাম স্বরপুর ত্যাগ করিয়া ভিন্ন গ্রামে গেলে অনায়াসে নীলকরদের অত্যাচার হইতে রক্ষা পাইতেন। কিন্তু যেহেতু প্রঙ্গা-সাধারণের দুঃখ তিনি নিজের অন্তরে গ্রহণ করিয়াছেন, তদন্য তিনি গ্রাম ত্যাগ করেন নাই। সাধুচরণ ও তাহার ভ্রাতা রাইচরণকে উড সাহেব তাহাদের ফসলের জমিতে নীল বগনের জন্য পাগন গ্রহণের নির্মিত তাহাদের উপরে অত্যাচারে প্রবৃত্ত হইলে, নবীনমাধব তথায় উপস্থিত হন এবং উত্তকে তাহাদের মুক্ত করিয়া দিতে অনুরোধ করেন। উড তাঁহার প্রতি অশিষ্ট ব্যবহার করিলে নীলকরদের দেওয়ান গোপীনাথ, নবীনমাধবের অমর্যাদা সহ্য করিতে না পারিয়া তাঁহাকে গৃহে ফিরিয়া যাইতে অনুরোধ করেন। আবার তিনি ক্ষেত্রমণির উপরে সম্ভাব্য অত্যাচারের কথা শুনিয়া নির্ভীকচিত্তে তোরাপের সহায়তায় ক্ষেত্রমণিকে কামাসক্ত রোগের কুটির হইতে তাহাকে উদ্ধার করেন। উপরের দুই ঘটনা হইতে আমরা নবীনমাধবের মহানুভবতা, নির্ভীকতা এবং মানসিক দৃঢ় সংকল্পের পরিচয় পাই বটে, কিন্তু ট্রাজেডি নায়কের অনমনীয় মরণ পণ সংকল্পের দৃঢ়তার পরিচয় তাঁহার মধ্যে পাই না। বরং দেখিতে পাই তাঁহার চরিত্রে ধর্মভীরুতাহেতু দুর্বলতা। এই কারণে তিনি অত্যাচারের বিরদ্ধে কঠিন সংকল্প লইয়া দাঁড়াইতে পারেন নাই, অথবা প্রজা সাধারণের মধ্যে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়িয়া তুলিতে পারেন নাই। উড তাঁহাকে লাঞ্ছিত করিলে তিনি স্থান-কাল ভুলিয়া উডকে পদাঘাত করিয়াছেন এবং উড লাঠির আঘাতে তাঁহার মস্তক বিদীর্ণ করিয়াছে। এই ঘটনা নবীনমাধবের স্থির বিচারবুদ্ধির পরিচয় দেয় না। নাট্যপরিণাম তাই ট্রাজেডির সুউচ্চ মহিমা হইতে বিচ্যুত হইয়াছে। 'নাগিনীরা চারিদিকে ফেলিছে নিঃশ্বাস'; দানবদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের জন্য প্রাণশক্তিতে দুর্বার মানুষদের প্রতিরোধ গড়িয়া তুলিবার জন্য তিনি আহ্বান জানান নাই। কিন্তু ঘটনাবলীর পরিণাম যাহা সম্ভাব্য ও অপরিহার্য, সেই পথে না যাইয়া করুণ পরিণামে শেষ হইয়াছে। ফলে করুণরস নাটকের অঙ্গীরস হইয়া উঠিয়াছে। ইহা ট্রাজেডি হয় নাই।
নাটকের অন্তিম দৃশ্যে পরিলক্ষিত হয় মৃত্যুর সমারোহ। ইহা দর্শক ও পাঠক মনে কারুণ্যে ও বেদনায় অভিভূত করে। তথাপি মৃত্যুর দৃশ্য ঠিক সম্ভাব্য ও বিশ্বাস্য হইয়া উঠে নাই। আরিস্টটলের উক্তি এই প্রসঙ্গে স্মরণীয়। তিনি বলিয়াছেন 'A convincing impossibility is preferable to an unconvicing possibility. সুতরাং রসসৃষ্টির দিক হইতে এই নাটকের উপসংহার বিশ্বাস্য ও অপরিহার্য নহে। তবুও নবীনমাধবের আত্মদান একদিক হইতে বিবেচনা করিলে ব্যর্থ হইবার নহে, কারণ অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে সৎ জীবনকে আত্মদান করিতে হয়। ট্রাজেডির এই দিকটি এই নাটকে প্রদর্শিত হইয়াছে।
****তথ্যসংগ্রহ---****
(দীনবন্ধু মিত্রের নীলদর্পণ -এম এল সম্পাদিত)
0 মন্তব্যসমূহ