Hot Posts

6/recent/ticker-posts

চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত

 

((চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত

চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত কি

চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত কে প্রবর্তন করেন

দশসনা বন্দোবস্ত  পাঁচসনা বন্দোবস্ত 

চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বলতে কি বুঝ))) 

**বিঃদ্র-বাংলা বিভাগের সকল পড়াশোনা পেতে ব্লগটিতে যুক্তথাকুন https://monoweredu13.blogspot.com/?m=1 

চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত--১৭৫৭ সালে পলাশীর প্রান্তরে বাংলার স্বাধীনতার অস্তমিত হয়েছিল। সার্থ আর লোভের ফাঁদে পরে বাংলার রাজ পরিবার ভয়াবহ বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলো। আর তার মাশুল দিতে হয়েছিলো চরমভাবে। ১৭৬৯-৭০ সনের দুর্ভিক্ষের প্রচণ্ডতা ও সাধারণভাবে আইন-শৃঙ্খলা ও অর্থনীতির পতন দ্বৈত শাসনের ব্যর্থতা প্রমাণ করে। কোম্পানি বাহাদুরের প্রত্যয় হলো এইবার দায়িত্বহীন দ্বৈত শাসনের অবসান ঘটিয়ে নিজ হাতে দীউয়ানি শাসন গ্রহণ করা উচিত। ১৭৭২ সনে কোর্ট অব ডাইরেক্টরের আদেশ বলে নায়ের দীউয়ান রেজা খানকে অপসারিত করে কোম্পানির সরকার নিজ হাতে দীউয়ানির ভার গ্রহণ করে।

গভর্নর ওয়ারেন হেস্টিংসের উপর এমন একটি ভূমিব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করার দায়িত্ব পড়ে, যা দেশবাসী ও কোম্পানি উভয়ের জন্যই লাভজনক হবে। কিন্তু এহেন ভূমি ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে হেস্টিংসের সম্মুখে তিনটি বড় অসুবিধা ছিল। প্রথমত, দেশের গোটা সম্পদ সম্পর্কে ইতিপূর্বে কোনো জরিপ না হওয়ায় হেস্টিংস জানতেন না, কোন ভিত্তিতে তিনি রাজস্ব নির্ধারণ করবেন। পূর্বেকার রাজস্ব রেকর্ডকেও মান হিসাবে ধরা যায় না; কেননা পলাশীর পরে রাজস্ব শাসনে অব্যবস্থা ও মহাদুর্ভিক্ষে লোকক্ষতির দরুন ভূমি সম্পদে যে ঘাটতি দেখা দিয়েছে, তার কোনো সঠিক পরিসংখ্যান জ্ঞান না থাকায়, হেস্টিংসের পক্ষে রাজস্ব নির্ধারণের কোনো একটি গ্রহণযোগ্য ভিত্তি মেনে নেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। তাঁর দ্বিতীয় বড় অসুবিধা ছিল, রাজস্ব সংগ্রহ করার মাধ্যমে নির্ধারণ করা। কার মাধ্যমে কোম্পানি রাজস্ব সংগ্রহ করবে। কোম্পানির এত লোক নেই যে, প্রত্যেক এলাকায় নিজস্ব এজেন্ট নিয়োগ করে রায়তের নিকট থেকে রাজস্ব আদায় করবে। তাছাড়া ভাষা, স্থানীয় প্রথা, আচার, রীতিনীতি সম্পর্কে অজ্ঞতাও ছিল সীমাহীন। সরাসরি রাজস্ব সংগ্রহে প্রশাসনিক খরচও পড়ে অনেক। অতএব দেশীয় এজেন্সির মাধ্যমে রাজস্ব সংগ্রহ করাই উত্তম। এর মধ্যেই নিহিত ছিল হেস্টিংসের তৃতীয় অসুবিধা। কারা হবে এই দেশীয় এজেন্সি ? জমিদার ? ইজারাদার ? জমির সঙ্গে জমিদার বা ইজারাদারের সম্পর্ক কি হবে ? অর্থাৎ জমির মালিক কে ? সরকার, জমিদার ইজারাদার, না রায়ত ? যে-ই জমির মালিক হোক না কেন, রাজস্ব সংগ্রহকারী সঙ্গে রায়ত ও সরকারের সম্পর্কে কি হবে? তাদের পারস্পরিক দায় অধিকার কিভাবে এবং কোন ভিত্তিতে নির্ধারিত হবে?

ওয়ারেন হেস্টিংসের বুঝিতে দেরি হয়নি যে, এদেশের ভূমি ব্যবস্থা সম্পর্কে কোনো স্থায়ী সিদ্ধান্তে পৌঁছার আগে ভূমি রাজস্ব সম্পর্কে প্রচুর অভিজ্ঞতা লাভ করতে হবে। সেই অভিজ্ঞতা লাভ না হওয়া পর্যন্ত তিনি সাময়িক স্বল্পমেয়াদি ভূমি বন্দোবস্ত নীতি অবলম্বন করার পক্ষপাতিত্ব প্রকাশ করেন। তাঁর নিকট সর্বপ্রথম সমস্যা ছিল দেশের সম্পদ সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করা এবং সেই সম্পদ অনুযায়ী ভূমিরাজস্ব স্থির করা। কোম্পানির সরকার মনে করেন যে, জমিদার তালুকদারগণ কোনো অবস্থাতেই সঠিক তথ্য পরিবেশন করবে না, তারা আপ্রাণ চেষ্টা করবে দুর্ভিক্ষজনিত ক্ষতির অজুহাতে জমির প্রকৃত মূল্য গোপন করতে এবং সম্পদের তুলনায় অনেক কম রাজস্ব বন্দোবস্ত আদায় করতে। জমিদারগণ যেন তা না করতে পারে, সেই জন্য হেস্টিংস পাঁচ বৎসরের জন্য জমি নিলামের মাধ্যমে ইজারা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। নিলামে যারা সর্বোচ্চ ডাক দেবে, তাদের সঙ্গেই জমি পাঁচ বৎসরের মেয়াদে বন্দোবস্ত করা হবে। সরকারের ধারণা হলো যে, সম্পদের সর্বোচ্চ সীমা অতিক্রম না করা পর্যন্ত জমিদার চেষ্টা করবে জমিদারি নিজের দখলে রাখার জন্য। এমনিভাবে জমির আসল মূল্য প্রকাশ হয়ে পড়বে।


কিন্তু ফল হলো অন্যরূপ। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ধনী ফটকাবাজেরা জমিদারদের চেয়ে বেশি নিলাম ডেকে পঞ্চসনা ইজারা লাভ করে। অধিকাংশ জমিদার জমির পরিচালনা থেকে বঞ্চিত হয়ে পেনশনভোগী শ্রেণীতে পরিণত হয়। পাঁচ বৎসর অতিক্রান্ত হওয়ার কিছু পূর্বে হেস্টিংস পঞ্চসন। বন্দোবস্তের প্রতিক্রিয়া কি তা জানতে চেষ্টা করেন। পঞ্চসনা বন্দোবস্ত পরিচালনার জন্য পাঁচটি প্রাদেশিক কাউন্সিল গঠন করা হয়েছিল। ঐসব প্রাদেশিক কাউন্সিলকে পঞ্চসনা বন্দোবস্তের প্রতিক্রিয়া জানাতে বলা হলো। তাদের রির্পোটে জানা যায় যে, পঞ্চসনা বন্দোবস্ত সারাদেশে অত্যাচার উৎপীড়নের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বেশির ভাগ ইজারাদারই সম্পদতিরিক্ত নিলাম ডাকে। অতিরিক্ত রাজস্ব সংগ্রহ করতে তারা অমানুষিক অত্যাচার-উৎপীড়ন শুরু করে। তাদের অত্যাচারে অনেক রায়ত বাড়িঘর ছেড়ে পলায়ন করে। ঢাকা প্রাদেশিক কাউন্সিলের প্রধান রিচার্ড বারওয়েল রিপোর্ট দেন (১লা ফেব্রুয়ারি, ১৭৭৫), "দীওয়ানি লাভের পর থেকে, বিশেষ করে ১৭৭২ সালের ইজারাদারি বন্দোবস্তের পর থেকে দেশের কৃষি ও কৃষক সম্প্রদায় সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। সব প্রাদেশিক কাউন্সিলই অনুরূপ মত প্রকাশ করে। হেস্টিংস নিজে স্বীকার করেন যে, পঞ্চসনা বন্দোবস্তের ফলে দেশের কৃষি শিল্পের সমূহ ক্ষতি হয়েছে। ১৭৭৫ সনের ৮ই মার্চ তারিখে তিনি এক মিন্যুটে লেখেন, "১৭৭২ সালে দেশের রাজস্ব সম্পর্কে কোম্পানির জ্ঞান এত সীমিত ছিল যে, নিলামি বন্দোবস্ত ছাড়া উপায় ছিল না। জমির মূল্য শুধু জমিদারেরাই জানতেন। তাঁরা সরকারের নিকট তাঁদের সম্পত্তির প্রকৃত মূল্য ফাঁস করে দেবেন, এমন আশা করা বাতুলতা। তাদের অধীনস্থ জমির সত্যিকারের মূল্য যাচাই করার একমাত্র উপায় ছিল, জমি নিলামে বন্দোবস্ত করা। কিন্তু বিপদ হলো, এই যে, এই ব্যবস্থার ফলে ফটকাবাজদের মধ্যে এমন জোর প্রতিযোগিতা হয়েছে যে, অনেক স্কুলেই জমির আসল মূল্যের অনেক অধিক ডাকা হয়েছে। ফলে কৃষকের উপরনিদারুণ চাপ পড়েছে।" জমি ও কৃষকের সঙ্গে ইজারাদারদের কোনো স্থায়ী স্বার্থ ও সম্পর্ক ছিল না। অতএব, ইজারার মেয়াদ যতই ঘনিয়ে আসে, ততই ইজারাদারগণ তাদের শোষণ প্রক্রিয়া এঁটে আনে। তাদের স্বাভাবিক ভয় ছিল যে, মেয়াদ ফুরিয়ে গেলে তাদের পক্ষে বকেয়া রাজস্ব সংগ্রহ করা সম্ভব হবে না।

 ১৭৮৪ সনের পিটস ইন্ডিয়া বিল আলোচনায় ইজারাদারি বন্দোবস্তের প্রতিক্রিয়া আলোচনা করা হয়। পিটস ইন্ডিয়া আইনে শুধুমাত্র জমিদারদের সঙ্গে ভূমি বন্দোবস্ত করার সুপারিশ করে। একটি স্থায়ী ভূমিব্যবস্থা প্রবর্তন করে এর বাস্তবায়নের জন্য চিরস্থায়ী আইন-কানুন প্রয়ণন করার জন্যও পিটস ইন্ডিয়া আইন কলকাতার কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেয়।চিরস্থায়ী আইন প্রণয়নের সুনির্দিষ্ট আদেশ নিয়ে লর্ড কর্নওয়ালিস ১৭৮৬ সনে গভর্নর। জেনারেল হয়ে আসেন। কর্নওয়ালিস নিজে ছিলেন একজন ভূম্যধিকারী। বৃটিশ পার্লামেন্টেও ছিল ভূম্যধিকারীদের আধিপত্য। কলকাতা ও বৃটিশ সরকার উভয়ই বাংলাদেশের বিদ্যমান জমিদার শ্রেণীকে বৃটিশ ভূম্যধিকারী সমাজের সমজাতীয় মনে করলেন। কিন্তু বস্তুতপক্ষে বাংলাদেশের জমিদার শ্রেণী ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের। মুঘল আমলে জমিদার ছিল সরকারি রাজস্বের সরকারি সংগ্রাহক। রায়তেরা নির্দিষ্ট হারে রাজস্ব দিত। সেই রাজস্ব সংগ্রহ করার জন্য সরকার বংশানু ক্রমিক জমিদার নিযুক্ত করতেন।

বংশানুক্রমিক স্থানীয় প্রতিনিধি। রায়তের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক ছিল প্রথা ও সামাজিক নিয়মের উপর নির্জাশীল।


হেস্টিংসের আমলে মুঘল ভূমিব্যবস্থা পরিহার করে পঞ্চসনা ও পরে বাৎসরিক মেয়াদে রাজস্ব বন্দোবস্ত প্রচলন করাতে সরকার ও রায়ত উভয়েরই ক্ষতি হয়েছে। ১৭৮৪ সনের আইন মোতাবেক কর্নওয়ালিস চাইলেন ভূমিব্যবস্থার চিরস্থায়ী আইন প্রণয়ন করতে। কিন্তু চিরস্থায়ী আইন প্রণয়নের নামে কর্নওয়ালিস যে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করেন, তা মুঘল আইন বা পিটের আইন কোনোটার মধ্যেই পড়ে না। তিনি যে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করেন, তা ছিল সম্পূর্ণ বৃটিশ মডেলের। ১৭৯৩ সনে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করার আগে তিনি ১৭৮৯-৯০ সনে জমিদারদের সঙ্গে একটি দশসনা বন্দোবস্ত করেন এবং ঘোষণা করেন। যে, তাঁর চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত পরিকল্পনা কোর্ট অব ডাইরেক্টার অনুমোদন করলে এই দশসনা বন্দোবস্তকেই তিনি চিরস্থায়ী বলে ঘোষণা করবেন। কোর্ট অব ডাইরেক্টার তাঁর পরিকল্পনা অনুমোদন করে ১৭৯২ সনে। ১৭৯৩ সনের মার্চ মাসে কর্নওয়ালিস চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ঘোষণা করেন। এর অর্থ এই যে, এখন থেকে জমির একচেটিয়া মালিক হবে জমিদার। রায়তগণ হবে তাদের প্রজা। মালিক হিসাবে জমিদার জমি বিক্রয় করতে, দান করতে বা যে কোনো কার্যে ব্যবহার করতে পারবে, সরকারের পূর্বসম্মতি নিতে হবে না। এজার সঙ্গে তাদের দায়-অধিকার নির্ধারণেও সরকারের কোনো সম্মতি নিতে হবে না। সর্বোপরি দশসনা বন্দোবস্তকালে যে রাজস্ব ধার্য হয়েছে, ভবিষ্যতে তার আর পরিবর্তন হবে না। চিরকালের জন্য তা স্থির বলে গৃহীত হবে। তবে শর্ত হলো এই যে, এখন থেকে জমিদারদের রাজস্ব কিস্তি নিয়মিত শোধ করতে হবে, নচেৎ জমি নিলামে বিক্রি করে বকেয়া রাজস্ব আদায় করা হবে। আঞ্চলিক অভিজাত শ্রেণী হিসেবে আগে জমিদারদের হাতে যে বিচার ও পুলিশ ক্ষমতা ছিল, তা এখন আর থাকবে না। সায়ের বা শুল্ক আদায়ের ক্ষমতা থেকেও জমিদার বঞ্চিত হলো। অর্থাৎ পূর্বের সামত্ত ক্ষমতা থেকে তাদের সম্পূর্ণভাবে বঞ্চিত করা হলো।

চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের উদ্দেশ্য কি ছিল ? ১৭৭২ সনের পর থেকেই চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের আলোচনা শুরু হয়। এর পক্ষে যুক্তি ছিল এই যে, ভূমি ব্যবস্থায় স্থায়িত্ব এলে জমিদারগণ ভূমিতে পুঁজি বিনিয়োগ করবেন। নিজের স্বার্থেই জমিদার তার উদ্বৃত্ত অর্থ জমির উন্নয়নে ব্যবহার করবেন। তার ফলে জমি উন্নত হবে, কৃষি শিল্পে উৎপাদন বাড়বে, দেশের অর্থনীতি সমৃদ্ধিশালী হবে। ইংল্যান্ডে যেমন ভূম্যধিকারী সমাজ কৃষি শিল্পে বিপ্লব আনয়ন করেছে, তেমনি বাংলাদেশেও জমিদারদের নেতৃত্বে কৃষিবিপ্লব হবে। তাছাড়া, জমিদার সমাজ শত সুবিধার বিনিময়ে সরকারের অনুগত থাকবে। সামাজিক শাসক হিসেবে এমনিভাবে জমিদার শ্রেণী হবে ভারতে বৃটিশ সাম্রাজ্যের রাজনৈতিক ভিত্তি।পাঁচসনা, একসনা দশসনা ও পরে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে দেশের সুমাজবিন্যাসে, বিশেষভাবে ভূমাধিকারী সমাজে যে পরিবর্তন এসেছে, তার সামান্য আলোচনা প্রয়োজন। পাঁচসনা ইজারাদারি বন্দোবস্তের ফলে অধিকাংশ জমিদার তাদের জমিদারি ব্যবস্থাপনা থেকে বঞ্চিত হয় এবং তাদের স্থান দখল করে নূতন পুঁজিপতি, যাদের ইতিপূর্বে ভূমির সঙ্গে সম্পর্ক ছিল না। কোম্পানির কর্মচারী, মুৎসুদ্দি, বেনেরা তাদের প্রভাব লাভ করে ইজারা লাভ করে। উচ্চপদস্থ কর্মচারীরা তাদের ব্যক্তিগত বেনেদের নামে বেনামি ইজারা লাভ করে। এমনকি গভর্নর জেনারেল হেস্টিংস পর্যন্ত ব্যক্তিগত বেনেদের নামে লক্ষ লক্ষ টাকার ইজারা গ্রহণ করেন। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ভূমিতে বেনে-মুৎসুদ্দির অনুপ্রবেশ এদেশের সামাজিক ইতিহাসে এক নূতন যুগের সূত্রপাত করে। এই বেনে-মুৎসুদ্দি শ্রেণীই ধীরে ধীরে স্থায়ী ভূদাধিকারী শ্রেণীতে পরিণত হয় এবং আধুনিক বাংলায় প্রথম কাতারের মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সম্মান ও শক্তি লাভ করে।

চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পর ভূমাধিকারী সমাজে অভূতপূর্ব পরিবর্তন আসে। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত কোনো জরিপের উপর ভিত্তি করে সম্পন্ন হয়নি। ফলে অনেক জমিদারিতে সম্পদাতিরিক্ত রাজস্ব ধার্য করা হয়, আবার অনেক জমিদারিতে সম্পদের চেয়ে অনেক কম রাজস্ব ধার্য করা হয়। ফলে অধিক রাজস্ব জর্জরিত জমিদারিগুলি অল্পকালের মধ্যে সূর্যাস্ত আইনে নিলামে বিক্রি হয়ে যায়। বাংলার বড় বড় জমিদারিগুলিই সাধারণত সূর্যাস্ত আইনের শিকার হয়। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তকালে দেশের গোটা রাজস্বের প্রায় অর্ধেক রাজস্ব দিত ছয়টি বড় জমিদারি। এগুলো হচ্ছে বর্ধমানের জমিদারি, নাটোরের জমিদারি, দিনাজপুরের জমিদারি, নদীয়ার জমিদারি, বীরভূমের জমিদারি ও বিষ্ণুপুরের জমিদারি। এই সব বিশালাকার জমিদারদের মুঘল সরকার রাজা, মুহারাজা উপাধি দেন। এই সব রাজাদের মধ্যে একমাত্র বর্ধমানের রাজা ছাড়া বাকি সব কয়টি রাজাই চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রথম সাত বছরের মধ্যেই সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস হয়ে যান। পরবর্তীকালে জমিদার হিসেবে তাদের যে সত্তা থাকে, তা পূর্ব আয়তনের ছায়া মাত্র। এইসব মহাজমিদারিগুলি যাদের কাছে হস্তান্তরিত হয়, তাদের বেশির ভাগই ছিল সরকার ও জমিদারের কর্মচারী বেনে মুৎসুদ্দি, ব্যবসায়ী, মহাজন ইত্যাদি। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পরে যেনব বড় বড় নূতন জমিদার পরিবারের আবির্ভাব হয়, তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কাশিমবাজার জমিদারি। এর প্রতিষ্ঠাতা কান্তবাবু ছিলেন গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংসের ব্যক্তিগত বেনে: মুর্শিদাবাদের কান্দির জমিদারি, এর প্রতিষ্ঠাতা গঙ্গা-গোবিন্দ সিং ছিলেন হেস্টিংসের মুত্সুন্দি। নড়াইলের (যশোহর) জমিদারি, এর প্রতিষ্ঠাতা রামকৃষ্ণ রায় ছিলেন নাটোর জমিদারির প্রধান গোমস্তা; কলকাতায় ঠাকুর জমিদারি, এর প্রতিষ্ঠাতা গোপীনাথ ঠাকুর ও দ্বারকনাথ ঠাকুর ছিলেন প্রথমে সরকারি কর্মচারী ও পরে ব্যবসায়ী; ঢাকার খাজা পরিবার, এর প্রতিষ্ঠাতা খাজা আলিমুল্লা (নবাব আবদুল গনির পিতা) ছিলেন ব্যবসায়ী। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের বদৌলতে আবির্ভূত এই সব প্রকাও নতুন জমিদারেরা প্রত্যেকেই পরবর্তীকালে রাজা, মহারাজা বা নবাব উপাধি প্রাপ্ত হন।

উইলিয়াম হান্টারের অনুসরণে অনেকে মনে করেন যে, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে মুসলমান জমিদার সব ধ্বংস হয়ে যায়, এবং তাদের স্থান দখল করেন নব্য হিন্দু পুঁজিপতি। এই ধারণার ঐতিহাসিক যৌক্তিকতা নেই। মুঘল আমল থেকে ভূমি প্রশাসনে হিন্দুদের 

ছিল একচেটিয়া আধিপত্য, আর মুসলমানদের ছিল বিচার বিভাগে। চিরস্থায়ী বন্দোস্তকালে ছয়টি বৃহৎ জমিদারির মধ্যে একমাত্র বীরভূমের রাজা ছিলেন মুসলমান, বাকি সবাই হিন্দু। ক্ষুদ্র জমিদারদের মধ্যেও বেশির ভাগ ছিলেন হিন্দু। যে যৎসামান্য জমিদার ছিলেন মুসলমান, তাদের বেশির ভাগই ছিলেন অতি ক্ষুদ্র এবং ক্ষুদ্র জমিদারগণ সূর্যাস্ত আইনে খুব কমই ক্ষতিগ্রস্ত হন।


চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে ভূম্যধিকারী সমাজের গঠন ও মানসিকতায় যে পরিবর্তন আসে, তার একটি বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, জমিদারদের অনুপস্থিতি ও পর্যায়ক্রমে মধ্যস্বত্ব সৃষ্টি। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রথম দশ বৎসরের মধ্যেই বাংলার প্রায় অর্ধেক রাজস্ব-ভূমি নতুন জমিদারদের হস্তগত হয়। এইসব নতুন জমিদারদের অনেকেই শহরে বসবাস করে। গুরাতন ব্যবসায় লিপ্ত থাকে। জমিদারিকার্য পরিচালিত হয় স্থানীয় য়েব গোমস্তা কর্তৃক। জমিদারি পরিচালনার ঝামেলা এড়ানোর জন্য অধিকাংশ অনুপস্থিত নব্য জমিদার নানা রকমের মধ্যস্বত্ব প্রথা সৃষ্টি করে। মধ্যস্বত্বভোগী শ্রেণীর উদ্ভূত বাংলার গ্রামীণ সমাজের এক নতুন সমস্যা। কৃষকের সঙ্গে জমিদারের সরাসরি সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়। শুধু জমিদারের সঙ্গেই সম্পর্ক ছিন্ন হয়নি। মধ্যস্বত্বভোগীদেরও অনেকে পাতি মধ্যস্বত্ব সৃষ্ট করে নিজে অনুপস্থিত হয়ে যায়। এমনিভাবে কৃষক ও জমিদারদের মধ্যে মধ্যস্বত্ব শ্রেণীর কয়েকটি স্তর সৃষ্টি হয়।সমাজবিন্যাসে সৃষ্টি হয় নতুন স্তর, নতুন সমস্যা। এককথায় বৃটিশ শাসনের ভূমি ব্যবস্থার ফলে প্রচলিত ভূম্যধিকারী সমাজে যে অভূতপূর্ব পরিবর্তন দেখা দেয়, তার প্রতিক্রিয়া শুধু ভূপতিদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। উৎপাদন ক্ষেত্রে, সমাজবিন্যাসে, আচার-উৎসব ও চিন্তাধারায় সর্বত্র অনুভূত হয় বৃটিশ ভূমিব্যবস্থার সুদূরপ্রসারী প্রভাব।

চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে রায়ত ভূমিতে তার স্বত্ব হারায়। মুঘল আমলে যারা ছিল খোদখাসূতা বা স্থায়ী আবাসিক রায়ত, ভূমিতে তাদের স্থায়ী অধিকার ছিল। কিন্তু চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের আইনে জমিদার হয় জমির একমাত্র মালিক এবং রায়ত পরিণত হয় জমিদারের ইচ্ছাধীন প্রজায়। মুঘল শাসনতন্ত্রে জমিদারের পক্ষে খাজনা বৃদ্ধি করা বা রায়তকে তার জমি থেকে উৎখাত করা ছিল প্রায় অসম্ভব। প্রত্যেক পরগনার জন্য ভূমির গুণ অনুযায়ী খাজনার হার নির্দিষ্ট করা ছিল। সেই নির্দিষ্ট হার ছিল পরগনা নিরিখ নামে পরিচিত। পরগনা নিরিখের অতিরিক্ত খাজনা ধার্য করা জমিদারের পক্ষে ছিল কঠিন। কিন্তু চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত জমিদারকে জমির একমাত্র মালিক বলে ঘোষণা করে এবং ইচ্ছামত খাজনা বৃদ্ধি করার ক্ষমতা জমিদার লাভ করে। জমি এখন জমিদারের ব্যক্তিগত সম্পত্তি। পূর্বেকার স্বত্বাধিকারী রায়ত এখন জমিদারের ইচ্ছাধীন প্রজা। ঊনবিংশ শতকের শুরু থেকে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। ফলে জমির উপরে জনসংখ্যার চাপ বৃদ্ধি পায়। এই সুযোগে জমিদারগণ ইচ্ছামতো খাজনা বৃদ্ধি করতে থাকে। মাটিতে প্রজাদের অধিকার না থাকায় জমিদারের বর্ধিত খাজনা মেনে নিতে তারা বাধ্য হয়। যারা বর্ধিত

খাজনা দিতে আপত্তি করে তাদের উপর চলে নির্মম নির্যাতন ও নিষ্পেষণ। ঊনবিংশ শতকের তিন দশক পরে যে, দেশময় কৃষক অসন্তোষ দেখা দেয়, তা জমিদার শ্রেণী কর্তৃক অত্যাচার ও শোষণ প্রক্রিয়ারই ফল।


অনেকে মনে করেন যে, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে দেশের কৃষির সম্প্রসারণ ঘটে। তাদের মতে জমিদার কর্তৃক দেয় সরকারি রাজস্ব যেহেতু ছিল চিরস্থায়ী ও অপরিবর্তনীয়, আর যেহেতু সরকারি রাজস্বের উপরে সমস্ত আয়ের অধিকারী ছিল জমিদার একা, সেহেতু জমিদারগণ অর্থনৈতিক কারণেই কৃষির সম্প্রসারণ করে আয় বৃদ্ধি করার চেষ্টা করে। পতিত ও পারিপার্শ্বিক অরণ্য আবাদ করার চেষ্টা করে। এ কথা ঠিক যে, ঊনবিংশ শতকে কৃষির যথেষ্ট সম্প্রসারণ ঘটে। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সময়ে বাংলার প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ জমি জঙ্গলাকীর্ণ ছিল বলে কর্তৃপক্ষ মনে করে। কিন্তু ঊনবিংশ শতকের তৃতীয় দশক নাগাদ এই অনাবাদ জঙ্গল পরিবেশ আমরা লক্ষ্য করি না। এর কারণ কৃষির ব্যাপক সম্প্রসারণ। এই সময়ে নানা রকম অর্থকরী ফসল (যথা—রেশম, নীল, পাট, ইক্ষু, তামাক, চা প্রভৃতি) ব্যাপক বৃদ্ধি পায়। অনস্বীকার্য যে, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পর কৃষির যথেষ্ট সম্প্রসারণ ঘটে। কিন্তু এর কারণ কি জমিদারদের সক্রিয় প্রচেষ্টা না জনসংখ্যা বৃদ্ধি ? সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা যায় যে, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পর কৃষির সম্প্রসারণ ঘটেছে যথেষ্ট, কিন্তু উন্নতি হয়নি। কৃষির উন্নতি ও কৃষির সম্প্রসারণ এক কথা নয়। কৃষির কৌশল ও পদ্ধতিগত পরিবর্তন সাধন করে সমপরিমাণ জমিতে অধিক পরিমাণ ফসল ফলানো এবং উদ্বৃত্ত ফসল লাভজনকভাবে বাজারজাত করার ব্যবস্থাকে বলা যায় কৃষির উন্নতি, আর চিরাচরিত কৃষি কৌশলের অধীনে জনসংখ্যার বৃদ্ধির ফলে যে পতিত জমি আবাদ করা হয়, তা হচ্ছে কৃষির সম্প্রসারণ। সেই সম্প্রসারণে কৃষকের অর্থনীতির কোনো পরিবর্তন ঘটে না। সম্প্রসারণের ফলে বাড়তি ফসল বাড়তি মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে মাত্র। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে কৃষির উন্নতি হয়নি, কৃষির সম্প্রসারণ হয়। এই সম্প্রসারণের জন্য দায়ী বাড়তি লোকসংখ্যা, জমিদারের সক্রিয় প্রচেষ্টা নয়।

***তথ্যসংগ্রহ***

*(বাংলাদেশের ইতিহাস

ডঃ মুহম্মদ আবদুর রহিম ডঃ আবদুর মমিন চৌধুরী ডঃ এ. বি. এম. মাহমুদ ডঃ সিরাজুল ইসলাম)

**পলাশি থেকে পার্টিশন, আধুনিক  ভারতের ইতিহাস--শেখর বন্দ্যোপাধ্যায়))

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ