--ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ
মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার
উইলিয়াম কেরি
ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ কেন প্রতিষ্ঠা করা হয়
ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ এর শিক্ষক কে ছিলেন-
**বিঃদ্র-বাংলা বিভাগের সকল পড়াশোনা পেতে ব্লগটিতে যুক্তথাকুন https://monoweredu13.blogspot.com/?m=1
---বাংলা গদ্যের বিবর্তনের সঙ্গে ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের কিসের যোগাযোগ, প্রথমেই জিজ্ঞাস, ব্যক্তির মনে এই প্রশ্ন জাগতে পারে। লর্ড ওয়েলেসলি ভারতের গভর্ণর জেনারেল হয়ে এসে লক্ষ্য করলেন, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর কর্ম নির্বাহ করবার জন্য এবং দেশীয় শাসন চালানোর জন্য বিলেত থেকে যে সমস্ত 'আহেলা' সিভিলিয়ান কর্মচারীরা আসতেন, বয়সে তাঁরা ছিলেন অতি নবীন, প্রায় বালখিলা বলা যেতে পারে। তাঁরা বিলেত থেকে যখন আসতেন তখন নিজেদের ভাষাও ভালো করে শিখতেন না!! যে-দেশ শাসন করবার জন্য তাঁরা প্রেরিত হতেন, সে দেশ সম্বন্ধেও তাঁরা ছিলেন সম্পূর্ণ অজ্ঞ। তাই সংশাসনের জন্য ওয়েলেসলি মনে করলেন এদেশে এমন একটি কলেজ প্রতিষ্ঠিত। হওয়া দরকার যেখানে তরুণ সিভিলিয়ানেরা পড়াশুনা করে এদেশের ভাষা, সাহিত্য, ভূগোল, ইতিহাস, আইনকান প্রভৃতি শিখবেন। এর জন্য ১৮০০ সালে কলকাতা লালবাজারের কাছে ফোর্ট উইলিয়ম কলেজ প্রতিষ্ঠা করলেন। অবশ্য এর সঙ্গে বাঙালীর যোগ ছিল না—কিন্তু বাংলা সাহিত্যের, বিশেষতঃ গদ্যসাহিত্যের যোগ ছিল।এই কলেজে বিভিন্ন প্রদেশের আধুনিক ভাষা এবং পুরাতন যুগের সংস্কৃত, উর্দু, ফারসী প্রভৃতিরও শেখার ব্যবস্থা করা হল। অন্যান্য ভাষা বিভাগে একাধিক অধ্যাপক নিযুক্ত হলেন। কিন্তু বাংলা সংস্কৃত-মারাঠী বিভাগের ভার নেবেন কে? এই সময়ে বাইবেলের অনুবাদে হস্তক্ষেপ করে। ফেনী শাসকমহলে পরিচিত হয়েছিলেন। সুতরাং বাংলা, মারাঠী ও সংস্কৃতের সমস্ত ভার তাঁর ওপর অর্পিত হল। তখন তিনি উক্ত তিন ভাষার বিভাগীয় প্রধান হয়ে দেশীয় অধ্যাপক নিত্ত করতে লাগলেন। আমরা এখানে শব্দে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে বাংলা পড়ানো এবং তার জন্য বাংলা গ্রন্থ প্রকাশের ইতিহাসই আলোচনা করব।
ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ ১৮৫৪ সাল পর্যন্ত চাল, থাকলেও ১৮১৫ গ্রাম অব্দের পর বাংলা সাহিত্যে এর প্রভাব খর্ব হতে আরম্ভ করে। কারণ এই সময়ে রামমোহন রায় কলকাতায় স্থায়িভাবে বসবাস করতে আসেন। বাংলা সাহিত্যের উন্নতিসাধনে সচেষ্ট হন এবং নানারূপ প্রগতিশীল আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। রামমোহনের প্রভাবের জন্যই ক্রমে ক্রমে ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের বাংলা বিভাগের মহিমা হ্রাস পায়। তা ছাড়া বিলাতেই কলেজ স্থাপন করে (হেলিবেরি) সেখানে নবনিযুক্ত তরুণ সিভিলিয়ানদের পড়াবার ব্যবস্থা করা হয়।ফোর্ট উইলিয়ম কলেজে বাংলা পড়াতে গিয়ে বিদেশীদের সহজে বাংলা ভাষা শেখাবার জন্য কেরাঁ খুব চিন্তিত হলেন। তিনি দেখলেন সহজ বাংলায় লেখা গদ্য গ্রন্থ প্রকাশিত না হলে বিদেশীকে বাংলা শেখানো অত্যন্ত দুরূহ। তখনও কোন গদ্যগ্রন্থের পথি তাঁর হাতে আসেনি। তাই তিনি নিজে বাংলা গদ্যে বই লিখলেন, এবং বাঙালী অধ্যাপক ও অন্যান্য পণ্ডিতদের দিয়ে লিখিয়েও নিলেন। পণ্ডিত ও লেখকদের উৎসাহ দেবার জন্য তিনি কলেজ কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে পণ্ডিত-মন্দীদের জন্য অনেক পুরস্কার ও অন্যান্য নানাধরনের সহায়তা চেয়ে নিলেন। তাঁর অধীন অধ্যাপকমণ্ডলী এবং বাইরের কেউ কেউ তাঁর নির্দেশে অনেকগুলি বাংলা গদ্যগ্রন্থ লিখেছিলেন—অবশ্য প্রায় সবগুলি সংস্কৃত, ইংরেজী ও ফারসী থেকে অনূদিত এবং অধিকাংশ পুস্তিকা রুপকাহিনীমূলক। ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের জন্য রচিত ও প্রকাশিত পুস্তিকাগুলির সঙ্গে সে যুগের বাঙালীর অল্পস্বল্প পরিচয় থাকতে পারে। কিন্তু এই সমস্ত গ্রন্থকে খ্রীষ্টানী ব্যাপার বলে অনেকেই এর থেকে দূরে দূরে থাকতেন। রচনার দিক দিয়ে একমাত্র মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কারই কিয়ৎপরিমাণে প্রশংসার যোগ্য। অন্য লেখকদের পুস্তিকাগুলির ভাষা এত অনভ্যস্ত ও জড়তাপূর্ণ যে, সাধারণ পাঠকসমাজে এ সমস্ত দস্তিকার বিশেষ চলন ছিল না।কেরীসাহেব নিম্নলিখিত পণ্ডিত ও মুন্সীদের সাহায্যে অনেক গদ্য পুস্তিকা রচনা করিয়ে নিয়েছিলেন। (১) গোলোকনাথ শর্মা (হিতোপদেশ ১৮০২ সালে প্রকাশিত), (২) তারিণচিরণ মিঠ (ওরিয়েন্টাল ফেলিস্ট -ঈশপস্ ফেবসের অনুবাদ-১৮০৩), (৩) রাজীবলোচন মুখোপাধ্যায় (মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রায়স্য চরিতং-১৮০৫) (8) চণ্ডীচরণ মুন্সী (তোতা ইতিহাস–তুতিনামা নামক ফারসী গ্রন্থের বল্গানবাদ-১৮০৫), (৫) রামকিশোর তর্ক'চূড়মণির 'হিতোপদেশ' (১৮০৮ সালে রচিত, কিন্তু পাওয়া যায়), (৬) হরপ্রসাদ রায় (পুরুষপরীক্ষা, বিদ্যাপতির ঐ নামের সংস্কৃত গ্রন্থের অনুবাদ –১৮১৫), (৭) কাশীনাথ তর্ক পঞ্চানন (পদার্থতত্ত্ব-কৌমুদী-১৮২১,আত্মতত্ত্বকৌমুদী–১৮২২)। এ ছাড়াও বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হবে (৮) রামরাম / (৯) মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার এবং (0) সাহেবের।
রামরাম বস, একটি বিচিত্র চরিত্র। তাঁর সম্বন্ধে অনেক গল্পকাহিনী প্রচলিত আছে। কেরী ও টমাসকে খ্রীস্টান হবার আশা দিয়ে, এমন কি কবিতায় খ্রীষ্টস্তুতি লিখেও তিনি কোনদিন স্বধর্ম ত্যাগ করেননি। কেরী সাহেবর তিনি বাংলা শিখিয়েছিলেন। প্রায় সারা জীবন তিনি কেরী ও শ্রীরামপুর মিশনের অনূর্গত ছিলেন। তাঁর লেখা দু'খানা গদ্যগ্রন্থ 'রাজা প্রতাপাদি চরি' (১৮০১) ও লিপিমালা' (১৮০২) এখানে উল্লেখযোগ্য। রাজ প্রতাপাদিত্য চরিত্র বাঙালীর লেখা প্রথম মুদ্রিত গদ্যগ্রন্থ।
ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের প্রসিদ্ধ পণ্ডিত, বাংলাদেশের একজন স্মরণীয় চরিত্র মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কারের কথা এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করা প্রয়োজন। তাঁর প্রতিভা, চরিত্র, সমাজনেতৃত্ব প্রভৃতি এখানে আলোচনার প্রয়োজন নেই। শব্দ এইটুকু মনে রাখলেই যথেষ্ট হবে যে, মার্শম্যান প্রভৃতি মিশনারীর দল তাঁর পায়ের কাছে বসে সংস্কৃত শিক্ষা করেছিলেন, রামমোহনের যুগে রাম মোহনের প্রতিবাদ করেও তিনি কোন কোন বিষয়ে উদার ও যুক্তিপূর্ণ পন্থা অবলম্বন করেছিলেন- যদিও তিনি ইংরেজী জানতেন না। ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের প্রধান পণ্ডিতের পদ লাভ করে, উপযুক্ত কৃতিত্বের পরিচয় দিয়ে এবং নানাভাবে বিচার বিভাগকে সাহায্য করে, পুরাতন স্কুলের' লোক হয়েও তিনি আধুনিক কর্মকুশলতায় অসাধারণ কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। কিন্তু সে সকল ছেড়ে দিলেও গদ্যসাহিত্য ও রীতির বিবর্তনে তাঁর নাম চিরস্মরণীয় হয়ে আছে।ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের ছাত্রদের অধ্যয়নের জন্য মৃত্যুঞ্জয় বরিশ সিংহাসন' (১৮০২), 'হিতোপদেশ' (১৮০৮), 'রাজাবলি' (১৮০৮) 'প্রবোধ চন্দ্রিকা' (রচনাকাল—আননুমানিক ১৮১৩, মুদ্রিত ১৮৩৩) এই ক'খানি গদ্যপুস্তিকা রচনা করেন। রামমোহনের বেদান্ত তত্ত্বের বিরুদ্ধে লেখা পুস্তিকাও তাঁর রচনা বলে মনে হয়। 'বত্রিশ সিংহাসন' ও 'হিতোপদেশ' সংস্কৃত কাহিনীর সরল অথচ গম্ভীর রূপান্তর। 'রাজাবলি’ বাঙালীর রচিত প্রথম ইতিহাস। “প্রবোধচন্দ্রিকা’য় নানাবিধ তত্ত্বকথা, ভাষারীতি, ন্যায়, দর্শন প্রভৃতি বর্ণিত হয়েছে। এই গ্রন্থটি পরবর্তী কালে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো হত বলে অধিকতর জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল।ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের গণ্ডিত-সূন্সী ও কেরী সাহেবের গদ্য স্বাস্থ প্রধানতঃ লেখা হয়েছিল বিলিতি সিভিলিয়ান কর্মচারীদের বাঙ্গা শেখাবার জন্য। বিদেশী ছাবেরা কেরী ও বাঙালী অধ্যাপকসের কাছে দিনের মধ্যেই ভাল বাংলা শিখতেন। কেউ কেউ সদর বাংলা বক্তৃতা করে পারতেন একটা দৃষ্টান্ত: "অনেক লোকের অননুমান যে আসীয়ারদের পি ইয়রোপীয়দের মত নহে। তল্লিমিয় তাহারা ইহারদের মতো নীতিজ্ঞ হইে পারিবে না এই দুই এক বাক্য হইতে উৎপন্ন...।" কলেজের পরীক্ষায় তাঁদে বাংলাতেই বক্তৃতা করতে হত, কেউ বা প্রবন্ধ লিখবার মতো ভাষাজ্ঞানও অর্জন করেছিলেন। কিন্তু এই পদ্ধস্তিকাগুলি নানাকারণে জনসমাজে বেশী প্রচারিত হয়নি। দেখা যাচ্ছে যে, কেরী সাহেবের সহকারীদের কেউ সংস্কৃত সাহি কেউ ফারসী রীতি, কেউ-বা ইংরেজী ধরনের অদ্বয় অনূসেরণ করেছিলেন, কেউ কেউ আবার মুখের অমসৃণ কথাকেও সাহিত্যে ব্যবহার করতে ছিলেন। অর্থাৎ বাংলা গদ্যের যথার্থ রীতি কি হবে, তাই নিয়ে কেরী ও তাঁর সহকর্মীরা নানা ধরনের পরীক্ষা চালিয়েছিলেন—কিন্তু কেউ-ই আদর্শ গ নির্ধারণ করতে পারেননি। সহজাত শিল্পবোধ ছিল বলে ওরই মধ্যে নতু সাব্য গদ্যরীতির কাঠামো অনেকটা ধরতে পেরেছিলেন। বাইবেলের অনুবাদে কেরাঁ যতই ব্যর্থ হোন না কেন, সরল বাংলা গদ্যরীতি, বিদেশী হয়েও, তিনি যেভাবে আয়ত্ত করেছিলেন, তাতে মনে হচ্ছে তিনিও মৃত্যুঞ্জয়ের প্রভাবে সাধুরীতির ছাঁদটি ভালোই শিখে নিয়েছিলেন। কিন্তু বাংলা গদ্য তখনও গাল গল্পের মধ্যে সঙ্কুচিত হয়েছিল। চিন্তার বিশাল ক্ষেত্রে, মননের সুগভীর প্রত্যয়ের দ্বারা সংগঠিত বাংলা গদ্য সর্বপ্রথম আবির্ভূত হয় রাজা রামমোহনের রচনার মধ্যে। আর তার হাত ধরেই বাংলা সাহিত্যে এক অনন্য মাএায় পৌঁছেছিলো।
***তথ্যসংগ্রহ***
((বাংলা সাহিত্যের সম্পূর্ণ ইতিবৃত্ত
ড. অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়)))
0 মন্তব্যসমূহ