(স্বদেশী আন্দোলন, স্বদেশী আন্দোলন বলতে কি বুঝায় স্বদেশী আন্দোলন কি
স্বদেশী পণ্যের গুণগত মান স্বদেশী আন্দোলনের গুরুত্ব স্বদেশী আন্দোলন pdf
স্বদেশী আন্দোলনের নেতা কে ছিলেন স্বদেশী আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন কে
স্বদেশী আন্দোলনের কারণ ও ফলাফল স্বদেশী আন্দোলনের কারণ
(স্বদেশী আন্দোলন (১৯০৩-১৯০৮)স্বদেশী আন্দোলন বলতে কি বুঝ স্বদেশী আন্দোলন এর নেতা কে ছিলেন চরমপন্থী বলতে কি বুঝ))
স্বদেশী আন্দোলন ও বাংলা সাহিত্য)
**বিঃদ্র-বাংলা বিভাগের সকল পড়াশোনা পেতে ব্লগটিতে যুক্তথাকুন https://monoweredu13.blogspot.com/?m=1
স্বদেশী আন্দোলন (১৯০৩-১৯০৮)---
ঊনবিংশ শতকের শেষভাগে অনেক জাতীয়তাবাদী নেতা দেশজ দ্রব্য ব্যবহার করে দেশজ শিল্পের উন্নতি সাধন ও উৎসাহ বিধানে আহ্বান করেন। এদের মধ্যে বাংলার ভোলানাথ চন্দ্রের নাম সবিশেষ উল্লেখ্য। ১৮৭৩ সালে তাঁর বিখ্যাত প্রবন্ধ 'A Voice for the Commerce and Manufacture'-এ তিনি ভারতবাসীকে স্বদেশি দ্রব্য ব্যবহার করে দেশপ্রেমের আদর্শে ও দেশসেবায় উদ্বুদ্ধ হতে ডাক দেন। অতঃপর ১৯০৫ সালে বাংলা বিভাগকে কেন্দ্র করে এই আন্দোলন প্রধানত রাজনৈতিক কারণে গুরুত্ব লাভ করে। উগ্রপন্থী নেতৃবৃন্দ বিশেষ করে তিলক, লাজপাত রায়, ব্রিপিনচন্দ্র পাল ও অরবিন্দ ঘোষের সক্রিয় উৎসাহে এই আন্দোলন জাতীয় গণ-আন্দোলনে রূপান্তরিত হয়।কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ প্রথম থেকেই নানাভাবে বঙ্গভঙ্গ রোধের প্রচেষ্টা চালিয়ে আসছিল। তারা বৃটিশ সরকারের উপর ঐক্যবদ্ধভাবে ফলপ্রসূ চাপ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে স্বদেশি আন্দোলনের আদর্শকে রাজনৈতিক অভীষ্ট অর্জনে ব্যবহার করে। অবশেষে তারা আইরিশ জাতীয়তাবাদীদের অনুকরণে একটি অভিনব পদ্ধতির আশ্রয় গ্রহণ করে বৃটিশ দ্রব্য বর্জন, বিদেশি রীতিনীতি ও আদর্শ পরিহার করে এবং স্বদেশি দ্রব্য ব্যবহার করে ও দেশীয় আদর্শে উদ্বুদ্ধ হতে জনগণকে আহ্বান করে। এই অর্থনৈতিক অস্ত্র প্রধানত রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনের উদ্দেশ্য হাসিল করার কাজে ব্যবহৃত হয়। ১৯০৫ সনের ১৩ই জুলাই কলকাতার বিখ্যাত সাপ্তাহিক ‘সঞ্জীবনী'র সম্পাদক কৃষ্ণকুমার মিত্র সর্বপ্রথম 'বয়কট' বা বর্জন আন্দোলনের ডাক দেন। (৭ই আগস্ট ১৯০৫ সনে কলকাতার টাউন হলে এক বিরাট প্রতিবাদ সভায় বর্জন নীতি গৃহীত হয়। দেখতে দেখতে সারাদেশে বর্জন আন্দোলন জোরদার হয়ে ওঠে এবং স্বদেশি আন্দোলন ভারতের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। ১৯০৫-০৬ সালে বাংলায় যে বর্জন আন্দোলনের বীজ উপ্ত হয়েছিল, এটাই পরবর্তীকালে অসহযোগ আন্দোলনরূপে বিশাল মহীরূহে পরিণত হয়। এই আন্দোলন শিক্ষা, রাজনীতি ও সামাজিক ক্ষেত্রেও অনুপ্রবেশ করে। সকল বৃটিশ পণ্য বিশেষত বস্তু, তাছাড়া লবণ, চিনি, সিগারেট এবং বিলাস সামগ্রী বর্জনের পিছনে যেমন একটি অর্থনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল, দেশীয় শিল্পোন্নয়ন বিধান এবং তেমনি দেশকে স্বনির্ভরশীল করে তোলা, অন্যদিকে স্বদেশি আন্দোলনের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল বঙ্গভঙ্গ রদ করা। আন্দোলনকারীরা বুঝতে পেরেছিল যে, বৃটিশ বস্ত্রশিল্পের মালিকেরা বাধ্য হয়ে নিজেদের স্বার্থে বৃটিশ সরকারকে তাদের সিদ্ধান্ত বাতিল করার জন্য চাপ প্রয়োগ করবে। স্বদেশি আন্দোলনে সারাদেশে দেশজ শিল্প প্রতিষ্ঠায় এবং সাংস্কৃতিক জীবনে দেশাত্মবোধক ভাবের এক নতুন জোয়ার আসে।এর ফলে দেশে বিলাতি দ্রব্যের আমদানি বেশ কিছুটা হ্রাস পায়। বিলাতি কাপড়ের বাজারে মন্দা দেখা দেয়। এজন্য ইংরেজ পরিচালিত সংবাদপত্রে স্বদেশিদের তীব্র নিন্দা করা হয়। স্বদেশি আন্দোলনের ফলে দেশে নতুন নতুন শিল্প প্রতিষ্ঠান ও জাতীয় শিক্ষা
প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। জাতীয় শিক্ষালাগুলিতে ছাত্রদের চরিত্র গঠন ও মানসিক শক্তির বিকাশ ছাড়াও জাতীয়তাবোধ এবং দেশপ্রেমের দীক্ষা দেওয়া হতো। তাছাড়া জাতীয় ইতিহাস, সাহিত্য, দর্শন এবং দেশের অর্থনীতি সম্বন্ধে বিদ্যার্থীদের জ্ঞান প্রসার এবং প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য আদর্শের মধ্যে সমন্বয় সাধনের উপর গুরুত্ব দেওয়া হতো। দেখতে দেখতে জাতীয় শিক্ষার আন্দোলন সারা ভারতে ছড়িয়ে পড়ে এবং অচিরেই দেশের সর্বত্র ও সকল সম্প্রদায়ের মধ্যে জাতীয় শিক্ষার প্রসার ঘটতে থাকে।১৯০৬ সালে ১৪ই আগস্ট জাতীয় শিক্ষা পরিষদ (National Council of Education) গঠিত হয়। শিক্ষা কাউন্সিল মাতৃভাষার মাধ্যমে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি বিদ্যা ও সাহিত্যের প্রভৃতি বিষয়ে শিক্ষা দেওয়ার সুপারিশ করে। তবে ইংরেজি পাঠ্য বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত থাকবে। তাছাড়া শিক্ষা পরিষদ টেকনিক্যাল শিক্ষা সম্প্রসারণের উপর জোর দেয়। প্রায় একই সময় Society for the Promotion of Technical Education (S.P.T.E) প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠান দুটি পৃথক হলেও উভয়ের উদ্দেশ্য ছিল টেকনিক্যাল শিক্ষার উন্নতি বিধান এবং উভয় সমিতিরই সভাপতি ছিলেন রাসবিহারী ঘোষ। ১৯১০ সালে উভয় প্রতিষ্ঠান মিলিত হওয়ার পর সাহিত্য ও বিজ্ঞান বিভাগের নাম হলো Bengal Nationai College, ব্যবহারিক বিজ্ঞান ও টেকনিক্যাল বিভাগের নাম হলো Bengal Technical Institute। স্বাধীনতা-উত্তরকালে উভয় প্রতিষ্ঠান যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্ভূক্ত হয়। এখানে উল্লেখ্য যে, বিপ্লবী শ্রী অরবিন্দ ঘোষ Bengal National College-এর প্রথম অধ্যক্ষরূপে এতে নবজীবনের সঞ্চার করেছিলেন। স্বদেশি ও বর্জন আন্দোলনের প্রভাবে একদিকে যেমন জাতীয়তার জাগরণ হয়,অন্যদিকে বাংলা সাহিত্যেও এর ফল হয় সুদূরপ্রসারী। স্বদেশি আন্দোলন বাঙালির জীবনে নতুন দিগন্তের উন্মেষ ঘটায় এবং এর প্রকাশ পেয়েছিল বাংলা কবিতা, সঙ্গীত, নাটক ও যাত্রার মাধ্যমে। এতে জাতীয় জীবনে দেশপ্রেমের প্রবল জোয়ার আসে । কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ এই সময়ে তাঁর সুবিখ্যাত “আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি। চিরদিন তোমার আকাশ তোমার বাতাস আমার প্রাণে বাজায় বাঁশি –এই গানটি রচনা করেন, যা বর্তমানে আমাদের জাতীয় সঙ্গীত। স্বদেশি ও বয়কট আন্দোলনে ছাত্র, যুবকশ্রেণী বিশেষ সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। এই সময়ে জাপানের নিকট ইউরোপের অন্যতম শক্তিশালী দেশ রাশিয়ার পরাজয়, আইরিশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন, নবীন তুর্কি আন্দোলন এবং 'রুশ বিপ্লব' প্রভৃতি এই দেশের যুব সমাজকে নতুন প্রেরণা ও উদ্দীপনা যোগায়। তাছাড়া স্বদেশের জন্য আত্মোৎসর্গ করার দীক্ষাও তার গ্রহণ করে। হিন্দু পত্র পত্রিকা, বিশেষ করে সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জীর 'বেঙ্গলী' এবং মতিলাল ঘোষের “অমৃতবাজার" স্বদেশি ও বর্জন আন্দোলনকে সফল করার জন্য প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তুলতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। ফলে বৃদ্ধিজীবী, ছাত্র, যুবক, মহাজন, জমিদার এবং কৃষক প্রজা সকলেই এই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে, এবং নানাভাবে সরকারকে তাদের সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের জন্য প্রয়োজনীয় চাপ সৃষ্টি করতে ও সত্যাগ্রহ প্রভৃতি অস্ত্র ব্যবহার করতে কুণ্ঠিত হয়নি। অবশ্য এই আন্দোলন বাংলার অধিকাংশ মুসলমান জনগণের বিশেষ সমর্থন লাভে ব্যর্থ হয়। কারণ, আন্দোলন ক্রমশ হিন্দু ধর্মাশ্রিত সাম্প্রদায়িক হওয়ার ফলে মুসলমানরা এতে একাত্মতা প্রকাশ করেনি। মুসলমান নেতাদের মধ্যে ব্যারিস্টার আবদুর রসুল, খান বাহাদুর মোহাম্মদ ইউসুফ এবং লিয়াকত হোসেন প্রমুখ এই আন্দোলনের সঙ্গে সহযোগিতা করেন। গ্রামাঞ্চলে হিন্দু জমিদার ও মহাজনেরা বলপূর্বক দরিদ্র মুসলমান কৃষকদের স্বদেশি আন্দোলনে যোগদান এবং বিদেশি দ্রব্য বর্জন করতে বাধ্য করত। মুসলমান জমিদার ও ব্যবসায়ীরা যারা এই আন্দোলনের সঙ্গে সহযোগিতা করতে অস্বীকার করে, তাদের সঙ্গে স্বদেশিদের নানাপ্রকার অপ্রীতিকর ঘটনার সৃষ্টি হয়। এবং নানাস্থানে হিন্দু-মুসলমানে সংঘর্ষ হয়। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট হয় এবং স্বদেশিদের বিরুদ্ধে মুসলমান জনগণকে উত্তেজিত করার জন্য যে সকল 'ইস্তাহার' বিলি করা হয়, তাদের মধ্যে ইব্রাহিম খানের "লাল ইস্তাহার" বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সাম্প্রদায়িক কলহ ও মারামারির পিছনে সরকার যে পরোক্ষভাবে দায়ী ছিল, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই।স্বদেশি ও বর্জন আন্দোলনে একদিকে যেমন ভারতীয় শিল্পের, বিশেষ করে বস্ত্রশিল্পের ব্যাপক প্রসার ঘটেছিল, তেমনি অন্যদিকে দেশীয় তাঁত শিল্পের সর্বনাশও করে। স্বদেশি আন্দোলনের ফলে ভারতে যে ধনিক শ্রেণীর জন্ম হলো, এদের অধিকাংশই ছিল হিন্দু। এসব শিল্পপতিরা প্রথমে নিজেদের কায়েমি স্বার্থে কংগ্রেসকে সমর্থন করে এর মেরুদণ্ড হয়ে দাঁড়ায় এবং জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে পূর্ণ সমর্থন জ্ঞাপন করে এবং পরবর্তীকালে কংগ্রেসের নানা প্রতিক্রিয়াশীল নীতিতে ইন্ধন যোগায়। স্বদেশি আন্দোলন ক্রমশ স্বরাজ আন্দোলনে পরিণত হয়। সেজন্য ঐতিহাসিক উইলিয়ম ডুরান্ট ১৯০৫ সালের স্বদেশি আন্দোলনকে ভারতে স্বাধীনতা ও মুক্তি আন্দোলনের অগ্রদূতরূপে আখ্যায়িত করেছেন। কারণ অতি দ্রুতগতিতে এই আন্দোলন সমগ্র ভারতে গণ আন্দোলনরূপে ছড়িয়ে পড়ে এবং বিদেশি শাসনের নাগপাশ থেকে মুক্তিলাভের সংগ্রামে পরিণত হয়। সেজন্য মহাত্মা গান্ধী ১৯০৮ সালে লিখেছিলেন, “বঙ্গভঙ্গের পরেই ভারতের প্রকৃত নবজাগরণ ঘটেছে। এই বঙ্গ বিভাগেই বৃটিশ সাম্রাজ্যের বিভাগের কারণ হবে।”
যাহোক, স্বদেশি আন্দোলনের প্রধান রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সফল হয়নি। বৃটিশ সরকার – তাদের বঙ্গবিভাগ সিদ্ধান্তে অটল থাকে। উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য আন্দোলনকারীরা চরমপন্থী নেতাদের প্ররোচনায় নতুন কর্মপন্থা গ্রহণ করে। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল বিপ্লবাত্মক আন্দোলনের মাধ্যমে ইংরেজ সরকারের পতন ঘটানো। বিপ্লবীরা সমগ্র দেশে অগ্নিমস্ত ছড়াতে থাকে। দেশে সন্ত্রাসবাদী কাজ শুরু হয়। অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনের জন্য এরা হিংসাত্মক নীতি গ্রহণ করতেও দ্বিধাবোধ করে না। প্রধানত ঢাকা ও কলকাতাকে কেন্দ্র করে বিপ্লব সংঘ গড়ে ওঠে। বিপ্লবীরা নানা গুপ্ত সমিতি প্রতিষ্ঠা করে। এদের মধ্যে কলকাতার 'যুগান্তর' এবং ঢাকার অনুশীলন সমিতি' বিশেষ প্রসিদ্ধ। ঢাকা অনুশীলন সমিতির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন ব্যারিস্টার প্রমথনাথ মিত্র। এর উদ্দেশ্য ছিল যে, অনুশীলন বা চর্চা দ্বারা উন্নতি লাভ ও অভীষ্ট সিদ্ধ করতে হবে। প্রমথ মিত্র ও চিত্তরঞ্জন দাস প্রথমে কলকাতায় ১৯০৩ সনে অনুশীলন সমিতি প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯০৫ সনে প্রমথ মিত্র বিপিনচন্দ্র পালের সঙ্গে ঢাকায় এসে অনুশীলন সমিতির একটি শাখা স্থাপন করেন। ঢাকা অনুশীলন সমিতির দায়িত্ব পড়ে পুলিন বিহারী দাসের উপর। ১৯০৬ সন নাগাদ কলকাতায় সন্ত্রাসবাদীদের দ্বিতীয় দল ‘যুগান্তর’ সমিতির জন্ম হয়। অরবিন্দ ঘোষ ও তার কনিষ্ঠ ভ্রাতা বারীন্দ্র ঘোষ এই 'যুগান্তর' সমিতি পরিচালনা করেন এবং সমিতির মুখপত্র 'যুগান্তর পত্রিকা প্রকাশিত হওয়ার ফলে বাংলার যুব সম্প্রদায় ক্রমশ এই দলের দিকে আকৃষ্ট হয়। এমনকি কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও এই সময় এই আন্দোলনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন।১৯০৫ সালে বাংলা বিভাগকে কেন্দ্র করে যে স্বদেশি আন্দোলন শুরু হয়, বিপ্লবীরা তাতে সক্রিয় অংশ নেয়। তাদের প্রচেষ্টায় সারা বাংলাদেশে, বিশেষত পূর্ববঙ্গে সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন জোরদার হয়। পুলিন ও প্রতুল গাঙ্গুলী এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতে থাকেন। সমগ্র দেশে গুপ্ত সমিতির বহু শাখা-প্রশাখা প্রতিষ্ঠিত হয়। এই সমস্ত সমিতিতে শারীরিক কসরত ছাড়াও যুবকদের মারণাস্ত্র ব্যবহার করতে শিক্ষা দেওয়া হতো। দেশময় অগ্নি সংযোগ, লুটতরাজ এবং রাজনৈতিক হত্যা অহরহ চলতে থাকে। সুদূর চীন ও জার্মানি থেকে বিপ্লবীরা উৎসাহ ও অর্থ সাহায্য পেত। এরা বাংলার গভর্নর ফ্রেজার এবং পূর্ববঙ্গ ও আসামের গভর্নর ফুলারকে হত্যা করার ব্যর্থ প্রচেষ্টা করে। বিপ্লবের অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে শত শত যুবক-ছাত্র এই আন্দোলনে যোগ দেয়। ১৯০৮ সনে বিপ্লবী ক্ষুদিরাম এবং প্রফুল্ল চাকী এই আন্দোলন করতে গিয়ে জীবন দান করেন। তা প্রধানত "হিন্দুদের দ্বারা পরিচালিত ও বঙ্গভঙ্গ রদই এর অন্যতম উদ্দেশ্য হলেও কিছু কিছু মুসলমান যুবক এই আন্দোলনের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিল, কিন্তু পরবর্তীকালে হিন্দুদেরী কালীর নামে শপথ গ্রহণ এবং 'বন্দে মাতরম' সঙ্গীত চালু করা হলে মুসলমানদের উৎসাহে ভাটা পড়ে এবং তা হিন্দু আন্দোলনে পর্যবসিত হয়।কিন্তু দেশে স্বদেশি আন্দোলন ও সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন সত্ত্বেও বৃটিশ সরকার তাদের সিদ্ধান্তে অটল থাকে। বরঞ্চ প্রশাসন যন্ত্র ও দমন নীতি, বিশেষ করে ছাত্র-দমননীতি, প্রকট ও সক্রিয় হয়ে ওঠার ফলে এই আন্দোলন ক্রমশ ক্ষীণবল হয়ে পড়ে। পূর্ববঙ্গ ও আসামের জনগণ এই সময়ে শিক্ষা ও অর্থনীতিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে উন্নতি করতে শুরু করে। ঠিক সেই সময়ে নতুন প্রদেশের ভাগ্যে নেমে আসে এক প্রচণ্ড আঘাত। শেষ পর্যন্ত বৃটিশ সরকার বৃটিশ বণিক এবং কংগ্রেসি নেতাদের চাপের নিকট নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয় এবং তাদের সাম্রাজ্যবাদী নীতির স্বার্থে মুসলমানদের স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিতে দ্বিধা করে না১৯১০ সালের শেষের দিকে মিন্টোর স্থলে লর্ড হার্ডিঞ্জ নতুন ভাইসরয় হয়ে আসেন। ভারতে পদার্পণ করেই তিনি ঘোষণা করেন ১৯১১ সনের ডিসেম্বরে বৃটিশ সম্রাট ও সম্রাজ্ঞী মেরী ভারত সফরে এলে পঞ্চম পূর্ণ দিল্লীতে দরবার করবেন। সেজন্য তিনি প্রথম থেকেই কংগ্লোসি নেতাদের সন্তুষ্ট করার জন্য আপোস নীতি গ্রহণ করেন এবং বঙ্গভঙ্গ রদ করতে মনস্থ করেন। এই ব্যাপারে তিনি ভারত সচিব লর্ড ক্রুর সমর্থন পাঞ্জ করেন। তিনি রাজধানী কলকাতা থেকে দিল্লীতে স্থানান্তরিত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।এতে একদিকে যেমন কলকাতা সন্ত্রাসবাদীদের হাত থেকে অপেক্ষাকুর মুহু থাকবে, অন্যদিকে দিল্লীতে রাজধানী স্থানান্তরিত হলে উত্তর ভারতের মুসলমানরাও খুশি হবে। কারণ শিল্পীর একসময়ে মুঘল সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিল। ১৯১১ সনের ডিসেম্বর মাসে সম্রাট পঞ্চম জর্জ ও রানী মেরীর ভারত আগমন উপলক্ষে দিল্লীতে তাদের সম্বর্ধনা জ্ঞাপনের জন্য এক বিরাট আয়োজন করা হয়। হাজার হাজার ভারতবাসী দিল্লীতে তাদের সাদর সম্ভাষণ জানায় এবং বৃটিশ সরকারের প্রতি তাদের আনুগত্য প্রকাশ করে। সম্ভবত এই আনুগত্যের পুরস্কার হিসেবে সম্রাট পঞ্চম জর্জ দিল্লীর দরবারে হঠাৎ করে বঙ্গভঙ্গ রদের কথা ঘোষণা করেন। ভারতের রাজধানী কলকাতা থেকে দিল্লীতে স্থানান্তরিত হয়। পূর্ব বাংলাকে আবার কলকাতার প্রশাসনে আনা হয়। সমগ্র বাংলাকে নিয়ে গভর্নরের অধীনে নতুন প্রদেশ (Presidency) সৃষ্টি হয়। বিহার ও উড়িষ্যাকে একত্র করে লে. গভর্নরের অধীনে একটি নতুন প্রদেশে পরিণত করা হয়। আসাম পূর্বের ন্যায় চাঁদ কমিশনারের অধীনে ন্যস্ত হয়। নতুন ব্যবস্থাটি ১৯১২ সনের জানুয়ারি থেকে কার্যকর হয়। স্বাভাবিকভাবেই মুসলমানেরা বঙ্গভঙ্গ রদে তীব্র অসন্তোষ ও ক্ষোভ প্রকাশ করে। ঢাকা এবং কলকাতায় মুসলমানেরা প্রতিবাদ সভা করে সরকারি বিশ্বাসঘাতকতার প্রতিবাদ জানায়। অবশ্য বর্ণহিন্দুরা এবং কংগ্রেস নেতারা তাকে স্বাগত জানায় ও উল্লসিত হয়। এই ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি আঘাত পেয়েছিলেন নবাব সলিমুল্লাহ নিজে । ভগ্নমনোরথ নবাব হতাশায় রাজনীতি থেকে অবসর গ্রহণ করেন।।এই সময়ে ১৯১২ সনের প্রথম দিকে লর্ড হার্ডিঞ্জ ঢাকা আগমন করলে নবাব এই অঞ্চলের জনগণের শিক্ষার জন্য ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি জানান। বাংলার অনেক হিন্দু নেতা এর বিরোধিতা করে। ১৯১৫ সনের জানুয়ারি মাসে অকস্মাৎ সলিমুল্লাহর মৃত্যু হয়। তাঁর জীবদ্দশায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়নি সত্য, কিন্তু এর একযুগের মধ্যেই তাঁর স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়। ১৯২১ সনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়। পরবর্তীকালে এই বিশ্ববিদ্যালকে কেন্দ্র করে পূর্ব বাংলার মুসলমান মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর সৃষ্টি হয়।।
***তথ্যসংগ্রহ ***
বাংলাদেশের ইতিহাস(ডঃ মুহম্মদ আবদুর রহিম ডঃ আবদুর মমিন চৌধুরী ডঃ এ. বি. এম. মাহমুদ ডঃ সিরাজুল ইসলাম)
**শেখর বন্দ্যোপাধ্যায়
পলাশি থকে পার্টিশান আধুনিক ভারতের ইতিহাস)
0 মন্তব্যসমূহ