(সুবোধ ঘোষের শ্রেষ্ঠ গল্প সুবোধ ঘোষের গল্প সুবোধ ঘোষের গল্প জতুগৃহ সুবোধ ঘোষের গল্প ফসিল সুবোধ ঘোষের গল্প থিরবিজুরী ফসিল গল্পের বিষয়বস্তু সুবোধ ঘোষ)
**বিঃদ্র-বাংলা বিভাগের সকল পড়াশোনা পেতে ব্লগটিতে যুক্তথাকুন https://monoweredu13.blogspot.com/?m=1
(১)****জতুগৃহ ----
এত রাত্রে এটা কোন ট্রেন? এই শীতার্ত বাতাস, অন্ধকার আর ধোঁয়া ধোঁয়া বৃষ্টির মধ্যে ট্রেনটা যেন হাঁপিয়ে হাঁপিয়ে ছুটে এসে রাজপুর জংশনের প্ল্যাটফর্মের গায়ে লাগলো।
খুব সম্ভব গঙ্গার ঘাটের দিক থেকে ট্রেনটা এসেছে। এখনো অদূর গঙ্গার বুকে সেই স্টিমারের চিমনি বাঁশির শব্দ শোনা যায়, যে স্টিমারটা একদল যাত্রীকে ঘাটে নামিয়ে দিয়ে একটু হালকা হয়ে আর হাঁপ ছেড়ে আবার ওপারে চলে যাচ্ছে।
প্ল্যাটফর্মের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ট্রেনের এঞ্জিন আস্তে আস্তে হাঁপাতে থাকে। ফার্স্ট ক্লাস ওয়েটিংরুমে বয়টা একটু ব্যস্ত হয়ে ওঠে। টেবিল চেয়ার বেঞ্চ আর আয়নটার ওপর ঝটপট তোয়ালে চালিয়ে একটু পরিচ্ছন্ন করে ফেলে। জমাদার এসে রুমের টুকিটাকি আবর্জনা বড় বড় ঝাড়ুর টার্ন দিয়ে সরিয়ে নিয়ে যায়।ঘাটের ট্রেনটা ছোট হলেও এবং যাত্রীর সংখ্যা কম হলেও ফার্স্ট ক্লাসের যাত্রী দু'-একজন তার মধ্যে পাওয়াই যায়। হয়তো কাটিহারের কোন চিনিকলের মহাজন, অথবা দার্জিলিং-ফেরত কোন চা-বাগানের সাহেব, এই ধরনের কুলিন শ্রেণীর যাত্রীও থাকেন, শুধু সাঁওতাল কুলির দলই নয়। কিন্তু আজ এখন যাঁরা এই ক্লান্ত ট্রেন থেকে নেমে ব্যস্তভাবে এসে ফার্স্ট ক্লাসওয়েটিংরুমে আশ্রয় নিলেন, তাঁদের সঙ্গে চিনিকল অথবা চা-বাগানের কোনসম্পর্ক নেই।
কুলির মাথায় বাক্স-বেডিং চাপিয়ে প্ল্যাটফর্মের ওপর দিয়ে গুঁড়ো-গুঁড়ো বৃষ্টির মধ্যে তরতর করে হেঁটে ওয়েটিংরুমে প্রথম এসে ঢুকলেন এক বাঙালী মহিলা। গায়ে কাশ্মিরী পশমে তৈরি একটা মেয়েলী আখৃস্টার, কানে ইহুদী প্যাটার্নের ছোট ফিরোজার দুল, খোঁপা বিলিতি ধাঁচে ফাঁপানো।তারপরেই যিনি এসে ঢুকলেন, তাঁরও সঙ্গে কুলি, আর তেমনি বাক্স বেডিংয়ের বহর। চোখে চশমা, গায়ে শাল, দেশী পরিচ্ছদে ভূষিত এক বাঙালী দ্রলোক।এক ভদ্রলোক আর এক মহিলা, একই ট্রেনের যাত্রী হয়ে এক ওয়েটিংরুমে ইনি হয়তো ঘণ্টা দুয়েক আর উনি ঘণ্টা তিনেক পথপ্রান্তের এই শিবিরে ট্রেনের এসে আশ্রয় নিয়েছেন। এই মাত্র সম্পর্ক, যদি নেহাতই একে সম্পর্ক বলা যায়। প্রতীক্ষায় থাকবেন, তারপর চলে যাবেন যাঁর যাঁর পথে।
কিন্তু আশ্চর্য, ঘরে ঢোকা মাত্র দু'জনে দু'জনের মুখের দিতে তাকিয়ে প্রথমে চমকে ওঠেন, তারপরেই চিত্রবৎ স্তব্ধ হয়ে থাকেন। দু'জনেই যেন অপ্রস্তুত ও লজ্জিত, বিরক্ত ও বিড়ম্বিত, এবং একটু ভীতও হয়েছেন। যেন কাঠগড়া থেকে পলাতক ফেরারী আসামীর মত বহুদিন পরে এবং নতুন করে এক আদালত ঘরের মধ্যে দু’জনে এসে পড়েছেন। মাধুরী রায়ের আলস্টারে কুচি কুচি জলের ফোঁটা নিঃশব্দে চিকচিক করে। শতদল দরও জালভেজা চশমার কাচ মুছে নিতে ভুলে যায়।এটা রাজপুর জংশনের ওয়েটিংরুম, আদালত নয়। জজ নেই উকিল নেই, সাক্ষী নেই, সারি সারি সাজানো কতগুলি নিষ্পলক লোকচক্ষুও নেই। প্রশ্ন করে লজ্জা দিতে, স্বীকৃতি বা স্বাক্ষর আদায় করতে তৃতীয় কোন ব্যক্তি নেই। তবু এই নিবৃত সান্নিধ্যই দু'জনের কাছে বড় বেশি দুঃসহ বলে মনে হয়। সরে পড়তে পারলে ভাল, সরে যাওয়াই উচিত।
শতদল দরজার কাছে এগিয়ে এসে ডাক দেয়—কুলি। মাধুরীর জিনিসপত্র ছড়িয়ে পড়ে আছে ঐ বেঞ্চের ওপর। শতদলের
জিনিসপত্র স্তূপীকৃত হয়ে রয়েছে ঐ টেবিলটার ওপর।
এক্ষুনি জিনিসপত্র আবার কুলির মাথায় চাপিয়ে শতদল দত্তকে চলে যেতে হবে। কিন্তু কোথায়, তা সে জানে না। শুধু অদৃশ্য লজ্জায় অভিভূত এই ওয়েটিংরুম ছেড়ে অন্য কোনখানে, হয়তো ঐ মুসাফিরখানায়, যেখানে এরকম আলো নেই, আসবাবও নেই, কিন্তু অতীতের এক অস্পষ্ট ছায়াকে এত জীবন্ত মূর্তিতে মুখোমুখি দেখে বিব্রত হওয়ার শঙ্কাও সেখানে নেই। শতদলের ডাকে সাড়া দিয়ে কিন্তু কুলিদের কেউ এল না, এল ওয়েটিংরুমের বয়। —হুজুর!
বয়কে উত্তর দিতে হবে। শতদল দত্ত আর একবার দরজা পর্যন্ত পায়চারি করে এগিয়ে যায়, বাইরে উকি দিয়ে তাকায়, গুঁড়ো বৃষ্টির একটা ঝাপটা মুখে এসে লাগে। ফিরে এসে আবার টেবিলটার পাশে দাঁড়ান, যেন নিজেরই চিন্তার ভেতর পায়চারি করে উত্তর সন্ধান করছে শতদল।
চুপ করে দাঁড়িয়ে কি ভাবতে থাকে শতদল, বোধহয় ততক্ষণে নিজের মনের অবস্থাটার ওপরই রাগ করে একটু শক্ত হয়ে উঠেছে। এভাবে বিচলিত হওয়ার কোন অর্থ নেই। ওয়েটিংরুমের মধ্যে মাত্র একজন যাত্রীকে দেখে এভাবে পালিয়ে যাওয়ার অর্থ, একটা অর্থহীন দুর্বলতার কাছে হার মেনে যাওয়া।
বয় বলে–করমাস করুন হুজুর। বেশ স্বচ্ছন্দভাবে শতদল দত্ত টেবিলের কাছে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসে,
স্বচ্ছন্দ স্বরে বয়কে নির্দেশ দেয়—চা নিয়ে এস। আর ওদিকে, কাশ্মিরী পশমের অস্টার গা থেকে নামিয়ে মাধুরী রায় বেঞ্চের ওপর রাখে। জিনিসপত্রগুলি সরিয়ে একটু জায়গা করে নিয়ে বেঞ্চের ওপরই চুপ করে বসে থাকে।
শতদল দত্ত আর মাধুরী রায়। দু'জন ট্রেনযাত্রী মাত্র, রাজপুর জংশনের
ওয়েটিংরুমে বসে থাকে ট্রেনের প্রতীক্ষায়। এছাড়া দু'জনের মধ্যে আজ আর
কোন সম্পর্ক নেই।
শুধু আজ নয়, সাজা প্রায় পাঁচ বছর হলো দু'জনের মধ্যে কোন সম্পর্ক নেই। কিন্তু তার আগে ছিল, সেও প্রায় একটানা সাত বছর ধরে। সম্পর্কের লক্ষণ দেখা দিয়েছিল প্রায় বারো বছর অতীতে, যে অতীতে মাধুরী মিত্র নামে দেখতে-বড় সুন্দর এক অনূঢ়া তরুণী শতদলের মোবউদির বান্ধবী মাত্র ছিল। আর স্থানটা ছিল ঘাটশিলা, সময়টা ফাল্গুন, মধুদ্রমের বীথিকায় যখন সৌরভের উৎসব জাগে। তারই মধ্যে আকস্মিক এক 'অপরাহের আলোকে শুধু একটি বেড়াতে যাবার ঘটনা, সেই তো মাধুরী মিত্রের সঙ্গে শতদল দত্তের সম্পর্কের আরম্ভ)
এক বছরের পরিচয়ে দু'জনে দু'জনকে যে খুবই বেশি ভালবেসেছিল, তাতে সন্দেহ নেই। সে ভালবাসা আইনমত রেজিস্ট্রারিও করা হয়, তার মধ্যেও কোন ভুল ছিল না। কিন্তু বিয়ের পর সাতটি বছর পার হতে না-হতেই মাধুরী দত্ত আর শতদল দত্তের মধ্যে যে ভালবাসার জোর আর রইল না। তাই আবার দু'জনেই। স্বেচ্ছায় এবং আইনমত আদালতের শরণ নিল, রেজিস্ট্রারি-করা সম্পর্ক বাতিল করে দিয়ে দু'জনের ছাড়াছাড়ি হয়ে গেল।
কে জানে কেমন করে দু'জনেই বুঝতে পেরেছিল, ভালবাসার জোর আর নেই। মনের দিক থেকে দু'জনে দু'জনেরই কাছে যখন পর হয়ে গেল, তখন লোকচক্ষুর সম্মুখে অনর্থক আর থিয়েটারের স্বামী-স্ত্রীর মত দাম্পত্যের অভিনয় না করে দু'জনেই দু'জনের কাছ থেকে বিদায় নিল। কেউ কাউকে বাধা দিল না।
ফাল্গুনের ঘাটশিলার মধুদ্রমের সৌরভে যে প্রেমের আবির্ভাব, মাত্র সাতটি
নতুন ফাল্গুনও তার গায়ে সহ্য হলো না। এতজোর ভালবাসার পর বিয়ে, তবু
বিয়ের পর ভালবাসার জোরটুকুই ভেঙে যায় কি করে? তাও দু'জনেই বাস্তব আর চাক্ষুস প্রমাণ দেখে বুঝেছিল। একদিন এই ঘরে বসে একমনে বই পড়ছিল মাধুরী, আর ওঘরে একা একা নিজের হাতে কাপড়চোপড় গুছিয়ে বাক্সে ভরছিল শতদল। এক সপ্তাহের জন্য ভুলনেশ্বরে গিয়ে থাকতে হবে, প্রত্নবিভাগের একটা সার্ভে তদারকের জন্য। শতদলের রওনা হবার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত মাধুরী একবার এসে চোখের দেখা দিয়েও যেতে পারলো না। সেদিনই মনে হয়েছিল শতদলের, এই যে পৌষের প্রভাতে জানাল দিয়ে এত আলো ঘরের ভেতরে এসে লুটিয়ে পড়েছে, নিতান্ত অর্থহীন, কোন প্রয়োজন ছিল না।
পৌষের সকালবেলাটাই শুধু অন্যায় করেনি। সেই বছরেই চৈত্রের একটা রবিবারের বিকালবেলাও ভয়ানক এক বিদ্রূপ করে দিয়ে চলে গেল। প্রতি রবিবারের মত সাজসজ্জা করে বেড়াতে যাবার জন্য প্রস্তুত হয়ে বসেছিল মাধুরী, এই ঘরে। আর পাশের ঘরে গভীর মনোযোগ দিয়ে চালুক্য স্টাইলের মন্দিরভিত্তির একটা স্কেচ আঁকছিল শতদল। বেড়াতে যাবার কথা একটি বারের জন্যও তার মনে হলো না, কোন সাড়াও দিল না। জানালা দিয়ে বাইরের আকাশের দিকে তাকিয়ে মাধুরীর শুধু মনে হয়েছিল, অস্তাচলের মেঘে এই ক্ষণিকের রক্তিমা নিতান্ত অর্থহীন, একটা অলক্ষুণে ইঙ্গিত, আর একটু পরেই তো অন্ধকারে সব কালো হয়ে যাবে। এই ছলনার খেলা আর না করে সূর্যটা যদি একটু ভাড়াতাড়ি ডুবে যায়, তবেই ভাল।
একে একে এইরকম আরও সব লক্ষণ দেখে দুজনেই বুঝেছিল, ভালবাসা আর নেই। কিংবা, ভালবাসা ছিল না বলেই লক্ষণগুলি একে একে দেখা দিচ্ছিল। কে জানে কোনটা সত্য! হয়তো চেষ্টা করলে দু'জনেই জানতে পারতো, হয়তো জেনেছিল, হয়তো জানেনি। যাই হোক, জানা-না জানার ব্যাপারে কেউ কাউকে দোষ দিতে পারে না। হয় দু'জনেই জেনেশুনে চুপ করে ছিল, কিংবা দু'জনে ইচ্ছে করেই জানতে চেষ্টা করেনি।
এ-ও হতে পারে, দু'জনেই নতুন করে আর গোপন করে কোন নতুন জনের ভালবাসায় পড়েছিল। তাই মিথ্যে হয়ে গেল ঘাটশিলার পুরাতন ফাল্গুন। কিংবা সে ফাল্গুন নিজেই সৌরভহীন হয়ে গিয়েছিল, তারই বেদনা দু'জনকে দুই দিকে নিয়ে চলে গেল। একজনকে একটি হেমন্তের সন্ধ্যায়, আর একজনকে একটি আষাঢ়ের পূর্ণিমায়। যা-ই হোক না কেন, দু'জনের ঠিক করেছে। কেউ কাউকে দোষ দিতে পারে না।
কেউ কাউকে দোষ দেয়ওনি। ঘৃণা করেছিল, মার্জনা করতে পারেনি, দু'জনেই দু'জনকে। কিন্তু মনে মনে। যেদিন এই মনের বিদ্রোহ মনের মধ্যে পুষে রাখা দুঃসহ হয়ে উঠলো, সেদিন সরে গেল দু'জন। কেউ কাউকে অভিযোগ আর অপবাদের আঘাত না দিয়ে ভদ্রভাবে আদালতে আবেদন করে সাত বছরের সম্পর্ক নিঃশেষে ঢুকিয়ে দিল।
ছাড়াছাড়ি হবার পর, বছর দেড়েক যেতে না-যেতে শতদল শুনেছিল, মাধুরী বিয়ে করেছে অনাদি রায় নামে এক এঞ্জিনিয়ারকে। মাধুরীও খবরের কাগজে পড়েছিল, অধ্যাপক শতদল দত্ত আবার বিয়ে করেছেন, নব জীবন-সঙ্গিনীর নাম সুধাকণা, কলকাতারই একটা সেলাই স্কুলের টিচার
এই নতুন দুটি বিয়েও নিশ্চয় দেখেশুনে ভালবাসার বিয়ে। যে যাই বলুক,
মাধুরী জানে অনাদি রায়কে স্বামীরূপে পেয়ে সে সুখী হয়েছে। বাইরে থেকে না
জেনেশুনে যে যতই আজেবাজে মন্তব্য করুক না কেন, শতদলও জানে, সুধাকে
পেয়ে সে সুখী হয়েছে।
তাই আজ রাজপুর জংশনের এই ওয়েটিংরুমে, এই শীতার্ত মাঝরাত্রির নিঃশব্দ মুহূর্তগুলির মধ্যে মাধুরী রায় আর শতদল দত্তের সম্পর্ক নিয়ে এসব প্রশ্ন আর গবেষণা নিতান্ত অবাস্তর ও নিষ্প্রয়োজন। সে ইতিহাস ভালভাবেই শেষ করে দিয়ে ওরা দু'জনে একেবারে ভিন্ন হয়ে গেছে, কোন সম্পর্ক নেই। অতীতের প্রশ্ন নয়, প্রশ্নটা ছিল বর্তমানের।এমন করে একটা অযথা সময়ে পথের প্রতীক্ষা ঘরে সেই দুটি জীবনেরই মুখোমুখি সান্নিধ্য দেখা দেয় কেন, যারা প্রতিদিন মুখোমুখি হবার অধিকার আদালতের সাহায্যে পাঁচ বছর আগেই নিয়মবহির্ভূত করে দিয়েছে? এই আকস্মিক সাক্ষ যেন একটা বিদ্রুপের ষড়যন্ত্র। যেমন অবৈধ তেমনি দুঃসহ। ঘটনাটাকে তাই যেন মন থেকে কেউ ক্ষমা করতে পারে না, অথচ আপত্তি বা প্রতিবাদ করারও কোন যুক্তি নেই। মাধুরী না হয়ে, আর শতদল না হয়ে, যদি অন্য কোন মহিলা যাত্রী ও পুরুষ যাত্রী এভাবে এই প্রতীক্ষা-গৃহে আশ্রয় নিত, এ ধরনের অস্বস্তি নিশ্চয় কারো হতো না। বরং স্বাভাবিকভাবে দু’-একটা সাধারণ
সৌজন্যের ভাষায় দু'জনের পক্ষে আলাপ করাও সম্ভব হতো। কিন্তু মাধুরী রায় আর শতদল দত্ত, পরস্ত্রী আর পরপুরুষ, কোন সম্পর্ক নেই, তবু মনতরা সঙ্কোচ আর অস্বস্তি নিয়ে ওয়েটিংরুমের নিঃশদতার মধ্যে অসহায়ভাবে যেন বন্দী হয়ে বসে থাকে।
এই নীরবতার মধ্যে শতদল দত্তের ভারাক্রান্ত মন কখন যে ডুবে গিয়েছিল, তন্দ্রার মত একটা ক্লান্তিহরণ আরামে দুই চোখ বুজে গিয়েছিল, তা সে বুঝতে পারেনি। চোখ খুলে প্রথমেই বুঝতে পারে এটা ওয়েটিংরুম। একটু দূরে বেরে ওপর বসে রয়েছে মাধুরী, দেয়ালের দিকে মুখ ঘুরিয়ে কৌতূহলহীন এবং নিষ্পলক একজোড়া চোখের দৃষ্টি
শতদল কিন্তু মুখ ফিরিয়ে নিল না। তার দু'চোখে একটা লুকিয়ে দেখার
কৌতূহল যেন চঞ্চল হয়ে ওঠে। কিন্তু কি এমন দেখবার আছে, আর নতুন করেই
বা দেখবার কি আছে?
আজ। এমন মেঘ রঙের ক্রেপের শাড়ি তো কোন দিন পরেনি মাধুরী, এমন করে এত লম্বা আঁচলও মাধুরীকে কখনো লুটিয়ে দিতে দেখেনি শতদল। বেড়াতে যাবার সময় মাধুরীকে অবশ্যই পরতে হতো তাঁতের শাড়ি, ঢাকাই বা অন্য কিছু, চলতে গেলে যে শাড়ির ভাঁজে ভাঁজে ফিসফিস করে অদ্ভুত এক শব্দের সুর শিহরিত হয়। আঁচলে অবশ্যই মাখতে হতো একফোঁটা হাসুনাহারার আরক। এইভাবে সুর ও সৌরভ হয়ে শতদলের পাশে চলতে হতো মাধুরীকে, নইলে শতদলের মন ভরতো না। সেই সুর আর সৌরভের কোন অবশেষ আজ আর নেই। মাধুরী বসে আছে এক নতুন শিল্পীর রুচি দিয়ে গড়া মূর্তির মত, নতুন রঙে আর সাজে। এমন করে সন্তর্পণে অনধিকারীর অবৈধ লোভ নিয়ে এবং লুকিয়ে কোনদিন মাধুরীকে দেখেনি শতদল। আজ দেখতে পায় আর বুঝতে পারে, এ মূর্তি সে মূর্তি নয়। একেবারে নতুন, আর বেশ একটু কঠিন, এঞ্জিনিয়ার অনাদি রায়ের স্ত্রী মাধুরী রায়।
অবান্তর চিন্তা আর অস্বস্তি থেকে মুক্তি পায় শতদল। বেশ স্বচ্ছন্দভাবে এবার নিজের প্রয়োজনের দিকে মন দেয়। ছোট একটা চামড়ার বাক্স খুলে তোয়ালে আর সাবান বের করে। হোল্ড-অল খুলে তার ভেতর থেকে একটা বালিশ আর চাদর বের করে অর্ধশয়ান লম্বা চেয়ারটার ওপর রাখে।শতদলের দিকে তাকিয়ে দেখার কোন প্রয়োজন ছিল না মাধুরীর, সে তাকিয়েছিল আয়নায় প্রতিবিধিত শতদলের দিকে। ইচ্ছে করে নয়, আয়নাতে শতদলকে দেখতে পাওয়া যাচ্ছিল, তাই। এবং ইচ্ছে না থাকলেও লুকিয়ে দেখার এই পোভটুকু সামলাতে পারেনি মাধুরী।আয়নার দিতে তাকিয়ে দেখতে পায় মাধুরী, বেশ স্বচ্ছন্দভাবে কাজ করছে শতদল। হাতগড়িটাকে খুলে নিয়ে একবার দম দিয়ে টেবিলের ওপর রাখে শতদল। মাধুরী বুঝতে পারে, এ ঘড়িটা সেই ঘড়ি নয়। ঘড়ির ব্যান্ডটাও কালো --চামড়ার, যে কালো রং কোনদিন পছন্দ করতো না মাধুরী। এবং মাধুরীর রুচির সম্মান রেখে শতদলও কোনদিন কালো ব্যান্ড পরতো না। আরও চোখে পড়ে, স্বাধটাও নতুন। বালিশের ঢাকাটার মধ্যে বৈশিষ্ট্য আছে, রঙিন আর ফুল তোলা।
মাধুরী আবার বলে একটা মুখের কথা বললে এমন ভয়ানক দোষের কিছু শতদলের গম্ভীর মুখ হঠাৎ সুস্মিত হয়ে ওঠে। হেসে হেসে বলে–মা, দোষ আর কি?
মাধুরী উঠে দাঁড়ায় এবং এগিয়ে আসে। নিস্তব্ধ ওয়েটিংরুমের দুঃসহ মুহূর্তগুলির পেষণ থেকে যেন আত্মা এতক্ষণে পেয়েছে। শতদলের স্বচ্ছন্দ হাসির শব্দে মাধুরীর ক্লিষ্ট মনের গাম্ভীর্যত ভেঙে গেছে। শতদলের হাত থেকে গেলাসটা নিয়ে হাসিমুখে বলে, তুমি বসো।
এটা ওয়েটিংরুম। কর্নওয়ালিশ স্ট্রীটের বাড়ি নয়, আর মাধুরীর জন্মদিনের উৎসবও আজ নয়, যেদিন উৎসবের সোরগোল থেকে শতদলকে এমনই একটি ঘরের নিভৃতে নিয়ে গিয়ে সেই জীবনে প্রথম নিজের হাতে খাবার পরিবেশন করে খাইয়েছিল মাধুরী।
কুঁজো থেকে জল ঢেলে নিয়ে খেলাসটা টেবিলের ওপর রেখে খাবারগুলো একটা ডিসের মধ্যে সাজিয়ে দিতে থাকে মাধুরী। কাচের গেলাসে আর মাধুরীর হাতের চুড়িতে অসাবধানে সংঘাত লাগে, শব্দ হয়, পাঁচ বছর আগের নিস্তব্ধ अटी সে নিরূণে যেন চমকে ভোগে ওঠে। দুই ট্রেনযাত্রী নয়, দেখে মনে হবে, ওয়া এই সংসারের দুটি সহজীবনযাত্রী; আর, সে জীবনযাত্রায় কোন খুঁত আছে বলে মনে হয়। মাধুরীর হাতের আঙুলগুলি যদিও একটু রোগা হয়ে গেছে, কিন্তু খাবারগুলোকে সেই রকমই আলগোছে যেন চিমটে দিয়ে তোলে, সেই পুরনো অভ্যাস। শতদলের পাশে প্রায় গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে, নিস্তব্ধ ঘরে মাধুরীর ছোট নিঃশ্বাসের শব্দ মাঝে মাঝে বেশ স্পষ্ট করে শোনা যায়। আঁচলটা কাঁধ থেকে খসে দিয়ে শতদলের একটা হাতের ওপর লুটিয়ে পড়েছে। লক্ষ করে না মাধুরী। এমন
বিসদৃশ বা অপার্থিব কিছু নয় যে লক্ষ্য করতেই হবে। —সবই দেখছি বাজারের তৈরি খাবার।
মাধুরীর কথার মধ্যে একটা আপত্তির আভাস ছিল, যার অর্থ বুঝতে দেরি হয় না শতদলের। বাজারের তৈরি খাবারের বিরুদ্ধে মাধুরীর মনে যে চিরন্তন বিদ্রোহ আছে, তা শতদলের অজানা নয়। তাই যেন দোষ স্খালনের মত সুরে
সঙ্কুচিতভাবে বলে— "হ্যাঁ, কাটিহার বাজারে ওগুলি কিনেছিলাম।
মাধুরী—যাচ্ছ কোথায়?
শতদল – কলকাতায়।
মাধুরী— তুমি এখন কলকাতাতেই...। শতদল-হ্যাঁ... তুমি?
এ কথাগুলি না উঠলেই বোধহয় ভাল ছিল। হাত কাঁপে, কাজের স্বাচ্ছন্দ্য হারায় মাধুরী শতদলের প্রশ্নে যেন নিজের পরিচয়টা হঠাৎ মনে পড়ে গেছে মাধুরীর। কুণ্ঠিতভাবে একটু তফাতে সরে গিয়ে মৃদুস্বরে মাধবী উত্তর দেয়-রাজগীর।এই পর্যন্ত এসেই প্রসঙ্গ ফুরিয়ে যায়। আর প্রশ্ন করে জানাবার মত কিছু নেই। একজন কলকাতা, আর একজন রাজগীর। দু'জন দুই ট্রেনযাত্রী।
নয়, এক লাইনের ট্রেনও নয়। তবু মনের ভুলে দু'জন যেন বড় কাছাকাছি হয়ে গিয়েছিল। যা নিতান্ত অশোভন ও অসঙ্গত, তাই দিয়ে দু'জনে যেন কিছুক্ষণের মত শোভন ও সঙ্গত হয়ে উঠেছিল। হয়তো কোন প্রসঙ্গ পায় না বলে শতদল বলে তোমাকে তাহলে বোধহয়
পাটনার ট্রেন ধরতে হবে? —হ্যাঁ। তুমি খেয়ে নাও।
এক নিঃশ্বাসে যেন জোর করে কোনমতে কথাগুলি উচ্চারণ করেই মাধুরী সরে যায়। সত্যিই তো, পাটনার ট্রেনেই তাকে চলে যেতে হবে, চিরকালের মত। এখানে বসে থাকবার জন্য সে আসেনি। নিজের হাতঘড়িটার দিকে সন্ত্রস্তভাবে তাকায় মাধুরী; তারপর আবার আগের মতই বেঞ্চটার ওপর গিয়ে বসে থাকে।
খাবারগুলো শতদলের সম্মুখে সাজানো। কাচের গেলাসের গায়ে বিদ্যুতের বাতিটার আলো ঝলকায়, জলটাকে তরল আগুনের মত মনে হয়। আবার বোধহয় অপ্রস্তুত ও লজ্জিত হয়েছে শতদল। কিন্তু বড় শ্লেষ, বড় জ্বালা আছে এ লজ্জায়। সব জেনেশুনেও হঠাৎ লোভের ভুলে এক প্রহেলিকার মায়াকে কেন সত্য বলে বিশ্বাস করেছিল শতদল?
ছটফট করে চেয়ার ছেড়ে ওঠে দাঁড়ায় শতদল, চাদরটা গায়ে জড়িয়ে লম্বা চেয়ারের ওপর শুয়ে পড়ে, সিগারেট ধরায়। খাবার খেতে পারল না শতদল। কিন্তু কেন? এ প্রশ্নের উত্তর আজ নিজের মনের মধ্যে খুঁজে পাওয়ার জন্য কোন চেষ্টা করে না
শতদল। ওয়েটিংরুম আবার ওয়েটিংরুম হয়ে ওঠে। দুই সম্পর্কহীন অনাত্মীয়, ভিন্ন ভিন্ন ট্রেনের দুই যাত্রী প্রতীক্ষার মুহূর্ত গুনছে। কিন্তু ট্রেনও আসে না, তৃতীয় কোন যাত্রীও ঘরে প্রবেশ করে না। আসে বয়, হাতে একটি ট্রে, তার ওপর চায়ের সরঞ্জাম সাজানো। একটি টি-পট, একটি দুধের জার, একটি চিনির পাত্র, কিন্তু পেয়ালা দুটি।
টেবিলের ওপর ট্রে-সমেত চায়ের সরঞ্জাম রেখে বয় চলে যায়। তৃষ্ণার্ত দৃষ্টি তুলে চায়ের পাত্রের দিকে একবার ঢাকায় শতদল, কিন্তু পরমুহূর্তে যেন একটা বাধা পেয়ে দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়।ট্রের ওপর দুটি চায়ের পেয়ালা। কি ভয়ানক বিদ্রূপ! কোন্ বুদ্ধিতে বয়টা দুটি চায়ের পেয়ালা দিয়ে গেল কে জানে? সেরকম কোন নির্দেশ তো বয়কে দেয়নি শতদল।
চা খাওয়াও আর সম্ভব হলো না।সোজাসুজি তাকিয়ে না দেখুক, মাধুরী যেন মনের চোখ দিয়ে স্পষ্ট করেই দেখতে পাচ্ছে, খাবার স্পর্শ করছে না শতদল, চা-ও বোধহয় খাবে না। বয়টা এক নম্বরের মুখ্যু, চা-টা যদি ঢেলে দিয়ে যেত, তবে ভদ্রলোক বোধহয় এরকম কুণ্ঠিত হয়ে বসে থাকতেন না। কিন্তু এত কুণ্ঠাইবা কেন? এ তো আর মধুপুর নয়, সেজমামার বাসাও নয়, আর সেই বড়দিনের ছুটির দিনটাও নয়।
বড়দিনের ছুটিতে মধুপুরে সেজমামার ওখানে বেড়াতে গিয়েছিল শতদল আর মাধুরী। প্রথম দিনেই দুর্ঘটনাটা ঘটেছিল, অনেকটা এইরকমই নিঃশব্দ প্রতিবাদের
মত চা না খেয়ে সারা সকালটা বাগানের একটা ঝাউয়ের নিচে চেয়ার টেনে বলে রইল শতদল। প্রতিবাদের কারণ, বাড়িতে এত লোক থাকতে আর সবার উপরে মাধুরী থাকতেও শতদলকে চা দিয়ে গেল বাড়ির চাকর। রহস্যটা যখন পরা পড়লো, বাড়িসুদ্ধ লোক তখন লজ্জায় অপ্রস্তুত হয়ে গেল। সবচেয়ে বেশি বকুনি খেল মাধুরী। মামীমা বকলেন, সেজমামা বকলেন, এমনকি স্বল্পভাষী বড়দাও বকলেন— যখন জানিস যে, তুই নিজের হাতে চা না এনে দিলে শতদল অসন্তুষ্টকিন্তু এটা ওয়েটিংরুম, সেজমামার বাসা নয়। অভিমানী স্বামীর মত এমন মুখ ঘুরিয়ে এভাবে পড়ে থাকা আজ আর শতদলকে একটুও মানায় না।
কিন্তু কি আশ্চর্য, এই বিসদৃশ অভিমানের আবেদন ওয়েটিংরুমের অন্তর যেন স্পর্শ করেছে। রঙ্গমঞ্চের একটি নাটকাঙ্কের দৃশ্যের মত কৃত্রিম হয়েও ঘটনাটা সত্যি সত্যি মান-অভিমানের দাবি নিয়ে যেন প্রাণময় হয়ে ওঠে। মাধুরীকে এখানে ধমক দিয়ে কর্তব্য স্মরণ করিয়ে দেবার কেউ নেই, তবু নিজের মনের গভীরে কান পেতে শুনতে পায়, কেউ যেন তাকে কর্তব্য স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে।
—খাবার খাচ্ছ না কেন?
বড় কোমল ও মৃদু অনুনয়ের সুর ছিল মাধুরীর কথায়। শতদল শান্তভাবে উত্তর দেয় না। এতে রাত্রে এসব আর খাব না।
—তবে শুধু চা খাও।
—হ্যাঁ, চা অবশ্য খেতে পারি।...তুমি খাবে? মাধুরীর মুখের হাসির ছায়া পড়ে। আমার কি চা খাবার কথা ছিল?
শতদল লজ্জিতভাবে হাসে—তা অবশ্য ছিল না। কিন্তু বয়টা যখন ভুল করে।দুটো পেয়ালা দিয়েই গেছে, তখন...।
—তখন এক পেয়ালা চা আমার খাওয়াই উচিত, এই তো?
মাধুরীর কথার মধ্যে কোন সঙ্কোচ বা জড়তা ছিল না। হেসে হেসে কথাগুলি বলতে পারে মাধুরী।
শতদল বলে—আমি তো তাই মনে করি! বয়টার আর কি দোষ বলো? মাধুরী—না, বয়কে আর দোষ দিয়ে লাভ কি?
দু'জনেই ক্ষণিকের মত গম্ভীর হয়। সত্যিই তো বয়কে দোষ দিয়ে লাভ কি। মাধুরীর কথাগুলির মধ্যে কেমন একটা আক্ষেপের সুর যেন মিশে আছে। বোধহয় বলতে চায় মাধুরী, বয়টার দোষ হবে কেন, দোষ অদৃষ্টের, নইলে আজ পাঁচ বছর পরে এমন একটা বিশ্রী রাত্রিতে একটা ওয়েটিংরুমের চক্রান্তে পড়ে কেন এভাবে অপ্রস্তুত হতে হবে?হয় আর চুপ করে বসে থাকায় শক্তি ছিল না, নয় ইচ্ছে করে এইওয়েটিংরুমের চক্রান্তে আত্মসমর্পণ করতে চায় মাধুরী। উঠে দাঁড়ায়, টেবিলের
কাছে এগিয়ে আসে, চা তৈরি করে। সেই হাতে, সেই নিপুণতা দিয়ে, স্বচ্ছন্দে ও সাগ্রহে শতদলও ওঠে, একটা চেয়ার তুলে নিয়ে এসে টেবিলের কাছে নিজের চেয়ারের পাশে রাখে। মাধুরীর দিকে তাকিয়ে বলে–বসো।মাধুরী আপত্তি করে না। আপত্তি করার মত জোগুলিকে আর মনের মধ্যে
খুঁজে পায় না। রাজপুর জংশনের ওয়েটিংরুম দুই অনারীয় নরনারীর মনের ভুলে ধীরে ধীরে সম্পত্তির নিস্তৃত নীড়ের মত আবেগময় হয়ে উঠেছে, বুঝতে পারলেও কেউ আর ঘটনাটাকে বাধা দিতে চায় না। শতদলের পাশের চেয়ারে বসে পড়ে
চায়ে চুমুক দিয়ে একটা তৃপ্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে শতদল। শুধু চায়ের আস্বাদ পেয়ে নিশ্চয় নয়, চায়ের সঙ্গে মাধুরীর হাতের স্পর্শ মিশেছে, তৃষ্ণা মিটে যাবারই
কথা। শতদল হাসিমুখে বলে তোমার গম্ভীর ভাব দেখে সত্যিই এতক্ষণ অস্বস্তি হি মাধুরীও হাসে তোমার তো অস্বস্তি হচ্ছিল, কিন্তু আমার যা হচ্ছিল তা আমি জানি।শতদল–ভয় করছিল বুঝি?
মাধুরী মাথা হেঁট করে হ্যাঁ।
শতদল–ছি, ভয় করবার আছে? হাসতে হাসতে আলাপটা শুরু হয়েও শেষ দিকে কথাগুলি কেমন একটা করুণতার তারে বিনমিত হয়ে যায়। মাধুরীর কথাগুলির বেদনাময় স্বীকৃতির মত, শতদলের কথায় আশ্বাসের নিবিড়তা। সে অতীত হয়েই গেছে, আজ আর ভয় করবার কি আছে?
মানুষ মরে যাবার পর যেমন তার কথা মমতা দিয়ে বিচার করা সহজ হয়ে ওঠে, আর ভুলগুলি ভুলে গিয়ে গুণগুলিকে বড় করে ভাবতে ইচ্ছে করে, শতদল আর মাধুরী বোধহয় তেমনি করেই আজ তাদের মৃত অতীতকে মমতা দিয়ে বিচার করতে পারছে। অতীতের সেই ভয়, ঘৃণা ও সংশয়ের ইতিহাস যেন নিজেরই জ্বালায় ভস্ম হয়ে সংসারের বাতাসে হারিয়ে গেছে। আজ শুধু মনে হয়, সেই অতীত যেন সাত বছরের একটি রাত্রির আকাশ, তার মধ্যে ফুটে উঠেছিল ছোট বড় কত তারা, কত মধুর ও স্নিগ্ধ তার আভা। সে আকাশ একেবারে হারিয়ে গেছে, ভাবতে কষ্ট হয়, বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করে না, ফিরে পেতে ইচ্ছা করে বৈকি!
শতদলের মুখের দিকে তাকিয়ে মাধুরী বলে, তুমি অনেক রোগা হয়ে গেছ। শতদল—নিজে কি হয়েছ?
চায়ের পেয়ালাটা হাতে ধরে রেখেছিল মাধুরী। সেই দিকে তাকিয়ে শতদল অনুযোগের সুরে বলে—আঙুলগুলোর এ দশা হয়েছে কেন?
মাধুরী—কি হয়েছে?
শতদল–কি বিশ্রী রকমের সরু সরু হয়ে গেছে। মাধুরী লজ্জিতভাবে হাসে, আঁচলের আড়ালে হাতটা লুকিয়ে ফেলতে চায়। কিন্তু শতদল যেন একটু দুঃসহ লোভের ভুলে কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে মাধুরীর হাতটা টেনে নিয়ে দু'হাত দিয়ে চেপে ধরে। মাধুরী আপত্তি করে না।
এ বড় অদ্ভুত! সাত বছরের যে জীবন-কুঞ্জ একেবারে বাতিল হয়ে গেছে, আজ এতদিন পরে দেখা যায়, বাতিল হয়ে গেছে তার কাঁটাগুলি, বাতিল হয়নি তার ছায়া।
একটা অজানা সত্য যেন আজ হঠাৎ আবিষ্কার করে ফেলেছে, মাধুরীর মুখের দিকে তাকিয়ে বলে–তোমার মুখটি কিন্তু সেই রকমই আছে মাধুরী, একটুও বদলায়নি।
বদলে গেছে সব, শুধু সেই মুখটি বদলায়নি। বাতিল হয়ে গেছে সব, শুধুসেই ভালবাসার মুখটি বাতিল হয়ে যায়নি। এও কি সম্ভব? হয় চোখের ছলনা, নয়
কল্পনার বিভ্রম।
সব ছলনা ও বিভ্রমকে মিথ্যে করে দিয়ে মাধুরীর সারা মুখে নিবিড় এক লজ্জার ছায়া রক্তাভ হয়ে ওঠে। প্রথম ভালবাসার সম্ভাষণে চঞ্চলিতচিত অনূঢ় মেয়ের মুখের মত নয়, বাসরকক্ষে প্রথম পরিচিতা ব্রীড়ানাতা বধুর মুখের মত নয়, দীর্ঘ অদর্শনের পর স্বামীর সম্মুখে সমাদরধন্য নারীর মুখের মতই!প্রণয়কুঞ্জ নয়, বাসরকক্ষ নয়, দম্পতির গৃহনিভৃত নয়, রাজপুর জংশনের
ওয়েটিংরুম। তবু শতদল আর মাধুরী, দুই ট্রেনযাত্রী বসে থাকে পাশাপাশি, যেনএইভাবে তারা চিরকালের সংসারে সহযাত্রী হয়ে আছে, কোনদিন বিচ্ছিন্ন হয়নি। চা খাওয়া শেষ হয়। মাধুরী জিজ্ঞাসা করে কাকাবাবু এখন কোথায় আছেন? শতদল—তিনি দেরাদুনে বাড়ি করেছেন, এখন সেখানেই আছেন।
মাধুরী—পুঁটি?
শতদল—পুঁটির বিয়ে হয়ে গেছে, সেই রমেশের সঙ্গে। দিল্লির সেক্রেটারিয়েটে
ভালই একটা চাকরি পেয়েছে রমেশ। মাধুরীর হাতটা বড় শক্ত করে ধরেছিল শতদল। যেন পাঁচ বছর অতীতের
এক পলাতক মায়াকে অনেক সন্ধানের পর এতদিনে কাছে পেয়েছে। দু'হাত দিয়ে
ধরে রেখেছে তার এক হাত, যেন আবার হারিয়ে না যায়।
—তুমি বিশ্বাস কর মাধুরী?
-কি?
—তোমাকে আমি ভুলিনি, ভুলতে পারা যায় না। বিশ্বাস না করার কি আছে, চোখেই দেখতে পাচ্ছি।
—কিন্তু তুমি?
-কি?
—তুমি ভুলতে পেরেছ আমাকে?
দু'চোখ বন্ধ করে মাধুরী, যেন চারদিকের বাস্তব সংসারের লোকচক্ষুগুলিকে অন্ধ করে দিয়ে উত্তর দেবার জন্য প্রস্তুত হয়। মাথাটা শতদলের বুকের কাছে একটু ঝুঁকে পড়ে, 'দু'চোখের কোণে ছোট ছোট মুক্তা-কণিকার মত দুটি সজলতার বিন্দু জেগে ওঠে।
দু'হাতে জড়িয়ে মাধুরীর মাথাটা বুকের উপর টেনে নেয় শতদল—বলতেই হবে মাধুরী, আমি না শুনে ছাড়বো না।হঠাৎ ছটফট করে ওঠে মাধুরী, যেন মাধুরীকে একটা আগুনের জ্বালা হঠাৎ দু'হাতে জড়িয়ে ধরেছে। শতদলের হাত ছাড়িয়ে উঠে দাঁড়ায়। বাইরে শীতার্ত রাত্রির স্তব্ধতা চমকে দিয়ে প্রবল শব্দে লোহার ঘণ্টা বাজছিল ঝনঝন করে। ঘরেরভেতর আয়নটাও কাঁপছিল। যেন দুটি জীবনের এই দুঃসাহসের ব্যভিচার সইতে না পেরে ওয়েটিংরুমটাই আর্তনাদ করে উঠেছে। ধুলিয়ান আপ প্যাসেঞ্জার এসে পড়েছে, ছুটোছুটির সাড়া পড়ে গেছে প্ল্যাটফর্মের ওপর। —এই ট্রেনেই তো ওর আসবার কথা।
উদ্ভ্রান্তের মত কথাগুলি বলতে বলতে দরজার দিকে ছুটে যায় মাধুরী।
তৃতীয় যাত্রী এসে ওয়েটিংরুমে প্রবেশ করে। মাধুরীকে দেখতে পেয়েই তার সারা মুখ আনন্দে দীপ্ত হয়ে ওঠে, যেন এই অমাবৃত রাত্রির পথে এতক্ষণ পরে পান্থশালার আলোেক দেখতে পেয়েছে মাধুরী রায়ের স্বামী অনাদি রায়।
মাধুরীর মুখও পুলকিত হয়ে উঠেছে দেখা যায়, কিন্তু তখনো যেন একটু বিষণ্নতার স্পর্শ লেগে ছিল, ক্লান্ত প্রদীপের আলোকে যেমন একটু ধোঁয়ার ভাব থাকে।
অনাদি রায় কিন্তু তাতেই বিচলিত হয়ে ওঠেন। মাধুরীর কাছে এগিয়ে এসে ব্যস্তভাবে প্রশ্ন করেন—শরীর-টরীর ভাল বোধ করছো তো? —হ্যাঁ, ভালই আছি।
-অনেকক্ষণ ধরে একা একা বসে থাকতে হয়েছে, না?
-হ্যা
—কি করবো বলো? ট্রেনগুলো যে রকম বে-টাইমে চলছে, নইলে দু'ঘণ্টা
আগেই পৌঁছে যেতাম।
অনাদি রায় উৎসাহের সঙ্গে একটা বেডিং খুলতে আরম্ভ করেন। আপত্তি করে–থাক, ওসব খোলামেলা করে লাভ নেই। —তুমি একটু শুয়ে নাও মাধুরী, রেস্ট পেলে শরীর ভাল বোধ করবে।
–থাক, আর কতক্ষণই বা।
অনাদি রায় কিন্তু নিরুৎসাহিত হলেন না। বাক্স খুলে একটা মির্জাপুরী আলোয়ান বের করলেন। দুর্ভাঁজ করে নিজের হাতেই আলোয়ানটা মাধুরীর গায়ে পরিপাটি করে জড়িয়ে দিলেন।
এতক্ষণ চেয়ারের ওপর স্থির হয়ে বসে দেখছিল শতদল। একটা প্রহসনের দৃশ্য, নির্মম ও অশোভন। কিন্তু বেশিক্ষণ স্থির হয়ে বসে থাকা আর সম্ভব হলো না। একবার ব্যস্ত হয়ে উঠে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে গিয়ে বাইরে উকি দিয়ে দেখে। ফিরে এসে জিনিসপত্রগুলি একবার অকারণ টানাটানি করে। যেন একটা শান্তির কারাগারে বন্দী হয়ে শতদলের অন্তরাত্মা ছটফট করছে। যেন একটু সুস্থির হবার মত ঠাঁই, অথবা পালিয়ে যাবার পথ খুঁজছে শতদল।
দৃশ্যটা সত্যি সহ্য হল না। মির্জাপুরী আলোয়ান যেন মাধুরীর পথশ্রমক্লান্ত আত্মাকে শত অনুরাগে জড়িয়ে ধরে রয়েছে। অনাদি রায় নামে এই সজ্জন, কী গরবে গরীয়ান হয়ে বসে আছেন হাসিমুখে! আর ঐ মাধুরী, যেন পৌরাণিক কিংবদন্তীর এক নারী, স্বয়ংবরার অভিনয় মাত্র করে, কিন্তু বরমাল্য দান করে তারই গলায়, যে তাকে লুঠ করে রথে তুলে নিয়ে চলে যেতে পারে। এক ভগ্নবাহু প্রতিদ্বন্দ্বীর মত সকল পরাভবের দীনতা নিয়ে অসহায়ভাবে তাকিয়ে থাকে শতদল।সহ্য করতে কস্ট হয়।
চলে গেলেই তো হয়, কেন বসে বসে এত জ্বালা সহ্য করে শতদল? যেতে পারে না একটি লোডের জন্য। মাধুরীর কাছ থেকে সেই প্রশ্নের উত্তরটা শুনে যাবার লোভ। মাধুরী তাকে ভুলতে পারেনি, মাত্র এইটুকু সত্য মাধুরীর মুখ থেকে শুনে যেতে পারলেই জয়ীর আনন্দ নিয়ে চলে যেতে পারবে শতদল।
কিন্তু ইহজীবনে এই উত্তর শুনে যাবার কোন সুযোগ আর হবে কি? অনাদি রায় ঘড়ি দেখলেন, বোধহয় ট্রেনের টাইম হয়ে এসেছে। মাধুরী তার আখৃস্টার জড়ানো গায়ে। কুলিও পৌঁছে গেল, পাটনার ট্রেন আসছে। স্বামীর পাশে দাঁড়িয়েছিল মাধুরী। কুলিরা চটপট জিনিসপত্রগুলি মাথায় চাপিয়ে দাঁড়ালো। রাজপুর জংশনের ওয়েটিংরুমকে শূন্য করে দিয়ে ওরা এখনই চলে যাবে। শতদলের মনে হয়, মাধুরী যেন যাবার আগে এক জতুগৃহের গায়ে আগুনের জ্বালা লাগিয়ে দিয়ে সরে পড়ছে।
সাত বছরের আকাশ কি নিতান্ত মিথ্যা? তাকে কি ভুলতে পারা যায়? ছিন্ন করে দিলেই কি ভিন্ন করা যায়? এ প্রশ্নের উত্তর আর দিয়ে যাবে না মাধুরী, উত্তর দেবার আর কোন সুযোগও নেই। কোন দিকে না তাকিয়ে শুধু স্বামীর সঙ্গে হাসতে হাসতে এই ঘরের দুয়ার
পার হয়ে চলে গেলেই ভাল ছিল, কিন্তু ঠিক সেভাবে চলে যেতে পারলো না
মাধুরী। কুলিরা চলে গেল, অনাদি রায় এগিয়ে গেলেন, কিন্তু দরজার কাছ পর্যন্তএসে মাধুরী যেন চরম অন্তর্ধানের আগে এই জতুগৃহের জন্যই একটা অলীক
মমতায় টানে একবার থমকে দাঁড়ায়। মুখ ফিরিয়ে শতদলের দিকে তাকায়।
হাসিমুখে বিদায় চায়—যাই।
শতদল হাসতে চেষ্টা করেও হাসতে পারে না। অনেকগুলি অভিমান আর দাবি একসঙ্গে এলোমেলোভাবে তার কথায় ফুটে উঠতে চাইছে। কিন্তু এত কথা বলার সময় আর কই? শুধু সেই একটি প্রশ্নের উত্তর শুনে চরম জানা জেনে নিতে চায় শতদল।
—যাচ্ছ, কিন্তু আমার প্রশ্নের উত্তর তো দিয়ে গেলে না মাধুরী? হাসি মুখে যায়, মাধুরী বিস্মিতভাবে তাকিয়ে প্রশ্ন করে–কিসের প্রশ্ন?
শতদল বলে—সত্যি ভুলে গেছ?
উত্তর দেয় না মাধুরী। ভুলেই গেছে বোধহয়। সাত বছরের ইতিহাস ভুলতে পারেনি মাধুরী, সাত মিনিট আগে কথা সে কি ভুলে গেল? এরই মধ্যে বিশ্বসংসারের নিয়মগুলি কি এমনই উল্টে গেল যে, সব ভুলে যেতে হবে। বুঝতে পারে না শতদল।
মাধুরী বলে—যাই, দেরি হয়ে যাচ্ছে।
শতদলের সব কৌতূহলের লোভ যেন একটা রূঢ় আঘাতে ভেঙে যায়। এতক্ষণে মনে পড়ে, মাধুরীর যে একটি পরম গম্ভব্য আছে, আর দেরি করতে পারে না। সাত বছর দেরি করিয়ে দিয়েছে শতদল, এখন আর এক মুহূর্তও মাধুরীকে দেরি করিয়ে দেবার কোন অধিকার নেই। শতদল বিমর্ষভাবে বলে—বুঝেছি, তুমি উত্তর দেবে না।
মাধুরী শান্তভাবে বলে উত্তর দেওয়া উচিত নয়।
শতদল কেন? মাধুরী—বড় অন্যায় প্রশ্ন।
–বুঝেছি! ছটফট করে চেয়ার ছেড়ে উটে দাঁড়ায় শতদল। তার অন্তরাত্মা যেন কিসের মোহে অবুঝ হয়ে আছে, যার জন্যে বার বার শুধু বুঝতে হচ্ছে। অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে শতদল এক নিঃশ্বাসে এবং একটু রূঢ়ভাবে বলে—যাও, কিন্তু এরকম একটা তামাসা করে যাবার কোন দরকার ছিল না।
বড় তিক্ত শতদলের কথাগুলি। মুহূর্তের মধ্যে মাধুরীর মুখটাও কঠিন হয়ে ওঠে, ভ্রু কুঞ্চিত ওঠে। চুপ করে কি যেন ভেবে নেয়। কিন্তু পরমুহূর্তে আগের মতই আবার হাস্যময় হয়ে ওঠে। বোধহয় সেই অলীক মমতার টানে এই জতুগৃহকে যাবার আগে জ্বালিয়ে দিয়ে নয়, একটু বুঝিয়ে দিয়ে আর হাসিয়ে দিয়ে
যাবার জন্য প্রস্তুত হয় মাধুরী। হাতঘড়ির দিকে একবার চকিতে তাকিয়ে নিয়ে মাধুরী বলে একবার
সুধাকে নিয়ে রাজগীরে বেড়াতে এস। শতদল অপ্রস্তুতভাবে তাকায়—তারপর?
—তারপর তোমার দু'জনে যেদিন বিদায় নেবে, আমি এসে ট্রেনে তুলে দিয়ে
--কেন?
—আমাকে একটা তামাসা দেখাবার সুযোগ তোমরাও পাবে, এইমাত্র। —তাতে তোমার লাভ?
মাধুরী হেসে ফেলে লাভ কিছু নয়, তোমার মতই হয়তো এই রকমমিছিমিছি রাগ করে কতগুলি বাজে কথা বলবো। মাত্র কয়েকটি মুহূর্ত, নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে থাকে শতদল, তারপরেই বলে ওঠে—বুঝলাম।
কথাটা বেশ জোরে উচ্চারণ করে, এবং সঙ্গে সঙ্গে হেসেও ফেলে শতদল। বাজে কথার অভিমান আর দাবীগুলি যেন নিজের স্বরূপ চিনতে পেরে অট্টহাস্য করে উঠেছে। এতক্ষণে সত্যিই বুঝতে পেরেছে শতদল। হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে সময় দেখতে থাকে এবং দরজার দিকে না তাকিয়েও বুঝতে পারে শতদল, মাধুরী চলে গেল।
জতুগৃহে আর আগুনের স্ফুলিঙ্গ লাগানো না, লাগানো উচ্চহাসির প্রতিধ্বনি। রাজপুর জংশনের যেন সুপ্তি ভেঙে গেল। আর একটি আগন্তুক ট্রেনের সঙ্কেতধ্বনিও বাজে। কলকাতার ট্রেনও এসে পড়েছে। এদিকের প্ল্যাটফর্মে নয়, উল্টো দিকে। কুলির মাথায় জিনিসপত্র চাপিয়ে শতদল দত্তও ব্যস্তভাবে চলে যায়।
দু'দিকের ট্রেন চলে যাবে। রাজপুর জংশনের শেষ রাত্রি ক্ষণিক কলরবের পর নীরব হয়ে যাবে। এরই মধ্যে এক প্রতীক্ষাগৃহের নিভৃতে দুই ট্রেনযাত্রীর সম্পর্কের ইতিহাস নিয়ে কি যে পরীক্ষা হয়ে গেল, তার সাক্ষ্য আর কিছু থাকবে না।
কিন্তু এখনও আছে, যদিও দেখে কিছু বোঝা যায় না।
ওয়েটিংরুমের টেবিলের ওপর একটি ট্রে, তার ওপর পাশাপাশি দুটি শূন্য চায়ের পেয়ালা। কোথা থেকে কারা দু'জন এসে, আর পাশাপাশি বসে তাদের তৃষ্ণা মিটিয়ে চলে গেছে। রাজপুর জংশন আবার ঘুমিয়ে পড়ার আগে বয় এসে তুলে নিয়ে যাবে, ধুয়ে মুছে সাজিয়ে রেখে যাবে, একটা পেয়ালা কাবার্ডের এই দিকে, আর একটা হয়তো একেবারে ঐ দিকে।
(২)****ফসিল----
নেটিভ স্টোট অল্পনগড়; আয়তন কাঁটায় কাঁটায় সাড়ে-আটষট্টি বর্গমাইল]। তবুও নেটিভ স্টেট, বাঘের বাচ্চা বাঘই। মহারাজ আছেন; ফৌজ, ফৌজদার, সেরেস্তা, নাজারৎ সব আছে। এককুড়ির উপর মহারাজের উপাধি? তিনি ত্রিভুবনপতি; তিনি নরপাল, ধর্মপাল ও অরাতিদমন। চারপুরুষ আগে এরাজ্যে বিশুদ্ধ শাস্ত্রীয় প্রথায় অপরাধীকে শূলে চড়ানো হতো; এখন সেটা আর সম্ভব নয়। তার বদলে
অপরাধীকে শুধু উলঙ্গ করে নিয়ে মৌমাছি লেলিয়ে দেওয়া হয়। সাবেক কালের কেল্লাটা যদিও লুপ্তশী, তার পাথরের গাঁথুনিটা আজও অটুট। কেল্লার ফটকে বুনো হাতীর জীর্ণ কঙ্কালের মত দুটো মরচে-পড়া কামান। তার নলের ভেতরে পায়রার দল স্বচ্ছন্দে ডিম পাড়ে; তার ছায়ায় বসে ক্লান্ত কুকুরেরা ঝিমোয় দপ্তরে দপ্তরে শুধু পাগড়ি আর তরবারির ঘটা; দেয়ালে দেয়ালে ঘুঁটের
মত তামা আর লোহার ঢাল সচিব আছে, সেরেস্তাদারও আছে। ক্ষত্রিয় তিলক আর মোগল তকমার অদ্ভুত মিলন দেখা যায় দপ্তরে। যেন দুই যুগের দুই জাতের আমলাদের যৌথপ্রতিভার সাহায্যে মহারাজা প্রজারঞ্জন করেন। সেই অপূর্ব অদ্ভুত শাসনের তাপে উত্ত্যক্ত হয়ে রাজ্যের অর্ধেক প্রজা সরে পড়েছে দূর মরিসাসের চিনির কারখানায় কুলির কাজ নিয়ে।
সাড়ে-আটষট্টি বর্গমাইল অগুনগড়–শুধু ঘোড়ানিম আর ফণীমনসায় ছাওয়া রুক্ষ কাঁকরে মাটির ডাঙা আর নেড়া নেড়া পাহাড়। কুর্মি আর ভীলেরা দু'ক্রোশ দূরের পাহাড়ের গায়ে লুকানো জলকুণ্ড থেকে মোষের চামড়ার থলিতে জল ভরে আনে—জমিতে সেচ দেয়—ভুট্টা যব আর জনার ফলায়।
প্রত্যেক বছর স্টেটের তসীল বিভাগ আর ভীল ও কুর্মি প্রজাদের মধ্যে একটা সংঘর্ষ বাধে। চাষীরা রাজভাণ্ডারের জন্য ফসল ছাড়তে চায় না। কিন্তু অর্ধেক ফসল দিতেই হবে। মহারাজার সুগঠিত পোলো টীম আছে। হয়শ্রেষ্ঠ শতাধিক ওয়েলারের হেষারবে রাজ-আস্তাবল সতত মুখরিত। সিডনির নেটিভ এই দেবতুল্য জীবগুলির ওপর মহারাজার অপার ভক্তি। তাদের তো আর খোল ভুষি খাওয়ানো চলে না। ভুট্টা, যব, জনার চাই-ই।তসীলদার অগত্যা সেপাই ডাকে। রাজপুত বীরের বল্লম আর লাঠির মারেক্ষাত্রবীর্যের স্ফুলিঙ্গ বৃষ্টি হয়। এক ঘণ্টার মধ্যে সব প্রতিবাদ স্তব্ধ, সব বিদ্রোহ
প্রশমিত হয়ে যায়। পরাজিত ভীলদের অপরিমেয় জংলী সহিষ্ণুতাও ভেঙে পড়ে। তারা দলে দলে রাজ্য ছেড়ে গিয়ে ভর্তি হয় সোজা কোন ধাঙড়-রিক্রুটারের ক্যাম্পে। মেয়ে মরদ
শিশু নিয়ে কেউ যায় নয়াদিল্লি, কেউ কলকাতা, কেউ শিলং। ভীলেরা ভুলেও আর ফিরে আসে না।
শুধু নড়তে চায় না কুর্মি প্রজারা। এ-রাজ্যে তাদের সাতপুরুষের বাস। ঘোড়ানিমের ছায়ায় ছায়ায় ছোট বড় এমন ঠাণ্ডা মাটির ডাঙা, কালমেঘ আর অনন্ত মূল্যের চারার এক একটা ঝোপ; সালসার মত সুগন্ধ মাটিতে। তাদের যেন নাড়ীর টানে বেঁধে রেখেছে এই মাটি। বেহায়ার মত চাষ করে, বিদ্রোহ করে আর মারও খায়—ঋতুচক্রের মত এই ত্রিদশার আবর্তনে তাদের দিনসন্ধ্যার সমস্ত মুহূর্তগুলি ঘুরপাক খায়। এদিকে ওদিক হবার উপায় নেই।
তবে অম্লনগড় থেকে দয়াধর্ম একেবারে নির্বাসিত নয়। প্রতি রবিবারে কেল্লার সামনে সুপ্রশস্ত চবুতরায় হাজারের ওপর দুঃস্থ জমায়েত হয়। দরবার থেকে বিতরণ করা হয় চিড়ে আর গুড়। সংক্রান্তির দিনে মহারাজা গায়ে আলপনা আঁকা হাতীর পিঠে চড়ে আর জলুস নিয়ে পথে বার হন—–প্রজাদের আশীর্বাদ করতে। তার জন্মদিনে কেল্লার আঙিনায় রামলীলা গান হয় প্রজারা নিমন্ত্রণ পায়। তবে অতিরিক্ত ক্ষত্রিয়ত্বের প্রকোপে যা হয়—সব ব্যাপারেই লাঠি। যেখানে জনতা আর জয়ধ্বনি, সেখানে লাঠি চলবেই আর দু'চারটে অভাগার মাথা ফাটরেই। ছিড়ে আশীর্বাদ বা রামলীলা—সবই লাঠির সহযোগে পরিবেশন করা হয়; প্রজারা সেই ভাবেই উপভোগ করতে অভ্যস্ত।
লাঠিতন্ত্রের দাপটে স্টেটের শাসন আদায় উসুল আর তসীল চলছিল বটে, কিন্তু যেটুকু হচ্ছিল, তাতে গদির গৌরব অটুট রাখা যায় নরেন্দ্রমণ্ডলের চাঁদা আর পোলো টিমের খরচ! রাজবাড়ির বাপেরকেলে সিন্দুকের রূপো আর সোনার গাদিতে হাত দিতে হয়। আর, সিন্দুকও খালি হাতে থাকে।
অগুনগড়ের এই উদ্বিগ্ন অদৃষ্টের সন্ধিক্ষণে দরবারের ল-এজেন্টদের পদে নিযুক্ত হয়ে এল একজন ইংরেজী আইননবিস উপদেষ্টা। আমাদের মুখার্জীই এল ল-এজেন্ট হয়ে। মুখার্জীর চওড়া বুক—যেমন পোলো ম্যাচে তেমনি স্টেটের কাজে অচিরে মহারাজার বড় সহায় হয়ে দাঁড়ালো। ক্রমে মুখার্জীই হয়ে গেল ডি ফ্যাক্টো সচিবোত্তম, আর সচিবোত্তম রইলেন শুধু সই করতে।
আমাদের মুখার্জী আদর্শবাদী। ছেলেবেলার ইতিহাস-পড়া ডিমোক্রেসীর আজও তার চিন্তার পাকে পাকে জড়িয়ে আছে। বয়সে অপ্রবীণ হলেও সে অত্যন্ত শান্তবুদ্ধি। সে বিশ্বাস করে যে সৎসাহসী সে কখনো পরাজিত হয় না, সে কল্যাণকৃৎ তার কখনো দুর্গতি হতে পারে না।
মুখার্জী তার প্রতিভার প্রতিটি পরমাণু উজাড় করে দিল স্টেটের উন্নতির সাধনায়। অল্পনগড়ের আবালবৃদ্ধ ফেলল তাদের এজেন্ট সাহেবকে, একদিকে যেমন কট্টর অন্যদিকে তেমনি হমদরদ। প্রজারা ভয় পায় ভক্তিও করে। মুখার্জীর নির্দেশে বন্ধ হলো লাঠিবাজি। সমস্ত দপ্তর চুলচেরা অডিট করে তোলপাড় করা হলো। স্টেটের জরীপ হলো নতুন করে; সেঙ্গাস নেওয়া হলো। এমন কি মরচে
পড়া কামান দুটোকেও পালিস দিয়ে চকচকে করে ফেলা হলো। ল-এজেন্ট মুখার্জীই একদিন আবিষ্কার করল অম্লনগড়ের অন্তর্ভৌম সম্পদ। কলকাতা থেকে জিওলজিস্ট আনিয়ে সার্ভে ও সন্ধান করিয়ে একদিন বুঝতে পারে
মুখার্জী—এই অল্পনগড় রত্ন, এর গ্লানিটে গড়া পাজরের ভাঁজে ভাঁজে অভ্র আর অ্যাসবেস্টসের স্তূপ। কলকাতার মার্চেন্টদের ডাকিয়ে ঐ কাঁকুরে মাটির ডাঙাগুলিই। লাখ লাখ টাকায় ইজারা করিয়ে দিল। অঞ্জনগড়ের শ্রী গেল ফিরে।
আজ কেল্লার এক পাশে গড়ে উঠেছে সুবিরাট গোয়ালিয়রী স্টাইলের প্যালেস। মার্বেল, মোজেয়িক, কংক্রীট আর ভিনিসিয়ান সাসীরা বিচিত্র পরিসজ্জা! সরকারী গ্যারেজে দামী দামী, জার্মান লিমুজিন সিজান আর টুরার। আস্তাবলে নতুন আমদানী আইরিশ পনির অবিরাম লাথালাথি। প্রকাণ্ড একটা বিদ্যুতের পাওয়ার হাউস-দিবারাত্র ধক্ ধক্ শব্দে অঞ্জনগড়ের নতুন চেতনা আর পরমায়ু ঘোষণা করে।
সত্যই নতুন প্রাণের জোয়ার এসেছে অঞ্জনগড়ে। মার্চেন্টরা একজোট হয়ে প্রতিষ্ঠা করেছে—মাইনিং সিণ্ডিকেট। খনি অঞ্চলে ধীরে গড়ে উঠেছে খোয়াবাধনো বড় বড় সড়ক, কুলির ধাওড়া, স্প-বসান ইঁদারা, ক্লাব, বাংলো, কেয়ারী করা ফুলের বাগিচা আর জিমখানা। কুর্মি কুলির দলে দলে ধাওড়া জাঁকিয়ে বসেছে। নগদ মজুরী পায়, মুরগি বলি দেয়, হাঁড়িয়া খায় আর নিত্য সন্ধ্যায় মাদল ঢোলক পিটিয়ে খনি অঞ্চল সরগরম করে রাখে।
মহারাজ এইবার প্ল্যান আঁটছেন—দুটো নতুন পোলো গ্রাউণ্ড তৈরি করতে হবে; আরো বাইশ বিঘা জমি যোগ করে প্যালেসের বাগানটাকে বাড়াতে হবে। নহবতের জন্য একজন মাইনে-কথা ইটালীয়ান ব্যান্ডমাস্টার হলেই ভাল।
অঞ্জনগড়ের মানচিত্রটা টেবিলের ওপর ছড়িয়ে মুখার্জী বিভোর হয়ে ভাবে, তার ইরিগেশন স্কীমটার কথা। উত্তর থেকে দক্ষিণ সমান্তরাল দশটা ক্যানেল। মাঝে মাঝে থিলান-করা কড়া-গাঁথুনির শুস-বসানো বড় বড় ডাম। অঞ্জনা নদীর সমস্ত জলের ঢলটা কায়দা করে অঞ্জনগড়ের পাথুরে বুকের ভেতর চালিয়ে দিতে হবে—রক্তবাহী শিরার মত। প্রত্যেক কুর্মি প্রজাকে মাথাপিছু এক বিঘা জমি দিতে হবে বিনা সেলামীতে, আর পাঁচ বছরের মত বিনা খাজনায়। আউশ আর আমন; তা ছাড়া একটা রবি। বছরে এই তিন কিত্তি ফসল তুলতেই হবে। উত্তরে প্লটের সমস্তটাই নার্সারী, আলু আর তামাক; দক্ষিণেরটায় আখ, যব আর গম। তারপর—
তারপর ধীরে একটা ব্যাঙ্ক, ক্রমে একটা ট্যানারী আর কাগজের মিল। রাজকোষের সে অকিঞ্চনতা আর নেই। এই তো শুভ মাহেন্দ্রক্ষণ! শিল্পীর তুলির আঁচড়ের মত এক একটি এস্টিমেটে সে অঞ্জনগড়ের রূপ ফিরিয়ে দেবে। সে দেখিয়ে দেবে—রাজ্যশাসন লাঠিবাজি নয়, এও একটা আর্ট।
একটা স্কুল, এইটাতে মহারাজার স্পষ্ট জবাব, কড়ি নেই। মুখার্জী উঠলো; দেখা যাক বুঝিয়ে বাগিয়ে মহারাজার আপত্তি টলাতে পারে কি না। মহারাজা তাঁর গালপাট্টা দাড়ির গোছাটাকে একটা নির্মম মোচড় দিয়ে মুখার্জীর সামনে এগিয়ে দিলেন দুটো কাগজ—এই দেখ।
প্রথম পত্র, প্রবলপ্রতাপ দরবার আর দরবারের ঈশ্বর মহারাজ! আপনি প্রজার বাপ। আপনি দেন বলেই আমরা খাই। অতএব এ বছর ভুট্টা জনার যা ফলবে, তার উপর যেন তসীলদারের জুলুম না হয়। আমরা নগদ টাকায় খাজনা
দেব। আইনসঙ্গতভাবে সরকারকে যা দেয়, তা আমরা দেব ও রসিদ দেব। ইতি
দরবারের অনুগত ভৃত্য কুর্মি সমাজের তরফে দুলাল মাহাতো, ব্রকলম খাস। দ্বিতীয় পত্র মুহারাজার পেয়াদা এসে আমাদের খনির ভেতর ঢুকে চারজন কুমি কুলিকে ধরে নিয়ে গেছে আর তাদের স্ত্রীদের লাঠি দিয়ে মেরেছে। আমরা একে অধিকারবিরুদ্ধ মনে করি এবং দাবী করি, মহারাজার পক্ষ থেকে শীঘ্রই এ
ব্যাপারের সুমীমাংসা হবে। ইতি সিণ্ডিকেটের চেয়ারম্যান, গিবসন। মহারাজা বললে–দেখছে তো মুখার্জী, শালাদের হিম্মৎ। —হ্যাঁ দেখছি।
টেবিলে ঘুষি মেরে বিকট চিৎকার করে অরাতিদমন প্রায় ফেটে পড়লেন— মুড়ো, শালাদের মুড়ো কেটে এনে ছড়িয়ে দাও আমার সামনে। আমি বসে বসে দেখি; দু'দিন দু'রাত ধরে দেখি। মুখার্জী মহারাজাকে শান্ত করে আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। আমি একবার
ভেতরে ভেতরে অনুসন্ধান করি, আসল ব্যাপার কি।
বুদ্ধ দুলাল মাহাতো বহুদিন পরে মরিসাস থেকে অঞ্জনগড়ে ফিরেছে। বাকী জীবনটা উপভোগ করার জন্য সঙ্গে নগদ সাতটি টাকা এবং বুকভরা কাঁপানি নিয়ে ফিরেছে। তার আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে কুর্মিদের জীবনেও যেন একটা চঞ্চলতা— একটা নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়েছে।
কুর্মিরা দুলালের কাছে শিখেছে নগদ মজুরী কি জিনিস। ফয়জাবাদ
স্টেশনে কোন বাবুসাহেবের একটা দশসেরী বোঝা ট্রেনের কামরায় তুলে দাও!
বাস—নগদ একটি আনা, হাতে হাতে! দুলাল বলেছে–ভাইসব, এই বুড়োর মাথায় যটা সাদা চুল দেখছ, ঠিক ততবার সে বিশ্বাস করে ঠকেছে। এবার আর কাউকে বিশ্বাস নয়। সব নগদ নগদ। এক হাতে নেবে তবে অন্য হাতে সেলাম করবে।
সিণ্ডিকেটের সাহেবদের সঙ্গে দুলাল সমানে কথা চালায়। কুলিদের মজুরীর রেট, হুপ্তা, পেমেন্ট, ছুটি, ভাতা আর ওষুধের ব্যবস্থা—এ সব সেই কুর্মিদের মুখপাত্র হয়ে আলোচনা করেছে; পাকা প্রতিশ্রুতি আদায় করে নিয়েছে। সিণ্ডিকেটও দুলালকে উঠতে বসতে তোয়াজ করে চলে এস দুলাল। বল তো রাতারাতি বিশ ডজন ধাওড়া করে দি। তোমার সব কুর্মিদের ভর্তি করে নেব। কুলি পিছু পিছু কয়লা
দুলাল জবাব দেয়—আচ্ছা, সে হবে। তবে আপাতত আর কেরোসিন তেল মফতি দেবার অর্ডার হোক। —আচ্ছা তাই হবে। সিণ্ডিকেটের সাহেবরা তাকে কথা দেয়।
দুলালের আমন্ত্রণ পেয়ে একদিন রাজ্যের কুর্মি একত্রিত হলো ঘোড়ানিমের জঙ্গলে। পাকাচুলে ভরা মাথা থেকে পাগড়িটা খুলে হাতে নিয়ে দুলাল দাঁড়ানো— আজ আমাদের মণ্ডলের প্রতিষ্ঠা হলো। এখন ভাবো কি করা উচিত। চিনে দেখ, কে আমাদের দুশমন আর কেউ বা দোস্ত। আর ভয় করলে চলবে না। পেট আর ইজ্জত, এর ওপর যে ছুরি চালাতে আসবে তাকে আর কোন মতেই ক্ষমা নয় ।
ভাঙা শঙ্খের মত দুলালের ছবির কণ্ঠনালীটা অতিরিক্ত উৎসাহে কেঁপে কেঁপে আওয়াজ ছাড়ে ভাই সব, আজ থেকে এ মাহাতোর প্রাণ মণ্ডলের জন্য, আর মণ্ডলের প্রাণ...।
কুমি জনতা একসঙ্গে হাজার লাঠি তুলে প্রত্যুত্তর দলি—মাহাতোর জন্য।
ঢাকঢোল পিটিয়ে একটা নিশান পর্যন্ত উড়িয়ে দিল তারা। তারপর যে যার
ঘরে ফিরে গেল।
ঘটনাটা যতই গোপনে ঘটুক না কেন, মুখার্জীর কিছু জানতে বাকি রইল না।
এটুকু সে বুঝল—এই মেঘেই বজ্র থাকে। সময় থাকতে চটপট একটা ব্যবস্থা
দরকার। কিন্তু মহারাজ যেন ঘুণাক্ষরেও জানতে না পান। ফিউডল দেমাকে অস্ত্র
আর ইজ্জত কমপ্লেক্সে জর্জর এই সব নরপালদের তা হলে সামলানো দুষ্কর হবে। বৃথা একটা রক্তপাতও হয়তো হয়ে যাবে। তার চেয়ে নিজেই একহাত ভদ্রভাবে লড়ে নেওয়া যাক। পেয়াদারা এসে মহারাজাকে জানালো কুমিরা রাজবাড়ির বাগানে আর
পোলো লনে বেগার খাটতে এল না। তারা বলছে—বিনা মজুরীতে খাটলে পাপ
হবে; রাজ্যের অমঙ্গল হবে।
ডাক পড়ল মুখার্জীর। দুলাল মাহাতোকেও তলব করা হলো। জোড় হাতে দুলাল মাহাতো প্রণিপাত করে দাঁড়ালো। মেষশিশুর মত ভীরু, দুলাল যেন ঠক্
ঠক্ করে কাঁপছে! —তুমিই এসব শয়তানী করছ? মহারাজ বললেন।
—হুজুরের জুতোর ধুলো আমি।
– চুপ থাক ।
—জী সরকার।
–চুপ! মহারাজা জীমৃতধ্বনি করলেন। দুলাল কাঠের পুতুলের মত স্থির হয়ে গেল। মহারাজা বলেন—বিলাতী বেনিয়াদের সঙ্গে তোমার সম্পর্কে ছাড়তে
হবে।
আমার বিনা হুকুমে কোন কুর্মি খনিতে কুলি খাটতে পারবে না। —জী সরকার। আপনার হুকুম আমার জাতকে জানিয়ে দেবো।
—যাও।
দুলাল দন্ডবৎ করে চলে গেল। এবার আদেশ হলো মুখার্জীর ওপর। সিণ্ডিকেটকে এখুনি নোটিস দাও, যেন আমার বিনা সুপারিশে আমার কোন কুমি প্রজাকে কুলির কাজে ভর্তি না করে।
অবিলম্বে যথাস্থান থেকে উত্তর এল একে একে। দুলাল মাহাতোর স্বাক্ষরিত পত্র।—যেহেতু আমরা নগদ মজুরী পাই, না পেলে আমাদের পেট চলবে না, সেইহেতু আমরা খনি সাহেবদের কথা মানতে বাধ্য। আশা করি দরবার এতে বাধা দেবেন না।... আগামী মাসে আমাদের নতুন মন্দির প্রতিষ্ঠা হবে। রাজ তহবিল থেকে এক হাজার টাকা মঞ্জুর করতে সরকারের হুকুম হয়।... আগামী শীতের সময়ে বিনা টিকিটে জঙ্গলের ঝুরি আর লকড়ি ব্যবহার করার অনুমতি হয়।
নোটিসের প্রত্যুত্তরে সিণ্ডিকেটেরও একটা জবাব এল—মহারাজার সঙ্গে কোন
নতুন শর্তে চুক্তিবদ্ধ হতে আমরা রাজি আছি। তবে আজ নয়। বর্তমান চুক্তির মেয়াদ যখন ফুরোবে–নিরানব্বই বছর পরে। —কী রকম বুঝছ মুখার্জী? অগত্যা দেখছি ফৌজদারকেই ডাকতে হয়। জিজ্ঞাসা করি, খাল-কাটার স্বপ্নটা ছেড়ে দিয়ে এখন আমার ইজ্জতের কথাটা
একবার ভাববে কি না? মহারাজ আস্তে আস্তে বললেন বটে, কিন্তু মুখ-চোখের চেহারা থেকে বোঝা গেল, একটা আক্রোশ শত ফণা বিস্তার করে তাঁর মনের ভেতর ফুঁসে ফুঁসে ছটফটকরছে। মুখার্জী সবিনয়ে নিবেদন করে—মন খারাপ করবেন না সরকার। আমাকে সময় দিন, সব গুছিয়ে আনছি আমি।
মুখার্জী বুঝেছে দুলালের এই দুঃসাহসের প্রেরণা যোগাচ্ছে কারা। সিণ্ডিকেটের দুষ্ট উৎসাহেই কুর্মিসমাজের এই নাচানাচি। এই অশুভযোগ ছিন্ন না
করে দিলে রাজ্যের সমূহ অশান্তি–অমঙ্গলও। কিন্তু কি করা যায়!
দুলাল মাহাতোর কুঁড়ের কাছে মুখার্জী এসে দাঁড়ালো। দুলাল ব্যস্তভাবে বের হয়ে এসে একটা চৌকি এনে মুখার্জীকে বসতে দিল। মাথায় পাগড়িটা খুলে মুখার্জীর পায়ের কাছে রেখে দুলালও বসলো মাটির ওপর। মুখার্জী এক এক করে তাকে সব বুঝিয়ে বলে। যেন একটা অভিযানের সুরে মুখার্জীর গলার স্বর ভেঙে পড়ে—একি করছো মাহাতো! দরবারের ছেলে তোমরা, কখনো ছেলে দোষ করে কখনো বাপ। তাই বলে পরকে ডেকে কেউ ঘরের ইজ্জত নষ্ট করে না। সিণ্ডিকেট আজ তোমাদের ভাল খাওয়াচ্ছে, কিন্তু কাল যখন তার কাজ ফুরোবে তখন তোমাদের দিকে ফিরেও তাকাবে না। এই দরবারই তখন দুমুঠো চিঁড়ে দিয়ে তোমাদের বাঁচাবে।
মুখার্জীর পায়ে হাত রেখে দুলাল বলে—কসম, এজেন্ট বাবা, তোমার কথা রাখব। বাপের তুল্য মহারাজা, তাঁর জন্য আমরা জান দিতে তৈরি। তবে এ দরখাস্তটা একটু জলদি জলদি মঞ্জুর হয়।
দ্বিতীয় প্রশ্ন বা উত্তরের অপেক্ষা না করে মুখার্জী দুলালের কুঁড়ে থেকে বেরিয়ে পড়ে—নাঃ, রোগে তো ধরেই ছিল অনেক দিন; এবার দেখা দিয়েছে বিকারের লক্ষণ।
স্নান আহার আর পোশাক বদলাবার কথা মুখার্জীকে ভুলতে হলো আজ।
একটানা ড্রাইভ করে থামলো এসে সিণ্ডিকেটের অফিসে। —দেখুন মিস্টার গিবসন, রাজা-প্রজা সম্পর্কের ভেতর দয়া করে হস্তক্ষেপ করবেন না আপনারা আপনাদের কারবারের জন্য যে কোন সুবিধা দরবারের কাছে আবেদন করলেই তো পেয়ে যাবেন।
গিবসন বললেন—মিস্টার মুখার্জী, আমরা মনিমেকার নই, আমাদের একটা
মিশনও আছে। নির্যাতিত মানুষের পক্ষে নিয়ে আমরা চিরকাল লড়ে এসেছি।
দরকার থাকে, আরো লড়বো।
-সব কুর্মি প্রজাদের লোভ দেখিয়ে আপনারা কুলি করে ফেলছেন। স্টেটের এগ্রিকালচার তাহলে কি করে বাঁচে বলুন তো! ঝোঁকের মাথায় মুখার্জী তার ক্ষোভের আসল কারণটি ব্যক্ত করে ফেললো।
—এগ্রিকালচার না বাঁচুক, ওয়েল্থ্ তো বাঁচছে। এটা অস্বীকার করতে পাবেন? গিবসন বিদ্রূপের স্তরে উত্তর দেয়।
--তর্ক ছেড়ে কো-অপারেশনের কথা ভাবুন, মিস্টার গিবসন। কুলি ভর্তির সময় দরবার থেকে একটু অনুমোদন করিয়ে নেবেন, এই মাত্র। মহারাজাও খুশি হবেন এবং তাতে আপনাদেরও অন্য দিকে নিশ্চয় ভাল হবে।
—সরি, মিস্টার মুখার্জী। গিবসন বাঁকা হাসি হেসে চুরুট ধরালেন। নিদারুণ বিরক্তিতে লাল হয়ে উঠল মুখার্জীর কর্ণমূল। সজোরে চেয়ারটা ঠেলে দিয়ে দাঁড়ায় মুখার্জী। আর সেই মুহূর্তে অফিস ছেড়ে চলে যায়। ম্যাককেনা এসে জিজ্ঞাসা করলেন—কি ব্যাপার গিবসন?
—মুখার্জী, দ্যাট মংকি অ্যান অ্যাডমিনিস্ট্রেটর, ওকে মুখের ওপর শুনিয়ে
দিয়েছি। কোন টার্মই গ্রাহ্য করিনি। –ঠিক করেছ। শুনেছ তো ওর ঐ ইরিগেশন স্কিমটার কথা? সময় থাকতে ওই স্কিম ভণ্ডুল করে দিতে হবে, নইলে সাংঘাতিক লেবারের অভাবে পড়তে হবে। কারবার এখন বাড়তির মুখে, খুব সাবধান।
-কোন চিন্তা নেই। পোষা বিড়াল মাহাতো রয়েছে আমাদের হাতে। ওকে দিয়েই স্টেটের সব ডিজাইন ভণ্ডুল করবো। পরস্পর হাস্য বিনিময় করে ম্যাককেনা বলেন——মাহাতো এসে বসে আছে
যে; ওকে ডেকে নিয়ে এস, আর সেই কাজটা এবার সেরেই ফেল।
সিণ্ডিকেটের অফিসের পিছনের দরজার কাছে বসে ছিল মাহাতো। অফিসের একটা নিভৃত কামরায় মাহাতোকে নিয়ে গিয়ে গিবসন বলে—এই যে, দরখাস্ত তৈরি।
সব কথা লেখা আছে এতে। সই করে ফেল; আজই দিল্লীর ডাকে পাঠিয়ে দেব। সই করে মাহাতো। মাহাতোর পিঠ থাবড়ে ম্যাককেনা তাকে বিদায় দিল— ডরো মৎ মাহাতো, আমরা আছি। যদি ভিটে-মাটি উৎখাত করে, তবে আমাদের ধাওড়া খোলা থাকবে তোমাদের জন্য সব সময়, ডরো মাৎ
নিজের দপ্তরে বসে মুখার্জী শুধু আকাশপাতাল ভাবে। কলম ধরতে আর মন চায় না। মহারাজাকে আশ্বাস দেবার মত সব কথা ফুরিয়ে গেছে তার। পরের রথের সারথ্য আর বোধহয় চলবে না তার দ্বারা। এইবার রথীর হাতেই তুলে দিতে হবে লাগাম। কিন্তু মানুষগুলির মাথায় ঘিলু নিশ্চয়ই শুকিয়ে গেছে সব। সবাই নিজের নিজের মূঢ়তায়—একটা আত্মবিনাশের উৎকট কল্পনাতাগুবে মজে আছে
যেন। কিংবা সেই ভুল করেছে কোথাও। মহারাজার আহ্বান, খাস কামরায়।
সচিবোত্তম ও ফৌজদার শুদ্ধমুখে বসে আছেন। মহারাজা কৌচের চারিদিক পায়চারি করছেন ছটফট করে। মুখার্জী ঢুকতেই একেবারে অন্যুগার করলেন। নাও, এবার গদিতে থুথু ফেলে আমি চললাম। তুমিই বসো তার ওপর আর
স্টেট চালিও।
হতভম্ব মুখার্জী সচিবোত্তমের দিতে ঢাকায়। মুখার্জীর হাতে সচিবোত্তন তবুনি
তুলে দিলেন একটি চিঠি। পলিটিক্যাল এজেন্টের মোট–স্টেটের ইন্টার্নাল ব্যাপার সম্বন্ধে বহু অভিযোগ এসেছে। দিন দিন আরো নতুন ও গুরুত্বর অভিযোগ সব আসছে। আমার হস্তক্ষেপের পূর্বে, আশা করি, দরবার শীঘ্রই সুব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে সমর্থ হবে।
ফৌজদার একটু ভ্রুকুটি করে বলেন –এই সবের জন্য আপনার কনসিলিয়েশন পলিসিই দায়ী, এজেন্ট সাহেব।
ফৌজদারের অভিযোগের সূত্র ধরে মহারাজা চিৎকার করে উঠলেন–নিশ্চয়, খুব সত্যি কথা। আমি সব জানি মুখার্জী। আমি অন্ধ নই। —সব জানি? এ কি বলছেন সরকার?
—থামো, সব জানি। নইলে আমার রাজ্যের ধুলোমাটি বেচে যে বেনিয়ারা পেট চালায়, তাদের এত সাহস হয় কোথা থেকে। কে তাদের ভেতর ভেতর সাহস দেয়?
মহারাজা যেন দমবন্ধ করে কৌচের উপর এলিয়ে পড়লেন। একটা পেয়াদা ব্যস্তভাবে ব্যজন করে তাঁকে সুস্থ করতে থাকে। সচিবোত্তম কৌজদার আর মুখার্জী, ভিন্ন ভিন্ন দিকে মুখ ফিরিয়ে বোবা হয়ে বসে রইল। গলা ঝেড়ে নিয়ে মহারাজা আবার কথা পাড়লেন—ফৌজদার সাহেব, এবার
আপনিই আমার ইজ্জত বাঁচান।
সচিবোত্তম বলেন—তাই হোক, কুর্মিদের আপনি সায়েস্তা করুন ফৌজদার
সাহেব, আর আমি সিণ্ডিকেটকে একটা সিভিল সুটে ফাঁসাচ্ছি। চেষ্টা করলে
কন্ট্রাক্টের মধ্যে এমন বহু ফাঁক পাওয়া যাবে।
মহারাজা মুখার্জির দিকে চকিতে তাকিয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিলেন। কিন্তু মুখার্জি
এরই মধ্যে দেখে ফেলেছে, মহারাজার চোখ দুটো ভেজা ভেজা। সিংহের চোখে জল। এর পেছনে কতখানি অন্তর্দাহ লুকিয়ে আছে, তা স্বভাবত শশক হলেও মুখার্জি আন্দাজ করে নিতে পারে। সত্যিই তো, এ দিকটা তার এতদিন চোখে পড়েনি। তার ভুল হয়েছে। মহারাজার সামনে এগিয়ে সে আমায় ছুটি দিন। তবে আমায় যদি কখনো ডাকেন, আমি আসবই।
শান্তভাবে তার শেষ কথাটা জানালো। আমার ভুল হয়েছে সরকার। এবার
মহারাজা মুহূর্তের মধ্যে একেবারে নরম হয়ে গেলেন—না, না মুখার্জি, কি যে বলো! তুমি আবার যাবে কোথায়? অনেকে অনেক কিছু বলছে বটে, কিন্তু আমি তা বিশ্বাস করি না। তবে পলিসি বদলাতেই হবে; একটু কড়া হতে হবে। ব্যাঙের (লাথি আর সহ্য হয় না, মুখার্জী
শীতের মরা মেঘের মত একটা রিক্ততা, একটা ক্লান্তি যেন মুখার্জির হাতপায়ের গাঁটগুলোকে শিথিল করে দিয়েছে। দপ্তরে যাওয়া ছেড়ে দিয়েছে। সে শুধু বিকেল হলে, ব্রিচেস চড়িয়ে বয়ের কাঁধে দু'ডজন ম্যালেট চাপিয়ে পোলো লনে উপস্থিত হয়। সমস্তটা সময় পুরো গ্যালপে ক্ষ্যাপা ঝড়ের মত খেলে যায়। ডাইনে বাঁয়ে বেপরোয়া আন্ডার-নেক হিট চালায়। কড় কড় করে এক একটা ম্যালেট ভেঙে উড়ে ফালি হয়ে। মুখের ফেনা আর গায়ের ঘামের স্রোতে ভিজে
ঢোল হয়ে যায় কালো ওয়েলারের পায়ের ফ্লানেল। তবু স্কোরের নেশায় পাগল হয়ে মুখার্জি চার্জ করে। বিপক্ষদল ভ্যাবাচাকা খেয়ে অতি মন্থর ট্রটে ঘুর ঘুরে আত্মরক্ষা করে। চ শেষ হবার পরেও বিশ্রাম করার নাম করে না মুখার্জি। ক্যান্টারে ঘোড়া ছুটিয়ে যারা পোলো লনটাকে বিদ্যুদ্বেগে পাক দিয়ে বেড়াতে থাকে। রেকাবে ভর দিয়ে মাঝে মাঝে চোখ বুজে দাঁড়িয়ে থাকে—বুক ভ'রে যেন স্পীড পান করে।
খেলা শেষে মহারাজা অনুযোগ করেন-বড় রাফ খেলা খেলছো মুখার্জি। সেদিনও সন্ধ্যের আগে নিয়মিত সূর্যাস্ত হলো অল্পনগড়ের পাহাড়ের আড়ালে। মহারাজা সাজগোজ করে খেলার মাঠে যাবার উদ্যোগ করছেন। পেয়াদা একটা খবর নিয়ে এল–চৌদ্দ নম্বরের পীট ধসেছে, এখনো ধসছে। নব্বই জন পুরুষ
আর মেয়ে কুর্মি কুলি চাপা পড়েছে। —অতি সুসংবাদ! মহারাজা গালপট্টায় হাত বুলিয়ে উৎকট আনন্দের বিস্ফোরণে চেঁচিয়ে উঠলেন।—সচিবোত্তম কোথায়? কোই হ্যায়? শীগগির ডাক, সিণ্ডিকেটের দেমাক এইবার গুঁড়ো করবো।
–হুকুম করুন সরকার; একজন চাপরাশি এসে কাছে দাঁড়ায়। চেঁচিয়ে ওঠেন মহারাজ। — সচিবোত্তম, তার মানে আমাদের বুড়ো দেওয়ান সাহেব, তাঁকে শীগগির একবার ডাক। সিন্ডিকেটের দেমাক এইবার গুঁড়ো করবো। সচিবোত্তম এলেন, কিন্তু মরা কাতলা মাছের মত দৃষ্টি তাঁর চোখে |
বললেন— দুঃসংবাদ!
—কিসের দুঃসংবাদ?
—বিনা টিকিটে কুর্মিরা লকড়ি কাটছিল। ফরেস্ট রেঞ্জার বাধা দেয়। তাতে রেঞ্জার আর গার্ডদের কুর্মিরা মেরে তাড়িয়ে দিয়েছে।
—তারপর?—মহারাজার চোয়াল দুটো কড় কড় করে বেজে উঠল। —ভারপর ফৌজদার গিয়ে গুলি চালিয়েছে। ছরা ব্যবহার করলেই ভাল ছিল! তা না করে চালিয়েছে মুঙ্গেরী গাদা আর দেড় ছটাকী বুলেট। মরেছে বাইশ জন আর ঘায়েল পঞ্চাশের ওপর। ঘোড়ানিমের জঙ্গলে সব লাশ এখনো ছড়িয়ে পড়ে আছে।
মহারাজা বিমূঢ় হয়ে তাকিয়ে রইলেন খানিকক্ষণ। তাঁর চোখের সামনে পলিটিক্যাল এজেন্টের নোটটা যেন চকচকে সূচীমুখ বর্শার ফলার মত ভেসে বেড়াতে থাকে।
—খবরটা কি রাষ্ট্র হয়ে গেছে? —অন্তত সিণ্ডিকেট তো জেনে ফেলেছে।—সচিবোত্তম উত্তর দিলেন।
মুখার্জিকে ডাকলেন মহারাজা।—এই তো ব্যাপার মুখার্জি। এইবার তোমার
বাঙালী ইলপ্ দেখাও; একটা রাস্তা বাতলাও।
একটু ভেবে নিয়ে মুখার্জি বলে আর দেরি করবেন না। সব ছেড়ে দিয়ে মাহাতোকে আগে আটক করে ফেলুন। জন পঞ্চাশ পেয়াদা সড়কি লাটি লণ্ঠন নিয়ে অন্ধকারে দৌড় দিয়ে দুলালের ঘরের দিকে ছুটে চলে যায়।
মুখার্জি বলে—আমার শরীর ভাল নয় সরকার, কেমন গা বমি-বমি করছে। আমি যাই।
চৌদ্দ নম্বরের পীট ধসেছে। মার্চেন্টরা খুবই ঘাবড়ে গিয়েছে। তৃতীয় সীমের ছাদটা ভাল করে টিম্বার করা ছিল না, তাতেই এই দুর্ঘটনা। ঊর্ধ্বোৎক্ষিপ্ত পাথরের কুচি আর ধুলোর সঙ্গে রসাতল থেকে যে একটা আর্তনাদ থেমে থেমে বেরিয়ে আসছে—বুম বুম বুম্। কোয়ার্টসের পিলারগুলো চাপের চোটে তুবড়ির মত ধুলো হয়ে ফেটে পড়েছে। এরই মধ্যে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে পীটের মুখটা ঘিরে দেওয়া হয়েছে।
অন্যান্য ধাওড়া থেকে দলে দলে কুলিরা দৌড়ে আসছিল। মাঝ পথেই দারোয়ানরা তাদের ফিরিয়ে দিয়েছে। কাজে যাও সব, কিছু হয়নি। কেউ ঘায়েল হয়নি, মরেনি কেউ।
মার্চেন্টরা দল পাকিয়ে অন্ধকারে একটু দূরে দাঁড়িয়ে চাপা গলায় আলোচনা
করছেন। গিবসন বলেন—মাটি দিয়ে ভরাট করবার উপায় নেই, এখনো দু'দিন ধরে ধসবে। হাজিরা বইটা পুড়িয়ে আজ নতুন একটা তৈরি করে রাখ। অন্তত একশো নাম কমিয়ে দাও। ম্যাককেনা বলেন তাতে আর কি লাভ হবে? দি মহারাজার কানে পৌঁছে গেছে সব তা ছাড়া, দ্যাট মাহাতো, তাকে বোঝাব কি দিয়ে? কালকের সকালেই
শহরের কাগজগুলো খবর পেয়ে যাবে আর পাতা ভরে স্ক্যান্ডাল ছড়াবে দিনের পর
দিন। তারপর আসবেন একটি এনকোয়ারী কমিটি, একটা গান্ধিয়াইট বদমাশও
বোধহয় তার মধ্যে থাকবে। বোঝ ব্যাপার?
সে রাতে ক্লাবঘরে আর আলো জ্বললো না! একসঙ্গে একশো ইলেকট্রিক ঝাড়ের আলো জ্বলে উঠল প্যালেসের একটি প্রকোষ্ঠে। আবার ডাক পড়ল মুখার্জির। অভূতপূর্ব দৃশ্য! মহারাজা, সচিবোত্তম আর ফৌজদার—গিবসন, ম্যাককেনা,
মূর আর প্যাটার্সন। সুদীর্ঘ মেহগনি টেবিলে গেলাস আর ডিকেন্টারের ঠাসাঠাসি। সুস্মিতবদনে মহারাজা মুখার্জিকে অভ্যর্থনা করলেন—মাহাতো ধরা পড়েছে মুখার্জি। ভাগ্যিস সময় থাকতে বুদ্ধিটা দিয়েছিলে।
গিবসন সায় দিয়ে বলে—নিশ্চয়, অনেক ক্লামজি ঝঞ্ঝাট থেকে বাঁচা গেল। আমাদের উভয়ের ভাগ্য ভাল বলতে হবে।
এ বৈঠকের সিদ্ধান্ত ও আশু কর্তব্য কি নির্ধারিত হয়ে গেছে, ফৌজদার সেটা মুখার্জির কাছে সংক্ষেপে শুনিয়ে দিল। নিরুত্তর মুখার্জি। ওঠে,
ফ্যাকাশে হয়ে যায় মুখ। তারপর শুধু হাতের চেটোয় মুখ গুঁজে বসে থাকে। গিবসন মুখার্জির পিঠ ঠুকে বলে—এসব কাজে একটু শক্ত হতে হয় মুখার্জি, নার্ভাস হবেন না।।
রাত দুপুরে অন্ধকারের মধ্যে আবার চৌদ্দ নম্বর পীটের কাছে মোটর গাড়ি আর মানুষের একটা ভিড়। ফৌজদারের গাড়ির ভেতর থেকে দারোয়ানেরা কম্বলে মোড়া দুলাল মাহাতোর লাশটা টেনে নামালো। ঘোড়ানিমের জঙ্গল থেকে ট্রাক
বোঝাই লাশ এল আরো। ক্ষুধার্ত খনির গহ্বরের মুখে লাশগুলি তুলে নিয়ে দরোয়ানেরা ভুজিৎ চড়িয়ে দিল একে একে।
শ্যাম্পেনের পাতলা নেশা আর চুরুটের ধোঁয়ায় ছলছল করছিল মুখার্জির চোখ দুটো। গাড়ির বাম্পারের ওপর এলিয়ে বসে চৌদ্দ নম্বর পীটের দিকে তাকিয়ে সে ভাবছিল অন্য কথা। অনেক দিন পরের একটা কথা।
লক্ষ বছর পরে, এই পৃথিবীর কোন একটা জাদুঘরে, জ্ঞানবৃদ্ধ প্রত্নতাত্ত্বিকের দল উগ্র কৌতূহলে স্থির দৃষ্টি মেলে দেখছে কতগুলি ফসিল! অর্ধপশুগঠন, অপরিণতমস্তিষ্ক ও আত্মহত্যাপ্রবণ তাদের সাব-হিউম্যান শ্রেণীর পিতৃপুরুষের শিল্পীভূত অস্থিকঙ্কাল, আর ছেনি হাতুড়ি গাঁইতা; কতগুলি লোহার ক্রুড কিম্ভুত হাতিয়ার। অনুমান করছে তারা, প্রাচীন পৃথিবীর একদল হতভাগ্য মানুষ বোধহয় একদিন আকস্মিক কোন ভূ-বিপর্যয়ে কোয়ার্টস আর গ্রানিটের গহ্বরে সমাধিস্থ হয়ে গিয়েছিল। তারা দেখছে, শুধু কতগুলি সাদা সাদা ফসিল, তাতে আজকের এই এত লাল রক্তের কোন দাগ নেই।
বোঝাই লাশ এল আরো। ক্ষুধার্ত খনির গহ্বরের মুখে লাশগুলি তুলে নিয়ে দরোয়ানেরা ভুজিৎ চড়িয়ে দিল একে একে।
শ্যাম্পেনের পাতলা নেশা আর চুরুটের ধোঁয়ায় ছলছল করছিল মুখার্জির চোখ দুটো। গাড়ির বাম্পারের ওপর এলিয়ে বসে চৌদ্দ নম্বর পীটের দিকে তাকিয়ে সে ভাবছিল অন্য কথা। অনেক দিন পরের একটা কথা।
লক্ষ বছর পরে, এই পৃথিবীর কোন একটা জাদুঘরে, জ্ঞানবৃদ্ধ প্রত্নতাত্ত্বিকের দল উগ্র কৌতূহলে স্থির দৃষ্টি মেলে দেখছে কতগুলি ফসিল! অর্ধপশুগঠন, অপরিণতমস্তিষ্ক ও আত্মহত্যাপ্রবণ তাদের সাব-হিউম্যান শ্রেণীর পিতৃপুরুষের শিল্পীভূত অস্থিকঙ্কাল, আর ছেনি হাতুড়ি গাঁইতা; কতগুলি লোহার ক্রুড কিম্ভুত হাতিয়ার। অনুমান করছে তারা, প্রাচীন পৃথিবীর একদল হতভাগ্য মানুষ বোধহয় একদিন আকস্মিক কোন ভূ-বিপর্যয়ে কোয়ার্টস আর গ্রানিটের গহ্বরে সমাধিস্থ হয়ে গিয়েছিল। তারা দেখছে, শুধু কতগুলি সাদা সাদা ফসিল, তাতে আজকের এই এত লাল রক্তের কোন দাগ নেই।
(৩) *****থিরবিজুরী---
চিত্রা রায়ের স্বামী নিখিল রায়। লোকে বলে, হ্যাঁ, তা তো বটেই। বিয়ে যখন হয়েছে, তখন স্বামী না বলে আর উপায় কি? কিন্তু আসলে নিখিল রায় হলো একটা সাইফার। মাত্র চার বছর হলো বিয়ে হয়েছে নিখিলের। বিয়ের মাত্র এক মাস পরেই
নিখিলের সঙ্গে চিত্রা যেদিন ধানবাদের কাছে এই কলোনিতে কেরানী কোয়ার্টাসের
ছোট বাড়িটার ভিতরে এসে ঢুকলো, সেদিন অবশ্য কলোনি লেই
বলেছিল, হেডক্লার্ক নিখিল রায়ের বউ এসেছে, বড় সুন্দর বউ। নিখিল রায়ের স্ত্রী বেশ সুন্দরী, সংবাদটা রটে যেতে বেশি দেরি হয়নি। অফিসেও কাজের ফাঁকে নানা মুখের খোশগল্পের মধ্যে মাঝে মাঝে এই প্রসঙ্গটা ঝিলিক দিয়ে উঠতো। বাস্তবিক, সত্যিই নিখিল রায় একটা বিদ্যুৎ নিয়ে এসেছে। একেবারে একটি অথির-বিজরি, মাইরি!
নিয়ে এলে কোথা থেকে?
যারা জানে তারাই উত্তর দেয়—কলকাতা থেকে।
—কলকাতার দয়া তো খুব, এমন জিনিস এমনিতেই ছেড়ে দিলে?
—এসব তো ভাই দয়া-টয়ার ব্যাপার নয়। এসব হলো ভাগ্যির ব্যাপার। খুব
ভাগ্যি করেছিল নিখিল রায়।
সেদিন হেডক্লার্ক নিখিল রায়ের ভাগ্যকে অফিসের খোশগল্পগুলি হিংসে করলেও নিখিল রায়ের ভাগ্য একটুও বিচলিত হয়ে ওঠেনি। পথে বেড়াতে বের হতো নিখিল আর চিত্রা। যারা নিখিলকে চেনে, কিন্তু চিত্রাকে কখনো দেখেনি, তারাও দেখেই বুঝে ফেলতো, এই সুন্দরী মহিলাই হলো হেডক্লার্ক নিখিল রায়ের স্ত্রী।
দু'মাস যেতে না যেতে সারা কলোনিতে আর একটা সংবাদ রটে গেল খুব ভাল করেই এবং তারপর কলোনি ছাড়িয়ে ধানবাদের নানামহলে আসরে ও কোয়ার্টারে। বেশ সুন্দর গলা, খুব ভাল গান গাইতে পারে হরিনগর কলোনির
নিখিল রায়ের স্ত্রী। –কি নাম যেন ভদ্রমহিলার?
যারা শুনেছে নাম, তারাই উত্তর দেয়। – নাম হলো চিত্রা রায়। গানের খ্যাতির সঙ্গে সঙ্গে চিত্রা রায় নামটাও খ্যাত হয়ে গেল।
তারপর, চারটি মাস যেতে না যেতে, নানাজলসা, সভা ও সমিতির আহ্বানে আসতে আসতে আর উদ্বোধনী সঙ্গীত গাইতে গাইতে চিত্রা রায়ের মুখটাও চিত্রিত হয়ে গেল ছেলেমহল আর মেয়েমহল থেকে শুরু করে শিশুমহলের মনে পর্যন্ত। পথে চিত্রা রায় যদি একাই বেড়াতে বের হয়, তবুও কেউ আর চিনতে ভুল করে না।--ঐ, উনিই হলেন চিত্রা রায়, নিখিল রায়ের স্ত্রী চিত্রা রায়।
সেদিন এই রকমই ছিল চিত্রা রায়ের পরিচয়। সে পরিচয় নিখিলের নামের সঙ্গেই বাঁধা। কিন্তু এক বছর যেতে না যেতেই উল্টে গেল সেই পরিচয়। সন্ধ্যাবেলায় মার্কেটের আলোয় একটা দোকানের ভিতরে এসে দাঁড়ায় চিত্রা। জিনিসের দাম নিয়ে দরদস্তুর করে চিত্রা, আর নিখিল থাকে চিত্রার পাশে। দোকানের শো-কেসের কাচের উপর চিত্রা রায়ের সুন্দর চেহারার প্রতিচ্ছায়া ঝক্ করে।
দোকানের ভিতরেই হোক, আর দোকানের বাইরে পথের উপরেই হোক, চিত্রাকে আর নিখিলকে দেখতে পেরে লোকের মুখে আলোচনা চলে। ঐ ভদ্রলোক কে মশাই!
—ঐ তো, উনিই হলেন চিত্রা রায়ের স্বামী নিখিল রায়। সরকার অ্যান্ড সিনহার হেডক্লার্ক নিখিল রায়।
হ্যাঁ, এক বছরের মধ্যেই উল্টে গেল পরিচয়। চিত্রারই নামের ছায়ায় ঘুরে
বেড়ায় নিখিলের নাম। চিত্রাই হলো আসল অস্তিত্ব। তার পাশে আছে নিখিল।
চিত্রারই নামের গৌরব মানুষ করে রেখেছে নিখিলকে।
তবু তো মানুষ হয়েই ছিল, আর চিত্রার পাশেই ছিল নিখিল। কিন্তু এক বছর আগের সেই পরিচয়ও একেবারে অন্য রকমের হয়ে গেল আর তিন বছরের মধ্যে। তাই তো আজ লোকে বলে, নিখিল রায় একটা সাইফার।
চিত্রার পাশে আর নেই নিখিল। এখন চিত্রার পিছনে পড়ে গিয়েছে নিখিল। সিনেমা দেখতে বেড়াতে, সভা-সমিতিতে বা মার্কেটে, যেখানে যখন যায় চিত্রা, তখন নিখিল তার সঙ্গে সঙ্গেই থাকে, কিন্তু পিছনে। নিখিলের সঙ্গে যখন কথা বলে চিত্রা, তখন পিছনে মুখ ফিরিয়ে তাকাবারও কোন দরকার হয় না চিত্রার। চিত্রা যেন তার সম্মুখের পথের বাতাসকে উদ্দেশ কথা বলে।—সঙ্গে টাকা এনেছ তো?
ঠিক শুনতে পায় নিখিল। শুনতে একটু ভুলও হয় না। সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দেয়—এনেছি।
এতদিনে, ধানবাদের কাছে এই হরিনগরে এসে চার বছরের মধ্যেই চিত্রা তার জীবনের সম্মুখের পথ একেবারে অবাধ করে নিয়েছে। অথচ, চার বছর আগে একদিন এক সকালবেলায় হরিনগর কলোনির সব বাড়ির জানালাগুলিতে থরে ধরে সাজানো কৌতূহলী চক্ষুগুলি দেখতে পেয়েছিল, হেডক্লার্ক নিখিল চলেছে আগে আগে, তার পিছনে মাথা হেঁট করে আস্তে আস্তে হেঁটে চলেছে বড় সুন্দর ও শাস্ত আর একটু গম্ভীর একটি মুখ নিয়ে একটি বউ। আর আজ? আজ আর সেই
বউয়ের মুখটি দেখতে ঠিক সেই রকম শান্ত তো নয়, সেই একটু গভীরতার একটুক আজ আর নেই। বইয়ের মাথার কাপড় যেন এই চার বছরের মধ্যেই কোন এক খড়ের ঝাপটা লেগে খসে পড়ে গিয়েছে খাড়ের উপর পড়েছে তে পড়েই গিয়েছে, আর উঠতে পারছে না। আজ চিত্রা রায়ই চলে আগে আগে, আর নিখিল পিছনে।
পিছনে হোক, তবু চিত্রার সঙ্গেই আছে নিখিল। তবে লোকে বলে কেন, একেবারে সাইফার হয়ে গিয়েছে নিখিল? লোকে বুঝতে একটু ভুল করেছে। সামান্য একটু বাড়িয়ে বলেছে। সত্যি কথা হলো, সাইফার হয়ে যেতে চলেছে নিখিল। তাছাড়া, এবং লোকে না জানুক, আজ অফিস যাবার সময় যখন চিত্রার হাত থেকে একটা চিঠি স্বচ্ছলে হাত বাড়িয়ে নিয়েছে নিখিল, তখন আর কোন সন্দেহ নেই যে, এইবার সত্যি সাইকার হয়ে যাবে নিখিল।
অফিস যাবার জন্য তৈরি হয়ে প্রতিদিনের নিয়মের মত চিত্রার কাছে এসে দাঁড়ায় নিখিল। তাহলে আসি। চিত্রা বলে–শোন
খামে বন্ধ একটি চিঠি রয়েছে চিত্রার হাতে। হয়তো পোস্ট করতে হবে এই চিঠি। নিখিল বলে—চিঠি পোস্ট করতে হবে?
চিত্রা না। নিখিল—তবে?
হাত কাঁপে না চিত্রার, বোধহয় মনও কাঁপে না। শুধু অন্যমনস্কের মত অন্যদিকে তাকিয়ে কি যেন ভাবে। তারপরেই প্রশ্ন করে—ভুল করবে না তো? নিখিল–ভুল হবে কেন? কি এমন কঠিন কাজ করতে বলেছো যে ভুল হবে?
চিত্রা—তবে শোন। বলতে গিয়ে চিত্রার গলার স্বর একটুও কাঁপে না।
নির্দেশের প্রতীক্ষায় ব্যগ্রভাবে চিত্রার মুখের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে নিখিল। কিন্তু চিত্রা তাকায় না নিখিলের মুখের দিকে। কিন্তু তাতে কি হয়েছে? এটা নতুন কিছু নয়। আজ চার বছরের মধ্যে এই ঘরের ভিতর কদিনইবা নিখিলের মুখের দিকে তাকিয়েছে চিত্রা? সেজন্য কোন দুঃখ ও দুশ্চিন্তা জাগেনি নিখিলেরও মনে। আজ নতুন করে হঠাৎ জাগবারও কথা নয়।
চিত্রা বলে–তোমাকে বিশ্বাস করি বলেই বলছি। নিখিল হাসে আমাকে বিশ্বাস করবে না তো কাকে করবে?
নিখিল একটু আশ্চর্যই হয়। আজ একেবারে এরকম নতুন একটা প্রশ্ন কেন করছে চিত্রা? আজ পর্যন্ত তার ব্যবহারে এমন কোন ভুল কি দেখতে পেয়েছে। চিত্রা, যার জন্য বিশ্বাসের কোন কথা উঠতে পারে? মনে তো পড়ে না নিখিলের, কখনো একটা প্রতিবাদ করে, কোন অভিযোগ করে, কিংবা কোন কথার উত্তর দিতে একটু দেরি করে চিত্রার মনে কষ্ট দিয়েছে নিখিল।
চিত্রা বলে—তবে, এই চিঠিটা নিয়ে...। বলতে গিয়ে কেন জানি চুপ করে যায় চিত্রা। বিদ্যুৎ খেলে যায় যে সুন্দর চোখের দৃষ্টিতে, সেই চোখ দুটো যেন হঠাৎ একটা ছায়ায় পড়ে যায়। কিন্তু তারপরেই আর কিছু নয়। ঝকঝক করে চিত্রার চোখ দুটো।
চিত্রা বলে—এই চিঠিটা নিয়ে গিয়ে মিস্টার সরকারের হাতে দিতে হবে।
নিখিল—দেব।
চিত্রা—মিস্টার সরকারের টেবিলের ওপর ফেলে রেখে আসলে চলবে না। নিখিল—না, তাঁর হাতেই দেব। চিঠি নিয়ে চলে গেল নিখিল। এইবার, আর বেশি দেরি হবে না। বোধহয়
আজ সন্ধ্যা ফুরোতে না ফুরোতে সত্যিই সাইফার হয়ে যাবে নিখিল।
প্রস্তুত হয় চিত্রা। সন্ধ্যা আসতেইবা আর কতক্ষণ। চিঠি নিয়ে চলে গিয়েছে নিখিল, এবং চিত্রাও জানে, ও চিঠি খুলে পড়বার জন্য মনে একটু কৌতূহলও যে জাগবে, সে-রকম কোন সন্দেহের বস্তু দিয়ে তৈরিই নয় লোকটা। আর যদি কৌতূহল হয়, চিঠিটা পড়েই ফেলে নিখিল, তবুও কি কিছু বুঝবে বা মনে করতে পারবে ঐ মানুষ? কখনই না। ভেবে দেখলাম, আপনি আমার আপনজনের চেয়েও বেশি। আমি যাব।' এইটুকু একটা লেখা পড়ে কি-ইবা বুঝবে, আর বুঝেই বা কি করতে পারে নিখিল? এতদিন ধরে সবই দু'চোখে দেখেও যে কিছু বোঝেনি, সে ঐ সামান্য কয়েকটা লেখাকথা পড়ে ছাই বুঝবে!
আর বুঝলেইবা? নিখিল চিত্রার পথের বাধাই যে নয়। বাধা না হয়েই সে ধন্য হয়ে আছে। বাধা দেবে না নিথিল, বাধা দিতে জানে না নিখিল।
নিঃশব্দে স্থির হয়ে ঘরের ভিতর একা দাঁড়িয়ে ভাবতে ভাবতে ঝকঝক করে চিত্রার চোখ, দুরন্ত বিদ্যুতের জ্বালার মত সেই বেদনাটাই মনের ভিতর ছটফট করে ওঠে। চার বছর আগে হঠাৎ বাড়ির লোকের একটা নিষ্ঠুর ঝোঁক আর সদিচ্ছার আঘাতে যেদিন চূর্ণ হয়ে গেল তার মনের স্বপ্ন, সেই দিনটার স্মৃতি আজও জ্বলছে তার মনের মধ্যে। সেদিনের আক্ষেপ আর ঘৃণা একসঙ্গে মিলে যে ক্ষত সৃষ্টি করেছিল তার জীবনের একমাত্র কল্পনার বুকে, সেই ক্ষতের জ্বালা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যই অশান্ত হয়ে রয়েছে জীবন। কে বলেছিল ওরকম না বলে কয়ে আর হঠাৎ ধরে-বেঁধে একটা বিয়ে দিতে? কি দরকার ছিল? আর যদি বিয়েই দেওয়া হলো, তবে চিত্রার মত মেয়ের জন্য পৃথিবীতে কি আর কোন মানুষ ছিল না? যেন আড়ালে আড়ালে হঠাৎ একটা ষড়যন্ত্র এঁটে ফেললেন জ্যাঠামশাই ও জ্যাঠাইমা। একটি বারের মত একটি কথাতেও কোন আভাস দিলেন না যে, বাপু মা-মরা মেয়েকে পার করে দেবার জন্য তাঁরা একটা ব্যবস্থা করে ফেলেছেন। যদি বিয়ের পিঁড়িতে বসবার এক মিনিট আগেও বুঝতে পারত চিত্রা, ধানবাদের কাছে এক দেশী কোম্পানির এক ক্লার্ক এসেছেন বরের সাজ পরে, তবে পৃথিবীতে কারও
সাধ্য ছিল না যে, চিত্রাকে সেই পিঁড়ির উপর বসিয়ে দিতে পারে। সেদিনই সেই মুহূর্তে জ্যাঠামশাইয়ের সব চক্রান্তের উৎসব ভেঙে দিত চিত্রা, যেমন করেই হোক। সেই সন্ধ্যাতে লগ্ন ঘনিয়ে আসবার একটু আগে বরং একটা মিথ্যা কথাই বলেছিলেন জ্যাঠাইমা। ছেলে নাকি খুব ভাল ছেলে যে শুনেছে। এই সম্বন্ধের কথা, সে-ই নাকি খুশি হয়েছে।
চিত্রা জানে, কেন অমন কাজ করলেন জ্যাঠামশাই, জ্যাঠাইমা এবং আর সকলেই। লোকের অভিযোগ শুনতে শুনতে আর ভয় পেয়ে পেয়ে এরকম একটা ষড়যন্ত্র করে ফেললেন জ্যাঠামশাই। এ মেয়েকে বেশিদিন ঘরে পুষে রাখবেন না। ধীরেনবাবু – বন্ধুদের আর প্রতিবেশীদের এই অভিযোগের ভয়েই সারা হয়ে গেলেন জ্যাঠামশাই আর জ্যাঠাইমা। তাঁরা যদি বিয়ে দেবার জন্য ব্যস্ত না হয়ে উঠতেন, তবে কোন ক্ষতি হতো না কারও। জ্যাঠামশাইয়ের না, প্রতিবেশীদেরও না, আর আত্মীয়দেরও না। চিত্রারও না। চিত্রা নিজেই পৃথিবীতে খুঁজে নিত তার
জীবনের সঙ্গী। বেশি খুঁজতে হতো না চিত্রাকে। পারুল আর প্রীতির মত মেয়ে যখন নিজের চেষ্টায় মনের মত সঙ্গী খুঁজে নিতে পেরেছিল, তখন চিত্রাইবা পারতো না কেন? কিন্তু চিত্রার মনের আশা ও কল্পনাগুলিকে সেটুকু সুযোগও দিলেন না জ্যাঠামশাই।
সুযোগ বড়বেশি করেই আসছিল, তাই তো দুশ্চিম্ভিত হয়ে পড়লেন জ্যাঠামশাই। অদ্ভুত মন ওদের। চিত্রার বাক্স নানারকম সনামী আর বেনামী চিঠিতে ভরে উঠলো যে! শুনতে পেয়ে আর জানতে পেরে আতঙ্কিত হলেন জ্যাঠাইমা। কিন্তু সে কি চিত্রার অপরাধ? চিত্রা কি জীবনে কোনদিন চেয়েছিল, এই সব চিঠি? চিত্রার সুন্দর মুখ দেখে মানুষ যদি পাগল হয়ে যায় সে দোষ চিত্রার নয়। বরং জেনে নিশ্চিত হওয়াই উচিত ছিল জ্যাঠাইমার, কোন চিঠিরই উত্তর দেয়নি চিত্রা। কারণ চিঠিদাতাদের কাউকেই একটা মানুষ বলে মনে করতে পারেনি চিত্রা।
বিয়ের পর হরিনগরের এই কলোনিতে প্রথম এসে চুপ করে বসে ভাবতে ভাবতে মনের যন্ত্রণায় একদিন হেসেই ফেলেছিল চিত্রা। সেইসব চিঠির মানুষগুলি যে এই হেডক্লার্ক ভদ্রলোকটির চেয়ে অনেক বড় মানুষ। আজ তারা হয়তো মুখ টিপে হাসছে। শুনে অবাক হয়ে গিয়েছে পারুল আর প্রীতি, শেষে এটা কি একটা কাণ্ড করে বসলো চিত্রা। সন্দীপের মত এত গুণের রূপের ও টাকার মানুষ, এত বড় একজন চিফ অফিসারের ব্যাকুলতাও যে চিত্রার মন টুলাতে পারেনি, সেই চিত্রা বিয়ে করেছে এক দেশী কোম্পানির এক বড় কেরানীকে, যার মাইনে দু'শ' টাকা। প্রেম হলে নাহয় বোঝা যেত। কিন্তু প্রীতি আর পারুল জানে, চিত্রা কি সেই মেয়ে যে প্রেমের আবেগে কাঙ্গালের গলায় মালা দেবে? যে সে একটা লোকের মুখ দেখে মনে প্রেম জাগবে, এমন মনই করেনি চিত্রা।
চার বছর আগে চিত্রার জীবনের আকাঙ্ক্ষা যে ব্যথা পেয়েছিল, সেই ব্যথা মুছে যেতে পারেনি এক মুহূর্তের মতও, বরং দিন দিন আরও অস্থির, আরও মত্ত এবং আরও দুঃসাহসে শাণিত করে তুলেছে চিত্রার বিদ্রোহ।
জীবনে কি চেয়েছিল চিত্রা? আজ এখন নিজের মনকে পরীক্ষা করলে, আর স্মৃতি সন্ধান করলে ঠিক বুঝতে পারবে না চিত্রা, বিয়ের আগে কি ধরনের সুখী জীবন কামনা করেছিল চিত্রা। আজ শুধু মনে হয় এই কলোনিরই মালিক সরকার অ্যান্ড সিনহা কোম্পানির বারোআনা স্বত্বের অধিকারী বিনায়ক সরকারের মত মানুষের পাশে যদি ঠাঁই পাওয়া যেত, তবে ধন্য হতো আর সুখী হতো চিত্রার জীবন।
তবে কি বিনায়ক সরকারের টাকার পুঁজির পরিচয় জানতে পেরে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছে চিত্রা? না, ঠিক টাকার জন্য তো না। বিনায়ক সরকারের চেয়ে বেশি টাকার মানুষ কি ধানবাদের এই বিরাট কয়লা আর শিল্প রাজ্যের কোন অট্টালিকার মধ্যে নেই? টাকার জন্য নয়। বিনায়ক সরকার শুধু টাকার জন্যই বড় মানুষ নয়। বিনায়ক সরকার বড় সুন্দর ও বড় উজ্জ্বল এক বড় জীবনের মানুষ। ঐ রকমই এক জীবনের আলো হাসি ও উল্লাসের মধ্যে দাঁড়াবার জন্য চিত্রার মন স্বপ্ন দেখে এসেছে। নইলে বড়মানুষ তো কত রকমেরই আছে।
কিন্তু বিনায়ক সরকারের মত মানুষ পৃথিবীতে আর কোথাও আছে কিনা, জানে না চিত্রা। আজ মনে হয়, এই মানুষটি তার প্রসন্ন জীবনের সকল দীপ্তি নিয়ে এইখানে যেন চিত্রারই প্রতীক্ষায় দাঁড়িয়ে ছিল। সরকার অ্যান্ড সিম্হার বারোআনা মালিক, এতগুলি ফ্যাক্টরি যার দৌতল সৃষ্টি করছে দিনরাত, সেই মানুষও স্পষ্ট মুখ বুলে তার শূন্যমনের একটা হাহাকার প্রকাশ করেছে চিত্রারই কাছে। এইসব দৌলত সার্থক হতো, যদি চিত্রার মত মেয়ের ভালবাসার একটু ছোঁয়া লাগতো বিনায়কের জীবনে।
তাই, জীবনে যাকে দেখে আর যার মুখের হাসি আর ভাষা শুনে প্রথম মুগ্ধ হয়েছে চিত্রা, তারই কাছে চিঠি দিল এই প্রথম। বিনায়কের সঙ্গে অন্তরঙ্গ হবার পরেও তিনটি বছর কেটে গিয়েছে কিন্তু বিনায়কের আহ্বানে এত স্পষ্ট ভাষায় সাড়া দিতে পারলো চিত্রা, এই প্রথম।
চিঠি দিতে হাত কাঁপবার কথা নয়। চিত্রার হাতের সব দ্বিধা ও ভীরুতা মুছে গিয়েছে অনেক দিন আগেই। বিনায়কের গাড়ি আসবার আগে যে হাত দিয়ে নিজেকে এতদিন সাজিয়ে এসেছে চিত্রা, সে হাত আজ একটা চিঠি দিতে কাঁপবে কেন? শুধু একবার নিশ্বাসটা কেমনতর হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু কেন, কিসের জন্য? চিত্রা নিজেই জানে না, কেন।
নিশ্চয়ই নিখিলের কথা ভেবে নয়, যে নিখিল চিত্রার জীবনে একটা অস্তিত্বের বস্তুই নয়। বোধহয় বিনায়কেরই কথা ভেবে। স্ত্রী আছে বিনায়কের, বিবাহিত স্ত্রী। সেই স্ত্রীকে বর্জন করবার সাধ্য নেই বিনায়কের। বিনায়কই বলেছে, এইখানে তার জীবনের দুঃখ একটু জটিল ও গ্রন্থিল হয়ে গিয়েছে। বিনায়কের স্ত্রী মদুলা সরকার জীবনে স্বামী ছাড়া আর কিছু বোঝে না। সে এক অদ্ভুত বিস্ময়ের নারী। দশ বছর হলো বিয়ে হয়েছে বিনায়কের, ইউরোপ থেকে ফিরে আসার পরেই। বোম্বাইয়ের এক হোটেলে প্রথম দেখা হয়েছিল বিনায়কের সঙ্গে মৃদৃলার। সেই যে দেখা, সেই দেখাই মৃদুলার জীবনের পরিণাম রচনা করে দিল। মৃদুলার ভালবাসা বুঝতে সেদিন যদি ভুল করতো বিনায়ক, তবে আজ আর পৃথিবীতে থাকতো না মৃদুলা।
এ কাহিনী নিজেই চিত্রার কাছে অকপট ভাবে বলতে কোন কুণ্ঠা হয়নি বিনায়কের। যে মৃদুলা নিজের প্রাণের চেয়েও বেশি ভালবাসার সম্পদ বলে মনে করে বিনায়ককে, সেই মৃদুলাকে অস্বীকার করবার মত শক্তি নেই, এবং সে-রকম নিমর্ম হবার মতও শক্তি নেই বিনায়কের। তাই, শুধু তাই বিনায়কের ইচ্ছা এই যে...।
হ্যাঁ, বিনায়কের সেই ইচ্ছাই ভাল। বিনায়কের সঙ্গে চিত্রার বিয়ে হতে পারে। বটে; কিন্তু হতে অনেক বাধা আর আইনের ঝঞ্ঝাটও অনেক। এত সব ঝঞ্ঝাটের ঝড়ের মধ্যে যাবারইবা দরকার কি? তাই বিনায়কের সেই ইচ্ছাই জীবনের বরণ করে নিতে আজ মনের মধ্যে কোন কুণ্ঠা নেই চিত্রার। নাই বা হলো বিয়ে; তবু বিনায়কের আপনজন হয়ে যাবে চিত্রা। চিত্রার যে হাত কতবার কত আগ্রহে ধরবার জন্য হাত বাড়িয়েছে বিনায়ক, চিত্রার সেই হাত আজ শেষ কুণ্ঠা চিরকালের মত দূরে ছুঁড়ে ফেলবার জন্য সংকল্পে কঠিন হয়ে উঠেছে।
নিখিল আছে, চিত্রার স্বামী নিখিল। নিখিল থাকবে, ঠিক যেমনভাবে সুখী মন নিয়ে আর ধন্য হয়ে সে আছে। কিন্তু চিত্রার সঙ্গে সঙ্গে আর যেতে হবে না। চিত্রার পিছনে পিছনে থাকতে হয় নিখিলকে, এই বৃথা সাথীপনার মিথ্যা স্পষ্ট করেই মিথ্যা করে দেওয়া ভাল। বস্তুহীন ছায়ার মত মানুষটাকে পিছনে পিছনে আসতে দিয়ে লাভ কি? যে মানুষকে সঙ্গে নিয়ে কোথাও গিয়ে দাঁড়ালে কোন গর্বের আনন্দ নেই, সেই মানুষকে একটা ছায়ার মত সঙ্গে রেখে লাভ কি? না, আর নয়। বিনায়কের মত মানুষের এত বড় মনের ভালবাসাকে আর ব্যথা দিতে পারবে না চিত্রা। চিত্রার মন আজ নতুন প্রতিজ্ঞার দীক্ষা নিয়ে এতদিনের মিথ্যা কুণ্ঠার পাথরটাকে দু'পায়ে মাড়িয়ে ধুলো করে দেবার জন্য তৈরি হয়েছে! এইবার, আজ থেকে জগতের যে-কোন নিভৃতে আর উৎসবের আসরে বিনায়কের চোখের সামনে একাই এসে ধরা দেবে চিত্রা। বিশ্রী লোকচক্ষুর প্রশ্নগুলিকে আর ভয় করে চলবার কোন দরকার নেই। চিত্রার জীবনের একটা ভুয়া অস্তিত্ব শুধু পড়ে থাক এই কেরানীর নীড়ে, কিন্তু জীবন পড়ে থাকবে বিনায়কের কাছে।
এইভাবেই আজ একেবারে সাইফার হয়ে যেতে চলেছে নিখিল। অফিসের নানা মুখের খোশগল্পও আজকাল উত্তপ্ত হয়ে ওঠে।—এই অবস্থার জন্য দায়ী স্বয়ং নিখিল রায়। একটা বিশ্বাসী নির্বোধ। স্বচক্ষে সব দেখেও এতদিনে সাবধান হতে পারলো না, তাইতো...তাইতো স্বামী হয়েও সাইফার হয়ে গিয়েছে নিখিল।
বড়সাহেব বিনায়ক সরকারের চকচকে টুরারের পিছনের সিটে যদি চুপ করে বসে থাকে স্বামী নিখিল রায়, আর স্ত্রী চিত্রা রায় বসে থাকেন সামনের সিটে বড়সাহেবের পাশে, তবে কি এ সন্দেহ না করে থাকতে পারে হরিনগর কলোনির সাধারণ ভদ্রলোক আর অফিসের সাধারণ কেরানীর দল?
বাধা? কে বাধা দেবে চিত্রাকে? বাধা দেওয়ার যার কথা, সেই যে সবচেয়ে বেশি বাধ্য। সরকার অ্যান্ড সিন্হাব হেডক্লার্ক নিখিল রায় যেন স্ত্রী-গরবেই গরবী হয়ে রয়েছেন। ভগবান জানে, লোকটার চোখ কি ধাতুতে তৈরি, আর মনটাই বা কি রকমের প্রশান্ত মহাসাগর।
চার বছর আগে কেরানীর বউ হয়ে যে নারী একটু গম্ভীর মুখ নিয়ে অথচ শাস্ত ভাবে এসেছিল এই কলোনির টালি-ছাওয়া চালের ক্ষুদ্র গৃহে, আজ সেই নারী ও রাজ্যের এত চোখ বিস্ময়ে ধাঁধিয়ে দিয়ে সরকার অ্যান্ড সিন্হার বড়সাহেবের পাশে রাজেশ্বরীর মত বসে থাকে। চকচকে টুরারের ইঞ্জিনের গুরুগুগুন ছাপিয়ে ওঠে চিত্রার মুখের কলকল ফোয়ারা হাসির কলনাদ। সরকার ভিলার ফটকে ইউকালিপটাসের ছায়া থেকে সোজা নীল পরেশনাথের পায়ের কাছে তোপচাঁচির লেক পর্যন্ত, বিনায়কের টুরার চিত্রার মুখের মিষ্টি কলরব বুকে নিয়ে ছুটে যায় আর
আসে। পিছনের সিটে বসে নিখিলও মাঝে মাঝে হেসে ওঠে। অফিসের নানা মুখে নানা 'খোসগল্প' মাঝে মাঝে নানা ধিক্কারেও তিক্ত হয়ে ওঠে।--মেয়েটার আর দোষ কি? এরকম বেকুবের হাতে পড়লে সব মেয়েই ওরকম হয়ে যায়।
অফিসের মধ্যেই একজন মাদ্রাজী কেরানীর সঙ্গে একজন বাঙালী কেরানীর একদিন হাতাহাতি হয়ে গেল। মাদ্রাজী কেরানী বলেছিল, বাঙালীরাই এরকম হয়। এই ধরনের মাত্র একটা কথা সহ্য করতে না পেরে টেম্পোরারি মহিম মাদ্রাজীর সঙ্গে সেদিন যে মারামারি কাণ্ড করে বসলো, সেটা স্বচক্ষে দেখেও, আর কারণটা বুঝতে পেরেও হেডক্লার্ক নিখিলের মনে কোন উত্তাপ জাগেনি। কথাগুলি যেন কথাই নয়, একেবারে বাজে মিথ্যা ও কুৎসিত কতগুলি ছোট কল্পনার আক্রোশ। যত ছোটমনের পরিচয়।
নিখিলই যখন এসব চায়, তখন কে আর বাধা দেবে চিত্রার মত মেয়েকে, চোখে যার বিদ্যুৎ খেলে, আর শাড়ি পরার ও বেণী বাঁধবার ভঙ্গিতে ফ্যাশান উথলে পড়ে। হরিনগর কলোনির সকলের চক্ষুতে ভর্ৎসনা জাগিয়ে দিয়েছে চিত্রা নামে এক নারীর এই ভয়ানক অভ্যুত্থান। কিন্তু কোন তিক্ততা বিরাগ ও ভর্ৎসনা নেই শুধু একজনের চোখে, চিত্রার স্বামী নিখিল রায়ের চোখে।
লোকে আলোচনা করে, অফিসের নানামুখে একটা হতভম্ব অবস্থাও মাঝে মাঝে ফুটে ওঠে।—এরকম হয়ে গেল কেন নিখিল রায়? কোনরকম প্রমোশন বা লিফটও তো পাচ্ছে না নিখিল। সরকার অ্যান্ড সিন্হার বারোআনা প্রভু বিনায়ক সুরকার যদি ইচ্ছা করেন, তবে নিখিলকে এই অফিসের অন্তত সুপারিনটেন্ডেন্ট করে দিতে পারেন। কিন্তু সেরকম কিছু আঁচ-আভাসও তো পাওয়া যায় না।
তাই টেম্পোরারি মহিম বলে—সব দোষ ঐ ভয়ঙ্কর বড়সাহেবটির। এইরকম কীর্তি করা ওঁর অভ্যাস আছে। অনেক করেছেন উনি, আপনারা কোনই খবর রাখেন না। সত্যিই কেউ খবর রাখেন না। টেম্পোরারি মহিম কোথা থেকে এত খবর
জানলো কে জানে। হয়তো একেবারে বাজে কথা। ছাঁটাইয়ের লিস্টে নাম চড়েছে
বলে রাগের মাথায় যা-তা বলছে মহিম। মহিম বলে- ওঁদের যে একটি ক্লাব আছে, আর সেই ক্লাবে কি হয়, সে খবর আপনারা কেউ জানেন না।
তা কেউ জানে না ঠিকই। ক্লাব আছে, এইটুকু সকলেই জানে। মহিম বলে কারা সেখানে আসে তাও আপনারা কিছু জানেন না।
আর্সে কত গাড়ি-চড়া মানুষ। এইটুকু সকলেই জানে। পায়ে হাঁটা মানুষ সেখানে কখনও আসে না, আসতে পারে না, আসবার নিয়মও নেই। মহিম বলে—কতগুলো হোমরা-চোমরা অফিসার আসে, আর আসে কতগুলো
সাহেব, আর কতগুলো লেডি। আর পিপে পিপে মদ। -থাম থাম মহিম। বড়বেশি রঙ চড়াচ্ছ তুমি।
মহিম বলে—আমি সত্যি কথা বলছি কিনা, সেটা নিখিলবাবুই জানেন। আমি নিজের কানে শুনেছি, বড়সাহেব সেই ক্লাবে নিখিলবাবুকে স্ত্রীকে যাবার জন্য বলছেন।
-অ্যা? সকলে চমকে ওঠে আর বুঝতে পারে, আসল দোষ তাহলে নিখিলেরই। কিন্তু যার জীবনের পরিণাম নিয়ে এত আলোচনা, সেই চিত্রা রায়ের মন
এইসব খুঁটিনাটির আর বিচারের অনেক উপরে চলে গিয়েছে। আজও তো ভুলে যায়নি চিত্রা, সেই একটা ঘটনার কথা। বিয়ের পাঁচ মাস আগে দার্জিলিং-এ বেড়াতে গিয়েছিল চিত্রা, জ্যাঠাইমার বোন জয়া মাসিমার সঙ্গে। লেবঙের মাঠে চিত্রাকে দেখতে পেরে অপলক চক্ষে তাকিয়েছিল কোন এক স্টেটের রাজকুমার। আর সত্যিই, এক ভদ্রমহিলা এসে জয়া মাসিমাকে ইংরেজি ভাষায় জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ঐ মেয়ের বাপ কোন্ স্টেটের চিফ?
এই পৃথিবীর এক স্টেটের রাজকুমারী বলে মনে হয়েছিল যে মেয়েকে সেই মেয়ের শাড়ি পরার স্টাইল দেখেই ভয় পেয়ে গেলেন জ্যাঠামশাই। সে-মেয়ের মনের স্টাইলের কোন খবর নিলেন না। খবর নিলে বুঝতে পারতেন জ্যাঠামশাই, চিত্রাকে এভাবে একজন যে-সে লোকের হাতে ধরিয়ে দেওয়া কি ভয়ানক একটা নিষ্ঠুরতা।
সেই নিষ্ঠুরতাকে ক্ষমা করতে পারেনি চিত্রা। সেই চক্রান্তের দান নিখিল রায় নামে এই ভদ্রলোকটিকে জীবনে আপন বলে মনে মনে গ্রহণ করতে পারেনি চিত্রা। আর এই জন্য মনে কোন দুঃখ নেই চিত্রার। দেখে আরও সুখী হয়েছে চিত্রা, এই ভদ্রলোকের মনেও কোন দুঃখ নেই। চিত্রা ডাক দেওয়া মাত্র কাছে এসে দাঁড়ায়, বলা মাত্র চলে যায়, আর আসতে বললেই সঙ্গে আসে
স্বামী নামে পরিচিত এই মানুষটিকে একদিনের জন্য একটি রূঢ় কথা বলতে হয়নি চিত্রার। ভদ্রলোকই সে সুযোগ দেননি চিত্রাকে। নিখিল যেন চিত্রার নীরব চিন্তার বেদনাগুলিকেও শুনতে পায়; এমনই প্রখর তার কান।
ভোরে, টালি-ছাওয়া চালের ক্ষুদ্রকায় এই বাড়ির ভিতর বারান্দায় চেয়ারের উপর বসে আর সামনে ছোট টেবিলের উপর এক পেয়ালা চা রেখে যখন চুপ করে বসে থাকে চিত্রা, তখন যেন ঘরের ভিতরে থেকেও চিত্রার চোখ দুটোকে দেখতে পায় নিখিল। চিত্রার চোখ দুটো যেন উদাস হয়ে কুয়োতলার পেয়ারাগাছটার ছায়ার দিকে তাকিয়ে আছে। ঘরের ভিতর থেকে বের হয়ে এসে দেখতেও পায় নিখিল, তার ধারণা মিথ্যা নয়। চিত্রার চা জুড়িয়ে যাচ্ছে, কিন্তু চায়ের কাপের দিকে চোখ নেই চিত্রার। অন্যমনা হয়ে কি-যেন ভাবছে চিত্রা।
নিখিল তার নিজের হাতের চায়ের কাপে চুমুক দিতে পারে না। তোমার চা
যে ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে।
নিখিলের কথায় চিত্রার স্তব্ধ হাতটার শুধু চমক ভাঙে। চায়ের কাপ হাতে তুলে নেয় চিত্রা। কিন্তু একজন মানুষ যে হঠাৎ এসে চা খাওয়ার কথা স্মরণ করিয়ে দিল, সেটা চিত্রা বুঝতেও পারে কি না সন্দেহ। নিখিলের মুখের দিকে তাকায় না চিত্রা। একটা কথা বলবার জন্যও কোন সাড়া জাগে ঠোঁটে, রক্তগোলাপের আড্ডা দিয়ে আঁকা দুটি ঠোঁট। চিত্রার দুই
এক-একদিন মাঝরাতে নিজের ছোট ঘর থেকে ব্যস্তভাবে চিত্রার ঘরে ঢোকে নিখিল। ঘুমিয়ে আছে চিত্রা, কিন্তু যেন একটা দুঃখের স্বপ্ন দেখে বিড়বিড় করছে চিত্রা। অস্পষ্ট সেই স্বপ্নাতুর ভাষার মধ্যে যেন অভিমানের মত একটা বেদনা বিড়বিড় করে। পাখা হাতে নিয়ে ঘুমন্ত চিত্রার মাথায় কিছুক্ষণ বাতাস দিয়ে চলে
যায় নিখিল। পরদিন কথায় কথায় তার মনের উদ্বেগ প্রকাশ না করে পারে না। কাল
ঘুমের মধ্যে তুমি বড় কষ্ট পেয়েছ। চুপ করে থাকে চিত্রা, কোন উত্তর দেয় না, আর নিখিলের মুখে এই ধরনের কথাগুলি শুনতে ভালও লাগে না।
বোধহয় স্বপ্নের কথাগুলি মনে পড়ে যায়, তাই। যেন ঘুমের মধ্যে বড় স্পষ্ট করে দেখতে পায় চিত্রা, নিজেকে আর নিজের মনটাকেও। শাড়িতে আর বেণীতে স্টাইল আছে, মনের শখ-সাধ আর কল্পনাগুলির মধ্যেও স্টাইল আছে, কিন্তু এই স্টাইলগুলিই কি তার জীবনের একমাত্র কাম্য ছিল? না বোধহয়। ঘুমের মধ্যেই নিজের পুরানো মনটাকে যেন দেখতে পায় চিত্রা, আর বুঝতে পারে, মনের মত স্বামীর গর্বে গরবিনী হবার একটা আকাঙ্ক্ষা শুধু আঁকা আছে। সেই মনে। সেই আকাঙ্ক্ষারই বেদনা বিড়বিড় করে তার পাঁজরের আড়ালে এককোণে।
নিখিলের কথা শুনে চুপ করে থাকে চিত্রা। বলতে ইচ্ছা করলেও বলে না আমার স্বপ্নের খোঁজ নেবার জন্য তোমার আবার এত গরজ কেন?
স্বামীর পরিচয় চিত্রার জীবনে কোন গর্ব আনেনি, আনবেও না কোনদিন। তার জীবনের এই শূন্যতা একটা চিরকেলে শ্মশানের মত মনের মধ্যে জ্বলতো, যদি বিনায়ক সরকারের সঙ্গে দেখা না হতো একদিন এক গানের সভায়। চিত্রা জানে, ভাগ্য তাকে অন্তত এইটুকু কৃপা করেছে, অন্তত এইটুকু গর্ব এনে দিয়েছে চিত্রার মনে, বিনায়কের মত মানুষও দুঃখ পায় মনে মনে চিত্রার মত মেয়েকে জীবনে সঙ্গিনী করতে পারেনি বলে। গর্ব তো বটেই। মুলা সরকারের মত লেডি যার স্ত্রী সেই বিনায়কও আজ চিত্রাকে পাশে নিয়ে ইউকালিপটাসের ছায়ায় দাঁড়াতে পারলে সুখী হয়ে যায়। হরিনগর কলোনিতে এসে চার বছরের মধ্যেই চিত্রার চোখের বিদ্যুৎ জয়ী হয়েছে। যে মানুষকে দেখে হাজার মানুষ প্রতিদিন সেলাম আদাব ও নমস্তে জানায়, যে মানুষের মুখের দিকে অনেক লেডিই মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে, সে মানুষের সঙ্গে সন্ত্রীকে অন্তরঙ্গ হবার জন্য অনেক কন্ট্রাক্টর অনেক চেষ্টা করে, সেই মানুষ, সেই বিনায়ক সরকার শুধু বলে, এইবার শুধু
আর আমি চিত্রা, আর কেউ নয়; মাঝে মাঝে এই আলো আর ধোঁয়ার ভিড় থেকে একটু দূরে সরে গিয়ে শালবনের কিনারায় ছোট একটি জলস্রোতের কাছে...। হ্যাঁ, তাই হবে। তাই বিনায়কের চিঠির উত্তর দিয়েছে চিত্রা। অনেকবার এই আহ্বানের ভাষা বুকে লুকিয়ে নিয়ে চিত্রার কাছে এসেছে বিনায়কের অনেক চিঠি।
আজ প্রথম উত্তর দিল চিত্রা। কারণ, চিত্রার মনে আর কোন প্রশ্ন নেই।
সন্ধ্যার জন্য বিকাল থেকেই প্রস্তুত হয়েছিল চিত্রা! আর সন্ধ্যা হবার আগেই
বিনায়কের কাছ থেকে চিঠির উত্তর নিয়ে অফিস থেকে বাসায় ফিরলো নিখিল। জানিয়েছে বিনায়ক, সুখী হলাম চিঠি পেয়ে। আজ আমার সরকার অ্যান্ড সিন্হার সিলভার জুবিলি। কিন্তু তুমি বুঝবে চিত্রা, আজ আমার জীবনের এক তৃপ্তির জুবিলি। কারণ চিঠিতে তোমার মন চিনতে পারলাম, এই প্রথম। গাড়ি যাবে। চিঠি পড়ার পর চিত্রার চোখে পড়ে, নিখিলের হাতে আর একটি চিঠি রয়েছে।
সোনালী অক্ষরে ছাপানো একটি কার্ড।
চিত্রা—ওটা কি?
নিখিল–নেমন্তনের কার্ড। চিত্রা–কার নেমন্তন্ন?
নিখিল হাসে—মিস্টার ও মিসেস নিখিল রায়ের।
চিত্রার গলার স্বরে হঠাৎ একটা জ্বালা যেন কেঁপে ওঠে—তার
নিখিল সরকার অ্যান্ড সিন্হার সিলভার জুবিলি ককটেল পার্টি আছে। নেমন্তন্ন করেছেন মিস্টার সরকার।
মানে?
আজ। সরকার ভিলাতে
চিত্রা—তোমাকেও? চিত্রা চুপ করে থাকে কিছুক্ষণ। তারপরেই যেন নিজের মনে বিড় বিড় করে—নিয়ম তো আছে জানি। কিন্তু...।
নিখিল–হ্যাঁ, তাই তো নিয়ম।
কিন্তু এই নিয়মের অর্থ খুঁজে বের করবার কোন অর্থ আজ আর নেই। বেশিক্ষণ অপেক্ষাও করতে হয় না চিত্রাকে। বড়সাহেবের চকচকে টুরার পৌঁছে যায় হেডক্লার্কের কোয়াটারের সম্মুখে। একই সঙ্গে পাশাপাশি হেঁটে গাড়িতে গিয়ে উঠে বসে নিখিল আর চিত্রা, মিস্টার ও মিসেস রায়, স্বামী আর স্ত্রী।
গাড়িতে শান্তভাবে বসে রইল চিত্রা, কিন্তু রাগ হয় বিনায়কের উপর। আজ এত স্পষ্ট করে জানতে পেরেও এরকম ব্যবস্থা করলো কেন বিনায়ক? চিত্রা রায়ের জীবনে প্রথম প্রণয়ের অভিসারে নিখিল রায় নামে লোকটিকে চিত্রার সঙ্গে কেন যেতে বললো বিনায়ক? বিনায়ককে চিঠি দেবার সময় হাত কাঁপেনি যার, সেই শক্ত মনের চিত্রা রায়ও তার পাশের এই তুচ্ছ একটা অস্তিত্বকে সহ্য করতে অস্বস্তি বোধ করে। দুঃসহ এই অস্বস্তি।
কিন্তু সব অস্বস্তি মুহূর্তের মধ্যেই দূর হয়ে গেল। ইউকালিপটাসের পাশে মস্ত বড় শামিয়ানা আর আলোয় আলোকিত আসর। চকচকে টুরার যেন একেবারে এক নতুন জগতের সিংহদ্বারে নিয়ে এসে পৌঁছে দিল চিত্রাকে। এগিয়ে এল
বিনায়ক, আর বিনায়কের অভ্যর্থনার হাতে হাত দিতেই ঝিলিক দিয়ে হেসে উঠলো চিত্রার চোখের বিদ্যুৎ। যেন ছোট ছোট কুঞ্জ দিয়ে সাজানো একটা জগৎ। প্রতিটি কুঞ্জের ফুলের স্তবকের মধ্যে বিদ্যুতের রঙিন বাতি জ্বলে। প্রতিটি কুঞ্জে একটি করে টেবিল আর
দুটি করে চেয়ার। একদিকে নাচের আসর তৈরি করা হয়েছে। ছোট একটি
ডায়াস, তার দু'পাশে বসে জ্যাজ বাজায় কলকাতার বিলিতি হোটেল থেকে ভাড়া
করে আনা গোয়ানিজ বাদকের দল। বিনায়ক সরকার তার হাসিভরা মুখ চিত্রার কানের কাছাকাছি এনে তার জীবনের পরম তৃপ্তির সিলভার জুবিলির অর্থ বুঝিয়ে দেয়। — আজ এই উৎসবের এককোণে এক টেবিলের পাশে শুধু তুমি আর আমি। আজ পৃথিবী জানবে, তুমি
আমার আপনজন হয়ে গিয়েছ চিত্রা। চিত্রার হাসিতে বিদ্যুৎ খেলে যায়—তাই বলো। আমি ওপর রাগ করছিলাম।
বিনায়ক হাসে—আমাকে এখনো ভুল বুঝবে তুমি? চিত্রা—না, আর কখনো না।
ভুল বুঝে তোমার
জ্যাজ বাজে মত্ত হয়ে গেলাসে গেলাসে শেরি আর হুইস্কির পেগ ট্রের উপর সাজিয়ে নিয়ে ছুটাছুটি করে বয় আর বাটলার। সরকার অ্যান্ড সিন্হার সিলভার জুবিলির মদিরতা বিহ্বল ও উচ্ছল হয়ে ওঠে। গেলাস হাতে নিয়েই কোন সজ্জন উঠে দাঁড়ান আর টলতে টলতে আর এক টেবিলের কাছে গিয়ে দাঁড়ান। ওয়েলকাম জানিয়ে সেই টেবিলের সজ্জন চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ান। আর সেই চেয়ারের লেডি খিলখিল করে হেসে ওঠেন।
জ্যাজ বাজে আরও প্রমত্ত হয়ে। অভ্যাগতা লেডিদের শেরিসিজ ওষ্ঠে লিপস্টিকের রঙও লাস্যে তরল হয়ে ওঠে। এক একটি টেবিলে বিহ্বল যুগলমূর্তি। মিসেস ফর্দুনজীর টেবিলের কাছে এসে বসেন মিস্টার চৌধুরী। মিসেস চৌধুরী এই টেবিল আর সেই টেবিলের এক-এক দম্পতির সঙ্গে হাস্যালাপ বিনিময় করতে করতে শেষে গিয়ে বসেন মিস্টার পাত্রের পাশের শূন্য চেয়ারে। দেখা যায়, আসরের ঐ দিকে মিস্টার চ্যাটার্জির সঙ্গে আলাপ করছেন মিসেস পাত্র।
আর চিত্রা বসে থাকে আসরের প্রায় মাঝখানে নীল আলোকের এক স্তবকের নীচে একটি টেবিলের কোলের কাছে, বিনায়ক সরকারের পাশে। এই নূতন জগতের ভিড়ের মধ্যে কোথায় হারিয়ে গেল চিত্রা রায়ের স্বামী নিখিল রায়?
জানে চিত্রা, দেখতেও চায় না চিত্রা, আজ তার এই জীবনাস্তরের শুভক্ষণে পিছনের কোন মিথ্যা ছায়ার বাধাও আর রাখতে চায় না চিত্রা। পৃথিবীর সব চক্ষুর সম্মুখে বিনায়কের পাশে বসে চিত্রা আজ অকুণ্ঠচিত্তে জানিয়ে দিতে চায়, সে আড়া বিনায়কের জীবনের সবচেয়ে নিকটের আপনজন। পরিশ্রান্ত জ্যাজ থামে কিছুক্ষণের জন্য। তারপরেই শোনা যায়, সারা
আসর যেন সম্মিলিত কণ্ঠে হুররে জানিয়ে অভ্যর্থনা করছে একটা অতি
মাননীয়া আগন্তুককে।
বিনায়কের কানের কাছে মুখ এগিয়ে দিয়ে চিত্রা জিজ্ঞাসা করে ইনি কে?
বিনায়ক হাসে মূল
চমকে ওঠে চিত্রা।–মৃদুলারও কি এখানে আসবার কথা ছিল? বিনায়ক—–ছিল বৈকি। চিত্রা—আমাকে তো বলনি যে, মৃদুলা আসবে এখানে।
বিনায়ক–এর মধ্যে বলবার কি আছে? এটা তো সাধারণ নিয়ম। এই টেবিল থেকে ও টেবিল, তারপর আর এক টেবিল, শেরিতে উৎফুল্ল এক-একটি মুখের আনন্দধ্বনিকে যেন বিনম্র ভঙ্গিতে ছুঁয়ে ছুঁয়ে আপ্যায়িত করে ঘুরতে থাকেন মৃদুলা সরকার। বিরাট একটি জড়োয়া নেকলেস মৃদুলার গলা জড়িয়ে রয়েছে। ব্রোকেডের একটি স্কার্ফ এলোমেলো হয়ে লুটিয়ে রয়েছে মৃদুলার কাঁধের আর পিঠের উপর। পা টলছে মৃদুলা সরকারের। মৃদুলার এত জমকালো করে সাজানো চেহারাটা কেমন যেন
আলুথালু আর উদ্ভ্রান্ত। শুধু একজোড়া ডাগর চক্ষু এদিক-ওদিক তাকিয়ে মাঝে মাঝে কটুকট্ করে হেসে ওঠে। নিজের কানেই শুনতে পায় চিত্রা, তার কাছের টেবিলের এক অতিথি তার পার্শ্ববর্তিনীকে বলছেন, মৃদুলা সরকার আজ সকাল থেকে শেরিতে ভাসছেন বলে
মনে হচ্ছে? চিত্রা তাকায় বিনায়কের মুখের দিকে। —মৃদুলার কি হয়েছে বল তো? ও রকম করছে কেন?
বিনায়ক বলে—চিরকাল যা করে এসেছে, তাই করছে। চিত্রা—কি?
বিনায়ক –টিপ্সি মাত্রা বেশি হয়ে গিয়েছে।
আলোর আসরের মধ্যে একটা অন্ধকার যেন ধুকপুক করে উঠলো। এ কি
কথা বলছে আজ বিনায়ক তার নিজের মুখে? এই কি বিনায়কের গল্পের সেই
পতিব্রতা প্রেমিকা স্ত্রী মৃদুলা সরকার? চিত্রা বলে–তোমার কথা শুনে মৃদুলার সম্বন্ধে আমার অন্যরকম
হয়েছিল।
বিনায়ক–কি ধারণা হয়েছিল? চিত্রা—মনে হয়েছিল, এই সব শেরি-টেরির মানুষ নয় মৃদুলা।
ধারণা
বিনায়ক–শেরি সম্বন্ধেই তোমার মনে ভুল ধারণা রয়েছে ডিয়ার চিত্রা! চিত্রার । দিকে অদ্ভুত এক অলস ভঙ্গিতে তাকিয়ে কথা বলে বিনায়ক। হাসে চিত্রা রায়। রক্তগোলাপের আড্ডা দিয়ে গড়া দুই ঠোঁট যেন একটা বিস্ময় সহা করবার জন্য জোর করে হাসতে থাকে। অদ্ভুত ভীরু ভীরু হাসি। বিনায়কের অনুরোধে শেরির গেলাস দুই ঠোঁটের ভীরু হাসির কাছে তুলে নিতে গিয়েই হঠাৎ হাত থামায় চিত্রা। মৃদুলার রঙিন মূর্তিটার দিকেই আবার চিত্রার দু'চোখের দৃষ্টি ছুটে চলে যায়। মনে হয় চিত্রার, শেরির নেশায় টলমল দুটি চক্ষুর দৃষ্টি দিয়ে আর বাঘিনীর মত দুর্দান্ত একটা আগ্রহ নিয়ে কি যেন খুঁজে বেড়াচ্ছে মৃদুলা সরকার। কটকট করে হেসে উঠেছে মৃদুলার চোখ
দেখতে নেহাৎ অসুন্দর তো ময় মৃদুলার মুখ। নিজের রূপ সম্বন্ধে চিত্রার মনের ধারণায় যথেষ্ট অহঙ্কার থাকলেও মৃদুলাকে সুন্দর বলে স্বীকার করতে পারে। যেন অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল চিত্রা। জ্যাজের শব্দে চমক ভাঙে আর দেখতে পায়, দূরে দাঁড়িয়ে আসবের মাঝখানে এই টেবিলের দিকেই তাকিয়ে কটকট করে
হাসছে মৃদুলার দুই চক্ষু। এয়-ঘর করে কেঁপে ওঠে চিত্রা। প্রশ্ন করে চিত্রা—মৃদুলা এখানে এসে বসবে
বিনায়ক- ওগো না, না, না।
কিন্তু একটা ভয়ের শিহর যেন ধীরে ধীরে চিত্রার শরীরের রক্তে ঠাণ্ডা নাপের মত সিরসির করে ঘুরে বেড়ায়। বিনায়ক সরকারের পরিণীতা স্ত্রীর এ কি জীবন! বেশ তো অদ্ভুত রকমের উজ্জ্বল জীবন! আলোর মেলার মধ্যে দাঁড়িয়ে কটকট করে হাসছে ওর চোখ।
এদিকে আসে না, ওদিকেই ঘুরে বেড়ায় মৃদুলা। তবু দেখতে ভয় করে চিত্রার, বিনায়কের মত মানুষের পরিণীতা প্রেমিকা হয়েও এরকম হয়ে গেল কেন
মৃদুলা? এই কি রঙিন আর উজ্জ্বল জগতের নিয়ম? কি-যেন সন্ধান করে ফিরছে মৃদুলা। এবং টেবিলের পর টেবিলের ছায়া পার হয়ে চলে যাচ্ছে আসরের একেবারে শেষে, একেবারে শামিয়ানার রঙিন ঝালরের
গাঁ ঘেঁষা ছায়া-ছায়া একটি নিভৃতের একটি টেবিলের কাছে। পাথরের চোখের মত স্তব্ধ আর অপলক হয়ে তাকিয়ে থাকে চিত্রার চোখ। নিঃশ্বাস বন্ধ করে দেখতে থাকে চিত্রা, সুন্দর ব্রোকেডে জড়ানো এক বাঘিনীর কৌতূহল যেন এতক্ষণে শিকারের সন্ধান পেয়েছে। সেই টেবিলের পাশে বসে আছে একা একজন, তারই পাশে গিয়ে বসলো মৃদুলা। টিপ করে একটা শব্দ যেন হঠাৎ বেজে উঠলো চিত্রার বুকের ভিতর। ওখানে কেন মৃদুলা? ঐ নিরীহ নির্বোধ মানুষটার কাছে কেন মৃদুলা? হেডক্লার্ক নিখিল রায়ের সঙ্গে আলাপ করে কি লাভ
হবে মৃদুলার? বিনায়ক ডাকে—চিত্রা!
শুনতে পেয়েও মুখ ফিরিয়ে বিনায়কের দিকে তাকায় না চিত্রা। যেন সুদূর এক সংসারের রঙ্গমঞ্চের দিকে এক অদ্ভুত অদৃষ্টের খেলা দেখাবার জন্য তাকিয়ে আছে চিত্রা। দেখতে পায় চিত্রা, বয়ের হাতের ট্রে থেকে দুটি গেলাস তুলে নিল মৃদুলা। একটি নিজের কাছে রেখে, আর একটি গেলাস নিখিলের হাতে কাছে সমাদরের ভঙ্গিতে এগিয়ে দেয় মৃদুলা।
—সাবধান! যেন এই মুহূর্তের ‘অসাবধান মনের' এক নতুন দুর্বলতার সুযোগ পেয়ে চিত্রার মুখে চমকে উঠেছে ছোট্ট একটা অর্কুট আর্তনাদ। বিনায়ক বলে— তুমি এদিকে ঘুরে বসো চিত্রা।
জ্যাজ বাজে মত্ত হয়ে। নাচের আসরে দশজোড়া মূর্তি দুলে পা ফেলে। কিন্তু চিত্রার মনের চাঞ্চল্য যেন হঠাৎ মূর্ছিত হয়ে পড়েছে, কোন ভাষা আর বাজনার স্বর কানে আসছে না চিত্রার। মনে হয় শুধু, আসরের শেষ দিকে শামিয়ানার ঝালরের
কাছে একটা শিশুর অসহায় বুক একা দেখতে পেয়ে এক বাহিনী দিয়ে স বসেছে যুদ্ধ হয়ে শেরির নেশায় তৃপ্ত হয়নি মৃদুলা, আরও কিছু খুঁজছে মূলু --নো লাইট, ওয়ান মিনিট। কে যেন চেঁচিয়ে ফূর্তির মাথায় হাঁক দিল। সঙ্গে আসরের সব আলো যেন একটি ফুৎকারে নিভে গেল।
-এ কি! সেই মুহূর্তে চিৎকার করে উঠে দাঁড়ায় চিত্রা। হঠাৎ ভীত একটা পাখির আর্তনাদের মত করুণ চিত্রার গলায় সেই শব্দ। হঠাৎ অন্ধকার যেন চিত্রার বুকের উপর তীক্ষ্ণ একটা ছুরির আঘাতের মত লাফিয়ে পড়েছে। রঙিন ব্রোকেডে জড়ানো এক ভয়ঙ্করীর শেরিসিও ঠোঁট এইবার হিংস্র হয়ে কোন সর্বনাশ করে দেয় কে জানে। চেয়ার থেকে উঠে, যেন এই অন্ধকারের মধ্যেই দূরের সেই টেবিলের দিকে ছুটে যাবার জন্যে ছটফট করে চিত্রা
বিনায়ক হেসে ওঠে–আঃ, বসো চিত্রা।
পথ না পেয়ে, আর যেতে না পেরে অন্ধকারের মধ্যে থমকে দাঁড়িয়ে আসরের শেষ প্রান্তের দিকে অপলক চোখে তাকিয়ে থাকে চিত্রা। হঠাৎ চমকে ওঠে চিত্রা। বান করে আর্তনাদ করে সশব্দে একটা কাচের গেলাস যেন চূর্ণ কোথাও। ফুরিয়েছে এক মিনিট, দপ্ করে জ্বলে ওঠে আলো।
এই কয়েকটি মুহূর্তের অন্ধকারে আসরের মধ্যে যেন একটা নাটক চমকে উঠেছিল, তারই চিহ্ন দেখা যায় আসরের দু' জায়গায়। আসরের সব মানুষ আশ্চর্য হয়ে আর ভুরু কুঁচকিয়ে বুঝতে চেষ্টা করে, ব্যাপার কি? এদিকে, ভীত ও উদ্ভ্রান্ত দুটো চক্ষু নিয়ে বিনায়কের টেবিলের কাছে চিত্রা রায় পাথরের মূর্তির মত দাঁড়িয়ে আছে, আর তাকিয়ে আছে আসরের শেষ প্রান্তের একটা টেবিলের দিকে। আর ওদিকে, শেষ প্রান্তের টেবিলের কাছে একটা চেয়ার থেকে যেন হঠাৎ এক রূঢ় আঘাতে উল্টে পড়ে গিয়েছে মৃদুলা সরকার। মৃদুলারই গেলাস হাত থেকে ছুটে গিয়ে দূরে পড়েছে, আর চূর্ণ হয়ে গিয়েছে।
তাকিয়ে থাকে চিত্রা রায়ের পাথরের মত স্তব্ধ দুটি চক্ষু। তারপর ধীরে ধীরে বিচিত্র এক হাসির জ্যোৎস্না যেন ফুটে উঠতে থাকে সেই চক্ষুতে। আসরের সব চক্ষু তাকিয়ে দেখে, সত্যিই এক গরবিনী রাজেশ্বরীর মত ভঙ্গী নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে একনারী।
হ্যাঁ, গর্ব আর কি? বাঘিনীর আগ্রহ অন্ধকারের সুযোগে মত্ত হয়ে ছুঁতে গিয়েছিল চিত্রা রায়ের স্বামীকে। ভুল করেছে মৃদুলা, বুঝতে পারেনি মৃদুলা, চিত্রা রায়ের স্বামী বড় কঠিন স্বামী।
বিনায়ক ডাকে—দাঁড়িয়ে আছ কেন। বসো চিত্রা —হ্যাঁ, বসছি। হেসে হেসে বিনায়কের আহ্বানে সাড়া দেয় চিত্রা।
যেন চিত্রার বুকের ভিতর থেকে অদ্ভুত একটা বিদ্রূপ হাসির ঝর্ণা হয়ে ঝড়ে
পড়ছে। থামতে চায় না। এই অন্ধকারে–ভরা কয়েকটি মুহূর্তের মধ্যে নতুন কোন গর্ব পেয়ে গেল চিত্রা, যার জন্য এমন করে বিনায়কের দিকে করুণার চক্ষে তাকিয়ে স্বচ্ছন্দে অবাধে নিঃসঙ্কোচে আর মুখর হয়ে হেসে চলেছে চিত্রা? বোধহয়, চিত্রাই তখনো পারেনি যে, তার জীবনের সকল ক্ষোভের গভীরে লুকানো সেই বেদনার বিদ্যুৎ আজ জ্বালা হারিয়ে একেবারে স্থির হয়ে গিয়েছে।
আবার জ্যাজ বাজে মত্ত হয়ে, নাচের আসরে জোড়া নৃত্যপর মূর্তির ছায়া দোলে। চুপ করে, নিজের বুকের ভিতরের অদ্ভুত এক প্রসন্নতার ভারে অলস ও স্নিগ্ধ হয়ে চেয়ারের উপর বসে থাকে চিত্রা।
আবার নো লাইট। নিভে গেল সব আলোক। স্থির হয়ে, শক্ত হয়ে চুপ করে বসে থাকে চিত্রা। পর মুহূর্তে চমকে ওঠে। শেরির গন্ধ মাখানো একটা নিঃশ্বাসের সরীসৃপ যেন চিত্রার মুখের কাছে এগিয়ে আসছে।
ঝনূন্। সঙ্গে সঙ্গে একটা কাচের গেলাস চূর্ণ হয়ে যায় অন্ধকারে। একটি চেয়ার উল্টে পড়ে যায়। অন্ধকারের স্পর্ধাকে দুই হাতের ঘৃণাকঠিন একটি ধাক্কায় ধূলিসাৎ করে দেয় চিত্রা রায়।
চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়, থরথর করে কাঁপতে থাকে চিত্রার দেহ। যেন তার দুঃস্বপ্নমুক্ত জীবনটা গর্বের আবেশে কাঁপছে। দপ্ করে জ্বলে ওঠে আলো। সারা আসরের চক্ষু দেখতে পায়, বিনায়ক সরকার চেয়ার থেকে উল্টে পড়ে গিয়েছেন, আর তাঁরই হাতের গেলাস ছিটকে
পড়ে চূর্ণ হয়েছে। আসরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে শামিয়ানার শেষ প্রান্তের ঝালরের দিকে ছায়া ছায়া এক নিভৃতে দাঁড়ানো এক মূর্তির দিকে তাকিয়ে হাত তুলে আহ্বান জানায়
চিত্রা—এস। ব্যস্তভাবে এগিয়ে এসে নিখিল রায় চিত্রারই পাশে দাঁড়ায়। খপ্ করে নিখিলের একটা হাত ধরে ফেলে চিত্রা।– চল ।
সারা আসরের চক্ষু কিছুক্ষণের জন্য বিস্মিত অভিভূত ও একটু বিরক্ত হয়ে দেখতে থাকে, আসর ছেড়ে চলে যাচ্ছেন এক ভদ্রলোক আর এক মহিলা। কি রকম যেন ওদের দু'জনের চলবার আর তাকাবার ভঙ্গি। মনে হয় একেবারেই ম্যানার্স জানে না।
0 মন্তব্যসমূহ