--সুবোধ ঘোষের গল্প সুবোধ ঘোষের শ্রেষ্ঠ গল্প সুবোধ ঘোষের গল্প অযান্ত্রিক সুবোধ ঘোষের গল্প সুন্দরম সুবোধ ঘোষের গল্প গোত্রান্তর অযান্ত্রিক গল্পের বিষয়বস্তু--
**বিঃদ্র-বাংলা বিভাগের সকল পড়াশোনা পেতে ব্লগটিতে যুক্তথাকুন https://monoweredu13.blogspot.com/?m=1
(১)***অযান্ত্রিক---
বিমলের একগুঁয়েমি যেমন অব্যয়, তেমন অক্ষয়, তার ঐ ট্যাক্সিটার পরমায়ু। সাবেক আমলের একটা ফোর্ড, প্রাগৈতিহাসিক গঠন, সর্বাঙ্গে, একটা কদর্য দীনতার ছাপ। যে নেহাৎ দায়ে পড়েছে বা জীবনে মোটর দেখেনি, সে ছাড়া আর কেউ ভুলেও বিমলের ট্যাক্সির ছায়া মাড়ায় না।
দেখতে যদি জবুথবু, কিন্তু কাজের বেলায় বড়ই অদ্ভুতকর্মা বিমলের এই ট্যাক্সি। বড় বড় চাঁইগাড়ির পক্ষে যা অসাধ্য, তা ওর কাছে অবলীলা। এই দুর্গম অভ্রখানি অঞ্চলের ভাঙ্গাচোরা ভয়াবহ জংলীপথে, ঘোর বর্ষার রাত্রে, যখন ভাড়া নিয়ে ছুটতে সব গাড়িই নারাজ, তখন সেখানে অকুতোভয় এগিয়ে যেতে পারে শুধু বিমলের এই পরম প্রবীণ ট্যাক্সিটি। তাই সবাই যখন জবাব দিয়ে সরে পড়ে, একমাত্র তখনি শুধু গরজের খাতিরে আসে তার ডাক, তার আগে নয়।
ট্যাক্সিস্ট্যান্ডে সারি সারি জমকালো তরুণ নিউ মডেলের মধ্যে বিমলের বুড়ো ফোর্ড দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঝিমোয়, জটায়ুর মতো তার জরাভার নিয়ে। বাস্তবিক বড় দৃষ্টিকটু। তালিমারা হুড সামনের আর্শিটা ভাঙা, তোবড়ানো বনেট, কালিঝুলি মাখা পরদা আর চারটে চাকার টায়ার পাটি লাগানো; সে এক অপূর্ব শ্রী। পাদানিতে পা দিলে মাড়ানো কুকুরের মতো ক্যাঁচ করে আর্তনাদ করে ওঠে। মোটা তেলে ছাপ লেগে সীলগুলি এত কলঙ্কিত যে, সুবেশ কোন ভদ্রলোককে পায়ে ধরে সাধলেও তাতে বসতে রাজি হবে না। দরজাগুলো বন্ধ করতে বেশ বেগ পেতে হয়, আর যদিও বন্ধ হল তো তাকে খোলা হয়ে ওঠে দুঃসাধ্য। সীটের ওপর গামজা, নোংরা গোটা দুই গেঞ্জি আর তেলচিটে আলোয়ন।
বিমলের গাড়ির দূরায়ত ভৈরবহর্ষ শোনা মাত্র প্রত্যেকটি রিক্সা সভয়ে রাস্তার শেষ কিনারায় সরে যায়। আর দুঃসাহসী সাইকেলওয়ালারা বিমলের ধাবমান গাড়ির পাশ কাটিয়ে যেতে বুক কাঁপে। রাত্রির অন্ধকারে এক-একবার দেখা যায়, দূর থেকে যেন একটা একচক্ষু দানব অট্টশব্দে হা হা করে তেড়ে আসছে; বুঝতে হবে ঐটি বিমলের গাড়ি। একটি হেডলাইটের আলো নির্বাণপ্রাপ্ত। আলগা আলগা শরীরের গাঁটগুলো যে কোন সময়ে বিস্ফোরণের মতো শতধা হয়ে ছিটকে পড়তে পারে।
সবচেয়ে বেশি ধুলো ওড়াবে, পথের মেষ ক্ষ্যাপাবে আর কানফাটা আওয়াজ করবে বিমলের গাড়ি। তবু কিছু বলবার জো নেই বিমলকে। চটাং চটাং মুখের ওপর দু'কথা উল্টো শুনিয়ে দেবে—মশাই বুঝি কোন নোংরা কম্ম করেন না, চেঁচান না, দৌড়ন না? যত দোষ করেছে বুঝি আমার গাড়িটা!
কত রকমই না বিদ্রূপ আর বিশেষণ পেয়েছে এই গাড়িটা—বুড্ঢ়া ঘোড়া,
খোঁড়া, হাঁস, কানা ভুইস। কিন্তু বিমলের কাছে থেকে এ একটা আদুরে নাম
পেয়েছে এই গাড়ি–জগদ্দল। এই নামেই বিমল তাকে ডাকে, তার ব্যস্ত-ত্যন্ত কর্মজীবনে সুদীর্ঘ পনেরেটি বছরের সাথী এই যন্ত্রপশুটা, বিমলের সেবক, বন্ধু আর অনুদাতা।
সন্দেহ হতে পারে, বিমল তো ডাকে, কিন্তু সাড়া পায় কি? এটা অন্যের পক্ষে বোঝা কঠিন। কিন্তু বিমল জগদ্দলের প্রতিটি সাধ-আহ্লাদ, আবদার অভিমান এক পলকে বুঝে নিতে পারে।
‘ভারী তেষ্টা পেয়েছে, না রে জগদ্দল? তাই হাঁসফাঁস কচ্ছিস? দাঁড়া বাবা দাঁড়া।" জগদ্দলকে রাস্তার পাশে একটা বড় বট গাছের ছায়ায় থামিয়ে, কুঁয়ো থেকে বালতি ভরে ঠান্ডা জল আনে, রেডিয়েটের মুখে ঢেলে দেয় বিমল। বগ বগকরে চার-পাঁচ বালতি জল খেয়ে জগদ্দল শান্ত হয়, আবার চলতে থাকে। এ ট্যাক্সির মালিক ও চালক বিমল স্বয়ং। আজ নয়, একটানা পনের বছর ধরে।
স্ট্যান্ডের এক কোণে তার সব দৈন্য আর জরাভার নিয়ে যাত্রীর অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকে বুড়ো জগদ্দল। পাশে হালমডেল গাড়িটার সুমসৃণ ছাইরঙা বনেটের ওপর গা এলিয়ে বসে পিয়ারা সি বিমলকে টিটকারি দিয়ে কথা বলে—'আর কেন, এ বিমলবাবু? এবার তোমার বুড়িকে পেনসন দাও।
—হ, তারপর তোমার মতো একটা চটকদার হাল-মডেল বেশ্যে রাখি।' বিমল সটান উত্তর দেয়। পিয়ারা সিং আর কিছু বলা বাহুল্য মনে করে; কারণ বললেই বিমল রেগে যাবে, আর তার রাগ বড় বুনো ধরনের।
ক্বার্তিক পূর্ণিমায় একটা মেলা বসবে এখানে থেকে মাইল বারো দূরে, সেখানে আছে নরসিংহ দেবের বিগ্রহ নিয়ে এক মন্দির। ট্যাক্সিস্ট্যান্ডে যাত্রীর ভিড়। চটপট ট্যাক্সিগুলো যাত্রী ভরে নিয়ে হস হস করে বেরিয়ে গেল। শূন্য স্ট্যান্ডে একা পড়ে থেকে শুধু ধুঁকতে লাগল বুড়ো জগদ্দল। কে আসবে তার কাছে, যার ঐ প্রাগৈতিহাসিক গঠন আর পৌরাণিক সাজসজ্জা? গোবিন্দ এসে সমবেদনা জানিয়ে বললো—কি গো বিমলবাবু, একটা ভাড়া
পেলে না?
—না। —তবে আর কি? এর শোধ তুলব সন্ধ্যেয়। ডবল ওভারলোড নেব, যা থাকে
কপালে।
—ও করে আর ক'দিন কারবার চলবে? বরং এইবার আর দেরি না করে জগদ্দলকে একচেঞ্জ দিয়ে ঝরিয়া থেকে আনিয়া নাও মগনলালের গাড়িটা তোফা ছ'সিলিণ্ডার সিডান, সত্যি।
—আরে যেতে দাও কে অত ঝঞ্ঝাট করে বল? —এটা বঝঞ্ঝাট? আর নিত্যি এই লুকিয়ে পাকিয়ে ওভারলোড নেবার হয়রানি,সেটা ঝঞ্ঝাট নয়?
-না ভাই যেতে দাও, ওসব কথা? নাও বিড়ি খাও
গোবিন্দ চুপ করে গেল। স্বাগদ্দলে প্রসঙ্গ পরের মুখে আলোচনা বিমল কোনদিনই বরদাস্ত করে না। চেপে যাওয়াই ভাল, নইলে এখনি হয়ত একটা অপভাষা ব্যবহার করে বসবে।
বাজে কথায় মন না দিয়ে বিমলও ক্যানেস্তারা ভরে জল নিয়ে এল—–পিচকারি দিয়ে বুড়ো জগদ্দলের ধুলোকাঁদা ধুতে লেগে গেল। হামা দিয়ে গাড়িটার তলার ঢুকে চিৎ হয়ে শুয়ে পিচকারির জল ছড়ায়। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে, টাইরেডের গলায় গোবরের দাগটা গেল কি না ডিফারেন-সিয়ালের বর্তুল পেটটা ন্যাতা দিয়ে ঘষে ঘধে চকচকে করে ফেলে। আবার দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে–আঃ, হুডটা
বেজায় পুরনো, দু'জায়গায় ফেটে মস্ত বড়ো দুটো ফাঁক হাঁ করে আছে।
—কি করব জগদ্দাল। এবার তালি নিয়েই কাজ চালা। আসছে পূজোয় ক'টা ভাল রিজার্ভ পেলে তোকে নতুন রেক্সিনের হড পরাব, নিশ্চয়! জগদ্দলের প্রসাধন এখানেই ক্ষান্ত হয় না। পকেট হাতড়ে বিমল শেষ
দুয়ানিটা বার করে কেরোসিন তেল কিনে বোল্ট্রগুলোর মরচে মুছতে লেগে যায়। গৌর এসে বলল—'এ্যা, এ কি হচ্ছে বিমলবাবু ভাঙা মন্দির চুনকাম!' বিমল বিশ্রীভাবে মুখ বিকৃত করে খেঁকিয়ে উঠল— সোজা কেটে পড় না
রাজা এখান থেকে, কে তোমার বকবক করতে ডেকেছে?
বিমল এইটেই বুঝে উঠতে পারে না যে, তার এইসব প্রাইভেট ব্যাপারে অপরে এত মাথা ঘামাতে আসে কেন? ‘গ্রাইভেট’–পিয়ারা সিং হেসে যেন গড়িয়ে পড়ে। গাড়িভি ঘরকা আওরাত হ্যায় ক্যা?"
কারবার ডুবতে বসেছে, তবুও বিমলের ঐ এক রোখ। এক কুদৃশ্য বুড়ো গাড়িটার উপর একটা উৎকট মায়া তার কারবারি বুদ্ধিকেও দিয়েছে ঘুলিয়ে! তা না। হলে এতবড় মক্ষিচোষক কৃপণ বিমল— যে ধানবাদে পুরিরে দাম বেশি বলে দিনটা উপোসে কাটিয়ে পরদিন গলায় ফিরে সস্তাদরে দু’গুণ খাওয়া খায়, সেই বিমল অকুণ্ঠহাতে এ গাড়ির পিছনে খরচ করে চলেছে, ভন্মে ঘি ঢালছে।
বুলাকি প্রাগলারও এমনি ধরনের স্নেহান্ধতা ছিল তার ভাঙা টিনের গামলার উপর। নিজে বসেবসে বৃষ্টি ভিজত, কিন্তু ছাতা দিয়ে সযত্নে ঢেকে রাখতো তার ভাঙা গামলাটিকে।
সন্ধ্যের আবছা অন্ধকার নেমে এল, দোকানগুলিতে দু'একটা পেটম্যাক্স বাতি উঠল জ্বলে। ময়রার দোকানের উনুন থেকে পুঞ্জ পুঞ্জ ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ে অন্ধকারটা আরও পাকিয়ে তুলল। অদূরে ট্রাফিক পুলিশটাকেও একটু আনমনা দেখাচ্ছে। পোঁটলা-পুঁটলি নিয়ে একদল চাষী গেরস্থ আসছে এইদিকে–দূর দেহাতের যাত্রীসব। এই তো শুভলগ্ন।
বিমল হাঁকল, গলা নয়তো, চোঙবিশেষ–চলা আও, চলা আও। রামগড়, রাঁচী নয়াসরাই। মজুদগঞ্জ, চিত্রপুর, ঝালদা। কনসেসান রেট-কসসেসান। আগম্ভক যাত্রিদলের কানের ভেতরে দিয়ে মরমে পৌঁছাল এ ডাক। কনসেসান রেট কিন্তু সংখ্যায় চোদ্দোজন, বুড়ো জগদ্দলের উদর গহ্বরে ছ'জনের
স্থানে ঠেলে দিলে চৌদ্দজনকে। হুবহু কাঙ্গারুর পেটে, কার সাধ্য বোঝে বাইরে থেকে ক'টি জীবন সেখানে প্রচ্ছন্ন। ক্ষিপ্র হাতে ঘুরিয়ে দিল স্টার্টিং হ্যালে–নার দু'তিন পাক। মত্ত সিংহের মতো বুড়ো জগদ্দলের গর্জে উঠল। পানের দোকানে লাল জলের বোতলগুলো কেঁপে উঠল ঠুং ঠুং করে। হর্ণের বিলাপে বাজার মাত করে একটুকরো কাল-বৈশাখীর মতো জগদ্দল স্ট্যান্ড ছেড়ে ডাইনের সড়ক ধরে উধাও হয়ে গেল।
হাঁ, একখানা গাড়ি গেল বটে—পানওয়ালা বলল—'আজব এক চীজ হ্যায় বিমলবাবুকা ট্যাক্সি।'7 এই হল বিমলের নিত্যদিনের সংক্ষিপ্ত কর্মসূচি।
জগদ্দলের বিরুদ্ধে সমস্ত দুনিয়াটা ষড়যন্ত্র করছে। এই রকম একটা সংশয় বিমলের মনে দৃঢ়মূল হয়ে গেছে। দেখে আর আশ্চর্য হয়—উড়ন্ত চিলগুলোও বেছে ঠিক 'জগদ্দলের' মাথার উপর মলত্যাগ করে। পথচারী লোকেরা পান খেয়ে হাতের চুনটি নিঃসঙ্কোচে জগদ্দলের গায়েই মুছে দিয়ে সরে পড়ে। স্ট্যান্ডে আরও তো ভালমন্দ সাতাশটা গাড়ি রয়েছে, তাদের তো কেউ এতটা অশ্রদ্ধা করতে সাহস করে না। জগদ্দলই বা কার পাকা ধানে এমন মই দিল?
জগদ্দল! বিমল আস্তে আস্তে ডাকে। স্নেহে দ্রব হয়ে আসে তার কন্ঠস্বর। তার সকল মমতা রক্ষাকবচের মতো জগদ্দলকে যেন এই সমবেত অভিশাপ আর নিত্য গল্পনা থেকে আড়াল করে রাখতে চায়। —'কুছ পরোয়া নেই জগদ্দল। আমি আর তুই আছি।'—একটা সুদর্পিত
চ্যালেঞ্জ ঘোষণা করে বিমল বেপরোয়াভাবে, বিড়িতে জোরে জোরে টান দিয়ে যেন
প্রতিসংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হয়ে নেয়। ঝড়-ঝঞ্ঝা নিয়ে এক আধটা দুর্দিনও আসে, আকস্মিক আধিব্যাধি মেরামতও থাকে— তাই প্রত্যেক গাড়িই এক আধবার কামাই দিতে বাধ্য। কিন্তু জগদ্দলের উপস্থিতি ছিল সূর্যোদয়ের চেয়েও নিয়মিত ও নিশ্চিত। সমব্যবসায়ী ট্যাক্সিচালক মহলে এ-ও একটা ঈর্ষার কারণ হতে পারে। অন্ততঃ পক্ষে বিমলের তাই বিশ্বাস! একটা বুনখুনে বুড়ো যদি দিনের পর দিন অনায়াসে লাফ-ঝাঁপ ডনকুস্তি মেরে বেড়ায়, কেন জোয়ান না থাকে হিংসা করে?
জগদ্দলকে নিয়ে এই অহেতুক গর্বে বিমল ফুলে থাকত সর্বদা। জগদ্দল তার গত পনের বছরের বিলাসে ব্যসনে দুর্দিনে নিত্য-সহচর। একাগ্র সেবায় তাকে পরিপুষ্ট করে এসেছে। দেব নরসিংহের কাছে কত লোক কত বিচিত্র মানত করে—কত রূপ দেহি যশো দেহি। বিমল দু’পয়সার ফুল বাতাসা নরসিংহের পায়ের কাছে রাখে, মনে মনে ধ্বনিত হয়। একান্ত, সামান্য একটু দাবী হে বাবা, জগদ্দল যেন বিকল না নয়। এ বয়সে আর আমার সঙ্গীহীন করো না বাবা, দোহাই
‘লোকটাও একটা যন্ত্র'—বেঙ্গলী ক্লাবে আলোচনা হয়। — নইলে পনের বছর ধরে অহর্নিশি মোটরধ্যানে। এ মানুষের সাধ্য নয়। বিমল নিজেই বলে, পোড়া পেট্রলের গন্ধে ওর কেমন বেশ একটু মিঠে মিঠে
নেশা লাগে।
'আমিও যন্ত্র। বেঙ্গলী ক্লাব বলেছে ভালো। বিমল খুশি হয়ে মনে মনে
হাসে।
কিন্তু জগদ্দল ও যে মানুষের মতো, এ তত্ত্ব বেঙ্গলী ক্লাব বোঝে না, এইটেই দুঃখ। এই কম্পিটিশনের বাজারে, এইসব শিকরে-বাজের ভিড়ে, এই বুড়ো জগদ্দলই তো দিন গেলে নিদেন দুটি টাকা তার হাতে তুলে দিচ্ছে। আর তেল খায় কৃত কম গ্যালনে সোজা বাইশটি মাইল দৌড়ে যায়। বিমল গরীব, জগদ্দল যেন এই সত্যটুকু বোঝে।
আরবী ঘোড়ার মতো প্রমত্ত বেগে জগদ্দল ছুটে চলেছে রাঁচীর পথে। সাবাস তার দম দৌড় আর লোড টানার শক্তি। কম্পমান স্টিয়ারিং হুইলটাকে দুহাতে আঁকড়ে ও বুক ঠেকিয়ে বিমল ধরে রয়েছে। অনুভব করছে দুঃশীল জগদ্দল প্রাণস্ফূর্তির শিহর। কনকনে মাঘী হাওয়া ইস্পাতের ফলার মতো চামড়া চেঁছে চলে যাচ্ছে। মাথায় জড়ানো কম্ফোটারটা দু'কানের ওপর টেনে নামিয়ে দিল বিমল; বিমলের বয়স হয়েছে, আজকাল ঠাণ্ডাফাণ্ডা সহজে কাবু করে দেয়।
সম্মুখে পড়ল একটা পাহাড় ঘাট। এই সুবিসর্পিত চড়াইটা জগদ্দল রুষ্ট চিতাবাঘের মতো একদমে গোঁ গোঁ করে কতবার পার হয়ে গেছে। সেদিনও অভ্যস্ত বিশ্বাসে ঘাটের কাছে এসে বিমল চাপল এক্সিলেটার পুরো চাপ! জগদ্দল পঞ্চাশ গজ এগিয়ে খং খং করে কঁকিয়ে উঠল। যেন তার বুকের ভেতর কটা হাড় সরে গিয়েছে। উৎকর্ণ হয়ে বিমল শুনল সে আওয়াজ! না ভুল নয়, সেরেছে জগদ্দল! পিস্টন ভেঙে গেছে!
ক'দিন পরে মাঝপথে এমনি আকস্মিকভাবে বেয়ারিং গিয়ে একটা বড়
রিজার্ভ নষ্ট হয়ে গেল। তারপর একটা না একটা উপসর্গ লেগেই রইল। এটা দূর
হয় তো ওটা আসে। আজ ফ্যানবেল্ট ছেঁড়ে, কাল কারবুরেটারে তেল পার হয় না,
পরশু প্লাগগুলো অচল হয়ে পড়ে— শর্ট সারকিট হয়। এিত বড় বিশ্বাসের পাহাড়টা শেষে বুঝি টলে উঠল। বিমল ক'দিন থেকে অস্বাভাবিক রকমের বিমর্ষ। এদিকে সেদিকে ছুটোছুটি করে বেড়ায়। জগদ্দলেরও নিয়মভঙ্গ হয়েছে, স্ট্যান্ডে আসা বাদ পড়েছে মাঝে মাঝে। উৎকণ্ঠায় বিমলের বুক
দুর দুর করে। তবে কি শেষে সত্যই জগদ্দল ছুটি নেবে? —'না, আমি আছি জগদ্দল; তোকে সারিয়ে টেনে তুলবই, ভয় নেই।'
মোটরবিশারদ পাকামিস্ত্রী বিমল প্রতিজ্ঞা করে। কলকাতায় অর্ডার দিয়ে প্রত্যেকটি জেনুইন কলকব্জা আনিয়ে ফেলে বিমল। নতুন ব্যাটারি, ডিস্ট্রিবিউটর, অ্যাক্সেল, পিস্টন সব আনিয়ে ফেলল। অকৃপণ হাতে শুরু হলো খরচ, প্রয়োজন বুঝল রাতারাতি তার করে জিনিস আনায়। রাত জেগে খুটখাট মেরামত, পার্টস বদল আর তেলজল চলেছে জগদ্দলকে রৌগে ধরেছে, বিমল যেন ক্ষেপে উঠেছে। অর্থাভাব–বেচে ফেলল ঘড়ি, বাসনপত্র, তক্তাপোষটা পর্যন্ত।
সর্বস্ব তো গেল, যাক। পনের বছরের বন্ধু জগদ্দল এবার খুশি হবে, হবে সেরে উঠবে। খুব করা গেছে যা হোক, এবার নতুন হুড, রং, আর বার্নিস পড়লে
একখানি বাহার খুলবে বটে। বিমলের কল্পনা যেন নিজেরাই খুশিতে বিমলের মনের ভিতর হাসতে থাকে।
রাত দুপুরের জগদ্দলকে গ্যারেজে বন্ধ করার সময় বিমল একবার আলো তুলে দেখে নিল। খুশি উপচে পড়ল তার দু'চোখে এই তো বলিহারি মানিয়েছে জগদ্দলকে। ক'দিনের অক্লান্ত সেবায় জগদ্দলের চেহারা ফিরে গেছে। দেখাচ্ছে যেন একটি তেজি পেশীওয়ালা পালোয়ান। এক ইশারায় দঙ্গলে ভিড়ে যেত প্রস্তুত। হাত মুখ ধুয়ে শুয়ে পড়ল বিমল। বড় পরিশ্রমের চোট গেছে ক'দিন।। কিন্তু কী আরামই না লাগছে ভাবতে—জগদ্দল সেরে উঠেছে; কাল সকালে সগর্জনের নতুন হর্নের শব্দে সচকিত করে জগদ্দলকে নিয়ে যখন স্ট্যান্ডে গিয়ে দাঁড়াবে বিমল, বিস্ময়ে হতবাক হবে সবাই, আবার জ্বলবে হিংসেতে।
হঠাৎ বিমলের ঘুম ভেঙে গেল। শেষ রাত্রি তবু নিরেট অন্ধকার ঝুপ ঝুপ করে বৃষ্টি পড়ছে। ধড়ফড় কর উঠে বসল -জগদ্দল ভিজছে না তো! গ্যারেজের টিনের ছাদটা যা পুরানো, কত ফুটো ফাটাল আছে কে জানে। কোন ফাঁকে ইঞ্জিনে জল ঢুকলে হয়েছে আর কি! বডির নতুন পালিশটাকেও স্রেফ ঘা করে দেবে।
কেরোসিনের বাতি জ্বালিয়ে নিয়ে গ্যারেজে ঢুকে বিমল প্রায় চেঁচিয়ে উঠল আরে হায়! হায়। ছাদের ফুটো দিয়ে ঝুপ ঝুপ করে বৃষ্টির জল ঝরে পড়েছে ঠিক ইঞ্জিনের ওপর। দৌড়ে শোবার ঘর থেকে বিমল নিয়ে এল তার বর্ষাতিটা; টেনে আনল বিছানার কম্বল সতরঞ্চি চাদর।
ইঞ্জিনের ভেজা বনেটটা মুছে ফেলে কম্বলটা চাপিয়ে দিল, তার ওপর
বর্ষাতিটা! সতরঞ্চি আর চাদর দিয়ে গাড়িটার সর্বাঙ্গ ঢেকে দিয়ে নিজেও ঢুকে
পড়ল ভেতরে; নতুন নরম গদিটার ওপর গুটিসুটি হয়ে বিমল শুয়ে পড়ল; আরামে
তার দুচোখে যেন ঘুমের ঢল নেমে এলো।
পরদিনের ইতিহাসে। স্ট্যান্ডের উদগ্রীব জনতা জগদ্দলেকে ঘিরে দাঁড়াল, যেন একটা অঘটন ঘটে গেছে। স্তুতিমুখর দর্শকেরা দাঁড়িয়ে দেখল বিমলের অপূর্ব মিস্তিরী-প্রতিভার নিদর্শন। বিমলও টেনে টেনে কয়েকবার হাসল। কিন্তু কেমন যেন একটু অস্বচ্ছ সে হাসি, একটা শঙ্কায় ধূসর স্পর্শে আবিল।
কেন? বিমলের মনের ভিতরে বেদনা ছড়ায় একটা সন্দেহ। জগদ্দল চলছে ঠিকই, কিন্তু কই সেই স্টার্টমাত্র শক্তির উচ্চকিত ফুকার, সেই দর্পিত হেষাধ্বনি আর দুরন্ত বনহরিণের গতি?
শহর থেকে দূরে একটা মাঠের ধারে গিয়ে বিমল বেশ করে জগদ্দলকে পরীক্ষা করে দেখল।
—চল বাবা জগদ্দল! একবার পক্ষিরাজের মতো ছাড় তো পাথা!' বিমল চাপল এক্সিলেটার! নাঃ বৃথা, জগদ্দল অসমর্থ। ফার্স্ট, সেকেণ্ড, থার্ড প্রত্যেকটি গিয়ার পর পর পাল্টে টান দিল বিমল।
শেষে রাগ চড়ে গেল মাথায়—'চল, নইলে মারব লাথি। অক্ষম বৃদ্ধের মতো জগদ্দল হাঁপিয়ে হাঁপিয়ে চলতে থাকে
'আদর বোঝে না, কথা বোঝে না, শালা লোহার বাচ্চা, নির্জীর ভূত' বিমল সত্যি সত্যি ক্লাচের ওপর সজোরে দুটো লাথি মেরে বসল।
বিমলের রাগ ক্রমশ বাড়ছে, সেই বুনো রাগ। আজ শেষ জবাব জেনে দেবে সে! জগদ্দল থাকতে চায় না যেতে চায়? অনেক তোয়াজ করেছে সে, আর নয়।
রাগে মাঘাটা খারাপই হয়ে গেল বোধ হয়। বিমল ঠেলে ঠেলে প্রকাণ্ড সাত আটটা পাথর নিয়ে এল। ঘামে ভিজে ঢোল হয়ে গেল পরিশ্রান্ত বিমলের বাকি কামিজ। এক এক করে সব পাথরগুলো গাড়িতে তুলে দিল। একেই বলে লোড! এই লোড জগদ্দলকে আজ টানতে হবে, দেখা যাক, জগদ্দলের সেই শক্তি আছে, না চিরকালের মতো ফুরিয়ে গিয়েছে।
চল জগদ্দল,,গাটে গাঁটে আর্তনাদ বেজে উঠল ক্যাচ ক্যাচ করে। অসমর্থ আর পারবে না জগদ্দল এ ভার বইতে।
এইবার বিমল নিশ্চিত। জগদ্দলকে যমে ধরেছে। এ সত্যে আর সন্দেহ নেই। এত কড়া কলিজা জগদ্দলের, তাতেও ঘুণ ধরল আজ। কৃতান্তের ডাক, আর রক্ষে নেই, এইবার দিন ফুরিয়ে সন্ধ্যা নামবে। শেষ কড়ি খরচ করে ও রইল না জগদ্দল।
আমি শুধু ৱৈনু বাকি... পরিশ্রান্ত বিমল মনে মনে যেন বলে উঠল— কিন্তু আমারও তো হয়ে এসেছে। চুলে পাক ধরেছে, রগগুলো জোঁকের মতো গা ছেয়ে ফেলেছে সব। সেদিনের আর বেশি বেশি দেরি নেই, যেদিন জগদ্দলের মতো এমনি করে হাঁপিয়ে আর খুঁড়িয়ে আমাকে বাতিল হয়ে যেতে হবে।
বিড়ি ধরিয়ে নিয়ে চুপ করে জগদ্দলের দিকে তাকিয়ে থাকে বিমল। মনের
ভিতরে যেন একটা শূন্যতার আক্ষেপ ছটফট করতে থাকে। 'জগদ্দল আগেই যাবে
বলে মনে হচ্ছে। তারপর আমার পালা! যা জগদ্দল, ভালো মনেই বিদায় দিলাম।
অনেক খাইয়েছিস, পরিয়েছিস, আর কত পারবি? আমার যা হবার হবে। যা
কোনদিন হয়নি, তাই হলো ইস্পাতের গুলির মতো শুকনো ঠাণ্ডা বিমলের চোখে
দেখা দিল দু'ফোটা টলটলে উষ্ণ জল। ফিরে এসে বিমল জগদ্দলকে গ্যারেজের বাইরে বেলতলায় দাঁড় করিয়ে নেমে পড়ল। পেছনে ফিরে আর তাকাল না। সোজা গিয়ে উঠোনে বসে পড়ল, সামনে রাখল দু'বোতল ভেজালো মহুয়া।
একটি চুমুক সবে দিয়েছে, শোনা গেল কে ডাকছে–বিমলবাবু আছ! গোবিন্দের গলা। গোবিন্দ এল, সঙ্গে একজন মারোয়াড়ী ভদ্রলোক। —আদাব বাবুজী।
—আদাব, কোন গাড়ির এজেন্ট আপনি? বিমল প্রশ্ন করল। গোবিন্দ পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলল— গাড়ির এজেন্ট নন উনি; পুরনো লোহা কিনতে এসেছেন কলকাতা থেকে তোমার তো গাদাখানেক ভাঙা আক্সেল আর রীঘটিম জমে আছে। পর বুঝে ছেড়ে দাও এবার। বিমল খানিকক্ষণ নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে রইল দু'জনের দিকে। ভবিতব্যের
ছায়ামূর্তি তার পরম ক্ষুধার দাবী নিয়ে, ভিক্ষাভাগুটি প্রসারত করে আজ সামনে
এসে দাঁড়িয়েছে। এমনিতে ফিরবে না যে, শ্রেষ্ঠ ভিক্ষা চাই। ব্যাপারটা বুঝল বিমল।
--হ্যাঁ আছে পুরানো লোহা, অনেক আছে, কত পর ন -চোদ্দ আনা মণ বাবুজী, মারোয়াড়ীর ব্যগ জবাব এলো।– লড়াই লেগেছে, এইতো মওকা, ঝেড়েছ সব দিয়ে ফেলুন বাবুজী। —হ্যাঁ সব দেব। আমার ঐ গাড়িটাও দেব। ওটা একেবারে অকেজো হয়ে
গেছে। হতভম্ব গোবিন্দ শুধু বলল--সে কি গো বিমল বাবু? নেশা ভাঙল এক ঘুমের পর। তখনো রাত, বিমল আর এক বোতল পার করে শুয়ে পড়ল।
ভোর হয়ে এসেছে। থেকে থেকে ঘুম ভেঙে যাচ্ছে বিমলের বাইরের জাগ্রত পৃথিবীর সমস্ত কোলাহল থেকে উপচে পড়ছে শুধু একটি শব্দ, বিমলের কানের কাছে আছড়ে পড়ছে ঠং ঠং ঠকাং ঠকাং। মারোয়াড়ীর লোকজন ভোরে ঐসেই বিমলের গাড়ি টুকরো টুকরো করে খুলে ফেলেছে।
শোক আর নেশা জগদ্দলের পাঁজর খুলে পড়েছে একে একে। বিমলের চৈতন্যও থেকে থেকে কোন অন্তহীন নৈঃশব্দের আবর্তে যেন পার্ক নিয়ে নেমে যাচ্ছে অতলে। তারপরই লঘুভার হয়ে ভেসে উঠেছে ওপরে। এরই মাঝে শুনতে পাচ্ছে বিমল, ঠং ঠং, ঠকাং ঠকাং, ছিন্নভিন্ন ও মৃত জগদ্দলের জন্য কারা যেন
কবর খুঁড়ছে ঠং ঠং ঠকাং ঠকাং, যেন অনেক কোদাল আর অনেক শাবলের শব্দ।
(২)***সুন্দরম্---
সমস্যাটা হলো সুকুমারের বিয়ে। কি এমন সমস্যা। শুধু একটি মনোমত পাত্রী ঠিক করে শুভলগ্নে শাস্ত্রীয় মতে উদ্বাহ কার্য সমাধা করে দেওয়া; মানুষের একটা জৈব সংস্কারকে সংসারে পত্তন করে দেওয়া। এই তো! কিন্তু বাধা আছে—সুকুমারের ব্রহ্মচর্য। বার বছর বয়স থেকে নিরামিষ
ফোঁটা তিলক ধরেছে সে। আজও পায়ে সেধে তাকে মুসুরির ডাল খাওয়ান যায় না। সাহিত্য কাব্য তার কাছে অস্পৃশ্য। পাঠ্যপুস্তক ছাড়া জীবনে সে পড়েছে ক'খানি যোগ্যশাস্ত্রের দীপিকা। বাগানের নির্জন পুকুরঘাটে গভীর রাতে একাধ প্রাণায়ামে কতবার শিউরে উঠেছে তার সুষুম্না। প্রতি কুম্ভকে রেচকে সুকুমার অনুভব করেছে এক অদ্ভুত আত্মিক শক্তির তড়িৎস্পর্শ, শ্বাসে প্রশ্বাসে রক্তে ও স্নায়ুতে।
সুকুমার চোখ বুজলেই দেখতে পায় তার অন্তরের নিভৃত কন্দরে সমাসীন এক বিরাগী পুরুষ। অবিষ্ট অবস্থায় কানে আসে, কে যেন বলছে—মুক্তি দে, মুক্তি দে। জপ ছেড়ে চোখ মেলে তাকালেই দেখতে পায়, কার এক গৈরিক উত্তরীয় ক্ষণিকের দেখা দিয়ে মিলিয়ে গেল বাতাসে।
সুকুমার বন্ধুদের অনেকবার জানিয়েছে—বাস্, এই এগজামিনটা পর্যন্ত, তার পর আর নয়। হিমালয়ের ডাক এসে গেছে আমার।
সুকুমারের বাবা কৈলাসডাক্তার বলতেন প্রোটিনের অভাব। পেটে দুটো ভালো জিনিস পড়ুক, গায়ে মাংস লাগুক, এসব ব্যামো দু'দিনেই কেটে যাবে। কত পাকামি দেখলাম। কিন্তু মা, পিসিমা, ছোটবোন রাণু আর ঝি, তাদের মন প্রবোধ মানে না।
সকলে মিলে চেপে ধরলো কৈলাসডাক্তারকে—যত শীগগির পার পাত্রী ঠিক করে ফেল আর দেরী নয়! ঝিয়ের কোঁদল তো লেগেই আছে–ছি ছি সংসার থেকেও ছেলের বনবাস।
ছোটজাতের ছোটঘরেও কেউ এমন কসাইপনা করে না বাপু। সমস্যা সমাধানের ব্যবস্থা হলো। কৈলাসবাবু পাত্রী দেখবেন। ভগ্নীপতি কানাইবাবু সুকুমারের মতিগতির চার্জ নিলেন। যেমন করে পারেন কানাইবাবু সুকুমারকে সংসারমুখো করবেন।
পাশের খবর বেরিয়েছে। কানাইবাবু সুকুমারকে দিয়ে জোর করে দরখাস্ত সই করালেন! নাও, সই কর। মুন্সেফী চাকরি নয়। সংসারে থেকেও সাধন হয়। ঐ যাকে বলে, পাকাল মাছের মত থাকবে। জনকরাজা যেমন ছিলেন।
বাড়ির বিষণ্ণ আবহাওয়া ক্রমে উৎফুল্ল হয়ে আসছে। কৈলাসবাবু পাত্রী দেখে এসেছেন। এখন সমস্যা সুকুমারকে কোন মতে পাত্রী দেখাতে নিয়ে যাওয়া। কানাইবাবু সকলকে আশ্বস্ত করলেন—কিন্তু ভাববার নেই; সব ঠিক হো যায়েগা। সংসারের ওপর সুকুমারের এই নির্লেপ, এখনও কেটে যায়নি ঠিকই। তবু
একটু চাঞ্চল্য, আচারে আচরণে রক্তমাংসের মানুষের মেজাজ এক-আধটুকু দেখা
দিয়েছে যেন।
তবু একবার পাড়ার ঘরে কানাইবাবুর সঙ্গে সুকুমারের একটা বচসা শোনা গেল। বাড়ির সবারই বুক দুরদুর হয়ে উঠলো। ব্যাপার কি?
কানাইবাবুর কথার ফাঁদে পড়ে সুকুমারকে উপন্যাস পড়তে হয়েছে, জীবনে এই প্রথম। নাভিমূলে চন্দনের প্রলেপ দিয়ে, অগুরু পুড়িয়ে ঘরের বাতাস পবিত্র করে নিয়ে অতি সাবধানে পড়তে হয়েছে। বলবান ইন্দ্রিয়গ্রাম, কি হয় বলা তোযায় না।
কিন্তু উপন্যাস না নরক। যতসব নীচ রিপুসেবার বর্ণনা। সমস্ত রাত ঘুম হয়নি, এখনও গা ঘিন ঘিন করছে। সুকুমার বলে—আপনাকে এবার ওয়ার্নিং দিয়ে ছেড়ে দিলাম কানাইবাবু।
মানে অপমানে সম্পূর্ণ উদাসীন কানাইবাবু বললেন—আজ সন্ধ্যেয় সিনেমা
দেখাতে নিয়ে যাব তোমায়। যেতেই হবে ভাই, তোমার আজ্ঞাচক্রের দিব্যি। তা
ছাড়া ভাল ছবি, ধ্রুবের তপস্যা। মনটাও তোমার একটু পবিত্র হবে। কানাইবাবুর এক্সপেরিমেন্ট বোধহয় সার্থক হয়ে উঠলো। ক'দিন পরেই দেখা গেল, সুকুমার কাব্য পড়ছে, কোন্ এক আখড়ায় গিয়ে মাথুর শুনে এসেছে, ঘন
ঘন সিনেমায় যাচ্ছে। এদিকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট পত্রও চলে এসেছে। কিন্তু অনাসক্তির ঘোর সম্পূর্ণ কাটেনি। আজকাল সুকুমারের অতীন্দ্রিয় আবেগ হয়। জ্যোৎস্না রাতে বাগানে একা বসে বসে নেবুফুলের সুগন্ধে মনটা অকারণে উড়ে চলে যায়—ধূলিধূসর সংসারের বন্ধন ছেড়ে যেন আকাশের নীলিমার সাঁতার দিয়ে বেড়ায়! একটা বিষণ্ণ সুখকর বেদনা। কিসের অভাব! কাকে যেন চাই! কে সেই না-পাওয়া? দীর্ঘশ্বাস চাপতে গিয়ে লজ্জা পায় সুকুমার। রাত করে সিনেমা দেখে বাড়ি ফিরবার পথে কানাইবাবু সুকুমারকে জিজ্ঞেস
করলেন—নাচটা কেমন লাগলো? সুকুমার সহসা উত্তর দিল না। একটু চুপ করে বললো—কানাইবাবু?
-কি?
—মানুষের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই।
—নিশ্চয়। কালই চল বারাসাত। যাদব ঘোষের মেয়ে বনলতা। তোমার মেজদি যেতে লিখেছে। আর বাবা তো আগেই দেখে এসেছেন। উকীলের মুহুরী যাদব ঘোষ। বংশ ভাল আর মেয়ে বনলতা দেখতে ভালই।
যাদব ঘোষ অল্প পণে সৎপাত্র খুঁজছেন। মেজদি একটি বছর পনের বয়সের মেয়েকে হাত ধরে সামনে টেনে নিয়ে এলেন। —ভাল করে দেখে নে সুকু, মনে যেন শেষে কোন খুঁতখুঁত না থাকে।
যাত্রাদলের রাজকুমারীর মত মেয়েটাকে যতদূর সম্ভব জবরজং করে সাজানো। হয়েছে। বিরাট একটা ঝকমকে বেনারশী শাড়ি আর পুরু সাটিনের জ্যাকেট। পাড়ার মেয়েদের কাছ থেকে ধার করা চুড়ি রুলি বালা ও অনন্ত, কনুই পর্যন্ত বোঝাই করা দুটি হাত। ঘামে চুপসে গেছে কপালের টিপ, পাউডারের মোটা খড়ির স্রোত গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে গলার ওপর। মেয়েটি দম বন্ধ করে, চোখের দৃষ্টি হারিয়ে যেন যজ্ঞের পশুর মত এসে দাঁড়ালো।
বনলতার শক্ত খোঁপাটা চট করে খুলে, চুলের গোছা দু'হাত মেজদি বললেন-দেখে নে সুকু। গাঁয়ের মেয়ে হলে হবে কি? তেলচিটে ঘাড় নয়, যা তোমাদের কত কলেজের মেয়ের দেখেছি। রামোঃ।
তুলে ধরে
মেজদি যেন ফিজিয়লজি পড়াচ্ছেন। বনলতার থুতনিটা ধরে এদিক ওদিক ঘুরিয়ে দেখালেন। চোখ মেলে তাকাতে বললেন— ট্যারা কানা নয়। পায়চারি করালেন—খোঁড়া নয়। সুকুমারের মুখের সামনে বনলতার হাতটা টেনে নিয়ে আঙুলগুলি ঘেঁটে ঘেঁটে দেখালেন—দেখছিস তো, নিন্দে করার জো নেই।
দেখার পালা শেষ হলো। বাড়ি ফিরে কানাইবাবু জিজ্ঞাসা করলেন কি যোগীবর, পছন্দ তো? সুকুমার চুপ করে বসে রইল। মুখের চেহারা প্রসন্ন নয়। কানাইবাবু বুঝলেন, এক্ষেত্রে মৌনং অসম্মতি লক্ষণ!
—সিনেমায় বনানী দেবীর নাচ দেখে দেখে পাকিয়েছ ভায়া, এ সব মেয়ে কি
পছন্দ হয়!—কানাইবাবু মনের বিরক্তি মনে চেপে রাখলেন।
পিসিমা বললেন ছেলের আপত্তি তো হবেই। হা-ঘরের মেয়ে এনে হবে
কি? মুহুর-টুহুরীর সঙ্গে কুটুম্বিতা চলবে না। সুন্দরী মেয়ে চাই। এইটেই বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে এখন। কৈলাসডাক্তার পাত্রী দেখেছেন আর বিপদের কথা এই যে, তাঁর চোখে অসুন্দর তো কেউ নয়। তাই কৈলাসডাক্তার কাউকে সুন্দরী বলে সার্টিফিকেট দিলেই চলবে না। এ বিষয়ে তাঁর রুচি সম্বন্ধে সকলের যথেষ্ট সংশয় আছে। প্রথম ছেলে, জীবনসঙ্গিনী নিয়ে ঘর করতে হবে যাকে, সম্বন্ধে মতটা গ্রাহ্য। তারপর আর সকলের।
কৈলাসবাবু নিজে কুরূপ। কুৎসা করা যাদের আনন্দ তারা আড়ালে বলে ‘কালো জিত’ ডাক্তার। ভদ্রলোকের জিভটাও নাকি কালো। যৌবনে এ গল্পনা কৈলাসডাক্তারকে মর্মপীড়া দিয়েছে অনেক। আজ প্রৌঢ়ত্বের শেষ ধাপে এসে সেই পীড়িত মর্মের কোন অভিমান আর নেই।
বাংলোর বারান্দায় সোফায় বসে নির্দিষ্ট মনে কৈলাসডাক্তার এই কথাই ভাবছিলেন। এই রূপতত্ত্ব তাঁর কাছে দুর্বোধ্য। আজ পঁচিশ বছর ধরে যে ঝানু সার্জন ময়নাঘরে মানুষের বুক চিরে দেখে এসেছে, তাকে আর বোঝাতে হবে না, কাকে সোনার দেহ বলে। মানুষের অন্তরঙ্গ রূপ-এর পরিচয় কৈলাসডাক্তারের মত আর কে জানে। কিন্তু তাঁর এই ভিন-জগতের সুন্দরম, তাকে কদর দেবার মত দ্বিতীয় মানুষ কৈ? দুঃখ এইটুকু।
হঠাৎ শেকল বাঁধা হাউন্ডটার বিকট চিৎকার আর লাফঝাপ। ফটক ঠেলে হুড়মুড় করে ঢুকলো মানুষের ব্যঙ্গমূর্তি কয়েকটি প্রাণী। যদু ডোম আর নিতাই সহিস দৌড়ে এল লাঠি নিয়ে
যদু ও নিতাইয়ের গলাধাক্কা গ্রাহ্য না করে ফটকের ওপর জুত করে বসলো একটা ভিখারী পরিবার। নোংরা চটের পোঁটলা, ছেঁড়া, মাদুর, উনুন, হাঁড়ি, ক্যানেস্তারা, পিঁপড়ে ও মাছি নিয়ে একটা কদর্য জগতের অংশ। সোরগোল শুনে সবাই বেরিয়ে এল।
কৈলাসবাবু বললেন—কে রে এলো যদু? চাইছে কি? —এ ব্যাটার নাম হাবু বোষ্টম, তাঁতীদের ছেলে। কুন্ঠ হয়ে ভিক্ষে ধরেছে।
কুণ্ঠী হাবু তার পরিবাঁধা হাত দুটো তুলে বললো—কৃপা করো বাবা! —এই বুড়ীটা কে?
—এ মাগীর নাম হামিদা। জাতে পশ্চিমা, বেদিয়া, বসন্তে কানা হবার পর দলছাড়া হয়েছে। এ এখন হাবুরই বৌ। হামিদা কোলের ভেতর থেকে জড়ানো ক'মাসের একটা ছেলেকে দু'হাতে
তুলে ধরে নকল কান্নায় কঁকিয়ে কঁকিয়ে বললো— বাচ্চাকা জান হুজুর! এক পিয়ালী দুধ হুজুর! এক মুঠটি দানা হুজুর! —আর এই ধিক্কি ছুঁড়িটা কে? পিসিমা প্রশ্ন করলেন।
—ওর নাম তুলসী । হাবু আর হামিদার মেয়ে।
-আপন মেয়ে?
—হ্যাঁ পিসিমা। যদু উত্তর দিল।
তুলসী একটা কলাই-করা থালা হাতে করে বসে আছে। পরিধানে খাটো একটা নোংরা পর্দার কাপড়, বুকের ওপর থেকে গেরো দিয়ে ঝোলানো। আভরণের মধ্যে একটা কৌড়ির তাবিজ।
দেখবার মত চেহারা এই তুলসীর! বছর চৌদ্দ তবু সর্বাঙ্গে একটা রূঢ় পরিপুষ্ট। ডাকিনীর টেরাকোটা মূর্তির মত কালি-মাড়া শরীর। মোটা থ্যাবড়া নাক। মাথার বেঢপ খুলিটা যেন একটা চোট লেগে টেরে-বেঁকে গেছে। বড় বড় দাঁত, যেন একটা জন্তুর হিংসে ফুটে রয়েছে। মুখের সমস্ত পেশী ভেঙেচুরে গেছে, ছন্নছাড়া বিক্ষোভে। এ মুখের দিকে তাকিয়ে দাতাকর্ণও দান ভুলে যাবে, গা শিরশির করবে। কিন্তু যদু বললো তুলসীর ভিক্ষের রোজগারই নাকি এদের পেটভাতের একমাত্র নির্ভর।
হাবু ঠিক ভিক্ষে করতে আসেনি। মিউনিপিপ্যালিটি এদের বস্তি ভেঙে দিয়েছে। নতুন আফিমের গুদাম হবে সেখানে। শহরের এলাকায় এদের থাকবার আর হুকুম নেই।
হাবু কান্নাকাটি করলো—একটা সার্টিফিকেট দিন বাবা। মুচিপাড়ার ভাগাড়ের পেছনে থাকবো। দীননাথের দিব্যি, হাটবাজারে ঘেঁষবো না কখনো। তুলসীই
ভিক্ষে খাটবে, ওর তো আর রোগবালাই নেই। পিসিমা বললেন—যেতে বল, যেতে বল। গা ঘিন ঘিন করে। কিছু দিয়ে বিদেয় করে দে রাণু।
রাণু বললো আমার ছেঁড়া ফ্লানেলের ব্লাউজটা দিয়ে দিই। এই শীতে তবু ছেলেটা বাঁচবে।
হ্যা গিয়ে দে। থাকে তো একটা ছেঁড়া শাড়িও দিয়ে দে। বয়স হয়েছে মেয়েটার, লজ্জা রাখতে হবে তো।
বৈশাসডাক্তার বললেন- আচ্ছা যা তোরা। সার্টিফিকেট দেব, কিন্তু খবরদার হাটবাজারে আসিস না। হাবু তার সংসারপত্র নিয়ে আশীর্বাদ করে চলে গেলে তুলসীর কথাটাই
আলোচনার হলো আর একবার। কৈলাসবাবু
তুলসীকে। ওরও বিয়ে হয়ে যাবে, জানো?
হেসে বললেন দেখলে তো সুন্দরী
ঝি উত্তর দিল- বিয়ে হবে না কেন? সবই হবে। তবে সেটা আর বিয়ে নয়। কৈলাসবাবু একটি পাত্রী দেখে এসেছেন। নন্দ দত্তের বোন দেবপ্রিয়া। মেয়েটি ভালই, তবে সুকুমার একবার দেখে আসুক।
দেখানো হল দেবপ্রিয়াকে। মেদের প্রাচুর্যে বয়স ঠিক ঠাহর হয় না। চওড়া কপাল, ছোট চিবুক, গোল গোল চোখ। গায়ের রঙ মেটে, কিন্তু সুমসৃণ। ভারি ভুরু দু'টাতে যেন তিব্বতী উপত্যকার ধূর্ত একটু ছায়া, প্রচ্ছন্ন এক মঙ্গোলিনীকে ইসারায় ধরিয়ে দিচ্ছে। ঠোঁটে হাসি লেগেই আছে। সে বোধহয় জানে, তার এই
অপ্রাকৃত পৃথুলতা লোক হাসাবার মতই। দেবপ্রিয়ার গলা মিষ্টি গান গায় ভাল। সুকুমার হাঁ না কিছুই বলে না। বলা তার স্বভাব নয়। বোঝা গেল, এ মেয়ে তার পছন্দ নয়। পিসিমা বললেন—হবেই না তো পছন্দ। শুধু গলা দিয়েই তো আর সংসার
করা যায় না। তা ছাড়া নন্দরা বংশেও খাটো। কৈলাসডাক্তার দুশ্চিন্তায় পড়লেন। সমস্যা ক্রমেই ঘোরালো হচ্ছে। এ মোটেই সহ ব্যাপার নয়। নানা নতুন উপসর্গ দেখা দিচ্ছে একে একে। শুধু সুন্দরী হলেই চলবে না। বংশ, বিত্ত, শিক্ষা ও রুচি দেখতে হবে।
মাঝে মাঝে পুরুত ভট্টাচায্যি আরও খানিকটা ইন্ধন জুগিয়ে গেছেন। সমস্যাটা ক্রমেই তেতে উঠেছে। ভট্টাচায্যি বাড়ির সকলকে বুঝিয়ে গেছেন— নিতান্ত আধ্যাত্মিক এই বিয়ে জিনিসটা। কুলনারীর গুণ-লক্ষণ মিলিয়ে পাত্রী নির্বাচন করতে হবে। গৃহিণী সচিব সখি প্রিয়শিষ্যা, সব যাচাই করে দেখতে হবে। সারাজীবনের ধর্মসাধনার অংশভাগিনী, এ ঠাট্টার ব্যাপার নয়। ধরে বেঁধে একটা নিয়ে এলেই চলবে না। ওসব যাবনিক অনাচার চলবে না।
হ্যাঁ, তবে সুন্দরী হওয়া চাই-ই। কারণ সৌন্দর্য একটা দেবসুলভ গুণ। এবার যতদূর সম্ভব সাবধানে, খুব ভেবেচিন্তে কৈলাসডাক্তার এক পাত্রী দেখে
এলেন। অনাদি সরকারের মেয়ে অনুপমা সুশিক্ষিতা ও সুন্দরী। অনুপমার বয়স একটু বেশি। রোগা বা অতিতন্বী দুই-ই বলা যায়। মুখশ্রী আছে কি না—আছে তা বিতর্কের বিষয়। তবে চালচলনে সুরুচির আবেদন আছে নিশ্চয়। রূপে যেটুকু ঘাটতি তা পুষিয়ে গেছে সুশিক্ষার হ্রাদিনী গুণে।প্রতিবাদ করলো রাণু। -না, ম্যাচ হবে না। যা ঝিরকুট চেহারা মেয়ের!
ঋষি বালকের মত কাঁচা মন সুকুমারের হাঁ-না বলা তার ধাতে সম্ভব নয়। কিংবা অতিরিক্ত লজ্জা, তাও হতে পারে। তবে তার আচরণেই বোঝা গেল, এ বিয়েতে সে রাজী নয়।
পিসিমা বললেন–ভালই হল। জানি তো, কী কিপটে এই অনাদি চাষা। বিনাখরচে কাজ সারতে চায়। পাত্র যেন পথে গড়াচ্ছে। দৈবজ্ঞী মশায় এসে পিসিমাকে স্মরণ করিয়ে দিলেন পাত্রীর রাশি আর গণ
খুব ভাল করে মিলিয়ে দেখবেন পিসিমা। ওসব কোন তুচ্ছ করার জিনিস নয়। —সবই গ্রহের কৃপা। দৈবশ্রী সুকুমারের কোষ্ঠী বিচার করে বাড়ির সকলকে বড় রকম একটা প্রেরণা দিয়ে চলে গেলেন। —যা দেখছি তা তো বড়ই ভাল মনে হচ্ছে। পাডাকীরিটি, আর নেই, এবার কেতুর দশা চলেছে। এই বছরের মধ্যে
ইউলাভ। সুন্দরী রামা, রাজপদং, ধনসুখং। আর, আর কত বলবো।
—এই ভুঁড়ি ওখানে কি করছিস? কৈলাসবাবু ধমকে উঠলেন। সুকুমারের পড়ার ঘরের সামনের বারান্দায় ফুলগাছের টবের কাছে বসে আছে তুলসী। হাতে কলাই-করা থালাটা।
যদু কোত্থেকে এসে একসঙ্গে হুমকি দিল। -ওঠ এখান থেকে হারামজাদি! কেমন ঘাপটি মেরে বসে আছে চুরির ফিকিরে। কৈলাসডাক্তার বললেন— যাক, গালমন্দ করিস নে। খিড়কির দোরে গিয়ে
বসতে বল। সামনে কানাইবাবুকে পেয়ে কৈলাসডাক্তার বললেন—কি কানাই? এবার আমাকে বিড়ম্বনা থেকে একটু রেহাই দেবে না কি? সুন্দরী পাত্রী জুটলো
তোমাদের?
—আজ্ঞে না! চেষ্টার তো ত্রুটি করছি না। —–চেষ্টা করেও কিছু হবে না। তোমাদের তো মাথামুণ্ডু কিছু নেই।
–কি রকম?
—কি রকম আবার? চুল কালো হলে সুন্দর আর চামড়া কালো হলে কুৎসিত। এই কথাটা কি মহাব্যোমে লেখা আছে, শাশ্বত কালি দিয়ে? একটু চুপ করে থেকে কৈলাসডাক্তার বললেন—পদ্মপত্র যুগ্মনেত্র পরশয়ে শ্রুতি। ধন্যি বাবা কাশীরাম! একবার ভাব তো কানাই, কোনো ভদ্রলোকের যদি নাক থেকে কান পর্যন্ত ইয়া দুটো চোখ ছড়িয়ে থাকে, কী চীজ হবে সেটা!
কানাইবাবু বললেন—যা বলেছেন। কত যে বাজে সংস্কারের সাত-পাঁচ রয়েছে লোকের। তবে মানুষের রূপের একটা স্ট্যান্ডার্ড অবশ্য আছে।
অ্যানথ্রপলজিস্টরা যেমন বলেন...।
—অ্যানথ্রপলজিস্ট না চামড়াওয়ালা। কৈলাসবাবু চড়া মেজাজে বললেন— আসুক একবার আমার সঙ্গে ময়নাঘরে। দুটো লাশের ছাল ছাড়িয়ে দিচ্ছি। চিনে বলুক দেখি, কে ওদের আলপাইন নেগ্রিটো আর কে প্রোটো-অস্ট্রাল। দেখি ওদের বংশবিদ্যের মুরোদ। মেলা বকো না আমার কাছে। কানাইবাবু সরে পড়ার পথ দেখলেন।
—জান কানাই, আমাকে আড়ালে সবাই কালোজিত বলে ডাকে। বর্বর আর গাছে ফলে? একটা বাজে টাবু ছাড়বার শক্তি নেই, সভ্যতার গর্ব করে। আধুনিক হয়েছে। যত সব ফাজিলের দল।
কৈলাসডাক্তার ক্ষুব্ধ লাল চোখ দুটিকে শান্ত করে চুরুট ধরালেন। সেদিন সন্ধ্যাবেলা সত্যদাসের বাড়িতে ভাল একটি পাত্রী দেখে খুশি মনে কৈলাসডাক্তার ফিরলেন। ফটকে পা দিয়েই দেখলেন, সুকুমার পড়ার ঘরের সামনে বসে যদু আর নিতাই তুলসীর সঙ্গে হাসি-মস্করা করছে।
—এই রাস্কেল সব! কি হচ্ছে ওখানে? তুলসী ওর থালা হাতে নিয়ে আর দৌড় দিয়ে পালিয়ে গেল। যদু নিতাই আমতা আমতা করে কিছু একটা গুছিয়ে বলতে বৃথা চেষ্টা করে চুপ করে রইল। কৈলাসবাবু সুকুমারকে ডেকে বললেন—ঘরের দোর খোলা রাখ কেন? সেই ভিখিরি ছুঁড়িটা কদিন থেকে ঘুরঘুর করছে এদিকে। খুব নজর রাখবে, কখন কি চুরি করে সরে পড়ে, বলা যায় না।
সুকুমার মাকে ডেকে কৈলাসবাবু জানালেন—সত্যদাসের মেয়ে মমতাকে দেখে এলাম। একরকম পাকা কথাই দিয়ে এসেছি। এবার সুকুমার আর তোমরা দেখে এস। আমায় আর নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরিও না।
যথারীতি মমতাকে দেখে আসা হলো। মমতার রূপে অসাধারনত্ব আছে, সন্দেহ নেই। যেন একটি অমাবস্যা কুমারী, ঘুটঘুটে কালো। সমস্ত অবয়বে একটা সুপেশল কাঠিন্য। মণিবন্ধ ও কনুইয়ের মজবুত হাড় আর হাতপায়ের লোমঘন পারুষ্য পুরুষকে লজ্জা দেয়। চওড়া করোটির ওপর অতিকুঞ্চিত স্থূলতন্ত্র চুলের ভার, নীলগিরির চূড়ার ওপর মেঘস্তবকের দৃশ্যটা মনে পড়িয়ে দেয়। মূর্তির শিল্পীরা অবশ্য খুশি হয়ে বললেন, এ যেন এক দৃঢ়া দ্রাবিড়া নায়িকার মূর্তি। মমতার প্রখর দৃষ্টির সামনে সুকুমারই সঙ্কুচিত হল। বরমালা-কাঙাল অবলার দৃষ্টি এ নয়; বরং এক অকুতোলজ্জা স্বয়ংবরার জিজ্ঞাসা যেন জ্বলজ্বল করছে মমতার
দুই চোখে। সত্যবাবু গুণপনার পরিচয় দিলেন—পরিশ্রমী মেয়ে, কারণ স্বাস্থ্য খুব ভাল। ছাত্রীজীবনে প্রতিবছর স্পোর্টে প্রাইজ পেয়ে এসেছে। মেয়ে দেখে এসে সুকুমার মুখভার করে শুয়ে রইল। রাণু বললো—এ নিশ্চয়
রাক্ষসগণ। পিসিমাও একটু বিমর্ষ হয়ে বললেন—হ্যাঁ, সেই তো কথা। বড় হট্টাকট্টা চেহারা। নইলে ভাল বরপণ দিচ্ছিল, দানসামগ্রীও।
তবু কৈলাসডাক্তার তোড়জোড় করছেন। মমতারই সঙ্গে বিয়ে একরকম
ঠিক। এবার একটু শক্ত হয়েছেন তিনি। দশজনের দশ কথার চক্রে আর ভূত
সাজতে পারবেন না।
কিন্তু যা কখনো হয়নি, তাই হল। সুকুমারের প্রকাশ্য বিদ্রোহ। সুকুমার এবার মুখ খুলেছে। রাণুকে ডেকে নিয়ে জানিয়ে দিয়েছে—সত্যদাসের সঙ্গে বড় গলাগলি দেখছি বাবার! ওখানে যদি বিয়ে ঠিক হয়, তবে একটু আগেভাগে জানাবি। আমি যুদ্ধে সার্ভিস নিচ্ছি।
কথাটা শুনে পিসিমার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো সুকুমারের মা রান্না ে
বৈঠকখানায় গিয়ে কৈলাসবাবুর সঙ্গে একগ্রস্থ সেরে এলেন। কিন্তু ফল হল না কিছুই। কৈলাসবাবু এবার অটল। সুকুমারের মা কেঁদে ফেললেন—ঐ হদকুচ্ছিত মেয়ের সঙ্গে বিয়ে তোমার ছেলে ঐ মেয়ের ছায়া মাড়াবে ভেবেছ? এমন বিয়ে না দিয়ে ছেলের হাতে চিমটে
দিয়ে বিদেয় করে দাও না!
কৈলাসবাবুর অটলতার ব্যতিক্রম হল না কিছুই। তিনি শুধু একটা দিন স্থির করার চেষ্টায় রইলেন। সুকুমার মারমূর্তি হয়ে রাণুকে বললো—সেই সৈবজীটা এবার এলে আমায়
খবর দিবি তো!
—কোন দৈবজ্ঞী?
—ঐ যে বেটা সুন্দরী রামাটানা বলে গিয়েছিল। জিভ উপড়ে ফেলবো ওর। আড়ালে দাঁড়িষে কৈলাসডাক্তার শুনলেন। ও বার্তালাপ। রাগে ব্রহ্মতালু জ্বলে উঠলো তাঁর! সুকুমারের মাকে ডেকে প্রশ্ন করলেন—কি পেয়েছ?
শঙ্কিত চোখে কৈলাসবাবুর দিকে তাকিয়ে সুকুমারের মা বললেন—কি হয়েছে?
-ছেলের বিয়ে দিতে চাও? —কেন দেব না?
—সৎপাত্রী চাও, না সুন্দরী পাত্রী চাও?
সুকুমারের মা ভেবে নিয়ে ভয়ে ভয়ে বললেন—সুন্দরী পাত্রী।
-বেশ তবে লিখে দাও আমাকে, সুন্দরী কাকে বলে। তন্বী শ্যামা পক্কবিম্বাদর, আরও যা আছে সব লিখে দাও। আমি ফর্দ মিলিয়ে পাত্রী দেখবো। এই বিদঘুটে প্রস্তাবে সুকুমারের মা'র মেজাজও ধৈর্য হারাবার উপক্রম করলো। তবু মনের ঝাঁজ চেপে নিয়ে বললেন তার চেয়ে ভাল, তোমায় পাত্রী দেখতে হবে না, আমরা দেখছি।
—ধন্যবাদ। খুব ভাল কথা। এবার তা হলে আমি দায়মুক্ত। —হ্যাঁ।
কৈলাসডাক্তার এখন অনেকটা সুস্থির হয়েছেন। হাসপাতালে যান আসেন। রুগী নিয়ে, ময়নাঘরের লাশ নিয়ে দিন কেটে যায়। যেমন আগে কাটতো।
বাগানের দিকে একটা হট্টগোল। কৈলাসডাক্তার এগিয়ে দেখেন, যদুডোম আর নিতাই তুলসীকে ঘাড় ধরে হিড়হিড় করে টেনে বাগানের ফটক দিয়ে বার করে দিচ্ছে। -কি ব্যাপার নিতাই?
–বড় পাজি এ চুড়িটা, হুজুর। পয়সা দেয়নি বলে দাদাবাবুর ঘরে ঢিল ছুঁড়েছিল। আর, এই দেখুন আমার হাত কামড়ে দিয়েছে।
কৈলাসডাক্তার বললেন—বড় বাড় বেড়েছে ছুঁড়ির। ভিখিরীর জাত, দয়া করলেই কুকুরের মত মাথায় চড়ে। কেবলই দেখছি মাস তিন চার থেকে শুধু এদিকেই নজর। এবার এলে পুলিশে ধরিয়ে দিবি।
তুলসী ফটকের বাইরে গিয়েও মত্তা বাতুলীর মত আরও কয়েকটা ইটপাটকেল ছুঁড়ে চলে গেল। কৈলাসডাক্তার বললেন সব সময় ফটকে তালা বন্ধ রাখবে। সেদিনই সন্ধেবেলা। অনেক রাতে রুগী দেখে বাড়ি ফিরতেই কৈলাসডাক্তার দেখলেন, ফটক খুলে অন্ধকারে চোরের মত পা টিপে টিপে সরে পড়ছে তুলসী।
কৈলাসবাবুকে দেখে আরও জোরে দৌড়ে পালিয়ে গেল! কৈলাসডাক্তার হাঁক
দিতেই যদু ও নিতাই হাজির হল লাঠি হাতে।
অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে কৈলাসডাক্তার বললেন—এ কি? ফটক খোলা, বারান্দায় আলো জ্বলছে, সুকুমারের ঘরে আলো, আমার বৈঠকখানা খোলা তোমরা সব জেগেও রয়েছ, অথচ ছুঁড়িটা বেমালুম চুরি করে সরে পড়লো।
কৈলাসডাক্তার সমস্ত ঘর তন্নতন্ন করে দেখলেন—আমার ঘরটা সব তছনছ করেছে কে? টেবিল থেকে নতুন বেলেডোনার শিশিটাই বা গেল কোথায়? অনেকক্ষণ বকাবকি করে শাস্ত হলেন কৈলাসডাক্তার। কিন্তু চুরি হয়নি বলেই মনে হল।
পরের দিন। দিনটা আজ ভাল নয়। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত আকাশে দুর্যোগ ঘনিয়ে আছে। কানাইবাবু এসে কৈলাসডাক্তারকে জানালেন—সুন্দরী পাত্রী পাওয়া গেছে। জগৎ ঘোষের মেয়ে। সুকুমারের এবং আর সবারও পছন্দ হয়েছে। বংশে শিক্ষায় ও গুণে কোন ত্রুটি নেই।
কৈলাসডাক্তার বললেন বুঝলাম তোমরা কল্পতরুর সন্ধান পেয়েছ, সুখবর। —আপনাকে আজ রাত্রে আশীর্বাদ করতে যেতে হবে।
—তা যাব।
যদুডোম এসে তখুনি খবর দিলে, তিনটে লাশ এসেছে ময়না তদন্তের জন্য। কৈলাসডাক্তার বললেন—চল রে যদু। এখনি সেরে রাখি। রাত্রে আমার নানা কাজ রয়েছে।
ময়নাঘরে এসে কৈলাসডাক্তার বললেন—বড় মেঘলা করেছে রে। পেট্রোমান্স বাতি দুটো জ্বেলে দে যন্ত্রপাতিগুলো গামলায় সাজিয়ে আস্তিন গুটিয়ে নিয়ে কৈলাসডাক্তার
বললেন—রাত হবে নাকি রে যদু? -আজ্ঞে না। দুটো আগুনে পোড়া লাশ, পচে পাঁক হয়ে গেছে। ও তো জানা
কেস, আমি চিরে ফেড়ে দেব। বাকি একটা শুধু... – নে কোন্টা দিবি, দে! কৈলাসডাক্তার করাত হাতে টেবিলের পাশে
দাঁড়ালেন। লাশের ঢাকাটা খুলে ফেলতেই কৈলাসডাক্তার চমকে উঠলেন—অ্যা, এ কে
রে যদু?
যদু ততক্ষণে আলগোছে সরে পড়ে ঘরের বাইরে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল। কৈলাসডাক্তারের প্রশ্নে ফিরে এসে বললো—হ্যাঁ হুজুর, তুলসীই, সেই ভিখিরী মেয়েটা।
কৈলাসডাক্তার বোকার মত যদুর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। যদু চটপট হাত চালিয়ে তুলসীর নোংরা শাড়ীটা আর গায়ের ছেঁড়া কোটটা খুলে মেঝের ওপর ছুঁড়ে ফেলে দিল। আবার বাইরে যাবার চেষ্টা করতেই কৈলাসডাক্তার বললেন—যাচ্ছিস কোথায়? স্পিরিট দিয়ে লাশট মোেছ ভাল করে। ইউক্যালিপটাসের তেলের বোতলটা দে। কিছু কর্পূর পুড়তে দে, আরও একটা
বাতি জ্বাল। —ওয়ান মোর আনফচুনেট।
কথাটার মধ্যে যেন একটু বেদনার আভাস ছিল। তুলসীর লাশে হাত দিলেন কৈলাসডাক্তার।
করাতের দু'পৌচে খুলিটা দুভাগ করা হল। কৈলাসডাক্তারের হাতের চুরি ফোঁস ফোঁস করে সনিশ্বাসে নেচে কেটে চললো লাশের উপর। গলাটা চিরে দেওয়া হল। সাঁড়াশি দিয়ে পটপট করে পাঁজরাগুলো উল্টে দিলেন কৈলাসডাক্তার।
যেন ঘুমে ঢলে রয়েছে তুলসীর চোখের পাতা। চিমটে ফাঁক করে কৈলাসডাক্তার দেখলেন, নিশ্চল দুটি কণীনিকা যেন নিদারুণ কোন অভিমানে নিষ্প্রভ হয়ে আছে। শুকিয়ে কুঁচিয়ে গেছে চোখের শ্বেতপটল। সুজলা অশ্ৰুশীলা নাড়ীগুলো অতিস্রাবে বিষণ্ন।
—ইস, মরার সময় মেয়েটা কেঁদেছে খুব। কৈলাসডাক্তার বললেন। যদু বললো—–হ্যাঁ হুজুর, কাঁদবেই তো। সুইসাইড কিনা! করে ফেলে তো ঝোঁকের মাথায়। তারপর খাবি খায়, কাঁদে আর মরে।
—গলা টিপে মারেনি তো কেউ? কৈলাসডাক্তার খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করলেন। কৈ কোন আঘাতের চিহ্ন নেই! গুচ্ছ গুচ্ছ অম্লান স্বররুজ্জু, শ্বাসবহা নালিটাও তেমনি প্রফুল্ল। অজস্র লালায় পিচ্ছিল সুপুষ্ট এসনিকা।
—এত লালা! মরবার আগে মেয়েটা খেয়েছে খুব পেট ভরে। –হ্যা হুজুর, ভিখিরি তো খেয়েই মরে।
দেহতত্ত্বের পাকা জহুরী কৈলাসডাক্তার। তাঁকে অবাক করেছে, আজ কুৎসিতা এই তুলসী। কত রূপসী কুলবধূর, কত রূপাজীবা নটীর লাশ পার হয়েছে তাঁর হাত দিয়ে। তিনি দেখেছেন তাদের অন্তরঙ্গ রূপ, ফিকে ফ্যাকাশে ঘেয়ো তুলসী হার মানিয়েছে সকলকে। অদ্ভুত!
বাতিটা কাছে এগিয়ে নিয়ে কৈলাসডাক্তার তাকিয়ে রইলেন প্রবাল পুষ্পের মালঞ্চের মত বরাঙ্গের এই প্রকট রূপ, অছয় মানুষের রূপ। এই নবনীতপিণ্ড মস্তিষ্ক, জোড়া শতদলের মত উৎফুল্ল হৎকোষের অলিন্দ আর নিলয়। রেশমী ঝলরের মত শত শত মোলায়েম ঝিল্লী। আনাচে কানাচে যেন রহস্যে ডুব দিয়ে আছে সুসূক্ষ্ম কৈশিক জাল।
কৈলাসডাক্তার তেমনই বিমুগ্ধ হয়ে দেখলেন থরে বিথরে সাজানো সারি
সারি রক্তিম পর্যকা। বরফের কুচির মত অল্প অল্প মেদের ছিটে। মাহি ঘিরে
নেমে গেছে প্রাণদা নীলার প্রবাহিকা।
কৈলাসডাক্তার বাতিটাকে আরও কাছে এগিয়ে নিয়ে আর দুচোখ অপলক করে দেখতে থাকেন-খণ্ডস্ফটিকের মত পীতাভ ছোট বড় কত গ্রন্থির বীথিকা। প্রশান্ত মুকুটধমনী! সন্ধিতে সন্ধিতে সুপ্রচুর লসিকার বুদ্বুদ। গ্রন্থিক্ষীরে নিষিক্ত অতি অভিরাম এই অংগুপেশীর স্তবক আর তরুণাস্থির সজ্জা ঝাঁপিখোলা রত্নমালার মত আলোয় ঝলমল করে উঠলো।
আবিষ্ট হয়ে গেছেন কৈলাসডাক্তার। কুৎসিতা তুলসীর এই রূপের পরিচয় কে রায়ে? তবুও, এ তিমিরদৃষ্টি হয়তো ঘুচে যাবে একদিন। আগামী কালের কোন প্রেমিক বুঝবে এ রূপের মর্যাদা। নতুন অনুরাগের তাজমহল হয়তো গড়ে উঠবে
সেদিন! যাক্ ... । কৈলাসডাক্তার আবার হাতের কাজে মন দিলেন। যদু বললো—এ সবে কোন জথম নেই হুজুর। পেটটা দেখুন।
ছুরির ফলার এক আঘাতে দু’ভাগ করা হল পাকস্থলী। এইবার কৈলাসডাক্তার দেখলেন, কোথায় মৃত্যুর কামড়। ক্লোমরসে মাখা একটা অজীর্ণ পিও—সন্দেশ পাউরুটি আর...আর বেলেডোনা।
—মার্ডার!
হাতের ছুরি খসে পড়লো মেঝের ওপর। সে শব্দে দু'পা পিছিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন কৈলাসডাক্তার।
উত্তেজনায় বুড়ো কৈলাসডাক্তারের ঘাড়ের রগ ফুঠে উঠলো দপ দপ করে। পোখরাজের দানার মত বড় বড় ফোঁটা কপাল থেকে ঝরে পড়লো মেঝের ওপর।
হঠাৎ ছটফট করে টেবিলের কাছে আবার এগিয়ে এলেন কৈলাসডাক্তার। ছোঁ মেরে কাঁচিটা তুলে নিয়ে তুলসীর তলপেটের দুটো বন্ধনী ছেদ করলেন। নিকেলের চিমটের সুচিক্কণ বাহুপুটে চেপে নিয়ে, স্নেহাক্ত আগ্রহে ধীরে ধীরে টেনে তুলে ধরলেন, পরিশুল্কে ঢাকা সুডৌল সুকোমল একটি পেটিকা। মাতৃত্বের রসে ঊর্বর, মানব জাতির মাংসল ধরিত্রী। সর্পিল নাড়ীর আলিঙ্গনে ক্লিষ্ট ও কুঞ্চিত, বিষিয়ে নীল হয়ে আছে একটি শিশু আশা।
আবেগে কৈলাসডাক্তারের ঠোঁটটা কাঁপছিল থরথর করে। যদু
ডাকালো—হুজুর। ডেকে সাড়া না পেয়ে বাইরে গিয়ে নিতাই সহিসের পাশে বসলো।
নিতাই জিজ্ঞেস করে—এত দেরী কেন রে যদু? —শালা বুড়ো নাতির মুখ দেখছে।
(৩)**গোত্রান্তর---
মকতপুর। কাঁচা সড়কের ওপর এইতো একটা জরাজীর্ণ বাড়ি। খোলার চালের পুরনো বাঁশের গাঁটি থেকে ঘুনের ধুলো ঝরে পড়ে। তিন বছর পলেস্তারা পড়েনি। ঘরে একপাল মানুষ। কাচ্চা, বাচ্চা, কাঁথা আর লেপ তোষকের জঞ্জাল। এই তো সঞ্জয়ের সুইট হোম।
এক বড়দার গোনাগুনতি মাসোহারার জোর ভাত-কাপড়ের ক্ষুধা আর বাগিয়ে রাখা যায় না। সবদিকে ব্যয়বাহুল্য নির্মমভাবে ছেঁটে ফেলা হয়েছে। এখন কোপ পড়েছে পেটের ওপর। ঘি চিনি চা–সংসারের বুভুক্ষু জিভটার এক একটা অংশ বড়দা প্রতিমাসে ছুরির পৌঁচ দিয়ে কাটছেন। এ ছাড়া উপায় নেই। কে জানতো, সঞ্জয় এত লেখাপড়া শিখেও রোজগারের বেলায় এমন হুঁটো হয়ে বসে থাকবে। এক-আধ দিন নয়, আজ চার বছর ধরে।
বিকেলবেলার হালকা ঝড়ে বাড়ির সমুখে শিরিষ গাছে শুকনো সুঁটিগুলো ঝুম ঝুম করে বাজে, মোটা ঘুঙুরের বোলের মত। এই সময়টা বেশ লাগে। সারাদিনের সঞ্চিত আলস্য অবসাদে মিষ্টি হয়ে ওঠে।
সেদিন বারান্দায় বসে এক গেলাস গুড়ের তৈরি চা নিয়ে সঞ্জয় চুমুকে তার
নিত্যদিনের ভাবনাগুলির আস্বাদ ঝালিয়ে নিচ্ছিল।
যে যার পথ দেখ। বড়দা সময়ে অসময়ে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন। কিন্তু বছর চারেক আগেকার কথা। পরীক্ষার দিন এই বড়দা নিজের হাতে টিফিন কেরিয়ারে খাবার নিয়ে কলেজ হলের গেটে দাঁড়িয়ে থাকতেন। সেও একদিন গেছে। বড়দার মনের সুপ্ত সাধ আকাঙ্ক্ষাগুলি সেদিন ছিল দুঃখ অভাবের কালিতে মাথা বিনম্র কামনার মালার মত। এই অভাবের গ্লানি একদিন ধুয়ে মুছে যাবে। সঞ্জয়ের একটা চাকরি হবে, রূপোর লাঠির স্পর্শে মকতপুরের দত্তবাড়ি স্বাচ্ছন্দ্যে ঝকঝক করে উঠবে। এই ছিল অবধারিত সত্য।
এম-এ ডিগ্রী। সচ্চরিত্রতা স্বাস্থ্য আর খেলাধুলার দশটা সার্টিফিকেট, বিলিতি পত্রিকায় ছাপা তার নিজের লেখা তিনটে অর্থনীতির প্রবন্ধ, গান আর অভিনয়ের মডেল, ভূমিকম্পে সুকঠোর সেবাব্রতের প্রশংসাপত্র – সঞ্জয়ের বহু ও বিচিত্র প্রতিভার পরিচয় একটা মোটা বাঙিল বাঁধা হয়ে বাক্সে পড়ে আছে। চার বছর দরখাস্তবাজি করে একটা চাকরি জোটেনি। বড়দা হতাশ হয়ে পড়েছেন। মায়ের মুখেও গঞ্জনাবাক্য উথলে ওঠে।
অপ্রতিভ হয়ে গেছে সঞ্জয়। কিন্তু এই ধিকৃত চারটি বছরের প্রতি মুহূর্তের ভাবনায় তার অনেক মোহ ভেঙে গিয়েছে। আগে এমনি অবস্থায় পড়লে লোকে
বিবাগী হয়ে যেত। কিন্তু সা অন্য ধাতুতে তৈরি। বিংশ শতাব্দীর বিপ্লবী ধনবিজ্ঞানের সূত্রগুলি তার জানা আছে।
সঞ্জয় বুঝেছে, এখানে প্রত্যেকটি স্নেহ পণ্য মাত্র। প্রত্যেকটি আশীর্বাদ এক একটি পাওনার নোটিশ। চার বছর বয়স, এই ভাই-ঝি পুতুল, মাথা ধরলে চুলে হাত বুলিয়ে দেয় ঠিকই। কিন্তু সঞ্জয় জানে, এক রত্তি মেয়ের এই হৃদ্যতার মধ্যে লুতাতন্তর মত কী সূক্ষ্ম কারবারী বুদ্ধি লুকিয়ে আছে। কাজ শেষ হলেই সোজা দাবী জানাবে—সিল্কের ফিতে চাই আমার।
ওপর থেকে দেখতে কী সুন্দর! মা বাপ ভাই বোন, আপনজন, আত্মীয়তার নীড়। কত গালভরা প্রবচন! একটু আঁচড় দিলেই চামড়া ভেদ করে দেখা দেয় নিলর্জ্জ মহাজনের মাংস! সঞ্জয় এক এক সময় হেসে ফেলে। তবে এ তত্ত্ব নতুন কিছু নয়। ইতিহাসের শিরায় শিরায় মকতপুরের দত্তবাড়ির সংসারকলা। প্রেম প্রণয় আত্মীয়তা—লঙ্কা গুড় আদা মরিচ। যে ক্রেতা সেই আপনজন!
সুমিত্রাও অনেকদিন এদিকে আসে না। প্রেমের হাওয়া হয়তো ঘুরে গেছে। আশ্চর্য কিছু নয়! সুমিত্রার বাবা অভয়বাবুর মতিগতি কিছুদিন থেকেই উল্টো রকমের দেখাচ্ছে। বাড়ি মর্টগেজ দিয়েছেন। সুমিত্রারও কি পাত্র জুটে গেল?
গেল বিজয়া দশমির দিনও সে প্রণাম করতে এসেছিল। চাঁপা রঙের শাড়ীতে অমন কালো মেয়েকেও দেখাচ্ছিল কত সুন্দর?
ধরে,
চন্দনের টিপপরা সুমিত্রার কপালটা অলস হয়ে পড়ে রয়েছে দু'মিনিট সঞ্জয়ের পায়ের ওপর। বয়স্কা কুমারী মেয়েরা যৌবন অভিমানে যেন মাথা খুঁড়ছে। সুমিত্রা ভালবেসে ফেলেছে।
পুরনো দিনের এসব কাহিনী ভাবতে ভালই লাগছিল। কিন্তু বৌদি এসে সামনে দাঁড়ালেন। অভয়বাবুদের খবর শুনেছ ঠাকুরপো?
—না। —সাব রেজিস্টার নবীবনবাবুর সঙ্গে সুমিত্রার...। —বিয়ে, এই তো!
বৌদি; হেসে চলে গেলেন। হাসিটা তিরস্কারের মতই। যাক, সবচেয়ে বড় ভুলটাও ভেঙে গেল। এই একটা লাভ। ঐ চোখের জল, প্রণাম লজ্জানত মুখ— কী ক্ষুরধার পবিত্র কোকেট্রি! সে চিনেও চেনেনি। এটার তারই অপরাধ।
সময় থাকতে সরে পড়া চাই। নইলে নীলামী মহলে তার সব মনুষ্যত্বে অতি সন্তায় বিষিয়ে যাবে। এই ভঞ্চহাস ভদ্র সংসারের ছলনাকে পেছনে রেখে চলে যেতে হবে। বোকার মত নিছক একটা গোত্রমোহের তাড়নায় সমস্ত জীবনের ইষ্ট এখানে সে বাঁধা রাখতে পারবে না। সঞ্জয় বুঝেছে, তার সবচেয়ে বড় প্রয়োজন গোত্রান্তর! এই গৃহকুটের রহস্য সে ধরে ফেলেছে।
সঞ্জয় চলে যাচ্ছে দূরে দেশে। রতনলাল সুগার মিলে ত্রিশ টাকা মাইনের চাকরি। মাইনের কমবেশীর প্রশ্ন কিছু নেই। এই ত্রিশ টাকার চাকরির মধ্যে সে দেখেছে অজস্র মুক্তির প্রসাদ।
চাকরি করছে। ত্রিশ টাকায় আরম্ভ করে এখন ঠেকেছে পনর টাকায়। লোকটার ছায়ার মধ্যে দুর্ভাগ্যের ছোঁয়াচ।
একে কুৎসিত, তার ওপর পুরিসি। সপ্তাহে তিনদিন টেবিলে পাঁজর চেপে অসাড় হয়ে পড়ে থাকে। দেখে মনে হয় লোকটা মেরুদণ্ডহীন, নইলে কেন্নোর মত অমন গুটিয়ে পাকিয়ে পড়ে থাকা যায় না।
তাছাড়া আছে রুক্মিনী, নেমিয়ারের বোন। রতনলাল মিলের প্রবীণ অর্বাচীন সবাই সঞ্জয়কে সাবধান করে দিয়েছে—ঐ ভাইবোনের খপ্পর থেকে সামলে থেকো বাঙালীবাবু।
নেমিয়ার গায়ে পড়ে ঘনিষ্ঠ হবার চেষ্টা করছে। হঠাৎ এসে একদিন বলে গেল, এক নম্বরের কুয়োর জল ছাড়া অন্য জল খেয়ো না বাবুজী। ম্যালেরিয়া হবে।
আর একদিন কয়েক শিশি আইডিন, ক্যাস্টর অয়েল আর কুইনিনের বড়ি দিয়ে গেল। – তোমার জন্য নিয়ে এলাম করমপুর হাসপাতাল থেকে।
সঞ্জয় শুধু অপেক্ষায় আছে, দেখা যাক, এই নিষ্কাম প্রতীতি পরিণাম কোথায়
গিয়ে ঠেকে। ঠিকই তিন সপ্তাহের মধ্যে নেমিয়ারের ছদ্মবেশে ধরা পড়ে গেল। অফিসে খাতা লিখছিল সঞ্জয়। মুখ তুলে তাকাতেই দেখলো নেমিয়ার দাঁড়িয়ে, ছোট ছোট চোখ দুটো মিটিমিটি করে জ্বলছে। নেমিয়ার বললো—এইবার একটা বন্দুকের লাইসেন্স দিয়ে ফেল বাবুজী।
দু'জনের একসঙ্গে শিকার করা যাবে। রোজ খরগোসের রোষ্ট, দোয়াত্তা মহুয়ার
সঙ্গে জমবে ভাল।
সঞ্জয়কে নিরুৎসাহ দেখে একবার কি ভেবে নিয়ে হঠাৎ ব্যস্ত হয়ে বললো—
পাঁচটা টাকা লোন দাও তো বাবুজী। আসছে মাসে তাহলে তুমি পাবে ছ'টাকা
আট আনা।
সঞ্জয় স্পষ্ট বলে দিল, হবে না, মাপ কর!
নেমিয়ার চলে গেল সঞ্জয় হাসলো মনে মনে। মানুষের হৃদয়বৃত্তির চরম পরিচয় সে জেনেছে। অত সহজে ভবী আর ভোলে না। নেমিয়ার কোন ছার!
কিন্তু নেমিয়ারকে চিনতে বোধ হয় এখনো অনেক বাকি ছিল। রাত্রিবেলা জোর বৃষ্টির শব্দের মধ্যে দরকার বাইরের কড়া নাড়ছে সঞ্জয় দরজা খুলতেই ঘরে ঢুকলো রুক্মিনী হাতে খাবারে থালা।
কেউ।
—আজ নেমিয়ারের জন্মদিন। নেমিয়ার বলেছে আপনিই তার একমাত্র বন্ধু। তাই সামান্য কিছু খাবার নিয়ে এলাম আপনার জন্য। কথা শেষ করে রুক্মিনী থালাট নামিয়ে তক্তপোষের এক পাশে বসে পড়ে
হেসে ফেললো।
সঞ্জয় এই প্রথম ভাল করে দেখলো রুক্মিনীকে। মেয়েটা কালো আর রোগা। বেশ বুদ্ধিভরা সেয়ানা দৃষ্টি। চোখের কোল দুটোতে রাত-জাগা ক্লান্তির কালিমা। তবু দেখে বোঝা যায়, শুধু ভাল করে খেতে পেলেই এই চেহাররই কী চমক খুলবে। বেশ দামী একটা শাড়ী পরে এসেছে, বিলিতী সুগন্ধী মাখা। সবচেয়ে সুন্দর ওর দাঁতগুলো। কথা বলার সময় দেখায় দু'পাটি সারি বাঁধা ছোট ছোট
শুক্রমণি গোখরাজের মত। হেসে ফেলে যখন, তখন মুক্তদল কুঁড়ির স্তবকের মত হঠাৎ ফেঁপে ওঠে। সঞ্জয়ের তন্ময়তা দেখে রুক্মিনী অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বললো আপনি খেয়ে
নিন। ততক্ষণ আমি বসছি। খাওয়া শেষ হতেই রুক্মিনী উঠে ত্বরিৎ হস্তে এঁটো বাসনগুলি তুলে নিয়ে দাঁড়ালো—এবার ঢলি বাবুজী, অনেক রাত হয়েছে।
সময় একটু অপ্রস্তুত হয়ে বললো-একা যাবে কী করে? —তা যেতে পারবে। এক বঝলক হাসি হেসে বাইরে পা বাড়াতেই সঞ্জয় এঁটো হাত খপ করে ওর হাত চেপে ধরে। রুক্মিণী বলে— আঃ, বাসনগুলো পড়ে যাবে। আগে নামিয়ে রাখতে দাও।
ক'দিন পরে নেমিয়ার অফিসে টেবিলের সামনে এসে দাঁড়ালো। মেরুদণ্ডহীন প্রাণীর চোখ দুটো আর মিটমিট করে জ্বলছে। গলার স্বর নামিয়ে কথা বললে তুমি রক্মিনীকে ভালবাস? প্রশ্নের আঘাতে চমকে উঠতেই নেমিয়ার বলে—সে তো সুখের কথা। লজ্জা করবার কি আছে? আচ্ছা আমি চলি এবার । দাও।
সঞ্জয়–কি?
—সেই যে পাঁচটা টাকা দেবে বলেছিলে! চমকে ওঠে, টাকা দেয় সঞ্জয়।
—থ্যাঙ্ক ইউ! নোটটা পকেটে গুঁজে নেমিয়ার বলে—যখন যা দরকার হবে আমায় বলো। সত্যিকারের গোত্রান্তর হয়েছে সঞ্জয়ের। পাখি শুধু তার ডাকার আবেগে
যেমন করে সঙ্গিনী লাভ করে, রুক্মিনী তেমনিভাবে এসেছে তার কাছে। তার লাঞ্ছিত পৌরুষকে এই পথের মেয়েটাই সসম্মানে লুফে নিয়েছে। জলো দাম্পত্যের চেয়ে এ ঢের ভাল! তার বিদ্রোহের প্রথম পরিচ্ছেদ পূর্ণ হয়েছে।
বাড়ির চিঠি আসে। খাঁটি বাঙালী ভদ্র বাড়ির চিঠি–কেমন আছ? উন্নতির কতদূর হল? সংসারের বড় টানাটানি। কিছু পাঠাতে পারলে ভাল হয়।
চিঠি আসে কিন্তু উত্তর যায় না। মধ্যে অনেক দূর ব্যবধান বালুচর আর চোরাবালি চিঠিগুলো খবরের কাগজের টুকরোর মত মনে হয়। ও দুঃখ তো এর একা মতপুরের দত্তবাড়ীর নয়। এই নেমিয়ারের বৌ তিনটি ছেলে কোলে করে কুয়োয় ঝাঁপিয়ে আত্মহত্যা করেছে। সেই খবরের কার্টি আছে নেমিয়ারের বুকপকেটে। পৃথিবী দুঃখ মিটলে দত্তবাড়ীর দুঃখ মিটবে।
রাত্রে হাঁড়িয়া খেয়ে একদিন কড়া নেশার মাথায় জ্বালা ধরে। সঞ্জয়ের চোখ দিয়ে জল গড়াতে থাকে। রুক্মিনী অনুনয় করে জিজ্ঞাসা করে—তুমি কাঁদ কেন?
চিঠিগুলি কুচিকুচি করে ছিঁড়ে পুড়িয়ে দেয় সঞ্জয়, ক্ষ্যাপা বামুন যেমন করে
তার পৈতে ভস্ম করে
চুরাশী পরগনা থেকে সহস্র যোজন দূরে, লবণ পারাবারের অপর প্রান্তে ওলন্দাজের দেশে মুদ্রালক্ষ্মী যেন বিধবা হয়েছে। স্বর্ণমান বাতিল হয়ে বাট্টা আর
বিনিময়ের হার পাল্টে গেছে রাতারাতি। গিলভারের দাম এক দফায় নেমে গেছে সভা হয়ে।
সেই ঘৃদ্ধ বাণিজাবায়ু হু-হু করে আকাশে পাড়ি দিয়ে এসে ঠেকেছে কলকাতার বন্দরে। টন-টন জাভা চিনি নামছে অতি মন্দা পরে। ইন্ডিয়ান চেম্বারে বিষাদ। মতিপুর চম্পারণ আর কানপুর স্পেশাল বস্তাবন্দী হয়ে আড়তে আড়তে কাঁদছে।
ওলন্দাজের বাজারের অভিশাপ এসে লাগলো রতনলাল মিলে আর চুরাণী
পরগণার আখের ক্ষেত্রে মিলের ঘরে ঘরে মুনিবর্তী নোটিশ পড়ে গেলেন মাইনে
ও মঞ্জুরী শতকরা চল্লিশ কাট্
কিষাণেরা ফটকে ভীড় করেছে। চোঙ মুখে দিয়ে মুনিবর্জী আগের দর ঘোষণা করে দিলেন এগার পয়সা মণ। যে যে বেচতে রাজী আছ কাল থেকে কমল পৌছাও।
সছো পর্যন্ত মিলের ফটকে কর্মচারী ও কিষাণদের জনতা, নিঝুম হয়ে বসে রইল। রায়বাহাদুরের ছেলে সূর্যবাবু চলে গেলেন করমপুর, ট্রান্স টেলিফোন কলকাতার বাজারের অবস্থা জানতে।
ভীড় সরাতে রায়বাহাদুর স্বয়ং হাতজোর করে এসে দাঁড়ালেন বাবালোগ বৃথা ঝামেলা কেন? এ সব নসীবের মার। ভগবানের কাছে জানাও, যেন সুদিন ফিরে আসে।
কিষাণদের মধ্যে মুনিরাম একটু জবরদস্ত। সাফ জবাব দেবার মত ভিজ
ওরই আছে। মুনিরাম বললো সরকারী রেট তো পৌনে পাঁচআনা বাঁধা আছে
হুজুর।
রায়বাহাদুর স্মিতহাস্যে বললেন—ওসব সুখস্বপ্ন ছাড়ো ভাইয়া, সে রামরাজ
নেই। জাভা মাল এসে ডাকাতি করছে। তামাম আগুন লেগে গেছে! মিল বন্ধ না
করে দিতে হয়!
মুনিরামও ছাড়বার পাত্র নয়—কাল সকালে ঘরের ছেলেমেয়েগুলিকে সব পাঠিয়ে দেব মেহেরবানি করে গুলি চালিয়ে শেষ করে দেবেন। সেই বরং
ভাল। সস্নেহে ভর্ৎসনা করে রায়বাহাদুর বললেন— বেকুব খোড়া কাঁহাকা। যা যা
ঘরে গিয়ে মাথা ঠাণ্ডা কর সব। এ শঙ্কর পালোয়ান, ফটক বন্ধ করো। পরাজিত পল্টনের মত জনতা ফটক থেকে সরে গেল। কর্মচারী ও মজুরেরা যে যার ঘরের পথ ধরলো। শুধু সঞ্জয় চললো অন্যদিকে। সঙ্গে নেমিয়ার মুনিরাম
মুখলাল ছেদি আরও ক'জন কিষাণ। বুড়ো বটের তলায় পুরনো শিবালয়ের
সিঁড়িতে ওরা নিঃশব্দে এসে বসলো।
সঞ্জয় বললো–এর প্রতিশোধ নিতে হবে।
মুনিরামের অন্তরাত্মা যেন এই বরাভয়বাণীর জন্য ওত পেতে বসেছিল। লাফিয়ে উঠে বললো– দোহাই বাঙালীবাবু। একটা উপায় বলে দাও। কয়েকটা গবেটগোছের কিষাণ কি জানি কিসের প্রেরণায় ডাক ছাড়লো হর
হর মহাদেও!
মিয়ার -মুখ খিঁচিয়ে বিত্তি করে ধমক দিল- খবরদার! কোন আওয়াজ নয়। এই অবস্থার কিছুক্ষণ কেটে যাবার পর সময় প্রস্তাব করলো কেউ ফসল
বেচবে না। –তোমরা পর নামিও না। ওরা শেষে কিনতে বাধ্য হবে। নতুন মেশিন এসেছে, কাজ ওদের চালু করতেই হবে।
সবাই বললো–ঠিক কথা।
সুখলাল বললো— যদি না কেনে?
মীমাংসা হয়েই যাচ্ছিল, মুখলালের প্রশ্নে আবার বিতন্ডা শুরু হল। সঞ্জয় উঠে দাঁড়িয়ে বললো কিনতে বাধ্য হবে। লড়াই শুরু করে দাও। বট পাতা ছুঁড়ে সকলে কসম খাও।
সঞ্জয়ের কথার মধ্যে অদ্ভুত এক আশ্বাসের উদ্দীপনা ছিল। যেটুকু সংশয়ের মেঘ ছিল, সকলের প্রতিজ্ঞা আর উৎসাহের ঝড়ে তাও কেটে গেল। পুণ্য বাতাসে শিবালয়ের ঐ নিরেট বধির বিগ্রহটা সত্যিই যেন জেগে শেষ হল। এত দিনে। বৈঠক
রুক্মিণীর ঘরে কাছকাছি এসে সঞ্জয় বললো—নেমিয়ার, তুমি এবার যাও। আজ থেকেই কাজে লেগে যাও। খুব ভাল করে অর্গানাইজ কর। —বহুৎ আচ্ছা বাবুজী।
নেমিয়ার চলে গেলে সঞ্জয় অন্ধকারে অনেকক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।
এম-এ পাশ সঞ্জয় ক্যাশমুন্সী হয়ে গেছে। তার অপমানিত প্রতিভা যেন ব্যর্থ রোষে
ফণা নামিয়ে দিন গুণছিল। এইবার ফিরে ছোবল দিতে হবে, যতখানি বিষ ঢালতেপারা যায়।
অন্ধকারে চুপ করে দাঁড়িয়ে তার সমস্ত ভাবনাকে সংগ্রামের সাজে সাজিয়ে তৈরি হল সঞ্জয়। রতনলাল মিলের চিমনিটা অস্পষ্ট দেখা যায়। ডাইনোসরের মতে ঘাড় উচিয়ে তাকিয়ে আছে চুরাশী পরগণার বিস্তীর্ন আখের ক্ষেতের দিকে) "ঐ দানবীয় চর্বির স্তূপের ভিতর কোথাও হৃৎপিণ্ড লুকিয়ে আছে, তা সঞ্জয়ের অজানা নয়, ঠিক সেখানেই তাক করে আঘাত দিতে হবে।
মন-ভরা উল্লাস নিয়ে সঞ্জয় রুক্মিণীর ঘরে ঢুকলো। আদরের বাড়াবাড়ি দেখে রুক্মিণী প্রশ্ন করে—বড় সস্তায় সওদা পেয়েছ, না?
তবুও একদিন তো ছেড়েই দেবে! —সস্তা? আমার কি দেবার বাকী আছে? আর ছেড়েই বা দেব কেন?
রুক্মিনী যেন একটু অনুতপ্ত হয়ে হাত দিয়ে সঞ্জয়ের মুখ চেপে ধরে বললো— আচ্ছা! মাপ করো। আর বলবো না। তবে তুমি নিজেই সেদিন নেশার ঘোরে বলছিলে, আমি নাকি সরবতের গেলাস, সরবত নই! সঞ্জয়ের প্রত্যুত্তরেরঅপেক্ষা না করেই রুক্মিনী বললো—আমার কিছু থোক টাকা চাই।
একবার ভাল করে তাকিয়ে দেখ তো আমার দিকে।
রুক্মিণী গায়ের আঁচলটা নামিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। বুঝেছ? আমার
চলবে কি করে? —হ্যাঁ, বুঝেছি। সঞ্জয় গম্ভীর হয়ে গেল।
রতনলাল মিলের সমস্ত মেশিন বন্ধ || অতিকষ্টে দু'চার গাড়ি মাল যোগাড় হয়েছে। কলকাতার মার্কেটের অর্ডার মেটাবার শেষদিন এগিয়ে আসছে। রায়বাহাদুর প্রায়
পাগল হয়ে সদরে এস-ডি-ওর বাংলোতে দৌড়াদৌড়ি করছেন। চুরাশী পরগণার ফসল শুকোচ্ছে মাঠে মাঠে। এজেন্টরা গাড়ি আর টাকার তোড়া নিয়ে বস্তি বস্তি ঘুরে বেড়াচ্ছে। মাল ছাড়বে তো ছাড়। পাতা লাল হয়েছে কি এক আনাও দর দেব না। কিষাণরা হেসে চুপ করে থাকে। নেমিয়ার একেবারে উধাও হয়েছে। বাড়িতেও থাকে না, আসে না।
দাঁড়কাকের মত সে দিনরাত চুরাশী পরগণার মাঠে ঘাটে বস্তিতে উড়ে বেড়ায়। খবরদার এজেন্টদের কথা কেউ ঘাবড়িয়ো না। রতনলাল মিল ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। চুরাশী পরগণার ওপর শকুন উড়ছে ক'দিন থেকে! গো-মড়ক লেগেছে। মুনিরামের একটা ছেলেও মারা গেছে বসন্তে।
সাহুরা খেরোবাঁধা খাতা আর তমসুখের নথি নিয়ে দরজায় হানা দিচ্ছে তাগাদার। একজন রিক্রুটার ত্রিশজন তুরীকে গেঁথে নিয়ে সরে পড়েছে মালায় রবার বাগানের জন্যে। জিতেন নগরের সড়কে গরুর গাড়ি লুঠ হয়েছে। মিলিটারী পুলিশ রুট মার্চ করে গেছে।
পঙ্গপালের মত করমপুরের গয়লারা এসেছে দলে দলে। মোষ কিনেছে পাঁচ টাকায়, দুধেল গরু আট টাকায়, বাছুর বার আনা সাহুরা চড়া সুদে রুপোর গয়না বন্ধক নিচ্ছে, পেতল কাঁসার বাসন বিকিয়ে যাচ্ছে মাটির দরে।
চুরাশী পরগণার ঘরে ঘরে সেদ্ধ হচ্ছে কোনার গাছের পাতা। ঘরের দানা আনাজ নিঃশেষ।
এক মাস হতে চললো। রায়বাহাদুর এজেন্টদের গালাগালি দিয়েছেন। যেমন করে পার মাল নিয়ে এস। মার্কেটে আর ইজ্জৎ থাকে না। মেশিন যে মরচে পড়ে গেল।
এস-ডি-ও এসে মিল দেখে গেছেন। পেয়াদা দিয়ে চুরাশী পরগণায় ঢোল পিটিয়ে দিয়েছেন।—সব কোই হুঁশিয়ার হো যাও। ফসল ছাড়, একদিন মাত্র সময় দেওয়া গেল। নইলে কাল থেকেই লয়াবাদ পরগণা থেকে ফসল আনা হবে।
মুনিরাম আর মুখলাল এল সন্ধ্যাবেলা। ঘেয়োকুকুরের মত চেহারা। এখনও ভরসা জ্বলজ্বল করছে ওদের চোখে হাত পেতে হুকুম চাইছে—বাবুজী, এইবার কি করতে হবে হুকুম দাও।
সঞ্জয় বললো— আর ক'টা দিন সবুর কর। মুনিরাম আর সুখলাল চুপ করে অনেকক্ষণ বসে থেকে চলে গেল।তাদের
একটা কিছু বলবার হয়তো ছিল। বলা আর হল না। ঘটনাগুলি কেমন ঘোলা হয়ে আসছে। রায়বাহাদুর এখনও তাকে ডাকলো না, এই সঙ্কটে একটা পরামর্শের জন্য। আভাসে সঞ্জয় একদিন জানিয়েও ছিল—
যদি বলেন তো কিষাণদের আমি শান্ত করি।
এদিকে রুক্মিণী আবার এক কাঁটা গিলে বসে আছে। দুদিকেই একটা ব্যবস্থা এবার করা উচিত। কিন্তু নেমিয়ার ছাড়া কি করে কাজ হয়। কাজের বেলা লোকটাই সত্যিই বড় সহায়।
নেমিয়ার এসে সামনে দাঁড়ালো। কেরোসিনের বাতির ময়লা আলো। নোংরা খাকি প্যান্ট, ছেঁড়া কামিজ, পাখির বাসার মত রুক্ষ চুলে ভরা মাথাটা। কেন্নো নেমিয়ার দাঁড়িয়ে আছে,
লোহার মূর্তির মত ঋজু ও কঠিন। গোত্রহীন মানুষের স্বরূপ দেখে আজ সঞ্জয়
আঁতকে উঠেছে, বসে আছে মাথা নীচু করে। নেমিয়ার চাইতে এসেছে মিলের ক্যাশঘরের চাবি। গিরগিটির মত চেটে নিয়ে আসবো যা কিছু ক্যাশে আছে। ঘরে আগুন লাগিয়ে দেবো। ফাইল রেজিস্টার ছাই হয়ে যাবে! তোমাকে দায়ী করবে কি দিয়ে। কে বলবে কত ব্যালান্স ছিল? দাও চাবি দাও।
সঞ্জয় ঘাড়টা একবার তুলে তাকালো বাইরের অন্ধকারের দিকে। আলোটা একটু উজ্জ্বল থাকলে দেখা যেত, দমকা শিহরে তার হাঁটু দুটো থরথর করে উঠলো।
নেমিয়ার যেন ভয়ঙ্কর অর্থহীন এক ব্যালাড গাইছে— চুরাশী পরগণার রসদ চাই। তার পর দেখবো, লয়াবাসের সড়ক দিয়ে কোন মরদকা বাচ্চা বাইরের মাল আনতে পারে। কেউ বেচবে না ফসল, ক্ষেতে ক্ষেতে শুকিয়ে যাবে, পুড়িয়ে ছাই করে দেওয়া হবে। কিষাণেরা সব কসম খেয়েছে। আজ রাত্রে লাঠি মাজা হচ্ছে ঘরে ঘরে। সব তো গেছে, কিন্তু রতনলাল মিলকে দেখে নেবে তারা। মাথা দেবে,
মাথা নেবে। বসন্তে ক্ষতাক্ত মুখ, গোল চোখ, বেঁটে রোগ ঘুঁটে রঙের চেহারা নেমিয়ারের, যাকে চড়ুই পাখিও ভয় পায় না, সেই এসে দাঁড়িয়েছে সঞ্জয়ের সমুখে, অতি আসন্ন এক বিপ্লবের ফরমান হাতে নিয়ে।
নেতিয়ে পড়েছে সঞ্জয়। নেমিয়ার পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো—অত
ভাবনা কিসের কমরেড দাদা! তোমার কিষাণ ফৌজকে খেতে হবে তো। দাও
আর দেরী করে না।
ক্যাশঘরের চাবির তোড়া নিয়ে নেমিয়ার অন্ধকারে পিছলে সরে পড়লো। উদ্ভ্রান্তের মতো অনেকক্ষণ পায়চারি করে সঞ্জয় এসে দাঁড়াল ঘরের বাইরে একটু ঠান্ডা হাওয়া পেতে। একটা সামান্য দলাদলির এ রুদ্র পরিণাম সে কল্পনা করতে পারেনি। সার্কাস দেখাবার জন্যে যে সিংহকে খাঁচার বাইরে আনা হয়েছে, একটু সামান্য খোঁচা দিতেই সেটা যে বুনো হাঁক ছেড়ে অবাধ্য হয়ে উঠবে, কে এতটা ভেবেছিল?
—নেমিয়ার! অন্ধকারে সঞ্জয়ের ভাঙা গলা কেঁপে উঠলো। দৌড় দিল সঞ্জয়।
রুক্মিণীর ঘরের জনালার ফাঁক দিয়ে মৃদু আলোর সঙ্গে তারযন্ত্রের মতো একটা স্বর ঠিকরে এসে পড়েছে। সঞ্জয় দম বন্ধ করে জানালার ফাঁকে চোখ লাগিয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
মেঝের ওপর লুটোচ্ছে রুক্মিণী। শাড়ীর ভার খসে গিয়ে কোমরে শুধু গেরোটা লেগে আছে। খোঁপাটা মাটিতে ঘষা খেয়ে খেয়ে নোংরা হয়ে গেছে। কাচের চুড়িগুলো ভেঙে ছড়িয়ে রয়েছে এদিক ওদিক। আহত নাগিনীর মতো রুক্মিণী যেন কোমর ভেঙে অবশভাবে পড়ে আছে। শুধু এপাশে ওপাশে মোচড় দিয়ে কাতরাচ্ছে।
রুক্মিনীর প্রাণবায়ু যেন করাল ঝঞ্ঝার মতো সমস্ত শরীরে একবার শুমরে উঠলো। এমন অবস্থায় অনেকে তো মারা যায়। রুক্মিণীর কপালেও কি তাই আছে?
অনাবৃত মসৃণ হাঁটুর ওপর অতি পরিচিত সেইল নীল শিরার আঁকা-বাঁকা রেখাগুলি, জোঁকের মতো ফুটে উঠেছে। ঠোঁটের ওপর দাঁতের পাটি চেটে বসে গেছে। চোখের কোণ থেকে তোড়ে তোড়ে জল গড়িয়ে পড়ছে কান ভাসিয়ে। চাপা আর্তস্বরে পর্দায় পর্দায় তীক্ষ্ণ হয়ে উঠেছে। ফুসফুসটা ফেটে যায় বুঝি। এই কি মৃত্যু?
কী নিষ্ঠুর বিভ্রম! সমস্ত যন্ত্রণা ধন্য করে কপট মৃত্যুর আড়ালে এক নবজীবনের রক্তবীজ পৃথিবীর মাটিতে হাত বাড়িয়েছে। সঞ্জয় এক লাফে পিছনে এসে গাছের নিচে দাঁড়ালো। নেমিয়ার কোথায়? সঞ্জয় এগিয়ে যায়, নেমিয়ারের ঘরের দরজার ফাঁকে
উকি দেয়। কালো প্যান্ট পরে, কোমরে একটা চওড়া বেল্ট কষে নেমিয়ার বসে বসে চিবোচ্ছে বাসি রুটি হাঁড়ি থেকে ঢেলে পচাই খাচ্ছে এক-এক চুমুকে। একটা ধারালো ভোজালি সামনে রাখা। মুখে অদ্ভুত এক প্রসন্নতা; শুকনো ঠোঁট দুটো নেকড়ে ঠোঁটের মতো হাসছে।
এ-ঘরে ভাই, ও-ঘরে বোন, । পুরাকল্পের বর্বর পৃথিবীর দু'জন কুপিত ডাইন ও ডাইনী যেন ভুক করে সর্বনাশের আহ্বান করছে।
নদীতে বান ডাকে, ভয়াল তোর আসে, গর্জন করে। জেলে তার যথাসর্বস্ব ঘাড়ে তুলে দৌড় দেয়। সঞ্জয় দৌড় দিল। সড়ক না ধরে, মাঠের চালু খাড়াই খাদ গর্ত ডিঙিয়ে সঞ্জয়ে দৌড়াতে থাকে। মিল ফটকের আলোটা আলেয়ার মতো কুয়াশার দপ-দপ-দপ করছে। আর বেশি দূর নয়।
মকতপুরই বা কতদূর? আজ শেষরাত্রে ট্রেন ধরলে কাল বিকালে পৌছে যাবে। শিরিষ গাছে হয়তো সুঁটি পেকেছে। সোনালী বৈকালে হালকা বাতাসে মোটা ঘুঙুরের মতো শব্দ করে বাজে। বড়দা বারান্দায় বসে গুড়ের তৈরি চা খান। মা উঠোনে বসে লক্ষ্মী পিঁড়ি ধুতে থাকেন। পুতুল আকাশে আঙুল তুলে শঙ্খচিলের ঝাঁক গোনে—এক দুই তিন। সুমিত্রা, হয়তো তার বিয়ে হয়নি। তার শরবীদৃষ্টি ঘুরে বেড়ায় তপুরের বাড়ির জানালায়–পথে—আগম্ভক মোটরবাসের দিকে।
রায়বাহাদুর রতনলাল, সূর্যবাবু, মুনিবজী—সামনে টুলের ওপর বসে আছে সঞ্জয়-বিশীর্ণ রোগীর মতো। ভাঙা কাঁসরের মতো গলার আওয়াজ এক গেলাস গরম দুধ সঞ্জয়কে খেতে দেওয়া হয়েছে।
রায়বাহাদুর ডাকলেন—শঙ্কর পালোয়ান, ক্যাশঘরের পাহারা বসাও।
নেমিয়ার বাবুজীকে ছুরি দেখিয়ে চাবি নিয়ে গেছে। আজ রাতেই চুরি করতে
আসবে। চোট্টা শালাকে ধরে কাঁচা খেয়ে ফেলতে হবে।
রায়বাহাদুর এবার মুনিবজীকে হুকুম দিলেন বাবুজী স্টেশনে যাবেন! এখনই একটা ভাল ঘোড়ায় গদি চড়িয়ে দাও। আর আমার সিন্দুক খোল, বকশিশ দিতে হবে। বড় ইমানদার ছেলে।
বকশিশের পঞ্চাশটা টাকা হাতে নিয়ে আর আদাব জানিয়ে সঞ্জয় উঠলো। রায়বাহাদুর বললেন—কটা দিন বাড়ি গিয়ে বিশ্রাম কর। তারপর এসো আমার গোরখপুর মিলে—শওরূপেয়া তনখা।।
রামখড়ির রেঞ্জের গায়ে সরু জংলী পথে ঘোড়া ছুটিয়ে চলেছে সঞ্জয়।
আকাশের বুকটা লাল হয়ে গেছে। কিষাণেরা আগুন ধরিয়ে দিয়েছে নিজের নিজের ক্ষেতে। যেন পুড়ে পুড়ে শুদ্ধ হচ্ছে, চুরাশী পরগণা। সামনের মাঠটা পার হলেই স্টেশন, ডিস্ট্যান্ট সিগনালের আলোটা নীল
তারার মতো ভেসে রয়েছে। ছপ করে একটা শব্দ। ঘোড়াটা একটা স্রোতে পা দিয়েছে। সঞ্জয় ঘোড়া থেকে নেমে স্রোতের ধারে বসে আঁজলা ভরে জল খেল।
গেরস্থের মুর্গি চুরি করে একটা শেয়াল ভেজা বালির ওপর বসে গোঁপের রক্ত
চাটছিল। সেও জল খাবার জন্য স্রোতে মুখ নামালো।
0 মন্তব্যসমূহ