Hot Posts

6/recent/ticker-posts

ভাষা আন্দোলন ভিত্তিক গল্প ভাষা আন্দোলন এর সেরা গল্প বরকত যখন জানতো না, ভাষা আন্দোলনের গল্প বশীর আল হেলালের গল্প, একুশের গল্প

ভাষা আন্দোলন এর গল্প ভাষা আন্দোলন এর সেরা গল্প  বরকত যখন জানতো না, ভাষা আন্দোলনের গল্প 

***বরকত যখন জানত না সে শহীদ হবে 

--বশীর আলহেলাল


খুব ছোট গ্রাম। নাম হাবলা। দুই বড় গ্রামের মাঝখানে পড়েছে বলে বুঝি আরো ছোট মনে হয়। চারদিকে ফাঁকা খাঁ-খাঁ মাঠ। তার মধ্যে পূর্ব আর পশ্চিমের মাঠ এতো বড় যে দিগন্তের রেখাকে শিশুর চোখের কাজল-রেখার চেয়েও ক্ষীণ দেখায়। এই অঞ্চলে এই রকমের মাঠকে বলে ছাতি-ফাটা মাঠ। অর্থাৎ, ধরুন, বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠের গ্রীষ্মে খর-দুপুরে ওই মাঠ পেরিয়ে যদি কেউ এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে যায়, তৃষ্ণায় তার ছাতি অর্থাৎ বুক ফেটে যেতে পারে।বাংলার এই অঞ্চলে মাঠে গাছও থাকে না। থাকলে কদাচিৎ থাকে। হয়তো একটা অশ্বত্থ, কি শিমূল, কি একটা কালো বুড়ো আমগাছ। তালগাও থাকতে পারে। অবশ্য ি তালগাছ থাকে, একসঙ্গে পাশাপাশি দু'তিনটি, এমনকি দশ-বারোটিও থাকতে পারে। তখন এই জালয়গুলোকে একটু দূর থেকে দেখলে মনে হবে, বুঝি দুই হা-হা প্রান্তরের দৈত্যসম্রাট তাদের সাম্রাজ্যভাগের সীমানির্দেশের জন্যে এই তালগাছের খুঁটি পুঁতেছেন। আসলে ব্যাপারখানা তাই। কোনো দূর অতীতে হয়তো দুই ভাই কিংবা অন্য রকমের দুই শরিকের মধ্যে জমি নিয়ে অশান্তি, কলহ হয়েছিলো। হয়তো মারামারি ফাটাফাটিও হয়েছে। হয়তো চৈত্রমাসের তৃষ্ণার্ত মাটির ধূলোয় কিংবা আষাঢ়ের প্রথম বর্ষার পেলব কাদায় ওখানে র করেছিলো। তারপর গ্রামের মোড়ল ব্যক্তিদের সলিস বসেছে। মীমাংসা একটা হয়েছে, বাটোয়ারা হয়েছে। এর শরিক তখন তার জমির নতুন জ্বালে তালের আঁটি পুঁতে দিয়েছে। আর সেই হচ্ছে আজকের এই টাকা প্রাত্তরের তাল-বীদি। নিষ্ঠুর কোনো হালাকুর তলোয়ারের আঘাতের কঠিন কালো চিহ্নের মতো। এখন ওখানে শেষ-ফাল্গুনে চিল দম্পতি তিন পেড়ে বাচ্চা ফোটাবে বলে বাসা বাধে। আর যদি অশ্বত্থ শিমূল হয় তাতে বাস্ত বাঁধে দাঁড়কাক ।

এই হচ্ছে এই অঞ্চল। আর তার মধ্যে ছোট এই গ্রাম, নাম বাবলা। 'আর গ্রামের এই বাবলা নামই বা কেন হলো ? কে জানে সে ইতিহাস? কতো ইতিহাসই আমাদের জানা হয়নি, জানতে বাকি, কিংবা জানলেও ভুলে গেছি। এই অঞ্চলে বাবলা খুবই সাধারণ গাছ: সব গ্রামের কোল ঘেঁষে ছুটিং-ভরা অনাবাদি জমি, নাড়া ঢিপি কি ঘোলা জলের সেচের পুকুরের পাড়ে এই বেঁটে কালো গাছগুলি রয়েছে, তার কোনো কোনোটি কুঁজো, হয়তো যখন শিখ ছিলো বৈশাখী ঝড়ে গাজা ভেঙে গিয়েছিলো। ওই বাহু যে কোন কাজে লাগেঅন্তত আমি তো জানি না। একটুখানি সৌন্দর্য আছে ঝিরি ঝিরি পাতায়, কিন্তু সেও কঠিন কাঁটায় আকীর্ণ। ওই গাছের তলা দিয়ে খালি পায়ে হাঁটতে গেলে, কতো সাবধানে আঙুল টিপে-টিপে হাঁটতে হ্যাঁ, মাটিতে কাঁটা থিক থিক করে। তাহলে যদি ওই গাছ কোনো কাজেই না লাগে তো ওর তলায় কেউ যায় কেন? যাওয়ার অনেক কারণ থাকতে পারে। কোনো রাখালের গরুর পালে একটা ঠ্যাঁটা গরু আছে। সে মাঠের শ্যামল আলের কোমল ঘাস ফেলে ওই ন্যাড়া বাবলাতলায় গিয়ে দাড়িয়ে আছে। দু-একবার মাথা তুলে লম্বা জিভ বের করে বাবলার পাতা ছোঁয়ার চেষ্টা করেছিলো, এখন মাথা নামিয়ে মাটিতে নাক ঠেকিয়ে ফোঁস ফোঁস করে শ্বাস ছাড়ছে, কিন্তু ওখান থেকে নড়ছে না। রাখাল ওটাকে মুখ খারাপ করে ডাকছে, কিন্তু, মনে ওর কী ভাব জেগেছে কে জানে, গরুদের মধ্যেও কবি থাকে, একটু নড়ে-চড়ে, হয়তো গিয়ে গাছের গুঁড়িতে পিঠটা একটু চুলকে নিলো, কিন্তু ওখান থেকে নড়লো না। ঝিরঝিরে হাওয়ায় জায়গাটা কি বেশ ঠাণ্ডা? এই হাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে ওই গরু কি উদাস হয়ে গেছে? তখন রাখাল পাঁচন উচিয়ে ছুটে যায়। হ্যাঁ, তাকে ওই বাবলা-তলার কাছে গিয়ে থমকে দাঁড়াতে হয়, কারণ হয়তো বাবলার কাঁটা ওখানে থিক থিক করছে। *

**ভাষা আন্দোলন এর দৃষ্টি গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

তবে বাবলাগাছে যখন গ্রীষ্মে ফুল ফোটে, হলুদ রঙের ছোট-ছোট গোল-গোল ফুল অসংখ্য ফোটে, কোমল ঝুরঝুরে তাদের রেণুর মতো পাপড়ি, দেখতে ভালোই লাগে। আরো একটা ব্যাপার আছে। বাবলার ফুল যখন ফোটেনি, তখনো কুঁড়ি, ফোটার আগে-আগে, সবুজ-রঙের ঠিক নাকছাবিটির মতোই হয় দেখতে, মেয়েরা নাকে পরে। ওই কুঁড়ির সরু বোঁটা ফুটোয় কেমন সুন্দর বসে যায়। মনে আছে, সেই ছেলেবেলায় আমিই আমার বুবুর জন্যে ওইরকম পা টিপে টিপে গিয়ে বাবলা-ফুলের কুঁড়ি ছিঁড়ে এনেছি। গায়ে কাঁটা যে কখনো ফোটেনি এমনও নয়। ওহ্, সেই কাঁটা ফোটার কথা মনে পড়লে এখনো গা শিউরে ওঠে।

বাবলাগাছের আর এক উপযোগ আছে। সে বাবলার ফল বা শুঁটি। বিচিত্র সেই ফল। ছয় থেকে ন’ইঞ্চি লম্বা। যেন হালকা সবুজ রঙের ছেঁড়া মালা। গাছ-ভর্তি অসংখ্য ঝুলবে। অনাদরে ঝুলবে। কেউ তাকিয়ে দেখবে, কেউ দেখবে না। যখন পাকবে হয়তো দু-একটি ঘর-পালানো ছেলে কতকগুলো পেড়ে ভেতরে রয়েছে যে খোঁপে-খোপে কালো শক্ত ক্ষুদে সুন্দর বিচিগুলি, সেগুলি নিয়ে ফেলবে। কিন্তু, আঙ্গুল উপযোগ হচ্ছে, পাকার আগে, বুঝি কার্তিক-অঘ্রান মাসে, যখন তখনো আমনের খড় ওঠেনি খামারে, গোয়ালারা গাদা গাদা পেড়ে নিয়ে যাবে, নিয়ে গিয়ে খাওয়াবে গাইগুলোকে। বাবলার ফল খেলে গাই বেশি দুধ দেয়। আর স্কুলের ছাত্র-বেলায় আমরা বাবলার ফাটা গা বেয়ে গড়িয়ে পড়া আঠা খুঁজতাম, যা দিয়ে হয় গদ।

এই হচ্ছে বাবলার পাছ, সারা রাঢ়-বঙ্গ জুড়ে অসংখ্য রয়েছে যত্রতত্র। কিন্তু বাবলা নামে গ্রাম এই একটি চই গ্রামেই জন্ম আবুল বরকতের। ছোট, সামন্য একটি ঘ্রাণ। এখন কিছুই নেই ওখানে। হাট বসে না, স্কুল নেই, ডাকঘর নেই। নিম্নমধ্যবিত্ত কয়েক ঘর মুসলিম পরিবার আছে, এরই মধ্যে দু-চারটি হয়তো একটু বেশি সঙ্গতি ওয়ালা, একটু তাদের বেশি জমি আছে। আর যারা বেশিরভাগ আছে, পরের জমিতে খেটে-খাওয়া নিম্নশ্রেণীর ক্ষেত মজুর চাষা।

**ভাষা আন্দোলন এর আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

গ্রামের পূর্বে-পশ্চিমে বিস্তৃত। পূর্বের মাঠ এতোই বড়, এতোই খাঁ-খাঁ দূরে, বহু মাইল দূরে সামান্য দক্ষিণ কোণ ঘেঁষে চিনির যে একটি কল রয়েছে ভালো

করে নজর করলে তার ডিমনিটিকে দেখা যায়, মনে হয় কালো একটি কাঠি ওখানকার নরম মাটিতে ঘাসের মধ্যে কেউ পুঁতে রেখেছে। আমরা ছেলেবেলায় ওই দিকে গিয়ে কখনো কখনো বিকেলের অনুজ আলোর এই ডিমনিটির দিকে তাকিয়ে থাকতাম। হয়তো ওটাকে হারিয়ে ফেলতাম, আবার খুঁজে পেতাম। এই এখনে তো মূর্শিদাবাদ জেলা, কিন্তু এই ওয়ানে নদিয়া। এই যেখানে চিনির কলটি আছে, বহু দূরে, তাঁর চারপাশে রয়েছে মাইল-থাইল জুড়ে আখের ভেত। এরই মধ্যে কোথাও ছিলো সেই আমবাগান, এখন নেই, যেখানে স্বাধীন বাংলার হতভাগ্য শেষ নবাব সিরাজুদ্দৌলার বাহিনীর সঙ্গে লর্ড ক্লাইভের বাহিনীর যুদ্ধ হয়েছিলো। সিরাজ হেরে গিয়েছিলেন। কতো বিচিত্র সেই ইতিহাস। কারা তাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলে? অড়াটে সব সৈনিক, তারা এই দেশেরই লোক। তখন নবাব করতো নবাবি, খাজনা তুলতে, কিন্তু রাজনীতির সঙ্গে দেশের মানুষের সম্পর্ক থাকতো না। সেই ইতিহাসের দিকে এই এতো দূর থেকে আমরা তাকিয়ে থাকতাম। আমাদের চোখে সেই চিনি-কলের চিমনিটির তাই এতো গুরুত্ব ছিলো।

আর পশ্চিমের মাঠ চিরে জেলা বোর্ডের রাস্তা একটি আছে, উত্তর-দক্ষিণ, বাবলা থেকে আধ-মাইল দূরে। এ তল্লাটে মাটি এঁটেল। ওই কাঁচা সড়কের কাদায় বর্ষায় গরু-মোষের গাড়ির চাকা আটকে যায়। গাড়োয়ানকে তখন গাড়ি থেকে নেমে কাঁধ লাগিয়ে সেই চাকা ঠেলতে হয়।

এখন তো ইতিহাসের এটিল পথের কাদায় দেশটারই চাকা আটকে গেছে। একদিকে হিন্দু, অন্যদিকে মুসলমানরা ঠেলাঠেলি লাগিয়ে দিয়েছে অবশ্য। ফলে ইতিহাস কোনোদিকেই নড়ছে না। মানুষ তো গরুর মতোই গাধা। আর তাদের নেতারা সব শয়তান।

ওই যে জেলা বোর্ডের এঁটেল মাটির কাঁচা পথ, ওটা দুটো বৃহৎ ও বর্ধিষ্ণু গ্রামকে যুক্ত করেছে। একটি তালিবপুর এখানে মুসলমান বেশি, কিন্তু হিন্দুরাও আছে। অন্যটি কাগ্রাম, ওখানে হিন্দু বেশি, কিন্তু মুসলমানও আছে। এই দুইয়ের মাঝখানে বাবলা, এখানে হিন্দু নেই। উত্তরের ছোট মাঠটি পোয়াল তালিবপুর। দক্ষিণের ছোট মঠটি পেরোলে কাতাম। উভ গ্রামেই অনেক কিছু আছে। হাই স্কুল আছে, ডাকঘর আছে, হপ্তায় দু-দিন হাট বসে। জোবোর্ডের দাতব্য চিকিৎসালয় আছে। বড়-বড় ব্যক্তিরা আছেন, বড় বড় অফিসার, অবশ্য বেশিরভাগ কলকাতায় প্রবাসী। রাজনৈতিক নেতারা আছেন, যাঁদের কেউ এমনকি কলকাতা কর্পোরেশনের মেয়র হয়েছেন। সে যে কী এক সময় ছিলো। একদিকে মুসলিম লীগ, অন্যদিকে করা। আমার বাড়ি অনিরপুর। খন্ড এক জমিদারবাড়ি আমাদের গ্রামে। গড় দিয়ে ঘেরা সেই প্রাসাদ ছিলো বিপুল; হাতিশালে সত্যি হাতি ছিলো, ঘোড়াশালে ঘোড়া ছিলো, হাতি ঢোকার মতোন আলিশান সেট ছিলো। মনে হতো ইতিহাস সত্যি কথা কইছে। ছিলো খেলাধুলো, নাটক, গান। নাটকের অপসারণযোগ্য মঞ্চ ছিলো। একটা নর, কয়েকটা করে প্রস্থাবর ছিলো। হিন্দু প্রধান করোমে হয়তো সংস্কৃতির আরো বেশি ছিলো। কিন্তু তালিবপুরের ফুটবল-দলের খুব নান। যাত্রাদল ছিলো, নেটো আর আলকাপ-এর দলও ছিলা। কবিয়াল ছিলো। তালিবপুরে মুসলমান ছেলেদের কেষ্টব্যতার দল ছিলো। যে ছেলেটি বিবোধিনীরাই অর্থাৎ রাম নাজাত। সে দর্শকদের দল করে দিতো। যে হাই 'মরিলে ঝুলায়ে রেখো তমালেরই ডালে গো'। তমালের একটি গাছও ছিলো আমাদের গ্রামে। বিরাটএক পুকুরের পাড়ে কালো বেঁটে ঘাঁটি। এর তলা দিয়ে সত্যি রাধারা পুকুরে নাইতে যেতো।

ঈদের চাঁদ উঠলে অমনি আবদুল আলিমের এক ওস্তাদ গলায় হারমোনিয়া ঝুলিয়ে তার দল নিয়ে হ্যাজাকের আলোয় য়ের পথের গুলো উড়িয়ে পাড়ায় পাড়ার পেয়ে ফিরে রমজানের ওই রোজার শেষে এলো খুশীর ঈদ'। আবদুল আলিমেরও বাড়ি এই তালিবপুরে। বাবলার ছেলেরা কিছু পড়তে যায় কাদের স্কুলে, কিছু তালিবপুরের স্কুলে। হয়তো বেশি যায় তালিবপুরে। তালিবপুরের ফুটবলের মাঠটি বাবলা থেকে ওই তো দেখা যায় গ্রামের উপাত্তে। ওখানে বাবলার কেউ-কেউ খেলতেও যায়।

বরকতের নাম যে বরকত, আমি জেনেছিলাম সম্ভবত সে শহীদ হওয়ার পরে, তার, আগে জানতাম না। তার ডাক নাম ছিলো আবাই) ওই নামেই জানতাম। এই গল্প লিখতে বসে আমার চোখে পানি আসছে। সে আবাই ভাষা আন্দোলনে শহীদ হয়েছে বলে নয়। ইতিহাসের চাকা বসে গেলো এঁটেল মাটির কাদায়। কতো ঠেলাঠেলি চলছে। চলুক। ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে এই এতোটুকু আমি এবং আরো কতো মুসলমান তরুণ কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্না আর হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দির জয়ধ্বনিতে চোঙা ফুঁকে গলা বসিয়ে ফেললাম। আবাই পড়তো আমাদের গ্রামের স্কুলে। আমি একেবারে নিচের দিকের কোনো ক্লাসে, ও একেবারে উপরের দিকে। সন-তারিখ মনে নেই। অবশ্য ওর জন্ম ১৯২৮ সালে, আমার ১৯৩৬-এ। অনেক ব্যবধান। আবাইয়ের মামাতো এক ভাই পড়তো আমার সঙ্গে। আবাইয়ের অর্থাৎ শহীদ বরকতের মায়ের সঙ্গে তার ছবি আপনারা দেখতে পাবেন বাংলা একাডেমী: সিঁড়ির দেয়ালে যে-সব ছবি ঝুলছে তার একটি কি দুটিতে। আবাইকে তখনি চিনতার। সে আমার ওই সহপাঠীর সে ফুফাতো ভাই ছিলো বলে নয়। অনেক উপরের ক্লাসের ছাত্র সে, এবং কতো ছাত্র স্কুলে, আমার তাকে চেনার কথা নয়। কিন্তু সবাই তাকে চিনতো, কেবল তাকে নয়, তার ভাইগুলোকেও চিনতো। তার কারণ ওরা সব অস্বাভাবিক লম্বা লম্বা মানুষ ছিলো। ওর বাবাকেও দেখেছি। তিনিও ছিলেন অস্বাভাধিক লম্বা। হাটের ভিড়ে পা রাখলে সবার আগে এঁকেই দেখা যেতো। সম্ভবত যে-কোনো দরজায় মাথা হেঁট করে ঢুকতে হতো। অন্তত এই একটা কারণে সবাই ওদের চিনতো। আবাইয়ের উচ্চতা দেখে আমরা বিস্মিত হতাম, হয়তো হাসতামও। সেই যে হাসান হাফিজুর রহমান লিখেছেন :

""আবুল বরকত নেই: সেই অস্বাভাবিক বেড়ে ওঠা বিশাল শরীর বালক, মধুর শালের ছাদ ছুঁয়ে হাঁটত যেতাকে ডেকো না :,

বিশাল শরীর বলতে যা বোঝায় ঠিক তা না, সে মোটা ছিলো না, কিন্তু অস্বাভাবিক।

এখন সেই আবাইয়ের গল্পটা বলি।

ঠেলাঠেলিতে ইতিহাসের ঢাকা কাদা থেকে উঠেছে। কিন্তু মচকে গেছে। চলছে, কিন্তু খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে, আর ক্যাচর ক্যাচর শব্দ উঠছে। দক্ষিণে কাগ্রামে খুব উল্লাস, হিন্দুস্থান যে হয়ে গেছে মুর্শিদাবাদ। উত্তরে তালিবপুরে গভীর বিষাদের ছায়া, পাকিস্তান যে হইলো না মুর্শিদাবাদ। 

আবাইয়ের মনেও বড় দুঃখ, চাপা বেদনা। নবাবদের স্থান মুর্শিদাবাদ, মুসলিম বৃষ্টির এক পীঠস্থান মুর্শিদাবাদ, সে পাকিস্তান হলো না গোনা যায় এক নবাব পুত্র প্লেন ভাড়া করে উড়ে গিয়েছিলেন করচি, গিয়ে বলেছিলেন, আপনি এ কী করলেন, জিয়া সহ্যে। আগস্টের পরে কামান গেছে, শীত পড়েছে। টেস্ট পরীক্ষা চলছে। শেষদিনের পরীক্ষা। খুব পড়েছে কদিন, রাত জেগেছে। শরীরে তো খুব নেই, মাথাখানা ধড়। সরু গলা বুঝি আরো সরু হয়ে গেছে। মা কইমাছ জোগাড় করে সুন্দর ঝোল রান্না করে রেখেছেন । মা বলেছিলেন, ওরে, পানি গরম করে দি, ঘরে গোসল কর। শোন আবাই, বড় ঠাণ্ডা, পুকুরে খাস না, বাবা।

এমনিতে শাস্ত। মনে হয়, নিরীহই বুঝি। কিন্তু মনে যা ভাববে তাই করবে। বলে, না মা, পড়ে পড়ে মাথাটা গরম হয়ে আছে। ঠাণ্ডা করে আসি।

গায়ে সরষের তেল মাখলো, মাথার চাঁদিতে নারকেল তেল ঘষলো। সময় নেই। পুকুর সামান্য দূরে। লম্বা লম্বা পা ফোল গিয়ে স্বগুন-হুপুস কটা পূর্ব দিয়ে উঠে এলো। তোয় শরীর যেন জমে গেলো। যাক। মনে হচ্ছে, আমার যতো স্মৃতি, যতো অনুভব, যতো বিদ্যা এবং কল্পনা, একটা বরফের মতো শক্ত প্রকোষ্ঠে এখন বন্দি হয়েছে। পরীক্ষার খাতায় এখন ওদের আমি যেমন খুশি বের করবো আর পুতুল নাচ নাচাবো

. কিন্তু খেতে বসে কইমাছ দেখে অমনি হাত গুটিয়ে বসে রইলো। বললো, মা, এখন কি আমার কইমাছের কাঁটা বাছার সময় আছে? মা তাড়াতাড়ি কাছে এসে বসে বললেন, আবাই, তুই ভাতে ঝোল মাখা। কঁপি ভাজাটা

দিয়ে শুরু কর। আমি কাঁটা বেছে দিচ্ছি। এক লহমার বেশি লাগবে না।

সাবাই হাসলো মনে-মনে, আমি এখনো সেই তোমার কোলের খোকাটি আছি । কিন্তুরাগ দেখালো বাইরে। বললো, মা, তোমার ওই কই মাছটাছ আমার ভালো লাগে না। আজকেএকটা ডিম ভেজে দাও ।

'আজকে' বলার কারণ হচ্ছে, সেই যেদিন পরীক্ষা শুরু হয়েছে সেদিন থেকেই ও ডিম খেতে চাইছে, ডিম খেলে তবু গায়ে একটু বল হয়, চাই কি মাথাও খুলতে পারে, কিন্তু মা কিছুতে দেবেন না। ডিম হলো অপয়া। ডিম খেয়ে পরীক্ষা দিতে গেলে পরীক্ষা খারাপ হয়ে যাবে রে বাবা!!

কে বলেছে?

মুরুব্বিরা সব বলেছেন। -

আবাই তখন বলেছে, হুঁহ, মুরুব্বিরা সব ফলেছেন। তোমাদের মুরুব্বিরা জীবনে পরীক্ষা দিয়েছেন? সব তো ছিলো মূর্খ, পড়েছে আরবি-ফারসি ভাষা কী জানবে?

মা বলেছেন, ছি বাবা, ও-রকম করে বলতে হয় না। তাঁরা অনেক কিছু জানতেন। কোরান হাদিস জানতেন। কোনো ভালো কাজে বেরোলে, ধর, জমি কিনতে, বা, মামলার দিন পড়েছে, কোর্টে গেলে কখনো ডিম খেয়ে যেতেন না।

আৰাই বলেছে, ঠিক আছে, আমাকে দেখাও, কোরান-হাদিস খুলে দেখাও কোথায় লেখা আছে ভালো কাজে রেবোবার সময় ডিম খেতে নাই, তাহলে খাবো না।

মা লজ্জায় মুখ নামিয়ে বলেছেন, হ্যাঁ রে, আমি কি অতো কোরান হাদিস পড়েছি? আবাই ততোক্ষণে খেতে শুরু করেছে। বলেছে, কেন, ওই যে তোমার ভাইটি রয়েছেন। না, পাশের বাড়ি, গ্রামের প্রধান, উকে বলো না দেখাতে।

মা আর কিছু বলেননি। হাত দিয়ে মাছি তাড়াতে শুরু করেছেন। বলেছেন, যা, বাবা, যা, জতা কথা বলে না। কিন্তু আবাই ডিম ভালোবাসে। ডিম খেতে না পাওয়ার দুঃখ সে ভুলতেই পারছিলো না।

বলেছে, হ্যাঁ মা, আর তোমার ওই মামলা করতে যাওয়া আর গরিব মানুষের জমি কিনে

বেড়ানো, এগুলো বুঝি খু ভালো কাজ ?

তখন মা বলেছেন, হ্যাঁ রে, তোর চোদ্দ পুরুষ কিনে রেখে গিয়েছিলো বলেই তো আজ


যা হয় চাট্টি খাচ্ছিস। তখন হঠাৎ অবাই সেই কথাটা বলে ফেলেছে, না মা, আমি পাকিস্তানে চলে যাবো। মা কেমন যেন অস্থির হয়ে উঠেছেন। বোকার মতো ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকেছেন। তারপর বলেছেন, আবাই, চলেছিস পরীক্ষা দিতে, এখন রাখ তো বা ওই সব অলক্ষুণে কথা।

এ গেলো সেই প্রথম পরীক্ষার দিনের কথা। আজ শেষ দিন। আজ কইমাছ দেখে তার মাথা গরম হয়ে গেছে। মাছ যদি খেতেই হয় তো সে পছন্দ করে বোয়াল, আড়, চিংড়ি এইসব। আবার বলে কিনা, কাঁটা বেছে দিই। যাকগে, আজ পরীক্ষা দিয়ে এসে, আসতে আসতে তো সন্ধে হয়ে যাবে, দু'জোড়া ডিমের পোচ দিয়ে সে চা খাবে। না খেলে চলবে কেমন করে? সারা দুনিয়ার লোক তো আমার লম্বা হওয়াটাকে নজর দিয়ে দিয়ে আমাকে পাট-কাঠির মতো রোগা করে ছাড়লো। ওরা আ আয়ুটাকেই না শেষ করে দেয়। এখন ডিম-দি এইসব ঠিকমতো না খেলে ওই তালগাছের মতো কেবল মাথায় বাড়বো, আড়ে বাড়বো না।

নাকে-মুখে গুঁজে খাওয়া সেরে কাপড় পরে বাড়ি থেকে বেরিয়ে, হাশমতদের বাপ ধনের ভেতর দিয়ে একটা সংক্ষেপ পথ রয়েছে, ওই পথ ধরে মাঠে গিয়ে পড়লো। ধানকাটা শুরু হয়েছে। কোনো ক্ষেতে কাটার আগে মই দিয়ে ধানগাছগুলোকে শুইয়ে দেয়া হচ্ছে। কোনো ক্ষেতে কাস্তে চালানোর খস খস শব্দ উঠেছে। কোনো ক্ষেতে কাটা ধান আঁটি ধাদা হচ্ছে। একটি ক্ষেতের ধানের আঁটি গরুর গাড়িতেও তোলা হচ্ছে।)

তখন চারদিকে তাকিয়ে হঠাৎ চলতে চলতে মনের ভেতর থেকে পরীক্ষার খাতায় লিখতে হতে পারে বলে যে-সব ইতিহাসের সন-তারিখগুলোকে আউড়ালো, সেগুলো কখন কোথায় পালিয়ে গেছে। হলুদ রোদে দেহের জড়তা কেটে যাচ্ছে। রাতের শিশিরবিন্দুগুলি এখনো রয়েছে ঘাসের ডগায়। পায়ের স্যান্ডেল ভিজে যাচ্ছে। কাটা ধানের ঘ্রাণ উঠছে। তার সামনে আলের ঘাস থেকে মাঝেমাঝেই গঙ্গাফড়িং এদিক ওদিক লাফ দিচ্ছে। দল বেঁধে পায়রারা নেমেছে যান খুঁটে খেতে। এই যে একজোড়া ধূসর রঙের পাখি সুৎ করে গিয়ে না কাটা ধানের ক্ষেতে দিয়ে লুকিয়ে পড়লো, ও কী পাখি? মাঠ ভর্তি রোদে পোড়া শিশিরের এতো কেন গন্ধ?পাকিস্তান। ইস, পাকিস্তান শব্দটা কদিন হলো যখার ভেতর ঢুকে বসেছে। হাশমতের বড় ভাইটা তার চাচাকে নিয়ে পাকিস্তানে গেলো। ওখানে সব ব্যবস্থা করে তাপর সবাই মিলে চলে যাবে।

আবাইয়ের সাধারও ঢুকেছে চিন্তাটা। পাকিস্তান হালা দিয়ে সেই স্বপ্নের দেশ যে

স্বপ্নটাকে এ-দেশে তার হাত থেকে হঠাৎ কেড়ে নেয়া হয়েছে। সে আগে ভাবতে পারতো না

এখন হয়, এক ঘাটির স্বপ্নের শুরু অন্য ঘাটিতে তুলে নিয়ে গিয়ে রোপণ করা যায়। এ কী

কাণ্ড ঘটে গেলো? সে কী করবে? যাবে পাকিস্তানে? হ্যাঁ, যাবেই তো। কেন যাবে না ? কিন্তু হঠাৎ এই শীতের স্কালের মাঠে চারদিকে তাকিয়ে তার মনটা বেদনায় মোচড় দিয়ে উঠলো। এই যে দুটো পাখি সুৎ করে ধানের ক্ষেতে লুকিয়ে পড়লো, মনে হলো ওরাই যেন আমি। কার ভয়ে আমি ওইরকম সুং করে লুকিয়ে পড়তে চাইছি? এ না আমার জন্মভূমি? এই পথে না আমি হাজারবার হেঁটেছি। আমার বাবার কবর না এখানে আছে? আচ্ছা, ওই যে লোকগুলো মাঠে কাজ করছে, ওরা সব কী ভাবে?

আবাইয়ের হাতে সময় নেই। না হলে ওদের জিজ্ঞেস করে দেখতো, ওরা কী বলে? ওরা পাকিস্তানের কথা কি ভাবে? সেখানে কি যাবে? যদি যায় কেন যাবে? যদি না যায় কেনই বা না যাবে ?

কখানা ধান তুলে নেয়া ক্ষেতের উপর দিয়ে কোনাকুনি হাঁটছিলো, কখনো আল ধরে সোজা ইটছিলো। ধানের বাড়া বস্ত্র-বস পায়ে লাগছিলো। জেলাবোর্ডের রাস্তাটা বোনে তালিবপুরে ঢুকে নহলার আমবাগানের পাশ ঘেঁষে চলে গেছে, কোনাকুনি ওই আসা গিয়ে ও উঠবে। বাবলা থেকে বেরোলে তালিবপুর গ্রামের ওই সূচনাটাকে বড় সুন্দর দেখায় । দূর থেকে আম আর বাংলাগাছগুলোকে দেখলে মনে হয় ওরা সুন্দর জামা পরা ওই গ্রামের প্রতিহারী। প্রতিহারী হলে কী হবে, এরা যে-কাউকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্যেই দাড়িয়ে রয়েছে।

নহলার আমবাগানে গিয়ে উঠলো। সুন্দর বৃহৎ বাগানটি। এককালে কোনো বড়লোকের ছিলো, এখন একালের এক রাজপুরুষের হাতে চলে এসেছে, তিনি আবার আগস্টের পরে পরেই ঢাকা চলে গেছেন। এখন এই বাগানের কী হবে? মুর্শিদাবাদে যতোপ্রকারের আম হয় সং নমুনা নাকি এই বাগানে আছে। মধ্যরাতো বৃহৎ গাজীর পুকুর। ওখানে নাকি বৃহৎ প্রাচীন পর মাছ আছে যাদের কারো কারো ওজন আধ মন হবে।

এখন তো দেশ ভাগ হয়ে গেছে, পাকিস্তান হয়েছে। যিনি ছিলেন মালিক স্বপরিবারে চলে গেছেন ঢাকা। এখন এই বাগানের কী হবে? আবাইয়ের আর কাজ নেই/ দিতে চলেছে টেস্ট পরীক্ষা, ওই কথা ভাবছে। শিরশির করে ঠাণ্ডা বাতাস বইছে। দেখলো, আম খাচ্ছের পাতাগুলো সেই হাওয়ায় হাসছে। এই হাসির অর্থ ও স্পষ্ট বুঝলো। ওরা বলছে, কেন গো, এ আবার কেমন প্রকার প্রশ্ন তোমার। আমরা এখানে ছিলাম, এখানে আছি এখানে থাকবো। তুমি জানো না মানুষের চেয়ে, মানুষের বুদ্ধি কিংবা বিবেকের চেয়ে, মানুষের রাজনীতির চেয়ে গাছের বয়স বেশি? মাটির ব্যাস, পানির বয়স, এই যে দেখছো টলটলে কালো জলের পুকুর ঘ্যান্ড আমরা আমাদের মুখ দেখি, ওতে রয়েছে যে-সব মাছ তাদের বয়স, ওই যে মাথার উপর উড়ছে সব চিল, এই যে আমাদের গায়ে ঠোকর মারছে কাঠ-ঠাকরা, কতো কীট-পতঙ্গঅমাদের কোটরে কোটার বাসা বেঁধে আছে, এদের বয়স মানুষের চেয়ে বেশি? তোমরা যেখানে সাথ চলে যাও, আমরা আছি, থাকবো। - দেখলো, তাদের গ্রামের আরো দুটো ছেলে ওই যে আগে আগে আমবাগান ছেড়ে পথে

নামলো। ও পেছন থেকে ডাকলো, মানু, লিয়াকত। ওরা দাঁড়ালে গিয়ে ধরলো। মানুর বাবা রেলে কাজ করেন, এখন আছেন খড়গপুরে।

জনাই জিজ্ঞেস করলো, কী মানু, তোমার আব্বা পাকিস্তান যাচ্ছেন না ? মানু বললো হারা তো যেতে চান, আমারও ইচ্ছা যাওয়ার, আরে, বলো কেন, মা-কে নিয়ে হয়েছে ল্যাঠা। ওঁর যে রয়েছে এখান সাতগুটি, কিছুতে যেতে রাজি হচ্ছেন না।

মোল্লা মানুষ। তিনি গ্রামের ছোট মসজিদটির ইমাম। লিয়াকত বললো, আে তেতো পাকিস্তানের নাম শুনতেই পারেন না। আবাই বললো, তো দেখি উল্টো ব্যাপার। আরে, মৌলভি সাহেবরাই তো

পাকিস্তান করলেন। লিয়াকত বললো, না আব্বা বলেন, পাকি সৃষ্টি করে আল্লার দুনিয়াকে ওরা ছোট করে নিয়েছে। ইসতান ছিল্যে সার হিন্দুস্তানে, এখন তাকে নিয়ে দিয়ে ঢোকানো হলো

পাকিস্তানের খোঁয়াড়ে। আব্বা বলেন, জিয়া আবার মুসলমান নাকি যে মুসলমানের দেশ গড়বে ? মানু বললো, আরে, তোর আব্বা দেখি মওলানা আজাদের চেলা। শোন্ বাপু, আমি

বলি, পাকিস্তান ছাড়া কোনো উপায় ছিলে না।

আবাই পরীক্ষা দিয়ে যখন শেষ বিকেলে ফিরছিলো, দেখে হিন্দুদের মেয়েরাও সার বেঁধে নহলার আমবাগানে নামছে। সায়াহ্নের কোমল ছায়ায় মেয়েরা কোমল পায়ে এই রকম সার বেঁধে আমবাগানের গভীরতর ছায়ায় গিয়ে প্রবেশ করলে আমাদের বাংলাভাষায় তাকে কী বলে কে জানে। রবীন্দ্রনাথ বলাকার কথা বলেছেন। বলাকা ওড়ে আকাশে। এদের যদি আমি ধরো, ললাকা বলি, কেউ কি আমাকে বড্ড বেশি ঠাট্টা করবে ? কেন, নলনা থেকে ললাকা হয় না?

মেয়েগুলির কয়েকজনের চিবুক পর্যন্ত ঘোমটা। কিন্তু ঘোমটা টানলেই যে দেহের ঢেউ স্তব্ধ হয়ে যাবে এমন কোনো কথা নেই। এই ঘোমটাবতিরা হচ্ছে অন্য গাঁয়ের মেয়ে, এই গাঁয়ে বউ হয়ে এসেছে। আর যারা এই গাঁয়ের মেয়ে, অনূঢ়া কি বাপের বাড়ি বেড়াতে আসা, তাদের ঘোমটার বালাই নেই, বরং বহু করে বাধা কেঁপাগুলোকে বেন তারা দেখার জন্যেই খোল ধরেছে, যেমন করে বেদে ঢাকনা খুলে তার ভুজঙ্গের ঝাঁপি মেলে ধরে। আবাই একজনকে চিনলো । পাঠশালায় একসঙ্গে পড়তো। বুকের ভেতরটায় তার কেমন মায়া ছলছল করে উঠলো। কোথায় কোন গ্রামে কার ঘরের বউ চলে গেছে কে জানে। সিথিতে সিঁদুর বড় বেশি জ্বলজ্বল করছে। অল্প বয়েসি বিধবাও দু'এক জন আছে, ওদের অঙ্গের থান দেখলে বোঝা যায়। ওই ললাকার আসল কৃত্য কী আবাই জানে। কিন্তু কয়েকজনের কাঁখে পিতলের ঝকঝকে কলসিও আছে। যাওয়ার বেলা ওই পুকুর থেকে জল ভরে নিয়ে যাবে।কিন্তু আবাই ততোক্ষণে অন্য কথা ভাবছে। হ্যা, আমি দেশান্তরি হবো? এই এরা থাকবে, আমি চলে যাবো? আমি কে? ওরা কারা? আমি দুসলমান। ওরা হিন্দু। পৃথিবীতে কেউ মুসলমান, কেউ হিন্দু এ তো হবেই। পৃথিবীতে নানা কিছু আছে। হিন্দু মুসলমান আছে, আকাশ আছে, মাটি আছ, আনো আছে, আছে নি আছে। কেন মানুষেরই মাঝে স্বর্গ-নরক, মানুষেতে সুরাসুর। ওই যে বলাকার মতো লালকা মেনে দিয়ে মিলিয়ে গেলো নহলা বাগানের গাছের আড়ালে, আমি কবি হলে বলতাম, ও-ও নিসর্গের অংশ। হায় • নীতি আমার পরিচিত নিসর্গ থেকে যাবে, আমি থাকবো না।

আবাই বিচিত্র অনুভূতি নিয়ে নহলার বাগান থেকে মাঠে নামলো। এই এদিকে ওদের গ্রাম বাবলার কোল জুড়ে কেবল আমনের জমি। বছরে ওই এক ফসল আমনই হয়। পূর্ব পশ্চিান এতো বড় যে মাঠ সব এক ফসলি জমি, কারণ নির্ভর সেই বর্ষার বৃষ্টি। কিন্তু এখানে অনেকখানি জমিতে রবি ফসলের আবাদ হয়েছে। সড়কের তলা দিয়ে একটা নালা চলে এসেছে এইদিকে। ফুটবল-মাঠের পাশে রয়েছে নেচের বড় কুরটি। ওখান থেকে দোন দিয়ে পানি তুলে পাঠানো হচ্ছে এই নালা দিয়ে। তাতেই অনেকগুলো জমি সবুজ হয়ে উঠেছে, চোখ জুড়িয়ে যায়। রয়েছে আলু, ছোলা, সরষে। আর সব ক্ষেত্রেরই এখানে-ওখানে থোক থোক ধনে পাতা।ছোলার ঝাড়গুলো দেখে লোভ হচ্ছিলো। একমুঠো উপড়ে নিতে ইচ্ছে করছে। শক্ত খোলের মধ্যে রয়েছে সব ছোলার নরম সবুজ দানা। দাঁত দিয়ে খোলা ভাঙলে ঠোঁটে টক স্বাদ, লাগে। বেশ লাগে। কিন্তু পরের জমি। অদূরে লোকজনও রয়েছে, ক্ষেতে কাজ করছে। লোভ সামনে এগিয়ে যায়।

তখন দেখে একটা আলু আর একটা ছোলার ক্ষেতে পাশাপাশি কাজ করছে ওদের গায়েরই ক'জন লোক। এদের কেউ মুনির অর্থাৎ ক্ষেতমজুর, কেউ বর্গাদার অর্থাৎ ভাগে ভদ্রলোকের জমি চাষ করে। ওদেরই একজন গলা চড়িয়ে বলে উঠলো কী গো, আবাই মিয়া, এতোক্ষণে আপনার ইশকুল শেষ হলো?

আবাই দাড়ালো। বললো, হ্যাঁ আজ টেস্ট পরীক্ষা শেষ হলো। এবার ম্যাট্রিক দেবো কিনা। তোমরা দোয়া করো, বুঝলে রমাই-চাচা?

রমাই চাচা লোকটা আধ-বুড়ো। পাতলা ছিপছিপে দেহ, কাঁচাপাকা চালা খানিকটা

দাড়ি রয়েছে। বললো, আরে, বড়-মিয়া, সে-কথা বলতে হবে? দোয়া আমরা সব সময় করি। কিন্তু হ্যাঁ, বুঝলেন কিনা, একটা আবদার আছে।

কি?

খালি ম্যাট্রিক পাস দিলে চলবে না, হ্যাঁ, বি-এ গান দিতে হবে। ওই যে কাগ্রাম,তালিরপুর, ঘরে-ঘরে কতো আই-এ বি-এ পান। আমাদের বাবলা গাঁয়েরও নাম ছড়িয়ে দিতে হবে।

তখন আবাই বললো, ও রগাই-চাচা, এদিকে যে পাকিস্তান হয়ে গেলো গো! মুসলমানের দেশ পাকিস্তান।রমাই-চাচা উঠে দাড়ালো। কোমরে রয়েছে কেবল নেংটিটি। একটা গামছা জড়ানো ছিলো কোমরে। সেটি খুলে গায়ে জড়ালো। ঠাণ্ডাটি বুঝি এতোক্ষণে টের পেেেয়ছে। সে বললো, মুসলমানের দেশ পাকিস্তান??

আবাই বললো, হ্যাঁ।

রমাই চাচা জিজ্ঞেস করলো, শুনেছি তো আমরাও, কিন্তু সেটা কোন দিকে বলেন দেখি আবাই মিয়া ?

খানিকটা আছে আমাদের এই পূবদিকে, আর খানিকটা আছে পশ্চিমে, অনেক দূরে।

রমাই-চাচা আবার জিজ্ঞেস করলো, গঙ্গাপারের ওই দিকে নাকি ? আবাই বললো, না ঠিক গঙ্গা না, গঙ্গা তো গেছে মুর্শিদাবাদের মাঝখান দিয়ে। পদ্মার  ওই•

পারে।

রমাই-চাচা বললো, ওই হলো তোমার একই কথা।

আবাই বললো, কিন্তু আমাদের এই দেশ হয়ে গেলো হিন্দুস্থান। হিন্দুর দেশ হিন্দুস্থান।

রমাই-চাচা বললো, হিন্দুর দেশ হিদুক্ষণ।

কেন গো, এ-দেশে মুসলমান থাকবে না? মুসলমান যাবে কোথা? আমাদের বাবলায় হিন্দুই নাই, সব মুসলমান, তারা সব যাবে কোথা ? আবাই বললো, যে থাকতে চায় সে হিন্দুস্থানে থাকবে, যে যেতে চায় সে পাকিস্তানে যাবে।

রমাই-চাচা বললো, বেশ, তাহলে তো ভালো কথা। আবাই জিজ্ঞেস করলো, তোমরা কী করবে বলো দেখি, চাচা?

রমাই-চাচা বললো, না বাপু.. আমরা কোথাও যাবো না।

কিন্তু আমরা যে যাওয়ার কথা ভাবছি। রমাই-চাচা অবাক হয়ে বললো, বলেন কী গো, আবাই মিয়া ?

আবাই বললো, হ্যাঁ। কী করবো বলো। কষ্ট করে লেখাপড়া করছি। এখানে চাকরি

জুটবো না।

রমাই-চাচা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো, বললো, হায় রে খোদা, কী জমানা পড়লো। আবাই বললো, ও চাচা, কিন্তু পাকিস্তান তোমরা যাবে না কেন? সেটা মুসলমানের দেশ না?

তখন কুদ্দুস উঠে দাড়ালো। বললো, ও আবাই-মিয়া, আমরা কি চাকরি করি, না জমিদারি করি যে পাকিস্তানে যাবো? যে যাবে সে যাবে, এই জমি কি পাকিস্তানে যাবে ?

সে হঠাৎ ছেট হয়ে আলুর কেয়ারি থেকে একমুঠো ঘুরো ঘটি তুলে দেখালে, তারপর

সেগুলো ফেলে দিয়ে পাছার গামছায় হাত মুছলো। বললো, এই মাটি পাকিস্তানে যাবে ?

আবাই বললো, আচ্ছা, চলি।

বনে সে চলে এলো।

আবাইয়ের বুকের ভেতর দ্বন্দ্ব চললো, চলতে থাকলো। পাকিস্তান যাবে কি যাবে না। নিজের সঙ্গে নিজের তর্ক হয়। কখনো পাকিস্তান জেতে, কখনো হিন্দুস্থান। যখন হিন্দুস্থান জেতে তখন সেটাকে সে আর হিন্দস্থান বলে না, বলে, স্বদেশ। ওই স্বদেশপ্রেম তার মাঝে মাঝে বড় প্রবল হয়ে ওঠে। সবচেয়ে বড় কথাটা হচ্ছে, মা হন না রাজি। মূর্খ মানুষ, হায়, তিনি পাকিস্তান ব্যাপারটার মানেই বুঝতে পারেন না।

- আবাইয়ের ম্যাট্রিক পরীক্ষা হয়ে যায়। পাশ করে। বলে, মা, এখনো সময় আছে, বলো পাকিস্তানে যাই।

মা বলেন, না।

ম্যাট্রিক পাশ বলে কথা। বড় উৎক্রাত্তি। ভাইগুলোকে ডেকে সে ভোট লাগিয়ে দেয়। বলে, বল কে কোন দিকে? পাকিস্তানে যাবি, না হিন্দুস্থানে পড়ে থাকবি ? পাকিস্তান জেতে। কিন্তু তবু মা বলেন, না। বলেন, হ্যাঁ রে বাপ, হিন্দুদের সঙ্গে বলছিস বিনিময় করবি। আমার এইসব ঘর-বাড়িতে এনে তার উঠবে, কোথাকার কোন দেশের

মানুষ, হিন্দু, আচ্ছা, না হয় উঠলো, না হ্যা হলো হিন্দু, হিন্দুরাও মানুষ, আল্লাই তাদের বানিয়েছেন, তোর চোৎ-পুরুষের কবর আছে কবরস্তানে, তারা হয়তো সেগুলোর বেইজ্জতি

করবে, হ্যাঁ রে বাপ, পাকিস্তানে গিয়ে সুখী হতে পারবি? তোদের উপর তাঁদের লা'নং পড়বে না ? বল ? আরাই তখন বহরমপুরে গিয়ে কলেজে ভর্তি হয়।

আবাইয়ের দুই মামা। এই বাবলাতেই তাঁদের বাড়ি। বড়-মামা বড় অফিসার। তিনি প্রথমে একটু অন্যরকম ভেবেছিলেন, অর্থ, চোদ্দ-পুরুষের ভিটে, জমি-জিরেত, আত্মীয় পরিজন, চেনাজানা মানুষ, সব ফেলে যাওয়া। কিন্তু তারপর হঠাৎ মন শক্ত করে চলে গিয়ে ওখানে ঢাকায় চাকরিতে ঢুকে পড়লেন। তাঁর বড় ছেলেটাও গেলো, প্রথমে, তারপর আর ... সবাই গেলো। ওদিকে ঢাকায় আটচল্লিশ সালে হলো ভাষা আন্দোলন। ওর সেই মামাতো ভাই খুব একখানা বাংলাভাষার আবেগ আর দরদ-মাখানো চিঠি লিখেছিলো আবাইকে । আৰাই সেই চিঠি পড়ে কেমন একরকম করে হাসলো। বললো, আরে দূর, এক বাংলা থেকে যাবো আর-এক বাংলায়। আরে, কিসের তোমার ভারত-পাকিস্তান। আমি ভারতে থাকলেই কি ভারতীয় নাকি? আর পাকিস্তানে গেলেই কি পাকিস্তানি নাকি। ইদানীং কলেজে ভর্তি হয়ে সে রাষ্ট্রতত্ত্বের প্রতি কিঞ্চিৎ আগ্রহী হয়েছে। স্বপ্ন দেখছে রাষ্ট্রতয়ে অনার্স পড়বে, এম এ. পড়বে। সে বলে, এখন জাতিতত্ত্বের মীমাংসা কে করে দেবে দাও। পাকিস্তান যদি মুসলমান রাষ্ট্র হয়, ইসলামে তো জাতিতত্ত্ব নাই। মুসলমান হচ্ছে বিশ্ব নিৰিল জাতি। তাহাল লাহোর প্রস্তাবের আন্দোলন একটা শুরু হতে ওখানে বাধ্য।

আই.এ. পরীক্ষা দিয়ে মা কে বললো, মা, তুমি কি ভেবেছ পাকিস্তান খুব দূরে? এই তো রাজশাহী। একবার ঘুরে আসি। তুমি থাকো।

ঘুরে হোর মায়ায় জড়িয়ে গেলো। ফরিদপুর থেকে কই আসে এই ভাতা বড় বড় ঢাকার বাজারে! ভাবে এই কই মাছকে কতো ত্যা করতাম এই সেদিনও। কিন্তু কই মাছতে হবে- চিবিয়ে। এতে জানতে হয়। এর ভাইগুলো এক এক করে কা আসছিলো। মা সেই বাংলার পত্নীতে বসে ধূসরচোখে সন্ধ্যার আকাশের দিকে তাকিয়ে বলেন, তোরা থাক।

যখন ঊনিশশ' বাছন্ন সালের একুশে ফেব্রুয়ারি মেডিক্যাল কলেজের হোস্টেরোন বারান্দায় পুলিশের রাইফেলের গুলি অফ আঘাত করেছিলো, একটু রুষ্ট হয়েছিলো। কিন্তু এখন সে সুখেই আছে। না আজিমপুরের বাধানো কবরে নয়, বাংলার মানুষের হৃদয়ে, তাদের বিপ্লবে, স্মৃতিতে আর কল্পনায়।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ