Hot Posts

6/recent/ticker-posts

ভাষা আন্দোলন ভিত্তিক গল্প ভাষা আন্দোলনের গল্প আরো কিছু রক্ত আবুল হাসানাত এর একুশের গল্প

 


**আরো কিছু রক্ত

-- আবুল হাসানাত


স্বপ্ন একটু একটু করে ভেঙে যাচ্ছে। কেন ?(আলী দিশে পায় না। তার খুব খারাপ লাগছে, এ-কথাটি সে জোর দিয়ে বলতে পারে মাত্র। এর বেশি নয়। কারণ অনুসন্ধানে ব্রতী হতে হলে তার মন আরো খারাপ হয়ে যাবে, কারণ মন খারাপের কারণগুলো তার কাছে পষ্ট নয়। অথচ এই কয়েক বছর আগেও সে আরব দেশের ঘোড়ার মতো তাজা, প্রাণবন্ত ও উৎফুল্ল ছিলো। পূর্ব বাঙলার নওগায়ে তার জন্ম হলেও বরাবর তারা কলকাতায় মানুষ। আলীর বাবা কলকাতায় চাকরি করতো। দেশ ভাগের পর পাকিস্তানে এসেছে। তখন আলী কলেজের ছাত্র মাত্র। ঢাকা, জেলা শহর, রাজধানী হয়েছে। কী ভালোই না লাগতো তার। কলকাতাকে অর মনে হতো ইটের স্তূপ, আর ঢাকাকে মনে হয় গাছের ছায়া। সেই ঢাকা আস্তে আস্তে কেমন যেন বদলে গেলো। শহর বড় হলো। কাজ বেড়ে গেলো। আলীর বাবার পদোন্নতি হলো। কিন্তু রাজনীতি হলো জটিল। পাকিস্তানের নেতাদের রকমসকম তার ভালো লাগলো না। বিশেষ করে ভাষার লাশ জিন্নাহর বানী লিয়াকতের খোলা, নাজিমউদ্দিনের রক্তরা তাঁর তরুণ মনে প্রচণ্ড আঘাত দিলো, সৃষ্টি করলো বিরূপতা এবং এক ধরনের ঘৃণা উচ্চারিত হলো নেতাদের বিরুদ্ধে। 

কলা বিভাগের এক পাশে দাঁড়িয়ে ছিলো আলী। সময়মতো (মমতা কখন তার পাশে এসে দাড়িয়েছে সে টের পাইনি। মমতা দাঁড়াত কতকগুলো উৎসুক চোখ তাদের দিকে চোখ ফেরালো। এ-সময় ছাত্রীর সংখ্যা বেশি ছিলো না, কিছুসংখ্যক ছাত্রী তারা আবার সহজে কারোর সঙ্গে মেশে না—তাই মমতার, আলীর মেশামেশি অনেকেরই দৃষ্টি আকর্ষণ করে। আলী অবশ্য কিছুই ভাবে না। কারণ, কলকাতায় পড়তে তার সঙ্গে বেশ কয়েকটি মেয়ের আলাপ হয়েছিলো, অনুপমার সঙ্গে তো বন্ধুত্বই হয়েছিলো, সেই অনুপমা, সে চলে যাবে বলে হাত চেপে ধরে বুকে মাত্র রেখে কাদতে বসতে কতোবার বলেছিলো, আলীনা, তুমি চলে যেও না। তুমি থাকো। আমাকে ছেড়ে তুমি যেতে পারছো? আলী পেরেছে। তখন সে পাকিস্তানের স্বপ্নে বিভোর। সেই স্বপ্ন বাস্তব রূপ নিয়েছে। এখন দেশ গড়তে হবে, স্বপ্নের দেশ। তার সময় কোথা। পিছুটানের তো স্থান নেই।

মমতা বললো, কী ভাবছো? চলো-- সানী অপ্রস্তুত হাসি হাসে।কিন্তু মমতাদের ওয়ারীর ছবির মতো সুন্দর বাসায় এসে সে শাস্তি পায় না : সুস্থির হতে পারে না। কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ে সিরাজ ভাইয়ের সঙ্গে তার সামান্য কথা হয়েছিলো, তাতে সে জানতে পারে ঝড় আসছে, বড় রকমের ঝড়। ভাষার ব্যাপারে ছাত্র নেতারা খুব কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে চলেছে। সিরাজের সঙ্গে আলীর দেখা হয় না বললেই চলে, কারণ, সে একটি তপ্ত দলের প্রভাবশালী সদস্য। আলী সব কথা পরিষ্কারভাবে জানতে চাইলে সিরাজ বলেছিলো, আমাদের দাবি, রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই। আমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। পশ্চিম পাকিস্তানে অনেকগুলো ভাষা আছে, সিন্ধি, পাঞ্জাবি, বেনুষ্ঠি, পশতু কী করবেন আপনারা?

আমরা মিটিং করছি। বৈঠক হচ্ছে। এই ফেব্রুয়ারিতেই বড় ধরনের আন্দোলন হবে। তোমরা তৈরি থেকো, আলী। আমাদের 'লেট ডাউন' করো না।

সিরাজের কথাগুলোই তার মনের মধ্যে তোলপাড় করছিলো। মমতাকে শেষ পর্যন্ত সে "সব কিছু বললো।

<সমতা বললো, ভাষার প্রশ্নে সব ছাত্রই ঐক্যবদ্ধ। আমার ছোট খালা ইডেনে পড়ে। বললো, যাত্রীরা খুব গরম। তাই। এখন রাজনৈতিক নেতাদের সমর্থন পেলে হয়।

তারা দেবে। নেতৃত্ব রাখতে হলে সমর্থন না দিয়ে উপায় নেই। তবে জনসাধারণকে সাথে

নিতে হবে।

অবশ্যই। তাদের সঙ্গে না নিলে কোনো বড় কাজই হতে পারবে না। 

একটু থেমে সে যোগ করলো, জনগণও ভাবশ্য গরম। কারণ পাটের দাম বেড়েছে, কিন্তু তার বেনিফিট তারাপাচ্ছে না। চালের দাম বেড়েছে। গ্রাম-গঞ্জে কেরাসিন তেল পাওয়া যাচ্ছে না।

অথচ সরকার দিনের পর দিন সপ্ন দেখিয়ে চলেছেন। স্বপ্ন যে ঘুমের ঘোরে হারিয়ে যায় সে হয়তো জানো না।

এই ধরনের কথা বলতে বলতে হঠাৎ এক সময় তারা দুজনই থেমে যায়। তাদের যেন কোনো কথা নেই। সব কথা যেন শেষ হয়ে গেছে। এখন যেন মুখোমুখি বসবার সময়— কোনো কথা নয়—কিন্তু হৃদয়ে বাণী উভয়ে বুঝবে। বুকের ঢিবঢিব তারা শুনবে।

এভাবে কতোক্ষণ যেতো কে জানে। এক সময় মমতা বললো, রাজনীতি নিয়ে খুব মেতেছো তুমি, সামনে ফাইনাল পরীক্ষা। তা কী মনে আছে? 

আছে। বেশ।

তারপর ওর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে মমতা বললো, আমার কথা কী মনে আছে?

তা কী ভোলা যায়।

মিথ্যে বলবো কেন ?

তাই তো। মিথ্যে বলবে কেন। আমি যে কখন কী বলি। তারপর মৃদু হেসে বললো, তোমাদের কারো আপত্তি থাকবে না তো?

আপত্তি কিসের?

এই আমাদের—

কী

যাও—

ও বিবাহ কপালকুণ্ডলা...

উভয়ের সম্মিলিত হাসি-হাসি নয় যেন সুরের মূর্ছনা।

—মুসলিম লীগ নেতৃত্বের গোয়ার্তুমি ও হঠকারিতা শেষ পর্যন্ত সংঘাতের মুখোমুখিতে ঠেলে দিলো ছাত্রসমাজকে। তারা ক্রমশ উগ্র, বেপরোয়া ও সাহসী হয়ে উঠলো। নেতা, শিক্ষক, ছাত্র, অফিসার, কেরানি, উকিল-এডভোকেট ব্যারি টার সবাই মুখিয়ে উঠলো। রাষ্ট্রভাষা -- বাঙলা চাই—এই একটাই দাবি। এবং তা মানতে হবে। এই ভাষা নিয়ে আপোষ করার কিছু নেই।

বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলা গরম। সরকার ১৪৪ ধারা চালু করেছে। ছাত্রেরা তা ভাঙতে বদ্ধপরিকর। এ অবস্থায় যা হয় তাই হলো—'কনফ্রন্টেশন'। এক সময় এক ঝলক সিরাজকে দেখতে পেলো আলী। সে খুব ব্যস্ত। দৌড়াদৌড়ি করছে। একে-ওকে তাকে কি যেন নির্দেশ দিচ্ছে।

আমতলা গরম। মনে হয় হাজার খানিক সূর্য জ্বলছে। চিৎকার, আর স্লোগান। এক সময় সুর্যঙ্খল সৈনিকের মতো কয়েকজন কয়েকজন করে ছাত্রেরা ১৪৪ ধারা ভেঙে বিশ্ববিদ্যালয়ের গেট পেরিয়ে বেরিয়ে যেতে থাকলো।

এক সময় গর্জে উঠলো বন্দুক। যুক্তিতে হেরে গেলে শাসকেরা শক্তিই প্রয়োগ করে। ) গুটিয়ে পড়লো অনেকের সাথে আলী। মৃত্যুর আগে তার গর্জন : রাষ্ট্রভাষা বাঙলা চাই।

মমতার কাছে খবর পৌঁছতে দেরি হলো না। সে যেন শেষের কয়েকদিনের আলীর ব্যবহারে আচ করতে পেরেছিলো সামনে ভয়াবহ দিন। সে কাঁদতে পারলো না। শোকে সে পাথর হয়ে গেলো। এক সময় সে ডাক্তার বাবার হাত ধরে বেরিয়ে পড়লো লাশের সন্ধানে। লাশ দেবে না ওরা। গোপনে কবর দিয়ে দিয়েছে। মমতা যেন জানতো এমনটিই হবে, সে শক্ত হলো, লাখো আওয়াজের সঙ্গে সে আওয়াজ তুললো, রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই।

সে দেখলো চারিদিকে সমুদ্র-জনতা। ফুঁসছে। গজাচ্ছে। তীরে এসে আছাড় খাচ্ছে আবার ফিরে যাচ্ছে। তারপর দ্বিগুণ বেগে ধেয়ে এনে আছড়ে পড়ছে বেলাভূমিতে, ফেনা উঠছে, ভীষণ শব্দ হচ্ছে, কেঁপে উঠছে সমুদ্র-সৈকত।

মমতা ভাবিয়ে দেখে, চারদিকে শত শত হাान ভা সৈনিক---তোৱা প্ৰগ দেওয়ার জন্যে উদগ্রীব ভাষাকে তার মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করবেই করবে।

ক্ষমতা দৃপ্ত পদক্ষেপে পা বাড়ায়।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ