Hot Posts

6/recent/ticker-posts

ভাষা আন্দোলন এর গল্প দৃষ্টি গল্প আনিসুজ্জামান এর একুশের গল্প ভাষা আন্দোলন ভিত্তিক গল্প

**ভাষা আন্দোলন এর গল্প   দৃষ্টি গল্প আনিসুজ্জামান এর একুশের গল্প ভাষা আন্দোলন ভিত্তিক গল্প 

**দৃষ্টি 

আনিসুজ্জামান  


*পঁচিশ বছর কেরানিগিরি করলে চোখের আর কি শক্তি থাকে! তাছাড়া, চোখ খারাপ অনেক দিনের। চশমা নিয়েছিলেন সেই যখন ক্লাশ সেভেনে পড়তেন। সেদিন রাত্রে ঝড়ের সময় জানালার ছিটকিনি খুলে কপাটটা ধাক্কা দিলো টেবিলটায়। টেবিলের ওপরে রাখা মোটা লেনসের চশমাটা টেবিল থেকে পড়ে গেলো নিচে। খান দুই ইঁট দিয়ে তক্তপোষটা উঁচু করা ছিলো। চশমাটা সাতা দিয়ে বেঁধে পরা চলতো, কিন্তু দৌড়ে আসতে গিয়ে পালেহা পা চাপিয়ে দিলো তার ওপর।

আরেকটা যে কিনবেন, সে ভরসা সাদত সাহেবের আছে। তবে কবে সে প্রশ্ন অবাস্তব। কারন, পেনসনের টাকা ঠিকমতো পাচ্ছেন না। (আসাদ) যা মাইনে পায় তাতে সংসার কোনোমতে চলে। সালেহার বিয়ে দেওয়া দরকার, কিন্তু এ অবস্থায় সম্ভব হচ্ছে না। আসাদের বিয়ে হয়েছে অবশ্য। আল্লায় দিলে একটা বাচ্চা হবে এবার।

চশমাটা ভেঙে যাওয়ায় বড় অসুবিধায় পড়েছেন সাদত সাহেব। চোখ না থাকলে মানুষের আর যেন কিছুই থাকে না। ঘর ছাড়া কোথাও বেরোন না—তাও ঘরের জিনিসগুলো যদি অস্পষ্ট হয়ে যায় তাহলে মানুষ বাঁচে কি করে। বোবা কথা না বলতে পারলেও দেখতে তো পায়, তিনি ভাবেন—আবার ভাবেন, চোখে দেখেই বা কি হয়, যদি কথা না বলতে পারা যার । চিন্তাগুলোকে ঠেলে দিয়ে সাদত সাহেব হাঁকেন, ‘সালেহা, একটা পান দিয়ে যা তো মা।"

পান নিয়ে আসে হাসিনা) আাসাদের বৌ। 'পান নেন' শুনেই বুঝতে পারেন সাদত সাহেব। বলেন, 'সালেহা কোথায় ?"

"আছে ঘরে।"

তাকে দিয়ে পাঠালেই পারতে। তুমি এ সময়ে কম না করে: মা।

**ভাষা-আন্দোলনের,একুশের গল্প ও মুক্তিযুদ্ধের আরো গল্প পেতে ব্লগটিতে যুক্তথাকুন   https://monoweredu13.blogspot.com/?m=1


স্নেহের এ অভিযোগ শুনে হাসিনা হাসে। ভারি ভালো মানুষ তার শ্বশুরটি। সে জান লি আণায় উজ্জীবিত হয়ে কথাগুলো বেরিয়ে এসেছে বুড়ো শ্বশুরের মুখ থেকে। অন্য কথায় আসে হাসিনা। বলে, 'চশমাটা আপনি কিনে নিলেই পারতেন। কিছু টাকা ঘরে ছিলো-- আর কিছু ধার করে, নামনের মাসে তা শোধ দেওয়া যেতো। সাণত সাহেব হেসে উত্তর দেনসময়ে ঘরে টাকা-পয়সা কিছু রাখা দরকার। পুরোনো লোকের অনেক সেবা করলে - এবার নতুন লোকটির যত্ন নিতে হবে।' হাসিনা চলে আসে।

সালেহা এলো এবার দৌড়ে। বললে, 'আষা, কি হয়েছে জানো ?'

মেডিক্যাল ফেস্টেলে রাষ্ট্রভাষার দাবিতে ছাত্রেরা বিক্ষোভ করছিলো। পুলিশ গুলি চালিয়েছে।

'গুলি।' সাদ সাহেবের কণ্ঠে অবিশ্বাসের সুর।

“হ্যা। কাদুনে গ্যাস খুঁড়ে লাঠি চালিয়ে, গ্রেপ্তার করেও কিছু হয়নি। শেষে গুলি চালিয়েছে। ছজন মারা গেছে।

'ছজন!'

“ছজন মারা গেছে, আরো আহত হয়েছে।'

'তোকে কে বললে ?

(বাচ্চু। ও এতোক্ষণ ছিলো সেখানে। গুলি চালাবার পর চলে এসেছে।' 'কি আশ্চর্য। সাদত সাহেব এতোক্ষণ তাঁর চেতনায় ফিরে আসেন। বৃটিশ আমল এরচেয়ে খারাপ কি ছিলো? এ কয় বছরে কম জায়গায় তো আর গুলি চলনো না। “আমাদেরকে কি বোবা হয়ে থাকতে হবে নাকি। সালেহার গলার স্বর ঝাঁঝালো হয়ে ওঠে। সে ঘর ছেড়ে চলে যায়।

রুদ্ধ ঘরে সাদত সাহেব ভাবতে থাকেন, মানুষ থাকার অনুপযুক্ত হয়ে উঠছে যেন

দুনিয়াটা, আরো নানান কথা । সম্ভাবনার মাঝে আসাদ এসে পড়ে। আবার তিনি জিজ্ঞাসা করেন : 'সত্যিই ছ'জন মারা

'হ্যাঁ'। আসাদ অবসন্নভাবে বলে।

বৃদ্ধ আবার চিন্তায় ডুবে যান।

ঘুম থেকে উঠেই সাদত সাহেব খোঁজ নেন আসাদের! হাসিনা বলে, ‘অফিসে চলে

'এতো সকালে!'

'সকাল আর কোথায় ! আল শুক্রবার, সকালে অফিস।'

সত্যিই, সকাল আর কোথায়! উঠতে দেরি হয়ে গেছে তাঁর। রাইফেলধারী, সৈন্যদের মন পদশব্দ কান অনেক রাত জেগে শুনেছেন তিনি। চা নিয়ে এসে সালেহা বলে, ইয়াদের অফিসে আর্দ্র ধর্মঘট হতে পারে। ভাইয়া বললে যদুর সম্ভব চেষ্টা করবে। কিন্তু উইন্ডোর যদি চাকরি চলে যায়, আব্বা ! গভীর আশায় ভর করে কথা বলতে গিয়েও

সালেহার  মনে আছে প্রচ্ছন্ন হতাশা।

সাদত সাহেব অন্যমনস্কভাবে বলেন, 'না চাকরি করা যাবে না।' তবু কথাটা তাকে আরও এটা ভাবিত করে তুলে। ভাবনার কি আর শেষ আছে মানুষের।পথ-ঘাট নিস্তত্ত্ব। গাড়ি-ঘোড়ার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে না - আজ সব বন্ধ। চারজনের বেশি লোক এক সাথে চলছে না। সব তাই কেমন মৃত্যুর মতো স্তব্ধ। কিন্তু মৃত্যুর শান্তি নয় : একটা চাপা উত্তেজনায় কাপছে সারাটা শহ

মৃত্যুর কথায় নিজের মৃত্যুকে মনে পড়ে যায় বৃদ্ধের। তিনি ঘরে যাবেন, তারপর কে থাকবে? হয়তো মা সাদও যাবে। কে রইবে তখন? আসাদের ছেলেমেয়েরা? নিজেকেই উত্তর দেন। নিশ্চিত্তও হন কিছুটা খানিকটা ভরসাও খুঁজে পান সে অনাগত উত্তরাধিকারের চিন্তার যেন। তাঁর সঙ্গীর রক্তের উচ্চতায় বৃদ্ধের হিম হয়ে আস। বুকটাও উষ্ণ হয়ে ওঠে।

কে যেন কড়া নাড়ে। সালেহাকে ডেকে দেখতে বলেন তিনি।

দরজা খোলার আওয়াজ পান। সালেহা বলছে, 'কি খবর হালিম ভাই?" উত্তরটা তার শুনতে পা না তিনি। হালিম ছেলেটা আসাদের সাথে চাকরি করে, কাছেই থাকে। কি ব্যাপার!

কয়েকজনের পদশব্দ শুনতে পাওয়া যায় পাশের ঘরে। হাসিনা আর সালেহা ডুকার কেঁদে ওঠে। সাদ সাহেব বলেন, 'কি হলো সালেহা, — হাসিনা — তক্তপোষ থেকে পা নামিয়ে চটি পায়ে দেন। চন্দ্রমা নেই, এগুতে পারছেন না। সালেহা এ ঘরে আসে। কাঁদতে কাঁদতে বলে, 'ভাইয়ার গুলি লেগেছে—মারা গেছে। এবার থেমে থেমে হালিমের গলা শোনা যায় ‘অফিস স্ট্রাইক হয়ে প্রোসেশন বেরিয়েছিলো— পলিশ গুলি চালায়। সঙ্গে সঙ্গে মারা যায় ও। হাসপাতালে দিলে লাশ যদি না পাওয়া যায়, সেই ভেবে ডাক্তারখানা নিয়ে গিয়েছিলোম। সেখান থেকে নিয়ে এসেছি।

সালেহা সাদত সাহেবকে ধরে এ ঘরে নিয়ে আসে। সে কাঁদছে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে। হাসিনা আছড়ে পড়েছে মৃতদেহের ওপর! কাঁদছে। কাজের পেটের বাচ্চাটা বুঝি হঠাৎ নড়ে উঠলো..

সাদত সাহেব এতোক্ষণে কাঁদতে থাকেন। মৃতদেহের ওপর হাত বুলাতে থাকেন তিনি। দেখবার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করতে থাকেন। 'আমি কিছুই দেখতে পাচ্ছিনে। আসাদ কোথায় রে? আমি কিছুই দেখতে পাচ্ছিনে। কিছু বল ঝাপসাই হয়ে যাচ্ছে তাঁর— অস্পষ্ট বেড়েই চলেছে। মনে হচ্ছে এ অস্পষ্টতা আর কানোদিন দূর হবে না, আর কোনোদিন দেখতে পাবেন না কোনোদিন না? হাসিনার বাচ্চাটাকেও কি দেখতে পাবেন না?

হাসিনার হওয়া বাচ্চার চেহারাটা মনের ভেতর আঁকতে থাকেন, দেখতে ন প্রাণপণে। কান্নাটা জেল আসে আস্তে আস্তে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ