একুশের সেরা গল্পঃ-
ভাষা আন্দোলন এর গল্পঃ-
**মায়ের দ্বিতীয় বিবাহ
পূরবী বসু
আগস্ট ১৯৯৭
আজ থেকে ঠিক পঞ্চাশ বছর আগে আমার মা আবার বিয়ে করে। তখন ভরা বর্ষা। আকাশে প্রচণ্ড ঘাঘটা। পুকুর নদী নালা একেবারে টইটুম্বুর। নববধূর সাজে আবার নতুন করে সাজনো আমার মা। সানাই বেজে উঠলো। আতসবাজি ফুটলো আকাশে। আলোয় ঝলমল করে উঠলো বসতবাড়ি। সবুজ আর শাদা কাপড়ে শোভিত হলো প্রবেশ পথের উত্থিত দ্বার।
এটা মায়ের দ্বিতীয় বিয়ে। তাঁর প্রথম স্বামী আমার জন্মদাতা পিতার সংসারে সুখ পায়নি মা। পিতৃপরিবারের কৌলীন্য আর ব্রাহ্মণত্ব মাকে প্রতিনিয়ত বিব্রত করেছে। তবু এই ছাড়াছাড়ি চায়নি অনেকেই। ধরা যাক চিত্তজেঠুর কথাই। দুপক্ষকেই কম বুঝিয়েছে সে। কেসলুন চাচার সঙ্গে পরামর্শ করে সমঝোতার মাধ্যমে ঘরটা টিকিয়ে রাখার কতো চেষ্টাই না করেছে। চিত্তজেঠু মারা যাবার পরও ক্রমাগত চেষ্টা চালিয়ে গেছে শরু কাকু হাশিম মামা। কিন্তু মা অনড়। অবিচলিত তার সিদ্ধান্তে। অবশ্য মাকে উৎসাহ দেবার লোকেরও অভাব ছিলো না। যেমন মনসুর মামা, ইব্রাহিম মাস্টার, নাজিম খালু। তারা মাকে বোঝাতো, এই অবহেলা-অপমান থেকে মুক্তি পাবে মা। রাজরানী হয়ে থাকবে সে নতুন সংসারে।
সম্ভ্রান্ত ধনী পরিবারেই বিয়ে হয়েছিলো মায়ের। আমি তখন খুব ছোট। অন্য ভাই বোন দুটো আমার চাইতে কিছু বড়। মা ও তার নতুন স্বামী অর্থাৎ আমাদের নতুন বাবার সঙ্গে চলে এলাম তার নতুন বাড়িতে। প্রথম প্রথম নতুন পরিবেশে সব কিছুই অন্য রকম লাগতো। তারপর আস্তে আস্তে ভালো লাগতে শুরু করলো। দেখলাম ফজলুল চাচার কথাই ঠিক। এখানকার গ্রামীণ লোকজন বড় সহজ সরল আন্তরিক, বড় প্রাণখোলা।
**ভাষা-আন্দোলনের,একুশের গল্প ও মুক্তিযুদ্ধের আরো গল্প পেতে ব্লগটিতে যুক্তথাকুন https://monoweredu13.blogspot.com/?m=1
সময় কেটে যাচ্ছিলো একরকম পদ না। শুধু খারাপ লাগতো, কষ্ট হতো, যখন বাড়ির সকলে আমার বাবার পরিবারের নিন্দা করতে গিয়ে আমাদের প্রতিও তুচ্ছতাচ্ছিল্য দেখাতে শুরু করলো। কীরকম কঠিন, নিষ্ঠুর ও অবিবেচকের মতো মন্তব্য করতো সকলে। তার পরা এরকম, তোমার মায়ের বিয়ে হয়েছে, সে এখানে এসেছে বাড়ির বউ হয়ে, ভালো কথা। তোমরা বাপু আবার কেন এলে? আসলে যে কেন এলাম আমরাও জানি না। বাবার বাড়ির কেউ কি ছাড়তে চেয়েছিলো আমাদের ? না, একরকম জোর করেই চলে এসেছি, মাকে যে বড় ভালোবাসি আমরা। তা আমাদের অবহেলা করে করুক, কিন্তু ব্যাপারটা যে সেখানেই সীমাবদ্ধ রইলো না। এক সময় নতুন বাবা ও মায়ের ওপর অত্যাচার শুরু করলো। মনে মনে ভাবলাম, মাগো, বিয়ে যখন আবার করেইছিলে, একজন ব্রাহ্মণকে পড়ে গোত্রীয়ই যখন বেছে নিয়েছিলে, কেন একবার দেখে নিলে না সে তোমারই তারা রা বলে কিনা। তোমরা যে গুরস্পরের মুখের কথা পর্যন্ত বুঝতে পারো না। তোমার প্রতি কোনো শুভ বোধই নেই তার। নিজের সংসারে না আছে তোমার একফোঁটা কর্তৃত্ব, না আছে এতোটুকু নিয়ন্ত্রণ। তোমার অতীত জীবন নিয়ে যখন তখন নিষ্ঠুর কটু মন্তব্য করে সে। তোমার সাথে হাত তোলে পর্যন্ত। এ বিয়ে টেকে কী করে?
নিজের খানদানি ও ভাষার গরিমায় সবসময় বিভোর হয়ে থাকতেন আমার নতুন করা। আমরা যে 'আমাদের মায়ের ভাষাতে কথা বলতাম, সেটা খুবই অপছন্দ ছিলো তাঁর। নতুন বাবা করতেন ওটা ছোটলোকের ভাষা। সম্ভ্রান্ত লোকেরা ওভাবে কথা বলে না। তাঁর নিজের নাক এরি শব্দাবলীর মতোই পবিত্র ও শক্তিশালী মনে করতেন তিনি। তাঁর এই তাহার থেকেই সেই ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনাটি ঘটলো।
মায়ের দ্বিতীয় বিয়ের পর সাড়ে চার বছর কেটে গেছে ততোদিনে। ছোট ভাইটি অর্থাৎ বাবার নয়নের মণি সন্তানটি ভয়ানক দুরত্ত হয়ে উঠেছে। ফাল্গুনের প্রথম দিকের এক ঝলমলে দিন ছিলো সেটা। কৃষ্ণচূড়ার রক্তাভ লালিমায় আকাশটা আগুনের মতো উরত হয়ে উঠেগুিলো। শনশনে হাওয়া বইছিলো একটু একটু করে। গৃহবধূকে অস্থির ও উন্ননা করে দিয়ে গাছে গাছে কোকিল ডাকছিলো অলস সুরে। বাইরে বসে ছোট ভাইটি মনের আনন্দে আধো আধো বোলে আমের মুকুল আর মৌমাছি নিয়ে কি একটা ছড়া কাটছিলো আপন নন। শুনে পিতার সে কী অগ্নিমূর্তি। যতোবার তাকে ও ভাষায় কথা বলতে বারণ করে ততোবারই ভাইটি আরও খিল খিল করে হেসে বেশি করে বলে ও কথা। রাগের চোটে নবা প্রচণ্ডভাবে আঘাত করলো ভাইটিকে। সঙ্গে সঙ্গে জ্ঞান হারালো সে। আর ফিরলো না সে জ্ঞান। সেন ছিলো কালানের আট তারিখ। পুত্রশোকে মুহ্যমান যা তখুনি স্বামীকে চলে যাবার কথা ভেবেছিলো। কিন্তু অনুতপ্ত পিতা ও পরিবারের সকলে মাকে খুব করে বুঝালো, এটা নেহাতই দুর্ঘটনা। পুত্রবিয়োগ ও অনুশোচনায় যাবা নিজেও তখন অর্থ উন্মাদ। মা তার সফল কষ্ট বুকে চেপে আমাদের কথা ভেবে এর পরেও থেকে গেলো এ সংসারে। তবে এক শর্তে। আমাদের কথাবার্তা নিয়ে কোনো মন্তব্য বা অভিযোগ উঠবে না।
তেমন সরাসরি জঠেনি ঠিকই। কিন্তু এতে বাবার আভিজাত্যের দাপট কমলো না একটুও। তার উচ্চাকৃতা একসময় এমন বাড়াবাড়ি পর্যায়ে গেলো যে সব ধৈর্যের বাধন ভেঙে নো মায়ের। ততোদিনে সংসারে এসে যোগ হয়েছে আরও কয়েকটি নতুন ভাইবোন।
আমার মায়ের দ্বিতীয় বিয়েও ভাঙলো। ঠিক দুই যুগ পরে। মা এখন প্রৌঢ়, একদা সুন্দরী, স্বাস্থ্যবতী, ঝলমলে যৌবনে ভরপুর আমাদের সেই মা কিছুটা ক্লান্তও। দু' সংসার- ছাড়া, এই ক্রমাগত টানাপোড়েন আর ঝড়ঝাপটা মানের জীবনীশক্তি তাদের টাই নিঃশেষিত করে দিয়েছে। মার পক্ষে সম্ভব হতো না এ অত্যাচারী, বউ পেটানো স্বামীর খুত। থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া, যদি না আমরা দুপক্ষের সব ভাইবোন একজোটে মাকে মুক্ত চার ব্রজে বল মান হতাম।
আনা। মা এখন আর কারো দায়ী নয়। মিথ্যে আভিজাত্য আর বংশ মর্যাদার এবারে তাকে ড। নির্যাতন বন্দর কেউ নেই। আমরা সবাই হাফ ছেড়ে বাচলাম।প্রথম বছরটা ভালোই কাটলো। কিন্তু তারপরেই আবার সম্পর্কের সূহা সুতোয় কোথ টান পড়লো। সংসারে অভাব। প্রত্যাশিত চাকরির বাজারে দারুন মন্দা। বন্যায় ভেসে সেই কমল। সবচেয়ে বড় কথা আমার সৎ ভাইবোনেরাও কেমন যেন সন্দেহের চোখে দেখ আমাদের আজকাল। আমাদের প্রথম পিতার পরিবারের সঙ্গে ক্ষীণ যোগাযোগ রক্ষাটুকুে তারা তাদের প্রতি একনিষ্ঠতা ও ভালোবাসার অন্তরায় বলে মনে করে। আমাদের আড়ালে মাকে শাসায় তারা। ভয়ে বাবার বাড়ি, কারোর নামটাও উচ্চারণ করি না জান। তু অভিযোগ, ঘরের মূল্যবান সোনাদানা থেকে চালখড়িও নাকি পাচার করছি আমরা আমানে বাপের সংসারে। এদিকে আমাদের ছোট ভাই দুটি শুনছি গোপনে গোপনে না ফন্দিদিকির করছে মাকে তার দ্বিতীয় স্বামীর সঙ্গে ছিল করিয়ে দেবার জন্যে। এরই মধ্যে এ ব্যাপারে চুপি চুপি বার কয়েক পিতার বাসভবনে গিয়ে শলাপরামর্শও করে এসেছে তার। পিতার ঐশ্বর্য, পিতৃপরিবারের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়-স্বজনের সামাজিক-অর্থনৈতিক প্রতিপত্তি এই বর্তমান আর্থিক দুরবস্থার আশু সমাধানের একমাত্র পথ বলে তারা মনে করছে। আর এদিকে তাদের উৎসাহ দেবার জন্যে তো রয়েছেই সেই দুড়িওয়ালা ভণ্ড বুড়ো খোলাম্ আর তা কুচুটে দোস্ত মতিউর, যারা যায়ের প্রবল দুর্দশার দিনেও থাকে সব কিছু মুখ বুজে সয়ে স্বামীর পদতালেই বেহেশত আবিষ্কার করতে উপদেশ দিতো।
সব দেখে শুনে মায়ের চোখে আবার অবিরল জলের ধারা। দুই স্বামীর কাছে থেকে অ নয়, সন্তানের কাছ থেকেও অবিরাম কষ্ট পাচ্ছে আমার মা। নিজের ছেলেমেয়েদের মঞ্চে এই ক্রমাগত বচসা, অবিশ্বাস আর ঘৃণা থাকে অস্থির উন্মনা করে তুলছে। আকাশের দিকে, বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে মা সকলের জন্যে উদারতা ভিক্ষা করে। তার প্রার্থনা ফিরে আসে ২৩ আর বড় হয়ে। প্রার্থিত শান্তির দেখা নেই।
আমি চাই আমার মায়ের মুখে আবর হাসি ফোটাতে। কী সুন্দর লাগে মাকে যখন সে স্বতঃস্ফূর্তভাবে হাসে। ভাবছি আজ রাতে ছোট ভাইবোনগুলোর সঙ্গে বসবো একবার। বলবো, অনেক কষ্ট অনেক ঝড়কাণ্টীর ভেতর দিয়ে কেটেছে মায়ের জীবন। দীর্ঘ অত্যচার অনাচার সইবার পর বহু চিন্তা-ভাবনা করে অবশেষে বেজায় যে কঠিন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে সমর্থ হয়েছে না, নিজেদের হীন স্বার্থের কারণে তার সেই সিদ্ধান্ত পাল্টাবার চেষ্টা করা মারাত্মক অন্যায় হবে। বলবো, আমরা না হয় তাদের সং ভাইবোন, কিন্তু মাটি তো আপন। আনাদের প্রতি কটু মন্তব্য, কটাক্ষ করলে মা কষ্ট পাবে শুধু এজানাও কি আমর সঙ্গে ভালোবাসার অভিনয় করতে পারিস না? অভিনয় তো একটি শিল্পকলা, অনুশীলনে থেকে প্রায়ত করা যায়। ভালোবাসা না হোক, অন্তত সহনশীলতা আপনি জায়গা করে নেবে পরিচালিত অভিনয়ের মাঝখানে। সদিচ্ছা ও শুভেচ্ছা পুঁজি করে কল্পনা আর জগতের ধূসর সীমানা বরাবর পথ চলতে শুরু করবো আমরা। তারপর হয়তো দেখলো একদিন অন্তর্গত বোধ আস বাহ্যিক অভিনয়ের পার্থক্য খুজে গেছে।
তোরা চেষ্টা করে দেখ। আদিও কবি। আর কিছু না হোক, শুধু মায়ের মুখে আবার হাসি ফেরবার জন্যেই না হয় বড় অভিনেতা হবার চেষ্টা করলাম। সকলেই যে মাকে বড়ো ভালোবাসি আমরা।
0 মন্তব্যসমূহ