**
ভাষা আন্দোলনের প্রথম সংগ্রামী
সত্যেন সেন (১৯০৭-১৯৮১)
**দেখে এলাম মাকে। দেখে এলাম তাঁর নিজের পরিবেশে, সেই সব ছেলেমেয়েদের মাঝখানে, যাদের তিনি গর্ভে ধরেননি, কিন্তু তা হলেও যাদের তিনি মা! এই সব ছেলে মেয়ে ছাত্র আন্দোলন করে আর সময়ে অসময়ে তাঁর কাছে ভিড় জমায়। মা তাদের কেন্দ্রবিন্দু।
প্রথম দিনটির কথা মনে থাকবে। দেখা হয়েছিলো ঢাকা শহরের এক গনির উপর একটা ডাক্তারখানা থেকে বেরিয়ে আসছিলেন। সঙ্গে ছিলো তাঁর মেয়েটি। আমার পরিচিত মেয়ে। শুধু পরিচিত বললে রাগ করবে। সে আমার একান্ত জাপনজনের একজন। পরিচয় করিয়ে দিতেই মা সেই রাস্তার উপর সেই লোকজনের ভিড়ের মধ্যেখানেই আমাকে দুহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরলেন। এজন্য একেবারেই প্রস্তুত ছিলাম না। বিহিত হয়েছিলাম একটু। একটু দ্বিধা নেই, একটু অড়তা নেই, সহস্র-সুন্দর আবেগে বুকের মধ্যে টেনে নিলেন। অথচ সেই মুহূর্তেই প্রথম পরিচয়। আর বয়সের দিক দিয়ে হিসেব করলে আমি কম করে হলেও তাঁর দশ বছরের বড়। তাঁর সর্বগ্রাসী মাতৃত্বের সামনে পরিচয় আর অপরিচয়ের, বড় আর ছোটর ভেদরেখ যেন তুচ্ছ হয়ে গিয়েছে। সে সময় মা-মাসি-দিদিয়া এমনি করে আদর করে বুকে টেনে নিতেন, সে যুগ কতোকাল আগে পেরিয়ে এসেছি। ধু-;--করছে সেই দিগন্ত। শুধু সেই স্মৃতির হাওয়া সেই সুদূর থেকে বয়ে এসে মাঝে মাঝে স্বপ্নের এতো দোলা নিয়ে যায়।
সেদিন সেই জনবহুল গলিটার মাঝখানে মায়ের নিবিড় আলিঙ্গনে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে সেই মুহূর্তের জন্য মনে হচ্ছিলো যেন আমার বয়সের জড়ো করা যতোকিছু স্বঞ্জান, শতোকিছু আবর্জনা সব করে গড়ে গিয়ে আমাকে নির্মল আর সুন্দর করে তুলছে। বলছিলেন, ওদের মুখে তোমার কথা এতো বেশি শুনেছি যে, তোমাকে চিনতে আমার একটুও বাকি নেই। মা চিনে নিয়েছেন আমাকে। আমিও চিনে নিয়েই থাকে।মারের এই রূপটা এবার নিজের চোখে ভালো করেই দেখে এসেছি। কিন্তু সে কথা আমিবলতে বসিনি, আমি বলছি মার যার এক রূপের কথা, সেরূপ স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করিনি,অন্যের মুখে শুনেছি। সেই রূপের প্রসঙ্গ তুলতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের সুপরিচিত গানটির কথা মনে পড়ছেঃ-
"বহু মানিক দিয়ে ধাতা আঢ়
“তোমার মালা
তোমার শ্যামল শোভার বুকে
বিদ্যুতেরই জানা।
আষাঢ়ের বিদ্যুৎগর্ত শ্যামল শোভা। সেই বিদ্যুৎ জ্বালাময়ী মায়ের কথাই বলছি।"
বর্ধমানের মেয়ে। স্বাভাবিকভাবে তাঁর পিতৃকুল থেকে প্রবাহিত হয়ে এখুলে চলে আসার কথা নয়। তবু কেমন করে দিনাজপুরের এক শরিফ পরিবারে বউ হয়ে আসতে হলো তাকে। কেমন করে কি হয়ে গেলো ভালো করে বুঝতে না বুঝতেই তিনি দেখলেন, যে জগতে তিনি এসে পড়েছেন, এ অর্থৎ তাঁর কাছে সম্পূর্ণ অপরিচিত। সেই আলো বাহুতে তিনি বড় হয়ে উঠেছেন, এখানকার আলো-বায়ু তা থেকে স্বতন্ত্র।বিয়ের পর যেদিন প্রথম এ বাড়ির অন্দর মহলে এসে প্রবেশ করলেন সেদিন মনে হয়েছিলো যেন ভালো করে দম নিতে পারছেন না। এই অবরুদ্ধপুরীর মাঝখানে কেমন করে তিনি তাঁর সারা জীবন কাটাবেন? এ ছাড়াও তাঁকে যে আরও কতো কঠিন সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে, তিনি তা কল্পনাও করতে পারেননি।যে পরিবারে তিনি এসেছেন— শুধু দু'দিনের ঘন্ট বেড়াতে আসেনি, এই পরিবারের সঙ্গে অঙ্গীভূত হয়ে থাকবার জন্য এসেছেন। এরা পীরের পরিবার। অত্যন্ত কঠিন ধরনের প্রাচীনপন্থী গোঁড়া মুসলমান। এদের সঙ্গে প্রথম পরিচয়েই আঁতকে উঠতে হলো তাঁকে। এ বাড়ির কেউ বাংলায় কথা বলে না। বাংলায় কথা বলতে তাদের যে শুধু আভিজাত্যে বাধে তা নয়, এই নীয় পরিবারের লোকেরা মুসলমানী ভাষা উর্দুতেই কথা বলতে অভ্যস্ত। দুতীয় মর্যাদার দিক থেকে এঁরা বাংলা ভাষায় কথা বলাটা হীনতাসূচক বলে মনে করে। এ বাড়ির কেউ তাঁর সঙ্গে বাংলায় কথা বললো না। তাঁকে উর্দুতে যেসব প্রশ্ন করা হলো, তিনি পরিষ্কার বাংলায় তার উত্তর দিলেন।এইভাবে প্রথম দিন গেলো। পর দিনই বউকে স্পষ্টভাবেই জানিয়ে দেওয়া হলো যে, বাংলা ভাষা শিষ্টসম্মত ভাষা নয়, অতএব এ বাড়িতে বাংলা কথা বলা চলবে না। এই বংশের কেউ কোনোদিন বাংলা ভাষায় কথা বলেনি। এটাই এই পরিবারের বৈশিষ্ট্য। অতএব বউ যেন এখন থেকেই উর্দু ভাষার তালিম নিতে শুরু করে। কথা শুনে বউ তাদের মুখের দিকে বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো- এরা বলে কি । বাংলা ভাষায় কথা বলতে পারবে না! সেদিন এ সম্পর্কে আলোচনা এখানেই শেষ হলো। বউ কি ভাবলো বউ-ই জানে, এ বাড়ির লোকদের তা কল্পনা করার সাধ্য ছিলো না।এরপর বউকে উর্দু ভাষায় তালিম দেবার জন্য যিনি এগিয়ে এলেন, বউ তাকে একটুও আমল না দিয়ে সংক্ষেপে জানিয়ে দিলো, আপাতত উর্দু শিখবার কোনোই প্রয়োজন নেই তার। কারণ বাংলা তার মাতৃভাষা, সে বাংলাতেই কথা বলবে। এ বাড়ির কোনো বউয়ের মুখ থেকে যে এ রকম জবাব বেরিয়ে আসতে পারে, এটা এ-বাড়ির লোক কল্পনা করতে পারে। না। সারা বাড়িতে হুলস্থুল পড়ে গেলো। সবাই উত্তেজিত। তার স্বামী তাঁকে মিষ্টি কথায় বুঝিয়ে বললেন, উর্দু ভাষায় কথা বলা এ পরিবারের বংশানুক্রমিক রীতি, এ না মানলে কেমন করে চলবে। যা তার উত্তরে বললেন, বাংলা ভাষায় কথা বলাটা তাদের বংশানুক্রমিক রীতি,তিনিই বা বাংলা ভাষাকে কেমন করে ছাড়বেন। তা ছাড়া বাংলা ভাষা সমস্ত বাঙালি জাতি মাতৃভাষা। বাঙালি হয়ে কেন তিনি তাঁর মাতৃভাষা বাংলাকে বর্জন করবেন? এটা কখনোই হতে পারে না।
**ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের আরো গল্প পেতে ব্লগটিতে যুক্তথাকুন https://monoweredu13.blogspot.com/?m=1
মার স্বামী তাঁর হাতে যতো যুক্তি ছিলো তাই দিয়ে স্ত্রীকে বোঝাতে চাইলেন। কিন্তু কোনো যুক্তিই যখন কোনো কাজে এলো না তখন তিনি হতাশ হয়ে মুখ ফেরালেন। এবার উপর থেকে নিচে হুমকি আর গর্জন, এই বেয়াদপ বউকে শায়েস্তা করবার জন্য পীর পরিবারের তরফ থেকে প্রচণ্ড চাপ নেমে এলো। কিন্তু এই প্রবল চাপের ফলেও বউকে - এতোটুকু নোয়ানো গেলো না। সে যেমন ছিলো তেমনি সোজা দাঁড়িয়ে রইলো। সারাদিনে যে ক'টি কথা তাকে বলতে হতো, সে তা বাংলাতেই বলতো; কিন্তু কে তার সঙ্গে কথা বলবে। রাগারাগি আর গালাগালিতে যখন কোনোই ফল হলো না, তখন সেই ক্রোধ বিতৃষ্ণা ও ঘূর্ণায় রূপান্তরিত হয়ে যেতে লাগলো। বিশেষ করে এই পরিবারের মেয়েদের এমন পীর বংশের বউ হয়ে এ রকম নীচ প্রবৃত্তি কেমন করে হতে পারে এ কথা তারা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারলো না। তারা কেউ তাঁর সঙ্গে কথা বলতো না এবং যে কোনো উপলক্ষে তার উদ্দেশে তাচ্ছিল্য ও ঘৃণা ছড়াতো। মার একমাত্র সমাজ ছিলো এ বাড়ির ঝি-চাকরানিদের নিয়ে। তারা মার সঙ্গে বাংলা ভাষাতেই কথা বলতো এবং তাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলেই মার দিন কাটতো। এভাবে নীচ স্তরের বি-চাকরানিদের সঙ্গে তাঁকে এমন সহজভাবে মিলেমিশে যেতো দেখে এ-বাড়ির উপরের স্তরের প্রাণীরা নানাভাবে তাদের আপত্তি ও বিরক্তির ভাব প্রকাশ করতো । কিন্তু পরিবারের নকলের বর্জনের ফলে মার সমাজ এদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে রইলো এবং খাওয়া-দাওল্প ও অন্যান্য যাবতীয় ব্যাপারে তিনি তাদের সমপর্যায়ভুক্ত হয়ে রইলেন।
এইভাবে বর্ধমানের অষ্টাদশী মেয়েটির নতুন সংসারের পত্তন হলো। এইভাবে দিনের পর দিন মাসের পর মাস গড়িয়ে চললো। কিন্তু পীর পরিবার এতোকাল যে অবন্ত ও গুরুভার মহিমা নিয়ে বিরাজ করছিলো, তার মধ্যে বিরাট একটা ফাটল দেখা দিয়েছে। তাদের চলাচলহীন ও স্থাবর জীবন যাত্রার মধ্যে এক অপ্রত্যাশিত আলোড়ন জাগিয়ে তুলেছে আঠারো বছরের এই মেয়ে। বাইরের মুক্ত আকাশ-বিহারী একটি পাখি পীর পরিবারের সনাতনী ব্যবস্থার খাঁচার মধ্যে নিঃশব্দ প্রতিবাদের পাখা ঝাপটে মরছে। সে তার মাতৃভাষা, বাংলাকে কিছুতেই ছাড়বে না। এমন শক্ত আর একগুয়ে মেয়ে। কিছুতেই তাকে উর্দু ভাষায় তালিম দেওয়া যাচ্ছে না। কথাটা কেমন করে ও বাড়ির দেয়াল ডিঙিয়ে পাড়ার এবাড়িতে বাড়িতে ছড়িয়ে পড়েছে। কি চাকরাই হয়তো এই মুখরোচক সংবাদটি বহন করে নিয়ে গৈছে। যে শেনে সে-ই অবাক হয়ে যায়। এই বিষয়টা যে কোনো পরিবারের অন্তবিরোধের কারণ হতে পারে, এটা কারো ধারণায় আসতে চায় না।
পীর পরিবারের ইতিহাসে এই ধরনের সঙ্কট এই প্রথম দেখা দিয়েছে। তাদের পক্ষে এটা একেবারই অভাবিত। এই সঙ্কটের সমাধান না করলেই নয়। বাংলা ভাষা ইতরজনের ভাষা। সেই লোক- ভাষার প্রবাহের মধ্যে নিমগ্ন হয়ে থেকেও একটি গেরাফত- এর সুরক্ষিত দুর্গ গড়ে তুলে তার পাখানে যার তাদের বিশুদ্ধ উর্দু ভাষাকে এতোদিন ধরে রক্ষা করে চলেছে। আর একা কোথাকার কে একটা মেয়ে এসে তাদের সেই পবিত্র আবহাওয়াকে দূষিত করে তুলবে। এই সংসারে একটি মানুষও যদি সবার সঙ্গে বাংলায় কথা বলে তাহলে ক্রমে ক্রমে তাযে আর সবাইকে সংক্রামিত করে তুলবে না, এমন কথা কে বলতে পারে। সংক্রামক ব্যাধি তো সামান্য একটু সূচনা থেকে শুরু করে শেষে মহামারির আকারে ছড়িয়ে পড়ে।
পীর পরিবার সম্ভ্রস্ত হয়ে উঠলো। ওরা মিঠে-কড়ায় নানাভাবে মাকে তাদের পথে টেনে আনতে চাইলো। কিন্তু মাকে কিছুতেই তাঁর এই সংকল্প থেকে এতোটুকু নোয়ানো গেলো না । ইতিপূর্বে এই সংসারে কতো ঘর থেকে কতো মেয়ে এসেছে, তারা কেউ তো এমন ছিলো না। তারা আগে যে যেমন থাক না কেন, এখানে এসে নিঃশব্দে এখানকার নিয়ম মাথা পেতে নিয়েছে। নতুন ভাষাটাকে কেউ সহজে আয়ত্ত করে নিয়েছে, কারো বা সমস্ত লেখেছে, "কিন্তু আমি আমার মুখের ভাষা ছাড়বো না' এই কথা বলে প্রতিবাদ জানাবার মতো ধৃষ্টতা বা দুঃসাহস তাদের কারো ছিলো না। কিন্তু এই মেয়ের দুঃসাহসের সীমা নেই। মুরুব্বিদের নির্দেশের উত্তরে সে মৃদু অথচ সুস্পষ্ট কণ্ঠে এ সম্পর্কে তার নিজস্ব রক্তব্যটুকু জানিয়ে দেয়, তারপর নিজের পথ ধরে নিজে চলে। দিনাজপুরের সুবিখ্যাত পীর পরিবারের এখন সফট আর কখনও দেখা দেয়নি। তারা ভেবে পায় না এই মেয়েকে নিয়ে তারা কি করবে।
এক দিকে এই পরিবারের আর সবাই, আর একদিকে সে—একলা সে। সেই অচলায়তন পুরীতে তার পক্ষ হয়ে কথা বলবার মতো একটি প্রাণীও ছিলো না। এই পরিবারের কি পুরুষ কি মেয়ে, কি বড় কি ছোট তারা অতি অভ্যস্ত একই পথ ধরে চলে এসেছে, তারা এই একটি মাত্র পথ ছাড়া দ্বিতীয় পথের ধার ধারে না। আর এই মেয়ে কোথা থেকে এসে এতো দিনের সনাতনী রীতিকে তছনছ করে দিতে চাইছে। এই পরিবারের মানুষ এই বাড়ির মাঝখানে দাঁড়িয়ে বাংলা জবানে কথা বলবে এ কথা কল্পনা করতে পেরেছে কেউ, এ কথা সহ্য করতে পারে কেউ। সেই অঘটনই এখন ঘটে চলেছে। এতোদিনের পবিত্র ঐতিহ্য ভেঙে চুরমার করে দিলো। এমন বেয়াদব মেয়ে। এ মেয়ের পক্ষ হয়ে কে কথা বলবে!
স্বামী শান্ত, নিরীহ প্রকৃতির, অত্যন্ত সৎ স্বভাবের লোক। কিন্তু এই বৈষয়িক সংসার তাঁর কাছে তুচ্ছ, তিনি একান্তভাবেই আধ্যাত্বিক অগতের অধিবাসী। তাঁর শুরু তাকে নির্দেশ দিয়েছেন সংসার ধর্ম প্রতিপালন করতে। তাই তিনি চাকরি-বাকরি করছেন। বিয়ে বা করে বিষয়স্তানে আবদ্ধ হয়ে আছেন। তা না হলে সংসার ছেড়ে কবেই দেওয়ানা হয়ে বেরিয়ে যেতেন। স্বামী আর স্ত্রী দুজন দুই জগতের অধিবাসী। এক শয্যার শরিক হয়েও তাঁরা পরস্পরকে চেনেন না। মাঝখানে বিরাট ব্যবধান। দুজনেই অনুভব করেন এই ব্যবধান কোনো দিন অতিক্রম করা যাবে না। মাঝে মাঝে স্ত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে চমকে ওঠেন স্বামী। মেয়ে মানুষ অনেক দেখেছেন তিনি। আরও অনেকের মতো তারও ধারণা ছিলো মেয়েমানুষ পুরো মানুষ নয়, তারা সঙ্গীর এক দলা কাদা-মাটির মতো, পুরুষ তাকে দিয়ে রেমন বুঝি তেমন মূর্তি রচনা করতে পারে। পুরুষ তাকে যেভাবে চালাবে সে তেমনিভাবেই চলছে। মুক্তিকর্তার অভিরুচির ভাই। সেই জন্যই তিনি দেয়োক পুরুষের জেরের হাড় থেকে তৈরি করেছিলেন। কিন্তু স্ত্রীকে মোকাবিলা করতে গিয়ে এই পরিবারের ভাবী-পীর থমকে গেলেন। গ্রুপ দিনের মধ্যেই তিনি টের পেলেন তার স্ত্রী বলে পরিচিত এই মেয়ে মানুষটির মধ্যে একটি মানুষ রয়েছে এবং সেই মানুষটি তাঁর চেয়েও শক্তিশালী। তাই তাঁর স্ত্রীর চোখের দিকে তাকিয়ে তিনি কি যেন দেখতে পান যার জন্য তাঁকে অভিভূত হয়ে যেতে হয়। বুঝিএকই নামে ব্যক্তিত্ব। কিন্তু তা হলেও ভদ্রলোক প্রথমে মিষ্টি কথায় অনুরোধ করে, পরে ধমক বাদক এবং অবশেষে গালি কিছুতেই কোনো ফল পাওয়া গেলো না। নিজের মাতৃভাষাকে বর্জন করে পর আমাকে গ্রহণ করতে কিছুতেই তাঁকে রাজি করালে গোলো না। বছরের পর বছর এইভাবে গতি যে চালো। তাঁর প্রতিপক্ষ নিশ্চেষ্ট হন। ফলে ওঁর লাঞ্ছনার মাত্রা বেড়েই চললো।
অাফগলাম মায়ের মুখের দিকে। সাথন চুল অসময়ে পেকে গিয়েছে। কি ভীষণ অবস আর ক্লান্ত চেহারা। অন্তগামী চাঁদের মতো বিষণ্ণ মুখাচ্ছবি। কেন কিসের এই বিষণ্ণতা, কিসের এই দুঃসহ অবসাদ ? ঢাকা শহরে। রাস্তার উপর যেদিন তাঁকে প্রথম দেখি সেদিনও এই প্রশ্নটাই আমার মনে ডাক দিয়ে উঠেছিলো। হঠাৎ মনে হলো পরিবারের লোকদের কাছ থেকে দীর্ঘদিন ধরে যেই নির্যাতন ও লাঞ্চনা পেয়ে এসেছেন এবং নিঃশব্দে মুখ বুজে তা সহ্য করে এনেছেন, একি তারই প্রতিক্রিয়া ? এই অস্বাভাবিক জীবনের ঘাত-প্রতিঘাত তিনিও কি কিছুটা অস্বাভাবিক হয়ে গেছেন ? সেদিন মের সেই আনন্দময়ী মেয়েটি কি চিরদিনের জন্য হারিয়ে ফেলেছে নিজেকে? আর কি সে ফিরে আসবে না? কোনো দিন না ? হয়তো যা অনুমান করছি সবই ভুল। কিন্তু মার সেই অবসন্ন বিষাদ ভারনত চোখ দুটির দিকে তাকিয়ে ব্যথায় আমার বুকটা টন টন করে উঠলো। কে জানে কেমন করে মুখ থেকে কথাটা বেরিয়ে গেলো, তুমিই-বা এতো জেদ করতে গেল কেন? না হয় উর্দুতেই কথা বলতে। সারাটা জীবন এই নিগ্রহ ভোগ করতে গেলে কেন ? মা এবার চোখ তুলে আমার মুখের দিকে তাকালো। দেখলাম চোখের নেই বিষণ্ণ দৃষ্টি মুহূর্তের মধ্যে বদলে গেছে। তাঁর দু'চোখ থেকে উজ্জ্বল যাতা ঠিকরে বেরিয়ে এলো। মা বললো, জেদ। কিসের জেদ? ওরা আমাকে আমার নিজের ভাষায় কথা বলতে দেবে না কেন? কেন ওরা আমার উপর এমন করে অন্যায় জুলুম করে চলবে? আর কেনই-বা আমি সহ্য করে নেবো ? আমি কি মানুষ নই? মনে হলো, সেই মুহূর্তে সেই আঠারো বছরের মেয়েটি যেন আবার ফিরে এসেছে। আবার সে তার কথার পুনরাবৃত্তি করে বললো, কেন আমি ওদের এই অন্যায় জুলুম সহ্য করে নেবো? কেন ওরা আমার মাতৃভাষা বাংলায় আমাকে কথা বলতে দেবে না? মার এই কথার সঙ্গে সঙ্গে যেন বহু দূর থেকে একটা গানের কলি আমার কানে ভেসে এলো- ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়। তবু একটু ইতস্তত করে বললাম, কিন্তু সারা বাড়ির মধ্যে তুমি তো একা। এতোগুলো মানুষের বিরুদ্ধে কি করতে পারে তুমি?
মা এবার তার উত্তেজনাকে সংযত করে শান্ত কণ্ঠে বললো, কি করতে পারি আমি ? যা করতে পারি তা তো করেছি। আমি একা বলে ওরা যা বলবে তাই মাথা পেতে নেবো ? কেন ? কি করবে ওর জামার? মারবে ? মারুক। আমিতো সে জন্য প্রস্তুত হয়েই ছিলাম।
থমকে গেলাম। আর কথা বাড়াতে চাহস করলাম না। মার মাথাটা আস্তে আস্তে বালিশের উপর কাত হয়ে পড়লো। বড় অবস্থা, বড় ক্লান্ত। মা দু'দিন ধরে অসুস্থ। মনে হচ্ছে এখনি ঘুমিয়ে পড়বে। আহা, ঘুমোক।মা বলছিলো, যা করতে পারি, তা তো করেছি। সত্যি কথাই, একা মানুষ হয়েও অনেক কিন্তু করেছে মা। তাঁর ছেলেমেয়েদের মুখে এনেছি। ভাষার জন্য সংগ্রাম নিয়ে তাঁর বিবাহিত সূচনা। কিন্তু তার সংগ্রামের এই ইতি না। সেই অচলায়তনের
থেকেও মা একটির পর একটি নিষেধের গতি ভাঙতে ভারতে এগিয়ে চলেছেন। এ বাড়ির বউরা-মেয়েরা অসুর্য পশ্যা। এদের মতে যে মেয়ের আবরু নেই, সে মেয়ের আছে কি? আরকুই নারীর নারীত্বকে রক্ষা করে রাখে। দুঃসাহসিকা মা সেই পরম পবিত্র আবরুর মর্যাদা লঙ্ঘন করে প্রতিবেশীদের বাড়িতে যাতায়াত শুরু করলো। এইভাবে প্রতিবেশীদের সঙ্গে সে একটা নতুন সমাজ গড়ে তুললো। ওটা তার বিবাহিত জীবনের বেশ কয়েক বছর পরের কথা। পরিবারের পক্ষে এই ঘটনাটা বজ্রাঘাতের মতোই নিদারুণ। স্বাভাবিকভাবেই প্রচণ্ড রকম বাধা এলো। সমস্ত অভিযোগের উত্তরে মার একটি মাত্র কথা আমিতো কোনো অন্যায় করিনি, কেন তোমরা আমাকে বাধা দেবে? এটা যে অন্যায় এবং জঘন্য রকমের অন্যায়, বহু যুক্তিতর্ক দিয়েও এ কথাটা কেউ তাকে বুঝিয়ে উঠতে পারলো না। মা বলতো, মানুষের সঙ্গে মিলাবে মিশবে, দেখাশোনা করবে, আলাপ-পরিচয় করবে, একে তাপরের সঙ্গে সহযোগিতা করবে এটাই তো স্বাভাবিক, এটাই তো সঙ্গত। আমিতো কোনো খারাপ কাজ করছিনে। কথায় যখন কাজ হলো না, তখন এরা শারীরিকভাবে বাধা দিতে চেষ্টা করলো, কিন্তু তাতেও ডাকে আটকে রাখা সম্ভব হলো না। অবাধ্য গরুর মতো সে যখন-তখন বেড়া ভেঙে বেরিয়ে পড়তো। ক্রমে ক্রমে তার এই বাইরে যাবার অধিকারটা কায়েম হয়ে গেলো। তার পক্ষে নিয়ম ভাঙাটাই নিয়ম হয়ে দাঁড়ালো।মার ছেলেমেয়েদের জন্মের পর থেকে এই সংসারে একটি নতুন সংঘাতের সূচনা দেখা দিলো। এই ছেলেমেয়েদের এ বাড়ির ছেলেমেয়েদের মতো গড়ে তুলবার জন্যই সবাই উঠে পড়ে লাগলো। এদিকে মা তাদের আঁকড়ে ধরে রাখতে চাইলো। এ নিয়ে দু'পক্ষে বেশ কিছুদিন টানা—হ্যাঁচড়া চলে। ছেলেমেয়েরা তাদের বাবা এবং এ বাড়ির আর সকলের সঙ্গে উর্দু ভাষায় কথা বলতো। না বলে উপায় ছিলো না। বলতে বাধ্য করা হতো তাদের। শুধু মার স্বঙ্গে তারা তাদের মাতৃভাষায় কথা বলতো। কিন্তু মার শক্তির সঙ্গে ওদের শক্তি এঁটে উঠতে পারলো না। ছেলেমেয়েরা মার সঙ্গে প্রতিবেশীদের বাড়িতে যাতায়াত করতো এবং বাইরের আলো-বাতাসে অভিষিক্ত ও হাসি-গানে মুখর হয়ে ঘরে ফিরে আসতো। এই সংসার এবার কার্যত পরিষ্কার দু'ভাগে ভাগ হয়ে গেলো। একদিকে মা আর তার শাবকগুলি, অপরদিকে আর সবাই। একটি উর্দুয়াদী পরিবার বাংলা। শুধু ভাষার দিক নিয়েই নয়, পোশাক-আশাক, চাল-চলন, আচার-আচরণ সব কিছুই পৃথক হয়ে যাচ্ছিলো। পীর পরিবারের সজাগ প্রহরীদের দৃষ্টির সামনেই এই সমস্ত অঘটন ঘটে চলছিলো। নিখে বাঁধ দিয়ে ঠেকিয়ে রাখতে পারছিলো না।এই সমস্ত টানাটানির মধ্য দিয়ে মা এই বৃহৎ পরিবারের এক প্রান্তে তার ছেলেমেয়েদের নিয়ে তার নিজস্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী সেই ছোট্ট সংসারটুকু গড়ে তুলেছিলো, তার উপর তার অধিকার দিনের পর দিন সুপ্রতিষ্ঠিত হয়ে বসছিলো। তার প্রবল ব্যক্তিত্ব ও দৃঢ় সঙ্গম্পের মুখে ওদের সমস্ত বাধা ভেঙে খান খান হয়ে যাচ্ছিলো। ওদের সবার কাছেই তিনি চক্ষুশূন; কিন্তু ওরা কিছুতেই তার ইচ্ছাকে দমিয়ে রাখতে পারতো না। ওদের দৃঢ় মুষ্টি একটু একটু করে শিথিল হয়ে আসছিলো। বহু সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এই অন্ধকার অচলায়তনের একটা জানালা মা নিজ হাতে খুলে দিলো। তার মধ্য দিয়ে এক ঝলক আলো-বাতাস ঘরের মধ্যে এসে ঢুকলো। এ ভালো ওরা সইতে পারছিলো না। কিন্তু যেই জানালাটা খুলে গেছে, তাকে বন্ধ করে দেওয়া ওদের শক্তির বাইরে চলে গিয়েছিলো।এর পর নানা কারণে এই পরিবার টুকরো টুকরো হয়ে চারদিকে ছড়িয়ে পড়লো। একমাত্র মানের সংসারটুকুই এখানে থেকে গেলো। স্বামী সংসারে থেকেও নেই। তিনি তার সাধন-ভজন নিয়েই ব্যস্ত। চাকরি জীবনের শেষে তিনি উত্তরাধিকার সূত্রে পীরের আসন গ্রহণ করেছেন। তাঁর অধিকাংশ দিন মুরিদদের বাড়িতেই কাটে। দু'চার দিন বাসে হঠাৎ দুএক বেলার জন্য এসে উপস্থিত হন, আবার হঠাৎ মিলিয়ে যান। তাঁর খবর তিনিই শুধু রাখেন। মার শ্বশুরকুলের আত্মীয়ের কেউ তার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক রাখেন না। বর্ধমানের এই বেপরোয়া মেটো তাদের পীর পরিবারের পবিত্র পরিবেশকে বাইরের জাল দিয়ে অসি করে তুলেছে, এই দুখ তাঁরা কেমন করে ভুলে যাবেন।
মার সংগ্রামশীল জীবনের এই বিচিত্র কাহিনী শুনে ওড়িত হয়ে গিয়েছিলাম। কিছুটা তাঁর ছেলেমেয়েদের মুখে শুনেছি, মার মুখের দিকে তাকিয়ে বাকিটা কল্পনার দৃষ্টিতে দেখেছি। অবতারনত মুখের দিকে বরণ তাকাই তার ওই দীর্ঘ সংগ্রামের আঘাত চিহ্নগুলো যেন আমার চোখের সামনে পরিস্ফুট জয় ওঠে। দৈনন্দিন নিষ্ঠুর যাত্যাঘাতের ফলে মাকে স্বাস্থ্য, মানসিক শান্তি আর আনন্দ অনেক কিছুই বিসর্জন দিতে হয়েছে। কিন্তু জীবনের ভোগ, সুখ আর আনন্দ যার মধ্য দিয়ে সাধারণ মানুষ তাদের জীবনের চরম সার্থকতা খুঁজে পায়, যার কাছে তার চেয়েও বড় ছিলো তার এই অনমনীয় সকম্প অন্যায় জুলুমের সামনে কিছুতেই মাথা নত করবো না, যেটা ন্যায়ের পথ আর মুকুর পর, আমি সেই পথ ধরে চলবোই। এই আদর্শকে সামনে নিয়ে এই অসহায় মেয়ে মাহিমামণ্ডিত অচলায়তনের মহাশকির বহরীদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে জীবনতর কঠিন সংগ্রাম করে চলেছে এবং শেষ পর্যন্ত জয়ী হয়েছে। তার ফলে তাকে অনেক কিছু বিসর্জন দিতে হয়েছে; কিন্তু সে তার আদর্শকে বিসর্জন দেয়নি। এতো আমারই দেশের মেয়ে, আমারই দেশের মা, এ কথা যখন মনে করি তখন ভরসায় আর সাহসে আমার বুক ভরে যায়।
—সেদিন মার এই সংগ্রামী জীবন কথা শুনে বিন্বিত হয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু আমাদের সমাজে এটাই তো এই জাতীয় সংগ্রামের একমাত্র নিদর্শন নয়। যদি আমাদের ব্যাপক ও সুদূরপ্রসারী দৃষ্টি থাকতো, তাহলে দেখতে পেতাম বহু সংসারের খাঁচায় এমনি কতো মুক্তি- পাগল পাখি অধীর হয়ে মাথা কুটে মরছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাদের মাথা কুটে মরাই সার হয়। শেষ পর্যন্ত তারা ভবিষ্যতের হাতে আত্মসমর্পণ করে নির্জীব হয়ে পড়ে থাকে। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে পাখি মরিয়া হয়ে খাঁচা ভেঙে বেরিয়ে পড়ে। তারা আঘাতে আঘাতে - হয়, কিন্তু হার মানে না, আত্মসমর্পণ করে না।
আমাদের এই মা এমনি একটি পাখি। তাঁর জীবনতর সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে তিনি সেই পারাপারের দ্বার ভেঙে একাই যে শুধু বেরিয়ে এসেছেন তা নয়, সেই অন্ধ কারাগৃহ থেকে তার ভোলানেযেগুলোকেও মুক্ত করে বাইরে নিয়ে এসেছেন। তা না হলে তাদের হয়তো
"সেখানেই পচে গলে মরতে হতো। সংগ্রামী মা তোমাকে কন্দনা করি".।
0 মন্তব্যসমূহ