----কমলাকান্ত /কমলাকান্তের দপ্তর আলোচনা কমলাকান্ত কমলাকান্তের দপ্তর আলোচনা কমলাকান্তের দপ্তর এর বিষয়বস্তু কমলাকান্তের জবানবন্দি কমলাকান্তের দপ্তর প্রশ্ন উওর কমলাকান্ত চরিত্র সমাজ বাস্তবতা-----
***বিঃদ্র-বাংলা বিভাগের সকল পড়াশোনা পেতে ব্লগটিতে যুক্তথাকুন https://monoweredu13.blogspot.com/?m=1
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৩৮-৯৪) বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অন্যতম প্রধান লেখক চিন্তাবিদদের মধ্যে শীর্ষস্থানীয়। তিনি একাধারে ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক, বিজ্ঞানলেখক ও ধর্মতাত্ত্বিক। তার প্রবন্ধসমূহের ভেতরে প্রবেশ করলে এটি পাঠকদের কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, তিনি শুধু সমাজ-রাজনীতি-সং -ধর্মদর্শন ও শিক্ষার ব্যাপারে গভীরভাবে ভাবেন নি; বরং মানব-মনস্তত্ত্বের মর্মমূলেও তিনি তার চৈতন্যকে সচেতন ভাবে প্রবিষ্ট করিয়েছিলেন।
‘কমলাকান্তের দপ্তর' এ বঙ্কিম-মানসকে মনোবেদনা, শূন্যতাবোধ, নিঃসঙ্গতা ও আত্মাধিক্কার অধিকৃত করে রেখেছিল, তখনকার সামাজিক-রাজনৈতিক ও ঔপনিবেশিক দুঃশাসন ও স্বার্থপরতার কারণে। সমাজে তখন আদর্শের এবং বাস্তবজীবনের সংকটই শুধু ছিলো না; বুদ্ধিবৃত্তি বিকাশের সম্ভাবনা তখন জনমনকে পর্যুদস্ত করে ফেলেছিল। বহরমপুর ক্যান্টনম্যান্টের কমান্ডিং অফিসার কর্ণেল ডাফিন বঙ্কিমচন্দ্রকে (১৮৭৩-৭৪) লাঞ্ছিত করলে বঙ্কিম মনে প্রচন্ড ক্ষোভ সৃষ্টি হয়। যদিও কর্ণেল প্রকাশ্য আদালতে সহস্ৰলোকসম্মুখে বঙ্কিমের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। সেই সমকালেই ‘কমলাকান্তের দপ্তর' (১৮৭৫) রচিত হয়।
'কমলাকান্তের দপ্তর' শুধু বঙ্কিমচন্দ্রের মানস দ্বন্দ্বের ফসল নয়; বরং তৎকালীন শিক্ষিত মধ্যবিত্ত মানুষের মানসিক সংকটেরই প্রতিনিধিত্ব করছে এই তীব্র-তীক্ষ্ণ-ব্যঙ্গাত্মক-করুণ হাস্যরসাত্মক প্রবন্ধ গ্রন্থ। রাজনৈতিক-সামাজিক ক্ষেত্রে, শিক্ষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি ও বুদ্ধিবৃত্তিক— সর্বক্ষেত্রেই এমন নেতিবাচকতা, রুদ্ধশ্বাসের অবস্থা, স্তম্ভিত বিহ্বলতা, চাপা ক্ষোভ এবং নৈঃসর্গের বেদনাময়তা কার্যকর ছিল যে শিল্পী মানসে তো দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হওয়া তখন অনিবার্য হয়ে পড়েছিল। ঔপনেবেশিক শাসক কর্তৃক শোষণ ও কূটচক্রের ফলে এবং কতিপয় স্বার্থান্ধ দালাল ও চাটুবাররা শাসকদের সঙ্গে দহরম-মহরমের কারণে সমাজ ও রাজনীতিতে দুর্বৃত্তায়ণ, দুর্নীতিকরণ, এবং সর্বোপরি মনুষ্য-অকল্যাণকরতার পরিবেশ তখন তীব্রভাবে বিরাজিত ছিল। বঙ্কিমের সচেতন প্রাজ্ঞ-মানবকল্যাণপ্রবণ দূরদৃষ্টিসম্পন্ন শিল্পীমন তখন বিপর্যস্ততার দোলাচলে গভীরভাবে আলোড়িত ছিল। সে সময়পর্বের প্রচলিত আদর্শ, সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক জীবনাচার এমনই এক নেতিবাচকতার নষ্টভ্রষ্টতায় নিমজ্জিত ছিল যে, সচেতন বুদ্ধিজীবী-মনন তখন মানস-সংকটের ঘুর্নাবর্তে পড়তে বাধ্য। এজন্যই ‘কমলাকান্তের জবানবন্দী' তে বঙ্কিমচন্দ্র বলেছেন যে, মানুষটা ক্ষেপিয়া গিয়াছে'। কমলাকান্ত তো আসলে বঙ্কিমচন্দ্র স্বয়ং। সমাজের সামাজিক অসাম্য, সামাজিক ভন্ডামি, রাজনৈতিক কর্মনীতির একদেশদর্শিতা ও ঔপনেবেশিক শাসকদের অর্থগৃধ্রুতার আকাশচুম্বিতা বঙ্কিম-মানসকে বিচলিত ও পীড়িত করেছে বলেই কমলাকান্তের জবানিতে বঙ্কিমচন্দ্ৰ সামাজিক-রাজনৈতিক বাস্তবতার নির্মমতাকে স্পষ্টভাবে প্রবন্ধাকারে এই প্রবন্ধসমূহে তুলে ধরেছেন। একবিংশ শতাব্দীর এই প্রথম দশকে সমাজ-রাজনীতির স্বার্থান্ধতা এবং মানুষের লোভ ও দুর্নীতির উত্তুঙ্গতার সময়পর্ব কমলাকান্তের দপ্তরের বুদ্ধিবৃত্তিক অন্তসারের কথাই আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়। এই খানেই এই প্রবন্ধগ্রন্থ বুদ্ধিবৃত্তিক দূরদর্শিতার সাক্ষ্য বহন করে।
কমলাকান্তের দপ্তর সমকালীন মধ্যবিত্ত জীবনের আশা ও স্বপ্নভঙ্গের আর্তনাদ ও তাদের জীবন-সংকটের অন্তিরায় কষ্টকর বাস্তবতাকেই উপস্থাপিত করে। সমকালীন সামাজিক প্রতিবেশের বিকৃত-বিভ্রান্ত অবয়বের সঙ্গে জনমানসের ঘাত-প্রতিঘাতের দ্বন্দ্বচিত্রের হাহাকারময় দীর্ঘশ্বাসবার্তাই এই প্রবন্ধগ্রন্থে বিঘোষিত হয়েছে। সে সময়ের বর্ধিষ্ণু মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের আত্মোপলব্ধির পথই তখন শুধু অবরুদ্ধ হয়ে পড়েনি; বরং নিম্নবিত্ত মানুষের জীবনেও অনিশ্চয়তার মহান্ধকার ঘনিয়ে ওঠেছিল। তখনকার নবজাগত ব্যবসায়ী শ্রেণীও তাদের শিল্পায়নের পথকে জনগণ-মনোমধ্যে কল্যাণকরতার স্পষ্টতায় আলোড়িত করতে সক্ষম হননি। ফলে সমাজ উন্নয়নের প্রকৃত দর্শন তখন রুদ্ধতার বাতাবরণে আবদ্ধ হয়ে পড়েছিল। জীবনকর্ম ও জৈবনিক চিন্তার জটিলতার রুদ্ধগৃহে বঞ্চিম-মানস ছটফট করছিলো তখন; কমলাকান্তের ভাষ্যমধ্যদিয়ে জীবনের সে বিপর্যয়ের ব্যাকরণই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
কমলাকান্ত চরিত্রটি শ্রেষ্ঠ কমিক চরিত্র; কিন্তু ঔপন্যাসিক বঙ্কিমচন্দ্রের চেয়ে কমলাকান্তের দপ্তরের বঙ্কিমচন্দ্রের অধিকতর সাফল্য এখানেই যে এখানে হাস্যরস ও ব্যঙ্গের মাধ্যমে মানবজীবনের অনেক গভীর তাৎপর্যপূর্ণ অবলোকনকে তিনি দার্শনিক অন্তর্দৃষ্টিকে বৃত করে এই প্রবন্ধগ্রন্থে উপস্থাপনে চরম নৈপুণ্য প্রদর্শন করেছেন। কমলাকান্ত জীবনের অন্তর্নিহিত শূন্যতা ও সমাজের অন্তসারশূন্যতাকে চিহ্নিত করতে সক্ষম হয়েছেন। কমলাকান্তের প্রজ্ঞাদৃষ্টি সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনের গভীরতলে প্রবেশ করে মানুষের ক্ষুদ্রতা, নীচতা, ও হীনতাকে দেখিয়ে দিতে পেরেছে।
সাহিত্যের একটি বুদ্ধিবৃত্তিক ও ওজস্বিতাসম্পন্ন আঙ্গিক হলো প্রবন্ধ। এটি গদ্যে রচিত হয়। বলে জীবনের বিচিত্র বিষয়ের মননগভীরতা এতে প্রত্যাশিত থাকে। সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি, দর্শন, ধর্ম, সংস্কৃতি, নৃবিজ্ঞান, প্রত্নতত্ত্ব, বিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান – অর্থাৎ জ্ঞান শাখার এমন কোন শাখা নেই যা নিয়ে প্রবন্ধ রচিত হয়না। তবে বস্তুনিষ্ঠ প্রবন্ধে ব্যক্তিক-আবেগের চেয়ে বুদ্ধিবৃত্তিক উদ্দেশ্য-প্রবণতা বেশি কাজ করে। অন্যদিকে, মন্বয়ধর্মী বা ব্যক্তিনিষ্ঠ প্রবন্ধে ব্যক্তি-আবেগের সঙ্গে সমাজ-মানসের আন্তসম্পর্ক রূপায়িত হয়। এই ধরনের ময়তা-নির্ভর সাহিত্যিক প্রবন্ধগ্রন্থ হলো বঙ্কিমের কমলাকান্তের দপ্তর।
সাহিত্যের প্রবন্ধ-আঙ্গিকে প্রবন্ধের একটি নির্দিষ্ট দৈর্ঘ্য, ঘনবদ্ধতা ও উদ্দেশ্য-প্রবণ মননধর্মিতা কার্যকর থাকে। তবে 'Cursory' বা ভাসা-ভাসা ভাবে বিষয়ের মধ্যে যে প্রাবন্ধিক মানস যুক্ত থাকে, তা আমি মনে করিনা। বরং প্রবন্ধে থাকতে হবে অন্তর্গভীর দর্শন। একটি উদ্ধৃতি লক্ষ্যযোগ্য : As a form of literature, the essay in a composition of moderate length. usually in prose, which deals in an essay, cursory way with a subject, and in strict ness with that subject only as it affects the writer. প্রাবন্ধিক যদি শক্তিশালী চিন্তাবিদ হন, তাহলে, "The thoughts of the author at length become the thought of the reader'. পাঠকের মনকে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে শুধু জাগ্রতই নয়; বরং প্রভাবিত করাও প্রাবন্ধিকের কাজ। বঙ্কিমচন্দ্রের ‘কমলাকান্তের দপ্তর' এর বিষয়বস্তুর সমাজ-রাজনীতি-সাহিত্য-সংস্কৃতির অন্তদর্শনের বহুরূপিতা বর্তমান সময় ও সমাজ-মানসের মধ্যেও প্রযোজ্যতা রাখার স্পর্ধায় স্পর্ধিত।
'কমলাকান্তের দপ্তর' এর সর্বপ্রথম বাক্যটি হলো: অনেকে কমলাকান্তকে পাগল বলিত।' কমলাকান্ত আসলে পাগল নয়; বরং পাগলের অভিনয় করে সমাজ-রাজনীতির সব নেতিবাচকতাকে তিনি চোখে আঙুল দিয়ে সকলকে দেখিয়ে দিয়েছেন।
কমলাকান্ত যে বলেছেন, 'সাহেব সুবোর কাছে যাওয়া আসা চাই'-এর মাধ্যমে তোষামোদ ও ব্যক্তিত্বহীনতার মাধ্যমে যে অযোগ্যরা সমাজ-রাষ্ট্রের উচ্চপদে আসীন হতো, সে কথাই বঙ্কিমচন্দ্র বলেছেন। বর্তমান সমাজেও এ প্রবণতা খুবই বৃদ্ধি পেয়েছে। মূর্খরা যারা শুধু নাম দস্তখত করতে পারে তারা 'তালুক মুলুক' করেছে বলায় মোসাহেবি করে অযোগ্যরা যে ধনবান হয়ে ওঠেছে সমাজে—তাই লেখক বোঝাতে চেয়েছেন।
সমাজের মধ্যে অধিকাংশ লোকই স্বার্থের পেছনে ছুটতো। বঙ্কিমচন্দ্র 'কে গায় ওই প্রবন্ধে বলেছেন, পুষ্প যেমন নিজের জন্য ফুটে না; তেমনি মানুষ যাতে অন্য মানুষের কল্যাণে তার হৃদয় কুসুমকে প্রস্ফুটিত করে। 'মনুষ্য ফল' প্রবন্ধে বঙ্কিমচন্দ্র 'রমণীমন্ডলী' কে এ সংসারের নারিকেল বলেছেন। কুলীন ব্রাহ্মণেরা 'কাঁদি কাঁদি' নারিকেল 'পাড়িয়া' খেত বলে ব্রাহ্মণরা যে বহুবিবাহ করে সমাজদেহকে কলুষিত এবং নারীদের অধিকার বঞ্চিত করেছে–সেকথাই স্পষ্টতার সঙ্গে লেখক ঘোষণা করেছেন। ছোবরা হলো নারিকেলের বাহ্যিক অংশ; 'রূপও স্ত্রী লোকের বাহ্যিক অংশ' দুটোকেই লেখক অসাঢ় বলেছেন। বরং গুণবতী বিদূষী নারীর প্রতি লেখকের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি কাজ করেছে। ‘পতঙ্গ' প্রবন্ধে লেখক যে লিখেছেন, 'আমরা পতঙ্গ জাতি' পূর্বাপর আলোতে পুড়িয়া মরিয়া আসিতেছি”—এই ভাষ্যমধ্যদিয়ে ইতিহাস পরম্পরায় আমরা যে নির্যাতনের শিকার ছিলাম, সেকথা লেখক বুঝিয়েছেন। তবে ১২০০ থেকে ১৮০০ সময়-পর্বে মুসলিম শাসনের সময় বাংলাদেশ তো সাম্রাজ্য ও অর্থনীতিতে স্বর্ণোজ্জ্বল সময় নির্মাণ করেছিল।
‘আমার মন' প্রবন্ধে লেখক যে লিখেছেন, “আমি চিরকাল আপনার রহিলাম,— পরের হইলাম না, এইজন্যেই পৃথিবীতে আমার সুখ নাই, "।— এর মধ্য দিয়ে আসলে মানুষের উদ্দেশ্যে তিনি বুঝাতে চেয়েছেন যে, মানুষরা যাতে পরোপকারে তাদের জীবনকে উৎসর্গ করে। ধন, যশ এবং ইন্দ্রিয়াদির মাধ্যমে সুখ পাওয়া গেলেও সে সুখকে তিনি ক্ষণস্থায়ী বলেছেন। এই প্রবন্ধের একটি ভাষ্য উদ্ধৃতিযোগ্য; “ টাকা ভক্তি, টাকা মুক্তি, টাকা নতি, টাকা গতি, টাকা ধৰ্ম, টাকা অর্থ, টাকা কাম, টাকা মোক্ষ! ও পথে যাইও না; দেশের টাকা কমিবে, ও পথে যাও, দেশের টাকা বাড়িবে।' মানুষ যে শুধু অর্থের পেছনে ছুটেছে, মনুষ্যত্ব, নৈতিকতা, সততাকে বিসর্জন দিয়ে— জীবনের সে বিপর্যস্ততার কথা লেখক এখানে বলেছেন। ইন্দ্রিয়কে বশীভূত করে নৈতিকভাবে মনুষ্য জীবন যাপন করার কথা প্রাবন্ধিক বলেছেন। বিবাহের মাধ্যমে শুধু কাম চরিতার্থতা নয়; বরং নর-নারীর মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক সৃষ্টির উপর লেখক গুরুত্ব প্রদান করেছেন।
‘চন্দ্রালোকে’ প্রবন্ধে প্রাবন্ধিক ইংরেজদের নিন্দার মধ্যেই রাজনীতিকে আবর্তিত না করে বরং রাজনীতিকে ইতিবাচক দেশপ্রেমিক স্বাদেশিকতায় রূপান্তরিত করার কথা বলেছেন। 'বসন্তের কোকিল' প্রবন্ধে লেখক মানুষকে গলাবাজি না করে বরং কর্মপ্রবণতায় প্রণোদিত হবার কথা বলেছেন। এই প্রবন্ধে প্রাবন্ধিক বিশ্ব-আত্মারূপ প্রভুর প্রতি তাঁর চরম নিবেদনকে নিম্মোক্ত ভাষ্যে ব্যক্ত করেছেন : “এই অসম্ভব সুন্দর জগ্য-শরীরের যিনি আত্মা, তাঁহাকে ডাকি। আমিও ডাকি, তুইও ডাকিস।"
‘স্ত্রীলোকের রূপ' প্রবন্ধে লেখক স্ত্রীলোকের বাহ্যিক রূপের চেয়ে তাদের গুণের প্রতি গুরুত্বারোপ করেছেন। 'আমি শুনিতে চাই যে, তাহারা মুর্ত্তিমতি সহিষ্ণুতা, ভক্তি ও প্রীতি”-এর মাধ্যমে নারীর ধের্য্য, বিনয় ও প্রীতির কম নীয়তার কথা লেখক ব্যক্ত করেছেন। ‘বড় বাজার' প্রবন্ধে মানুষের স্বার্থপর ও ঠকবাজি চরিত্রের কথা বলা হয়েছে। দোকানদার ও পরিদ্দারের মধ্যে যুদ্ধ চলতে থাকে কে কাকে কত বেশি ফাঁকি দিতে পারে। 'সস্তা খরিদের অবিরতচেষ্টাকে মানুষাজীবন বলে- ভাষ্যমধ্যদিয়ে জীবন যাতে নিঃস্বার্থপরতার মহিমায় উদ্ভাসিত হয় সেই উৎকাঙ্ক্ষা তিনি ব্যক্ত করেছেন। 'আমার দুর্গোৎসব' প্রবন্ধে প্রাবন্ধিক দেবী দুর্গাকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন যে, দুর্গা সর্বমানবের জন্যে। নিজের স্বার্থ ভুলে পরের উপকার করা, ইন্দ্রিয়ের দোষকে পরিত্যাগ করে আত্মতত হয়ে স্রষ্টামুখী হবার আখাঙ্ক্ষাও তিনি এই প্রবন্ধে ব্যক্ত করেছেন।
‘একটি গীত' প্রবন্ধে প্রাবন্ধিক যে লিখেছেন, সুখের কথায় বাঙালির অধিকার নেই, দুঃখের কথায় আছে–এর মাধ্যমে বাঙালি যাতে কষ্টস্নানতাকে অতিক্রম করে জৈবনিক স্বাচ্ছন্দ্য অর্জন করে সেই স্বপ্ন তাঁর মধ্যে কাজে করেছে।
'বিড়াল' প্রবন্ধে নিঃস্ব-অভাবী মানুষদের স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ জীবন যাপনের নিশ্চয়তার কথা প্রাবন্ধিক বিড়ালের রূপকে ব্যক্ত করেছেন। 'এ সংসারে ক্ষীর, সর, দুগ্ধ, দধি, মৎস্য, মাংস ই তোমরা খাইবে; আমার কিছু পাইবনা কেন?'— বলে মূলত ধনিক পুঁজিবাদী (Capitalist) শ্রেণীকে আক্রান্ত করে গরিবদের অধিকার-পূর্ণ সুন্দর জীবনের আশাবাদের কথা ব্যক্ত করেছেন।
‘ঢেঁকি' প্রবন্ধে লেখক অত্যাচারী ব্যক্তিদের রূপক হিসেবে ‘ঢেঁকি'কে উপস্থাপন করেছেন। জমিদাররূপী ঢেঁকিরা 'প্রজাদিগের হৃৎপিণ্ড' পিষে তাদের আর্থিক-মানসিক জীবনকে বিপর্যস্ত করে দেয়। লেখক ঢেঁকি-কে প্রাবন্ধিক খুব ভয়ানক হিসেবে চিহ্নিত করেছেন, কারন প্রকৃত বিদ্যা, জ্ঞানচর্চা, প্রজ্ঞা ও নৈতিকতার বদলে তারা 'মা সরস্বতীর মুগু ছাপার গড়ে পিষিয়া বাহির করে।
বঙ্কিমচন্দ্র খুবই মানবিক দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন একজন লেখক ও চিন্তাবিদ। 'একা' প্রবন্ধে তিনি মনুষ্যত্বের জয়পতাকা উড্ডীন করেছেন, এভাবে “মানুষ জাতির প্রতি যদি আমার প্রীতি থাকে,তবে আমি অন্য সুখ চাই না।" মানুষকে ভালবেসে মানবজাতির উপকার করে তিনি তার জীবনকেঅতিবাহিত করার আকাঙ্ক্ষা এই প্রবন্ধের মধ্যে অভিব্যক্ত করেছেন।
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ঔপন্যাসিক হিসেবেই শুধু বিবেচ্য নন; তিনি বাঙালির একজন উচ্চমাপের চিন্তাবিদ-দার্শনিক। ধর্মতাত্ত্বিকও বটে। চিত্তের শুদ্ধি ও প্রবৃত্তির পাপ থেকে মুক্ত থাকাকে তিনি সকল ধর্মের প্রান বলেছেন। উনিশ শতকের শেষার্ধে বাঙালি সমাজ-রাজনীতি সংস্কৃতি-শিক্ষা ও সাহিত্যে যে মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটেছিল, তার অপনোদনার্থে তিনি প্রাজ্ঞ দার্শনিকের দৃষ্টিতে নৈতিক-মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির উন্মোচনের মধ্যদিয়ে জীবনের ইতিবাচক আশাবাদের আকাঙ্ক্ষা অনুসন্ধান করেছেন, তাঁর ‘কমলাকান্তের দপ্তর' শীর্ষক বিখ্যাত প্রবন্ধগ্রন্থে।
তথ্যসংগ্রহঃ-
কমলাকান্ত (বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়)
ভুমিকাঃ
ড. রহমান হাবিব
সহযোগী অধ্যাপক বাংলা বিভাগ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।
0 মন্তব্যসমূহ