--চর্যাপদ এর ভাষা, ও চর্যাপদ এর ব্যাকরণ, সান্ধ্যভাষা, চর্যাপদ এর ভাষা, চর্যাপদ এর ছন্দ, সন্ধ্যাভাষার পরিচয়, চর্যাপদ কোন যুগের আবিষ্কার, সন্ধ্যাভাষার বৈশিষ্ট্য কাল--
**বিঃদ্র-বাংলা বিভাগের সকল পড়াশোনা পেতে ব্লগটিতে যুক্তথাকুন https://monoweredu13.blogspot.com/?m=1
চর্যাগানগুলো সম্পাদন করে গ্রন্থের ভূমিকায় আচার্য হরপ্রসাদ শাস্ত্রী লিখেছেন- "সহজিয়া" ধর্মের সঞ্চল বই-ই সন্ধ্যাভাষায় লেখা। সন্ধ্যাভাষা মানে আলো-আঁধারির ভাষা কতক আলো, কতক আধার, খানিক বুঝা যায়, খানিক বুঝা যায় না।” ডঃ সুকুমার সেনের মতে—"দিবারাত্রির মোহনার সঙ্গে এ ভাষার কোনও সম্পর্ক নেই। 'ধ্য ধাতুর অর্থ এখানে স্পষ্টই প্রতীয়মান। সুতরাং বিশেষ অর্থবিশিষ্ট বা ধ্যানের ভাষা বলেই একে সন্ধ্যাভাষা' বলে অভিহিত করা হয়েছে।"
চর্যার ভাষা 'সন্ধ্যাভাষা'। অর্থাৎ সন্ধারই মত একটা রহস্ব- ময়তা প্রত্যেকটি চর্মাকে ঘিরে রয়েছে। চর্যাগীতের গূঢ় অর্থ নির্ণয় করতে যথেষ্ট ভাবতে হয়। অনেকক্ষেত্রেই প্রচলিত কোন ধাধ। অথবা প্রবাদবাকা কবির উপজীব্য। আর সেই সঙ্কেতের সাহায্যে সহজ ধর্মের তত্ত্ব ও সাধন পদ্ধতি জ্ঞাপন করা হয়েছে।
চর্যা ও দোহা রচনার যুগে বাংলায় ও বাংলার বাইরে শৌরসেনী অপভ্রংশই বিশেষভাবে সাহিত্যের ভাষা ছিল। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে তখন বাংলা ভাষাও ক্রমশঃ পরিপুষ্ট হয়ে সাহিত্যের উপযুক্ত ভাষা বলে পরিগণিত হয়। এমনও দেখা যায়, সে যুগে একই কবি বাংলা ও শৌরসেনী অপভ্রংশ-এ দু’ভাষাতেই সাহিত্যই সৃষ্টি করেছেন।
বাংলা ভাষাতত্ত্ববিদ পণ্ডিত ডক্টর সুনীতিকুমার চট্টো-- পাধ্যায়, ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, ডক্টর প্রবোধচন্দ্র বাগচী ভাষাতত্ত্বের বিচারে চর্যাগীতিকে নিঃসন্মেছে বাংলা ভাষার প্রাচীনতম নমুনা ঘোষণা করেছেন। চর্যার ব্যাকরণ, ছন্দ ও অলঙ্কারের সামার ব্যতিক্রম থাকলেও ওগুলো বাংলা ভাষার ই আদিরূপ এবং বাঙ্গালীর নিজস্ব সম্পদ।বাংলা ভাষার মত এর নিকটবর্তী ভাষাগুলোও-যেমন আসামী, উনি, হিন্দী, মৈথিলী ইত্যাদি চর্যাপদকে তাঁদের ভাষার প্রাচীনতম নমুনা বলে দাবি করেছেন।
***চর্যাপদের ব্যাকরণ/চর্যাভাষার ব্যাকরণঃ---
ক.ধ্বনিতত্ত্বঃ-
(১).প্রাকৃতের স্তরে সমীভূত যুক্ত ব্যয়নের সরলীকরণ এবং পূর্ববর্তী হ্রস্বম্বরের ক্ষতিপুরণমূলক দীর্ঘতা: জন্ম > জন্ম > জাম, কর্ম> কম > কাম-জামে কাম কি কাজে জাম (২২)। তবে বানানে কোথাও কোথাও এই দীর্ঘীকরণের চিহ্ন অনুপস্থিত—মধ্যেন> মস্কেন> মার্কে-র বদলে মঝে—সরা নারী মঝে উদ্ভিল চীরা (৪)। এ সব ক্ষেত্রে অ্য লিপিকর-প্রমাদ ও ঘটতে পারে।
(২)- অর্ধতৎসম শব্দে যুক্ত ও যুগ্ম ব্যয়নের সংরক্ষণ: দুর্লক্ষ্য > দুলথ—দুলকথ বিশানা (২৯), মিথ্যা > মিচ্ছা—উদক-চান্দ জিম সাচ ন মিচ্ছ। (৩৯), মৌক্তিক> মুক্তি— লব এ মুভিহার (১১)।
(৩). পদান্তের স্বরধ্বনি উচ্চারিত হয়। যেমন, ভগতি > ভনই—ডগই লুই (১), বসই সবরী বালী (২৮)। তবে কোথাও কোথাও পদান্তের-ইঅ (ইঅ) ই (ঈ)-তে রূপান্তরিত হয়েছে, যথা, পুস্তিকা > পোথিঅ > পোথী—আগম পোধী ইষ্টামালা (s), উত্থিত> উট ঠিঅ > উঠিঅ > উঠি—গঅণে উঠি চর অমণ ধান (২১)।
(৪)পদের মধ্যস্থিত একাধিক সন্নিকৃষ্ট স্বরধ্বনির মধ্যে কোথাও কোথাও য-শ্রুতি ও ব-শ্রুতির আগম: নিকটে > নিয়ড্ডী—নিয়ড্ডী বোহি দূর ম জাহী (৫), সমায়াতি > বামায়—বেণ্টে যামা (৩৩), অমৃত > অমিঅ > অমিয় (1) – অমিয়া আচ্ছন্তে বিস গিলেসি (৩৯), আয়াতি> আবই (=আত্মই)—ভব জাই ণ আবই (৪২), চেতয়তি চেঅই> চেবই (=চেঅই)—ঘুমই ৭ চেবই সপরবিভাগা (৩৩), ছেদয়তি> ছেত্মঅই > ছেবই (=ছেই)—ছেবই বিদুজন গুরু পরিমাণী (৪৫)।
(৫)পদের আদিতে স্বাসাঘাতের ফলে কোথাও কোথাও আস্থ্য অ-কারের দীর্ঘীভবনঃ বলিকা>কদিআ> কাছিমেলিলি কাচ্ছী (৮), চন্দ্র চন্দ > চাল-চান্দরে চাল কান্তি (৩১), জালন্ধবি (৩৬, পশ্চিমা হিন্দীতে 'জলস্করি'), পাণ্ডিত চাএ (<পণ্ডিতাচার্ব (৩৬), অংক:> হক:> হউ> হাউ (১, ১৮, ২০)।
খ. রূপতত্ত্বঃ-
১। চর্যার ভাষায় লিঙ্গ দুটি—পুংলিঙ্গ ও স্ত্রীলিঙ্গ। বাক্যে স্ত্রীলিঙ্গের প্রভাব অত্যন্ত সক্রিয়। কর্তা স্ত্রীলিঙ্গ হলে নিষ্ঠান্ত অতীতকালের ক্রিয়ারূপে স্ত্রী-প্রত্যয় ব্যবহৃত হত। যেমন, সোনে পরিণী করুণ৷ নাবী, কিংবা সসি লাগেনী তান্তী, কিন্তু পুংলিঙ্গে—ছহিল . চলিল কাহ্ন, ইত্যাদি।
২। শব্দরূপে একবচন ও বহুবচনের কোন তফাৎ নেই। বহুত্ব বোঝাবার জন্য কতকগুলি সমষ্টিবাচক শব্দ, যথা, লোহ (<লোক), সকল, জাল ইত্যাদি ব্যবহৃত হত —পারগামি লোখ, তুমহে লোখ, সকল সমাহিঅ তান্তিধ্বনিসএল, জোইনিজালে (খনি পোহাম—১৯), জাঙ্গু হনয়ে তুট্টই ইন্দিআল (৩০)।
৩।একই বিভক্তির দ্বারা একাধিক কারকের অর্থজ্ঞাপনঃ- এ, এ, “তে, এতে করণ ও অধিকরণ উভয় কারকেই প্রাফ হত। করণ: মুখদুখেতে, অপণে, সাণে, বেগে, আলিএ কালিত অধিকরণ : ঘরে, তৈলোএ, চীত্র, তিমাত্র, ঘরে, হিএ।
(৪)ক্ষেত্র বিশেষে বিভক্তির হলে অতসর্গের ব্যবহার করণের অনুসর্গ— সাথে, দি, বি, নই, সম, বিনে-জ্জন সাহে, দি চালী, তই বিহ, বহর লই, পিঠে সম, নিন্দ বিহণে।
(গ)শব্দরূপ :
(ক) বিশেষ্য:
কর্তা : কর্তৃবাচ্যের কর্তায় বিভক্তি প্রত্যক্ষ নয়—লুই ভগই, সঙ্গুরা নিদ পেল বছড়ী জাগঅ, ভবণই গহণ গম্ভীর বেগেঁ বাহী, লোঅ নির্ভর তরই। কর্মভাববাচ্যের অমুক্ত কর্তার বিভক্তি'-এ,-এ’, যথা, কুম্ভীরে থাঅ, কুক্কুরী পাত্র, মতিত্ৰ । কর্ম : মুখ্যকর্মের বিভক্তি ও প্রত্যক্ষ নয়, যথা, রুথের তেন্ডলি কুম্ভীরে থাম, গুরু পুচ্ছিঅ জান, রূপা থোই নাহিক ঠাবী, কমলরস পিবমি।
(খ)সর্বনাম :
দু একটি ক্ষেত্র ছাড়া বহুবচনবোধক পৃথক সর্ব নাম পদ নেই। বহুক্ষেত্রেই প্রথম পুরুষের সব নাম পদ ও নির্দেশক সব নাম পদ রূপের দিক থেকে অভিন্ন। কতকগুলি সর্ব নামজাত পদ বিশেষণ ও ক্রিয়াবিশেষণ রূপে ব্যবহৃত। সব নামের সম্বন্ধ পদ লিঙ্গান্তর-সাপেক্ষ।
কর্তা (কন্তু বাচো)
উত্তমপুরুষ : আমূহে, অভে. অহ মে. মো. হাঁড়ি।
মধ্যমপুরুষ: তুমহে, তু, তো, তুমহে লোঅ (বহুবচন)।
(ঘ)কালঃ-
বর্তমান কাল :
উত্তমপুরুষঃ--একবচন
-মি (< অশ্মি) পেথমি, জাণমি পুছমি, লেমি।-সি (< অসি) পুছসি, বাসসি, বাসি,বহুবচনঃ-আছছ', করছ, খেলছ,জাণহ, বিহরহ নেই।-হ (< :-),জাণহ, পরিমাণহ, ছেবহ,গিলেসি, বুঝসি, আইসসি,বিরূহ, হুবহ।
ভবিষ্যত কালঃ-
যথা, করিব নিবাস ( নিবাসঃ কৰ্ত্তব্যঃ) । মই ভাইব কীষ, জই তুমহে লোম হোইব পারগামী। স্ত্রীলিঙ্গে মই দিবি পিরিচ্ছা (=ময়। দাতব। পৃচ্ছা)।
অতীত কালঃ-
যথা, হুউহুকে কিঅ আহতু দাম, কাজ ডোহী বিবাহে চলিআ, জাহের বাণ চিহ্ন এবন জানী, কমল বিকমিউ। প্রাযুক্ত। অতীতের পদে কর্মবাচ্যে কোন বিভক্তি যুক্ত হয় না, তবে কর্তা কর্ম স্ত্রীলিদ হলে স্ত্রী-প্রত্যয় যুক্ত হয়, নই দেখিল নেয়া সৃষ্টম), মেলিলি কাছী (মুক্তা কক্ষিকা)।
**ছন্দঃ--
চর্যাগানগুলি যখন রচিত হয় তখন চর্যাকারদের সামনে দুটি ছান্দসিক আদর্শ বিদ্যমান ছিল. একটি অভিজাত সংস্কৃত ছন্দ, অন্যটি লৌকিক অপভ্রংশ ছন্দ। এই দুয়ের মধ্যে সংস্কৃতের ছান্দসিক আদর্শ চর্যাগানে একেবারেই গৃহীত হয়নি। কেননা, সংস্কৃত ছন্দে অগর সংখ্যা ও স্বরের লঘু-গুরুত্ব সম্পর্কে নিয়ম শৃঙ্খলা বড়ো কঠোর ও অনমনীয়। কিন্তু শব্দ বা শব্দগুচ্ছের আছক্ষরে শ্বাসঘাতবিশিষ্ট বাঙালীর উচ্চারণে সংস্কৃতের এই লঘু-গুরু-সংক্রান্ত নম রক্ষা করা সম্ভব ছিল না।।পাদাকুলকের অন্যান্য লক্ষণ—এতে চারটি পাদ, প্রতিপাদে ১৬ নারা এবং আর্ট মাত্রার পর যন্ত্রপাত ঘটে। চর্যার প্রায় অধিকাংশ গানই পাহাকুলকের আদর্শে রচিত।
(1) কাআ তরুবর। পঞ্চ বি ডাল।
চন্চল চীএ। পইঠে৷ কাল ।
(২) টালত মোর ঘর। নাহি পড়িবেষী।
হাড়ীত ভাত নাহি। নিতি আবেশী।
(৩) নগর বাহিরে ডোম্বি। তোহোরি কুড়িআ
ছোই ছোই জাই সো৷ ৰাহ্মণ নাড়িআ ॥
(৪) চালিঅ যহর। গউ নিবাণে।
কমলিনি কমল। বহই পণালে ৷
কিন্তু বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে মাত্র। ও অন্ত্য মিলের ব্যাপারে অপভ্রংশের অস্ত্যাহ প্রাস ও সমমাত্রিকতার রীতি সর্বত্র অবিকল অনুহৃত হয়নি। যেমন, উদাহরণে প্রদত্ত প্রথম পদটির মাত্রা সংখ্যা লক্ষ্য করা যাক :
૨ ১ ১ ১ ১৷ ২ ১ ১ ২ ১
কাআ ত রু ব র | পন চ বি ডাল =৮+৭
২ ১ ১ ২ ২ ১ ১ ২ ২ ১
॥ চন চল চীএ | পই ঠো কাল | =৮+৭
***তথ্যসংগ্রহঃ--
**চর্যাগীতি (অধ্যাপক হরলাল রায়)
**চর্যাগীতি পরিক্রমা(অধ্যাপক নির্মল কুমার দাশ)
0 মন্তব্যসমূহ