--নাথ সাহিত্য নাথ সাহিত্য বলতে কি বুঝ নাথ সাহিত্য কত প্রকার
নাথ সাহিত্য কাকে বলে নাথ সাহিত্যের কাহিনী
মহাযোগী গোরক্ষনাথ গোরক্ষবিজয়
নাথ ধর্ম নাথ পদবী--
**বিঃদ্র-বাংলা বিভাগের সকল পড়াশোনা পেতে ব্লগটিতে যুক্তথাকুন https://monoweredu13.blogspot.com/?m=1
**নাথ সাহিত্য ---
বাংলা সাহিত্য কে প্রধানত তিনটি যুগে ভাগ করা হয়েছে। প্রাচীন যুগ, মধ্যযুগ এবং আধুনিক যুগ । মধ্য যুগে যে সকল সাহিত্য রয়েছে তাদের মধ্যে নাথ সাহিত্য অন্যতম।
মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য প্রধানত বিভিন্ন ধর্ম ও উপধর্ম সম্প্রদায়ের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়েছে। শাক্ত, শৈব, বৌদ্ধ, বৈষ্ণব-এগুলি প্রধান ধর্মসম্প্রদায়। এরও পিছনে আছে বিশাল আর্ভের সংস্কৃতি। একদা প্রায় সারা ভারতবর্ষেই দ্রাবিড় ও নিষাদ সংস্কৃতি ছড়িয়ে পড়েছিল। আর্যরা এলেন তার অনেক পরে। এই মিশ্র ধর্ম চেতনা সারা ভারতবর্ষকেই নিয়ন্ত্রিত করেছে।শৈব নাথধামতও বিচিত্র ধর্মবোধের বারা নিয়ন্ত্রিত। বাংলাদেশে শৈব, নাথ সম্প্রদায় এখনও আছে। যগাঁ নামেই এই সম্প্রদায় সাধারণতঃ পরিচিত। এই সম্প্রদায়ভুক্ত সমাজনেতারা বলেন, আসলে তাঁরা 'যোগী', কিন্তু শব্দটি দ্রষ্টহরে 'যগী' এই অপশব্দে পরিণত হয়েছে। দশম শতাব্দীর দিকে সারা উত্তর ভারতে গোরক্ষ-পন্থী নাথসম্প্রদায় ছিল, পশ্চিম ভারতেও এদের বিশেষ প্রভাব দেখা যায়। বাংলাদেশেও এই সম্প্রদায় অতি প্রাচীন কাল থেকে নিজেদের সাধনভজন করে আসছিলেন এবং এখনও নানা শাখা-প্রশাথায় এরা বাংলাদেশের নানা অঞ্চলে ছড়িয়ে আছেন। এদের ধর্মকর্ম ও আচার-আচরণকে কেন্দ্র করে অনেক ছড়াপাঁচালী, লোকগীতি, আখ্যানকাব্য পাওয়া গেছে,সাহিত্যের ইতিহাসের দিক থেকে যার মূল্যে স্বীকার করতে হবে। দীনেশচন্দ্র সেন মনে করতেন, এই সাহিত্যের অন্তর্ভুক্ত ময়নামতীর গান, গোপ চিন্দ্রেরগান, গোরক্ষবিজয় প্রভৃতি ছড়াগান ও আখ্যানকাব্য বাংলা সাহিত্যের আদিপর্ব' অর্থাৎ দশম-দ্বাদশ শতাব্দীর দিকেই রচিত হয়েছিল। কিন্তু এই রচনা গুলি বিশেষ প্রাচীন নয়। ছড়াগুলি উত্তর বঙ্গের কৃষকদের মখে থেকে শুনে লিখে নেওয়া হয়েছে—কাজেই এগুলি হাল আমলের। 'গোরক্ষবিজয়' বা‘মনিচেতন'-এর পথিও দাএক শতাব্দীর পূর্ববর্তী হতে পারে, কিন্তু তার চেয়ে পুরাতন নয়। কাজেই প্রাপ্ত নাথসাহিত্যকে আমরা সপ্তদশ শতাব্দীর অন্তর্ভূক্ত করে আলোচনায় অগ্রসর হচ্ছি। তবে এই প্রসঙ্গে একথাও স্বীকার করতে হবে যে, বাংলা সাহিত্যের আদিপর্বে কোন-না-কোন প্রকার নাথসাহিত্য রচিত হওয়াই সম্ভ। কিন্তু তুর্কী অভিযানের পর প্রায় দশ বছর ধরে এদেশে যে ভয়াবহ অরাজকতা চলেছিল, তার বন্যাধারায় বোধ হয় এইজাতীয় সাহিত্যের নিদর্শন সম্পর্ণে অদৃশ্য হয়ে গেছে। চর্যাগীতিকার নথি নেপাল থেকে পাওয়া গেছে, এ পথি বাংলায় থাকলে আমরা পেতাম বলে মনে হয় না। এ-ও সেই অরাজকতার আঘাতে বিলপ্ত হয়ে যেত। কোন প্রদেশে 'গোরক্ষপন্থী নামেও পরিচিত।
নাথধর্মে ন'জন গরুর কথা জানা যায়। বৌদ্ধ তান্ত্রিকেরাও তাঁদের চুরাশি জন সিদ্ধাচার্যের সঙ্গে এই ন'জন নাথেরও পূজা করতেন।চর্যাগীতিকার পদে ও টীকায় নাথধর্মা ও নাথগরের উল্লেখ আছে। নাথধর্ম সংক্রান্ত গ্রন্থাদিতে এই নজন নাথের নামধাম থাকলেও এক গ্রন্থের বর্ণনার সঙ্গে অন্য গ্রন্থের বর্ণনার রেখায় মিল নেই। মোটামটি তাঁদের নাম-ধাম এইরকমঃ পর্বে (গোরক্ষনাথ) উত্তরাপথে জলধর (জালামুখী তীর্থ), দক্ষিণে নাগার্জুন (গোদাবরী নদীর কাছে), পশ্চিমে (দত্তাত্রেয়, দক্ষিণ-পশ্চিমে (দেবদত্তউত্তর-পশ্চিমে জড়ভরত কুরুক্ষেত্র ও মধ্যদেশে আদিনাথ এবং দক্ষিণ-পূর্বে সমদ্রোপকূলে মৎস্যেন্দ্রনাথ) এই হচ্ছেন নজন নাথগুরু। মারাঠী কাহিনী থেকে দেখা যাচ্ছে, আদিনাথ শিবের কাছে 'মহাজ্ঞান' (অর্থাৎ পিণ্ডদেহে মোক্ষলাভ বা অমরত্ব লাভ) শিক্ষা করেন শিব-ঘরণী পার্বতী, মৎস্যেন্দ্রনাথ ওজালন্ধরিপাদ। মৎস্যেদের (বাংলাদেশের মীননাথ) দুজন শিষ্য-গোরক্ষনাথও চৌরঙ্গীনাথ। জালধরের দুই শিষ্য-কানিফা (বাংলার কানপা) ও ময়নামতী। গোরক্ষনাথের দুই শিষ্য—গৈনীনাথ ও চপটিনাথ। এদেরও নানা শিষ্যপরম্পরা আছে, বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের আলোচনায় তার ততটা প্রয়োজন নেই। বাংলা সাহিত্যে আদিনাথ শিব, পার্বর্তী, মৎস্যেন্দ্রনাথ অর্থাৎ মীননাথ, গোরক্ষনাথ, জালারিপাদ অর্থাৎ হাড়িপা, রাণী ময়নামতী, কানপাএবং মনোমতীর একমার সন্তান গোপীচন্দ্র বা গোবিন্দচন্দ্রকে নিয়ে কিছ্যা কাব্যকাহিনী লেখা হয়েছে। আমাদের আলোচনার বিষয় শব্দে এইটুকু। এর মধ্যে মীননাথ-গোরক্ষনাথের কাহিনীকে কেন্দ্র করে .একাধিক পদখি লেখা হয়েছে। ময়নামতী ও তাঁর ছেলে গোপীচন্দ্রের বিষয়েবেশীর ভাগ মৌখিক ছড়া পাওয়া গেছে। আলোচনার সবিধের জন্য এই
মাথসাহিত্যকে দুটি বৃত্তে ভাগ করা যায়----
-(১) গোরক্ষনাথ বৃত্ত,
(২) ময়না মতী-গোপীচন্দ্র (গোবিন্দচন্দ্র) বৃত্ত।
১) গোরক্ষনাথ বৃত্ত----
গোরক্ষনাথকে কেউ কেউ ঐতিহাসিক ব্যক্তি বলতে চান। অষ্টম শতাব্দী থেকে চতুর্দশ শতাব্দীর মধ্যে যে-কোন সময়ে তিনি মর্তাদেহ ধারণ করে বর্তমান ছিলেন, এমন কথা শোনা যায়। ভারতের নানা অঞ্চল তাঁর আবির্ভবিস্থান বলে কম্পিত হয়েছে। এবিষয়ে চূড়ান্ত মীমাংসা হওয়া সংকঠিন।কারণ নানাপ্রকার জনশ্রুতি এবং পরোক্ষ উল্লেখ ভিন্ন তাঁর সম্বন্ধে ইতিহাসের দিক থেকে কোন সুদৃঢ় প্রমাণ উপস্থাপিত করা যায় না। যাঁরা এ বিষয়ে গবেষণা করেছেন, তাঁরা মনে করেন গোরক্ষনাথ পেশোয়ারে আবির্ভূত হয়েছিলেন( যোগী-সম্প্রদায় অর্থাৎ গোরক্ষপন্থীরা মনে করেন, তিনি পাঞ্জাবের অধিবাসী ছিলেন, পরে বিহারের গোরক্ষপুরে বাস করেছিলেন। এই সমস্ত তথ্য থেকে মনে হয়, তিনি উত্তর বা উত্তর-পশ্চিম-ভারতে কোন-না-কোনসময়ে মতশিরীরে বর্তমান ছিলেন।সম্ভবতঃ তিনি ভারতীয় সন্ন্যাসীদের মতো বহু স্থান ভ্রমণ করেছিলেন। তাঁর নানা অঞ্চলের শিষ্যেরা গরুকে
তাঁদের অঞ্চলে আবির্ভূত বলে দাবি করেছিলেন। যাই হোক, তাঁকে দশমী বা দ্বাদশ শতাব্দীর পরবর্তী মনে হচ্ছে না, খুব সম্ভব তিনি একজন ঐতিহাসিক
ধ্যরি–এর বেশী আর বিশ্বাসযোগ্য কোন তথ্য পাওয়া যায় না। পরবর্তীকালে শিব-মংসোন্দ্রনাথের পৌরাণিক আখ্যানের সঙ্গে তাঁর কাহিনী জুড়ে গিয়ে তিনি পৌরাণিক চরিত্রে পরিণত হয়েছেন।
গোরক্ষনাথকে ঘিরে নানাপ্রদেশেই অনেক রকমের গল্পের সৃষ্টি হয়েছে,আমরা শুধু বাংলাদেশের গোরক্ষনাথ-কাহিনীরই আলোচনা করব। গোরক্ষনাথ কর পথদুষ্ট এর, মীননাথকে উত্তর করার কাহিনী নিয়ে এদেশে
দূরেকমের বই লেখা হয়েছিল, একটির নাম 'গোরক্ষবিজয়, বা 'গোর্খ'বিজয়',আৰু একটির নাম 'মীনচেতন'। দুটির বিষয় একই।
কামক্রোধবিজয়ী সাত্ত্বিক পুরোষ গোরক্ষনাথ কীভাবে
তাঁর পথভ্রষ্ট গরুকে নারীদের কবল থেকে উদ্ধার করলেনএ কাব্যের মূলকাহিনীতে তারই পরিচয় আছে দেখা যাচ্ছে, আদিপুরুষ নিরঞ্জনের মুখ থেকে শিব, নাভি থেকে মীননাথ, হাড় থেকে হাড়িপা বা জালন্ধরিপাদ (বা
জালধরিনাথ), কান থেকে কানিফা (কানপা) এবং জটা থেকে গোরক্ষ (গোর্খ)নাথের জন্ম হল।
শিব জন্মালেন আদিপরেষের শ্রেষ্ঠ অঙ্গ মথে থেকে, আর গোরক্ষনাথ জন্মালেন উত্তমাঙ্গের সন্ন্যাসের চিহ্ন জটা থেকে। কাজেই গোরক্ষ কামক্রোধবিজয়ী সাত্ত্বিক সন্ন্যাসী। নিরঞ্জনের সর্বশরীর থেকে জন্মালেন গৌরী। নিরঞ্জনের নির্দেশে শিব গৌরীকে বিয়ে করলেন। এর পরে মীননাথও হাড়িপা (জালন্ধরিপাদ) মহাদেবের শিষ্য হলেন, গোরক্ষনাথ মীননাথকে গূরু বলে বরণ করলেন
এবং কানপা হলেন হাড়িপার শিষ্য।তারপর তাঁরা যোগধ্যানে নিমগ্ন হলেন। একদিন মহাদেব গৌরীকে সগোপনে যখন গহ্যাতিগহ্য “মহাজ্ঞান"তত্ত্ব বোঝাচ্ছিলেন তখন লোভী মীননাথ মাছের রূপ ধরে তা শুনে নেন। তাতে মহাদেব রুদ্ধ হয়ে তাঁকে বললেন যে, মীননাথ যা শুনেছেন তা সব ভুলে যাবেন। এরপর একদিন মহাদেবের শিষ্যদের নৈতিক বল পরীক্ষার জন্য পাবর্তী তাঁদের নিমন্ত্রণ করে অন্ন পরিবেশন করতে লাগলেন।
অন্য সমস্ত সিদ্ধা তাঁর ভুবনমোহন লাবণ্য দেখে মনে মনে কামের বশীভূত হয়ে পড়লেন। কিন্তু গোরক্ষনাথ তাঁকে মাতৃভাবে দেখলেন, এবং মনে মনে বললেন, আহা, ইনি যদি আমার মা হোতেন,তা হলে এর কোলে শিশু হয়ে দুধ খেতাম। পার্বতী অন্য শিষ্যদের চিত্ত চাঞ্চল্যের জন্য অভিশাপ দিলেন, কিন্তু তিনি গোরক্ষনাথকে আরও পরীক্ষাকরতে মনস্থ করলেন এবং পথের একপাশে বিবস্থা অবস্থায় শয়ে যতিশ্রষ্ঠের মনে বিকার সৃষ্টি করতে চাইলেন। কিন্তু গোরক্ষনাথ এতে কিছুমাত্র বিচলিত হলেন না, বরং এই অনূচিত কর্মের জন্য দেবাঁকে বিড়ম্বনার মধ্যে ফেললেন।যাইহোক, শিব গোরক্ষনাথকে বিয়ে করে সংসারী হতে বললেন। বাধ্য হয়ে গোরক্ষনাথ এক রাজকন্যাকে বিয়ে করলেন বটে, কিন্তু তাঁর সঙ্গে দাম্পতাজীবন যাপন করলেন না, কারণ তিনি যোগমার্গের সাধক, এ পথ তাঁর নয়।স্ত্রী এতে দুঃখ পেলে তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন যে, তাঁর স্ত্রী পুত্রসন্তান পাবেন—এর নাম কর্পটীনাথ। অতঃপর স্বপিত্রাদি ছেড়ে যোগী পথে বেরিয়ে পড়লেন। সেখানে কানপোর কাছে শুনলেন, তাঁর গরে, মীননাথ কদলী(অর্থাৎ প্যাঁলোক) রাজ্যে গিয়ে জপধ্যানাদি বিসর্জন দিয়ে ভোগসমূখে দিনকাটাচ্ছেন। তাঁর একটি ছেলেও হয়েছে, তার নাম বিন্দ,নাথ। তখন গোরক্ষউপযুক্ত শিষোর কাজ করবার জন্য ব্যস্ত হলেন এবং গরকে সংসারের মোহজাল থেকে উদ্ধার করে আবার যোগসন্ন্যাসের পথে ফিরিয়ে আনতে চাইলেন।তার জন্য তিনি সংরক্ষিত কদলীর পুরীতে গিয়ে নানা কৌশলে নর্তকীর বেশে মীননাথের সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন এবং নতাগীতের ছলে গহ্বকে বিস্মত'মহাজ্ঞান' স্মরণ করিয়ে দিতে চাইলেন। গর, সবই বুঝতে পারলেন বটে,কিন্তু সহজে কি দ্বীপত্রাদি ও সংসার বাঁধন কাটা যায়? গোরক্ষনাথ নিরূপায়হয়ে গুরুপূর বিন্দনাথকে মেরে ফেলে গরে মোহভঙ্গের চেষ্টা করলেন।কদলী রমণীরা কলরব করতে লাগল। তখন গোরস্নাথ বিন্দ নাথকে বাঁচিয়ে দিলেন বটে, কিন্তু নারীদের বাদড় করে উড়িয়ে দিলেন। বাদাড়ের দল উড়েচলে গেল কোথায় কে জানে! মীননাথের মোহ দূর হল। দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে,যেন স্বপ্নভঙ্গের পর, শিষ্যের হাত ধরে আবার সন্ন্যাসের পথে বার হলেন, পূরবিন্দনাথও সন্ন্যাস নিয়ে তাঁদের অনুসেরণ করল।
(২) ময়না মতী-গোপীচন্দ্র (গোবিন্দচন্দ্র) বৃত্ত---
বাংলাদেশের কোন কোন অঞ্চলে, বিশেষতঃ উত্তরবঙ্গের কৃষকসমাজে রাজাগোপীচন্দ্র ও তাঁর মাতা রাণী ময়নামতীর সম্বন্ধে অনেক অলৌকিক কাহিনীছড়া-পাঁচালী আকারে এখনও ফলিত আছে। কেউ কেউ বলেন, বাংলাদেশ থেকেই মূল কাহিনীটি বিহার, পাঞ্জাব,
রাজপুতানা, গজরাট, মহারাষ্ট্রে গিয়েছিল। বাংলার কাহিনীতে দেখা যাচ্ছে ত্রিপুরার অন্তর্গত মেহারকুলের রাজা মাণিকচন্দ্রের স্ত্রী হলেন রাণী ময়নামতী
এবং পত্রের নাম গোপীচন্দ্র বা গোবিন্দচন্দ্র। এই কাহিনীর কেন্দ্র কিন্তু রংপুর। নেপালে প্রাপ্ত ‘গোপীচন্দ্ৰ নাটকে' গোপীচন্দ্রকে বঙ্গের রাজা বলা হয়েছে। প্রাচীন কবি মহম্মদ জায়সীর হিন্দী কাব্য ‘পদ্মাবতে'ও গোপীচন্দ্ৰ
বাংলার রাজা বলে উল্লিখিত হয়েছেন। গজরাটী উপাখ্যানে গোপীচন্দ্রের পিতা তিলকচন্দ্রকে (মাণিকচন্দ্র নন) বাংলার রাজা বলেই উল্লেখ করা হয়েছে।ময়ূরভঞ্জ থেকে ওড়িয়া ভাষায় রচিত গোপীচন্দ্র-সংক্রান্ত যে কাহিনী পাওয়া গেছে, তাতেও তাঁকে ‘বঙ্গের রায় বলা হয়েছে। সুতরাং ধরে নেওয়া যেতে পারে যে, এ কাহিনীর উৎপত্তিস্থান হচ্ছে বাংলাদেশে, আর এদেশ থেকেই
কাহিনীটি অন্যান্য প্রদেশে বিস্তার লাভ করেছে। কাহিনীটি নাথ-সম্প্রদায়েরই অন্তর্ভুক্ত। কারণ এর জড় পূর্বের্তন কাহিনী 'গোরক্ষবিজয়ে'র মধ্যে নিহিত
আছে।'গোরক্ষবিজয়ে' দেখানো হয়েছে, একমাত্র গোরক্ষনাথ ব্যতীত অন্য নাথআচার্যেরা দেবী দুর্গাকে দেখে ক্ষণকালের জন্য কামের বশীভূত হয়েছিলেন।এবং দেবী তার জন্য তাঁদের অভিশাপ দিয়েছিলেন। জালন্ধরিপাদ বা হাড়িপাকে তিনি অভিশাপ দিলেন, মেহারকুলের রাণী ময়নামতীর কাছে গিয়ে নাঁচ কর্ম করতে হবে। তাঁর সঙ্গে ময়নামতীর সম্পর্ক গুরুভাই-ভগিনীরমতো, কারণ তাঁরা দুজনেই গোরক্ষনাথের শিষ্য। অভিশাপের ফলে জালন্ধরবা হাড়িপা ময়নামতীর রাজ্যে গিয়ে নাঁচ হাড়ীর কর্ম অবলম্বন করলেন।কানপাকে দূর্গা অভিশাপ দিয়েছিলেন, বিমাতার প্রতি আকর্ষণের হেতু তাঁকে অনেক দুঃখ পেতে হবে। কানপা-বিমাতা-সংক্রান্ত কোন পালা বা পাঁচালী বাংলাদেশে পাওয়া যায়নি। বাংলার বাইরে কানপোর ধরনের কাহিনী প্রচলিত
আছে।রাজা গোপীচন্দ্রের সন্ন্যাস গ্রহণই হচ্ছে গোপীচন্দ্রের পাঁচালীর মূল বিষয়।রাণী ময়নামতী অদ্ভুত শক্তি মহাজ্ঞানের অধিকারিণী ছিলেন। তিনি সেই বিদ্যার প্রভাবে দেখলেন যে, তাঁর স্বামী রাজা মাণিকচন্দ্রের শীঘ্র মৃত্যু হবে।তাঁকে দীর্ঘায়, দেবার জন্য রাণী স্বামীকে তাঁর কাছ থেকে 'মহাজ্ঞান ক্ষকরতে অনেক অনুরোধ করলেন। কিন্তু রাজা পৌরুষে ঘা লাগবে বলে স্ফীর কাছ থেকে 'মহাজ্ঞান' নিতে অস্বীকার করলেন। ফলে তিনি যমদূতের বশীভূত হয়ে মর্ত্যাদেহ পরিত্যাগ করলেন। ময়না যাদতের মধ্যে দারণে বন্দের অবতীর্ণ হয়েও লপ্ত-আয়, স্বামীকে বাঁচাতে পারলেন না। স্বামীর মৃত্যুরঅল্প দিন পরে তাঁর গোপাঁচন্দ্র নামে একটি পত্র হল। গোপীচন্দ্র রুমে বয়ঃপ্রাপ্ত হলে ময়নামতী পরকে অদনা-পদনা নাম্নী দুই রাজকুমারীর সঙ্গে বিয়ে,দিলেন এ দ'জন কিন্তু পরস্পরের ভগিনী। অতঃপর ময়নামতী দেখলেন,তাঁর সন্তানেরও তাঁর স্বামীর মতো অকালমৃত্যু হবে। হাড়িপার কাছে মন্ত্রদীক্ষা নিয়ে কিছুকাল সন্ন্যাস গ্রহণ করে পরিব্রাজক না হলে তাকে কেউ মৃত্যুর বাঁচাতে পারবে না। কিন্তু তরণে যৌবনে হাঁদের ছেড়ে গোপাঁচন্দ্র সন্ন্যাস গ্রহণ করতে রাজী হলেন না, আদনা-পদনা ও গোপনে শাশুড়ীর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করতে লাগল। স্ত্রীদের প্ররোচনায় গোপীচন্দ্র মাতৃচরিত্রেওকলক লেপন করতে কুণ্ঠিত হলেন না, হাড়িসিদ্ধা-জালন্ধরিপাদকে জড়িয়ে তিনি প্রকাশ্যেই মায়ের বিরুদ্ধে অসতীত্বের অভিযোগ আনলেন। তখন নিজেকে নিষ্কলঙ্ক সতী প্রমাণের জন্য ময়নামতী বাধ্য হয়ে ছেলের কাছে সকঠোর পরীক্ষা দিলেন। অতঃপর গোপীচন্দ্রের অভিযোগ, অসম্মতি ওপ্রতিবাদ আর টিকল না। তাঁকে মায়ের নির্দেশ মতো হাড়িসিদ্ধার কাছে মন্ত্র নিয়ে মাথা মাড়িয়ে সন্ন্যাসী সাজতে হল। হাড়িসিন্ধা তাঁকে হাঁরানটীর বাড়ীতে বাঁধা দিয়ে চলে এলেন। বহ দঃখকষ্টে গোপীচন্দ্রের দিন কাটতে লাগল। অবশেষে সন্ন্যাসের কাল অবসান হলে হীরানটীর কবল থেকে তাঁকে হাড়িসিধা উদ্ধার করলেন এবং আড়াই অক্ষরের মহাজ্ঞান শেখালেন।পরে সন্ন্যাসী গোপীচন্দ্র গৃহী হয়ে দুই স্ত্রীকে নিয়ে মহাসখে রাজত্ব করতেলাগলেন, মায়ের উপদেশে সন্ন্যাস নেবার ফলে তাঁর আর অকালমৃত্যু হল না।এই কাহিনী রংপুরের কৃষকসমাজে কতকটা এই আকারে প্রচলিত ছিল, এখনওআছে।
***তথ্য সংগ্রহ ---
বাংলা সাহিত্যের সম্পুর্ন ইতিবৃত্ত (ড.অসীতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়)
0 মন্তব্যসমূহ